মিহির আগেই, ট্রাকের মুখ ঘুরিয়ে রেখে গিয়েছিল। উদিত গাড়ি ব্যাক করে নিয়ে এল। গাড়ি থেকে নেমে, ও আর নারায়ণ হাত লাগিয়ে রায়মশাইদের মালপত্র নিয়ে পিছন দিকে তুলে দিল। বৃষ্টি না এলে, কোনও ভাবনা নেই। বৃষ্টি এলে, খোলা ট্রাকে ভিজতে হবে। মানিকচকে আটকে পড়ার থেকে, সেটা অনেক ভাল। রায় পরিবারের সবাইকে হাত ধরে টেনে তুলে দেবার পরে, সেই মেয়েটি উদিতের দিকে তাকাল। উদিতও জিজ্ঞাসু চোখে মেয়েটির দিকে তাকাল।
এখন আর বলাবলির কিছু নেই। মেয়েটি করুণ চোখে ওর দিকে চেয়ে বলল, আমাকে দয়া করে আপনাদের সঙ্গে একটু নিয়ে চলুন।
উদিতের হাওড়া স্টেশনের কথা মনে পড়ে গেল। কিন্তু মেয়েটির কথার পরে, আর মুখের চেহারা দেখে, করুণ মনে হল। বেকায়দায় পড়লে, সকলেই এরকম করে। তখন তো, মহারানির মতো ওয়াটারপ্রুফের জল দিয়ে, উদিতকে ভিজিয়ে, বই কিনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ও গম্ভীরভাবে, তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবেন আপনি?
মেয়েটা বলল, আপাতত আপনাদের সঙ্গে একটা নিরাপদ জায়গায় তো পৌঁছুনো যাক।
রায়মশাই বলে উঠলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, তা ছাড়া উপায় কী। একলা একটি বাঙালির মেয়ে, তাকে তো আর এখানে ওভাবে ছেড়ে চলে যাওয়া যায় না।
বলে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, তবে বাপু, ওই যা বলছিলাম, অমন সোমথ বয়সে, একলা বেরোনো তোমার ঠিক হয়নি।
মেয়েটি কৃষ্ণা মীনার দিকে তাকাল। ওরা দুজনেই মেয়েটির দিকে চেয়ে হাসল। ভাবখানা, বাবার কথায় কান দেবেন না। মেয়েটি বলল, বেরিয়ে পড়েছি, এখন আর কী করি বলুন।
উদিত হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আসুন।
মেয়েটি উদিতের হাত ধরল। তার আগে ব্যাগটা নারায়ণের হাতে দিল। উদিত সবাইকেই এভাবে হাতে ধরে তুলে দিয়েছে। তবু, সেই মুহূর্তেই মীনার সঙ্গে ওর চোখাচোখি হল। মীনা ঠোঁট কুঁকড়ে একটু হাসল। উদিত মনে মনে বলল, মেয়েটা ফাজিল আছে।
নারায়ণ ব্যাগটা মেয়েটির হাতে তুলে দেবার সময়ে, মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, বলতে পারেন, শিলিগুড়ির সঙ্গে কি কলকাতার টেলিফোন কেটে গেছে?
নারায়ণ বলল, আমি যখন এসেছি, তখনও কাটেনি বলেই জানি। এতক্ষণে কী হয়েছে, বলতে পারি না।
সবাইকে তুলে দিয়ে উদিত আর নারায়ণ সামনে গিয়ে বসল। ড্রাইভারের সিটের পিছনের পার্টিশনের জানালা দিয়ে, পিছনটা দেখা যাচ্ছে। উদিত তাকিয়ে দেখল, কৃষ্ণা মীনার কাছেই মেয়েটি বসেছে। কথাবার্তা বলছে। এঞ্জিনের শব্দ উঠল, উদিত গাড়ি স্টার্ট দিল। এমন সময়, জনা দুয়েক লোক কোথা থেকে ছুটে এসে বলল, বাবু, আমাদের একটু নিয়ে যান।
কোথায় যাবে?
যেখানে আপনারা নিয়ে যাবেন। এখানে আমাদের আর কিছু নেই।
রায়মশাইয়ের গলা শোনা গেল, উঠে পড়ো তাড়াতাড়ি, এখন আর কথা বাড়িয়ো না।
লোক দুটো উঠে পড়ল। একজনের হাতে একটা জ্বলন্ত হ্যারিকেন ছিল। সেটা আর নেভাতে দেওয়া হল না। গাড়ি এগিয়ে চলল। নারায়ণ বারে বারেই পিছনের জানালা দিয়ে দেখছিল। তার চোখে একটা জিজ্ঞাসু কৌতূহল।
উদিত গাড়ি চালাতে চালাতেই জিজ্ঞেস করল, কী দেখছিস, কাকে দেখছিস এত?
নারায়ণ কোনওরকম চমকে না উঠেই বলল, মেয়েটিকে আমার চেনা চেনা লাগছে।
কোন মেয়েটিকে?
মেমসাহেবকে।
ওদের সকলের চেহারা একরকম। সাজগোজ চুলের ফ্যাশান দেখলে মনে হয়, সবাই এক। আমি তো মেয়েটাকে প্রথমে অবাঙালি ভেবেছিলাম। কথা শুনে বুঝতে পারলাম বাঙালি।
নারায়ণ চুপ করে রইল। মেয়েটিকে বোধ হয় মনে করবার চেষ্টা করছে। উদিত নিজেই আবার বলল, এমনিতে ডাঁটের শেষ নেই। দায়ে পড়ে, এখন দয়া চাইছে।
নারায়ণ জিজ্ঞেস করল, তোকে ডাঁট দেখিয়েছে নাকি?
ওরা সবাইকে ডাঁট দেখায়।
কিন্তু মেয়েটাকে আমার চেনা চেনা লাগছে কেন? মনে হচ্ছে, এ মুখ আমার চেনা। কোথায় যেন দেখেছি।
দার্জিলিং কালিম্পং-এর হোটেলে টোটেলে কখনও দেখেছিস হয়তো।
হতে পারে।
আর না-হয় তো, তোদের তো অনেক মিলিটারি আর সিভিল অফিসারদের সঙ্গে মিশতে হয়, তাদের বউদের ভেটও দিতে হয়। সেরকম কেউ হবে।
নারায়ণ যেন একটু আশান্বিত হল। বলল, সেটা হতে পারে। বলতেই আবার ভুরু কুঁচকে উঠল। বলল, কিন্তু কোনও বাঙালি অফিসারের বউ হলে তো সিঁথেয় সিঁদুর থাকবে। এর তা নেই।
উদিত ঠোঁট উলটে বলল, অফিসারের বউয়েরা আবার সিঁদুর পরে নাকি?
সিথেয় অন্তত পরে।
আরে রাখ। দেখা আছে। ওই যে তোদের এক অফিসার, চক্রবর্তী, তার বউয়ের সিঁথেয় কোনওদিন সিঁদুর দেখিনি আমি। গেলাস গেলাস মদ ওড়াতে দেখেছি।
মিসেস চক্রবর্তীর কথা আলাদা। ওরকম মেয়েমানুষ।
নারায়ণ কথাটা শেষ করল না। উদিত মুখ টিপে হাসল। বলল, বল, ওরকম মনের মতো মেয়েমানুষ জীবনে কোনওদিন দেখিসনি। তুই তো আবার মিসেস চক্রবর্তীর সঙ্গে মজেছিস।
নারায়ণ হাসির শব্দ করে বলল, যাঃ।
যাঃ? তোদের দুজনকেই আমি মাতাল অবস্থায় দেখেছি।
নারায়ণ যেন লজ্জা পেয়ে বলল, সে হয়তো এক-আধদিন।
এক-আধদিন? প্রায়ই তো মিসেস চক্রবর্তীকে নিয়ে তুই এদিক ওদিক পালিয়ে যাস। রাত্রি কাটিয়েও আসিস। চক্রবর্তী কিছু বলে না?
