ঝুমু ও টোপর ও মথিত প্রহর
‘তুমি! কখন এলে! ফোন করোনি কেন?’
‘চলে এলাম।’
‘বাড়ি গিয়েছিলে? এসো এসো।’
‘আসব? আসলে বাড়িতে বাবা-ঝিরি কেউ নেই। পলাশ, কেমন আছিস?’
‘আমি ভাল আছি। তুমি কীরকম আছ ঝুমুদি?’
‘ভাল আছি। টোপর, হুট করে চলে এলাম, তোর কাজের ক্ষতি হবে, না রে?’
‘তুমি কবে থেকে এত পর হয়ে গেলে? এবাড়িতে কোনও দিন ভেবেচিন্তে এসেছ তুমি? এটা এখনও তোমারই বাড়ি আছে ঝুমু।’
পলাশ একপলক তাকাল টোপরের দিকে। ঝুমু সম্বোধন সে লক্ষ করেছে। সে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ‘আমি তবে ক্যামাক স্ট্রিট বেরিয়ে পড়ি?’
‘যা। সব গুছিয়ে নিয়ে যা। ফোন করবি।’
টোপর ঝুমু-র দিকে ফিরল। দেখছে গভীর অভিনিবেশে। ঝুমু দেখছে তার ছবি বাঁধিয়ে টেবিলে রেখেছে টোপর!
‘ফোন যে করোনি, আমি যদি ক্যামাক স্ট্রিট চলে যেতাম!’
‘তোর ফেরার জন্য অপেক্ষা করতাম টোপর!’
‘কী হয়েছে ঝুমু? এত অস্থিরতা কেন? যা হয়েছে তার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলে না কেন?’
‘আমার কিছু ভাল লাগছে না।’
‘আবার কাঁদছ তুমি ঝুমু। এসো, আমার কাছে এসো। দরজা বন্ধ করে দাও।’
আগে যখন টোপরের রাগ হত, অভিমান হত, ঝুমু এসে পায়ের কাছে বসত। টোপর বলত, ঝুমু ওভাবে বসলে তার পায়ের সাড় আসবে। গড়গড়ির কী হবে তখন?
আজ দু’জনের মাঝখানে হাসি নেই, কৌতুক নেই, বিষাদ ও গাম্ভীর্য।
‘আমি তোমার পাশে বসতে চাই। আমাকে সাহায্য করো ঝুমু। আমার তালবেতাল দাও। কতদিন পর তুমি এলে! আর আমি ছাড়ব না তোমায়। আমার যে কিছুই ভাল লাগে না তোমাকে ছাড়া।’
‘আমারও লাগে না।’
ঝুমুর স্বর বুঁজে এল। এক পলক চোখ রাখল টোপরের চোখে। এঘরে পা দিয়ে টোপরকে দেখা মাত্র তার বুকে ধ্বক ধ্বক করছিল। তার সমস্ত শরীর কেমন অবশ বিবশ, মধ্যদেহতট বেয়ে কী এক শিরশির অনুভব নিম্নগামী স্রোতে বহমান। এ কোন আশ্চর্য বোধ? কোন বিহ্বলতা?
টোপর তার হাতখানি নিল হাতে।
‘বলো ঝুমু।’
‘টোপর, আমার সারাক্ষণ তোকে মনে পড়ে, সারাক্ষণ তোর সঙ্গে কথা বলতে প্রাণ চায়, আমার সব কাজে তুই, সবখানে তুই।’
‘সেটা যে হওয়ারই ছিল ঝুমু।’
‘এটা ঠিক নয়। আমি তো মানিয়ে নিচ্ছিলাম। আমাকে অপমান করল। প্রতিদিন করে। বলে, আগ্রহ নেই, শুধু উত্তরাধিকারী চায় বলে…আমি কি একটা মানুষ নই? বিশ্বাস কর, আমার আর বাঁটুলের মধ্যে কোনও তফাত নেই।’
টোপর চুপ করে আছে। এই বিষ নিতে নিতে সেও হবে বিষকলেবর। আজ সে বিষে নীল হোক। এই বিষ নিতে নিতে সে এক কালকূট ঝরাতে ঝরাতে যাবে কোন স্বর্গপানে? স্বর্গ, না নরক? যদি ঝুমু থাকে, তাহার সকলি স্বর্গ, ঝুমুহীন সর্বত্র নরক নরক!
কিন্তু কী বলে সে! ঝুমুকে যে কষ্ট দেয় তাকে সে হত্যাও করতে পারে। তবু, কিছু বলা সমীচীন নয়। সেও যে দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে অপেক্ষা করে আছে যদি ঝুমু আসে। যদি আসে! তার কোনও কথা যদি ভুল বোঝে ঝুমুদি প্রেয়সী! ভাবে যদি, মতলব ভাল নয়, বিবাদ বাধাতে চায় স্বামীতে স্ত্রীতে। যত কাছাকাছি হও, যত প্রাণের মধ্যে প্রাণ নাও, শেষাবধি প্রতিটি মানুষ একেকটি আলাদা দ্বীপ! মধ্যবর্তী জলভাগ ভুলে যেতে নেই!
সে পরম আদরে হাতখানি ধরে থাকে শুধু আর ঝুমুকেই কথা বলতে দেয়। অজস্র অজস্র কথা, অবিরল, কান্না মেশা, ক্ষোভ মেশা, ঘৃণা মেশা।
একসময় বলতে বলতে, শুনতে শুনেত, তারা ভুলে গেল কে আছে কোথায়। ভুলে গেল এ জগৎ কাকে কী আখ্যা দেয়। কী নিয়ম। কোন ন্যায়। কোন দোষে কেবা হয় দোষী।
‘আমাকে জোর করল কেন? জোর করল কেন? আমি তো মানিয়ে নিচ্ছিলাম। বাঁটুলকে নির্বিবাদে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছিলাম। মন ছাড়া সম্পর্ক হয় নাকি? মন ছাড়া মা হওয়া যায়? ও টোপর, আমার সমস্ত শরীরে অপমান, মনে অপমান। আমাকে সারিয়ে দাও।’
‘এসো ঝুমু। সব শুষে নেব। সব দাগ মুছে দেব। এসো। কোনও ভয় নেই।’
এতকাল টোপর শুয়েছে কোলে, আজ ঝুমু মাথা রাখল টোপরের সবল, সাড়বান, যুবক ঊরুতে। অপূর্ব পুলকে সে কেঁপে কেঁপে উঠল। টোপর শক্তিমান বাহু দ্বারা তুলে নিল তাকে। কপালে চুম্বন দিল। নরম চুম্বন দুই চোখে। তাড়াহুড়ো নেই। আগ্রাসন নেই। কাম এক রিপু বটে, মানবিক প্রেরণায় রিপুরূপী কাম হয়ে ওঠে সুন্দরতর এক প্রেম। তাই তো মদনদেবতার কন্দর্প নাম! প্রেম গভীর ও সুন্দর। প্রেম সত্য ও অনির্বাণ। তার গভীরের তল নেই। উঁচুতার সীমা নেই। বিস্তার আদিগন্ত মেশা। তাকে পেতে জানতে হয়। ক’জন তা জানে?
ওষ্ঠে-অধরে মেশা বিপুল প্লাবন! নদী হয়ে গেল ঝুমু। সমুদ্রসমান হয়ে শতরূপ নামের যুবক তাকে পুরোপুরি অধিকার করে নিল।
কে ওই নারী? সংস্কারহারা! লজ্জাহীন! ভয়হীন! কেবল প্রেমের জোয়ারে ভেসে উঠে আসে কোন এক অর্থময় রতিব্যঞ্জনায়। অসাড় পা সমেত অর্ধাঙ্গ যুবক, রতিদেবী তাকে আলিঙ্গন করেন। অগ্নিময়ী দেবিকা ধীরে ধীরে ইন্দ্রাসনা হয়ে উঠলেন। শতরূপ দেব দু’হাতে ধারণ করলেন ক্ষীরামৃতভরা ঘট। আর মন্থন হতে লাগল রসপারাবারে।
প্রথম সঙ্গমের অতিশয়ী যন্ত্রণা টোপরের, প্রথম অদক্ষ ওঠাপড়া, ধর্ষণশাপমুক্ত ঝুমুর কামিনী, ছন্দে ছন্দে গড়ে নিল চিরবসন্তনগরী।
এই ভঙ্গি কোথা পেল ঝুমু? জানে না সে। এই আরোহিণী হয়ে ওঠা— সে কি বিগত মুহূর্তেও জানত এরকমই হবে?
হয়তো দেখেছিল ফিল্মে। হয়তো ছবিতে। মনে নেই। তবু মস্তিষ্কে গেঁথে গেছে।
অতঃপর ঝুমু ও টোপর, সুদীর্ঘ সময়, শুয়ে রইল শরীরে শরীর।
টোপর ও ঝুমু ও মধুর মুরতি
কতদিন পর দু’জনে কফি নিয়ে মুখোমুখি। ঝুমু-র দু’নয়নে প্রেম। টোপরের দু’নয়নে ভালবাসা, ঝুমু সলাজ, নবজলতরঙ্গে নবকল্লোলিনী। শতরূপ গভীর পুরুষ মনোময়।
‘থাকো ঝুমু। যেয়ো না।’
‘এভাবে কি চলে আসা যায়?’
‘এ আনন্দ ফেলে কোথা যাবে?’
বড়পিসির সাতখানা অধরা ডাক, জ্যোতির্ময়ের পাঁচখানা, ঝিরির একটি। সঙ্গে বার্তা, ‘তুই কোথায়? বড়পিসি ও বাবাকে ফোন কর। ভাবছে।’
জ্যোতির্ময় বললেন, ‘শাশুড়িকে না বলে চলে এলি ঝুমু? এ কেমন ব্যবহার? কোথায় তুই?’
‘টোপরের কাছে। শাশুড়িকে বলে এসেছি।’
‘বড়পিসিকে ফোন কর।’
জয়ী বললেন, ‘ওভাবে শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে এলি?’
‘কীভাবে?’
‘ছিছি ঝুমু, তোর কত প্রশংসা করেছি। এভাবে বোকার মতো চলে এলি?’
‘আমি ওঁকে বলেই এসেছি। আসতে পারি না? আমি কি বন্দি?’
‘শ্বশুরবাড়িতে প্রথম প্রথম নিষেধ মানতে হয়। আপন করে নিতে শিখতে হয় ঝুমু।’
‘তুমি তো আপনজন বড়পিসি, তোমাকে মায়ের মতো মেনেছি! কী বলে আমাকে কুকুরের জায়গায় ঠেলে দিলে? আমি বোকা। আমাকে কোথাও গুঁজে দিলেই হল।’
‘এজন্যই উপকার করতে নেই। আইবুড়ি হয়ে শুকিয়ে মরছিলি, বর জুটিয়ে দিলাম, কোথায় বর্তে যাবি, উলটে চোপা করছিস। আমার হয়েছে জ্বালা। ছিছি। কী লজ্জা! কল্যাণীদি আমার মুখে চুনকালি দিলেন!’
‘আমি শুধু বাপের বাড়ি এসেছি, এতে তোমাদের মুখে চুনকালি কী করে পড়ে?’
‘এত চোপা তোর! এত মুখ! এমন তো ছিলি না তুই ঝুমু? সব শুনেছি আমি। ওই ল্যাংড়ার সঙ্গে তোর রোজ গপ্পো! ও-ই তোকে কুবুদ্ধি দেয়। আমি হলফ করে বলতে পারি, তুই ওরই কাছে বসে আছিস!’
‘হ্যাঁ গো পিসি! আমি টোপরের কাছে বসে আছি! চারদিক দেখে বুদ্ধি আমার আপনিই খুলে যাচ্ছে। বোল নিজেই ফুটছে। কী করব বলো! আমি জানি আমি কোনও অন্যায় করিনি!’
ঝুমু ও টোপর কফি খেল। গভীর চুম্বন করল ফের।
‘থাকো ঝুমু। ও বাড়ি তোমার জন্য নয়।’
‘আমি বড় টোপর। আমাকে দায়িত্ব নিতে হবে। বাবার সম্মান, বড়পিসির সম্মান।’
‘তুচ্ছ করো। সব তুচ্ছ করে এসো। যে সম্মান বদ্ধমূল অর্থহীন সংস্কারের প্রতিনিধি মাত্র, অস্বীকার করো তাকে। তুমি মরে যাবে তিলে তিলে। ক্ষয় হয়ে যাবে। তোমার জীবনীশক্তি আহুতি দেবে কোন সংস্কার? আজ বলে দাও-যাবে না। যাবে না কোথাও।’
‘এভাবে চলে আসা যায় না।’
‘ঝুমু, আমি কখনওই তোমায় জোর করব না। আমি জোরে বিশ্বাসী নই। সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে জোর করে অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায়, ব্যক্তিগত জীবনে সে পন্থা অচল। সেখানে কোথাও অধিকার বলে কিছু নেই। যা আছে কেবল স্বীকৃতি। সেখানে উভয়েই দাতা, প্রার্থী উভয়ে। পরিস্থিতি ভেদে অবস্থান শুধু বদলে যায়। ঝুমু, আমি বলছি থেকে যাও, কারণ তা অনিবার্য। আমি তা দেখতে পাচ্ছি। তুমি পাচ্ছ না কারণ মায়াঞ্জন পরে আছ। ওটা ধুয়ে ফেলো। জীবনের অভিমুখ পালটানো কি যায় না? আমরা কেউ বলিপ্রদত্ত নই গো।’
‘টোপর, হয়তো তুই সত্যদ্রষ্টা। আমার আগেই তুই আমাকে চিনেছিলি। তোকে ছেড়ে চলে না গেলে আমার হৃদয়ে প্রেম চিহ্নিত হত না। জানাই হত না মনোজগতের ইতিকথা। টোপর, আমার সমস্ত দিয়েছি তোকে। আজকের আদরটুকুই না। তুই আছিস, এইটুকু জানা দিয়ে সমস্ত সইব আমি। দায়িত্ব কীভাবে অস্বীকার করি। সমাজ বন্ধন দেয়, তার শক্তি সহজে কি অতিক্রম করা যায়? আমার যে ওই অপরাধবোধ, তুই ছোট, কত ছোট, কী করে তোকে আমি প্রকাশ্যে স্থাপন করি!’
‘লোকে কী কবে, তাই না? লোক, লোক। তুমি অল্প অল্প মরে যাচ্ছ, কেউ কি পাঠাবে মৃতসঞ্জীবনী? ওই যে মেয়েটা, লাল, মরে যাচ্ছে, কেউ কি জীবন দিল তাকে? টাকা দেয়। তবু বলে না তো, ছেড়ে আয়। ও নরক তোর জন্য নয়। টাকা দিয়ে কী কেনে? ঠুনকো বানানো সম্মান। সংস্কার এমনই গভীর, ভুল পথ মৃত্যুর চেয়ে বেশি মর্যাদা আদায় পায়। ওই লাল নামে মেয়েটাকে সবাই আসলে পুড়িয়ে মারছে চন্দনের মহার্ঘ চিতায়। ঝুমু, জীবনের দিকে দেখো। মৃত্যু নয়। মৃত্যুকে ডেকো না। আরোপিত অর্থহীন রীতিতে নীতিতে দিয়ো না হৃদয় বিসর্জন। ও ঝুমু।’
‘পারব না টোপর। ভালবাসি তোকে। ভালবাসি। তবু পারব না।’
‘আমি রইলাম ঝুমু। আজীবন তোমাকেই ভালবেসে। আমি আছি।’
সন্দীপন ও ঝুমু ও নদীর কুমীর
ঝুমু যাবে না। যাবে না বাপের বাড়ি। এক সাধারণ মেয়ে সামাজিক সম্বন্ধ অবলম্বন ছাড়া আর কী বা করতে পারে! শাশ্বতী কি পারল, ওই নিগ্রহ, অপমান, প্রেমহীন পীড়নের সম্পর্ক ছেড়ে আসতে? আসা যায় না। ঝুমু এমনই বিশ্বাস করতে চায়, এমনই আঁকড়ে নিতে চায়। তারই উপর নির্ভর করছে বাবার সম্মান। পিসির সম্মান। তার নিজের ভবিষ্যৎ মর্যাদা, অবস্থান।
এবাড়ির একজন হয়ে ওঠার জন্য ঝুমু প্রাণপণ প্রয়াসী।
সেই এক অপূর্ব মিলন সম্বল করে ঝুমু ফিরে এসেছিল, অবিস্মরণীয় এক বিজন দুপুরে। সে যখনই একলা হয়, নেড়েচেড়ে দেখে। গভীরতম প্রেম দিয়ে রচনা হয়েছিল যে মুহূর্ত তাকে ভাবলেই, তার মনে লাগে আনন্দজোয়ার। দেহে অভিসারিকার ভাব, কামোন্মাদনা। ঝুমু তার লালনপালন করে, যত্ন করে খুব। প্রতিদিন হাঙরের দাঁতে নিজেকেই ছেড়ে দেয় ছিন্নভিন্ন হতে। সেসময় টোপরকে ভাবে ঝুমু। টোপরকে জড়িয়ে ভোরবেলা বিছানা ছেড়ে নামে। ও টোপর, টোপর। তুঁহু মম মৃতসঞ্জীবক।
এভাবে কি বাঁচা যায়? একদিন দু’দিন। তারপর? দু’ঠোঁটের মাছ ফেলে একদিন গাছের ডালের দিকে উড়ে যায় বক।
অভ্যাস হয়ে যাবে। সাধারণ মেয়ে, তার সব সয়ে যায়। তার তো টোপর আছে। শাশ্বতীর কে আছে? তবু টেনে যাচ্ছে তো! সাধারণীপনায়, প্রেমহীন নিকৃষ্ট জীবন নিয়ে প্রতিদিন ঘুম শয্যা জাগরণে সিদ্ধি প্রেরণায় শাশ্বতী ঝুমুর কাছে আদর্শ রমণী! সেখানেই সে নিরন্তর নিজেকে শাশ্বতীর অবস্থানে তুলনীয় রাখে। সে শাশ্বতীর চেয়ে ভাল আছে। শাশ্বতী, শাশ্বতী, লাল যার নাম, মোহাবেশে রাস্তায় বিছিয়েছিল কাম। কাম থেকে এখন সে কঙ্কালিনী নারী। গায়ে প্রস্রাবের দাগ, পায়ে পায়ে স্বগৃহে স্বয়ং ভিখারি।
ঝুমু নয়। ঝুমু ভিখারি তো নয়। ধারালো খাঁচায় প্রতিদিন একটু একটু করে ডানা কাটা যায়!
নিজেকে কঠোরে বাঁধতে সে আর টোপরকে ফোন করে ডাকে না। যখন আর না পারে, অন্তরাত্মা ছটফটিয়ে মরে টোপরের কণ্ঠলাগি, সে ছাতে যায়, ঘোরে, বাঁটুলকে জড়ায়, অপুদিকে পেলে দিব্য সামাজিক আলোচনা করে, ঝুল ঝাড়ে, অর্ধচেতন শ্বশুরের পায়ে ক্রিম ঘষে দেয়, আলমারি থেকে শাড়িগুলো নামায়, গুছিয়ে তোলে, ফোন করে ননদিনীকে, ফোন করে ঝাড়ু নমিকে, ঝিরিকে। অকারণ ঝুল ঝাড়ে। রবীন্দ্রসঙ্গীত চালিয়ে দেয়। টিভি দেখে। কিংবা দেখে না কিছুই। শোনে না কিছুই। যা করে, তাতে ফাঁকি নেই, কিন্তু প্রাণও নেই। ফাঁকি সে নিজেকেই অবিরত দেয়। বই পড়ে। একই পৃষ্ঠা বারংবার পড়ে। কিংবা দশ পাতা পড়ে মনেই করতে পারে না কী ছিল! তারও পর, সংবরণ অসম্ভবে ফোন করে।
‘টোপর।’
‘বলো ঝুমু।’
‘ভাল থাক।’
‘আমি ভাল আছি। ভাল নেই। আমাকে ডুবিয়ে ভালবাসা চেতনায় এ কোন আঁধার তুমি জড়াও রমণী। নিজেকে দিলেই যদি ঝুমু, কেন তবে ফিরিয়ে নিয়ে যাও।’
‘টোপর। সোনা। আমি যে সারাক্ষণ তোকে নিয়ে থাকি। দিবানিশি। অণুতে অণুতে।’
‘ফিকে হতে দিয়ো না আমায় ঝুমু। তুমি ছাড়া কারও কাছ প্রেম যাচিব না। চাই না চাই না ঝুমু, আর কোনও মানুষী বা নারী স্রেফ মধুভাণ্ড এক।’
ঝুমু একমনে চুল ঝাড়ে, ফুল পাড়ে। নিতান্ত সাধারণ মেয়ে, শ্বশুরের ঘর প্রাপ্তি তাকে ভারী কৃতজ্ঞ করেছে। কৃতজ্ঞ হতে হয়। বর্তে যেতে হয়। শেখায় সমাজ। সেও শিখছে। অ আ ক খ।
বাঁটুল এসে দাঁড়াল পাশে। হাত চেটে দিল। ঝুমু বলল, ‘কী চাই?’
‘উঁ উঁ উঁ।’
‘তুই আমার কেউ না।’
‘ওঁয়াও। গর র র র।’
‘কে তুই? প্রভুভক্ত কুকুর। বুদ্ধি নেই? চেঁচিয়ে পিটুনি খেয়েছিলি কেন?’
‘উঁঃ! উঁ উঁ উঁঃ!’
‘কী ভাবলি তুই? তোর জায়গাটা হাতছাড়া হয়ে গেল? ঈর্ষায় চ্যাঁচালি নাকি? অথবা উলটোটা। বাঁটুল। তুই বুঝেছিলি, না রে? জবরদখল অপরাধ বুঝেছিলি? নারীর শরীর নিজেই নিজের প্রভু। কেউ তার আধিকারী নয়। এই সারমেয়, তুই যা বুঝিস, এরা তা বোঝে না। তোরও সময় আসে, প্রভুত্ব মাড়িয়ে প্রতিবাদ প্রতিষ্ঠিত করা রে বাঁটুল! নারীর শরীর নিজেই নিজের প্রভু। সে কি সাধারণ মেয়েরও শরীর? বাঁটুল? সাধারণ মেয়েরা কি নারী? নারীদিবসের সংজ্ঞা তাদের জন্য অর্থ রাখে কিছু?’
বাঁটুল গর্ভবতী। ঝুমুও। তার গর্ভই চেয়েছিল এ বাড়ির লোক। তারা খুশি। সন্দীপন অতি যত্নে বাঁটুলকে চিকিৎসালয়ে নিয়ে যায়। ঝুমুরকে নিয়ে যায় শাশুড়ি কল্যাণী। পাড়ার ডাক্তার শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায় নামকরা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। তাঁর কাছে যায় না। অপরাজিতার সংগঠনে তিনি সভামুখ্য, তাই ব্রাত্য। ঝুমু যায় যাদবপুর।
শীঘ্র গুরুমা চেতলায় আসবেন। সাজো সাজো রব। মহাযজ্ঞ হবে এইবার। কী এক অমৃতযোগ উপস্থিত যা নাকি সাড়ে তিন বছরের পর একবার আসে। এসময় চাওয়ার মতো চাইলে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। কল্যাণী বলেছেন, ‘ছেলে চেয়ো ঝুমুর। যজ্ঞাহুতির সময় থাকবে আমার পাশে।’
‘ছেলে যদি না হয়?’
‘ছেলে চাই। মেয়ে নিয়ে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছি। জানো তো সবই। ওই এক মেয়ের জন্য সর্বস্ব গেল। ধন গেল, মান গেল। আমাদের ভবিষ্যতের কাঁটা একেবারে। ওর বাবাকে খেয়েছে। আমাদেরও খাবে।’
মধ্যরাতে সঙ্গমের পর সন্দীপন বলতে লাগল, ‘মা ক’দিন এসব করতে বারণ করেছেন। যদি জিজ্ঞেস করে, বোলো, কিছু হয়নি। আর হ্যাঁ, যা বলছিলাম। মাতাজির কাছে ছেলে চেয়ো। মা নাতি চায়।’
‘ছেলে যদি না হয়?’
‘মা মানবে না। মন প্রস্তুত রাখো।’
‘তার মানে?’
‘ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা আছে। চিন্তার কিছু নেই। উনি খুবই অভিজ্ঞ। নাম করা।’
‘গর্ভপাত! কী বলছ?’
‘করতেই হবে, কে বলল। ছেলে হলেই সমস্যা নেই।’
‘যদি বার বার মেয়ে হয়? যদি বাচ্চাই না হয় আর?’
‘মাতাজির আশীর্বাদ আছে, তাঁর বাণী মিথ্যে হবে না।’
‘তোমরা অদ্ভুত!’
তুমি, তুমি সম্বোধন! ঝুমু পৌঁছেছে এখানে। কিংবা নিজেকেই নামিয়েছে হচড়ে টেনে। মানিয়ে নিতে হবে তো!
এবার সে কী করে? ভাবছে। এরা কি ছাড়বে তাকে? রাজি হতে বাধ্য করবে? একটি যুদ্ধের মধ্যে ঢুকে পড়ল আরও এক রণ। এমনকী টোপরকেও বলতে পারেনি। মায়া হল। মাতৃহারা একাকী, আজন্ম নিষ্ক্রিয় পদদ্বয়ের বৈরীতার কারণে কতই না কষ্ট তার। প্রতি সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, প্রতি পল-অনুপল, প্রতি পদক্ষেপ তার কাছে মহারণ! কখনও বলে না কষ্টের কথা! সহ্যাতীত অধ্যবসায়ে একে একে অভ্যাস করেছে তালবেতাল নিয়ে চলা, গড়গড়ি, গাড়ি চালানোর প্রক্রিয়া। সহ্য করতে শিখেছে ব্যঙ্গ। উপহাস। মা যাকে ব্রাত্য করে গেছে, তার মর্মবেদনা কে বোঝে! বয়সের তুলনায় টোপর প্রাজ্ঞ, গভীর। সে তরুণ অশত্থের মতো ডালপালা মেলে ঝুমু-র সহায় হতে চায়। ঝুমুও হতে চায় এক রাধাচূড়া গাছ। তার ভাল লাগে। তার আকণ্ঠ আসবাসব পানের মতো মধুরতম আনন্দবোধ হয় যখন সে ভাবে এক অনতিক্রম্য পথ পার করে শীর্ষে আরোহণ করার সেই মুহূর্তের কথা। সে পেরেছিল। টৌপরকে সেই স্বাদ দিতে পেরেছিল। টোপর, টোপর, কে তোকে প্রতিবন্ধী বলে! তুই সক্ষম, সার্থক পূর্ণ পুরুষ!
সেই পুরুষের কাছে ঝুমুর নামের মেয়ে সব নিবেদন করে। সব দুঃখ, কষ্ট, বেদনাজর্জরতা! কিন্তু ভাবনাও যে হয়। সঙ্কোচ। টোপর কত ভার নেবে আর? ঝুমু যে অনেক বড়।
শাশ্বতী মাঝখানে একবার এসেছিল। চেয়েচিন্তে নিয়ে গেল দশ হাজার। সে যেন আরও ম্লান, আরও কৃশ বিষাদকাহিনি। তাকেও কি বলা যায় গর্ভফুল বাঁচাবার কথা? কিংবা ওই নারীবাদী অপরূপা অপরাজিতা? তাকে? যদি ছেলে না হয়!
তার মনে পড়ে কলেজের খুব কাছে ছিল নিরাপদে গর্ভপাত। হাসাহাসি করত তারা। খেলুড়ি মেয়েরা, পুরুষশিকার যাদের লক্ষ্য ছিল দিবারাত্র-তাদের নাম ছিল ‘ক্লিনিক ফেরত’। মেয়েদের আত্মপ্রতিষ্ঠার কাঙ্ক্ষিত মঞ্চ ছিল সি এ হওয়া। হিসাব বিশেষজ্ঞ। মজা করে তারা বলত— তোর লক্ষ্য কী? সি এ হওয়া, না সি এফ?…সেই ব্যঙ্গরসে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিত সমবয়সি ছেলের দল। তারা বলত, ওই কলেজে মেয়েদের ভ্রমণবৃত্তান্ত এরকম-সকালে উঠল। দাঁতটি মাজল। সাজল। পার্কে গেল। ঝোপের আড়ালে। পেট হল। কলেজে গেল। লেখাপড়া করল। বেরোল। ক্লিনিকে গেল। পেট খসানো হল। মেয়ে কুমারী হয়ে ঘরে ফিরে গেল। আবার সকাল।
সকালে উঠিয়া আমি
মনে মনে বলি
ইন্টু বিন্টু টিন্টু যেন
পার্কে করে চলি
পার্কের পরেই যাব
ক্লিনিকে ক্লিনিকে
কলেজের পাপ
ধুয়ে দেয় পাঁচসিকে!!
এই সমস্ত নিয়ে ঝিরি ও ঝাড়ু-নমির সঙ্গে কত হাসাহাসি করেছে ঝুমু। টোপরের সঙ্গে বিস্তর মজা লেনদেন করেছে। কিন্তু ইদানীং আর হাসি পাচ্ছে না! ন্যায়-অন্যায়, নীতি-দুর্নীতি, আদর্শ-অনাদর্শ, স্বাধীন বিধান ও অপরের অধীনতার দমবন্ধকর চাপ নিরন্তর দ্বন্দ্ব পাকাচ্ছে মনে। আদিরসে চুপচুপে ব্যঙ্গকৌতুক আজ ঝুমুকে বিরাট প্রশ্নচিহ্ন সম্মুখীন করেছে!
ঝুমু ও জ্যোতির্ময় ও অনিশ্চয়
ঝিরি, ঝুমু, জ্যোতির্ময় বসেছেন। মাত্র দুপুরটি হাতে নিয়ে এসেছে ঝুমুর। একবার টোপরের কাছে যাবে ভেবেছিল। গেল না যদি ধরা পড়ে যায় তার উদ্বেগব্যাকুলতা। ও ঠিক বুঝে যাবে! ওর অন্তর্ভেদী চোখ! ও ঝুমুকে ঝুমু-র চেয়ে বেশি জানে। যাবে না যাবে না ঝুমু। কিছুতে যাবে না। আতঙ্কে বিবর্ণ তার মুখে। সে যাবে না এ পোড়ামুখ নিয়ে।
‘তুই অত কেন উতলা হচ্ছিস। ডাক্তার কী বলেন দ্যাখ আগে।’
ঝিরি প্রতিক্রিয়াশীল। সে তীব্র বলে উঠল, ‘তোমার কথার অর্থ কী বাবা? সারাটা জীবন ও-বাড়িতে থাকতে হবে ওকে! এই যাদের মন! কী নিশ্চয়তা আছে, কোনও ছুতোয় দিদিকে মেরে ফেলবে না?’
‘দুটো এক নয় ঝিরি। ঝুমুকে ভালবাসেন ওঁরা।’
‘ভালবাসেন! ভালবাসার কী দেখলে? বিছানায় কুকুর শুইয়ে ওকে মাটিতে রেখেছে। ভালবাসা? এক পা বেরোতে দেয় না। ভালবাসা? দীপদা কোথাও নিয়ে যায় না, দু’দণ্ড কথাটি বলে না, ভালবাসা? গর্ভপাতের প্রস্তাব, ভালবাসা? টোপরের সঙ্গে পর্যন্ত কথা বলতে দেয় না। আমাদের কাছে আসতে দেয় না। ভালবাসা?’
‘শ্বশুরবাড়িতে এরকম একটু-আধটু হয়। পরে ঠিক হয়ে যাবে।’
‘পরে, পরে, কবে বাবা? ওরা নিকৃষ্ট প্রস্তাব করছে। তুমি কেন বুঝেও বুঝছ না? কন্যাভ্রূণহত্যা শুধু ভ্রূণহত্যার পাপ নয়, আইনবিরুদ্ধ। যারা পরিকল্পিতভাবে ভ্রূণহত্যা করে, তারা যে কাউকে খুন করতে পারে বাবা! ওই পরিবার ও ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা উচিত।’
‘দ্যাখ ঝিরি, জীবন অত সহজ নয়। সত্যিই কি ওরা এসব করবে? ভদ্র, শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত পরিবার! ওটা একটা কথার কথা।’
‘কে বলল তোমাকে? কথার কথা? তোমাকে প্রাণের কথা বলে গেছে? ওটা ভদ্র শিক্ষিতের প্রস্তাব? তুমিও কি মাকে এ প্রস্তাব করেছিলে বাবা? সন্দেহ হচ্ছে তো আমার।’
‘ঝিরি, তুই সীমা পার করে যাচ্ছিস।’
‘তুমি কী করতে বলছ? দিদি ওখানেই থাকবে? ওদের সব কথা শুনবে? বাবা, তুমি জানো তুমি কী বলছ?’
‘আমি ধৈর্য রাখতে বলছি। হঠকারিতা বারণ করছি। Life is an adjustment। এটা তোমাদের বুঝতে হবে। আমি একা হাতে তোমাদের বড় করেছি। টাকা খরচ করে বিয়ে দিয়েছি বিয়ে ভাঙার জন্য নয়। আজ যদি ও ফিরে আসে, কে দায়িত্ব নেবে? ও একা নয়, ওর সন্তান সমেত কে ভার নেবে? তুমি নেবে?’
‘ও নিজেই নিজের দায়িত্ব নিতে পারত যদি জোর করে ওর চাকরি না ছাড়াতে!’
‘আমি যা করেছি, তোমাদের ভালর জন্য। মেয়েদের নিরাপত্তা সবার আগে। ঝুমু সরল, বাস্তববুদ্ধি নেই, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান! কে জানে কোন ফাঁদে পড়ত!’
‘এখন যেমন ফাঁদে পড়েছে, না বাবা? তুমি ও বড়পিসি ঠেলে ফেলেছ! চমৎকার নিরাপত্তা দিয়েছ না ওকে?’
‘ওঁরা যা বলছেন, তা অন্যায়, মানছি। কিন্তু ওখানেই ঝুমুর ভবিষ্যৎ। আমি সন্দীপন ও কল্যাণীর সঙ্গে কথা বলব দরকার বুঝলে। জয়ীও বলবে।’
‘আর অশ্রদ্ধাটা কিছু না? যদি মেয়ে হলে দিদির সঙ্গে দুর্ব্যবহার বাড়িয়ে দেয়? যদি মারধোর করে? তুমি কি কিছুই বোঝো না বাবা? দীপদা দিদিকে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যায়নি, এ বাড়িতে আসে না, ওদের কোনও গল্প নেই। সম্পর্কটাই তৈরি হয়নি তো! সেখানে নিরাপত্তা কোথায়! এরকম ভয়ঙ্কর প্রস্তাব শোনার পর দিদি ওদের শ্রদ্ধা করতে, ভালবাসতে পারবে তো?’
‘সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে সম্পর্ক দৃঢ় হবে। মনে ক্ষমা রাখতে হয়। দেখো, আমি চাই না ঝুমু সব ভাসিয়ে ফিরে আসুক। এমনিতেই টোপরের সঙ্গে রোজ কথা বলে এই নিয়ে অভিযোগ উঠেছে। হাজার হোক রক্তে র সম্পর্কে তো ভাই নয়। বুঝতে হবে।’
‘আমি প্রবীরকাকে জানাব। আমি চুপ করে থাকব না। তুমি আমাদের একা হাতে বড় করেছ সেটা আমাদের অপরাধ নয়। তোমার দায়িত্ব ছিল। মায়ের অসুস্থতার জন্যও তোমার দায়িত্ব ছিল। হ্যাঁ, দিদির ভাল করার চেষ্টা করেছ তোমরা। কিন্তু ভাল না হলেও তাকে ভাল বলবে? তোমার সিদ্ধান্তে ভুল হচ্ছে বাবা। দিদিকে মরণফাঁদের মধ্যে ঠেলে দিয়েছ বলে দিলাম। এরা যা খুশি করতে পারে। আমি জন্মে মা হারিয়েছি, দিদি হারাতে পারব না।’
‘প্রবীর কী করবে? ঝুমুর দায়িত্ব নেবে? হ্যাঁ, বিয়েতে খরচ করেছে প্রবীর, সোনার নূপুর দিয়ে আশীর্বাদ করেছে, ঝুমুর প্রতি স্নেহ আছে, কিন্তু ও কী করবে? ঘরের কথা বাইরে বলে লাভ?’
‘দেখো, কেমন মানুষ তুমি, এক মুহূর্তে প্রবীরকাকে বাইরের লোক বানিয়ে দিলে। কেন জানো, তুমি বুঝতে পারছ তোমার সিদ্ধান্তগুলো অমানবিক হয়ে যাচ্ছে। সেটাকেই আড়াল করতে চাও।’
‘দ্যাখ ঝিরি, জীবনে কিছুই দেখিসনি, বড় বড় কথা বলছিস। সম্পর্ক ভাঙা খুব সোজা। আমি বলব, ধৈর্য রাখো। তাড়াহুড়ো কোরো না। সমস্ত সংসারেই ভালমন্দ আছে।’
ঝুমুর ও মালিনী ও অন্য ঋণী
যজ্ঞের দিন স্নান সেরে গহনা ও বেনারসি পরে ঝুমু কল্যাণী শাশুড়ির সঙ্গে চেতলায় উপস্থিত হল। সন্দীপন আসবে। কিছু পরে।
চেতলায় পৌঁছে তার মনে হল ছুটে চলে যায়। টোপর, ও টোপর, আমি কত কাছে, তবু যেতে পারছি না!
সে বলল, ‘একবার বাড়ি যাব।’
কল্যাণী বললেন, ‘কী কারণে? তোমার বাবা, বড়পিসি, ঝরোকা— সকলেই আসবেন।’
ঝুমু চুপ করে বসে আছে। বাড়ি মানে কী? লোকগুলোই তো শুধু নয়! তার গন্ধ। তার স্পর্শ। তাতে নিহিত সময়। দেওয়ালে দেওয়ালে অদৃশ্য অক্ষরে লেখা কত মুহূর্তের ইতিহাস! বাড়ি মানে প্রবীরকাকা! রুপুকাকিমার শাড়ি। এডিনিয়াম গাছ। গোপালীমাসি, ঝাড়ু-নমি সমেত সমগ্র কানাই সামন্ত সরু গলি। আর? আর কী? আর কে? ঝুমু-র বাড়ি মানে শোলার কদম ঝোলানো, চিকিমিকি জড়ি দেওয়া অদ্ভুত চোঙাটিও নয়? টোপর নয়? টোপর? টোপর? টোপর! ও টোপর! টোপর!
সে শাশুড়িকে অতিক্রম করবে না তবু। সে উদ্ধত হবে না। সে এক সাধারণ মেয়ে। সাধারণ বধূ। সম্পন্ন ঘর-বর পেয়েছে! না-ই বা হল প্রেম! নাই বা সসম্মান সোনার মুকুট। এ কূট কুটিল পৃথিবী আসলে মৃত্যুর কালো ঢিবি! কখন যজ্ঞ হবে? এখনও সে খেতে পায়নি। খিদে পাচ্ছে খুব। ঝুমু-র খিদে বেড়ে গেছে। পুত্রার্থে ক্রিয়তে যজ্ঞঃ এতই সহজ? খিদে সহ্য করো। কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে।
তিনতলা বাড়িটি আজ লোকারণ্য। সকলেই কি ছেলে চায়? ছেলে না পেলে গর্ভপাত চায়?
মৌনব্রতা মাতৃস্বরূপিণী গুরুআম্মা— গর্ভপাতের প্রস্তাব কি তাঁরও সম্মতিসাপেক্ষ নয়?
গুরু কত রকমের? গোপালীমাসির গুরু প্রসন্নানন্দজি ওই নিরক্ষর দরিদ্র মহিলাদের উন্নত মানবতার শিক্ষা দিয়েছিলেন। মন, চিন্তা, চেতনা— বুদ্ধির কলেবরে তিন অঙ্গ, তাদের ঘুম পাড়াতে নেই। কত সহজ ও গভীর শিক্ষা। আর এঁরা?
শাশ্বতীকে ধীর পায়ে প্রবেশ করতে দেখল সে। সে কি জানে, এ যজ্ঞ তারও বধ্যভূমি হতে পারে? সেও বুঝি কতশত মনস্কামনা নিয়ে মাতাজির শরণাগত!
ওই এল। সন্দীপন। ঝুমুর জীবনসঙ্গী। স্বামী। হ্যাঁ, স্বামী। জীবনসঙ্গী নয়। সে অন্যজন।
সন্দীপনের সঙ্গে একটি ছোট মেয়ে। ফুটফুটে শিশু। মাথায় রিবন। লাল জামা। লম্বা খোলা চুলে সে যেন লালপরি। সন্দীপনের হাত আঁকড়ে আছে। মনে হচ্ছে সন্দীপনেরই মেয়ে। এমন একটি মেয়ে তো তাদের হতেই পারে! সমস্যা কোথায়? শাশ্বতীর জীবন ও পরিণতি দুর্ভাগ্যজনক। তার মানে কি মেয়েজন্মই নিষেধ করে দিতে হবে? অসম্ভব! এরকম কোনও শর্ত মান্য করতে পারবে না সে। কী করবে? প্রথমত, জন্মের আগে গর্ভস্থ শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ আইনসঙ্গত নয়। দ্বিতীয়ত, অকারণ গর্ভপাত সে পাপ মনে করে। সে এক সাধারণ মেয়ে। সে গর্ভপাত কী করে মেনে নেয়?
সে কি এই শর্তের কথা তার টোপরকে বলবে?
সে কি পুলিশের কাছে যাবে?
কী করবে? কী করবে?
সে ঘেমে উঠল। হঠাৎ মনে হল সে পাগল হয়ে যাচ্ছে। তার সহজ স্বাভাবিক জীবন অকস্মাৎ জটিল দুর্বোধ্য ধাঁধায় ঢুকে পড়েছে। সে এই ভার নিতে পারছে না। সে ব্যাগ খুলে ফোন নিল।
‘টোপর।’
‘বলো ঝুমু। কী হয়েছে?’
‘আমার ভয় করছে।’
‘কেন ঝুমু?’
‘আমি চেতলায়। যজ্ঞবাড়িতে।’
‘ঝুমু, কিছু কি বিচলিত করছে তোমাকে যা আমাকে জানাতে পারোনি?’
‘টোপর, আমাকে ভুল বুঝিস না সোনা।’
‘আমি সাহায্য করছি তোমাকে ঝুমু। তুমি চাও, ও বাড়িতে মানিয়ে নিতে, মেনে নিয়েছি। তুমি ভাল থাকো। কিন্তু না থাকো যদি, অযথা নিজেকে কষ্ট দিয়ো না। আমি আছি। আমি তোমার জন্য আছি।’
‘আয় না তুই টোপর। এ বাড়ির সামনে আয়। আমি দূর থেকে একটু দেখি তোকে। আয় সোনা। এই জানালা দিয়ে বাইরের রাস্তা দেখা যাচ্ছে।’
‘আমি আসছি ঝুমু, ওখানেই বসে থাকো। নড়বে না। কোথাও যাবে না। শোনো, আমি জ্যোতিকাকা আর ঝিরিকেও সঙ্গে নিচ্ছি। ওদের তো যাবার কথা।’
‘আয় টোপর।’
কথা বলতে বলতে সে দেখতে পাচ্ছিল সন্দীপনের ঠিক পিছনেই মালিনীকে। সেই মেয়ে, যে এক মনে খোল বাজাচ্ছিল। আজ শাড়ি পরে আছে। সেদিনও সন্দীপন মালিনীর পাশে বসেছিল।
‘কেমন আছ ঝুমুর?’ শাশ্বতী ডাকল।
‘এসো। বসো।’
‘তুমি আসবে বলেই এলাম। সুখবর পেয়েছি।’
‘হ্যাঁ। তুমি টোপর দেখবে লাল?’
‘টোপর আসছে?’
‘এখানে আসবে না। ওই রাস্তায়। বাবা আর ঝিরিকে পৌঁছে দেবে।’
‘বেশ। দেখি তাকে।’
‘কেমন আছ লাল?’
‘এই মুহূর্তে বড় ভাল আছি। কেন জানো?’
‘কেন বলো।’
‘কাল আমার ছেলে ভুটকুন হঠাৎ আমার গলা জড়িয়ে শুয়ে পড়ল। আজকাল তো করে না এমন। বলল, মা, আমি খারাপ কাজ করেছি। আমার পাপ হয়েছে। বললাম, কী কাজ? সে বলল, তোমাকে কত কষ্ট দিই মা। জানো, আমাদের ক্লাসে সুকল্যাণ ওর মাকে কষ্ট দিত, তাই ওর মা মরে গেছে। গলায় দড়ি দিয়ে। তখন আমাদের ক্লাসটিচার রেজওয়ানা ম্যাম বললেন, মাকে কষ্ট দেওয়া পাপ। আমি আর কষ্ট দেব না তোমাকে মা। তুমি মরে যাবে না তো?… আমার হঠাৎ খুব আনন্দ হল ঝুমু। এত যে কষ্ট করি, ভুটকুনের জন্যই তো। ও আমাকে একটু ভালবাসলে আমি আবার নতুন করে বেঁচে উঠব। হয়তো দু’দিন পরেই ভুলে যাবে। আবার ওর বাবা যা বলবে, করবে। পীড়নের মধ্যে মজা আছে না ঝুমু? ছোটরা আকৃষ্ট হয়। তুমি কি ছোটবেলায় প্রজাপতির পাখনা ছিঁড়ে দিতে? পিঁপড়ে ছেড়ে দিতে গলন্ত মোমে? আমি দিতাম!’
রিবনবাঁধা লালপরি ছুট্টে এল ঘরে। ‘লালআন্টি।’
‘আরে! বুবুল! কেমন আছ তুমি?’
‘আমি তোমাকে ঠিক চিনতে পেরেছি।’
‘আমিও তো তোমাকে চিনলাম।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ আন্টি।’
‘এই কাকিমাকে চেনো?’
‘কে?’
‘দীপকাকার বউ।’
‘মা তো দীপকাকার বউ।’
‘আচ্ছা চলো, তোমাকে ঠাকুর দেখিয়ে আনি।’
ত্রস্ত পায়ে ঘরে এল মালিনী। ‘বুবুল বুবুল বুবুল! তুমি এখানে কী করছ। চলো। চলো আমার সঙ্গে।’
‘কেমন আছ মালিনীদি?’
মালিনী তাকাল শাশ্বতীর দিকে। জবাব দিল না। বুবুলের হাত ধরে বলল, ‘এ প্রশ্ন করার কি কোনও অর্থ হয়?’
ঝুমু-র দিকে তাকাল না মালিনী। দ্রুত পায়ে চলে গেল বুবুলকে নিয়ে। বুবুল চ্যাঁচাচ্ছে— আমি বউ কথা বলব। বউ কথা বলব।’
শাশ্বতী আঁচলে মুখ মুছল। চকচকে নকল রেশমের শাড়ি পরেছে। হাতিবাগানের ফুটপাথ থেকে কেনা নকল সোনার দুল, নকল চামড়ার ব্যাগ। ক্ষয় লাগা সৌন্দর্য এবং অপরিশীলিত জগতের প্রতিনিধি মনে হচ্ছে তাকে। এখানে সে বেমানান। এখানে সবাই তসরে, রেশমে, গরদ ও বেনারসিতে সেজে আছে। গায়ে গয়না। সত্যিকারের সোনার। ঝুমু-রও গায়ে গয়না ঝলোমলো। কেউ কেউ পরে আছে লাল বুটি জামদানি ঢাকাই। কেউ দক্ষিণ ভারতীয় লম্বা পল্লু দেওয়া অপূর্ব কাতান। পুরুষের গরদ বা ফিনফিনে তসর পাঞ্জাবি, পাজামা, সোনার বোতাম। গলদেশে সোনার কণ্ঠহার।
তবু শাশ্বতী এসেছে। হাতে চাকা চাকা দাগ। পোড়া ছ্যাঁকা মিলায় না কোনও দিন। তার ভারী মায়া হল। সে ডাকল। লাল!
‘এটা পরো তো।’
‘একি! না না! ঝুমুর! না!’
বেশ পুরু ও ভারী কাঁকন খুলে দিল ঝুমু। ‘পরো। আমি দিচ্ছি।’
‘না গো। না। যদি হারিয়ে যায়!’
‘হারাবে কেন? দেখো তো, কী সুন্দর লাগছে হাতটা।’
হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়ল ঝুমু। দাঁড়িয়ে পড়েছে। শাশ্বতীর কাঁকন পরা হাত চেপে ধরেছে আবেগে। তার করতলে স্বেদ। মুখে আনন্দচ্ছটা!
‘ওই দেখো টোপর। ওই যে।’
শাশ্বতী ঝুমুরকে দেখছে! কোথা থেকে আসে এই আলো? সে কি বোঝে না তা? নারীই নারীকে বোঝে। ভালবাসে যে মেয়েটা। অসম্ভব ভালবাসে ওই শতরূপ প্রতিবন্ধী ছেলেটাকে। বহুদর্শী অভিজ্ঞ পোড় খাওয়া শাশ্বতী, বুঝে গেল। সংস্কার সংসার গুরুজনের দাবি— সব মিলে এক অপূর্ব প্রেমের হত্যালীলা সম্পাদন করছে!
সে বলল, ‘চলো। কাছে চলো।’
‘না লাল।’
‘কেন?’
‘না।’
‘বাঃ! আমি দেখব না কাছ থেকে?’
‘তুমি যাও। তুমি কাছে গেলেই ও চিনবে। ঝিরিও আছে।’
‘চলে যাচ্ছে। নামল না গাড়ি থেকে! তুমি যেন কী ঝুমুর।’
‘কী আবার।’
‘টোপর তো দেখল না তোমাকে।’
‘থাক।’
দিদিইইই! ঝরঝর হেসে ঘরে এল ঝিরি। পেছনে জ্যোতির্ময়।
ঝুমুর ও শাশ্বতী ও জীবন স্থপতি
ঝিরির সময় নেই। এই যজ্ঞযাগে তার আগ্রহও নেই। সৌজন্যসাক্ষাতে এসেছিল, চলে গেল। একবার একান্তে বলে গেল, ‘টোপরের কিছু একটা হয়েছে।’
‘কী?’
‘তুই জানিস না?’
‘কী, বলবি তো!’
‘হি ইজ় ইন লাভ! দিদি! কী বোকা আমি! ওই লাল শাড়ি থেকেই আমার বোঝা উচিত ছিল।’
‘চুপ কর।’
‘চুপ করব? হোয়াট ডু ইউ মিন দিদি? তুই অন্যায় করেছিস। মানছি টোপর হ্যান্ডিক্যাপড। কিন্তু তোকে পাগলের মতো ভালবাসে।’
‘চুপ, ঝিরি।’
‘তুই সত্যি বোকা রে দিদি। আর ভীষণ রক্ষণশীল! তুইও শেষ অব্দি গর্ভপাত মেনে নিবি। তুইও অসৎ ও প্রবঞ্চক হয়ে যাবি দিদি। তুই-ও শেষ অব্দি ছেলের জন্য ঢিল বাঁধবি বটগাছে। তোর শ্বশুরবাড়ির উপযুক্ত তুই! দিদি, আমাকে অন্তত এটা বোঝাস না প্লিজ়, যে, টোপরের মন তুই বুঝিসনি! তুই সব বুঝে ঘাপটি মেরে ছিলি। অন্তত আমাকে বলতে পারতি একবার দিদি!
সারা শরীর প্রকম্পিত। ঝুমু বোনের তিরস্কারের কাছে স্বেদাপ্লুত, নতমুখী। হে ঈশ্বর! এ সে কোথায় পৌঁছল!
তার ভারী ইচ্ছে করল একবার জিজ্ঞেস করে, কী করে জানতে পারল, বুঝতে পারল ঝিরি। কিন্তু মরমে লজ্জায় মিশে গেল একেবারে। টোপর বলবে না। বলতেই পারে না। সত্যিই কি প্রেমের আলো ফোটে? দুই প্রবল ঐশিক ঈহা মিলিত হলে প্রলয়ঙ্কর সংঘর্ষ ও বিষ্ফোরণ হয়? তার চোখ ধাঁধানো আলো, তার শব্দ, তার নিঃসৃত শক্তিই জগতে ঘোষণা করে প্রেম! প্রেম এল! এল প্রেম অই!
আঃ! কী কষ্ট ঝুমু-র! টোপর! ও টোপর! কত দূর থেকে দেখা! তুই ভাল থাক সোনা!
যজ্ঞের গন্ধ আসছে। ঝুমু-র ডাক পড়বে কখন? তার খিদেবোধ চলে গেছে। অল্প অল্প গা গুলোচ্ছে। এবার সে ছেলে চাইবে। চাইলেই হবে? পেটে যদি কন্যাভ্রূণ থাকে, সে ছেলে হয়ে যাবে? কত শত ভুল বিশ্বাস! কত প্রবঞ্চনা! ঐশী শক্তির নামে, ধর্মের নামে, পুণ্যের নামে কী মিথ্যাচার, কী পাপ!
শাশ্বতীর হাত ধরে কল্যাণী এসে দাঁড়ালেন। চাপা স্বরে বললেন, ‘এই বালা তুমি ওকে দিয়েছ ঝুমুর?’
‘হ্যাঁ। আমিই পরালাম তো।’
‘দেবে না। এসব অলক্ষ্মীপনা আর যেন না দেখি! বাড়ির বউ গা থেকে গয়না খুলে দিচ্ছ! লাল খুলে দে। আর শোনো, চারটেয় ডাক পড়বে। কিছু খেয়ে ফেল না যেন।’
ঝুমু স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। কাঁকনখানি খুলে দিল শাশ্বতী। ঝুমু পরতে পারল না। ব্যাগে রেখে দিল। শাশ্বতী বলল, ‘মা ভাবল, আমি বুঝি নিয়ে নেব গয়নাটা। ভেবেছে, আমি চেয়েছি। মা’র দোষ নেই।’
ঝুমু তার হাত ধরে বসে রইল। বুবুলকে মারতে মারতে নিয়ে যাচ্ছে মালিনী। চিৎকার করে কাঁদছে লালপরি।
‘ওভাবে মারছে কেন? মেয়েটাকে মারছে কেন?’
‘চেনো না ওকে?’
‘হ্যাঁ। মালিনী।’
‘আর কিছু জানো?’
‘না’
‘একদিন জানবেই। আমিই বলি। দাদার এক ঘনিষ্ঠ সহকর্মীর স্ত্রী ও। শুভ-দা। খুব প্রাণবন্ত ছিল। বাইক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল। মালিনীদি চাকরি পেল শুভদা-র আপিসে। মানে দাদার ওখানে। সবাই জানে ওদের সম্পর্কে। দাদা কিন্তু বিয়ে করল না ওকে।’
‘কেন?’
শোক, তাপ, ঈর্ষা, উত্তেজনা কিছুই বোধ করছে না ঝুমু। এতটুকু ভালবাসেনি যাকে, তার জন্য কীসের অধিকারবোধ?
‘বিধবা বলে।’
‘বিধবাকে ভালবাসা যায়, বিয়ে করা যায় না?’
‘আমি ঠিক এটাই বলেছিলাম। ও বলল, সমস্ত জীবন শুভদা-র ছায়া ওকে বইতে হবে। কুচোটা আছে না? বুবুল?’
‘আহা!’
‘মা’রও মত ছিল না। বলেছিল— আমার সংসার কি গোয়ালঘর? গাইবাছুর এনে তুলতে হবে! দাদা বলেছিল বিয়েই করবে না। শেষ পর্যন্ত মায়ের জোরাজুরিতে…! বংশরক্ষা তো চাই! আমার ভুটকুন তো অন্য বংশ।’
‘ছুটির দিনেও যে তোমার দাদা সারাদিনের জন্য চলে যায়, সে কি মালিনীর কাছে?’
‘হ্যাঁ। ওটা ওর দ্বিতীয় বাড়ি। ঝুমুর, সত্যিটা দাদারই তোমাকে জানানো উচিত ছিল। বিয়ের আগেই। হয়তো আমারও তোমাকে জানানো উচিত ছিল। কিন্তু ভাবলাম, পাত্রীপক্ষ সব সময়ই পাত্র বিষয়ে খোঁজখবর করে। এটা তাদের দায়িত্ব। আমি অগ্রবর্তী হয়ে জানালে মা আমাকে আস্ত রাখবে না। আমার অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছ।’
‘কিন্তু মালিনী মেনে নিল কেন?’
‘কী করবে? দাদার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ও। শোনো ঝুমুর, এখনও, বয়স্থা আইবুড়ি, বিধবা, বিবাহবিচ্ছিন্না সমাজে অপাংক্তেয়। বালাই বিশেষ। আমাদের পুরুষরা বিদ্যাসাগরকে আজও ছুঁতে পারল না। তারা মেয়েদের এখনও হাটবাজারের ক্রয়বিক্রয়যোগ্য সামগ্রী ছাড়া কিছু ভাবে না।’
‘সবাই একরকম নয় লাল।’
‘বেশির ভাগ।’
‘তাই মালিনী আমার দিকে ফিরেও তাকাল না!’
‘ওর কী দোষ বলো! ও তো ভাবছে তুমি ওর নিরাপত্তা কেড়ে নিচ্ছ। একটা সাধারণ অসহায় মেয়ে। ওর তো ঈর্ষা হবেই।’
‘কিন্তু ও তো চাকরি করে বলছ। এত নির্ভরশীলতা কীসের জন্য?’
‘অভ্যাস ঝুমুর! নির্ভরতা একরকম অভ্যাস! সেই মেছুনির গল্পটা মনে নেই? ফুলের গন্ধে যার ঘুম আসেনি!’
ঝুমুর ঝুমুর
বাড়ি ফিরে চার বার বমি করল ঝুমু। গর্ভবতী। তার ওপর সারা দিন উপোস। যজ্ঞের আগুনের পাশে বসে ছিল দু’ঘণ্টা। গর্ভে যদি মেয়ে থাকে, মাতাজির মন্ত্রশক্তিতে ভ্রূণের পুরুষ রূপান্তর ঘটছে। আর যদি না হয়?
যদি না হয়?
বারাণসীতে একবার যজ্ঞ হয়েছে। তারপর এই মহাযজ্ঞে লাল নামের ভিখারিণী উৎপাত বিদূরণ মন্ত্র পড়া হল, কন্যাভ্রূণ রূপান্তরিত হল পুত্রে, পুত্রং রক্ষতে নরকগমনং। মহাশক্তি! সূর্যের মতো তেজ! মিহিরের মতো উজ্জ্বল। ঊষাপতির মতো সত্য! সত্য?
শিরদাঁড়া বেয়ে এক হিমস্রোত নেমে এল। হয় যুদ্ধ নয় মৃত্যু। ঝুমু কী করবে?
অতি ভোরে ঝমঝমিয়ে বেজে উঠল ফোন। উপরতলায় নীচতলায়। বাঁটুল চিৎকার করে উঠ। ঘ্রাউ ঘ্রাউ গ র র র! সে এখন শাশ্বতীর ঘরে শোয়।
ক’টা বাজে? এসময় কার ফোন?
বিছানার অন্য প্রান্তে ঘুমোচ্ছে সন্দীপন। সে ডাকল। ‘ফোন বাজছে।’
‘বাজুক।’
‘এ সময়ে ফোন। নিশ্চয়ই দরকারি।’
‘আমি উঠতে পারব না।’
‘কে ফোন করছে? সেলফোনে কেন করল না?’
ফোন থেমে গেল। সারা বাড়িই কি জানে, ঝুমু আছে, ধরবে!
শ্লথ পায়ে হেঁটে এল বাঁটুল। তাকাচ্ছে ঝুমুর দিকে। হঠাৎ ঝুমুর মনে পড়ে গেল, আর একদিন, তার গর্ভস্থ ভ্রূণের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যাবে। কী করবে সে। তার তলপেটে যন্ত্রণা হতে লাগল। হয় যুদ্ধ নয় মৃত্যু। সে মেনে নেবে? সে কি বশ্যতা স্বীকার করবে? বাঁটুলকে তার নিজের চেয়ে অনেক বেশি সফল ও স্বাধীন মনে হয়। এ পৃথিবীতে সাধারণ মেয়েরা আজও কেবল দাসী। চুক্তি পত্র দাসখত লিখে দেয় অন্ন কুড়োবে বলে। বাঁটুল কিন্তু খুশিমতো বাচ্চা দিতে পারে!
আবার বেজে উঠল ফোন। বাজছে। বেজে যাচ্ছে।
‘হ্যালো।’
উত্তেজিত হল্লাবোল স্বর ও প্রান্তে উৎকণ্ঠা সমেত।
‘হ্যালো! বউদির বাড়ির লোক বলছেন? হ্যালো।’
‘কে বউদি?’
‘ওই যে, কাল্টুদার বউ। এটা গড়িয়া তো?’
‘হ্যাঁ। কাল্টুর বউ? মানে লাল?’
‘লাল-নীল জানি না। শোনেন, সতী বউদি সতী বউদি। ভুটকুনের মা। আমরা পাড়ার ছেলে। সতী বউদি গায়ে আগুন দিয়েছিল। হাসপাতালে আসুন।’
‘গায়ে আগুন! কী বলছেন! কোন হাসপাতাল?’
‘আর জি করে। অবস্থা ভাল না।’
‘আপনি কে বলছেন? একটা নম্বর দিন। কাল্টু কোথায়?’
‘আপনি মেয়েছেলে মানুষ, একটা বেটাছেলে ডাকেন না। পুলিশ কেস-ফেস মিলে হেভি হুজ্জোতি হচ্ছে।’
ঝুমু-র গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। সে চিৎকার করছে। দীপ শুনছ, দীপ শোনো, দীপ ওঠো ওঠো…
শাশ্বতী ও ঝুমু ও বধির মোহর
একেবারে ভেঙে পড়েছে ঝুমু। অথচ এ বাড়িতে শোক নির্লিপ্ত, নির্বিকার। সে ক্রমাগত বলছে, ‘এটা আত্মহত্যা হতে পারে না। এটা খুন। ও কত খুশি ছিল। কত কথা বলল সেদিন।’
‘এটাই ওর পরিণতি।’
‘আপনারা ডায়রি করছেন না কেন? থানায় অভিযোগ করছেন না কেন? সারা পাড়া বলছে।’
‘সারা পাড়া? তুমি গিয়েছ বাগবাজারের পাড়ায়?’
জ্বলতে জ্বলতে রাস্তা দিয়ে ছুটে যাচ্ছিল লাল। শুধু শায়া আর ব্লাউজ়। শাড়ি কি জ্বলে গিয়েছিল, নাকি খুলে ফেলেছিল? লাল আগুনের ভিতর থেকে লাল নামের মেয়ে আর্তনাদ করতে করতে ধপ করে পড়ে গেল রাস্তার ওপর। লোকে টের পেয়ে কাঁথা বস্তা কম্বল চাপা দিচ্ছিল যখন, অতি ব্যস্ত পায়ে কাল্টু ছুটে আসে। সে ঘুমোচ্ছিল। টের পায়নি কিছুই। জ্বলন্ত মৃত্যুও অবলীলাক্রমে অদর্শন করা যায়।
‘আত্মহত্যাই করবে যদি, লিখে গেল না কেন?’
‘দেখো ঝুমু, আমরা এটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি চাই না।’
‘একটা মেয়ে জলজ্যান্ত মরে গেল, তার কোনও গুরুত্ব নেই? একটা মেয়ের জীবনের কোনও দাম নেই?’
‘যে যাবার সে গিয়েছে। ওকে নিয়ে আমরাও জ্বলেপুড়ে মরছি। আর অশান্তি ভাল লাগে না। তুমিও এ বিষয়ে যত কম মাথা ঘামাবে তত ভাল।’
‘ও তো নতুন করে বাঁচতে চেয়েছিল। সে চাওয়ার কোনও মূল্য নেই?’
‘তোমার ক্লিনিকে যাওয়া পিছিয়ে যাচ্ছে। কাল নিয়ে যাব।’
‘লাল টোপরকে দেখতে চেয়েছিল। সেদিন দূর থেকে দেখে কত খুশি! কত সুখী ছিল! আপনি ওকে গয়নাটাও পরতে দেননি।’
ঝুমু অস্থির! তিক্ত! সন্দিগ্ধ! এবং বেভুল!
দুপুরে, সন্দীপন বাড়িতে নেই। কল্যাণী ঘুমিয়ে আছেন। ঝুমু তার স্ত্রীধন অলঙ্কারগুলি নিল, টোপরের দেওয়া লাল ঢাকাইখানি জড়িয়ে নিল গায়ে। একটুকু দাঁড়াল আয়নার কাছে। সে দেখল। এক অনন্য ‘আমি’ সে। এই বীভৎস জীবন স্বচক্ষে দেখার ভিতর, সে আর শাশ্বতী একই আগুনে পুড়েছে। সে পুনরুজ্জীবিত কারণ তার টোপর তার পূর্ণ জীবনশক্তি। একদিন এই বেশে রুপুকাকি টোপরকে ছেড়ে গিয়েছিলেন, সে যাবে গ্রহণ করতে। চিরকালের মতো। ঝিরিকে বার্তা পাঠাল— কোথায় তুই?
‘পার্ক স্ট্রিটে। কেন?’
‘আমি বেরোচ্ছি।’
‘মানে? কোথায়?’
‘আমার জায়গায়। টোপর।’
‘দ্যাটস গ্রেট। সন্ধ্যায় দেখা হবে।’
‘আমি দ্বিধাহীন! তবে ঝড় উঠবে।’
‘just do whatever you said. বেঁচে যাবি দিদি।’
ঝুমু শাশ্বতীর ঘরে গেল। টেবিলে অল্প বয়সের ছবি। দুই বিনুনী। ঘাড় কাত করা। হাসছে। তুলে নিল ছবি। বাঁটুল দেখছে। ঝুমু বলল— চলি রে! তোর সব ক’টা ছানা মেয়ে হোক।
সে বেরিয়ে পড়ল।
‘টোপর, আমি এসেছি।’
‘এসো।’
‘আর যাব না।’
‘কোনও দিন যেয়ো না ঝুমু।’
‘ঝিরি আছে আমাদের দলে।’
‘বাবা আছে। বিবস্বান আছে। পলাশ আছে। জ্যোতিকাকাকেও টেনে নেব।’
‘এতজন পেয়ে গেলাম। হয় যুদ্ধ নয় মৃত্যু।’
‘মরব কেন? ঝুমু? এই তো শুরু হল আকাঙ্ক্ষিত জীবন। তুমি এসে গেছ। আর আমি কাউকে ভয় পাই না।’
ঝুমু টোপরের পায়ের কাছে বসল। টোপর বলল, ‘ওখানে নয় ঝুমু। তোমার কোলে মাথা রাখতে দাও। হাত বুলিয়ে দাও চুলে। আঃ! ঝুমু, আমি জানতাম তুমি আসবে। কোনও দিন। হয়তো আরও পঁচিশ বছর পর! না এসে পারবে না তুমি।’
‘অমানুষের জগৎ যদি না দেখতাম, আসতে পারতাম না রে।’
‘তুমি আমাকে ছেড়ে থাকতেই পারো না।’
‘তুই ঠিক জানিস টোপর? ধর, খুব ভালবাসা যদি পেতাম ওখানে? আসতে কি পারতাম? আমি অসহায় বলেই কি তোর কাছে এলাম?’
‘তোমাকে আর কেউ কী করে ভালবাসবে? তুমি তো আমার!’
‘আর যাব না। আর যাব না তোকে ছেড়ে।’
‘যেতে দিলে তো!’
ঝুমু মুখ নামিয়ে আনল। তার মনে আর কোনও বাধা নেই। দ্বিধা নেই। পিছুটান নেই। একজন তার শরীরে বাড়ছে। সে কার সন্তান? সে তার হৃদয়ছেঁড়া। একজন কোলে শুয়ে আছে। সেই তো হৃদয়। সেই তো প্রেমের সংজ্ঞা। বয়ঃক্রম বিচার করে না। জাত, কুল, ধর্ম মানে না। মানে নাকো সমাজশাসন। শুধু ভালবাসে। ঝুমু সর্বস্ব সমর্পণে টোপরের মুখ সাপটে নিল। ঠোঁট কী নরম, কী মধুর গন্ধ ওর শ্বাসবায়ু ভরা, কী প্রেম! ওঃ! কী আশ্চর্য প্রেম! একটা সাধারণ মেয়ে এত ভালবাসা পেলে অসাধারণ হয়ে উঠবে না?