৫. ক্ষতবিক্ষত একজন মানুষ
‘যদি সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতাম, তা হলে সাবধান থাকার চেষ্টা করতাম… কী বুঝিয়েছে লোকটা?’ জানতে চাইলাম আমি।
‘চার্লি মিডোস আসলে একটা বেকুব,’ বলল হোথর্ন। ‘ওর কথার মানে বুঝবার চেষ্টা করে লাভ নেই।
‘চার্লি? আপনি না বললেন জ্যাক?’
‘সবাই বলে, তাই আমিও বলেছি।’
ফুলহ্যাম ব্রডওয়ে স্টেশনের বাইরে একটা ক্যাফেতে বসে আছি আমরা। ধূমপান করছে হোথর্ন। মিডোস যেসব ডকুমেন্ট দিয়েছে ওকে, সেগুলো দেখেছে ইতোমধ্যে। আমাকেও দেখতে দিয়েছে।
মৃত্যুর আগে এবং পরে ডায়ানা ক্যুপারের কয়েকটা ফটোগ্রাফ পাওয়া গেছে। এবং মৃত্যুর আগে-পরে একই মানুষের শারীরিক পরিবর্তন দেখে রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে গেছি আমি। আন্দ্রিয়া কুভানেক যে-বর্ণনা দিয়েছিল মরদেহের, সেটার সঙ্গে যে-মানুষটা মঞ্চনাটক দেখে বেড়াতেন আর মেফেয়ারের দামি-দামি রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ খেতেন, তাঁর কোনো মিলই নেই।
ব্লুভানেক যা বলেছে পুলিশের কাছে, সেটা লিখিত আকারে আছে ওই ফাইলের ভিতরে:
.
সকাল এগারোটার দিকে কাজে আসি আমি। সাধারণত ওই সময় নাগাদই কাজ শুরু করি। বাড়ির ভিতরে ঢুকে দেখতে পাই মিসেস ক্যুপারকে, এবং সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারি, খুবই খারাপ কিছু-একটা ঘটেছে…
ফাইলের ভিতরে ওই মেয়ের একটা ছবি পাওয়া গেল। হালকাঁপাতলা শরীর, গোলগাল চেহারা। সে-চেহারা দেখতে কেমন ছেলেদের মতো। মাথায় খাটো আর খাড়া-খাড়া চুল। ছবিটা যখন তোলা হয়েছিল, তখন যেন আত্মরক্ষা করার কায়দায় তাকিয়ে ছিল ক্যামেরার দিকে। হোথর্ন বলেছে, মেয়েটার নাকি ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে। তারপরও ডায়ানা ক্যুপারের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এই মেয়েকে জোড়া দিতে পারছি না। মেয়েটাকে আসলে… খুনি হিসেবে মানাচ্ছে না একেবারেই। হোথর্ন যে-বর্ণনা দিয়েছে খুনির, তার তুলনায় খুবই ছোট হয়ে গেছে মেয়েটা।
আরও অনেক কিছু আছে এই ফাইলের ভিতরে। এবং সে-কারণে কেন যেন মনে হচ্ছে আমার, এখানে এই টেবিলে বসে কফি আর সিগারেট খেতে খেতে মিসেস ক্যুপারের হত্যারহস্যের সমাধান করে ফেলাটা সম্ভব হোথর্নের পক্ষে। তবে আমি চাই না সে-রকম কিছু ঘটুক। কারণ সেক্ষেত্রে খুবই ছোট হয়ে যাবে আমার বইটা। শেষপর্যন্ত হয়তো দেখা যাবে, উপন্যাসের বদলে কোনো একটা গল্প লিখে বসে আছি হোথৰ্নকে নিয়ে।
‘ওই লোকের সঙ্গে আপনার পরিচয় হলো কী করে?’ জিজ্ঞেস করলাম।
আনমনা হয়ে ছিল, তাই আমার প্রশ্নটা বুঝতে পারল না হোথর্ন। ‘কার কথা বলছেন?’
‘মিডোস।
‘পাটনির একই সাব কমান্ডে একসময় কাজ করতাম আমরা। ওর কথা বাদ দিন। ডায়ানা ক্যুপারকে নিয়ে কিছু বলতে চান?’
‘না। বরং আপনাকে নিয়ে কথা বলতে চাই।’
টেবিলের উপর ছড়িয়েছিটিয়ে রাখা কাগজগুলোর দিকে তাকাল হোথর্ন। কিছু বলল না।
কিন্তু আমিও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। ‘আপনাকে নিয়ে কাজ করতে হলে আপনার ব্যাপারে আরও অনেক কিছু জানতে হবে আমাকে।’
‘আমার ব্যাপারে কারও কোনো আগ্রহ নেই।’
‘কথাটা সত্যি হলে আজ এখানে থাকতাম না আমি। কথাটা সত্যি হলে আপনাকে নিয়ে যে-বই লিখবো, সেটা এককপিও বিক্রি হবে না।’
আরেকটা সিগারেট ধরাল হোথর্ন।
ওর দিকে তাকিয়ে আছি আমি। ‘দেখুন, হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় যে-মানুষটা, তাকে নিয়ে কিন্তু কাহিনি লেখে না কেউ। কাহিনি লেখা হয় ওই অপরাধ নিয়ে। লেখা হয় রহস্যটার সমাধান করে যে-গোয়েন্দা, তাকে নিয়ে। আপনার ব্যাপারে বই লেখার সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক বড় একটা ঝুঁকির মধ্যে আছি আমি আসলে। আপনি যদি এখনই সমাধান করে ফেলেন এই কেসের, তা হলে লেখার মতো কিছুই থাকবে না আমার হাতে। আর যদি সমাধান করতে না পারেন, সেক্ষেত্রে পুরো ব্যাপারটা সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই হবে না। কাজেই আপনার ব্যাপারে যত বেশি জানতে পারবো, আপনাকে তত মানবিকভাবে তুলে ধরতে পারবো পাঠকদের কাছে। কাজেই আমি যা-যা জিজ্ঞেস করবো, নিতান্ত অবহেলায় সেসব পাশ কাটিয়ে যাবেন না দয়া করে। আপনার আর আমার মাঝখানে এমন কোনো দেয়াল তৈরি করবেন না, যার আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারবেন আপনি।’
‘জ্যাক মিডোসকে নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না।’
‘বলার দরকারও নেই আপাতত। আপনার নিজের ব্যাপারে কিছু বলুন।’ সঙ্গে- আনা নোটবুকটা খুললাম আমি, কলম বের করলাম। ‘আপনি কোথায় থাকেন, তা- ও জানা নেই আমার।’
দ্বিধা করছে হোথর্ন।
আমার মনে হচ্ছে, পাথর ভেঙে সেটার ভিতর থেকে রক্ত বের করার চেষ্টা করছি। ‘গ্যান্টস হিলে থাকার মতো একটা জায়গা আছে আমার,’ শেষপর্যন্ত বলল হোথর্ন। ‘জায়গাটা উত্তর-পূর্ব লন্ডনের শহরতলীতে, সাফোকে যাওয়ার পথে।’
‘আপনি বিবাহিত?’
‘হ্যাঁ। তবে… একসঙ্গে থাকি না আমরা। এই ব্যাপারে আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না আমাকে।’
‘আপনি কি কোনো ফুটবল দলকে সমর্থন করেন?
‘আর্সেনাল।’
হোথর্নের বলার ভঙ্গিতে তেমন কোনো উৎসাহ টের পেলাম না। তার মানে খেলাধূলার প্রতি টান নেই ওর আসলে।
‘সিনেমা দেখেন?’
‘কখনও কখনও।’ অধৈর্য হয়ে উঠছে হোথৰ্ন।
‘গান শোনেন?’
‘মানে?’
‘ঠিক কী ধরনের গান শোনেন আপনি? ক্ল্যাসিকাল? জ্যাজ?’
‘গান তেমন একটা শোনা হয় না।’
‘ছেলে-মেয়ে আছে?’
দুই ঠোঁটের মাঝখান থেকে সিগারেটটা বের করল হোথর্ন। এমন এক ভঙ্গিতে সেটা ধরে আছে যে, দেখে মনে হচ্ছে, কোনো পয়জন ডার্ট ধরে আছে যেন। বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ছোঁ মেরে একটা কাগজ তুলে নিল টেবিলের উপর থেকে। ‘এসব দেখার কোনো আগ্রহ আপনার আছে কি নেই?’
তখনই বাসায় চলে যেতে পারতাম আমি। তখনই ভুলে যেতে পারতাম সব কিছু। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে ঘুরে এসেছি ওই ক্রাইমসিন থেকে। মনে হচ্ছে, ডায়ানা ক্যুপারকে যেন চিনি। যে-নৃশংসতার শিকার হয়েছেন তিনি, সেটার জন্য যেন একধরনের মায়া অনুভব করছি তাঁর প্রতি। মনে হচ্ছে, কিছু-একটা পাওনা আছেন তিনি আমার কাছে।
মনে হচ্ছে, ওই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে আরও অনেক কিছু জানার আছে আমার! ‘ঠিক আছে,’ নামিয়ে রাখলাম কলমটা। ‘দেখান।
মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে ছেলের কাছে টেক্সট মেসেজ পাঠিয়েছিলেন ডায়ানা ক্যুপার; হোথর্নের হাতে এখন যে-কাগজ আছে, সেটা ওই মেসেজেরই স্ক্রীনশট।
যে-ছেলেটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল, তাকে দেখেছি আমি এবং আমার ভয় লাগছে
‘কী জানতে পারলেন এই মেসেজ থেকে?’ জিজ্ঞেস করলাম।
‘মেসেজটা লিখে শেষ করার আগে, যে-কোনো কারণেই হোক না কেন, বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন মিসেস ক্যুপার। কারণ বাক্যের শেষে কোনো ফুলস্টপ নেই। কেন ভয় লাগছিল তাঁর, সেটা বলে যেতে পারেননি তিনি।’
‘অথবা… এ-রকমও হতে পারে, শুধুই ভয় লাগছিল মিসেস ক্যুপারের, অর্থাৎ বিশেষ কোনো কারণ ছিল না ব্যাপারটার।’
‘মিডোস হয়তো ঠিকই বলেছে। এই মেসেজের কোনো মানে নেই।’ আরও তিনটা কাগজ বের করল হোথর্ন। আজ থেকে দশ বছর আগে খবরের কাগজে প্রকাশিত আলাদা তিনটা আর্টিকেল।
.
ডেইলি মেইল, শুক্রবার, ৮ জুন ২০০১
সড়ক-দুর্ঘটনায় এক বালক নিহত
তার যমজ ভাইয়ের অবস্থা গুরুতর, তবে ডাক্তাররা বলছেন, বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে ছেলেটার।
আট বছর বয়সী একটা ছেলে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। একই দুর্ঘটনায় মারা গেছে তার যমজ ভাই। তাদের দু’জনকে চাপা দিয়ে পালিয়ে গেছে ক্ষীণ দৃষ্টির অধিকারী এক গাড়িচালক।
বেঁচে যাওয়া ছেলেটার নাম জেরেমি গডউইন। তবে তার সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। এমনকী চিড় ধরেছে খুলিতেও। মস্তিষ্কেও আঘাত পেয়েছে বেচারা। আর তার ভাই টিমোথি প্রাণ হারিয়েছে ঘটনাস্থলেই।
বৃহস্পতিবার বিকেলে সাড়ে চারটার দিকে ঘটে ওই দুর্ঘটনা। কেন্টের ডিলের কোস্টাল রিসোর্টে, দ্য মেরিনে ঘটেছে ঘটনাটা।
ওই দুই ছেলে, প্রত্যক্ষদর্শীরা যাদেরকে ‘অবিচ্ছেদ্য’ বলে বর্ণনা করেছে, তাদের আয়া ২৫-বছর-বয়সী মেরি ও’ব্রায়ানের সঙ্গে হোটেলে ফিরছিল। মেয়েটা পুলিশকে জানিয়েছে, রাস্তার একটা কোনা ঘুরে হঠাৎ হাজির হয় গাড়িটা। গতি কমানোর কোনো চেষ্টাই নাকি করেনি চালক। ওই গাড়ি চালাচ্ছিলেন এক মহিলা; দুই ভাইকে চাপা দিয়ে চলে যান তিনি।
গত তিন বছর ধরে জেরেমি আর টিমোথির দেখভাল করছিল মেরি। গাড়িচালক ওই মহিলা যে চাপা দিয়ে চলে গেছেন ছেলে দুটোকে, সেটা বিশ্বাসই করতে পারছে না সে।
এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ৫২ বছর বয়সী এক মহিলাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
.
দ্য টেলিগ্রাফ, শনিবার, ৯ জুন ২০০১
ক্ষীণ দৃষ্টির অধিকারী এক গাড়িচালককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ
টিমোথি গডউইন নামের আট-বছর-বয়সী একটা ছেলেকে গাড়িচাপা দিয়ে হত্যার অভিযোগে এক মহিলাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ওই একই ঘটনায় গুরুতরভাবে আহত হয়েছিল টিমোথির যমজ ভাই। গ্রেপ্তারকৃত মহিলার নাম ডায়ানা ক্যুপার। ৫২ বছর বয়সী মিসেস ক্যুপার অনেক বছর ধরে বাস করছেন কেন্টের ওয়ালমারে। পুলিশকে তিনি জানিয়েছেন, রয়্যাল সিঙ্ক পোর্টের গল্ফ ক্লাব থেকে ফিরছিলেন গাড়ি চালিয়ে, আর তখনই ঘটে দুর্ঘটনাটা।
জানা গেছে, ওই ক্লাবে বন্ধুদের সঙ্গে মদ্যপান করেছিলেন মিসেস ক্যুপার। তবে গতিসীমা ছাড়িয়ে যাননি তিনি গাড়ি চালানোর সময়। প্রত্যক্ষদর্শীরাও জানিয়েছে, দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন না তিনি। তবে সে-সময় চশমা ছিল না তাঁর চোখে। পরে পুলিশি এক পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে, চশমা ছাড়া ২৫ ফুট দূরের রেজিস্ট্রেশন প্লেট পড়তে পারেন না তিনি।
এ-ব্যাপারে তাঁর উকিলরা যে-বিবৃতি দিয়েছেন, সেটা নিম্নরূপ:
‘দুর্ঘটনাটা যেদিন ঘটেছে, সেদিনের বিকেলটা ওই ক্লাবে গল্ফ খেলে কাটিয়ে দিয়েছেন আমাদের মক্কেল। গাড়ি চালিয়ে যখন বাসায় ফিরে যাচ্ছিলেন তিনি, তখনই ঘটে ঘটনাটা। দুর্ভাগ্যবশত এবং ভুলক্রমে চশমা ফেলে যান তিনি, কিন্তু ভেবে নিয়েছিলেন, ওটা ছাড়াই গাড়ি চালাতে পারবেন, কারণ ওই ক্লাব থেকে তাঁর বাসার দূরত্ব বেশি না। পরে অবশ্য স্বীকার করেছেন, যখন টের পান দুর্ঘটনাটা ঘটিয়ে ফেলেছেন, তখন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন; আর তাই তাড়াহুড়ো করে সোজা ফিরে গিয়েছিলেন বাসায়। তারপরও ঘটনাটার গুরুত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল আছেন তিনি। এবং সেদিন রাতেই, অর্থাৎ ওই ঘটনার দু’ঘণ্টার মধ্যে, স্বেচ্ছায়-সজ্ঞানে যোগাযোগ করেছিলেন পুলিশের সঙ্গে।’
১৯৮৮ সালের রোড ট্রাফিক অ্যাক্টের সেকশন ১ এবং ১৭০ (২) ও (৪)-এর অধীনে মিসেস ক্যুপারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে পুলিশ। সে-অভিযোগে বলা হয়েছে, বিপজ্জনকভাবে গাড়ি চালিয়ে নিষ্পাপ ও নিরপরাধ একটি শিশুর প্রাণহানির কারণ হয়েছেন তিনি। যখন ঘটেছে ঘটনাটা, তখন থামাতে পারেননি গাড়িটা।
ওয়ালমারের লিভারপুল রোডের একটা বাড়িতে থাকেন মিসেস ক্যুপার। কিছু দিন আগে স্বামীকে হারিয়েছেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থতায় ভুগছিলেন ওই ভদ্রলোক। তাঁদের একমাত্র সন্তান ২৩ বছর বয়সী ড্যামিয়েন ক্যুপার। জানা গেছে, তিনি একজন অভিনেতা। রয়্যাল শেক্সপিয়ার কোম্পানির হয়ে বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেছেন। সর্বশেষ অভিনয় করেছেন ওয়েস্ট এন্ড স্টেজে দ্য বার্থডে পার্টি নামের নাটকে।
.
দ্য টাইমস, মঙ্গলবার, ৬ নভেম্বর ২০০১
ঘাতক চালক মুক্ত, দুর্ঘটনার শিকার পরিবার দাবি জানাল আইন পরিবর্তনের সড়ক-দুর্ঘটনায় নিহত আট বছর বয়সী এক ছেলের মা আজ মুখ খুলেছেন সাংবাদিকদের কাছে। অথচ ওই দুর্ঘটনা যার কারণে ঘটেছিল, ঘাতক সেই চালককে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে। কেন্টের সমুদ্র-তীরবর্তী শহর ডিলে রাস্তা পার হওয়ার সময় গাড়িচাপা পড়ে মারা যায় দুর্ভাগা ছেলেটা।
ওই ছেলের নাম টিমোথি গডউইন। ঘটনাস্থলেই মারা যায় সে। একই ঘটনায় গুরুতরভাবে আহত হয় তার যমজ ভাই জেরেমি। গাড়িচালক ৫২ বছর বয়সী ডায়ানা ক্যুপার নাকি দেখতেই পাননি ছেলে দুটোকে। জানা গেছে, মিসেস ক্যুপার সেদিন গল্ফ খেলতে গিয়েছিলেন নিকটস্থ এক ক্লাবে, আর সেখানেই নিজের চশমা ফেলে এসেছিলেন ভুলক্রমে। চশমা ছাড়া বিশ ফুট দূরের জিনিসও ঠিকমতো দেখতে পান না তিনি।
কেন্টারবারি ক্রাউন কোর্ট রায় দিয়েছে, চশমা না-পরে আইনবিরোধী কোনো কাজ করেননি মিসেস ক্যুপার। জাজ নাইজেল ওয়েস্টন বলেছেন, ‘চশমা ছাড়া গাড়ি চালানো বুদ্ধিমানের কাজ না, কিন্তু প্রচলিত আইনের কোথাও বলা হয়নি, ক্ষীণ দৃষ্টির অধিকারী কাউকে অবশ্যই চশমা পরে গাড়ি চালাতে হবে। আর সে-কারণেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, অভিযুক্ত মানুষটার বিরুদ্ধে যদি কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়, তা হলে সেটা যথোপযুক্ত হবে না।’
তবে মিসেস ক্যুপারকে আগামী এক বছরের জন্য সব ধরনের মোটরযান চালানোর ব্যাপারে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। নয়টি পেনাল্টি পয়েন্ট যুক্ত হয়েছে তাঁর ড্রাইভিং লাইসেন্সের সঙ্গে। এবং তাঁর জন্য জরিমানা ধার্য করা হয়েছে ৯০০ পাউন্ড।
আদালতকক্ষের বাইরে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় দুর্ঘটনার শিকার-হওয়া ছেলেটির মা জুডিথ গডউইনের। তিনি বলেছেন, ‘চোখে দেখে না এমন কারও বসা উচিত না গাড়ির ড্রাইভিং সিটে। ব্যাপারটা যদি আইনবিরোধী কিছু না-হয়ে থাকে, তা হলে অবশ্যই আইন পরিবর্তন করা উচিত। আমার ছেলে মারা গেছে। আরেক ছেলে বলতে-গেলে পঙ্গু হয়ে গেছে। ওদিকে নামকাওয়াস্তে কিছু জরিমানা ধার্য করে বেকসুর খালাস দিয়ে দেয়া হয়েছে ঘাতক ওই মহিলাকে। এটা মোটেও ঠিক না।
এদিকে রোড সেফটি চ্যারিটি ‘ব্রেক’-এর একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘গাড়ি সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না এমন কারও গাড়ি চালানো উচিত না।
.
আর্টিকেল তিনটার তারিখগুলোর উপর আরও একবার নজর বুলালাম আমি, ওগুলোর মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করতে বেশি সময় লাগল না আমার। বললাম, ‘ঠিক দশ বছর আগের ঘটনা এসব।’
‘ন’বছর এগারো মাস,’ আমার ভুল শুধরে দিল হোথর্ন। ‘জুনের শুরুর দিকে ঘটেছিল ওই দুর্ঘটনা।
‘দশ বছর পূর্তি হিসেবেই ধরে নেয়া যায় ঘটনাটাকে। …বেঁচে যাওয়া ছেলেটা… জেরেমি গডউইন… আর্টিকেল পড়ে বোঝা গেল মস্তিষ্কে বড় রকমের কোনো ক্ষতি হয়ে গেছে বেচারার।’ ডায়ানা ক্যুপারের টেক্সট মেসেজের কপিটা তুলে নিলাম হাতে। ‘যে-ছেলেটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল…’
‘কী মনে হচ্ছে আপনার? ওই দুর্ঘটনা আর মিসেস ক্যুপারের হত্যাকাণ্ডের মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে?’
‘জুডিথ গডউইন কোথায় থাকেন, জানা আছে আপনার?’ জবাব না-দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলাম।
ফাইলের কাগজপত্র কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করে হোথর্ন বলল, ‘হ্যারো-অন-দ্য- হিলের একটা ঠিকানা পাওয়া গেছে।’
‘তার মানে কেন্টে না?’
‘গডউইন পরিবার হয়তো ছুটিতে ছিল। জুনের প্রথম সপ্তাহ… তার মানে তখন গ্রীষ্মকাল চলছিল।
‘ওই মহিলার সঙ্গে কি দেখা করতে যাবো আমরা?’
‘তাড়াহুড়োর কিছু নেই। তা ছাড়া মিস্টার কর্নওয়ালিসের সঙ্গে মিটিং করার কথা আছে আমাদের।’
সহসা মনে করতে পারলাম না নামটা। কথাটা বললাম হোথৰ্নকে।
‘আন্ডারটেকার,’ মনে করিয়ে দিল সে। কাগজপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে, সব ঢোকাচ্ছে ফাইলের ভিতরে।
তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি ওর কাজ। ভাবছি, ওকে যতটা অপছন্দ করে ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মিডোস, ঠিক ততটাই পছন্দ করে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কেউ একজন অথবা একাধিক কর্মকর্তা। নইলে ওর কথামতো ক্রাইমসিন ওভাবে রাখত না পুলিশ, ওর অনুরোধে আমাকেও ঢুকতে দেয়া হতো না সেখানে।
সিগারেট শেষ করে উঠে দাঁড়াল হোথর্ন। ‘চলুন।
কফির দাম আরও একবার চুকাতে হলো আমাকে।
১৪ নম্বর বাসে সওয়ার হয়ে আমরা দু’জন পৌঁছে গেলাম ফুলহ্যাম রোডে। ডায়ানা ক্যুপার যেদিন খুন হয়েছেন, সেদিন তিনিও চড়েছিলেন এই বাসে। সেই ফিউনারেল পার্লারে যখন ঢুকছি, ঘড়িতে তখন বারোটা ছাব্বিশ।
যে-রকম বর্ণনা করেছিলাম আগে, পার্লারটা সে-রকমই। আইরিন লযের সামনে গিয়ে হাজির হলো হোথর্ন, পরিচয় দিল নিজের। ওই মহিলা আমাদেরকে সোজা নিয়ে গেল রবার্ট কর্নওয়ালিসের কাছে। করিডরের শেষপ্রান্তে কর্নওয়ালিসের অফিস।
আমাদেরকে অফিসরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেল না আইরিন, বরং বসে পড়ল একধারের একটা চেয়ারে। এমন একটা ভাব ফুটে আছে তার চেহারায় যে, দেখে মনে হচ্ছে, তার দোষেই অকালমৃত্যুর শিকার হয়েছেন ডায়ানা ক্যুপার। হয়তো ভাবছে, কর্নওয়ালিসের পাশাপাশি তাকেও কিছু-না-কিছু জিজ্ঞেস করা হবে।
একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম। আমাকে কর্নওয়ালিস অথবা আইরিনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল না হোথর্ন। ওই দু’জন হয়তো আমাকে হোথর্নের সহকারী ভেবে নিল।
‘পুলিশের সঙ্গে ইতোমধ্যে কথা বলেছি আমি,’ শুরু করল কর্নওয়ালিস।
‘হ্যাঁ, স্যর।’
কর্নওয়ালিসকে ‘স্যর’ বলে সম্বোধন করল হোথর্ন… ঘটনাটা ইন্টারেস্টিং মনে হলো আমার। একটা ব্যাপার খেয়াল করেছি, সাক্ষী বা সন্দেহভাজন অথবা তদন্তের কাজে সহায়তা করতে পারে এ-রকম কোনো লোকের সঙ্গে যখন কথা বলে সে, তখন ওই লোকদের কাছে নিজেকে উপস্থাপন করে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক কায়দায়। খুব সাদামাটা হয়ে যায় তখন, তোষামুদে একটা ভাব কাজ করতে থাকে ওর ভিতরে। এবং, যতদূর মনে হয় আমার, ইচ্ছাকৃতভাবে করে কাজটা। ওর সেই সাদামাটা আর তোষামুদে ভাবের কারণে, আত্মসংবরণের স্বাভাবিক যে-তাগিদ থাকে কোনো মানুষের ভিতরে, সেটা কমবেশি নষ্ট হয়ে যায়। তা ছাড়া, আমার মনে হয়, হোথর্নের ওই ভাব আসলে একটা মুখোশ… সেটার কারণে লোকে ঠাহর করতে পারে না, ঠিক কী ধরনের লোক সে। ঠাহর করতে পারে না, ওই মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থেকে লোকের কর্মকাণ্ডের চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে সে। বিনয় বা ভদ্রতা আসলে ওর জন্য একজাতের সার্জিকাল মাস্ক! সার্জনরা যেমন হাতে স্কালপেল নেয়ার আগে ওই মাস্ক পরেন, ওর কাজও অনেকটা তেমন।
–
‘যেদিন যেভাবে মারা গেছেন মিসেস ক্যুপার,’ বলল হোথর্ন, ‘সেটা খুবই অস্বাভাবিক। আর সে-কারণেই আমাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে এই কেসে… পুলিশের কাজে সহায়তা করার জন্য। আপনাদের সময় নষ্ট করছি… আমি আসলে খুবই দুঃখিত…’ ক্রুর হাসি হাসল। ‘যদি সিগারেট খাই, তা হলে কি কিছু মনে করবেন?’
‘আসলে…’
কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। ইতোমধ্যেই দুই ঠোঁটের মাঝখানে একটা সিগারেট গুঁজে দিয়েছে হোথর্ন। এবং ইতোমধ্যেই জ্বলে উঠেছে ওর লাইটার। ভ্রূ কুঁচকে গেছে আইরিন লযের, দস্তানির্মিত একটা পিরিচ ঠেলে দিল সে হোথর্নের সামনে… যাতে ওটা অ্যাশট্রে হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
হোথর্ন নাকমুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে কর্নওয়ালিসকে বলল, ‘মিসেস ক্যুপারের সঙ্গে সেদিন দেখা হওয়ার পর তাঁর সঙ্গে যা-যা কথা হয়েছে আপনার, সেগুলো আরেকবার বলবেন?’
হোথর্নের কথামতো কাজ করল কর্নওয়ালিস। যা বলল, তার প্রায় সবই মিলে গেল এই উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়ের সঙ্গে।
লোকটার কথা শেষ হওয়ার পর হোথর্ন জানতে চাইল, ‘মিসেস ক্যুপার কতক্ষণ ছিলেন আপনার সঙ্গে?’
কিন্তু কর্নওয়ালিস কিছু বলার আগে আইরিন বলে উঠল, ‘পনেরো মিনিটের কিছু বেশি।’
‘আপনাদেরকে পারিশ্রমিক বাবদ ঠিক কত টাকা দেয়ার কথা ছিল মিসেস ক্যুপারের?’
‘তিন হাজার এক শ’ সত্তর পাউন্ড,’ এবারও জবাব দিল আইরিন।
‘তিনি কি টাকাটা ক্রেডিট কার্ডের সাহায্যে পরিশোধ করেছেন?’
‘হ্যাঁ। পুরোটা।’
‘তিনি যখন এসেছিলেন এখানে, তখন তাঁর মেজাজমর্জি ঠিক কী রকম ছিল?’
‘আমাদের অন্য সব কাস্টোমারের মতোই,’ এবার মুখ খুলল কর্নওয়ালিস। ‘প্রথমদিকে কিছুটা অস্বস্তিতে ভুগছিলেন। তারপর আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসেন।’
‘আপনি বলেছেন, যা-যা চাহিদা ছিল ওই ভদ্রমহিলার, সব একটা কাগজে লিখে এনেছিলেন তিনি।’
‘হ্যাঁ।’
‘কাগজটা আছে আপনার কাছে?’
‘না। চলে যাওয়ার সময় ওটা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তবে আমি একটা কপি বানিয়ে নিয়েছি তাঁর সেই ফরমায়েশের।’
‘তিনি কি কোনো রকম তাড়াহুড়ো করছিলেন?’
‘আপনি বোধহয় জানতে চাইছেন, তাঁর ভাবভঙ্গি দেখে, তিনি বিপদে পড়েছিলেন কি না সেটা বোঝা যাচ্ছিল কি না। …না, সে-রকম কিছু মনে হয়নি আমার।’ মাথা নাড়ল কর্নওয়ালিস। ‘নিজের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের পরিকল্পনা করাটা অস্বাভাবিক কিছু না, মিস্টার হোথর্ন। মিসেস ক্যুপার অসুস্থ ছিলেন না। তিনি এমনকী নার্ভাস বা ভীতও ছিলেন না। কথাটা ইতোমধ্যে জানিয়েছি পুলিশকে।’
‘তাঁকে ফোন করেছিলেন কেন আপনি?’
‘কী বললেন?’
‘মিসেস ক্যুপারের ফোন রেকর্ড আছে আমার কাছে। সেটাতে দেখা যাচ্ছে, যেদিন খুন হয়েছেন তিনি, সেদিন দুপুর দুটো পাঁচ মিনিটে তাঁকে ফোন করেছিলেন আপনি। তিনি তখন মাত্র হাজির হয়েছেন গ্লোব থিয়েটারে… বোর্ড মিটিং চলছিল সেখানে। আপনি মিনিট দেড়েক কথা বলেছেন তাঁর সঙ্গে।
‘ঠিক। তাঁর স্বামীকে যে-জায়গায় কবর দেয়া হয়েছে, সে জায়গার প্লট নম্বরটা দরকার ছিল আমার।’ একটুখানি হাসল কর্নওয়ালিস। ‘ওই জায়গা মিসেস ক্যুপারের জন্য নিবন্ধন করাতে হলে রয়্যাল পার্ক চ্যাপেল অফিসে যোগাযোগ করার দরকার ছিল। এই তথ্য আমাকে জানাননি মিসেস ক্যুপার। এখানে একটা কথা বলে রাখি। আমি যখন ফোন করলাম তাঁকে, তখন কথা কাটাকাটির আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলাম বলে মনে হয়েছিল। আমার কল রিসিভ করার আগে বোধহয় কারও সঙ্গে তর্কাতর্কি করছিলেন মিসেস ক্যুপার। তিনি আমাকে বলেছিলেন, পরে ফোন করবেন। কিন্তু সে-ফোন আর করা হলো না তাঁর।’
‘হুঁ। আপনারা দু’জনই কি সেদিন কথা বলেছিলেন মিসেস ক্যুপারের সঙ্গে?’
‘রিসিপশন এরিয়ায় তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা হয়েছিল আমার,’ বলল আইরিন। ‘কিন্তু তাঁকে পথ দেখিয়ে এখানে নিয়ে আসার পরই চলে যাই আমি।’
‘আচ্ছা, এ-রকম কি হয়েছে… এখানে কিছুক্ষণের জন্য সম্পূর্ণ একা ছিলেন মিসেস ক্যুপার?
ভ্রূ কুঁচকে গেল কর্নওয়ালিসের। ‘কী অদ্ভুত প্রশ্ন! কেন জানতে চাইছেন কথাটা?’
‘কৌতূহল হচ্ছে, তাই।’
‘না, এখানে একা ছিলেন না মিসেস ক্যুপার। তাঁর সঙ্গে সারাটা সময় ছিলাম আমি।’
‘তবে…’ দ্বিধা করছে আইরিন, কথাটা বলবে কি না ভাবছে হয়তো, শেষপর্যন্ত বলেই ফেলল, ‘চলে যাওয়ার আগে ক্লোকরুমটা ব্যবহার করেছিলেন মিসেস ক্যুপার।’
‘ক্লোকরুম মানে টয়লেট?’
‘হ্যাঁ। শুধু ওই সময়টুকুই একা ছিলেন তিনি। সেখান থেকে বের হয়ে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে চলে যান। আরেকটা কথা। যখন চলে যাচ্ছিলেন তিনি, তখন… বেশ… কী বলবো… প্রসন্ন মনে হচ্ছিল তাঁকে।’
বুঝতে পারার ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল হোথর্ন, উঠে দাঁড়াল।
এমন সময় একটা কথা মনে পড়ে গেল আমার। বললাম, ‘টিমোথি গডউইন নামের কারও ব্যাপারে কি কোনো কথা বলেছিলেন মিসেস ক্যুপার?’
‘টিমোথি গডউইন?’ মাথা নাড়ল কর্নওয়ালিস। ‘কে সে?’
‘আজ থেকে বছর দশেক আগে মিসেস ক্যুপারের গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মারা গিয়েছিল ছেলেটা। একই দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিল ওই ছেলের যমজ ভাই জেরেমি গডউইন …
‘কী সাংঘাতিক!’ আইরিনের দিকে তাকাল কর্নওয়ালিস। ‘ওই দুই ভাইয়ের নাম কি তোমাকে বলেছিলেন মিসেস ক্যুপার?’
‘না।’
হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল হোথর্ন। ‘সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ, মিস্টার কর্নওয়ালিস।’
রাস্তায় বের হয়েই আমার মুখোমুখি হলো সে। ‘দয়া করে আমার একটা উপকার করুন। এর পরে যতবার থাকবেন আমার সঙ্গে, কাউকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। ঠিক আছে?’
‘মানে? আপনার সঙ্গে চুপচাপ বসে থাকবো, কিন্তু কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারবো না?’
‘ঠিক তা-ই।’
‘কেন, আমাকে কি বোকা বলে মনে করেন? আপনার কাজে সাহায্য করার সামর্থ্য আছে আমার।’
‘হ্যাঁ, তা হয়তো আছে, কিন্তু আপনি নিজেই বলেছেন, এই উপন্যাস আসলে একটা গোয়েন্দাকাহিনি। আর আমিই সেই গোয়েন্দা। কাজেই জিজ্ঞাসাবাদের দায়িত্বটা আমার উপরই ছেড়ে দিন দয়া করে।
‘ঠিক আছে, দিলাম। এবার বলুন কী জানতে পারলেন। ক্রাইমসিনে গিয়েছিলেন আপনি। মিসেস ক্যুপারের ফোন রেকর্ড দেখেছেন। আন্ডারটেকারের সঙ্গে কথা বলেছেন। বলুন, কী কী জানতে পারলেন?’
‘জানতে পেরেছি, ডায়ানা ক্যুপার জানতেন, তিনি মরতে চলেছেন।’
অপেক্ষা করছি… হয়তো আরও কিছু বলবে হোথর্ন।
কিন্তু আর কিছু বলল না সে, ঘুরে হনহন করে হাঁটতে লাগল ফুটপাত ধরে। কী করবো, ভাবলাম কিছুক্ষণ। তারপর অনুসরণ করতে শুরু করলাম হোথৰ্নকে।
ওর সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটাটা কষ্টকর।
৬. সাক্ষীদের বিবৃতি
ডায়ানা ক্যুপারকে তেমন একটা চিনতাম না আমি। কিন্তু এটা জানতাম, তাঁকে খুন করতে চাইবে, এ-রকম লোকের সংখ্যা নিতান্তই হাতেগোনা। তিনি ছিলেন বিধবা, নিজের মতো থাকতেন। তিনি যে খুব ধনী ছিলেন তা না, কিন্তু সচ্ছ্বল ছিলেন। একটা থিয়েটারের বোর্ড অভ ডিরেক্টর্সে ছিলেন। আর ছিলেন বিখ্যাত এক লোকের মা। ঘুমের সমস্যা ছিল তাঁর। আর ছিল একটা বিড়াল। মঞ্চনাটক প্রযোজনা করেন এ-রকম এক লোককে টাকা দিয়ে সে-টাকা খুইয়েছিলেন। নিজের বাসায় ক্লিনার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন এমন এক মেয়েকে, যার ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে। কিন্তু ওই প্রযোজক অথবা ওই ক্লিনার মেয়েটা কেন খুন করতে চাইবে তাঁকে? ঠিক জানি না।
ছোট একটা ছেলেকে, সত্যি বলতে কী, হত্যা করেছিলেন তিনি। গুরুতরভাবে জখম করেছিলেন ওই ছেলের ভাইকে। দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল মিসেস ক্যুপারেরই বেপয়োরা আচরণের কারণে… চশমা ছাড়া দূরের জিনিস দেখতে পেতেন না, অথচ সেদিন ড্রাইভিঙের সময় পরেননি ওটা। তার চেয়েও খারাপ কথা, ছেলে দুটোকে গাড়িচাপা দিয়ে থামেননি, বরং একটানা ড্রাইভিং করে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন নিজের বাসায়। এবং এত বড় একটা ঘটনার পরও বেকসুর খালাস পেয়ে গেছেন আদালত থেকে। আমি যদি টিমোথি আর গডউইনের বাবা হতাম, মিসেস ক্যুপারকে নিজহাতে খুন করার ইচ্ছা হয়তো জেগে উঠত আমার মনে।
ওই দুর্ঘটনাই কি ডায়ানা ক্যুপারের হত্যাকাণ্ডের মোটিভ?
এখন কথা হচ্ছে, গডউইন পরিবার যদি উত্তর লন্ডনের হ্যাঁরো-অন-দ্য-হিলের
বাসিন্দা হয়ে থাকে, তা হলে সেখানে কেন যাচ্ছি না আমরা?
কথাটা জিজ্ঞেস করলাম হোথর্নকে।
‘একবারে একটা পদক্ষেপ,’ মনে করিয়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বলল সে। ‘আমি
আগে আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে চাই।’
‘আরও কয়েকজন? মানে সেই ক্লিনার মেয়েটা?’
চলন্ত একটা ট্যাক্সির পেছনের সিটে পাশাপাশি বসে আছি আমরা দু’জন। অ্যাক্টনের শেফার্ড বুশে যাচ্ছি… সেখানেই থাকে আন্দ্রিয়া কুভানেক। রেমন্ড ক্লন্সকেও ফোন করেছিল হোথর্ন। ওই লোকের সঙ্গেও দেখা করতে যাওয়ার কথা আছে আমাদের।
হোথর্ন জবাব না-দেয়ায় আবার বললাম, ‘আন্দ্রিয়া কুভানেককেও কি সন্দেহ করছেন আপনি?’
‘করছি। কারণ পুলিশের কাছে মিথ্যা কথা বলেছিল সে
‘আর কুন্স? এসবের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা কী?’
‘মিসেস ক্যুপারকে ভালোমতোই চিনতেন কুন্স। একটা গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মহিলা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন, শতকরা আটাত্তর ভাগ ক্ষেত্রে খুনিদের সঙ্গে পূর্বপরিচয় থাকে তাঁদের।’
‘আসলেই?’
‘কেন, জানেন না? আমি তো ভেবেছিলাম জানেন। নাটক-সিনেমা লেখেন, আপনার তো জানার কথা।’ ট্যাক্সির ভিতরে ‘নো-স্মোকিং’ লেখা একটা বাতি জ্বলছে; কিন্তু সে-অনুরোধ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নিজের পাশের জানালার কাঁচ নামিয়ে দিল হোথর্ন বাটন-চেপে, তারপর একটা সিগারেট ধরাল। ‘স্বামী, সৎ বাপ, প্রেমিক… পরিসংখ্যান বলছে, সাধারণত এসব লোকই খুন করে মহিলাদেরকে।’
‘কিন্তু আপনি যেসব সম্পর্কের কথা বললেন, রেমন্ড কুন্সের সঙ্গে সেসবের কোনোটাই ছিল না মিসেস ক্যুপারের।’
‘ছিল না জানলেন কী করে? রেমন্ড ক্লন্স তো মিসেস ক্যুপারের প্রেমিকও হতে পারেন?’
‘ছেলের কাছে পাঠানো টেক্সট মেসেজে মিসেস ক্যুপার কী লিখেছিলেন, ভুলে যাচ্ছেন কেন? ক্ষতবিক্ষত ওই ছেলেটাকে দেখে ফেলেছিলেন তিনি, এবং সে- কারণে ভয় লাগছিল তাঁর। …আপনি আসলে কেন শুধু শুধু সময় নষ্ট করছেন, বুঝতে পারছি না।’
‘চলন্ত ট্যাক্সিতে সিগারেট খাওয়া নিষেধ,’ ইন্টারকমে শোনা গেল ড্রাইভারের অভিযোগ।
জবাবে বিশ্রী একটা গালি দিল হোথর্ন। তারপর বলল, ‘আমি পুলিশের একজন অফিসার।’ খোলা জানালা দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল, কিন্তু হু-হুঁ বাতাস সে-ধোঁয়া ফিরিয়ে নিয়ে এল ট্যাক্সির ভিতরে। ‘আমি আসলে কাজ শুরু করতে চাইছি এমন কিছু লোককে দিয়ে, যাঁদের সঙ্গে কোনো-না-কোনো সম্পর্ক ছিল মিসেস ক্যুপারের। যাঁদেরকে কোনো-না-কোনোভাবে চিনতেন তিনি।’ তাকাল আমার দিকে। ‘আপনার কোনো সমস্যা আছে?’
‘লন্ডনের এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ানোটা আসলে পাগলামি বলে মনে হচ্ছে আমার। তা-ও আবার আমার পকেটের পয়সায়।’
আর কিছু বলল না হোথৰ্ন।
বিরক্তিকর যাত্রা সব সময়ই দীর্ঘ বলে মনে হয়। সে-রকম একটা যাত্রা শেষ করে আমাদের ট্যাক্সিটা থামল সাউথ অ্যাক্টন এস্টেটের সামনে।
চারপাশে এখন স্ল্যাব ব্লক আর উঁচু উঁচু দালানের সারি। এসব দালান কয়েক দশক ধরে আছে এখানে। লন, গাছ, ফুটপাত ইত্যাদিও আছে আমাদের আশপাশে।
একটা স্কেটবোর্ড পার্কের পাশ দিয়ে হাঁটা ধরলাম আমরা। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির হলাম একটা আন্ডারপাসে, ঢুকে পড়লাম সেটার ভিতরে। রঙ দিয়ে আজেবাজে কিছু ছবি এঁকে রাখা হয়েছে দু’পাশের দেয়ালে। কোনো কোনো ছবির রঙ চুঁইয়ে পড়েছে পাশের কোনো ছবির উপর
আন্ডারপাসের ভিতরে, ছায়া-ঢাকা একটা জায়গায় বসে আছে জনা বিশেক ছোকরা। তাদের প্রায় সবার পরনে হুডি, সঙ্গে সোয়েটশার্ট। গোমড়া চেহারায় আর সন্দিহান চোখে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। কপাল ভালো… হোথর্ন জানে কোথায় যাচ্ছে সে। ওর কাছাকাছিই আছি আমি।
যেসব দালানের কথা বলেছি একটু আগে, সেগুলোরই একটাতে, দ্বিতীয় তলায় থাকে আন্দ্রিয়া কুভানেক। আসার আগে ফোন করেছিল হোথর্ন, কাজেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করার কথা মেয়েটার। পুলিশের ফাইল পড়ে জেনেছি, মেয়েটার দুটো বাচ্চা আছে। কিন্তু এখন হয়তো বাসায় থাকবে না বাচ্চা দুটো। কারণ ঘড়িতে এখন দুপুর দেড়টা… স্কুলে থাকার কথা তাদের। যা-হোক, আমরা দু’জন হাজির হলাম আন্দ্রিয়ার ফ্ল্যাটে
ফ্ল্যাটটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, কিন্তু খুবই ছোট। যে-ক’টা আসবাব দরকার, ঠিক সে-ক’টাই আছে… একটা বেশিও না, একটা কমও না। কিচেন টেবিলের সঙ্গে তিনটা চেয়ার। টিভির সামনে একটা সিঙ্গেল সোফা। বেডরুমের সংখ্যা মাত্র এক। আন্দ্রিয়া তার বাচ্চাদের নিয়ে রাতের বেলায় ঘুমায় কী করে, ভেবে পেলাম না। হতে পারে, তার বাচ্চারা ঘুমায় ওই বিছানায়, আর সে ঘুমিয়ে থাকে সোফার উপর।
কিচেন টেবিলের ধারে বসলাম আমরা। আমাদের মুখোমুখি বসেছে আন্দ্রিয়া। দেয়ালে লাগানো হুকে ঝুলছে কয়েকটা পাত্র আর প্যান। আমাদের মাথা থেকে সেগুলোর দূরত্ব কয়েক ইঞ্চি মাত্র। আমাদেরকে চা বা কফি কোনোটাই অফার করল না আন্দ্রিয়া। ফর্মিকার আচ্ছাদনে আবৃত কিচেন টেবিলের ও-ধারে বসে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমাদের দু’জনের দিকে। ছোটখাটো শরীর তার, গায়ের রঙ গাঢ়। সেই ফটোতে বাস্তবজীবনের-কঠোরতার ছাপ যতটা না পড়েছিল চেহারায়, তার চেয়ে অনেক বেশি কঠোর দেখাচ্ছে তাকে এখন। একটা টি-শার্ট আর জিন্স পরে আছে। প্যান্টটা ছিঁড়ে গেছে কয়েক জায়গায়। আসলেই ছিঁড়ে গেছে… কারণ যেসব জায়গায় যেভাবে ছেঁড়াফাটা দেখতে পাচ্ছি, সেটা হাল-আমলের ফ্যাশন হতে পারে না।
একটা সিগারেট ধরাল হোথর্ন। ওর কাছ থেকে আরেকটা সিগারেট চেয়ে নিল আন্দ্রিয়া। আমার চারপাশে এখন তামাকপোড়া ধোঁয়া। ভাবছি, পরোক্ষ ধূমপানজনিত কোনো অসুখে ভুগে মরার আগে এই বই লিখে শেষ করতে পারবো কি না।
আন্দ্রিয়ার সঙ্গে দেখা করতে পেরে হোথর্ন খুব খুশি… অন্তত সে-রকমই মনে হচ্ছে ওকে। পুলিশের কাছে যে-বিবৃতি দিয়েছিল মেয়েটা, যেটা ইতোমধ্যেই লিখে ফেলেছি আমি, সেটা আরেকবার শুনে নিল হোথর্ন ওই মেয়ের কাছ থেকে।
আন্দ্রিয়ার বক্তব্যে তেমন কোনো গরমিল পেলাম না আমি: যেদিন খুন হয়েছেন মিসেস ক্যুপার, সেদিন তাঁর বাসায় গিয়েছিল সে, লাশটা দেখতে পেয়েছে, ঘাবড়ে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে বাসার বাইরে, খবর দিয়েছে পুলিশে। তারা না-আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে বাসার বাইরেই।
‘তা হলে তো একেবারে কাকভেজা অবস্থা হয়েছিল আপনার,’ বলল হোথর্ন।
‘কী?’ সন্দেহের দৃষ্টি আরও ঘনীভূত হলো আন্দ্রিয়ার চোখে।
‘আপনি যখন লাশটা খুঁজে পেলেন সেদিন, তখন সমানে বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি যদি আপনার জায়গায় থাকতাম, তা হলে বাসার বাইরে যেতাম না, বরং গিয়ে ঢুকতাম রান্নাঘরে, এবং সেখানেই অপেক্ষা করতাম। মিসেস ক্যুপারের কিচেনটা চমৎকার। বাইরের ঠাণ্ডা আবহাওয়ার তুলনায় সে-জায়গা অনেক গরম। সবচেয়ে বড় কথা, বাড়ির ভিতরে ফোনও আছে। শুধু শুধু নিজের মোবাইল ব্যবহার করে পুলিশে খবর দিয়েছিলেন আপনি।’
‘বাইরে গিয়েছিলাম আমি। কথাটা ইতোমধ্যেই বলেছি পুলিশকে। কী ঘটেছিল, সেটা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল পুলিশ। তাদেরকে সব কথা বলেছি আমি।’
আন্দ্রিয়ার ইংরেজি উচ্চারণ ভালো না। ওর বাক্যগঠনও অসম্পূর্ণ। তবুও যা বলছে সে, সেটা বুঝে নিলাম। খেয়াল করলাম, সে যত রেগে যাচ্ছে, ওর ইংরেজি তত অসংলগ্ন হয়ে উঠছে।
‘জানি, আন্দ্রিয়া,’ বলল হোথর্ন। ‘পুলিশকে যে-বিবৃতি দিয়েছিলেন, সেটা পড়েছি আমি। তারপরও সেই লন্ডন থেকে এতদূর এসেছি… শুধু আপনার মুখোমুখি বসে আপনার কাছ থেকে সত্যি কথাটা শুনতে।’
নীরবতা।
ভিতরে ভিতরে চমকে গেছি আমি।
সত্যি কথা?
নির্নিমেষ তাকিয়ে আছি আন্দ্রিয়ার দিকে।
অনেকক্ষণ পর মেয়েটা বলল, ‘যা বলেছি, সত্যিই বলেছি।’
কিন্তু শুনে মনে হলো না, তেমন একটা জোর দিয়ে বলেছে সে কথাটা। ‘না, বলেননি,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল হোথর্ন। ‘এই দেশে ক’বছর ধরে আছেন?’
‘পাঁচ বছর।’
‘আর ডায়ানা ক্যুপারের বাসায় কাজ করছিলেন বছর দু’-এক?’
‘হ্যাঁ।’
‘সপ্তাহে ক’দিন কাজ করতেন সেখানে?’
‘দু’দিন। বুধবার আর শুক্রবার।‘
‘ছোটখাটো একটা সমস্যায় যে ভুগছিলেন আপনি, সেটা কি কখনও বলেছিলেন মিসেস ক্যুপারকে?
‘আমার কোনো সমস্যা নেই।
মাথা নাড়ল হোথর্ন… এমন ভঙ্গিতে যে, দেখে মনে হলো আন্দ্রিয়ার কথায় মনে চোট পেয়েছে। ‘আপনার অনেক সমস্যা। আপনি আগে থাকতেন হাডার্সফিল্ডে। চুরিচামারি করে বেড়াতেন দোকানে-দোকানে। কতই বা পেতেন ওসব কাজের জন্য? বড়জোর এক শ’ পঞ্চাশ পাউন্ড।’
‘আপনি কিছুই বোঝেন না!’ অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আন্দ্রিয়া হোথর্নের দিকে। যে-কোনো মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে হোথর্নের উপর।
আমার মনে হচ্ছে, এই জায়গা যদি আরেকটু বড় হতো, তা হলে ভালো হতো।
‘খাওয়ার মতো কিছু নেই আমার!’ অসহ্য কোনো আক্ষেপে ফুঁসছে আন্দ্ৰিয়া। ‘স্বামী নেই। দুটো বাচ্চা… একটার বয়স চার, অন্যটার ছয়। খাওয়ার মতো কিছুই নেই আমাদের এখানে!’
‘আর সে-কারণেই ‘সেইভ দ্য চিলড্রেন’ প্রজেক্ট হাতে নিয়ে এটা-সেটা তুলে নিতেন বিভিন্ন দোকান থেকে, নাকি? যা-হোক, আপনি আসলে সৌভাগ্যবতী… আপনার ‘কন্ডিশনাল ডিসচার্জের’ রায় দেয়ার সময় খোশমেজাজে ছিলেন জাজ।’
‘দুটো বছর মিসেস ক্যুপারের বাসায় কাজ করেছি আমি। আমার বাচ্চাদের দেখভাল করতেন তিনি। কাজেই আমার আর-কিছু চুরি করার দরকার হতো না। গত দুই বছরে সৎ জীবন যাপন করেছি আমি। পরিবারের দেখভাল করেছি।’
‘কিন্তু জেলে যদি যান, তা হলে পরিবারের এই দেখভাল আর করতে হবে না আপনাকে।’ কথাটা আন্দ্রিয়ার মনে ঢুকে যাওয়ার মতো সময় দিল হোথর্ন। তারপর বলল, ‘আমাকে মিথ্যা কথা বলেছেন আপনি। আপনার দুই বাচ্চার জন্য চিন্তা করবেন না… কোনো-না-কোনো প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব নেবে ওদের, অথবা স্লোভাকিয়ায় ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হবে ওদেরকে। …আমি শুধু জানতে চাই, কত টাকা নিয়েছেন আপনি।’
‘কীসের টাকা?’
‘মিসেস ক্যুপারের কিচেনে ফ্রিজের উপর একটা টিনের কৌটা আছে। ওটা খুলেছিলাম আমি। ভিতরে কয়েকটা কয়েন ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়নি। যদি বলি, ওই কৌটার ভিতরে টাকা রাখতেন মিসেস ক্যুপার? যদি বলি, তিনি মারা গেছেন… বলা ভালো, তাঁকে খুন করা হয়েছে টের পেয়ে ওই কৌটার ভিতর থেকে বেশ কিছু টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন আপনি, তা হলে?’
‘হ্যাঁ, ওই কৌটার ভিতরে টাকা রাখতেন মিসেস ক্যুপার। কিন্তু সে-টাকা আমি নিইনি। চোর নিয়েছে।’
‘না,’ রাগ দেখা দিল হোথর্নের দৃষ্টিতে। মুঠি পাকিয়ে ফেলেছে সিগারেট-ধরা হাতটা। ‘ওই বাড়িতে চোর ঢুকেছিল… সত্যি। বাড়ির এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়িয়েছে সে… এটাও ঠিক। ব্যাপারটা যেন এ-রকম: সে চেয়েছে, কোথায় কোথায় গেছে ওই বাড়ির, সেটা জানাতে চায় আমাদেরকে। কিন্তু টিনের কৌটাটার কথা আলাদা। জায়গামতোই ছিল ওটা। ঢাকনাটা লাগানো ছিল ঠিকমতো। কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায়নি ওটার গায়ে, অথচ পাওয়ার কথা ছিল। কারণ মিসেস ক্যুপার যদি একাই ব্যবহার করে থাকেন ওই কৌটা, তা হলে সেটার গায়ে তাঁর আঙুলের-ছাপ থাকতে বাধ্য। তার মানে এমন কেউ একজন ধরেছিল ওই কৌটা, যে-মানুষটা টিভিতে গোয়েন্দাকাহিনি দেখেছে প্রচুর। যে-মানুষটা জানে, ফিঙ্গারপ্রিন্টের মানে কী। আর সে-কারণেই কিছু-একটা দিয়ে ঘষে ঘষে মুছে সমস্ত ফিঙ্গারপ্রিন্ট গায়েব করে দিয়েছে সে ওই কৌটা থেকে।’
থামল হোথর্ন। তাকিয়ে আছে আন্দ্রিয়ার দিকে। দেখছে, ওর কথার কী প্রভাব পড়েছে মেয়েটার উপর।
কিছুক্ষণ পর বলল, ‘আমার কী ধারণা, জানেন? কৌটাটা খুলেছিলেন আপনি সেখান থেকে একগাদা নোট বের করে নিয়েছেন। কিন্তু তাড়াহুড়োর কারণে কয়েনগুলো নজরে পড়েনি আপনার, অথবা পড়লেও ওগুলো সরিয়ে ফেলাটা জরুরি মনে করেননি। … ঠিক বলেছি না?’
বিষণ্ণ দৃষ্টিতে হোথর্নের দিকে তাকিয়ে আছে আন্দ্রিয়া। ‘হ্যাঁ, টাকাগুলো সরিয়েছে আমি।’
‘কত?’
‘পঞ্চাশ পাউন্ড।’
‘ঠিক করে বলুন।’
‘এক শ’ ষাট।’
মাথা ঝাঁকাল হোথর্ন। ‘হুঁ, এবার কিছুটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে। যা-হোক, আপনি যে পুলিশের কাছে বলেছেন, বাইরে দাঁড়িয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, সেটাও ঠিক না। কারণ বাইরে তখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। কাজেই আমার অনুমান, আপনি তখন বাড়ির ভিতরেই ছিলেন। এবার বলুন, তখন আর কী কী করেছিলেন? আর কী কী নিয়েছেন?
আন্দ্রিয়ার চেহারা দেখে বুঝতে পারলাম, কোনো একটা সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করছে সে, এবং সে-চেষ্টা করতে গিয়ে কষ্ট হচ্ছে তার। হয়তো ভাবছে, নিজের আরও কিছু কুকীর্তির কথা স্বীকার করবে কি না… সেসব কথা স্বীকার করে নতুন কোনো ঝামেলায় জড়াবে কি না। অথবা হয়তো ভাবছে, মিথ্যা কথা বলে হোথর্নের রাগ আরও বাড়িয়ে দেবে কি না।
শেষপর্যন্ত সুমতি হলো মেয়েটার। উঠে গিয়ে কিচেন ড্রয়ার থেকে বের করল এক তা কাগজ, সেটা নিয়ে ফিরে এল। দিল হোথর্নের হাতে।
ভাঁজ খুলে পড়ল হোথর্ন :
মিসেস ক্যুপার,
আপনি হয়তো ভাবছেন, সহজেই আমার কাছ থেকে মুক্তি পেয়ে যাবেন। কিন্তু এত সহজে ছাড়ছি না আমি আপনাকে। কসম খেয়ে বলছি, যা বলেছি আপনাকে, সেটা তো কেবল শুরু। আপনার উপর নজর রেখেছি আমি, জানি কোন্ কোন্ জিনিস খুব প্রিয় আপনার কাছে। যা করেছেন, তার জন্য মূল্য দিতে হবে আপনাকে। বিশ্বাস করুন।
চিঠিটা হাতে লেখা হয়েছে। লেখার শেষে স্বাক্ষর করেনি কেউ। কোনো তারিখ নেই, কোনো ঠিকানা নেই।
চোখ তুলে আন্দ্রিয়ার দিকে তাকাল হোথর্ন। দৃষ্টিতে প্রশ্ন।
‘সপ্তাহ তিনেক আগে ওই বাড়িতে একটা লোক এসেছিল,’ ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলতে শুরু করল মেয়েটা। ‘লিভিংরুমে বসেছিল মিসেস ক্যুপারের সঙ্গে। আমি তখন উপরতলায় বেডরুমে ছিলাম। কিন্তু ওই দু’জনের কথাবার্তার আওয়াজ আমার কানে আসে। লোকটা খুব রেগে গিয়েছিল… চিৎকার করে কথা বলছিল মিসেস ক্যুপারের সঙ্গে।’
‘কবে?’ জানতে চাইল হোথর্ন। ‘কখন?’
‘বুধবার। দুপুর একটার দিকে।’
‘ওই লোককে কি দেখেছিলেন আপনি?’
‘লোকটা যখন চলে যাচ্ছে তখন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখেছিলাম তাকে। কিন্তু বৃষ্টি পড়ছিল তখন… ছাতা মেলে রেখেছিল লোকটা। তাই তার চেহারাটা দেখতে পাইনি।’
‘আপনি কি নিশ্চিত ওই মানুষটা একজন পুরুষলোক?’
জবাব দেয়ার আগে কিছুক্ষণ ভাবল আন্দ্রিয়া। ‘আমার তা-ই মনে হয়… হ্যাঁ।’
হাতেধরা কাগজটা মেলে ধরল হোথর্ন। ‘এটার কাহিনি কী?
‘ওটা আমি পেয়েছি মিসেস ক্যুপারের বেডরুমের টেবিল থেকে,’ আন্দ্ৰিয়াকে দেখে মনে হচ্ছে, কুকীর্তির কথা স্বীকার করতে লজ্জা পাচ্ছে। তার কথা শুনে হোথর্নের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, ভেবে ত্রিতও বোধ করছে হয়তো। ‘মিসেস ক্যুপার মারা যাওয়ার পর বাড়ির ভিতরে এখানে-সেখানে নজর বুলিয়েছিলাম আমি। তখন এই চিঠি দেখতে পাই।’ একটুখানি থামল, কী যেন ভাবছে। ‘আমার মনে হয় ওই লোকই খুন করেছে মিস্টার টিবসকে। ‘
‘মিস্টার টিবস? কে সে?’
‘মিসেস ক্যুপারের একটা বিড়াল ছিল। বিশাল ধূসর একটা বিড়াল।’ দুই হাত প্রসারিত করে প্রাণীটা-কত-বড়-ছিল দেখাল আন্দ্রিয়া। ‘বৃহস্পতিবার আমাকে ফোন
করেছিলেন মিসেস ক্যুপার। বললেন, ওই বাড়িতে সেদিন যাওয়ার দরকার নেই আমার। কারণ তিনি খুব আপসেট। বললেন, মিস্টার টিবসকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
‘চিঠিটা নিলেন কেন আপনি?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।
হোথর্নের দিকে তাকাল আন্দ্রিয়া। ভাবখানা এমন, আমাকে উপেক্ষা করার অনুমতি চাইছে।
মাথা ঝাঁকাল হোথর্ন। ইতোমধ্যে ভাঁজ করে ফেলেছে চিঠিটা, তারপর চালান করে দিয়েছে পকেটে।
আমার প্রশ্নের জবাব দিল না আন্দ্রিয়া।
মেয়েটাকে বোধহয় আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই হোথর্নের, তাই উঠে দাঁড়াল সে। ওই অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে এলাম আমরা।
একটা ট্যাক্সি ডেকে সেটাতে উঠে পড়ল হোথর্ন। ওর পাশে বসলাম আমি!
‘চিঠিটা আন্দ্রিয়া নিয়েছিল,’ বলল হোথর্ন, ‘কারণ সে ভেবেছিল, ওটা কাজে লাগিয়ে কিছু টাকা কামাই করবে। সেদিন যে-লোক দেখা করতে গিয়েছিল মিসেস ক্যুপারের সঙ্গে… মানে ছাতাওয়ালা লোকটার কথা বলছি… কেন যেন মনে হচ্ছে আমার, ওই লোককে চেনে আন্দ্রিয়া। অথবা হয়তো ভেবেছিল, খুঁজে বের করতে পারবে লোকটাকে। চিঠিটা নিয়ে গিয়ে ওই লোককে দেখানোর ইচ্ছা ছিল মেয়েটার… ব্ল্যাকমেইলিঙের উদ্দেশ্য ছিল। একটা সুযোগ পেয়েছিল সে, সেটা কাজে লাগানোর চিন্তা করছিল।’
শহরে ফিরে চলেছি আমরা। আরও একজনের সঙ্গে দেখা করার কথা আছে আমাদের। রেমন্ড ক্লুন্স– মঞ্চনাটকের প্রযোজক, মিসেস ক্যুপার যেদিন খুন হলেন সেদিন তাঁর সঙ্গে লাঞ্চ করেছিলেন।
আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, সময়ের অপচয় করছে হোথর্ন। কারণ আসল খুনির পরিচয় ওর পকেটেই আছে। যে-লোক লিখেছে ওই চিঠি, সে বলেছে, যা করেছেন, তার জন্য মূল্য দিতে হবে আপনাকে। কাজেই সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকার কথা না।
ভেবেছিলাম, আন্দ্রিয়া কুভানেকের সঙ্গে ইন্টারভিউর ব্যাপারে আরও কিছু বলবে হোথর্ন। কিন্তু মুখে তালা দিয়ে রাখল সে। একটু আগে যা বলেছে, তার পর থেকে তন্ময় হয়ে ভাবছে কী যেন। তন্ময় শব্দটা ঠিক হলো না মনে হয়। আমার বলা উচিত ছিল, আত্মচিন্তায় মগ্ন হয়ে গেছে সে।
পাশে-বসা লোকটাকে যেন নতুন করে চিনছি আমি। যখন কোনো কেস নিয়ে কাজ করে না সে, তখন ওর সঙ্গে একটা মরা মানুষের কোনো তফাৎ নেই। সে যে বেঁচে আছে, সেটা বোঝানোর জন্য ওর দরকার খুন… নিদেনপক্ষে সহিংস কোনো অপরাধ।
যা-হোক, একসময় পৌঁছে গেলাম রেমন্ড কুন্সের ঠিকানায়।
আন্দ্রিয়া ক্লুভানেকের সেই অ্যাপার্টমেন্টের সঙ্গে যদি তুলনা করা হয়, তা হলে বলতেই হবে, রেমন্ড ক্রুন্সের আবাসস্থলের সঙ্গে ওই মেয়ের মাথা-গুঁজবার-ঠাঁইয়ের আকাশ-পাতাল ব্যবধান আছে। ক্রুন্সের বাসাটা মার্বেল আর্চের পেছনে, কনোট স্কোয়ারের কাছে। বিল্ডিংটা দেখে হয়তো আশ্চর্য হওয়া উচিত ছিল আমার, কিন্তু হলাম না। মঞ্চনাটকের কোনো প্রযোজকের বাসগৃহ এ-রকম হওয়াই স্বাভাবিক।
ওই বিল্ডিং দেখতে নাটকের মঞ্চের মতো। লাল রঙের ইট দিয়ে বানানো হয়েছে সেটা। অবাস্তব কোনো দ্বিমাত্রিক ভাব যেন আছে ওই দালানের গঠনকাঠামোতে। সদর দরজাটা এত বেশি চোখে পড়ে যে, ওটাকে কর্তৃত্বব্যঞ্জক বলে মনে হয়। জানালাগুলোয় উজ্জ্বল রঙ করা। নিখুঁত প্রতিসাম্যের ছাপ পাঁচতলা ওই বাড়িতে। আদিম একটা ভাব আছে এখানকার সব কিছুতে… এমনকী ধাতব রেলিঙের প্রান্ত ঘেঁষে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে-থাকা ডাস্টবিনগুলোও ঝকঝকে- তকতকে। কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে গেছে বেসমেন্টের দিকে, সেখানে যাওয়ার আলাদা প্রবেশপথ আছে।
হোথর্নকে দেখে মনে হচ্ছে না, খুব একটা সন্তুষ্ট হয়েছে। ডোরবেলের গায়ে এত জোরে থাবা চালাল যে, মনে হলো, ওই জিনিসের সঙ্গে শত্রুতা আছে ওর। সারা রাস্তার কোথাও কেউ নেই। এখানকার বেশিরভাগ বাসাই বোধহয় ফাঁকা। হতে পারে, এখানকার বেশিরভাগ বাসার মালিক বিদেশি ব্যবসায়ীরা। আচ্ছা, এই জায়গার কাছাকাছি কোথায় যেন থাকতেন টনি ব্লেয়ার? এদিক-ওদিক তাকালাম। জায়গাটাকে কেন যেন ঠিক লন্ডন বলে মনে হচ্ছে না আমার।
ক্রুন্সের বাসায় একজন বাটলার আছে। পিনস্ট্রাইপের স্যুট আর ওয়েস্টকোট পরে আছে লোকটা। হাতে গ্লাভস। বয়সে আমার সমান প্রায়। মাথার কালো চুল ব্যাকব্রাশ করা। কেমন একটা গৌরবের ছাপ চেহারায়। সে-ছাপ, যতদূর মনে হলো, চর্চিত
‘গুড আফটারনুন, স্যর। প্লিজ ভিতরে আসুন।’ আমাদের নাম জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করল না লোকটা। তার মানে আমাদের আসার খবর আগেই জানিয়ে রাখা হয়েছিল তাকে।
দুটো রিসিপশন রুমের মাঝখানে বড় একটা হলওয়ে আছে, সেখানে হাজির হলাম আমরা। অবিশ্বাস্য সুন্দর কার্পেট বিছানো আছে মেঝেতে। ছাদ অনেক উঁচু। দেখে মনে হচ্ছে, কারও বাসায় আসিনি, বরং এমন কোনো হোটেলে হাজির হয়েছি, যেখানে কোনো পেয়িং গেস্ট নেই।
সিঁড়ি বেয়ে উঠে হাজির হলাম উপরতলার ল্যান্ডিঙে। সেখান থেকে লিভিংরুমে। যেখানেই চোখ যায়, আসবাব, ল্যাম্প, আয়না আর চিত্রকর্মের ছড়াছড়ি। সব কিছুই দামি, তারপরও সব কিছুতেই কেমন একটা উদাসীনতার ছাপ। অবহেলায় ফেলে-রাখা কোনো পত্রিকা অথবা কাদার দাগ লেগে থাকা কোনো জুতোর খোঁজে তাকালাম এদিক-ওদিক, কিন্তু সে-রকম কিছু দেখতে পেলাম না। খেয়াল করলাম, লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে আছি, তারপরও এই বাসা একেবারে নীরব। এই বাসা আমাকে যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে বিশাল কোনো শবাধারের কথা… বাসার মালিক যেন মারা গেছেন, তবে তার আগে নিজের ঐশ্বর্যের নমুনা রেখে গেছেন যত্রতত্র।
কিছুক্ষণ পর আমাদের সামনে হাজির হলেন রেমন্ড কুন্স। সাদামাটা কাপড় পরে আছেন তিনি। ব্যাপারটা আশ্চর্যজনক লাগল আমার কাছে। তাঁর বয়স পঞ্চাশের মতো। নীল রঙের ভেলভেটের-জ্যাকেট পরেছেন, ভিতরে রোল-নেকের জার্সি। একটা সোফায় বসে পড়লেন, পায়ের উপর পা তুলে দিয়েছেন। শক্তসমর্থ শরীর তাঁর, চুলগুলো রূপালি, নীল দুই চোখে খেলা করছে কৌতুক। মনে হচ্ছে, আমাদেরকে দেখে সন্তুষ্ট হয়েছেন।
‘বসুন,’ মুখোমুখি আরেকটা সোফা দেখিয়ে দিলেন তিনি। ‘কফি খাবেন?’ আমাদের জবাবের জন্য অপেক্ষা না-করে তাকালেন বাটলারের দিকে। ‘ব্রুস, মেহমানদের জন্য কফি নিয়ে এসো।’
‘হ্যাঁ, স্যর,’ চলে গেল ব্রুস।
বসে পড়লাম আমি আর হোথর্ন।
‘বেচারী ডায়ানার ব্যাপারে কথা বলার জন্য এখানে এসেছেন আপনারা,’ হোথর্নকে কিছু বলার সুযোগ না-দিয়ে নিজেই বলতে শুরু করলেন কুন্স। ‘যা ঘটেছে, সে-ব্যাপারে মনে কতখানি চোট যে পেয়েছি আমি, বলে বোঝাতে পারবো না। গ্লোব থিয়েটারে একসঙ্গে কাজ করার সুবাদে ডায়ানার সঙ্গে পরিচয় আমার। সেখানেই প্রথম দেখা হয় আমাদের। ওর ছেলে ড্যামিয়েনের সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। ছেলেটা খুবই প্রতিভাবান। আমার প্রযোজনায় একটা নাটক বানানো হয়েছিল… দ্য ইম্পর্টেন্স অভ বিইং আর্নেস্ট… সেটাতে কাজ করেছিল সে। ব্যবসায়িক সাফল্য পেয়েছিল নাটকটা। যা-হোক, পুলিশ যখন বলল খুন করা হয়েছে ডায়ানাকে, নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমার মনে হয় না এই পৃথিবীতে এমন কেউ আছে, যে ডায়ানার কোনো ক্ষতি করতে চায়। ডায়ানা এমন একজন মানুষ, যারা, যাদের সঙ্গেই পরিচয় হোক না কেন, তাদের ভালো চায়।’
‘যেদিন খুন করা হয়েছে তাঁকে,’ মুখ খুলল হোথর্ন, ‘সেদিন তাঁর সঙ্গে লাঞ্চ করেছিলেন আপনি। ‘
‘হ্যাঁ… ক্যাফে মুরানোতে। স্টেশন থেকে যখন বেরিয়ে আসছিল সে, তখন ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। আমাকে দেখে হাত নেড়েছিল। আমি ভেবেছিলাম, সব ঠিকই আছে। কিন্তু যখন খেতে বসলাম, টের পেলাম, কিছু-একটা হয়েছে ওর। কেমন যেন মনমরা দেখাচ্ছিল ওকে। কারণ কী জিজ্ঞেস করায় বলল, ওর পোষা বিড়াল মিস্টার টিবসকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। …কী একখানা নাম … মিস্টার টিবস! যা-হোক, চিন্তা করতে মানা করলাম ডায়ানাকে। বললাম, বিড়ালটা হয়তো তাড়া করেছিল কোনো ইঁদুরকে, এবং সে-কাজ করতে গিয়ে বাসার বাইরে চলে গেছে। অথবা অন্য কোনো কারণেও বাইরে গিয়ে থাকতে পারে ওটা। আসল কথা হচ্ছে, যেখানেই যাক না কেন, ফিরে আসবে আবার। কিন্তু আমার কথার তেমন কোনো প্রভাব ডায়ানার উপর পড়ল বলে মনে হয়নি। বেশিক্ষণ থাকতেও পারল না সে। অবশ্য… সেদিন বিকেলে ওর একটা বোর্ডমিটিং ছিল।’
‘শুনেছি আপনাদের দু’জনের মধ্যে নাকি পুরনো বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সে-সম্পর্কে বোধহয় ভাটা পড়েছিল, তা-ই না?’
‘ভাটা পড়েছিল!’ মনে হলো আশ্চর্য হয়েছেন কুন্স।
‘আপনার কোনো একটা নাটকে বিনিয়োগ করে নাকি টাকা খুইয়েছিলেন মিসেস ক্যুপার?’
‘আপনি বোধহয় মরোক্কান নাইটসের কথা বলছেন। না, ভাটা পড়েনি আমাদের সম্পর্কে। তবে আশাহত হয়েছিল ডায়ানা। আশাহত হয়েছিলাম আমরা দু’জনই। ডায়ানার যত টাকা নষ্ট হয়েছিল ওই নাটকের পেছনে, তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা নষ্ট হয়েছে আমার। কিন্তু মন খারাপ করিনি আমি… ব্যবসার হিসেবটাই এ-রকম– কখনও লাভ, কখনও ক্ষতি। এবং ব্যাপারটা জানা ছিল ডায়ানার।’
‘মরোক্কান নাইটস নাটকটা কী নিয়ে?’
‘প্রেমকাহিনি। এখানে দুটো লোক আছে। একজন সৈন্য, আরেকজন সন্ত্রাসী ব্যবসাসফল একটা উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে বানানো হয়েছিল নাটকটা, কিন্তু তারপরও কেন যেন দর্শকপ্রিয়তা পায়নি সেটা। হতে পারে মারামারির দৃশ্য একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল ওই নাটকে। …আপনারা কেউ দেখেছেন ওটা?’
‘না,’ বললাম আমি।
‘সমস্যা সেটাই। যাকেই জিজ্ঞেস করি, বলে, দেখিনি ওই নাটক।’
একটা ট্রে-তে তিন কাপ কফি নিয়ে ফিরে এল ব্রুস।
হোথর্ন বলল, ‘আপনি এমন কোনো নাটক কি কখনও বানিয়েছেন, যেটা ব্যবসাসফল হয়েছে?’
অপমানিত হলেন কুন্স। ‘আপনার চারপাশে একটু তাকিয়ে দেখুন, ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর। ব্যবসাসফল নাটক যদি একটাও বানাতে না-পারতাম, তা হলে এত কিছু যে জোগাড় করেছি, সেটা কীভাবে সম্ভব হতো?’
‘পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড খুইয়েছিলেন মিসেস ক্যুপার, তা-ই না?’
‘টাকাটা আপনার কাছে বড় একটা পরিমাণ হতে পারে, কিন্তু ডায়ানার জন্য তেমন কিছু ছিল না। যদি হতো, তা হলে নাটকের পেছনে টাকা-বিনিয়োগ করার কাজে এগিয়ে আসত না।’
‘সেদিন সকালে কোথায় গিয়েছিলেন মিসেস ক্যুপার, সে-ব্যাপারে আপনাকে কিছু বলেছিলেন?’
‘সেদিন সকালে মানে লাঞ্চের আগে?’ চোখ পিটপিট করছেন কুন্স। ‘না।’
‘দক্ষিণ কেনসিংটনের একজন আন্ডারটেকারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন তিনি। নিজের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করতে চেয়েছিলেন।’
ট্রে থেকে কফির একটা কাপ তুলে নিয়েছিলেন কুন্স, সেটা রেখে দিলেন আগের জায়গায়। ‘আসলেই? আশ্চর্য হলাম কথাটা শুনে।’
‘কেন, ক্যাফে মুরানোতে কথাটা আপনাকে বলেননি মিসেস ক্যুপার?
‘অবশ্যই না। যদি বলত, তা হলে আপনি বলার আগেই কথাটা বলতাম আমি আপনাকে। ওই কথা সহজে ভুলে যাওয়ার মতো না।’
‘আপনি বলেছেন, সেদিন লাঞ্চের সময় কেমন মনমরা মনে হচ্ছিল মিসেস ক্যুপারকে। ঠিক কী নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন তিনি, জানিয়েছিলেন?’
‘পোষা বিড়ালের কথাটা তো বলেছিই। আরেকটা কথা বলেছিল সে… টাকাপয়সা নিয়ে তখন আলোচনা শুরু হয়েছিল আমাদের মধ্যে… বলল, কেউ একজন কিছু-টাকা নিয়ে ঝামেলা করছে ওর সঙ্গে। ওই ঘটনার সঙ্গে একটা দুর্ঘটনার যোগসূত্র আছে… কেন্টে যখন থাকত সে…’
‘তখন একটা গাড়ি-দুর্ঘটনায় দুটো বাচ্চা ছেলেকে চাপা দিয়েছিলেন তিনি, ‘ ক্রুন্সের মুখের কথা কেড়ে নিল হোথর্ন।
মাথা ঝাঁকালেন কুন্স। কফির কাপটা তুলে নিলেন আবার, ছোট করে চুমুক দিলেন। ‘ঘটনাটা আজ থেকে বছর দশেক আগের। তখন ক্যান্সারে ভুগে মারা গেছে ডায়ানার স্বামী, ফলে একা একা থাকতে হতো ওকে। লোকটা ডেন্টিস্ট ছিল। এমন কিছু ক্লায়েন্ট ছিল তার, যারা সেলিব্রেটি। তাদের বাসাটাও ছিল চমৎকার, সাগরপাড়ে। যে-দুর্ঘটনার কথা বললেন, সেটা যখন ঘটে, তখন ডায়ানার সঙ্গে থাকত ড্যামিয়েন। যা-হোক, আমি যতদূর জানি, দোষ ডায়ানার ছিল না। বাচ্চা দুটো হঠাৎই দৌড় দেয়… রাস্তার অপর পাশে আইসক্রিম বিক্রি করা হচ্ছিল, সেখানে যেতে চাইছিল তারা। সময়মতো ব্রেক কষতে পারেনি ডায়ানা। পরে এই ব্যাপারটা নিয়ে জাজের সঙ্গে লম্বা সময় ধরে কথা বলেছিলাম আমি। তিনি ও বলেছিলেন, ডায়ানাকে কোনোভাবেই দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। কারণ কেউ যদি ছুটে এসে হাজির হয় চলন্ত গাড়ির সামনে, তা হলে কী করার থাকতে পারে?’
‘টাকা নিয়ে কে ঝামেলা করছিল মিসেস ক্যুপারের সঙ্গে, সে-ব্যাপারে কি আপনাকে কিছু বলেছিলেন তিনি?’
‘হ্যাঁ, বলেছে। লোকটার নাম অ্যালান গডউইন… ওই দুই ছেলের বাবা। ইদানীং নাকি প্রায়ই দেখা করত লোকটা ডায়ানার সঙ্গে, এটা-সেটা বিভিন্ন কিছু চাইত ওর কাছে।’
‘কী চাইতেন?’
‘মূলত টাকা। ওই লোককে পাত্তা দিতে নিষেধ করেছিলাম আমি ডায়ানাকে। বলেছিলাম, ওই দুর্ঘটনা অনেক বছর আগের। এবং সে-ব্যাপারে কিছুই করার নেই ওর।’
‘মিসেস ক্যুপার কি কখনও কোনো চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করেছিলেন আপনার কাছে?’ জানতে চাইলাম আমি।
‘চিঠি? মানে?’
‘মানে অ্যালান গডউইন কি কখনও কোনো চিঠি লিখেছিলেন মিসেস ক্যুপারকে?’
‘লিখেছিল নাকি?’ শূন্যতা দেখা দিয়েছে কুন্সের চেহারায়। ‘না, আমার তা মনে হয় না। ডায়ানা শুধু বলেছিল, ওর সঙ্গে ওই গডউইন লোকটা নিয়মিত দেখা করছে ইদানীং। বলেছিল, এই ব্যাপারে কী করা যায়, বুঝতে পারছিল না।’
‘আপনি বললেন, জাজের সঙ্গে নাকি কথা বলেছিলেন। কীভাবে সম্ভব হলো ব্যাপারটা?’
‘জাজ নাইজেল ওয়েস্টন আমার বন্ধু। শুধু তা-ই না, আমার কিছু নাটকে টাকাও বিনিয়োগ করেছিল।’
‘মিস্টার ওয়েস্টন কি বিবাহিত?’
‘জানি না। …কেন জানতে চাইছেন?’
‘এমনি।’
আর তেমন কোনো কথা হলো না। মিস্টার কুন্সকে বিদায় জানিয়ে নিচে নেমে এলাম আমরা।
রাস্তায় বের হয়েই একটা সিগারেট ধরাল হোথর্ন। ঘন ঘন টান দিচ্ছে, ঘন ঘন ধোঁয়া ছাড়ছে। আমার দিকে তাকাচ্ছে না।
‘ঘটনা কী?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।
জবাব দিল না হোথর্ন।
‘হোথৰ্ন?’
এবার আমার দিকে তাকাল সে। ‘মিস্টার ক্লন্স আর সেই জাজ মিলে মুক্ত করেনি তো জালে-আটকা-পড়া মিসেস ক্যুপারকে?
কথাটা ভাবছিলাম আমিও। ‘সেজন্যই কি জিজ্ঞেস করেছিলেন জাজ ওয়েস্টন বিবাহিত কি না?’
‘কথাটা জানতে চেয়েছিলাম, কারণ আমার কেন যেন মনে হয়েছিল, জাজ ওয়েস্টন সমকামী। মিস্টার কুন্সও তা-ই হয়ে থাকতে পারেন। তিনিও বিয়ে-থা করেননি।’
একটুখানি থমকে গেলাম। কিছুক্ষণ পর মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, ‘হুঁ। এখন তা হলে বাসায় ফিরে যাই আমি, নাকি? আগামীকাল ফোন করবো আপনাকে।’
হাঁটা ধরলাম আমি। কিছুদূর এসে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম।
যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে হোথর্ন। তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
পরিত্যক্ত কোনো বাচ্চার মতো মনে হচ্ছে ওকে।
৭. হ্যারো-অন-দ্য-হিল
সেদিন রাতে আমার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম ন্যাশনাল থিয়েটারে। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন নাটকটা দেখলাম, কিন্তু সত্যি বলতে কী উপভোগ করতে পারলাম না। সাড়ে এগারোটার দিকে ফিরে এলাম বাসায়। আমার স্ত্রী সোজা গিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়, কিন্তু আমার কেন যেন ঘুম আসছে না। জেগে থাকলাম অনেক রাত পর্যন্ত। হোথর্নকে নিয়ে যে-বই লিখছি, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে। এ-ব্যাপারে অবশ্য এখনও কিছু বলিনি আমার স্ত্রীকে।
খুনের কোনো সত্যি কাহিনি নিয়ে যদি কিছু লিখতে চাইতাম, সেটার প্রধান চরিত্র হিসেবে বেছে নিতাম না হোথর্নের মতো কাউকে। ওর মতো শ্বেতাঙ্গ, মাঝবয়সী আর বদমেজাজী গোয়েন্দা আরও অনেক আছে। তবে এই ব্যাপারে, কোনো সন্দেহ নেই, লোকটা চতুর। আন্দ্রিয়া কুভানেক যে টাকা চুরি করেছে, সেটা অনুমান করে ফেলেছে সে। মিসেস ক্যুপারের বিড়ালের ব্যাপারটাও কীভাবে যেন চলে এসেছে ওর মাথায়। তারপরও, মুশকিল হচ্ছে, এখনও ওকে ঠিক পছন্দ করতে পারছি না। আর এ-রকম একটা অবস্থায় ওকে নিয়ে কিছু লেখাটাও কষ্টকর। বললে কেউ বুঝবে কি না জানি না… উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের সঙ্গে সেটার লেখকের সম্পর্ক কিন্তু সম্পূর্ণ অন্যরকম। উদাহরণ হিসেবে অ্যালেক্স রাইডারের কথাই বলি। গত দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ওই ছেলেকে নিয়ে একের-পর-এক কাহিনি লিখছি। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, ওর ব্যাপারে কখনও কখনও পরশ্রীকাতরতায় ভুগেছি; তারপরও পছন্দ করেছি ওকে। ওর নতুন নতুন অ্যাডভেঞ্চারের কথা পাঠককে জানানোর জন্য আমার লেখার-টেবিলে ফিরে যাওয়ার তাগাদা অনুভব করেছি বার বার। সে সিগারেট খায় না। গালি দেয় না। পিস্তল বা বন্দুক কিছুই নেই ওর। তারপরও কমপক্ষে একডজন কেসে পৃথিবীটাকে উদ্ধার করেছে ধ্বংসের হাত থেকে। সবচেয়ে বড় কথা, সে হোমোফোবিক না… মানে, যারা সমকামী, তাদের ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথা নেই ওর
আচ্ছা, রেমন্ড ক্লন্স অথবা জাজ ওয়েস্টন সমকামী কি না, সে-কথা আমাকে অত অকপটে বলল কেন হোথর্ন? আর কোনো কিছু তো অত খোলামেলা বলে না সে?
কেমন হতাশ লাগছে। বসে আছি নিজের অফিসে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি বাইরে। ক্রসরেইলের নির্মাণকাজ চলছে ফ্যারিংডনে, বেশ কিছু লাল লাইট জ্বলছে সেখানে, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি সে-দৃশ্য। মনে মনে জিজ্ঞেস করছি নিজেকে, হোথর্নের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যেতে চাই কি না।
রাত বারোটা বেজে গেছে আরও আগেই। ক্লান্তি বোধ করছি। রেবেকা ওয়েস্টের দ্য মিনিং অভ ট্রিন পড়ছিলাম, ওটা খোলা অবস্থায় উপুড় করে রাখা আছে আমার কম্পিউটারের পাশে। হাত বাড়িয়ে নিজের দিকে টেনে নিলাম বইটা। ঘুম যখন আসছেই না, এই বইয়ে মনোনিবেশ করা যাক আবার। ১৯৪০-এর দশকে ফিরে যাওয়াটাই বোধহয় ভালো হবে আমার জন্য।
ঠিক তখনই টুং করে একটা আওয়াজ হলো আমার মোবাইলে। তাকালাম স্ক্রীনের দিকে।
একটা টেক্সট মেসেজ পাঠিয়েছে হোথর্ন।
ইউনিকো ক্যাফে
হ্যারো অন দ্য হিল
সকাল ৯:৩০
ব্রেকফাস্ট
হ্যারো অন দ্য হিল… মানে, গডউইন পরিবার যেখানে থাকে।
অর্থাৎ আগামীকাল সকালে সেখানে যেতে বলছে আমাকে হোথৰ্ন।
কী করবো? আবারও প্রশ্ন করলাম নিজেকে। যাবো?
ডায়ানা ক্যুপারকে কে খুন করেছে, সত্যিই জানতে চাই আমি। আসলে সত্যি কথাটা জানতে চাই। আমার ভালো লাগুক বা না-লাগুক, এই কেসের সঙ্গে জড়িয়ে গেছি। ওই মহিলার লিভিংরুমে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, নিজের চোখে দেখেছি কীভাবে জীবনযাপন করতেন তিনি। কীভাবে মারা গেছেন, দেখেছি সেটাও। তাঁর কার্পেটের এককোনায় বিশেষ একটা দাগ দেখেছি। এবং, স্পষ্ট টের পাচ্ছি, তাঁর কাছে ওই হুমকি-চিঠি কে পাঠিয়েছিল, জানতে চাইছি। আরও জানতে চাইছি, ওই একই লোক তুলে নিয়ে গেছে কি না অথবা খুন করেছে কি না মহিলার বিড়ালটাকে।
হোথর্ন আমাকে বলেছে, মিসেস ক্যুপার নাকি জানতেন, তিনি মরতে চলেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে সম্ভব হলো ব্যাপারটা? আর যদি সম্ভব হয়েও থাকে, তা হলে পুলিশের কাছে গেলেন না কেন তিনি?
এগুলো না-হয় বাদ দিলাম। আসল কথা হচ্ছে, গডউইন পরিবারের সঙ্গে দেখা করার জন্য ভিতরে ভিতরে কৌতূহলী হয়ে উঠেছি। বিশেষ করে জেরেমি গডউইনকে দেখতে ইচ্ছা করছে খুব। মনে পড়ে যাচ্ছে মিসেস ক্যুপারের সেই টেক্সট মেসেজ…
যে-ছেলেটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল…
আমি যদি এখন কাজ না-করি হোথর্নের সঙ্গে, তা হলে হয়তো অন্য কাউকে জুটিয়ে নেবে সে। হয়তো ওরা দু’জনে মিলে সমাধান করে ফেলবে এই রহস্যের, আর সেটা খবরের কাগজে পড়তে হবে আমাকে। এবং ব্যাপারটা মোটেও সুখকর হবে না আমার জন্য।
টের পেলাম, এই রহস্যের যখন সমাধান করা হবে, তখন ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতে চাই আমি।
ফোনটা এখনও আমার হাতে। আগামীকাল সকাল ন’টা ত্রিশ মিনিট। হ্যাঁরো অন দ্য হিল।
ফিরতি মেসেজ পাঠিয়ে দিলাম হোথর্নকে:
দেখা হবে।
তারপর গিয়ে শুয়ে পড়লাম।
ইউনিকো ক্যাফেটা হ্যাঁরো-অন-দ্য-হিল স্টেশন থেকে কিছুটা দূরে, জীর্ণশীর্ণ একসারি দোকানের শেষপ্রান্তে, রেললাইনের কাছে অবস্থিত। সময়মতো সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখি, ইতোমধ্যেই ব্রেকফাস্টের অর্ডার দিয়ে ফেলেছে হোথর্ন: ডিম, বেকন, টোস্ট আর চা। এই প্রথমবার স্বাভাবিক খাবারের অর্ডার দিতে দেখলাম ওকে।
খাবার যখন হাজির হলো, ক্লান্ত ভঙ্গিতে খেতে শুরু করল সে… ভাবখানা এমন, কী খাচ্ছে, সে-ব্যাপারে যেন সন্দেহ আছে ওর মনে। দেখে মনে হচ্ছে না, খেয়ে কোনো মজা পাচ্ছে। আমি ওর মুখোমুখি বসেছি বেশ কিছুক্ষণ, কিন্তু এই সময়ে আমার দিকে তাকিয়ে শুধু মুচকি হেসেছে একবার, কিছু বলেনি। ওর মনের ভিতরে কী চলছে আসলে, বুঝতে পারলাম না।
নিজের জন্য ব্রেকফাস্টের অর্ডার করলাম আমি: একটা বেকন স্যান্ডউইচ।
কেমন আছেন?’ জিজ্ঞেস করল হোথর্ন।
‘ভালো।’
উৎসাহের ছিটেফোঁটাও নেই আমার কণ্ঠে। কিন্তু সেটা হোথর্ন টের পেল কি না, বুঝলাম না।
বলল, ‘গডউইন পরিবারের ব্যাপারে কিছু হোমওয়ার্ক সেরে নিয়েছি।’
খেতে খেতে কথা বলছে সে। খেয়াল করলাম, ওর পাশে একটা নোটপ্যাড রাখা আছে।
‘পরিবারের কর্তাব্যক্তির নাম অ্যালান গডউইন। নিজের একটা ব্যবসা আছে তাঁর… ইভেন্ট অরগানাইযার। তাঁর স্ত্রীর নাম জুডিথ গডউইন। বাচ্চাদের একটা দাঁতব্য-প্রতিষ্ঠানে পার্টটাইম কাজ করেন। দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ছেলেটা ছাড়া আর কোনো সন্তান নেই ওই দম্পতির। ওই ছেলের নাম জেরেমি গডউইন, বয়স এখন আঠারো। ওর ব্রেইন ড্যামেজ্ড্। ডাক্তারদের কথা হচ্ছে, সার্বক্ষণিক সেবা-শুশ্রূষার দরকার আছে ছেলেটার।’ একটুখানি চা খেল হোথর্ন। ‘এখন কথা হচ্ছে, ডায়ানা ক্যুপারের যদি কোনো ভুল হয়ে না-থাকে, তা হলে এ-রকম হওয়াটা কিন্তু অসম্ভব না, ওই ছেলে হয়তো বিছানা অথবা তার হুইলচেয়ার থেকে নেমেছিল… যেদিন খুন হয়েছেন মিসেস ক্যুপার সেদিন হয়তো ব্রিটানিয়া রোড ধরে হেঁটে-চলে বেড়িয়েছিল।’
হাজির হয়ে গেল আমার বেকন স্যান্ডউইচ।
নোটপ্যাডের কয়েকটা পাতা উল্টাল হোথর্ন। পরিষ্কার হস্তাক্ষরে গুছিয়ে নোট লিখেছে সে। কিন্তু এত ছোট অক্ষরে লিখেছে যে, দূর থেকে চশমা ছাড়া পড়তে পারছি না।
‘বিশেষ ওই দুর্ঘটনার একটা সারসংক্ষেপ তৈরি করেছি,’ বলল সে। ‘যদি শুনতে কোনো অসুবিধা না-থাকে আপনার… মানে, আট বছরের একটা বাচ্চা গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মারা যাচ্ছে…
‘অসুবিধা নেই আমার
‘ডিলের রয়্যাল হোটেলে উঠেছিল ওই দুই ভাই আর তাদের আয়া… মেরি ও’ব্রায়ান। সেদিন সারাটা সকাল সৈকতে ছিল তারা তিনজন, তারপর ফিরে যাচ্ছিল হোটেলে। পথে এক আইসক্রিমের দোকান দেখতে পেয়ে সেদিকে ছুটে যায় দুই ভাই। মেরি পরে পুলিশের কাছে শপথ করে বলেছে, রাস্তাটা নাকি ফাঁকাই ছিল। কিন্তু ভুল প্রমাণিত হয়েছে কথাটা। অর্ধেকটা রাস্তা পার হয়েছে কি হয়নি দুই ভাই, একটা মোড় ঘুরে হাজির হয়ে যায় মিসেস ক্যুপারের গাড়ি, চাপা দেয় ওই দু’জনকে। মেরি বেঁচে যায় অল্প কয়েক ইঞ্চি দূরে থাকার কারণে। মারা পড়ে এক ভাই, আরেকজন গুরুতর আহত হয়। ওদিকে মিসেস ক্যুপার গাড়ির গতি না- কমিয়ে বলতে-গেলে পালিয়ে যান। রাস্তার দু’পাশে অনেক লোক ছিল তখন, তাদের অনেকে চোখের সামনে ঘটতে দেখেছে ঘটনাটা। এবং ওই ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর পুলিশের কাছে যদি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি না-দিতেন মিসেস ক্যুপার, তা হলে তাঁর অবস্থা হয়তো খারাপ হতো।’
‘জাজ ওয়েস্টনের সঙ্গে পূর্বপরিচয় ছিল তাঁর।’
‘বলা ভালো, এমন কাউকে ভালোমতো চিনতেন তিনি, যে-লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল জাজ ওয়েস্টনের।
‘একই কথা।’
‘না, এক না। বিচারকেরা অনেককেই চেনেন। কিন্তু তার মানে এ-ই না, যাদেরকেই চেনেন তাঁরা, তাদের ব্যাপারেই পক্ষপাতিত্ব করেন।’
আর কোনো কথা হলো না। নিঃশব্দে ব্রেকফাস্ট শেষ করলাম আমরা। ওয়েইট্রেস বিল নিয়ে এল। সেটার দিকে তাকালও না হোথর্ন। সে আশা করছে, বিলটা আমি দিয়ে দেবো।
কিন্তু এবার একটু শক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বললাম, ‘খেয়াল করেছি, এখন পর্যন্ত যতবার কফি আর ট্যাক্সির বিল চুকাতে হয়েছে আমাদেরকে, প্রতিবারই কাজটা করেছি আমি। অথচ আধাআধি বখরার কথা ছিল আমাদের মধ্যে। যদি তা- ই হবে, তা হলে খরচও আধাআধি ভাগ করে নেয়া উচিত।’
‘ঠিক আছে!’ কণ্ঠ শুনে মনে হলো, আমার কথায় বিস্মিত হয়েছে হোথর্ন।
ওয়ালেট বের করল সে, তারপর সেটার ভিতর থেকে বের করল দশ পাউন্ডের একটা নোট। ওই নোট এত মলিন হয়ে গেছে যে, ওটা আসলেই দশ পাউন্ডের নোট কি না, সন্দেহ হলো আমার। কিন্তু একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম, হোথর্নের ওয়ালেটে আর কোনো টাকা নেই।
ভীষণ লজ্জিত হলাম মনে মনে। বুঝতে পারলাম, ছোটলোকের মতো একটা কাজ করে ফেলেছি। যা-হোক, এই ঘটনার পর যতবারই কোনো বিল চুকাতে হয়েছে আমাদেরকে, প্রতিবারই আমি করেছি কাজটা, হোথর্নকে একটা পয়সাও দিতে হয়নি। এবং সে-ব্যাপারে কখনও কোনো আপত্তি করিনি।
আমরা দু’জন একসঙ্গে বেরিয়ে এলাম ক্যাফে থেকে। হ্যাঁরো অন দ্য হিল ভালোমতোই চেনা আছে আমার। ফয়েল’স ওয়ার-এর বেশ কিছু দৃশ্য এখানে ক্যামেরাবন্দি করা হয়েছে। শুধু তা-ই না, আমার প্রথম বোর্ডিংস্কুলটাও ধারেকাছেই। আশপাশে তাকিয়ে একটু আশ্চর্যই হলাম। গত পঞ্চাশ বছরে বলতে- গেলে কোনো পরিবর্তনই হয়নি এই জায়গার।
তাকালাম হোথর্নের দিকে। ‘গতকাল রাতে কী করলেন?’
‘মানে?’
‘মানে গতকাল রাতে কী করেছেন আপনি সেটা জানতে চাইছি। ডিনার সারতে কোথাও গিয়েছিলেন? নাকি কাজ করেছেন এই কেস নিয়ে?’
কোনো জবাব দিল না হোথর্ন।
‘আপনার জবাবটা এই বইয়ে ব্যবহার করতে পারবো আমি।’
‘ডিনার করেছি। কিছু নোট লিখেছি। তারপর ঘুমিয়ে পড়েছি।’
কী খেয়েছিল সে? কার সঙ্গে বিছানায় গিয়েছিল? ঘুমিয়ে পড়ার আগে টিভি দেখেছিল? টিভি কি আদৌ আছে ওর বাসায়?
জানি, এসব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে একটারও উত্তর পাবো না। জিজ্ঞেস করার মতো সময়ও নেই আমার হাতে।
কারণ আমরা দু’জন হাজির হয়ে গেছি রক্সবরো অ্যাভিনিউ’র একটা ভিক্টোরিয়ান বাড়ির সামনে। বাড়িটা তিন তলা, গাঢ় লাল রঙের ইট দিয়ে বানানো। এ-রকম কোনো বাড়ি দেখতে পাওয়ামাত্র চার্লস ডিকেন্সের কথা মনে পড়ে যায় আমার।
মেইনরোড থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত এই বাড়ি। নুড়িপাথরে ছাওয়া একটা রাস্তা এগিয়ে গেছে সেটার দিকে। একটা ডাবল গ্যারেজ আছে এককোনায়। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, খুবই জীর্ণশীর্ণ অবস্থা বাড়িটার। বাগানের কথা যদি বলি অথবা বাড়ির রঙের কথা… সব কিছুরই হতশ্রী অবস্থা। কয়েকটা জানালার গোবরাটে টবে চাষ করা হচ্ছে ফুলগাছ, কিন্তু সবগুলো ফুলই মরা। আলোর কোনো চিহ্নই নেই কোনো জানালায়।
গডউইন পরিবার এই বাড়িতেই থাকে। বলা ভালো, ওই পরিবারের যে- তিনজন সদস্য বেঁচে আছে, তাঁদের আবাসস্থল এই ভগ্নপ্রায় বাড়ি।
৮. ক্ষতিগ্রস্ত জিনিসপত্র
ঢুকে পড়লাম বাড়ির ভিতরে। হলটা অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা। বাইরে যতটা ঠাণ্ডা, তার চেয়ে বেশি শীতলতা এই হলের ভিতরে। শুধু তা-ই না, পর্যাপ্ত আলোও নেই এখানে। মনে হলো, নতুন সাজসজ্জার ব্যাপারে যেন চিৎকার করে কাঁদছে এই জায়গা। পায়ের নিচে কার্পেটের অস্তিত্ব টের পাচ্ছি, কিন্তু সেটা নিতান্তই মামুলি…. ছেঁড়াফাটা আর জায়গায় জায়গায় দাগেভরা; কোথাও আবার বিবর্ণ। বাতাসে কেমন একটা ছাতলা-পড়া গন্ধ।
আমাদের জন্য দরজা খুলে দিয়েছিলেন পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর বয়সী এক মহিলা। একটু পর পর তাকাচ্ছেন আমাদের দিকে, তাঁর সে-দৃষ্টিতে সন্দেহ দেখতে পাচ্ছি। অনুমান করে নিলাম, তিনিই জুডিথ গডউইন। তাঁর মতো কোনো মহিলা যে কোনো দাঁতব্য-প্রতিষ্ঠানে কাজ করবেন, তা আর আশ্চর্যের কী? একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম… বিয়োগান্ত যে-ঘটনা তাঁর জীবন বদলে দিয়েছে, এত বছর পরও সেটা যেন ছেড়ে যায়নি তাঁকে।
জানতে চাইলেন, ‘আপনি হোথৰ্ন?’
‘আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালো লাগল,’ বলল হোথর্ন, আবারও সেই তোষামোদের-মুখোশে আড়াল করেছে নিজের চেহারা। ‘আমাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য ধন্যবাদ।
‘রান্নাঘরে আসতে কোনো অসুবিধা নেই তো আপনাদের? কফিটা না-হয় সেখানেই পরিবেশন করতাম…’
আমি কে, তা বলল না হোথর্ন। জুডিথ গডউইনও মনে হয় আমার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী নন, কারণ আমার পরিচয় জানতে চাইলেন না।
তাঁর পিছন পিছন কিচেনে গিয়ে হাজির হলাম আমি আর হোথর্ন। রান্নাঘরটা সিঁড়ির অন্য পাশে। এখানে বেশ গরম। কোথাও কোনো বৈচিত্র্য নেই। কালের ছোবল দেখতে পাচ্ছি জায়গায় জায়গায়। একধারে দাঁড়িয়ে আছে ফ্রিজটা। ওটা যখন কেনা হয়েছিল তখন দামি ছিল, কিন্তু এতদিনে জীর্ণ অবস্থা হয়েছে। চুম্বকের সাহায্যে কয়েকটা পোস্ট-ইট নোট আটকে দেয়া হয়েছে ওটার বড়িতে। কোনো কোনো নোটে লেখা আছে রেসিপি, কোনোটাতে আবার টেলিফোন নম্বর। আবার কোনো নোটে দেখতে পাচ্ছি জরুরি ঠিকানা। ওভেনটা কেমন তেল চিটচিটে। বহুল ব্যবহারের কারণে পুরনো হয়ে গেছে ডিশওয়াশারটা। আরেকধারে দেখা যাচ্ছে একটা ওয়াশিং মেশিন। চলছে ওটা, নোংরা পানি ছিটকে ছিটকে এসে ঘোলা করে দিচ্ছে ওটার জানালা। এমনিতে রান্নাঘরটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নই, তারপরও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, এই ঘরের পিছনে আরও কিছু টাকা বিনিয়োগ করা দরকার এ-বাড়ির বাসিন্দাদের। ওয়াইমেরানার জাতের একটা ঘেয়ো কুকুর আধবোজা চোখে শুয়ে ছিল এককোনায়, আমাদেরকে ঢুকতে দেখে লেজ নাড়তে লাগল।
পাইন কাঠে বানানো বড় একটা টেবিল আছে কিচেনে, সেটার একধারে দুটো চেয়ারে বসে পড়লাম আমি আর হোথর্ন। সিঙ্ক থেকে একটা পারকোলেটর তুলে নিলেন জুডিথ গডউইন, কলের পানিতে ধুলেন সেটা। তারপর ওটাতে কফি চাপিয়ে দিলেন চুলায়। কাজ করতে করতে কথা বলতে লাগলেন আমাদের সঙ্গে।
‘ডায়ানা ক্যুপারের ব্যাপারে আমার সঙ্গে কথা বলতে চান আপনারা।
‘হ্যাঁ,’ বলল হোথর্ন। ‘পুলিশের সঙ্গে নিশ্চয়ই ইতোমধ্যে কথা হয়ে গেছে আপনার?’
‘হয়েছে। তবে বেশিক্ষণ না।’ এগিয়ে গিয়ে ফ্রিজ খুললেন জুডিথ, দুধের একটা প্লাস্টিক-কার্টন বের করলেন। শুঁকলেন ওটা, তারপর রেখে দিলেন কাউন্টারের উপর। ‘আমাকে ফোন করেছিল ওরা। জানতে চেয়েছিল, মিসেস ক্যুপারকে দেখেছি কি না।’
‘দেখেছিলেন?’
ঘুরে তাকালেন জুডিথ, কেমন বেপরোয়া একটা দৃষ্টি দেখা দিয়েছে চোখে। ‘গত দশ বছরের মধ্যে ওই মহিলার সঙ্গে একবারের জন্যও দেখা হয়নি আমার।’ ঘুরলেন আবারও। একটা প্লেটে কিছু বিস্কিট সাজানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ‘আর… ওই মহিলার সঙ্গে আমার দেখা করার দরকারটাই বা কী? তাঁর কাছে যাওয়ারও কোনো প্রয়োজন নেই আমার।’
অনিশ্চিত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল হোথর্ন। ‘মিসেস ক্যুপারের মৃত্যুতে খুশি হয়েছেন আপনি… এ-রকম ভাবতে চাই না আমি।’
কাজ করতে করতে থেমে গেল জুডিথের হাত। ‘মিস্টার হোথর্ন, কী যেন বলেছিলেন… কী পরিচয় যেন দিয়েছিলেন আপনি নিজের?’
‘বলেছিলাম, এই কেসে পুলিশকে সাহায্য করছি। তারাই খবর দিয়েছে আমাকে।
‘তার মানে আপনি একজন প্রাইভেট ডিটেক্টিভ?’
‘আমি একজন পরামর্শদাতা।
‘আর আপনার বন্ধু?’
‘আমরা একসঙ্গে কাজ করছি,’ বললাম আমি।
‘মিস্টার হোথর্ন, আপনি কি বলতে চান আমি খুন করেছি মিসেস ক্যুপারকে?’
‘না, সে-রকম কিছু তো বলিনি।
‘কিন্তু আপনার কথার মানে তো সেটাই, নাকি? আপনি জানতে চেয়েছেন, মিসেস ক্যুপারকে দেখেছি কি না। জানতে চেয়েছেন, তাঁর মৃত্যুতে খুশি হয়েছি কি না।’ পানি ফুটছে কেতলিতে, আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। তাড়াহুড়ো করে ওটা চুলা থেকে নামালেন জুডিথ। ‘সত্যি বলতে কী, ওই মহিলার মৃত্যুতে খুশি হয়েছি আমি। আমার জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছিলেন তিনি। ধ্বংস করে দিয়েছিলেন আমার পরিবারের জীবন। ড্রাইভিং করা উচিত ছিল না তাঁর, অথচ সেটাই করছিলেন সেদিন, এবং সে-কাজ করতে গিয়ে মেরে ফেলেছেন আমার একটা ছেলেকে। আমার জীবন থেকে সব কিছু ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। মিস্টার হোথর্ন, আমি একজন খ্রিস্টান। নিয়মিত গির্জায় যাই। ওই মহিলাকে ক্ষমা করে দেয়ার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু যদি বলি তাঁর খুন হওয়ার খবরটা শোনার পর খুশি হইনি, তা হলে মিথ্যা বলা হবে। শত্রুর মৃত্যুর খবরেও খুশি হওয়াটা পাপ… অনুচিত; তারপরও বলবো, যে বা যারাই খুন করে থাকুক না কেন মিসেস ক্যুপারকে, উচিত কাজটাই করেছে। ও-রকম কোনো কাজেরই উপযুক্ত ছিলেন তিনি আসলে।
নীরবতা।
চুপ করে আছি আমরা।
তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি, কফি বানাচ্ছেন জুডিথ। বলতে গেলে থাবা চালিয়ে তুলে নিলেন পারকোলেটরটা। একই কায়দায় তুলে নিলেন কয়েকটা মগ আর দুধের জগ। ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে রেগে গেছেন। ট্রে-টা নিয়ে এসে বসে পড়লেন আমাদের মুখোমুখি। দাবি জানানোর কায়দায় বললেন, ‘আর কী জানতে চাইছেন আপনারা?’
‘আপনি আমাদেরকে যা-যা বলতে পারেন তার সব,’ বলল হোথর্ন। ‘দুর্ঘটনার কাহিনি দিয়েই শুরু করুন না?’
‘দুর্ঘটনা?’ তিতা আর সংক্ষিপ্ত হাসি হাসলেন জুডিথ। ‘ঠিকই বলেছেন আসলে… দুর্ঘটনা। ওই শব্দ ছাড়া আর কী ব্যবহৃত হতে পারে বিশেষ সে-ঘটনার জন্য? আমি তখন ওই শহরেই ছিলাম। ফোন করা হলো আমাকে, বলা হলো, ‘কিছু মনে করবেন না… খারাপ একটা খবর আছে আপনার জন্য… একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।’ ভেবেছিলাম, তেমন গুরুতর কিছু না। কিন্তু কল্পনাও করতে পারিনি, আমার টিমি ততক্ষণে লাশ হয়ে শুয়ে আছে মর্গে। কল্পনা করতে পারিনি, আমার অন্য ছেলেটা আর কোনো দিন স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে না।’
‘ওদের সঙ্গে ছিলেন না কেন আপনি?’
‘একটা কন্সফারেন্সে ছিলাম আমি তখন। ওই সময় ‘শেল্টার’ নামের একটা প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করছিলাম। ওয়েস্টমিনিস্টারে দু’দিন ব্যাপী একটা ইভেন্ট চলছিল আমাদের। আর আমার স্বামী তখন একটা ব্যবসার কাজে গিয়েছিল ম্যানচেস্টারে।’ একটুখানি থামলেন জুডিথ। ‘আমরা এখন আর একসঙ্গে থাকি না। এবং সেটার জন্যও ওই দুর্ঘটনাকে দায়ী করতে পারেন।’ আবারও কিছুক্ষণের নীরবতা। ‘আমাদের দুই ছেলের স্কুলের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা তখন শেষ। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, ওদেরকে ওদের আয়ার সঙ্গে কোথাও ঘুরতে পাঠাবো। ডিলের সাগরসৈকতে নিয়ে গেল সে ওই দু’জনকে। যে-হোটেলে উঠেছিল ওরা, সেখানে স্পেশাল একটা অফার চলছিল তখন। আর সে-কারণেই ওই হোটেল বেছে নেয়া হয়েছিল। খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল আমার দুই ছেলে। চোখের সামনে দুর্গ দেখতে পাচ্ছিল ওরা, সৈকতে খেলতে পারছিল, ইচ্ছা হলে চুঁ-ও মেরে আসতে পারছিল র্যাসগেটের টানেলগুলো থেকে। টিমির কল্পনাশক্তি ছিল দারুণ। জীবনের সব কিছুই ছিল ওর কাছে অ্যাডভেঞ্চার।’
আলাদা তিনটা কাপে কফি ঢাললেন তিনি। প্রয়োজনমতো দুধ আর চিনি মেশানোর দায়িত্বটা ছেড়ে দিলেন আমাদের উপর।
বলতে লাগলেন, ‘মেরি… মানে, সেই আয়ার কথা বলছি… এক বছরেরও বেশি সময় ধরে দেখভাল করছিল আমার দুই ছেলের। কাজেকর্মে বেশ ভালো ছিল সে। ওকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতাম। দুর্ঘটনাটার কারণ জানার চেষ্টা করেছি আমরা বার বার, কিন্তু একবারের জন্যও ভাবিনি, দোষ মেরির। পুলিশ আর সাক্ষীরা সবাই একই কথা বলেছে। যা-হোক, মেরি এখনও আছে আমাদের সঙ্গে।’
‘সে-ই কি দেখভাল করে জেরেমির?’
‘হ্যাঁ। আসলে… দোষ না-করেও দায় এড়াতে পারেনি বেচারী। জেরেমি যখন শেষপর্যন্ত ছাড়া পেল হাসপাতাল থেকে, মেরি টের পেল, জেরেমিকে ছেড়ে চলে যেতে পারবে না সে। আর তাই…।’ কথা শেষ না-করে থেমে গেলেন জুডিথ। বোঝা গেল, দুঃসহ স্মৃতি রোমন্থন করতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর। ‘ওরা তিনজন তখন ছিল সাগরসৈকতে। প্যাডলিং করছিল। দিনটা ছিল চমৎকার, কিন্তু সাঁতার কাটার মতো গরম পড়েনি। সৈকতের পাশেই ছিল রাস্তা। আরেকধারে ছিল সী-ওয়াল আর প্রোমেনাড। হঠাৎই আমার দুই ছেলে একটা আইসক্রিম-শপ দেখতে পায়। মেরি কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেদিকে ছুট লাগায় ওরা। চিৎকার করে ওঠে মেরি, থামতে বলে ওদেরকে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! আমার ছেলে দুটো হঠাৎ ও-রকম কাজ করতে গেল কেন, তখনও বুঝতে পারিনি আমি, আজও পারি না। ওদের বয়স তখন ছিল মাত্র আট বছর, তারপরও অবুঝ বলতে যা বোঝায়, সে-রকম ছিল না।
‘যা-হোক, ওরা যেভাবেই ছুট লাগিয়ে থাকুক না কেন, মিসেস ক্যুপারের উচিত ছিল সময়মতো ব্রেক কষা। যথেষ্ট সময় ছিল তাঁর হাতে। কিন্তু…। আমরা পরে জানতে পারি, চশমা ছাড়া তিনি রাস্তার একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত দেখতে পান না। কাজেই ওই অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে মোটেও উচিত কাজ করেননি। তাঁর সেই বেপয়োরা আচরণের কারণেই সেদিন ঘটনাস্থলে মারা পড়ে টিমি। আর জেরেমি গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে স্রেফ উড়াল দিয়েছিল। মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছিল, কিন্তু কপালগুণে বেঁচে গেছে।’
‘মেরি ব্যথা পায়নি?’
‘না। ওর কপালও আসলে ভালো। ছেলে দুটোকে ধরার জন্য সামনের দিকে দৌড় দিয়েছিল সে। মিসেস ক্যুপারের গাড়িটা কয়েক ইঞ্চির জন্য মিস করেছে ওকে। …মিস্টার হোথর্ন, আদালতে যখন বিচারকাজ চলছিল, তখন এসব ব্যাপারে কথা হয়েছে। যা-হোক, আমার কথা হচ্ছে, মিসেস ক্যুপার কোন্ জাতের মহিলা? দু’-দুটো বাচ্চা ছেলেকে গাড়িচাপা দিয়ে রাস্তায় ফেলে রাখলেন, তারপরও ফিরে গেলেন বাসায়? অথচ পুলিশের কাছে বললেন, তিনি নাকি আতঙ্কিত হয়ে গিয়েছিলেন!’
‘নিজের ছেলের কাছে ফিরে গিয়েছিলেন তিনি।’
‘ঠিক। ড্যামিয়েন ক্যুপার। আজ সে একজন নামকরা অভিনেতা। দুর্ঘটনাটার সময় মায়ের সঙ্গে থাকত। অনেকেই তখন বলাবলি করছিল, মিসেস ক্যুপার নাকি তাঁর ছেলেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন… তিনি নাকি চাননি, তাঁর ছেলের নাম প্রেসে যাক। কথাটা যদি সত্যি হয়, তা হলে বলতে বাধ্য হচ্ছি, মা-ছেলে দু’জনই হাড়ে হাড়ে শয়তান। যা-হোক, সেদিনই পুলিশের কাছে হাজির হয়েছিলেন মিসেস ক্যুপার, কিন্তু আমি বলবো, যেহেতু ওই কাজ না-করে কোনো উপায় ছিল না তাঁর সেহেতু করেছেন কাজটা। দুর্ঘটনাটা ঘটতে দেখেছে অনেকেই। ওই গাড়ির নম্বরপ্লেটও দেখতে পেয়েছিল। আরেকটা কথা। আমার দুই ছেলেকে গাড়িচাপা দিয়ে মিসেস ক্যুপার যে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, রায় ঘোষণার সময় সেটা মনে রাখা উচিত ছিল জাজের। কিন্তু… বেকসুর খালাস পেয়ে গেলেন মিসেস ক্যুপার।’
বিস্কিটের প্লেটটা তুলে নিলেন মিসেস গডউইন, সাধলেন আমাকে।
‘না, ধন্যবাদ,’ বললাম আমি। এ-রকম একটা কথোপকথনের সময় ঘরোয়া এই আয়োজন করলেন কী করে তিনি, ভেবে আশ্চর্য লাগছে।
হোথর্ন বলল, ‘বুঝতে পারছি এসব কথা বেদনাদায়ক হয়ে যাচ্ছে আপনার জন্য, তারপরও… আপনার সঙ্গে আপনার স্বামীর ছাড়াছাড়ি হলো কবে?’
‘লম্বা কাহিনি। দুর্ঘটনাটার পর আমি আর অ্যালান দুষছিলাম একজন আরেকজনকে… কেন ওই সৈকতে যেতে দিয়েছিলাম আমাদের ছেলে দুটোকে, কেন সেখানে ছিলাম না আমরা ইত্যাদি ইত্যাদি। অ্যালান তখন ব্যবসার একটা কাজে ম্যানচেস্টারে ছিল… আগেও বলেছি বোধহয়। যা-হোক, ওই দুর্ঘটনাই ফাটল ধরাল আমাদের দু’জনের সম্পর্কে। যে-সত্যের মুখোমুখি হতে চাইনি কখনও, সেটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হলো আমাদের দু’জনকে। শেষপর্যন্ত… এই তো… কয়েক মাস আগে চলে গেল অ্যালান। আমাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে… এটা বলাটা বোধহয় উচিত হবে না। বরং আমি বলবো, একসঙ্গে থাকাটা আর সহ্য করতে পারছিলাম না আমরা।’
‘তাঁর দেখা পেতে পারি কী করে, বলতে পারেন? তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভালো হতো।’
এক তা কাগজে কিছু-একটা লিখে সেটা হোথর্নের দিকে বাড়িয়ে ধরলেন মিসেস গডউইন। ‘ওর মোবাইল নম্বর। চাইলে ফোন করতে পারেন ওকে। ভিক্টোরিয়ার একটা ফ্ল্যাটে থাকে সে। থামলেন তিনি, কিছু-একটা বলি-বলি করেও বোধহয় বলতে পারছেন না। শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। ‘অ্যালানের ব্যবসা খুব-একটা ভালো যাচ্ছে না ইদানীং। এই বাড়ি আর রাখা সম্ভব হচ্ছিল না আমাদের পক্ষে। আমরা এই বাড়ি বিক্রি করে দেয়ার কথা ভাবছিলাম। তারপরও এখানে আছি… শুধু জেরেমির কারণে।’
মাথা ঝাঁকাল হোথর্ন। ‘আপনি বললেন, ডায়ানা ক্যুপারের সঙ্গে নাকি দেখা করেননি। আপনার স্বামী দেখা করেছিলেন কি না ওই মহিলার সঙ্গে, জানেন?’
‘এই ব্যাপারে আমাকে কিছু বলেনি সে। দেখা করার মতো কোনো কারণ ছিল কি না, তা-ও জানি না।’
‘আচ্ছা, যেদিন মারা গেলেন মিসেস ক্যুপার, মানে গত সপ্তাহের সোমবার, সেদিন কি তাঁর বাড়ির কাছাকাছি কোথাও গিয়েছিলেন?’
‘আগেও বলেছি, আবারও বলছি… না।’
ধীরে ধীরে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল হোথর্ন। ‘কিন্তু দক্ষিণ কেনসিংটনে গিয়েছিলেন আপনি।’
‘কী বললেন? বুঝলাম না।
‘বললাম, সেদিন, মানে যেদিন খুন হয়েছেন ডায়ানা ক্যুপার, সেদিন দক্ষিণ কেনসিংটন স্টেশন থেকে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে বের হতে দেখা গেছে আপনাকে।’
‘আপনি জানলেন কী করে?’
‘সিসিটিভি ফুটেজ দেখেছি, মিসেস গডউইন। কেন, কথাটা কি অস্বীকার করতে চান?’
‘অবশ্যই না। দক্ষিণ কেনসিংটন… আপনি কি বলতে চান, সেখানেই কোথাও থাকতেন মিসেস ক্যুপার?’
জবাব দিল না হোথর্ন, তাকিয়ে আছে মিসেস গডউইনের দিকে।
‘ডায়ানা ক্যুপার কোথায় থাকতেন, সে-ব্যাপারে কিছু জানা ছিল না আমার। আমার ধারণা ছিল, তিনি কেন্টেই থাকতেন। যা-হোক, কিংস রোডে কিছু কেনাকাটা করতে গিয়েছিলাম। এই বাড়ি বিক্রি করিয়ে দেয়ার জন্য একজন দালাল ধরেছি; টুকটাক কয়েকটা জিনিসের একটা লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছিল লোকটা আমার হাতে, বলেছিল সেগুলো কিনে আনলে নাকি এই বাড়ির চেহারা কিছুটা হলেও খুলবে। আর তাই কয়েকটা ফার্নিচারের-দোকানে গিয়েছিলাম।’
কথাটা কেন যেন বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হলো না আমার কাছে। ভগ্নপ্রায় অবস্থা হয়েছে এই বাড়ির, এবং জুডিথ গডউইনের অবস্থা দেখলেই বোঝা যায় তাঁর কাছে বাড়তি কোনো টাকা নেই। সে-কারণেই বিক্রি করে দিতে চাইছেন তিনি এই বাড়ি। কয়েকটা আসবাব কিনে এনে যদি সাজিয়ে রাখেন, কী এমন চেহারা খুলবে বাড়িটার?
‘কখনও কিছু লিখে মিসেস ক্যুপারের কাছে পাঠিয়েছিলেন কি না আপনার স্বামী, সে-ব্যাপারে কিছু বলেছিলেন তিনি আপনাকে?
‘কখনও কিছু লিখে… মানে, চিঠি অথবা ওই জাতীয় কোনো কিছুর কথা বলছেন? জানি না আসলে। কথাটা ওকেই জিজ্ঞেস করলে ভালো হয়।’
‘জেরেমির কী অবস্থা?’
হোথর্নের মুখে ছেলের নাম উচ্চারিত হওয়ামাত্র শরীর শক্ত হয়ে গেল জুডিথ গডউইনের।
চটজলদি হোথর্ন বলল, ‘আপনি বলেছেন আপনার সঙ্গেই নাকি থাকে সে।’
‘হ্যাঁ।’
‘আচ্ছা, এ-রকম কি হতে পারে, জেরেমিই লেগেছিল মিসেস ক্যুপারের পেছনে?’
জবাব দেয়ার আগে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন জুডিথ। আমি ভাবলাম, রাগে বিস্ফোরিত হবেন তিনি, এই মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলবেন আমাদেরকে। কিন্তু সে-রকম কিছু ঘটল না। শান্ত গলায় তিনি বললেন, ‘মিস্টার হোথর্ন, জেরেমির বয়স যখন আট, তখন গুরুতর আঘাত পেয়েছিল সে, এবং সে-আঘাত এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে। মাথায় এত জোরে ব্যথা পেয়েছিল যে, ওর মস্তিষ্কের টেম্পোরাল আর অক্সিপিটাল লোব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ওর স্মৃতিশক্তি, বাচনক্ষমতা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা, এমনকী দৃষ্টিশক্তিও। এখন ওর বয়স আঠারো। কিন্তু আর কোনো দিন সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে না। যত দিন যাচ্ছে, ওর সমস্যাগুলো আরও বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে আমার। ইদানীং শর্ট-টার্ম ওয়ার্কিং মেমোরি-লসে আক্রান্ত হচ্ছে সে। কোনো কিছুর উপর একটানা মনোযোগ ধরেও রাখতে পারছে না। সার্বক্ষণিক পরিচর্যার দরকার আছে ওর।’
থামলেন তিনি। কিছুক্ষণ পর আবার বলতে লাগলেন, ‘আমার কথার মানে এ- ই না, বাসা ছেড়ে কোথাও যায় না সে। বরং বাইরে বের হয়, কিন্তু কখনোই একা যায় না। কাজেই মিসেস ক্যুপারের পেছনে লাগা বলতে আপনি যা বোঝাতে চাইছেন, সেটা একইসঙ্গে হাস্যকর, অসম্ভব এবং আপত্তিজনক।’
‘বুঝতে পারছি। কিন্তু… বললে বিশ্বাস করবেন কি না জানি না… খুন হওয়ার কিছুক্ষণ আগে নিজের ছেলের কাছে অদ্ভুত একটা টেক্সট মেসেজ পাঠিয়েছিলেন মিসেস ক্যুপার। আমার বুঝতে যদি ভুল হয়ে না-থাকে, ওই মেসেজে মিসেস ক্যুপার বলেছিলেন, আপনার ছেলেকে নাকি দেখেছেন তিনি।
‘সেক্ষেত্রে… কিছু মনে করবেন না, সরাসরিই বলছি… বুঝতে ভুল হয়েছে আপনার।’
‘সেজন্যই বলেছি, মিসেস ক্যুপারের মেসেজটা অদ্ভুত। তিনি কিন্তু বিশেষ কোনো একজনের কথা নির্দিষ্ট করে বলেছেন তাঁর সেই মেসেজে। যা-হোক, গত সপ্তাহের সোমবারে কোথায় ছিল জেরেমি, জানেন?’
‘অবশ্যই জানি। উপরতলায় ছিল… এখনও সেখানেই আছে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ঘর ছেড়ে বের হয় না। এবং আগেও বলেছি আবারও বলছি, একা কোথাও যায় না।’
দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালাম। যুবতী এক মেয়ে ঢুকল রান্নাঘরে। তার পরনে জিন্স আর ঢিলেঢালা জার্সি। দেখামাত্র চিনতে পারলাম মেয়েটাকে… কাউকে বলে দিতে হলো না… মেরি ও’ব্রায়ান। আয়া অথবা শিশুপালনকারিণী বলতে যা বোঝায়, ওই মেয়েকে দেখামাত্র সে-রকম মনে হয়। সে-রকম একটা ভাব ফুটে আছে তার নাদুসনুদুস চেহারায়। সেই সঙ্গে আছে গাম্ভীর্যের ছাপ। বুকের উপর ভাঁজ করে রেখেছে মোটা মোটা দুই হাত। খুব সম্ভব স্ট্রেইট করিয়ে রেখেছে কালো চুলগুলো। বয়স পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি। তার মানে, অনুমান করলাম, দুর্ঘটনাটা যখন ঘটেছিল, তখন তার বয়স পঁচিশের কাছাকাছি ছিল।
‘দুঃখিত, জুডিথ,’ বলল সে, উচ্চারণে আইরিশ টান আছে, ‘আপনার সঙ্গে যে অতিথি আছে, জানা ছিল না আমার।’
‘সমস্যা নেই, মেরি। পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি মিস্টার হোথর্ন, আর…’
‘অ্যান্টনি,’ বললাম আমি।
‘ডায়ানা ক্যুপারের ব্যাপারে আমাকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছেন তাঁরা।’
‘ওহ্,’ ঝুলে পড়ল মেরির চেহারা। আড়চোখে তাকাল দরজার দিকে। চলে যাবে কি না, ভাবছে বোধহয়। অথবা হয়তো ভাবছে, এখানে না-এলেই ভালো করত।
‘ডিলে কী ঘটেছিল, সে-ব্যাপারে তোমার সঙ্গে হয়তো কথা বলতে চাইতে পারেন তাঁরা।
মাথা ঝাঁকাল মেরি। আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনারা যা জানতে চাইবেন, বলবো আমি। তবে… এসব কথা হাজারবার বলেছি ইতোমধ্যে।’ এগিয়ে এসে বসে পড়ল টেবিলের একধারে।
উঠে গেলেন জুডিথ, চলে গেলেন ঘরের এককোনায়।
একটুখানি আশ্চর্য না-হয়ে পারলাম না। কোনো একটা চাপা উত্তেজনা চলছে নাকি জুডিথ আর মেরির মধ্যে?
‘কীভাবে সাহায্য করতে পারি আপনাদেরকে?’ বলল মেরি।
‘সেদিন ঠিক কী ঘটেছিল, বলতে পারেন আমাদেরকে,’ বলল হোথর্ন। ‘আমি জানি এসব কথা আগেও অনেকবার বলেছেন, তবু আবারও যদি বলেন, আমাদের কাজে লাগতে পারে।’
‘ঠিক আছে।’ ভাব দেখে মনে হলো, মেরি যেন স্থির হওয়ার চেষ্টা করছে।
তাকালাম জুডিথের দিকে। আমাদেরকেই দেখছেন তিনি।
‘সৈকত থেকে চলে এলাম আমরা,’ বলতে শুরু করল মেরি। ‘ছেলে দুটোকে কথা দিয়েছিলাম, হোটেলে ফিরে যাওয়ার আগে আইসক্রিম খেতে পারবে ওরা। আমরা উঠেছিলাম রয়্যাল হোটেলে। সৈকত থেকে হোটেলটা ছিল কাছেই। যা- হোক, ছেলে দুটোকে বার বার বলেছিলাম, রাস্তা পার হওয়ার সময় আমার হাত যাতে ধরে রাখে… কিছুতেই যাতে না-ছাড়ে। সাধারণত ও-রকম কিছু করত না ওরা। কিন্তু সেদিন ওরা দু’জনই ছিল অতিমাত্রায় ক্লান্ত– লম্বা সময় ধরে হুটোপুটি করেছিল সৈকতে, তাই। আইসক্রিমের দোকানটা হঠাৎ করেই দেখতে পেল, আর তারপর… আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি, রাস্তা পার হওয়ার জন্য ছুট লাগিয়েছে ওরা… দৌড়ে যাচ্ছে ওই দোকানের দিকে
ওদের পেছন পেছন ছুট লাগালাম আমিও। ইচ্ছা ছিল, ধরে ফেলবো ওদেরকে। আর ঠিক তখনই দেখতে পেলাম গাড়িটা… নীল রঙের একটা ভক্সওয়াগেন… ছুটে আসছে আমাদের দিকে। আমি নিশ্চিত ছিলাম, আমাদেরকে দেখতে পাবে চালক, ব্রেক কষবে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। টিমোথি আর জেরেমিকে আমি ধরে ফেলার আগেই ওদেরকে জোরে ধাক্কা মারল গাড়িটা। দেখলাম, হুমড়ি খেয়ে এক পাশে পড়ে গেল টিমোথি, আর জেরেমি স্রেফ উড়াল দিল বাতাসে। ভেবেছিলাম, দুই ভাইয়ের মধ্যে জেরেমিরই ক্ষতি হবে বেশি।’ মিসেস গডউইনের দিকে তাকাল মেরি। ‘আপনার সামনে এসব কথা বলতে ভালো লাগে না আমার, জুডিথ।’
‘সমস্যা নেই, মেরি। তাঁরা শুধু জানতে চাইছেন… তার বেশি কিছু না।’
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল মেরি। তারপর আবার বলতে শুরু করল, ‘টিমোথি আর জেরেমিকে চাপা দিয়ে গজ বিশেক এগিয়ে গেল গাড়িটা, তারপর সজোরে ব্রেক কষল ড্রাইভার, রাস্তার সঙ্গে চাকার ঘর্ষণের বিশ্রী আওয়াজ উঠল। ভেবেছিলাম, গাড়ি থেকে নামবে সে, কিন্তু সে-রকম কিছু ঘটেনি। বরং হুট করে গাড়ি চালু করল, গতি বাড়াল, কিছুক্ষণের মধ্যেই গায়েব হয়ে গেল।’
‘ড্রাইভিং সিটে মিসেস ক্যুপারকে দেখেছিলেন?’
‘না। তবে… যতদূর মনে পড়ে, ওই মহিলার মাথার পেছনদিকটা নজরে পড়েছিল আমার। আসলে… চোখের সামনে ও-রকম একটা ঘটনা ঘটতে দেখে সাংঘাতিক নাড়া খেয়েছিলাম মানসিকভাবে, অত কিছু খেয়াল করার মতো অবস্থা ছিল না আমার তখন।’
‘ঠিক আছে। বলে যান।’
‘আর বেশি কিছু বলার নেই। আশপাশ থেকে খুব দ্রুত হাজির হলো অনেক লোক। আইসক্রিমের সেই দোকানের পাশেই ছিল একটা ওষুধের দোকান। সে- দোকানের মালিক হাজির হয়েছিলেন সবার আগে। তাঁর নাম ট্র্যাভার্টন। তিনি খুব সাহায্য করেছিলেন সেদিন।’
‘আইসক্রিমের সেই দোকান থেকে কেউ আসেনি?’
‘না,’ তিক্ত কণ্ঠে বললেন জুডিথ। ‘কারণ দোকানটা বন্ধ ছিল।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মেরি। ‘অথচ দেখুন… কপাল খারাপ হলে যা হয় আর কী… দোকানটা যে বন্ধ ছিল, সেটা খেয়ালই করেনি টিমোথি বা জেরেমি। ‘ক্লোজড’ লেখা ছোট্ট একটা সাইনবোর্ডও ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল দরজায়, সেটাও চোখে পড়েনি ওদের কারও।’
‘তারপর কী হলো?’
‘পুলিশ এল। একটা অ্যাম্বুলেন্সও এল। আমাদেরকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো… আমাদের তিনজনকেই। আমি বার বার জানতে চাইছিলাম, টিমোথি আর জেরেমির অবস্থা কী। কিন্তু জবাবটা দেয়া হচ্ছিল না আমাকে, কারণ আমি ওদের মা না। যা-হোক, একে-ওকে বলে জুডিথকে ফোন করানোর ব্যবস্থা করলাম। ফোন করা হলো অ্যালানকেও।
‘ডায়ানা ক্যুপারকে খুঁজে বের করতে কত সময় লেগেছিল পুলিশের?’
‘দুর্ঘটনার ঘণ্টা দুয়েক পর ওই মহিলার ছেলেই তাঁকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে এসেছিল পুলিশ স্টেশনে। যদি না-ও আনা হতো তাঁকে, পালিয়ে বাঁচতে পারতেন না তিনি। কারণ একজন প্রত্যক্ষদর্শী দেখে ফেলেছিল তাঁর গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নম্বর। সে-নম্বর যদি জানিয়ে দেয়া হতো পুলিশকে, গাড়িটা কার খুঁজে বের করতে সময় লাগত না।’
‘পুলিশ স্টেশনেই কি মিসেস ক্যুপারের সঙ্গে দেখা হয় আপনার?’
‘না। যখন বিচারকাজ অনুষ্ঠিত হচ্ছিল, তখন দেখেছিলাম ওই মহিলাকে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে একটা কথাও বলিনি।’
‘এবং সেদিনের সেই বিচারকাজের পর আর কখনও মিসেস ক্যুপারের সঙ্গে দেখাও হয়নি আপনার?’
‘না। কেন দেখা করবো? আমার জন্য তিনি ছিলেন এ-রকম একজন মানুষ, যার চেহারা কখনও দেখতে চাওয়ার ইচ্ছাও হতো না।’
‘গত সপ্তাহে কেউ একজন খুন করেছে তাঁকে।
‘আপনি কি বলতে চাইছেন আমিই করেছি কাজটা? প্রশ্নটার জবাব যদি হ্যাঁ হয়, তা হলে বলতে বাধ্য হবো, উদ্ভট চিন্তাভাবনা করছেন। মিসেস ক্যুপার কোথায় থাকতেন, এমনকী সেটাও জানা ছিল না আমার।’
কথাটা কেন যেন বিশ্বাস হলো না আমার। আজকাল কারও ঠিকানা খুঁজে বের করাটা বলতে-গেলে কোনো ব্যাপারই না।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম মেরি ও’ব্রায়ানের দিকে। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম, প্রথম দেখায় যে-রকম মনে হয়েছিল, মেয়েটা তার চেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। একটা তরতাজা ভাব আছে তার মধ্যে। একরকমের সরলতা আছে। সব মিলিয়ে খুবই আবেদনময়ী। একইসঙ্গে, টের পেলাম, কেন যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না এই মেয়েকে। কেন যেন বার বার মনে হচ্ছে, সত্যি কথাটা পুরোপুরি বলছে না সে আমাদেরকে।
জুডিথ গডউইন বললেন, ‘মিস্টার হোথর্নের ধারণা, জেরেমি নিজেই গিয়ে দেখা করেছিল ওই মহিলার সঙ্গে।’
‘সেটা সম্পূর্ণ অসম্ভব,’ বলল মেরি। ‘জেরেমি একা কোথাও যায় না কখনও।’
দেখে মনে হলো না, একটুও দমে গেছে হোথর্ন। বলল, ‘হতে পারে। কিন্তু আপনারা জানেন কি না জানি না, খুন হওয়ার কিছুক্ষণ আগে ছেলের কাছে অদ্ভুত একটা টেক্সট মেসেজ পাঠিয়েছিলেন মিসেস ক্যুপার। সেটাতে যা বলা হয়েছে, তা পড়ে আমরা ধারণা করছি, খুন হওয়ার আগে জেরেমিকেই দেখেছিলেন তিনি।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল সে, তারপর হঠাৎ জানতে চাইল, ‘এই মাসের নয় তারিখে… সোমবারে… আপনি আর জেরেমি কি এখানেই ছিলেন?’
‘হ্যাঁ,’ জবাব দিতে কোনো রকম দ্বিধা করল না মেরি।
‘সেদিন দক্ষিণ কেনসিংটনের একটা দোকানে কিছু কেনাকাটা করতে গিয়েছিলেন মিসেস গডউইন; তাঁর সঙ্গে যাননি?’
‘দোকানপাট ঘেন্না করে জেরেমি। ওকে সঙ্গে নিয়ে কোনো কিছু কিনতে যাওয়াটা দুঃস্বপ্নের মতো।’
জুডিথ বললেন, ‘আপনারা এক কাজ করছেন না কেন? সরাসরি গিয়ে দেখা করছেন না কেন জেরেমির সঙ্গে?’
কথাটা শুনে, মনে হলো, আশ্চর্য হয়েছে মেরি।
হোথর্নের দিকে তাকিয়ে আছেন জুডিথ। ‘আপনারা ইচ্ছা করলে গিয়ে দেখা করতে পারেন জেরেমির সঙ্গে। ইচ্ছা করলে টুকটাক প্রশ্নও জিজ্ঞেস করতে পারেন ওকে। তবে… একটু খেয়াল রাখবেন… সে কিন্তু অল্পতেই আপসেট হয়ে যায়।’
মিসেস গডউইনের কথায় মেরির-মতো আশ্চর্য হয়েছি আমিও। তবে, বুঝতে পারলাম, জেরেমির সঙ্গে দেখা করিয়ে দিয়ে আমাদের-কবল-থেকে মুক্তি পেতে চাইছেন তিনি আসলে।
যা-হোক, সম্মতি জানানোর কায়দায় মাথা ঝাঁকাল হোথর্ন।
আমাদের দু’জনকে নিয়ে উপরতলায়-যাওয়ার সিঁড়ির উদ্দেশে রওয়ানা হলেন জুডিথ।
সিঁড়ি বেয়ে উঠছি আমরা। পুরনো কাঠের-সিঁড়ি ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ করছে আমাদের পায়ের নিচে। যত উপরে উঠছি, এই বাড়ি তত পুরনো আর বেখাপ্পা ঠেকছে আমার কাছে। দোতলায় চলে এলাম। ল্যান্ডিং পার হয়ে হাজির হলাম একটা ঘরের সামনে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, এই ঘর কোনো এককালে মাস্টার বেডরুম ছিল এবং এখন এখানে থাকতে দেয়া হয়েছে জেরেমিকে। করিডরের একটা জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে দূরের রক্সবরো অ্যাভিনিউ।
ঘরের দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ। সেটাতে টোকা দিলেন জুডিথ। জেরেমির পক্ষ থেকে সাড়ার জন্য অপেক্ষা করলেন না। আমাদেরকে নিয়ে ঢুকে পড়লেন ভিতরে।
‘জেরেমি?’ বললেন তিনি। ‘দু’জন লোক এসেছেন… তোমার সঙ্গে দেখা করতে চান।
‘তাঁরা কারা?’ আমাদের দিকে উল্টো ঘুরে আছে জেরেমি।
‘এই তো… আমার দু’জন বন্ধু। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান।’
একটা কম্পিউটারের সামনে বসে আছে জেরেমি। কোনো একটা গেম খেলছে… খুব সম্ভব মর্টাল কম্ব্যাট। কণ্ঠ শুনেই বোঝা গেল, কিছু-একটা সমস্যা আছে ওর। কেমন ভাঙা ভাঙা উচ্চারণ… যেন ঠিকমতো কথা বলতে পারে না। শুনলে মনে হয়, যেন বসে আছে দেয়ালের ওপাশে… যেন দেয়াল ভেদ করে শোনা যাচ্ছে ওর গলার আওয়াজ। বেশ মোটা সে। মাথায় লম্বা লম্বা কালো চুল। সে-চুলে কতদিন চিরুনি পড়েনি, কে জানে! পরনে ব্যাগি জিন্স আর একটা মোটা-বেঢপ সোয়েটার। ঘরের দেয়ালে-দেয়ালে এভারটন ফুটবল দলের পোস্টার। ডাবল বিছানাটায় এভারটনের একটা লেপ দেখতে পাচ্ছি। সব কিছু পরিপাটি, তারপরও কেমন যেন জীর্ণশীর্ণ। মনে হয়, কেউ যেন এই সাজানো ঘর ফেলে চলে গেছে।
যে-গেম খেলছে জেরেমি, সেটার একটা লেভেল শেষ করল; চাপ দিল পজ বাটনে। তারপর ঘুরল আমাদের দিকে।
ওর চেহারাটা গোলগাল। ঠোঁট মোটা। গালের এখানে-সেখানে হালকা দাড়ি আছে। ওর মস্তিষ্ক যে ক্ষতিগ্রস্ত, সেটা ওর বাদামি চোখের দিকে তাকালে স্পষ্ট বোঝা যায়– কৌতূহলের ছিটেফোঁটাও নেই সেখানে, আমাদেরকে দেখেও যেন দেখছে না। আমি জানি ওর বয়স আঠারো, কিন্তু দেখতে আরও বড় বলে মনে হচ্ছে।
কে আপনারা?’ জিজ্ঞেস করল সে।
‘আমার নাম হোথর্ন। আমি তোমার মায়ের বন্ধু।’
‘আমার মায়ের খুব বেশি বন্ধু নেই।’
‘কথাটা মনে হয় ঠিক না।’ এদিক-ওদিক তাকাল অথবা তাকানোর ভান করল হোথর্ন। ‘তোমার ঘরটা সুন্দর, জেরেমি।
‘এখন আর এই ঘর আমার না। আর কিছুদিনের মধ্যেই এই বাড়ি বিক্রি করে দিচ্ছি আমরা।’
‘এই ঘরের মতোই সুন্দর আরেকটা ঘরের ব্যবস্থা করে দেবো আমরা তোমাকে,’ বলল মেরি। আমাদেরকে পাশ কাটিয়ে ঢুকে পড়েছে সে ঘরের ভিতরে, বসেছে বিছানায়।
‘আমাদেরকে যদি এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে না-হতো, তা হলে মনে হয় ভালো হতো,’ জেরেমির কণ্ঠে আক্ষেপ।
‘আপনারা কি কিছু জিজ্ঞেস করতে চান ওকে?’ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন জুডিথ, আমরা কী জানতে চাইবো জেরেমির কাছে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন
সম্ভবত।
‘তুমি কি প্রায়ই বাইরে যাও, জেরেমি?’ জিজ্ঞেস করল হোথর্ন।
কথাটা কেন জানতে চাইল সে, ঠিক বুঝলাম না। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, লন্ডনের রাস্তায় একা বের হওয়ার মতো সক্ষমতা নেই জেরেমির। আগ্রাসী বা অন্য কোনো ধরনের হিংসাত্মক মনোভাবও দেখতে পাচ্ছি না ওর ভিতরে। ওর ভিতর থেকে ওসব আবেগ বের করে নিয়ে গেছে দুর্ঘটনাটা। একইসঙ্গে জীবনের স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশও বিদায় নিয়েছে ওর ভিতর থেকে।
‘মাঝেমধ্যে বাইরে যাই আমি,’ বলল জেরেমি।
‘কিন্তু একা না,’ বলল মেরি।
‘কখনও কখনও বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাই,’ বলল জেরেমি। শুনে মনে হলো, মেরি একটু আগে যা বলেছে, সেটার প্রতিবাদ করেছে যেন
‘তোমাকে একটা ট্যাক্সিতে তুলে দিই আমরা তখন। গন্তব্যের শেষপ্রান্তে তোমার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন তিনি। কাজেই এভাবে দেখা করতে যাওয়াটা একা-একা কোথাও যাওয়ার মধ্যে পড়ে না।
‘কখনও দক্ষিণ কেনসিংটনে গেছ তুমি?’ জানতে চাইল হোথর্ন।
‘অনেকবার।’
মিসেস গডউইন বললেন, ‘ওটা কোথায়, জানে না সে।’
আর তেমন কোনো কথা হলো না জেরেমির সঙ্গে। এই ঘরে থাকতে মোটেও ভালো লাগছে না আমার, তাই বেরিয়ে এলাম। হোথর্নও চলে এল আমার পিছু পিছু। আমাদেরকে নিচতলায় নিয়ে গেলেন জুডিথ গডউইন।
হোথর্ন বলল, ‘মেরি মেয়েটা যে এখনও আছে আপনাদের সঙ্গে, সেজন্য কৃতিত্ব পাওয়া উচিত তার।’
কণ্ঠ শুনে মনে হলো, মেরির উপর সন্তুষ্ট হয়েছে সে। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে আমার, আসলে আরও কিছু তথ্য আদায় করে নিতে চাইছে মিসেস গডউইনের কাছ থেকে
‘টিমোথি আর গডউইনকে খুব আদর করত মেরি,’ শীতল কণ্ঠে বললেন জুডিথ। ‘তাই দুর্ঘটনার পরও রয়ে গেছে আমাদের সঙ্গে। এবং সে যে আছে, সেজন্য আমি খুশি।
আরও একবার মনে হলো আমার, কিছু একটা বলছেন না তিনি।
‘আপনারা এখান থেকে চলে যাওয়ার পরও কি সে থাকবে আপনাদের সঙ্গে?’
‘এই ব্যাপারটা নিয়ে এখনও কথা হয়নি ওর সঙ্গে।’
হাঁটতে হাঁটতে সদর-দরজার কাছে হাজির হয়ে গেছি আমরা।
দরজাটা খুলে দিলেন জুডিথ। ‘একটা কথা বলি… কিছু মনে করবেন না। আর যদি না-আসেন আপনারা, ভালো হয়। কারণ মনোযোগ ব্যাহত হয়, এ-রকম কিছু পছন্দ করে না জেরেমি। তা ছাড়া যাদেরকে চেনে না, তাদের সঙ্গে ঠিকমতো কথাও বলতে পারে না। আসলে… আমি চেয়েছিলাম ওকে দেখুন আপনারা, যাতে কী- অবস্থা-ওর বুঝতে পারেন। চেয়েছিলাম যাতে বুঝতে পারেন, ডায়ানা ক্যুপারের সঙ্গে যা ঘটেছে, সে-ব্যাপারে কিছুই করার নেই আমাদের। পুলিশও বিশ্বাস করে না, ওই ঘটনায় কোনো সম্পৃক্ততা আছে আমাদের। এর বেশি কিছু বলার নেই আমার।
‘ধন্যবাদ,’ বলল হোথর্ন। ‘সহযোগিতা করলেন আমাদেরকে।’
চলে এলাম আমরা।
দরজাটা লাগিয়ে দেয়া হলো আমাদের পেছনে।
পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল হোথর্ন, একটা ধরাল। খোলা বাতাসে বেরিয়ে এসে আমারও ভালো লাগছে।
‘চিঠিটা মিসেস গডউইনকে দেখালেন না কেন?’ জানতে চাইলাম আমি।
‘কী?’ ম্যাচকাঠি ঝাঁকাচ্ছে হোথর্ন, নেভাচ্ছে আগুন।
‘ডায়ানা ক্যুপার যে-চিঠি পেয়েছিলেন, সেটা মিসেস গডউইনকে দেখাননি বলে আশ্চর্য হয়েছি। কোন চিঠির কথা বলছি, বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই… আন্দ্রিয়া ক্লুভানেকের কাছ থেকে যেটা পেয়েছিলেন, সেটা। হতে পারে, ওই চিঠি মিসেস গডউইনই লিখেছেন। অথবা তাঁর স্বামী লিখেছেন। তাঁকে যদি দেখানো হতো চিঠিটা, হাতের-লেখা চিনতে পারতেন তিনি।
অনিশ্চিত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল হোথর্ন। খেয়াল করলাম, আনমনা হয়ে আছে সে… কিছু-একটা ভাবছে। বিড়বিড় করে বলল, ‘আহা বেচারা!’
বুঝে নিলাম, জেরেমির কথা ভাবছে। বললাম, ‘আসলেই… ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা ঘটে গেছে ওই ছেলের সঙ্গে।’
আন্তরিকভাবেই বলেছি কথাটা। মনে পড়ে গেছে আমার দুই ছেলের কথা। লন্ডনের রাস্তায় প্রায়ই বেরিয়ে পড়ে ওরা সাইকেল নিয়ে। কখনও কখনও হেলমেট পড়তে ভুলে যায়। তখন ওদের সঙ্গে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে হয় আমাকে। কিন্তু… এই ব্যাপারে বেশি কিছু করারও নেই আমার। ওদের দু’জনের বয়সই ত্রিশের কাছাকাছি… আসলে একটা বয়সের পর ছেলে-মেয়েদেরকে তেমন কিছু বলাও যায় না। যা-হোক, জেরেমি গডউইন যেন আমার কাছে দুঃস্বপ্নের কোনো মূৰ্ত প্ৰকাশ।
‘আমার একটা ছেলে আছে,’ বলল হোথর্ন।
‘ওর বয়স কত?’
‘এগারো।’
খেয়াল করলাম, কেমন মনমরা হয়ে গেছে হোথর্ন। ওর আনমনা ভাবটা যায়নি।
হাঁটতে শুরু করল সে। ওর পিছু নিলাম।
অদ্ভুত কিছু-একটা ঘটল এমন সময়।
আজব কোনো এক তাড়না অনুভব করলাম আমি নিজের ভিতরে। অথবা… হতে পারে… কোনো একটা নড়াচড়া দেখতে পেলাম চোখের কোনা দিয়ে। মনে হতে লাগল, কেউ যেন নজর রাখছে আমাদের উপর। হাঁটতে হাঁটতে থেমে দাঁড়ালাম, ঘুরে তাকালাম মিসেস গডউইনের বাড়ির দিকে।
হ্যাঁ, আমার অনুমান ভুল হয়নি।
জেরেমি গডউইনের ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে আছে কেউ একজন। তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।
মানুষটা কে, সেটা আমি ঠাহর করার আগেই সরে গেল সে ওই জানালার কাছ থেকে।
৯. তারকার ক্ষমতা
হাঁটতে হাঁটতে ফিরছি আমরা টিউব স্টেশনে। বেজে উঠল হোথর্নের মোবাইল ফোন। কল রিসিভ করল সে, কথা বলল কিছুক্ষণ, কিন্তু নিজের নামটা বলল না। শুধু চুপ করে থেকে আধ মিনিটের মতো শুনল ও-প্রান্তের কথাগুলো। তারপর লাইন কেটে দিল।
‘ব্রিক লেনে যেতে হবে আমাদেরকে,’ বলল আমাকে।
‘কেন?’
‘লন্ডনে ফিরে এসেছে ড্যামিয়েন ক্যুপার।’
‘একটু আগে আপনাকে ফোন করেছিল কে?’
সেটা জানা কি খুব জরুরি?’
‘প্রয়োজনীয় ইনফর্মেশন কোত্থেকে পাচ্ছেন আপনি, জানতে কৌতূহল হচ্ছে আমার।’
কিন্তু হোথর্ন কিছু বলল না।
সে চুপ করে আছে দেখে বলে চললাম, ‘আপনি জানতেন, দক্ষিণ কেনসিংটন স্টেশনে গিয়েছিলেন জুডিথ গডউইন। কেউ একজন সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে দিয়েছিল আপনাকে। আন্দ্রিয়া ক্লুভানেকের ক্রিমিনাল রেকর্ডের ব্যাপারেও জানা ছিল আপনার। অথচ আপনি এখন আর পুলিশে চাকরি করছেন না। তারপরও দেখা যাচ্ছে ইনফর্মেশনের কোনো অভাব হচ্ছে না আপনার।’
‘এসব তেমন জরুরি কিছু না।’
‘আপনার জন্য হয়তো না, কিন্তু আমার জন্য জরুরি। আপনাকে নিয়ে একটা বই লিখছি আমি। কাজেই পাঠককে জানাতে হবে, কোত্থেকে এসব তথ্য জোগাড় করছেন। নিশ্চয়ই বলবেন না, বাতাস থেকে এত কথা জানতে পারছেন? দরকার হলে বলুন কারও সঙ্গে কোনো একটা গ্যারেজে দেখা করছেন, আর সে-লোক এসব কথা জানাচ্ছে আপনাকে। তার নাম-পরিচয় গোপন রাখার স্বার্থে তাকে ‘ডিপ থ্রোট’ হিসেবে আখ্যায়িত করতেও কোনো অসুবিধা নেই আমার। আচ্ছা, থাক, বাদ দিন। সত্যিটা জানা দরকার আমার। বোঝাই যাচ্ছে, আপনাকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করার মতো কেউ-না-কেউ আছে। আমি জানতে চাই, কে লোকটা?’
‘ঠিক আছে। বলছি। কিন্তু তার নাম বলা যাবে না। ধরে নিন, আমার এক পুরনো সহকর্মী সে। আমার সঙ্গে যা ঘটেছিল, সে-ব্যাপারে মোটেও খুশি ছিল না সে। মানে… আমি বলতে চাইছি… ওই ঘটনায় আমার কোনো দোষ ছিল না আসলে। যা-হোক, ঘটনাটার পর থেকে আমাকে একজন কনসালটেন্ট হিসেবে ব্যবহার করছে ওই লোক।’
‘আপনারা এ-রকম কতজন কাজ করছেন পুলিশের পক্ষে?’
‘বলতে গেলে আমি একাই। কারণ অন্য যারা পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করছে, তারা কোনো সুফল বয়ে আনতে পারছে না। তাদের পেছনে শুধু শুধু টাকা আর সময় খরচ করছে পুলিশ।’
‘ব্রিক লেনের ব্যাপারে কী যেন বলছিলেন?’
‘গতকাল ফিরে এসেছে ড্যামিয়েন ক্যুপার। একটা বিজনেস ক্লাস ট্রিপে সওয়ার হয়ে লস অ্যাঞ্জেলস থেকে এসেছে সে। সঙ্গে তার বান্ধবীও আছে। মেয়েটার নাম গ্রেস লভেল। তাদের সঙ্গে আবার একটা বাচ্চাও আছে।’
‘ড্যামিয়েন ক্যুপারের যে কোনো সন্তান ছিল, আগে বলেননি।
‘আগে বলেছিলাম, ওই লোকের কোকেন খাওয়ার বদভ্যাস আছে। যা-হোক, ব্রিক লেনে নিজের একটা ফ্ল্যাট আছে তার। এখন সেখানেই যাচ্ছি আমরা।
হোথর্ন আমাকে কবে বা কখন বলেছিল কোকেন খাওয়ার বদভ্যাস আছে ক্যুপারের, মনে করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। যা-হোক, হ্যাঁরো স্কুলটা পার হলাম দু’জনে, এগিয়ে যাচ্ছি স্টেশনের দিকে। এই কেসে নিজের ভূমিকা নিয়ে ভাবছি। লন্ডনের এখানে-সেখানে যাচ্ছে হোথর্ন, ওকে স্রেফ অনুসরণ করছি আমি… তার বেশি কিছু না। ব্যাপারটা অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছে আমার মনে। কারণ পশ্চাদ্গমনের এই ব্যাপারটা বই-লেখার-ক্ষেত্রে কীভাবে সাহায্য করবে আমাকে, ঠিক বুঝতে পারছি না। ব্রিটানিয়া রোড থেকে ফিউনারেল পার্লার, তারপর সাউথ অ্যাক্টন, মার্বেল আর্চ, হ্যাঁরো-অন-দ্য-হিল… আর এখন যাচ্ছি ব্রিক লেনে। আমার কাছে পুরো ব্যাপারটা এখন একটা হত্যারহস্যের তুলনায় লন্ডনের এ টু জেড’ বলে মনে হচ্ছে।
জেরেমি গডউইনের সঙ্গে দেখা করেও কোনো ফায়দা হয়নি… ব্যাপারটা বেশ বিরক্তিকর ঠেকছে আমার কাছে। অথচ ডায়ানা ক্যুপার টেক্সট মেসেজ পাঠিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন, জেরেমিকে দেখেছিলেন তিনি। আবার একইসঙ্গে এ-কথাও ঠিক, একা একা বাড়ির বাইরে বের হওয়া অথবা লন্ডনের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোটা সম্ভব না জেরেমির পক্ষে। আর নৃশংস ও সুপরিকল্পিত কোনো হত্যাকাণ্ডের কথা যদি বলি… ও-রকম কোনো কিছু ওই ছেলের দ্বারা এককথায় অসম্ভব। এখন কথা হচ্ছে, জেরেমি যদি মিসেস ক্যুপারের গলায় ফাঁস আটকে না- থাকে, তা হলে কে করেছে কাজটা?
ব্রিক লেনে যাওয়ার জন্য একটা টিউব ট্রেনে সওয়ার হলাম আমরা। টিউবে না-উঠে যদি ট্যাক্সি নিতাম, তা হলে সারাদিনেও পৌঁছাতে পারতাম কি না জায়গামতো, সন্দেহ আছে
আমাদের কামরার ভিতরটা বলতে গেলে খালি। হোথর্নের মুখোমুখি বসেছি আমি।
দরজাটা লেগে যাওয়ামাত্র সে জানতে চাইল, ‘কোনো নাম রেখেছেন?’
‘নাম? কীসের?’
‘বইটার!’
‘এখনও নাম রাখার সময় হয়নি। কারণ, এখন পর্যন্ত সমাধান করতে পারেননি আপনি রহস্যটার। যদি করতে পারেন, সেক্ষেত্রে আমি বুঝতে পারবো, কী নিয়ে একটা বই লিখতে যাচ্ছি।’
‘কোনো বই লেখার সময় নামটা কি আগেই ভেবে নেন না? ‘
‘না।’
বইয়ের নামকরণের ব্যাপারটা কখনোই সহজ কোনো কাজ বলে মনে হয় না আমার। যুক্তরাজ্যে প্রতি বছর দুই লক্ষের মতো বই প্রকাশিত হয়। কোনো কোনো বই লেখেন স্বনামধন্য লেখক বা লেখকেরা। কোনো কোনো বইয়ের নামকরণ করা হয় মাত্র দুই কি তিন শব্দ ব্যবহার করে। পুরো প্রচ্ছদের বড়জোর ছয় থেকে নয় ইঞ্চির মতো জায়গা দখল করে ওসব নাম। আমার মতে, বইয়ের নাম হতে হবে সংক্ষিপ্ত, স্মার্ট, এবং সেটার একটা অর্থ থাকতে হবে। এমনভাবে করতে হবে নামকরণের কাজটা, যাতে সহজেই পড়তে পারে পাঠক, এবং সহজেই মনে রাখতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, নামটা হবে হবে মৌলিক। এত কিছু মিলিয়ে নামকরণের কাজটা দুরূহ হয়ে যায় কখনও কখনও।
বিখ্যাত অনেক বইয়ের নাম কিন্তু অন্য কোনো জায়গা থেকে ধার-করা। যেমন ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড, দ্য গ্রেন্স অভ র্যাথ, অভ মাইস অ্যান্ড মেন, ভ্যানিটি ফেয়ার। অন্য কোনো-না-কোনো বই থেকে নেয়া হয়েছে এসব নাম। আগাথা ক্রিস্টি তাঁর বিরাশিটা সাহিত্যকর্মের অনেক বইয়ে ব্যবহার করেছেন বাইবেল, শেক্সপিয়ার, টেনিসন, এমনকী রুবাইয়াত অভ ওমর খৈয়াম-এর কোনো কোনো নাম। আমার মতে, নামকরণের ব্যাপারে ইয়ান ফ্লেমিংকে এখনও হারাতে পারেনি কেউ। কী একেকটা নাম যে ব্যবহার করেছিলেন তিনি… ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ, ইউ অনলি লিভ টোয়াইস, লিভ অ্যান্ড লেট ডাই!
যা-হোক, মোদ্দা কথা হচ্ছে, হোথর্নকে নিয়ে যে-বই লিখছি অথবা লিখতে যাচ্ছি, সেটার কোনো নাম ঠিক করিনি এখনও। বইটা আদৌ লিখে শেষ করতে পারবো কি না, সে-ব্যাপারে এখনও সংশয় রয়ে গেছে আমার মনে।
হোথর্ন চুপ করে আছে, ডুবে আছে নিজের ভাবনায়। ওকে বিরক্ত করতে ইচ্ছা করছে না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। সাঁইসাঁই করে একের পর এক স্টেশন ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে আমাদের টিউব ট্রেন… ওয়েম্বলি পার্ক, সাউথ হ্যাঁম্পস্টিড, বেকার স্ট্রিট। শেষের স্টেশনটা আমাকে মনে করিয়ে দিল শার্লক হোমসের কথা।
‘হোথর্ন ইনভেস্টিগেটস’ কেমন হয়?’ হঠাৎ বলে উঠল হোথর্ন।
‘কী বললেন?’
‘বইটার একটা নাম প্রস্তাব করলাম আর কী।’
আরও লোক উঠেছে ট্রেনে। নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল হোথর্ন, এগিয়ে এসে বসে পড়ল আমার পাশে। ‘আমি চাই, আমাকে নিয়ে যে-ক’টা বই লিখবেন আপনি, সবগুলোর প্রচ্ছদে আমার নাম থাকবে।’
সে যে কোনো একটা সিরিযের কথা ভাবছে, কল্পনাও করিনি কখনও। বলা বাহুল্য, কথাটা শুনে রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেল আমার।
বললাম, ‘নামটা ভালো লাগল না।’
‘কেন?’
‘কারণ নামটা সেকেলে।’
‘তা-ই?’
‘হ্যাঁ। আগাথা ক্রিস্টির একটা বই আছে: পার্কার পাইন ইনভেস্টিগেটস। হেটি ওয়েইনথ্রপ ইনভেস্টিগেটস নামে আরেকটা বই আছে। কাজেই এই নামে বই লেখা হয়ে গেছে একাধিক
ও আচ্ছা। তা হলে অন্য কোনো নাম ভেবে বের করতে হবে আমাকে।’
‘দরকার নেই। বইটা আমি লিখছি। কাজেই নামকরণের দায়িত্বও আমার।’
‘ঠিক আছে। কিন্তু খেয়াল রাখবেন নামটা যাতে ভালো হয়। …সত্যি বলতে কী… আপনার দ্য হাউস অভ সিল্ক বইয়ের নামটা মোটেও ভালো লাগেনি আমার কাছে।’
কড়া জবাব দিতে যাচ্ছিলাম কথাটার, কিন্তু তার আগেই ইউস্টন স্কোয়ারে পৌঁছে গেল আমাদের ট্রেন। বাদ দিলাম বইয়ের নামকরণের প্রসঙ্গটা, ভাবতে লাগলাম ড্যামিয়েন ক্যুপারকে নিয়ে।
ওই লোকের ব্যাপারে ইতোমধ্যে অল্পবিস্তর জানা হয়ে গেছে আমার… গতকাল রাতে গুগলে সার্চ করে কিছু তথ্য জেনে নিয়েছি।
রাডা, মানে রয়্যাল অ্যাকাডেমি অভ ড্রামাটিক আর্টের ছাত্র ছিল সে; ১৯৯৯ সালে বেরিয়ে আসে সেখান থেকে। হ্যাঁমিল্টন হোডেল নামের একটা ট্যালেন্ট এজেন্সি তখন বলতে গেলে ছোঁ মেরে তুলে নেয় তাকে। পরের দুই বছর ধারাবাহিকভাবে কাজ করতে থাকে শেক্সপিয়ার কোম্পানিতে… দ্য টেম্পেস্টে অভিনয় করেছে এরিয়েল হিসেবে, ম্যাকবেথে অভিনয় করেছে ম্যালকম হিসেবে। হেনরি ফাইভে অভিনয় করেছে নাম-ভূমিকায়।
এরপর গিয়ে যোগ দেয় টিভিতে। বিবিসি’র একটা কন্সপাইরেসি থ্রিলার ছিল … স্টেট অভ প্লে, ২০০৩ সালে প্রচারিত হতো সেটা; অভিনয় করে ওই সিরিজে। তারপর অভিনয় করে বিবিসি’র-ই একটা নাটকে, নাম ব্লিক হাউস। এতই চমৎকার হয়েছিল ওর অভিনয় যে, বিএএফটিএ নমিনেশন পেয়েছিল প্রথমবারের মতো। একই বছর দ্য ইম্পর্টেন্স অভ বিইং আর্নেস্ট নাটকের জন্য জিতে নিয়েছিল ইমার্জিং ট্যালেন্ট অ্যাওয়ার্ড। গুজব আছে, সে নাকি ডক্টর হু নামের একটা নাটকে অভিনয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল, কারণ ততদিনে চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু হয়ে গেছে ওর। পর পর দুটো সিনেমায় অভিনয় করে ফেলল: ম্যাচ পয়েন্ট এবং প্রিন্স ক্যাস্পিয়ান ২০০৯ সালে পাড়ি জমায় হলিউডে। ম্যাড মেন-এর দুটো সিজনে অভিনয় করে সেখানে গিয়ে। তারপর সুযোগ পেয়ে যায় হোমল্যান্ড-এর প্রধান চরিত্রে অভিনয় করার। মিসেস ক্যুপার যখন মারা গেলেন, সে-সময় নাগাদ শুরু হওয়ার কথা ছিল ওই সিরিযের শুটিং।
ব্রিক লেনে দুই বেডরুমের যে-ফ্ল্যাটে থাকে সে, সেটা কবে নাগাদ কিনেছে, সে-ব্যাপারে আসলে নিশ্চিত না আমি। তবে এটা জানি, লন্ডনে যখন আসে, তখন ওখানেই গিয়ে ওঠে।
জায়গামতো হাজির হলাম আমি আর হোথর্ন। একটা গুদামের দ্বিতীয় তলায় বানানো হয়েছে ওই ফ্ল্যাট। ডাবল হাইটের লিভিংরুমটা দেখামাত্র কেন যেন মনে হলো আমার, এটা কোনো টেলিভিশন সেটের মতো মেকি। আলাদা রান্নাঘরের বদলে ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্টাইলের কিচেন স্টেজ আছে। একটা সিটিং এরিয়া আছে, সেখানে আগের দিনের কিছু চামড়ার সোফা আছে। একটা কফি টেবিল ঘিরে আছে কয়েকটা আর্মচেয়ার। কাঁচের একটা দরজা দেখতে পাচ্ছি, ওটা দিয়ে বের হলে রুফ টেরেসে হাজির হওয়া যাবে। আরেক কোনায় দেখতে পাচ্ছি পোড়ামাটির কিছু পাত্র আর একটা গ্যাস বারবিকিউ। দূরের একদিকের দেয়াল ঘেঁষে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে একটা উরলিটজার জুকবক্স। আরেকদিকের দেয়াল ঘেঁষে একটা প্যাঁচানো সিঁড়ি উঠে গেছে উপরতলায়।
আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ড্যামিয়েন ক্যুপার। কিচেন কাউন্টারের ধারে একটা বার স্টুলের উপর বসে আছে সে। তাকে দেখে কেন যেন ঠিক স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না। কেমন অবসন্ন দেখাচ্ছে। চওড়া কলারের শার্টটা খুলে রেখেছে বুকের কাছে। বুকের লোমের সঙ্গে লেপ্টে থাকতে দেখা যাচ্ছে সোনার একটা চেইন। দেখা যাচ্ছে, রোদে পুড়ে বাদামি হয়ে গেছে ওর সে-জায়গার চামড়া। মনে হচ্ছে, কোনো একটা ফ্যাশন ম্যাগাজিনের জন্য পোজ দিচ্ছে বোধহয়।
নজরকাড়া সুদর্শন সে, এবং ব্যাপারটা জানা আছে তার। জেট পাথরের মতো কালো চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করে রেখেছে। দুই চোখ গাঢ় নীল। প্লেনে চেপে এতদূর যাত্রা করে এসেছে বলেই হয়তো ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আবার এমনও হতে পারে, লন্ডনে পা দেয়ামাত্র হয়তো তাকে ছেঁকে ধরেছিল পুলিশ… জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তা ছাড়া মিসেস ক্যুপারের শেষকৃত্যানুষ্ঠানটাও আয়োজন করা বাকি আছে।
মোবাইল ফোনে কথা বলছে সে, ওই অবস্থাতেই হাতের ইশারায় কাছে ডাকল আমাদেরকে। তাকে বলতে শুনলাম, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি যাবো তোমার কাছে। এখন আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য কয়েকজন লোক এসেছে। নিজের খেয়াল রেখো। দেখা হবে।
লাইন কেটে দিল। তাকাল আমাদের দিকে।
‘হাই। দুঃখিত… জরুরি একটা ফোন এসেছিল। মাত্র গতকাল ফিরে এলাম, আর এসেই পাগলপারা হওয়ার অবস্থা।’
মনে পড়ে গেল ড্যামিয়েন ক্যুপারের ব্যাপারে আমাকে কী-কী বলেছিল হোথর্ন। টাকাপয়সার টানাটানি চলছে লোকটার। ঝামেলা হচ্ছে বান্ধবীকে নিয়ে। ড্রাগসের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে সে।
কথাগুলো কেন যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হলো আমার।
হাত মেলালাম আমরা।
‘কফি খাবেন?’ জানতে চাইল ড্যামিয়েন। ইশারায় দেখিয়ে দিল সোফাটা,
বসতে বলছে আমাদেরকে।
‘ধন্যবাদ।’
কফি বানানোর মেশিন আছে ড্যামিয়েনের এখানে। ওটা চালু করে দিল সে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বলতে শুরু করল, ‘মনে হচ্ছে কোনো একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি যেন। আমার বেচারী মা-টা! গতকাল বিকেলে পুলিশের সঙ্গে লম্বা সময় ধরে কথা হয়েছে আমার। আজ সকালেও কথা বলেছি। আমাকে যখন খবরটা জানানো হলো, বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না।’ একটুখানি থামল, তারপর আবার বলতে লাগল, ‘আপনারা যা-যা জানতে চাইবেন, সব বলবো। যে-বেজন্মা খুন করেছে আমার মাকে, তাকে ধরতে যা যা করা সম্ভব আমার পক্ষে…
‘আপনার মাকে শেষ কবে দেখেছেন?’ জিজ্ঞেস করল হোথৰ্ন।
‘শেষ যে-বার এসেছিলাম লন্ডনে, তখন। মানে ডিসেম্বরে।’ ফ্রিজ খুলে দুধ বের করল ড্যামিয়েন। ‘বাচ্চাটার সঙ্গে সময় কাটাতে চাইছিল মা… তাঁর একটা নাতনি আছে। গতবারের ক্রিসমাস একসঙ্গে কাটিয়েছি আমরা। মায়ের সঙ্গে ভালোই বনিবনা হয়েছে গ্রেসের। ওরা যে একজন আরেকজনকে ভালোমতো চিনতে পেরেছে, সেজন্য আমি খুশি।’
‘শুনলাম আপনার মায়ের সঙ্গে আপনার ভালো সম্পর্ক ছিল,’ বলল বটে, কিন্তু হোথর্নের চোখ দেখে বুঝতে পারলাম, অন্যকিছু ভাবছে ওর মন।
‘হ্যাঁ। অবশ্যই। মানে… আমি আমেরিকায় চলে যাওয়ার পর এখানে একা একা থাকাটা সহজ ছিল না মায়ের পক্ষে। কিন্তু আমার কাজে সব সময় সবরকমের সহযোগিতা করেছেন তিনি। আমি যা করছিলাম, তা নিয়ে গর্ব ছিল তাঁর মধ্যে। থাকবে না-ই বা কেন? আমার বাবা মারা গেছেন অনেক বছর আগে। তারপর আর বিয়ে করেননি মা। আমার মনে হয় আমার সাফল্যই তাঁর জন্য অনেক বড় কিছু ছিল।’ দুই কাপ কফি বানিয়ে আমার আর হোথর্নের হাতে দিল ড্যামিয়েন। ‘মায়ের খুন হওয়ার খবর শুনে কত বড় চোট যে পেয়েছি আমি মনে, বোঝাতে পারবো না আপনাদেরকে।’
‘সপ্তাহখানেক আগে মারা গেছেন তিনি,’ মন্তব্য করল হোথ
‘মানে… আমি আরও আগে কেন আসিনি, সেটা জানতে চাইছেন? জরুরি কিছু কাজ ছিল। নতুন একটা শো’র রিহার্সাল করছিলাম আমরা। সব কিছুগোছগাছ করে আসতে হয়েছে আমাকে। আমেরিকাতে একটা কুকুর আছে আমার, ওটার দেখভালের দায়িত্বও বুঝিয়ে দিতে হয়েছে।
‘একটা কুকুর আছে আপনার? বাহ্, ভালো
‘হ্যাঁ, ওটা ল্যাব্রাডুডল প্রজাতির।’
বুঝতে পারার ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল হোথর্ন। ‘আপনি যখন আমেরিকায় থাকতেন, তখন নিশ্চয়ই আপনার মায়ের সঙ্গে কথা হতো?’
‘হ্যাঁ, হতো।’
‘নিয়মিত?’
‘সপ্তাহে একবার। সেটা যদি সম্ভব না-হতো, তা হলে দু’সপ্তাহে অন্তত একবার। …মা প্রায়ই আসতেন আমার এখানে, দেখে যেতেন ঠিক-ঠাক আছে কি না সব কিছু। টেরেসের গাছগুলোতে পানি দিতেন। টুকটাক আরও কিছু কাজ করতেন।’ অনিশ্চিত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল ড্যামিয়েন। ‘আসলে সব সময় কথা হতো না আমাদের দু’জনের। নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন মা। আমেরিকার সঙ্গে ইংল্যান্ডের সময়ের পার্থক্য আছে, সেটাও একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াত কখনও কখনও। তবে টেক্সট মেসেজ আর ই-মেইলের আদান-প্রদান নিয়মিত চলত আমাদের মধ্যে।
‘যেদিন মারা গেলেন তিনি,’ মুখ খুললাম আমি, ‘সেদিন একটা টেক্সট মেসেজ পাঠিয়েছিলেন আপনার কাছে।
‘হ্যাঁ। পুলিশকে কথাটা বলেছি। মা বলেছিলেন, তিনি ভয় পেয়ে গেছেন।’
‘ওই মেসেজের মাধ্যমে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন তিনি, জানেন?’
‘বিশেষ একটা ছেলের কথা বোঝাতে চেয়েছেন। আপনারা হয়তো জানেন… একবার ডিলে…’
‘ছেলেটা শুধু আহতই হয়নি,’ চট করে বলে উঠল হোথর্ন, ‘বলতে গেলে বিকলাঙ্গ হয়ে গেছে।’ সোফার কোনায় বসেছে সে, পায়ের উপর পা তুলে দিয়েছে। ওকে যতটা না গোয়েন্দা বলে মনে হচ্ছে,তার চেয়ে বেশি মনে হচ্ছে একজন ডাক্তার। ‘গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ওর মস্তিষ্ক। সার্বক্ষণিক পরিচর্যার দরকার আছে ওর।’
‘ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু করেননি মা… একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।’ দেখে মনে হলো, হঠাৎই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে ড্যামিয়েন। পকেট হাতড়াচ্ছে সে, ধারণা করলাম সিগারেট খুঁজছে।
নিজের প্যাকেটটা বের করল হোথর্ন, একটা সিগারেট অফার করল ড্যামিয়েনকে।
ওটা নিল ড্যামিয়েন।
ওরা দু’জনে সিগারেট ধরাল।
‘আপনি কি বলতে চাইছেন, মায়ের হত্যাকাণ্ডে হাত ছিল ওই ছেলের?’ বলল ড্যামিয়েন। ‘অথচ পুলিশ একবারও ছেলেটার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি আমার সামনে। পুলিশের ধারণা, কোনো একটা ডাকাতি সংঘটিত হয়েছে মায়ের বাড়িতে। তখন গড়বড় হয়ে গিয়েছিল কিছু-একটা, ফলে ওই ডাকাত অথবা ডাকাতরা…’ কথা শেষ না-করে থেমে গেল।
‘সেটা পুলিশের ধারণা, মিস্টার ক্যুপার। কিন্তু আমার কাজ হচ্ছে, পুরো ঘটনা খতিয়ে দেখা। যা-হোক, ডিলের সেই ঘটনার ব্যাপারে আমাকে কি কিছু বলতে পারেন?’
‘মানে আমি গাড়ির ভিতরে ছিলাম কি না সেটা জানতে চাইছেন? যিশুর শপথ, গাড়ির ভিতরে ছিলাম না আমি তখন। দেখুন, ঘটনাটা দশ বছর আগের। মা তখন থাকতেন ওয়ালমার নামের একটা গ্রামে… জায়গাটা ডিলের সঙ্গে। সেখানেই জন্মেছি আমি। বাবা মারা যাওয়ার পরও ওখানেই থাকতে চেয়েছিলেন মা। যে- বাড়িতে থাকতাম আমরা, সেটার খুব কদর ছিল তাঁর কাছে। আমার মনে আছে, বিশেষ সেই দুর্ঘটনা যখন ঘটল, তখন ছিল মায়ের জন্মদিন। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম আমি, সেখানে ছিলাম কয়েকটা দিন। কয়েকটা চিত্রনাট্য পড়ছিলাম, ভাবছিলাম কোন্ কাজে হাত দেয়া যায়। দুর্ঘটনাটা যেদিন ঘটল, সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। গল্ফ খেলতে গিয়েছিলেন মা। কথা ছিল, সেদিন রাতে একসঙ্গে কোথাও ডিনার করতে যাবো আমরা। কিন্তু মা যখন বাসায় ফিরলেন, তখন তাঁর অবস্থা রীতিমতো ভয়াবহ। কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ভুলে চশমা ফেলে এসেছিলেন, আর বাড়ি ফেরার পথে একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছেন… কাদেরকে যেন চাপা দিয়েছেন। বললেন, বুঝতে পেরেছেন সাংঘাতিক ব্যথা পেয়েছে ওই ছেলেগুলো। কিন্তু ওই দুই ভাইয়ের একজন যে ঘটনাস্থলেই মারা পড়েছে, সে- ব্যাপারে কোনো ধারণাই ছিল না তাঁর।’
‘গাড়ি থামালেন না কেন তিনি?’
‘এখন আর সত্যি কথাটা বলতে কোনো অসুবিধা নেই, মিস্টার হোথর্ন। কারণ এখন আর মায়ের বিচার করতে পারবেন না আপনি… কেউই পারবে না। … মা তখন গাড়ি থামাননি, কারণ আমার কথা ভেবে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল তাঁর। আমার ক্যারিয়ার তখন সবে ডালপালা মেলতে শুরু করেছে… চমৎকার কিছু রিভিউ পেয়েছিলাম আমি হেনরি ফাইভের জন্য, ওটা ব্রডওয়েতে প্রদর্শনের ব্যাপারে কথাবার্তাও চলছিল। মা ধরেই নেন, ওই অবস্থায় যদি খারাপ কোনো খবর ছড়িয়ে পড়ে আমাকে নিয়ে, তা হলে সেটা আমার ক্যারিয়ারের ক্ষতি করবে। আমার কথার মানে এ-ই না, পুলিশের কাছে ধরা দেয়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না মায়ের। বরং ও- রকম কোনো চিন্তাই করেননি তিনি। আসলে… তিনি সবার আগে কথা বলতে চাইছিলেন আমার সঙ্গে। তা ছাড়া…’
‘কী?’ সামনে ঝুঁকল হোথর্ন।
‘একটা মেয়ে দেখাশোনা করছিল ওই ছেলে দুটোর। সে বলেছে, একই আইসক্রিম শপ দেখতে পায় ওরা, তারপর ছুটে যায় সেদিকে। কিন্তু দোকানটা বন্ধ ছিল তখন। কাজেই আমার মনে হয় না এসবের কোনো মানে আছে। আরেকটা কথা। একজন প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া গিয়েছিল, পরে গায়েব হয়ে যায় লোকটা।’
‘কার কথা বলছেন?’
ছেলে দুটো গাড়ির নিচে চাপা পড়ার পর যে-লোক সাহায্য করার জন্য সবার- আগে ছুটে গিয়েছিল ঘটনাস্থলে, তার কথা। কিন্তু যেইমাত্র পুলিশ আর অ্যাম্বুলেন্স হাজির হলো, সঙ্গে সঙ্গে গায়েব হয়ে গেল সে। পরে আর কেউ কখনও খুঁজে পায়নি তাকে। তার নাম-পরিচয়ও জানা যায়নি। এমনকী সাক্ষ্য দেয়ার জন্য পুলিশের কাছে অথবা আদালতেও হাজির হয়নি লোকটা।’
‘তার মানে আপনি বলতে চাইছেন দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ছিলেন না আপনার মা?’
‘না, সে-রকম কিছু বলতে চাইছি না… কিন্তু ওই দুর্ঘটনার পর মা কতখানি মুষড়ে পড়েছিলেন, সেটা যদি দেখতেন! জানেন, দুর্ঘটনার পর থেকে গাড়ি চালানোই ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। মন ভেঙে গিয়েছিল তাঁর। তারপর একসময় বুঝতে পারেন, ওয়ালমারে থাকা আর সম্ভব না তাঁর পক্ষে। দুর্ঘটনার কয়েক মাস পর আমাদের সেই বাড়ি বিক্রি করে দেন, চলে আসেন লন্ডনে।
বাইরে, অন্য কোনো ঘরে, একটা টেলিফোন বাজছে। উঠে গিয়ে কল রিসিভ করল ড্যামিয়েন, কিছুক্ষণ কথা বলে ফিরে এল।
‘ওই পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল আপনার মায়ের?’ জানতে চাইল হোথর্ন।
‘গডউইন পরিবারের কথা বলছেন?’ আরও একবার অনিশ্চিত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল ড্যামিয়েন। ‘ছিল। তারা কখনোই ক্ষমা করতে পারেনি মাকে। আদালতের সিদ্ধান্তও মেনে নিতে পারেনি। মা মারা যাওয়ার সপ্তাহ দুয়েক আগে তাঁর সঙ্গে ঝগড়া করে গেছে ওই ছেলে দুটোর বাবা অ্যালান গডউইন।
‘জানতে পারলেন কী করে?’
‘মা বলেছিলেন আমাকে। ব্রিটানিয়া রোডের যে-বাসায় থাকতেন তিনি, সেখানে গিয়েছিল ওই লোক। বিশ্বাস হয় কথাটা? শুনেছি ব্যবসায় ধরা খেয়েছিল সে, আর সেজন্য টাকা চাইছিল মায়ের কাছে। তাকে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন মা। পরে একটা হুমকি চিঠি পাঠায় সে মাকে। …আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন তা হলে বলবো, ব্যাপারটা হয়রানি ছাড়া আর কিছু না। যা-হোক, মাকে পুলিশের কাছে যেতে বলেছিলাম আমি।’
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল হোথর্ন, কিন্তু পারল না… যুবতী আর খুবই আকর্ষণীয় এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণী নেমে আসছে প্যাচানো সেই সিঁড়ি বেয়ে। একহাতে ধরে রেখেছে ছোট একটা মেয়ের হাত। অন্য হাতে একটা মোবাইল ফোন।
‘ডেম,’ ডাকল মেয়েটা ড্যামিয়েনকে, ‘জেসন ফোন করেছে।’ কেমন নার্ভাস শোনাল তার কণ্ঠ। ‘বলছে, ব্যাপারটা নাকি জরুরি।’
‘ঠিক আছে,’ এগিয়ে গিয়ে মেয়েটার হাত থেকে মোবাইল ফোনটা নিল ড্যামিয়েন, চলে গেল টেরেসে। কিছুক্ষণ কথা বলে ফিরে এল। ‘দুঃখিত, আমার ম্যানেজার ফোন করেছিল।’
কৃষ্ণাঙ্গ ওই মেয়ের দিকে তাকালাম। সে-ই সম্ভবত গ্রেস লোভেল। কোনো সন্দেহ নেই, এ-ই মেয়ে একজন মডেল অথবা অভিনেত্রী। অথবা হয়তো কোনো এককালে তা-ই ছিল। বয়স ত্রিশের কিছু বেশি। বেশ লম্বা। চোখ আর গালের মাঝখানে হাড় দুটো বেশ উঁচু। লম্বাটে ঘাড়, পেলব কাঁধ। খুবই টাইট ফিটিং একটা জিন্স আর ঢিলেঢালা কিন্তু দামি একটা জার্সি পরে আছে। জার্সিটা ঢলঢল করছে ওর গায়ে। সঙ্গের বাচ্চাটার বয়স তিনের বেশি হবে না। বড় বড় চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে বাচ্চাটা।
‘আমি গ্রেস,’ নিজের পরিচয় দিল কৃষ্ণাঙ্গ ওই মেয়ে। ‘আর আমার সঙ্গের এই বাচ্চাটার নাম অ্যাশলি। …অ্যাশলি, হ্যালো বলো।’
কিছু বলল না বাচ্চাটা।
‘ড্যামিয়েন কি কফি অফার করেছে আপনাদেরকে?’ জিজ্ঞেস করল গ্রেস। ‘হ্যাঁ, ধন্যবাদ।’
‘আপনারা কি ডায়ানার ব্যাপারে এসেছেন এখানে?’
‘হ্যাঁ।’
‘এই ব্যাপারটা নিয়ে একেবারে ভেঙে পড়েছে ড্যামিয়েন। কিন্তু ওকে দেখলে বোঝা যায় না সেটা। নিজের আবেগ লুকিয়ে রাখতে পারে সে।’
বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ করেই ড্যামিয়েনের পক্ষে সাফাই গাইতে শুরু করল কেন গ্রেস, ঠিক বুঝলাম না। আমার কাছে আশ্চর্য লাগল ব্যাপারটা।
হোথর্ন বলল, ‘তিনি বলেছেন, গত ক্রিসমাসে নাকি মিসেস ক্যুপারের সঙ্গে ছিলেন আপনারা।
‘হ্যাঁ। একসঙ্গে সময় কাটিয়েছি আমরা। তবে আমার চেয়ে অ্যাশলির প্রতি বেশি আগ্রহ ছিল ড্যামিয়েনের মায়ের।’ ফ্রিজ থেকে এক কার্টন জুস বের করল গ্রেস, প্লাস্টিকের একটা কাপে ঢালল কিছুটা। কাপটা দিল অ্যাশলির হাতে। ‘আমার চেয়ে অ্যাশলির প্রতি যে আগ্রহ বেশি ছিল ড্যামিয়েনের মায়ের, সেটা মনে হয় অস্বাভাবিক কিছু না। ওদের পরিবারের প্রথম নাতনি মেয়েটা।’
‘আপনিও কি অভিনয় করেন?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘হ্যাঁ। মানে… করতাম একসময়। অভিনয় করতে গিয়েই ড্যামিয়েনের সঙ্গে পরিচয় আমার। রয়্যাল অ্যাকাডেমি অভ ড্রামাটিক আর্টে একসঙ্গে ছিলাম আমরা। সেখানে হ্যামলেট নাটকে অভিনয় করেছিল সে। চমৎকার হয়েছিল নাটকটা। সবাই টের পেয়েছিল, একদিন বড় তারকা হতে পারবে ড্যামিয়েন। …অফেলিয়ার চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম আমি ওই নাটকে।’
‘তার মানে আপনারা একসঙ্গে আছেন অনেকদিন।’
‘না। রয়্যাল অ্যাকাডেমি অভ ড্রামাটিক আর্টের পর ড্যামিয়েনকে বলতে গেলে কুড়িয়ে নেয় আরএসসি। সে তখন চলে যায় স্ট্র্যাটফোর্ড-আপন-এইভনে। আর আমি চুটিয়ে অভিনয় করতে শুরু করি বেশ কিছু টিভি নাটকে। সত্যি বলতে কী,
কয়েক বছর আগে আবার দেখা হয়েছে আমাদের। তারপর… একসঙ্গে থাকতে শুরু করলাম আমরা। বছর তিনেক আগে জন্ম হলো অ্যাশলির।’
‘তা হলে তো ব্যাপারটা কষ্টকর হয়ে গেল আপনার জন্য,’ বললাম আমি। ‘কাজকর্ম বাদ দিয়ে এখন বাসায় থাকতে হচ্ছে আপনাকে।
‘না। সিদ্ধান্তটা আমারই ছিল।’
কথাটা বিশ্বাস করলাম না। কারণ নার্ভাসনেস দেখতে পাচ্ছি গ্রেসের চোখে। মোবাইল ফোনটা নিয়ে এসে যখন ড্যামিয়েনের হাতে দিল সে একটু আগে, তখন তার চোখে একই রকম নার্ভাসনেস দেখতে পেয়েছিলাম।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন নার্ভাস হয়ে পড়েছিল গ্রেস? ওর হাত থেকে মোবাইল ফোনটা কেড়ে নিতে পারে ড্যামিয়েন, সে-কথা ভেবে? নাকি ড্যামিয়েনকে কোনো কারণে ভয় পায় সে? কোনো সন্দেহ নেই আমার মনে, ড্রামা স্কুলে যখন পরিচয় হয়েছিল ওই দু’জনের, তখন যে-রকম ছিল ড্যামিয়েন, সাফল্য পাওয়ার পর অনেকখানি বদলে গিয়ে সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষে পরিণত হয়েছে।
কথা শেষ করে ঘরে ফিরে এল ড্যামিয়েন। ‘দুঃখিত। সবাই কেমন যেন পাগলপারা হয়ে গেছে। আগামী সপ্তাহেই শুটিং শুরু হতে যাচ্ছে আমাদের।’
জেসন কী বলল?’ জানতে চাইল গ্রেস।
‘আমি কবে ফিরছি, জিজ্ঞেস করল। লোকটা একটা বোকা। মাত্র এলাম আমি লন্ডনে, আর অমনি…’ কথা শেষ না-করে থেমে গেল ড্যামিয়েন, তাকাল হাতঘড়ির দিকে। ‘লস অ্যাঞ্জেলসে এখন ভোর পাঁচটা। অথচ ইতোমধ্যেই ট্রেডমিলে চড়ে ব্যায়াম শুরু করে দিয়েছে সে। কথার ফাঁকে ফাঁকে ওই মেশিনের আওয়াজ পেয়েছি।’
‘আপনি কবে ফিরে যাচ্ছেন তা হলে?’ জিজ্ঞেস করল হোথৰ্ন।
‘মায়ের শেষকৃত্যানুষ্ঠান হবে শুক্রবারে। শনিবারে চলে যাওয়ার ইচ্ছা আছে আমার।’
‘ওহ্,’ চেহারা ঝুলে পড়েছে গ্রেসের, ‘আরও কয়েকটা দিন থাকতে পারলে ভালো হতো!’
‘হ্যাঁ, হতো, কিন্তু উপায় নেই।’ আমাদের দিকে তাকাল ড্যামিয়েন। ‘আর কোনো কিছু কি জানতে চাওয়ার আছে আপনাদের?’ বোঝা গেল, অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে। ‘আসলে… আর কীভাবে সাহায্য করতে পারি আপনাদেরকে, ঠিক বুঝতে পারছি না। যা-যা জানতাম, সবই বলেছি পুলিশকে। আর… একটা কথা বলি… এখন কেন যেন মনে হচ্ছে আমার, মায়ের খুনের তদন্ত মোড় নিচ্ছে অন্য কোনো দিকে।’
মুখ বিকৃত করে ফেলল হোথর্ন, দেখে মনে হলো যেন আপসেট হয়েছে ড্যামিয়েনের কথায়। ‘আপনি কি জানেন, আপনার মা নিজের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের পরিকল্পনা করেছিলেন?’
‘না, জানি না। কারণ কথাটা আমাকে বলেনি মা।’
‘কেন করতে গেলেন তিনি কাজটা, সে-ব্যাপারে কোনো ধারণা আছে আপনার?’
‘না, নেই। মা খুব গোছানো স্বভাবের মানুষ ছিলেন। শেষকৃত্যানুষ্ঠান, উইল…
‘উইলের ব্যাপারটা তা হলে জানা আছে আপনার?’
কথাটা শোনামাত্র রেগে গেল ড্যামিয়েন। গাল দুটো লাল হয়ে গেল তার; দেখে মনে হলো, ছোট দুটো লাল বাল্ব যেন জ্বলে উঠেছে সেখানে। ‘উইলের ব্যাপারটা অনেক আগে থেকেই জানি আমি। কিন্তু এই ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কোনো কথা বলবো না।
‘আমার ধারণা আপনার জন্য সব কিছু রেখে গেছেন আপনার মা।
‘বললাম তো, এই ব্যাপারে কিছু বলবো না আপনার সঙ্গে। কারণ ব্যাপারটা ব্যক্তিগত।’
উঠে দাঁড়াল হোথর্ন। ‘শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে দেখা হবে আপনার সঙ্গে।’
‘আমি জানতে পেরেছি, ওই অনুষ্ঠানে আমাকে দু’-চারটা কথা বলার অনুরোধ জানিয়ে গেছেন মা। আর গ্রেস একটা কবিতা পড়বে সেখানে।
‘সিলভিয়া প্লাথ,’ বলল গ্রেস।
‘মা যে প্ল্যাথের কবিতা পছন্দ করতেন, জানা ছিল না আমার। তবে… যারা মায়ের শেষকৃত্যের আয়োজন করছে, তাদের অফিস থেকে ফোন করা হয়েছিল আমাকে। একজন মহিলা… নাম আইরিন লয। কীভাবে কী করতে হবে, সেসব নাকি লিখে দিয়ে গেছেন মা।’
‘যেদিন এসব ব্যবস্থা করেছেন আপনার মা, সেদিনই খুন হয়েছেন তিনি… ব্যাপারটা আশ্চর্যজনক বলে মনে হয় না আপনার?’
প্রশ্নটা শুনে, মনে হলো, ড্যামিয়েনের বিরক্তি আরও বাড়ল। ‘আমার ধারণা ব্যাপারটা কাকতালীয় ঘটনা ছাড়া আর কিছু না।’
‘মজার একটা কাকতালীয় ঘটনা।’
‘এসবের মধ্যে মজার কী খুঁজে পেলেন আপনি, বুঝলাম না,’ এগিয়ে গিয়ে ফ্ল্যাটের সদর-দরজাটা খুলে ধরল ড্যামিয়েন… নিঃশব্দে বিদায় নিতে বলছে আমাদেরকে। শীতল কণ্ঠে বলল, ‘আপনাদের সঙ্গে দেখা হয়ে এবং কথা বলে ভালো লাগল।’
বেরিয়ে এলাম আমরা। হাজির হলাম নিচের ব্যস্ত রাস্তায়।
হাঁটার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না হোথর্নের মধ্যে। অন্যমনস্ক হয়ে আছে। ‘কিছু একটা মিস করছি আমি সম্ভবত।’
‘কী?’
‘জানি না। ডায়ানা ক্যুপার তাঁর ছেলেকে একটা টেক্সট মেসেজ পাঠিয়েছিলেন… সেটার ব্যাপারে কিছু-একটা জিজ্ঞেস করেছেন আপনি ড্যামিয়েনকে। আচ্ছা, আপনাকে না আমি মুখ বন্ধ রাখতে বলেছিলাম?’
‘আপনার সমস্যাটা কী?’ খেঁকিয়ে উঠলাম আমি, আর সহ্য করতে পারছি না। ‘আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলবেন না বলে দিচ্ছি! আপনার কথা শুনছি আমি, সময়ে সময়ে নোট নিচ্ছি। কিন্তু যদি ভেবে থাকেন আপনার পেছন-পেছন সারা লন্ডনে একটা পোষা কুকুরের মতো ঘুরে বেড়াবো, তা হলে ভুল করেছেন। আমি কোনো বোকা গাধা না। আর… ওই টেক্সট মেসেজের ব্যাপারে ড্যামিয়েনকে প্রশ্ন করে এমন কী ভুলটা করেছি, শুনি? মোটেও অপ্রাসঙ্গিক হয়নি আমার প্রশ্নটা।
আমার দিকে তাকিয়ে আছে হোথর্ন। ‘আপনি ভেবে দেখুন!’
‘কেন, আপনার কাছে কি অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে প্রশ্নটা?’
‘জানি না। হতেও পারে, আবার না-ও হতে পারে। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, আমার প্রশ্নের জবাবে কিছু-একটা বলেছে ড্যামিয়েন এবং সেটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। আসলে আমি যা বলতে চাইছি তা হলো, আমার ভাবনার ট্রেনটার যাত্রা ব্যাহত করে দিয়েছেন আপনি।’
‘ঠিক আছে। তা হলে আরও যা-যা জানতে চাওয়ার আছে আপনার ড্যামিয়েনের কাছে, সেসব ওই শেষকৃত্যানুষ্ঠানের সময় জেনে নিয়েন ওর থেকে। হাঁটা ধরলাম আমি। ‘তারপর দয়া করে জানিয়ে দিয়েন আমাকে।’
‘শুক্রবার এগারোটা!’ উঁচু গলায় বলল হোথর্ন, শেষকৃত্যের সময়টা জানিয়ে দিচ্ছে আমাকে। ‘ব্রম্পটন সেমেট্রি।’
থেমে দাঁড়ালাম আমি, ঘুরলাম। ‘যেতে পারবো না। কাজ আছে আমার।’
দ্রুত পায়ে হেঁটে আমার কাছে হাজির হলো হোথর্ন। ‘আসতেই হবে আপনাকে। ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। ভুলে যাচ্ছেন কেন… নিজের শেষকৃত্যানুষ্ঠান চেয়েছিলেন মিসেস ক্যুপার।’
‘না, ভুলিনি, কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং আছে আমার। দুঃখিত। আপনাকে যা করতে হবে তা হলো, যা-যা ঘটবে সেখানে, সেসবের নোট নিতে হবে। তারপর বিস্তারিত জানাতে হবে আমাকে। আমি নিশ্চিত, আমার চেয়ে বেশি নির্ভুল হবে আপনার পর্যবেক্ষণ।
একটা ট্যাক্সি দেখতে পেলাম, ইশারায় থামালাম ওটা। এবার আমাকে বাধা দেয়ার আর কোনো চেষ্টা করল না হোন।
ঘাড় ঘুরিয়ে যাতে না-তাকাই, সে-ব্যাপারে সচেষ্ট আছি। তারপরও ট্যাক্সির আয়নায় দেখতে পেলাম হোথর্নকে। দাঁড়িয়ে আছে আগের জায়গায়, আরেকটা সিগারেট ধরাচ্ছে।
গতি বাড়ল আমার ট্যাক্সির।