কী বলবে? সারাদিন মদ খায়, আর কোলা ব্যাং-এর মতো পড়ে থাকে।
কী জীবন এদের আমি ভাবতে পারি না।
এদের জীবন বলে কিছু নেই।
দুজনেই চুপ করল। রাস্তার অধিকাংশ জুড়েই জল। মাঝে মাঝে শুকনোও পাওয়া যাচ্ছে। উদিতকে প্রতি মুহূর্তেই সাবধানে চালাতে হচ্ছে। যেখানে জল, সেখানেই রাস্তা মাঠ একাকার। যে কোনও মুহূর্তেই, মাঠের গভীর জলে গিয়ে পড়তে হতে পারে। খানপুর, রহিমপুর পার হওয়ার পরে, জলের গভীরতা বাড়তে আরম্ভ করেছে। পিছনের যাত্রীদের বিশেষ কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। উদিত আরও সাবধান হল। রাস্তার ধারে ধারে, যে সব গাছপালা আছে, তার সীমারেখা ধরেই, গাড়ি চালাবার চেষ্টা করছে।
আটগমের কাছাকাছি এসে, গাড়ি ঘণ্টায় তিন মাইল বেগ নিল। জল অনেক বেশি। কারবোরেটারে জল ঢুকলে আর দেখতে হবে না। গাড়ি এখানেই থেকে যাবে। দুদিকেই আম বাগান, ঘন অন্ধকার। মাঝখানে রাস্তাটা যে কোনদিক দিয়ে গিয়েছে, কিছুই বোঝা যায় না। নিরুপায় হয়ে গাড়ি দাঁড় করাতে হল। এভাবে গাড়ি চালানো যায় না।
যে দুজন লোক পরে উঠেছিল, তারা নিজেরাই যেচে জলে নামল। দুজনের হাতেই বড় বাঁশের লাঠি। তারা বলল, আমাদের আলো দেখান। আমরা রাস্তার দু পাশ দিয়ে হেঁটে যাই, তা হলে নিশেন পাবেন, পিছু পিছু আসতে পারবেন। মনে হয়, গোটা একটা মাইল এরকম রাস্তা হবে।
কথাটা মিথ্যা না। লোক দুটো কোমর-ডোবা জলে, সেইভাবে হেঁটে চলল, আর তাদের দুজনের মাঝখান দিয়ে, আস্তে আস্তে গাড়ি এগোল। প্রায় ঘণ্টাখানেক চলে, শুকনো রাস্তা পাওয়া গেল। তাদের মধ্যে একজন বলল, এবার নেয়ামতপুর হয়ে ইংরাজবাজার চলেন, রাস্তা বোধ হয় ভালই আছে।
কথাটা তারা মিথ্যা বলেনি। তারপরে ইংরাজবাজার পর্যন্ত রাস্তাটা ভালই পাওয়া গেল। রায়মশাই তো দুহাত তুলে আশীর্বাদ। ইংরাজবাজারে এসে, শহরের আর আলোর মুখ দেখে, সকলের মুখেই আলো দেখা দিল।
উদিত জিজ্ঞেস করল, কোন পাড়ায় আপনার আত্মীয়ের বাড়ি?
রায়মশাই বললেন, সেখানে তোমার এ গাড়ি ঢুকবে না। এখন গাড়িটা কোথায় রাখবে বলো, তারপরে আমাদের সঙ্গে চলো। আমাদের কাছেই তুমি থাকবে।
উদিতের সঙ্গে নারায়ণের চোখাচোখি হল। নারায়ণ নিচু স্বরে বলল, মিছিমিছি থাকব কেন, চল রাতে রাতেই চলে যাই। রাস্তার জল বাড়বে ছাড়া তো কমবে না। কোনওরকমে এক বার শিলিগুড়ি পৌঁছুতে পারলে হয়।
উদিতের তা-ই ইচ্ছা। সেই কথাই ও রায়মশাইকে বলল, আমরা বরং চলেই যাই। আপনারা তো এখন নিরাপদেই থাকবেন। অবস্থা ভাল হলে, ধীরেসুস্থে যাবেন।
মীনা বলে উঠল, তা হলে, আমরাও আপনাদের সঙ্গে চলে যাই না কেন?
রায়মশাই দুহাত নেড়ে বলে উঠলেন, না না, এই রাত করে, তোদের নিয়ে যাওয়া যায় নাকি। ওরা জোয়ান ছেলে, গাড়িটা রয়েছে।
তবু কৃষ্ণা মীনা উদিতকে ওদের আত্মীয়ের বাড়ি খেয়ে যেতে বলল। উদিত বলল, এখান থেকেই কিছু খেয়ে নেব, ভাববেন না। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়তে চাই।
রায় পরিবার এবং অন্য দুটি লোক নেমে গেল। কিন্তু সেই মেয়েটি তখনও বসে রয়েছে। রায়মশাই তাকে ডাকলেন, কই গো মা, তুমি আমাদের সঙ্গে এসো।
মেয়েটি উদিতের দিকে এক বার তাকাল। উদিত বলল, হ্যাঁ, আপনিও এঁদের সঙ্গেই যান। আপনার কেউ আছে এখানে, কোনও আত্মীয় বা চেনাশোনা লোক।
মেয়েটি উদ্বেগভরা চোখে ঘাড় নেড়ে বলল, না।
রায়মশাই বললেন, তাতে কী হয়েছে, আমাদের সঙ্গেই থাকবে।
মেয়েটি বলল, আপনারা শিলিগুড়ির দিকেই যাচ্ছেন। আমাকে সেদিকেই যেতে হবে। আমি আপনাদের সঙ্গে গেলে আপত্তি আছে?
জবাব দিলেন রায়মশাই, আপত্তির কারণ তো আছেই। তুমি একলা একটি মেয়ে, এই দুর্যোগের মধ্যে এদের সঙ্গে কোথায় যাবে?
মেয়েটি তবু উদিতের দিকে তাকিয়ে রইল। মীনা বলে উঠল, আপনার খালি এক কথা বাবা, উনি একলা কোথায়। ওঁরা দুজন তো আছেনই।
রায়মশাই হতাশ বিরক্তিতে বললেন, তা হলে আমার কিছু বলার নেই। ওর যদি সাহস থাকে, যাবে।
মেয়েটি মীনার দিকে সকাতর কৃতজ্ঞতায় তাকাল। তারপরে উদিতের দিকে। উদিত নারায়ণের দিকে।
নারায়ণ বলল, তুই কথাবার্তা বল, আমি দু-একজনের কাছে রাস্তাঘাটের খবর নিয়ে আসি।
উদিত মেয়েটির দিকে ফিরে বলল, বিপদের ভয় যদি আপনার না থাকে চলুন।
মীনা ফোড়ন কাটল, আপনি আছেন কী করতে?
গাড়ি সুদ্ধ ডুবলে তো আর আমি বাঁচাতে পারব না।
মীনা ঠোঁট মুচকে হেসে বলল, ডুবলে একসঙ্গেই ডুববেন, কারোর কিছু বলার থাকবে না।
কয়েকটি রিকশা ডেকে রায়মশাই মালপত্র চাপিয়ে, সপরিবারে রওনা হলেন। যাবার আগে, উদিতকে আবার আশীর্বাদ করে গেলেন। সকলেই উদিতের কাছ থেকে বিদায় নিল। মীনার ঠোঁটের হাসিটা সেইরকম। এমনকী একবার কানের কাছে মুখ নিয়ে চুপিচুপি বলেও ফেলল, আপনাকে খুব পছন্দ হয়েছে।
উদিত থমকে হেসে উঠেছে। মীনা খিলখিল করে হেসে উঠেছে।