প্ৰথম খণ্ড (অবাক বাংলাদেশ : রহস্যঘেরা প্রহেলিকাচ্ছন্ন হেঁয়ালি )
দ্বিতীয় খণ্ড - রাষ্ট্রের মূলনীতিসমূহ : পথের শেষ কোথায়?
তৃতীয় খণ্ড - রাষ্ট্র পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ : লুপ্ত করেছে আমার ভুবন দুঃস্বপনের তলে
চতুর্থ খণ্ড - নির্বাচন : আমার ভোট আমি দেব
পঞ্চম খণ্ড - রাজনৈতিক সংস্কৃতি : কান্ডারি হুঁশিয়ার
ষষ্ঠ খণ্ড - উত্তরণের সন্ধান : কোথায় চলেছি?

৫. গণতন্ত্র : গণতন্ত্রের গণতন্ত্রায়ণ

৫. গণতন্ত্র : গণতন্ত্রের গণতন্ত্রায়ণ

৫.১ অবতরণিকা

১৯৭৯ সালে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার দ্রবীভবনের পর মার্কিন বুদ্ধিজীবী ফ্রান্সিস ফুকোইয়ামা ‘The End of History’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লেখেন। এ প্রবন্ধের বক্তব্য হলো, স্নায়ুযুদ্ধের শেষে ইতিহাস তার পূর্ণতা লাভ করেছে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় সমাজতন্ত্র বনাম উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে একটি প্রতিযোগিতামূলক দ্বন্দ্ব চলছিল। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানে উদার গণতন্ত্র জয়লাভ করে। তিনি বলেছেন :

What we may be witnessing is not just the end of the Cold War, or the passing of a particular period of post-war history, but the end of history as such: that is, the end point of mankind’s ideological evolution and the universalization of Western liberal democracy as the final form of human government.

ফুকোইয়ামার বক্তব্যের দুটি অংশ রয়েছে। প্রথমত, প্রতিযোগিতামূলক দ্বন্দ্বে সমাজতন্ত্র ধোপে টেকেনি। এ বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত হওয়ার কোনো কারণ নেই। তাঁর দ্বিতীয় বক্তব্য হলো, পশ্চিমা জগতের উদার গণতন্ত্র সারা বিশ্বে গৃহীত হয়েছে। এই বক্তব্য নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে।

গণতন্ত্রের কোনো সর্বজনীন রূপ নেই। রাষ্ট্রভেদে গণতন্ত্রের প্রকার, আচার ও আচরণে ভিন্নতা ঘটে। সব দেশই সমানভাবে গণতান্ত্রিক নয়। রাষ্ট্রভেদে গণতন্ত্রের হেরফের হয়। ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী অ্যান্থনি গিডেন্স এ সম্পর্কে ঠিকই লিখেছেন, ‘Democracy isn’t an all or nothing thing. There can be different forms, as well as different levels, of democratisation.’২ বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের রূপ এবং পর্যায় ভিন্ন। এমনকি সংস্কৃতিভেদেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তারতম্য ঘটে। যেমন ধরুন, বিলাতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও সেখানে অভিজাত শ্রেণির দাপট অনেক বেশি। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের ভূমিকাই মুখ্য। এ সম্পর্কে একটি চুটকি প্রায়ই শোনা যায়। একজন আমেরিকান পরিব্রাজক বিলাতে গিয়ে দেখতে পান যে সেখানে অভিজাত শ্রেণির লোকেরা দেশ শাসন করছে। তিনি এক ব্রিটিশ নাগরিককে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কীভাবে এ ধরনের লোকদের সরকারে নির্বাচিত করো, যারা তোমাদের মতো সাধারণ মানুষকে খাওয়ার দাওয়াত দিতে রাজি হয় না? উত্তরে ব্রিটিশ নাগরিক বলল, তোমরা কীভাবে সে ধরনের ব্যক্তিদের নির্বাচিত করো, যাদেরকে তোমাদের নিজের বাড়িতে দাওয়াত দিতে অপমানবোধ করো (অর্থাৎ মার্কিন নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নিম্নশ্রেণির)?

গণতন্ত্র জয়যুক্ত হয়েছে, ফুকোইয়ামার এ বক্তব্য সঠিক নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পৃথিবীর অনেক দেশেই এখনো চূড়ান্ত রূপ নেয়নি। উপরন্তু দেশভেদে গণতন্ত্রের রূপও ভিন্ন। কাজেই সমাজতন্ত্রের পরাজয় ঠিকই হয়েছে কিন্তু গণতন্ত্রের চূড়ান্ত বিজয় এখনো হয়নি। পৃথিবীর সর্বত্র গণতন্ত্র নিয়ে নানা নিরীক্ষা চলছে।

এই প্রবন্ধের লক্ষ্য হলো, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূল স্তম্ভ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে যেসব সমস্যা রয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করা এবং সম্ভাব্য সমাধান সম্পর্কে আলোচনা করা। প্রবন্ধটি পাঁচটি খণ্ডে বিভক্ত। অবতরণিকার পর দ্বিতীয় খণ্ডে গণতন্ত্রের ধারণার বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। গণতন্ত্রের সংজ্ঞা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। সে জন্য প্রথমেই গণতন্ত্র কী, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণার প্রয়োজন রয়েছে। গণতন্ত্র কী, শুধু তা জানলেই চলবে না; গণতন্ত্রের উদ্দেশ্য কী, সে সম্পর্কে আলোচনার দরকার রয়েছে। তাই তৃতীয় খণ্ডে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সম্ভাব্য সুফল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে গণতন্ত্রের বিকল্প ব্যবস্থার বিপরীতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার লাভ-ক্ষতি তুলে ধরা হয়েছে। চতুর্থ খণ্ডে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সমস্যা ও সম্ভাবনা বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। উপসংহারে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুসংহত করার জন্য কিছু সুপারিশ রাখা হয়েছে।

৫.২ গণতান্ত্রিক ধারণার বিবর্তন : প্রত্যক্ষ, প্রতিনিধিত্বশীল, উদার ও অনুদার গণতন্ত্র

আধুনিক অর্থে গণতন্ত্রের জন্ম হয়েছে প্রাচীন গ্রিসে। কিন্তু গ্রিসের কোনো কোনো রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও গ্রিক দার্শনিকেরা গণতন্ত্র মোটেও পছন্দ করতেন না। প্লেটো তাঁর স্বপ্নরাজ্যে শাসক করতে চেয়েছেন দার্শনিক রাজাদের। দার্শনিক রাজারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হন না। অ্যারিস্টটল বলছেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যাঁরা নেতা হন, তাঁরা সাধারণ ঘরের দরিদ্র এবং অমার্জিত সন্তান। এখানে গরিবেরা শাসন করে এবং ধনীদের অধিকার নেই। এর ফলে এটি আদর্শ ব্যবস্থা নয়।

গ্রিসে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে যুক্তি গ্রিক দার্শনিকদের লেখায় পাওয়া যাবে না। গণতন্ত্রের সবচেয়ে সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন এথেন্স নগরীর নন্দিত জননায়ক পেরিক্লিস। গণতন্ত্র নিয়ে এই ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছিলেন যুদ্ধে নিহত এথেনিয়ানদের স্মরণে স্মৃতিসভার বক্তৃতায়। পেরিক্লিসের বক্তব্য থুকিডিডিস তাঁর অমর গ্রন্থ History of the Peloponnesian War-এ বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। পেরিক্লিস তাঁর বক্তব্যে বলেন যে শহীদেরা এথেন্সের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে রক্ষা করার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। এরপর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কী, সেটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন :

Our constitution is called a democracy because power is in the hands not of a minority but of the whole people. When it is a question of settling private disputes, everyone is equal before the law; when it is a question of putting one person before another in positions of public responsibility, what counts is not membership of a particular class, but the actual ability which the man possesses. No one, so long as he has it in him to be of service to the state, is kept in political obscurity because of poverty. And, just as our political life is free and open, so is our day-to-day life in our relations with each other. We do not get into a state with our next-door neighbour if he enjoys himself in his own way, nor do we give him the kind of black looks which, though they do no real harm, still do hurt people’s feelings. We are free and tolerant in our private lives; but in public affairs we keep to the law. This is because it commands our deep respect.[৩]

পেরিক্লিসের এথেন্সে গণতন্ত্রের বিশ্লেষণের সঙ্গে আধুনিক বিশ্বের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার তুলনা করলে গণতন্ত্রের বিকাশের মূল সমস্যাগুলো সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। প্রথমত পেরিক্লিস বলছেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা সংখ্যালঘুদের হাতে থাকে না, ক্ষমতা থাকে The whole people বা সমগ্র জনগোষ্ঠীর হাতে। আজকের গণতন্ত্রের সঙ্গে এথেন্সের গণতন্ত্রের এটি সবচেয়ে বড় তফাত। এথেন্সের গণতন্ত্র ছিল প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র। যেখানে সব ভোটার সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণ করতে পারত। এথেন্সে সমগ্র জনগোষ্ঠীর পক্ষে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ সম্ভব ছিল, কারণ পেরিক্লিস যাঁদের সমগ্র জনগোষ্ঠী বলছেন, তাঁরা হচ্ছেন সেই সব ব্যক্তি, যাঁদের রাজনৈতিক অধিকার ছিল। এথেন্সের অধিকাংশ অধিবাসী ছিল দাস। দাসদের রাজনৈতিক অধিকার ছিল না, নারীদের রাজনৈতিক অধিকার ছিল না, দরিদ্রদের রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। উপরন্তু এথেন্স ছিল একটি নগর রাষ্ট্র। এর আয়তন ছিল সীমিত। কাজেই এথেন্সে পেরিক্লিস যাকে whole people বা সমগ্র জনগোষ্ঠী বলে আখ্যা দিয়েছেন, তাদের সংখ্যা ছিল মাত্র কয়েক হাজার। তাদের সবার পক্ষে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে জড়িত হওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু আজ পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্রেই জনসংখ্যা অনেক বেশি ও সর্বজনীন ভোটাধিকার স্বীকৃত। তার ফলে সমগ্র জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। এথেন্সে যে গণতন্ত্র প্রচলিত ছিল, তাকে এখন প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বা direct democracy বলা হয়ে থাকে। বর্তমান বিশ্বে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালিত হয় প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বা representative democracy-এর মাধ্যমে। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের পক্ষে প্রধান যুক্তি হলো যে যেহেতু সব ভোটারের অনুমতি নিয়ে বর্তমান বিশ্বে রাষ্ট্র পরিচালনা করা সম্ভব নয়, সেহেতু ভোটারদের নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনের দুটি মারাত্মক কুফল রয়েছে। প্রথমত পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেই প্রতিনিধিরা সংখ্যাগুরুর ভোটে নয়, সংখ্যালঘুর ভোটে নির্বাচিত হন (এ প্রসঙ্গে এই বইয়ের ১১ অধ্যায়ে আলোচনা দেখুন)। তাই নির্বাচিত সরকার মানে সংখ্যাগুরু ভোটারদের সরকার না-ও হতে পারে। দ্বিতীয়ত, সংখ্যালঘুদের দ্বারা নির্বাচিত সরকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত অনিচ্ছুক সংখ্যাগুরুর ওপর চাপিয়ে দেয়। প্রত্যক্ষ নির্বাচন-ব্যবস্থায় এটি সম্ভব নয়; প্রতিটি সিদ্ধান্ত সবার অংশগ্রহণে হয়। তাই জনগণের ওপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।

দ্বিতীয়ত, পেরিক্লিস বলছেন যে এথেন্সের নাগরিকেরা একে অপরের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে সহনশীল এবং উদার; সবাই আইনের শাসন মেনে চলে। আইনের শাসন হলো এথেনীয় গণতন্ত্রের প্রাণ। এ ধরনের গণতন্ত্রকে আধুনিক বিশ্বে লিবারেল ডেমোক্রেসি বা উদার গণতন্ত্র বলা হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে বর্তমান বিশ্বে উল্লেখযোগ্য-সংখ্যক রাষ্ট্রে অনুদার গণতন্ত্র রয়েছে। এসব রাষ্ট্রে শুধু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, কিন্তু ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা নেই। এবং বিরোধী দলের নাগরিক অধিকারসমূহ সব সময় মেনে চলা হয় না। তাই অনুদার গণতন্ত্রে সরকার নির্বাচিত হয় ঠিকই কিন্তু সেখানে আইনের শাসন দুর্বল এবং জনগণের নাগরিক এবং শাসনতান্ত্রিক অধিকারের মর্যাদা নেই। বর্তমান পৃথিবীতে অনুদার গণতন্ত্রের সংখ্যা বাড়ছে। একটি সমীক্ষার ভিত্তিতে ফরিদ জাকারিয়া বলছেন, ১৯৯০ সালে ২২ শতাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অনুদার গণতন্ত্র প্রচলিত ছিল। ১৯৯২ সালে এই হার ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়। ১৯৯৭ সালে এই হার ৫০ শতাংশে ওঠে, যা পরে সামান্য নেমে আসে। তবে এখন অনুমান করা হচ্ছে যে পৃথিবীর প্রায় ৫০ শতাংশ দেশে বিভিন্ন ধরনের অনুদার গণতন্ত্র রয়েছে।[৪]

তৃতীয়ত, পেরিক্লিস বলছেন যে রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনের জন্য যাঁদের নির্বাচন করা হয়, তাঁরা শুধু যোগ্যতার ভিত্তিতেই নির্বাচিত হন। নির্বাচিত ব্যক্তিরা কোন শ্রেণির, তা বড় কথা নয়, রাষ্ট্রের প্রতিটি যোগ্য ব্যক্তি তাঁদের যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারেন। এ ধরনের নির্বাচন এথেন্সে সম্ভব ছিল; কারণ, সেখানে মোট ভোটারের সংখ্যা ছিল সীমিত। আজকের বিশ্বে বেশির ভাগ নির্বাচনী পদে অনেক ভোট সংগ্রহ করতে হয়, এর ফলে যোগ্যতম লোকেরাই নির্বাচিত হবে, এ নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব নয়।

পেরিক্লিসের বর্ণিত এথেন্সের গণতন্ত্র ও আজকের বিশ্বে বিভিন্ন দেশে প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তুলনা করলে গণতান্ত্রিক ধারণার বিবর্তনের মূল ধারাগুলো বিশ্লেষণ করা সম্ভব।

প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বনাম প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্ৰ

তাত্ত্বিকভাবে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রই প্রকৃত গণতন্ত্র। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে অধিকাংশ ভোটারের অনুমতি ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয় না। এই ব্যবস্থা এথেন্সের মতো একটি ছোট নগরীতে নেওয়া সম্ভব ছিল, কিন্তু আধুনিক বিশ্বে সব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে জনমত যাচাই করতে হলে রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রায় অচল হয়ে যাবে। তাই তাত্ত্বিকভাবে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র শ্রেয় হওয়া সত্ত্বেও আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র চালু করা হয়েছে। টমাস জেফার্সন বলেছেন : ‘A democracy [is] the only pure republic, but impracticable beyond the limits of a town.’ মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জেমস বুকানন এবং গর্ডন টুলক লিখেছেন, ‘Direct democracy, under almost any decision-making rule, becomes too costly in other than very small political units when more than a few isolated issues must be considered. [৫]

যেহেতু প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভব নয়, সেহেতু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র চালু করা হয়েছে। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের প্রধান যুক্তি হলো, যেহেতু সব ভোটারের অনুমতি নিয়ে বর্তমান বিশ্বে রাষ্ট্র পরিচালনা করা সম্ভব নয়, সেহেতু ভোটারদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। ভোটারদের প্রতিনিধিত্ব করবেন নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নয়, সংখ্যালঘিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত হন (এ প্রসঙ্গে এ বইয়ে একাদশ অধ্যায়ের আলোচনা দেখুন)। এ অবস্থায় সংখ্যালঘুদের দ্বারা নির্বাচিত সরকারও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত অনিচ্ছুক সংখ্যাগুরুদের ওপর চাপিয়ে দেয়। এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশে নির্বাচনী প্রক্রিয়া গণতন্ত্রের জন্য কতটুকু সহায়ক, সে সম্পর্কে প্রশ্ন উঠেছে। যেসব দেশে এক ভোট বেশি পেলে কেউ নির্বাচিত বলে গণ্য হয় (যাকে ইংরেজিতে first- past the post rule বলে), সেসব দেশে সংখ্যালঘুদের ভোটে নির্বাচিত সরকারের পক্ষে বড় বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়।

এর প্রতিকারস্বরূপ পৃথিবীর অনেক দেশেই আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচন প্রবর্তন করা হয়েছে। সংখ্যাগুরুর ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমর্থন ছাড়া এ ধরনের সরকার পরিচালনা করা যায় না। পক্ষান্তরে আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনে অসুবিধাও রয়েছে। এই পদ্ধতিতে দলের প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে সংসদে আসন বণ্টন করা হয়। এর ফলে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দলের প্রতি অনুগত হন, কিন্তু কোনো নির্বাচনী এলাকার জনগণের সমর্থন অর্জন করার বাধ্যবাধকতা সাংসদদের থাকে না। এবং এতে নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং সাংসদদের মধ্যে কোনো বন্ধন গড়ে ওঠে না। এ ধরনের ব্যবস্থা তাই অনেক ক্ষেত্রেই ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। পক্ষান্তরে সংখ্যালঘুদের দ্বারা পরিচালিত সরকারও একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান নয়। কাজেই সঠিক নির্বাচন-পদ্ধতি কী হবে, সেটি আজকের বিশ্বে গণতান্ত্রিক বিবর্তনের জন্য অত্যন্ত জরুরি। সাম্প্রতিক কালে বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে বিভিন্ন দেশে আনুপাতিক হারে নির্বাচন-পদ্ধতি প্রবর্তিত হচ্ছে।

নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নির্দিষ্ট মেয়াদে, যথা পাঁচ বছর বা চার বছরের জন্য নির্বাচিত হন কিন্তু মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই প্রতিনিধিরা জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলতে পারেন। আস্থা হারালেও নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাঁদের মেয়াদ পূর্ণ করেন, আইনত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের এ ব্যাপারে কিছু করার ক্ষমতা থাকে না। সংখ্যালঘু ভোটে নির্বাচিত সরকার এক দিনের ভোটে চার-পাঁচ বছরের জন্য দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে যান এবং তাঁদের নিজেদের ইচ্ছামাফিক দেশ শাসন করেন। এই অবস্থার একমাত্র প্রতিকার হতে পারে যখন কোনো সরকার তাদের জনপ্রিয়তা হারায়, তখনই তাদের নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধ্য করার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। তবে এ ধরনের ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে দেশে সরকার অত্যন্ত অস্থিতিশীল হবে এবং সরকারের পক্ষে দৃঢ়তার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। তবু কোনো কোনো দেশে ‘রিকল’ (recall) ব্যবস্থা বা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রত্যাহারের জন্য ভোট অনুষ্ঠানের বিধান করা হয়েছে। এই ব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ নির্বাচনের সুফল পাওয়া সম্ভব, কিন্তু এর কুফল এত বেশি যে কোনো রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারে এখন পর্যন্ত রিকল ব্যবস্থা চালু করা হয়নি। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯টি অঙ্গরাজ্যে, যেমন ক্যালিফোর্নিয়াতে রিকল ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ২০০৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়াতে গ্রে ডেভিস গভর্নর পুনর্নির্বাচিত হওয়ার এক মাস পর তাঁকে ‘রিকল’ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ‘রিকলে গভর্নর গ্রে ডেভিস পরাজিত হন এবং পরবর্তী সময়ে পুনর্নির্বাচিত না হতে পারায় ডেভিস তাঁর পদ হারান। তবে এ ধরনের ‘রিকল’ (recall) ব্যবস্থার নজির এখনো অত্যন্ত সীমিত।

আধুনিক বিশ্বে কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র চালু করার পক্ষে নতুন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এর পেছনে দুটি ধারা কাজ করছে। এক, তথ্যপ্রযুক্তিতে বিপ্লবের ফলে জনগণ অতি কম ব্যয়ে অনেক তথ্য জানতে পারেন। তাঁদের পক্ষে রাজনীতিবিদদের ছাড়াই অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব। তথ্যপ্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরিচালনার ব্যয় হ্রাস করেছে। দুই, আজকের বিশ্বে বিভিন্ন রাষ্ট্রে জনগণের মধ্যে শিক্ষার হার অনেক বেড়ে গেছে। এই শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রপরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে চায়। অধ্যাপক মাতসু সাকা প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের নিম্নরূপে সংজ্ঞা দিয়েছেন :

Direct democracy is an umbrella term that covers a variety of political processes, all of which allow ordinary citizens to vote directly on laws rather than candidates for office.[৬]

প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনে ভোটাররা বিশেষ ব্যক্তিকে প্রতিনিধি নির্বাচন করেন এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ভোটারদের প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে ভোটাররা নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা এসব নির্ধারিত নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। প্রতিনিধি বাছাইয়ের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নীতিনির্ধারণের জন্য referendum বা plebiscite বা গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। প্রাচীন এথেন্সে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নগর সভায় বা town meeting-এ গৃহীত হতো। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চার ধরনের গণভোট দেখা যায়।

ক. Ballot Measure বা Proposition: এই ব্যবস্থায় ব্যালটে উল্লেখিত আইন ভোটাররা অনুমোদন বা প্রত্যাখ্যান করেন।

খ. Initiative বা উদ্যোগ : পূর্বনির্ধারিত-সংখ্যক ভোটার কোনো ক্ষেত্রে নতুন আইন দাবি করতে পারে এবং এই দাবির ওপর গণভোট অনুষ্ঠিত হয়।

গ. Referendum বা Petition Referendum: সংসদে কর্তৃত্ব অনুমোদিত আইন অনুমোদনের জন্য Referendum অনুষ্ঠিত হয়। এই Referendum পূর্বনির্ধারিত-সংখ্যক ভোটারের দাবিতে অনুষ্ঠিত হয়।

ঘ. Legislative Referendum: জনমত যাচাইয়ের জন্য কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এ ধরনের গণভোট অনুষ্ঠিত হয়।

বর্তমান বিশ্বে referendum-জাতীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে। তবে কোথাও সরকার প্রত্যক্ষভাবে ভোটারদের দ্বারা পরিচালিত হয় না। প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকার পরিচালিত হয়। বর্তমান বিশ্বে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার-ব্যবস্থাতেই গণভোট অনুষ্ঠান করে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের সুবিধা অর্জনের চেষ্টা চলছে।

তবে গণভোটের মতো প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অসুবিধাও রয়েছে। এ প্রথমত, কোনো কোনো সমাজে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী সংখ্যালঘুদের শোষণ করতে চায়। সে ধরনের সমাজে গণভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত সংখ্যাগুরুর দুঃশাসন বা Tyranny of the majority প্রতিষ্ঠা করতে পারে। দ্বিতীয়ত, প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র পরিচালনা করেন পেশাদার রাজনীতিবিদেরা। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে জনগণ অনেক সিদ্ধান্ত ভালো করে বিচার-বিশ্লেষণ না করে আবেগের ভিত্তিতে নিতে পারে। পক্ষান্তরে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে রাজনীতিবিদেরা সঠিক বিচার-বিশ্লেষণের পর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদেরা পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে আপসের উদ্যোগও নিতে পারেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গণভোট অনুষ্ঠিত হলে এসব সুবিধা থেকে সমাজ বঞ্চিত হতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশের সংবিধানে গণভোটের বিধান রয়েছে, তবে সংবিধানে ব্যবস্থা না থাকলেও সরকার অথবা সংসদ গণভোটের উদ্যোগ নিতে পারে। অনেক দেশে গণভোটের সুযোগের অপব্যবহার হয়ে থাকে। ঘন ঘন অহেতুক গণভোট সরকারকে অচল করে দিতে পারে। কাজেই কোন কোন ক্ষেত্রে এবং কাদের অনুরোধে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে, সে সম্পর্কে সংবিধানে (অথবা অন্য কোনো আইনে) বিধান থাকা বাঞ্ছনীয়।

উইকিপিডিয়ার হিসাব অনুসারে বর্তমানে বিশ্বে কমপক্ষে ৫০টি দেশে গণভোট চালু রয়েছে (আফ্রিকায় ৩টি, এশিয়াতে ১৩টি, ইউরোপে ২৪টি, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় ৮টি ও অস্ট্রেলিয়ায় ২টি দেশে)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যদিও কেন্দ্রীয় সরকারে গণভোটের বিধান নেই কিন্তু রাজ্য সরকারে এবং স্থানীয় সরকারে প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে গণভোটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের শাসনতন্ত্রেও গণভোটের বিধান রয়েছে। তাইওয়ানে গণভোটের বিধান রয়েছে। অস্ট্রেলিয়াতে গণভোটের বিধান রয়েছে। ব্রিটেনে অতি সম্প্রতি দুটি উল্লেখযোগ্য গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। একটি গণভোটে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রস্তাব অল্প ভোটে হেরে যায়। আর একটি গণভোটে ব্রিটেনে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয় এবং বর্তমানে এ সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন চলছে।

গণভোট সরকারের কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশগ্রহণে শুধু সহায়কই হয় না, এর ফলে কতগুলো অতিরিক্ত সুবিধাও পাওয়া যায়। প্রথমত, এর ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ উপকৃত হন, করের ক্ষেত্রে যেখানে গণভোটের ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানে করের হার হ্রাস হয় এবং সরকারি অর্থের সদ্ব্যবহারের পরিমাণ বাড়ে। উপরন্তু গণভোট থাকলে দেশে সহিংস গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রয়োজন হয় না। গণভোটের মাধ্যমে অনেক বিতর্কিত প্রশ্নের সমাধান হতে পারে। যেমন বাংলাদেশে বর্তমানে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে একটি বড় বিতর্ক রয়েছে। এ বিতর্কে দুটি বিরোধী রাজনৈতিক দল জড়িত রয়েছে। তারা তাদের পছন্দমতো ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চায়। এ ব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে না দিয়ে যদি গণভোটের মাধ্যমে জনগণের হাতে দেওয়া হয়, তাহলে গ্রহণযোগ্য সমাধান বের করা অনেক সহজ হতে পারে।

উদার গণতন্ত্র বনাম অনুদার গণতন্ত্র

পেরিক্লিসের এথেন্সে উদার গণতন্ত্র ছিল। বর্তমান বিশ্বে উদার এবং অনুদার দুই ধরনের গণতন্ত্র রয়েছে। ফরিদ জাকারিয়া উদার গণতন্ত্রের নিম্নরূপ সংজ্ঞা দিয়েছেন :

A political system marked not only by free and fair elections, but also by the rule of law, a separation of power and protection of basic liberty, of speech, assembly, religion and property.[৯]

উদার গণতন্ত্রের জন্য শুধু অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই যথেষ্ট নয়। এর জন্য প্রয়োজন আইনের শাসন : সংবিধানের মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষমতা নির্দিষ্টকরণ। আরও প্রয়োজন বাকস্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সম্পত্তি ভোগের স্বাধীনতা। এর জন্য একদিকে যেমন আইনের শাসনের প্রয়োজন, অন্যদিকে তেমনি পরমতসহিষ্ণু সংস্কৃতির প্রয়োজন রয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত যেসব দেশে নতুনভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হয়েছে, সেসব দেশে এই শর্ত প্রতিপালন করা সম্ভব হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে যে আইনের শাসন ও কার্যকর পরমতসহিষ্ণুতার ক্রমিক অবক্ষয় ঘটছে। এর ফলে দেশে দেশে গড়ে উঠছে Illiberal democracy বা অনুদার গণতন্ত্র। উদার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য উপযুক্ত রাজনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি রাতারাতি গড়ে ওঠে না। ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াতে একটি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি যথাযথ প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠে। এর ফলে পৃথিবীর অনেক দেশেই চটজলদি উদার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না।

সর্বোচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের রাষ্ট্রের উপযুক্ত কাজে নির্বাচন

পেরিক্লিস দাবি করছেন যে এথেনীয় গণতন্ত্রে যারা যে কাজের উপযুক্ত, তাদের সে কাজে নির্বাচিত করা হতো। নির্বাচনের ক্ষেত্রে পেরিক্লিসের মতে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য লাভ করে। বর্তমান বিশ্বে অধিকাংশ পদে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রার্থী নির্বাচিত করা হয়ে থাকে। তবে এতে সব সময় যে সমস্যা হবে তা নয়, অনেক ক্ষেত্রে এত বেশিসংখ্যক উপযুক্ত প্রার্থী থাকেন যে তাঁদের যে কেউ সরকারের কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে সমর্থ। তবু বর্তমান বিশ্বে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে যোগ্যতা বনাম রাজনৈতিক বিবেচনার প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। তবে এর কোনো গ্রহণযোগ্য সমাধান এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। সরকারি পদে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে মেধাভিত্তিক নিয়োগ এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য অবশ্যশর্ত। সাংবিধানিক পদসমূহেও উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচন করতে হবে।

সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করলে বর্তমান বিশ্বে সব ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের উপাদান চালু করা না গেলেও অনেক ক্ষেত্রেই এর অনেক উপাদান চালু করা সম্ভব। প্রকৃতপক্ষে অনেক রাষ্ট্রেই প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র এবং প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের সমন্বয় করা হয়েছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য গণভোটের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে অনেক বড় ধরনের প্রশ্ন রয়েছে, যেগুলো শুধু রাজনীতিবিদদের পক্ষে নিরসন করা সম্ভব নয়। এই অবস্থাতে বড় বড় নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে গণভোটের ব্যবস্থা করা উচিত এবং রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা চালু করা উচিত। এর ফলে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন এবং রাজনীতিবিদেরা শুধু সম্পদের ভাগ-বাঁটোয়ারাতে ব্যস্ত না হয়ে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন।

৫.৩ প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের জয়যাত্রা

যদিও সম্প্রতি বিশ্বের অনেক দেশ প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের বিভিন্ন উপাদানের (রেফারেন্ডাম বা রিকল) সমন্বয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তবু কয়েক শতাব্দী ধরে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রকে সুষ্ঠু ভিত্তির ওপর গড়ে তোলার সংগ্রাম চলছে। অনেক রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক ভোটাধিকার সংকুচিত ছিল। এর ফলে সব নির্বাচিত সরকার প্রকৃত অর্থে প্রতিনিধিত্বশীল ছিল না। আর শুধু নির্বাচিত সরকারই যথেষ্ট নয়। কাদের ভোটে সরকার নির্বাচিত, সেটি ছিল মূল প্রশ্ন। বর্তমান বিশ্বে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত সরকারকেই গণতান্ত্রিক সরকারের মর্যাদা দেওয়া হয়। কিন্তু এই সর্বজনীন ভোটাধিকার ব্যাপারটি অতি সম্প্রতি স্বীকৃতি লাভ করেছে। সারণি-৫.১-এ বিভিন্ন রাষ্ট্রে সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রবর্তনের সময় দেখা যাবে।

সারণি-৫.১
উন্নত দেশসমূহে গণতন্ত্রের বিকাশ

উন্নত দেশসমূহে গণতন্ত্রের বিকাশ

ওপরের সারণিতে ১৯টি উন্নত দেশে সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রবর্তনের তারিখ দেখা যাবে। এই তালিকা অনুসারে প্রথম নারী ও পুরুষদের সর্বজনীন ভোটাধিকার স্বীকৃত হয় নিউজিল্যান্ডে, ১৯০৭ সালে। আর এই অধিকার সর্বশেষ স্বীকৃত হয় সুইজারল্যান্ডে, ১৯৭১ সালে। পুরুষদের সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রথম স্বীকৃত হয় ফ্রান্সে, ১৮৪৮ সালে।

সর্বজনীন ভোটাধিকার সহজে মেনে নেওয়া হয়নি। অনেক দেশেই এ নিয়ে তুমুল গণ-আন্দোলন করতে হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ প্রথমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাধিকার সম্প্রসারণের ইতিহাস স্মরণ করা যেতে পারে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেয়, তবু প্রথম দিকে সেখানে ভোটাধিকার ছিল খুবই সংকুচিত। কৃষ্ণাঙ্গ ও মহিলাদের ভোটাধিকার ছিল না। ১৮৬০ সালে যখন লিঙ্কন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তখন যুক্তরাষ্ট্রে ৩৫টি অঙ্গরাজ্য ছিল। সেগুলোতে মহিলাদের কোনো ভোটাধিকার ছিল না। নিউ ইংল্যান্ডের পাঁচটি রাজ্যে কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকার স্বীকৃত ছিল আর নিউইয়র্কে কালোদের জন্যও ভোটাধিকার ছিল, যদিও সম্পত্তির শক্ত শর্ত জুড়ে কালোদের ভোটাধিকার হরণ করা হয়। লিঙ্কন যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তখন আমেরিকার সব নাগরিকের মধ্যে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশের বেশি লোকের ভোট দেওয়ার অধিকার ছিল না। এই ভোটারদের ৪০ শতাংশ ভোট, অর্থাৎ মোট নাগরিকদের ১৬ থেকে ১৮ শতাংশ ভোট পেয়ে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। লিঙ্কনের সংজ্ঞা অনুসারে গণতন্ত্র হচ্ছে ‘government of the people, by the people, for the people’। অথচ সংকুচিত ভোটাধিকার আইনের জন্য তিনি ছিলেন একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর দ্বারা নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। কৃষ্ণাঙ্গদের ও মহিলাদের ভোটাধিকার সম্প্রসারণ সহজে ঘটেনি; এর জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করতে হয়েছে। ১৮৭০ সালে ফেডারেল সরকার আইন করে কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকার দেয়। কিন্তু বর্ণবিদ্বেষী রাজ্য সরকারগুলো সে আইনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ও বেআইনিভাবে কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকার ঠেকিয়ে রাখে। এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মানবাধিকার আন্দোলন Civil Rights Movement গড়ে ওঠে। দীর্ঘ সময় ধরে এই আন্দোলনের কর্মীরা মাঠে কাজ করেন। ১৯৬৫ সালে Voting Rights Act পাস হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। যুক্তরাজ্যেও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তুমুল গণ-আন্দোলন করতে হয়েছে। ইংল্যান্ডে এই আন্দোলন চার্টিস্ট আন্দোলন নামে পরিচিত। এই আন্দোলনের ফলে যুক্তরাজ্যে দুটি সংস্কার আইন পাস করতে হয়।

ভোটাধিকার সম্প্রসারণের আগে সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই ভোটাধিকার ছিল সীমিত। ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব সত্ত্বেও ১৮৪৮ সালে ফ্রান্সে মোট জনসংখ্যার এক শতাংশেরও ভোটাধিকার ছিল না। ১৮৩২ সালে সংস্কার আইনের ফলে ইংল্যান্ডের মোট পুরুষ নাগরিকদের ১৮ শতাংশ ভোটাধিকার পায়। সীমিতসংখ্যক ভোটারের নির্বাচন-ব্যবস্থা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। ইংল্যান্ডে ১৮৫৩-৫৪ সালের আগে নির্বাচনে দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য কোনো আইন ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বেশির ভাগ দেশেই গোপন ব্যালটের ব্যবস্থা ছিল না। ফ্রান্সে ১৯১৩- এর আগে গোপন ব্যালট প্রথা চালু ছিল না। ফ্রান্সে ১৯১৩ সালে গোপন ব্যালট প্রথা চালু করা হয়। নির্বাচন-ব্যবস্থার এই সংস্কার এমনি হয়নি। এর জন্যও অনেক দেশে আন্দোলন করতে হয়েছে।

