জবরদস্ত মিশ্র আর লালা রামবালক
দপ্তরের হরেক কিসিমের১ এলেমদারের সঙ্গেই ছিল আমার দহরম-মহরম। আমাদের আবার ছোট ছোট আড্ডাও ছিল। সেখানে চলত নানা খোশগল্প। মালুম হয়ে ছিল যে ডরপোকদের দলে আমিই হলাম সব থেকে বেচারা। শুনতা ক্যা এদের মধ্যে যদি পুঁটিমাছ হয় তা হলে বাকিরা যে সবাই হাঙর-কুমির তাও বলা যাবে না। আমার ইয়ার দোস্তদের আমদানির নানা ফিকির শুনে আশায় আশায় চোখ চকচক করত, থর থর করে কেঁপে উঠত বদন। পয়সা করার কত যে কায়দা! এদের সবারই ছিল বেশ কয়েকটা করে পাকা মকান। বাজারে অনেক দোকান ঘরেরই এরাই হল মালিক। মহল্লায় এরা চলে ফেরে কেশর ফুলিয়ে। এদের টক্কর নেবে এমন কে আছে! চলুন এদের কিছু কারনামা শোনাই।
জবরদস্ত মিশ্র হল কালো-শক্তপোক্ত মাঝবয়সি। চেহারায় একটা তেল চুকচুকে ভাব যা দেখে অনেকেই ধোঁকা খেত। চার টাকা মাস মাইনের বরকন্দাজ ছিল সে। জেলা বেইনসাফপুর, থানা জালিমপুর, থানেদার রামবালক। এই থানেদারের দঙ্গলে সেও ছিল একজন। এদের ঢিট করার মতো কোনও আদমি মিলত না। তাই তালুক-মুলুক ঘুরে চলত এদের বেপরোয়া লুঠতরাজ। মিলত মুর্দা লাশ, তালাবের আস-পাশ বা সরাইখানায় পড়ে থাকত মরার হাল আদমি সব কিছু যার লুঠ হয়ে গেছে। মিলত না শুধু জোর-জবরস্তির কোনও নিশান। সিভিল সার্জেন সুরতহালের পর শুধু বলতেন, “মনে হচ্ছে এদের ধুতরোর মতো কোনও জহর খাওয়ানো হয়েছিল। লাশের গায়ে কোনও চোটের নিশান নেই।” একেবারে বেয়াকুবের হাল। সরকার বাহাদুরকে সব খবর দিয়ে রিপোর্ট পাঠাতেন ম্যাজিস্ট্রেট। উলটে তাঁর কিসমতে জুটত ধাতানি। ম্যাজিস্ট্রেট তখন পালটা হুকুম জারি করতেন, “বদমাশগুলোর হদিশ করতে না পারলে থানেদারদের তনখা বনধ।” হুজুরের হুড়ো খেয়ে রামবালকরা বের হত তল্লাশিতে। কিন্তু সুরাগ মিলত না। যতরকম কোশিস এস্তেমাল করার সবই হত, ফল সেই এক। আমরা তাই লর্ড বার্লির (Lord Burleigh) ঢঙে গর্দান হেলিয়ে এলান করতাম, এ বহুত পেঁচিদা মামলা!
একবার খবর মিলল, চারজন মুসাফিরকে জহর খাইয়ে লুঠ করা হয়েছে। এদের ভিতর মৌত হয়েছে দু’জনের আর বাকি দু’জন জিন্দা। তারা নাকি বহু কোশ চলার পর এক বিশাল পিপুল গাছের তলায় এসে থামে। কাছেই ছিল এক মিঠা পানির তলাব। ঠিক হয় সেখানে জিরিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি দুপুরের খানাটাও খাওয়া হবে। খানা বলতে তো খানিকটা করে চৌবেনা (chubenah) ওই গাছতলাতেই আরাম করছিল আরেক দল মুসাফির। তাদের ওই খানা দেখে তারা কিছুটা ছাতু দিতে চাইল আর ছাতু খেয়েই সবাই বেহুঁশ। তাদের গাঁঠরিতে ছিল হরেক কিসমের চাঁদির জেবরাত যেমন, চুড়ি, পঁইছা ইত্যাদি সবই ওই খাবিশেরা লুঠ করেছে।
পুলিশের উপর আবার জারি হল ভয়ানক সব হুকুম। এবার খোদ কোতোয়াল আর থানেদারই বেরিয়ে পড়ল মুজরিমদের পাকড়াও করতে। কিন্তু কোনও হদিশই মিলল না। আখেরে লালাকে পাঠানো হল আমার কাছে। “ভাইয়া, হুজুর বলেছেন, তুমি তো ভবানীপ্রসাদ সাহুর খাসিয়ত খুব ভালই জান। ও হল একজন খতরনাক থাঙ্গিদার (thangeedar)। ব্যাটা কিছুদিন হল আমাদের আর কিছুই ঠেকাচ্ছে না। এখন জলদি তুমি ওর ডেরায় যাও। চালাও খানা-তল্লাশি আর মর্জিমাফিক জব্দ কর চাঁদির সামান।” চট করে আমি ইশারাটা ধরে নিলাম। তবে আমিও কোনও আনপড় নাদান নই, শুরু হল আমার খেল। দোনামোনা গলায় বললাম, “তবে কী জান লালাজি, সাহুর দোকানে চাঁদির চুড়ি আর পঁইছার কোনও কমতি নেই। কোনগুলো মুসাফিরদের তা মালুম হবে কেমন করে?” রামবালক জবাব দিল, “জবরদস্ত মিশ্র এতদিনে আমাদের যা বোঝার সেটা বুঝে গেছি। কেন বেকার সওয়াল করে ওয়াক্ত বরবাদ করছ। এখন গিয়ে ভবানীপ্রসাদের ডেরা থেকে মাল জব্দ কর। কে কী করে সে সব শনাক্ত করবে তাই নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না।” হুকুম মাফিক শুরু হল কাজ। সাহু জানতে চাইল, আমার কি দিমাগ খারাপ হয়েছে, এত দিনের দোস্তি তাও তল্লাশি করছি? সে কী এতই বুরবক যে চোরাই মাল ঘরে রাখবে, ইজ্জত নেই নাকি তার? আমি জবাব দিলাম, “আরে সাহু, দোস্ত আমার। তোমার সিন্দুকে এত যে সোনা-চাঁদি তার কী কোনও জবাব আছে?” (এরপর আমাদের ভিতর কী বাতচিত হয়েছিল সে সব আমি বলব না)। ইশারাটা ধরে নিয়ে সে একশো টাকা কবুল করল। খালি হাতে তো রামবালকের সামনে যাওয়া চলে না। তাই দু’-চারটে খুচরো চাঁদির চুড়ি আর পঁইছা উঠিয়ে নিলাম। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কী বলতে হবে সে তালিম দিলাম সাহুকে। তাকে যখন সওয়াল করা হবে এসব সে কোথা থেকে পেয়েছে, তখন, সে বলবে— বামনি লছমনিয়ার কাছ থেকে। দু-দিন আগেই লছমনিয়া তাকে সেগুলো বিক্রি করে। ভবানীপ্রসাদকে গ্রেফতার করে আর ওই চাঁদির টুকরোগুলো নিয়ে আমি হাজির হলাম রামবালকের সামনে। শুরুতে পুরোটা চুপচাপ হজম করে তারপর বলতে শুরু করল, শ্রী-শ্রী-শ্রী। শেষে আমার দিকে ফিরে বলে উঠল, খতম হল মুসিবত১। দেখ দু-দিনের ভিতর আমাদের নাম হুজুরের কাছে রোশন হবে। থানেদারকে পঞ্চাশ টাকা কবুল করায় জামিন মিলল সাহুর।
নিশানা এবার লছমনিয়া। তাকেও তো তালিম দিতে হবে। বেটি তো কোনও কিছু শুনতেই নারাজ। হুকুম হল, জবরদস্ত মিশ্র আর রামবালক তোমরা ওকে সবক শেখাও। আমি উঠিয়ে আনলাম একটা গুঁড়ো লঙ্কার বস্তা। তারপর আচ্ছা করে ঝেড়ে তাই দিয়ে ঢেকে দিলাম ওই বেটির মুখ আর মাথা। যাবে কোথায়! ফড় ফড় করে রাজি হয়ে গেল আমরা যা কবুল করাতে চাই। থানার তিনজন ইশাদির২ সামনে নেওয়া হল লছমনিয়ার জবানবন্দি। সেই মতো গ্রেফতার হল দেবী মিশ্র আর সিংহরাম। তারা সব নালিশ ইনকার৩ করল। দু’জনেই ছিল দাগি বজ্জাত। তাই দরকার পড়ল মেরামতের। ঠা ঠা রোদে খাড়া দাঁড়় করিয়ে রাখা হল। গরমে আর তেষ্টায় যখন তাদের বেহুঁশ হাল তখন ইস্তেমাল করা হল লঙ্কার বস্তার দাওয়াই। ইশাদিদের সামনে এরাও গড় গড় করে দিল জবানবন্দি। ম্যাজিস্ট্রেট হুজুরের সামনে এবার পেশ করা গেল এক হুনর মামলা। যে দু’জন মুসাফির জিন্দা ছিল তাদের কথামতো যারা ছাতু খেতে দেয় তাদের ভিতর ছিল দু’জন মরদ আর একজন মেয়েছেলে। মরদরা বলেছিল তারা ব্রাহ্মণ। এবার তো দু’জন মরদ আর একজন মেয়েছেলে একরার করেছে যে তারাই জহর খাইয়ে লুঠপাট চালিয়েছিল আর এই চাঁদির টুকরোগুলো হল সেই চোরাই মালেরই অংশ। আমাদের পুরো কোশিস বেকার হতে বসল মুসাফিররা তাদের শনাক্ত করতে না পারায়। চাঁদির টুকরো দেখে তো সেগুলো কোন চুড়ির আর পঁইছার বোঝা যায় না। তা হলেই বা কী, আসামিরা তো খুলে আম একরার করেছে।
হুজুর তো আমাদের কেরামতিতে মহাখুশ। রামবালকের জন্য অনেক কিছু করার ওয়াদা করে ফেললেন আর আমাকে তখুনি বানিয়ে দেওয়া হল পুলিশের জমাদার। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে আসামিরা তাদের গুনাহ কবুল করল। অন্য অপরাধে যেহেতু তাদের আগেও সাজা হয়েছে তাই তারা গেল দায়রায়। রেহাই মিলল সাহুর কারণ সে জানত না জহরতগুলো চোরাই আর সে নিজে এগিয়ে এসে ওগুলো আমাদের হাতে তুলে দেয়। জানাতে ভুলল না জহরতগুলো কিনেছিল লছমনিয়ার থেকে। জবরদস্ত মিশ্র তার খোশগল্প থামাল। আমাদের হাঁ হয়ে যাওয়া মুখ দেখে হাসতে লাগল মিট মিট করে।
বললাম, “দোস্ত, তোমার কেরামতি তারিফ লায়েক। কিন্তু এত সহজে মনে হয় না সাহেবদের বুদ্ধু বানানো যায়। আমিও মোওকা মাফিক দু’-চারটে কায়দা ইস্তেমাল করেছি। কিন্তু তুমি যা শোনালে তেমন জব্বর কেরদানি তো আমার খোয়াবেও আসে না। গুনাহগারদের কী সাজা হল?”
একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে জবরদস্ত মিশ্র আবার বলতে বসল, “মনে করতাম এই দুনিয়ায় কী হচ্ছে তা নিয়ে রামজির কোনও শিরদর্দ নেই। তবে এবার যা হল তাতে আমার সব বিশ্বাস গেল উলটেপালটে। সবটা শোনার পর তুমিও ভেবে দেখ। জজ জুনাব সাহেবের আদালতে রায় বের হওয়ার ঠিক দু-দিন বাকি তখন ম্যাজিস্ট্রেট হুজুর পাশের জেলার অফিসিয়েটিং জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে পেলেন একটা রুবকারি (Roobukaree)। জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট ছিল এক গরম দিমাগ ছোকরা। সে চাইত সব কাম কাজ নিজের হাতে করবে। আমলাদের সে পাত্তাই দিত না। তার মনে হত এদের উপর ভরসা করা মানেই বরবাদ হওয়া। তার রুবকারিতে বলা ছিল, একটা দলকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওই দলে দু’জন মরদ আর একজন ঔরত। এতদিন ধরে এরাই লুঠমার চালিয়ে এসেছে। এবার একদল মুসাফিরকে ধুতরো খাওয়াতে গিয়ে হাতেনাতে গ্রেফতার হয়। এই দলের কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত করা গেছে হরেক কিসমের সোনা চাঁদির জহরত। বমাল গ্রেফতার হওয়ায় খোলসা করে একরার করেছে তাদের সব গুনাহ। একথাও বলেছে, বেইনসাফপুর দায়রা আদালতে নাকি কয়েকজন বেকসুরের সাজা হবে। পিপুল গাছের তলায় মুসাফিরদের গাঁঠরি থেকে তারা কী কী মাল হাতিয়েছিল বাছাই করে দিয়েছে সেই সব। এখন বেইনসাফপুরের ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে তাদের সেই জবানবন্দির একটা নকল তুলে দেওয়া হল।
শোরগোল পড়ে গেল চার ধারে। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তো তখন পুরো পুলিশ পল্টনের উপর মহা খাপ্পা। আবার করে যে দু’জন মরদ আর ঔরতের জবানবন্দি নেওয়া হয়েছিল তাদের ফের জেরা করতেই বেরিয়ে এল আসল কিস্সা। এত কিছুর পরেও সব বরাবর থাকত যদি না মুসাফিররা শনাক্ত করত ছোকরা ম্যাজিস্ট্রেটের পাঠানো মাল তাদেরই আমানত বলে। সাফ জাহির হল যাদের আসামি বলে চালানোর চেষ্টা হচ্ছে তারা বেকসুর। কোতোয়াল, লালা রামবালক আর দু’জন থানেদারকে বরখাস্ত করা হল। আমি আবার হলাম সেই পুরনো বরকন্দাজ।
ভেবেছিলাম আরও কিছু খোশগল্প শুনতে পাব কিন্তু তার আগেই আমাদের মজলিশ ভেঙে গেল। সবার মতো পা বাড়ালাম ঘরের পথে।
১. কিসিম: রকম, প্রকার
১. মুসিবত: দুর্ভাগ্য, ঝামেলা, ঝঞ্ঝাট
২. ইশাদি: সাক্ষী
৩. ইনকার: অস্বীকার, প্রত্যাখ্যান