চণ্ডাল সূক্ষ্ম হইতে পারিল না, আপনার ছোট আড়ায় আসিয়া, সঘন নিঃশ্বাস ফেলিল; সে মনে হয় পলাইয়া আসিয়াছে, সে মনে হয় পথ হারাইয়াছে।
বৈজুনাথ যে দুই কলস মদ আনিয়াছিল তাহার একটি হইতে নরকপালে ঢালিয়া পান করিল, পরক্ষণে নরকপালের দিকে চাহিয়া বিড় বিড় করিয়া কি যেন বা বলিল, রুক্ষ আড়ষ্ট নিঃশ্বাস কণ্ঠস্বরে পাতা পোড়ার শব্দ, যাহা শুদ্ধ ভাষায় সম্ভবত বলিয়াছিল, “হায় কার অঞ্জলিবদ্ধ হাত, তুমি হাড় হয়ে আছ। এ কপাল কাহাকে আহ্বান করে। মন কি সকল সময় উর্ধলোকে–সেখানে যায়।”
ইহার পর অঙ্গুলি দিয়া আসব গ্রহণ করত চুষিতে লাগিল। যদিও সে এ প্রশ্ন করিয়াছে, যদিও সে আপনার মধ্যে শ্রান্তিকে দর্শন করিয়াছে, আপনার অনুভব স্রোতকে তাহার নিজস্ব প্রকৃতিতেই দেখে, তবু পুনরায় ঢালিল। পান করিয়া গঙ্গার তীরে গিয়া দাঁড়াইয়া ব্যাকুল স্বরে কহিল, “মা মা গো লেমিনাথ শালাকে জরিয়ে দাও গো, আর পাপ নয় মা গো…পাপীকে উদ্ধার কর।” বলিতে বলিতে বৈজু তাহার নিজের দেহের মধ্যস্থিত এক অত্যাশ্চর্য গাম্ভীর্যের সম্মুখীন; অন্যপক্ষে হ্রদ, তুষার, বহু বহু, জলে স্থলে ঊর্ধে যাহা কিছু বাক্যের অন্তরালে অশরীরী হইতেছে, ইহারা তাহার স্বপ্নের সামগ্রী, ইহারা তাহার পথিপ্রজ্ঞার ফলক, যে সে সুখে নিদ্রা যাইতে পারিবে তাহারই এই অপরিমিত আয়োজন। অনন্তর রাগত স্বরে কহিল, “শালী”, বলিয়া কয়েক পদ ছুটিয়া আসিয়া হয়ত সংস্কার বশে, হয়ত রুষ্টকৰ্ম্মা নিয়তি তাহাকে বিড়ম্বিত করে, অগ্নিহীন চিতায় নামিয়া স্থির; ভস্মরাশি, তাহার সহসা পদাঘাতে চকিত, বিভ্রান্ত; বৈরাগ্যজননী এই চিতায় এখন সে এবং তাহার ছায়া। সে ঘোর শেষ লইয়া একা; অদূরে অসংখ্য বাক্যনিচয় নিরর্থক। এত দুর্ধর্ষ শরীর, এক ভীম উর্বরতা এখন দারুভূত; উপরের উৎকৃষ্ট প্রতিবিম্ব এবং নিকটের স্রোত সর্প-মিথুনের মত, দিব্য, সুস্থ, চিত্তহারী বন্ধনে দীপ্যমান। চিতামধ্য হইতে এ লীলাচাতুর্য দেখিয়া সে যুগপৎ বিহ্বল, চমকিত, রিক্ত। ঝটিতি আপনার বল লাভ করিয়া উন্মত্ত হইয়া হুঙ্কার দিয়া হরিধ্বনি করিল, উত্তরোত্তর তাহার কণ্ঠ উচ্চগ্রামে উচ্চগ্রামে।
মনুষ্যদেহী চণ্ডালের ঈদৃশ দুঃসহ সঘন চীৎকারে দিকসকল আর এক চক্ষুতে পরিণত, ভ্রাতৃজীবনসকল ত্রাসযুক্ত; বৃক্ষ পত্রাদি থরহরি এবং সুখনীড় এ পৃথিবী এক মহাধ্বনিতে পরিপূর্ণ হইল, বিশ্বসংসার বুঝি যায়!
তাহার কণ্ঠনাদে এ-বাক্যই ঘোষিত হইল যে আমি, বৈজুনাথ, মাতা যেমন দেহ দেন, তেমনি নরদেহকে আমি সৎকারে সাহায্য করি। সেই বৈজুনাথ এক অবৈধ প্রণয় দেখিয়াছে, এক বিসদৃশ মিথুনের সে দ্রষ্টা, যে মিথুন অন্যায়, যুক্তিহীন। আপনাকে স্বকীয় চীৎকারে সম্মোহিত করত চিতা হইতে এক লম্ফে উঠিয়া অসূৰ্য্যম্পশ্যা ব্যাকরণশুদ্ধ অন্ধকারকে আপনার ভাই সম্বোধন করিয়া দাম্ভিক হইল এবং কিছুক্ষণ পরে নবদম্পতির চাঁদোয়াকে বেষ্টন করিয়া, বৈজয়ন্তীমালার ইঙ্গিত ধরিয়া, সহুঙ্কারে ছুটাছুটি করিতে লাগিল, মুখে “ওই লম্বোদরজননী হাই শিবশন্তো” এবং তাহার দক্ষিণ হস্ত ঊর্ধে ঘুরিতে ব্যস্ত।
যশোবতী বিস্মিত হইবার পূর্বেই সীতারাম, এই ভয়ঙ্কর শব্দে, কাঁদিয়া উঠিলেন। কাঁদিতে কাঁদিতে কহিলেন, “শীত শীত…” বলিয়া স্ত্রীকে আঁকড়াইয়া ধরিতে চাহিলেন। যশোবতী স্বামীর হস্তদ্বয় আপনার কণ্ঠে স্থাপনা করত এখন অন্য হাতে কাজললতা মাটিতে ঠুকিতেছিলেন।
বৈজুনাথ এখন শুধু “বল হরি হরি বোল…লম্বোদর” বলিয়া তাঁহাদের চক্রাকারে পরিভ্রমণ : করিতেছে। তাহার পদখনিত ধূলা উড়ে, ছায়া মাটিতে নাই, যাহা জৈবিক, যাহা মনহীন, যাহা হয় অহিতৈষী।
যশোবতী আর সহ্য করিতে পারিলেন না। আপনার দুর্জয় সাহস নিজেকেই আতঙ্কিত করিল, তিনি শুধু নানাবিধ একত্র মিশ্রিত ব্যাঘ্ৰ কভু কর্কশ, চক্রবাক সহসা তীক্ষ্ণ, বায়স কভু দীর্ঘ, ঋষভ ঝটিতি উদ্ধত–নিনাদে উচ্চারণ করিলেন, “এই…এই।”–অর্থাৎ খবরদার খবরদার।
নয়ন সমক্ষে এ কোন ভীম তীব্রতা!
সীতারাম এখনও তেমনি আলিঙ্গন করিয়া আছেন, যে আলিঙ্গনের প্রতি বিন্দুতে, কেয়ারিতে, বিশাল দিব্য সুদীর্ঘ শেষহীনতা ঝিম; যে, অতিবড় গঞ্জের বারাঙ্গনায়ও পর্যন্ত সে-সুদীর্ঘতা বুঝিতে সমুৎসুক এবং এই অপ্রাকৃতিক আরাম যাহার অন্তর্বর্তী চালোক, যে চন্দ্রালোকের অন্তর্বর্তী ভ্রমণশীলতার অভিধা, যে ভ্রমণশীলতার অন্তর্বর্তী সুন্দরের উষ্ণতার বিচিত্রতার মাধুর্যের সুধার লৌকিকতার জ্যামিতির ভূমিকার উৎপ্রেক্ষা অবর্ণনীয়া; তাহাকেই, সেই আরামকেই রমণীকুলশ্রেষ্ঠা যশোবতী আপন রোমকূপ-সহস্র, যাহা পুরুষ মানুষের, ইতরজনের অবামনসগোচর, তাহা দ্বারা স্বাদ গ্রহণে প্রগম্ভ; এই হেতু যে ইতঃপূর্বের বৈজুনাথের চক্রান্ত যাহাতে শ্মশানের মেদগন্ধযুক্ত মৃত্তিকা চিরতপ্ত এবং সে তাপ হরিহরণকারী, তাহা মৃত্যুকে বীভৎস ফলে জীবনকে জঙঘাদ্বয়ের মধ্যে লুক্কায়িত করিতে উৎসাহদানে–বিফলকাম হইয়াছে, একারণ জঙ্ঘা যেহেতু তাহাই মানুষের একমাত্র পলায়নের ক্রোড়, অন্যপক্ষে স্বাধীনতা। চক্রান্ত বিফলে যশোবতী জয়গর্বিত, ফলে তিনি ভাবনাবিরহিত মনে তখন সেই অলঙ্কার বলয় ইত্যাদি, যেগুলি আত্মরক্ষাকল্পে ব্যবহার করিয়াছিলেন, সে সকল পুনরায় সংগ্রহে ব্যাপৃতা হন। অদূরে চণ্ডালের দেহ চিহ্ন, বেলাপৃষ্ঠে মুদ্রিত, বৈজুনাথ যেন বা আপনার এই ছায়াকে পাহারায় রাখিয়া গিয়াছে। তাঁহার এই অলঙ্কার সংগ্রহ যাত্রা না অভিসার, শূন্য তীর ঝটিতি মহাগুল্ম, তৃণস্থান, লতাবিতান গহন কাননে আচ্ছাদিত। শুধু মৃত্তিকা ও তাহার অচ্ছেদ্য সম্পর্ক এখানেই তিনি অলঙ্কারাদি অন্বেষণ করেন, হৃত সম্পদ লাভ করিয়া একদা গঙ্গায় তাহা শুদ্ধ করিবার নিমিত্ত কয়েক পদ অগ্রসর হইয়াছিলেন, তিনি তীরে দণ্ডায়মানা, নিম্নে জলোচ্ছাস; সহসা তাঁহার ধারণা হয় স্রোতোধারার উপর আপনার সম্পদ সমুদয় মেলিয়া ধরিলেই শুদ্ধ হইবে, ইহার পর আবার এই আক্রমণ।
উগ্রতেজা বলিষ্ঠ বৈজুনাথ এখনও তেমনিভাবে তাঁহাদের বেষ্টন করিয়া সবেগে ধাবমান, তাহার পদদলিত তপ্ত ও তীব্রতর প্রভাবিশিষ্ট ধূলারাশি শূন্যমার্গে উখিত; সে দাম্ভিক, তাহার ঔদ্ধত্যের পরিসীমা নাই, তাহার বেগবিক্রমে একথাই প্রকাশিত যে, আমি মহাবিটপীসকল অক্লেশে উৎপাটন করিব, আমি উত্তুঙ্গ গিরিসকল বিদারণ করিব, আমি মত্ত সাগরকে সংক্ষোভিত করিব। স্বপ্নের দ্রষ্টাকে আমি দাস রাখিব, আমার গতি অব্যর্থ, কি সাগরশৈলে কি বনে অথবা পাতালে–কোথাও আমার গতি প্রতিহত হয় না।
সীতারাম-অভিলাষিণী যশোবতী দুরদৃষ্ট দর্শনে প্রমাদ গণনা করিলেন; একধারে, অতি প্রতীক্ষার অরুণাভ ভেদ করিয়া মনসিজ আলিঙ্গন; অন্যত্রে জাগরণে, প্রত্যক্ষে–নাদ উচ্চনাদ গর্জন মেঘরব, এবং ধূলারাশি! সাধ্বী আর এক মুহূর্তকাল বিলম্ব না করিয়া স্বামীর আলিঙ্গন এক স্থানে রাখিয়া অর্থাৎ স্বামীর ভয়ার্ত হস্তদ্বয় হইতে আপনাকে মুক্ত করত কোমরে কাপড় জড়াইয়া কোন সময় যে কাজললতা হাতে দুষ্টকৰ্ম্মা চণ্ডালের পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইয়াছেন, তাহা তিনি নিজেই জানিতেন না। কালসর্পের মত বেণী চমকাইতে লাগিল, এবং তাঁহার পূর্বপুরুষের সাধনার দেহখানি শুধুমাত্র শব্দময়। আননে চন্দ্রালোক নাই, নিয়ম লঙঘন করত এখন, ওতপ্রোত সূৰ্য্যালোক দীপ্তি দান করে।
চণ্ডাল তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিল; বৈজুনাথের দেহ যেমত বা একটি সাষ্টাঙ্গ খাড়া প্রমাণ; দেখিল গঙ্গায় যেন ঢল নামিয়াছে; দেখিল, যাহা ভয়ঙ্কর উহা দুধর্ষ, তাহা অভিরাম, হাজার জোনাকি। সে গতি কোনক্রমে সম্বরণ করিয়া দুই পা পিছাইয়া গিয়াছিল, নিরক্ষর বিড়ম্বনায় তাহার শ্রবণশক্তি ক্লীব, দৃষ্টি হস্তীদলিত অন্ধকার মাত্র; গঙ্গাতীরে, স্তব্ধতার তলে, কেন না স্রোত অধুনা রেখানিচয়, বৃদ্ধের গোঙানির শব্দ শোনা যায়। চণ্ডাল ভূত-চালিতের মত কি জানি কেন আপনার হস্ত প্রসারিত করিয়া ক্রমে ভীতভাবে নামাইয়া লইল, আপনার ওষ্ঠ লেহন করিল।
“চণ্ডাল”–শুদ্ধভাষায় মানিনী যশোবতী তারস্বরে হুঙ্কার দিয়া উঠিলেন; ইনি সেই যিনি আপন দয়িতের ভয় নিবারণার্থে ভয়ঙ্কর ডাকে একদা সমস্ত মেদিনীকে প্রকম্পিত, সমস্ত স্পন্দনকে শিথিল করিয়াছিলেন। অতএব তাঁহার নির্ভীক উচ্চনাদে বৈজুনাথ বিহ্বল; সে কোনক্রমে আপনকার চক্ষুদ্বয় তুলিয়া সেই অপূৰ্ব্ব রমণীকে অবলোকন করিতে গিয়া আকল্প নবীন অতি সূক্ষ্ম স্পন্দনের বিভূতি দেখে, যাহা দিব্যচক্ষুর অন্তর্গত, যাহা কাব্য-মনসার চিৎস্বরূপ; তথাপি মূঢ় বৈজুনাথ, যে সন্ধ্যা এবং ব্রাহ্মমুহূৰ্ত্ত সম্পর্কে নিশ্চেতন অনভিজ্ঞ, সে আপনার সুদীর্ঘ নিঃশ্বাসে আপনাকে বলবান করিয়া রূঢ় চক্ষে চাহিল, এবং নির্বোধের ন্যায় ঈষৎ হাস্য করিল।
যশোবতী সরোবর সরিৎ, নদী, লতাগুল্মাদি সপ্তপর্ণবনানী, গিরিসমূহ, ভূতগ্রাম সকলের, মৎস্যাদি উভচর সকলের যেন–পথরোধ করত এখনও দৃঢ়, একক; তাঁহার অবগুণ্ঠন নাই, হস্তে সীতারামের। কাজল চচ্চা নিমিত্ত ফলক ইব কাজললতা, মারাত্মক ছুরিকার ন্যায় শোভা পাইতেছে; ঈদৃশী লজ্জাহীনতা এবং দুর্জয় আভঙ্গ দেহসৌষ্ঠবের মধ্যে তিনি নিশ্চয়ই বিদ্যমান ছিলেন, তন্নিবন্ধন অনন্তর চণ্ডালকে পূর্ণভাবে নিরীক্ষণ করত কহিলেন, “তোমার…তোমার মনে কি কোন মায়া-দয়া নেই” একথা বলিতে বলিতে তাঁহার, হরিণনয়না যশোবতীর, সুতপ্ত অশ্রুধারা নামিল।
এ হেন বাক্যে অনাৰ্য্য চণ্ডালের শিরা-উপশিরা হা-হা করিয়া উঠিল, আজন্ম ক্ষুৎপিপাসা কাতর তাহার মন, কথাগুলিকে যেমত বা আহার করিবার মানসে আঘ্রাণ করিল এবং উত্তর দিল, “দয়া মায়া…” এ উচ্চারণে ভঙ্গ ছিল।
সঙ্গে সঙ্গে প্রতিধ্বনিত করিলেন, “হু”–তখন তিনি ক্রোধে ফুঁসিতেছিলেন।
“বটে বটে, এ শ্মশানে” বলিয়া বৈজুনাথ অত্যধিক তাচ্ছিল্য-সহকারে সমগ্র শ্মশানকে অঙ্গুলিদ্বারা নির্দ্দেশ করিয়া পুনরায় যোগ করিল, “এ শ্মশানে পাব কুত্থাকে গো কনে বউ”–এ সময় তাহার অঙ্গুলিতে চন্দ্রলোক লাগিয়াছিল, এবং ইহার পর আপনার মনে দয়া মায়া’ বলিয়া হাসিয়া উঠল।
যশোবতী চণ্ডালের হাস্য তরঙ্গের প্রতি মনোনিবেশ করিলেন, তখনও তিনি যথার্থ সম্বিৎ ফিরিয়া পান নাই, তিনি এখনও অনবগুণ্ঠিতা, তবু ইহা ধ্রুব যে, তিনি আলোতে, অন্ধকারে, একাকিনী, লোকচক্ষে, রক্তমাংসে বধূ; তাঁহার তীক্ষ্ণ রূঢ় সাহসদীপ্ত গম্ভীর কণ্ঠস্বর শ্রুত হইল “তুমি কি ওঁকে মেরে ফেলতে চাও? তোমার মনে কি ভগবান এতটুকু মায়া মমতা…”
“ভাল গল্প গো ভাল গল্প! মায়া মমতা একমাত্তর আমার থাকার কথা, না? আমি জাত চাঁড়াল, বলি মায়া মমতা কোথাকে পাব গো, ও সব ত বামুন কায়েতের ঘরে মরাই মরাই…বেশ মিঠে হিম হাওয়া, না গো…”
“চাঁড়াল”
“ভুল বেগোড় বুঝলে বটে বামুনের মেয়ে, এক গল্প বলি, এখানে যা ছিল, একটু একটু করে সবই পাঁচ ভূতের চিতায় গেছে…মায়া দয়া!”
“তুমি”…
“হ্যাঁ গো কনে বউ তুমি কখন কেঁদেছ?”
যশোবতী সহসা মৃত্তিকায় পদাঘাত করিয়া দর্পভরে কহিলেন, “তুমি ওঁকে শান্তিতে…” এবং উক্তির সঙ্গে সঙ্গেই এবাক্যের ম্লান নিদারুণ ছায়া দুইজনের ইতিমধ্যে নিপট হইয়া দেখা দিল, আর যে ক্রমে তাহা বিলীয়মান। যশোবতী চণ্ডালকে নিরুত্তর দেখিয়া আরবার সুন্দর করিয়া কথা কয়টি উচ্চারণ করিলেন, “তুমি কি শান্তিতে…”
“মরতে” ইহা বৈজুনাথ প্রশ্ন করে নাই, তাহার কণ্ঠস্বরের বেদনা কোন তুমুল সমুদ্র পার হইতে চাহিল, অনন্তর কুয়াশায় আবছায়া স্বরে কহিল “কনে বউ তুমি খুব খাসা, তাই হে যা বল তাই সে কথাই তোমার লাগসই হে, এখন তুমি বল দয়া মায়া আছে কি না, বাঃ!”
বাক্য, শব্দের পূর্বের এক অচিন নিস্তব্ধতা এখানে আবর্তিত হইল! মিলন অভিলাষিণী সুন্দরী, অন্যধারে শ্মশান পরিচর্যাকারী নরদেহ।
বৈজুনাথের ওষ্ঠ ওঠানামা করে; ঝটিতি, এই গহনরাত্রে যাহার একান্তে কুয়াশা আবৃত খরধারা, তাহার ভগ্নস্বর শ্রুত হইল, “বামুনের মেয়ে, কনে বউ, আমি আকাশ খাই গো, তুমি পূব দক্ষিণ দশ দিক কখন দেখেছ…এখানে তোমার তরে সব সোনা হবে” বলিয়া কিঞ্চিৎ শ্মশান-মৃত্তিকা তুলিয়া আরম্ভ করে, “দেখ, দেখ তুমি হেঁটে গেলে, এ মাটি আবাদ হবে…” বলিতে বলিতে বৈজুনাথ ষড়ৈশ্বৰ্য্যময়ীর প্রায় নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল।
চণ্ডালের করপুটে মৃত্তিকা, কুয়াশা নাই, যশোবতী সজল স্নেহময়ী চক্ষে এ মৃত্তিকা দেখিয়া, চকিতে কয়েক পদ পশ্চাদপসরণ করিলেন। বৈজুনাথ হস্তস্থিত মৃত্তিকারাশি ফেলিয়া দিয়া ম্লান হাস্যে কহিল, “কাল শালা যাকে লিয়েছে সে যাক্। কিন্তু কেউ কাউকে ঠেলে চিতায় ফেলবে, এটা কি বল? ওগো বাবু, আমার দোষ লিও না,– এ সময় তাহার আওয়াজ কুয়াশা-বিজড়িত, আর্দ্র, শ্রমখিন্ন; দীনমানসে আন্তরিক ভাবে বলিল, “আমি মারলে ঠেঙ্গা ফিরলে লাঠি নই, উঁচু নই চাঁড়াল গো, চাঁড়াল…পুঁথিপাঠ নাই, তোমার চিতা করব না হেঁকে বললুম…আমি ঠাকরুণ ইন্দ্ৰত্ব আশা করি না, বৈকুণ্ঠবাস চাই না, নয় হে দুঃখ হয়েছিল…দেহ বড় ভালবাসি মড়াকে যত্ন করি…”
“চণ্ডাল”–যশোবতী উচ্চৈঃস্বরে তাহাকে প্রকৃতিস্থ করিতে চাহিলেন, সমস্ত আবহাওয়া এখন তাঁহাকে কিয়দংশে শান্ত করে, আর তিনি সম্যক, হয়ত বুঝিয়াছিলেন, বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, এই, ইহা শ্মশানভূমি হইলেও ইহা আদর্শতুল্যা অলাতচক্রাকৃতি পৃথিবীর, যাহা উত্তম হাস্যধ্বনি পরিমণ্ডিত, অংশ; নিম্নে, উগ্র তীব্র ক্ষিপ্ত বেগবতী স্রোতস্বিনী!
যশোবতীর কণ্ঠস্বর সঙ্গীতময় হইত যদি তাহা আকাশচারী; কাব্যময় হইত যদি তাহা সৃজনক্ষম; চিত্রমায়া হইত যদি তাহা বর্ণিকাভঙ্গধর্মী।
“হা হা, বুঝি বুঝি গো রহ রহ.কনে বউ, যে মানুষ নিজে ভস্ম হতে চায়, সে এ সোনার ত্রিভুবন জ্বালাতে পারে গোগা…ছিলাম শব তোমায় দেখি শিব হইলাম গো,– এইটুকু বলিয়াই আপনার জিহ্বা কাটিয়া কান মলিয়া কহিল, “না হয় ভস্ম হব গো, তবু আমি তোমার হাতেই হব গো, রামের হাতেই হব হে…”
“তুমি যাবে কি না”–এ বাক্য সাগর অভিমুখী, সাগররূপ কান্তর মিলন অভিলাষিণী স্রোতকান্তার একনিষ্ঠতা দর্শনে সাহসী হইয়া তিনি বলিয়াছিলেন।
“আমি এ হতে দিব না গো…তুমি পালাও হে, দুনিয়াটা খুব বড় কনে বউ–দুনিয়াটা খুব বড় বলতে, আমার কেমন রোমাঞ্চ হচ্ছে হে…পালাও কনে বউ।”
“মড়াই তোমার বুদ্ধিতে চলে…”
“মড়া” বৈজুনাথ এবম্প্রকার বিস্ময়ে এ বাক্য উচ্চারণ করে যে, বাক্যের সহিত চিত্র এই প্রথম একক হইয়া, একটি বিস্ফারিত নেত্র, পরিক্রমণশীল! ইহা সে দর্শনে অনড়, আপনকার ক্ষোভ, মর্মবেদনা, অপ্রসন্নতা, কিছু প্রশমিত হইবার পর সে ধীরে ধীরে কহিল, “মড়া!” ক্ষুদ্র একটি নিস্তব্ধতা দেখা গেল, ইহাও তাহার বাক্য বৈ অন্য নহে, এবং করুণ আর্তনাদে কহিল, “নর দেহ, নর দেহ যার কেউ নেই যে নিজে ছিল” পরক্ষণেই আপনার দুর্বলতা বুঝিয়া সশ্লেষে বলিল, “মড়া আই গো কি গেদা গো তোমার কনে বউ…আমি কি মানুষ হব না, বামুনের মেয়ে, কখন হয়ত বলবেক হারে তোর বড় নপর চপর, বেটা তুই পাতকুড়নোর অধম ছোট জাত…হাঁটছিস আমাদের মত, কনে বউ আমার হাতে জল চলে না রূপো চলে…বুদ্ধি…”
“তুমি যাবে কি না…”
বৈজুনাথ হয়ত তাঁহার মানরক্ষা নিমিত্ত দুয়েক পদ ধীর পদক্ষেপে সরিয়া আসিয়া হঠাৎ বসিয়া পড়িয়া কুয়াশা পরিবৃত গঙ্গার দিকে চাহিল, ছোট একটি দীর্ঘশ্বাস, সম্ভবত তাহার, চণ্ডালের, ঘুরিতে ঘূর্ণায়মান অপসারিত; ক্রমে শান্ত কণ্ঠে আপন মনে বলিতে লাগিল, “তোমার বিয়ে দেখলাম গো, গান গাইলাম গো, আমি তারাগুলোকে জলে দেখি, জাত চাঁড়াল এমন বিয়া-সাদি আমি দেখি নাই, মাগভাতার মাদুরে এক, হেঁসেলে দুই, প্রকারে তিন–আমার বউ বলত; তোমার বিয়ার দিন তারিখ নাই। কিন্তু তুমি দিয়ে দিলে বুড়ার হাঁড়িতে চাল, তাই বলে…এমন বিয়ে এ যে ভেল্কী…বুঝাও কোন মতে সিদ্ধ, তবে হ্যাঁ খুব খেয়েছিলাম গো–এ এক অবাক গল্প না গো কনে বউ?”
যশোবতী চণ্ডালের গতিবিধি অনুসরণ নিমিত্ত এখনও সেখানেই; আপনার ছায়ার প্রতি তীব্র কুঞ্চিত দৃষ্টি হানিয়া বৈজুনাথকে দেখিলেন, যাহার গাত্রবস্ত্র, গামছা, আলুলায়িত যাহা মন্থর বায়ুতাড়িত।
যশোবতী বাক্যহীনা, তথাপি বেলাতটে, এখন আসীন বৈজুনাথের মনে হইল, কনে বউ তাহার বোকা সরল কথায় বিদ্রূপ করিলেন, ফলে সে গম্ভীর স্বরভঙ্গে বলিল, “আমরা আর কি বল আমাদের ত জ্বললে আঁধার, নিভলে আলো–এ বড় ভাগ্য যে আমা হেন মানুষ নিঃশ্বাস নেয়!”
যশোবতী হেঁয়ালী বুঝিলেও একথা তাঁহার বিশ্বাস ছিল, যে বৈজুনাথ সেইটুকুর মধ্যে বাঁচিয়া নাই, তাহার পিছনে সম্পর্ক আছে, অনেক ঔদ্ধত্য আছে, সে দুর্ধর্ষ; অনন্য মনে এ সকল কিছু তিনি জ্ঞান করিতেছিলেন এবং এই সূত্রে হয়ত তাঁহার মনে হইয়াছিল তিনি যশোবতী, কি এখনও দিক নির্ণয় করিতে সক্ষম, তিনি কি প্রহর মানিতে পারদর্শী, তিনি কি ফুলসকল ফলসমূহ মৎস্যাদিকে চিনিয়া লইতে অভিজ্ঞা! এবং ঠিক এই সময়ই প্রত্যক্ষ করিলেন যে চণ্ডাল বৈজুনাথ বাঁকিয়া সম্মুখে তাহার হস্তদ্বয় ভুমি’পরি ন্যস্ত, পদদ্বয় কিছু বিস্তৃত, অবাক নয়নে তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়াছে। তাঁহার, যশোবতীর, দৃষ্টি অনুভব করিয়া কহিল, “তুমি কি সুন্দর…”
“চণ্ডাল” তাঁহার বাক্য মেঘরহিত আকাশকে বিদীর্ণ করিল।
“সত্যিই তুমি সুন্দর কনে বউ…” বলিয়া বৈজুনাথ উঠিয়া দাঁড়াইয়া ধূলা হাতে হাত আঘাত করত ঝাড়িয়া ফেলিয়া কহিল, “যাক আর সময় বেশী নেই, কাল…কাল যখন চাঁদ লাল হবে কিন্তু তবু বলব কনে বউ তুমি সত্যই মাটি ছুঁয়ে বলছি কাল চাঁদ যখন লাল হবে,– বলিতেই সে, চণ্ডাল, অচিরাৎ ত্রাসে বিমর্ষতায় নিদ্রিত, স্বপ্ন তদীয় রজনী লইয়া নিঃশ্বাস তাহার মিত্র হইয়া দেখা দিল; অঙ্গুলি যেখানে হাসে, সেই দুয়ে হাস্যধ্বনি, মত্ত মাতঙ্গ স্বভাব এবং তাহা ঘোর, মেঘদর্শন, অধুনা তরঙ্গায়িত! বৈজুনাথ আত্মসম্বরণ করিল, জাগিল; সমস্ত, প্রতিবিম্বিত দীপ্তিতে, আধোউদ্ভাসিত বৰ্তমান সমাকীর্ণ উদ্ভট ব্যাকুল দৃশ্যমানতা অবলোকনে তাহার মনে হয়, আপনার স্বপ্নকে লইয়া এখানেই ঘর করিবে, কেন না এই লোক চরাচর তাহার স্যাঙাৎ, ইহার সহিত তাহার বহুকালের প্রণয়, তথাপি যাহাকে কিছুক্ষণ পূৰ্ব্বে আপন আত্মম্ভরি মনে, পৃথিবীটা খুব বড়’ বলিতে রোমাঞ্চিত হয়, কেননা সে ঐ সূত্রে সুমহান বিরাটত্ব অনুভবে ক্ষণমাত্র বীতচেতন। ক্রমে বৈজুনাথ মায়িক স্বরে কহিল, “কিন্তু তবু বলি সময় নাই গো, আমার এক গল্প শুন হে তুমি, তুমি কনে বউ তুমি লিজে নারী কি পুরুষ একথা জানি না, তুমি কোন দেশের কোন মাহালের তা জানি না, কিন্তু পুড়বে ভাবতে যেন আমি চৌচির, এ কথা ভাবতে আমি মুরারী গো (অর্থাৎ দারুভূত)” ইহার পর চণ্ডালের কণ্ঠস্বর যেন শায়িত এবং শোনা গেল, “অহরহ তুমি তুমি ভাবতে আমি যেন তুমি হই যাই হে” এবং পুনরায় তাহার শব্দপ্রবাহ ব্যক্ত করে, “মনে লয়, মন মানে ভরত–আহা জনক রাজা হরিণ হরিণ হরিণ করতে হরিণ” বলিতেই তাহার দেহ হরিণের নিরীহগতি প্রযুক্ত, সে কিছুটা চলিল।
অন্যপক্ষ এতাবৎ, সূক্ষ্ম যশোবতী, নিম্নে, নিকটে, আপন ইহকাল দিয়া স্বামীর অস্তিত্ব-অভিজ্ঞান সকল দেখিয়া লইতে কৃতনিশ্চয়; ফলে এই হয় ধ্রুব যে, বাগ্মী চণ্ডালের অজস্র ধ্বনিপ্রবাহ তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করে নাই; শুনিতেন যদি, তাহা হইলেও, তাঁহার কোনই বিচ্যুতি ঘটিত না, তাঁহার সঙ্কল্পের নিকট উহা বালখিল্য উচ্ছাস পরম্পরা, যাহাকে নিমেষেই, ধরিত্রীপৃষ্ঠের বারিপাত হেতু ক্ষেত্রের অলীক ঝরণা পরাস্ত করিতে এক লহমা, তথাপি তাঁহার একথা মনে হইলেও হইতে পারে, যে, ইহা কি শ্মশান? বীজ বপন করিলে যথার্থই এখানে কি অঙ্কুর দেখা দেয় না!
বৈজুনাথ হরিণগতি সম্বরণ করত চকিতে ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া অব্যর্থ কণ্ঠে বলিল, “তোমাকে আমি মরতে দিব না হে”,–পুনরায় দ্রুত পাশ হাঁটিয়া কহিল, “পারতুম যদি, তোমায় ছুঁয়ে দিতুম গো কনে বউ।”
এবম্প্রকার ভাষায় যশোবতীর দেহ, শিখা যেমত, ভ্রমর যেমত, পদ্মপত্র যেমত, তড়িৎ প্রবাহ যেমত, অতীব চঞ্চল, আপনার মস্তক সঞ্চালন করিয়া অন্তর্মুখী হইতেই হস্তধৃত কাজললতা মাটিতে খসিল। তিনি, ইহা কি সত্য, সম্মোহিতা হইলেন।
বৈজুনাথ যশোবতীর এ বৈলক্ষণ্য অনুধাবন করে নাই, সে উদ্দীপ্ত, সে আপনার কথা সাজাইতে ব্যস্ত, “হ্যাঁ গো, তোমার সত্যি সত্যি বিয়ে হয়েছে, না সেটা স্বপ্ন…কে জানে বাপু.আমার কেমন আঁট নাই…মনে হয় দশ রাত জাগা…কখন কোথায় মনে লেয় না, কখন না থাকলে কোথায় সেটা নাই…মনে লেয় আমার গা-চাটা বয়েস…” বলিয়াই অতি সূক্ষ্মভাবে হাসিয়া নববধূর প্রতি দৃষ্টিপাত করিল।
যশোবতী পর্ব্বতছায়ার মত স্থির।
এতদ্দৃষ্টে, চণ্ডাল স্তম্ভিত, নিস্পৃহ; ইহার কিছুক্ষণ পরে সে কেমন এক ভাবের ভাবী হইয়া, ঘোর বশে মৃত্তিকা তুলিয়া করজোড়ে, চণ্ডাল বৈজুনাথ, সুন্দর প্রার্থনার কণ্ঠে বলিতে আরম্ভ করিল, “তোমায় মান্য করি কনে বউ, তুমি বামুনের মেয়ে আমার দোষ লিও না, তুমি একবার ভাব আমি খল কটু নই, তুমি হে গহনা ছুঁড়লে…আমি কিন্তুক সে মনা নই হে, তঞ্চক বঞ্চক…সত্যিই যদি, তাহলে লিয়ে ফেরার হতুম…” বলিয়া সে অল্পকাল থামিল, মৃত্তিকারাশি ঝরা শব্দ শোনা গেল।
সহসা ঐ শান্ত একটানা শব্দ ভেদ করিয়া বিদ্রুপাত্মক এক ঘোষণা হইল, “মাতাল বজ্জাত।” ইহা যশোবতী বলিয়াছিলেন।
বৈজুনাথ যুগপৎ, অন্যরূপে ইহার প্রতিধ্বনি করিল; মৃত্তিকা সকল সদম্ভে ফেলিয়া, আপনার গণ্ডে বার বার চপেটাঘাত করত কহিল, “হা কপাল, কপাল, চেনা মানুষকে চিনতে লারলে গো, চোখ কালো বলে কি দিনমান আঁধার হবে হে? মদ! বলি গল্প শোন, মদ আমাকে সৎ করেছে তাই না এতেক বললুম…মদকে দুষো না, মদের নাম প্রমোদন…মদ আমায় সংযম করে,…তোমাকে খোলাখুলি বললাম হে তারই জোরে…”
“তুমি যাবে না…”
“ওই গো ভাবের ঘরে চুরি,– এবং পরক্ষণেই মুখভঙ্গী সহকারে কহিল, “তুমি কি ভাবো ওই ঘাটের মড়া তুমার সোয়ামী…
“হ্যাঁ, স্বামী” যশোবতীর এই উত্তরে সমগ্র বিশ্বের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ছিল, এ স্বীকারোক্তির অখণ্ড তৈলধারাবৎ পতিভক্তিতে কাল বিমর্পিত হইল; স্পন্দন গতি যাবতীয় দ্রব্যসকলের আর প্রয়োজন নাই–চন্দ্র সূৰ্য্য অচিরাৎ দায়মুক্ত।
বৈজুনাথ একমাত্র জীব যে আপনার মাথা তুলিতে এখনও সমর্থ, সে যারপরনাই শক্তিতে ফুকার দিয়া উঠিল, “মিছা মিছাই মিথ্যা হে কঠিন মিথ্যা গো” সমস্ত জীব জগতের হাহাকার তাহার এই আৰ্তনাদ, যাহা দিগ্বিদিকে মাথা ঠুকিয়া ফিরিল; অতঃপর সে দন্তঘর্ষণ করিতে করিতে ব্যক্ত করে, “আ হা…মানুষ এক অচিন গাছ, মানুষ বড় ডাগর জীব গো, কাঠের বিড়াল দিয়া ইন্দুর ধরে…..তাই না?” বলিয়া হা-হা রবে হাস্য করিয়া আবার জলদগম্ভীর কণ্ঠে কহিল, “মিথ্যা।”
তাহার, বৈজুনাথের, বাক্যশব্দ যেমন বা সূৰ্য্যকে নাম ধরিয়া ডাকিল, ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকারে সময় আরূঢ় হইয়া উদ্দাম, কৰ্ম্ম প্রতিশ্রুত হইয়া আবর্তিত হইল।
বৈজুনাথ আর বাক্যক্ষয় করিল না, সে শ্লথ পদবিক্ষেপে অগ্রসর হয়; সে যেমন বা কিয়দংশে মর্মাহত, চন্দ্রালোকে এত বড় মিথ্যার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না, ফলে তাহার মস্তক অবনত; একবার, সে মুখ ফিরাইয়া যশোবতাঁকে নিরীক্ষণ করে, দেখিল, তিনি তখনও তেমনভাবেই দণ্ডায়মানা।
.
যশোবতী ইদানীং একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করত, আত্মকেন্দ্রিক, এবং নিমেষেই সহজ, এবং অতি দ্রুত আপনার অঙ্গাভরণ সংযত বিন্যস্ত করিয়া, যেন বা দৌড়াইয়া, স্বামীর নিকট প্রত্যাবর্তন করিলেন। অর্ধ-আস্বাদিত আলিঙ্গন, চাঁদোয়ার ছোট অন্ধকারে, যাহা তিনি রাখিয়া সম্মুখ সমরে নামিয়াছিলেন তাহা সন্ধান করিতে এখন প্রয়াসী।
বৃদ্ধ সীতারাম তখনও কাঁদিতেছিলেন; ধীর বিলম্বিত লয়ে ক্রন্দনের ধারা শূন্যতায় উঠে নামে। যশোবতীর কেমন যেমন ভাবান্তর দেখা দিল, অবশ্য তাহা কয়েক মুহূর্তের জন্য, যদিও তিনি স্বামীর নিকটেই তথাপি আৰ্ত্ত ত্রাস আবিষ্ট রোরুদ্যমান বৃদ্ধের সযত্নে চক্ষু মুছাইবার মত স্নেহ তাঁহার মধ্য হইতে অন্তর্হিত; ভূতগ্রস্তের ন্যায় তিনি বসিয়া আছেন, কৃষ্ণপক্ষের শশিকলা যেরূপ ক্রমশঃ ক্ষীণা, তেমনই তিনি, যশোবতী, অঘোরচারী ঈপ্সিত অমাবস্যা তাঁহার ধমনীতে, রক্তে, পরিপ্লাবিত। কিছুকাল পূর্বের কথা, তামসিক চণ্ডালের রাজসিক কণ্ঠে সত্ত্বগুণ দীপ্ত বাক্যালাপ সম্ভবত তাঁহাকে, তাঁহার দেহ হইতে উচ্ছেদ করিয়াছিল, অবশ্যই সত্যই অমৃতবারি সেচন করে নাই। কখনও কখনও তাঁহার পলাতক মন দেহের সহিত সহজ বন্ধন লাভ কালে, তথা দেহের সহিত মন সংযুক্ত হইবার কালে, দেহ ওতপ্রোতভাবে দুলিয়াছিল; যশোবতী আপনার ললাটে, এ সময়, দক্ষিণ হস্ত প্রদান করিয়াছিলেন; তাহা কি করাঘাত সূত্রে অথবা স্বেদ মুছিবার কারণে তাহা জানিবার উপায় নাই–কেন না উহাতে কোন চিত্রসংজ্ঞা ছিল না। আর যে এইক্ষণেই তিনি মানসচক্ষে অবলোকন করেন, কাহারা যেমত বা এক মধুর গীত গাহিতে গাহিতে আসিতেছে, ইহাদের স্বেদ নাই, ইহারা ক্লান্ত নহে, যে গীতের মধ্যে আশা, যে আশার মধ্যে গোলাপের গন্ধ, যে গোলাপ গন্ধের মধ্যে বাল্যকাল, যে বাল্যকালের মধ্যে নিরীহতা, কাহার অন্তরীক্ষ আলেখ্য বহনে গর্বিত।
এই দৃশ্যকাব্য তিনি যেন পান করিতেছিলেন, কিছুকাল এইভাবে অতিবাহিত, পরে আপনার দেহভার অনুভব হয়। চণ্ডালের সহিত সাক্ষাৎকার অতীব আশ্চৰ্য্য, শরীর তদবধি সন্তপ্ত, তিনি জল লইয়া চক্ষু কর্ণে এবং আপনার পদযুগের বৃদ্ধা অঙ্গুষ্ঠার উপর দিয়া, অতি বিস্ময়কর কথা যে, তিনি। আপনার বিকলাঙ্গ ছায়ার উপর জল সিঞ্চিত করিয়া, এখন আলগোচে কিঞ্চিৎ পান করিলেন। শীতল জলের স্পর্শে বুঝিয়াছিলেন, মস্তক শিরঘূর্ণনে উপদ্রুত, যদিচ শিরঘূর্ণন এখনও প্রশমিত হয় নাই, তথাপি তদবস্থায় আপনার চমৎকার সুডৌল মৃণালভুজদ্বারা জন্মান্তরের স্বামীকণ্ঠ, মহতী গভীর হৃদয়ে আলিঙ্গন করিয়াছিলেন।
.
সপ্তর্ষি মণ্ডলের অনতিপূৰ্ব্বে চন্দ্র প্রতিভাত।
অলৌকিক দম্পতি ঘুমে নিশ্চিহ্ন, খুব ধীরে শয্যার খড় বায়ু-সঞ্চালিত। ইহা শ্মশানভূমি, এখানে ঘুমন্তরা আনীত হয়, এখানেও ঘুম আসে; দুজনেই স্বামী এবং স্ত্রী ঘুমে দৃষ্টিরহিত। এক পার্শ্বে মৃতকল্প বৃদ্ধ, অন্যপার্শ্বে পরিশ্রান্ত যশোবতী, ঘুমঘোরে অনেকখানি শয্যাচ্যুত হইয়া বাহিরে, হিমক্লিষ্ট ভূমির উপরে আসিয়া পড়িয়াছিলেন, দেহ ত্রিভঙ্গ, কুণ্ডলীকৃত নহে, কর্কশ ধ্বনি ব্যক্ত, এবং তাঁহার অর্ধ উন্মুক্ত মুখ বহিয়া লালা নিঃসৃতবান। এমত অবস্থায় তাঁহার নিঃশ্বাস-আলোড়িত বক্ষের উপর একটি ছায়া পড়িল।
‘ভাবের ঘরের চোর’ এই উক্তিও শোনা গেল।
হঠাৎ ছায়া উধাও; কেননা যাহার ছায়া সে কিঞ্চিৎ দূরে সরিয়া যায়। এ ছায়া চণ্ডালের, চণ্ডাল এখনও সম্ভবত নিশ্চেষ্ট হয় নাই, ধৃষ্টতা এখনও প্রধুমিত হইতেছিল; বৈজুনাথের সহসা অপসরণের কারণ এই যে, সে এক অদ্ভুত কিছু এই সান্নিধ্যের মধ্যে দেখে।
একদা যশোবতীর বিবাহের পূর্বে, এক রাত্রে সে ভেড়ীপথ হইতে অন্তর্জলীসুত্রে আনীত, সীতারামকে কেন্দ্র করিয়া কীৰ্ত্তন পরিক্রমণ দেখিয়াছিল; চক্রাকারে ভ্রমণকে মাঝে মাঝে শ্মশানের। চিতার আলোকচ্ছটা উল্লেখ করিতেছিল, আর কুয়াশাবৃত চন্দ্রালোকে যাহা প্রহেলিকা। মন্দিরগাত্রে। রাশমণ্ডলের আলেখ্যর ন্যায় সমস্ত সংস্থান, নেহাৎ সহজ হইলেও উহা অতিকায়, উহা ভয়প্রদ। সেই অনুভূতির কথা মনে করিয়া বৈজুনাথ এখন শুষ্ক, দুৰ্বল; তাহার কেমন যেন মনে হইল সে কীৰ্ত্তনের চক্রকে ভেদ করিয়া আসিয়াছে; সত্যই, সে শঙ্কিতচিত্তে আপনার চারিপার্শ্বে লক্ষ্য করিল। সত্যই সেই রহস্যময়, মস্তক আবৃত, শীতকুণ্ঠিত লোকগুলি ভ্রাম্যমাণ কিনা!
পুনরায় একই মনোভাবে ঘুমন্ত যুগলমূর্তি দর্শনে সে নিঃসন্দেহে হতজ্ঞান, সম্মুখে রাশমণ্ডলের প্রাণস্বরূপ কেন্দ্র চারিভিতে আলোক উদ্ভাসিত, আর মধ্যে চাঁদোয়ার অন্ধকার, বৃদ্ধ আবছায়া, যশোবতী প্রতীয়মানা; বৈজুনাথ সম্যক উপলব্ধি করে যে তাহার শক্তি অপহৃত হইয়াছে, ক্ষমতা বাষ্পময়, পদদ্বয় রোগীর ন্যায় কম্পিত। কিন্তু তাহার পূর্ধ্বমুহূর্তের চিন্তার আলোড়ন এখন ছিল; সে একদা শুনিল, তাহার আপনার দেহমধ্যে উন্মত্ত মাভৈঃ’ ধ্বনি। ক্রমাগত একই ধ্বনি শুনিতে শুনিতে তাহার চক্ষু সঙ্কীর্ণ হইয়া উঠে, এবং স্বীয় মৃদু হাস্যে সমস্ত সকল বিড়ম্বনাকে উচ্ছেদ করত কহিল, “হা রে ভাবের ঘরের চোর। কনে বউ, এই ত দেমাক, টিকারী, চৈত্রের দুপুরের ক্ষেতের মত পড়ে আছে, রহো রহো হে হে মরণের ছাঁচ হে, মিথ্যেবাদী আমি! সতী হব লোকমান্যি হব…সতী রাণী হে, আমি জাত চাঁড়াল আকাশ বাতাস ভালবাসি না, গঙ্গা লয়, ধুক ধুক করা নরদেহ বড় ভালবাসি…আমি…” এ সকল কথা যখন সে বলে, তখন তাহার ছায়া পুনরায় শ্রীঅঙ্গের উপর বিস্তৃত হয়। আমি’ বলার পরক্ষণেই তাহার ছায়া অদৃশ্য।
বৈজুনাথ চাঁদোয়ার একপার্শ্বে এখন, খড় চড় চড় করিয়া উঠিল, বৃদ্ধ সীতারামকে আচম্বিতে দুই হাতে তুলিয়া দাঁড়াইবার কালে, তাহার একটি হাত যশোবতীর কোমল অঙ্গ স্পর্শ হয়। এইভাবে বৃদ্ধকে নির্বোধের মত তুলিয়া লওয়াতে চাঁদোয়ায় বৃদ্ধদেহটি আবৃত হইয়া পড়িয়া সাক্ষাৎ বিঘ্ন উৎপাদন করে, বেচারী অশীতিপর মরণোম্মুখ বৃদ্ধের প্রাণান্ত আকুল দুঃখধ্বনি একবার মাত্র শুত হয়। তাহার পর নির্বিকার! ইহাতে চণ্ডাল, সত্যই বিমূঢ়, স্থির; সে যেন চন্দ্রালোককে জিজ্ঞাসা করিল, সে যেন শ্মশানভূমিকে জিজ্ঞাসা করিল, সে যেন পারিপার্শ্বিক অন্ধকার সকলকে প্রশ্ন করিলকি ব্যাপার? কিন্তু পরক্ষণেই সে কৃতনিশ্চয়, বদ্ধপরিকর, চাঁদোয়া-আবৃত অবস্থায় বৃদ্ধকে দক্ষিণে কভু বামে আন্দোলিত করিল, দ্রুত কার্য সম্পাদন নিমিত্ত চণ্ডাল হিতাহিত কাণ্ডজ্ঞানরহিত; সীতারামের সূত্রবৎ দেহ এমত মনে হয় যেন জালে পড়িয়াছে; শত চেষ্টাতেও বৈজুনাথ কোনরূপে তাহাকে মুক্ত করিতে সমর্থ নহে। কখন মহা আক্রোশে দাঁত দিয়া চাঁদোয়ার কাপড় ধরিল, কখনও বা চুপ কখনও বা খুঁটিতে পদাঘাত করিল; পদাঘাত করিতেই হাঁড়িকুড়ি লণ্ডভণ্ড ছত্রাকার। বৈজুনাথ দেহ লইয়া অন্তর্ধান করিল।
এই শব্দে যশোবতীর ত্বক, সূক্ষ্মতা জাগ্রত হইল সত্য কিন্তু গভীর নিদ্রা ভঙ্গ হইল না। তিনি অভিভূত অবস্থায় গাত্রবস্তু আপনার শরীরে আচ্ছাদিত করিয়া পার্শ্ব পরিবর্তন করিলেন। নববধুর প্রাণ, জীবনঅভিলাষী দুদ্ধর্ষ চণ্ডাল আপনার কার্যসিদ্ধি নিমিত্ত দ্রুতগ হইল। সীতারামের পদদ্বয় এবং বামহস্ত ভৌতিকভাবে আন্দোলিত, ঘর্মাক্ত চণ্ডাল দাঁত দিয়া রজ্জুবন্ধন ছিন্ন করিয়া পলায়ন করিবার পূৰ্ব্বে যশোবতাঁকে দেখিয়া লইবার ইচ্ছা করিল, কিন্তু তাহা সম্ভবপর হয় নাই কারণ চাঁদোয়া ছিঁড়িয়া যবনিকার সৃষ্টি করিয়াছিল। অভাগিনী তখনও ঘুমে অচেতন। বৈজুনাথ বৃদ্ধকে লইয়া ক্ষিপ্রবেগে ক্রমশঃ ঢালুতীরে নামিয়া গেল।
পরোপকারে দৃঢ়সংকল্প বৈজুনাথ বৃদ্ধকে লইয়া বিশেষ সন্তর্পণে গঙ্গায় পদক্ষেপ করিতে করিতে নামিতে লাগিল। তাহার কণ্ঠে বার বার ধ্বনিত হইল, “পাপ আবার কি–পাপ শালা…তুমি শালা যত নষ্টের গোড়া, হ্যাঁ…দোসর লাও শালা বুড়ো–” বলিতে বলিতে সে কিছুটা গঙ্গায় নামিল। একবার মুমূর্ষ দেহটি দক্ষিণে বামে আন্দোলিত করে। ইহার একটি পা গঙ্গাস্রোতে, অন্যদিকে হস্ত গঙ্গার জলস্পর্শ করিয়াছে। বৈজুনাথের ঊরু জলমগ্ন, সে পা টিপিয়া টিপিয়া অগ্রসর হইতেছিল।
অচৈতন্য সীতারামের হস্ত সহসা যেন দৈববলে, মন্ত্রবলে বৈজুনাথকে হতচকিত করিয়া তাহার কণ্ঠ আবেষ্টন করিল। সে টলিয়া গেল, তাহার পর সম্বিৎ ফিরিয়া পাইয়া কহিল, “ওরে শালা বিলে দোসরঘোর” বলিয়া আপনার চিবুক দ্বারা আঘাত করিল, দুইহস্ত প্রসারিত করিয়া দেহটি দূরে সরাইল, তথাপি বন্ধন মুক্ত হইল না। সে পদদ্বয় হইতে ডান হাতখানি সরাইয়া লইতে বৃদ্ধের দেহ জলে পড়িল। তথাপি আলিঙ্গন মুক্ত হইল না–পুনৰ্ব্বার চেষ্টা করিল; তাহার পর আস্তে আস্তে কহিল, “কি রে বাবা, আমায় দোসর লিবি নাকি” সঙ্গে সঙ্গেই বৈজুনাথ ভীত।
বৃদ্ধকে আর কোলে লওয়ার কথা তাহার স্মরণ হইল না, সে দুই হস্ত ছাড়িয়া পালাইবার চেষ্টা করিল। …বৃদ্ধ তাহার কণ্ঠে জগদ্দল হইয়া আছে। সে যেমত ভাঁড়ে বাঁধা নেউলের দশাপ্রাপ্ত হইল। গঙ্গার জল চোখে মুখে দিল এবং সিক্ত বৃদ্ধকে কোনক্রমে তীরে লইয়া উঠে।
সীতারামকে মাটিতে রাখিতেই দ্বি-খণ্ডিত লতার মত বৈজুকণ্ঠলগ্ন হস্তদ্বয় খসিয়া পড়িল। বৈজুনাথ অবাক হইয়া তাঁহার হাতের দিকে তাকাইল; এখন তাহার সাহস ফিরিয়াছে, দৌড়াইয়া আপনার আড়ায় ঢুকিয়া মদ্য পান করিয়া কিছু রঞ্জু ও ছোট একটি কলস হস্তে এখানে উপস্থিত হইল। বৃদ্ধের হাত দুটি একত্রিত করিয়া বাঁধিবার কালে বারবার সে পিছনে তাকাইয়াছিল।
.
যশোবতীর হঠাৎ নিদ্রাভঙ্গ হয়, উঠিয়াই তিনি কবরী রচনার জন্য বেণীতে হস্তদ্বয় প্রদান করিয়া পক্ষীর মত মুখোনি ঘুরাইতেই, ছিন্ন চাঁদোয়ার প্রতি লক্ষ্য পড়িল, হাই মুখে রহিয়া গেল, আর যে, চাঁদোয়া কিছুমাত্র উত্তোলন করিতেই, যখন দেখিলেন যে সেই প্রিয় বৃদ্ধ দেহটি নাই তখন নির্বোধের মত হস্ত দিয়া বিছানা অনুভব করিলেন। চাঁদোয়া পড়িল, তিনি তাহা ছিন্ন করিয়া যখন দেখিলেন কেহ নাই, তখন তাঁহার মস্তক শুষ্ক পাতার মত কাঁপিল। বুড়ো বলিয়া তারস্বরে চীৎকার করিয়াই জিব কাটিলেন। নিজের উন্মুক্ত মৎস্যচিহ্ন ঊরুদেশে আপনাকে উদ্বুদ্ধ করিবার নিমিত্ত চিমটি কাটিতে লাগিলেন, আর যে তৎকালে হৃতবৎসা গাভী যেমত চীৎকার করে সেইরূপ তারস্বরে গগন বিদীর্ণ করিলেন—”কৰ্ত্তা -কৰ্ত্তা- কৰ্ত্তা।”
.
যশোবতী কোনদিকে খুঁজিবেন! বিভ্রান্তভাবে দৌড়াইলেন, স্রোত পথরোধ করে অন্যদিকে নিঃসঙ্গ নৌকা, অন্যদিকে ভেড়ীপথের লতাপাতা আগাছা পথরোধ করিল। তাঁহার পায়ে লতা জড়াইয়া গেল, তিনি বৈজুনাথের আড়ার দিকে গতি ফিরাইলেন, খানিক পথ আসিতেই তিনি স্তম্ভিত, শাসহীন, দেখিলেন–ব্যগ্র, ব্যস্ত বৈজুনাথ স্বামীর হস্তে রঞ্জু বাঁধিতেছে; কলসটি যেমন বা ভূতগ্রস্ত। কি যে করা উচিত তাহা তিনি ভাবিয়া পাইলেন না। আপনার তর্জ্জনী গণ্ডদেশে স্থাপিত হইল। হৃদ্বয় সচাপশরযোজিত ধনুলতার মত বক্র, নয়নযুগল স্ফীত।
বৈজুনাথের দেহ চঞ্চল, সে ক্রমাগতই রোমাঞ্চিত; অথচ কোনক্রমেই তাঁহার আগমন উপলব্ধি করিতে পারে নাই, এ কারণে যে, তাহার কণ্ঠ হইতে অনর্গল কটুক্তি আক্রোশ বাহির হইতেছিল, যথা– “দোসর শালা।”
যন্ত্রচালিতের মত দু’এক পা অগ্রসর হইয়া যশোবতী অতর্কিতে দৌড়াইয়া গিয়া নিকটস্থ ভস্মপরিবৃত একখানি অর্ধদগ্ধ কাষ্ঠ হস্তে তুলিয়া লইয়া উন্মাদিনীর মত ছুটিয়া আসিয়া বৈজুনাথকে আঘাত করিলেন। বৈজুনাথের পিঠ বাঁকিল দড়িসমেত হাত কিছু দূরে গেল, যশোবতী থামিলেন না। বৈজুনাথ কোন অঙ্গ দিয়া নিজেকে রক্ষা করিবে ভাবিয়া পাইতেছিল না, পশুর মত চীৎকার করিতে করিতে ধরাশায়ী হইল।
.
দেবী প্রতিমার ভঙ্গীতে দণ্ডায়মানা যশোবতী, হস্তে কাষ্ঠ খণ্ড। পায়ে ছিন্নলতা চমকিত, ক্রোধে জ্ঞানরহিত-অপরিসীম ক্রোধ দেহের মধ্যে শব্দ তরঙ্গ যেমত বা কম্পমান, সহসা তাঁহার কি এক রূপান্তর হয়।
ক্রোধ হইতে কাম সঞ্জাত (!) হইল, দিকসকল তমসাচ্ছন্ন, তিনি এহেন ঘনঘটায় একাকিনী, আপনার সুদীর্ঘ অন্তরীক্ষে প্রবেশ করিতে সাহসী হইলেন, আপনার আয়ত্তের বহির্ভূত হইলেন। পলাশের উষ্ণতা এখানে নিঃশেষিত বিকারগ্রস্ত হইবেক, বহুধা ধমনীর মধ্যে কখনও সুঙ্গ হাস্য খিলখিল করিয়া উঠিল, এখন স্ফীত হয়; সুন্দর সূক্ষ্ম ভঙ্গিমায় ঊর্ধ্বে চিত্তশরীরে উঠিয়া সৌরজগতে পথ হারাইল। নির্বিকার সমাধি–অল্পকাল পরে, ক্রমে বিস্ময় আসিল, তথাপি মনে হয় তিনি যেমত বা সনাথ আছেন এবং এরূপ অনুভবে, লোকচক্ষুর সম্মুখে তিনি যেমন বা বিবসনা হইয়া গেলেন, ব্ৰীড়াবনত মুখে শঙ্কায় প্রমাদ গণিলেন, কেননা চতুঃষষ্ঠি প্রকার লক্ষণসমূহ দেখা দেয়, কেননা মৎস্যচিহ্ন উরুদেশ সিক্ত এবং আপন জিহ্বা দংশন করত দক্ষিণ পা বাম পদের পার্শ্বে স্থাপিত করিয়া কিয়ৎকাল নির্জীব অবস্থায় রহিলেন। তাঁহার পিছনে, গঙ্গায়, কারণ সলিলে স্রোত ছিল। …আঃ রমণী! আঃ আশ্চর্য! যে তুমি দুটি অব্যক্তকে একই দেহে–যে দেহে, সূক্ষ্মতা, আলো পায়, ধারণ কর। এক হৃদয়ে অন্য জরায়ুতে। তুমি সেই লীলা সহচরী।
এখন যশোবতী হস্তধৃত কাষ্ঠখণ্ড গঙ্গায় নিক্ষেপ করিলেন। কাষ্ঠের অন্তস্থিত অগ্নি সশব্দে নিৰ্বাপিত হইল।
ক্রমে তাঁহার জ্ঞানের সঞ্চার হয়, ত্বরিতে নতজানু হইয়া বসিয়া দেখিলেন, চণ্ডাল বৈজুনাথ শুইয়া পড়িয়া ছটফট করিতেছে, নিজের কাঁধের একস্থানে বুলাইতে বুলাইতে বলিতেছে, “তোমার তরে কনে বউ…” মাটি হইতে মুখ না তুলিয়াই সে এই কথা বলিয়াছিল।
যশোবতী ঘৃণায় মুখ ফিরাইয়া ক্রমে ক্রমে দেখিলেন, বৃদ্ধের আপনার মস্তক অতিক্রম করিয়া হস্ত দুইখানি বিস্তৃত, দেহ যেন একটি রেখাবৎ, বসন সিক্ত, স্বামীর দুরদৃষ্ট দর্শনে পাগলিনীর মত ছুটিতে, যাইতে, লজ্জিত হইয়া ক্ষণকাল দাঁড়াইলেন। পরক্ষণেই চীৎকার করিয়া উঠিলেন। অসহায় ক্রন্দনরোলে ত্রিভুবন বিদীর্ণ হয়। পৃথিবী আর একবার দুঃখময়ী হইল। বিদ্যুৎবেগে স্বামীর নিকট গিয়া, তাঁহার হস্ত নিজ বক্ষে ধারণ করিয়া রোদন করিতে লাগিলেন, কখনও কখন ‘ঠাকুর’ এই বাক্য শুধুমাত্র উচ্চারণ করিয়াছিলেন।
“কৰ্ত্তা কথা কও গো” বলিয়া তিনি গঙ্গার বেলাতট চাপড়াইয়া কাঁদিতে লাগিলেন। সীতারাম এখন দেহমাত্র। যশোবতী কোনরূপে তাঁহার ঊর্ধ্বাঙ্গ আপনার উরুর উপরে স্থাপন করিয়া অঞ্চলপ্রান্ত দিয়া মুখ মুছাইতে মুছাইতে স্বরভঙ্গ কণ্ঠে নানা কথা বলিলেন। “কৰ্ত্তা কোথা গেলে গো, আমাকে ফেলে…”
মধ্যে মধ্যে “কথা কও কথা কও”…এই অনুরোধ বাক্য পৃথিবীকে মায়া বশীভূত করে। কালক্রমে তাঁহার ধারণা জন্মিল ইনি, বৃদ্ধ, প্রাণহীন নহেন, অচৈতন্য মাত্র। এবং এই বোধে, তাঁহার সহজ জ্ঞান ফিরিয়া আসিল, মুহূর্তেই তিনি আপনার বস্ত্রদ্বারা গাত্র মুছাইয়া, অনন্তর, স্বামীদেহ যতনে তুলিবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করিতে লাগিলেন। পুনঃপুনঃ বলসঞ্চয়হেতু, গভীর নিঃশ্বাস লইলেন; আপনাকে প্রস্তুত করিবার নিমিত্ত জিহ্বা নোলকে ঠেকিল। তথাপি এ অধ্যবসায় বিফল হয়।