গ্রেট পিরামিড
‘সালটা ১৮৬৭, গা-পুড়ে-যাওয়া গরমের মধ্যেই বছর বত্রিশের এক আমেরিকান নিউজ রিপোর্টার কায়রোর পাঁচ মাইল পশ্চিমে মরুভূমির দিকে চলেছেন। একটা ছোটো ডিঙিতে করে নীল নদ পার হতে হল, বাকিটা পথ বালির মধ্যেই পায়ে হেঁটে। দিগন্তে যে তিনটে দানবকে দেখা যাচ্ছিল তাদের সবচেয়ে বড়োটার কাছাকাছি আসতেই তিনি দেখলেন দিগন্তটা কেমন হঠাৎ হারিয়ে গেল। ওঁর সামনে দাঁড়ানো পাথরের তৈরি আশ্চর্যটার মাথা যেন আকাশ ফুঁড়ে উঠে গেছে। সাংবাদিক এবারে সেই পাথর বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলেন। সাড়ে চারশো ফিটের চুড়োটায় যখন পা রাখলেন তখন চারপাশটা দেখে যেন তাক লেগে গেল। পৃথিবীটা এত ওপর থেকে কখনো দেখা হয়নি আগে! একদিকে হলুদ বালির সমুদ্র বিছিয়ে রয়েছে। তার যেন কোনো শেষ নেই। অন্যদিকটা আবার সবুজ, মাঝখান দিয়ে সরু সুতোর মতো নীল নদ বয়ে গেছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছোটো ছোটো গ্রামগুলোও দেখা যাচ্ছে। আর সবচেয়ে দূরে পাঁচিলের মতো পাম গাছের সারি।
সাংবাদিকের ছোটোবেলাকার একটা স্বপ্ন সত্যি হল। খুফুর পিরামিডে চড়ার স্বপ্ন।
আমরা দু-জন এতক্ষণ হাঁ করে ভবেশদার কথা শুনছিলাম। দিলখুশাতে আজকে ভিড় কম ছিল, সপ্তাহের মাঝখানে তো। আমরা ভেতরের দিকের একটা টেবিলে বসেছিলাম, তাই এম জি রোডের বাস ট্যাক্সির আওয়াজও একটু কম আসছিল। গল্প শোনার একদম আদর্শ পরিবেশ যাকে বলে। তবে রেস্টুরেন্টটার দেওয়ালে বিশ্রী গোলাপি রং করেছে, সেটা বড্ড চোখে লাগছিল প্রথমে। কিন্তু ভবেশদা মুখ খোলার পরেই সেসব কোথায় হাওয়া হয়ে গিয়ে চারপাশে ইজিপ্টের মরুভূমি চলে এল। খাবার দিতে মনে হয় এখনও একটু দেরি আছে। ভবেশদা গ্লাসের জলে একটু চুমুক দিয়ে এবারে বললেন,
‘বলো তো দেখি এই লোকটার নাম কী, যে কিনা তরতর করে খুফুর পিরামিডে উঠে গেল?’
‘আমেরিকান সাংবাদিক, ১৮৬৭… এভাবে হয় নাকি? আপনি আরও কিছু হিন্ট দিন।’
পাশের পিরামিডের চুড়ো থেকে দেখা খুফুর পিরামিডের মাথার তুরা পাথরের আস্তরণ
‘ওকে, ইনি ১৮৯৬ কলকাতায় এসেছেন, ময়দানে হেঁটেছেন। যে হোটেলে ছিলেন তাকে বলেছিলেন জুয়েল অফ দি ইস্ট ! এখন সেটার নাম ললিত গ্রেট ইস্টার্ন।’
আমাদের বোকার মতো মুখ দেখে ভবেশদা একটু বিরক্তই হলেন এবারে,
‘নিজের শহরটাই ভালো করে চেনো না। এদিকে এসেছ ইজিপ্টের গল্প শুনতে। যাক গে, টম সয়ার, হাকলবেরি ফিনের নাম শুনেছ নিশ্চয়?’
এবারের শব্দগুলো কমন পড়েছিল। পিজি বিজয়ীর মতো হাসতে হাসতে বলল,
‘বুঝেছি কার কথা বলছেন, মার্ক টোয়েন যে কলকাতাতে এসেছিলেন সেটাই জানতাম না। টোয়েনেরও তাহলে ইজিপ্টের নেশা ছিল?!’
‘শুধু টোয়েন নয়, ভায়া। গত কয়েক শতাব্দী ধরে বিশ্বের তাবড় তাবড় লোককে এই দেশটা টেনে এনেছে। তার অনেকটাই ওই পিরামিডের জন্য।’
‘দ্য গ্রেট পিরামিড!’
‘শুধু সেটা নয়। দেশটা জুড়ে নব্বইয়ের ওপরে পিরামিড ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তবে তাদের মধ্যে সেরা হল গিজার তিনটে পিরামিড। যেগুলোকে আমরা ছোটোবেলায় হিস্ট্রির বইতে দেখেছি। ইজিপ্টের প্রথম পিরামিডের কথা তো আগেই বলেছি তোমাদের।’
‘হ্যাঁ, সাকারার স্টেপ পিরামিড।’
‘ঠিক, তবে গিজার পিরামিডগুলো সেটার থেকে অনেক বড়ো। প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটা। এই পিরামিড বানানোর গল্পটাও কিন্তু দারুণ, বুঝলে।’
ব্যস, আবার এক মুহূর্তের মধ্যে আমরা চলে এলাম ধু-ধু মরুভূমির মাঝখানে। ভবেশদা বলতে লাগলেন,
‘আজ থেকে সাড়ে চার হাজার বছর আগের কথা, গিজার মরুভূমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন এক বাইশ বছরের যুবক। ওর নজর চারপাশের চুনাপাথরের পাহাড়গুলোতে। ফারাও খুফু এখন মিশরের অধিপতি। এত কম বয়সেই তার অধীনে উত্তর আর দক্ষিণ মিশর এক হয়েছে। যে কাজটা ওর বাবা নেফ্রু শুরু করেছিলেন সেটা খুফু শেষ করতে পেরেছেন। দেশ জুড়ে শান্তি এখন।
‘খুফু অমর হতে চান, হওয়াটাই স্বাভাবিক। ফারাওরা ঈশ্বর ‘‘রা’’-এর প্রতিনিধি। মারা যাওয়ার পরে তাঁরদের অমর হয়ে থাকাই দস্তুর। সেইজন্যই মমি বানানো হয়, পিরামিড বানানো হয়। ওঁর বাবা নেফ্রুও তো দুটো পিরামিড বানিয়েছিলেন নিজের জন্য। একটা মেইদাম নামের এক জায়গায়। কিন্তু সেটাকে ঠিক পিরামিড বলা যায় না। অঙ্কের হিসেবের গণ্ডগোলের জন্য সেই পিরামিডের পেটের কাছ থেকে অনেকটা বেঁকে আসতে হয়েছিল। পরে অবশ্য দাশুর নামের আরেকটা জায়গাতে নেফ্রু আরেকটা পিরামিড বানান। সেটা নিখুঁত। সূর্য ডোবার সময় সেই পিরামিডের গায়ের পাথরগুলো লাল লাগে। এমনটা আর একটাও নেই ইজিপ্টে। তবে খুফুর স্বপ্ন আরও বেশি কিছুর।
‘খুফুর নিজের একটা পিরামিড হবে। সেটা হবে আগের বানানো যেকোনো পিরামিডের থেকে অনেক অনেক বড়ো। এমন কিছু একটা যেটা আগে এই দেশের কেউ দেখেনি। পরেও কেউ বানাতে পারবে না। সেই পিরামিড বানানোর জন্যই খুফু গিজার এই জায়গাটা বেছে নিয়েছেন। কারণ দুটো। এক, হাতের কাছেই থাকা চুনাপাথরের খনি, যেখান থেকে পিরামিড বানানোর জন্য পাথর খুব সহজেই পাওয়া যাবে। আর দ্বিতীয়ত এই জায়গাটা বেশ উঁচুও, তাই অনেক দূর থেকে দেখতেও পাওয়া যাবে পিরামিডটা। কিন্তু মুশকিল একটাই, রাজধানী মেমফিস থেকে প্রায় পনেরো মাইল দূরে এই গিজা। রাজার সমাধি রাজধানী থেকে এত দূরে হলে চলে নাকি? কী করা যায়? দুটোকে কাছাকাছি আনা তো অসম্ভব। তবে ওদের দূরত্বটা একভাবে কমিয়ে ফেলাই যায়। মেমফিস শহর নীল নদের গায়েই। সেই নীল নদ থেকেই একেবারে গিজা অবধি লম্বা খাল তৈরি করে ফেললেন খুফু। দুটো জায়গার মধ্যে যাতায়াত করার খুব সুবিধা হয়ে গেল এতে। প্রতি বছর নীল নদের বন্যার জন্য সেই খালে জলের অভাবও হল না। খুফু গিজার মরুভূমিতেই নিজের আরেকটা রাজপ্রাসাদও বানিয়ে ফেললেন। পিরামিড তৈরি তো আর একদিনের কাজ নয়। তিরিশ বছর ধরে একটু একটু করে তৈরি হয়েছিল গ্রেট পিরামিড! খুফু এই পিরামিড বানানোর কাজটা দিয়েছিলেন…’
‘দুটো ফিশ কবিরাজি, একটা চিকেন কাটলেট। চা আসছে।’
টেবিলের ওপরে ঠকাস ঠকাস করে প্লেটগুলো রাখতে রাখতে বলল ওয়েটার। এমনভাবে রসভঙ্গের জন্য একেবারে দুর্বাসা মুনির মতো তাকালাম ওর দিকে। কিন্তু তাকানোই সার। প্লেটগুলো নামিয়ে রেখেই লোকটা অন্য টেবিলে চলে গেল। পিজি ফিশ কবিরাজি খায় না। ওর নাকি সব মাছেই আঁশটে গন্ধ লাগে। তাই ওর জন্য কাটলেটটা নেওয়া। ভবেশদার মুখটা কিন্তু উজ্জ্বল হয়ে উঠল দেখলাম। কবিরাজির গায়ে লেগে থাকা ঝুরিগুলো তুলে একটু কাসুন্দি আর একটু টমেটো সসে চুবিয়ে মুখে পুরে দিলেন। দিয়েই গাইতে আরম্ভ করলেন,
‘হোঁটো সে ছুঁলো তুম…’
রেলগাড়ি লাইনচ্যুত হচ্ছে দেখে আমাকে মুখ খুলতেই হল এবারে,
‘ভবেশদা।’
‘উমম…’
‘বলছি, খুফু পিরামিডটা বানাতে দিলেন…’
‘ও, হ্যাঁ হ্যাঁ। ভালো খাবার মুখে পড়লেই না আমার কেমন গজল এসে যায়। সরি, সরি। তা যেটা বলছিলাম, খুফু কাজটা দিলেন নিজেরই এক আত্মীয় হেমিউনুকে। তার দায়িত্বেই তৈরি হল গ্রেট পিরামিড। তেরো একর জায়গা নিয়ে। এক একটা দিক ২৩০ মিটার লম্বা। উচ্চতায় প্রায় দেড়শো মিটার। স্ট্যাচু অফ লিবার্টির থেকেও উঁচু। ভলিউমের দিক থেকে বলতে গেলে কুড়িখানা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ঢুকে যাবে ওর মধ্যে।’
‘বলেন কী! এত বড়ো যে সেটা ছবি দেখে বুঝিনি।’
‘হ্যাঁ, বললাম না, প্রাচীন পৃথিবীর সাতটা আশ্চর্যের একটা হল গ্রেট পিরামিড। এত পুরোনো একটা জিনিস আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আরবিতে একটা প্রবাদ আছে জানো? মানুষ সময়কে ভয় পায়, আর সময় ভয় পায় পিরামিডকে। এখন একে যে অবস্থায় দেখ তার চেয়ে অনেক সুন্দর ছিল কয়েক হাজার বছর আগেও। গোটা পিরামিডটার গা মোড়ানো ছিল ঝকঝকে সাদা পাথর দিয়ে। সেই পাথর এসেছিল গিজার দক্ষিণ পূর্বের তুরা নামের একটা জায়গার খনি থেকে। নীল নদ দিয়ে নৌকায় করে আনা হয়েছিল সেই পাথর। সূর্যের আলো পড়লে ঝিকমিকিয়ে উঠত পিরামিডটা সেই সময়। কিন্তু পরের দু-হাজার বছর ধরে মানুষ ওই সাদা পাথর খুলে নিয়ে গেছে নিজেদের ঘরবাড়ি বানানোর জন্য। গোটা ইজিপ্ট জুড়ে অনেক পুরোনো বাড়ি আর প্রাসাদে আজও সেই সাদা পাথর পাওয়া যায়।
পিজি এতক্ষণ চুপচাপ কাটলেট খাচ্ছিল। এবারে মুখ খুলল ও,
‘পিরামিডের ভিতরে কী ছিল ভবেশদা! অনেক ঐশ্বর্য থাকার কথা তো!’
‘তা হয়তো ছিল, পিজি ভায়া। কিন্তু সেসবের কিছুই পাওয়া যায়নি। পিরামিড বানানোর হাজার বছরের মধ্যেই ডাকাতরা ওর মধ্যে ঢুকে সব লুঠ করে নেয়। কিন্তু বুদ্ধি করে পিরামিডে ঢোকার রাস্তাটাও এমনভাবে বন্ধ করে দেয় যাতে বাইরে থেকে কিছুই বোঝা না যায়। তারপরে মানুষ পিরামিডে ঢোকে আরও দু-হাজার বছর পরে। সেই লোকটার নাম আল মামুন।’
‘আরে! কাকাবাবুর ‘‘মিশর রহস্য’’তে একজন মিশরীয় বিজনেসম্যানের নাম ছিল তো আল মামুন!’
খুফুর পিরািমডে আল মামুনের তৈরি প্রবেশপথ (নীচের গর্ত)
‘হ্যাঁ, কিন্তু এই আল মামুন যে সে লোক নয়। বাগদাদের রাজা, যদিও ওদেরকে ঠিক রাজা বলা হত না। রুলারদের বলত কালিফ। তো, এই আল মামুন ঠিক করে পিরামিডের ভেতরে ঢুকবে। কিন্তু চারিদিকে ঘুরেও কোনো রাস্তা খুঁজে পাওয়া গেল না। তখন গরম ভিনিগার ঢেলে পিরামিডের পাথরে ফাটল ধরানোর চেষ্টা চলল। তাতে কাজ না হওয়ায় শেষে হাতুড়ির দ্বারস্থই হতে হয় মামুনকে। পিরামিডের গায়ে পাথর ভেঙে গর্ত করে সেইখান থেকে ভেতরের দিকে টানেল বানানো হতে থাকে। তবে মামুন ভাগ্যবান ছিলেন। কিছুদূর অবধি টানেল কাটার পরেই শ্রমিকরা একটা গুপ্ত সুড়ঙ্গে এসে পড়ে, যেটা ওপরদিকে উঠে গেছে। সেই পথ একটু ওপরে গিয়েই অনেকটা চওড়া হয়ে যায়। এখন সেই পথকে বলে গ্র্যান্ড গ্যালারি। এই পথ শেষ হয় একটা খুব নীচু ছাদের ছোটো ঘরে, এখন যাকে বলা হয় কুইন’স চেম্বার। এই ঘরের একটা দেওয়াল দিয়ে আবার সুড়ঙ্গ কেটে মামুন এসে পড়েন একটা বিশাল বড়ো ঘরে, যার সিলিং অনেক উঁচুতে। ঘরের দেওয়ালগুলোও বাকি পিরামিডের পাথরের থেকে আলাদা, লাল রঙের। পরে জানা গেছে এই পাথর এসেছিল কায়রো থেকে সাড়ে আটশো কিলোমিটার দূরে থাকা আসওয়ান শহরের খনি থেকে! নীল নদের পথে।
খুফুর পিরামিডের গুপ্ত সুড়ঙ্গ
‘মামুন একটু হতাশই হন এই ঘরে ঢুকে। একদম ফাঁকা। শুধু পশ্চিমদিকে একটা পাথরের সারকোফেগাস রয়েছে। মামুন সেই সারকোফেগাস খোলেন। পিরামিড থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে মামুন ঘোষণা করে দেন যে তিনি সারকোফেগাসের মধ্যে একটা মমি পেয়েছেন যার সারা শরীর সোনা দিয়ে মোড়ানো, হাতে তলোয়ার আর বুকের ওপরে একটা বড়ো রুবি পাথর বসানো। খুব সম্ভবত নিজের নাম ছোটো হয়ে যাওয়ার ভয়ে আল মামুন ডাহা মিথ্যে কথা বলেছিলেন। ওইখানে কিছু পাওয়ার কথাই নয়। কারণ পিরামিড তো তার আগেই ডাকাতরা ফাঁকা করে দিয়েছে। তবে ওই সারকোফেগাসটা খুব সম্ভবত খুফুরই ছিল। আর ওই ঘরকে এখন বলে কিং’স চেম্বার।’
খুফুর পিরামিডের ভেতরের নকশা
আমি এবারে বললাম,
‘ও আচ্ছা, বুঝেছি। তাহলে আগে যে কুইন’স চেম্বারের কথা বললেন ওখানে খুফুর স্ত্রী-র মমি ছিল এক সময়ে?’
‘একদমই ভুল ধারণা। খুফুর পিরামিডে ওর স্ত্রী-র কোনো মমিই ছিল না। ওই ঘরটা কিং’স চেম্বারের থেকে একটু ছোটো হওয়ায় নাম কুইন’স চেম্বার। হয়তো একসময় ওই ঘরে কোনো ঐশ্বর্য সত্যিই ছিল। ওই ঘরে এখন আর যাওয়া যায় না। কিং’স চেম্বারে কিন্তু এখন টুরিস্টরাও ঢুকতে পারে। আল মামুনের বানানো পথটাই এখনও ব্যবহৃত হয় কিং’স চেম্বারে পৌঁছোনোর জন্য।’
‘আরিব্বাস! তাহলে খুফুর সারকোফেগাসটা এখনও আছে!’
‘আছে তো। একরকমভাবে আছে ফাঁকা সারকোফেগাসটা।’
‘আচ্ছা, তাহলে দুটো ঘর পিরামিডের মধ্যে।’
‘না, দুটো নয়, সব মিলিয়ে আটটা। সতেরোশো শতাব্দীতে ব্রিটিশ আর্কিয়োলজিস্টরা বাকিগুলো আবিষ্কার করে। কিং’স আর কুইন’স চেম্বার ছাড়াও কিং’স চেম্বারের গায়ে রয়েছে একটা ছোটো অ্যান্টিচেম্বার। আর কিং’স চেম্বারের সিলিংয়ের ওপরে রয়েছে চারটে ফাঁকা ঘর। খুব সম্ভবত যাতে পাথরের ভারে কিং’স চেম্বারের সিলিং না ভেঙে পড়ে তাই এই ঘরগুলো বানানো হয়েছিল। কিং আর কুইন’স চেম্বারটাকে জুড়েছে গ্র্যান্ড গ্যালারি। সেখান থেকে আরেকটা সুড়ঙ্গ চলে গেছে পিরামিডের গা অবদি। সেটার একটা অংশ আল মামুন খুঁজে পেয়েছিলেন। কুইন’স চেম্বার থেকে আবার একটা সুড়ঙ্গ চলে গেছে মাটির নীচের আরেকটা ঘরে। দুঃখের কথা সেটাও একদম ফাঁকা অবস্থাতে পাওয়া যায়। অবাক করার ব্যাপার হল এই যে, কিং’স আর কুইন’স চেম্বার থেকে আরও চারটে সুড়ঙ্গ চলে গেছে বাইরের দিকে। কিন্তু তার সবকটাই অদ্ভুতভাবে পিরামিডের গা অবদি পৌঁছোনোর আগেই শেষ হয়ে গেছে। কেন এগুলো বানানো হয়েছিল সেটা কেউ জানে না। আবার খুফুর পিরামিডের সঙ্গে কিন্তু ক্রিকেট খেলার একটা ক্ষীণ লিঙ্ক আছে।’
‘তাই নাকি! সেটা কীভাবে?’
‘কিং’স চেম্বারের ওপরে যে চারটে ফাঁকা ঘর ছিল সেগুলো আবিষ্কার করেছিলেন হাওয়ার্ড ভ্যাস নামের এক আর্কিয়োলজিস্ট। তিনি এই ঘরগুলোর নাম বিখ্যাত ব্রিটিশদের নামে রাখেন। তাদের মধ্যে একটা ঘরের নাম রাখা হয় অ্যাডমিরাল নেলসনের নামে। এঁকে নিশ্চয়ই চেনো?’
‘চিনি মানে, নাম শুনেছি, ক্রিকেটে ১১১-কে তো নেলসন’স নাম্বার বলে।’
‘ঠিক, হোরাশিও নেলসন ছিলেন ব্রিটিশ নেভির ফ্ল্যাগ অফিসার। ১৮০৫ সালে ট্রাফালগারের বিখ্যাত যুদ্ধে মারা যান। এই অ্যাডমিরাল নেলসনের নাম থেকেই নেলসন’স নাম্বার এসেছে। কারণ নাকি নেলসনের একটা চোখ, একটা হাত আর একটা পা ছিল না। তবে এই তথ্য ভুল যদিও, নেলসনের একটা করে চোখ আর হাত না থাকলেও পা দুটোই ছিল। তাই ক্রিকেটে ১১১-কে নেলসন’স নাম্বার বলার কোনো যৌক্তিকতাই নেই… এই দেখ, আবার অন্য কথায় চলে যাচ্ছি। কাজের কথায় ফিরে আসি।
খুফুর পিরামিডের ভেতরে
গ্র্যান্ড গ্যালারিতে যাওয়ার গুপ্ত সুড়ঙ্গ
গুপ্ত সুড়ঙ্গ (উপরে) ও গ্র্যান্ড গ্যালারি (নীচে)
কিংস চেম্বারে ঢোকার রাস্তা (উপরে) ও কিংস চেম্বারে রাখা সারকোফেগাস (নীচে )
‘এই পিরামিডকে নিউক্লিয়াস করেই গিজার মরুভূমিতে গড়ে ওঠে একটা বিশাল কবরখানা। খুফুর পিরামিডের পাশেই আরও দুটো বিশাল পিরামিড বানায় ওঁর ছেলে খাফরে আর নাতি মেনকুরে। পিরামিডের গায়ে তুরার সাদা পাথরের একটা আস্তরণের কথা বললাম না? ওইটা এখন একমাত্র খাফরের পিরামিডের মাথার কাছটাতেই পাওয়া যায়। এই তিনটে পিরামিড ছাড়াও গিজার প্লেটুতে এখন আছে আরও আটখানা ছোটো পিরামিড আর ১০০০-এর ওপরে কবর। আর আছে বিখ্যাত স্ফিংস!’
‘স্ফিংস নিয়ে কিছু বলুন না, ভবেশদা!’
‘উফফ, বলেছি না একদিনে একটাই জিনিস হজম করতে। এবারে আমি বরং তোমাদেরকে একটা প্রশ্ন করি।’
ভবেশদার একটা প্রশ্ন মানেই আরেকটা দারুণ কিছুর খোঁজ পাওয়া। তাই আমি পিজি দু-জনেই এবারে প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলাম,
‘কী?’
‘এতক্ষণ তো খুফুর পিরামিডের কথা শুনলে। এবারে বলো তো এই দুর্দান্ত জিনিসটা বানানো সম্ভব হল কী করে?’
পিজি বলল,
‘এটা তো শুনেছি একটা রহস্য, বাংলায় অনুবাদ করা দানিকেনের একটা বই পড়েছিলাম। তাতে লেখা ছিল যে গ্রহান্তরের এলিয়েনরা নাকি পিরামিড বানাতে মিশরীয়দের হেল্প করেছিল।’
‘ধুস, ওসব গাঁজাখুরি। মিশরীয়রা নিজেরাই বানিয়েছিল। বিজ্ঞান আর অঙ্কতে অনেক এগিয়ে ছিল ওরা। তবে হেরোডটাস খুফুকে ভিলেন বানিয়ে দিয়েছিলেন।’
‘কীভাবে?!’
‘হেরোডটাস ইজিপ্টে এসেছিলেন খুফুর দু-হাজার বছর পরে। তাই পিরামিড বানানোর ব্যাপারে যেটুকু জেনেছিলেন তার পুরোটাই ছিল জনশ্রুতি। তার ওপরে ভিত্তি করেই ইতিহাস লিখে ফেলেন। হেরোডটাসের মতে খুফু ছিলেন খুব নিষ্ঠুর একজন ফারাও। জোর করে মিশরীয়দের পিরামিড বানানোর কাজে লাগিয়েছিলেন। এক লাখ ক্রীতদাস অমানুষিক পরিশ্রম করে পিরামিড বানিয়েছিল। বাইবেলের এক্সোডাসেও তো ইহুদি ক্রীতদাসদের কথা বলা আছে, যাদের ফারাওরা পশুর মতো খাটায়। এর কতটা সত্যি তাই নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যাই হোক, খুফুর বদনাম ঘুচতে অপেক্ষা করতে হয় প্রায় আড়াই হাজার বছর। হেরোডটাসকে ভুল প্রমাণ করেন একজন ইজিপশিয়ান আর্কিয়োলজিস্ট। তাঁরর নাম জাহি হাওয়াস।
‘১৯৯০ সালে জাহি’র দল পিরামিড চত্বরের কাছেই একটা বিশাল কবরখানা আবিষ্কার করে, যেটা খুব সাধারণ মানের। কিন্তু কবরখানার মানুষগুলোর পরিচয় থেকেই বোঝা যায় ওদের কাজ। ওরাই পিরামিড বানানোর কাজ করত। ১৯৯৯-তে এই শ্রমিকদের ছোটো একটা গ্রামও খুঁজে পাওয়া যায় গিজাতেই। এক লাখ নয়, ১০,০০০ মানুষ কাজ করেছিল খুফুর পিরামিড বানানোর জন্য। এবং তাদের প্রত্যেককেই পারিশ্রমিক দেওয়া হত। থাকার জায়গাও ছিল বেশ। শুধু তাই নয়, কায়িক পরিশ্রমের ধকল নিতে পারার জন্য ওদের ডায়েটও ছিল বেশ ভালো। দেশ জুড়ে পশুর মাংস খুব মূল্যবান হলেও ওদের রেশনে সেটা রোজ থাকত। এমনকী স্বাস্থ্যের খেয়ালও খুব ভালোভাবে রাখা হত। অত ভারী ভারী পাথর বইবার সময় অ্যাক্সিডেন্ট হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাই কাছেই ছিল একটা ছোটো হাসপাতাল, যেখানে হাড় ভাঙার জন্য প্লাস্টার করা বা ছোটোখাটো অ্যাম্পুটেশনের কাজ চলত। আবার অনেক হতভাগ্য শ্রমিকেরই কবর পাওয়া গেছে ঘাড় বা মাথা ভাঙা অবস্থায়। তবে তাদের খুব যত্ন করে কবর দেওয়া হয়।’
জাহি হাওয়াস
‘হুমম, এটা তাহলে বুঝলাম যে নিজেদের ইচ্ছাতেই সবাই কাজ করেছিল। কিন্তু পিরামিডটা বানাল কী করে ওরা?’
পিরামিডের ঢালে যেভাবে পাথর টেনে নিয়ে যাওয়া হত
‘আগেই বললাম, ওরা আর্কিটেকচারে তুখোড় ছিল। পিরামিডের নকশাটা আগেই বানিয়ে নিয়ে তারপরে সেইটা ধরে কাজ এগোয়। ভারী পাথরগুলোকে টেনে আনার জন্য রাস্তার বালিকে জলে ভিজিয়ে দিত ওরা। এতে পাথর টানা অনেক সহজ হয়ে যেত। অর্ধেক মানুষ লাগত একটা বড়ো পাথরকে টানতে। তারপরে কাঠের র্যাম্পের ওপর দিয়ে এনে পাথরগুলোকে একের পর এক বসাত। তবে এই কাজটা তিরিশ বছর ধরে করে যাওয়ার মতো প্ল্যানিং আর ম্যানেজমেন্ট চমকে দেওয়ার মতো। ওহ, এই দেখো, এতক্ষণ ধরে এত খুফু খুফু করে যাচ্ছি, একটা মজার কথা তো বলাই হয়নি। যে লোকটার জন্য এরকম আকাশচুম্বী একটা জিনিস বানানো হল সেই লোকটার মমি যে আগেই নষ্ট হয়ে গেছে ডাকাতদের হাতে সেটা আগেই বলেছি। কিন্তু গোটা ইজিপ্টে খুঁজেও খুফুর একটার বেশি স্ট্যাচু পাওয়া যায়নি। আর সেটা মাত্র তিন ইঞ্চি লম্বা। জ্যামিতি বক্সের স্কেলও ওর দ্বিগুণ হয়।’
আমি এবারে বললাম,
‘আচ্ছা খুফুর কথা তো শুনলাম, কিন্তু ওঁর মায়ের গল্প তো বললেন না?’
‘হেতেফেরিস?’
‘হ্যাঁ, আগের দিন জানতে চাইলাম না? সেই হেতেফেরিসের টুম্বে কোনো মমি ছিল না! আবার ফিরেও এল! যেমনটা মিশর রহস্যে বলেছিল।’
খুফুর মূির্ত
ভবেশদা এবারে একটু ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
‘ও হ্যাঁ, বলেছিলে বটে। সে-গল্প বলাই যায়। কিন্তু কবিরাজিটা তো শেষ হয়ে গেল। আজকাল এরা সাইজও ছোটো করে দিয়েছে কেমন। কিন্তু টেস্টটা বুঝলে এক…’
‘এই যে দাদা! এদিকে আরেকটা ফিশ কবিরাজি দিতে হবে!’
পিজি বুঝে গেছে কী করতে হবে এখন। ভবেশদাকে এই অবস্থায় কিছুতেই ছাড়া যাবে না।
হেতেফেরিসের রহস্যটা আজকে জানতেই হবে।