টালমাটাল
সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বছর তিরিশ কোম্পানিকে রাজা এবং পার্লামেন্টের বিবাদের মধ্যে গা বাঁচিয়ে সাবধানে চলতে হয়। গৃহযুদ্ধ (১৬৪২-৫১) আর ‘গ্লোরিয়াস রেভলিউশন’ (১৬৮৮)— এই দুই ঘটনার মধ্যবর্তী সময়ের অস্বস্তিকর পরিবেশ কোম্পানিকে সাবধানী করে দেয়। কোনও দীর্ঘমেয়াদি প্ল্যান করে ব্যাবসা করা সম্ভব তো ছিলই না, বরং দু’- একবার দেউলে হবার উপক্রম হয়েছিল। প্রচণ্ড অর্থাভাবে পড়ে প্রথম চার্লস মাঝেমাঝেই কোম্পানির উপর চাপ দিতেন। ১৬৪০ নাগাদ স্কটিশ আক্রমণের সময়ে সুযোগ সামনে এল। রাজা কোম্পানির গুদামে রাখা ছয় লক্ষ পাউন্ড পরিমাণ গোলমরিচ ধারে কিনে ফেললেন। কিনে মাল বাজারে বিক্রি করে ৫০০০০ পাউন্ড স্টার্লিং জোগাড় করলেন। তাড়াহুড়োয় মাল বিক্রি হল খুব কম দামে। কোম্পানির দু’দিকেই ক্ষতি, ধার কবে শোধ হবে তার কোনও ঠিক নেই, দামও পাওয়া গেল প্রত্যাশার অনেক কম। রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরে অবশ্য সেই ধারের কিছুটা শোধ করা হয়।
এই সময়ে রাজপন্থী ও তাদের বিরোধীদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহের কারণে গোলমরিচ জাতীয় দামি জিনিসের বাজার পড়ে যায়। অলিভার ক্রমওয়েলের রাজত্বকালে ভারত মহাসাগরের ইংরেজ-ওলন্দাজ দ্বন্দ্বের জের টেনে ইউরোপে দু’ দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধে (১৬৫২)। ১৬৫৪ সালের শান্তি চুক্তিতে ক্রমওয়েল কোম্পানির জন্যে কিছু ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি আদায় করেন, যার অনেকটাই দেওয়া হয়নি। তবে ক্রমওয়েলের আমলে কোম্পানির নতুন চার্টার চালু হল (১৬৫৭), যার সূত্রে কোম্পানি স্থায়ীভাবে যৌথ কারবারি হিসেবে স্বীকৃত হল।
স্বদেশে ও বিদেশে নানারকম অনিশ্চয়তায় পড়ে কোম্পানির ডিরেক্টররা ভারতে তাদের এজেন্টদের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কমাতে বলছিল। এই সাবধানতার ফল হয় একেবারে উলটো রকমের। একদিকে কোম্পানির প্রতিযোগী নিজস্ব বা ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীরা সাহসী হয়ে তাদের ব্যাবসা বাড়াতে উদ্যোগী হয়। অন্যদিকে সদর দপ্তরের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ব্রাঞ্চ অফিসের কর্মচারীরা অনেক দুঃসাহসী কাজ করে ফেলে যাতে লন্ডন অফিসের একেবারেই সায় ছিল না। বম্বে, মাদ্রাজ ও কলকাতার প্রতিষ্ঠা এই মনোভাবের সবচেয়ে ভাল উদাহরণ।
‘ইন্টারলোপার’
কাঁচা টাকা হাতে থাকলে লন্ডনের যে-কোনও ব্যবসায়ী ভারত মহাসাগরের বাণিজ্যে ঢুকে পড়তে সবসময়ই প্রস্তুত। আইনত ভারতের উপকূলে বা এশিয়ার মধ্যে ব্যাবসা চালাতে হলেই কোম্পানির অনুমতি দরকার ছিল না। সমস্যা হচ্ছে, সবথেকে লাভজনক পার্টনারশিপ ছিল নিষিদ্ধ পণ্যের বাজারে। এই জিনিসের বাজার ইউরোপে। এগুলি কোম্পানির একচেটিয়া চার্টার দ্বারা সংরক্ষিত। কাজেই ব্যাবসা মানেই একটু-আধটু বেআইনি রাস্তা ধরা দরকার।
কোম্পানির ভিতরেই অনেক অফিসার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে জুটে নিজস্ব কারবারে লেগে যেত। সাধারণের বিশ্বাস ছিল যে কোম্পানির চাকরিতে মাইনে কম। কোম্পানিও কখনও এই বিশ্বাস নিয়ে তর্ক তোলেনি। বরং একটা সমঝোতা ছিল যে কর্মচারীরা নিজস্ব ব্যাবসায় ক্ষতি পুষিয়ে নেবে, যতক্ষণ সেই ব্যাবসা চার্টার রক্ষা করে হচ্ছে। প্রায় প্রত্যেক পদস্থ অফিসার, মায় পাদরি ও ডাক্তার শুদ্ধু, প্রবল উদ্যমে কারবার চালাত। অফিসাররা কখনও কখনও নিজেদের নামে ছোটখাটো জাহাজ (১০০ টনের কাছাকাছি) কিনে ফেলত। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী কোনও বাজারে জিনিস কিনে এই জাহাজ সুরাট, ইরান, বা করমণ্ডলের অন্য বাজারে বিক্রি করত। কখনও মেরামতের প্রয়োজনে বা মৌসুমি হাওয়া ঠিক সময়ে ধরা যায়নি বলে কোম্পানির নিজের বড় জাহাজ বন্দরে বেশি দিনের জন্যে আটকা পড়লে সেই জাহাজ পদস্থ অফিসাররা নিজেদের কাজে লাগাত।
কোম্পানির সম্পদের এই ধরনের ব্যবহার ন্যায্য কি না তাই নিয়ে কলহ লেগেই থাকত। কিন্তু অপরাধী অফিসাররা অনেক সময়ে কোম্পানির কাজে এত অপরিহার্য ছিল যে উচ্চপদস্থ চাকুরেদের সঙ্গে স্বার্থের সংঘাত লাগলে কোম্পানির পক্ষে সবসময়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হত না। বাইরে অনেক হম্বিতম্বি করলেও গোপনে ক্ষমা করে দেওয়া হত।
সবথেকে বড় সমস্যা, অনেক প্রাইভেট ব্যবসায়ী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকরা মনে করত যে তাদের সৎ আচরণ শেখাবার নৈতিক অধিকার কোম্পানির থাকতে পারে না। কারবার যে সবসময়ে সুযোগসন্ধানী তা তো নয়। ফ্রান্সিস ডে-র উদাহরণ চোখের সামনে। ডে ফোর্ট সেন্ট জর্জ তৈরি করলেন কোম্পানির টাকায় নয়, ধারের টাকায়, আর ধার পাওয়া গেল তাঁর ব্যবসায়ী হিসেবে সুনামের দৌলতে। ওয়েডেল কোম্পানির হয়ে সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ লড়ে ব্যাবসার কারণে হেনস্থায় পড়লেন। অক্সেন্ডেন ও অঞ্জিয়ের, দু’জনেই বম্বে প্রতিষ্ঠায় ঐতিহাসিক ভূমিকা নিয়েছেন, দু’জনকেই স্বদেশে মর্যাদাহানির চেষ্টার সামনে পড়তে হয়েছে। এলিহু ইয়েলকে মাদ্রাজের গভর্নর পদ থেকে সরে যেতে হল একই কারণে।
এই সব অফিসারদের যদি বা হেনস্থা করা সম্ভব হয়েছিল, টমাস পিট এসে সব হিসেবনিকেশ উলটে দিলেন। ১৬৭৪ সালে বিশ বছর বয়েসি ডর্সেটের এক ছোকরা বালেশ্বরে কোম্পানির কারখানায় এসে পৌঁছলেন নিজস্ব ব্যাবসা শুরু করবার উদ্দেশ্য নিয়ে। পিট খুবই পরিশ্রমী ও বুদ্ধিমান লোক ছিলেন। ফলে কয়েক বছরের মধ্যে ইরান-ভারত রুটে চিনি আর ঘোড়ার কারবার করে বড়লোক হয়ে গেলেন। কোম্পানির কাছ থেকে একাধিক বার হুমকি এসেছিল পিটকে রাস্তা থেকে সরে যাবার জন্যে। সে সব গ্রাহ্য করা দূরে থাক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে পিট বালেশ্বরের একজন পদস্থ অফিসারের মেয়েকে বিয়ে করে ফেললেন, এবং শ্বশুরবাড়ির আশীর্বাদে লন্ডন অফিসের তোয়াক্কা না করে কাজ করে চললেন।
১৬৮১ সালে পিট কয়েক দিনের জন্যে ইংল্যান্ডে ফিরতেই আদালতে মামলা রুজু হল। কিন্তু সমন লেখা শেষ হতে না হতেই অপরাধী ভারতে ফিরে এসেছেন। শুধু তাই নয়, বাংলার নবাবের সঙ্গে একটা কারখানা বসাবার ব্যাপারে কথাবার্তা শুরু করে দিয়েছেন। অবশেষে ১৬৮৪ সালে পিটকে গ্রেপ্তার করে নির্বাসনে পাঠানো হল। কিছু দিন বাদে সামান্য টাকা জরিমানা দিয়ে পিট ছাড়া পেলেন। নির্বাসনের কারণে হাতে অনেক সময় ছিল, তারই সদ্ব্যবহার করে ডর্সেটে অনেকে জমিজমা কিনে ফেললেন। আবার সেই জমিদারি ব্যবহার করে ১৬৮৯ সালে পার্লামেন্টেও ঢুকে পড়া গেল। পিটের পার্লামেন্টে যোগদান ইন্টারলোপার সম্প্রদায়ের কাছে একটা বিরাট ঘটনা, কারণ পিট আগে থেকেই এই দলের মুখপাত্র ছিলেন। ১৬৯৩ সালে পিট ভারতে ফিরে এলেন। আরও একবার কোম্পানি কিছু দিন তাঁর পিছনে লেগে ব্যর্থ হল।
এইবার ঘটনা একটি অদ্ভুত মোড় নিল। ১৬৯৫ সালে কোম্পানি হার স্বীকার করে পিটকে মাদ্রাজের গভর্নর পদ নিতে ডাকল, এবং পিট সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলেন। পরের বছর কোম্পানির মিটিংয়ে এই নিয়ে তুলকালাম হয়। কিন্তু সিদ্ধান্ত বজায় রইল।
মাদ্রাজে পিট পনেরো বছর কাজ করেছিলেন। প্রথম কয়েক বছরে কর্ণাটকের নবাব সংক্রান্ত অনেক জটিল রাজনৈতিক ও সামরিক সমস্যা নিয়ে জড়িয়ে ছিলেন, আর শেষ কয়েক বছরে মাদ্রাজের শাসনব্যবস্থা নিয়ে। এই শেষের বছরগুলিতে পিটের সঙ্গে তাঁর কয়েক জন সহকর্মীর খটাখটি লাগে। বিষয়, মাদ্রাজ এলাকায় ভারতীয় বসবাসকারীদের সমাজব্যবস্থা। তীক্ষ্ণ বাস্তববুদ্ধির অধিকারী পিট তাঁর সহকর্মীদের ভারতীয়দের সামাজিক বিবাদে, বিশেষ করে জাতিধর্ম নিয়ে বিবাদে, জড়িয়ে পড়া থেকে নিরস্ত করার চেষ্টা করে সফল হননি। এইসব গোলমালের জেরেই ১৭১০ সালে তাঁকে ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে বলা হল।
জীবনের শেষ পনেরো বছর পিট জমিদারি পরিচালনা আর পার্লামেন্টের কাজ নিয়ে কাটিয়ে দিলেন। কিন্তু বিতর্ক তাঁর পিছু ছাড়েনি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হিরে নিজের কাছে রাখার অধিকার আছে কি না এই নিয়ে পিটকে অনেক জবাবদিহি করতে হয়েছে। মাদ্রাজের এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ১৭০২ সালে পিট হিরেটা সংগ্রহ করেন। স্বভাবসিদ্ধ বিচক্ষণতা থেকে পিট ইংল্যান্ডে হিরেটা কাটান। ওজনে পাথরটা আগের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ হয়ে যায়, কিন্তু দামে বেড়ে হয় পাঁচ গুণ। শেষ পর্যন্ত পাথরটা বিক্রি হল ফ্রান্সে। সেখানে মারি আন্তোয়ানেতের মুকুটে কিছু দিন আর নেপোলিয়নের তরোয়ালের খাপে কিছু দিন প্রদর্শিত হয়। এখন ল্যুভর মিউজিয়ামে দ্রষ্টব্য।
পিটের কাছাকাছি সময়ে আরও কয়েক জন ইন্টারলোপার বিখ্যাত হয়েছিলেন। টমাস বাওরি বহু বছর বঙ্গোপসাগরে ব্যাবসা করে ও জাহাজ ভাড়া দিয়ে শেষে ইংল্যান্ডে ফিরে যান। এই সময়ের মধ্যে বাওরি মালয় ভাষা শিখলেন ও এই ভাষার একজন এক্সপার্ট হয়ে গেলেন। বাওরি-র সবথেকে বিখ্যাত কীর্তি তাঁর ডায়েরি। লেখা ১৬৮০ থেকে ১৬৯০-এর মধ্যে। মৃত্যুর অনেক বছর পরে ছেপে বেরোয়। এই বইয়ে সমকালীন বাংলার উপরে অত্যন্ত মূল্যবান বর্ণনা পাওয়া যায়। জন চাইল্ড ছিলেন বম্বের একজন বিশিষ্ট গভর্নর, তিনিও খোলাখুলি প্রাইভেট ব্যাবসা চালিয়ে প্রচুর পয়সা করেন।
পিটের আসল উত্তরাধিকার অবশ্য একই পথে হাঁটা এই মানুষরা নয়। বরং পার্লামেন্ট ও পার্লামেন্টের বাইরে একটা ক্রমবর্ধমান লবি, যারা বিশ্বাস করত যে কোম্পানির একচেটিয়া অন্যায় অধিকার, ও এর বিরোধিতা করে পিট হিরোর মতো কাজ করেছেন।
একচেটিয়ার কালো হাত
বণিক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত একটা দল অনেক দিন ধরে একচেটিয়া চার্টারের তীব্র বিরোধিতা করে চলেছে। তাদের বক্তব্য কোম্পানির চার্টারের ফায়দা তোলে মুষ্টিমেয় কয়েকটি পরিবার যারা নতুন শেয়ার বিক্রি বন্ধ করে দিয়ে পুরনো শেয়ারের উপর নিজেদের দখল বজায় রেখেছে। এরা কোম্পানির বিনিয়োগে টাকা ঢালে বাজার থেকে ধার নিয়ে। অবশ্যই সেই ধার বেশ ব্যয়সাপেক্ষ, কিন্তু লাভের হার এত বেশি যে পুষিয়ে যায়। এই কৌশল খাটানোর আর একটা খরচের দিক হল শেয়ারের দাম বাড়লে যে ক্যাপিটাল গেইনস হয়, তার সদ্ব্যবহার হত না। কিন্তু ডিরেক্টররা সেই ক্ষতি নিয়ে মাথা ঘামাত না।
সপ্তদশ শতাব্দীতে কোম্পানির হয়ে লড়বার লোক অনেক মজুদ ছিল। পালটা আক্রমণে সবচেয়ে জোরালো নেতৃত্ব দিলেন জোসায়া চাইল্ড (১৬৩০-৯৯)। মদের ব্যবসায়ী চাইল্ড প্রথম জীবনে কাজ শুরু করেন প্রাইভেট ব্যবসায়ী হিসেবে। ১৬৭০-এর দশকে তাঁর উদ্যোগে রয়াল আফ্রিকান কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পরে দুরদর্শিতার সঙ্গে ব্যাবসা ও কোম্পানির কাজ পরিচালনা করে সত্তরের দশকের শেষে কোম্পানির সবথেকে বড় শেয়ারহোল্ডার হলেন চাইল্ড। আরও অনেকে ডিরেক্টরদের গুপ্ত সমিতির নেতৃত্ব দিয়েছেন। চাইল্ডের নেতৃত্ব অনেকটাই আলাদা। তিনি সমালোচকদের মুখ বন্ধ করার জন্যে কলম ধরলেন।
ছদ্মনামে চাইল্ড অনেকগুলি পুস্তিকা লিখে ফেললেন। এই প্যামফ্লেটগুলির মুখ্য উদ্দেশ্য হল ভারত মহাসাগরে রাষ্ট্রনীতি হিসেবে একচেটিয়ার সমর্থন করা। তাঁর বক্তব্য, একচেটিয়ার কারণে সরকার লাভবান হয়েছে, কারণ একটা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কর আদায় করা অনেক জনের কাছ থেকে কর নেওয়ার চেয়ে কম খরচের। ‘ইকনমি অফ স্কেল’ যুক্তি ব্যবহার করে বলা হল যে এর ফলে আরও ভাল আর বড় জাহাজ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। ভারত-ইংল্যান্ড ব্যাবসার বিরোধিতার একটা বড় যুক্তি ছিল দুষ্প্রাপ্য রুপো ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছে। চাইল্ড এই ধারণার বিরোধিতা করলেন খুব সংগত কারণে। বিদেশি বাণিজ্যের আসল ভালমন্দ কী পরিমাণ সোনারুপো পাচার হল তার উপরে নির্ভর করে না। বাণিজ্যের থেকে সাধারণ মানুষের কী হিতসাধন হল ও ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় ইংল্যান্ড কতটা এগিয়ে রইল তার উপরে নির্ভর করে। আজকের দিনের লিবারালিজম- বিরোধীদের সুরে চাইল্ড বললেন লাগামছাড়া প্রতিযোগিতার অনেক দোষের দিক আছে।
সে যুগে সামরিক বল পেছনে না থাকলে বৈদেশিক বাণিজ্য চালানো কঠিন ছিল। সামরিক বলের উৎস একটাই হওয়া উচিত, তা নইলে অন্তর্দ্বন্দ্বই সবাইকে শেষ করে দেবে। শুধু তাই নয়, সেই উৎস সরকারের অনুমোদিত হওয়াও দরকার। বলাবাহুল্য, চাইল্ডের আমলে টাকা ঢালা হয়েছিল ভারতের উপনিবেশগুলিতে প্রতিরক্ষার পেছনে। জোসায়া চাইল্ড একা এই পলিসির সমর্থক ছিলেন না। আর একজন বড় শেয়ারহোল্ডার টমাস কুক জোসায়ার ডান হাত ছিলেন এবং দরবারে ঘুষ দেওয়ার ষড়যন্ত্রে জোসায়ার সঙ্গে শামিল ছিলেন। তিনিও ভারতে আরও আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে ব্যাবসা চালানোর পক্ষপাতী ছিলেন। বম্বেতে এই নীতির কর্ণধার ছিলেন জন চাইল্ড, জোসায়ার বন্ধু। শতাব্দীর শেষ দশকে এই নীতি প্রয়োগ করতে গিয়ে জন চাইল্ডের সঙ্গে ঔরঙ্গজেবের লড়াই লেগে যায়।
১৬৮৮ সালের ‘গ্লোরিয়াস’ বিপ্লবের সময়ে ডাচ ‘স্টাটহোল্ডার’ তৃতীয় উইলিয়াম ইংল্যান্ডের রাজা হলেন। ঠিক তখনই কোম্পানিকে পার্লামেন্টের ভিতরে ইন্টারলোপার গোষ্ঠীর সঙ্গে লড়তে হচ্ছে। জোসায়া চাইল্ডের কাজেকর্মে যারা অসন্তুষ্ট ছিল এই গোষ্ঠী তাদের সমর্থনে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়, যেমন শেয়ার বিক্রির জন্যে আন্দোলন, শেয়ারের ব্যক্তিগত মালিকানা সীমিত রাখার জন্যে চেষ্টা, এমনকী কোম্পানি তুলে দেওয়ার প্রস্তাব তোলা। যে ইংরেজ তাঁতিরা ভারত থেকে আমদানি কাপড়ের জন্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তারাও কোম্পানির বিরুদ্ধ দলের সদস্য।
ঐতিহাসিক আলফ্রেড প্লামার দেখিয়েছেন যে পার্লামেন্টে আর্জি করে লাভ না হওয়ায় তাঁতিরা দাঙ্গা শুরু করে। শেষে তাদের কথা ভেবেই ভারতের কাপড়ের উপরে শুল্ক বসল, তবে তাতে আমদানির পরিমাণ বড় একটা কমেনি।
সমালোচনা এড়াবার জন্যে কোম্পানি উদার হস্তে মন্ত্রী ও দরবারের পদস্থ অফিসারদের ঘুষ দিয়ে চলত। রাজাকেও এই সময়ে ১০০০০ পাউন্ড ভেট দেওয়া হয়। ৫০০০০ পর্যন্ত অফার ছিল, কিন্তু রাজা অত টাকা নিতে রাজি হননি। এইসব কাণ্ডকারখানা দেখে সাধারণ লোকেদের মনে ধারণা তৈরি হয়েছিল যে কোম্পানি আর সিটি অফ লন্ডন, শহরের তথা ইউরোপের অর্থনীতির সবথেকে ক্ষমতাশালী দুটো কেন্দ্র কাজ করে চলেছে ভাল লোকেদের মন্দ বানিয়ে দেওয়ার জন্যে।
১৬৯৩ সালে এই সব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে হাউস অফ কমন্স এক কমিটি বসাল। কমিটি লেডেনহল স্ট্রিটে কোম্পানির সদর দফতরে ঢুকে অনেক লেজার বই ঘেঁটেঘুঁটে একটা রহস্যময় খরচের আইটেম খুঁজে পেল। দেখা গেল ‘বিশেষ পরিষেবা’ নামের খাতে হাজার হাজার পাউন্ড খরচ করা হয়েছে। কিন্তু এই পরিষেবা ঠিক কী তা নিয়ে নতুন ডিরেক্টর কুক-কে বাদ দিলে কারওরই বিশেষ কিছু জানা নেই। সোরা সরবরাহ বায়না দেওয়া হয়েছে বোর্ডের সদস্যদের প্রিয় কিছু ব্যক্তিকে। কালো টাকার ব্যাপারে সরাসরি কোনও তথ্য বেরল না, তবে এক চর এসে কমিটিকে জানাল যে কুকের বিশ্বস্ত একটি লোক প্রচুর টাকাকড়ি হাতে নিয়ে লুকিয়ে রয়েছে। নিশ্চয়ই ‘গোলমাল মিটে যাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছে। কুককে জেলে পাঠানো হল। উদ্দেশ্য যে সব কথা খুলে না বললে তাঁকে ছাড়া হবে না। শেষ পর্যন্ত মামলা টিকল না। প্রধান সাক্ষী বিদেশে পালিয়ে যায়। কিন্তু কোম্পানির একচেটিয়া প্রতিষ্ঠান হয়ে থাকবার নৈতিক অধিকার বড় রকম ধাক্কা খেল।
এই সব ঘটনার পরে ভারত-ব্রিটেন ব্যবসায়ে ব্রিটেনের রাজার ভূমিকা কিছুটা বদলে যায়। সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে রাজার অনেকগুলো বিশেষ অধিকার পার্লামেন্ট নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। কিন্তু অন্যদিকে, ভারত মহাসাগরে বাণিজ্যের ব্যাপারে রাজার নাক গলানোর ক্ষমতা কিছুটা বেড়ে যায়। কারণ, একচেটিয়া ব্যাবসার চার্টার রাজার দেওয়া। সে ক্ষমতা পার্লামেন্ট পুরোপুরি নিয়ে নিতে চায় না, নিলে রাজাকে সরাসরি অমান্য করা হয়। রাজার নিজের তখন কোম্পানিকে খুব দরকার, কারণ ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধ বাধায় টাকার প্রয়োজন বেড়েছে, আর কোম্পানি কর দেওয়ার ব্যাপারে বরাবরই নির্ভরযোগ্য। সংগত কারণেই ভয় ছিল যে একচেটিয়া উঠে গিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হলে কেউ-ই কর দেবে না, আর তার ফল পড়তে পারে যুদ্ধক্ষেত্রে!
শেষ পর্যন্ত সব দল মিলে যে সমঝোতায় পৌঁছল তার ফলস্বরূপ আরও একটা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তৈরি হল। এবারে বেশ কয়েক জন ইন্টারলোপারের টাকায়। রাজা নতুন কোম্পানির অধিকার মেনে নিলেন, আর একই সঙ্গে যেসব ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীরা কোনও দলেই নেই তাদের বেআইনি ঘোষণা করলেন। একচেটিয়ার আদর্শ বজায় রইল, আবার ইন্টারলোপারদের খুশি করারও চেষ্টা হল। আদর্শর থেকেও বড় কথা, দুই দলই রাজাকে এবং পার্লামেন্টের সদস্যদের নানারকম আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। নতুন কোম্পানি রাজাকে অনেক টাকা ধার দিয়ে বসল। এদের ব্যাবসা তাড়াতাড়ি উঠে যাওয়ার পেছনে সেই ধার একটা কারণ।
এই সব গন্ডগোলের কারণে একচেটিয়ার পেছনে সমর্থন কমলেও দেখা গেল অবস্থা বিশেষে একচেটিয়ার বিকল্প নেই, বিশেষ করে অর্থনীতিতে যাকে বলে স্বাভাবিক একচেটিয়া বা ন্যাচারাল মনোপলি। যেসব ব্যাবসায় ঝুঁকি অত্যধিক ও একসঙ্গে অনেক টাকা বিনিয়োগ করলে লাভের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়, সেখানে মনোপলি গজিয়ে ওঠা স্বাভাবিক। পুরনো কোম্পানি এক শতাব্দী কালে অনেকগুলি দুর্গ, গুদাম, জাহাজ, সৈন্যবাহিনীর মালিক হয়ে বসেছে। হাজার হাজার কারিগর, ব্যবসায়ী বা বণিকদের সঙ্গে কারবার করছে। এই কোম্পানির কাছে বাড়তি ঝুঁকি নেওয়া কষ্টকর নয়। নতুন কোম্পানির প্রথম থেকেই অর্থকষ্ট, চেনাশোনা কম। রাজার নেওয়া ধার শোধ শুরু না হওয়া পর্যন্ত কোম্পানি টিকবে কি না সন্দেহ।
শেষে অর্থবিভাগের প্রধান সিডনি গডলফিনের উদ্যোগে দুই কোম্পানিকে একত্রীকরণের প্রস্তাব কার্যকরী করা হল। সরকারের তরফে এবারও সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা কর আদায় নিয়ে। ১৭০৮ সালে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী, যাদের সাধারণে পরিচয় ছিল ‘ইংলিশ কোম্পানি’ এবং ‘লন্ডন কোম্পানি’ নামে, এক হয়ে নতুন নাম নিল ‘ইউনাইটেড কোম্পানি অফ মার্চেন্টস ট্রেডিং ইন দি ইস্ট ইন্ডিজ়,’ এরাই হল একচেটিয়া চার্টারের অধিকারী।
ভারতে এই দলাদলির বিশেষ প্রভাব পড়েনি। বছর পাঁচেক দুই দলের অফিসাররা পরস্পরের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যায়। দুই দলই কারখানার সামনে ইংরেজ পতাকা উড়িয়ে দাবি করে যে তারাই রাজার একমাত্র প্রতিনিধি, এবং স্থানীয় দরবারে গিয়ে অন্য দলকে বেআইনি ঘোষণা করার আর্জি জানায়। বাংলার অর্থমন্ত্রী মুর্শিদকুলি খাঁ ও নবাব আজিম-উস-শান দুই দলের সঙ্গেই কথাবার্তা চালু রাখলেন, অর্থাৎ দুই দলের কাছ থেকেই প্রচুর ঘুষ নিলেন। এঁরা কার কাছে কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন জানা নেই। তবে দুই কোম্পানির একত্রীকরণ সেইসব দর-কষাকষির অবসান ঘটাল।
একত্রীকরণ কোম্পানিকে সাময়িক ভাবে হলেও এমন এক ধরনের স্থৈর্য এনে দেয় যা প্রথম শতাব্দীর ইতিহাসে দেখতে পাওয়া যায় না। কোম্পানির মূলধন বাড়ল ও স্থায়িত্ব পেল। ব্যাবসা, পরিকাঠামো ও পরিবহন ক্ষমতা স্থিতিশীল হল। রাজা ও পার্লামেন্টের মধ্যে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে ব্যাবসায় পিছিয়ে পড়ার যুগ শেষ হল। কোম্পানি মাঝেমাঝে সরকারকে টাকা ধার দিত, বিশেষ করে যুদ্ধবিগ্রহ চলতে থাকলে। প্রতিদানে পার্লামেন্ট কোম্পানির স্বশাসনের অধিকার অনেকটা মেনে নিল।
সরকার ও কোম্পানির মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হল, কিন্তু ভারত মহাসাগরে গন্ডগোল দানা বেঁধে উঠছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষে বেশ কয়েক জন শক্তিশালী ‘প্রাইভেটিয়ার’ ভারতের উপকূলে ঘোরাফেরা করছে। এরা ছিল ভাড়াটে নৌসেনাদের ক্যাপ্টেন। যুদ্ধবিগ্রহ বাধলে তাতে যোগ দিত। শান্তির সময়ে কখনও ব্যবসায়ীদের হয়ে কাজ করত, কখনও জলদস্যুর ভূমিকায় মালজাহাজ আক্রমণ করত। সুরাটের কাছে একদল প্রাইভেটিয়ার ১৬৯০-এর কাছাকাছি মহা উৎপাত শুরু করে দিল।
জলদস্যু
১৬৯৪ সালে ইংরেজ ক্যাপ্টেন অ্যাভরির নেতৃত্বে একটা দল সুরাটের প্রসিদ্ধ বণিক মোল্লা আব্দুল গফুরের জাহাজ লুঠ করে। পশ্চিম ভারতের সবথেকে ক্ষমতাশালী সংস্থার উপরে আক্রমণ প্রাইভেটিয়ার সমস্যাকে প্রকট করে দিল। এদের সামলানো মুশকিল এই কারণেই যে এরা সাধারণ জলদস্যু নয়, যুদ্ধের সময়ে এরা দেশের হয়ে যুদ্ধ লড়ে। ফলে ইউরোপে যুদ্ধ চললে এরা আশ্রয় ও সাহায্য পায় স্বদেশের সরকার ও কোম্পানির কাছ থেকে। সরাসরি না হলেও অনেক অফিসার গোপনে এদের সাহায্য করতে প্রস্তুত। অ্যাভরির আক্রমণের প্রতিবাদে সুরাটের ব্যবসায়ীরা এত খেপে উঠল যে কোম্পানির ডিরেক্টরের প্রাণ নিয়ে টানাটানি। সরকারি জেলখানায় বন্দি না থাকলে হয়তো জনতার রোষ তাঁকে শেষ করে ফেলত। গন্ডগোল থামলে কোম্পানির সঙ্গে সুরাটের বণিকদের চুক্তি হল যে দেশি জাহাজ বিশেষ করে হজ-গামী জাহাজের সুরক্ষার ভার কোম্পানি নেবে।
দু’বছর বাদে আর এক প্রসিদ্ধ জলদস্যু উইলিয়াম কিডের দল সুরাটের উপকূলে আসে। স্কটল্যান্ডের লোক কিডের জীবনের প্রথম চল্লিশ বছর কাটে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও নিউ ইয়র্কের কাছে, অনেকটা সময় দস্যুতা করে। ১৬৯৬ সালে কিডের দল মাদাগাস্কারে ঘাঁটি গাড়ে। ঘাঁটি শক্ত হলে এই দল এমন একটি কাজ করে বসল যা পাকা জলদস্যুরাও করতে সাহস পেত না। এরা হজ থেকে ফেরত আসা এক জাহাজ লুঠ করল। জাহাজ ভরতি তীর্থযাত্রী, সকলেই মোটামুটি অবস্থাপন্ন। যাত্রীরা অল্পবিস্তর বাধা দিলে, তাদের নিষ্ঠুরতা চরমে গিয়ে দাঁড়ায়, দস্যুরা কয়েক জন উচ্চবংশজাত মহিলার শ্লীলতাহানি করতেও ছাড়েনি,’ নিকোলাও মানুচ্চি জানালেন।
কিডের দল হয়তো ভেবেছিল তাদের কেউ চিনে ফেলার আগেই তারা মাদাগাস্কার পাড়ি দিতে পারবে। কিন্তু মক্কা-ফেরত জাহাজের কিছু দূরেই ছিল কোম্পানির প্রহরী জাহাজ। কিডের সঙ্গে এদের যুদ্ধ বেধে গেল। সেবারের মতো কিডের দল পালাতে পারল। কিন্তু এই ঘটনার পর থেকে বাছবিচার না করে এরা আরব সাগরে হানা দিয়ে বেড়াতে থাকল। তাদের শিকারের মধ্যে ছিল একাধিক ফরাসি জাহাজ, এমনকী দু’-একটা ইংরেজ জাহাজও।
ঔরঙ্গজেব স্থির করলেন যে ইংরেজ কোম্পানিই এই গন্ডগোলের জন্যে দায়ী। বিশ্বাসটা একেবারে ভিত্তিহীন নয়, কারণ কোম্পানি অফিসাররা দস্যুদের পরিচয় জানত। কেউ কেউ এদের চিনতও। কিন্তু এদের উপদ্রব বন্ধ করার ব্যাপারে অফিসাররা কিছুটা নির্লিপ্ত ছিল, কারণ যুদ্ধের সময়ে এদের সাহায্য দরকার হতে পারে। ঔরঙ্গজেব রেগে থাকলেও খুব কড়া পদক্ষেপ নিলেন না। তাঁর প্রধানমন্ত্রী আসাদ খাঁ এবং অন্যান্য অফিসাররা ব্যাপারটা বেশি দূর গড়াতে দিলেন না। তবে ইংরেজ সরকার ও কোম্পানির সদর দপ্তর ভয় পেয়ে গেল। দস্যুদমন নিয়ে অনেক চিঠি চালাচালির একটা ফল হল যে দস্যুদের সবথেকে ক্ষমতাশালী পৃষ্ঠপোষকরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সাহায্য বন্ধ করে দিল। এর অল্প পরেই কিডকে গ্রেপ্তার করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় (১৭০১)।