৫. চিঠিপত্র : এলিজা ফে ১৭৮০-৮২১

চিঠিপত্র : এলিজা ফে ১৭৮০-৮২১

প্রথম চিঠি

কলকাতা, ২২ মে ১৭৮০

.

প্রিয় বন্ধু,

তোমরা শুনে নিশ্চয় আনন্দিত হবে, অবশেষে প্রায় বারো মাস আঠারো দিন পরে আমি কলকাতা শহরে এসে পৌঁছেছি। কলকাতা আমার কল্পনার শহর, কতদিন কত দীর্ঘশ্বাস যে ফেলেছি এই শহরের কথা মনে করে তার ঠিক নেই। আমার কত কামনা—বাসনা, কত ভয়—ভাবনা, ভবিষ্যতের কত আশা—আকাঙ্ক্ষা, কত বিলাসব্যসনের স্বপ্ন যে এই মহানগরীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে তা তোমাদের বুঝিয়ে বলতে পারব না। সেই কলকাতার বিবরণ দেবার আগে মাদ্রাজের কথা একটু বলে নিয়ে আরম্ভ করব।

মিস্টার ফে ও মিঃ পপহাম দু’জনেই আমাকে বলেছিলেন যে, সমুদ্রতীরে আলাদা নৌকা আমাদের জন্য ঠিক থাকবে, কিন্তু তীরে পৌঁছে দেখলাম কিছুই ঠিক নেই। নিরুপায় হয়ে তাই একটি মালবাহী নৌকায় আমরা যাত্রা করলাম। নৌকাটিতে যাত্রীদের জন্য একটুও জায়গা ছিল না, আমি কোনোরকমে একটি খুঁটির পিঠে বসবার একটু ব্যবস্থা করে নিয়েছিলাম। যে কোনো মুহূর্তে ছিটকে পড়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল, মিস্টার ফে অনেক কষ্টে আমাকে সামলে রেখেছিলেন। ঢেউয়ের আঘাতে মধ্যে মধ্যে নৌকাটি এমন টলমল করছিল যে আমাদের বাঁচবার কোনো আশা ছিল না। সহযাত্রীদের মধ্যে মিঃ ও’ডনেল ও মিস্টার মুর নানাভাবে আমাদের জমিয়ে রেখেছিলেন। ক্রমে বিপদের উদ্বেগ আমাদের মন থেকে কেটে গেল, নৌকাও বেশ বেগে চলতে থাকল ঢেউয়ের মাথার উপর দিয়ে, এবং দূর থেকে আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠল পুরীর জগন্নাথের মন্দির। তিনটি বড় বড় পিরামিডের মতন অট্টালিকা, হিন্দুদের বিখ্যাত দেবালয়।

মন্দিরের ভিতরে জগন্নাথের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত, এবং তাঁর পূজার্চনার জন্য বিরাট পুরোহিতবাহিনী নিযুক্ত। শুনেছি, বছরের কোনো নির্দিষ্ট দিনে মূর্তিগুলিকে মন্দিরের বাইরে আনা হয় এবং বিশাল একটি রথের উপর বসিয়ে হাজার লোক তার দড়ি ধরে টানতে থাকে। ভক্তবৃন্দ ঈশ্বরপ্রেমে উদভ্রান্ত হয়ে জগন্নাথের রথের চাকার তলায় প্রণিপাত হয়ে আত্মোৎসর্গ করে। তাদের বিশ্বাস দেবতার উদ্দেশ্যে এইভাবে জীবন দান করলে সশরীরে স্বর্গবাসের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হয়ে যায়। খ্রিস্টধর্মের অমর বাণী এদের কর্ণকুহরে এখনও প্রবেশ করেনি, তাই আজও এরা কুসংস্কারের গাঢ় অন্ধকারে ডুবে রয়েছে। ঈশ্বরের কৃপায় ভবিষ্যতে এমন একদিন আসবে যখন অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমগ্ন সমস্ত মানুষ জ্ঞানের আলোকস্পর্শে উজ্জীবিত হয়ে উঠবে এবং মানবজাতির মধ্যে ভেদাভেদ দূর হয়ে ভ্রাতৃত্ববন্ধন দৃঢ় হবে। সেইদিন আমরা সকলে এক ঈশ্বরের সন্তান হব।

গঙ্গার শাখা হুগলি নদীর তীরে কলকাতা শহর প্রতিষ্ঠিত। তার ন’মাইল দক্ষিণে গার্ডেনরিচে নৌকা ভিড়লে শহরের চমৎকার রূপ দূর থেকে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। নদীর তীর ধরে মনোরম অট্টালিকা গড়ে উঠেছে, মাদ্রাজের মতন কলকাতাতেও এগুলিকে ‘বাগানবাড়ি’ বলা হয়। প্রত্যেকটি বাড়ির চারদিকে বাগান, সামনে সবুজ ঘাসের ‘লন’ নদীর পাড় দিয়ে জলের কিনারা পর্যন্ত নেমে গেছে। তীর ধরে বরাবর এরকম একটার পর একটা বাড়ি বাগান ও লন বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। চোখ মেললে দৃষ্টি কোথাও বাধা পায় না, সবুজের ঢেউয়ের উপর দিয়ে দুলতে দুলতে গিয়ে কলকাতার কোল স্পর্শ করে। বাগানবাড়িগুলি কলকাতা শহরের সমৃদ্ধি ও সুরুচির সাক্ষী হয়ে তীরের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে।

নদীর দৃশ্যও অপূর্ব। লন্ডনের টেমস নদীর চেয়ে অনেক প্রশস্ত। নদীর বুকের উপর অসংখ্য নৌকা ভাসছে, সারি সারি নোঙর করা রয়েছে কত রকমের গড়ন, কত বিচিত্র আকারের সব নৌকো যে তা বলা যায় না। এত বিচিত্র নৌকোর সমাবেশ কোনো নদনদীর বুকে দেখিনি কখনও। নদীর সৌন্দর্য ও গাম্ভীর্য নৌকাগুলির জন্য আরও বেড়েছে। সাপমুখো (হাঙরমুখো) নৌকাগুলো কী সুন্দর! কতকগুলি নৌকো ছিপছিপে গড়নের, জলের সঙ্গে মিশে তরতর করে বয়ে চলেছে (জেলেডিঙি)। বজরা—নৌকোগুলো বেশ বড়, একটি পরিবারের সকলে মিলে তাতে আরামে যাওয়া যায়। ব্যবসায়ীদের নানা রকমের সব বাণিজ্যতরী, তার পাশে রণতরী, এবং তার সঙ্গে রংবেরঙের সুসজ্জিত বাহারে সব বিলাস—বজরার বিচিত্র সমাবেশে নদীর উপর চমৎকার একটি নয়নাভিরাম চিত্রপট রচিত হয়েছে। সুন্দর উজ্জ্বল আবহাওয়ায় সমস্ত দৃশ্যটি যেন ঝলমল করছে মনে হয়।

হুগলি নদীর পূর্ব তীরে কলকাতা শহর। তীর থেকে ফোর্ট উইলিয়াম ও ‘এসপ্ল্যানেড’ পার হয়ে এলে শহরের রূপ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ফোর্টের সামনে জায়গাটিকে ‘এসপ্ল্যানেড রো’ বলা হয়। বড় বড় প্রাসাদে ঠাসা জায়গাটি। গবর্নমেন্ট হাউস ও কাউন্সিল হাউস ছাড়া বাকি সমস্ত বাড়িঘর শহরের সেরা ভদ্রলোকদের বাসগৃহ। ফোর্টের মধ্যে সামরিক বিভাগের লোকজন ছাড়া আর কাউকে বাস করতে দেওয়া হয় না। মাদ্রাজের সঙ্গে কলকাতার পার্থক্য হল, ফোর্ট সেন্ট জর্জে সব রকমের লোক বাস করে, কলকাতার ফোর্টে তা করে না। সেইজন্য মাদ্রাজের ফোর্ট অনেকটা শহরের মতন দেখতে, কলকাতার ফোর্ট দেখতে সামরিক দুর্গের মতন। তা ছাড়া কলকাতার ফোর্ট এত পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন ও সুবিন্যস্ত, সবুজ ঘাসের আচ্ছাদন দিয়ে চারদিকে এমন সুন্দর করে সাজানো ঢালু জমি, বাঁধ, পাড়—সবদেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়, সামরিক রুক্ষতার কথা মনেই পড়ে না। এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশই মনোরম। উত্তাপ বেশি হওয়া সত্ত্বেও (দিনের বেলা ৯০ ডিগ্রির কম থাকে না) পরিপার্শ্বের সবুজের হানি হয় না। গ্রীষ্মকালে আমাদের দেশ যেমন নীরব রুক্ষ মূর্তি ধারণ করে, ফাটাচোরা মাটির দিকে চেয়ে মনে হয় যেমন গাছপালা কোনোদিনই জন্মাবে না, এ দেশে কখনও তা মনে হয় না। দিনের উত্তাপ রাতের হিমে শীতল হয়ে যায়, শুকনো মাটিতে রস সঞ্চারিত হয়, প্রাণের স্পন্দনের মতন তার উপর তৃণগুচ্ছ গজিয়ে ওঠে। এ দেশের গোরু—মহিষ ছাগল—ভেড়া এই সবুজ তৃণ খেয়ে বেঁচে থাকে। বাংলাদেশের ‘মাটন’ তাই খেতে খুব সুস্বাদু এবং প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। কলকাতার কাছে সুন্দর একটি ঘোড়দৌড়ের মাঠ আছে, শহরের শৌখিন লোকেরা সকাল—সন্ধ্যায় সেখানে বেড়াতে যান।

কলকাতার একটি সভ্রান্ত পর্তুগিজ পরিবারে আমরা অতিথি হলাম। ভদ্রলোক বিপত্নীক ছিলেন, কিন্তু থাকতেন তাঁর শ্যালিকার সঙ্গে। কলকাতা থেকে বিশ—তিরিশ মাইল দূরে ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগরে তাঁর জন্ম এবং দীর্ঘকাল অনভ্যাসের জন্য নিজের দেশি ভাষায় (ফরাসি) কথা বলতে অক্ষম, যদিও অন্যে কথা বললে বুঝতে তাঁর কোনো অসুবিধা হত না। আমি অনেক কষ্টে পর্তুগিজ ভাষা কিছুটা শিখেছিলাম, কথা বললে বুঝতে পারতাম। অতএব আমাদের দুজনের কথাবার্তা হত পর্তুগিজ ও ফরাসিতে, তিনি পর্তুগিজে বলতেন, আমি ফরাসিতে উত্তর দিতাম। এই ভাববিনিময়ের ফলে এ দেশের অনেক রীতিনীতি—প্রথা সম্বন্ধে আমি বেশ জ্ঞান সঞ্চয় করেছি, খাদ্যদ্রব্যের মূল্য থেকে আরম্ভ করে প্রাত্যহিক জীবনের বহু প্রয়োজনীয় তথ্যও সংগ্রহ করেছি।

সমস্ত বিপদ—আপদ ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যেও আমাদের পরিচয়পত্রগুলি আমরা যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছিলাম। আমার স্বামী ওকালতি করবার জন্য এসেছেন, জর্জদের কাছে ভাল প্রশংসাপত্র না দেখাতে পারলে তাঁর ওকালতির অনুমতি পাওয়ার কোনো আশা নেই। অল্পদিনের মধ্যেই সার রবার্ট চেম্বার্সের সঙ্গে আলাপ হল এবং তিনি ও তাঁর স্ত্রী দু’জনেরই বিশেষ প্রীতির পাত্র হয়ে উঠলাম আমরা। অসুস্থতার জন্য আমি তাঁর অভ্যর্থনা—উৎসবে যেতে পারব না বলে তাঁরা কোনো ব্যবস্থাও করেননি। কিন্তু এত ভদ্র তাঁরা, যে স্বামী—স্ত্রী দু’জনেই আমার সঙ্গে পর্তুগিজ ব্যবসায়ীর গৃহে দেখা করতে এসেছিলেন। মিসেস চেম্বার্সের মতন সুন্দরী মহিলা আমি কখনও চোখে দেখিনি। তখন তাঁর পূর্ণ যৌবন। তার উপর তাঁর অমায়িক ব্যবহার ও মিষ্টি কথাবার্তার জন্য তাঁর সৌন্দর্য আরও শতগুণ বেড়ে যায়। একবার তাঁর কাছে এলে আর দূরে সরে যাওয়া যায় না। আমাদের প্রতি তাঁদের ভালবাসা তাই প্রতিদিন বাড়ছে। মিসেস চেম্বার্স প্রতিদিন যত আমার দুঃখের কাহিনি শুনছেন তত তাঁর কোমল হৃদয় গভীর সহানুভূতিতে আরও কোমল হচ্ছে।

.

কলকাতা, ২৯ মে ১৭৮০

মিসেস হেস্টিংসের কাছেও আমাদের পরিচয়পত্র পাঠিয়েছি। অনেক আগেই তাঁর কাছে গিয়ে আমার পরিচয় করা উচিত ছিল, কিন্তু অসুস্থতার জন্য তা পারিনি। হেস্টিংস বেলডেভিয়ার হাউসে থাকেন, শহর থেকে প্রায় মাইল পাঁচেক দূরে। গ্রীষ্মকালে এতটা পথ যাতায়াত করা কষ্টকর, বিশেষ করে আমার মতন পঙ্গুর পক্ষে। সৌভাগ্যবশত মহিলা বাড়িতে ছিলেন এবং সেদিন তাঁর তিনজন বান্ধবীও এসেছিলেন বেড়াতে। তাঁদের মধ্যে একজন, মিসেস মট (Mrs. Motte) চমৎকার মহিলা। মিসেস হেস্টিংসের অসাধারণত্ব প্রথম নজরেই চোখে পড়ে, বোঝা যায় যে সাধারণ মেয়েদের থেকে তিনি একেবারে ভিন্ন জাতের, কিন্তু তাঁর বাইরের চেহারায় একটা উদভ্রান্তের ছাপ আছে। তার কারণ, তাঁর অঢেল সোনালি কেশরাশি এমন আলুথালু অবস্থায় গোল গোল করে জড়িয়ে মুখের দু’পাশে কাঁধের উপর তিনি ফেলে রেখে দেন, যে প্রথমে দেখলেই কেমন যেন উদাস উদভ্রান্ত বলে মনে হয়। অবশ্য এই বিচিত্র কেশবিন্যাসের ফলে তাঁর অপরূপ সৌন্দর্যের সারল্য এমন দর্শনীয় হয়ে ভেসে উঠত চোখের সামনে (মনে হয় সেই রূপটাই দেখানো তাঁর ইচ্ছে), যে সহজে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব হত না। তাঁর বেশভূষা ছিল আরও বিচিত্র। চলতি ফ্যাশনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না তাঁর। অন্য মহিলারা যা কল্পনা করতে পারতেন না, এরকম বেশে তিনি সেজেগুজে থাকতেন এবং বাইরের সমাজেও চলে ফিরে বেড়াতেন। বেশভূষার এই উৎকট স্বাতন্ত্র্যটাও তাঁর, মনে হয়, নিজেকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর চেষ্টা ছাড়া কিছু নয়। কেশগুচ্ছ বলছে, ‘আমাকে দেখ’, বেশভূষা বলছে, ‘আমাকে দেখ’। গবর্নর—জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের স্ত্রী তিনি, শহুরে সমাজের সম্ভ্রমের সর্বোচ্চ শিখরে সসম্মানে অধিষ্ঠিত, কাজেই বেশ ও কেশ যদৃচ্ছা বিন্যাস করে থাকার ও বেড়াবার অধিকার তাঁর আছে। সমাজের প্রচলিত ফ্যাশনে তাঁর খেয়াল চরিতার্থ হবে না, বরং খেয়ালের জন্য নতুন ফ্যাশন চালু হবে সমাজে।

মিসেস হেস্টিংস এমন একটি উচ্চাসনে বসে সকলের দিকে চোখ নামিয়ে চেয়ে দেখতেন, যে অনেক সময় তাঁকে নিষ্ঠুর বলে মনে হত। সকলের কাছ থেকে তিনি গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মান দাবি করতেন, কিন্তু তার বদলে তাঁর কাছ থেকে সকলে সমবেদনা বা অনুকম্পা প্রত্যাশা করত না। আমাকে তিনি ভদ্রভাবেই অভ্যর্থনা করলেন, রাত্রে খেতেও বললেন, আমি নিমন্ত্রণ গ্রহণও করলাম, কিন্তু আমার দৈব দুর্বিপাকের কথা শুনে তিনি বিচলিত হলেন বলে মনে হল না। আমি যখন সব কাহিনি বললাম তখন গম্ভীর হয়ে তিনি উত্তর দিলেন, ‘কেবল কৌতূহল মেটানোর জন্য এত দূর দেশে না—আসাই আপনাদের উচিত ছিল।’

হায় অদৃষ্ট! কে কার দুঃখ বোঝে! আমি যে শখ করে কৌতূহল মেটানোর জন্য এ দেশে আসিনি, আমার স্বামীকে বেহিসেবি অপব্যয়, বিলাসিতা ও উচ্ছৃঙ্খলতার পথে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এসেছি, সে কথা বললে মিসেস হেস্টিংস কি বিশ্বাস করবেন বা বুঝতে পারবেন? আমি না এলে আমার স্বামীর বাংলাদেশে আসা হত না এবং তাঁর জীবনটাও নষ্ট হয়ে যেত। এসব কথা কাকে বলব, কে—ই বা বুঝবে। মিসেস হেস্টিংসের কথাবার্তায় আমি খুশি হতে পারিনি, তাঁর উদাসীনতায় মনে কষ্ট পেয়েছি। ভাগ্য যাঁদের উপর প্রসন্ন তাঁরা বোধহয় কখনও ভাগ্যহীনদের বেদনা উপলব্ধি করতে পারেন না, মনে করেন তাঁরা ভিন্ন এক জাতের মানুষ। বোধহয় সমাজের ও সংসারের এই নিয়ম।

এবারে আমার বাসাবাড়ি সম্বন্ধে কিছু বলব। অতি সুন্দর বাড়ি, দেখলে মনে হয় নিখুঁত। আসবাবপত্তর যা যেখানে দরকার সব সাজানো আছে, বড়লোকের বাড়ি যে তা বলে দিতে হয় না। অর্থ থাকলে যতরকম সুখস্বাচ্ছন্দ্য ও বিলাসের ব্যবস্থা করা যায় তার ত্রুটি নেই কোথাও। কিন্তু অর্থ থাকলেই রুচি থাকবে এমন কোনো কথা নেই। বাড়িটাতে ঐশ্বর্যের জাঁক আছে, আড়ম্বর আছে, কিন্তু ছিমছাম রুচির পরিচয় নেই। বিত্তবান যাঁরা, ছিমছাম থাকার ব্যাপারে তাঁরা উদাসীন। মধ্যবিত্তরা বরং এদিক দিয়ে অনেক বেশি রুচিবান। বাড়ির বাগানটি বেশ সুবিন্যস্ত, কিন্তু সব বাড়ি সম্বন্ধে এ কথা কত দূর সত্য জানি না। জানালার শার্সি, খড়খড়ি সবই বন্ধ থাকে, বাইরে খসখসের টাটি ঝোলানো থাকে ঘর ঠান্ডা রাখার জন্য। দরজা—জানালায় এইরকম খসখসের পর্দা ঝুলিয়ে রাখলে নাকি গরম হাওয়া ঘরে ঢুকতে পারে না। এই বস্তুটি এর আগে দেখিনি কখনও। সন্ধ্যা না হলে বাড়ির গৃহকর্ত্রী আমাকে বাইরে বেরুতে দিতেন না, এবং বেরুবার সময় নানা রকমের উপদেশ দিতেন।

আগামীকাল সকালে এখানে আমাদের রাজার জন্মতিথি উৎসব পালন করা হবে। আমরা দু’জনে উৎসবে নিমন্ত্রিত। কিন্তু শারীরিক অক্ষমতার জন্য আমার যাবার উপায় নেই। মিস্টার ফে সাধারণত এই ধরনের উৎসবে কিছুতেই যেতে চান না।

কলকাতার সুপ্রিমকোর্টের চিফ জাস্টিস সার এলিজা ইম্পের সঙ্গে আমার স্বামীর পরিচয় হয়েছে। তিনি তাঁকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়েছেন এবং পরিচয়পত্রগুলি বেশ খুঁটিয়ে পড়েছেন। পত্র যাঁরা লিখেছেন তাঁদের সকলকেই প্রায় তিনি চেনেন, কারণ বিলেতে Bar—এর সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগ ছিল। মিস্টার ফে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তাদের অনুমতি নিয়ে আসেননি বলে তাঁর মনে সন্দেহ ছিল যে, হয়তো সার এলিজা তাঁকে এখানকার আদালতে ঢুকতে না—ও দিতে পারেন। কিন্তু সন্দেহটা প্রকাশ করামাত্রই তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন, ‘না মশায়, না, আপনার কোনো চিন্তা নেই। এইসব কাগজপত্র নিয়ে আপনি যদি ইংলন্ড থেকে না এসে একেবারে উপরের মেঘলোক থেকেও সোজা কলকাতায় নেমে আসতেন, তাহলেও আপনাকে কোর্টে ওকালতি করার অনুমতি আমি দিতাম। মনে রাখবেন সুপ্রিমকোর্ট সর্বব্যাপারে স্বাধীন, কারও হুকুম মেনে চলে না। তা তিনি যত বড় কর্তাব্যক্তিই হন—না কেন। আপনি কোম্পানির ডিরেক্টরদের অনুমতি নিয়ে এসেছেন কি না তা আমাদের জানার দরকার নেই। আমরা দেখব, আপনি একজন যোগ্য শিক্ষিত ব্যারিস্টার কি না। অতএব আমাদের Bar—এ আপনাকে প্রবেশ করতে দিতে আমার কোনো আপত্তি নেই।’

জাস্টিস হাইডের সঙ্গেও মিস্টার ফে—র পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সার এলিজা। এইসব কথাবার্তার মধ্যে এলিজার যে বলিষ্ঠ মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে তা নিশ্চয় প্রশংসনীয়। এখানে দেখছি গবর্নমেন্ট ও সুপ্রিমকোর্টের মধ্যে ক্ষমতার ব্যাপার নিয়ে বেশ একটা পারস্পরিক সন্দেহ ও বিরোধের ভাব আছে। উভয়েরই চিন্তা, কেউ কারও স্বাধীন ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করছে কি না। কোম্পানির অ্যাটর্নি মিস্টার নেলর আদালতের অবমাননার জন্য কারাদণ্ড ভোগ করেছিলেন। এই ঘটনার পর থেকে সরকার ও বিচারবিভাগের সম্পর্ক ক্রমেই তিক্ত হয়ে ওঠে। অবশ্য প্রসঙ্গত আমি বিষয়টির উল্লেখ করলাম, কারণ সরকার আদালতের বিবাদে আমাদের কোনো স্বার্থ নেই। কোর্টের কাজ চললেই আমরা খুশি। মিস্টার ফে এর মধ্যেই অনেক মামলা পেয়েছেন। এখন সব সময় তাঁকে এই মামলার কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। আমার মনে হয়, তাঁর এ দেশে আসার উদ্দেশ্য সফল হবে।

.

কলকাতা, ২০ জুলাই ১৭৮০

অবশেষে হায়দর আলি তাঁর মুখোশ খুলে ফেলে দিয়ে বিপুল উদ্যমে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আরম্ভ করেছেন। আমরা যে ঠিক সময়মতন নিরাপদে চলে আসতে পেরেছি, সেটা নেহাত অদৃষ্টের জোরে বলতে হবে। সম্প্রতি একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল, তিনি আরবের বিশাল মরুভূমির ভিতর দিয়ে, আলেপ্পোর পথে এ দেশে এসেছেন। তিনি বললেন যে এ পথে কোনো ইয়োরোপীয় মহিলা যাত্রীর পক্ষে নিরাপদে আসা সম্ভব নয়। সুতরাং যাত্রাপথে আমরা আরও অনেক বেশি বিপদে ও ঝঞ্ঝাটে পড়তে পারতাম। কর্ণাটকে হায়দরের সৈন্যদের নিষ্ঠুর অত্যাচারের কাহিনি অনেক শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু তা এত মর্মান্তিক যে চিঠিতে বিস্তারিত না—লেখাই ভাল।

কাজকর্মে আমি যে কত ব্যস্ত থাকি তা তোমরা ভাবতে পারবে না। লেডি চেম্বার্স অনুগ্রহ করে তাঁর কয়েকটি পোশাক ধার দিয়েছেন। সেগুলি দেখে আমি আমার প্রয়োজনীয় পোশাক তৈরি করে নেব। এর মধ্যে গৃহস্থালিও আরম্ভ করে দিয়েছি। এ কাজ যে কত কঠিন এ দেশে তা তোমাদের জানা নেই। ভৃত্যরা এখানে কাজ করতে চায় না, বিশেষ করে যে কাজের জন্য তাদের নিযুক্ত করা হয়, সে কাজে সব সময় তারা ফাঁকি দেবার চেষ্টা করে। তাদের উপর প্রহরীর মতন নজর না রাখলে সংসার চালানো যায় না। একটা দৃষ্টান্ত দিই। কিছুক্ষণ আগে একটি ভৃত্যকে একটা ছোট টেবিল নিয়ে আসতে বলেছিলাম। তখন থেকে দাঁড়িয়ে সে যে হাঁকডাক করে বাড়ি মাথায় করছে, এখনও থামেনি। অর্থাৎ অন্য চাকরকে সে হুকুম করছে টেবিলটা আনার জন্য। আমি বললাম, তুমি নিজে আনতে পারো না? আমি তাকে সাহায্য করতে গেলাম। সে বলল, ‘ও, আই নট ইংলিশ, আই বেঙ্গলম্যান!’ ভৃত্যটি আমাকে মিশ্র ইংরেজিতে বুঝিয়ে দিলে, ‘ইংলিশম্যানের’ মতন ‘বেঙ্গলম্যানের’ গায়ে জোর নেই। দু’তিনজন ‘বেঙ্গলম্যান ইক্যুয়াল টু একজন ইংলিশম্যান’। এই হল এখানকার অবস্থা।

.

আজকে এইখানেই চিঠি শেষ করে বিদায় নিচ্ছি। মনে রেখো, এখানকার প্রচণ্ড গরমের মধ্যে বসে তোমাদের এত বড় চিঠি লিখতে আমি ক্লান্তি বোধ করিনি। সুতরাং এর উত্তরে তোমরা যদি বেশ বড় চিঠি আমাকে না লেখো, তাহলে আমি সত্যি খুব দুঃখিত হব। আমাদের ভালবাসা নিয়ো। ইতি—

তোমাদের প্রীতিমুগ্ধ

ই. এফ.

২  

দ্বিতীয় চিঠি

কলকাতা, ২৯ আগস্ট ১৭৮০

.

প্রিয় বন্ধু,

গতকাল তোমাদের চিঠি পেয়েছি। অসংখ্য ধন্যবাদ! বাইরে থেকে ডাকহরকরার ‘বিলেতের চিঠি’ হাঁক শুনে আমি ড্রেসিং রুম থেকে ছুটে বেরিয়ে এসেছি, মিস্টার ফে—ও তাঁর স্টাডি থেকে দৌড়ে এসেছেন। স্নেহ—ভালবাসার সাড়া পাবার জন্য মানুষের অন্তর বোধহয় এরকমই আকুল হয়ে থাকে।

অন্য কথা ছেড়ে দিয়ে আমার ঘরের কথা বলি। ঘরবাড়ির কোনো খুঁত নেই কোথাও। কিন্তু তা না থাকলে কী হবে, চারদিকের চোরছ্যাঁচড়ের উপদ্রবে তিষ্ঠবার উপায় নেই। ইংলন্ডে ভৃত্যরা বদমায়েশ হলে তাদের শাস্তি দেওয়া হয়, অথবা কর্মচ্যুত করা হয়। অন্যান্য ভৃত্যরা তা—ই দেখে শিক্ষালাভ করে এবং সাবধান হয়ে যায়। এ দেশের ভৃত্যদের মানুষ হিসেবে কোনো মর্যাদাবোধ নেই। কটু কথা বললে বা অপমান করলে তারা লজ্জা পায় না। দু’একটা দৃষ্টান্ত দিলে আমার এই ভৃত্যবেষ্টিত শোচনীয় অবস্থাটা তোমরা বুঝতে পারবে।

আমার খানসামা সেদিন এক গ্যালন দুধ ও তেরোটা ডিম এনেছিল দেড় পাঁইটের মতন কাস্টার্ড তৈরি করার জন্য। লোকটা যে কত বড় নির্লজ্জ চোর তা হিসেব দেখেই বুঝতে পারবে। কিন্তু ব্যাপারটা ইঙ্গিত করতে সে আমাকে ভয় দেখাল। বাধ্য হয়ে তাকে তাড়িয়ে অন্য একজন খানসামা নিযুক্ত করলাম। সাবধান করার জন্য গোড়াতেই নতুন লোকটিকে বলে দিলাম, ‘দ্যাখো বাপু, সব জিনিসের বাজারদর আমি জানি, সুতরাং বেশ বুঝেসুঝে কেনাকাটা করবে এবং আমাকে হিসেব বুঝিয়ে দেবে।’ এ কথার উত্তরে সে আমাকে বলল, ‘তাহলে আমাকে ডবল মাইনে দিতে হবে।’ এই কথা বলার পর তাকে আমি বিদায় করে দিলাম। আগের খানসামাটি একদিন এসে হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চাইল, আবার তাকে কাজে নিযুক্ত করলাম। পায়ে হাত দিয়ে ‘সেলাম’ করতে এরা খুব অভ্যস্ত। কিন্তু এতটা দৈন্য ও দাসত্ব স্বীকার না করে যদি তারা সততা সম্বন্ধে একটু সচেতন হত তাহলে ভাল হত। লোকটা যে ধূর্ত তা আমি জানি। তবু সে পুরনো লোক, আমার রুচি—প্রকৃতি জানে, সুতরাং ঠকাবার আগে অন্তত একটু চিন্তা করবে ও সাবধান হবে। এই কথা ভেবে পুরনো খানসামাকেই কাজে বহাল করা সাব্যস্ত করলাম। আমার অনুমান খুব মিথ্যা হল না। আগে সে আমাদের প্রত্যেকের জন্য ১২ আউন্স করে মাখনের হিসেব দিত, এখন সে নিজেই স্বীকার করে যে ৪ আউন্সের বেশি লাগে না।

আমার মনে হয়, এইসব বিষয় নিয়ে ইংলন্ডে তোমাদের যে চিঠি লিখি সে খবর ভৃত্যেরা জানে। তা না হলে ওদের নিজেদের এত কথা আমি শুনতে পেতাম না। সম্প্রতি আমার বাজার—সরকার চাকরি ছেড়ে চলে গেছে, এবং যাবার সময় নাকি ভৃত্যদের কাছে বলে গেছে যে, আমার মতন মানুষের কাছে তাদের মতন গরিবদের নোকরি করা পোষায় না। অন্য বাড়িতে কাজ করলে কমসে—কম এক টাকা করে তার দৈনিক উপরি থাকে, মাইনে ছাড়াও। কিন্তু আমার কাছে কাজ করলে দৈনিক দু’এক আনা থাকে কি না সন্দেহ, এবং তা—ও আবার আমার বকবকানিতে দিয়ে দিতে বাধ্য হয়। তাহলে বুঝতে পারছ, কীরকম হিসেবি গৃহিণী আমি। তোমরা বোধহয় এ কথা বিশ্বাস করতে চাইবে না। বাজার—সরকার আমি আর রাখব না ঠিক করেছি, কারণ খানসামারই এই কাজ করা উচিত। এত চাকরবাকর নিয়ে সংসারের খরচ কুলানো অসম্ভব। সামান্য দু’চার আনা পয়সা রোজগার করার জন্য এ দেশের লোক যে কী করতে পারে না তা তোমরা কল্পনা করতে পারবে না। এখানে এখন আইনসঙ্গত সুদের হার হল শতকরা ১২ টাকা, কিন্তু ছোট ছোট দোকানদারেরা তার দ্বিগুণ হারে টাকা সুদে খাটায়। প্রতিদিন অল্প টাকা লেনদেন করে তারা কড়ায়—গন্ডায় সুদ কষে আদায় করে নেয়। এ দেশে এখনও কড়ির প্রচলন আছে বলে একটা কানাকড়িও সুদ তারা ছাড়ে না। ৫১২০ কড়িতে এক টাকা হয়। এখানকার সবচেয়ে মারাত্মক প্রথা হল বেনিয়ান রাখা। এই বেনিয়ানরা হাজাররকম প্রতারণা কৌশলের উদ্ভাবক। টাকাপয়সার সমস্ত লেনদেন বেনিয়ানদের হাত দিয়ে করতে হয় বলে পদে পদে তারা মুনাফা আদায় করে নেয়।

এবারে আমার সংসারের খরচপত্তর এবং এখানকার দ্রব্যমূল্য সম্বন্ধে কিছু বলব। আমাদের বাড়ি ভাড়া মাসে ২০০ টাকা। কলকাতার খুব অভিজাত পাড়ায় থাকলে ভাড়া ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা হত। এখন আমরা যে পাড়ায় থাকি সেখানে ভাড়া একটু কম। অন্য জায়গায় আরও একটু ভাল বাড়িতে উঠে যাব ভাবছি। ইংলন্ডে থাকতে শুনেছি যে, বাংলা দেশে অত্যধিক গরমের জন্য খিদে পায় না, কিন্তু এখানে এসে তার বিশেষ কোনো প্রমাণ পাচ্ছি না। গরম বেশি বটে, কিন্তু খিদেও বেশ প্রচণ্ড, খাদ্যও প্রচুর দরকার হয় ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য। বেলা দুটোর সময় ভরদুপুরবেলায় আমরা মধ্যাহ্নভোজন করি। এখন আমাদের খাবার সময় হয়েছে। মিস্টার ফে বাজপাখির মতন লুব্ধদৃষ্টিতে খাবার টেবিলের দিকে চেয়ে আছেন। আমি অসুস্থ হলেও খাবার ইচ্ছা আমারও বেশ প্রবল। কি কি খাদ্য আমরা খাই জানো? একটা স্যুপ, মুরগির রোস্ট, ভাত ও মাংসের ঝোল, ভাল চিজ, টাটকা মাখন, চমৎকার পাউরুটি, মাটনের তরকারি, কচি ভেড়ার রাং, পায়েস, টার্ট এবং এর সঙ্গে উপাদেয় পানীয় মদিরা। খাদ্যের বাহুল্য দেখে মনে হবে, ভোজনটা বুঝি এ দেশে খুবই ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু ঠিক তা নয়, কারণ একটা গোটা ভেড়ার দাম দু’টাকা, একটা বাচ্চা ভেড়ার দাম এক টাকা। ছ’টা মুরগি বা হাঁস বা পায়রা এক টাকায় পাওয়া যায়। বারো পাউন্ড পাউরুটির দাম এক টাকা, দু’পাউন্ড মাখনের দাম এক টাকা। ভাল চিজের দাম আগে কলকাতায় খুব বেশি ছিল, তিন—চার টাকা করে পাউন্ড, কিন্তু এখন অর্ধেক দামে দেড় টাকায় পাওয়া যায়। বিলেতি ক্ল্যারেটের বোতল ষাট টাকায় এক ডজন। দাম ও তালিকা দেখে মনে কোরো না যে, প্রতিটি খাদ্য আমরা প্রত্যহ খাই। মধ্যে মধ্যে খেতে হয়, তবে কদাচিৎ এরকম ভূরিভোজনের সুযোগ ঘটে।

বেশ সাবধানে ভেবেচিন্তে এ দেশে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নির্বাহ করা উচিত, তা না হলে লোভে পড়ে বেশি খরচের সম্ভাবনা থাকে, এবং দরকার হলেই অতি সহজে যেহেতু টাকা ধার পাওয়া যায়, তাই খরচের লোভও সামলানো যায় না। আমরা কল্পনা করতে পারিনি যে, টাকা ধার পাওয়া এখানে এত সহজ ব্যাপার হতে পারে। কলকাতার ইয়োরোপীয় দোকানদাররা সব সময় জিনিসপত্তর বাড়িতে পাঠিয়ে দেবার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে, এবং বেনিয়ানরাও টাকা ধার দেবার জন্য নিজেদের মধ্যে পাল্লা দিতে থাকে। কেউ বলে, ‘সাহেব’ আমাকে তোমার বেনিয়ান রাখো, আমি পাঁচ হাজার টাকা অগ্রিম দেব।’ কেউ বলে সাত হাজার, কেউ বলে দশ হাজার। কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যয়বিলাসিতার সুযোগ এই অবস্থায় সবচেয়ে বেশি, কারণ বাবুগিরির খরচ জোগানোর জন্য বেনিয়ান বা টাকা ধার পাওয়ার কোনো অসুবিধা হয় না। কোম্পানির ‘রাইটার’দেরও তাই দেখা যায়, চাকরি নিয়ে কলকাতায় আসার কয়েক মাসের মধ্যেই চরম বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। বয়সে যুবক বলে তাঁদের বিলাসিতা অতি দ্রুত শৃঙ্খলহীন স্বেচ্ছাচারিতায় পরিণত হয়। এরকম কয়েকজনকে আমি দেখেছি, শহরে আসার দু’তিন বছরের মধ্যে মাথার চুল পর্যন্ত ডুবে গেছে। তাঁদের পরিত্রাণের আর কোনো পথ আছে বলে মনে হয় না। সুদের হার এখানে শতকরা ১২ টাকা। বেনিয়ানরা মুচলেকা নিয়ে টাকা ধার দেয়। বছরের শেষে সুদ কষে আসলের সঙ্গে যোগ করে, সুদে—আসলে মিলে বছরে ঋণের সংখ্যাটি ফুলেফেঁপে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। বেনিয়ানের ‘মাস্টার’ (মাস্টার হলেও আসলে তিনি বেনিয়ানের দাস) ক্রমে এই ঋণের তলায় অসহায়ের মতন ডুবতে থাকেন, ঋণ দ্বিগুণ বা তিনগুণ হতে থাকে। একটি কথাও তিনি বলতে পারেন না, কারণ ঋণ থেকে মুক্তি পাবার তাঁর সাধ্য নেই বলে কেবল গভীরে, আরও গভীরে ডুবে যাওয়া ছাড়া তাঁর গত্যন্তরও নেই।

আমি তোমাদের আগের চিঠিতে লিখেছি যে, মিস্টার ফে গত ১৬ জুন তারিখে (১৭৮০) সুপ্রিমকোর্টের অ্যাডভোকেট হিসেবে প্র্যাকটিস করার অনুমতি পান। তারপর থেকে অনেক মামলা পরিচালনার কাজে তিনি প্রায় সব সময় নিযুক্ত আছেন, এবং মক্কেলরাও তাঁর কাজে খুব খুশি। সকলেই তাঁকে খুব উৎসাহ দেন। এইভাবে যদি তিনি মামলা পেতে থাকেন তাহলে আমাদের দিনগুলো ভালই কাটবে মনে হয়। সোনার মোহরও প্রচুর পাওয়া যাবে, বন্ধুবান্ধব—প্রতিবেশীরও অভাব হবে না। ইংলন্ডের তুলনায় কলকাতায় অ্যাডভোকেটদের ফি (fee) অনেক বেশি।

কয়েক সপ্তাহ আগে সার রবার্ট চেম্বার্স তাঁর গাড়িতে করে যাবার সময় একটি দুর্ঘটনার মধ্যে পড়েন। ঘোড়া খেপে যাওয়ার ফলে দুর্ঘটনাটি ঘটে। রবার্ট রীতিমতো আহত হন এবং অনেকদিন তাঁকে শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে হয়। সম্প্রতি তিনি কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছেন। যা—ই হোক, আমি সার রবার্টের ব্যবহারে খুব সন্তুষ্ট হতে পারিনি, কারণ আমার স্বামী তাঁর কাছ থেকে বিশেষ কোনো সাহায্য পাননি। বহুদিন হল মিসেস চেম্বার্সের সঙ্গেও দেখাসাক্ষাৎ হয়নি, কারণ আজকাল তিনি খুব কমই স্বামীকে ছাড়া বাইরে বেরোন। যেদিন দুর্ঘটনা ঘটে সেইদিনই দুপুরে তাঁদের বাড়ি আমাদের যাবার কথা ছিল। এখন তাঁরা কলকাতার বাইরে চলে গেছেন, কয়েক মাস পরে ফিরবেন।

কলকাতা, ৩১ আগস্ট ১৭৮০

আর—একদফা চিঠি পেলাম তোমাদের এবং তোমরা সকলে বেশ সুখেস্বচ্ছন্দে আছ জেনে খুশি হলাম। খবর পেলাম, কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি জাহাজ ছাড়বে, অতএব চিঠি লেখা শেষ করে এখনই এগুলো পাঠিয়ে দিতে হবে। এখানকার রাজনৈতিক খবরাদিতে চিঠির পৃষ্ঠা ভর্তি করা অর্থহীন, কারণ তার জন্য তোমাদের ‘ক্যালকাটা গেজেট’ পত্রিকা নিয়মিত পাঠাব ঠিক করেছি। আমার বিশ্বাস, অল্পদিনের মধ্যেই হায়দর আলি বেশ জব্দ হয়ে যাবে।

মিস্টার হেয়ার অনেকবার আমাদের এখানে বেড়াতে এসেছেন। মিস্টার ফে—র ব্যাপারে এখন তাঁর কোনো আগ্রহ নেই। এই হল দুনিয়ার নিয়ম, বিশেষ করে হেয়ারের মতন যাঁরা পরিপার্শ্বের দাস, কেবল সুসময়ের বন্ধু হিসেবেই তাঁদের দেখা যায়। হেয়ার সাহেব আমাদের এই রকমের বন্ধু ছিলেন। তাঁর বিবরণ শুনে মনে হয়, আমরা যে কষ্ট পেয়েছি তা নাকি আমাদের শাপে বর হয়েছে। তা না হলে হয়তো আমরা সকলে জাহাজডুবি হয়ে মারা যেতাম। ঈশ্বর যে কত কারণে কী ইচ্ছা করে মানুষকে নানা বিপর্যয়ের ভিতর দিয়ে যেতে বাধ্য করেন তা বলা যায় না। তাই অনেক সময় দেখা যায়, সবচেয়ে কণ্টকাকীর্ণ পথ দিয়ে না গেলে জীবনে সুখ ও শান্তির রাজ্যে পৌঁছনো যাবে না। এই অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানুষের উপর ঈশ্বরের আশীর্বাদ বর্ষিত হয়। এ সম্বন্ধে তোমাদের কী মত জানবার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকব, পত্রোত্তরে জানিয়ো।

.

কলকাতা, ৮ সেপ্টেম্বর ১৭৮০

আর নতুন কথা কিছু লেখবার নেই। আমার স্বাস্থ্য বেশ ভালই আছে। এই সময়টা খুব একঘেয়ে মনে হয়, কিছুতেই যেন কাটতে চায় না। যাঁরা নিয়মিত কাজকর্মের লোক, ছুটির দিনগুলো এখানে তাঁদের বড্ড ক্লান্তিকর মনে হয়। ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন। আশা করি আবার আমরা সুখে মিলিত হব। আমাদের ভবিষ্যৎ বেশ উজ্জ্বল বলে মনে হয়, এবং যদি অপ্রত্যাশিত কোনো অঘটন ঘটে তাহলে তো মন্দ হবার কোনো সন্দেহ নেই। আজকের মতন বিদায় নিচ্ছি।

তোমাদের প্রীতিমুগ্ধ

ই. এফ.

৩  

তৃতীয় চিঠি

কলকাতা, ২৭ সেপ্টেম্বর ১৭৮০

.

প্রিয় বন্ধু,

কিছুদিন আগে যে দুঃসংবাদ দিয়েছিলাম তার জের কেটে গেছে। তারপর আরও একটি ভয়ংকর ঘটনা ঘটে গেছে এখানে। তা—ই নিয়ে এখন সকলে আলাপ—আলোচনায় মত্ত। স্বয়ং গবর্নর—জেনারেল এবং কাউন্সিলের প্রথম সদস্য মিস্টার ফ্রান্সিসের সঙ্গে ডুয়েল লড়াই হয়ে গেছে। দুই পক্ষের গুলি ছোড়ার পর গবর্নর ছুটে গিয়ে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর হাত ধরে দুঃখ প্রকাশ করেন। এরকম অবাঞ্ছিত ব্যাপারের জন্য সত্যিই তিনি আন্তরিক দুঃখিত বলে মনে হয়। শুনেছি গবর্নর—জেনারেল হেস্টিংস খুব ভাল মানুষ। ফ্রান্সিস আহত হলেও খুব তাড়াতাড়ি পিস্তলের গুলি তাঁর দেহ থেকে বার করে ফেলা হয়েছিল। তার জন্য তাঁর জ্বর হয়নি। এবং মনে হয়, শীঘ্রই তিনি সেরে উঠবেন।

উভয়ের মধ্যে বিবাদের সূত্রপাত হওয়ার কারণ এই কাউন্সিলের কার্যবিবরণীতে মিস্টার ফ্রান্সিস একটি প্রস্তাব হেস্টিংসের বিরুদ্ধে লিপিবদ্ধ করেন, এবং কিছুতেই তা প্রত্যাখ্যান করতে চান না। প্রস্তাবের বিষয়বস্তু কী তা সঠিক আমি জানি না, তাই সে বিষয়ে চিঠিতে মন্তব্য করা থেকে বিরত রইলাম। তা ছাড়া এইসব রাজনৈতিক বিবাদে মাথা গলানোর কোনো আগ্রহ আমার নেই, এমনকি কানে শুনতেও আমার বিরক্তিবোধ হয়। ডুয়েলিং ব্যাপারটাই আমার কাছে একটা অসভ্য প্রথা মনে হয়। অবশ্য মানুষের জীবনে এমন সব অপ্রত্যাশিত ঘটনার উদ্ভব হয়, যে তাতে ডুয়েল লড়ে সমস্যার সমাধান করা ছাড়া উপায় থাকে না। সমাজের যা বর্তমান রীতিনীতি তাতে এ ছাড়া উপায়ও থাকে না। ভাল বন্ধুবান্ধবরা এইসব ব্যক্তিগত বিবাদের নিষ্পত্তি করতে পারেন, কিন্তু সেরকম বন্ধু পাওয়াও সহজ নয়। কলকাতার ইংরেজ সমাজ ফ্রান্সিসকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। তিনি এখন গবর্নমেন্টের বিরোধী পক্ষের নেতা, সুতরাং ডুয়েলের পিস্তলের গুলিতে হঠাৎ তাঁর মৃত্যু হলে অনেকেই খুব দুঃখিত হবেন।

গত চিঠি লেখার পর থেকে আমার মুসলমান ভৃত্যদের নিয়ে বড় ঝঞ্ঝাটে পড়েছি। তার কারণ, কয়েকটি ব্যাপারে তাদের গোঁড়ামি এত প্রবল, যে তাতে কোনো কাজ চলে না। যেমন মুসলমান খানসামা বা বেয়ারারা শুয়োরের মাংস স্পর্শ করে না। তার ফলে কোনোদিন এই খাদ্যটি আমাদের খানা টেবিলে উঠলে তারা টেবিল বা প্লেট কিছুতেই পরিষ্কার করে না। রাঁধুনি বা অন্য ভৃত্যদের তা করতে হয়। এই সংস্কারটা তাদের ধর্মের অঙ্গ বলে আমি বিশেষ আপত্তি করিনি। এ অসুবিধা দেখলাম শহরের সকল ইয়োরোপীয় বাসিন্দাদের ভোগ করতে হয়। কেবল সেনাবিভাগের লোকেরা এই দায় থেকে একরকম মুক্ত বলা চলে। সকলের একই সমস্যা দেখে অবশেষে শহরের ইয়োরোপীয় অধিবাসীরা মনস্থ করেন যে, মুসলমান ভৃত্যদের তারা হয় এই সংস্কারটি ছাড়তে, না—হয় চাকরি ছাড়তে বাধ্য করবেন। প্রথমে তারা চাকরি ছেড়ে দেবে ঠিক করল, কারণ সামান্য চাকরির জন্য ইহকাল—পরকালের ধর্ম জলাঞ্জলি দিতে তারা রাজি নয়। তাদের এই সিদ্ধান্তে আমরা বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু দিন চারেক পরে তারা ফিরে এসে পুনরায় চাকরি করার ইচ্ছা জানাল। নিষিদ্ধ খাদ্যটি স্পর্শ করতে তাদের আর আপত্তি হল না, কারণ তারা বলল যে, পরে স্নান করে ফেললে স্পর্শদোষ কেটে যায়। এই স্নান করার আলসেমির জন্য তারা টেবিল বা প্লেট সাফ করতে চাইত না। যা—ই হোক, এখন সব একরকম ঠিক হয়ে গেছে, এবং কোনো কাজকর্ম করতে আর কোনো সংস্কার বা ওজর—আপত্তি নেই।

প্রথমে যে গুরুতর ঘটনার কথা উল্লেখ করেছি (হায়দর আলির যুদ্ধ), তা হল কর্নেল বেলির সেনাবাহিনীর বিচ্ছিন্নভাবে সংহারের ঘটনা। আমার বিশ্বাস, শীঘ্রই আমরা এই দুর্ঘটনার প্রতিশোধ নিতে পারব। জবরদস্ত সেনাধ্যক্ষ সার আয়ার কুট কয়েকদিনের মধ্যেই যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হবেন, এবং প্রতিপক্ষের অসংযত সেনাদলকে প্রচণ্ড আঘাত করে শায়েস্তা করবেন। এই যুদ্ধের ব্যাপারে সম্প্রতি সত্যই আমার কৌতূহল খুব বেড়েছে।

এখন সবচেয়ে অস্বস্তিকর হল এখানকার আবহাওয়া। অত্যন্ত গরম পড়েছে, এবং বাইরের প্রকৃতি মনে হয় যেন দমবন্ধ করে আছে, একটুও হাওয়া নেই কোথাও। কত রকমের পোকামাকড় যে সব সময় ঝঙ্কার করছে তার ঠিক নেই। সবচেয়ে অসহ্য হল এখানকার ছারপোকা ও মাছি। ছারপোকার দুর্গন্ধে ঘর যেন ভরে থাকে সব সময়। আমাদের দেশে ইংলন্ডেও ছারপোকা আছে, কিন্তু এরকম বিকট দুর্গন্ধ তাদের নেই। মধ্যে মধ্যে বাতাসে কীটপতঙ্গ উড়িয়ে নিয়ে যায় বটে, কিন্তু বর্ষা না—কাটা পর্যন্ত এদের হাত থেকে নিস্তার নেই। অর্থাৎ আগামী মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত এদের উপদ্রব সহ্য করতে হবে মনে হয়।

কালিকটে একজন ক্যাপ্টেন আমাদের দেখাশুনা করতেন। কয়েক মাস আগে তিনি পালিয়ে এসে আমাদের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। এখন এদিকে তিনি একটা চাকরির খোঁজ করছেন। মিস্টার ফে তাঁকে একতলায় একটি ঘর দিয়েছিলেন থাকার জন্য, কয়েক সপ্তাহ তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তাঁর নাম ওয়েস্ট। এই ভদ্রলোকের কাছ থেকে আমাদের বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্রের সমস্ত খবর আমরা পেয়েছিলাম। ওয়েস্ট বেশ হৃষ্টপুষ্ট লোক, খুব পরিশ্রমী। এখানকার আবহাওয়া তিনি বেশ ধাতস্থ করে দিয়েছেন। সম্প্রতি তিনি পাটনায় গেছেন কয়েকটি বোটের দায়িত্ব নিয়ে এবং সেখানে কিছুদিন থাকবেন মনস্থ করেছেন। শোনা যায়, মিস্টার আয়ার্স তাঁর সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলেন এবং তাঁকে নাকি গোপনে হত্যা করারও চক্রান্ত হয়েছিল। তার কারণ হল, জন ছয়—আট বদমায়েশ সেপাই নিয়ে আয়ার্স স্থানীয় ধনী গৃহস্থদের ধনসম্পত্তি লুট করতে চেয়েছিলেন, এমন কি প্রয়োজন হলে তাদের খুন করারও মতলব করেছিলেন। স্বভাবতই মিস্টার ওয়েস্ট এই বীভৎস চক্রান্তে কোনো সহযোগিতা করতে চাননি, এবং তার জন্য আয়ার্সের দল তাঁর উপর খুবই ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। পাছে ওয়েস্ট তাঁদের এই হীন চক্রান্ত বাইরে ফাঁস করে দেন সেইজন্য তাঁকেই হত্যা করার জন্য ভয় দেখিয়েছিলেন আয়ার্স। অবশেষে ওয়েস্ট রাতারাতি একটা ক্যানো (Canoe)—তে করে কোচিনে পালিয়ে আসেন এবং সেখান থেকে বাংলাদেশে সুবিধামতো সমুদ্রপথে যাত্রা করেন। আমি ভাবছি, কী সাংঘাতিক লোক এই আয়ার্স। ধরা পড়লে ইংরেজরা নিশ্চয় তাঁকে পলাতক বলে গুলি করে মারবে।

.

৩ নভেম্বর ১৭৮০

ইংলন্ড থেকে এর মধ্যে আবার কিছু চিঠিপত্র পেয়েছি এবং তোমরা সকলে ভাল আছ জেনে খুশি হয়েছি। গত কয়েক মাস অত্যন্ত বোকার মতন দিনগুলো কাটিয়েছি কিন্তু এখন শহরে বেশ লোকজনের সমাগম হতে আরম্ভ হয়েছে। শুনেছি এই সময় শীতকালে কলকাতা শহরে লোকজনের বেশ ভিড় হয়। মিস্টার ফে—র ওকালতি ব্যবসাও বেশ ভাল চলছে। কয়েকদিন হল লেডি ও সার রবার্ট চেম্বার্স ভ্রমণ সেরে শহরে ফিরে এসেছেন এবং ৬০০ পাউন্ড দিয়ে কলকাতায় চমৎকার একটি বড় বাড়ি কিনেছেন। শ্রীমতী এখন নতুন বাড়ি আসবাবপত্তর দিয়ে সাজাতে খুব ব্যস্ত। সেইজন্য তাঁর সঙ্গে আজকাল খুব কম দেখাসাক্ষাৎ হয়। অবশ্য আজকাল দেখা হলে উনি আমাদের সঙ্গে খুব ভদ্র ব্যবহার করেন।

১৯ ডিসেম্বর ১৭৮০

মিস্টার ফে—র সঙ্গে সম্প্রতি এখানে ড. জ্যাকসন নামে এক ভদ্রলোকের আলাপ হয়েছে। ইনি আয়ারল্যান্ডের লোক এবং অনেক খ্যাতনামা লোকের সঙ্গে পরিচিত। পরিচয় হবার পর দু’জনের মধ্যে বেশ ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়েছে। ড. জে হলেন কোম্পানির চিকিৎসক, তাঁর নিজের প্রাইভেট প্র্যাকটিসও বেশ ভাল। মোটা টাকা তিনি রোজগার করেন। সপরিবারে ওঁরা একদিন আমাদের বাড়ি এসেছিলেন। বড় ছেলেটি বেশ সুশ্রী ও সুপুরুষ দেখতে, সেনাবাহিনীর লেফটেনান্ট। কিছুদিন হল তার বিবাহ হয়েছে। জাহাজে আসার সময় একটি মেয়ে তারই মায়ের সঙ্গে আসছিল, নাম মিস চ্যান্ট্রি। তার সঙ্গে পরিচয় হবার পর দু’জনের বিবাহ হয়। এখন তারা মা—বাবার সঙ্গেই এক পরিবারে আছে। খুব বেশি দিন এ দেশে তারা আসেনি। ডাক্তারের স্ত্রী হলেন জামাইকার মেয়ে এবং তা বলে দিতে হয় না, কারণ জায়গার গুণ তাঁর চরিত্রে প্রতিফলিত। সূর্যালোকে উজ্জ্বল যেমন তাঁর দেশ তেমনি উদার ও উন্মুক্ত তাঁর মন ও স্বভাবচরিত্র। তাঁর আতিথেয়তা সত্যিই দুর্লভ। পার্টি দিতে তিনি খুব ভালবাসেন, কিন্তু এক সেকেলে ধরনের পার্টি—রাত্রে খাবার পর একটু গানবাজনা আমোদ—আহ্লাদ না হলে তাঁর ভাল লাগে না। ডিনার পার্টি এঁরা সাধারণত দেন না, তবে শীতকাল আরম্ভ হবার পর ডিনারের নিমন্ত্রণ অনেকের কাছ থেকে পেয়েছি। এখানে ডিনারের সময় হল বেলা দুটো এবং অনেকক্ষণ সময় ডিনার টেবিলে বসে থাকতে হয়, বিশেষ করে শীতকালে। কারণ এখানে যাঁরা থাকেন তাঁরা দেখেছি গ্রিল, স্টু ইত্যাদি খাদ্য খুব ভালবাসেন এবং খুব গরম গরম টেবিলে না দিলে খান না। ‘বর্ধমান স্টু’ (Burdwan Stew) নামে এক রকমের স্টু আছে যা মাছ, মাটন ও মুরগি একসঙ্গে মিশিয়ে তৈরি করা হয়, কতকটা স্প্যানিশ ‘ওল্লা পোদ্রিদা’র মতন। অনেকে মনে করেন যে সিলভার সসপ্যানে রান্না না করলে বস্তুটি নাকি সুস্বাদু হয় না। হতে পারে হয়তো, কিন্তু তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না, কারণ সাদাসিধে খাবার খেতেই আমি ভালবাসি, বড়লোকি ভোজ্য আমার সহ্য হয় না। তাই খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে কোনো মতামত দেবার অধিকার নেই।

ডিনার খাবার সময় পর্যাপ্ত সুরাপানও করা হয় কিন্তু টেবিলের কাপড় সরিয়ে নিয়ে যাবার পর পান করার রীতি নেই। কেবল অবিবাহিতদের পার্টিতে এই রীতি মানা হয় না শুনেছি। ডিনার খাবার পর এখানে বিশ্রামের নামে নিদ্রার অভ্যাসটাও এত প্রবল যে তার হাত থেকে কেউ মুক্ত নন। মধ্যাহ্নভোজনের পর এই দিবানিদ্রার অভ্যাসের জন্য বিকেলে কলকাতার রাস্তাঘাটে ইয়োরোপীয়দের একেবারেই দর্শন পাওয়া যায় না, মনে হয় যেন মাঝরাতের মতন সব নিস্তব্ধ ও ফাঁকা। সন্ধের পর সাহেবরা রাস্তায় একে—একে বেরুতে থাকেন, ঘোড়দৌড়ের মাঠের দিকে সান্ধ্যভ্রমণে যান। রাস্তাঘাট ধুলোয় ভরে থাকে, দম ফেলতেও কষ্ট হয়। ভ্রমণান্তে বাড়ি ফিরে সকলে নিয়মিত চা—পান করেন। চা—পানে এখানে সকলেই অভ্যস্ত, শীত—গ্রীষ্ম কোনো সময়েই তা বাদ দেওয়া হয় না। চা—পান শেষ হলে রাত দশটা পর্যন্ত তাস—খেলা বা গানবাজনা চলতে থাকে, তারপর ‘সাপার’ খাবার সময় হয়। পাঁচ তাসের ‘লু’ (Five Card Loo) খেলাই বেশি চলে এবং এক টাকা থেকে দশ টাকা পর্যন্ত বেটিং চলে। তোমাদের হয়তো মনে হবে যে বেটিং—এর মাত্রা খুব বেশি, কিন্তু এখানকার প্রথানুযায়ী কিছুই নয়। ট্রিডলি ও হুইস্ট খেলারও চলন আছে, কিন্তু শেষোক্ত খেলায় মহিলারা সাধারণত যোগদান করেন না। খেলার ঝক্কি কম হলেও ভদ্রলোকেরা এত বেশি বেটিং করেন, যে প্রত্যেকের ভয় হয় হারজিতের কথা ভেবে।

বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতদের বাড়িতে বেড়াতে যাবার সময় হল সন্ধ্যাবেলা। অপরিচিতদের সঙ্গে পরিচয় করতে হলেও এই সময় সাক্ষাৎ করার রীতি। অর্থাৎ সামাজিক পরিচয়াদির ব্যাপারটা সন্ধ্যার পরেই শুরু হয়। খুব বেশি সময় কেউ একজনের বাড়িতে এসে থাকেন না, কারণ একদিনে তাঁকে একাধিক বাড়িতে যেতে হয়, আবার নিজের বাড়িতেও অতিথি আসার সম্ভাবনা থাকে। এই সামাজিকতা রক্ষার ব্যাপারটা প্রধানত মহিলাদের। ভদ্রলোকেরাও এই সময় আলাপ—পরিচয় করতে আসেন, এবং তখন তাঁদের যদি টুপি নামিয়ে রাখতে বলা হয় তাহলে বুঝতে হবে যে সেদিনের ‘সাপার—এ’ তিনি নিমন্ত্রিত হলেন। তাই অনেক ভদ্রলোককে দেখা যায়, সন্ধ্যার পর আলাপ করতে এসে টুপিটা হাতে নিয়ে গৃহকর্ত্রীকে দেখিয়ে নাচাতে থাকেন। ইচ্ছা যাতে টুপিটা তাঁকে রাখতে বলা হয়, কারণ তাহলে তিনি রাতের সাপার খেয়ে যেতে পারেন। কিন্তু সহজে গৃহকর্ত্রীরা তা বলেন না, এবং তিনি প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে টুপি নাচাবার পর বিমর্ষচিত্তে বিদায় নেন।

সামনে ক্রিসমাস ও নববর্ষের উৎসব আসছে, ঘরে ঘরে তার তোড়জোড় চলছে। নববর্ষের পাবলিক বলনাচ একটা বড় ঘটনা। এ সম্বন্ধে এখন কিছু তোমাদের লিখব না, উৎসব শেষ হয়ে গেলে জানাব। সম্প্রতি আমার মেজাজটাও খুব ভাল নয়, কারণ কয়েকটা ব্যাপারে মিস্টার ফে—র আচরণে আমি অসন্তুষ্ট হয়েছি। অদ্ভুত চরিত্রের লোক আমার স্বামী মিস্টার ফে। শহরের প্রভাব—প্রতিপত্তিশালী লোকজনের সঙ্গে, অথবা যাঁরা তাঁর ওকালতি কাজকর্মে বিশেষ সাহায্য করতে পারেন এমন সব ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ—পরিচয় করতে তিনি একটুও উদগ্রীব বলে মনে হয় না। আজ পর্যন্ত তাঁকে সঙ্গে করে আমি ডা. জ্যাকসনের বাড়ি যেতে পারিনি, অথচ শহরে কোনো নতুন ভদ্রলোক এলে আগে তাঁর সঙ্গেই পরিচিত হবার চেষ্টা করেন। এ বিষয়ে কিছু বললে তিনি পরিষ্কার জবাব দেন যে এত বেশি সামাজিকতা তাঁর ধাতে সয় না। দু’একবার তিনি সার রবার্ট চেম্বার্সের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন বটে, কিন্তু সুপ্রিমকোর্টের অন্যান্য জজদের সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ পরিচয় করেননি, আদালতে তাঁদের চেহারা দেখেছেন মাত্র। কিছুদিন আগে সার এলিজা ইম্পে তাঁর সঙ্গে জাস্টিস হাইডের পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, এবং চিফ জাস্টিস নিজে যখন সেজন্য তাঁর দিকে এগিয়ে আসছিলেন তখন মিস্টার ফে এমনই মুখচোরা যে তিনি ভয়ে বলে ফেললেন, হাইডের সঙ্গে তাঁর আগেই পরিচয় হয়েছে। এই কথা শুনে চিফ জাস্টিস সেই যে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলেন, আর তাঁর দিকে ফিরে চাননি। ঘটনাটি ঘটেছিল যেদিন মিস্টার ফে আদালতের অ্যাডভোকেট তালিকাভুক্ত হন। এখানকার রীতি হল, আদালতের নতুন সেশন আরম্ভ হবার প্রথম দিনে জাস্টিস হাইডের বাড়িতে ব্রেকফাস্টের সভায় ব্যবহারজীবীরা সকলে মিলিত হন এবং সেখান থেকে শোভাযাত্রা করে কোর্টহাউসে যান।

আজকের মতন চিঠি এইখানেই শেষ করছি। পরের চিঠিতে, আশা করি, আরও অনেক নতুন খবর দিতে পারব।

.

তোমাদের স্নেহার্থিনী

ই. এফ.

৪  

চতুর্থ চিঠি

কলকাতা, ২৭ জানুয়ারি ১৭৮১

প্রিয় বোন,

.

গত চিঠি লেখার পর থেকে আমরা এখানে ক্রিসমাসের ফুর্তিতে মশগুল হয়ে আছি। ইংলন্ডে বোধহয় ক্রিসমাসের এত সমারোহ হয় না, কিন্তু এখানে প্রাচীনকালের উৎসবের মতন বেশ ধুমধাম করে ক্রিসমাস—পর্ব পালন করা হয়। ক্রিসমাসের দিন শহরের ইংরেজ ভদ্রলোকেরা তাঁদের বাড়িঘর সুন্দর করে সাজান, বাইরে থেকে দেখতে চমৎকার লাগে। বড় বড় কলা গাছ ফটকের দু’পাশে বসানো হয়, এবং বাড়ির থাম, দরজা ইত্যাদি ফুলের মালা জড়িয়ে এমনভাবে সাজানো হয় যে, দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে দেখতে ইচ্ছে করে।

কর্মচারীরা সকলে মাছ, ফলমূল ইত্যাদি নানাবিধ জিনিস সাহেবকে ওইদিন ভেট বা উপহার পাঠায়। বেনিয়ান থেকে আরম্ভ করে খানসামা—চাপরাশি পর্যন্ত কেউ বাদ দেয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই উপহারের বদলে আমাদেরও বকশিস ও উপহার দিতে হয়, কিন্তু তাহলেও বড়দিনের এই উপহার আমাদের কাছে সত্যিই খুব লোভনীয়।

প্রেসিডেন্সির সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকদের ওইদিন বিরাট ডিনার দেওয়া হয় গবর্নমেন্ট হাউসে, এবং সন্ধ্যায় মহিলাদের আপ্যায়ন করা হয় জমকালো বলনাচে ও সাপারে। এই ভোজ ও বলনাচের পুনরাবৃত্তি হয় নববর্ষে ও রাজার জন্মদিনে। ‘হয়’ না বলে ‘হয়েছে’ বলা উচিত ছিল, কারণ শেষের উৎসবের তারিখটি গ্রীষ্মকালে পড়াতে খুবই অসুবিধা হতে থাকে। একে দারুণ গরম, তার উপর সকলকে পুরো পোশাক—পরিচ্ছদ পরে ফিটফাট হয়ে যেতে হয়, ভিড়ও হয় খুব। গরমে এমন অবস্থা হয় যে, অনেকে সভাস্থলেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারিখটা তাই বদলে ৮ ডিসেম্বর করা হয়েছে এবং তাতে সকলেই খুব খুশি হয়েছে মনে হয়। উৎসবের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়ার সাধ্য নেই আমার, ইচ্ছাও নেই। এককথায় বলা যেতে পারে যে, চরম আড়ম্বরবহুল উৎসব বলতে যা বোঝায়, এগুলি সেই ধরনের উৎসব। একটির সঙ্গে অন্যটির বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই, এবং বিবরণ দিলে তা একঘেয়ে ও বিরক্তিকর মনে হবে বলে আপাতত দিলাম না।

কিছুদিন আগে মিসেস জ্যাকসন আমার জন্য হারমনিক ট্যাভার্নের একখানি টিকিট সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন। শহরের বাছা বাছা ভদ্রলোকেরা হারমনিকের পৃষ্ঠপোষক, শীতকালে তাঁরা বর্ণানুক্রমে কনসার্ট, বলনাচ ও নৈশভোজ দিয়ে থাকেন। পালাক্রমে প্রায় এক লক্ষ অন্তর হারমনিকে এই পার্টি দেওয়া হয়। মিস্টার টেলার নামে এক ভদ্রলোকের পার্টিতে আমি গিয়েছিলাম। তারপরই আমার চাঁদা শেষ হয়ে গেল। দুঃখের কথা, কারণ শহরে এরকম সুরুচিপূর্ণ ও সুপরিকল্পিত আনন্দ—উৎসবের ব্যবস্থা আর কোথাও নেই। যে—কেউ এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হলে আপশোস করবেন। বিচিত্র সব সঙ্গীতের আসর আমরা উপভোগ করেছি। লেডি চেম্বার্স খুব চমৎকার বীণা বাজাতে পারেন, এবং একদিন নিকোলাসের ‘সোনাটা’ বাজিয়ে সকলকে মোহিত করে দিলেন। এক ভদ্রলোক এই বাজনা শুনে পরদিন আমায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এত সুন্দর সঙ্গীত জীবনে আর কোনোদিন শুনেছি কি না।

এই সুরসভায় মিসেস হেস্টিংসও উপস্থিত ছিলেন। তবে তিনি অনেক দেরি করে এসেছিলেন, এবং এসে হলের উল্টোদিকে এত দূরে বসেছিলেন যে, তাঁকে দেখা যায় না বা কথাবার্তা বললেও শোনা যায় না। আমি তাঁকে অনেকক্ষণ পর্যন্ত দেখতেই পাইনি। বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাবার পর মিসেস জ্যাকসন আমার মুখের দিকে চেয়ে কী যেন সন্ধান করছি দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, গবর্নর—পত্নীকে আমি অভিনন্দন জানিয়েছি কি না? আমি বললাম, ‘না, জানাইনি; কারণ জানাবার সুযোগ পাইনি। যতবার তাঁর দিকে চেয়ে চোখে চোখ ফেলার চেষ্টা করেছি, ততবার তিনি অন্যদিকে চেয়ে থেকেছেন।’

‘ও, তা—ই নাকি?’ মিসেস জ্যাকসন বললেন, ‘তাহলে তো হবে না। আপনাকে চোখ না ফিরিয়ে একদৃষ্টে তাঁর দিকে চেয়ে থাকতে হবে, যতক্ষণ না তিনি দেখতে পান। মিস চ্যান্ট্রি তা—ই করেছেন, আমি তা—ই করেছি, আপনাকেও তা—ই করতে হবে। তা না করলে তিনি ক্ষুব্ধ হবেন।’

আমি তাঁর উপদেশ অনুসারে তা—ই করলাম, পলক না ফেলে চেয়ে রইলাম মিসেস হেস্টিংসের দিকে। দেখলাম তাতে কাজ হল, অল্পক্ষণের মধ্যেই তিনি আমাকে দেখতে পেয়ে ঈষৎ গ্রীবা বেঁকিয়ে মুচকি হাসলেন, আমিও ঘাড় নামিয়ে বিনত অভিনন্দন জানালাম। কিছুক্ষণ পরে তিনি উঠে এসে আমাদের কাছে বসলেন এবং আমার সঙ্গে বেশ মিষ্টি করে কথা বলতে লাগলেন।

লেডি কুট (Lady Coote) ও মিস মলি ব্যাজেটের সঙ্গে গবর্নর—গিন্নি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। মলি ও লেডি কুটের গভীর বন্ধুত্ব বাল্যকাল থেকে। বালিকা বয়সে দু’জনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, বিবাহ যাঁর আগে হবে তাঁর সঙ্গে অন্য বন্ধুকে থাকতে হবে। লেডি কুটের বাবা ছিলেন সেন্ট হেলেনার গবর্নর। সার আয়ারের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হবার পর সেন্ট হেলেনা থেকে যখন তিনি চলে আসেন, তখন মলি, হেলেনার মেয়ে হয়েও, তাঁর সঙ্গী হয়ে ইংলন্ডে যান সেখান থেকে ভারতবর্ষে আসেন। তারপর থেকে তাঁরা দু’জন একসঙ্গে আছেন। পরস্পরের প্রতি এরকম গভীর বন্ধুত্ব ও ভালবাসা সচরাচর দেখা যায় না।

.

কলকাতা, ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৭৮১

গতকাল আমরা আমাদের বন্দিজীবনের মুক্তির দিনের বাৎসরিক উৎসব পালন করেছি। ডা. জ্যাকসনকে নিমন্ত্রণ করেছিলাম। মিস্টার ও’ডনেল ও কয়েকজন বন্ধুবান্ধবও অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। এইদিনটাকে আমি আমার জীবনের ‘জুবিলি ডে’ বলি। আশা করি, তোমরা ইংলন্ডে থেকেও আমার এইদিনের স্মৃতিটুকু বিস্মৃত হওনি।

একটা কথা মনে থাকতে বলি—সদর খাঁ ও আয়ার্স আমাদের দু’জন বড় শত্রু, কিছুদিন হল তাঁদের বদমায়েশি বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। প্রথম ব্যক্তি তেলিচেরিতে আহত হয়ে মারা গেছেন, দ্বিতীয়জন মনে হয় মদ্যপান করে অসভ্যের মতন গালাগাল করতে করতে মিলিটারি অফিসারদের সামনে উদ্ধত ভঙ্গিতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। ভঙ্গিটা এই যে গুলি করে করুক, পরোয়া করি না। অফিসাররা অবশ্য তা—ই করেছিলেন, গুলি করেই তাঁকে মারা হয়েছিল। আয়ার্সের মতন অদ্বিতীয় দুশমনের এইভাবে মৃত্যু হওয়াটাও যথেষ্ট সম্মানের মনে হয়। আমি ভেবেছিলাম, তাঁকে গ্রেফতার করে বন্দি করা হবে এবং পরে সামরিক বিচারে পলাতক বলে গুলি করা হবে।

হতভাগ্য ওয়েস্টও মারা গেছেন। বেচারা যে বোট নিয়ে পাটনা যাত্রা করেছিলেন, নদীর চড়ায় আটকে তা ডুবে যায় এবং তিনিও মারা যান।

.

কলকাতা, ২৬ মার্চ, ১৭৮১

গবর্নমেন্টের চিঠিপত্তর নিয়ে শীঘ্রই একটা জাহাজ ইয়োরোপ যাবে। চিঠি পাঠাবার এ সুযোগ ছাড়া উচিত নয় বলে আমাদের এখানকার থিয়েটার সম্বন্ধে সামান্য দু’চার কথা বলে চিঠি শেষ করছি।

থিয়েটার—গৃহ চাঁদা তুলে তৈরি করা হয়েছে এবং দৃশ্যপট ইত্যাদি দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। নাটক অভিনয়ে সাধারণত অ্যামেচাররাই অংশগ্রহণ করেন। পেশাদার অভিনেতাদের অভিনয় করতে দেওয়া হয় না। কিন্তু তাহলেও এই অ্যামেচার থিয়েটারে যেসব অভিনয় আমি দেখেছি—যে কোনো ইয়োরোপীয় স্টেজের অভিনয়ের সঙ্গে তার তুলনা করা চলে। কিছুদিন আগে Venice Preserved নামে একটি নাটক অভিনীত হয়েছিল। ক্যাপ্টেন কল (সেনাবিভাগের), মিস্টার ড্রোজ (বোর্ড অফ ট্রেড—এর), ও লেফটেন্যান্ট নর্ফার যে তিনটি চরিত্র অভিনয় করেছিলেন তা সত্যি খুব উচ্চাঙ্গের। নর্ফারকে স্টেজের বাইরে দেখলে কীরকম মেয়েমুখো মনে হয়, কিন্তু শুনেছি সামরিক অফিসার হিসাবে তিনি নাকি খুব সাহসী। বাইরে এমনভাবে সাজগোজ করে থাকেন তিনি যে দেখলে মনে হয় যেন বলনাচ নাচতে যাচ্ছেন। অথচ হঠাৎ কাজকর্মের তলব পড়লে তিনি আদৌ ক্যাবলামি করেন না। জানি না, কী করে ভদ্রলোক এমন পরিপাটি করে সেজে থাকেন। কেশের বাহার দেখে মনে হয় তারই পরিচর্যা করতে বেশ সময় লাগে।

এই ধরনের অ্যামেচার থিয়েটারের একটা বড় অসুবিধে হল যে, কেউ কোনো পরিচালকের তাঁবে কাজ করতে চান না। সকলেই স্বাধীন, এবং যাঁর যা ইচ্ছা সেই ভূমিকায় অভিনয় করতে চান। তার ফলে যাঁকে যা মানায় না এরকম বেমানান অভিনয় অনেককেই করতে হয়। একটা হাস্যকর অবস্থার সৃষ্টি হয় অভিনয়ের সময়। তার জন্য ট্র্যাজেডি দেখতে গিয়ে প্রায়ই কমেডির মতন হাসতে হয়। থিয়েটারের মতন একটা শিশুপ্রতিষ্ঠানের পক্ষে এরকম অবস্থার সৃষ্টি হওয়া মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। কিন্তু তবু বলব, সন্ধ্যাবেলা থিয়েটারে যাওয়ার চেয়ে ভাল সময় কাটানোর আর কিছু নেই। টাকাপয়সার অভাব না থাকলে আমি কিন্তু একটা অভিনয় দেখাও বাদ দিতাম না। তবে একটি করে স্বর্ণমোহর প্রবেশ—দক্ষিণা দিতে হয়। কয়েক ঘণ্টার আমোদের জন্য এতটা মূল্য দেওয়া অসম্ভব।

আজকের মতন বিদায় নিচ্ছি, পরে আবার লিখব।

তোমাদের স্নেহপ্রার্থিনী

ই. এফ.

পঞ্চম চিঠি

কলকাতা, ২৬ মে ১৭৮১

.

প্রিয় বোন,

তুমি বোধহয় লক্ষ করেছ, গত কয়েক মাস ধরে আমার চিঠির সুর অনেক বদলে গেছে, আগেকার উচ্ছ্বাস আর বিশেষ নেই। ব্যক্তিগত জীবনের সব ঘটনা তোমাকে জানাইনি, কারণ তুমি তা শুনলে দুঃখ পাবে। মিস্টার ফে—র অবিবেচনা ও অসংযত আচরণ ক্রমে অসহ্য হয়ে উঠছে। সে—সব কথা তোমাকে জানাইনি, এবং তাই চিঠি ভর্তি করার জন্য অনেক আজেবাজে কথা লিখতে হয়েছে। তা হলেও বাজে কথার ফাঁকে ফাঁকে হয়তো তুমি তার খানিকটা আভাস পেয়েছ এবং ভেবেছ যে জীবনটা আমার স্বাভাবিকভাবে চলছে না, কোথায় একটা কিছু বিপর্যয়ের সূচনা হয়েছে। আমার মনে হয় না মিস্টার ফে আর বেশি দিন কলকাতা শহরে ওকালতি ব্যাবসা করতে পারবেন।

এখানে আসার পর থেকে ভদ্রলোক তাঁর নিজের খেয়ালখুশিমতন চলছেন, কোনো বিষয়ে আমার মতামত বা পরামর্শ নেওয়ার দরকার বোধ করেন না। মুষ্টিমেয় একদল লোক, যাঁদের একমাত্র কাজ হল গবর্নমেন্টের বিরোধিতা করা এবং পদে পদে তার কাজকর্মে বাধা দেওয়া, তাঁদের সঙ্গে মিস্টার ফে—র খুব বন্ধুত্ব। তার ফলে সরকারি মহলে তিনি রীতিমতো অপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। কিছুদিন আগে কলকাতা শহরের ঘরবাড়ির উপর যখন ট্যাক্স ধার্য করা সাব্যস্ত হয় তখন আমাদের বাড়িতে মিস্টার ফে—র বন্ধুবান্ধবদের ঘন ঘন বৈঠক বসতে থাকে, এবং এই ট্যাক্স যে বেআইনি সে সম্বন্ধে তিনি তাঁদের আন্দোলন করার জন্য উস্কানি দিতে থাকেন। ব্যাপারটা জানতে পেরে আমি প্রতিবাদ করি এবং তাঁকে এই সর্বনাশের পথ অবিলম্বে ছাড়তে অনুরোধ করি। আমাদের গবর্নরের চরিত্র কার না জানা আছে? তিনি যেমন তাঁর বন্ধুদের কখনও ভোলেন না, তেমনি শত্রুদেরও ভুলেও ক্ষমা করেন না। অতএব মিস্টার ফে যদি ভেবে থাকেন যে মিস্টার হেস্টিংসের শত্রুতা করে তিনি গা বাঁচিয়ে থাকতে পারবেন, তাহলে তিনি মূর্খের স্বর্গলোকে বাস করছেন বলতে হবে। কিন্তু আমার সমস্ত অনুরোধ—উপরোধ ব্যর্থ হয়, কারণ আমার কোনো পরামর্শই তিনি গ্রাহ্য করেন না, তাচ্ছিল্য করে উপেক্ষা করেন। তাঁর পন্থা তিনি এখনও পূর্ণোদ্যমে অনুসরণ করে চলেছেন, এবং যত অবাঞ্ছিত ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানো যেন তাঁর অন্যতম কর্তব্য হয়ে উঠেছে। তার জন্য নিজের ওকালতি—ব্যবসায়ে তিনি আর মন দিতে পারেন না।

যখনই কোনো পার্টিতে নিমন্ত্রণ হয় তখনই মিস্টার ফে যে—কোনো অজুহাতে তা এড়িয়ে যেতে চান, এবং আমাকে উপস্থিত হয়ে তাঁর অনুপস্থিতির কারণ বুঝিয়ে বলতে হয়। লেডি চেম্বার্স, জ্যাকসনরা এবং আর দু—একজন এখনও তাঁর প্রতি খানিকটা আগ্রহ দেখান বটে, কিন্তু আর কতদিন যে তা দেখানো সম্ভব হবে জানি না। কিছুদিন হল চেম্বার্সের একটি পুত্রসন্তান হয়েছে। আমি তখন তাঁদের কাছেই ছিলাম। শিশুটির সঙ্গে আমারও একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কয়েকদিনের মধ্যেই তার নামকরণ উৎসব হবে। স্যার এলিজা ও লেডি ইম্পে নবজাত শিশুর আনুষ্ঠানিক অভিভাবকত্ব গ্রহণ করবেন। লেডি চেম্বার্সের ইচ্ছা আমিও অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকি, কিন্তু স্যার রবার্ট কিছুতেই মিস্টার ফে—কে অনুষ্ঠানে ডাকতে রাজি নন। সুতরাং মুশকিল হয়েছে, যদি মিস্টার ফে’কে ব্যাপারটা বোঝাতে পারি তবেই আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হবে।

.

কলকাতা, ৩ জুন ১৭৮১

অনুষ্ঠানপর্ব শেষ হয়ে গেছে। মিস্টার ফে—কে নিয়ে আমার কোনো হাঙ্গামা হয়নি। কারণ নিমন্ত্রণের কথা বলামাত্রই তিনি বললেন যে সেদিন তাঁর অন্য একটা নিমন্ত্রণ আছে, তাই তিনি যেতে পারবেন না। অনুরোধ করলেন যেন চেম্বার্সদের তাঁর অনুপস্থিতির কারণটা বুঝিয়ে বলি। এরকম অপ্রত্যাশিতভাবে রেহাই পেয়ে আমি তাড়াতাড়ি বললাম, হ্যাঁ, তা তো নিশ্চয়ই বলব। আমার খুব ভাল লাগেনি ব্যাপারটা। বুঝতেই পারছ, না—লাগাই স্বাভাবিক। অনুষ্ঠানে মনপ্রাণ দিয়ে যোগ দিতে পারিনি, যদিও স্যার এলিজা ও তাঁর স্ত্রী আমার সঙ্গে খুবই ভাল ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু তাহলে কী হবে? এমন একটা অনুষ্ঠান যেখানে আমার স্বামীর উপস্থিতি অবাঞ্ছনীয়, তা সে যে কারণেই হোক—না কেন আমার কখনও ভাল লাগতে পারে না। তাই প্রসন্নমুখে আমার পক্ষে ঘুরে বেড়ানোও সম্ভব হচ্ছিল না। তা সত্ত্বেও অনুষ্ঠানে আমাকে যেতে হয়েছিল নিজেরই স্বার্থে, কারণ মানুষের সাহচর্যের ও পরিচয়ের সুযোগ ছিল বলে। এ সুযোগ ছাড়ব কী করে? বিপদে—আপদে তো এঁদেরই শরণাপন্ন হতে হবে? আর বিপদ তো আমার যে—কোনো সময়ই হতে পারে।

.

কলকাতা, ২৪ জুন ১৭৮১

কোর্ট যদিও অনেকদিন হল খুলে গেছে, মিস্টার ফে প্রায় খালি হাতেই বসে আছেন, কোনো মামলা—মকদ্দমা নেই। অ্যাটর্নিরা তাঁকে মামলা দিতে ভয় পান। একদিনে দু’জন অ্যাডভোকেট মামলায় নিয়োগ করা হয় এবং অন্যদিকে একজন, তবু তাঁকে মামলা চালাতে দেওয়া হয় না। এটা যে কতখানি দুঃখের ব্যাপার তা তুমি বুঝতে পারবে না। অর্থ রোজগারের এত বড় সুযোগ মিস্টার ফে স্বভাবের দোষে হারিয়েছেন। এসব সহ্য করা আমার পক্ষে যে কত কঠিন তা আমিই জানি। ভগবান আমাকে অসাধারণ সহ্যগুণ দিয়েছেন। আমার শুধু এইটুকুই সান্ত্বনা যে তাঁকে আজকের এই অবশ্যম্ভাবী সর্বনাশের পথ থেকে বাঁচাবার জন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি।

গতকাল লেডি চেম্বার্সের কাছে আমার অবস্থার কথা সমস্ত খুলে বলেছি। এ কথাও বলেছি যে মিস্টার ফে অল্পদিনের মধ্যেই কলকাতা শহর ছেড়ে যেতে বাধ্য হবেন। সব শুনে খুবই বিচলিত হয়ে তিনি বললেন, ‘আপনি মোটেই চিন্তিত হবেন না। মিঃ ফে যদি চলেই যান তাহলে সোজা আপনি আমার বাড়িতে এসে উঠবেন এবং নিজের বাড়ির মতন থাকবেন। স্যার রবার্ট ও তাঁর স্ত্রী—র এই সহৃদয় আমন্ত্রণ সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করলেন। ঈশ্বরের ইচ্ছায় এরকম একটি নিশ্চিন্ত আশ্রয় পেয়ে স্বস্তি পেলাম। যতদিন না ইয়োরোপে ফিরে যেতে পারি ততদিন অন্তত নির্ভাবনায় থাকতে পারব।

.

কলকাতা, ১৭ জুলাই ১৭৮১

এ মাসের শেষ তারিখে আমরা বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। ভবিষ্যতে কবে আবার আমি ও আমার স্বামী এক বাড়িতে বাস করার সুযোগ পাব, তা ঈশ্বর জানেন। আমাদের মনোমালিন্যের ব্যাপারটা মিস্টার ফে যে কীরকম উদাসীনভাবে গ্রহণ করেছেন তা চোখে না দেখলে তুমি বুঝতে পারবে না। যেন কিছুই ঘটেনি, অথবা ঘটলেও কিছু আসে, যায় না, এরকম একটা ভাব নিয়ে থাকেন তিনি সবসময়। সম্প্রতি তাঁর একজন খুব বড় পেট্রন জুটেছেন, কর্নেল ওয়াটসন। সকলেই জানেন, ওয়াটসন কৃতী ও সংগতিসম্পন্ন পুরুষ, গবর্নমেন্টের বিরোধী পক্ষের একজন জাঁদরেল লোক, স্যার এলিজা ইম্পেরও ঘোর শত্রু। স্যার এলিজার বিরুদ্ধে ওয়াটসন অভিযোগ করে বিচার দাবি করেছেন। তার জন্য তাঁর একজন বিশ্বস্ত এজেন্ট চাই, যিনি গোপন নথিপত্র নিয়ে ইংলন্ডে যাবেন। মিস্টার ফে এই এজেন্টের কাজটি যোগাড় করার খুব চেষ্টা করেছেন। তার জন্য কয়েকটি দলিলপত্র লেখা তিনি বাঙালি কেরানিদের দিয়ে কপি করাতে আরম্ভ করেছেন। বাঙালিদের দিয়ে কপি করানোর কারণ হল, ইংরেজি তাঁরা বিশেষ জানেন না এবং যেটুকু জানেন তাতে ইংরেজি লেখার অর্থ বুঝতে পারেন না। সুতরাং গোপন বিষয় তাঁদের ইংরেজিতে লিখতে দিলে তা বাইরে প্রকাশ হবার সম্ভাবনা থাকে না।

কর্নেল ওয়াটসনকে আমাদের বাড়িতে কোনোদিন আসতে দেখিনি। সমস্ত কাজকর্ম তাঁরা এমনভাবে করেছেন যে মনে হয় যেন ভয়ানক রহস্যময় একটা ব্যাপার। আমি নিজে ব্যাপারটা একেবারেই পছন্দ করি না, কারণ এসব করে শেষ পর্যন্ত মানুষের যে—কোনো উপকার হতে পারে তা মনে হয় না। তাই আমি আভাস—ইঙ্গিতেও জানাইনি যে বিষয়টা সম্বন্ধে আমি কিছু জানি। তবু এখনও স্বামীর প্রতি স্ত্রী—র কর্তব্য কিছুতেই ভুলতে পারি না, তাই দূর থেকে অসহায়ের মতন ব্যাপারটা দেখে যাই, হাত—পা বাঁধা, কিছু করতে পারি না। আমাদের একজন অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় বন্ধু এই ঘটনার সঙ্গে জটিলভাবে জড়িয়ে পড়বেন। তুমি বুঝতেই পারছ কার কথা আমি ইঙ্গিত করছি। আজকের মতন এখানেই বিদায় নিচ্ছি, পরে বাড়ি বদল করে আবার তোমায় চিঠি লিখব।

তোমাদের স্নেহের বোন

ই. এফ.

৬  

ষষ্ঠ চিঠি

কলকাতা, ২০ আগস্ট ১৭৮১

.

প্রিয় বোন,

গত চিঠি লেখার পর থেকে কয়েকটি গুরুতর কারণে আমার মনের উপর দিয়ে বেশ বড় একটা ঝড় বয়ে গেছে। ঝড়ের ঝাপটা সহ্য করাই অসম্ভব মনে হয়েছিল। মিস্টার ফে গত ৩১ জুলাই তারিখে আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন। সেইদিনটা যে আমার কী ঝঞ্ঝাটে কেটেছে তা বলা যায় না। বাড়ির যেসব আসবাবপত্তরের দাম শোধ করা হয়নি সেগুলি দোকানদারদের ফেরত পাঠাতে হয়েছে, বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে ধার করে যা আনা হয়েছিল তা—ও তাদের ফিরিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতে হয়েছে। সব দিয়ে—থুয়ে বাকি যা ছিল শেষকালে একজন পাওনাদার এসে সব ঝেড়েমুছে নিয়ে চলে গেছে। আমার স্বামীটি তাঁর বেহিসেবি খরচের দায় সামলাবার জন্য এমন কঠিন শর্তে অত্যধিক সুদে তাঁর কাছ থেকে টাকা ধার করেছিলেন যার খেসারত শেষ পর্যন্ত এইভাবে দিতে হল। এখন আমাকে কপর্দকহীন, সহায়—সম্বলহীন একজন রিক্ত মহিলা বলতে পারো। সম্বল বলতে শুধু নিজের কয়েকখানা কাপড়জামা আছে। তা—ই দিয়েই স্বামীর অবিমৃষ্যকারিতার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে আমাকে, এবং তার যা কিছু কুফল তা—ও আমাকে একাই ভোগ করতে হবে। জানি না তা করা সম্ভব হবে কি না, কারণ এই ভ্রমণের সময় দীর্ঘ পথ চলাফেরা করার ফলে স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে গেছে। তার উপর কালিকটের বন্দিজীবনের দুঃসহ যন্ত্রণার কথা মনে হলে রীতিমতো ভয় হয়, দেহে আর কিছু আছে বলে মনে হয় না।

লেডি চেম্বার্স এই দুঃসময়ে আমাকে তাঁর সহোদর বোনের মতন কাছে টেনে নিয়েছেন, এবং যখন যেখানে যান সর্বদাই আমাকে সঙ্গে যেতে বলেন। কিন্তু বাইরের সমাজে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করা আমার পক্ষে সহজে সম্ভব হবে না, অন্তত কিছুদিন সময় লাগবে। যেদিন থেকে এখানে এসেছি সেইদিন থেকে একটি বিশেষ ঘটনার কথা জানতে পেরে আমি স্থির করে ফেলেছি যে মিস্টার ফে—র মতন মানুষের সঙ্গে কোনোমতেই আর আমার অদৃষ্টকে জড়িয়ে রাখা সম্ভব নয়। যে ব্যক্তি মানবিক ও আধ্যাত্মিক কোনো সম্পর্ককেই শ্রদ্ধা করতে শেখেননি তাঁর সঙ্গে জীবন কাটানো অসম্ভব। উকিল—বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করে তাই আমি তাঁর কাছ থেকে বিধিমতে বিবাহবিচ্ছেদ দাবি করেছি। আমার প্রস্তাবে সম্মত হওয়ায় মিস্টার এস. একটি দলিলপত্র মুসাবিদা করেন সার রবার্ট চেম্বার্সের সঙ্গে পরামর্শ করে। এবার থেকে আমি যাতে সম্পূর্ণ স্বাধীন হতে পারি, মিস্টার ফে—র কোনো অধিকার আমার উপর যাতে না থাকে, এমনকি আমার টাকাকড়ি সম্পত্তি পর্যন্ত যাতে আমি যাকে খুশি উইল করে দিতে পারি, এসব ব্যবস্থা দলিলপত্রে করা হয়েছে। সলিসিটর মিস্টার জোন্স ও মিস্টার ম্যাকভাগ, এই দু’জনকে আমার ট্রাস্টি নিযুক্ত করেছি। এঁদের চেয়ে ভাল বা নির্ভরযোগ্য লোক আর কেউ আমার জানা নেই। তোমার কাছে আর কিছু আমার জানাবার নেই। আর কেউ না জানুক, তুমি তো অন্তত জানো, কী না করেছি আমি এই অকৃতজ্ঞ ভদ্রলোকের জন্য। শেষে আমার মতন মেয়ের ধৈর্যও তাঁকে সুপথে ফেরাতে পারল না।

এ বিষয় নিয়ে আর বেশি আলোচনা করতে চাই না। গত ১১ আগস্ট দলিলপত্রে সই করা হয়ে গেছে। মিস্টার ফে—র ব্যক্তিগত জীবনের অনেক গোপন ব্যাপার আমার পক্ষে জানা স্বাভাবিক বলে, অভদ্র দাম্ভিকের মতন সই করার দিন তিনি আমার দিকে চেয়ে বললেন যে প্রতিশোধ নেবার জন্য আমি হয়তো সেগুলি প্রকাশ করে দিতে পারি। হয়তো তিনি এখনও তা—ই ভাবতে পারেন, কারণ আমি তাঁর ওই উদ্ধত কথার কোনো জবাব দিইনি। কেবল তার মুখের দিকে সোজা স্থিরদৃষ্টিতে একবার তাকিয়েছিলাম। আমার দৃষ্টিতে ক্ষোভ ও রাগ কিছুটা নিশ্চয় প্রকাশ পেয়েছিল, এবং তার সামনে তিনি চোখ নামিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তা হতেই হবে, কারণ বিবেকের দংশনে মানুষ কাপুরুষ হয়ে যায়।

.

.

কলকাতা, ৫ সেপ্টেম্বর ১৭৮১

সার রবার্ট চেম্বার্স চুঁচুড়ার কোর্টের প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হয়ে সেখানে চলে গেছেন। লেডি চেম্বার্স ও পরিবারের অন্যান্য সকলেও তাঁর সঙ্গে গেছেন। সুতরাং এখন আমি একলাই এই বিরাট বাড়ির মালিক হয়ে রয়েছি, এবং নির্জনে চলতে—ফিরতে শুতে—বসতে নিজের ভাগ্যের কথা অহরহ ভাবার সুযোগ পেয়েছি। সার রবার্ট অবশ্য আমাকে তাঁর বিশাল লাইব্রেরির চাবি দিয়ে গেছেন। দরকার হলে আমি তার সদব্যবহার করতে পারি। কিন্তু পড়াশুনা করতে হলে যে মানসিক প্রশান্তি দরকার তা কোথায়? যদি তা থাকত বা কখনও আসে তাহলে বইয়ের গভীর সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার অপ্রত্যাশিত সুযোগ ও অবকাশ পাওয়া যাবে।

সম্প্রতি মিসেস হোয়েলারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। এরকম পরিচয়কে জীবনের একটা সম্পদ বলা যায়। একদিন লেডি চেম্বার্সের সঙ্গে তাঁর বাগানে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেদিন যে আদরযত্ন তিনি করেছিলেন তা কখনও ভুলব না। তিনি আমাকে সর্বদাই সাহায্য করার জন্য উন্মুখ। মিস্টার হেস্টিংস রাজনৈতিক কাজে বাইরে গেলে মিস্টার হোয়েলার এখানে তাঁর কাজকর্ম দেখাশুনা করেন। এর থেকে বুঝতে পারবে এখানকার সমাজে মিসেস হোয়েলারের প্রতিপত্তি কতখানি। কিন্তু তাহলেও স্বভাবচরিত্রে ও ব্যবহারে এত অমায়িক তিনি যে না জানলে তাঁর সামাজিক মর্যাদার কথা কিছুই বোঝা যায় না। সভা—পার্টির নিমন্ত্রণ তাঁকে এত বেশি রক্ষা করতে হয় যে অধিকাংশ নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করা ছাড়া তাঁর উপায় থাকে না। সেটাও তিনি এত ভদ্রভাবে করেন যে তাঁর অসম্মতির জন্য কারও মনে কোনো ক্ষোভ থাকে না।

আমি এখনও কলকাতা শহরে আমাদের ধর্মোপাসনার ব্যবস্থার কথা তোমাকে কিছু লিখিনি। উপাসনা করার জন্য পুরানো ফোর্ট উইলিয়ামে আমাদের একটি ঘর আছে, এবং সেটা যে খুব বড় ঘর তা নয়। এটা কলকাতার মতন শহরে আমাদের দিক থেকে নিশ্চয় লজ্জার কথা। একটি নতুন গির্জা তৈরি করার কথাবার্তা কিছুদিন ধরে চলছে, ভাল জায়গাও দেখা হয়েছে তার জন্য, কিন্তু ব্যাপারটা তার বেশি আর এগোয়নি।

এ দেশের প্রথা, ধ্যানধারণা, আচার—ব্যবহার ইত্যাদি সম্বন্ধে যা সংগ্রহ করতে পেরেছি তা তোমাকে জানাব। স্বভাবতই আমার বিবরণটা সংক্ষিপ্ত ও ভাসা—ভাসা হবে, তবে তাতেও তোমার জানবার আগ্রহ বাড়বে।

প্রথমে মৃত স্বামীর সঙ্গে বিধবা স্ত্রী—র সহমরণের বীভৎস প্রথার কথা উল্লেখ করতে হয়। একে সতীদাহ প্রথা বলে। শোনা কথা নয়, সত্য ঘটনা, তবে আমি স্বচক্ষে সতীদাহের সমস্ত আনুষ্ঠানিক ব্যাপার দেখবার সুযোগ পাইনি, বরং ইচ্ছা হয়নি বলতে পারো। কোনো ইয়োরোপিয়ান এ দৃশ্য দাঁড়িয়ে দেখেছেন বলে মনে হয় না। আমার বিশ্বাস হয় না যে স্বামীর প্রতি স্ত্রী—র গভীর প্রেম থেকে এই প্রথার উৎপত্তি হয়েছে। প্রেম, ভালবাসা বা মায়ামমতা, অথবা পতিকে পরম গুরু বলে ভক্তি করার প্রেরণার সঙ্গে এর কোনো সম্বন্ধ নেই। তা যদি থাকত তাহলে সেই স্বামী—স্ত্রী’র সন্তানেরাও একই ভালবাসার টানে পিতা—মাতার জ্বলন্ত চিতার দিকে এগিয়ে যেত। পরিবারের ভালবাসাটা কেবল স্ত্রী’র ক্ষেত্রে সত্য হল, আর সন্তানদের ক্ষেত্রে সত্য হল না, এ কথা মানুষের বিশ্বাসযোগ্য নয়। ভক্তি বা ভালবাসার সঙ্গে যদি এই কুৎসিত প্রথার কোনো সুদূর সম্পর্কও থাকত তাহলে বিধবা স্ত্রী বা যিনি গর্ভধারিণী মা তিনি, অনাথ ছেলেমেয়েদের মুখ চেয়েও জীবিত থাকার চেষ্টা করতেন। অনুসন্ধান করে আমি যতটুকু জানতে পেরেছি তাতে দাম্পত্যপ্রেমের সঙ্গে সহমরণের সম্বন্ধ নেই, কারণ উভয়ের যখন বিবাহ হয় তাদের মুখ দিয়ে কথাই ফোটে না, এবং দু’জনেই হয়তো হামাগুড়ি দিতে থাকে। শৈশবেই দু’জনের পিতা—মাতা ছেলেমেয়েদের বিবাহের জন্য বাকদান করে থাকেন। সুতরাং প্রেম—ভালবাসা গোড়াতেও থাকে না, পরেও বহু পুত্রকন্যা—পরিবেষ্টিত পরিবারের জলবায়ুতে তা লতিয়ে ওঠার সুযোগ পায় না। আসলে প্রথাটা হল এ দেশে স্ত্রীজাতির নিষ্ঠুর দাসত্ব প্রথার একটা বড় নিদর্শন। স্ত্রী হল পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি, গহনা ও টাকাকড়ির প্রাণহীন পোঁটলাপুঁটলির মতন। মরার পর সম্পত্তিটি তিনি রেখে যেতে চান না, সঙ্গে নিয়ে যেতে চান। তার জন্যই সহমরণের প্রয়োজন, এবং শাস্ত্রবচনের আধ্যাত্মিক আস্তরণ দিয়ে এই হীন উদ্দেশ্য চাপা দেওয়া দরকার। এই হল পতিভক্তি—প্রণোদিত সহমরণের প্রকৃত ব্যাখ্যা। তাই এ দেশের লোকেরা যখন নারীচরিত্রের মহত্ত্ব সম্বন্ধে বড় বড় কথা বলেন তখন সত্যিই আমার হাসি পায়। কারণ একটা সামাজিক কুপ্রথার দাস হওয়ার মধ্যে বাহাদুরি নেই কিছু, মহত্ত্বের তো প্রশ্নই ওঠে না। সতীরা অবশ্য সমাজে বীরাঙ্গনা বলে কীর্তিত হন এবং পতিগতপ্রাণা বলে কিছুদিন সমাজের লোক তাঁদের স্মরণ করেন। ইংলন্ডেও যদি বীরত্ব ও সতীত্বের এই সাময়িক গৌরবের সঙ্গেও এরকম কোনো সামাজিক কুপ্রথার আচরণ জড়িত থাকত, তাহলে ইংরেজ রমণীরাও হয়তো তা পালন করতে কুণ্ঠিত হত না। যেসব স্বামীর সঙ্গে জীবনে একদিনও হয়ত তাঁরা শান্তিতে ঘর করতে পারেননি, বীরাঙ্গনার স্তোকবাক্যের লোভে হয়তো তাঁদের সঙ্গেও তাঁরা স্বেচ্ছায় সহমরণে যেতেন। তাই বীরত্ব সতীত্ব মহত্ত্ব ইত্যাদি কথা শুনলে হাসি পায়।

তা ছাড়া সত্যিই যদি এ দেশের মেয়েদের বীরত্বের কথা ওঠে তাহলে তার জন্য সহমরণের পরীক্ষা দেবার কোনো দরকার নেই। এ দেশের মেয়েরা সব দিক থেকেই বীরাঙ্গনা। সারাটা জীবনের প্রত্যেকটা দিন অসহ্য জ্বালাযন্ত্রণা, দুঃখকষ্ট, নির্যাতন—অপমান তাদের সহ্য করতে হয়। তা করার পরেও স্বামী, পুত্রকন্যা ও পরিবারের অকুণ্ঠ সেবায় তাঁরা আত্মোৎসর্গ করেন। তার পরেও তাঁরা যদি সমাজে বীরাঙ্গনার সম্মান না পান, এবং তার জন্য সতীদাহের মতন কদর্য নাটকের অভিনয় করতে হয়, তাহলে তার চেয়ে লজ্জার কথা আর কিছু নেই। যে—কোনো ‘সতীর’ চেয়ে এ দেশের সাধারণ মেয়েরা অন্তত দশগুণ বেশি বীর। এইসব সামাজিক প্রথার কথা মনে হলে তাই হিন্দুধর্মের উপর শ্রদ্ধা বা আস্থা থাকে না।

.

হিন্দুরা চারটি বর্ণে বা জাতিতে বিভক্ত—ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র। জাতিগত মর্যাদার দিক থেকেও এই চারিটি বর্ণ যথাক্রমে বিন্যস্ত। সর্বোচ্চ মর্যাদা ব্রাহ্মণের, তারপর ক্ষত্রিয়ের, তারপর বৈশ্যের এবং সকলের নিচে শূদ্রের। প্রত্যেক বর্ণের পেশা, কাজকর্ম ও সামাজিক দায়িত্ব স্বতন্ত্র। যদি কেউ তা পালন না করে তাহলে তাকে সমাজচ্যুত করা হয়, সে ‘পারিয়া’ হয়ে যায়। এই সমাজচ্যুতদের পঞ্চম জাতি বা বর্ণ বলা যেতে পারে। জনসমাজের যত আবর্জনা সব এসে এই তলার স্তরে জমা হয়, এবং সমাজের যত রকমের নোংরা কাজ আছে তা—ই করে তারা জীবনধারণ করে। সকলে ব্রহ্মের ধর্মে বিশ্বাস করে এবং ‘ব্রহ্ম’ থেকে যাঁদের নাম ‘ব্রাহ্মণ’ হয়েছে তাঁরাই ধর্মাচরণে পৌরোহিত্য করেন। স্বভাবতই সমাজের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় জাতি তাঁরাই। হিন্দুদের যা—কিছু ধর্মকথা সব নাকি ‘বেদ’ নামক পবিত্র গ্রন্থে আছে। সেই গ্রন্থ দুর্বোধ্য ও অচল সংস্কৃত ভাষায় লেখা এবং তা কেবল ব্রাহ্মণদের পাঠ করার অধিকার আছে। হিন্দুরা ত্রিদেবতার পূজা করেন—ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব। ব্রহ্মা হলেন স্রষ্টা, বিষ্ণু হলেন ত্রাতা এবং শিব হলেন প্রলয়কর্তা। এই সৃষ্টি—স্থিতি—প্রলয়ের ধ্যানধারণা ত্রিনাথের মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে। আবার এ কথাও হিন্দুরা বলেন যে অনাদি অনন্ত ব্রহ্মাই হলেন পরমেশ্বর, বাকি সমস্ত ঈশ্বর—ধারণার মূল উৎস। ব্রহ্মা সমস্ত জ্ঞানের ও সত্যের আকরস্বরূপ। হিন্দুদের দেবতার মন্দির আছে, কিন্তু সেখানে শুনেছি হিন্দু ছাড়া কারও প্রবেশাধিকার নেই। আমি মন্দিরে যাইনি বা তার ভিতরে প্রতিষ্ঠিত কোনো দেবতার মূর্তিও দেখিনি; লোকমুখে শুনে মনে হয়েছে মূর্তিগুলি যত দূর ভয়াবহ ও কিম্ভূতকিমাকার হতে পারে তা—ই। এই প্রসঙ্গে পোপের একটি কবিতা মনে পড়ে :

Gods changeful, partial, passionate, unjust,

Whose attributes are rage, revenge or lust.

এইসব দেবতার প্রতি এ দেশের লোকদের যে কী অচল ভক্তি, এবং তার যে কী উন্মত্ত প্রকাশ তা তোমাকে চিঠিতে বর্ণনা করে বোঝাতে পারব না। ‘পুণ্ডরম’ বলে একটা জাত আছে (দক্ষিণ ভারতীয়) যাদের পেশাই হল ভিক্ষা করা। পেশা হলেও তারা কিন্তু অদ্ভুত ভিখিরি। খুব ক্ষুধার্ত না হলে তারা ভিক্ষা চায় না, এবং যতটুকু না হলে খেয়ে বেঁচে থাকা যায় না তার বেশি ভিক্ষা করেও না। সামান্য খেতে পেলেই তারা খুশি হয়ে সারাদিন শিবের গান গেয়ে বেড়ায়। আর—একজাতের ভিখিরি আছে যারা পায়ে পেতলের আংটা ও তাবিজ পরে ঘুরে বেড়ায়, দেবতার গান গেয়ে ভিক্ষা করে। এরা কতকটা আমাদের দেশের ধর্মযাজকের মতন, যদিও আমার মনে হয় ইয়োরোপের যাজকদের চেয়ে ভারতবর্ষের যোগী ও সন্ন্যাসীরা ধর্মের ব্যাপারে অনেক বেশি আত্মনিগ্রহ সহ্য করেন। এঁরা যে কেবল দুঃখকষ্টের প্রতি উদাসীন তা নয়, আত্মপীড়ন কতরকম উপায়ে করা সম্ভব তা এঁদের উদ্ভাবন করতে অসুবিধা হয় না। কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি: বড় বড় নখ না—গজানো পর্যন্ত হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাখা; দিনের পর দিন, এমনকি সপ্তাহের পর সপ্তাহ এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা; ঊর্ধ্ববাহু হয়ে সোজা বসে থাকা।

আত্মশোধনের জন্য অথবা অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করবার জন্য এই যোগী সন্ন্যাসীরা যেসব দণ্ড ভোগ করতে অভ্যস্ত তা রীতিমতো ভয়াবহ। আমি স্বচক্ষে দেখেছি একজন যোগীকে জিবে লৌহশলাকা বিদ্ধ করে রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি করতে। তখন তার জিব দিয়ে অজস্র ধারায় রক্ত ঝরে পড়ছিল। শুনেছি চড়কপূজার সময় শত শত সন্ন্যাসী পিঠে লোহার হুক বিঁধিয়ে চড়কগাছের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। হুকের সঙ্গে কারও কারও পিঠে কাপড় বাঁধা থাকে, গাছে হুক ছিঁড়ে গেলে নিচে পড়ে যায়। দৈবক্রমে একবার আমি এই দৃশ্য দেখে ফেলেছিলাম, কারণ স্বেচ্ছায় এ দৃশ্য কেউ দেখতে চায় না। একটি লোক পিঠে হুক বিঁধিয়ে খুব জোরে চড়কগাছের মাথায় ঘুরপাক খাচ্চিল, তখন তাকে মানুষ বলে চেনাই যাচ্ছিল না। এই নিষ্ঠুর আত্মনিগ্রহের যুক্তি হল, ভগবানের কাছে এইভাবে কষ্ট স্বীকার করে জীবনের পাপতাপ, অন্যায়—অপরাধ সব ধুয়ে—মুছে যায় এবং পাপীতাপীরা পবিত্র হয়ে মৃত্যুর পরে স্বর্গবাসের নিশ্চিত অধিকার লাভ করে। আর অনুষ্ঠান পালনের সময় কোনোক্রমে যদি মৃত্যু হয় তাহলে তো কথাই নেই, কারণ সেক্ষেত্রে সশরীরে স্বর্গবাসের নাকি গ্যারান্টি থাকে। অতএব মৃত্যুর জন্য তারা চিন্তিত নয়, কারণ মৃত্যু মানুষের মুক্তিদাতা। এ বিশ্বাস থেকে তাদের টলানো সহজ নয়।

চড়কপূজার মতন অনুষ্ঠান ছাড়াও অন্যান্য আরও অনেক ব্যাপারে হিন্দুদের এই বিচিত্র চরিত্রের প্রকাশ দেখেছি। তাঁদের বাইরের কোমলতা ও ভীরুতা দেখে মনে হয় না যে এত সহজে অম্লানবদনে মৃত্যুও বরণ করতে পারেন। মৃত্যুটা যেন তাঁদের কাছে কিছুই নয়, এবং এ ব্যাপারে তাঁরা এত দৃঢ়চিত্ত ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে পারেন যে তাঁদের বাইরের চেহারা দেখে তা কেউ কল্পনাও করতে পারবেন না। নিজেদের অবিচল আস্থা অনুযায়ী দাবি তাঁরা যেন মৃত্যুর বিনিময়ে আদায় করার জন্য সর্বদাই প্রস্তুত। সম্প্রতি এই ধরনের একটি ঘটনা ঘটেছে যা শুনলে তোমরা অবাক হয়ে যাবে। একজন হিন্দু ভিক্ষুক, জাতিতে ব্রাহ্মণ, কোনো বড়লোকের বাড়িতে ভিক্ষা করতে গিয়েছিল। ধনিক গৃহস্বামী জাতিতে ছোট ছিলেন। হয় তাকে ভিক্ষা দেওয়া হয়নি, অথবা অল্প ভিক্ষা দেওয়া হয়েছিল, ঠিক জানি না। ব্রাহ্মণ ভিক্ষুকের অন্তর্নিহিত ব্রাহ্মণ্য তেজ উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। তখন প্রশ্নটা দাঁড়ায়—ছোট জাতের এত বড় স্পর্ধা, ব্রাহ্মণকে ভিক্ষা না দিয়ে অপমান করা। ব্রাহ্মণ ভিখিরি বড়লোকটির যোগ্য শাস্তি দেবার সংকল্প করে দরজার কাছে সটান শুয়ে পড়ল, প্রতিজ্ঞা করল যে অন্যায়ের প্রতিবিধান না করলে একতিলও সে নড়বে না। বড়লোকের বাড়ি, ভৃত্যের অভাব নেই। ভৃত্যরা এসে একে একে তাকে ভাল মুখে ভয় দেখিয়ে চেষ্টা করল দরজার কাছ থেকে উঠিয়ে দেবার জন্য, কিন্তু সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হল। প্রতিজ্ঞা ব্রাহ্মণের, ভিখারির নয়, সুতরাং তা টলানো সম্ভব হল না। অবশেষে ভৃত্যরা ধরাধরি করে তুলে তাকে দরজার কাছ থেকে সরিয়ে দিল। তার ফলে সে হল্লা করে পাড়া তোলপাড় করতে লাগল এবং বলল যে অন্যায়ের প্রতিকার না—হওয়া পর্যন্ত সেই স্থান থেকে সে কিছুতেই নড়বে না। গৃহকর্তা তাকে নানাভাবে বুঝিয়ে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলেন, তাতেও কোনো ফল হল না। গোঁড়া হিন্দুর মতন অটল প্রতিজ্ঞা নিয়ে সে দরজার কাছে শুয়ে রইল, এবং তার দাবি হল অন্যায়ের প্রতিকার চাই। প্রায় ৩৮ ঘণ্টা শুয়ে থাকার পর বৃদ্ধ ভিখিরির শেষনিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল। মৃত্যুর সময় তার নিশ্চয় এই বিশ্বাস ছিল যে অন্যায়ের প্রতিকার একদিন হবেই, এবং তার মৃত্যু সেই প্রতিকারের পথ পরিষ্কার করবে। একদিক থেকে বিচার করলে তার ধারণা যে ভুল তা বলা যায় না, কারণ বাড়ির দরজার সামনে এইভাবে একজন ভিখিরির মৃত্যুর ফলে লোকটিকে জরিমানা ও গঞ্জনার যে অসহ্য শাস্তি ভোগ করতে হবে তা বর্ণনাতীত।

যা—ই হোক, আমি অন্তত জীবনে কখনও এই ধরনের আশ্চর্য মনোবল এবং ততোধিক আশ্চর্য পরম নিশ্চিন্তে মৃত্যুবরণের কথা শুনিনি। ভারতবর্ষের হিন্দু চরিত্রের অনমনীয় দৃঢ়তা, তেজস্বিতা ও একাগ্রতার দৃষ্টান্ত হিসেবে এই ঘটনাটি উল্লেখ করলাম। এইসব বলিষ্ঠ গুণের পাশাপশি দুর্বলতা, ভাবাতিশয্য, প্রভৃতি বিপরীত সব গুণের এক অদ্ভুত সমাবেশ হয়েছে হিন্দুচরিত্রে। বাইরে থেকে একজন নিরীহ হিন্দুকে দেখে বোঝাই যায় না যে তার মধ্যে কি ভয়ানক আগ্নেয়গিরি লুকানো আছে, প্রয়োজন হলে যার মৃত্যুভয়হীন ভয়ংকর রূপ যে—কোনো সময় প্রকাশ পেতে পারে।

সম্প্রতি একজন ধনিক হিন্দুর একটি বিবাহের শোভাযাত্রা দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। পাত্রের সঙ্গে পাত্রীও শুনলাম একই পাল্কির মধ্যে বসে চলেছে। পাল্কিটি চমৎকার করে সাজানো। পাত্র ও কন্যা উভয় পক্ষের আত্মীয়স্বজন তাদের সঙ্গে চলেছে নানারকমের বেশভূষায় সেজেগুজে। কেউ যাচ্ছে ঘোড়ার পিঠে চড়ে, কেউ পাল্কিতে করে, কেউ—বা হাতির পিঠে চড়ে। বড়লোকের বাড়ির বিয়ে, জাঁকজমকের অভাব নেই। সবার আগে গেছে নর্তক—নর্তকী ও গাইয়ে—বাজিয়েরা। রাত্রে শুনলাম কন্যাপক্ষের বাড়িতে প্রচুর বাজি পোড়ানো হয়েছিল এবং বেশ চর্বচোষ্য ভোজ দিয়েছিলেন কন্যার পিতা। ভোজে কোনো ইয়োরোপিয়ান কেউ উপস্থিত ছিলেন বলে শুনিনি। এই ধরনের বিবাহ এখানে প্রায়ই ঘটে থাকে। একজন ধনী লোকের একটিমাত্র কন্যা ছিল, তিনি স্বজাতির একটি দরিদ্র ছেলেকে মেয়ের স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে বাড়িতেই রাখতে চান। তাঁর পক্ষে এরকম ব্যবস্থা করারও বিশেষ প্রয়োজন, তার কারণ মেয়ের স্বামী এক্ষেত্রে তাঁর পরিবারে পুত্রের মতন গৃহীত হওয়া ছাড়া উপায়ই নেই। এরকম বিবাহে পাত্রকে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে এসে তার সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং সে শ্বশুরের পরিবারের নিজের লোক হয়ে যায়। আইনত কন্যার সঙ্গে গৃহসম্পত্তি যৌতুক দেওয়া নিষিদ্ধ হলেও এক্ষেত্রে যার কিছু নেই এরকম ছেলেকে ঘরবাড়ি সব দেওয়া হয়। এইভাবে বিবাহ করে দরিদ্রের পক্ষে প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক হওয়া এ দেশে মোটেই শক্ত নয়, তবে একটি মেয়ের জীবনের দায়িত্বের বিনিময়ে তা হতে হয়। কিছুদিনের মধ্যে বৃদ্ধ শ্বশুর মারা যান। তখন তাঁর যুবক জামাইটি হঠাৎ স্বাধীন হয়ে নিজের ইচ্ছা পূরণ করার চেষ্টা করে। এতদিন সে যা করেছে তা নিজের পিতা—মাতা ও শ্বশুরের ইচ্ছা পূরণ করার জন্য। অতএব প্রথম সুযোগ পাওয়ার পরেই সে তার আত্মীয়াদের একটি গরিবের ঘরের মেয়ের খোঁজ করতে বলে বিবাহ করার জন্য। অল্পদিনের মধ্যেই হয়তো তার বিবাহ হয়ে যায়। প্রথমে গরিবের ছেলে হয়ে বড়লোকের মেয়ে বিয়ে করে সে ঘরজামাই হয়েছিল, এবারে শ্বশুরের মৃত্যুর পর নিজে বড়লোকের ছেলের মতন গরিবের মেয়ে বিয়ে করে ঘরে আনল। এ দেশে এই বহুবিবাহ প্রথা অত্যধিক প্রচলিত, দু’চারটি বিবাহ করতে পুরুষদের কোনো সংকোচ বা দ্বিধা নেই। প্রথাটির আরও বৈচিত্র্য হল, প্রথম স্ত্রী—র মর্যাদা পরবর্তী স্ত্রী—দের তুলনায় সবসময়েই বেশি। আইনত স্বামী প্রত্যেক স্ত্রী’র সঙ্গে পালাক্রমে বাস করতে বাধ্য। প্রথাটা বেশ বিচিত্র নয় কি?

আমার বেনিয়ান দত্তরাম চক্রবর্তী গত বিশ—ত্রিশ বছর হল বিবাহ করেছেন, কিন্তু সবচেয়ে আনন্দের কথা হল যে এখনও পর্যন্ত একটির বেশি বিবাহ করেননি। কিন্তু খুব অহংকার করে বলেন যে তাঁর পুরানো স্ত্রী নিয়ে তিনি বেশ সুখে—স্বচ্ছন্দেই ঘরকন্না করছেন, যা তাঁর বহু সমবয়স্ক বন্ধুবান্ধব নতুন নতুন একাধিক স্ত্রী নিয়ে করতে পারছেন না। বেনিয়ানবাবু কথাটা নেহাত মিথ্যে বলেননি। আমারও ধারণা, তাঁর কথাই ঠিক।

হিন্দু মহিলাদের কখনও ঘরের বাইরে বেরুতে দেখা যায় না। যখন তাঁরা বাইরে বেরোন, পাল্কিতে বা গাড়িতে করেই চলাফেরা করেন এবং তার চারদিক পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকে। ইচ্ছা হলেও মুখ বাড়িয়ে কিছু দেখা যায় না এবং কোনো কৌতূহল মেটানো যায় না। একবার আমি দৈবাৎ দু’টি অতীব সুন্দরী মহিলাকে দেখে ফেলেছিলাম। কিন্তু নানা রকমের বেশভূষায় ও গহনাগাটিতে তাঁরা এমন সুসজ্জিত যে সত্যিই আসলে তাঁরা কতখানি সুন্দর তা বলা মুশকিল। যাবতীয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সাজগোজ করতে তাঁদের সমস্ত সময়টুকু কেটে যায়। মাথার চুল বাঁধতে, চোখের ভ্রূ—জোড়া ও পাতা কাজলকালো করতে, দাঁত—হাত—নখ সুদৃশ্য করতে প্রচুর সময় ও অবকাশের দরকার হয়। হিন্দু রমণীদের প্রসাধন—নৈপুণ্য দেখলে অবাক হতে হয়। সাজগোজের কলাকৌশল চর্চা করতে এত বেশি সময় তাঁরা অতিবাহিত করেন যে মনে হয় যেন এ ছাড়া আর অন্য কোনো কাজ নেই তাঁদের। কিন্তু তার জন্য তাঁদের বোধহয় দোষ দেওয়া যায় না, যেহেতু রূপচর্চা তাঁদের করতেই হয়, প্রথমত স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্য, দ্বিতীয়ত সপত্নীদের চিত্তাকর্ষণের প্রতিযোগিতায় পরাজিত করার জন্য।

.

.

কলকাতা, ২৭ সেপ্টেম্বর ১৭৮১

যেসব হিন্দুরা পয়সা দিয়ে কাঠ কিনতে পারেন তাঁরা দাহ করে মৃতদেহ সৎকার করেন। কলকাতার পাশে গঙ্গায় নৌকা করে বেড়াতে বেরোলে এই মৃতদাহের দৃশ্য অনেক দেখা যায়, কারণ গঙ্গার তীর ধরে হিন্দুদের সব শ্মশান। অত্যন্ত বীভৎস দৃশ্য, রাতেই বেশি দেখা যায়। এ বিষয়ে বেশি কিছু আর লিখব না। যারা গরিব লোক, কাঠ কেনার পয়সা জোগাড় করতে পারে না, তারা মৃতদেহ গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেয় এবং তা পচে দুর্গন্ধে আবহাওয়া দূষিত করে। এর চেয়ে দাহপ্রথা বীভৎস হলেও ভাল। বহুবার আমি নদীর ধারে বেড়াতে গিয়ে দ্রুতপদে হেঁটে ফিরে এসেছি, মৃতদেহ সৎকারের সশব্দ অনুষ্ঠান সহ্য করার ক্ষমতা হয়নি।

রুগণ ও মুমূর্ষুদের সম্বন্ধে হিন্দুদের আরও বীভৎস একটি প্রথা আছে। এ দেশের ব্রাহ্মণরা কেবল পৌরোহিত্য করেন না, চিকিৎসাদিও করেন। কোনো রোগীকে দেখেশুনে যখন তাঁরা আত্মীয়স্বজনের হাতে সমর্পণ করে দেন, তখন রোগী জীবিত থাকলেও ধরে নিতে হবে যে তার মৃত্যু নিশ্চিত। অতএব মৃত্যুর পূর্বের অনুষ্ঠান গঙ্গাজলির কাজ আরম্ভ হয়। আত্মীয়রা কাঁধে করে তাকে গঙ্গার ঘাটে নিয়ে যায় এবং সেখানে জলে চুবিয়ে তার চোখ—মুখ নাকে গঙ্গামাটি ঠেসে গুঁজে দেওয়া হয়। তার ফলে রুগণ লোকটি ক্রমেই মরণাপন্ন হতে থাকে এবং মরেও যায়। অর্থাৎ মরতে তাকে বাধ্য করা হয়, কারণ গঙ্গাজলির পর বেঁচে থাকলেও তাকে আর ঘরে ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। তাহলে তাকে জাতিচ্যুত করা হয়।

ডাঃ জ্যাকসন একবার একজন হিন্দু রাজার স্ত্রী—র গঙ্গাযাত্রা শুরু হবার সময় রাজবাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলেন। ব্যাপার দেখে তিনি রাজাকে বলেন যে তাঁর স্ত্রী বেঁচে ওঠার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে এবং তিনি নিজে তাঁর চিকিৎসা করবেন। ভাগ্যিস গঙ্গাযাত্রা অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যায়নি। তাহলে তো মহিলাকে মরতেই হত। জ্যাকসন কোম্পানির ডাক্তার, তাঁর নামডাক খুব। রাজা তাঁর প্রস্তাবে রাজি হলেন এবং রানির চিকিৎসা চলতে থাকল। রানি বেঁচে উঠলেন এবং আজও তিনি বেশ দিব্যি বেঁচেবর্তে আছেন। এ ঘটনার পর জ্যাকসনের সুনাম আরও বেড়েছে, এবং তিনি গঙ্গাযাত্রার স্তর থেকে আরও দু’চারজন রোগীর জীবন রক্ষা করেছেন।

চিঠিখানা বেশ দীর্ঘ হয়ে গেল, সুতরাং এইখানেই শেষ করছি। আশা করি শীঘ্রই তোমাদের সুসংবাদ শুনতে পাব।

ইতি—

তোমাদের স্নেহের বোন

ই. এফ.

৭  

সপ্তম চিঠি

কলকাতা, ১৭ ডিসেম্বর ১৭৮১

.

প্রিয় বোন,

সার রবার্ট ও লেডি চেম্বার্স কলকাতায় কিছুদিন ছিলেন, এখন আবার বাইরে চলে গেছেন খুব মানসিক কষ্ট পেয়ে। লেডি চেম্বার্সের ইচ্ছে ছিল এখানেই থাকেন, কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি তাঁদের পরিবারে একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। নবজাত শিশুটি ছ’মাস বয়স হবার পর হঠাৎ তিন দিনের অসুখে মারা গেছে কয়েক সপ্তাহ আগে। ছেলেটির কথা আমিও সহজে ভুলতে পারব বলে মনে হয় না।

মিস্টার ও মিসেস হোসিয়া কলকাতায় এসেছেন এবং গ্রসভেনর জাহাজে ইংলন্ডে ফিরে যাবার ব্যবস্থাও করেছেন। আমি ভেবেছিলাম তাঁদের সঙ্গে যাব, কিন্তু তা সম্ভব হল না।

উত্তর ভারতের কোনো এক জায়গায় মিস্টার হোসিয়া রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি একজন সৎচরিত্র ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। তাঁর স্ত্রী—র মতন অমায়িক ভদ্রমহিলাও আমি দেখিনি। একবার তাঁর সঙ্গে দেখা হলে না ভালবেসে পারা যায় না।

সার চেম্বার্সের মা খুব সুন্দর অভিজাত প্রকৃতির বৃদ্ধা মহিলা, বয়স অনুপাতে সর্ববিষয়ে তাঁর জ্ঞান ও কৌতূহল অনেক বেশি। মিসেস হোসিয়ার সঙ্গে তাঁর আলাপ—পরিচয় হবার পর তাঁদের সাহচর্যে আমার দিনগুলি এখানে বেশ ভাল কেটেছে। এর আগে বর্ষাকালে যখন একা ছিলাম তখন সঙ্গীহীন অবস্থায় দিনগুলি আমার খুবই কষ্টে কেটেছে। ডাঃ জ্যাকসনের বাড়ি আমি নিয়মিত যাতায়াত করি। তা ছাড়া আরও কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে সম্প্রতি আমার পরিচয় হয়েছে যেখানে কোনো নিমন্ত্রণ বা আপ্যায়নের প্রত্যাশা না করেই মধ্যে মধ্যে আমি যাই। সত্যি কথা বলতে কী, কোনোরকম পারিবারিক বা সামাজিক লৌকিকতা এখন আর আমি সহ্যই করতে পারি না। বর্তমানে মনের দৈন্য আমার কত দূর বেড়েছে তা বুঝতে পারছ, অথচ একসময়ে কত উচ্চাশাই না পোষণ করতাম সমাজ ও মানুষ সম্বন্ধে। এখন কেবল একটি কথা আমার অনবরত মনে হয়, যে সমাজে আমি সহজে মেলামেশা করব, সেখানে আমার সঠিক স্থান কোথায়। বোধহয় কোনো স্থান নেই, একমাত্র অপমানের ও বেদনার স্থান ছাড়া। তাই আমার মন চায় এই স্থান থেকে অন্য কোথাও চলে যেতে এবং এমন এক জায়গায় সান্ত্বনা খুঁজতে যেখানে অন্তত তা দেবার মতন লোকের অভাব নেই। আর কিছু না হোক সেখানে অন্তত মৃত আশা—আকাঙ্ক্ষাগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠবে না। মনে কোরো না এসব কথা তোমাকে লিখছি কোনো ব্যক্তিগত অনুশোচনার ফলে, অথবা এইসব হতাশার কথা লিখছি বলে মনে ভেবো না যাঁরা নানাভাবে আমার উপকার করেছেন তাঁদের কথা অকৃতজ্ঞের মতন ভুলে গেছি। বহু মহানুভব ব্যক্তির সান্নিধ্যেও আমি এসেছি এবং তাঁরা সবসময় আমার প্রতি যে উদার ব্যবহার করেছেন তা আমার দাবি তো দূরের কথা, প্রত্যাশা করারও অধিকার নেই। সেই ব্যবহার কি কোনোরকমে ভোলা সম্ভব? সম্ভব নয়। এটা আমার সারাজীবন গর্ব করে বলার মতন ব্যাপার যে বন্ধুবান্ধবের ভাগ্য আমার ভাল। যতদিন আমি জীবিত থাকব ততদিন এই বন্ধুদের সহৃদয়তার কথা আমি ভুলতে পারব না।

আজকের মতন এখানেই থাক, পরের চিঠিতে আরও কিছু লিখব। আশা করি ঈশ্বরের ইচ্ছায় শীঘ্রই আমি আমার প্রিয় পরিজনদের সঙ্গে মিলিত হতে পারব।

.

.

কলকাতা, ২৭ জানুয়ারি ১৭৮২

সপ্তাহ তিনেক আগে মিসেস হোসিয়ার একটি সন্তান হয়েছে। এখন তাঁর সমুদ্রযাত্রা করতে বাধা নেই, অতএব পুরোদমে তার প্রস্তুতি চলেছে। সার রবার্টের বড়ছেলেটিও হোসিয়াদের সঙ্গে যাচ্ছে। সুন্দর ছেলেটি, নাম টমাস, বয়স বছর সাতেক হবে। বিলেত পাঠাবার বয়সের দিক থেকে একটু দেরি হয়ে গেল মনে হয়, কিন্তু এর আগে ওঁরা সঙ্গে পাঠাবার মতন ভাল লোক পাননি। হোসিয়াদের একজন অন্তরঙ্গ বন্ধুর একটি মেয়েও যাচ্ছে। মেয়েটির নাম মিস শোর, টমাসের সমবয়সি। মিসেস হোসিয়া তাঁর একটি বছর দেড়েকের ছোট মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন। নবজাত শিশুটি লেডি চেম্বার্সের কাছে থাকবে। আগামীকাল একটি নামকরণের অনুষ্ঠান হবে, এবং সেখানে বড় বড় সব দলের অভ্যর্থনার ব্যাপার থেকে দূরে সরে থাকা আমার উপায় নেই। কেবল একটি পরিবারের ক্ষেত্রে তা পারব না। হোসিয়ার নবজাত শিশুর নামকরণ হবে আগামী মাসের গোড়ার দিকে এবং তাতে সার রবার্ট সপরিবারে নিমন্ত্রিত হয়েছেন। এখন মিসেস হোসিয়ার পরিবারের সঙ্গে আমি খুব গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছি, তাঁর সঙ্গে সত্যিকারের বন্ধুত্ব—সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। যদি তাঁর সঙ্গে দেশে ফিরে যেতে পারতাম, ভালই হত, এখন তা নানা কারণে সম্ভব হচ্ছে না। আর একটি জাহাজও সম্প্রতি যাত্রা করেছে, কিন্তু তাতেও যাত্রীর ভিড় বেশি। সুতরাং ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা ছাড়া আমার উপায় নেই। শুধু কি যাত্রীর ভিড়? প্রত্যেক যাত্রীর সঙ্গে কী পরিমাণ যে লটবহর যায় তা ভাবা যায় না। মিস্টার ও মিসেস হোসিয়ার জন্য ২৯টি ট্রাঙ্ক ভর্তি জিনিসপত্র আমি নিজে গুনে দেখেছি। তা ছাড়া চেস্ট—ড্রয়ার, নানা রকমের প্যাকেট, কেবিনের বহু জিনিস তো আছেই। মাদ্রাজ ঘুরে যাবার জন্য তাদের খরচও বেশি পড়বে, বাংলা দেশ থেকে সোজা যাত্রা করলে এই অতিরিক্ত খরচের একটি টাকাও লাগত না। এক জাহাজ থেকে অন্য জাহাজে মালপত্তর ওঠানামা করানোর খরচ ও অসুবিধাও কম নয়। সেটাও তাদের ভোগ করতে হবে।

.

.

চুঁচুড়া, ১০ ফেব্রুয়ারি ১৭৮২

গত প্রায় পনেরো দিন ধরে অত্যধিক কাজকর্মের চাপে চিঠিপত্র লেখার অবসর পাইনি। সম্প্রতি একটা ঘটনা ঘটেছে যেটা খুব দুঃখের। সে কথা পরে বলছি।

আমাদের বন্ধুরা গত ২ তারিখে চলে গেছেন। সদ্যোজাত বাচ্চাটিকে রেখে যাবার সময় মিসেস হোসিয়া খুব বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। হবারই কথা, কারণ মাত্র ২৫ দিনের কোলের শিশুকে কোনো মায়ের পক্ষে এইভাবে ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। অন্য কারণেও যাবার সময় তাঁর দুশ্চিন্তা হয়েছিল। অ্যাডমিরাল সাফরেন বঙ্গোপসাগরে নিজেদের জাহাজের চলাফেরার উপর বিশেষ নজর রাখেন, কিন্তু স্যার হিউজেস ফরাসি নৌবহরের পশ্চাদ্ধাবনে ব্যস্ত।

ছেলেকে ইংলন্ডে পাঠিয়ে সার রবার্ট ও লেডি চেম্বার্স দু’জনেই খুব মুষড়ে পড়েছেন। মিসেস চেম্বার্স একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন নাতির শোকে। জাহাজ ছাড়ার পাঁচ দিন পরে তাঁর হঠাৎ খুব অসুখ হয় এবং সাত দিনের দিন বৃদ্ধা মারা যান। সার রবার্ট খুবই ব্যথিত হয়েছেন মা’য়ের মৃত্যুতে। হবারই কথা, না হলে আমি বিস্মিত হতাম। কারণ তাঁর মতন স্নেহশীলা মায়ের কথা সহজে ভোলা যায় না। বৃদ্ধ বয়সেও তিনি তাঁর ছেলে রবার্টের সঙ্গে ইংলন্ড থেকে ভারতবর্ষে এসেছিলেন। তাঁর মতন উদার দানশীলা মহিলাও আমি দেখিনি। তাঁর মৃত্যুতে শোকাভিভূত হয়েছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স প্রায় সত্তর বছর হয়েছিল। পরদিন তাঁর শবযাত্রায় অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি যোগ দিয়েছিলেন, উল্লেখযোগ্য মহিলা ও ভদ্রলোকের মধ্যে কেউ বাদ ছিলেন কি না সন্দেহ। তিনি যেরকম স্বভাবের মহিলা ছিলেন তাতে তাঁর প্রতি এই শ্রদ্ধানিবেদনে আমি সত্যিই খুব খুশি হয়েছি।

চুঁচুড়া শহরটি কেমন, তোমার জানার কৌতূহল নিশ্চয় হচ্ছে। কিন্তু শহরের ঘরবাড়িগুলি খুব সুন্দর, সুবিন্যস্ত ও পরিচ্ছন্ন, এই কথা বললে শহর সম্বন্ধে আর কিছু বলার থাকে না। শহরবাসীরা যে খুব আনন্দে দিন কাটায় এমন কথা বলা যায় না। শাসকরা তাঁদের প্রতি উদার এবং সকলের ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ সম্বন্ধেও সচেতন বলে মনে হয়।

এই শহরটি দখল করার ব্যাপার নিয়ে একটা অদ্ভুত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তা নিয়ে পরে আদালত পর্যন্তও গড়াতে পারে। একটি কোম্পানির জাহাজ (ফ্রিজেট বা যুদ্ধের স্লুপ) কলকাতায় যখন অপেক্ষা করছে তখন খবর এল যে ডাচরা যুদ্ধ আরম্ভ করে দিয়েছে। খবর পেয়ে সেই জাহাজের ক্যাপ্টেন তাঁর নাবিক—লস্কর নিয়ে চুঁচুড়া অভিযান করেন এবং সেখানে রাত প্রায় দুটোর সময় পৌঁছে স্থানীয় গবর্নরকে বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। ব্যাপারটা কিছু বুঝতে না পেরে এবং সৈন্যসামন্তসহ প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত না—থাকায়, গবর্নরও তাঁর হুকুম মেনে নিতে বাধ্য হন। এদিকে কোম্পানির সৈন্যদল যথাসময়ে নির্দেশ অনুযায়ী সকাল সাতটায় চুঁচুড়ায় পৌঁছে দেখে যে তাদের কর্তব্যকর্ম আগেই করে ফেলা হয়েছে। ঘটনাটা আদ্যোপান্ত শুনে সকলেই খুব হাসাহাসি করতে লাগল। ক্যাপ্টেনকে বলা হল তাঁর দখলিস্বত্ব ত্যাগ করতে। তিনি বললেন, তা তিনি করতে পারেন, কিন্তু তাঁর লোকলস্করকে পুরস্কৃত করতে হবে। ব্যাপারটা বিচিত্র নয় কি?

অষ্টম চিঠি

কলকাতা ২৭ মার্চ ১৭৮২

.

প্রিয় বোন,

এইটাই বোধহয় বাংলা দেশ থেকে লেখা আমার শেষ চিঠি। কারণ অনেক চেষ্টা করে অবশেষে একটা নতুন জাহাজে স্থান সংগ্রহ করতে পেরেছি। জাহাজটির এই প্রথম সমুদ্রযাত্রা। জাহাজের একজন সঙ্গিনীও পাওয়া গেছে এবং তাতে আমার পক্ষে খুবই ভাল হয়েছে। ক্যাপ্টেন লুইস জাহাজের কর্ণধার। কর্নেল ও মিসেস টোটিংহ্যাম সপরিবারে আমাদের সঙ্গে যাবেন। তাঁরা ছাড়া কোম্পানির দু’জন সিভিলিয়ান, সাতজন মিলিটারি কর্মচারী এবং তেরোটি শিশুও আমাদের সঙ্গে যাত্রা করছে। এপ্রিল মাসের গোড়ায় জাহাজ ছাড়ার কথা। মিসেস ডব্লুর বাড়িতে কাল রাতে ক্যাপ্টেন লুইসের সঙ্গে খানা খেলাম। তাঁর অমায়িক আচরণে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি। সাধারণত জাহাজের ক্যাপ্টেনরা বেশ একটু অহংকারী হয়ে থাকেন, কিন্তু লুইসের মধ্যে তার কোনো আভাস পাওয়া যায় না। এরকম একজন কমান্ডারের অধীনে সমুদ্রযাত্রা করা সত্যিই সৌভাগ্যের কথা। জাহাজের সহযাত্রীরা ভাল হলে আমাদের সমুদ্রযাত্রা বেশ আরামের হবে মনে হয়।

বাক্সপ্যাঁটরা—জিনিসপত্র সব তাড়াতাড়ি গোছগাছ করতে হচ্ছে, লেডি চেম্বার্স যথাসাধ্য সাহায্য করছেন। অন্যান্য বন্ধুরাও যেখান থেকে যা পারছেন জোগাড় করে দিচ্ছেন। এমন সব জিনিস যা জাহাজে তো বটেই, এমনকি ইংলন্ডে গিয়েও কাজে লাগতে পারে। এখানে এক ভদ্রমহিলা একটি স্কুল করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন আমাকে, কিন্তু স্বাস্থ্যের কথা ভেবে তাতে সম্মত হওয়া সম্ভব হল না। অবশ্য স্কুল করতে পারলে খুব ভাল হত; কারণ যে মহিলাটি প্রস্তাব করেছিলেন তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের পরিচয় ও বন্ধুত্ব, কাজকর্মের ব্যাপারে মতামতের অমিল হত না বলেই মনে হয়।

.

কলকাতা, ২৭ মার্চ ১৭৮১

গতকাল সন্ধ্যায় ক্যাপ্টেন পি—র সঙ্গে আমার এক তরুণী বান্ধবী মিল টি—র বিবাহের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। ডাঃ জ্যাকসনের বাড়িতে বিবাহ হয়েছিল। অনুষ্ঠান উপলক্ষে বলনাচ হবে ঠিক হল, কিন্তু তখন অতিথিদের মধ্যে কাউকে নাচতে রাজি করানো সম্ভব হল না। শরীর খারাপ বলে আমার দিক থেকে নাচের কোনো প্রশ্নই ওঠেনি। অবশেষে মিসেস জ্যাকসন ৬৫ বৎসরের বৃদ্ধা, নিরুপায় হয়ে নাচের আসরে নামলেন। সে কী নাচ! যেমন নাচের ছন্দ, তেমনি পায়ের ক্ষিপ্রতা ও দ্রুততাল। অবলীলাক্রমে তিনি প্রায় ঘণ্টা দুই নাচলেন, যে—কোনো স্বাস্থ্যবতী যুবতিরও লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাবার কথা। যাই হোক, তাঁর নাচের সুফল হল এই যে অনেকে উৎসাহিত হয়ে একে—একে আসরে নামলেন। নাচ শেষ হলে সকলে বসে বেশ আনন্দে সাপার খাওয়া গেল। প্রচলিত ‘টোস্টে’র পালা সাঙ্গ করে রাত্রি প্রায় একটার সময় বাড়ি ফিরলাম। কামনা করি, নবদম্পতি সুখে—শান্তিতে থাকুক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *