৫. জুতোর শব্দ

জুতোর শব্দে চোখ খুলে ভরত দেখল মিসেস মুখার্জি বেরিয়ে এসেছেন। অদ্ভুত হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, কেউ এসেছিল বুঝি?

হ্যাঁ। আমাদের কলেজে পড়ে।

মেয়েটি দেখতে বেশ। তোমার গার্লফ্রেন্ড?

ভরত ভদ্রমহিলাকে দেখল। তারপর নিঃশব্দে মাথা নেড়ে না বলল।

মহিলা হাসলেন, আমিও তাই ভাবছিলাম। এতদিন তোমাকে দেখছি, কখনও কোনও মেয়ের সঙ্গে মিশতে দেখিনি। কে যেন বলছিল নিচের তলার রবীনবাবু নাকি তোমাকে পাকড়ে নিয়ে গেছেন মেয়ের টিচার করে, আমার তো বিশ্বাস হয় না। যাগ গে এসব কথা, তোমার শরীর কেমন আছে বল!

ভালই।

ওঃ যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। অভিজ্ঞতা হল খুব, তাই না?

কীসের অভিজ্ঞতা?

ড্রাগ খাওয়ার। আচ্ছা, খাওয়ামাত্রই নেশা হয়ে গিয়েছিল?

 ওটা বলে বোঝানো যাবে না। আপনি খেয়ে দেখুন।

খুব ইচ্ছে করে জানো! আমি একটু ডানপিটে আছি বলেই ইচ্ছেটা হয়। কিন্তু ভয় লাগে, যদি নেশা হয়ে যায়। ড্রাগখোরদের চেহারা কি বিচ্ছিরি হয়।

ভরত আর দাঁড়াল না। ভদ্রমহিলা ওইভাবে অনন্তকাল কথা বলে যেতে পারেন কিন্তু তার আর দাঁড়াতে ভাল লাগছে না। কিছুটা অভদ্রের মতই সে ভেতরে চলে এসে দরজা বন্ধ করল। সুদেষ্ণা এসেছিল এই খবরটা ফ্ল্যাটে ঢোকার আগেই মা জেনে যাবে। অবশ্য তাতে মা কিছু। মনে করবে বলে মনে হয় না। করলেই বা কী করা যাবে। সুদেষ্ণা এসেছিল বন্ধুর মতো খোঁজ নিতে। একা আসতে স্বচ্ছন্দ হতে পারেনি বলে সঙ্গী নিয়ে এসেছে। হয়তো ওই সঙ্গী নিয়ে আসার কারণে মা-ও স্বচ্ছন্দ বোধ করবে।

ভরত আবার কলেজে যাওয়া শুরু করল। বাড়ি থেকে কলেজে ঢোকা এবং লাইব্রেরি ফেরত বাড়ি যাওয়া ছাড়া আর কোনও কিছুতেই তার আগ্রহ নেই। বেঁচে থাকলে হলে তোমাকে ঝামেলা এড়াতে হবে। দেশপ্রেম, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ইত্যাদি বইপত্রে ছড়ানো থাকা কথাবার্তা সঙ্গে জীবনের কোনও মিল নেই এই সত্য তাকেও মেনে নিতে হবে। তার টিউশনিগুলো এখন হাতছাড়া হয়ে গেছে। এতকাল বিনা নোটিসে মাস্টারমশাই-এর উধাও হয়ে যাওয়া কোনও অভিভাবক মেনে নিতে পারেনি। আবার নতুন করে ছাত্র পড়ানোর কাজ জোটাতে না পারা পর্যন্ত মায়ের কাছেই হাত পাততে হবে। শেষপর্যন্ত সে নিজের সঙ্গে লড়াই করে সিদ্ধান্তে এল, হাত পাতা নয়, যতদিন চাকরি না পাবে ততদিন তাকে খরচ দেওয়া মা-বাবার পবিত্র কর্তব্য। সে পৃথিবীতে এসেছে ওদের ইচ্ছেয়, বড় হচ্ছে ওদের পরিকল্পনামাফিক। হ্যাঁ, স্কুল ছাড়ার পর পড়াশুনার ধারা হয়তো সে নিজে নির্বাচন করেছে কিন্তু কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়টায় তাকে সাহায্য করার দায়িত্ব মা-বাবার। আদর্শ নামক একটি সোনার পাথরবাটির স্বপ্ন দেখে যারা তাদের মেরুদণ্ড ধীরে ধীরে বেঁকে গোল হয়ে যায়। চিড়িয়াখানা এবং মিউজিয়মের মধ্যে প্রাণবন্ত অবশ্যই প্রথমটি। আদর্শ এখন মিউজিয়ামে চমৎকার মানানসই।

কলেজে ঢুকছিল ভরত। গেটের কাছে ছেলেমেয়ে বেশি নেই। একটা বোগা মেয়ে হলুদ শাড়ি পরে সামনে হাঁটছিল। ওর হাতে দুটো খাতা। ভরত ওকে ভাল করে লক্ষ্যই করেনি কারণ তার প্রয়োজন ছিল না। হঠাৎ তার মনে হল মেয়েটা পড়ে যাচ্ছে। যেতে যেতে দাঁড়িয়ে গিয়ে টলতে শুরু করেছে। ব্যাপারটা মাথায় ঢুকতেই ভরত এগিয়ে গেল দ্রুত। কিন্তু ততক্ষণে মেয়েটা ঢলে পড়েছে মাটিতে। খাতাদুটো ছিটকে গেল একপাশে। যারা দূরে ছিল তারা চিৎকার করে ছুটে এল। ভরত আগে পৌঁছেছিল। মেয়েটার চোখ বন্ধ, মুখ একেবারের সাদা। কপালজুড়ে ঘাম। ডাকাডাকিতেও ওর চোখ খুলল না।

এখনই একজন ডাক্তার ডাকা উচিত। অথবা হাসপাতালে। যে ভরত ইদানিং কোনও ঝামেলায় যাবে না বলে ঠিক করেছিল সে-ই নিজের অজান্তে উদ্যোগ নিল। কলেজে পৌঁছে দেওয়া এক ছাত্রীর গাড়িতে মেয়েটিকে তুলে আর একটি ছাত্রকে সঙ্গে নিয়ে ছুটল মেডিক্যাল কলেজে। হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে তখন খুব ভিড়। মেয়েটিকে মাটিতে শুইয়ে রেখে একজন ডাক্তার পরীক্ষা করলেন। করে বললেন, মনে হচ্ছে উইন্ড থেকে হতে পারে। শরীরে রক্তও নেই। পরীক্ষা না করে কিছু বলা যাবে না। প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে একটা ইনজেকশন দিলেন ডাক্তার।

চারধারে চিৎকার চেঁচামেচি। বারান্দার গা ঘেঁষাঘেষি খাটে নিস্তেজ রুগিরা শুয়ে আছে। এইসময় মেয়েটা চোখ খুলল। ভরত তাকে জিজ্ঞাসা করল, এখন কেমন লাগছে? আমি একই কলেজে পড়ি।

মেয়েটা আবার চোখ বন্ধ করল, আমি কোথায়?

 হাসপাতালে। মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলে।

মেয়েটা চারপাশ তাকিয়ে দেখল। তারপর ভরত আপত্তি করা সত্ত্বেও উঠে বসল, আমি বাড়ি যাব। প্লিজ।

এই অবস্থায় তুমি কী করে যাবে? ডাক্তার বলেছে তোমার পরীক্ষা হবে।

আমি এখন ভাল হয়ে গেছি। আমি বাড়িতে যাব।

সঙ্গী ছাত্রটি বলল, ও যদি পারে তাহলে বাড়িতে ফিরে যাক। এখানে যা অবস্থা তাতে একটুও ভরসা পাওয়া যাচ্ছে না।

কিন্তু যেতে হলে ডাক্তারে অনুমতি তো লাগবে।

কিস্যু দরকার নেই। ওর নাম এখনও এখানকার খাতায় ওঠেনি। আমাকে যেতে বলেছিল ওসব করতে। এই, তুমি উঠে দাঁড়াতে পারবে? ছেলেটি জিজ্ঞাসা করল।

মেয়েটা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

ভরত জিজ্ঞাসা করল, কোথায় থাক তুমি?

বাগবাজার।

মেয়েটা যে অসুস্থ তাতে কোনও সন্দেহ নেই। চিকিৎসা না করিয়ে ওকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ায় আপত্তি ছিল ভরতের। কিন্তু এর মধ্যে সে জানতে পেরেছে কেবিন বা পেয়িং বেডে জায়গা পাওয়া নাকি এখনই সম্ভব নয়। যদি সোর্স অথবা টাকার ব্যবস্থা করা যায় তাহলে ব্যবস্থা হতে পারে। মানুষের প্রয়োজন নিয়ে কিছু মানুষ ব্যবস্থা করবেই এদেশে এবং সেটা মেনে নিতে হবে। ওই দুটোর কোনোটারই যখন ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না তখন ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। এভাবে বারান্দায় ফেলে রেখে যাওয়া যায় না।

সঙ্গী ছেলেটি বেরিয়ে গেল ট্যাক্সি ডাকতে। মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে ট্যাক্সি খোঁজার চেয়ে সেইটেই ভাল। মেয়েটা উঠে বসেছিল। ওর শরীর মাঝেমাঝে কেঁপে উঠছে। মুখ একদম সাদা। ভরত আবার জিজ্ঞাসা করল, তুমি যেতে পারবে?

মাথা নাড়ল মেয়েটি। কিন্তু ওর কষ্ট হচ্ছে বোঝা গেল।

তোমার নাম কী?

শ্রাবণী।

তুমি আমার হাত ধরে উঠে দাঁড়াও দেখি পার কিনা! ভরত হাত বাড়াল।

শ্রাবণী চেষ্টা করল, সে যখন সোজা হল তখনও তার শরীর কাঁপছে। ভরত চারপাশে তাকিয়ে হাসপাতাল কর্মচারীদের কাউকে দেখতে পেল না। এভাবে নিয়ে যাওয়া অন্যায় কিন্তু সে কী করতে পারে!

ট্যাক্সিতে বসে একপাশে মাথা এলিয়ে দিল শ্রাবণী। ভরত তার পাশে বসেছে, সঙ্গী ছেলেটি সামনে। হ্যারিসন রোডের মোড় এসে ছেলেটি বলল, আমার একটা জরুরি কাজ আছে, তুমি তো ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে যাচ্ছ, আমি আর গিয়ে কী করব!

ভরত শ্রাবণীর দিকে তাকাল। সে মাথা হেলিয়ে দিয়ে একপাশে নেতিয়ে পড়ে আছে। ট্যাক্সি থামিয়ে ছেলেটা নেমে যাওয়ার পর ভরতের খেয়াল হল ওর পকেটে মাত্র পনেরটা টাকা রয়েছে। যদি এর থেকে বেশি ভাড়া মিটারে ওঠে তাহলে সে কি করবে? শ্রাবণীর উচিত ট্যাক্সির ভাড়া মেটানো কিন্তু ওর যা অবস্থা তাতে একটুও ভরসা পাওয়া যাচ্ছে না। ভরত ঠিক করল বেশি ভাড়া উঠলে শ্রাবণীর বাড়ির লোকেদের বলবে ভাড়া মিটিয়ে দিতে। সে যে পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছে এই ঢের।

গিরিশমঞ্চের উল্টোদিকে ট্যাক্সিটা দাঁড়াতে বলল শ্রাবণী। নিস্তেজ গলায় জানাল এই গলিতে ঢুকতে হবে। গলি এত সরু যে ট্যাক্সিওয়ালা রাজি হচ্ছিল না। শ্রাবণীর অসুস্থতার কথা বলতে লোকটা বাধ্য হলো। এর মধ্যে মিটার দেখে হিসেব করে নিয়েছে ভরত চোদ্দটাকা পঁচাত্তর দিতে হবে। আর এক ধাপ উঠে গেলে তার পকেটে পয়সা নেই। অতএব ওর বাড়ির সামনে গাড়িটাকে নিয়ে যেতে হবে।

একটি পুরনো বাড়ির সামনে পৌঁছে হাত তুলল শ্রাবণী। একজন টাক মাথা ভদ্রলোক সেই বাড়ির রকে লুঙ্গি পরে খালি গায়ে বসে কাগজ পড়ছিলেন। গলিতে ট্যাক্সি ঢুকছে দেখে কাগজ সরিয়েছেন মুখ থেকে। ভরত দরজা খুলে ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে বলল, শ্রাবণী খুব অসুস্থ। ওকে ধরে ধরে নামাতে হবে।

কী হয়েছে? ভদ্রলোকের চোখ ছোট হয়ে গেল।

 মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল। জ্ঞান ছিল না।

বাড়ির ভেতরে গিয়ে বলুন।

ভরত দেখল শ্রাবণী শরীরটাকে কোনমতে নিচে নামিয়ে আনছে। মাটিতে পা দিয়ে মেয়েটা গাড়িটাকে আঁকড়ে ধরল। ওর হাঁটার ক্ষমতা নেই। বাধ্য হয়ে ভরত এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরল। শ্রাবণী বিড়বিড় করে বলল, আমি যেতে পারব।

.

কথাগুলো যে নিছকই সঙ্কোচের কারণে বলা সেটা বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়, ভরত ওকে ধরে ধরে ভেতরে নিয়ে চলল। দরজা খোলাই ছিল। হঠাৎই একটা চাপা আর্তনাদ শোনা গেল। ভরত দেখল একজন মহিলা ছুটে আসছেন। পরনে আটপৌরে শাড়ি। রোগা মহিলা দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন শ্রাবণীকে, কী হয়েছে? কী হয়েছে তোর?

শ্রাবণী যেন তার শরীরের শেষ শক্তিটুকু এতক্ষণ আঁকড়ে ছিল, মহিলা জড়িয়ে ধরা মাত্র সেটুকুও চলে গেল। শরীর এলিয়ে পড়ল তার। মহিলা কোনওমতে ওকে টানতে টানতে ভেতরে ঢুকে গেলেন। ভরত কী করবে বুঝতে পারছিল না। এঁদের সঙ্গে ভেতরে যাওয়া কি শোভনীয় হবে? ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়ে আছে। ভাড়া না মিটিয়ে দিলে মিটার বাড়বে। সে চটপট বাইরে এসে দেখল মিটার আর এক ধাপ উঠেছে। মুখ ফিরিয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকাল। উনি এখন কাগজ পড়ছেন। নিশ্চয়ই এ বাড়ির কেউ নয়। অগত্যা পকেট থেকে পনের টাকা বের করল ভরত। ট্যাক্সিওয়ালা সেটা নিয়ে বলল, আরও আট আনা দিন। ভরত সত্যি কথা বলল, আট আনা নেই।

লোকটা কিছু না বলে ট্যাক্সিটা ঘোরাবার চেষ্টা শুরু করল।

ভরত ভেবে পাচ্ছিল না সে কী করবে। তার পকেটে এখন একটাও পয়সা নেই। বাড়ি যেতে হলে হেঁটে যেতে হবে। সেটা খুব সহজ ব্যাপার নয়। সে সোজা টাকামাথা ভদ্রলোকের সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি শ্রাবণীর কোন আত্মীয়?

কেন?

দরকার ছিল।

সোজা ভেতরে গিয়ে বাঁ দিকে উঠে যান। ওই অংশটা ওদের।

লোকটাকে খচ্চর বললে সেই প্রাণীটিকে অপমান করা হবে বলে মনে হল ভরতের। কিন্তু সে হেঁটে বাড়িতে ফিরতে পারবে না। ভেতরে ঢুকল সে। বাঁ এবং ডান দু দিক দিয়ে সিঁড়ি ওপরে ওপরে উঠে গেছে। বাঁ দিকটা ধরল সে। পুরনো বাড়ি, অনেককাল সংস্কার করা হয়নি কেমন স্যাঁতসেঁতে গন্ধ চাপ হয়ে বেরুচ্ছে।

ওপরে উঠতেই সেই মহিলার গলা শুনতে পেল, আমি কী করব! আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। তুই একটু শুয়ে থাক আমি অবনীডাওারকে ডেকে আনি।

ভরত দরজায় দাঁড়িয়ে দেখল শ্রাবণী বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে আর মহিলা তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কথা বলছেন। চোখ তুলে তাকে দেখতে পেয়ে মহিলা দ্রুত চলে এলেন সামনে, আপনি–তুমি, তুমি ওকে নিয়ে এসেছ?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

কে তুমি?

আমরা একই কলেজে পড়ি। কলেজে ঢোকার সময় ও পড়ে যায় হঠাৎই। জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ওকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু সেখানে ও কিছুতেই থাকতে চাইল না। বাধ্য হয়ে ট্যাক্সি করে ওকে এখানে নিয়ে এসেছি। ভরত ইচ্ছে করে ট্যাক্সি শব্দটা একটু জোর দিয়ে উচ্চারণ করল যাতে ভদ্রমহিলার খেয়াল হয় ভাড়াটা তার দিয়ে দেওয়া উচিত।

তোমাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দেব বাবা! এত কষ্ট করে ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেলে। তুমি একটু বসো, আমি ডাক্তারবাবুকে ডেকে নিয়ে আসছি।

আপনি কেন যাবেন? আমাকে বলুন, ডাক্তারের চেম্বার কোথায়, আমি যাচ্ছি।

না। তোমাকে উনি চেনেন না। তুমি গেলে এখনই আসতে চাইবে না। আমি আসছি। ভদ্রমহিলা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেন।

ভরত অসহায় বোধ করল। এই বাড়িতে আর কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না। বিছানায় মড়ার মত শুয়ে আছে শ্রাবণী। মেয়েটা যে খুবই অসুস্থ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ওর বাবা দাদা অথবা কোনো পুরুষমানুষ কি এবাড়িতে নেই? এইসময় অস্ফুট শব্দ করল শ্রাবণী। চোখ বন্ধ করেই বলল, জল।

এইসময় জল দেওয়া উচিত কিনা তা জানে না ভরত। আবার কেউ জল খেতে চাইলে না দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কি সম্ভব? সে টেবিলের ওপর জলের জাগ আর গ্লাস দেখতে পেল। গ্লাসে খানিকটা জলঢেলে সে বিছানার পাশে গিয়ে বলল, জল এনেছি, মুখ তুলে খেতে পারবে?

মাথাটা সামান্য তোলার চেষ্টা করেও পারল না শ্রাবণী। চোখ না খুলেই মাথা নেড়ে না বলল। ভরত সামান্য ঝুঁকে বলল, হাঁ করো।

ধীরে ধীরে মুখ খুলল শ্রাবণী। কিন্তু ওপর থেকে গ্লাস নামিয়ে মুখে জল ঢালা সহজ ব্যাপার নয়। চলকে বাইরে পড়তে পারে, বেশি পড়ে গেলে শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়াও অসম্ভব নয়। অতএব লক্ষ্য ঠিক রাখতে এক হাতে শ্রাবণীর মুখ ধরতে হলো। সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত শীতল একটা স্পর্শ পেল ভরত। পেয়ে শরীর শিরশির করে উঠল। গ্লাস থেকে সামান্য জল মুখে ঢালামাত্র শ্রাবণী সেটা বেশ কষ্ট করে গিয়ে ফেলল। গ্লাস সরিয়ে নিয়ে ভরত জিজ্ঞাসা করল, শরীর কেমন লাগছে?

শ্রাবণী কথা না বলে মাথা নেড়ে জানাল ভাল নয়।

চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল ভরত। শ্রাবণী তার থেকে সামান্য ছোট হতে পারে। এই বয়সে সে নিজে কদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে নার্সিংহোম থৈকে ফিরে এসেছে। তার নিজেরও কোনো হুঁশ ছিল না সেসময়। নিজের অজান্তেই সে ওই পরিস্থিতিটাকে ডেকে এনেছিল। কিন্তু শ্রাবণীর মতো মেয়ে কেন অসুস্থ হবে। এই মেয়েটা বোগা, ফ্যাকাশে। কিন্তু ওর চোখ দুটো আশ্চর্য সুন্দর, চিবুকটা বড় মায়াময়ী, শ্রাবণী মোটেই সুন্দরী বলা যাবে না। যৌবনে পৌঁছানোর পরও প্রকৃতি বড় কৃপণ থেকেছে তার বেলায়। অধিকাংশ বাঙালি মেয়ের সঙ্গে শ্রাবণীর কোনও পার্থক্য নেই। তবু, এখন এই শায়িত শ্রাবণীকে দেখে তার মনে কি রকম মায়ার জন্ম হলো।

সিঁড়িতে কথা শোনা যাচ্ছিল। ভরত দরজার দিকে একটু এগোল। শ্রাবণীর মা প্রায় ছুটতে ছুটতে ফিরছেন ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে। ডাক্তার ঘরে ঢুকে শ্রাবণীর পাশে চলে গেলেন, কী ব্যাপার? আবার কী হলো? শ্রাবণী জবাব দিল না। ডাক্তার ভরতের দিকে তাকালেন, অতএব ভরতকে বলতে হল। শুনতে শুনতে ডাক্তার পালস দেখে প্রেসার মাপার যন্ত্র চালু করেছেন। ওঁকে খুব গম্ভীর দেখাচ্ছিল। বললেন, হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসা অন্যায় হয়েছে।

ভরত বলল, ও থাকতে চাইছিল না। তাছাড়া ওখানে চিকিৎসা হচ্ছিল না।

কিন্তু ওকে এখনই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। রক্ত দেওয়া দরকার। এই মেয়ে বেশ অ্যানিমিক। হিমোগ্লোবিন কমতে কমতে এখন কোথায় গিয়েছে কে জানে। আপনাকে আমি বলেছিলাম ডক্টর দত্তের কাছে ওকে নিয়ে যেতে, গিয়েছিলেন?

ও যেতে চায়নি। বলেছিল এখন ভাল আছে।

ননসেন্স। এখনই অ্যাসেমব্লি অফ গড চার্চ হসপিটালে নিয়ে যান। পার্ক স্ট্রিট-পার্কসার্কাস মোড়ে হসপিটালটা। ওখানে গিয়ে ডক্টর দত্তের সঙ্গে দেখা করুন। আমি ওঁকে ফোন করে দিচ্ছি।

ডাক্তারবাবুকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসে শ্রাবণীর মা বললেন, এখন কী করি!

উনি যা বললেন তাই করুন। ভরত বলল।

আমি বাবা একা মানুষ। রাস্তাঘাট তেমন চিনিও না। আমার হাত-পা কেমন করছে!

অগত্যা ভরতকে উদ্যোগী হতে হলো। ট্যাক্সি ডেকে আনার পর শ্রাবণীকে নামাতে তাকেই হাত লাগাতে হলো। সে বুঝতে পারছিল এই বাড়িটা এখন শরিকে ভর্তি এবং কেউ কারও সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসে না। ট্যাক্সি ছাড়ার আগে সে পরিষ্কার জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি টাকাপয়সা সঙ্গে নিয়েছেন? হাসপাতালে নিশ্চয়ই দরকার হবে।

শ্রাবণীর মা মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ বাবা।

মেয়ের মাথা কোলে নিয়ে ভদ্রমহিলা পেছনের আসনে বসেছিলেন। ড্রাইভারের পাশে বসে ভরত চমকে উঠল। শ্রাবণীর নাকের ফুটো দিয়ে কাঁচা রক্ত চুঁইয়ে আসছে। ভদ্রমহিলাকে কথাটা বলতে তিনি চাপা আর্তনাদ করে আঁচল চেপে ধরলেন মেয়ের নাকে। ভরত শ্রাবণীর অসুখ বুঝতে পারছিল না। ডাক্তার বলে গেলেন ও অ্যানিমিক। তাহলে শরীর থেকে রক্ত বেরোবে কেন?

.

অ্যাসেমব্লি অফ গড চার্চ হসপিট্যালে পৌঁছে জানা গেল আউটডোরের সময় শেষ হয়ে গিয়েছে। ইমার্জেন্সি কেস ছাড়া এখন ভর্তি হচ্ছে না। ডক্টর দত্ত ভোরবেলায় এসে বেলা পর্যন্ত পেশেন্ট দেখে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। শ্রাবণীকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল একটা বেঞ্চিতে। ভরতের মনে হল হসপিট্যালটা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কিন্তু শ্রাবণীকে তো আবার ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। হঠাৎ একজন কর্মী সামনে এসে চিৎকার করলেন, ডক্টর দত্তর সঙ্গে দেখা করতে কেউ কি এসেছেন? ভরত চমকে উঠল। তারপর দ্রুত কাছে গেল, তাঁ, আমরা এসেছি।

কর্মীটা বলল, ডাক্তারবাবু দোতলায় আছেন। পেশেন্টকে নিয়ে যান।

উনি তো বাড়ি চলে গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ। আবার ফিরে এসেছেন। জলদি যান।

ছোট্ট ঘরটিতে যে ভদ্রলোক বসেছিলেন তার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। ফর্সা ছোটোখাটো চেহারা, সাদা চুল, হাসলেন, তুমি অসুস্থ? এখানে ওকে শুইয়ে দিন। হ্যাঁ।

শ্রাবণীকে প্রশ্নটা করেই উঠে দাঁড়িয়েছিলো ডাক্তার। শ্রাবণীর মা মেয়েকে শুইয়ে দিতেই পরীক্ষা আরম্ভ করলেন। তারপর ফিরে চেয়ারে গিয়ে টেলিফোনটা তুললেন, চটপট চলে এসো। একটি মেয়ের রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। কুইক।

রিসিভার নামিয়ে রেখে শ্রাবণীর মাকে জিজ্ঞাসা করলো, যা যা হয়েছে সব বলুন।

শ্রাবণীর মা বলতে লাগলেন মেয়ে রক্তাল্পতায় ভুগছে। অ্যানিমিক। ডাক্তারের ওষুধ ঠিকঠাক খেয়ে যাচ্ছে। আজ হঠাৎ কলেজে পড়ে যায়। ওর বন্ধুরা ওকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে থাকতে চায়নি শ্রাবণী। ফলে ওকে বাড়িতে আনতে হয়েছে। নাক দিয়ে রক্ত পড়েছে। ডক্টর দত্ত বললেন, আগের রক্তপরীক্ষা করার রিপোর্টটা দেখি।

শ্রাবণীর মা যে ব্যাগে করে সেই কাগজপত্র এনেছেন তা জানত না ভরত। দেখে ডাক্তারের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। বললেন, অনেক আগেই আমাদের কাছে এলে ভাল করতেন।

এইসময় অ্যাপ্রন পরা একজন ঢুকতেই ডাক্তার ইশারায় শ্রাবণীকে দেখিয়ে দিলেন। ভরত দেখল সূচ ফুটিয়ে টানা মাত্রা প্লাস্টিকের সিরিঞ্জের অনেকটা লাল হয়ে গেল। শ্রাবণী কোনও শব্দ করল না। ডাক্তার বললেন, রিপোর্ট পরে দিও। এখন শুধু হিমোগ্লোবিনটা কত বলে দাও। আমি অপেক্ষা করছি।

বলে যাওয়ার আগে লোকটি জিজ্ঞাসা করল, স্যার, আপনি বাড়ি চলে গিয়েছিলেন না?

হ্যাঁ। কেন?

আবার ফিরে এলেন এসময়ে?

বাড়িতে বসে টিভি দেখার চেয়ে এই মেয়েটির পাশে থাকা অনেক জরুরি, যাও।

লোকটি মাথা নেড়ে চলে যাওয়ামাত্র আর একজন উঁকি মারল। ডক্টর দত্ত গলা চড়ালেন, কী চাই? এটা তো আমার পেশেন্ট দেখার সময় নয়!

না ডাক্তারবাবু। ট্রেন বন্ধ বলে খুব দেরি হয়ে গিয়েছিল আসতে। আমি শুধু জানতে এসেছিলাম ছেলেকে কি আপনার কাছে আনব?

কোথায় যেন থাকা হয়?

রাণাঘাট।

 ও। শ্রীমান শ্ৰীমন্ত সওদাগর। কেমন আছে সে?

ভাল। স্কুলে যাচ্ছে।

ওষুধ?

ঠিকঠাক খাচ্ছে। আটমাস হয়ে গেল।

মাইগড! আমি আপনাকে বলেছিলাম ঠিক চারমাস পরে নিয়ে আসতে। আপনি ওর বাবা না ক্রিমিনাল? ছেলেকে খুন করতে চান? কালই নিয়ে আসবেন নইলে আর কোনদিন আসতে হবে না। গেট আউট।

লোকটি মাথা নেড়ে চলে যেতেই টেলিফোন বাজল। ডক্টর দত্ত সাড়া দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন কত? উত্তরটা শুনে বললেন, ডিটেলস্ রেডি করো। রিসিভার নামিয়ে জোরে নিঃশ্বাস নিলেন চোখ বন্ধ করে, ও কোথায় পড়ে?

প্রেসিডেন্সিতে।

ডক্টর দত্ত চেয়ার ছেড়ে উঠে শ্রাবণীর মাথায় হাত রাখলেন, ওর বাবা?

চারবছর হল চলে গেছেন?

 আপনাদের সোর্স অফ ইনকাম?

কিছু রেখে গিয়েছিলেন। তারই সুদে চলে যাচ্ছে।

কত?

কত মানে? শ্রাবণীর মায়ের মুখ শক্ত হল।

ভুল বুঝবেন না। কত সুদ পান? দুই তিন হাজার নাকি বিশ পঁচিশ?

উনি তো বেশি রেখে যেতে পারেননি। চার হাজার টাকার মতো পাই। আমি সঙ্গে টাকা এনেছি। কী লাগবে বলুন!

মাইগড! ডাক্তার চলে এলেন টেবিলে। তারপর ভরতের দিকে তাকালেন, তুমি কে?

 ভরত বলল, আমি প্রেসিডেন্সিতে পড়ি।

ওর বন্ধু?

না। আজ ও পড়ে যেতে ওর সঙ্গে আসি।

বাঃ গুড। শুনুন মা, আপনি একটা দরখাস্ত লিখুন। তাতে বলবেন আপনার মাসিক আয় হাজার টাকার বেশি নয়। যদি হাসপাতাল থেকে আপনার মেয়ের চিকিৎসার জন্যে সাহায্য করা হয় তাহলে আপনি বাধিত হবেন। তুমি ওঁর হয়ে এখনই লিখে দাও।

সাহায্য নিতে হবে কেন? শ্রাবণীর মা প্রতিবাদ করলেন।

যদি আপনার মাসিক আয় অনেক হত তাহলে সাহায্য নিতে বলতাম না। কয়েক বছর আগে। আমি একটু শিশুকে বাঁচাবার চেষ্টা করি। অনেক করেও শেষ পর্যন্ত তাকে রাখতে পারিনি। তার বাবা বিরাট ব্যবসায়ী। ছেলে মারা যাওয়ার পর তিনি একদিন এখানে এসে এক কোটি টাকার চেক দিয়ে বললেন, তার ছেলের রোগে যেসব ছেলেমেয়ে আক্রান্ত হবে তাদের চিকিৎসা যেন ওই টাকায় হয়। আমরা একটা কমিটি করেছি। যে সব বাবা-মায়ের রোজগার কম তাদের সন্তানের চিকিৎসা ওই টাকায় করা হয়ে থাকে। যা সন্দেহ হচ্ছে তা যদি ঠিক হয় তাহলে আপনার মাসিক আয়ের টাকায় এই মেয়ের চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। একটা ইঞ্জেকশনের দামই হয় তো হাজার টাকা। দরখাস্ত লিখে আমাকে দিন। আমি রেকমেন্ড করে দিচ্ছি। আপনার ওটা নিয়ে সুপারের কাছে যান। তিনি অর্ডার করে দিলে বাকি ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ততক্ষণে ওকে বেডে ভর্তি করে দিচ্ছি। হাত বাড়িয়ে একটা সাদা কাগজ আর কলম তুলে ভরতের দিকে এগিয়ে দিলেন ডক্টর দত্ত। তারপর উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

ভরত হতভম্ব হয়ে বসেছিল। এরকম ঘটনা এখনও কলকাতায় ঘটে? তার চোখের সামনে মেডিকেল কলেজের বারান্দাটা ভেসে উঠল। কলকাতার বেশির ভাগ মানুষ যখন নিজের স্বার্থের বাইরে যেতে রাজি নয় তখন ডক্টর দত্তকে তার দেবদূত বলে ভাবতে ইচ্ছে করল। শ্রাবণীর মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে দরখাস্ত লেখা শেষ হবার আগেই দুজন লোক স্ট্রেচারে শুইয়ে শ্রাবণীকে নিয়ে গেল।

শ্রাবণীর মা পেছন পেছন যাচ্ছিলেন কিন্তু ভরত তাকে নিষেধ করল, এখন যাবেন না।

 কিন্তু—

 ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলা আগে দরকার।

কিন্তু ওর কী হয়েছে তা এখনও বলেননি।

এইসময় ডক্টর দত্ত ঢুকলেন। ভরত তার সামনে দরখাস্তটা রাখতেই তিনি চোখ বুলিয়ে হাসলেন, গুড। চমৎকার লিখেছ। নিজে দরখাস্তের একপাশে খসখস করে কয়েক লাইন লিখে বললেন, মা, আপনি একা সুপারের কাছে যান। এটা ওঁকে দেখান। ওখান থেকে পাশের অফিসে গিয়ে মেয়ের নামে কার্ড করিয়ে ভর্তির কাগজপত্র ঠিক করে নিন।

শ্রাবণীর মা জিজ্ঞাসা করল, ওর অসুখটা কী ধরনের?

ডক্টর দত্ত মাথা নাড়লেন, আপাতত ধরে নিন রক্ত কম। তা থেকে অনেক কিছু হতে পারে, সমস্ত রিপোর্ট আগে পাই তারপর আপনাকে বলব। আপনি আর দেরি করবেন না।

ভরত শ্রাবণীর মায়ের সঙ্গে এগোতে যাচ্ছিল কিন্তু তাকে হাত নেড়ে চেয়ারে বসতে বললেন ডক্টর দত্ত। শ্রাবণীর মা বেরিয়ে গেলে তিনি বললেন, ইয়ং ম্যান, তোমার সাহায্য যে এখন খুব দরকার।

কী করতে হবে বলুন?

রক্ত চাই। ফ্রেশ ব্লাড। মেয়েটির ব্লাডগ্রুপের সঙ্গে যাদের মিলবে তাদের বিকেলের মধ্যে এখানে জড়ো করো। ওকে আজই রক্ত দিতে হবে।

ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে আনলে হবে না?

নো। ব্লাড ব্যাঙ্কের রক্ত তাদেরই ব্যবহার করা উচিত যাদের ফ্রেশ ব্লাড পাওয়ার কোন সোর্স নেই। তুমি কলেজে পড়। সেখানে প্রচুর ছেলেমেয়েকে একসঙ্গে পাবে। তোমার পক্ষে তাদের এখানে এনে জড়ো করা সহজ। তিনি টেলিফোন তুলে নম্বর ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলেন, শ্রাবণীর ব্লাডগ্রুপ কী?

উত্তরটা শুনে রিসিভার নামিয়ে রেখে বললেন, ভগবানকে ধন্যবাদ যে সহজ গ্রুপের রক্ত ওর শরীরে। তুমি ও গ্রুপের ছেলেদের জোগাড় কর। যারা নিজের গ্রপ জানে না তাদেরও নিয়ে। এসো। সামান্য রক্ত দিলে তাদের শরীরের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না। কিন্তু অনেক বিপন্ন মানুষ বেঁচে যাবে। যাও।

ডাক্তারবাবু, শ্রাবণীর ঠিক কী হয়েছে?

আমি তো একটু আগে বললাম সমস্ত রিপোর্ট না দেখে বলা যাবে না। তবে আমার অভিজ্ঞতা বলে ওর লিউকোমিয়া হবার টেন্ডেন্সি আছে।

লিউকোমিয়া? তার মানে ব্লাড ক্যান্সার?

 রাবিশ। ব্লাড ক্যান্সার! তার মানেই পেশেন্ট বাঁচবে না? এসব বোকা বোকা কথা শিক্ষিত ছেলের বলা উচিত নয়। আর লিউকোমিয়া হলেই ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ওই রোগটার দুটো ধরন আছে। একটা হলে আমাদের কিছু করার নেই। কিন্তু দ্বিতীয় ধরনের লিউকোমিয়া হলে আমরা লড়াই করতে পারি। আমি অন্তত আটজন পেশেন্টের নাম বলতে পারি যারা গত বারো বছর ধরে ঠিক বেঁচে আছে। কাজ কর্ম করছে কিন্তু তাদের নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়, আমার কাছে আসতে হয়। সুতরাং ছোকরা, কোনওরকম আপসেট হবে না। বন্ধুদের নিয়ে এসো, আমি চারটের সময় এখানে থাকব। বাই। ডক্টর দত্ত উঠে দাঁড়ালেন।

ভরত না বলে পারল না, আমার ভাবনা-চিন্তা পাল্টে যাচ্ছে।

কী কারণ? ডক্টর দত্ত দাঁড়িয়ে গেলেন পা বাড়িয়েই।

এখন আপনার মত মানুষ এই শহরে বেঁচে আছেন আমি ভাবতে পারিনি!

মাইগড! আমাকে দেখে কি অ্যাবনর্মাল বলে মনে হচ্ছে?

সত্যি বলতে হলে বলব ঠিক তাই। যেখানে কেউ কারো জন্যে ভাবে না, স্বার্থপরতা ছাড়া কোনো বোধ মানুষের নেই সেখানে আপনি পেশেন্টদের জন্যে এত ভাবছেন, এটা নর্মাল নয়।

তুমি ভুলে যাচ্ছে, আমি আমার কর্তব্যটুকুই করছি।

কেউ যেখানে সেটা করে না সেখানে আপনি করলে অ্যাবনর্মাল হবে। এই অসময়ে হাসপাতালে ফিরে এলেন, ওকে ফর্মালিটিস ছাড়াই ভর্তি করে নিলেন, ওর ব্লাড পরীক্ষা করানো জন্যে একদিন অপেক্ষা করলেন না এবং তার ওপর চিকিৎসার খরচের সুরাহা করে দিলেন কোনও সুপারিশ না থাকা সত্ত্বেও যেখানে মানুষ নিজের জমি বিক্রি করতে কর্পোরশনকে ঘুষ দিতে বাধ্য হয়।

তুমি উত্তেজিত হয়ে পড়েছ। আমি আবার বলছি যা করা উচিত তার বেশি কিছুই করছি না। যাদের তুমি দেখেছ তাদের বাইরেও মানুষ আছেন। মাদার টেরেসার কথা ছেড়ে দাও, ভারত সেবাশ্রমের কর্মীদের কথা ভাবো, পাড়ায় পাড়ায় এমন অনেক ছেলেকে পাবে যারা নিঃস্বার্থে কাজ করে যায়। এই যে তুমি, শ্রাবণীর আত্মীয় বা বন্ধু নও, তুমি কোন্ স্বার্থে এতক্ষণ এখানে আছ? কেন তুমি কলেজের ছেলেদের জোগাড় করে আনবে রক্তের জন্যে? চলো। তোমাকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে যাই।

নিচে নেমে শ্রাবণীর মায়ের কাছে জানা গেল হসপিটালের সুপার কিছু প্রশ্ন করেছিলেন। সত্যি সত্যি তার আয় হাজারের নিচে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ করেছিলেন। তারপর হেসে বলেছিলেন, ডক্টর দত্ত যখন সুপারিশ করেছেন তখন আমি ছেড়ে দিচ্ছি। মেয়ে ভাল হয়ে চলে যাওয়ার সময় সাধ্যমত ডোনেট করে গেলে খুশি হব।

ডক্টর দত্ত বললেন, অবশ্যই। আপনি তো আমাকে টাকা দিতে চেয়েছিলেন, তখন যা পারবেন দিয়ে যাবেন। ভর্তি হয়ে গেছে?

আধঘণ্টা পরে আসতে বলেছে।

ঠিক আছে। আপনি কাজ শেষ করে বাড়ি চলে যান। আজ বিকেলে আর আসার দরকার। নেই। ও আছে। চলি। ভরতকে নিয়ে ডক্টর দত্ত বেরিয়ে এলেন।

গাড়িতে ওঠার আগে ভরতের মনে হল এই বয়সে এত স্মার্ট চেহারা সে কখনও দ্যাখেনি। গাড়ি চলতে শুরু করা মাত্র সে প্রশ্ন করল, আপনার বয়স কত?

সেভেন্টি ফাইভ। কেন?

আপনি এখনও তরুণ।

 থ্যাঙ্কস। মিলিটারিতে ছিলাম হে। অভ্যেসটা রয়ে গেছে। তোমার প্রব্লেমটা কী বলে? চারপাশের মানুষদের ওপর তোমার খুব রাগ?

ছিল। এখন নেই।

কেন? উবে গেল কী করে?

দেখলাম রোমে থাকতে হলে রোমানদের মতনই থাকতে হবে। আগে যা অসৎ অন্যায় বলে মনে হত তার প্রতিবাদ করতাম। ঘরে বাইরে সেসবের বাড়াবাড়ি দেখে মাথা খারাপ হয়ে যেত। এখন আর করি না। বুঝে গেছি বাঁচতে হলে আমাকেও অসৎ হতে হবে। অসাড়ে অন্যায় কাজ করে যেতে হবে। ভরত অকপটে মনের কথা বলল।

ভরত আশা করছিল ডক্টর দত্ত তাকে উপদেশ দেবেন। যে সমস্ত উপদেশ সমস্ত বাঙালি পিতারা তাদের সন্তানকে দিয়ে থাক তারই কিছুটা শুনতে হবে। কিন্তু তিনি কোনো কথা না বলে চুপচাপ গাড়ি চালাতে লাগলেন। অতএব আর কথা এগোল না। প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে তাকে নামিয়ে দিয়ে ভদ্রলোক চলে গেলেন।

.

কলেজের একটি মেয়ের লিউকোমিয়া হয়েছে এবং রক্ত দরকার, খবরটা চাউর হওয়া মাত্র অভাবনীয় ঘটনা ঘটল। দলে দলে ছেলেমেয়েরা ইউনিয়ন অফিসের সামনে এসে জড়ো হলো। তারা সবাই রক্ত দিতে চায়। অভিজিৎ এ ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছিল। ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে সে বলেছিল, আমাদের কলেজের, এক বন্ধু, শ্রাবণী, আজ এই মুহূর্তে হাসপাতালে শুয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। তাকে শক্তি জোগাতে আমাদের এখনই রক্ত দেওয়া দরকার। আপনারা যদি একজন সহপাঠিনীর প্রাণ বাঁচাতে চান তাহলে সাড়ে তিনটের মধ্যে ইউনিয়ন অফিসের সামনে উপস্থিত হবেন। তার ফলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা দাঁড়াল একশ আটচল্লিশ।

অভিজিৎ ভরতকে জিজ্ঞাসা করল, আজ কতজনকে নিয়ে যেতে বলেছে?

কোনো সংখ্যা আমাকে উনি বলেননি।

তাহলে এক কাজ করি। তিরিশজন করে পর পর পাঁচটা ব্যাচে আমরা ওখান যাব। তিরিশজনের মধ্যে ও গ্রুপের রক্ত যা পাওয়া যাবে তা শ্রাবণীর পক্ষে আজকের জন্যে যথেষ্ট। অভিজিৎ লিস্ট রেডি করে ফেলল চটপট।

তিরিশজন ছেলেমেয়ে যেভাবে ট্রামে বাসে উঠল তাতে মনে হচ্ছিল কোনও বিজয় অভিযানে যাচ্ছে। মল্লিকবাজার থেকে হৈ হৈ করে ওরা যখন হাসপাতালের গেটে পৌঁছল তখন দুপাশের মানুষ অবাক হয়ে দেখছে। দারোয়ান গোছের কয়েকজন তাদের পথ আটকাল, দলবেঁধে আসার কারণ জানতে চাইল। ভরত বলল, ডক্টর দত্ত এদের আসতে বলেছেন রক্ত দেবার জন্যে। আমাদের এক বন্ধুর রক্ত দরকার।

লোকগুলো এত অবাক হয়ে গেল যে নিজেদের মুখ চাওয়াচায়ি করল। ভরত সবাইকে লাইন বেঁধে নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করতে বলল। সে সময় পেশেন্টদের দেখতে এসেছেন তাদের আত্মীয়স্বজন। ওরা লাইন করে দোতলায় উঠতেই ভরত ডক্টর দত্তকে দেখতে পেল। খবর পেয়ে বেশ হন্তদন্ত হয়ে আসছেন। ভরত তাকে বলল, আজ আমরা তিরিশজন এসেছি।

তিরিশ? হাসিতে মুখ ভরে গেল ডক্টর দত্তের। দুহাতে বাড়িয়ে বললো, ওয়েলকাম, দোতলার কোণে ঘরে চলে যাও তোমরা। মাথা নাড়লেন তিনি, আমি খুব খুশি, খুব। তোমরা আছ বলেই এখনও পৃথিবীটা সুন্দর।

অভিজিৎ এগিয়ে এল, ডাক্তারবাবু, আরও একশ আঠারোজন ছেলে মেয়ে অপেক্ষা করছে, প্রত্যেকদিন তিরিশজন করে এসে আপনাকে রক্ত দিয়ে যাবে।

থ্যাঙ্ক মাই বয়। তোমরা আমাকে লড়াই করার শক্তি দিলে। গো অ্যাহেড। তিরিশজন ছেলেমেয়ের রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করে জানা গেল পনেরজনই শ্রাবণীর সাহায্যে লাগবে। ভরত লক্ষ্য করল ছেলেমেয়েদের কেউ কেউ নার্ভাস হচ্ছে কিন্তু পিছিয়ে যাচ্ছে না। রক্ত দেওয়া হয়ে গেলে অভিজিৎ বলল, ভরত, যাওয়ার আগে শ্রাবণীকে দেখে যাওয়া উচিত আমাদের। ও কোথায় আছে?

যেহেতু এখন ভিজিটার্স আসতে পারেন তাই ওরা কারও অনুমতির জন্যে অপেক্ষা করল না। ভরত অভিজিৎ আর একটি মেয়ে তিনতলায় উঠে এল। খোঁজ করতে ওরা যখন শ্রাবণীর বিছানার পাশে উপস্থিত হল তখন একজন নার্স রক্তের বোতল টাঙাচ্ছেন। অন্য হাতে স্যালাইন চলছে। শ্রাবণীর চোখ বন্ধ। মুখ সাদা। নাকের নিচে লালচে দাগ। নার্স রক্ত চালু করে সেই দাগ তুলো দিয়ে মুছে নিলেন।

এই ঘরে আরও গোটা আটেক বিছানা এবং তাতে অসুস্থ স্ত্রীলোক এবং শিশু শুয়ে রয়েছে। ভরত লক্ষ্য করল কোথাও নোংরা পড়ে নেই। অভিজিৎ নিচু গলায় ডাকল, শ্রাবণী? শ্রাবণী শুনছ? আমরা তোমার পাশে আছি।

শ্রাবণীর চোখের বন্ধ পাতা সামান্য নড়ল কিন্তু কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। ওরা কিছুক্ষণে দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে আসছিল কিন্তু অল্পবয়সী এক মহিলাকে কাঁদতে দেখে থমকে দাঁড়াল। মহিলার সামনের বিছানায় একটি শিশু শুয়ে আছে। শিশুটি বলল, মা আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো আমি পায়খানায় যাব। এখানে থাকলে পায়খানা হবে না। ওমা। চল না। ওমা।

অভিজিৎ জিজাসা করল কি হয়েছে ওর?

মহিলা জবাব না দিয়ে কাঁদতেই লাগলেন। এই সময় নার্স এসে দাঁড়াল পাশে, স্থির হোন ভাই। ডাক্তারবাবু আজ রাত্রে শেষবার চেষ্টা করবেন। আপনাকে শক্ত হতে হবে।

ওরা তখনও দাঁড়িয়ে আছে দেখে নার্স ইশারায় করিডোরে ডেকে নিয়ে এল, ডক্টর দত্তর কেস। প্রথমবার যখন এসেছিল তখন খুব খারাপ অবস্থা ছিল। লিউকোমিয়া কিন্তু লড়াই করা যায়। বাচ্চাটা ঠিক হয়ে গিয়েছিল। বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় ডক্টর দাসও পই পই করে ওদের বলে দিয়েছিলো যদি নাক দিয়ে রক্ত বের হয় সঙ্গে সঙ্গে ওকে রক্ত দিতে হবে। প্রত্যেক পনেরো দিন অন্তর ব্লাড টেস্ট করতে। রক্ত দেবার নিয়ম হলো ফ্রেশ ব্লাড় নিয়ে বোতলটাকে উপুড় করে রাখতে হবে কিছুক্ষণ যাতে লোহিত কণিকা বোতলের মুখে চলে আসে আর শ্বেতকণিকা ওপরে উঠে যায়। রক্ত দেওয়ার সময় এর ফলে লোহিত কণিকা আগে যাবে শরীরে, সেটাই দরকার। এরা সেই নির্দেশ না মেনে লোকাল ডাক্তারের কথামত ফ্রেশ ব্লাড সঙ্গে সঙ্গে শরীরে দিয়েছে। যার ফলে বাচ্চাটার শরীর রক্ত নিতে পারেনি। হেমারেজ হয়ে গেছে। নাক কান দিয়ে তো বটেই পেটের ভেতর ছড়িয়েছে রক্ত। যার ফলে ওর পায়খানার দ্বারে চলে এসে রক্ত এমন জমাট হয়ে গেছে যে আর পায়খানা হচ্ছে না। ডক্টর দত্ত এবার কোনওমতে ব্লিডিং বন্ধ করেছেন। কিন্তু পেটের ভেতর সেই রক্তের ডেলাটাকে সরাতে পারছেন না। ওটাকে না সরালে ওর পায়খানা হবে না। এর ফলে ওর পেট ফুলছে। ডুস জোলাপ কিছুতেই কাজ হচ্ছে না।

অভিজিৎ জিজ্ঞাসা করল, অপারেশন করে ওটা সরানো যাবে না!

যাবে। কিন্তু ওই বাচ্চাকে অপারেট করা অসম্ভব ব্যাপার। ওই শরীর সেটা সহ্য করতে পারবে না। শরীরে কোনও শক্তি নেই রক্তাল্পতার জন্যে। কিন্তু এ অবস্থা চললে ও কালকের মধ্যেই মারা যাবে জেনে আজ রাত্রে ডক্টর দত্ত মরিয়া হয়ে অপারেশন করবেন। যদি সহ্য করতে পারে তাহলে বেঁচে যেতে পারে। তার সম্ভাবনা খুবই কম।

ওর মা ব্যাপারটা জনেন?

হ্যাঁ। ওর বাবা শোনার পর ওপরে উঠছেন না।

মন খুব খারাপ হয়ে গেল ওদের। নিচে নামতেই একজন এসে বলল ডক্টর দত্ত ডাকছেন। অভিজিতরা সঙ্গে এল। ডক্টর দত্ত তাদের বসতে বললেন। ওঁকে খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। অভিজিতরা সঙ্গে এল। প্রথমে জানতে চাইলেন। শ্রাবণী পড়াশুনায় কীরকম?

ভরত মাথা নাড়ল, আমি ঠিক জানি না। তবে ভাল রেজাল্ট না হলে প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হওয়া যায় না। একথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন?

ডক্টর দত্ত শব্দ করলেন ঠোঁট দিয়ে। খুব আফসোসে মানুষের মুখে এমন শব্দ বের হয়। তারপর বললেন, আমার সন্দেহটা ভুল হলে সবচেয়ে খুশি আমিই হতাম। কিন্তু আমাকে খুশি করার কোনো ইচ্ছে ভগবানের নেই। ওর রিপোর্ট পেয়েছি। তবে হাল ছেড়ে দেবার মতো। লিউকোমিয়া নয়। আমরা লড়তে পারব। তারপর তোমরা তো আছ। সহজে হার মানার কথাই ওঠে না।

অভিজিৎ ঝুঁকে পড়ল, ডাক্তারবাবু, আপনি যত রক্ত চান আমি এনে দেব। দরকার হলে অন্য কলেজের ছেলেমেয়েদের কাছে অ্যাপিল করব। একটু আগে আমরা একটা বাচ্চার মুখে মৃত্যুর ছায়া এসেছি। ওকে কি বাঁচানো যায় না?

কার কথা বলছ?

ওপরে রয়েছে বাচ্চাটা। হেমারেজ হওয়ার যার পায়খানা হচ্ছে না।

হঠাৎ ডক্টর দত্ত উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, দে কিলড হার। আমি পই পই করে বলে দিয়েছিলাম কীভাবে রক্ত দিতে হবে। ওরা সেটা গ্রাহ্য করেনি। এম বি বি এস করলেই ডাক্তার হওয়া যায় না। অভিজ্ঞতা না থাকলে সিনিয়ারদের কথা শুনতে হয়। এত কষ্ট করে বাচ্চাটাকে দাঁড় করিয়েছিলাম, ওরা অবহেলায় সেটা নষ্ট করল। হ্যাঁ, রাত নটায় আমি অপারেশন করব বলে। ঠিক করেছি। কিন্তু ওর যা অবস্থা পেট কাটামাত্র প্রাণ বেরিয়ে যেতে পারে। যদি সেটা নিশ্চিত বুঝতে পারি তাহলে আমি সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করব। হয়তো তার মধ্যেই ও চলে যাবে। যাওয়ার আগে খামোকা শরীর কাটাছেঁড়া করি কেন। ডক্টর দত্ত বললেন।

ভরত বলল, কিন্তু যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ কি আশা করা উচিত না। শুনেছি ডাক্তাররা রোগীর মৃত্যুর পরও অপেক্ষা করেন খানিকক্ষণ যদি প্রাণ ফিরে আসে।

ইয়েস মাই বয়। তাই করা উচিত। কিন্তু এক্ষেত্রে!–ডক্টর দত্ত উঠে দাঁড়ালেন। তাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিল, যা হোক শ্রাবণীকে এখন কতগুলো প্রসেসের মধ্যে যেতে হবে। ইটস রিয়েলি পেইনফুল। ওর শরীর কতটা রক্ত নিতে পারছে সেটা আগে দেখা যাক।

ওরা বেরিয়ে এল। নিচে ছেলেমেয়েরা অপেক্ষা করছিল। তখন সন্ধে হয়ে এসেছে। প্রত্যেকেরই বাড়ি ফেরার তাড়া। ভরত আবিষ্কার করল তার দিকে যাওয়ার কেউ নেই। এবং তখনই খেয়াল হল পকেটের কথা। একটা টাকাও নেই তার কাছে। টাকার কথা মনে পড়তেই প্রচণ্ড খিদে পেয়ে গেল। সেই সাতসকালে বাড়ি থেকে বের হবার আগে খেয়েছিল, গোটা দিনে খাওয়ার সুযোগ হয়নি, মনেও আসেনি। এলেও ট্যাক্সি ভাড়া দিয়ে দেবার পর খাবার কোনও উপায় ছিল না। পকেটে টাকা থাকলে খিদে পেলে সেটাকে উপেক্ষা করে কিছুক্ষণ সময় কাটানো যায় কিন্তু এখন টাকা নেই বলেই মনে হচ্ছে, না খেলে আর হাঁটতে পারবে না। জিভ শুকিয়ে আসছে। মাথা ঘুরছে অথচ ওইসব উপসর্গ খানিক আগে বিন্দুমাত্র ছিল না।

সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে সে ছুটন্ত গাড়ি দেখছিল। এখন পার্ক স্ট্রিট ধরে শুধুই গাড়ির মিছিল। এখন তাকে হেঁটে বাড়ি ফিরতে হবে। অন্তত পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা। বাড়িতে ফেরার পর খাওয়া। নিজের ওপর খুব রাগ হচ্ছিল। এখন। আজ সারাটা দিন তার কী ভাবে কাটল? শ্রাবণী যদি না পড়ে যেত, সে যদি ওকে হাসপাতাল এবং বাড়িতে না নিয়ে যেত তাহলে এখন এই সমস্যা হত না। কে শ্রাবণী? আজকের আগে তো সে মেয়েটাকে চিনতই না, সেই মেয়ের লিউকোমিয়া হয়েছে। বলে সারাদিন ধরে এত ছুটোছুটি করার কী দরকার ছিল? এইসব ভাবনা মাথায় আসায় যখন নিজের ওপর রাগটা বাড়ছিল, তখন ডক্টর দত্তর মুখ মনে এল। আর সেটা আসামাত্র কিরকম মিইয়ে গেল ভরত। মাথা নেড়ে সে রাস্তাটা পার হয়ে থানার সামনে চলে এল। খারাপ লাগা বোধটাকে ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করছিল সে। তখনই রবীনবাবুকে দেখতে পেল। থানা থেকে বেরিয়ে একটা অ্যাম্বাসাডারে উঠতে যেতেই ভরতের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল তার।

আরে, তুমি এখানে।

প্রথমে লোকটাকে দেখে বিরক্ত হয়েছিল ভরত কিন্তু দ্রুত সেটাকে কাটিয়ে উঠল সে, আপনি কি বাড়িতে যাচ্ছেন?

না। কেন? রবীনবাবু যেন বেশ অস্বস্তিতে পড়েছেন।

আমি একটু প্রব্লেমে পড়েছি।

তাই নাকি? পকেটমার হয়ে গেছে বোধহয়?

ভরত বেঁচে গেল। ভদ্রলোক কী করে বুঝলেন তার পকেটে টাকা নেই। সে অন্য ব্যাখ্যায় না গিয়ে নীরবে মাথা নাড়ল।

ভদ্রলোক পকেটে হাত দিয়ে একটু ভাবলেন, ঠিক আছে এসো। আমরা একটু চা খেয়ে বাড়ি ফিরব। কিংবা ড্রাইভারকে বলতে পারি তোমাকে ড্রপ করে দিয়ে আসতে। ওঠো।

ভদ্রলোক পেছনের সিটে উঠে পড়লেন। ভরত যেন বেঁচে গেল। ড্রাইভারের পাশের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে সে লক্ষ্য করল মধ্যবয়সিনী এক সুন্দরী মহিলা রবীনবাবুর পাশে বসে আছেন। রবীনবাবুকে বলতে শুনল, এর নাম ভরত। আমার মেয়ের টিচার। আমাদের বিল্ডিং-এই থাকে। ও হ্যাঁ, ওসি বললেন, তোমার কোনও চিন্তার কারণ নেই। আর ঝামেলা হবে না।

ওসিকে ইনভাইট করেছ?

দূর! চুনোপুঁটিকে খাইয়ে কী হবে। রাঘব বোয়ালদের একদিন বলতে হবে। তা পকেটমার কোথায় হল? ট্রামে না বাসে?

প্রশ্নটা যে তাকেই করছেন বুঝতে সামান্য দেরি হল। সঙ্গে সঙ্গে একটু ঝুঁকে রবীনবাবু বললেন, আরে, কী ভাবছ বলো তো! কত গেছে?

বেশি নয়। ভরত সামলে নিল।

সাবধানে চলাফেরা করবে তো! টাকা হাতাবার জন্যে পাঁচ পাবলিক মুখিয়ে আছে। এই দ্যাখো, সারাদিন শ্রমিকদের নিয়ে কারবার আমার, কম সাবধানে থাকতে হয়। রক্ত জল করে টাকা রোজগার করতে হয় হে। ড্রাইভার, বাঁদিকে ঢাক। হ্যাঁ, আর একটু।

একটা বার কাম রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়িটা দাঁড়াল। ওঁরা নামছিলেন, ভরত মুখ ঘুরিয়ে বলল, আমি না হয় চলে যাই।

আরে যাবে তো বটেই। একটু চা খেয়ে যাও। সেদিন তোমার সঙ্গে একটু ঝামেলা হয়ে গিয়েছিল। এসো। ওরা এগিয়ে যেতে বাধ্য হতে নামল ভরত।

স্বপ্নলোকের এই স্বপ্নপুরীতে রবীনবাবু যে বেশ পরিচিত তা আপ্যায়নে বোঝা গেল। ভর সন্ধেবেলায় টেবিলে মদ্যপান শুরু হয়ে গিয়েছে। আরামদায়ক চেয়ারে বসে রবীনবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, চায়ের সঙ্গে কী খাবে বলো?

আমার কোনো পছন্দ নেই। ভরতের বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। এই ভদ্রলোক তাকে বলেছিলেন ব্রোকেন ফ্যামিলির ছেলে জানলে তাকে বাড়িতে ঢোকাতেন না।

একটা চা আর দুটো চিকেন স্যান্ডউইচের অর্ডার দিলেন রবীনবাবু। তারপর বললেন, আজ থানায় গিয়েছিলাম এঁর জন্যে। ক্যামাক স্ট্রিটে ওঁর কারখানায় ঝামেলা হচ্ছে। ঠিক শ্রমিক বিক্ষোভ বলা যাবে না, যাবে? প্রশ্নটি মহিলাকে।

মহিলা হেসে উঠলেন, কিন্তু কোনো কথা বললেন না।

খাবার এল। ভরত দেখল চা এসেছে তা তার একার জন্যেই। অর্থাৎ ওঁরা এসব খাবেন না। যত চটপট পারে সে খাবার শেষ করল। এবং ওই মুহূর্তে মনে হল খিদের সময় স্যান্ডউইচ ট্যান্ডউইচকে খাবার হিসেবে ধরা উচিত নয়। হঠাৎ রবীনবাবু পার্স বের করে তিনটে দশ টাকার। নোট তুলে ধরলেন, এগুলো রাখো। ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাও।

ভরত একটু ইতস্তত করে টাকাগুলো নিয়ে বলল, আমি আজই ফেরত দিয়ে দেব।

নো। কখনই না। আমি তোমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। আমি চাই তুমি আমার মেয়েকে পড়াও এমনি নিতে সম্মানে বাধলে এটাকে অ্যাডভান্স হিসেবে নিতে পার।

আপনি আবার আমাকে বাড়িতে ঢুকিয়ে বিপদ ডাকবেন?

অ্যাঁ? ওহো। তোমার স্মরণশক্তি দেখছি জব্বর। যাক গে। তুমি আমার একটা উপকার করো। যাওয়ার সময় বাড়িতে বলে যেও ওদের খাওয়া-দাওয়া করে নিতে। মিটিং সেরে ফিরতে একটু দেরি হয়ে যাবে আজ। বলে দাও। ভরতের দিকে এমনভাবে হাত নাড়ালেন রবীনবাবু তাকে বোঝা গেল চলে যেতে বলছেন এবং একই সঙ্গে বেয়ারাকে ইশারা করলেন অর্ডার নিয়ে যেতে।

অন্যদিন হলে বাসে বাড়ি ফিরে ভরত। আজ ইচ্ছে করে ট্যাক্সি নিল। যতক্ষণ মিটারে কুড়িটাকা আটআনা না উঠল ততক্ষণ সে এ রাস্তা সে রাস্তায় ঘুরল। পুরো তিরিশ টাকা ড্রাইভারের হাতে তুলে দিয়ে ভরতের বেশ আনন্দ হল।

লিফটে ঢুকে প্রথমে নিজেদের ফ্লোরের বোতাম টিপেছিল সে তারপর মনে পড়তে দ্বিতীয় বোতাম টিপল। লিফট থেকে নেমে হঠাৎ তার মনে হল পারমিতার যদি শ্রাবণীর মতো লিউকোমিয়া হয় তাহলে সে কি ওর ওপর রাগ করতে পারবে? এতদিন ওর কথা ভাবতেই মনে হত নিতম্বপক্ক মেয়ে কিন্তু লিউকোমিয়া শব্দটি মনে আসার পর আর সেটা মনে এল না। কিরকম দুঃখ দুঃখ ভাব এল। ভরত বোতাম টিপল।

দ্বিতীয়বারের পর পারমিতা দরজা খুলল। খুব অবাক হয়ে বলল, তুমি? ভরত অবাক হল। এই মেয়েটা তাকে শেষ বার বলেছিল, আমি আপনাকে আই লাভ ইউ বলতে পারি? আর আজ স্বচ্ছন্দে তুমি বলছে।

কী করছ? ভরত ইচ্ছে করেই জিজ্ঞাসা করল।

আমি? কিচ্ছু না।

ভেতরে যেতে বলবে না?

 বাবা কিন্তু এখনই আসবে।

আসুক না। ভরত মেয়েটির পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকল।

বাবা এলে খুব রাগ করবে।

করবেন না। ওঁর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ভরত হাসল, আমার খুব খিদে পেয়েছে। তুমি কিছু খাওয়াতে পার?

এখানে বসো। আমি মাকে বলি। পারমিতা ভেতরে চলে গেল।

 ভরত বসল না। সে এপাশ ওপাশ দেখতে দেখতে পারমিতার ঘরের দরজায় আসতেই একটি ছেলেকে দেখতে পেল। বছর বাইশের রোগা জিনস্ পরা ছোকরা, মাথায় অমিতাভ বচ্চনের মত চুল, তার দিকে বোকা বোকা চোখে তাকাচ্ছে।

তুমি কে ভাই? ভরত হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করল।

ছেলেটিই উঠে দাঁড়াল, আমি, আমি, এখানেই থাকি৷

এ বাড়িতেই?

না, না। সামনের ফ্ল্যাটবাড়িতে। আমি আসছি।

আরে! যাচ্ছ কেন? আমি তো তোমাকে চলে যেতে বলিনি। তুমি নিশ্চয়ই পারমিতার বন্ধু?

 না মানে, ওই রকমই।

 চুমু-টুমু খেয়েছ?

না, বিশ্বাস করুন, আমি আজ প্রথম এলাম, কিছুই করিনি। আমি এলাম। ছেলেটা প্রায় ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরিয়ে গেল। বাইরের দরজায় শব্দ হলো। ভরত দেখল পারমিতা এসে দাঁড়িয়ে আছে। ওর মুখ খুব শক্ত, চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক নয়।

ভরত হেসে ফেলল, অসময়ে এসে তোমার খুব অসুবিধে করলাম?

পারমিতা কোনো জবাব দিল না, একই ভাবে দাঁড়িয়ে রইল।

চেয়ারে বসল ভরত, তোমার বাবা আমাকে খুব ভাল চা আর স্যান্ডইউচ খাইয়ে বলেছেন তোমাকে আবার পড়াতে। অতএব আমার ওপর রাগ করে লাভ নেই।

আমি তোমার কাছে পড়ব না।

 কেন?

আমার ইচ্ছে নয়, তাই।  

ঠিক আছে, আমি তোমাকে আর বকব না, অসময়ে এসে তোমাকে এমন জব্দ করব না। তুমি তোমার বয়ফ্রেন্ডদের সঙ্গে দিব্যি আড্ডা মারতে পারবে। ঠিক আছে?

ও আমার বয়ফ্রেন্ড নয়।

তাহলে কী? তুমি সম্পর্ক নেই এমন ছেলেকে এই নির্জন ঘরে ডেকে নিয়ে এসেছ জানলে তোমার বাবা খুশি হবেন?

বাবা জানতে পারত না।

কিন্তু একটু আগে তুমি বললে তোমার বাবার আসার কথা ছিল।

বাবা এলেই এঘরে আসে না। বাথরুমে গেলে ও চলে যেত।

তার মানে তুমি চাও না তোমার বাবা ওকে দেখুক। সম্পর্কটা কী?

 কোনও সম্পর্ক নেই। ইশারা করত, আসতে বললাম। আমার খুব একা লাগে তাই। ও আমার হাত ধরেছিল, ওই অবধি, কাল থেকে আর পাত্তা দিতাম না।

ছেলেটার তাতে খুব কষ্ট হতে পারে, ওভাবে তুমি ওকে বিট্রে করেছ।

আমার তাকে কী! আমি তো আগ বাড়িয়ে ওকে ডাকিনি, পারমিতা ঠোঁট টিপল, আশা করি বাবাকে এসব বলা হবে না। বলেই বেরিয়ে গেল।

ভরত টেবিলের একপাশে রাখা বইগুলো দেখতে লাগল। সবই প্রেমের উপন্যাস। খুব নামকরা কোনও লেখকের নয়, হঠাৎ হঠাৎ বেস্ট সেলার হওয়া এক একটা উপন্যাস যার পাতায় পাতায় দাগ দেওয়া। পারমিতা ফিরে এল টোস্ট আর ওমলেট নিয়ে। টেবিলে রেখে জিজ্ঞাসা করল, চা না কফি?

ওসব কিছু লাগবে না।

 খাওয়া শেষ করে ভরত জিজ্ঞাসা করল, তোমার মা কোথায়?

নিজের ঘরে বসে টি ভি দেখছে।

তোমার সম্পর্কে কোনও খবর রাখে না।

টাইফয়েডের পর থেকে মা আর কিছু পারে না।

 শোনো, তোমার বাবার ফিরতে দেরি হবে। উনি একজন মহিলার সঙ্গে মিটিং করছেন। আমি এখন যাচ্ছি। ভরত পা বাড়াল।

পারমিতা চট করে সামনে এসে দাঁড়াল, রাগ করেছ?

কেন?

বিশ্বাস করো, ওই ছেলেটার সঙ্গে আমি কিছু করিনি।

 বিশ্বাস করলাম।

তাহলে চলে যাচ্ছ কেন? আমি না তোমাকে বুঝতে পারি না। তুমি অন্য সব ছেলেদের মতো নও। আই লাভ ইউ। পারমিতা দুহাত বাড়িয়ে হিন্দি সিনেমার নায়িকার মতো ভরতের কাঁধ ধরে হাসল

আমি তো চাকরি করি না, রোজগার নেই, তোমাকে বিয়ে করতে পারব না।

ধ্যুৎ। বিয়ের কথা কে বলেছে। জাস্ট বলো, আই লাভ ইউ!

সঙ্গে সঙ্গে পারমিতা তাকে চুমু খেল। ছোঁ মেরে নিয়ে যাওয়া চিলের তৎপরতার কাছে হার স্বীকার করতে হল ভরতকে, মুখ সরাতে পারল না। কিন্তু ঠোঁটের স্পর্শ পাওয়া মাত্র ভরতের শরীর গুলিয়ে উঠল। কি রকম একটা কষা স্বাদ, গন্ধটাও সুবিধের নয়। চুমু খেলে যদি এরকম অনুভূতি হয় তাহলে লোকে চুমু খায় কেন? পারমিতা তখন হাসছিল, কি রকম চোর চোর দেখাচ্ছে প্রথম? তুমি এর আগে কখনও কারও কাছে চুমু পাওনি?

না। এই প্রথম আর এই শেষ।

তার মানে? পারমিতা হতভম্ব।

তুমি আর কখনও আমার সঙ্গে এসব করবে না।

 সে কি প্রেম করলে এসব না করে থাকা যায় না।

তাহলে প্রেম করবে না। ভরত রুমাল বের করে ঠোঁট মুছল।

তুমি ইয়ার্কি মারছ!

আমি সিরিয়াসলি বলছি। চললাম।

ভরত যখন দরজার কাছে তখন পেছন থেকে পারমিতা ডাকল, শোনো, তুমি আর কখনও এবাড়িতে আসবে না আর আমি কার সঙ্গে কি করছি তা নিয়ে ভাববেও না। যাও।

মা দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করল, লাইব্রেরিতে ছিলি?

না। পাশ কাটিয়ে ভেতরে চলে এল ভরত। সোজা বাথরুমে গিয়ে পেস্টব্রাশে নিয়ে দাঁত মাজতে লাগল। মা এগিয়ে এসে অবাক গলায় জানতে চাইল, একি রে! এখন ব্রাশ করছিস?

একটু বেশি খাওয়া হয়ে গেছে।

কোথায়?

জবাব না দিয়ে মুখ ধুয়ে নিল ভরত। পেস্টের গন্ধে সেই অনুভূতিটা উধাও হয়ে গেছে। তোয়ালেতে মুখ মুখ মুছে বেরিয়ে এল ভরত, তুমি এত তাড়াতাড়ি?

তাড়াতাড়ি কোথায়? এই সময় তো রোজ আসি। তোর জন্যে পেস্ট্রি এনেছিলাম তুলে রাখি, মনে হচ্ছে খাবি না। মা কিচেনের দিকে চলে গেলেন। তারপরই মনে পড়ে যেতে বললে, সুদেষ্ণা ফোন করেছিল একটু আগে।

কী বলল?

তুই নেই জেনে ফোন রেখে দিল।

অ।

ওইভাবে বললি কেন?

কী ভাবে বললাম? ওর সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই, খামোকা কেন যে ফোন করে। ভরত নিজের ঘরে চলে এল।

পোশাক পাল্টে পরিষ্কার হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল সে। খুব টায়ার্ড লাগছে এখন। সকাল থেকে খুব টেনশন এবং ছোটাছুটি করতে হয়েছে। শ্রাবণী বাঁচবে কি না তা একমাত্র ঈশ্বরই বলতে পারেন। ওই অসুখ হলে মানুষ এখনও কোনও আশা করতে পারে না অথচ ডক্টর দত্ত করছেন। ডক্টর দত্তের মুখ মনে আসতেই অদ্ভুত আরাম এল। এমন মানুষ পৃথিবীতে আছেন তা সে জানত না। প্রতিদিন খবরের কাগজে ডাক্তারদের অবহেলার কাহিনি পড়ে পড়ে যে ধারণা তৈরি হয়েছিল, শুধু তাই কেন, প্রতিষ্ঠত নামী ডাক্তারদের যে প্রফেশনাল আচারণ আজ স্বাভাবিক তার বিপরীত মেরুতে এখনও আছেন ডক্টর দত্ত। ওঁকে দেখে ভাল হতে, ভাল থাকতে ইচ্ছে করে। চারপাশের অবিরত অসাধুতা ওঁকে কি স্পর্শ করে না? নাকি ওঁরও অন্য রূপ আছে? মাদার টেরেসার যে ভাবমূতির ভারতীয়দের কাছে আছে তা ঈশ্বরের বিকল্প। কিন্তু বি বি সি ওঁর সম্পর্কে যে নোংরা ছুঁড়েছে তার বিরুদ্ধে পৃথিবীব্যাপী প্রতিবাদ হচ্ছে না কেন? মাদার নিজে করবেন না, সেটাই স্বাভাবিক, এখনও কলকাতায় প্রতিবাদ জানিয়ে একটাও মিছিল বের হলো না। তখনই অস্বস্তি আসে।

ভরতের মনে হলো শ্রাবণীকে বাঁচাতেই হবে। যে মেয়েকে আজ সকালের আগে সে দ্যাখেনি তার জন্যে মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগল। শ্রাবণী সুদেষ্ণা বা পারমিতা নয়, রোগা শ্যামলা বাংলাদেশের একটা সাধারণ মেয়ে। কিন্তু ভরত ক্রমশ ওর জন্যে টান অনুভব করতে লাগল। সে চোখ বন্ধ করে ভাবল হঠাৎ তার নিজের রক্তে যদি লোহিতকণিকা কমে যেতে থাকে, যদি শ্বেতকণিকারা দেহ-অধিকার তৎপর হয় তাহলে? এসব হওয়ার আগে সে কিছুই জানতে পারবে না, হওয়া শুরু হলে কিছুই করার থাকবে না। নিজের শরীর অথচ নিজেরই অজানা।

ঘুমিয়ে পড়েছিল ভরত, বেল বাজাতে চোখ খুলল কিন্তু বিছানা ছাড়ল না।

একটু বাদেই মা দরজা খুলল, বাবার গলা পাওয়া গেল, খাব না।

তখনও দরজা বন্ধ হয়নি, মা জানতে চাইল, ফোনে বলোনি কেন?

বাবার গলা স্বাভাবিক নয়, একদিন না খেলে খাবার নষ্ট হবে না, ফ্রিজ আছে। আর যদি হয়েও যায় তাহলে এমন কিছু অপরাধ হবে না।

তুমি এত ড্রিঙ্ক করে এসেছ কেন?

 করলাম। গুডনাইট। তু

মি এভাবে আমার সঙ্গে কথা বলতে পার না।

উঃ। আবার আরম্ভ হলো। এ বাড়িতে একটুও শান্তি নেই।

আরম্ভ আমি করলাম? আমি জানি তোমার পক্ষে এই অভিনয় বেশিদিন চালানো মুশকিল। আমি এইদিনটার অপেক্ষায় ছিলাম। পায়ের শব্দে মনে হল মা নিজের ঘরে দৌড়ে চলে গেল। বাবার কোনও আওয়াজ পাচ্ছিল না ভরত। সে বিছানা থেকে উঠল না। ঘড়িতে এখন দশটা বাজতে সাত। ফেরার পক্ষে এমন কিছু রাত হয়নি। তবে ইদানীং তারা তিনজন সাড়ে নটায় ডিনারটেবিলে বসছিল। আজ বাবার দেরি হচ্ছে দেখে মা নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছিল বলে তাকে ডাকেনি। কিন্তু আজকের ঘটনাটা কী ঘটল? বাবা রাত দশটার মধ্যে ড্রিঙ্ক করে বাড়িতে এসে জানিয়েছে যে ডিনার খাবে না। শোনামাত্র মা খুব অপমানিত বোধ করে একেবারে সম্পর্কের যেসব ক্ষত এতদিন চাপা ছিল তার গায়ে হাত রাখল। এভাবে দেখলে বাবার দোষটা কিছুতেই খুব মারাত্মক নয়। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে বাবা একদিন একটু বেশি খেতেই পারে এবং খাওয়ার পর ডিনারে ইচ্ছে নাও থাকতে পারে। অতএব দোষের পাল্লাটা মায়ের দিকেই ভারী হচ্ছে। আবার আজকের ঘটনাটা যদি এভাবে দেখা যায়, মা ভালমন্দ বেঁধে বাবার জন্যে অপেক্ষা করছিল। বেশ কয়েক মাস বাবা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে। ড্রিঙ্ক করে বাড়িতেই এবং সাড়ে নটায় হাসিমুখে খেতে বসে। মায়ের মন সেভাবেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ কোনো নোটিস না দিয়ে নিয়ম। ভেঙে বাড়ি ফেরার কারণ মা জানতে চাইতেই পারে। দুঃখ প্রকাশ না করে নিজের কাজের সাফাই গেয়েছে বাবা। মায়ের প্রশ্ন শুনে ধৈর্য হারিয়ে মূল জায়গায় ধাক্কা দিয়েছে, এ বাড়িতে শান্তি নেই। এবং এই শব্দগুলো মাকে অপমান করার পক্ষে যথেষ্ট। এই ব্যাখায় দোষের পাল্লা বাবার দিকেই ভারী, সমর্থন মা-ই পাবে।

অর্থাৎ একই ঘটনা যে যেমন ভাবে ব্যাখ্যা করবে সে তেমনভাবে সাজাতে পারে। কিন্তু তারপর কী হবে? মা বাবা কি আবার সেই আগের সম্পর্কহীনতায় ফিরে যাবে? ভরত উঠল। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল ডাইনিং কাম ড্রাইং রুমে কেউ নেই, আলো জ্বলছে। সে মায়ের দরজায় গিয়ে বলল, খাবার দেবে না?

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মা বেরিয়ে এল। মুখ থমথমে, বুঝতে অসুবিধে হয় না যে চোখের জল ঘর থেকে বেরুবার আগে মুছে নিয়েছে। চেয়ার টেনে ভরত বসতেই খাবার এগিয়ে দিতে লাগল মা। ভরত জিজ্ঞাসা করল, তুমি খাবে না?

মা জবাব দিল না।

 কি হল? বসো। বাবা না হয় খেয়ে এসেছে, তুমি তো খাওনি। বসো।

মা ওর মুখের দিকে তাকাল। তারপর প্রতিবাদ করবে না বলেই চেয়ার টেনে বসে পড়ল।

ভরতের ইচ্ছে করছিল অনেক কথা বলতে। কিন্তু কোনও কথাই বলতে পারল না। যে দুটি মানুষ তাকে জন্ম দিয়েছে, তিলতিল করে বড় করেছে তাদের নিজস্ব সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে গেলে যেসব বাঁধ ভেঙে যাবে তা কখনই তার পক্ষে শোভনীয় নয়। সে দেখল যতটুকু না খেলে নয় ঠিক ততটুকুই মা খেল।

খাওয়া শেষ হতেই টেলিফোন বাজল। ভরত উঠে রিসিভার তুলল, হ্যালো।

ওপাশে সুদেষ্ণার গলা, সরি, একটু অসময়ে ফোন করছি। আমি সন্ধের সময় ফোন করেছিলাম, তখন তুমি বাড়িতে ছিলে না।

কী ব্যাপার? ভরত দেখল মা তাকিয়ে আছে। সে রিসিভারে হাত চাপা না দিয়েই বলল, সুদেষ্ণা!

কেউ আছে? সুদেষ্ণা জানতে চাইল।

মা। বলো।

আজ কী হয়েছিল কলেজে? আমি যেতে পারিনি নাচের প্রোগ্রাম ছিল, পরে শুনলাম।

তাহলে তো শুনেছই।

ডিটেলস শুনতে পাইনি। মেয়েটিকে তুমি চেন?

আগে চিনতাম না। কলেজে খুব আটপৌরে চেহারার অনেক মেয়ে পড়ে, তারা সচরাচর চেনার মতো কোনো কাজ করে না।

তুমি কি আমাকে ইঙ্গিত করছ?

না। মেয়েটি অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমরা হাসপাতালে নিয়ে গেছি। শুনলাম রক্ত দিয়েছে অনেকে!

হ্যাঁ। ওর রক্ত দরকার।

কী অসুখ?

লিউকোমিয়া।

সর্বনাশ।

হ্যাঁ। এটা ওই মেয়েটির না হয়ে কারো হতে পারত। আমার খুব ভাল লেগেছে শোনামাত্র ছেলেমেয়েরা এগিয়ে এসেছে রক্ত দিয়ে ওকে বাঁচাতে।

কিন্তু লিউকোমিয়া হলে মানুষ কি বাঁচে?

যে ডাক্তার দেখছেন তিনি চেষ্টা করবেন বলেছেন। আর কেউ নাও বাঁচতে পারে ভেবে কি আমরা সাহায্য করব না। ধরো, তোমার যদি লিউকোমিয়া হত তাহলে কি সবাই হাত গুটিয়ে বসে থাকত?

আমি কি এক্ষেত্রে কিছু করতে পারি?

কাল অ্যাসেমব্লি অফ গড চার্চ হসপিটালে গিয়ে ডক্টর দত্তর সঙ্গে দেখা করে বলল যে শ্রাবণীকে সাহায্য করতে চাও, উনি কী করতে হবে বলে দেবেন। গুড নাইট। রিসিভার নামিয়ে রাখল ভরত।

মা শুনছিল কথাগুলো। জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে রে?

ভরত অল্প কথায় ঘটনাগুলো বলল। শুনতে শুনতে মায়ের মুখে কালো ছায়া নামল। বাবার সঙ্গে ঘটনাটা ঘটার পর যে অন্ধকার ছিল মায়ের মুখে এখনকার অভিব্যক্তি তার থেকে আলাদা। অদ্ভুত গলায় জিজ্ঞাসা করল, ওর বাবা নেই?

না। বিধবা মা-ই সব।

তাহলে চিকিৎসা হবে কী করে?

 রক্তের জন্যে আমরা আছি আর ওষুধপত্রের দায়িত্ব ডক্টর দত্ত নিয়েছেন।

ভদ্রলোককে আমার দেখতে ইচ্ছে করছে। কি মানুষ! মা বলল, দেখিস, এই মেয়ে ঠিক বেঁচে যাবে। তোরা এতজন রক্ত দিতে গিয়েছিলি, বৃথা যাবে না।

হঠাৎই ভরতের মনে হল মায়ের মনটা এখন অন্যরকম হয়ে গিয়েছে। বাবার সঙ্গে ঘটনাটা ঘটার পর যে পাথর চেপেছিল ওখানে, তা শ্রাবণীর কাহিনি শোনার পর যেন আপাতত অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। শ্রাবণীর অসুখ মায়ের ওপর এই মুহূর্তে যে কাজ করল তা মা নিজেই কখনও জানবে না।

তিনদিন ধরে ক্রমাগত দলবেঁধে ছেলেমেয়েরা রক্ত দিয়ে এল। শ্রাবণীর ব্লিডিং বন্ধ হয়েছে। ডক্টর দত্ত বলছেন যতদিন ওর হিমোগ্লোবিন একটা স্টেডি জায়গায় না আসছে ততদিন উনি ওকে ছাড়বেন না। বিছানায় শুয়ে শ্রাবণী একটু-আধটু কথা বলতে পারছে। ওর মা দুবেলা আসেন মেয়ের কাছে। তৃতীয় দিনের বিকেলে ভরত ঢুকতেই বেডের পাশে বসা শ্রাবণীর মা বললেন, এই হল ভরত।

শ্রাবণী মুখ ফিরিয়ে তাকাল। শীর্ণমুখ, কোটরে বসা বড় বড় চোখ, চুল দুই বিনুনিতে বাঁধা। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল।

ভরত হাসল, এখন কেমন আছ?

শ্রাবণী জবাব দিল না। ওর ঠোঁটে একটা হাসি আলতো এল। এত বিবর্ণ হাসি ভরত কখনও দ্যখেনি। শ্রাবণীর মা বললেন, ওকে সব কথা বলেছি। তুমি যা করেছ তার ঋণ শোধ করার ক্ষমতা আমার নেই।

আমি কিছুই করিনি মাসিমা। শ্রাবণী আমাদের কলেজে পড়ে। আলাপ থাকলে বন্ধুই হতো। এখন তো তাই হয়ে গিয়েছে। এখন আর ব্লাড দিচ্ছে না?

নার্স বলল রাত্রে দেবে। ডাক্তারবাবু এসে দেখে যাবেন একটু পরে। বসোনা। মাসিমার কথায় ভরত বসল দ্বিতীয় টুলে।

শ্রাবণী জিজ্ঞাসা করল, আপনি কোন ইয়ারে পড়েন?

ভরত মাথা নাড়াল, আপনি-টাপনি না। তুমি বলবে। আমরা এক কলেজে পড়ি সেটাই শেষ কথা। ইয়ার-টিয়ারের কথা বলে ভাগাভাগির কী দরকার। আর সবাই এসেছিল তোমার কাছে?

সকালে এসেছিল। তখন ও ঘুমোচ্ছিল বলে নার্স দেখা করতে দেয়নি। শ্রাবণীর মা বললেন, এখন মনে হচ্ছে এই ডাক্তারবাবুর কাছে আমাদের অনেক আগে আসা উচিত ছিল। উনি তোমাকে

কী বলেছিলেন?

কোনো বিপদ নেই, শ্রাবণী ভাল হয়ে যাবে। ভরত জানাল।

 শ্রাবণী আবার সেই হাসি হাসল।

তুমি হাসলে কেন? ভরত জিজ্ঞাসা করল।

 লিউকোমিয়া কখনও ভাল হয়? শ্রাবণী বিষণ্ণ গলায় জিজ্ঞাসা করল।

খুব অবাক হয়ে গেল ভরত। শ্রাবণী রোগের নামটা জানল কী করে? ওর মা এত বড় ভুলটা করলেন? মেয়েকে না জানালে হত না?

তোমার লিউকোমিয়া হয়েছে কে বলল?

আমি জানি।

ভুল জানতে পারো তো?

আমি ডক্টর দত্তকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। উনি স্বীকার করেছেন। অবশ্য বলেছেন যে ধরনের লিউকোমিয়া ফ্যাটাল তা নাকি আমার হয়নি। উনি নিশ্চিত যে আমি যদি ওঁর কথা শুনি তাহলে আবার পড়াশুনা করতে পারব।

তাহলে? তুমি ওঁর কথা শুনবে তো?

হাসল শ্রাবণী, বাঁচতে আমার খুব ইচ্ছে যে।

শ্রাবণীর মা ওর কপালে হাত বোলাতে লাগলেন। ভরত একটু ঝুঁকে বিছানার পাশে নেতিয়ে পড়ে থাকা শ্রাবণীর প্রায় সাদা আঙুলগুলো ধরল, তুমি আবার কলেজে যাবে। আমরা তোমার বন্ধু, তোমার পাশে আছি।

শ্রাবণীর আঙুলগুলো সামান্য নড়ে ভরতকে ছুঁলো। ভরত একটু অপেক্ষা করে যখন বুঝল মেয়েটার শরীরে কোনও শক্তি নেই তখন হাত সরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল, মাসিমা, আপনি কি এখনই ফিরবেন?

ছটা বেজে গেলে ডাক্তারবাবু আসবেন, তারপর।

একা যেতে অসুবিধা হয় না?

আমি মল্লিকবাজার থেকে ট্রামে উঠি।

ভরত বলল, যাই শ্রাবণী। তারপর হাঁটতে যেতেই কানে এল, আসবে। ঘাড় নাড়ল। করিডোর পেরিয়ে নিচে নেমে জানতে পারল ডক্টর দত্ত তখনও আসেননি। হঠাৎ ওর খেয়াল হল সেই বাচ্চাটার কথা যার অপারেশন অনিবার্য ছিল। সে চটপট ওপরে উঠতে সিঁড়িতেই সেই নার্সের মুখোমুখি হল যাঁর কাছে ঘটনাটা শুনেছিল। ভরতকে মহিলা প্রথম চিনতে পারেননি। ভরত তাকে মনে করিয়ে দিতে মাথা নাড়লেন মহিলা, অপারেশন করা যায়নি, টেবিলে নিয়ে যাওয়ার আগেই–।

ভরত চোখবন্ধ করল। তারপর দ্রুত নেমে এল নিচে। পার্কস্ট্রিটে দাঁড়িয়ে ওর মনে হল দুর্বল মানুষেরা কার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে? ধান্দাবাজ অর্থলোভী কিছু মানুষ না ঈশ্বরের বিরুদ্ধে? কেন ভদ্রলোক এত খামখেয়ালি? মানুষ যদি ভগবানের স্রষ্টা হয়ে থাকে তাহলে সেই মানুষদের ওপর ভগবানের বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতা নেই কেন? ঠিক তখনই সে ডক্টর দত্তকে দেখতে পেল। পার্কস্ট্রিট থেকে হসপিটালের গলিতে তার গাড়ি ঢুকছে। পেছনের সিটে মাথা এলিয়ে চুপচাপ বসে আছেন। তার মনে হল এইসব মানুষ আছেন বলেই ভগবান মাঝে মাঝে জব্দ হন।

প্রায় আড়াই মাস পরে ডক্টর দত্ত শ্রাবণীকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। সেই সঙ্গে পই পই করে তাকে কি করতে হবে বা না হবে সেই নির্দেশগুলো মনে রাখতে বললেন। একমাস পরে শ্রাবণীকে আবার আসতে হবে হাসপাতালে। ওর শরীর এর মধ্যে সামান্য গোলমাল করলেই যেন ডক্টর দত্তকে টেলিফোন করা হয়। রিলিজ হবার আগের বিকেলে শ্রাবণীর মা ভরতকে আলাদা ডেকে বললেন, আমি ডাক্তারবাবুকে শ্রাবণীর সামনে ছাড়া পাচ্ছি না, উনি। এত ব্যস্ত, কয়েকটা কথা যে জিজ্ঞাসা করা দরকার।

আপনি কি আমাকে বলছেন ওঁকে জিজ্ঞাসা করতে?

তুমি জিজ্ঞাসা করলে কি ভাল দেখাবে?

তাহলে চলুন, যত ভিড় থাকুক আমি ওঁকে বলব।

 ছটা বেজে গেলে সে মাসিমাকে নিয়ে নিচে নামল। আজ শ্রাবণী বেশ ভাল। হেঁটে করিডোরে পর্যন্ত এল। সামান্য মোটা হয়েছে ফ্যাকাশে ভাবটাও নেই। হেসে বলেছিল, তোমাদের রক্ত আমার শরীরে। আমার নিজস্ব বলে কিছু রইল না।

ভরত বলেছিল, নিজস্ব নিয়ে খুব ভুগলে, এখন তা নিয়ে আফসোস কেন?

শ্রাবণী বলেছিল আফসোস কোথায়? এ তো আনন্দ।

ডক্টর দত্তের চেম্বারে বেজায় ভিড়। বাইরেও লোক দাঁড়িয়ে আছে। সাধারণত এমন ভিড় সকালেই হয়। মানুষজনকে কাটিয়ে ঢুকতে ঢুকতে ভরত শুনল, আগামীকাল একটি বেড খালি হবার কথা অথচ দুজন পেশেন্টকে ভর্তি না করলেই নয়। কি যে করি। বলতে বলতে মুখ ফিরিয়ে ভরতকে দেখে বললেন, কী ব্যাপার?

শ্রাবণীর মা আপনার কাছে কিছু জানতে চাইছেন।

আনো।

মাসিমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল আবার ভরত। সে প্রথম দিন থেকেই লক্ষ্য করছে অন্য ডাক্তারদের মত ডক্টর দত্তের চেম্বারের বাইরে বেয়ারা জাতীয় কোনও পাহারাদার নেই। যে কেউ সহজেই ঢুকে যেতে পারে। এটা ঠিক না বেঠিক তা সে বুঝতে পারেনি। আজ মনে হলো এতে তাদের সুবিধে হয়েছে। ডক্টর দত্ত বললেন, বলুন মা!

মাসিমা অন্য মানুষদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আর কোনও ভয় নেই তো?

ডক্টর দত্ত মাথা নাড়লেন, কোনো গ্যারান্টি নেই। তবে যদি আমার কথা শুনে চলে তাহলে খারাপ হবার সম্ভাবনা কম। একবার কারও হার্ট জখম হয়ে গেলে কেউ বলতে পারে কখনও আর সেটা হবে না? এও সেরকম।

মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু ভাবব না?

ভাববেন না কেন? ও পড়াশুনা করুক, নিজের পায়ে দাঁড়াক। তবে এখনই যেন কোনও চাপের মধ্যে না যায়। বলতে বলতে ডক্টর দত্তের চোখ ছোট হয়ে এল, আপনি কি ওর বিয়ে থার কথা ভাবছেন?

মাসীমা বললেন, ও ছাড়া আমার কেউ নেই। আমার বয়স হয়েছে। চিন্তা হয়।

নো। নেভার। এখনই ওসব নিয়ে ভাববেন না। তাছাড়া একটা মেয়ে পড়াশুনা করবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে, এটা না চেয়ে তাকে বিয়ে দিয়ে সংসারের জাঁতাকলে জুড়ে দেওয়ার অভ্যেস বাঙালি বাবা-মায়ের কবে যাবে বলতে পারেন? আমি তো বলি যেসব বাপ-মা মেয়েকে অল্প বয়সে বিয়ে দিতে চায় তাকে দাঁড়াবার সুযোগ না দিয়ে তারা এসকেপিস্ট, স্বার্থপর। মেয়ে তাদের দায়, বিয়ে দিয়ে কাঁধ থেকে সেই দায় নামাতে চায়। তাছাড়া বিয়ে দেবেন কার সঙ্গে? আপনার মেয়ের লিউকোমিয়া হয়েছিল জানলে কোনো বঙ্গসন্তান ওকে বিয়ে করতে আসবে? আছে কারও সেই হৃদয়? ইতিহাস বলে এইসব পেশেন্টদের দশ বারো বছর বাদে আবার আক্রমণ হয়। যদ্দিন ও বাঁচবে সুস্থ হয়ে বাঁচুক। পড়াশুনা শেষ করুক, চাকরি করুক, কারও গলগ্রহ হয়ে শ্রাবণী থাকতে যাবে কেন? ও খুব ইনট্রোভার্ট এবং ইনটেলিজেন্ট মেয়ে। ওর জীবনটা ওকেই যাপন করতে দিন। তবে কেউ যদি ওর প্রেমে পড়ে সব জেনেশুনে তাহলে আমরা ওয়েলকাম করব। কিন্তু জানিয়ে দেব সন্তান যেন না হয়। ঠিক আছে? আর কিছু জিজ্ঞাস্য আছে?

মাসিমা মাথা নাড়লে, না।

ডক্টর দত্ত ভরতের দিকে তাকালেন, কিহে ইয়ংম্যান, তুমি আমার সঙ্গে কি একমত?

ভরত জবাব দিল, নিশ্চয়ই। আমার বিশ্বাস শ্রাবণীও আপনাকে সমর্থন করবে।

ডক্টর দত্ত হাসলেন, একটা মজার কথা শোনো। শ্রাবণীকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম ও কাউকে ভালবাসে কিনা। মানে বয়ফ্রেণ্ড আছে কিনা? সে চটপট মাথা নেড়ে জবাব দিল, এখানে আসার আগে তেমন কেউ ছিল না।

শ্রাবণীর মা অবাক হয়ে বললেন, সেকি!

আর বলবেন না, ডক্টর দত্ত মাথা নাড়লেন, আমি তার নাম জানতে চাইলাম। সে বলল, বলতে অসুবিধে আছে। ব্যাপারটা নাকি তার তরফ থেকেই।

শ্রাবণীর মা হঠাৎ অত লোকের মধ্যে ভরতের দিকে এমন ভাবে তাকালেন যে ভরতের খুব অস্বস্তি হতে লাগল। ভরত কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। ডক্টর দত্ত চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে মিটমিট হাসছিলেন। তারপরেই বেশ গম্ভীর হয়ে তিনি বললেন, বুঝলে ইয়ংম্যান, তোমরা আমাকে ঈর্ষা করতে পার।

কেন? ভরতের মুখ থেকে প্রশ্ন বেরিয়ে এল।

সেই ভাগ্যবানের নাম ডক্টর দত্ত। বলেই হো হো করে হাসতে লাগলেন তিনি। ভরত দেখল শ্রাবণীর মায়েরও মুখের চেহারায় প্রশান্তি এসেছে। বৃদ্ধ ডাক্তারের হাসি মাসিমার সমস্ত উদ্বেগ মুছিয়ে দিয়েছে। বাইরে বেরিয়ে এসে তার খুব অবাক লাগছিল। যে কোনো মা মেয়ের প্রেমিকের খবর পেলে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন হবেন কিন্তু মৃত্যুর নিঃশ্বাস যে মেয়ের গায়ে পড়ছে তার। মা কোন্ যুক্তিতে একই ভাবে উদ্বিগ্ন হন? ভরত ঠিক করল যে শ্রাবণীর বাড়িতে যাবে না যদি না শ্রাবণী তাকে ডেকে পাঠায়।

.

কফিহাউসে সেদিন জোর তর্ক চলছে। পূর্ব ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ থেকে কমিউনিজম উধাও হয়ে গিয়েছে। ভারতবর্ষের অন্য রাজ্যগুলোর ও ব্যাপারে যে আগ্রহ নেই তা ইতিমধ্যে প্রমাণিত। মুশকিল হলো, মানুষের কথা বলতে হলে, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে কথা বললেই এতদিন ধরে শোনানো শ্লোগানগুলোর দৌলতে তা কমিউনিজম ঘেঁষা বলে মনে হয়। একজন পাঁড় কংগ্রেসি। নেতা যখন মানুষের সপক্ষে গল্প লেখেন তখন সন্দেহ হয় ভেক ধরে কমিউনিজমের দলে তিনি ঢুকতে চাইছেন কিনা। আসলে পুরনো অভ্যেস থেকেই মানুষের কথা বলতে গেলে চট করে কমিউনিজমের কথা মনে আসে। তর্ক চলছিল, এই ভাবনার পরিবর্তন হওয়া উচিত। এই সময় একটি ছেলে এসে খবর দিল শ্রাবণী ক্লাসে এসেছে।

ভরত অবাক হল। তাদের পার্ট ওয়ান পরীক্ষার সময় হয়ে গিয়েছে। এতদিন অনুপস্থিত থেকে শ্রাবণী কী করে পরীক্ষা দেবে। তার মনে পড়ল, শ্রাবণী বাড়ি ফেরার পর ওর সঙ্গে দেখা করতেও কখনও যায়নি এবং একই সঙ্গে ডক্টর দত্তর খবর নেওয়া হয়নি। আড্ডার সবাই খবরটা পেয়ে খুব খুশি হল। ওদের মধ্যে যারা রক্ত দিয়েছিল তাদের একজন বলেই ফেলল, যাক, আমাদের রক্তটা দেখছি কাজে লেগেছে। কিন্তু আমার মনে হয় ওর খুব খারাপ ধরনের অ্যানেমিয়া হয়েছিল তাই বেঁচে গেছে। লিউকোমিয়া নয়। হলে আবার ক্লাসে আসত না।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে ভরত উঠে পড়ল। কফিহাউস থেকে বেরিয়ে গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ছুটি হবার বেশি দেরি নেই। কোন ক্লাসে শ্রাবণী আছে সে জানে না তাই এখানে দাঁড়ানোই ভাল, দেখা হয়ে যাবে। এই সময় অভিজিৎ সামনে এল, খবর পেয়েছ? শ্রাবণী আবার ক্লাসে এসেছে। একই সঙ্গে প্রশ্ন করেই উত্তরটা দিয়ে দিল অভিজিৎ।

একটু আগে শুনলাম।

মাসিমা আপত্তি করছিলেন কিন্তু আমি জোর করলাম। বাড়িতে বসে থাকলে ও আরও ভীতু হয়ে যাবে। জ্ঞর দত্তের আপত্তি নেই যদি শ্রাবণী সহ্য করতে পারে। আজ বেরুবার সময় একটু নার্ভাস ছিল প্রথম, পরে ঠিক এসেছে। অভিজিৎ জানাল।

তুমি ওদের বাড়িতে যাও নাকি?

হ্যাঁ। ওর মায়ের পক্ষে তো ডক্টর দত্তের সঙ্গে যোগাযোগ করা সব সময় সম্ভব নয়। আমার সঙ্গেই চেক আপে যেত শ্রাবণী। কিন্তু মুশকিল হল ওর পার্সেন্টেজ নিয়ে কলেজ খুব প্রব্লেম করছে। বলছে পরীক্ষা দিতে দেবে না। কিন্তু শ্রাবণীর ইচ্ছে ও দেয়। আমি ওকে এই কমাসের নোটস দিয়েছি বলে ওর সম্ভবত অসুবিধে হবে না। কাল প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা বলব। না হলে ইউনিয়ন লেবেলে মুভ করতে হবে। শ্রাবণী ইচ্ছে করে অ্যাবসেন্ট হয়নি। এত বড় অসুখের পরও ও যে কলেজে এসেছে তাকে এনকারেজ না করে আইন দেখালে চলবে কেন? তুমি কী বলো?

ঠিকই তো।

মাসিমাকে বলেছি কদিন ওকে নিয়ে আসা নিয়ে যাওয়া আমি করব। যাই। অভিজিৎ চলে গেল। হঠাৎ মেজাজটা খিঁচড়ে গেল ভরতের। তার মনে হল শ্রাবণীর জন্যে এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোনও মানে হয় না। সে হনহনিয়ে হাঁটা শুরু করল।

.

পার্ট ওয়ানের রেজাল্ট মোটামুটি হল। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র হিসেবে তার আরও ভাল নম্বর পাওয়া উচিত ছিল কথাটা মা খুলে না বললেও অভিব্যক্তিতে বোঝাল। বাবা আজকাল প্রায়ই কলকাতা থাকে না। ওঁদের ব্যাঙ্গালোর অফিসে প্রায়ই যেতে হচ্ছে। অনেক সময় মাস দেড়েক পরে ফিরে আসে। মাঝখানে যে ভরতের রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে সে খবর বাবা জানে না। বাবার যে হঠাৎ অফিসের কাজের চাপে বাইরে যেতে হচ্ছে তা মা স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। মা মনে করে বাবা ইচ্ছে করে ওই কাজটা নিয়েছে। এর চেয়ে যদি ট্রান্সফার নিয়ে চলে যেত তাহলে বলার কিছু ছিল না। তবে বাবার এই পরিবর্তনে বাড়িতে আর ঝামেলা তৈরি হচ্ছে না। সন্ধের পর একমাত্র টিভির আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না।

রেজাল্ট ভাল না হওয়ার ব্যাপারটাকে প্রথমে গুরুত্ব দেয়নি ভরত। অর্ণব বসুরায় ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে পার্ট ওয়ানে, পার্ট টুতেও পাবে হয়তো। এম-এসসিতে একই থাকলে হয় রিসার্চ করবে নয় পড়াবে। চার পাঁচ থেকে দশ হাজারে জীবন শেষ। কলেজের অধ্যাপকদের দিকে তাকিয়ে ওর মনে হয় এইসব ভদ্রলোকেরা বছরের পর বছর নতুন নতুন ছাত্রছাত্রীদের একই কথা শুনিয়ে যাচ্ছে এবং এখন প্রায় যন্ত্র হয়ে গেছে। ওঁদের হয়তো একটুও ভাল লাগে না প্রতিদিন একই কথা বলতে কিন্তু মাইনে পাওয়া যাবে বলেই বলে যেতে হচ্ছে। প্রথম প্রথম ছাত্র তৈরি করার উন্মাদনা যদি থেকেও থাকে তা কুড়ি-পঁচিশ বছর পরে নিশ্চয়ই থাকতে পারে না। ব্যতিক্রম হয়তো আছে, কিন্তু অর্ণব বসুরায় যে সেই ব্যতিক্রম হবে একথা কী করে বলা যায়।

তাকে বি. এসসি পাস করতে বে কারণ বেঁচে থাকতে গেলে যে চাকরি দরকার তার জন্যে ওই ডিগ্রি প্রয়োজন। আবার বি. এসসি পাস করলেই যে চাকরি পাওয়া যাবে তা কোনো মূর্খ ভাবে না। এ এক অদ্ভুত গেঁড়াকল। ক্রমশ ওর মন থেকে বিজ্ঞান নিয়ে দেখা নানাবিধ স্বপ্ন উধাও হয়ে যাচ্ছিল এবং সেই সময় সে খবরের কাগজে একটি ঘটনা পড়ল। শিলিগুড়ি শহরে একজন প্রথিতযশা ডাক্তারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। ভদ্রলোক গত তিরিশ বছর ধরে ওই শহরে প্র্যাকটিস করছেন। তার চিকিৎসার গুণে মানুষ এত উপকৃত যে মফস্বল থেকে রুগিরা ছুটে আসত। অন্যান্য ডাক্তারের থেকে তাঁর পসার অনেক বেশি ছিল। ভদ্রলোক গাড়ি বাড়ি করেও রুগিদের অবহেলা করতেন না। সারাদিন অন্তত দুঘন্টা গরিব রুগিদের বিনাপয়সায় দেখতেন এবং প্রয়োজন হলে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভদের কাছে পাওয়া ওষুধও বিলিয়ে দিতেন। এই ডাক্তারের প্রথম স্ত্রীর অভিযোগক্রমে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছেন কারণ তাঁর কোনও মেডিক্যাল ডিগ্রি ছিল না।

প্রথমে ভরতের মনে হয়েছিল একটা চিটিংবাজকে ধরে পুলিশ ঠিক কাজই করেছে। পরে ভেবে দেখল কেন লোকটাকে চিটিংবাজ বলা হবে? সে মানুষের কোনো অপকার করা দূরের কথা উপকারই করে গেছে। বড় বড় ডিগ্রিধারী ডাক্তারদের চেয়ে লোকটা সাধারণ মানুষের আস্থা বেশি অর্জন করেছে যখন তখন তার চিকিৎসায় কোনও ভুল ছিল না। সে অর্থবানদের কাছে যেমন পয়সা নিত তেমনি গরিবদের সাহায্য করত, এতে প্রমাণ হয় লোকটা চামার ছিল না। শুধু ডিগ্রি না থাকাটা যদি অপরাধ হয় তাহলে বাংলাদেশের মফস্বল গ্রামে যেসব ডাক্তার রোগ সামান্য জটিল হলেই শহরে নিয়ে যেতে বলে রুগিকে, তাদের ডিগ্রি কেন কেড়ে নেওয়া হবে না? ভরত এইসব ভাবনা গুছিয়ে নিয়ে বাংলা এবং ইংরেজি কাগজে চিঠি লিখল। স্কুল কলেজে না পড়িয়েও যদি কোনও শিক্ষিত মানুষ প্রাইভেট টিউশনি করতে পারেন অথবা কোচিং স্কুল খুলতে পারেন তাহলে এই ভদ্রলোকের দোষ কোথায়? চিঠি দুটো ছাপা হলো। এবং সঙ্গে সঙ্গে ভরতের বক্তব্যের বিরোধিতা করে চিঠি প্রকাশিত হতে লাগল। যে কেউ চিকিৎসার অনুমতি পেলে হাতুড়েদের কৃপায় মানুষের প্রাণ বিপন্ন হবে। একজন হাতুড়ে সফল হওয়া মানেই সবাই তা হবে মেনে নেওয়া যায় না। ব্যতিক্রম চিরকালই ব্যতিক্রম। এটাকে প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। চিঠিগুলো পড়ে ভরতের মনে হলো সে ঠিকই ভাবছে। ব্যতিক্রম যে সে হবেই এমন স্থিরতা নেই। প্রেসিডেন্সি থেকে পাস করে কেউ কেউ বাসের কন্ডাক্টরি যে করছে না তা কি হলফ করে বলা যায়?

পার্টটু পরীক্ষার পর সে সোজাসুজি মাকে বলল, আর আমি পড়ছি না।

রবিবারের সকাল। গতকাল বাবা ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরেছে। সবে ঘুম থেকে উঠে চায়ের কাপ আর খবরের কাগজ নিয়ে বসেছে এই সময় ভরত কথাটা বলল। মা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে?

দেখি। কিছু একটা করতে হবে।

তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে?

আমার তো মনে হয় না।

তোর বাবার সঙ্গে কথা বল।

ইদানীং বাবা এখানে টানা না থাকার কারণেই, ভরত লক্ষ্য করেছে মা এবং বাবার মধ্যে সংঘাত হয় না। উল্টে কোথাও যেন সমঝোতা হয়ে গেছে ওদের মধ্যে। কোনও কথা মাকে বললে উত্তর শোনা যায়, ঠিক আছে, তোমার বাবা আসুক, কথা বলে দেখি। এবং তার থেকে ভরতের মনে হয়েছে বিয়ের পনের কুড়ি বছর পরে স্বামীস্ত্রীর মাঝে মাঝে আলাদা থাকা উচিত যতদিন না তাদের শরীরে বার্ধক্য পুরোপুরি জাঁকিয়ে বসছে। মানসিক ব্যবধান বাড়লে একসঙ্গে থাকলে যে চক্ষুলজ্জা একটু একটু করে চলে যায় তা সাময়িক বিচ্ছেদে শেষ পর্যন্ত থেকে যায়।

বাবা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল, সমস্যাটা কী?

তোমার ছেলে বলছে আর পড়বে না।

ভরত লক্ষ্য করল এই সময়ে তোমার ছেলে শব্দদুটো বাবাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করল না।

 কেন? তুই তো জয়েন্ট না দিয়ে এই লাইনেই পড়তে চেয়েছিলি।

ঠিকই। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এসব আমার জন্যে নয়। তাছাড়া আলটিমেট লক্ষ্য যদি টাকা রোজগার করা হয় তাহলে সময় নষ্ট করে লাভ কী। যেটুকু না পড়লে লোকে বলবে মূর্খ হয়ে আছে সেটুকু তো শেষ করেছি।

কী ভাবে টাকা রোজগার করবি?

 সেই পথটা ভাবছি।

ঠিক আছে, তোর যদি আর পড়তে ইচ্ছে না করে তাহলে আই এ এস, ডব্লু বি সি এস দে। ব্যাঙ্কের পরীক্ষাগুলোয় বোস। তোর মতো ছাত্রর পক্ষে ডিফিকালট হবে না।

তর্ক করল না ভরত। বলল, দেখি।

মা চুপচাপ শুনছিল। বলল, এখনই টাকার রোজগারের মতলব কেন? তোর তো কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। মানুষের জীবনে টাকা রোজগারই শেষ কথা নয়। তাহলে বড় মুদিওয়ালা, লোহার কারবারীরা সমাজে অনেক সম্মান পেত।

ভরত হেসে ফেলল। মা রেগে গেল আমি কি হাসির কথা বললাম?

ভরত বলল, একজন বিখ্যাত লোহার কারবারীর নাম জামসেদজি টাটা। সেদিন একটা কাগজে পড়ছিলাম আমেরিকায় কে মার্টস নামে একটা বিশাল মুদির দোকানের চেইন সারাদেশে ছড়িয়ে আছে যার মালিককে সবাই খাতির করে। প্রেসিডেন্ট থেকে ফার্স্টক্লাস পেয়ে পাস করা দারুণ ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র আই এ এস করে যখন মন্ত্রী ঘরে ঢোকে তখন সেই অশিক্ষিত মন্ত্রী চেয়ারে পা তুলে বসে থাকে। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র তাকে স্যার স্যার বলে ডাকতে বাধ্য হয়। মা, জীবনের কনসেপ্টটা পাল্টে গিয়েছে।

বাবা হাসল, তোর যদি পড়তে ইচ্ছে না করে তাহলে বোম্বেতে চলে যা। ওখানে একটা কোর্স করে অ্যাড এজেন্সিতে ঢুকে পড়। সেটা আমি পারব। পরিশ্রম করলে টাকার অভাব হবে না। বাবা আবার নিজের ঘরে ফিরে গেল।

মা গজগজ করতে করতে কিচেনে ঢুকল। ভরতের মনে হলো তাকে নিয়ে বাবার চেয়ে মা বেশি স্বপ্ন দেখত। কী করা যাবে!

দ্বিতীয় যে কাগজটা বাড়িতে আসে তার পাতা খুলল ভরত। তলার দিকে অভিজিতের নাম। আজকাল ছাত্রনেতা হিসেবে তো বটেই, যুবনেতা হিসেবে অভিজিৎ প্রায়ই কাগজে প্রচার পাচ্ছে। কফিহাউসে শুনেছিল এজন্যে নাকি সাংবাদিকদের সঙ্গে সদ্ভাব রাখতে হয়। নিয়মিত কাগজে নাম ছাপা হলে পার্টিতে কদর বাড়ে। অভিজিৎ যে কোনো সুযোগে কেন্দ্রকে যেমন গালাগাল দেয় তেমনি পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন ব্যবস্থাকে ছেড়ে কথা বলে না। তার বক্তব্য মন্ত্রীরা যা করতে চাইছেন, বামফ্রন্ট যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা কিছু আমলা বানচাল করে দিতে চাইছে বলে জনসাধারণ বঞ্চিত হচ্ছে। কোনো সমাজবিরোধী গুরুতর অভিযোগ ধরা পড়লে অভিজিৎ তার সঙ্গে পার্টির সম্পর্ক অস্বীকার করে। তার বক্তব্য মানুষের সপক্ষে যারা কাজ করে তারা কেন মানুষের শত্রুকে দলে রাখবে। যখন বিরুদ্ধে প্রমাণ জোরদার হয় তখন তার বক্তব্য বামফ্রন্টের শত্রুরা তাদের হেয় করার জন্যে ওইসব সমাজবিরোধীকে চুপিসাড়ে দলে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এ ব্যাপার সাবধান হতে হবে। আর এই সব করে ক্রমশ অভিজিৎ প্রথম সারিতে উঠে আসছে। আজকের কাগজে লেনিনের জন্মদিনে তার বক্তব্য, বিকল্প কোনও দল নেই বলে বামফ্রন্টকে মেনে নিতে হবে এমন কথা কেউ যেন না ভাবেন। যেসব বামফ্রন্টীয় কর্মী জনসাধারণের আস্থা হারিয়েছেন তাদের নির্দ্বিধায় দল থেকে ছেটে ফেলতে হবে। মানুষের বিশ্বাস নিয়ে ফাটকাবাজি পার্টি কখনই বরদাস্ত করবে না।

ভরত হেসে ফেলল। অভিজিৎ ক্রমশ আরও বুদ্ধিমান হয়ে উঠেছে। সামনের নির্বাচনে পার্টির তরফে নমিনেশন পাওয়া ওর পক্ষে সহজ হয়ে যাচ্ছে। এই বিধানসভায় যদি নাও হয় পাঁচ বছর পরে মন্ত্রী ও হবেই হবে। কারণ ও শিখে গেছে কী করে ইমেজ বাঁচিয়ে কথা বলতে হয়। যেসব কর্মী এখনও চিরাচরিত স্লোগান আওড়ে চলেছে তারা কখনই ওপরের সারিতে উঠতে পারবে না। অভিজিতেরা পারবে।

অভিজিতের কথায় মনে এল শ্রাবণীকে। হাসপাতালে সেই শেষ দেখা। মেয়েটা কেমন আছে এখন? শ্রাবণীর কথা মনে পড়ে যাওয়ায় ভেসে উঠল ডক্টর দত্তের মুখ। হঠাৎ একটা অপরাধবোধ মনে ঢুকে পড়ল। এই মানুষটির প্রতি তার মনে একসময় এত শ্রদ্ধা জন্মেছিল অথচ দীর্ঘসময় সে আর যোগাযোগ করেনি। ডক্টর দত্তকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল। কিন্তু উনি নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসা করবেন শ্রাবণীর সঙ্গে দেখা হয়েছে কি না। সে কি বলবে যেহেতু অভিজিৎ সব করেছে তাই। আমি যোগাযোগ রাখিনি! মাথা নাড়ল ভরত। ডক্টর দত্তের কাছে যাওয়ার আগে একবার শ্রাবণীর বাড়িতে বুড়িছোঁয়ার মতো যাওয়া উচিত।

অনেকদিন বাদে গলিতে ঢুকে অস্বস্তি হচ্ছিল। বাড়িটার সামনে এসে দেখল সেই বৃদ্ধ একই ভঙ্গিতে রকে বসে আছেন। লোকটার সঙ্গে কথা বলার কোনও মানে হয় না। উনি কোনও খবর দেবেন না। পাশ দিয়ে ভেতরে ঢুকছিল ভরত এইসময় প্রশ্ন শুনল, কাকে চাই?

শ্রাবণীর কাছে যাচ্ছি।

সে তো বাড়িতে নেই।

কোথায় গিয়েছে?

হাসপাতালে।

সেকি! কবে?

দিন দশেক হল।

ভরতের বুকের ভেতর ধক্ করে উঠল। প্রশ্ন করার মানে হয় না, শ্রাবণী নিশ্চয়ই অ্যাসেমব্লি অফ গড চার্চে আবার ভর্তি হয়েছে। সে ট্রাম ধরার জন্যে ছুটল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *