খাবার সাজাতে সাজাতে আমেনা আবার বীথির বাবার চিঠিটা মনে করেন। বীথির বাবা লিখেছেন, বীথিকে আপনার কাছে এনে কিছুদিনের জন্যে রেখে দিন।
প্রস্তাবটা পেয়ে একদিকে যেমন কষ্ট হয়েছে, তেমনি খুশি লেগেছে আমেনার। হোক না কয়েকদিনের জন্যে তবু তো বীথি থাকবে তার কাছে। তার নিজের মেয়ে হলে এতদিনে। বীথির মতোই বড় হত। কিন্তু আবুর সাথে মেয়েটার যদি সত্যি সত্যি ভাব হয়ে থাকে তো আবু কষ্ট পাবে। আমেনার কষ্টটা সেইখানে।
পরে তিনি মনে মনে একটা সমঝোতায় এসেছেন। বীথি তো আর তেমন দূরে রইল না, পরের ঘরেও রইল না। আবু আসবে যখন খুশি। বরং আবু–বীথি, তখন দুজনকেই পাওয়া যাবে চোখের সমুখে।
ভাবলেন আবু হয়ত ইতিমধ্যেই শুনেছে বীথিকে নিয়ে আসা হচ্ছে এখানে, তাই আগে থেকে নিজেই পা বাড়িয়েছে তার দুয়ারে। নইলে কোনদিন আসে না এ সময়ে, এই ভরদুপুরে আজ আসবে কেন? এসেছে, পরে যেন সময়ে অসময়ে এলে অবাক না হন তিনি। ভাবতে ভাবতে আমেনার মুখে মধুর হাসি দেখা দিল।
আবু খেতে বসলে আমেনাও তার পাশে একটা চেয়ার টেনে বসলেন। দেখলেন আবুর গোগ্রাসে খাওয়া। একটু মন্দা পরলে শুধোলেন, কী সব শুনি, আবু?
আবু চোখ তুলে তাকাল। বুঝতে পারল না।
কী?
বলতে গিয়ে অপ্রতিভ হয়ে পড়লেন আমেনা। বড় জোর বলতে পারলেন, ঐ আর কী!
আবু এবারে অবাক হয়ে গেল। বড় চাচিমার কথায় সম্পূর্ণ একটা নতুন সুর বাজছে।
গ্লাসে পানি ভরে দিতে দিতে তিনি বললেন, হ্যাঁরে, তুই নাকি বীথিকে বিয়ে করবি?
কাকে?
আহা, বীথি। শুনছি, তাই জিজ্ঞেস করলাম।
আবু আমেনার দিকে একটুখন তাকিয়ে থেকে হাত ধুতে ধুতে বলল, ঠাট্টা করছ কিনা বুঝতে পারলাম না।
ওই তোর খাওয়া হলো?
তোয়ালে দিয়ে হাত মুছে আবু তার চেয়ার আমেনার মুখোমুখি নিয়ে বসল। বলল, হয়েছে। তুমি ঠাট্টা করছ বলে খাওয়া নিয়ে আমিও ঠাট্টা করব নাকি? আমার বেশ খিদে পেয়েছিল।
আমেনা রাগ করলেন শুনে।
তোর সাথে ঠাট্টা করবার আর কথা পেলাম না?
আবু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। বুঝতে পারল। বলল, তোমাদের সব হয়েছে কী? সেদিন সন্ধ্যায় মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ৰাথি কোথায়? আমাকে অবাক করে দিয়ে উত্তর দিলেন—-
ওকে নিয়ে এত মাতামাতি কেন? মাতামাতি কিসের, চাচিমা? কেন, বীথির আমি কী করেছি?
তবে কি ওরা এমনি বলে?
কে কী বলে না বলে তা আমি জানব কী করে?
বীথির সঙ্গে বেড়াতে যাস না তুই?
যাই।
ওর ঘরে যাস?
যাই।
যাবার একটা সময় আছে।
বীথির কাছে আমার আবার সময় বুঝে যেতে হবে নাকি?
কথাটার অন্য মানে বুঝলেন আমেনা। বললেন, তবে যে বললি ওর সঙ্গে ভাব নেই!
বেশ তো বীথিকেই জিজ্ঞেস করে দেখো। ওর সঙ্গে কী আমার আর কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না?
এটা একটা সম্পর্কের ছিরি হলো, আবু?
রাগ করে উঠে দাঁড়ায় আবু।
চললি?
যাবো নাতো কী!
.
দুপুর থেকে জ্বরটা নেই হাশেমের। মাথায় বালতি বালতি পানি ঢালার পর এই এতক্ষণে চোখের লালটা কমেছে। মরিয়ম ছেলের মাথা মুছিয়ে দিয়ে তোয়ালে নিঙড়ে রাখলেন।
হাশেম শুধাল, বীথি কই, মা?
এইতো এতক্ষণ ছিল তোর কাছেই, লক্ষ করিসনি। ওর শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না, ঘরে গেছে।
হাশেম উদ্বিগ্ন হলো।
কেন, কী হয়েছে?
কিছু না।
মরিয়মের বাঁ হাতে রয়েছে হাশেমের মুখ। তিনি সিথি করিয়ে দিচ্ছেন আস্তে আস্তে। মরিয়মের মন বীথি চলে যাবে শুনে অবধি খারাপ হয়ে আছে। তার ওপরে সে রাতে বীথির জড়িয়ে ধরে অমন কান্না তাঁকে আরো দুর্বল করে দিয়ে গেছে যেন। নিয়ে যাওয়ার কথা। শুনলে বীথি কষ্ট পাবে, এটা তার চেয়ে আর কেউ ভালো জানে না।
মায়ের হাত থেকে সরে এসে হাশেম বালিশে মাথা রেখে চোখ বুজতে খুঁজতে বলে, ওকে একা থাকতে দিও না, মা। একা থাকলে ও মরে যাবে। তুমি ওর দিকে তাকিয়ে দেখতে পারো না?
দেখিরে দেখি।
জানো মা, ওই তোমাদের অসুবিধে। মানুষের অন্তরটা হচ্ছে একটা আলাদা পৃথিবী। মানুষটার নিজস্ব পৃথিবী। তোমারই পেটে ধরা ছেলে, অথচ তার বুকের ভেতরে কী আছে। জানতে পারো? কেউ কি কারো কথা জানতে পারে? বার থেকে আবছা আবছা শুধু অনুভব করা যায়। বীথিকে জানবে কী করে? সেদিন প্রথম দেখলাম। দেখে যেন আমার নিজেরই ভয় করল।
দরোজায় দাঁড়িয়ে বীথি।
মরিয়ম বললেন, তুই আবার উঠে এলি?
হাশেম চোখ মেলে দেখে। হাত বাড়িয়ে দেয়।
আয়, বীথি। জ্বরটা তুই কমিয়েই দিলি।
মরিয়ম খুশি হয়ে ওঠেন।
এখন ভালো লাগছে, বাবা?
হ্যাঁ।
বলে হাশেম স্নান হাসে। আবার সেই সুন্দর হাসিটা।
বীথি তখন তার শিয়রে বসে কপালে হাত রাখে। হাশেম বলে, এলি কেন? মা বলছিলেন তোর শরীর খারাপ। তুইও মরবি নাকি, বীথি?
.
সন্ধ্যের আগে দিয়ে হাশেমকে হাঁটতে দেখে সবাই অবাক হলো। এই দুপুরেও দাঁড়াতে পারছিল না। মরিয়ম ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
উঠলি কেন, হাশেম?
হাশেমের যেন তা কানেই যায় না। লম্বা লম্বা পা ফেলে কেমন অদ্ভুতভাবে হাঁটতে থাকে বারান্দা দিয়ে।
মরিয়ম তখন একেবারে তার কাছ বরাবর উঠে আসেন। তিরস্কার করে বলেন, তুই আমাকে জ্বালাতেই এলি, হাশেম। পড়ে গিয়ে মাথা ফাটাবি নাকি?
হাশেম মায়ের কাঁধে হাত রেখে বলে, বড়ড ভীতু তুমি। বলেছি না, শরীরটা এতকাল চোখ বুজে থেকে এখন শোধ নিচ্ছে। শরীরটা যা খুশি করছে, আমি তাই বলে বসে থাকব নাকি? আমাকে হাঁটতে দাও, মা।
মরিয়ম তখন ঘরে এসে বীথিকে পাঠিয়ে দেন তার সঙ্গে থাকবার জন্যে।
হাশেম ততক্ষণে নেমে গেছে রাস্তায়।
রাস্তাটা বিকেলের আভায় শান্ত হয়ে আছে। দুধারের বাসাগুলো আড়াল পড়েছে সুন্দর করে ছাটা দেয়াল–গাছে। বাঁধানো নিকানো চত্বরের মতো ভ্রম সৃষ্টি করছে রাস্তায় পীচ।
বীথিকে দেখে হাশেম বলল, মা পাঠিয়ে দিলেন বুঝি? বেশ তো আয়, দুজনে মিলে বেড়ানো যাক।
হাশেম বীথিকে পেয়ে আশ্বস্ত হলো। এই মুহূর্তে কথা বলার একটি লোক দরকার। মাথার মধ্যে কথারা তখন থেকে জোট পাকাচ্ছে।
অনেকক্ষণ চুপচাপ হাঁটবার পর বীথি হঠাৎ শুধোয়, তুমি অমন করো কেন, হাশেম ভাই?
হাশেম মুখ উজ্জ্বল করে হাসে।
কী করি রে?
বীথি এই কটা দিনে হাশেমকে নিজের এত কাছে মনে করতে পেরেছে যে, সেই কথা জিগ্যেস করতে আর কোন বাধা নেই। বকুলের কথা ভাবতে থাকে বীথি। মুখে বলে, আর কেউ হলে বিছানা থেকে উঠতে পারত না।
আচমকা উত্তর আসে হাশেমের কাছে থেকে, তুই নিজেকে দিয়ে বুঝতে পারিস না?
কম্পিত কণ্ঠে বীথি বলে, না, কই?
পরে বলে, একটু একটু পারি।
হাশেম তখন আবার হাসে। বীথির কাঁধে হাত রেখে সন্ধ্যের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলে, বীথি, এ হচ্ছে একটা বন্ধন। তোর মানব–জন্মের মাশুল। দ্যাখ, আমি ধর্ম মানিনে, আমি কেবল একটা জিনিসেরই দাম দিই—-যাকে আলোকিত আত্মা বলি।
বীথি শুধোয়, বুঝতে পারলাম না কিন্তু।
হাশেম তখন বিশদ করে বলতে চেষ্টা করে, ভাল থেকে মন্দটা চিনে নেবার ক্ষমতা অর্জন। করা চাই, বীথি। এর কথাই বলছি, মানুষের জন্ম থেকে ঐ একটিই সাধনা। আর সব তো তার কাজ নয়, কাজের নামে ফাঁকি। বলেছি, ধর্ম মানিনে, তাহলে আমার বিশ্বাস কিসে? বিশ্বাস আমার তোর সবার অন্তরের পরে, বীথি। মনটাকে প্রথমে শিক্ষিত করে তুলতে হয়। একবার শিক্ষা শেষ হলে তার আর ভয় নেই। তখন মনের নির্দেশে সে যা কিছু করতে পারে, যা করবে সব ভাল।
বীথি বলে, দেশ শুদ্ধ মানুষকে কি এই বুঝিয়ে এলে, যে ওপরে কেউ নেই?
তা কেন? ঈশ্বর আছেন, নিশ্চয়ই আছেন। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে এতকাল যা শুনেছিস, সব মিথ্যে। তিনি আমার অপরাধের জন্যে দোজখে নেবেন না, পুণ্যের জন্যে বেহেশতের ডবল মালা গলায় পরিয়ে দেবেন না। আমরা সবাই তাঁর স্বর্গের আনন্দের অংশ। কিন্তু মানুষ তো? তাই পৃথিবীতে স্বর্গ সৃষ্টি করতে গিয়ে কেউ যদি অনাসৃষ্টি করে বসি তো তিনি ব্যথিত হন, শাস্তি দেন না, দিতে পারেনই না। সেইজন্যে তো বলি, বিশ্বাসকে বড় করে তোল। কী করে?
হাশেম এক মুহূর্তের জন্যে দাঁড়াল।
সবার মতো তুইও প্রশ্নটা করলি। ওইখানেই সবাই ভুল করে আমার কাছে হাত পেতে দাঁড়ায়। আমি নিজেই যে ভুগছি এইটে কেউ বুঝলো না, সাধু মনে করে সবাই পা জাড়িয়ে ধরলো। পাঁচটা বছর আমি স্থির থাকতে পারিনি রে।
বীথি মনে মনে হাশেমের কথাগুলো নিয়ে ভীষণ ভাবতে থাকে।
ভালোবাসতে শেখ, বীথি। খুব বড় করে ভালোবাসা। মানুষের সবচেয়ে বিচ্ছিরি, কিন্তু সবচেয়ে সুন্দর বৃত্তি ওইটে। যে স্বর্গে যাবার জন্যে মানুষের মাথা কুটে মরা, সেতো এই ভালোবাসারই রূপসৃষ্টি। এর পেছনে পরিকল্পনাটা দেখেছিস ঈশ্বরের? মানুষকে তিনি হাড় মাংসের ভেতরে এমন একা করে রেখেছেন যে, তাকে বেরুবার জন্যে সাধনা করতেই হবে। আত্মার এই বেরিয়ে আসা, এর নামই তো ভালোবাসা। কিন্তু এত যে বলছি, বোঝাতে পারব না তবু। নিজের রক্ত দিয়ে বুঝতে হয়।
বীথির কেমন ভয় করতে থাকে হাশেমের কথা শুনে। হাশেম কথা বলতে বলতে তাকে পেছনে ফেলে আপনমনেই হাঁটছে। নিজের মধ্যে আবার ডুবে গেছে লোকটা। বীথির দিকে যেন তার দৃষ্টিই নেই।
বীথি জোরে পা ফেলে তার সঙ্গ নিলে, হাশেম মুখ ফিরিয়ে বলে, ইস্, জীবনে এত অসংগতি, বীথি। মাহবুব এসেছিল না? ওর কথাই ধর। ইতিহাসে এম,এ, পড়ে ফার্স্ট ক্লাস পেল। কিন্তু কাজ নিল কী? কেরানির। যার সঙ্গে ইতিহাস জানার কোনো সম্পর্কই নেই। এখন আবার। দাঁড়িয়েছে প্যারেডের মাঠে। একটার সঙ্গে আরেকটার এত গরমিল যে দিনভোর হো হো করে হাসলেও তোর হাসি ফুরোবে না। তবু কি মাহবুব বুঝতে পারে? আসলে যে কাজ ওর। করার কথা তা হয়ত এ তিনটের একটাও না। অথচ বেশ আছে।
মাহবুবকে হঠাৎ নতুন আলোয় দেখতে পায় বীথি। বলে, হয়ত তাই।
হাশেম বলে, একী শুধু তার একার? সবার। মানুষের একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে, সে নিজের সাফাই চমৎকার সৃষ্টি করতে পারে। বড় বিচ্ছিরি ক্ষমতা। তাই আসলে যেখানে মানুষ মরে আছে, সেখানে সে ভাবে বেঁচে আছে। বেঁচে কজন থাকতে পারে, বীথি?
প্রশ্নটা করে নিজেই তার উত্তর ভাবতে থাকে হাশেম। পরে বলে, এত যে বকে চলেছি, রাস্তার মানুষ শুনলে মনে করবে, আমি পাগল। মনে করবে, পৃথিবীতে যুদ্ধ, খাদ্য বলে কোনো সমস্যাই নেই। তা কেন? বরং বাইরে থেকে এগুলোই তো প্রবল। কিন্তু ভেতরে? মানুষের আত্মার ভেতরে এত অরাজকতা, শূন্যতা চলছে যে তার একটা বিহিত না করলে। কী হবে ভেবে দেখেছিস? ভেতরের ফাঁকিটা ভরাবার জন্যে মানুষ নিজের সঙ্গে কেবলি ফাঁকি খেলছে এইটে বুঝতে পারিস না?
বীথির মনে হয়, হাশেম ভাই বেঁচে আছে।
হঠাৎ হাশেম তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, মানুষের আয়ু কত, বীথি?
বীথি ভাবতে ভাবতে উত্তর দেয়, চল্লিশ—- পঞ্চাশ ষাঠ আনকের আরো বেশি।
হাশেম বলল, এটা হচ্ছে মানুষের আরেকটা ফাঁকি। ধৃষ্টতাও বলতে পারিস।
শুনে বীথি অবাক চোখে তাকায়।
হাশেমের চোখে যেন মেঘের মতো ছায়া লেগেছে। সে বলে, মানুষের আয়ু আসলে একদিন দুদিন তিনদিন, বড়জোর চার দিন। কোনো মানুষের আয়ু আবার একেবারেই নেই। মরবার। সময় মানুষ এক মুহূর্তে পেছনের যে কটা দিনের কথা মনে করতে পারে, যে কটা দিনের জন্যে তার আবার জীবন শুরু করতে ইচ্ছে করে, সেই কটা দিনই তার আসল আয়ু। জীবনে এ রকম দিন দুটো তিনটের বেশি আসে না, বীথি।
বীথি তখন নিজের কথা ভাবতে থাকে। চোখ বুজে মনে করতে চেষ্টা করে, সে বেঁচে ছিল কটা দিন? অবাক হয়ে যায়, যখন তার চোখে ভেসে ওঠে সেই রাতটার কথা যে রাতে আবু তাকে নিয়ে বাগানে অশ্রান্ত গায়চারি করছিল আর বলছিল, তোকে কেন ডাকলাম, বীথি?
বীথি বিব্রত হয়ে পড়ে। আর তো সে মনে করতে পারছে না। তাহলে এই কি সে পরম দিন যেদিন তার জীবন ছিল সত্য, পৃথিবী ছিল আনন্দ?
হঠাৎ হাশেম বলে, বীথি, আমার আবার জ্বর আসছে নাকি দ্যাখতো?
উদ্বিগ্ন হয়ে সে হাশেমের হাত ধরে জ্বরটা বুঝতে চেষ্টা করে। বলে, কই না তো।
আসছে রে আসছে। আমি বুঝতে পারছি না? আজ আবার আমার খুব বকাবকি করতে ইচ্ছে করছে।
থাক, তোমাকে বকতে হবে না। ঘরে চলো।
হাশেমের সে কথা যেন কানেই যায় না। বলে, জীবনে বেঁচে থাকার দিন সৃষ্টি কর, বীথি। নইলে মানুষ হয়ে, অনুভূতির মত সাংঘাতিক সব বোমা বুকে নিয়ে জন্মালি কেন? দুজনে বাসায় ফিরে আসে। হাশেমের জ্বর সত্যি আবার এসেছে।
.
বীথি, বীথি, শোন।
বাতাসের মতো অতিদূর, কোমল, প্রায় ফিসফিস কণ্ঠ কাঁপন তোলে। রাত এখন অনেক। বীথির বড় আশা হয়, এই বুঝি সে আবার বেঁচে উঠল ভ্রম হয়, যেমন করে দল মেলে পদ্ম তেমনি করে কোথাও উন্মোচিত হচ্ছে তার জীবন। বীথি বাইরে এসে দেখে আবু তার জন্যে নতমুখে অপেক্ষা করছে। অন্যদিন হলে সে নিজেকে তার ডাকের মুখে পাথর করে রেখে বিছানায় পড়ে কাতরাতে; আজ যেন তার সম্মোহন লেগেছে।
তোর সঙ্গে কথা আছে, বীথি। বাগানে আসবি একবার?
বাগানে সেই পুরনো সিঁড়ির ধাপে বসলো বীথি আর আবু।
ঠাণ্ডা হাওয়ার জন্যে বীথি তার শাড়ির আঁচল ভালো করে গায়ে জড়িয়ে বেলি গাছটার দিকে তাকিয়ে রইল। সেদিন তার কী ভূতে পেয়েছিল, গাছটার অমন সর্বনাশ করে রেখেছে। আজ অবধি একটা নতুন কলিও আসে নি। তবুও কোথা থেকে কিসের সৌরভ ফুটে বেরিয়েছে। তুই আমাকে জ্বালাতেই এসেছিস, বীথি?
বীথি অবাক হয়ে যায়। অবাক হয়ে আবার চোখ নামিয়ে নেয়। তার প্রস্তুত মন যেন আর্তনাদ করে খানখান হয়ে ভেঙে যায়। বেঁচে উঠবার বাসনা ছিল বীথির। আজ যদি আবু বলত, তাহলে সে সব দিতে পারত।
আবু তাকে চুপ দেখে বলে, জ্বালানো নয়তো কী? আমি নাকি তোকে বিয়ে করবার জন্যে খেপে উঠেছি। শুনেছিস?
বীথির তখন উঠে চলে যেতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু শরীরের কী হয়েছে, যেন এইখানে তার জন্ম, এইখানে মৃত্যু।
আবার আবু বলে, কিরে, সবাই বলছে, তোর কানে যায় না?
বীথি কী উত্তর দেবে? অভিমান হয় প্রচণ্ড। বুকটা ফুলতে থাকে কবুতরের মতো। আবু তো ঠাস্ করে তাকে একথা বলতেই পারে। আবুর কি? তার কাছে সে তো কেবল অনুভূতি ঢালবার গেলাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। নইলে কোনদিন কী বীথির দিকে সে তাকিয়ে দেখেছে? এইতো এখনো যে আবু তার সম্মুখে আছে, যেন সে আদৌ এখানে নেই।
কিরে, কথা বলছিস না।
বীথি তখন উত্তর করে, আমি শুনিনি।
শুনে আবু তরংগের মতো ধ্বনি সৃষ্টি করে তার হাসিতে। বলে, সবাই কী একচোখো, বীথি। তোর সঙ্গে যে আমার ভালবাসা নেই, আমি তাকে যে একটুও ভালোবাসি না, এইটে কারো চোখে পড়ল না। চোখে পড়ল কখন তোর কাছে আসি, কখন তুই বেরোস আমার সঙ্গে, এইসব।
বীথি শিউরে উঠে। আবু তার চারধারে এমন এক কঠিন বৃত্ত টেনে আত্মমগ্ন হয়ে আছে যে। দেয়ালের ওপারে তাকাবার চোখ তার অন্ধ এখন।
শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে বীথি উচ্চারণ করল, কেন তুমি আমাকে টানো? আর টেনো না। আমি এসব কিছু বুঝি না। তোমার হাতে কি আমাকে মরতে বলো।
এতগুলো কথা একসঙ্গে কোনদিন বীথি বলেছে বলে আবুর মনে পড়ে না। অবাক হয়ে শুধোয়, তোর আজ কী হয়েছে?
কী হবে? কিছু না।
তারপর একটু থেমে যোগ করে, এ কথা বলবার জন্যে আমাকে এভাবে ডেকে না আনলেও হতো।
আবু হাসে।
কেন? কেউ দেখলে গুজবটা বিশ্বাস করবে। এই ভয়, না? একে তুই ভয় করিস?
ভয় করবো কেন? আমি তোমাকে ভালোবাসিনি। ভয় কিসের?
এই কথাটা বলতে গিয়ে তার যে কী কষ্ট হলো তা আবু জানতেও পারল না। বীথির সমস্ত স্নায়ু যেন টানটান হয়ে যোচড় খেতে লাগল। বীথি কাঠ হয়ে বসে রইল।
আবু নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বীথি, তুই আর আমার কাছে আসিস না, আমিও আসবো না। সাধ করে ক্ষতি ডেকে এনে লাভ কী?
বীথি ভাবে, এই যদি তার মৃত্যুর মুহূর্ত হয়, তাহলে পেছনে একটি মাত্র দিন শুধু রইল। আর কিছু না। একটা দিন কি একজন মানুষের অহংকারের জন্যে যথেষ্ট? মরতে তার ভয় করতে লাগল, যেন এখুনি সত্যি সত্যি তার মরণ আসছে।
অশান্ত উঠে দাঁড়ায় আবু।
তবু তো তুই আমাকে বুঝতে পারতি। আজ থেকে সে পথটাও বন্ধ করে দিলাম রে। মরতে হয়, আমি নিজের ভেতরেই মরে যাব।
চমকে ওঠে বীথি। আবুও যে মৃত্যুর কথা ভাবছে।
হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে আবু বলে, জানিস বীথি, আমি একটা পাথরকে ভালবেসেছি।
বলতে বলতে আবু যেন স্পষ্ট দেখতে পায় বিলকিসকে।
আমার ভাগ্যটা এমন কেন রে? কী দেখলাম আমি ওর? যেদিন প্রথম দেখলাম সেদিন মনে হলো, আমার জন্মের মুহূর্ত থেকে ও আমার এইখানটায় বাসা করে ছিল।
আবু হাত দিয়ে নিজের হৃদয় দেখায়। দেখিয়ে বিসদৃশ রকমে চুপ করে থাকে। এক সময়ে জেগে উঠে বলে, কোনদিন ভালবাসলে বুঝবি, এই অক্ষমতার বরফে পা রেখে দাঁড়িয়ে থাকাটা কী।
বলে আবু ফিরে যা বারান্দা দিয়ে। বারান্দা দিয়ে সিঁড়িতে, সিঁড়ি দিয়ে ওপর তলায় তার নিজের ঘরে। আবু যদি ফিরে আসত তাহলে দেখত, বীথির মাথার ভেতরে আবার সেই অবোধ্য যন্ত্রণা হচ্ছে, বীথি নিঃশব্দে কাঁপছে হাঁটুর ওপর মুখ নামিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।