পৃথিবীর সর্বত্র গণতন্ত্র এগিয়ে যাচ্ছে না। কোথাও কায়েমি স্বার্থবাদীদের ষড়যন্ত্রে গণতন্ত্র পিছিয়েও যাচ্ছে। উন্নত দেশসমূহে দেখা যাচ্ছে, গণতন্ত্রের স্ববিরোধিতা বা paradox of democracy। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের জয়যাত্রা চলছে। যেসব রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল না, তারা উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অনুকরণ করছে। অন্যদিকে উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের প্রতি বীতশ্রদ্ধা দেখা যাচ্ছে। উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভোটারদের উপস্থিতির হার লক্ষণীয়ভাবে কমে যাচ্ছে। তবু গণতন্ত্রের পক্ষে দুটি সুসংবাদ রয়েছে। প্রথমত, উন্নত দেশসমূহের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার কমলেও এখনো গণতন্ত্রের ওপর আস্থা অটুট রয়েছে। সমাজতত্ত্ববিদ গিডেন্স জানাচ্ছেন যে সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, রাজনীতিবিদদের ওপর আস্থা কমে গেলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ৯০ শতাংশ লোক এখনো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতায় আস্থাশীল। দ্বিতীয়ত, রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে সাধারণ মানুষ রাজনীতি বর্জন করছেন না; অনেক রাষ্ট্রেই তরুণেরা রাজনীতিতে অংশ নিচ্ছে। বিশেষত সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই নাগরিক সংগঠন বা civic group-সমূহ কার্যকর রয়েছে। এ ধরনের সংগঠনসমূহই গণতন্ত্রকে অর্থবহ করে তোলে।[১০]

৫.৪ গণতন্ত্র ও উন্নয়ন : লি কুয়ান ইউ বনাম অমর্ত্য সেন

১৯৯৩ সালে ভিয়েনাতে সর্বজনীন মানবাধিকার সম্পর্কে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে চীন, সিঙ্গাপুরসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহ সব দেশের জন্য অভিন্ন মানবাধিকারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এদের বক্তব্য হলো, উন্নয়নশীল দেশসমূহের জন্য রাজনৈতিক অধিকারের চেয়ে অর্থনৈতিক অধিকার অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই পৃথিবীর সর্বত্র একই ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা মানবাধিকারের প্রয়োজন নেই। এই বক্তব্যের পক্ষে তিনটি বক্তব্য তুলে ধরা হয়।

প্রথমত, রাজনৈতিক অধিকার ও মানবাধিকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। গণতান্ত্রিক সরকারের চেয়ে কর্তৃত্ববাদী সরকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য উপযোগী। কয়েক দশক ধরে কর্তৃত্ববাদী সরকারের নেতৃত্বে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন এ মতবাদের সমর্থন করে। এ বক্তব্য প্রথম জোরালোভাবে তুলে ধরেন সিঙ্গাপুরের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ। এই বক্তব্য তাই ‘লি থিসিস’ বা লির বক্তব্য নামে পরিচিত।

দ্বিতীয়ত, এ কথা জোর দিয়ে দাবি করা হয় যে দরিদ্র মানুষেরা অর্থনৈতিক অধিকারকে রাজনৈতিক অধিকারের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় শুধু ভাত একটু নুন।’ অনেকে আরও বলে থাকেন, দরিদ্রদের কেউ কেউ গণতান্ত্রিক অধিকার চাইলেও সামগ্রিকভাবে দরিদ্রদের জন্য অর্থনৈতিক অধিকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

তৃতীয়ত, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জন্ম ও বিকাশ পাশ্চাত্য জগতে। এই মূল্যবোধ এশিয়ানদের জন্য প্রযোজ্য নয়। পশ্চিমা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ব্যক্তির অধিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এশিয়ান মূল্যবোধে সামাজিক শৃঙ্খলা ও সামঞ্জস্য অনেক মূল্যবান। কাজেই এশিয়ার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে গণতন্ত্র অচল।

প্রথমে লির বক্তব্য নিয়ে আলোচনা শুরু করা যাক। এ কথা সত্য যে চীন, সিঙ্গাপুরের মতো কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে প্রবৃদ্ধির হার গণতান্ত্রিক ভারতের চেয়ে বেশি। এর অর্থ এই নয় যে গণতন্ত্র যেখানে অনুপস্থিত, সেখানে প্রবৃদ্ধির হার বেশি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহে প্রবৃদ্ধির হার বেশি হওয়ার কারণ ভিন্ন। এ প্রসঙ্গে অমর্ত্য সেন বলছেন যে কর্তৃত্ববাদী সরকারের জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়নি। এই দেশগুলো উন্মুক্ত বাজারে প্রতিযোগিতা করেছে; এরা আন্তর্জাতিক বাজারকে ব্যবহার করেছে; এরা সাক্ষরতার হার বাড়িয়েছে এবং স্কুলশিক্ষার সম্প্রসারণ করেছে। এরা সাফল্যের সাথে ভূমি সংস্কার করেছে এবং বিনিয়োগ, রপ্তানি ও শিল্পায়নের জন্য উৎসাহ দিয়েছে। অমর্ত্য সেন তাই লিখেছেন :

The economic policies and circumstances that led to the economic success of East Asian economies are by now reasonably well understood. While different empirical studies have varied in emphasis, there is by now a fairly agreed general list of ‘helpful policies’ that includes openness to competition, the use of international markets, a high level of literacy and school education, successful land reforms and public provision of incentives for investment, exporting and industrialization. There is nothing whatsoever to indicate that any of these policies are inconsistent with greater democracy and actually had to be sustained by the elements of authoritarianism that happened to be present in South Korea or Singapore or China.[১১]

ইতিহাসে অনেক দেশ দেখা যায় যেখানে কর্তৃত্ববাদী সরকার শাসন করেছে কিন্তু সেখানে কোনো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়নি। পক্ষান্তরে এমন উদাহরণও রয়েছে যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে দেশ অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করেছে। উদাহরণস্বরূপ আফ্রিকা মহাদেশের বতসোয়ানা নামক একটি দেশের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। এই দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি ঘটেছে। ভারতে সাম্প্রতিক প্রবৃদ্ধি থেকে প্রমাণিত হয় যে গণতন্ত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রতিবন্ধকতা নয়। উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের সম্পর্ক নিয়ে একটি সমীক্ষায় অ্যাডাম প্রেজওরস্কি (Adam Przeworski) এবং ফার্নান্ডো লিমোগনো (Fernando Limogno) যথার্থই মন্তব্য করেছেন, ‘We do not know whether democracy fosters or hinders economic growth’[১২]। গণতন্ত্রের পক্ষে যুক্তি দেখানো হয় যে অপেক্ষাকৃত কম সচ্ছলদের ধীরে ধীরে ক্ষমতায়নের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রবৃদ্ধি সৃষ্টিকারী পুঁজিবাদী সম্পত্তি ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। পক্ষান্তরে গণতন্ত্রের বিপক্ষে বলা হয় যে গণতন্ত্র দ্রুত ভোগের পরিমাণ বাড়ায়, এর ফলে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বিঘ্নিত হয়। অন্যদিকে অনেক ক্ষেত্রে কর্তৃত্ববাদী সরকার সঞ্চয় বাড়ায় ঠিকই, কিন্তু উদ্বৃত্ত অর্থ তাদের উচ্চাভিলাষী ব্যক্তিগত প্রকল্পে ব্যয় করে। যুক্তি দুদিকেই আছে। কাজেই গণতন্ত্র ও উন্নয়নের সম্পর্ক নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয়।

লি প্রমাণ করতে পারেননি যে কর্তৃত্ববাদী সরকার হলেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে। তবে অমর্ত্য সেন দেখাচ্ছেন যে দেশে গণতন্ত্র নেই, সে দেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা বেড়ে যায়। তিনি লিখছেন :

Indeed, no substantial famine has ever occurred in a democratic country-no matter how poor. This is because famines are extremely easy to prevent if the government tries to prevent them, and a government in a multiparty democracy with elections and free media has strong political incentives to undertake famine prevention. This would indicate that political freedom in the form of democratic arrangements helps to safeguard economic freedom (especially freedom from extreme starvation) and the freedom to survive against famine mortality.[১৩]

