৫. ঝিমুনি ছাড়াই জেগে উঠার ৫টি ধাপ
একটু ভেবে দেখুন, ভোরে ঘড়ির (কিংবা ফোনের) সুজ বাটন চাপার কোন অর্থই হয় না। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম বলা যে, “আমি এত ভোরে ঘুম থেকে উঠা অপছন্দ করি- একবার সুজ বাটন চাপি… এবং আবার… এবং বারবার”
—ডেমিট্রিয়াস মার্টিন
সকালটা আমি আর একটু বেশি পছন্দ করতাম যদি আর একটু দেরিতে শুরু হতো।
—অজানা
.
প্রথমে স্বীকারোক্তি, ঘুম থেকে বিনা দ্বিধায় জেগে উঠার যে পদ্ধতি এখন আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করব তা না থাকলে, সত্যি কথা- আমি এখনও ঘুমতাম …কিংবা ঝিমাতাম। এবং আরও বেশি যা ক্ষতিকারক তা হচ্ছে, আমি এখনও পুরনো, অলস মানসিকতায় আটকে থাকতাম … “ভোরে উঠা আমার কর্ম না!”
বলা হয়ে থাকে যে, ভোরে ঘুম থেকে উঠতে কেউ পছন্দ করেন না। কিন্তু এই সময় ওঠার যে সজীব অনুভূতি সেটা সবাই পেতে চান। শরীরচর্চার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই রকম- শরীরচর্চা শুরু করার পর যে পরিবর্তন আসবে তা সম্পর্কে আমরা সবাই ওয়াকিবহাল; সবাই সেই অনুভূতি পেতে চাই। কিন্তু খুব কম মানুষই শরীরচর্চা শুরু করি। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠা, বিশেষ করে নির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে- সবসময়ই আপনার ভেতর শক্তির একটা নির্দিষ্ট ধরনের বিচ্ছুরণ ঘটায়।
ভোরে জাগার অনুপ্রেরণা বাড়ান
আমাদের বেশির ভাগের ক্ষেত্রে সকালে অ্যালার্ম বাজার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ঘুমের গভীরতম পর্যায় থেকে একধাপ এগিয়ে আসি জাগরণের দিকে। তখনও আমরা নিদ্রাচ্ছন্ন, ধরুন আধা নিদ্রাচ্ছন্ন। এখন এই আধা নিদ্রাচ্ছন্ন অবস্থা থেকে সম্পূর্ণ সচেতন হয়ে ওঠার তাড়নাকে মাপব; ১০-এর স্কেলে। যদি ১০ হয়- আমরা সম্পূর্ণভাবে তৈরি বিছানা ছাড়ার জন্যে; যদি ১ হয়- আমরা আবার পূর্ণ নিদ্রায় ফিরে যেতে চাই। অনুশীলন শুরু করার আগে মোটামুটি সবাই এই স্কেলের ১ অথবা ২ পয়েন্টে থাকুন। এটা স্বাভাবিক, সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। আমাদের অবচেতন মন (নির্দিষ্ট তাড়না ছাড়া) অবশ্যই আধা থেকে পূর্ণ নিদ্রায় ফিরে যেতে চাইবে।
ভোরে জেগে উঠা ও অসাধারণ একটি দিনের জন্যে এই যে নির্দিষ্ট তাড়না কিংবা অনুপ্রেরণার কথা বলা হচ্ছে, যা আমাদের এক কিংবা দুই পয়েন্ট থেকে নয় কিংবা দশ পয়েন্টে নিয়ে যাবে, তা কীভাবে অর্জন করা সম্ভব? উত্তর খুব সহজ। ভোরে জেগে উঠার জন্যে আমরা ধীরে ধীরে, নীচে আলোচনা করা ধাপগুলো একেকবারে একেকটি অনুসরণ করব।
প্রথম ধাপ : বিছানায় যাবার আগেই সিদ্ধান্ত নিন
মনে রাখবেন— পূর্ণ নিদ্রা থেকে সচেতনতা আসার পর প্রথম যে চিন্তাটা আসে তা হচ্ছে ঘুমোতে যাওয়ার আগে যে চিন্তাটা আমাদের মনে ছিল। উদাহরণ দিই, ছোটবেলায়, ঈদ কিংবা পূজার আগের রাতে আমরা খুব উত্তেজিত থাকতাম। বিছানায় গিয়ে পরিকল্পনা করতে করতে ঘুম তাম- সকালে উঠে কী কী করতে হবে। সেই সময়ের ভোরের কথা মনে করুন। অ্যালার্ম বাজার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সম্পূর্ণ সচেতনতায় চলে আসতাম। বিছানা ছাড়তাম এবং রাতের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেমে যেতাম ক্লান্তি কিংবা দ্বিধা অনুভব করা ছাড়াই। খুব খুশি মনে উৎসাহের সঙ্গে দিনটিকে আলিঙ্গন করতাম।
অন্যদিকে রাতে বিছানায় যাওয়ার আগে যদি আপনার শেষ চিন্তাটা এরকম হয় যে, “ছয়টায় ঘুম থেকে উঠতে হবে? সারাদিনের কাজ শেষে এত ক্লান্ত আমি! এত রাত হয়ে গেল বিছানায় আসতে- তারপরও!” এরপর সকালে অ্যালার্ম বাজার পর কী মনে হতে পারে? ব্যাপারটা কম-বেশি সবার ক্ষেত্রেই একই- “এর মধ্যে ছয়টা বেজে গেছে? এখনও ক্লান্ত আমি। আর দশ মিনিট ঘুমালে এমন কিছু ক্ষতি হবে না।” এবং সুজ বাটন; এবং একই গল্প!
নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন। মূল লক্ষ্যটা হচ্ছে- ঘুমোতে যাওয়ার আগেই ঘুম থেকে উঠার জন্যে মনকে ইতিবাচক অনুপ্রেরণা দিয়ে রাখতে হবে। এই ব্যাপারে সাহায্য পেতে আপনি www . tmm book . com-এ যেতে পারেন। এখানে ঘুমানোর আগে সুনির্দিষ্ট কিছু কথা ও ভাবনার খোরাক দেওয়া আছে, যা আপনাকে কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য পূরণে সাহায্য করবে।
ধাপ-২: ঘড়ি কিংবা ফোন বিছানা থেকে যতখানি সম্ভব দূরে সরিয়ে রাখুন
যদি এখনও ঘড়ি বিছানা থেকে দূরে না সরিয়ে থাকেন, এখনই সরান। অ্যালার্ম বাজার পর সেটা বন্ধ করার জন্যে হলেও আপনাকে বিছানা থেকে উঠতে হবে, হেঁটে ঘড়ির কাছে যেতে হবে। এই গতি আপনার শরীরে শক্তির প্রবাহ বাড়াবে; প্রবাহিত শক্তি তন্দ্রা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করবে।
বিছানার পাশে কিংবা বিছানাতেই যদি ঘড়ি কিংবা ফোনটা থাকে, আমরা সবাই জানি, কী ঘটে। উঠার ইচ্ছা না থাকলে আমরা অ্যালার্ম স্থায়ীভাবে বন্ধ করি; সুজ বাটন চাপি; কানে বালিশ চেপে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ি। এমনকি আমাদের অবচেতন মন অনেক সময় অ্যালার্ম বাজার ব্যাপারটাকে স্বপ্ন হিসেবে উপস্থাপনও করে।
আপনাকে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে অ্যালার্ম বন্ধ করতে হবে এই ব্যাপারটা আপনাকে ঘুম থেকে জেগে উঠার স্কেলে ১ পয়েন্ট থেকে ২ কিংবা ৩-এ পৌঁছে দেবে।
ধাপ-৩ : দাঁত মাজুন
বিছানা ছেড়ে হেঁটে এসে অ্যালার্ম বন্ধ করলেন। এখন আপনাকে বিছানা আবার ডাকবে। কিন্তু আপনি সেই ডাক না শুনে সোজা ওয়াশ রুমে যাবেন। সিংকের সামনে দাঁড়ান; আয়নায় নিজেকে দেখুন; মুখে ঠাণ্ডা পানির ঝাপটা দিন; আবার নিজেকে দেখুন। পরিবর্তন লক্ষ্য করে উৎফুল্ল হোন। ব্রাশে পেস্ট লাগান- দাঁত মাজুন। এই পুরো ব্যাপারটা আপনাকে স্কেলের পরবর্তী ধাপে তুলে দেবে। এখন যেহেতু আপনার মুখ দুর্গন্ধ ও জীবাণুযুক্ত, এখন সময় …
ধাপ-৪ : পুরো এক গ্লাস পানি খান
আমরা যদি কিছু স্বাভাবিক মানুষের ঘুমের সময় পর্যবেক্ষণ করি, দেখা যাবে তিনি বা তারা মোটামুটি ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমিয়েছেন। এই ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা আমরা শরীরে কোনো জ্বলানি (খাবার, পানি) সরবরাহ করি না বরং সঞ্চিত শক্তি খরচ করি শরীরের প্রয়োজনীয় তাপের চাহিদা মেটাতে। সুতরাং খুব স্বাভাবিক ভাবেই আপনার শরীরে খাদ্যের বিশেষ করে পানির চাহিদা থাকবে। সকালের অসীম তন্দ্রাচ্ছন্নতা শুধুমাত্র বিশ্রামের অভাবের কারণেই হয় না বরং শরীরে পানির চাহিদা অনেকাংশে দায়ী। সুতরাং আমরা এখন পূর্ণ এক গ্লাস পানি ধীরে সুস্থে পান করব।
আপনারা সবাই জানেন, আমাদের শরীরে পানির চাহিদা খুব বেশি। তাই দিনের অন্যান্য অংশেও ঝিমুনি, হাই তোলা ও অবসাদ-এসব সমস্যাও আপনি এক গ্লাস পানি খেয়ে তাৎক্ষনিকভাবে মিটিয়ে ফেলতে পারেন। যাই হোক,দাঁত মাজার পর এক গ্লাস পানি খাওয়ার মূল লক্ষ্য হচ্ছে ঘুমের সময় শরীরে সৃষ্টি হওয়া পানি শূন্যতা দূর করা। এক গ্লাস পানি গ্রহণের পর আপনি সম্ভবত এখন পয়েন্ট স্কেলের ৫-এ আছেন।
ধাপ ৫ : কাপড় পরুন অথবা গোসল করুন
এই ধাপে দুইটা বিষয় আছে। আপনি ইচ্ছেমতো ক্রম নির্ধারণ করতে পারেন।
৫.১ : শরীরচর্চার জন্যে নির্ধারিত পোশাক পরুন এবং সরাসরি Miracle Morning অনুশীলনে ঢুকে পড়ুন।
৫.২ : গোসল করে ফেলুন।
আমি ব্যক্তিগতভাবে আগে অনুশীলন করতে পছন্দ করি। কারণ শরীরচর্চার পরে অনেক সময় গোসল করাটা আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। আবার অনেকে আগে গোসল করে নিতে চান। তাদের যুক্তি হচ্ছে- এভাবে খুব সহজে, দ্রুত তন্দ্ৰামুক্ত হওয়া যায়, যা আপনাকে অনুশীলনের সময় অন্য কোনো ধরনের মানসিক পিছুটানে ফেলবে না।
আপনি যা-ই আগে করুন না কেন, আপনি এখন মোটামুটি স্কেলের ৫ কিংবা ৬ পয়েন্টে আছেন। এখন আপনার জন্যে ক্লান্তি এড়িয়ে সজীব হয়ে Miracle Morning অনুশীলনে আর খুব একটা বেগ পেতে হবে না। এখন ভাবুন, এই ধাপগুলো বাদ দিয়ে, অ্যালার্ম বাজার পরই (যখন আপনি পয়েন্ট স্কেলের ১-এ) আপনি যদি অনুশীলন করার চেষ্টা করতেন কী প্রচণ্ড মানসিক দ্বন্দ্বে ভুগতেন!
ঝিমুনি ছাড়াই জেগে উঠার ৫টি ধাপ আর একবার, সংক্ষেপে :
১. ঘুমোতে যাওয়ার আগেই উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট করে নিন। এটা সবথেকে জরুরী ধাপ। মনে রাখবেন, সকালের প্রথম চিন্তাটা আসে রাতের শেষ চিন্তার পথ বেয়ে। সুতরাং জেগে উঠার জন্যে প্রয়োজনীয় মানসিক অনুপ্রেরণার ব্যবস্থা রাতেই সেরে ফেলুন।
২. অ্যালার্ম দেওয়ার উপকরণ (ঘড়ি, ফোন কিংবা অন্যান্য ডিভাইস) বিছানা থেকে দূরে রাখুন। কতদূরে রাখবেন? এত দূরে যেন অ্যালার্মের আওয়াজ আপনাকে নিদ্রার গভীরতা থেকে ধাক্কা দিতে পারে এবং আপনাকে বিছানা থেকে হেঁটে গিয়ে অ্যালার্ম বন্ধ করতে হয়।
৩. দাঁত মাজুন। প্রয়োজনে মেন্থল ফ্লেভারড কিংবা এরকম কোন মাউথওয়াস ব্যবহার করুন।
৪. এক গ্লাস পানি খান। শরীরকে কখনোই পানির অভাব বুঝতে দেওয়া উচিত না। সুতরাং … তাড়াতাড়ি।
৫. পোশাক পাল্টান কিংবা গোসল করুন।
Miracle Morning প্যাকেজের তরফ থেকে বোনাস
মনে রাখা দরকার, এই ৫টি ধাপ খুবই কার্যকরী, কিন্তু এগুলোই শেষ নয়। Miracle Morning অনুশীলনকারীদের জন্যে এখানে আরো কিছু টিপস দেওয়া হলো—
ক) ঘুমানোর আগের আত্মকথন : যদি এখনো প্রস্তুত না করে থাকেন, www.tmmbook.com থেকে ঘুরে আসুন। এখানে আগে থেকেই প্রস্তুত করে রাখা, পরীক্ষিত কিছু আত্মকথনের নমুনা দেওয়া আছে। আশা করি আপনি উপকৃত হবেন।
খ) বেডরুমের লাইট অ্যালার্মের সঙ্গে সিংক্রোনাইয করুন: প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা অনেক অত্যাশ্চর্য উদ্ভাবনের অভিজ্ঞতার সংস্পর্শে আসছি। স্বয়ংক্রিয় আলোক ব্যবস্থাও এখন বেশ সুলভে পাওয়া সম্ভব। এটা অতি আশ্চর্য ও কার্যকরী একটা ব্যবস্থা, সন্দেহ নেই। আপনার এলার্মের সঙ্গে সঙ্গে যদি ঘরের বাতিগুলোও জ্বলে ওঠে, অবশ্যই তা বিছানা ছাড়ার বাড়তি তাগিদ হিসেবে কাজ করবে। আঁধার ঘরে ফের ঘুমিয়ে পড়াটা যত সহজ, আলোকোজ্জ্বল ঘরে সেটা এত সহজ না। যদি অটোমেটেড লাইটের ব্যবস্থা না করা যায়- বিছানা ছেড়ে অবশ্যই আলো জ্বালাবেন।
গ) ওয়েক আপ কল : অভিজাত হোটেলগুলোতে এই সার্ভিস পাওয়া যায়। যেখানে আপনার চাহিদামতো সময়ে হোটেল কর্মচারী আপনাকে ফোন করে ঘুম থেকে তুলে দেবেন। এই সুবিধা সবজায়গায় পাওয়া সম্ভব না হলেও অনেক বিকল্প ব্যবস্থা আছে। অ্যান্ড্রয়েড কিংবা আইফোনের এ্যাপ স্টোরে এই ধরনের অনেক অ্যাপ পাবেন। এছাড়াও আপনি www.mywakeupcalls.net-এর সেবা গ্রহণ করতে পারেন।
উপরে উল্লেখিত কৌশলগুলো ছাড়াও আপনার চাহিদা ও সুবিধামত কৌশল আপনি ব্যবহার করতে পারেন। যদি সেই সব কৌশলের কয়েকটা আমার সঙ্গে শেয়ার করতে চান তাহলে www. Miracle morningblog . com কিংবা www. My tmm community . com-এ শেয়ার করতে পারেন। আমি খুবই উৎসাহী আপনার কথা শোনার জন্যে।
আমাদের মূল লক্ষ্য পূর্বনির্ধারিত উদ্দেশ্য পূরণে দ্বিধাহীন মনে, সহজে, স্বাভাবিকভাবে Miracle Morning অনুশীলন শুরু করা। এই উদ্দেশ্য পূরণে প্রয়োজনীয় সব কৌশল গ্রহণের স্বাধীনতা আপনার আছে। তবে আসুন শুরু করি ঘুমাতে যাওয়ার আত্মকথন পড়ার মধ্য দিয়ে। এরপর ঘড়ি বিছানা থেকে দূরে সরিয়ে রাখুন, বিছানার পাশে এক গ্লাস পানি রেখে ঘুমুতে যান।