বিপ্লবী যুদ্ধ হচ্ছে জনসাধারণের যুদ্ধ, কেবলমাত্র জনসাধারণকে সমাবেশ করে এবং তাদের উপর নির্ভর করেই এ যুদ্ধকে চালিয়ে নেয়া যেতে পারে। — মাও সে তুঙ
৫. ক্রেমলিনের টাইপরাইটারের চোখে স্তালিন আমল
বর্ণনায় মনে হতে পারে এটা গল্প। কিন্তু অজানা তথ্যে এটা আসলে গল্প নয়, সত্য বয়ান। আর সেই বয়ান দিচ্ছেন দীর্ঘদিন ক্রেমলিনে স্তালিনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ কাজ করা একজন টাইপিস্ট। ক্রেমলিনের টাইপিং বিভাগের এক মহিলা কর্মী মেরি এস বুর জীবনের সায়াহ্নে পর্যন্ত যা মনে রেখেছিলেন সেভাবেই বলেছেন। তিনি বলেন : স্তালিনের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নে কোনো দুর্নীতির প্রশ্রয় ছিল না। মেরি এস বুরভ ২০০৬ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এখন জীবিত থাকলে, এবছর ৯০তে পড়তেন। ১৯২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মেরি এস বুরভের জন্ম। কয়েক বছর আগে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন ভ্রাদিসলাভ শেরস্তুকভ। আজও সেদিনের স্মৃতি উঁকি দিলে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এমনই হৃদয়ের অন্তঃস্তল ছুঁয়ে গিয়েছিল সেই সাক্ষাৎকার। আমি তাকে পরপর প্রশ্ন করছিলাম। আর তিনি। অবলীলায় উত্তর দিচ্ছিলেন।– রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র প্রাভদা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে সেই সাক্ষাৎকার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে মস্কোর একটি দোতলা বাড়িতে তাঁরা থাকতেন। মেরিদের বাড়ির কিছুটা দূরেই কতগুলো সরকারি দপ্তর ছিল। যুদ্ধের সময় সবকটিই ধ্বংস হয়ে যায়। মেরির বাবা ছিলেন কারখানার শ্রমিক। মেরি টাইপরাইটিং শেখেন, কিছুদিন এখানে-সেখানে কাজ করেন। শেষে সরকারি কাজ পান। মেরির টাইপ করার গতি ছিল অসাধারণ। দেশের প্রতি ভালোবাসা এবং কাজের ক্ষেত্রে নিষ্ঠা তাকে অন্যদের মাঝে একটা আলাদা পরিচয় করে দিয়েছিল। এরপর মেরি কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশনা বিভাগে কাজ করার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। ১৯৪২ সালে মেরির জীবনে আসে সব থেকে স্মরণীয় মুহূর্ত। ক্রেমলিনে : কাজ করার আহ্বান। প্রশাসনিক দপ্তরে টাইপিং বিভাগে। যা খোদ কমরেড স্তালিন নিজে দেখতেন।
আমি তাঁর কাছে অফিসটি সম্পর্কে জানতে চাই। জানতে চাই স্তালিন সম্পর্কে। মানুষ-স্তালিন’, খানিক চিন্তা করেন বৃদ্ধা। তারপর বলেন, একটু অন্যরকম ছিলেন। আর ওই দপ্তরের পরিবেশ– ‘তা-ও ছিল অন্যরকম।’ তিনি জানান, ‘বিভাগটিতে আমরা মোট সাতজন ছিলাম। সবাই টাইপিস্ট। কমরেড স্ত লিনের দপ্তরটি ছিল ক্রেমলিনের তিন তলায়। কমরেড স্তালিন এবং আমরা সবাই প্রথম প্রথম দু’তলা সিঁড়ি বেয়ে উঠতাম। তারপর লিফটে।’
মেরির কাছে জানতে চাই যুদ্ধের সময় ক্রেমলিনের পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির কাজের পরিবেশ কেমন ছিল?
উত্তরে তিনি বলেন, সর্বত্রই ছিল কাজের ক্ষেত্রে বলশেভিক প্রতিযোগিতা। টাইপিং বিভাগেও ছিল তাই। প্রতিদিন আমরা নিজেদের কাজের মূল্যায়ন করতাম। হিসাব রাখতাম কে কত পাতা টাইপ করেছি। কাজে যোগ দেওয়ার পর আমার বেতন ছিল ২৫০ রুবল। দু’মাস পরে তা বেড়ে হয় ৬৫০ রুবল। তারপর ১,৪০০ রুবেল। কিন্তু তারপরই দেশ কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। আমার বেতন কমে হয় ৭৫০ রুবল। যুদ্ধের সময় আমরা প্রতিদিন সাড়ে দশ ঘণ্টা কাজ করতাম। টাইপিং বিভাগের পাশেই একটা ঘর ছিল বিশ্রাম নেওয়ার। পালা করে ঐ ঘরেই কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নিতাম। রাতে বাড়ি ফিরতাম। পরের দিন আবার। কাজে। জরুরি পরিস্থিতিতে রাতেও কাজ করতাম। টাইপিং বিভাগে ২৪ ঘণ্টাই কাজ চলত। লাগাতার। কমরেড স্তালিন প্রতিদিন বেলা ১টায় ক্রেমলিনে আসতেন। সারারাত ক্রেমলিনে কাটিয়ে দাচায় (ছোট বাড়িটিতে) ফিরতেন পরদিন ভোর ৫টায়। এই ছিল তাঁর রুটিন।
খানিক চিন্তা করে মেরি আবার বলেন, একজন আধিকারিক ছিলেন। তিনিই আমাদের পালা করে কাজের সময় ঠিক করে দিতেন। সেই সময় পার্টির গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র দেখতে বিভাগে আসতেন কমরেড শেচেরবাকভ, ভিলিনস্কি, ভাসিলেভস্কি, স্টেমেঙ্কো ছাড়াও পার্টির অন্য নেতারা। তারপর সেই নথি পাঠানো হতো কমরেড স্তালিনের কাছে।’
আমি প্রশ্ন করেই চলেছি মেরিকে। কিন্তু কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে মেরিকে কখনো মনে হয়নি কোনও রকমের দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন। একটা সময় বললেন, অনেকটা নিজেরই খেয়ালে, যেন বহু অতলে প্রথিত স্মৃতির নির্যাস উগ্রে দিচ্ছেন, ‘মস্কোর মানুষ কমরেড স্তালিনকে বড় ভালোবাসতেন। তবে কমরেড স্তালিন একদমই তোষামোদ পছন্দ করতেন না। তার সময় প্রশাসনিক ব্যবস্থাও ছিল তেমনই চোস্ত। কোনও রকমের ঢিলেমি বরদাস্ত করা হতো না। এই প্রসঙ্গে একটি ছোট্ট ঘটনার কথা জানালেন অশীতিপর বৃদ্ধা। কোনও একটি কারণে মস্কোর বাসিল শিক্ষাদপ্তরে একবার স্তালিনের মেয়ে আসেন। কমরেড স্তালিনের মেয়ে বলে কথা! আধিকারিক নড়েচড়ে বসেন। কেক এবং চা দিয়ে স্তালিনের মেয়েকে অভ্যর্থনা জানানো হয়। এপর্যন্ত সব মোটামুটি ঠিক ছিল। কিন্তু পরদিন শিক্ষা দপ্তরের ঐ আধিকারিককে ক্রেমলিনে ডেকে পাঠানো হয়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ঐ আধিকারিককে সতর্ক করে দেয়। কোনো বৈষম্য চলবে না। নিমন্ত্রণ অথবা আতিথেয়তাও নয়। এমনই ছিল সেই সময়টা।’
অন্যদিকে নিজের কথা বলতে গিয়ে জানান, তখন যুদ্ধ চলছিল। জার্মানির আক্রমণ। মস্কোর কঠিন সময়। ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই। কিন্তু সেই সময়ও তারা কয়েকজন বন্ধু উচ্চশিক্ষার জন্য রাতে কলেজে পড়তেন। তাদেরই মধ্যে ছিলেন মেলেনিকোভা। কঠিন পরিশ্রমে একবার মেয়েটি খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সব জেনে স্বয়ং কমরেড স্তালিনই তাঁকে ছুটির ব্যবস্থা করে দেন।
কমরেড স্তালিনের মৃত্যুর পরের ঘটনা তার কাছে জানতে চাই। বিশেষত বিংশতিতম পার্টি কংগ্রেসে কুশ্চভের রিপোর্ট বলে মার্কিন সরকার যা প্রচার করে এবং দেশে-বিদেশে কমরেড স্তালিন সম্পর্কে যে কুৎসা শুরু হয় তা নিয়ে। উত্তরে মেরি জানান ‘কমরেড স্তালিনের মৃত্যুর পর কিছু সময় ক্রেমলিনে কাজ করেছিলাম। পরে অন্যত্র। কিন্তু সেভিয়েত ইউনিয়নেই ছিলাম। এখনও মনে পড়ে শেষ পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির একটি নথি টাইপ করেছিলাম।
ক্ষোভের সঙ্গে আরও বলেন, স্তালিনের মৃত্যুর পর ক্রেমলিনের পরিস্থিতি দেখে লজ্জা হতো। সোভিয়েত ইউনিয়নের গৌরবজনক ইতিহাস পদদলিত হতে দেখতাম। মনেই হতো না, এই সেই ক্রেমলিন। যেখানে বসে কমরেড স্তালিন দেশকে একটি ভয়ংকর যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পরাস্ত করেছিলেন ফ্যাসিবাদকে। সেদিন মস্কোর কঠিনতম সময়ও ক্রেমলিন ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাননি কমরেড স্তালিন। আমার মতো একজন সাধারণ মহিলাও কমরেড স্তালিনের সঙ্গে প্রয়োজনে দেখা করতে পারত। ক্রেমলিনের ক্যান্টিনের রাঁধুনি, সাফাই কর্মী, গাড়ি চালক দরকারে যোগাযোগ করতে পারতেন তাঁর সঙ্গে। একে আপনি কী বলবেন?
মেরি জানান, ‘অত্যন্ত ভদ্র এবং বিনয়ী ছিলেন স্তালিন। সবসময়ই কোনো না কোনো কাজ করছেন। সে তার বিরুদ্ধে যতই চক্রান্ত অথবা দুর্নাম রটানো হোক না কেন। সব সময় সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিতেন স্তালিন। দাচায় বিশ্রামের অবসরটুকু ছাড়া। শুধু কাজ আর কাজ। সব সময়।
কিছুটা থেমে মেরি বলেন, সেটা ১৯৫১ সাল। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সমস্যা শীর্ষক একটি দলিল তৈরি হয়। আমি এবং এক সহকর্মী সেই দলিল টাইপ করেছিলাম। স্তালিনের স্মৃতি অত্যন্ত প্রখর ছিল। সামান্যতম জুটিও তাঁর চোখকে ফাঁকি দিতে পারত না।
‘সেসময় দুর্নীতির কোনো স্থান ছিল না। ছিল না ক্রুশ্চেভের সময়কার পার্টি নেতাদের আমলে রমরমিয়ে চলা পাইয়ে দেওয়ার রেওয়াজও। এক্ষেত্রে একটি ঘটনা সম্পর্কে বললেই আপনি বুঝতে পারবেন। একবার মস্কোর বুকে এক পার্টিনেতা বাড়ি পান। বিশাল ঝকঝকে বাড়ি। বিষয়টি পার্টি নেতৃত্বের কানে আসে। দু’দিন পর দেখা যায় বাড়িটির বাইরে একটি বোর্ড টাঙানো। আর বোর্ডে লেখা প্রাথমিক বিদ্যালয়।
মেরি আক্ষেপ করে বলেন, আজ মস্কোর অবস্থা দেখুন। ইয়েলৎসিন এবং পুতিনের মতো রাষ্ট্রনেতারা ভোগবাদে ডুবে রয়েছেন। সেই অর্থে যা তাদের নয়। সাধারণ মানুষের।
২০০৬ সালের ৭ জানুয়ারি মেরি এস বুরভের মৃত্যু হয়। আজ রয়ে গেছে শুধুই তাঁর স্মৃতি। (সোভিয়েত ইউনিয়নের লাল ফৌজের কর্নেল ছিলেন লেখক ভাদিসলাভ শেরস্তুকভ)