অমর্ত্য সেন বলছেন যে ১৯৪৭ সালে ভারতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কোনো দুর্ভিক্ষ হয়নি। প্রতিতুলনায় ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সময়কালে চীনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দুর্ভিক্ষ ঘটে, যাতে প্রায় তিন কোটি লোক প্রাণ হারায়। চীনে দুর্ভিক্ষ ঘটেছে এ কারণে যে সেখানে কর্তৃত্ববাদী সরকার ছিল, যার কোনো জবাবদিহি ছিল না। চীনের গণমাধ্যম ছিল নিয়ন্ত্রিত, তাই এ নিদারুণ দুর্ভিক্ষ নিয়ে সেখানে কোনো আলোচনাও হয়নি। পক্ষান্তরে ভারত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এখানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সাংবিধানিকভাবে সংরক্ষিত ছিল। কাজেই দেশে খাদ্যের অভাব দেখা দিলে হইচই পড়ে যেত এবং সরকারকে যেভাবেই হোক, খাদ্য সংগ্রহ করতে হতো। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভাবে এবং স্বাধীন গণমাধ্যম না থাকায় চীনের এ দায় ছিল না। তাই চীনে দুর্ভিক্ষ হয়েছে, ভারতে দুর্ভিক্ষ হয়নি। অমর্ত্য সেন এ বিষয়ে আরও অনেক উদাহরণ দিয়েছেন। উপরিউক্ত আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে লির পরামর্শ গ্রহণ করে গণতন্ত্রকে খর্ব করলে শুধু যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জিত না হতে পারে তা নয়; গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করলে গরিব দেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা বেড়ে যাবে।

কর্তৃত্ববাদী শাসনের পক্ষে দ্বিতীয় যুক্তি হলো, গরিব মানুষেরা অর্থনৈতিক উন্নতি চায়; রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। অনেক কর্তৃত্ববাদী নেতাই এ মতবাদে বিশ্বাস করেন। প্রকৃতপক্ষে এর কোনো ভিত্তি নেই। জনগণ কোথাও কর্তৃত্ববাদী শাসনকে স্বেচ্ছায় মেনে নেয়নি। দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশে জনসাধারণ আন্দোলন করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। চীনকে বাদ দিলে কর্তৃত্ববাদী সরকার এখনো মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে শাসন করছে। কিন্তু মালয়েশিয়াতে এখনো গণতান্ত্রিক অসন্তোষ বিরাজ করছে। সিঙ্গাপুরে লির সাফল্যের কারণ হলো যে তিনি সেখানে চীনাভাষীদের কর্তৃত্ব রক্ষা করেছেন। তাই চীনাভাষীদের সমর্থনে সেখানে কর্তৃত্ববাদী সরকার এখনো টিকে আছে।

গণতন্ত্রের সমালোচকেরা বলে থাকেন যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ পাশ্চাত্যের সামাজিক পরিবেশে লালিত হয়েছে। এই মূল্যবোধের সঙ্গে প্রাচ্যের জনগণের মূল্যবোধের কোনো সম্পর্ক নেই। এই মতবাদ ঐতিহাসিকদের কাছ থেকে আসেনি, এই মতবাদের প্রবক্তা হচ্ছেন সেসব রাজনীতিবিদ, যাঁরা কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চান। তাঁরা প্রাচ্যের মূল্যবোধের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, সেটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। চীনের কনফুসিয়াস যেমন সামাজিক শৃঙ্খলার ওপর জোর দিয়েছেন, তেমনি তিনি আবার রাষ্ট্রের প্রতি অন্ধ আস্থায় বিশ্বাস করতেন না। ভারতে বৌদ্ধ দর্শন গণতন্ত্রকে সমর্থন করে। কাজেই এশীয় মূল্যবোধ সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে, তার অধিকাংশই মনগড়া।

অমর্ত্য সেন যথার্থই বলেছেন যে তিন ধরনের কারণে গণতন্ত্র মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, গণতন্ত্র মানুষের রাজনৈতিক এবং সামাজিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য প্রত্যক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয়ত, গণতন্ত্র মানুষের অর্থনৈতিক প্রয়োজনকে এগিয়ে নিয়ে যায়। অমর্ত্য সেন একে আখ্যা দিয়েছেন Instrumental role বা হাতিয়ারস্বরূপ ভূমিকা। এই ভূমিকা নিয়ে লি ও অমর্ত্য সেনের বক্তব্য ওপরে আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয়ত, গণতন্ত্র মানুষের প্রয়োজন নির্ধারণে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উন্মুক্ত বিতর্কের মাধ্যমে মানুষ তাদের ভাবের লেনদেন করে এবং এই লেনদেনের প্রক্রিয়ায় মানুষের চাহিদা অনেক স্পষ্ট হয়ে ওঠে I

মানুষ শুধু অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নই চায় না, তারা মানবাধিকার নিশ্চিত করতে চায়। মানবাধিকারের সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক সারণি-৫.২-এ দেখানো হয়েছে।

সারণি-৫.২
গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সংযোগ

গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সংযোগ

নাগরিকের জীবনকে সমৃদ্ধ করার জন্য গণতন্ত্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উন্মুক্ত বিতর্কের মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে ভাবের আদান- প্রদান সম্ভব। এর ফলে বিতর্কিত প্রশ্নসমূহ নিয়ে ঐকমত্য অথবা প্রায় ঐকমত্য গড়ে তোলাও সম্ভব। দেশের মানুষের মধ্যে মানুষের চাহিদা সম্পর্কে ঐকমত্য না থাকলে সেখানে সরকারের পক্ষে দায়িত্ব পালন করা অত্যন্ত কষ্টকর। কাজেই এ বিষয়ে গণতন্ত্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

এ কথা সত্য যে গণতন্ত্র হলেই সব রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হবে না। তবে গণতন্ত্রের যেসব বিকল্প রয়েছে, সেসব ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের চেয়ে অনেক বেশি ত্রুটি রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ১৯৪৭ সালের ১১ নভেম্বর উইনস্টন চার্চিল ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গণতন্ত্রের পক্ষে যে যুক্তি দিয়েছেন, তা স্মরণ করা যেতে পারে :

Many forms of governments have been tried and will be tried in the world of sin and woe. No one pretends that democracy is perfect or all wise. It has been said the democracy is the worst form of government except for those all other forms of government that have been tried from time to time.[১৪]

গণতন্ত্র পরিপূর্ণ শাসনব্যবস্থা নয়, কিন্তু গণতন্ত্রের বিকল্প শাসনব্যবস্থাসমূহ নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রের চেয়ে দুর্বল ও অকার্যকর।

৫.৫ বাংলাদেশে গণতন্ত্র

পৃথিবীর অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পাশ্চাত্য জগৎ থেকে আমদানি করা হয়। কিন্তু পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে প্রাচীনকাল থেকেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশ এ ব্যতিক্রমধর্মী রাষ্ট্রের মধ্যে একটি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে ভারতের পূর্বাঞ্চলে শাসকদের নির্বাচিত করা হতো। আনুমানিক ৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে পাল বংশের রাজা গোপাল সিংহাসনে বসেন। কিন্তু গোপাল গায়ের জোরে রাজা হননি, দেশের জনগণ তাঁকে রাজা করেছে। এই বিবরণ দুটি উৎস থেকে পাওয়া যায়। প্রথমত, খালিমপুর তাম্রশাসনে বলা হয়েছে যে গোপালের সিংহাসনে আরোহণের পূর্বে দেশে মাৎস্যন্যায় বা অরাজকতা বিরাজ করছিল। এই পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দেশের জনগণ গোপালকে রাজা নির্বাচিত করে। বৌদ্ধ লেখক লামা তারানাথ ষোড়শ শতাব্দীতে লিখিত তাঁর গ্রন্থে গোপালের নির্বাচনের কথা উল্লেখ করেছেন। উপরিউক্ত তথ্য বিবেচনা করে ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদার লিখেছেন :

About the middle of the eighth century A.D. a heroic and laudable effort was made to remedy the miserable state of things. The people at last realized that all their troubles were due to the absence of a strong central authority and that this could be set up only by voluntary surrender of powers to one popular leader by the numerous chiefs exercising sovereignty in different parts of the country. It reflects no small credit upon the political sagacity and spirit of sacrifice of the leading men of Bengal that they rose to the occasion and selected one among themselves to be the sole ruler of Bengal to whom they all paid willing allegiance. It is not every age, it is not every nation, that can show such a noble example of subordinating private interests to public welfare. The nearest parallel is the great political change that took place in Japan in A.D. 1870. The result was almost equally glorious and the great bloodless revolution ushered in an era of glory and prosperity such as Bengal has never enjoyed before or since.[১৫]

আইয়ুব খানের আমলে ড. মোহর আলীর নেতৃত্বে কোনো কোনো ঐতিহাসিক রমেশ মজুমদারের এই বর্ণনাকে অতিরঞ্জিত বলে দাবি করেন।[১৬] তাঁদের বক্তব্য ছিল যে অষ্টম শতাব্দীতে রাজা নির্বাচিত হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু এই সমালোচনা সঠিক নয়। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী প্রদেশ আসামে একটি পাল বংশ রাজত্ব করেছে। আসামের পাল বংশের ইতিহাসেও বলা হয়েছে, সেখানে গোপাল নামে এক রাজা জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছিলেন।[১৭] ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও রাজা নির্বাচিত হওয়ার বিবরণ পাওয়া যায়। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হতো নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা। এ দেশে যেমন রাজতন্ত্র ছিল, তেমনি গণতান্ত্রিক ধারাও প্রচলিত ছিল। তবে এই গণতন্ত্রের উদ্দেশ্য সংখ্যাগুরুদের প্রতিনিধিদের ক্ষমতায় বসানো নয়, এর উদ্দেশ্য ছিল ঐকমত্যের সরকার প্রতিষ্ঠা। যে অর্থে পেরিক্লিস গণতান্ত্রিক সরকারকে সব নাগরিকের সরকার বলে আখ্যা দিয়েছেন, সে ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠা করা।

পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামে বাঙালিদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। ইংরেজ শাসনামলের প্রাথমিক পর্যায়ে এই অঞ্চলে বিভিন্ন প্রতিরোধমূলক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। যার মধ্যে রয়েছে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, ওয়াহাবি বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, সিপাহি বিদ্রোহ ইত্যাদি। এ আন্দোলনগুলো যদিও সরাসরি গণতান্ত্রিক আন্দোলন ছিল না, তবু এদের লক্ষ্য ছিল জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত করা। পরবর্তীকালে কৃষক বিদ্রোহ ও উপজাতীয়দের মধ্যেও বিদ্রোহ দেখা দেয়। বিশ শতকের প্রথম থেকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনসমূহ পরিচালিত হয়। ১৯০৫ সালে শুরু হয় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন। এরপর আসে খেলাফত আন্দোলন, আসে অসহযোগ আন্দোলন, আসে ভারত ছাড়ো আন্দোলন। এসব আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে কংগ্রেস এবং কংগ্রেসের একটি লক্ষ্য ছিল দেশে স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা। ১৯৪৭ সালে ভারতকে দুভাগে ভাগ করে স্বাধীনতা দেওয়া হয়। পাকিস্তান অঞ্চলে মুসলিম লীগের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম লীগ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতায় এলেও তারা ক্ষমতায় যাওয়ার পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে দূরে সরে আসে। এর ফলে বাংলাদেশ অঞ্চলে নতুন করে গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু হয়। এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এ আন্দোলন ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। এ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল দেশে বহুদলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা। মুসলিম লীগ পাকিস্তানকে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ১৯৫০ সালে তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঘোষণা করেছিলেন :

I have always said, rather it has always been my firm belief, that the existence of the league not only the existence of the league, but its strength is equal to the existence and strength of Pakistan. So far, as I am concerned, I had decided in the very beginning, and I reaffirm it today, that I have always considered myself as the Prime Minister of the League. I never regarded myself as the Prime Minister chosen by the members of the Constituent Assembly.[১৮]

এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করে বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন : তিনি জনগণের প্রধানমন্ত্রী হতে চান নাই, একটা দলের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছেন। রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দল যে এক হতে পারে না, এ কথাও তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অনেকগুলি রাজনৈতিক দল থাকতে পারে এবং আইনে এটা থাকাই স্বাভাবিক। দুঃখের বিষয়, লিয়াকত আলী খানের উদ্দেশ্য ছিল যাতে অন্য কোনো রাজনৈতিক দল পাকিস্তানে সৃষ্টি হতে না পারে। ‘যো আওয়ামী লীগ করেগা উসকো শের কুচাল দে গা’—এ কথা একমাত্র ডিকটেটর ছাড়া কোনো গণতন্ত্রে বিশ্বাসী লোক বলতে পারে না। জিন্নাহর মৃত্যুর পর সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করেছিলেন।[১৯]

একদলীয় স্বৈরাচারের বিপক্ষে বঙ্গবন্ধু সব সময়ই বহুদলীয় গণতন্ত্রের পক্ষে বক্তব্য রেখেছেন। তিনি তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তাই লিখেছেন, ‘বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র চলতে পারে না।’[২০] উপরন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন, কোনো নেতা যদি অন্যায় কাজ করে, তবে তার প্রতিকার করার অধিকার জনগণের রয়েছে। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘কোনো নেতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তার প্রতিবাদ করা এবং তাকে বুঝিয়ে বলার অধিকার জনগণের আছে। যেমন হযরত ওমরকে (রা.) সাধারণ নাগরিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি বড় জামা পরেছিলেন বলে।’[২১] আওয়ামী লীগ মূলত গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিশ্বাস করত এবং স্বতন্ত্র নির্বাচনের বদলে যুক্ত নির্বাচন এবং তরুণ জনগণের ভোটাধিকার দেওয়াতে বিশ্বাসী ছিল। তবে গণতন্ত্রের বিভিন্ন দুর্বলতা সম্বন্ধে আওয়ামী লীগের কোনো সুস্পষ্ট বিশ্লেষণ বা বক্তব্য ছিল না।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে কর্তৃত্ববাদী ও গণতন্ত্রপন্থী দুটি ধারা দেখা যায়। দুর্ভাগ্যবশত কর্তৃত্ববাদী ধারার সূচনা ঘটে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে একদলীয় রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এই ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যান সামরিক শাসকেরা—সামরিক শাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ও পরবর্তীকালে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ এই কর্তৃত্ববাদী ধারা সহজেই মেনে নেয়নি। গত চার দশকে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন করলে নিম্নলিখিত দুর্বলতাসমূহ সহজেই ধরা পড়ে।

ক. অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থতা। অনেক নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে নির্বাচন শাসকদলের পাতানো খেলায় পর্যবসিত হয়। শুধু যেসব নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়, সেসব নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য বলে স্বীকৃত হয়।

খ. সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত নয় এমন সরকার কর্তৃক দেশ শাসন বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সাংসদেরা নির্বাচিত হন। আনুপাতিক ভিত্তিতে নির্বাচন না হওয়ার ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ ভোটে নির্বাচিত সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করে। এর ফলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রাষ্ট্রপরিচালনায় অংশগ্রহণ সম্ভব হয় না।

গ. প্রতিনিধিত্বশীল সরকারে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। সব গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের সমাধানের দায়িত্ব সমাধানের দায়িত্ব সাংসদদের।

সাংসদদের। গণভোট বা referendum-এর ব্যবস্থা না থাকাতে (শুধু সামরিক শাসকেরা তাঁদের শাসনকে বৈধ করার জন্য পাতানো গণভোটের ব্যবস্থা করেন) কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে জনমত যাচাই করা হয় না। রাজনীতিবিদেরা সাধারণত দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সিদ্ধান্ত নেন। এর ফলে বিরোধী দলের বক্তব্য কোনো কাজে লাগে না। বিরোধী দলের পক্ষে হরতাল দেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠিত হলে হরতালের রাজনীতির প্রকোপ কমতে পারে।

ঘ. জনমত অগ্রাহ্য করার অনুদার মূল্যবোধ। এক দিনের নির্বাচনে জয়লাভ করলে পুরো মেয়াদে দেশ শাসন করা হয়। এই ব্যবস্থার ফলে সরকার একবার নির্বাচনে জিতলে জনমতকে অগ্রাহ্য করে দেশ শাসন করতে পারে।

ঙ. বাংলাদেশে অনুদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে। সংঘাতের রাজনীতিতে বিরোধী বক্তব্যের কোনো স্থান নেই। উদার গণতন্ত্র যেসব মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তার বেশির ভাগই বাংলাদেশে অনুপস্থিত। এখানে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত, নির্বাহী, বিচার ও সংসদের ক্ষমতার সুস্পষ্ট বিভাজন নেই।

৫.৬ উপসংহার

বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার চারটি মূল স্তম্ভ হলো জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র। এই চারটি লক্ষ্যের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো গণতন্ত্র। বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতে লালিত হয়েছে। বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কায়েম করতে হবে। উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ছাড়া ধর্মনিরপেক্ষতা সম্ভব নয়। কাজেই জাতীয় লক্ষ্য অর্জনের জন্য সুষ্ঠু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা একান্ত আবশ্যক। অথচ বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বারবার ব্যাহত হয়েছে।

পৃথিবীর অনেক দেশেই গণতন্ত্র পাশ্চাত্যের অনুকরণে প্রবর্তন করা হয়েছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র পাশ্চাত্য থেকে ধার করা হয়নি। এখানে প্রাচীনকাল থেকে গণতান্ত্রিক ধারা প্রচলিত। বাংলাদেশ অঞ্চলের সবচেয়ে স্থিতিশীল ও বৃহৎ সাম্রাজ্য পাল সাম্রাজ্যের প্রথম নৃপতি গোপাল জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের মানুষ বারবার বৈদেশিক শাসন প্রত্যাখ্যান করেছে। ঐকমত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সুষ্ঠু সমাধান। যদিও সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের উদ্ভব, তবু বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের চেতনার উন্মেষ ও বিকাশ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেই হয়েছে।

গণতন্ত্রের জন্য আত্মত্যাগের পরও বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এখনো পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বিকশিত হয়নি। ফ্রিডম হাউস নামে একটি মার্কিন সংগঠন পৃথিবীর রাষ্ট্রসমূহকে গণতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছে : (ক) পূর্ণ গণতান্ত্রিক বা স্বাধীন, (খ) আংশিক গণতান্ত্রিক বা আংশিক স্বাধীন, (গ) অগণতান্ত্রিক বা স্বাধীন নয়। ২০১৬ সালে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। (সারণি-৫.৩ দেখুন )

সারণি-৫.৩
ফ্রিডম হাউসের মূল্যায়নে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অবস্থান

ফ্রিডম হাউসের মূল্যায়নে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অবস্থান

দক্ষিণ এশিয়ার সাত দেশের গণতন্ত্রের মূল্যায়নে বাংলাদেশের স্থান পঞ্চম। মালদ্বীপ ও পাকিস্তান ছাড়া অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় দেশের অবস্থান বাংলাদেশের ওপরে। ভারত ইতিমধ্যে সর্বোচ্চ গণতান্ত্রিক শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মূল্যায়নের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান শ্রীলঙ্কা, ভুটান ও নেপালের নিচে। বাংলাদেশ সার্বিক মূল্যায়নে মাত্র ৪৯ নম্বর পেয়েছে, অথচ পরিপূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক দেশের মূল্যায়নে ১০০ নম্বর পেয়েছে এমন দেশও রয়েছে। শুধু মূল্যায়নের দিক থেকেই বাংলাদেশের অবস্থান উদ্বেগজনক নয়, ২০১৬ সালের মূল্যায়ন থেকে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছে।[২২]

এ অবনতির মূল কারণ হলো বাংলাদেশে মানবাধিকারের লঙ্ঘন ও জঙ্গিবাদের তৎপরতার ফলে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন করে উদ্যোগ নেওয়া অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে।

গত চার দশকে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অনেক উত্থান ও পতন ঘটেছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য নিম্নরূপ ব্যবস্থাসমূহ বিশেষভাবে বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে।

– অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন একটি অবশ্য পালনীয় শর্ত। বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। শুধু নির্বাচন কমিশনের সংস্কার করে নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করা যাবে না, এর জন্য নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কেও জাতীয় ঐকমত্যের প্রয়োজন রয়েছে।

– আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার প্রবর্তন। বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। বর্তমান সংখ্যাগুরু ভোটভিত্তিক নির্বাচন-ব্যবস্থা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নির্বাচনী এলাকার জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে বাধ্য করে। এর ফলে এ ধরনের প্রতিনিধিরা স্থানীয় সমস্যার সমাধানে সচেষ্ট থাকেন। পক্ষান্তরে আনুপাতিক হারে নির্বাচিত সাংসদদের এ ধরনের প্রবণতা থাকে না। তবু একটি কারণে বাংলাদেশে সম্পূর্ণ আনুপাতিক হারে অথবা আনুপাতিক হার ও সংখ্যাগুরুভিত্তিক নির্বাচনের মিশ্র ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। প্রথমত, যেখানে নির্বাচনী এলাকায় এক ভোট বেশি পেলে নির্বাচিত হওয়া যায়, সেখানে ভোট জালিয়াতির আশঙ্কা বাড়ে। বাংলাদেশে আনুপাতিক হারে নির্বাচনে একটি আসনলাভের জন্য তিন লাখ ভোট জাল করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে বর্তমানে সংঘাতের রাজনীতি বিরাজ করছে। প্রধান দলগুলোর মধ্যে কোনো লেনদেন নেই। আনুপাতিক হারে নির্বাচন হলে কোয়ালিশন সরকার গঠনের প্রয়োজন অনেক ক্ষেত্রে দেখা দেবে। এর ফলে সংঘাতের রাজনীতি যে অবিশ্বাসের দেয়াল গড়ে তুলেছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই ভেঙে যাবে। আনুপাতিক হারে নির্বাচন বাংলাদেশে রাজনীতিতে পুনরায় সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। তৃতীয়ত, আনুপাতিক হারে নির্বাচনের ফলে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমতের প্রতিফলন ঘটবে। চতুর্থত, আনুপাতিক হারে নির্বাচনে দলগুলো বিশেষজ্ঞদের মনোনয়ন দিতে পারে। এতে সংসদেও কাজের মান উন্নত হবে।

– বাংলাদেশে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের গণতন্ত্রায়ণ। এ ব্যবস্থায় দেশের জনগণ এক দিনের রাজা। শুধু ভোটের দিন জনমতকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। বাকি সময় রাষ্ট্র নির্বাচিত দল পরিচালনা করে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেয়। বড় বড় রাজনৈতিক প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে। গণভোট ও প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের সমন্বয় সম্ভব। তবে ‘রিকল’ বা নির্বাচিত প্রতিনিধিকে প্রত্যাহার ব্যবস্থার সঙ্গে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের সমন্বয় সম্ভব নয়। তাই যদি অনেক ক্ষেত্রে ‘রিকল’ ব্যবস্থার প্রয়োজন দেখা যায়, তবু এ মুহূর্তে তা প্রবর্তন করা বাঞ্ছনীয় হবে না।

– উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রসার। অনুদার গণতন্ত্রকে উদার গণতন্ত্রে রূপান্তর করতে হবে। বাংলাদেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উদার গণতন্ত্রের মূল্যবোধ অনুপস্থিত। আইনের শাসন, ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা স্বীকার করতে হবে। এর জন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন করতে হবে।

– সক্রিয় রাজনৈতিক আন্দোলন—গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আন্দোলনের মাধ্যমে আদায় করতে হয়। সক্রিয় রাজনৈতিক আন্দোলন ছাড়া গণতন্ত্রের বিকাশ সম্ভব নয়। এ আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলো সহযোদ্ধা হতে পারে। কিন্তু শক্তিশালী সিভিল সমাজ ছাড়া গণতন্ত্রকে সুসংহত করা সম্ভব নয়। গণতান্ত্রিক সংগ্রাম প্রসঙ্গে অ্যান্থনি গিডেন্স যথার্থই লিখেছেন, ‘Nothing comes without struggle. But the furtherane of democracy at all levels is worth fighting for and it can be achieved.’ [২৩]

পাদটীকা

১. Francis Fukuyama. 1989. ‘The End of History?’ The National Interest. Summer 1989

২. Anthony Giddens. 1999. Runaway World, How Globalization Is Reshaping Our World. London: Profile Books, 69

৩. Thucydides. 1954. History of the Pelopponesian War. Translated by Rex Warner. London: Penguin Book, 141

৪. Farid Zakariah. 2003. The Future of Fredom. New York: Viking, 1999

৫. James Buchanon and Gordon Tullok 1962. The Calculus of Consent. Ann Arbor. University of Michigan Press, 213

৬. John G. Matsusaka. 2005. Direct Democracy Works’. The Journal of Ecnomic Perspective. Spring 2005, 187

৭. এ প্রসঙ্গে দেখুন Joshoua J. Doyck and Edward L. Lascher Jr. 2009 Direct democracy and political efficiency Reconsidered’. Political behavior. December 2009; 401, 427

৮. John J. Matsusaka. 2005 ‘The Eclipse of Legislator. Direct Democracy in the 21st Century’. Public Choice. July 2005, 157 to 169

৯. Farid Zakaria. 1992. The Rise of Liberal Democracy’. Foreign Affairs. November, December 1992

১০. Anthony Giddens. 1999 প্রাগুক্ত, ৭১, ৭২

১১. Amartya Sen. 1999 Development as Freedom. New York. Alfred A. Knopf, 151

১২. Adam Przeworski and Fermando Limogno. 1993 ‘Political regimes and economic growth. Journal of Economic Perspectives. Summer 1993, 51-69

১৩. Amartya Sen. 1999 প্রাগুক্ত, ৫১-৫২

১৪. Quoted in Reichard M. Lanworth http:// reichardlanworth.com/worst-from-of-government

15. R. C. Majumdar. 1959 The Age of Imperial Kanau: History and culture of Indian people vol-4. Bombay, 44

১৬. Abdul Momen Chowdhury. 1967 Dynastic History of Bengl. Dacca: Asiatic society of Pakistan

১৭. Debabrata Datta. 1986 History of Assam. Calcatta: Sreevhumi Publishing Company

১৮. উদ্ধৃত শেখ মুজিবুর রহমান। ২০১২। অসমাপ্ত আত্মজীবনী। ঢাকা : দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ১৩৪

১৯. শেখ মুজিবুর রহমান। ২০১২। প্রাগুক্ত, ১৩৩-৩৪

২০. শেখ মুজিবুর রহমান। ২০১২। প্রাগুক্ত, ২১৪

২১. শেখ মুজিবুর রহমান। ২০১২। প্রাগুক্ত, ১০০

২২. Freedom House 2016 Freedom in the World 2016, 18

২৩. Anthony Giddens. ১৯৯৯ প্রাগুক্ত, ৮২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *