কিন্তু সেদিনের চৌদ্দ পনেরো বছরের রাধার সঙ্গে আজকের উনিশ যাই-যাই রাধার অনেক–অনেক তফাৎ। বাবা মারা যাবার পর থেকে নিজের ভিতরের এক স্থির বিশ্বাসের জোরে সে দাঁড়িয়ে আছে। অভাব অনটনের মুখ দেখেনি। বরং স্বাচ্ছল্য যেচে এসেছে, আসছে। বাবার কথা থেকেছে আবার কালীর স্বপ্ন দেখে মনের সেই রোখও সফল হয়েছে। পেট চালানোর জন্যে তাকে পথে-পথে গান গেয়ে বেড়াতে হয়নি, অথচ এই গান গেয়েই অনায়াসে তার দিন চলে যাচ্ছে। বাবা সেই কথার পর এক বছরের মধ্যে মেয়ের গান আর গলার উন্নতি দেখে অবাক হয়েছিল। তারপর জিগ্যেস করেছিল, এসব গান তুই এভাবে গাইতে শিখলি কি করে? রাধার ইচ্ছে করছিল জবাব দেয়, মা-কালী শিখিয়েছে–তার মস্করার জবাব দেবে পণ করেছিল বলেই শেখা হচ্ছে। কিন্তু তা তো আর বলা যায় না। বলেছিল কালীর গান কপালী বাবার কাছে, কারবালার মাতনের গান মাজারের ফকির সাহেবের কাছে আর বিৰিমায়ের দু’তিনটে গান শফিদার মায়ের কাছে শিখেছে। এরা কে কেমন গায় রাধার বাবার জানা আছে, তার মনে হয়েছে মেয়ের আসল গুরু তার ভাব আর আবেগ। এ দুটোর সঙ্গে মিষ্টি মাজা গলা তো আছেই। এরপর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় চার বছর বাবাই সন্ধ্যায় বা রাতে ওকে ডেকে গান নিয়ে বসেছে। কেবল কালীর গান নয়, গোপাল রাধা-কৃষ্ণের গান, এমন কি শিবের গানও। রাধা বুঝেছে পয়সা রোজগার বেশি হয় না বলেই বাবার গলায় এসব গান বেশি শোনেনি। কিন্তু ওর বেলায় এ-সব গানেও রোজগার কম হচ্ছে না। ও অবশ্য রোজগারের দিকটা মোটে ভাবেই না। কিন্তু টাকা এলে কি করবে? আর বাবা মারা যাবার পরে নিজের ভাবেও তো কত মনগড়া গান গেয়ে ফেলে। গাঁয়ের স্কুলের তিন ‘কেলাস’ পড়া তো বিদ্যে, কিন্তু গান ওর মন থেকে উঠে আসে। আবার ভুলেও যায়।
এখন তো কাছে দূরে কত জায়গা থেকে ডাক আসে তার। অবশ্য হাল ফ্যাশনের গানের আসরে নয়। কত বড় লোক মধ্যবিত্ত লোক তাদের ঘরোয়া ঠাকুরের পূজা উৎসব উপলক্ষে ভক্তির গানের আসর বসায়। রাধাকে তারা যেচে এসে ডেকে নিয়ে যায়। এখন বহুজনের কাছে তার খাতির কদর। লক্ষ্মীকান্তপুর, বিষ্টুপুর, জয়নগর, ধপধপি –ভাক এলে কোথায় না গিয়ে পারে? এই বয়সেই বার দুই তিন কলকাতায় গিয়ে পুজো-পার্বণের ঘরোয়া আসরে গেয়ে এসেছে। এ দিকের চেনা-জানা লোকেরাই তাদের কলকাতায় আত্মীয়দের ওই সব আসরে সাদরে নিয়ে যায়।
..এসবের এক কণাও কি ওর নিজের শক্তি নিজের জোরে হয়েছে। ছাই। মস্করা করে স্বপ্ন দেখিয়ে যে ওকে গানে নামিয়েছিল সব তার শক্তি, তার জোর। গান নয়, এই শক্তির মহিমা নিজের সত্তা দিয়ে অনুভব করে, বিশ্বাস করে। …সাধারণ লোক নয়, গানের দৌলতে এ-ভাবে এগোনর ফলে অনেক বড় ঘর শিক্ষিত ঘরের ছেলেদের চোখে লোভ দেখেছে, আসরে আলাপের ফাঁক খুঁজে কাছে ঘেষার চেষ্টা দেখেছে। যার জোর আর বিশ্বাসের ওপর সে দাঁড়িয়ে, রাগের বদলে হাসিই পায়। ঘরে ফিরে আয়নায় দাঁড়িয়ে অনেক সময় সকৌতুকে নিজেকে দ্যাখে। লম্বা স্বাস্থ্য-টাস্থ্য এ নিজেও স্বীকার করে, আর ছেলেবেলা থেকে পাঁচ জনের মুখে নিজের ডাগর চোখ দুটোর প্রশংসা শুনে এ-ও মেনেই নিয়েছে চোখ দুটো সুন্দরই, কিন্তু কালো তো, আর এমন আহামরি মুখও কিছু নয়, তবু আসরের রূপসীদের ছেড়ে হ্যাংলা ছোঁড়াগুলো ওকে গিলে খেতে চায় কেন? আর ঠিক এই চিন্তা করতে গিয়ে বিষ্টুপুরের রায় বাড়ির গৃহিণী বিন্দুবাসিনী দেবী আর জয়নগরের সেন বাড়ির রুমা সেনের কথা মনে পড়ে যায়। ওঁরা দু’জনেই গোপাল ভক্ত। নিয়মিত বিগ্রহ পূজা হয়। রুমা সেন মস্ত লোকের ঘরণী ছিলেন, নিঃসন্তান, বিধবা হবার পর থেকে দেশের অর্থাৎ জয়নগরের বাড়িতে ভাগ্নেকে নিয়ে থাকেন। ভাগ্নে অজয় গুপ্তর বছর বাইশ বয়েস, জয়নগর থেকে কলকাতায় যাতায়াত করে কী পড়াশুনা করে নাকি। আরবিন্দুবাসিনীও বড়লোকের বাড়ির গিন্নি, চার ছেলের মা। স্বামী আর বড় তিন ছেলে কেবল টাকার পিছনে ছুটছে, ছোট ছেলেটা ভদ্র কিন্তু অলস গোছের, সে-ই কেবল সর্বদা মায়ের কাছে থাকে, কিছুই করে না। কিন্তু বড় তিন ছেলের বউ নিয়ে বিন্দুবাসিনী দেবীর মনে অশান্তি, কারো সঙ্গে কারো মিলমিশ নেই, স্বামী ছেলেরা বা বউরা কেউ গোপালকে মোটে ভক্তিশ্রদ্ধা করে না, যেমন-তেমন করে কেবল দায়সারা কর্তব্য করে। এই দুঃখেই বিন্দুবাসিনী এখন পর্যন্ত ছোট ছেলের বিয়ের নাম করেন না। তার ধারণা, তার গোপাল মাঝে মাঝে রাগ অভিমান করে, মান করে, আর তখনই রাধার ডাক পড়ে। রাধা গান গেয়ে গোপালের মান ভাঙাতে যায়। আর রুমা সেনের বাড়িতেও গোপালের নামে বাধার ডাক পড়েই। ওই দু’বাড়ি থেকেই বছরে দু’জোড়া দু’জোড়া চার জোড়া শাড়ি রাধার বাঁধা প্রাপ্য। তাছাড়া প্রতি মাসেই নিতে না চাইলেও তারা ওর বটুয়ায় বিশ পঁচিশ টাকা করে গুঁজে দেবেনই। শাড়ি টাকা এমন আরো কতজনই দেয়। সে-কথা নয়। এই দু’জনেই একই রকমের আবেগের কথা ওকে শুনিয়েছিলেন।
বিন্দুবাসিনী দেবী ভাবে বিভোর গান শুনে একদিন ছলছল চোখে বলেছিলেন, গোপালেব আমার এতদিনে মান ভাঙল, তুইই বোধ হয় কোনো জন্মে রাধা ছিলি।
আর রুমা সেন বলেছিলেন, বিভোর হয়ে গান করিস যখন তোকেই যে আমার রাধা মনে হয় রে!
তা হেসে হেসে দু’জনকে একই জবাব দিয়েছিল রাধা শ্ৰীমতী রাধা তো কাঞ্চনবর্ণ রূপসী ছেলেন গো, আমি তো কালো!
বিন্দুবাসিনী মনের খেদে খেঁকিয়ে উঠেছিলেন, তোব মতো রূপ পেলে এ-কালের দেমাকী রূপসী রাধার বর্তে যেত বুঝলি? কটাক্ষ তিন বউয়ের উদ্দেশে। তারা সকলেই বেশ ফসা আর সুশ্রী।
আর রুমা সেন খানিক ওর মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলেছিলেন, তোর কত রূপ যদি জানতিস থাক না জানাই ভালো।
রূপের এই বিশেষত্বটুকুই রাধা ঠিক-ঠিক ধরে উঠতে পারে না। …তবে, একটু কিছু আছেই জানে, যা দেখে আদেখলে পুরুষগুলোর লোভী চোখ অন্যকে ছেড়ে আগে ওর দিকেই ছোটে।
.
কিন্তু যে-বিশ্বাস তার আসল পুঁজি, যার জোরে ও নিঃশঙ্ক চিত্তে সর্বত্র ঘুরে বেড়াতে পারত, এমন একটা ঘটনার ফলে সেই বিশ্বাস আর জোরের ওপর বড় রকমের একটা ধাক্কা পড়েছে। …হ্যাংলা লোভীর দল চারদিকে তো আছেই জানে, কিন্তু ওর অনিচ্ছায় কেউ ওর একটা কেশও স্পর্শ করতে পারবে না এ-ধারণা একেবারে বদ্ধমূল হয়ে গেছল। যে রক্ষা করার সে তাকে রক্ষা করেই যাবে। কিন্তু এবারে কি হল, দু’দুটো ডাকাত ওকে জাপটে মাপটে ধরল, একজন নোঙরা গামছা দিয়ে ওর মুখ বেঁধে ফেলল, তারপর এক-একবার এক একজন ছানাছানি করে ওকে কাঁধে তুলে নিয়ে গেছে, ছাড়াতে চেষ্টা করলেই পিছনে কিল-চড় পড়েছে।…মা শেষ পর্যন্ত ওকে রক্ষা করল বটে, কিন্তু সে-জন্য এক বুড়ীকে প্রাণ পর্যন্ত দিতে হল।
রাধা এই চিন্তা নিয়েই পাগলের মতো ছটফট করে কাটালো কটা দিন। তার এই জোর আর এই বিশ্বাস গেলে আর থাকল কি? যায়নি বটে, কিন্তু বড় রকমের নাড়া তো খেয়েছে। মায়ের কি ইচ্ছে, এমন শাস্তি দিয়ে মা ওকে কি বোঝাতে চায়।
এমন একটা ঘটনা চারিদিকে রটে যেতে সময় লাগল না। যাকে নিয়ে এই ঘটনা তার নাম রাধা-পাঁচ দশ ক্রোশের মধ্যে তাকে না চেনে কে? আর যে বুড়ী ওকে উদ্ধার করতে গিয়ে জেবন দিল সে হল গিয়ে লক্ষ্মীকান্তপুরের ছিনাথ (শ্ৰীনাথ) পোদ্দারের লোক–ওই একটি জোতদারকেই বা গোটা অঞ্চলের মধ্যে না চেনে কে? কিন্তু এ রটনা লোকের মুখে মুখে রসালো হয়ে ছড়াতে লাগল। একটা থুথুড়ি বুড়ী রাধাকে তিন ডাকাতের হাত থেকে উদ্ধার করে প্রাণ দিয়েছে এ কি একটা বিশ্বাসযোগ্য কথা? ফুর্তির সময় ঝামেলা বরদাস্ত করতে পারেনি বলেই ডাকাতরা বুড়ীকে মেরে চাষের জমির ধারে ফেলে রেখেছে এ বরং সম্ভবের মধ্যে পড়ে। এমনও হতে পারে ডাকাতদের মধ্যে বুড়ীর কেউ চেনা লোক বেরিয়ে পড়েছে, তাই আগে থাকতে তাকে মেরে তারা নিশ্চিন্ত হয়েছে। বুড়ীকে মারার ব্যাপারটা রাধাও দেখে থাকবে, বুড়ীর দেহ সনাক্ত হবেই জেনে ডাকাতদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে রাধা থানায় এসে নিজের উদ্ধার পাওয়ার গল্প কেঁদেছে।
মাতনের কিছু লোক ছাড়া কেউ এ গুজবে মন থেকে বিশ্বাস করতে চায়নি অন্তত। কিন্তু এসব রটনা ছোঁয়াচে ব্যাধির মতো একটু নাড়াচাড়া দিয়েই যায়। প্রতিবেশিনীদেরই কেউ কেউ নিজেরাই এসে রাধার কানে কথাটা তুলেছে, বিলাসীও বলেছে। ড্যাকরারা সব এই-এই বলছে, মুখে আগুন সব।
সাত দিনের মধ্যে রাধা আর ঘর ছেড়ে নড়েনি। তাই নিয়েও কথা, দেহের কি হাল হয়েছে কে জানে, বেনোর শক্তি থাকলে তো। কোন্ মাস্তান নাকি বিজন ডাক্তারকে একটু বেশি রাতে রাখার ঘর থেকে বেরুতে স্বচক্ষে দেখেছে। …চিকিৎসার দরকার হয়েছে নিশ্চয়। তাকে কপালী বাবার সঙ্গেও কথা বলতে দেখেছে। দেখাটা মিথ্যে না হতে পারে, কাবণ, দু’দিন বাদেই অংশুমানের স্ত্রী জিপে ডাক্তার চৌধুরীর স্ত্রীকে তুলে নিয়ে তার ডেরায় এসে দেখে গেছেন। রাধা সারাক্ষণই গুম হয়ে বসেছিল, পাঁচটা কথাও বলেনি। স্ত্রীর মুখে এ কথা শুনে পরদিন রাতের দিকে একটু ফুরসৎ পেয়ে ডাঃ চৌধুরীও রাধাকে দেখতে এসেছিলেন। তাঁর ভয় হয়েছিল বড় রকমের মানসিক আঘাতটাঘাত পেল কিনা। কপালী বাবা সকাল সন্ধ্যায় অনেকটা ময়ই এখন এখানে কাটিয়ে যান। তার সঙ্গেও ডাক্তারের দেখা হয়েছে। রাধা ভালো আছে দেখে তিনি উঠোনে দাঁড়িয়ে রাখার সম্পর্কেই কিছু কথাবার্তা বলেছেন। তাঁর এবং তার স্ত্রীর মত, চেষ্টা চরিত্র করে এখন রাধার একটা বিয়ে দেওয়া উচিত।
আগে-পরে রাধাকে দেখতে অনেকেই এসেছেন। কালীভক্ত দোতারাবাবু এসেছেন, ভাগ্নে অজয় গুপ্তকে নিয়ে রুমা সেন এসেছেন, ছোট ছেলে নিখিল রায়কে নিয়ে বিষ্টুপুরের বিন্দুবাসিনী দেবী এসেছেন। আশ্চর্য, কতগুলো ব্যাপারে মানুষের ভাবনা চিন্তা একই রকমের হয়। তারা প্রত্যেকেই একই মত ব্যক্ত করে গেছেন–রাধার এবারে একটা বিয়ে হওয়া উচিত। আর সেটা সব থেকে বেশি মনে হয়েছে কপালী বাবারও।
নিজের সেই বিশ্বাস আর জোরের ওপর নাড়া পড়তে রাধার দৃষ্টিও যেন অন্যরকম হয়ে গেছে। …মামী আর মায়ের সুবাদে অজয় গুপ্ত আর নিখিল রায়ও তাকে পছন্দ করত, রাধাও তাদের ভদ্র ভালো মানুষই ভাবত। বেশি রাতেও কতদিন এক-একজন ওকে ডেরায় পৌঁছে দিয়েছে, রাধা সাইকেল-রিকশয় এসেছে, তার কেউ না কেউ পাশে পাশে সাইকেলে। কিন্তু এবার তারাও যখন মা বা মামীর সঙ্গে এসেছে, তাদের চোখেও রাধা যেন লোভ উঁকিঝুঁকি দিতে দেখেছে। এ কি হল রাধা, বিশ্বাস কি এরপর তাহলে ও আর কাউকেই করতে পারবে না?
কপালী বাবা বিয়ের কথা তুলতে তাকে অবাক করে রাধা ঠাণ্ডা মুখে সায় দিল, হ্যাঁ, বিয়ে এবারে একটা করব।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন কপালী বাবা। যাক, নিশ্চিন্ত করলি। …তা কাকে বিয়ে করবি ভেবেছিস?
-ভাবিনি। ভাবছি
–মনোহরকে তোর সঙ্গে দেখা করতে বলব?
রাধা ভ্রূকুটি করে উঠল, তোমাকে কারো হয়ে ওকালতি করতে হবে না।
এ-সব কথায় বিলাসীর কান সর্বদা খাড়া। মেয়ের এই ভ্রুকুটি একবারও আসল রাগ মনে হল না। সে ওই দুপুরেই প্রথমে পাড়ার সমবয়সী অন্তরঙ্গ কয়েকটি রমণীর কাছে খুব গোপনে খবরটা ফাস করল। তাদের মধ্যে একজনের গলা পর্যন্ত ধারে বিকিয়ে আছে নিতাই স্যাকরার কাছে। নিতাইয়ের দুর্বলতা তার তত অজানা নেই, সে তার দৃত হয়ে কতসময়ে পাকে প্রকারে বাধার মন বুঝতে চেষ্টা করেছে। সে তড়িঘড়ি ছুটল নিতাই স্যাকরার দোকানে। এদিকে মনোহরকে ফাঁক মতো খবরটা বিলাসীই দিয়ে এসেছে। এ-ও বলেছে রাধার তাকেই পছন্দ মনে হয়। এটুকু মেহনতের সুফল দুটি টাকা হাতেনাতে পেয়েছে।
পরদিন দুপুরেই নিতাই এসে হাজির। এসময় ছাড়া রাধাকে আর নিরিবিলিতে কখন পাবে, সকাল-সন্ধ্যা তো ওই বাবাটি এখানে ঠাঁই গেড়ে বসে থাকেন। রাধার বোনাইয়ের বন্ধু হিসেবে আগে তো এখানে হামেশাই আসত, আর রাধার বাপ বেঁচে থাকতে একই উদ্দেশে তাকেও তোয়াজ তোষামোদ করতে আসত।
উঠোনে দাঁড়িয়ে বার দুই গলা খাকারি দিল, তারপর গলা যতটা সম্ভব নরম করে দু’বার বিলাসী-বিলাসী বলে ডাকল।
দরজা খুলে গেল। রাধার পিঠের ওপর চুলের বোঝা ছড়ানো। গম্ভীর মুখে স্থির চোখে সোজা তাকাতে গলায় মধু ঢেলে বলল, এক বারটি তোর কাছে না আসি পারলাম না–
-সে-তো দেখতে পাচ্ছি। কেন?
–ইয়ে এত ধকল গেল তোর ওপর দে..
–আমার ওপর দে কি ধকল গেল? রাধার গলার স্বর ঈষৎ তীক্ষ্ম।
নিতাই বলল, উ কথা ছাড়, কোনো শালার কথায় আমি কান পাতি না–আমার কথা হল এবার তুই আমার ঘরে আয়, আমি তোকে মাথায় করে রাখব।
রাধা চেয়ে রইলো একটু।–গয়না-টয়না গড়িয়ে রেখেছ?
নিতাই ভেবাচাকা খেয়ে গেল। ইয়ে, মানে তোর জন্যি গয়না?
-হ্যাঁ, গড়িয়ে রাখাই ভালো, দু’বছর মাত্র অপিক্ষে করছ, আর ছের দশেকের মধ্যে তোমার গলাতেই মালা দিতে ইচ্ছে হবে কিনা কে জানে। তার মুখের ওপর দরজা দুটো বন্ধ করে দিল।
সন্ধ্যায় মনোহর পাইক কপালী বাবার ডেরা হয়ে এখানে হাজির। কপালী ববাই বলে দিয়েছেন নিজে গিয়ে রাধার মন বুঝে নেগে যা, আমি আর তাহলে এখন যাচ্ছি না।
এসেই বলল, কপালী বাবা আসতি বললেন-এলাম।
রাধা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডা মুখে জিগ্যেস করল, কেন আসতি বললেন?
–একটু বসতে দিবি না দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা হবে?
রাধা ভিতরে চলে গেল। এক হাতে চাটাই অন্য হাতে লণ্ঠনটা নিয়ে বেরুলল। দাওয়ায় চাটাই পেতে লণ্ঠনটা সামনে রেখে নিজে আবার দরজা ঘেঁষে দাঁড়ালো।
মনোহর গ্যাঁট হয়ে বসল। কপালী বাবা তোর মন বুঝে নেবার জন্য আসতি বললেন।
একটু চুপ করে থেকে রাধা জিজ্ঞেস করল, মনের কী বোঝার জন্যি?
যতটা সম্ভব সমর্পণের সুরে মনোহর জবাব দিল, তোর বে-তে মত হয়েছে, এখনো তুই আমাকে বাতিল করবি কিনা সেটুকু বোঝার জন্যি।
রাধা আবার চুপ খানিক। আমাকে কুজিঘরে টেনে নে গিয়ে তিন ডাকাত বে-ইজ্জৎ করেছে সে-কথা শোনোনি?
মনোহর এবার দরাজ গলায় জবাব দিল, তিন ছেড়ে পাঁচ হলেও আমি কেয়ার করি না, ডাকাতের অত্যাচার তুই সেধে নেতে গেছিস, এ-জন্যিই তো আগের থেকেও তোর ওপর আমার বেশি দরদ, বেশি টান।
এবারে রাধার গলার সুর রুদ্ধ একটু।–ও, লোকে যা বলে বেড়াচ্ছে তুমি তা বিশ্বাস করেছ, তার পরেও টান দেখাতি এয়েছ?
চতুর মনোহর তক্ষুনি বুঝে নিয়েছে সে কোন ফঁদে পড়ল। তাড়াতাড়ি সামাল দিতে চেষ্টা কবল, যারা অমন কথা বলে তারা হারামীর বাচ্চা বুঝলি? এ-কথা যারা বলে আমার ও-কথাগুলো তাদের মুখের ওপর জবাব–নইলে গঙ্গা জলে দাঁড়িয়ে হলপ করলেও কি তাদের বোঝানো যাবে–নইলে তোর তেজ আমি জানি না… এক হাজার লাল পিঁপড়ে দিয়ে খাইয়ে আমাকে মারতে বসেছিলি? তোর কথা বিশ্বাস না করা আর মা-কালীর কথা বিশ্বাস না করা তো সমান কথা।
রাধা চেয়ে আছে। ঠোঁটের ফাঁকে একটু একটু হাসির ফাটল ধরছে।–ঠিক আছে এখন ঘরে যাও, পরে আমার মনের কথা বাবার কাছেই জেনে নিও।
.
রাধার ভগ্নিপতি সকালে দুপুরে বা বিকেলে যখনই হোক রোজই একবার করে শ্যালিকার খবর নিতে আসে। বিষ্টুপুরের আগের স্টেশন জয়নগর ট্রেনে কয়েক মিনিটের পথ। আর স্টেশন থেকে এক দেড় ক্রোশ হেঁটে আসা কিছুই না। কপালী বাবা তাকে রাধার সামনেই ডেকে বলেছিলেন, আপনার জন বলতে তো একমাত্র তুমি, যেটুকু পারো খবর টবর নিও।
তা হারাণ মণ্ডল নোজই এই কর্তব্য করতে আসে। রাধার সঙ্গে এ ক’দিনের মধ্যে একটা কথাও হয়নি। উঠোনে দাঁড়িয়ে দেখে রাধা চুপচাপ ঘরে বসে আছে। না ডাকলে ঘরে ঢোকার সাহস নেই, দাওয়ায় বা উঠোনের পিছন দিকে চালা ঘরে বসে বিশ্রাম করে খানিক। বিলাসীর কাছ থেকে খবর নেয়। তারপর চলে যায়।
সেদিন (অর্থাৎ মনোহর পাইক বড় রকমের আশা নিয়ে চলে যাবার পরদিন ) বিকেলে হারাণ উঠোনে পা দিয়েই ধমকে দাঁড়ালো। আজ ঘরে নয়, রাধা দরজার বাইরে দাওয়ায় দাডিযে। তাকে দেখে অপলক দুই চোখ মুখের ওপর আটকে রইলো।
–কি গো বোনাইদাদা কি মনে করে?
হারাণ মণ্ডল আরো হকচকিয়ে গেল। খুব গম্ভীর বটে, কিন্তু শালীর গলা অনেকটা আগের মতোই নরম যেন। বিড়বিড় করে জবাব দিল, তোর খপর নিতে এলাম…রোজই তো আসি।
–কেন, বড় খবরটা তোমার কানে ঢোকেনি? লোকে কি বলছে শোনোনি?
আট বছরের বড় দিদিকে হারাণ মণ্ডল যখন বিয়ে করে নিয়ে যায়, এ-মেয়ের তখন ন’বছর মাত্র বয়েস। এখন যে চোখেই দেখুক, বড় আদরেরই তে। ছিল। রাগত মুখে বলে উঠল, যারা বলে তাদের জিভ খসি যাবে!
জবাব শুনে রাধা ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো একট। ঠোঁটে হাসির আভাস।–হুঁ?..আচ্ছা খপর নিতে এয়েছে। যখন ভালো করেই নাও, ঘরে এসে বোসো।
হারাণ মণ্ডল বিস্ময়ে হাবুডুবু খেতে খেতে দাওয়ায় এসে উঠল, চপ্পল খুলে ভিতরেও ঢুকল। এই মেয়ে আগে তাকে কথায় কথায় নাকাল করে মজা পেত, মাঝে একটা বছর তার দিকে মুখ তুলেও তাকায়নি। রাধা আবার সেই পুরনো দিনে ফিরে এলে তার থেকে খুশি আর কে হবে?
রাধা মাটির মেঝেতে চাটাই পেতে দিল। বোসো বোনাই… খাবে কিছু?
এই ঘরেও হারাণ এক বছর বাদে ঢুকতে পেল। বসে জবাব দিল, আজ বেলায় খেয়ে বেরিয়েছি…কতদিন তো খিদের মুখে ফিরে যাই, খপরও নিস না
–আ-হা, রাধার যেন কাতর মুখ, তোমার খাবার জিনিস যে আমার ঘরে থাকে না, আজও নেই তবু ভালোবেসে জিগেস করে ফেললাম।
হারাণ মণ্ডল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো।
-বুঝতে পারছনি? বলি ভাং সিদ্ধির মাত্রা দিদির শোকে ক’গুণ বেড়েছে, দু’গুণ না চার গুণ?
হারাণ মণ্ডল আবারও হকচকিয়ে গেল, মাথা হেঁট একটু। বেচারার একলা ঘরে নেশা বলতে ভাঙে, নেশা। রাতে ওই নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে। মাত্রাও আগে থেকে ঢের বেড়েছে, তবে দু’গুণ কি চার গুণ বলতে পারবে না। এখন আবার শুধু ভাঙে হয় না, সঙ্গে এটা-ওটা মেশাতে হয়। কিন্তু রাধার মুখে হঠাৎ এসব কথা কেন! মুখ তুলে যা দেখল তা-ও যেন বিশ্বাস হয় না। রাধা তার দিকে চেয়ে টিপটিপ হাসছে।
-কি বলবি বল…
-বলব? শুনে আবার ভিরমি খাবে না তো? বিয়ের নামে তো জিভ দিয়ে টসটস করে জল গড়াতো, এখনো সে সাধ আছে গেছে?
সাহস করে হারাণ মণ্ডল গলা দিয়ে শব্দ পর্যন্ত বার করতে পারছে না।
রাধা একটু চেয়ে থেকে আবার বলল, সাধ যদি থাকে তো সোজা এখেন থেকে কপালী বাবার কাছে যাও, দিনক্ষণ ঠিক করে একেবারে বর সেজে এসো।
হারাণ মণ্ডলের হৃৎপিণ্ডটাই বুঝি বুক ঠেলে বেরিয়ে আসবে। বিশ্বাস করবে না করবে না? বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আমি বে করব…মানে তোকে?
রাধা ঝামটা দিয়ে উঠল, না আমাকে কেন–ওই বিলাসী বুড়ীকে!
এই লোককে ঘরে ঢুকতে দেখেবিলাসী সন্তর্পণে দাওযার দেয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে কথা-বার্তা শুনছিল। হঠাৎ এই মুখ ঝামটা কানে আসতে দু’আঙুল জিভ কামড়ে ছুট লাগালো।
এ-দিকে আনন্দে দিশেহারা হারাণ মণ্ডলও ঘর ছেড়ে বেরুবার মুখে বাধা পড়ল।শোনো বোনাই!
নিশ্বাস বন্ধ করে হারাণ ঘুরে দাঁড়ালো। হাসি চাপার চেষ্টায় ডাগর দুই চোখ পাকিয়ে রাধা বলল, এখন পর্যন্ত বোনাই বলব না তো কি বলব?
বিগলিত হারাণ মণ্ডল জবাব দিল, তোর যা খুশি তাই বল
-ও-বাব্বা! তা শোনো আগে থাকতে বলে রাখি, বে’র পর আমি কারো ঘর করতি যেতে পারব নি, এখান থেকে ঠাঁই-নাড়াও হব না, তোমার যখন ইচ্ছে এখেনে যখন ইচ্ছে বিষ্টুপুরে থাকবে…কিন্তু আমাকে নিয়ে টানাটানি করলে বে ভেঙে দেব জেনে রাখো।
–ঠিক আছে ঠিক আছে। তোর ইচ্ছা মতোই সব হবে।
খেয়ালী মেয়ের আবার পাছে মত বদলায় সেই ভয়ে পড়িমরি করে সে কপালী বাবার ডেরার দিকে ছুটল।
.
এদিন একটু রাত করে কপালী বাবা রাধার খোঁজে এলেন। ওকে সামনে পেয়েই বললেন, কি রে পাগলী, দুই ডবল বয়সের বোনাইকে বেছে নিলি শেষ পর্যন্ত।
রাধা হেসেই জবাব দিল, ডবল হবে না, বছর তেরো-চোদ্দ বড় হবে। তা শিবের বয়সের কি আর গাছ পাথর আছে!…একদিক থেকে খুব মিল বুঝলে বাবা, ভাং খেয়ে ব্যোম হয়ে পড়ে থাকে।
দিন কয়েকের মধ্যে কপালী বাবা হারাণ মণ্ডল আর রাধাকে তার জংলি কালীর সামনে বসিয়ে তন্ত্রমতে বিয়ে দিয়ে দিলেন। তার জনাকয়েক চেলা কেবল এ-বিয়ের সাক্ষী থাকল। মা-কালীকে প্রণাম করে রাধা মনে মনে প্রার্থনা করল, কেউ না থাকলে নয় বুঝে এই একজনকেই নিলাম, কিন্তু দিদির ব্রত কোনো না যেন মা-গা, তার থেকে বরং আমি সন্তান চাই না।
রাধার বিয়ে আর সেটা কিনা ভগ্নিপতি হারাণ মণ্ডলের সঙ্গে। দু দিনের মধ্যে এখবর কেবল মাতন জয়নগর বা বিষ্টুপুর কেন, দূরে দূরেও ছড়িয়ে গেল। এমন ভক্তিমতী মেয়েটাকে ডাকাতে ধরে নিয়ে গেছল শুনে তারা কতটা বিষণ্ণ হয়েছিল, ক’দিনের মধ্যে তার বিয়ের খবর শুনে ততোটাই খুশি তারাও যেচে এসে শুভেচ্ছা জানিয়ে এটা-সেটা দিয়ে গেল। আর কাছের মানুষদে তো ভিড়ই পড়ে গেল। আবার ঠারেঠোরে এমন কথাও বাতাসে উড়ল যে, তিন তিনটে ডাকাতের পাল্লায় পড়েছিল, কোন্ বিপদ ঘটে সেই ভয়ে এমন তড়িঘড়ি বিয়ে এবং ভগ্নিপতিকে বিয়ে কিন্তু বিশিষ্টজনদের আনাগোনার ফলে এই কুৎসা তেমন সোচ্চার হয়ে উঠতে পারেনি। কালীভক্ত দোতারবাবু এসে একশ এক টাকা দিয়ে আশীর্বাদ করে গেছেন, রুমা সেন আর বিন্দুবাসিনী দেবী রাধাকে একখানা করে গয়না দিয়ে গেছেন। সঙ্গে একজনের ভাগ্নে অন্যজনের ছেলে ছিল। –হ্যাঁ, মন বিষিয়ে ছিল বলে রাধারই চোখের দোষ হয়ে ছিল। এই দুজনের চোখে এখন আর লোভের ছোবল দেখছে না-ও সি অংশুমান ঘোষের স্ত্রী খুব সুন্দর একখানা শাড়ি দিয়েছেন। রাধা বলেই এ ধরনের বিয়ের পরেও তার প্রাপ্তি যোগ খুব কম হল না।
মন বিষিয়ে আছে কেবল মনোহর পাইক আর নিতাই স্যাকরার। এই কারণেই দুজনের ভাব এখন। বাবার কাছে এক চেলার মুখের খবর, নিতাইয়ের দোকানে বসে মনোহর নাকি বুক ঠুকে বলেছে, রাধাকে সে একদিন না একদিন চরম শিক্ষা দেবেই দেবে–না যদি পারে তাহলে ওকে যেন সবাই বে-জন্মা বলে। দোতারবাবুর বাজার সরকারও বাবাকে ভয়-ভক্তি করে। সে-ও এসে চুপিচুপি বলে গেছে, হাওয়া ভালো নয়, মনোহর পাইকের মেজাজ ভালো মতো বিগড়েছে। এখানকার মস্তানদের লিডার হিসাবে মনোহরের ক্রোধ দুর্বলের গর্জন বলে ভাবে না কেউ।
কিন্তু মনোহর পাইক চতুর কত সেটা কপালী বাবার বুঝতে বাকি। ক’দিন না যেতে তারও মনে হয়েছে ভিতরের ক্রোধ একটু বেশি জাহির করে ফেলেছে। বাইরে অনেকেই তাকে একটু সমঝে চলে বটে, কিন্তু রাধা আর বাবার ভক্তের সংখ্যা কম ন্য।-না, বাবাকে অন্তত সে বিৰূপ করে তুলতে চায় না এখন। যেসব কাজে-কর্মে ভিড়েছে, তাতে বাবার ভক্ত হিসেবে তার পরিচয় আরো উজ্জ্বল হওয়া বরং বাঞ্ছনীয়।
বুদ্ধিটা মাথায় আসতেই রাতে দামী বোতল নিয়ে বাবার কাছে হাজির। তাকে দেখেই বাবার রক্তচক্ষু। বোতল পায়ের কাছে রেখে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করে উঠতেই তিনি ব্যঙ্গম্বরে বলে উঠলেন, আবার এসব ভড়ং কেন, তোরা শালারা তো রাধার শেষ দেখে নিবি বলে শাসাচ্ছিস শুনলাম।
করজোড়ে মনোহর বলল, মানুষ ক্ষ্যাপা হয়ে গেলে কি হয় তোমার তো জানা আছে বাবা–দুঃখে যন্ত্রণায় আমার কি মাথার ঠিক ছেল! মাথা এট্ট ঠাণ্ডা হতে মনে হল, যা হয়ে গেছে, এরপর বাবার ছিচরণ খোয়ালে তো সই গেল–যা বলেছি সেসব ক্ষ্যাপা কুকুরের কথা বাবা, সব ভুলে মানা করে দাও।
এরপর খুশি হয়ে বাবা বোতল খুলেছেন। উপদেশ দিয়েছেন, এবারে তুই দেখে শুনে একটা বে করে ফ্যাল
মুখখানা কালি করে মনোহর মাথা নেড়েছে। বলেছে, সেই ছেলেবেলা থেকে আশা হিল থাকে ঘরে আনব, তা যখন হলনি, আর বে নয়।
এসব কথা বাবা পরদিনই রাধাকে বলেছেন। শুনেই রাগতমুখে রাধা বলে উঠেছে, ও একটা পাজির পা-ঝাড়া বাবা, ওর কোন কথা বিশ্বাস কোরো না।
বলেছে বটে, কিন্তু কোথাও একটু খচখচ করে লেগেছে। সেই ছেলেবেলা থেকে পিছনে লেগেছিল, সত্যি কথাই। ওর বিয়ের সাধ ভালো হাতে মেটানোর জন্য লাল পিঁপড়ের কামড় খাইয়ে একেবারে আধমরা করেছিল। একটু চুপ করে থেকে রাধা আবার বলেছে, ওর চরিত্তি আমার জানা আছে, তুমি থমকে বলে দাও এক মাসের মধ্যে বে করতি হবে। ঠিক করবে দেখে নিও, এ, রাধার জন্যি একেবারে বিবাগী দশা–বে করবে না।
.
ডাক এলেই রাখা আবার গান গাইতে যায়। কিন্তু সর্বত্র আসরে প্রথম যে গানটি গায় তা হল ডাকাতে ধরার ফলে যে কুৎসা রটেছিল তার সরস জবাব। এ-গানও নিজের মন থেকে উঠেছিল, পাছে তুলে যায় তাই লিখে রেখেছিল। নিজের সুরে বাঁধা ওই গানটাই প্রথমে গায়। লোকে কান পেতে শোনে, খুশিতে মন ভরে ওঠে, আবার চোখও সজল হয়। রাধা চোখ বুজে দুলে দুলে গায়ঃ
তুই কালের বুকে দাঁড়ায়ে কালী।
চার আঙুল লাজ দেখালি,
মা আলো (আর) তার মেয়ে কালো
এমন বিচার কোথায় পেলি?
নিজে সাজলে দিগম্বরী
সবাই বলে আহা মরি।
মেয়ে রয় বসন পরি
তবু বলে লাজে মরি!
মা তোর সবই দেখি উল্টা পালটা
মা সতী আর মেয়ে কুলটা!
এবার মাগো রঙ্গ ছাড়
হতেছে খুব বাড়াবাড়ি,
(মা) যদি রাখতে চাস নিজের মান
তবে মায়ে-মেয়ে কর সমান।
পাড়ার কালীপুজোর আমন্ত্রণে সৌজন্য রক্ষার্থে সস্ত্রীক এসে ওর মুখে এ-গান অংশুমানও শুনেছেন। ভালো লেগেছিল। ওই এক গানেই আসর জমিয়ে দিয়েছিল। সুচারু দেবী সানন্দে জানিয়েছেন, ওর মুখে এ-গান আমি আরো দুবার দু’জায়গায় শুনেছি। ডাকাতে ধরে নিয়ে যাবার পর সেই যে নানা কুৎসা রটেছিল, তার জবাব দেবার জন্য এ-গান ও নিজে বেঁধেছে!
অংশুমান কোনো মন্তব্য করেননি। কিছুদিনের মধ্যে সুচারু দেবী মেয়ে-জামাই দুজনকেই নেমন্তন্ন করেছেন। রাধা প্রথম এসে তার বাড়িতে উপোসী থেকে গেছে, এ খেদ তার যায়নি। ওদের আনার জন্য জিপও পাঠিয়েছেন। কিন্তু রাধা একলা এসেছে। অন্য জনের কথা জিগ্যেস করতে হেসে বলেছে, জামাই তোমাদের রাতের ভাঙের জের কাটাতে নিমানেও ঢুলুঢুলু–তাকে কে আনে। পরের আড়াই তিন বছরের মধ্যে রাধা আর বার-তিনেক সুচারু দেবীর নেমন্তন্ন রাখতে কোয়ার্টারসে এসেছে। বাড়িতে কোনো আনন্দ অনুষ্ঠান হলেই রাধার নেমন্তন্ন। সব বাড়িতেই রাধার কদর কত সুচারু দেবী তা স্বচক্ষে দেখে আসছেন। অংশুমান মুখে প্রকাশ করেন না, কিন্তু মেয়েটার ভারি সহজ চালচলন সাদাসাপটা কথাবার্তা তারও ভালোই লাগে। অবশ্য স্ত্রীর মতো নয়, তাঁর বিশ্বাসের আবেগ অন্যরকম।
তৃতীয়বার রাধা আসতে তার এমনি সাদাসাপটা কথা শুনে অংশুমান কিন্তু রেগেই গেছলেন।…তার তিন বছর হয়ে গেল এখানে, এবার কেবল বদলি নয়, মনে মনে প্রমোশনের আশা করছেন। এমএসসি ডিগ্রি আর চাকরির রেকর্ডের বিবেচনায় এটা দুরাশা কিছু নয়। তাছাড়া তিন থেকে চার বছরের মধ্যে বদলি তো তারা হয়েই থাকেন।
খাওয়া-দাওয়ার পর এটা-সেটা গল্প হচ্ছিল। অংশুমান সামনে বসে সেদিনের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিলেন, কলকাতার ইংরেজী বাংলা কাগজদুটো বেশ দেরিতে আসে, সকালে প্রায়ই ভালো করে পড়া হয়ে ওঠে না।
কথায় কথায় সুচারু দেবী বললেন, হ্যাঁরে রাধা ডাক্তার গিন্নির কোন্ বোনকে দেখে আর তার খুব বিপদের কথা শুনে তুই নাকি বলে দিয়েছিলি পনেরো দিনের মধ্যে সব বিপদ কেটে যাবে–তাই হয়েছিল, সত্যি নাকি?
লজ্জা পেয়ে রাধা বলল, আমি বলার কে, মা বলালে, বলি ফেললাম, ডাক্তার দিদির বোন কান্নাকাটি করছেল সোয়ামীর ব্যাঙ্কের কি গণ্ডগোলে তার বিচার চলছে, শাস্তি হলে চাকরি যাবে জেল হবে, তা ভদ্রলোকের মুখে চেয়ে আমি কোনো বিপদের হেঁয়াই দেখলাম না, কিন্তু ওই বোনের কান্না দেখে ঘাবড়ে গেলাম, তখন মা বলে দিলে কিচ্ছুটি হবে না।
অংশুমান তখনো মুখ থেকে কাগজ সরাননি। কাকতালীয় ব্যাপার কিছু ঘটেছে ধরে নিয়ে মনে মনে হাসছেন। স্ত্রী হঠাৎ সাগ্রহে জিগ্যেস করে বসলেন, তা তোর বড়বাবুকে দেখে বলে দে না, বদলির তো সময় হয়ে আসছে, এবার প্রমোশন মানে উন্নতি টুন্নতি কিছু হবে কি না?
মুখ থেকে অংশুমান এবার কাগজ সরালেন। স্ত্রীর বিশ্বাসের বহর দেখে কৌতুকই বোধ করছেন। রাধা একটু ঘুরে তাঁর দিকে কয়েক পলক চেয়ে রইলো, তারপর তার স্ত্রীর দিকে ফিরে আসতে করে বলে বসল, তোমরা এখন ইখেন থেকে নতুছ টড়হ না-গো দিদি, আমাদের ভাগ্যিতে ইখেনেই তোমরা আরো অনেক বছর আছ।
শুনেই অংশুমান বিরক্তিতে ভুরু কোচকালেন। এদিকে সুচারু দেবী বলে উঠলেন, বলিস কি রে তুইমার ছ’মাস এক বছরের মধ্যে তো নড়তেই হবে, তাছাড়া উন্নতিও হবার কথা।
নেই অংশুমান তাকেই খেঁকিয়ে উঠলেন, এসব তোমাকে কে জিগ্যেস করতে বলেছে-বুজরুকির কথা শুনতে খুব ভালো লাগে –কেমন?
বড়বাবুর হঠাৎ এই রাগ দেখে রাধা প্রথমে বেশ অবাক। তারপর গম্ভীর। মোড়া ছেড়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো। স্থির চোখে মুখের দিকে চেয়ে বইলো খানিক। ধীর ঠাণ্ডা গলায় বলল, বুজরুকির কথা আমি বলি না বড়বাবু, মা সহজে বলায় না, কিন্তু রগড় দেখার জন্য হঠাৎ হঠাৎ কেন যে বল তা-ও জানি না, বাগ করো আর যা-ই কবে এখন অনেক বছরের মধ্যি তোমার নড়া-চড়া বা উন্নতি-টুন্নতি কিছুই হবেনি, ইখেনেই থাকতে হবে তোমাকে বড়বাবু।
এবারে অংশুমান আরো রেগে গেলেন। বলে উঠলেন, আর তার অনেক আগে যদি আমাকে এখান থেকে যেতে হয় তাহলে যে-কোনো ছুতোষ আমি তোকে এখানকার লক-আপে ঢুকিয়ে রেখে যাব জেনে রাখিস।
-কোথায় ঢুকিয়ে রাখবে?
অংশুমান চেঁচিয়ে উঠলেন, এখানকার গারদে–বুঝলি? সহজে যাতে না ছাড়ে সেই ব্যবস্থা করে যাব।
এবারে বাধা হেসে মাথা হেলালো। তাই কোরো, এক বছর ছেড়ে তিন বছরে তুমি ঠাঁই না হলে আমি নিজে তোমার লোক অপের বাসিলে হব।
…একটা বছরের ওপর ঘুরে গেল। অংশুমান নিজে কলকাতায় এসে তদবির করে গেছেন। কিন্তু প্রশাসনের চেহারাই তখন অন্য বকম। চতুর্থ জেনারেল ইলেকশনে হেরে প্রযুল্ল সেনকে সরে যেতে হয়েছে, তার জায়গায় অজয় মুখার্জি মুখ্যমন্ত্রী, তার কিছুদিনের মধ্যে প্রফুল্ল ঘোষ। পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা তখন নিজেদের নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। মফস্বলের এ পর্যায়ের কর্মচারীর ব্যক্তিগতভাবে কার কি ক্ষতি হচ্ছে দেখার ফুরসৎ নেই।
শুনে সুচারু দেবী চিন্তিত। মেয়েটা তাহলে কি কথা বলে গেছল গো?
অংশুমান বিরক্ত। ছাড়ো তে! কলকাতার বাবুদের কি এভাবেই চলবে নাকি? এখন না হয় ছ’মাস আট মাসের মধ্যে হবে!
*
ডাক্তার বিজন চৌধুরীর মুখে খবরটা শুনে সুচারু দেবী তো কেঁদেই ফেললেন, মনে যত রাগই থাক অংশুমানও স্তম্ভিত।
রাধার স্বামী হারাণ মণ্ডল মারা গেল। সেরিব্রাল থ্রম্বসিস, এক থাবাতেই দেহের একদিক পড়ে গেছে, গত কাল বিকেলে খবর পেয়ে ডাঃ চৌধুরী ছুটে গেছলেন, আজ গিয়ে ডেথ সারটিফিকেট লিখে দিয়ে এলেন।
রাধার তেইশ বছর বয়েস মাত্র।
ডাক্তারের পরের কথায় স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বিস্মিত। বললেন, আশ্চর্য মেয়ে মশাই আর তেমনি স্নায়ুর জোর। কান্নাকাটি হা-হুতাশ কিচ্ছু নেই। উল্টে ঠাণ্ডা মুখে তাকে নাকি বলেছেন, এরকম কিছু একটা ঘটবে ও আগেই বুঝেছে, করাত ধরে খুব বাজে স্বপ্ন দেখছিল।
কি স্বপ্ন সেটা তিনি বলতে পারলেন না, জিগ্যেস করার সময়ও নয়।
রাধার চার বছরের বিবাহিত জীবনে হারাণ মণ্ডলের অস্তিত্ব প্রায় নিষ্প্রভই ছিল। তার বাইরের কাঠামো দেখে বোঝা যায়নি ভাঙের সঙ্গে নানা ছাই-ভস্ম মিশিয়ে খেয়ে খেয়ে জীবনী শক্তি কত ঝঝিরা করে ফেলেছে। রাধার মতো বউ পেয়েই খুশি, কিন্তু তার সাধ যতো ছিল সাধ্য ততো ছিল না। কিন্তু এ নিয়ে রাধার খুব একটা অভিযোগ ছিল না। নেশা ছাড়াতে চেষ্টা করে দ্যাখে লোকটার খাবিখাওয়া মাছের মতো প্রাণ যায় যায়। তাই চেষ্টা ছেড়েছে। লোকটা তার কথায় ওঠে-বসে, রাধা নিজের মন মেজাজ আর ভাব নিয়ে বেশ আছে।
কেবল এক ব্যাপারে বয়স্ক মানুষটার ওপর খুব বিরক্ত। লোকটার শোয়া বড় খারাপ। নেশার ঘোরে কিনা জানে না, জায়গা পেলে বেহুশ ঘুমে ঘরের চারদিকে গড়াবে। এদিকে তার ঘরের মাটির দেয়ালে ঠেস-দেওয়া সারি সারি ছবি বসানো। মাঝখানে মা-কালীর বড় ছবি, তারপর শিবের। এদের এক পাশে ফকির সাহেবের দেওয়া মলোঙ্গা বাবার ছবি, বড়পীরের ছবি। অন্যদিকে শফিদার মায়ের দেওয়া বনবিবি আর বিবিমায়ের ছবি। বনবিবির পায়ের কাছে তিন-তিনটে বাঘ। রাধা রোজ সক্কলের সামনে ফুল-জল রাখে, ভক্তিভরে সবাইকে প্রণাম করে। গান গেয়ে বা কপালী বাবার জংলি মায়ের আরতি দেখে রাধার ফিরতে একটু রাত হয়ই। কিন্তু এসেই সেই এক দৃশ্য তাকে দেখতেই হবে। মানুষটার লুংগি ঠিক থাকে না বলে রাধার হুকুমে তাকে একটা পাজামা পরে শুতে হয়। কিন্তু ঘুমের মধ্যে গড়াতে গড়াতে কোনো না কোনো ছবির গায়ে তার পা ঠেকবেই।
রাধা আঁতকে উঠে চেঁচামেচি করে ছুটে আসে, বকাবকি করতে করতে ধাক্কা মেরে মেরে ঠেলে ঠেলে তাকে জায়গায় নিয়ে যায়। নেশার ঘোরে লোকটা বিড়বিড় করে কি বলে, আবার ঘুমিয়ে পড়ে। যার গায়ে পা ঠেকেছে অনেকক্ষণ ধরে তাকে তো বটেই, বাকি সব ছবিতে ভক্তিভরে প্রণাম করে তবে স্বস্তি। কতদিন সকালে বকাঝকা করেছে, এঘরে আর তোমার ঠাঁই হবে না, পিছনের ওই চালা ঘরে তোমার শোবার ব্যবস্থা করব।
বেজার মুখ করে হারাণ বলে, আমি কি ইচ্ছে করে তোর ঠাকুরের গা ছুঁই?
সে রাতে ঘুমনোর আগে রাধা ঘরে থাকলে আর এরকম হয় না, ওকে ডিঙিয়ে তো আর যেতে পারে না। বিছানা পেতে মাঝখানে উঁচু করে কিছু রেখে গেলেও এক-এক রাতে এসে দেখে সে-সব ঠেলেঠুলে ঠিক ফোটোর দিকে বা কোনো ফোটোর গায়ে তার পা। ভেবেচিন্তে রাধা এরপর একটা পাকা ব্যবস্থা করল। ওর নিজের একটা বড়সড় আর উঁচু টিনের বাক্স আছে, আর হারাণের তার থেকে একটা হোট বাক্স আছে। বিছানা পেতে সেই দুই বাক্স মাঝখানে রেখে তবে বেরুত। ফিরে এসে সে দুটো সরিয়ে তবে নিজের শোয়া।
তা সত্ত্বেও নেশার ঘোরে জায়গা ভুল করে সে এক-একদিন রাধার জায়গায় শুয়ে পড়ে। ছবিগুলোর তখন বিতিকিচ্ছিরি দশা। বিলাসীকে বকাবকি করার পর এ-ও অবশ্য কমেছে। লোকটার হুশ থাকতে থাকতে সে-ই দেখে নেয় ঠিক জায়গায় শোয় হল কিনা। হপ্তা তিনেক আগে রাধা বিকেলের দিকে বেরিয়েছিল। সন্ধ্যার মধ্যেই ফেরার কথা। কিন্তু এমন আটকে গেল, ফিরতে রাত নটা। মনে যে আশংকা ছিল এসে দেখে তার থেকেও বিপত্তি। বিছানার মাঝ খানে বিলাসী বাক্স পেতে দেবে এমন আশা করাও ভুল। লোকটা চিৎপাত হয়ে ছবিগুলোর উপরে পড়ে আছে।
তার পর থেকেই রাধা মাঝে মাঝে বিদিকিচ্ছিরি স্বপ্ন দেখে চলেছে। একদিন দেখল মায়ের খা রক্তে ভেজা, কোনদিন দেখল শিবের মাথার সাপ ফণা উঁচিয়ে ফোঁস ফোঁস করে কারো দিকে তেড়ে যাচ্ছে। একদিনের স্বপ্ন, বনবিবির পায়ের কাছ থেকে বাঘ তিনটে জীবন্ত হয়ে উঠে সগর্জনে কারো দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
এর দুদিন বাদে হারাণ মণ্ডল মারা গেল।
.
একটা বছরের ওপর কেটে গেল, আটষট্টি সাল পেরিয়ে উনসত্তর চলছে। ও সি হিসেবে অংশুমানের এখানে ছ’ বছর চলেছে। যেমন হতাশ তেমনি বিরক্ত। প্রশাসনের স্থিতি আসা দুরে থাক, দিনে দিনে আরো জটিল হয়ে পড়েছে। গেল বছরে প্রেসিডেন্ট রুল গেছে, তার প্রতিক্রিয়া পুলিশ কতৃপক্ষের ওপরেও পড়েছে। এ বছর আবার দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার শাসনে এসেছে, অজয় মুখার্জি মুখ্যমন্ত্রী, জ্যোতি বসু উপমুখ্যমন্ত্রী। এই সরকারের স্থিতিশীলতা অনিশ্চিত, পুলিশ প্রশাসনেরও বিশেষ কাউকে নিয়ে মাথা ঘামানোর অবকাশ নেই। তার ওপর নকশাল উপদ্রব নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে, ফলে শক্ত অফিসার হিসেবে অংশুমানের সুনামই তাঁর ক্ষতির কারণ। বড় কর্তাদের কাছ থেকে বন্ধ খামে যা আসে তার বেশির ভাগই সতর্ক তৎপরতার আদেশ বা নির্দেশ।
মনের এই অবস্থায় অনেক দিন পরে রাধার সঙ্গে দেখা। সঙ্গে স্ত্রী সুচারু দেবী।
তাঁর সঙ্গেও রাধার দেখা সাক্ষাৎ কমে গেছে, কারণ, বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান ছাড়া রাধা বাড়ি যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। হারাণ মণ্ডল মারা যাবার পর সুচারু দেবী একবার এসেছিলেন। ওকে তেমন শোকগ্রস্ত না দেখে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। কিন্তু তারপর ডেকেও আর তাকে বাড়িতে আনতে পারেননি। ইতিমধ্যে ডাক্তার গিন্নির বাড়িতেও সে আর আসেনি। মাঝে একবার মাত্র তার গান আছে শুনে ডাক্তার গিন্নিকে সঙ্গে নিয়ে দু’মাইল দূরের এক অনুষ্ঠানে গেছলেন। তখন দেখা হয়েছে। কিন্তু রাধাকে তখন অনেকে ঘিরে, কথা বলার সুযোগ হয়নি। দোতারাবাবুর মারফৎ রাধাকে একবার দেখা করার কথা অংশুমান নিজে মুখ ফুটে বলে পাঠিয়েছিলেন। এখানে আসার অনেক দিন পরে দোতারাবাবুর সঙ্গে আত্মীয়তার যোগসূত্র বেরিয়ে পড়েছিল। তার স্ত্রীর দুর সম্পর্কের কিরকম ভাই হন। বয়সে অংশুমানের থেকেও পাঁচ-ছ বছরের বড়। এদিকে এলে মাঝে মাঝে কোয়ার্টারস-এ আসেন। খোলামেলা মনের দূর-সম্পর্কের এই কালীভক্ত দাদাটিকে সুচারু দেবীর ভালো তো লাগেই, অংশুমানও পছন্দ করেন। তাঁর মারফৎ রাধাকে আসতে বলার কারণ স্ত্রীর ক্ষোভ আর চাপা গঞ্জনা। ওর প্রসঙ্গ উঠলেই বসেন, ও এখানে আর আসবে কেন, বাড়িতে নেমন্তন্ন করে এনে যে মূর্তি দেখিয়েছ। এখন ওর কথাই ফলছে কিনা?
ব্যাপার শুনে দোতারাবাবু হেসেছিলেন আবার একটু অবাকও হয়েছিলেন। বলেছিলেন, কখন যে কি মুডে থাকে মেয়েটা কিন্তু ও ভবিষ্যদ্বাণী-টানি করে এতো জানতাম না। তারপর সুচারু দেবীকে বলেছেন, তবে নিশ্চিন্ত থাকো, ও কারো ওপর রাগ পুষে রাখার মেয়েই নয়, এখন কারো বাড়িতেই বিশেষ যায়টায় না, ওর গান শোনার ইচ্ছে হলে আমাকেই এখন কপালী বাবার ডেরায় যেতে হয়, সন্ধ্যার পর বেশির ভাগ সময় সেখানেই পড়ে থাকে, জংলি কালীকে গান শোনায়। আমার বাড়িতে বিগ্রহ নেই, রুমা সেন আর বিন্দুবাসিনী দেবীর বাড়িতে গোপালের বিগ্রহ আছে, কেবল ওই দু’ বাড়িতে যায় শুনেছি। তবু বলব’খন।
থানার বড়বাবু যেতে অনুরোধ করেছেন শুনে রাধা বলেছে, মন না টানলে কোথাও তোত যেতে পারি না, দেখি–
গেল বারে কালীপুজো উপলক্ষে রাধা কোথাও গাইতে বেরোয়নি, এবারে এসেছে। সুচারু দেবী স্বামীকে আগে থাকতেই তাড়া দিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু এমনই চাকরি পুলিশের, বেরুবার ঠিক আগে দুটো ছেলেকে নকশাল সন্দেহে ধরে আনা হয়েছে, তারা নাকি কোথাকার এক খুনের ব্যাপারে জড়িত।
ঝামেলা তখনকার মতো চাপা দিয়ে এসে পৌঁছুলেন যখন, রাধার সবে তখন তৃতীয় গান শেষ হয়েছে। শ্রোতাদের এবারের তাগিদ, ক্ষ্যাপা বাবার গান, বামা ক্ষ্যাপার সেই গান থোক।
দেরির জন্য সুচারু দেবী স্বামীর ওপর বিরক্ত, কিন্তু তক্তাপোষের ওপর সাদা চাদর বিছানো মঞ্চে রাধাকে দেখে তাঁর দু’চোখ জুড়িয়ে গেল। পরনে চওড়া হালকা নীল-পাড় আনকোরা শাড়ি, গায়ে সেই রঙের ব্লাউস, পিঠের ওপর খোলা চুল ছড়ানো। মঞ্চে জোরালো আলো। সেই আলোয় চব্বিশের উপছানো কালো রূপের যৌবন শুধুই যেন শান্ত ভাবের শাসনে বাঁধা। হাটু মুড়ে পিছ-পা করে বসা, মেরুদণ্ড সোজা। দু’চোখ বোজা, অল্প অল্প দুলছে।
অস্ফুট স্বরে সুচারু দেবী বললেন, আগের থেকেও কত সুন্দর লাগছে ওকে দেখতে–আ-হা!
শেষের আ-হাটুকু অকাল বৈধব্যের কারণে। গান শুরু হতে শ্রোতারা একেবারে চুপ।
তুই যেমন মা ধনীর বেটী বাবা তেমন ধনীর বেটা।
বুড়োবৃষ সিদ্ধির ঝোলা এই তোমাদের পুঁজিপাটা।
ধন দিবি তোর মাথা মুণ্ড, বাবার তরে বিষের ভাণ্ড
তোমার সম্বল নরমুণ্ড, হাতে একটা গলায় কটা।
বাস বিনা শ্মশানবাসিনী বস্ত্ৰবিনা উলঙ্গিনী
অন্ন বিনা ত্রিশূলপাণি, পায়ে পড়ে দেখায় ঘটা।
ঘুরে ফিরে দুবার করে গাইল। একটু স্থির হয়ে বসে থেকে আবার অনুরোধ আসার আগেই উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে মাথা নুইয়ে সকলের উদ্দেশ্যে নমস্কার করল।
বেশি না হলেও রাধার গান অংশুমান আগেও শুনেছেন। খারাপ অবশ্যই লাগেনি। কিন্তু কোনরকম ভাব বা আবেগের যোগ ছিল না। অথচ আশ্চর্য, আজ চোখের কোণ দুটো কি রকম শিরশির করে উঠল, বুকের তলার অনুভূতিটুকুও অন্যরকম। গানের দরুণ নয়, নিজের মনেই একটু পরিবর্তনের আভাস পাচ্ছেন।
আগেই বলা ছিল, উঠে দুজনে সামনের ক্লাবঘরে গিয়ে দাঁড়ালেন। মিনিট দুই বাদে একজন ভলান্টিয়ার রাধাকে তাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে গেল।
দেখেই রাধা খুশি।–ও মা, বড়বাবু যে! দিদি কেমন আছ?
সুচারু দেবী তার হাত ধরলেন, আগে তোর কথা বল, আমাদের তো ত্যাগই করেছিস।
অপ্রতিভ মুখে নিজের দোষ স্বীকারই করল যেন। ডেকে পাঠিয়েছিলে তবু যেতে পারিনি–কিন্তু কি করি গো দিদি, মা যেন গলায় গামছা বেন্ধে টানি রেখেছে।
অংশুমান বললেন, তোর দিদির ধারণা আমার ওপর রাগ করেই তুই আর আসিস না
রাধার দু’চোখ বড় বড়, আমি রাগ করতি যাব কেন গোয় তার পরেই মনে পড়তে হেসে উঠল। তাই তো! তোমার ইখেন থেকে নড়ার কি হল গো বড়বাবু-ক’বছর হল?
অংশুমানের ভালো লাগছে, হালকা বোধ করছেন। জবাব দিলেন, অনেক বছর, নড়ার কি হল দেখতেই পাচ্ছি।
রাধা হেসে সুচারু দেবীকে বলল, রাগ করব কি, আমার মনেই ছেল না। বড়বাবুর দিকে ফিরল, দুঃখ করছ কেন, ভালোই তো আছ
এই প্রথম একটু দুর্বলতা ধরা পড়ল অংশুমানের।– ভালো করে দ্যাখ, দেখি, এ-রকম ভালোই এখন থেকে যাবে?
রাধার ডাগর দু’চোখ আস্তে আস্তে তার মুখের ওপর স্থির হল। অপলক কয়েক পলক। তারপর হালছাড়া গোছের করে জবাব দিল, হলনি, মা কিছু বলে দেল না, আমি কি কিছু জানি যে নিজে বাহাদুরি করে বলব!
এই জবাবই আজ কেন যেন সব থেকে ভালো লাগল অংশুমানের।
.
আরো একটা বছর গড়াতে চলল। রাধার পঁচিশের যৌবনে আবার একজনের পঞ্চার দিনে দিনে যেন অমোঘ হয়ে উঠছে। গোড়ায় গোড়ায় রেগে গেছে, সমস্ত সত্তা দিয়ে প্রতিরোধ করতে চেয়েছে। এখনো নিজের সঙ্গে যুঝছে, কপালী বাবার সঙ্গে যুঝছে, আর ওই একজনের সঙ্গেও যুঝছে। কিন্তু যোঝার জোর কমে আসছে তা-ও নিজেই অনুভব করছে।
ওই একজন মনোহর পাইক।
ক’বছর আগে কপালী বাবার কাছ থেকে ক্ষমা পাওয়ার ব্যাপারে একবার রাধার কাছেও এসেছিল মনোহর পাইক। কপালী বাবাই বলেছিলেন, আমি না-হয় ক্ষমা করলাম, কিন্তু রাধা ভুল বুঝছে, একবার তাকে বলে যা
আপোসের মুখই বটে তখন, কিন্তু দু’চোখে তখনো রাধা থেকে থেকে লোভ চিকিয়ে উঠতে দেখেছে। তবু সত্যিই রাগ করেনি, কারণ এত বছরের লোভ ছাড়ব বললেই একদিনে ছাড়া যায় না। কিন্তু মুখে রাগ দেখিয়েছে। বলেছে বিবাগী হবার দশা তোমার নয়, পয়সার জোর হয়েছে, খুঁজলে আমার থেকে ঢের ভালো আর ঢের সুন্দর মেয়ে পাবে, ফের যখন আসবে একেবারে বউ নিয়ে এসো।
মনোহর বলেছে, তুই ভালো থাক, আমার ভাবনা আমিই ভাবতে পারব।
কিছুদিন বাদে মনোহরের মা মারা গেল শুনে কর্তব্যের দায়ে এক বা তার ওখানে গেছল শোক যে কত মুখ দেখেই বোঝা গেছে। যতক্ষণ ছিল, লোভের চাউনি সর্বাঙ্গ ছেকে ধরে ছিল। রাধা দায় সেরে হাঁপ ফেলে ঘরে ফিরল পরের দু’বছরে অনেক গানের আসবেই রাধা তাকে দেখেছে। ভক্তির গানে কিছুমাত্র আগ্রহ নেই বাধা খুব ভালো করেই জানে! ছেলেবেলায় অনেক বার বলেছে, ও সব গান ছেড়ে সিনেমার গান শেখ না। কেবল দেখার টানেই আসে জানা কথা। কিন্তু বাক্যালাপ এর মধ্যে আর হয়নি।
হারাণ মণ্ডল মারা যাবার পর দেখা করতে আসেনি। বুদ্ধি আছে বলেই আসেনি। এলে রাখা হয়তো তাড়িয়েই দিত। বেশ ভালো করেই জানে ওই মৃত্যুতে খুশি কেবল এই একজনই হয়েছে। দু’দিন আগে হোক পরে হোক উৎপাত শুরু হবে জেনেই মনটাকে কঠিন করে তুলছিল। প্রথম মাস দুই রাধা কপালী বাবা অর্থাৎ জংলি কালীর কাছে গিয়ে বসে থাকত। খেয়াল খুশি মতো নাম করত। বিকেলে বিকেলে যাবার সময় রাধা পিছনের পুকুর পার ধরে জংলা পথে যায়, কিন্তু রাতে ফেরার সময় সদর দিয়েই ফিরতে হয়। এক এক রাতে সেখান থেকে বেরিয়ে দেখে সাইকেল নিয়ে ওই মূর্তি দাঁড়িয়ে। রাধা রাগে রি-রি করতে করতে বাড়ি ফেরে, কিন্তু সজ নিয়ে মনোহর একটি কথাও বলে না। রাধাকে ডেরা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে সাইকেলে চেপে চলে যায়।
এ-রকম বার দুই তিন হবার পর রাধা ঠিক করেছে যা বলার কপালী বাবাকে দিয়েই বলবে। কিন্তু পরদিন সন্ধ্যার পর ওই মূর্তি সোজা কপালী বাবার ডেরায় এসে হাজির। হাতে একটা টর্চ। সাইকেলটা দাওয়ায় ঠেস দিয়ে রেখে উঠে এলো। কপালী বাবাকে বেশির ভাগ লোক ভক্তি যত না করে ভয় হয়তো তার থেকে বেশি করে। রক্ত চক্ষু মেলে রাধা এই একজনের বুকের পাটা দেখল। টর্চটা কপালী বাবার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এটা ওকে দিয়ে দিও বাবা, এই গরমে যা সাপের উপদ্রব, অন্ধকারে পথ চলা ঠিক নয়।
সাপের উপদ্রব নতুন কিছু নয়, আর রাধা ছেলেবেলা থেকেই রাতে পায়ে হেঁটে চলা-ফেরা করছে। সাহস দেখে অবাক। আর বাবাও তেমনি, টর্চটা নেবে কি নেবে না ভেবে পাচ্ছেন না। রাধা হিসহিস করে বলে উঠল, আমাকে সাপে কাটুক বাঘে খাক তোমার তাতে কি?
জবাব না দিয়ে টর্চটা বাবার সামনে রেখে প্রস্থান করল। না রাধা ও-টর্চ ছোঁয়ও নি।
কিন্তু সাত আট মাস ধরে এরকম নীরব উপদ্রব বেড়েই চলল। রাধার ঘরের সামনের রাস্তা দিয়ে সাইকেলে কম করে বিশ ত্রিশবার যাতায়াত করে। আবার এক-একদিন সকালে ঘর ছেড়ে দাওয়ায় দাঁড়িয়েই রাধা দেখে সাইকেলে ঠেসে দিয়ে ওই মূর্তি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। চোখাচোখি হয়, রাধা দুচোখে ওকে ভস্ম করতে চায়। মনোহর পাইক নির্লিপ্ত মুখে সাইকেলে উঠে চলে যায়। একদিন গিয়ে দেখে সে আগে থাকতে কপালী বাবার ডেরায় জংলি কালীর সামনে বসে আছে। একদিন দেখামাত্র রাধা কপালী বাবার ওপরেই রাগে ফেটে পড়ল।-বলি এত লাই দিচ্ছ কেন, এখানে একটু নাম করতি আসি তা-ও বন্ধ করতি চাও?
ওর রাগ দেখেও কপালী বাবা হাসছেন। মনোহরের দিকে তাকালেন।–বললাম, ওর আসার সময় হয়েছে, পালা–এখন দোষটা পড়ল আমার ঘাড়ে।
মনোহর একটি কথাও বলল না। উঠে চলে গেল। রাধা সরোষে তাকে যেতে দেখল তারপর বাবার দিকে ফিরল। ওকে এরকম করে আসকরা দিচ্ছ কেন, তোমারও কি ইচ্ছে একটা বছর না যেতে আমি ওকে বিয়ে করে বসি।
একটু চেয়ে থেকে কপালী বাবা বললেন, বছর যেতে আর দেড় মাসও বাকি নেই।–তার পরে বিয়ে করতে রাজি আছিস?
রাধা তাজ্জব হয়ে চেয়ে রইলো খানিক। তারপর বলে উঠল, তোমাকে কি খুব বেশি বোতলের ওপর রেখেছে ও?
–তা রেখেছে।…আবার আমার একবার হিমালয়ে ঘুরে আসার সাধ দেখে খরচ যা লাগে তাও দেবে বলেছে।
রাধা কি নিজের কান দুটোকে বিশ্বাস করবে? বাবার হিমালয়ে ঘোরার অনেক দিনের সাধ জানে। আগে অনেক সময়ই রাধাকে বলেছেন, মা যদি যোগাযোগ করে দ্যান, এখানে এসে মায়ের পুজোটা তুই রোজ করে যেতে পারবি না? মন্ত্র-টন্ত্রের দরকার নেই, তোর মতো পুজো আর কেউ করতে পারবে না।
বাবা আবারও গম্ভীর তেমনি আমার কথা ছেড়ে দে, ওর মদ না খেলেও আমার দিন চলে যাবে, আর মা না চাইলে হিমালয়ও হবে না–ছোঁড়াটা আমাকে পাগল করে ছাড়ছে তা-ও না। আমার কথা তোর ভাবার দরকার নেই, কিন্তু তুই কি করবি সেটা খুব ভালো করে চিন্তা কর। আমার মাঝে মাঝে খটকা লাগে, মনোহর সেই ছেলেবেলা থেকে যে ভাবে তোকে চেয়ে আছে, বয়েস তিরিশ পার হতে চলল তবু বিয়ে করল না–ওর জন্যেই মা অমন হুট করে হারাণকে টেনে নিল কিনা।ও বলে হারাণকে তুই কেবল জেদ করে বিয়ে করেছিলি। সে যাক, তুই তোর মনের দিকে তাকা, মনটাকে খুব ভালো করে দেখে আর বুঝে নে, এভাবেই জীবনটাকে চালিয়ে দিবি এ-সংকল্পের যদি নড়চড় না হয় তাহলে মনোহরকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে আমার দুদিনও লাগবে না।
সেই রাতে নাম-গান করতে গিয়েও রাধা বিমনা হয়ে পড়ছিল। ঘরে ফিরেও অনেক রাত পর্যন্ত ছটফট করেছে। কপালী বাবা যেন ওর অগোচরে একটা পর্দা সামনে থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। নিজের মন দেখতে পাচ্ছে রাধা-যে একজন এসেছিল, সে তার জীবন বা যৌবনের দোসর হতে পারেনি। পরিপূর্ণ যৌবনের নারী-সত্তা যে এমন উপোসী, তার হদিস আর কি কখনো পেয়েছে। বাবা তার এ কি সর্বনাশ করে বসল? পরেই মনে হল, বাবা ওর নিজের মন দেখতে আর বুঝতে বলেছে শুধু। ওর ভিতরে রস-কষ নেই, এমনতো নয়, এই উপোসী সত্তাকে চোখ ঠেরে আর কতদিন দাবিয়ে রাখা যেত? এই প্রথম টের পেল তার ভিতরের ওই উপোসী রমণী সত্তা খুব স্থির হয়ে বসে নেই।
পরের রাতে রাধা জয়নগরের রুমা সেনের বাড়ি থেকে গান গেয়ে ফিরছিল। রাধাভাবে রাধা আবিষ্ট, রুমা সেন চোখের জলে ভেসেছেন।
মানা করি নাই রংগিনী আর যমুনায় যাইও না,
কালো রূপ লাগিলে অঙ্গে হেমাংগী আর রবে না।
রাধা সাইকেল রিকশয় ফিরছে। রাত দশটার কাছাকাছি। তাকে পৌঁছে দেবার জন্য রুমা সেনের ভাগ্নে অজয় গুপ্ত সাইকেলে পাশে পাশে আসছে। হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি খেয়ে একবার ঘাড় ফেরাতে রাধার মনে হল অজয় গুপ্তর দেড় দু’হাত তফাতে আরো একজন সাইকেল চালিয়ে আসছে। ভালো করে তাকালো। তাই।
আত্মস্থ হতে কয়েক সেকেণ্ড সময় লাগল। তারপর বেশ সহজ গলায় রাধা অজয় গুপ্তকে বলল, তোমাকে আর আসতে হবে না বাবু, তোমার পাশে যে আসছে সেই পৌঁছে দেবে।
কথাগুলো মনোহর পাইকেরও কানে গেল। অজয় গুপ্ত ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিল কে আসছে, তারপর সাইকেল ঘুরিয়ে নিয়ে চলে গেল।
ঘরের সামনে এসে রাধা সাইকেল রিকশ থেকে নামল। সাইকেল থেকে মনোহরও। রিকশ ভাড়া রুমা সেন আগেই দিয়ে রেখেছিলেন, সে রিকশ নিয়ে চলে গেল।
সরু রাস্তার এদিকে রাধা, ওদিকে মনোহর পাইক। অন্ধকারে কেউ কারো ভালো করে মুখ দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু দুজনেই দুজনার দিকে চেয়ে আছে।
রাধাই প্রথম ঝাঝালো গলায় কথা বলল, ভেতরে আসার ইচ্ছে না ঘরে ফেরার?
সাইকেল নিয়ে মনোহর আস্তে আস্তে এগিয়ে এলো। গম্ভীর গলায় বলল, আমি কেবল শেষবারের মতো দু’চারটে কথা বলার মতো সময় চাইছি।
রাধাও তেমনি গম্ভীর।–দুটো কি চারটে কি তার বেশি আগে হিসেব করি নাও, আমি গুনব।
মনোহর চুপ করে চেয়ে আছে।
-আচ্ছা বলে ফ্যালো।
ইখেনে দাঁড়িয়ে?
রাধা বলল, ও-মাঝ রাতে ঘরে ঢুকি বলার মতো কথা? আচ্ছা তোমার কথা আমি বুঝি নিছি, আমার জবাব কাল বাবাব থেকে শুনি নিও
খুব ঠাণ্ডা মুখ আর ঠাণ্ডা গলা মনোহরের। যদিও রাধার কথাবার্তার সুর আজ অন্যরকম লাগছে, কিন্তু এটুকু বিশ্লেষণ করার মতো মন নয়–শোন রাধা, আজই হাঁ-না শেষ কথা বলে দে, কাল বা আর কোনোদিনই হয়তো আর আমার মুখ দেখবি না!
উঠোনে পা দিতে গিয়েও রাখা ঘুরে দাঁড়ালো। আবছা অন্ধকার ফুড়ে মুখখানা ভালো করে দেখতে চেষ্টা করল।-কেন? গাঁও ছাড়ি বিবাগী হয়ে যাবে?
মনোহর তেমনি ঠাণ্ডা গলায় জবাব দিল, গাও ছেড়ে না।… একদিন তুই আমাকে শয়ে শয়ে পিঁপড়ে দিয়ে খাইয়েছিলি, এমন যার তুলনায় ওটা কিছু না–তা যন্তন্ন শেষ করতে গাও ছাড়ি না, আমি দেহ ছাড়ার শপথ নিছি, তার ব্যবস্থা মজুত আছে, তুই তোর শেষ কথা বলি দে।
রাধার বুকের ভিতরটা ভয়ানক ধড়ফড় করে উঠলো। মনে হল দশ বছর আগে শয়ে শয়ে লাল পিঁপড়েগুলো এক সঙ্গে ওর দেহেই কামড় বসালো। পরের মুহূর্তে ভয়ংকর রাগ হয়ে গেল। কাল কি শুনতে বাবার কাছে যেতে বলেছে এই গোঁয়ার তা-ও বোঝেনি। অস্ফুট স্বরে বলল, ভিতরে আসি দাঁড়া–
নিজে আগে হন হন করে চলে এলো। আধা-আধি দরজা আগলে বিলাসী দাওয়ায় শুয়ে আছে, তার মাথার কাছে লণ্ঠন জ্বলছে। নাক ডাকিয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে সে। দেখে নিয়ে রাধা তেমনি দ্রুত ফিরল। মনোহর সাইকেলটা বাইরে ঠেস দিয়ে রেখে উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে।
রাধা তার আধ হাতের মধ্যে এগিয়ে এলো। ফিসফিস গলায় রাগ ঝাড়ল, বীর মরদের মুখখানা ভালো করি দেখতে পেলি হত। খপ করে দু’হাতে তার চুলের মুঠো ধরে মাথাটা নিজের মুখের সামনে টেনে নামালো। একটা চুমু খেয়েই ধাক্কা মেরে ঠেলে সরালো। –শেষ কথা হল? এখন ঘরে গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাও গে যাও।
.