৫. কোনও চালাক মিরগেল

ফাতনাটার দিকে তাকালেই বোঝা যায়, জলের নীচে বঁড়শির টোপ কোনও চালাক মিরগেল তার ল্যাজের ঝাপটায় খসিয়ে নিয়ে গিলে খেয়েছে। খেয়ে যাক, আমি মাছ ধরতে বসিনি। বাগানের এক পাশে ডুমুরের গাছ থেকে পিঁপড়ের ডিমের বাসাটা এক থাবায় ছিঁড়ে নিয়ে ছিপটা নিয়ে পুকুরের পাড়ে বসেছিলাম। কোথাও থাকতে পারছিলাম না, কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না, কোথাও যেতেও ইচ্ছা করছিল না। কারখানায় ক্লোজার চলছে। বাড়িটার মধ্যে নিজেকে ভূতের মতো লাগছিল। দোতলার ঘরে কেবলই সেই দেওয়ালের বন্ধ আলমারিটা খুলে দেখতে ইচ্ছা করছিল, যার মধ্যে রয়েছে ওদের ছবি। যা দেখতে ইচ্ছা করে না, অথচ খুব খিদে পেলে যেমন হাতের কাছে পড়ে থাকা খাবার লুকিয়ে দেখতে ইচ্ছা করে, সেই রকম আমার অবস্থা হয়। বিশেষ করে বিধাতার ছবি।

বিধাতা! আশ্চর্য, মা কেন আমার ছেলের এমন একটা নাম রেখেছিল। বিধাতা মানে তো ভগবান। অবিশ্যি বিধাতাকে সবাই বিধু বলেই ডাকত। ওর ভাল নাম রাখা হয়েছিল স্বর্ণজ্যোতি। আমার নাম স্বর্ণকমল, ছেলের নাম স্বর্ণজ্যোতি। খুকুর ভাল নাম ছিল জ্যোৎস্না। তারপরে ও কেন নিজের নামটা বদলিয়েছিল? রুমা। কী নাম ওটা? কে দিয়েছিল নামটা? কেউ দিয়েছিল, খুকুর অন্য এক জগতের লোক তারা তাদের কেউ দিয়েছিল। আর আমার মনে হয়, ওই নাম বদলানোর মধ্যেই কোথায় যেন একটা সর্বনাশ লুকিয়েছিল, যে সর্বনাশ শেষ পর্যন্ত সেভেনটি থ্রির সেই ভয়ংকর রাতটাকে ঘরের মধ্যে টেনে এনেছিল।

হ্যাঁ, এ কথা শুনলে আমাকে একটা উল্লুক আর পাঁঠা ছাড়া আর কিছু ভাববে না, কিন্তু আমি জানি, ওই নাম রাখার মধ্যেই সর্বনাশটা লুকিয়েছিল। সেভেনটি থ্রির সেই রাতঝগড়ার পরেও খুকুকে আমি বুকের কাছে জড়িয়ে ধরতে গেলাম, আর ও আমার বুকের কাছে কামড়ে দিল, উরুতের ওপর গোড়ালি তুলে মারল, আর তার পরের দিন।

আমি হ্যাঁচকা টানে ছিপটাকে জল থেকে টেনে তুলে নিলাম। আমার দাঁতে দাঁত বসে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে, আমি কিছু একটা বুক আর গলার কাছে আটকে রাখতে চাইছি, কিন্তু আমার মাথার মধ্যে দপদপ করছে। আমি বসে থাকতে পারলাম না। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। এখন আমার সারা গায়ে রোদ। পুকুরের জল যেন চুপচাপ শান্তভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি পিঁপড়ের ডিমের ঠোঙাটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম জলে। বাঁ হাতে তুলে নিলাম সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই, তারপরে উন্মাদ রাগে ছিপের নাইলনের সুতো দিয়ে চাবুক মারার মতো জলের বুকে চাবকাতে লাগলাম। সরু ছিপে আর সুতোয় সাঁই সাঁই শব্দ উঠল।

এই যে দুদেদা, ঘাট ফাঁকা দেখে জলে চাবুক হাঁকছ?’ পুকুরের পুবের বাঁশঝাড়ের উঁচু পাড় থেকে গলা ভেসে এল।

আমি তৎক্ষণাৎ থেমে মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম, আশেপাশের পাড়ারই তিনটি ছেলে। বাইশ-পঁচিশের মধ্যে বয়স। প্রত্যেকেরই গায়ে ঝকঝকে ট্রাউজার আর জামা। পায়ে চকচকে স্যান্ডেল, ঠোঁটে সিগারেট। ওরা সব গৌর সেনের চ্যালা। পাড়ার সব জায়গায়, বাগানে, আঁদাড়ে বাঁদাড়ে, বাড়ির সামনে পিছনে ঘুরে বেড়ায়। ওদের কথার মানেও আমি বুঝি। ঘাট ফাঁকা মানে, কোনও মেয়ে চান করছে না, আর আমি তো মেয়েদের স্নান দেখবার জন্যই পুকুরের ধারে এসে বসি। সেইজন্যই পুকুরের জলে চাবকাচ্ছি।

শুয়োরের বাচ্চা! এ ছাড়া আমার মাথায় আর কিছু এল না, কিন্তু আমি শান্তভাবে বললাম, শালা সকাল থেকে একটা মাছও খেলে না।

ওরা বাঁশঝাড়ের ছায়ায় দাঁড়িয়ে গেল, আর এগিয়ে এল না। একজন বলল, তোমার আসল টোপ ছিঁড়ে নিয়ে, যে-মাছ ভাগবার তা ভেগে গেছে, আর কেউ খাবে না।

তিন জনেই হেসে উঠল। ওরা খুকুর কথা বলছে, আমি জানি। ওদের কাছে আমি এক ধরনের বুদ্ধিহীন জড়ভরত, যার কোনও অনুভূতি, মান-অপমান বোধ নেই। ওরা আমার কাছে এখন সিগারেট চাইতে পারে, ইচ্ছা করলে, বাজারে পাঠিয়ে কিছু কিনিয়ে আনতে পারে। তোক ডাকিয়ে ডাব পাড়িয়ে খেতে পারে। বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কেটে নিয়ে যেতে পারে। এখন ওরাই এ এলাকার সর্বেসর্বা। বুলে পঞ্চানন জটাই, সব এলাকা ছাড়া। অবিশ্যি ওদের কাছেও আমি তা-ই ছিলাম, পাড়ার বন্ধু হিসাবে যা একটু আলাদা খাতির ছিল। আমাকেও ওরা একই চোখে দেখত, জটাই ছাড়া। জটাই-কেন জানি না, জটাই আমাকে যেন একটু অন্য চোখে দেখত। না হলে, নকুল সেই এক দিন সেকেন্ড যুক্তফ্রন্টের আমলে, আমাদের বাড়িরই দোতলায় ঠাকুরদার ঘরে আমার পাছায় যে-ভাবে লাথি মেরেছিল, আর পঞ্চানন বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল, জটাই না থাকলে, ওদের দুজনকে কিছুতেই সামলানো যেত না। জটাই পরে আমাকে বলেছিল, তুই আবার মুখ ফুটে ও সব সত্যি কথা বলতে গেছলি কেন? নির্মল যদি কারখানার ম্যানেজারের গাড়িতে চেপে বেড়ায়, তার সঙ্গে গৌর সেনের তুলনাটা দিতে গেলি কেন? ইউনিয়নের লিডার হলে, ও সব করতেই হয়। ওতে গৌর সেন আর নির্মলে কোনও তফাত নেই। আসলে দেখতে হবে, কারা সাচ্চা মজুরের বন্ধু, ইউনিয়নটা কাদের।

কথাটা ঠিক। নির্মলদের ইউনিয়ন না হলে আমি চাকরিটা পেতাম না। কিন্তু আমি কথাটা বলেছিলাম হাসতে হাসতে, যেন সত্যি মজা পেয়েছিলাম। মজা! সত্যি, আমি জীবনে কিছুই শিখিনি। কারণ, তারপরেও, আমার মুখ থেকে এমন কথা বেরিয়ে গিয়েছে জলধরদার মতো ভদ্র আর শান্ত আর শিক্ষিত আর আমি যাকে সৎ বলে জানি আমার ওপর রেগে গিয়ে বলেছিল, তোমার সঙ্গে দেখছি। আমাদের কোনও সম্পর্ক রাখা উচিত নয়। তুমি একটা আস্ত গাড়ল আর আমরা তোমাকে ক্যানডিডেট মেমবার হিসাবে ভাবছি।

অথচ আমি একটা কথাই হেসে বলেছিলাম, সুহাসবাবুকে নমস্কার, ওই লোকের কথা ভাবলে আমার গায়ে কাঁটা দেয়।… কথাটা মনের মধ্যেই থাকত, কোনও দিন মুখ ফুটে কোথাও বলিনি। বাইরের কোনও লোকের সামনেও বলিনি, নিজেদের মধ্যেই বলেছিলাম। কিন্তু কথাটা যে একটা ভয়ংকর গুরুতর ঘটনা, নিজেদের মধ্যেও আলোচনা করা বা বলা চলে না, আমি বুঝতে পারিনি। কথা একটা বড় ভয়ংকর জিনিস, তার ওপরে কোথায় কার সামনে বলতে হবে, সেটা যে কখনও ভাবিনি বা বুঝতে পারতাম না, তা না। তবু, কী করে এক এক সময় আমার মুখ থেকে হঠাৎ এক একটা কথা বেরিয়ে যেত, আমি নিজেই টের পেতাম না। আর তখনই আমার ভিতর থেকে চাবুক খাওয়া পাগলা ঘোড়ার দলের মতো, সমস্ত ভাবনাগুলো দৌড়ে ছিটকিয়ে যেত।

সুহাস দাসা, হ্যাঁ লোকটার নাম ছিল তাই। আমাদের কারখানারই একটা ডিপার্টমেন্টের চারজম্যান ছিল। ভাল পোস্ট। দেখতেও চেহারাটা ভাল ছিল, এমএসসি পাশ ছিল। সেও ছিল আমাদের কারখানার ইউনিয়নের একজন লিডার, অবিশ্যি নির্মলের থেকে নীচে, কিন্তু নির্মলের সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব ছিল, আর ম্যানেজারের সঙ্গে তাকেও আমি গাড়ি চেপে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। মনে আছে, ঘটনাটা ঘটেছিল, সেকেন্ড যুক্তফ্রন্টের আমলের দশ মাসের মাঝামাঝি। আমাদের ইউনিয়ন ছাড়া, আর কোনও ইউনিয়নই ছিল না। কিন্তু বলরাম মিত্তিরের একটা গ্রুপ তলে তলে ওদের ইউনিয়নটা জাগিয়ে তোলবার চেষ্টা করছিল। আসলে, সেটা ছিল গৌর সেনেরই একটা চাল। যা শত্রু পরে পরে। বলরাম মিত্তিরের দলের ছেলেরা মাঝে মাঝে আওয়াজ দিতেও আরম্ভ করেছিল। আসলে ওরা তখন বাংলা কংগ্রেস, ফরওয়ার্ড ব্লক, এস ইউ সি মিলেমিশে, একটা যাকে বলে ইউনাইটেড ট্রেড ইউনিয়ন গড়তে চেয়েছিল, আর কারখানার মধ্যে ওদের কিছু সাপোর্টারও ছিল।

সুহাস দাস বিবাহিত, কলকাতায় থাকত, কিন্তু সেকেন্ড ফ্রন্টের আমলে ও কলকাতার বাইরে আমাদের এলাকায় একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল। বউটি দেখতে ভাল ছিল, শুনেছিলাম, নিজের মামাতো বোনকে বিয়ে করেছে। যাই হোক গিয়ে, লোকটাকে আমার ফার্স্টক্লাস জেন্টলম্যান মনে হত, দু-একবার রবিবারে নির্মলের সঙ্গে আমাদের বাড়িতেও এসেছিল। আমার মনে আছে, সেই সময়টা ছিল শীতকাল। সকালবেলাই নির্মল আমাকে জানিয়ে দিয়েছিল, বিকালে কারখানার ছুটির পরে একটা গোলমালের সম্ভাবনা আছে, আমি যেন বাড়ি চলে না যাই।

নির্মলের কথা তবু এক রকম, কেন না, বন্ধু বলেও, ওকে এক রকম লিডার হিসাবে মেনেই নিয়েছিলাম। কিন্তু দুপুরে সুহাস দাস এসে যখন হুকুম করেছিল, আমাকে না বলে ছুটির পরে কোথাও যাবেন না আমার মোটেই ভাল লাগেনি। সেই এক দিনই লোকটার কথাবার্তা আমার ভাল লাগেনি। আমি কারখানার মধ্যে সারা দিনই বুঝতে পারছিলাম, ডিপার্টমেন্টে ডিপার্টমেন্টে একটা কিছু চলছে। বলরাম মিত্তিরের গ্রুপও চুপচাপ ছিল না।

আমার ছুটি হয়ে যেত বেলা দুটোতেই। কারণ আমার অ্যাটেনডেন্স ছিল ভোর ছটায়। অবশ্য কলকাতার বাইরের থেকে বলে একটা ঘণ্টা গ্রেস পেতাম। আর এক ঘণ্টা পেতাম, ইউনিয়নের তাঁবেদার বলে। তাবেদার মানে, নির্মলের বন্ধু বলে। আমি ছুটির পরে থেকে গিয়েছিলাম। আমাদের দলের সকলেই ছিল, কেউ কারখানার মধ্যে, কেউ কারখানার বাইরে। শীতের বেলা, চারটে বাজতে না বাজতেই কারখানায় আলো জ্বলে উঠেছিল, পাঁচটার মধ্যেই বাইরে অন্ধকার। প্রথমেই গোলমালটা লেগেছিল কারখানার মধ্যে। আমি তো কিছু বুঝে ওঠার আগেই, কারখানার ভিতরে বাইরে মারামারি শুরু হয়ে গিয়েছিল। আমি এমনই দিশাহারা হয়ে পড়েছিলাম, বুঝতেই পারছিলাম না, কে কাকে মারছে। লোহার ডাণ্ডা, ছুরি ব্যবহার করা হয়েছিল। আমি যখন কারখানার বাইরে, তখন আমার পাশ থেকেই সুহাস দাসকে চিৎকার করে উঠতে দেখেছিলাম, ভেতরে বাইরে সব আলো অফ করে দাও।

দু মিনিটের মধ্যে চারদিকে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার নেমে এসেছিল, তার মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ এক একটা আলো কোথা থেকে ঝলকিয়ে উঠছিল, বুঝতে পারছিলাম না, আর তার সঙ্গে আচমকা চিৎকার। চিৎকার মানে, মরণ চিৎকার। তারপরেই আমার পাশেই দেখেছিলাম, সুহাস দাস ছুরি উঁচিয়ে একজনের কাঁধে মারতেই, সে পড়ে গিয়েছিল। দেখেই চিনতে পেরেছিলাম ফরওয়ার্ড ব্লকের ছেলে শঙ্কর, বলরাম মিত্তিরের দলের ইয়োকে বলে খুব মিলিট্যান্ট ফাইটার। শঙ্কর পড়ে যেতেই, সুহাস দাস তার ভারী জুতো দিয়ে প্রথমেই ফুটবল মারার মতো ওর মাথায় মেরেছিল, আর ফট করে একটা শব্দ হয়েছিল। আমার বুকটা ধক করে উঠেছিল, মাথার খুলিটা ফেটে গিয়েছে। সুহাস দাস চিবিয়ে বলেছিল, শুয়োরের বাচ্চা, আমাকে না ফঁদ দেখাতে চেয়েছিলি? বলেই লাফ দিয়ে শঙ্করের পেটের ওপর উঠে, এমন নেচেছিল, আমার মনে হয়েছিল, শঙ্করের পেটের নাড়িভুড়ি নিশ্চয়ই ফেটে বেরিয়ে পড়বে। তখন ও গোঙাচ্ছিল, আমি বলব ভাবছিলাম, সুহাসবাবু, ছেড়ে দিন, মরে যাবে।

গাড়ল আর কাকে বলে। ভাগ্যিস বলিনি, তা হলে শঙ্করের মতো অবস্থা আমারও হত। আমি যেন ভাবতেই পারছিলাম না, সুহাস দাসের মতো একটা সুন্দর ভদ্রলোক, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, সে কীভাবে শঙ্করকে লাথিয়ে পিটিয়ে দলা পাকিয়ে মেরে ফেলেছিল। পুলিশ আসতে বেশ দেরি করেছিল, খবরটা আগে থেকেই তাদের জানানো ছিল। নির্মল আমাকে সেকথা বলেছিল। মোট তিন জনকে খতম করা হয়েছিল। আমাদের কারও কারও চোট লেগেছিল। আমার লাগেনি, কারণ আমি তো হাঁ করে সব দেখছিলাম। নির্মল কোথায় ছিল, আমি দেখতেই পাইনি। পুলিশ আসতে দেখেই, সে বলে উঠেছিল, পালাও। পালিয়েছিলাম।

তারপরে সেভেনটিটু-তে সুহাস দাস সেই যে চাকরি ছেড়ে চলে গিয়েছিল, আর কখনও তাকে চোখে দেখিনি। আজকাল শুনি, সে নাকি শিলিগুড়িতে আছে, বিরাট ব্যবসা ফেঁদেছে, গাড়ি বাড়ি করে, মামাতো বোনের পেটে দুটি ছেলের জন্ম দিয়ে বেশ সুখেই আছে। কোনও কালেই মানুষ চিনতে শিখিনি। সেই ঘটনার পর থেকে সুহাস দাসের সঙ্গে কথা বলতে আমার জিভ জড়িয়ে যেত। আসলে সুহাস দাসকে প্রশংসা করার জন্যই ওইরকম কথা আমি বলেছিলাম, যে কারণে জলধরদাও আমার ওপর রেগে গিয়েছিলেন। তবে ওই ক্যানডিডেট মেম্বারশিপ না কী বলে, ও সব আমি কোনও দিনই হইনি, নির্মলরাই বলত, আমাকে পার্টির মেম্বার করে নেবে। জলধরা এমনভাবে বলেছিলেন, মেম্বারশিপের জন্য আমার খুব লোভ ছিল। আসলে নির্মলদের সঙ্গে থাকলেও, নিজেকে আমি ওদের মতো কোনও দিনই ভাবতে পারিনি। ও সব আমার কাছে বরাবরই ভজঘট ব্যাপার বলে মনে হয়েছে। কোনও দিনই নিজেকে নিয়ে কিছু ভেবেছি কি? যখন যা ঘটেছে, আর মনে হয়েছে এটাই আমার ঠিক, তখন তাই করেছি। আর করতে গিয়ে এই বিয়াল্লিশ বছর তিন মাস বয়সেও দেখে এলাম, কিছুই ঠিক করিনি।

সুহাস দাস চলে গিয়েছিল, নির্মলও থাকেনি। সেভেনটিথ্রি-র গোড়ার দিকে, গোটা শরীরটা গুলিতে ঝাঁঝরা অবস্থায় নির্মলকে পাওয়া গিয়েছিল, ফ্যাকটরি থেকে একটু দূরে। পুলিশ খুনিকে খুঁজে পায়নি। পুলিশ কি সুহাস দাসকে কোনও দিন খুঁজে পেয়েছিল? পুলিশ কখনও কাউকে খুঁজে পাবে, কোনও শুয়োরের বাচ্চাও

যাক গিয়ে, কী হবে আমার ও সব কথা ভেবে? ও সব বিষয়ের খেই আমি কোনও দিন খুঁজে পাব না। আসলে এই মুহূর্তে এ সব কথা আমি ভাবতে চাইনি। আমি ভূতে পাওয়ার মতো, সকালে, পিঁপড়ের ডিমের বাসাটা খামচিয়ে ছিঁড়ে, ছিপটা নিয়ে এসে বসেছিলাম। সেই ভূতের দৌরাত্ম্যেই, পুকুরের জলে ছিপের সুতো চাবকাচ্ছিলাম। আর তখনই এসে পড়ল তিনটি শুয়োরের বাচ্চা। আমি ছিপটাকে শূন্যে। ঘুরিয়ে, সুতো গুটিয়ে নিলাম।

দুদেদা, চলবে নাকি?’ বাঁশঝাড়ের কাছ থেকে একজনের গলা শোনা গেল।

ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, ওদের এক জনের হাতে একটা বড় বোতল। দেখলে মনে হয় সাদা জলে ভরতি, আসলে চোলাই মদ। আজকাল অবিশ্যি কথাটা চালু হয়ে গিয়েছে, সাটটা খেলো, চুলু পিও, ইন্দিরা গান্ধী যুগ যুগ জিও। চালু কথাটা পোস্টারে এখনও দেখিনি, যেমন একটা পোস্টার দেখেছিলাম, শুয়োরের বাচ্চা জনগণ, রইল তোদের নির্বাচন, আমরা চললাম বৃন্দাবন। কী বলব ওদের? আমার। চোয়াল যতই শক্ত হোক, আমি বলতে পারব না, ওদের বোতলের মদের থেকেও আঁজালো মদের নেশায় আমার মাথা দপদপ করছে। তা হলেই ওরা ছুটে আসবে, দুদেদা, তা হলে সে মাল আমাদের একটু দাও।

আমি ওদের দিকে তাকিয়ে হেসে মাথা নাড়লাম। ওরাও জানে, আমি ওদের সঙ্গে বসব না। আমি পিছন ফিরে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। আমি জানি, এই ভর দুপুরে, এখন আশেপাশের কয়েকটা মেয়ে পুকুর ঘাটে আসবে। মেয়েগুলো চেনা, অথচ যেন চেনা না, কারণ আমাদের সামনেই এমন বেপরোয়া ভাবে চলাফেরা করে, যা মুখে আসে বলে আর হাসাহাসি করে, এই ছেলেগুলির থেকে কোনও অংশে কম যায় না। খুকু কি ওই মেয়েগুলোর মতো হয়ে গিয়েছিল?

আমি পাঁচিল ঘেরা পিছনের বাগানের দরজা দিয়ে ঢুকলাম। ঠাকুরদার আমলের অনেক চিহই। এখনও এ দিকটায় ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এক কালের গোয়ালঘর, যার মাথায় টালি এখন আর নেই। পাকা মেঝের আস্তরণ উঠে এবড়ো খেবড়ো হয়ে গিয়েছে। গোরুদের খাবার দেবার পাকা থাক থাক চৌবাচ্চাগুলোর ইট কারা খসিয়ে নিয়ে গিয়েছে। আর এক পাশে পাশাপাশি দুটো বড় ধানের গোলার ইটের গাথুনি দিয়ে তোলা প্ল্যাটফরমই শুধু আছে বেতের তৈরি দেওয়াল নেই। এক পাশে কিছু কলা গাছ, দু-একটা আম গাছ, আর বাকি সবই আঁসশ্যাওড়ার জঙ্গল, যেগুলোর গায়ে তেলাকুচোর লতা জড়িয়ে উঠেছে। উত্তর দিকের পাঁচিলও অনেক জায়গায় ভেঙে গিয়েছে।

বাড়ির একেবারে পিছনের বাথরুমের পাশ দিয়ে, ভিতরে ঢোকবার দরজা দিয়ে ঢুকলাম। সোজা। চোখ পড়ল বাইরের ঘরের দিকে। বাবা বসে আছে তক্তপোশের ওপর, আর মেয়েরা প্লাস্টিকের ঝুড়ি আর ব্যাগ বুনছে। হ্যাঁ, মেয়েরাই, তবে সেই দলটা আর কোনও দিনই ফিরে আসতে পারেনি। এ দলটা। আলাদা, একটা গোটা ফ্যামিলি। সেই লক্ষ্মী নামে যে বউটা বাবার রান্না করত এক সময়ে, তার ছটি মেয়েই এখন এখানে কাজ করে। লক্ষ্মীও কাজ করে। বাবার রান্না করে লক্ষ্মীর এক বিশ-বাইশ বছরের। মেয়ে।

আমার বিয়ের পরে, আস্তে আস্তে আবার কারখানার কাজ শুরু হয়েছিল। লক্ষ্মীর মেয়েদের নিয়ে শুরু হয়েছিল, সেটা একটা কথা, তা ছাড়া, বাবা তখন আমার সঙ্গে মোটামুটি একটা মিটমাট করে নিয়েছিল। অবিশ্যি তার মানে এই না, বাবা আবার সংসারে ফিরে এসেছিল, আমাদের সবাইকে নিয়ে মাকে নিয়ে সংসার গড়ে তুলেছিল। সে তার বাইরের ঘরের কারখানা আর সংসারকে আলাদাই রেখেছিল, তবু সেই সময়ে বাবাকে খানিকটা বাবা বাবা মনে হয়েছিল। অন্তত বছরখানেক, বছর দেড়েকের জন্য। বিধাতার জন্মেরও কয়েক মাস পরে পর্যন্ত।

কিন্তু নমস্কার ত্রিলোচন চাটুয্যেকে। ভবী ভোলবার লোক সে কোনও কালেই না। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, কিছু ঘটলে, লক্ষ্মীর সঙ্গেই ঘটতে পারে। আমার ভাবনা! চিরকালের ছিটকে যাওয়া পাগলা ঘোড়ার দল। অবাক হয়ে দেখেছিলাম, লক্ষ্মীর মেজো মেয়েটাকে, আস্তে আস্তে আমার ষাটের ওপর বয়স বাবাটি কেমন নিজের মতো তৈরি করে নিয়েছিল, সম্পর্ক অবিশ্যি দাদু আর নাতনি, কিন্তু বাবার এখন পরিষ্কার জবাব, আমি তো আর কোনও মেয়েকে জোর করে ধর্ষণ করছি না, আমার এলেম নিয়ে আমি চলছি।

এলেম। সত্যি, জীবনে কখনও কিছুই বুঝতে পারলাম না। মেয়েটার নাম মালতী-মাতি বলে ডাকে সবাই। চোখের সামনে বাবা কী করে কী যে করল, মেয়েটা দেখতে দেখতে বড় হল, যেন খরার পরেই বানের জলের মতো, আর তার পরেই রাত্রে লক্ষ্মী সব মেয়েকে নিয়ে বাড়ি চলে যেত, কিন্তু মালতি থেকে যেত। যেত মানে, এখনও থাকে। আমি কাকে দেখে অবাক হব বুঝতে পারি না। বাবাকে না মাতিকে দেখে? গোড়ায় অবিশ্যি আমার সঙ্গে লেগে গিয়েছিল। তখনও এ বাড়িতে খুকু ছিল। কবে এ বাড়ি ছেড়ে খুকু চলে গিয়েছিল-খুকু আর বিধাতা?

দুদে, তুই কি চান করে এলি?’ মায়ের গলা শোনা গেল রান্নাঘর থেকে।

আমি না থেমে সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে বললাম, না।

মায়ের গলা শোনা গেল রান্নাঘরের দরজায়, সেকি, এতখানি বেলা হয়ে গেল, চান করলি নে? খাবি কখন?

আমি সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে বললাম, আমার খিদে নেই, তুমি খেয়ে নিয়ে।

মায়ের আর কোনও কথা শোনা গেল না। আমি জানি, মা খাবে না, আর আমি ইচ্ছা করে, মাকে কখনও উপোসি রাখতে চাই না। কিন্তু সব দিন সমান না। এক একটা দিন, আমাকে কে তাড়া করে। ছুটিয়ে নিয়ে যায়। সব জেনেও এমন দিনে আমি মাকেও খুশি করতে পারি না। আমি জানি, মা স্নান করবে, ঠাকুরকে জল দেবে, তারপরে ঘরের দরজা ভেজিয়ে চুপ করে শুয়ে থাকবে আর কাঁদবে।

দোতলার থাম ঘেরা বারান্দাটা আয়নার মতো ঝকঝকে। ছিপটাকে ফেলে দিলাম একপাশে। একটা সিগারেট ধরিয়ে, ঘরের শিকল খুলে ঢুকলাম। আমার ঘর, এক সময়ের জ্যাঠামশাইয়ের ঘর। কোনও আসবাবপত্র নেই, কেবল মাথার ওপরে একটা সিলিং ফ্যান ছাড়া। খাট নেই, ড্রেসিং টেবিল নেই, পাশের ঘরে ওয়ারড্রব নেই। নেহাত ঝটপাট দেওয়া না হলে গোটা বাড়ির মধ্যে এই পাশাপাশি দেড়খানি ঘরকে পোভোঘর মনে হত। জানালা খোলা পেলেই থামের মাথা থেকে পায়রাগুলো এসে ঢোকে। ঘরের মধ্যে তাই পায়রার গন্ধ। আমি পাশের ঘরে গেলাম।

অন্ধকার ঘর। সুইচ টিপে আলো জ্বালালাম। বাইরের জানালা খুলতে ইচ্ছা করল না। নিচু হয়ে বসলাম একটা পুরনো ট্রাঙ্কের কাছে। তালাবন্ধ ট্রাঙ্ক। ট্রাঙ্কের পাশেই দেওয়ালে ঝোলানো একটা কাপড়ের ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে এক গোছ চাবি বের করলাম। চাবি বেছে নিয়ে ট্রাঙ্কের তালা খুলোম, ডালা তুললাম। নীল রঙের একটা ছোট পাঞ্জাবি, চার-পাঁচ বছরের বিধাতার একটা পাঞ্জাবি, বুকে গলায় সোনালি সুতোর নকশা ভোলা। ধোপদুরস্ত না, ব্যবহার করা, কোঁচকানো, কিন্তু আমি নিজের হাতে পাট করে রেখেছি, ধুতে দিতে ইচ্ছা করেনি। বিধু কত কী মাখিয়েছে, খাবারের দাগ, ধুলার দাগ, সেই সঙ্গে ওর গায়ের গন্ধ। যেমনটি পেয়েছিলাম, তেমনটিই রেখে দিয়েছি।

বিধাতার আর কিছু নেই, এই জামাটা ছাড়া। অথচ কত থাকা উচিত ছিল। খেলনাগুলো কোথায় কে নিয়ে গিয়েছিল? ভাঙাচোরা কিছুও তো থাকতে পারত। কিছুই ছিল না, খুঁজে পাইনি, কেবল ঘরের কোণে দলামোচড়া পাকানো এই জামাটা ছাড়া। জামাটার নীচেই খবরের কাগজ। আমি আস্তে আস্তে জামাটা তুলে নিলাম, নাকের কাছে ধরলাম। সেভেনটি থ্রি আর সেভেনটি সিক্স। প্রথম প্রথম যে-গন্ধটা ছিল, এখন আর তা নেই। ট্রাঙ্কের মরচে পড়া রঙের গন্ধ, বিধুর খাবার ধুলা গায়ের গন্ধ, সব শুষে নিয়েছে। আমি দেখতে পাচ্ছি, বিধাতা এই জামাটা গায়ে দিয়ে, সারা বাড়ি দৌড়ে বেড়াচ্ছে। হ্যাঁ, আমি ওর হাসি, আর চিৎকারও শুনতে পাচ্ছি কিন্তু এ বাড়িতে না, ওর হাসি আর চিৎকার ভেসে আসছে যেন যাদবপুর অঞ্চলের একটা ইস্কুলের উঠোন থেকে।

আমার বুকে এটা কী হচ্ছে? কেউ নিশ্চয়ই ছুরি বিধিয়ে দিচ্ছে না? তবে কী এটা? বিধুর জামাটা বুকে আর হাঁটুতে চেপে, আমি ট্রাঙ্কের খবরের কাগজটা তুললাম। একটা অল্প দামের লালপাড়, লালডোরা তাঁতের শাড়ি। পাশে, ঠাকুরদার ঘরে, খাটের নীচে দেখতে পেয়েছিলাম। সেভেনটি থ্রি-র নভেম্বরের সেই দিনটাতে কাপড়টাও বিধুর জামার মতোই দলামোচড়া পাকানো পড়ে ছিল। দেখেই টেনে নিয়েছিলাম, আর ফড়ফড় করে টেনে এপাশে ওপাশে অনেকখানি ছিঁড়ে ফেলেছিলাম। তারপরেই হঠাৎ থেমে, শাড়িটা মুখে চেপে ধরেছিলাম। খুকু যেন ওর গোটা শরীরটা নিয়ে আমার মুখের ওপর চেপে বসেছিল, আর আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এসেছিল। মনে হয়েছিল, আমার নিশ্বাস আর কোনও দিন পড়বে না। কিন্তু দোতলার বারান্দায় যেন কার পায়ের শব্দ পেয়েছিলাম, আর লুকিয়ে তাড়াতাড়ি শাড়িটা খাটের তোশকের নীচে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। মনে করতে পারি না, কে এসেছিল। এসেছিল, সে আবার ফিরে গিয়েছিল, আর আমি তাড়াতাড়ি শাড়িটা বের করে, এই ট্রাঙ্কের মধ্যে এনে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম।

বিধুর কথা যেমন মনে করতে পারি, এই নীল পাঞ্জাবিটা গায়ে সারা বাড়িতে দৌড়ে বেড়াচ্ছে, সেই রকম, এই শাড়িটা পরে খুকু এ বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এমন একটা ছবি মনে করতে পারছি না। এই শাড়িটা কি খুকু কোনও দিন পরেছিল? পরে আমার সামনে এসেছিল? মনে করতে পারছি না। অথচ শাড়িটা যে দিন খুঁজে পেয়েছিলাম, মনে হয়েছিল, গোটা শাড়িতে ওর শরীরটা যেন জড়ানো। পুরোপুরি ওর গন্ধ লেগে ছিল শাড়িটাতে। প্রথম দেখা মাত্র ছিঁড়ে কুটিকুটি করতে চেয়েছিলাম। পারিনি। কেন?

আবার সেই ভাবনা। যার কোনও জবাব আমার জানা নেই। বিধুর ইস্কুলে খেলা করে বেড়াবার মতো, খুকুর কথা আমি ভাবতে পারছি না। কী করছে ও এখন? নিশ্চয়ই বাড়ি নেই? মানে, যাদবপুরে নেই। জোড়াদিঘি পাড়ার বাড়ি ওর বাবা মা সেভেনটি ফোরেই ছেড়ে চলে গিয়েছে। জোড়াদিঘি পাড়ার বাড়ি বিক্রি করে যাদবপুরে একটা বাড়ি কিনেছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারি, খুকু এখন বাড়ি নেই। খুকু এখন–খুকু এখন–আহ্, এটা কী ঘটছে আমার বুকের মধ্যে? খুকুকে আমি একেবারে জামাকাপড় খোলা দেখতে পাচ্ছি। একটা খুব সুন্দর ঘর, কলকাতার কোনও নামকরা জায়গায়, ভাল ফ্ল্যাটের ঘরে পরদা ঢাকা আবছায়া, খাটে খুকু, গায়ে কোনও জামাকাপড় নেই, আর একজন পুরুষ, তার গায়েও জামাকাপড় নেই।

আমি লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। পাঞ্জাবি আর শাড়ি মেঝেতে পড়ে গেল। মনে হল, আমি হুংকার দিয়ে চিৎকার করে উঠব। কিন্তু আসলে আমি শুনতে পাচ্ছি, পাশের ঘরের দরজা খোলা পেয়ে পায়রারা ঢুকে পড়েছে, আর বাগানের গাছে একটা পাখি পিক পিক করে ডাকছে। আরও দূরে বোধ হয় কোকিলই হবে, কারণ সে রকম ডাকই ভেসে আসছে।

আমি আস্তে আস্তে আবার বসলাম। পাঞ্জাবি আর শাড়ি টেনে নিলাম। কী যেন সেই লোকটার নাম? কল্পনাথ ভট্টাচার্য, হ্যাঁ, কল্পনাথ ভট্টাচার্য, বিপ্লবী নাটুকে দলের অভিনেতা, এখন অবিশ্যি রাস্তা বদলিয়েছে, খুকু এখন শুধু তার সঙ্গেই ঘোরে। কিন্তু তার কি কলকাতায় সাজানো গোছানো সুন্দর ফ্ল্যাট আছে? নেই। সে সব খুকুর আগের ব্যাপার, কল্পনাথের সঙ্গে মেশার আগের ঘটনা। কল্পনাথ তার আগের বউ ছেলেমেয়ে ছেড়ে, এখন খুকুকে নিয়ে।

আমি ট্রাঙ্কের দিকে তাকালাম। ছেঁড়া শাড়িটাও আমি পাট করেই রাখি, আর তার নীচেই থাকে একটা খাম। আমি খামটা তুলে নিলাম। মুখ খোলা খামের ভিতর থেকে বের করলাম কয়েকটা ফটো। খুকু–একা এলানো চুল, বিয়ের আগে, শাড়ির আঁচল বুকের এক দিকে। খুকু একা, বিয়ের পরে আমাদের বাড়ির বাগানে পদ্মফুল গাছের ঝাড়ের পাশে। বিধাতা–একা উলঙ্গ, বয়স দুই, হাসছে। বিধাতা একা প্যান্ট শার্ট পরা, বেড়ালছানা হাতে। খুকু কোনও সাজগোজ করেনি। দরকারও ছিল না, যদিও ও সাজতে ভালবাসত। কিন্তু এ ছবিতে, ওর সমস্ত রূপ যেন আগের সব রূপকে ছাপিয়ে গিয়েছে। আমি অবিশ্যি জানি না, কেন এই রূপকে আমার এত ভাল লাগছে। কেউ ভাবতে পারে, আমি বুঝি ওর মা হওয়ার রূপের জন্য এ রকম ভাবছি। তা না, আসলে, এই যে খুকু হাসছে, ঘাড় একটু কাত করা, চুল কেমন উশকো খুশকো, আর আগের থেকে ওর সারা গায়ে যেন একটা ঢল নেমেছে, যা দেখলেই, ভিতরে কেমন একটা ছটফটানি জেগে ওঠে। আসলে, এই খুকুকে দেখলে স্থির থাকা যায় না, যেন মনে হয় ও হাত না বাড়িয়েও জড়িয়ে ধরতে আসছে।

ফটোগুলো নিয়ে আমি উঠে দাঁড়ালাম। তাসের মতো সাজিয়ে দেখতে লাগলাম, আর এটা কী ঘটছে আমার বুকের মধ্যে? নিশ্চয়ই কেউ ছুরি বিধিয়ে দিচ্ছে না? আমার ঠোঁট দুটো এমন নড়ছে, যেন ছোট শিশু মায়ের বুকে মুখ দেবার জন্য অস্থির হয়ে উঠছে। এ বার কি কেঁদে উঠবে?

আমি ফটোগুলো ট্রাঙ্কের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। পাঞ্জাবি শাড়ি ঢুকিয়ে দিয়ে, জোর শব্দে ট্রাঙ্কের তালা বন্ধ করে দিলাম। তালা লাগালাম না। দাঁতে ঠোঁট চেপে, ট্রাঙ্কের পিছনে হাত বাড়িয়ে একটা বোতল বের করলাম। গায়ে লেখা রয়েছে সালফিউরিক অ্যাসিড। বোতলটা নাড়াচাড়া করে দেখলাম, তারপরে আবার আস্তে আস্তে ট্রাঙ্কের পিছনে রেখে দিলাম। নিজের মুখটা আমার দেখতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু ঘরে একটাও আয়না নেই। সেই কবেকার একটা ছোট আয়না, বারান্দার থামের গায়ে ঝোলানো আছে, এক সময়ে যেটার সামনে দাঁড়িয়ে দাড়ি কামাতাম। কিন্তু সেই আয়নায় এখন আর মুখ দেখতে যেতে ইচ্ছা করছে না।

আমি পাশের বড় ঘরে এলাম। দুটো পায়রা-পায়রি প্রেম করছিল। আমি ঢুকতেই উড়ে পালিয়ে গেল। ওরা সারা দিন প্রেম করে কিন্তু কী যে বলাবলি করে, কিছুই বুঝতে পারি না। ওরা যেন এই জগৎ সংসারের কেউ না। মানুষ কি এ রকম হতে পারে?

আমি দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে ছিটকিনি এঁটে দিলাম। পাখার সুইচটা খুলে দিয়ে, মেঝের ওপর চিত হয়ে পড়লাম। আর হাঁপাতে লাগলাম। যেন আমি এতক্ষণ ধরে, সেই সকাল থেকে অনেক খেটেছি, অনেক লড়েছি, আর এখন যাকে বলে, একেবারে যেন বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছি। চোখ খোলা রাখতে পারছি না।

.

একটা স্বপ্নের ঘোরের মতো ফরটি নাইনের প্রথম দিকের শীতে, সকালবেলাটা আমার চোখের সামনে ভাসছে। দিদিমার শ্রাদ্ধশান্তি তখন মিটে গিয়েছিল। বাবা মা ঠাকুরদা ঠাকমা, আমাদের বাড়ির সবাই বসিরহাটের শ্রাদ্ধ বাড়িতে গিয়েছিল। দাদু বলেছিলেন, তিনি সময় মতো একদিন আমাকে এ বাড়িতে পৌঁছে দেবেন।

মনে আছে, বসিরহাট থেকে শীতের ভোরের অন্ধকার থাকতে দাদু আমাকে নিয়ে বেরিয়েছিলেন। একটি টিনের সুটকেসে আমার জামাকাপড়, খান কয়েক বই, একটা কাপড়ের পুঁটলিতে টুকিটাকি আরও কিছু জিনিস। দাদু আমাকে নিয়ে সকালবেলা এই বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন। বাইরের ঘরের দরজাটা, রাস্তার দিকে খোলা ছিল, কিন্তু কারোকে দেখা যাচ্ছিল না। আর এক বারও মনে হয়নি, আমি নিজেদের বাড়ি এসেছি। বরং মনে হয়েছিল, কোনও অচেনা বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়িয়েছি। আমি নিজে থেকে বাড়ির মধ্যে ঢুকিনি।

দাদু রাস্তার দিক দিয়ে আমাকে নিয়ে বাইরের ঘরে ঢুকেছিলেন। এক পাশে তক্তপোশ পাতা ছিল, এখনও যেমন আছে। তা ছাড়া এক পাশে ছিল একটা ডিমের মতো আকৃতির টেবিল, খান কয়েক চেয়ার। দাদু কারোকে দেখতে না পেয়ে, এক বার গলা খাঁকারি দিয়েছিলেন আর আমাকে বলেছিলেন, যাও, তুমি ভেতরে গিয়ে বাবা মার সঙ্গে, সকলের সঙ্গে দেখা করো। আর খবর দাও, আমি এসেছি।

আমি দাদুর আরও গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিলাম, বলেছিলাম, না, আমি যেতে পারব না, তুমি আগে চলো।

দাদু হেসে উঠেছিলেন, বলেছিলেন, যেতে পারবে না মানে কী? এটা তো তোমাদেরই বাড়ি! নিজেদের বাড়িতে নিজে ঢুকবে, এতে আবার না পারার কী আছে?

কিন্তু বাড়িটাকে সত্যি আমাদের বাড়ি বলে মনে হয়নি। আমি দাদুর কথার জবাব না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দাদু আবার গলা খাঁকারি দিয়ে খানিকটা সরে দাঁড়িয়েছিলেন, যেখান থেকে খোলা দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতরটা দেখা যায়। আমিও দাদুর গায়ে গায়ে সরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। দেখেছিলাম, পুবে পশ্চিমে লম্বা বারান্দাটার বুকে থামের ছায়া পড়েছিল। কে একটা বউ, বাড়ির ঝি এক পাঁজা বাসন নিয়ে পুব দিকের একেবারে শেষ দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকেছিল, কিন্তু আমাদের দিকে তার চোখ পড়েনি। অথচ কোথা থেকে কাদের গলার স্বর ভেসে আসছিল। বোধ হয় নীচের রান্নাঘর থেকেই ঠাকমা জ্যাঠাইমা মায়েদের গলা ভেসে আসছিল। বিরাট বাড়ির মধ্যে সে সব স্বর এমন কিছু স্পষ্ট ছিল না।

আমি এখন বুঝতে পারি, দাদু তার কুটুম বাড়িতে পৌঁছে খুবই অস্বস্তিবোধ করছিলেন। তিনি পুরুষ মানুষ, হঠাৎ বাড়ির অন্দরমহলে ঢুকে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। যাকে বলে সভ্যতা ভব্যতা, সে সবে তার আটকাচ্ছিল। আর ইয়ে–ওই যাকে বলে অভ্যর্থনা, কুটুম্ববাড়িতে কেউ এলে অভ্যর্থনা না করলে কী করেই বা বাড়ির ভিতরে ঢোকা যায়? শত হলেও মেয়ের শ্বশুরবাড়ি।

ওই রকম যখন অবস্থা তখনই, মা এখন যে-ঘরে থাকে, সে ঘর থেকে ঠাকুরদা বেরিয়ে এসেছিলেন। ঘর থেকে বেরিয়ে তিনি বাইরের ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, কিন্তু আমি আর দাদু যে দাঁড়িয়ে আছি, সে দিকে তার যেন খেয়ালই ছিল না। মুখ তুলে বাইরের ঘরের কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে কী সব বিড়বিড় করছিলেন। দাদু দু হাত কপালে ঠেকিয়ে হেসে বলেছিলেন, কেমন আছেন বেয়াইমশাই? ভাল তো?

ঠাকুরদা দাদুর দিকে ফিরেও তাকাননি, যেন তার কথা শুনতেই পাননি। একেবারে পিছন ফিরে আবার পাশের ঘরে ঢুকে পড়েছিলেন। দাদু একটা নিশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, কয়েক মাসের মধ্যে বেয়াইমশাইয়ের যে কী হল, এখন তো দেখছি আর লোজনও চিনতে পারেন না।

আমি বসিরহাটে থাকতেই শুনেছিলাম ঠাকুরদার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কেন, কী কারণ, কেউই জানত না। আমি প্রত্যেক বছরেই একবার-দুবার আসতাম। ঠাকুরদা আমাকে একটু-আধটু আদর করতেন, বলতেন, তুই তো বসিরহাটের ছেলে হয়ে গেছিস। আমরা হলুম দখনো। তোর জীবনটা বসিরহাটে কেটে যাবে।.ঠাকুরদাকে আমি কখনই নাতি নাতনিদের নিয়ে মাথায় করে নাচতে দেখিনি। বরাবরই একটু কথা বলতেন বেশি, আর তাড়াতাড়ি হড়বড় করে কথা বলতেন। কিন্তু তিনি যে শেষ জীবনে ওই রকম কেবল বিড়বিড় করবেন, লোকজন চিনতে পারবেন না, ঘন ঘন মাথা চুলকাবেন আর হঠাৎ হঠাৎ একটা কথা বলে উঠবেন, যার কোনও মাথামুণ্ডু নেই, আমি ভাবতেও পারিনি। ঠাকুরদা যে কেন পাগল হয়ে গিয়েছিলেন কেউ কোনও কারণ খুঁজে পায়নি।

দাদু আমাকে আবার বলেছিলেন, এভাবে বাইরের ঘরে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে? বাড়ির ভেতরে ঢুকতে তোমার কী অসুবিধে আছে?

দাদুর কথা শেষ হবার আগেই আমার বোন পানতু সিঁড়ি দিয়ে দোতলা থেকে নেমে এসেছিল, আর ওর দৃষ্টি পড়েছিল আমাদের দিকে। আমার ছ বছর বয়েস থেকে চৌদ্দ বছর বয়েসের মধ্যে নিজেদের বাড়ির কারও সঙ্গেই আমার তেমন ভাব হয়নি। পানতু আমার থেকে চার বছরের ছোট। বাড়ি আসার আগে ওর সঙ্গে আমি কটা কথা বলেছিলাম, আঙুলে গুনে বলা যায়। ও আমাদের দেখে বড় বড় চোখ করে তাকিয়েছিল, তারপরেই দুপাশে দুই বিনুনি দুলিয়ে পুব দিকে ছুটে গিয়ে আমিষ রান্নাঘরে ঢুকেছিল। যতদিন ঠাকুরদা ঠাকমা বেঁচেছিলেন আমাদের বাড়িতে নিরামিষ আর আমিষ রান্নাঘর ছিল। আমিষ বলতে মাছ মাংস রান্না করবার জন্য, পুব দিকে বারান্দার ডাইনে একটা আলাদা ঘর ছিল। ছিল মানে এখনও আছে। তবে সে সব নিয়মকানুন এখন উঠে গিয়েছে।

পানতু ছুটে গিয়ে আঁশের–মানে আমিষ রান্নাঘরে ঢুকতেই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মা বেরিয়ে এসেছিল। মায়ের মাথায় ঘোমটা ছিল, মুখে নিশ্চয় পান টেপা ছিল। আমাদের দেখেই বাইরের ঘরের দিকে তাড়াতাড়ি হেঁটে এসেছিল। সঙ্গে সঙ্গে পানতু। আর দরজার কাছ থেকে উঁকি দিয়ে দেখছিল সেই কাজের বউটি, একটু আগেই যে বাসনের পাঁজা নিয়ে ঢুকেছিল। মা এসে বাইরের ঘরে ঢোকেনি, কারণ বাড়ির বউয়ের পক্ষে সেটা নিষেধ ছিল। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মা খুশি খুশি হেসে বলেছিল, একি গো বাবা, তুমি এ ঘরে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে এসো।

দাদুর মুখেও হাসি ফুটেছিল, বলেছিলেন, তোদের কারোকে দেখতেই পাচ্ছিনে। তোর ছেলেও হয়েছে সেই রকম। এত করে বলেছি, যাও বাড়ির ভেতরে গিয়ে খবর দাও, কিছুতেই যাবে না। আমি আজ দুদেকে নিয়ে আসব, সেই চিঠি পেয়েছিলি তো?

হ্যাঁ পেয়েছি।‘ মা বলেছিল, ‘সকালে আসবেনা বিকেলে তা লেখনি। তুমি ভেতরে এসো। কী দুদে, তুই কি বাড়িতে ঢুকবি না নাকি?’

দাদু বাড়ির ভিতরে ঢুকেছিলেন। মা দাদুকে নিচু হয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিল। দাদু আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত তুলে বলেছিলেন, জয়তু। কই দুদে, মাকে প্রণাম কর। আমার দিকে ফিরে তাকিয়েছিলেন।

পানতুটা আমার দিকেই তাকিয়ে দেখছিল। আমি ভিতরে ঢুকে মাকে প্রণাম করেছিলাম। দেখা হলেই প্রণাম করতে হবে নাকি? কয়েকদিন আগেই তো বসিরহাটে দেখা হয়েছিল। তখনও প্রণাম করেছিলাম। দাদু পানতুর গাল টিপে আদর করে মাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ছোটটি কোথায়?

ছোটটি মানে বিতির কথা দাদু জিজ্ঞেস করেছিলেন। মা বলেছিল, আমাদের বউয়ের মেয়ে কুড়ুনি ছোট মেয়েকে নিয়ে আশেপাশের কোনও বাড়িতে গেছে। বড় হিঁচকাঁদুনে মেয়ে হয়েছে। এসো, বসবে এসো।

হ্যাঁ চল৷’ দাদু পা বাড়িয়ে বাঁয়ে দাদুর ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখে প্রায় চুপিচুপি বলেছিলেন, বেয়াই

মশাইকে এবার যেন আরও অন্য রকম দেখলাম।

আমি দাদুর গা ঘেঁষে যেতে যেতে ঠাকুরদার ঘরের ভিতরে দেখেছিলাম। ঠাকুরদা পায়চারি করছিলেন। মাও গলার স্বর নামিয়ে বলেছিল, এখন বলতে গেলে একেবারে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছেন। একটাই রক্ষে, ক্ষ্যাপামি করেন না, কারোকে তেড়ে মারতেও যান না।

ভগবানের যে কখন কী অভিরুচি হয়। দাদু আবার একটা নিশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, ঠাণ্ডা মাথার মানুষ, কত বিষয়বুদ্ধি, কী সুন্দর কথাবার্তা বলতেন। আমাদের দেখে চিনতেই পারলেন না।

মা সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল, আমাদেরও কি চিনতে পারেন নাকি? বাড়ির কারোকেই চিনতে পারেন না, একমাত্র মাকে ছাড়া।

মা বলতে ওই ক্ষেত্রে আমার মা তার শাশুড়ির কথা বলেছিল, তারপরে সিঁড়ি ছাড়িয়ে প্রথম ঘরটির দরজায় দাঁড়িয়ে বলেছিল, মা, আমার বাবা দুদেকে নিয়ে এসেছেন।

আমি দাদুর সঙ্গে ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। জানতাম, ওই ঘরটা ঠাকমার থাকবার ঘর না। সারা দিন ওই ঘরে থাকতেন, রাত্রে ঠাকুরদার দক্ষিণের মারবেল পাথরের ঘরে শুতে যেতেন। দেখেছিলাম ঠামা বঁটি পেতে বসে থোড় কুটছিলেন। কোটা থামিয়ে বলেছিলেন–

বসিরহাটের বেয়াই এসেছেন? এ ঘরে আসতে বলল, একটা আসন পেতে দাও। আসুন চক্কোত্তি মশাই।

মা সরে দাঁড়িয়েছিল। দাদু ঘরে ঢুকে দু হাত কপালে ঠেকিয়ে বেশ খানিকটা নিচু হয়েই নমস্কার করে বলেছিলেন, হ্যাঁ, এই যে এসেছি। আপনার শরীর-টরীর ভাল তো?

আর শরীর। ঠাকমা বলেছিলেন, এখন গেলেই হয়। তাতেও আবার ভাবনা, বুঝলেন চক্কোত্তি মশাই, আপনার বেয়াইকে এভাবে ফেলে যেতেও এখন মন খারাপ হয়।

দাদু বলেছিলেন, তা তো বটেই। শুনলাম, একমাত্র আপনাকেই চিনতে পারেন।

মা ঘরে ঢুকে একটা আসন পেতে দিয়েছিল। দাদু বসেছিলেন। ঠাকমা বলেছিলে, সেই হয়েছে আর। এক মুশকিল। কারও হাতে খাবেন না, কারও হাত থেকে জল নেবেন না। আর বুঝতেই পারছেন, এমন অসাব্যস্ত হয়ে পড়েছেন কাপড়চোপড় পরিয়ে দিতে হয়। তাই বলছিলাম, এখন আমার ডাক এলেও যাওয়া এক ভাবনা।

বটেই তো, বটেই তো৷’ দাদু বলেছিলেন ত্রিলোচন কোথায়, তাকে দেখছিনে?

ঠাকমার ভাঁজ পড়া ঠোঁট দুটো বেঁকে উঠেছিল, আবার ঘোড় কোটা শুরু করে বলেছিলেন, তার কথা আর বলবেন না। বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় তুলেই দিয়েছে। বেশির ভাগ কলকাতাতেই থাকে, যখন ইচ্ছে হয় একবেলা বা একদিন এসে ঘুরে যায়। কলকাতায় কী রাজকায্যি করে সেই জানে। বাপ পাগল, সে সব ভাবনা চিন্তাও নেই। নেহাত রতনটা ছিল, প্রত্যেক রোববারই বউমাকে নিয়ে এসে সারা দিন থাকে। সেই যা একটু সংসারের জন্য ভাবে। কলকাতা থেকে পাগলের ডাক্তারও রতন এনেছিল। ডাক্তার ওষুধ-বিষুধও দিয়েছিল, সারল না।

রতন আমার জ্যাঠামশাইয়ের ডাক নাম। ভাল নাম সত্যেশ্বর। তিনি জ্যাঠাইমাকে নিয়ে শিয়ালদহে রেল কোয়ার্টারে থাকতেন। আমি সে কোয়ার্টার দেখেছি, বিরাট কোয়ার্টার। আশেপাশে সব সাহেবরা থাকত। কিন্তু ওই সব কথাবার্তা শুনতে আমার মোটেই ভাল লাগছিল না। আমি ঠাকমার ঘরের দরজার কাছ থেকে সরে আসতে যাচ্ছিলাম। তখনই ঠাকমা বলে উঠেছিলেন, কীরে দুদে, তুই কি সূয্যিবংশের রাজার ছেলে হয়েছিস নাকি?

আমি কথাটার মানে বুঝতে পারিনি। দাদু ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন, সে কি দাদু, তুমি ঠাকমাকে প্রণাম করোনি? ছি ছি, এ যে আমার দুর্নাম, আমি তোমাকে মানুষ করতে পারিনি।’

ভাবতেই পারিনি, ঠাকমা আমার সঙ্গে কথা না বললেও আমার দিকে নজর ছিল ঠিকই। ওই বয়সেও আমি বুঝতে পেরেছিলাম, ঠাকমার কথার মধ্যে বেশ খোঁচা ছিল। আমি ঘরে ঢুকে ঠাকমাকে প্রণাম করে বেরিয়ে আসছিলাম, আর তিনি আবার বলে উঠেছিলেন, আমাকে করলি, দাদুকে করলিনে? এ সব কি শেখাতে হয় নাকি, যে কজন গুরুজন সামনে থাকেন, সবাইকেই পেন্নাম করতে হয়।

আমি আবার দাদুকেও প্রণাম করেছিলাম।

আমি বাইরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। আমার কিছুই ভাল লাগছিল না। পানতু আমার দিকেই দেখছিল। কিন্তু ওর সঙ্গে বলার মতো কোনও কথা ছিল না আমার। মনে হচ্ছিল, একটা বিরাট অচেনা বাড়িতে আমি একেবারে একলা। একমাত্র দোতলায় যেতে আমার ইচ্ছা করছিল। ভেবেছিলাম, বড়দা মেজদা ওপরে আছে। আমি সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠেছিলাম। পানতু আমার পিছনে পিছনে এসেছিল। আমি ডাইনে বাঁয়ে তাকিয়েছিলাম। ডান দিকে পা বাড়াতেই পানতু বলে উঠেছিল, মায়ের ঘর এদিকে।

আমি পুব দিকে তাকিয়েছিলাম। জানতাম, বাবা মা ওইদিকে পাশাপাশি দুটো ঘরে থাকে। এমন নয় যে আমি কারোর ঘর চিনতাম না। পানতু অবিশ্যি সেই রকম ভেবেছিল। বাবার ঘরটা খুবই সাজানো ছিল। খাট আলমারি ড্রেসিংটেবিল। পাশের ঘরটা মায়ের ঘর বলা হত। সে ঘরে সামান্য তক্তপোশ, কথা মাদুর ছাড়া বিশেষ কিছু ছিল না। আমাদের ভাই বোনদের জন্মের পর থেকেই মা পাশের ঘরে থাকত। আমি পানতুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বড়দা আর মেজদা কোথায়?

বড়দা কলকাতায়, মেজদা ঠাকুরদার ঘরে পড়ছে। পানতু জবাব দিয়েছিল।

আমি ডান দিকে গিয়ে মারবেল পাথরের দক্ষিণ খোলা ঘরের দরজায় উঁকি দিয়েছিলাম। এক পাশে খাট, অন্য পাশে চোঙা লাগানো টেবিলের মতো উঁচু গ্রামোফোন। এক কোণে, পশ্চিমের জানালার ধারে একটা ছোট টেবিল আর চেয়ার। মেজদা সেই টেবিলে পড়ছিল। পায়ের শব্দে ফিরে তাকিয়ে আমাকে দেখে প্রথমে ভুরু কুঁচকেছিল, তারপরে হেসে বলেছিল, দুদে নাকি রে? কখন এলি?

এই তো একটু আগে। আমি বলেছিলাম, বড়দা কলকাতায় গেছে কেন?

মেজদা বলেছিল, তুই জানিস না, দাদা তো দু মাস হল কলেজে পড়ছে। ও এখন বাবা-মার সঙ্গে রোববারে এখানে আসে। আমারও তো সামনে ইস্কুল ফাইনাল। তুই তো এবার এখানকার ইস্কুলে ভরতি হবি।

আমি মাথা ঝাঁকিয়েছিলাম। মেজদা আবার টেবিলে বইয়ের ওপর ঝুঁকে পড়েছিল। আমি সরে এসেছিলাম। জ্যাঠামশাইয়ের ঘরে শিকল ভোলা ছিল। পুব দিকে এগিয়ে দেখেছিলাম, মায়ের ঘরটা খোলা, কিন্তু বাবার ঘরের শিকলে তালা ঝুলছে। আমি পানতুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এ ঘরে তালা কেন?

বাবা লাগিয়ে দিয়েছে। চাবিও বাবার কাছে থাকে।

 কেন?

 তা আমি কী জানি।

বাবা তার ঘরে তালা লাগিয়ে চাবি নিজের কাছে রেখে দেয়, কথাটা শুনে আমার ভাল লাগেনি। এমনকী বাবার ঘরের জানালাগুলোও বন্ধ ছিল, ভিতরের কিছু দেখবার উপায় ছিল না। আমি পুব দিকের বারান্দার দরজা খুলে খোলা ছাদে গিয়েছিলাম। একেবারে শেষ প্রান্তে পাইখানা আর বাথরুম। দরজায় শিকল তোলা। আমি উত্তর দিকে আলসের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। কাকাদের বাড়ির বাগান আর বাড়ির ভিতর দিকটা দেখা যাচ্ছিল। কাকিমা বা আরও কেউ কেউ বাড়ির মধ্যে কাজে কর্মে চলাচল করছিল। সামনেই একটা পেয়ারা গাছ, তখনও আলসে অবধি মাথা তোলেনি।

আমি ফিরে তাকিয়ে দেখেছিলাম পানতু নেই। আমার ভিতরটা কেমন খাঁ খাঁ করছিল। মনে হচ্ছিল তখনই ছুটে বসিরহাট চলে যাই। সেখানে তবু আমার কয়েকজন বন্ধু ছিল। দাদুর বাড়ির ঘর দরজা উঠোন বাগান সবই আমার অন্য রকম লাগত। মনে হত, ওখানে আমার মনটা আপনিই ভাল থাকত, সহজে নিশ্বাস পড়ত আর সবকিছুই নিজের বলে মনে হত। আমাদের বিরাট বাড়িটা আমাকে যেন হাঁ করে গিলতে আসছিল। এখনও আমার মনে আছে, পুবের খোলা ছাদোড়িয়ে আমার বুকটা টনটন করে উঠেছিল, আর চোখে জল এসে পড়েছিল আর মনে মনে বলেছিলাম, ভগবান, আমাকে বসিরহাটে ফিরিয়ে নিয়ে চলো। হাড়োয়ার বিদ্যাধরী নদীর ধারে পীর গোরাচাঁদের কথা আমার মনে পড়েছিল। ফাল্গুন মাসে আমি গোরাচাঁদের মেলায় দু বার গিয়েছিলাম। দাদু অবিশ্যি যাননি কারণ তিনি বলতেন, ও সব হল মুসলমানদের ব্যাপার, আমি ওখানে যাব না। তুমি যেতে চাও তোমার সঙ্গে লোক দিয়ে আমি পাঠিয়ে দেব।

দাদুকে আমার অনেক আগে থেকেই চেনা উচিত ছিল। তিনি এমনই গোঁড়া হিন্দু, অন্য কোনও ধর্ম বিষয়েই তার একটুও টান ছিল না। অথচ হাড়োয়ার পীর গোরাচাঁদের মেলায় আমি বিস্তর হিন্দুদের দেখেছি। অনেক দূর থেকেও আসত, কারণ, সকলেরই বিশ্বাস ছিল পীর গোরাচাঁদ সাক্ষাৎ দেবতা। তার থানে গিয়ে যা কিছু মানত করা যায়, তা-ই ফলে। আমি আমাদের পুবের খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে পীর গোরাচাঁদকে মনে মনে বলেছিলাম, তুমি আমাকে বসিরহাটে ফিরিয়ে নিয়ে চল, আমি তোমাকে সিন্নি চড়াব, পুজো দেব।..

কেউ আমার কথা শোনেনি। না ভগবান, না পীর গোরাচাঁদ। এক দিন থেকেই দাদু চলে গিয়েছিলেন। দু দিন পরেই মেজদা আমাকে ক্লাস নাইনে ভরতি করে দিয়েছিল। বন্ধুবান্ধব জুটতেও দেরি হয়নি। জ্যাঠামশাই এসে কলকাতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, এক সপ্তাহ পরে আবার রেখে গিয়েছিলেন। আমার বেশ মনে আছে, জ্যাঠামশাই ভুলেও এক বার বাবার কথা বলেননি। কেবল জ্যাঠাইমা এক দিন বলেছিলেন, বড় হ, তারপরে তোর বাবার কীর্তি কাণ্ড সব শুনবি।…এর বেশি কিছু বলেননি।

আমি বাড়ি ফেরার তিন সপ্তাহ বাদে বাবা এসেছিল। আমি তখন নীচের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। মানুষটাকে দেখবার আগেই, আমার নাকে বিলিতি সেন্টের গন্ধ লেগেছিল। দেখেছিলাম, বাবার গায়ে দুধ গরদের পাঞ্জাবি চুনোট করা তাঁতের ধুতি। চুল একটু উশকো খুশকো। মহাশয়ের চেহারাটি তো সত্যি সুন্দর। তার মতো নাক চোখ মুখ কিছুই আমি পাইনি। এক বার ঠাকুরদার ঘরের দিকে দেখে আমার দিকে তাকিয়েছিল। আমি ভাবছিলাম, বাবাকে আমার প্রণাম করা উচিত। কিন্তু বাবা মোটে দাঁড়ায়নি, চলতে চলতেই আমাকে বলেছিল, দাদুর বাড়ির পাট চুকল?.আর কোনও কথা বলেনি। কবে এসেছি, কার সঙ্গে, কেমন আছি একটা কথাও না। নীচে সিঁড়ির পাশে ঠাকমার ঘরের দরজায় পঁড়িয়ে বলেছিল, কী করছ মা?

আমি ঠাম্মার গলা শুনতে পেয়েছিলাম। কে, ধানু?’ তারপরেই ঠামার গলা যেন কেমন নিহ শুনিয়েছিল, জনমভর যা করে এসেছি, তাই করছি।

তোমার শরীর ভাল?’ বাবা আবার জিজ্ঞেস করেছিল।

 ঠাকমার গলা তেমনই শোনা গিয়েছিল, এ শরীরের ভাল আর মন্দ।

আমি বাবার দিকে তাকিয়ে বেশ বুঝতে পারছিলাম কথাগুলো বলতে হবে তাই বলেছিল, আর আমি না দেখেও বুঝতে পারছিলাম ঠামা বাবার দিকে না তাকিয়ে নিজের কাজ করে যাচ্ছিলেন। মা পাশের নিরামিষ রান্নাঘরে ছিল। সেখান থেকে বিনতির ঘ্যানঘেনে কান্না শোনা যাচ্ছিল। বাবা সেদিকে যায়নি। আমার দিকে এক বার দেখে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে চলে গিয়েছিল। আমি ইস্কুল চলে গিয়েছিলাম। সারাদিন বাবা কী করেছিল, মায়ের সঙ্গে কথা বলেছিল কি না কিছুই জানি না। সন্ধ্যাবেলা এক বার বেরোতে দেখেছিলাম, রাত্রে কখন ফিরে এসেছিল জানি না। পরের দিন সকালেই আবার কলকাতা চলে গিয়েছিল। আমি অবিশ্যি আশা করিনি, বাবা আমাকে কাছে ডেকে আদর করবে, কারণ আমার তখন চৌদ্দ বছর বয়স হয়েছিল। কিন্তু আমাকে যেন বাবার চোখেই পড়েনি, একটা কথাও আর বলেনি। অথচ পরের দিন কলকাতা যাবার আগে মেজদার সঙ্গে কথা বলেছিল, পানতুকে কাছে ডেকে মাথায় হাত দিয়ে ইস্কুলের পড়াশোনার কথা জিজ্ঞেস করেছিল। আমি অবাক হয়েছিলাম, ভয়ও হয়েছিল, মনে হয়েছিল আমি যেন বাবার কাছে কোনও অপরাধ করেছি।

বাবা ওই রকম মাসে দু-মাসে এক দিন বা দু দিনের জন্য বাড়ি আসত আর চলে যেত। আমার সঙ্গে সামান্য দু-একটা কথা বলত, যা না বললেও চলত। বাবার আসা যাওয়া নিয়ে ঠামা ছাড়া কেউ কিছু বলত না। রবিবারে জ্যাঠাইমা এলে ঠাকমার সঙ্গে বাবার কথাবার্তা হত, সবটাই দুঃখ আর আক্ষেপের। ঠাকমা একটা কথা প্রায়ই বলতেন, অমন ভাল চাকরি, কত উপুরি রোজগার ছিল, সে সব ছেড়ে ছুঁড়ে ধানুটা যে কী উঞ্ছবৃত্তি করে বেড়াচ্ছে। ওর ঘাড়ে অপদেবতা ভর করেছে।

ঠাকমার ওইসব কথা শুনে জ্যাঠাইমা ঠোঁট বাঁকাতেন, ঘাড়ে ঝটকা দিতেন, যেন বড়ই বিতৃষ্ণা, আর আমার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলতেন, তুই কিছুই করতে পারলিনে। এক বার যদি ঘুরে দাঁড়াতিস তা হলে ঠাকুরপোও হয়তো ঘুরত!

মা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসত। কোনও কথা বলত না। আমি এমন কথাও এক দিন শুনেছিলাম, জ্যাঠাইমা মাকে বলেছিলেন, লোকটা যেখানে সেখানে যা-তা করে আসবে, আর তোকে তু বলে ডাকলেই ঠাকুরপোর খাটে গিয়ে শুবি! ..অবিশ্যি কথাটা বলবার সময় জ্যাঠাইমা আমাকে দেখতে পাননি আর আমিও তখন কথাটার ঠিক কিছু অর্থ বুঝতে পারিনি। এখন অবশ্যি বুঝতে পারি, আর মনে হয় জ্যাঠাইমা যেন ঠিকই বলেছিলেন।

আমি জানতাম, বাবা পি ডবলিউ ডি-র ক্যাশ ডিপার্টমেন্টে চাকরি করত। চাকরিটা করলে, ফিফটির গোড়াতেই ক্যাশিয়ার হয়ে যেত। উপুরি রোজগারের কথাও শুনেছিলাম, ঘুষ আর চুরি যাকে বলে সে সবও নাকি অনেক বেড়ে যেত। কিন্তু সেখানেও বাবা নাকি কী একটা কীর্তি করেছিল। হয়তো হাতে হাতকড়া পড়ত। আমার এক পিসেমশাই ছিলেন পি ডবলিউ ডি-র একজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার, যার দৌলতে বাবা চাকরি পেয়েছিল। তার চেষ্টাতেই বাবা শাস্তির হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল।

বাড়ি ফিরে আসার পর আমি একটাও ভাল ঘটনা ঘটতে দেখিনি। এখন আমার হিসাবে ছ বছর বয়স থেকে চৌদ্দ বছর বয়স পর্যন্ত আমার জীবনটা ছিল সুখের, যা আমি কোনও দিনই ভুলতে পারি না। তারপরে আমার তিরিশ বছর বয়স থেকে প্রায় আটত্রিশ বছর বয়স অবধি, সেই আট বছরও ছিল একরকম সুখেরই। একটা মানুষের গোটা জীবনে, ছেলেবেলায় আর বড় হয়ে টোটাল ষোলো বছর সুখে কাটানো, বোধ হয় বিরাট একটা ব্যাপার। যদিও ছয় থেকে চৌদ্দ, বসিরহাটের সেই আট বছর সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখার মতো। আর তিরিশ থেকে আটত্রিশ-খুকুর সঙ্গে জীবনটা ঠিক সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখার মতো না। ওই বছরগুলোকে বোধ হয় রক্ত দিয়ে এঁকে রাখার মতো বলা যায়। শরীরের শিরায় শিরায় রক্তের মধ্যে একটা সুখ ভোগ করা যায়, আবার রক্ত ঝরলে কষ্ট হয়। সেই রকম সুখ আর কষ্ট, দুই রকমই আমি ভোগ করেছিলাম, তবু কেন যেন মনে হত কষ্টের মধ্যেও একটা সুখ ছিল। সত্যি সত্যি তো খুকু আমার রক্ত ঝরাত না, কিন্তু কখনও কখনও ও এমন সব কাজ করত আর তা করত অত্যন্ত নির্দয় আর নিষ্ঠুরভাবে, বুকে ছুরি বেঁধার থেকে তা কিছু কম ছিল না। তবু ও যে আমার, কেবল আমারই, এই ভেবে আমার সব কষ্টের মধ্যেও একটা সুখ পেতাম। অথচ, কোনও দিনই বুঝতে পারিনি, আমার সব বিশ্বাস ভাবনা চাবুক খাওয়া পাগলা ঘোড়ার মতো ছিটকে হারিয়ে যাবে।

আমি কোনও রকমে থার্ড ডিভিশনে ইস্কুল ফাইনাল পাশ করার পরেই শুনেছিলাম, বাবার একটি কীর্তি, যে-কথা আমাকে জ্যাঠাইমা বলেননি। ঠাকমার কাছ থেকে শুনেছিলাম। জ্যাঠামশাই রেলের ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তারও অনেক বাঁ হাতের রোজগার ছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরে, তার নিজের নামে তিনি কোনও সম্পত্তি করতে পারেননি। তাই কলকাতার বাইরে উত্তর শহরতলিতে বিরাট বাড়ি আর বাগান করেছিলেন আমার বাবার নামে আর হরিণঘাটার দিকে তিরিশ বিঘা ধান জমি, তাও কিনেছিলেন বাবার নামেই। পাছে ধরা পড়ে যান তাই জ্যাঠাইমা বা বড়দা মেজদার নামেও কিছুই করেননি। দলিল দস্তাবেজ ছিল সবই ঠাকমার কাছে।

ঠাকমা যেন ভয়ে চুপিচুপি গলায় বলেছিলেন, কী করে জানব, তোর বাবা একটা সোঁদরবনের বাঘ, ঘাপটি মেরে চক্কর দিয়ে ফিরছিল। জানতেও পারিনি, কবে আমার আলমারি থেকে, তোর জেঠুর বাড়ি বাগান জমির সব কাগজপত্তর চুরি করে নিয়েছিল। তুই বসিরহাট থেকে আসার মাত্তর ছ মাস আগে, তোর বাবা সব বেচে দিয়েছিল। রতন নেহাত মাথা ঠাণ্ডা, তাই পাগল হয়নি। তোর বাবা তোর ঠাকুরদা ছাড়া কারোকে ভয় পায় না। কিন্তু তার তখন মাথা খারাপের সব লক্ষণই দেখা দিয়েছে, তা নইলে তোর বাবা হয় তো এতটা সাহস করত না। তারপরের কীর্তি তো তোর চোখের সামনেই ঘটল।

হ্যাঁ, তার পরের কীর্তি ঘটেছিল, আমি বসিরহাট থেকে আসার ছ মাস পরে। সেটা ফরটিনাইনের শেষ দিকে। জ্যাঠামশাই খুন হয়েছিলেন। শিয়ালদহের কোয়ার্টার ছেড়ে, জ্যাঠাইমা বাড়ি চলে এসেছিলেন। বাবাও কলকাতা ছেড়ে বাড়ি এসেছিল, আর একেবারে অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছিল। বাবাকে তখন প্রায়ই ঘরে বা পুকুরের ধারে বা ছাদে একলা কাঁদতে দেখা যেত। বেশির ভাগ সময়েই জ্যাঠাইমার আশেপাশে থাকত।

নমস্য ব্যক্তি ত্রিলোচন চাটুয্যে। বাড়ির সকলের মনে একটা পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। জ্যাঠাইমা পর্যন্ত বলতেন, ঠাকুরপো, আমি তোমার মনের কথা বুঝি। এখন নিজের দাদার জন্য তোমার প্রাণ পুড়ছে। কিন্তু যা ঘটবার তা ঘটে গেছে, এখন তুমি নতুন করে সংসারের হাল ধরো।

জ্যাঠামশাই অন ডিউটি খুন হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে রেলবোর্ড ওয়ার্কার্সদের কোনও বিক্ষোভ ছিল না। তবু বাবা বলেছিল, কমিউনিস্টরাই দাদাকে খুন করেছে।

কমিউনিস্ট পার্টি তখন বেআইনি, সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দিয়েছিল। বাবা সহজেই কমিউনিস্টদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়েছিল। যদিও সে কথায় কেউ কান দেয়নি, কারণ কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং পুলিশের ধারণা ছিল, জ্যাঠামশাইকে লোহার ডাণ্ডা দিয়ে মাথা ফাটিয়ে অন্য কোথাও খুন করে, কাঁচরাপাড়ার কাছে রেল লাইনের ধারে ডেড বডি ফেলে দেওয়া হয়েছিল। সম্ভবত চলন্ত ট্রেনের তলায় ফেলে, একটা অ্যাকসিডেন্টের রূপ দেবার চেষ্টা হয়েছিল, তা সম্ভব হয়নি। অন ডিউটি খুন হওয়ার জন্যেই জ্যাঠামশাইয়ের মৃত্যুর জন্য কেন্দ্রীয় সরকার দশ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল, আর প্রভিডেন্ট ফান্ডের সমস্ত টাকাই দিয়েছিল। রিটায়ার করার আগে, তা পুরোটা পাওয়ার কথা ছিল না।

জ্যাঠাইমা বিশ্বাস করে, টাকা পয়সা তোলার সব দায়িত্বই বাবাকে দিয়েছিলেন। বিশ্বাস! বিষয়টা কী? ওটা কি মনের কোনও সুড়সুড়ি নাকি? লাগলে আর স্থির থাকা যায় না? বাবা জ্যাঠাইমাকে দিয়ে কী সব সই সাবুদ করিয়ে নিয়েছিল, কেউ কিছু বুঝতে পারেনি। আসলে, কারোর মনে কোনও খটকাই লাগেনি। মেজদারও না। বাবা আবার হাওয়া হয়ে গিয়েছিল। বাড়ির সবাই অস্থির হয়ে উঠেছিল। অন্য কোনও কারণে না, বাবার কোনও বিপদ আপদ হয়েছে কি না, সকলেই সেই দুশ্চিন্তায় ভুগেছিল। তারপরে জ্যাঠামশাইয়ের এক বন্ধু এসে হাজির হয়েছিলেন, যিনি জ্যাঠামশাইয়ের নীচের পোস্টে ছিলেন। তাঁর কাছ থেকে জানা গিয়েছিল, ত্রিলোচনবাবুকে জ্যাঠাইমা জ্যাঠামশাইয়ের সমস্ত প্রাপ্য টাকা, লিখে দিয়েছিলেন। টাকার পরিমাণ মোট পঁচাশি হাজার ছিল।

ওই সময়ে অবিশ্যি আমি জ্যাঠামশাইয়ের খুনের ব্যাপারে ঠিক কিছু ভাবতে পারিনি। এখন ইদানীং, আমার মনে হয়, সমস্ত ব্যাপারটাই ছিল বাবার প্রি-প্ল্যানড। জ্যাঠামশাইকে বাবাই খুন করেছিল, কেবল মাত্র তার টাকার জন্যে। সমস্ত ঘটনাটা ভাবলে, এই চিন্তাই আমার মনে আসে।

আমার ইস্কুল ফাইনাল পাশের পরে, ঠাকুরদা উন্মাদ অবস্থায় মারা গিয়েছিলেন। বাবা বাড়ি এসেছিল। আমি খুব আশা করেছিলাম, বড়দা মেজদা একটা কাণ্ড ঘটাবে। আশ্চর্য। তারা কেউ বাবার সঙ্গে কথা বলেনি। বাবা পিতৃদশার কাছা পরে, জ্যাঠাইমার পায়ে কেঁদে পড়েছিল। কেন? না, বাবা হঠাৎ একটা ব্যবসায়ে টাকা ঢেলে সর্বস্বান্ত হয়েছে। তবে সে তার বউদির সমস্ত টাকাই ফিরিয়ে দেবে। আমি ভেবেছিলাম, জ্যাঠাইমা অন্তত বাবাকে চিৎকার করে অভিশাপ দেবেন। কিন্তু না, জ্যাঠাইমা একটিও কথা না বলে, বাবার সামনে থেকে সরে গিয়েছিলেন। কেবল ঠাকমা চিৎকার করে কেঁদেছিলেন। সেটা তার স্বামীর শোকেও বটে, বাবাকে বাড়ির মধ্যে দেখেও বটে।

ঠাকুরদার শ্রাদ্ধের পরে বাবা আবার কলকাতায় চলে গিয়েছিল। বড়দা তখন চাকরি পেয়েছে। জ্যাঠাইমা বড়দা মেজদাকে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন গড়িয়ায়, আর কিছু জমি বাগান বিক্রি করে সেখানেই বাড়ি করেছিলেন। আমরা পড়েছিলাম অগাধ জলে। আমি কিছু কিছু জমিজমার সন্ধান রাখতাম। তা দিয়ে সারা বছরের খাবার জোটা সম্ভব ছিল না। আমি নানা ভাবে খোঁজ নিয়ে, বাবার কলকাতার ঠিকানা জোগাড় করেছিলাম। বৌবাজারে এক গলির মধ্যে, পাড়াটা মোটেই ভাল ছিল না। আশা করতে পারিনি, ত্রিলোচন চাটুয্যে এত টাকার মালিক, ওইরকম একটা পাড়ায়, ভেজা স্যাঁতসেঁতে পুরনো একতলা বাড়িতে থাকবে।

কিন্তু অবাক হবার মতো ঘটনা আরও ছিল। বাড়ির নম্বরটা দেখে, খোলা দরজা দিয়ে আমি বাড়ির মধ্যে ঢুকেছিলাম, আর বাঁ দিকের একটা ঘরে দেখেছিলাম, বাবা খাটের ওপর এলিয়ে কাত হয়ে শুয়ে আছে। খাটের নীচেই লাল মেঝের ওপর একটি মেয়ে বসেছিল। বাবার একটা হাত মেয়েটার কাঁধের ওপর দিয়ে, প্রায় বুকের কাছে। আমি থ হয়ে গিয়েছিলাম মেয়েটাকে দেখে। কারণ মেয়েটা আমাদের পাড়ার, এক ভদ্র পরিবারের মেয়ে। ভদ্র! তা ছাড়া কী? নগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, আমাদের নগুকাকার আঠারো-উনিশ বছর বয়সের মেয়ে। আমার থেকে বোধ হয় বছরখানেক বড় ছিল, তবু ওকে পাড়ায় নাম ধরেই ডাকতাম। ওর ডাকনাম ছিল পুটু। মাজা মাজা রঙের ওপর, চোখ মুখ ভাল ছিল, বিশেষ করে ওর লম্বা শরীরে স্বাস্থ্যে, আর মাথা ভরতি এক পিঠ কোঁকড়ানো চুলে, বেশ একটা চটক ছিল। ও আমার দিকে তাকিয়েই, চমকিয়ে উঠে, একটু সরে বসে ছিল। আমি কিছু বুঝতেই পারিনি, অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পুটু তুই এখানে?

তুই এখানে কী মনে করে?’ বাবা তার লুঙ্গিটা গোছাতে গোছাতে উঠে বসেছিল, এখানকার ঠিকানা পেলি কী করে?

ঘরের মধ্যে একটা সুন্দর চাঁপা ফুলের গন্ধ ছড়িয়েছিল। খাট বিছানা আলমারির পাল্লায় আয়না, আলনা সবই বেশ ঝকঝকে দেখাচ্ছিল। ঢোকবার সময়ে দেখেছিলাম, মাঝখানে বাঁধানো উঠোন আর কলতলা এক পাশে। একটি বুড়ি ঝি বাসন মাজছিল, অন্যান্য ঘরের দরজাগুলো বন্ধ ছিল। আমি বলেছিলাম, ঠিকানাটা কষ্ট করে জোগাড় করতে হয়েছে। পুটু এখানে কী করছে?

ও কলকাতায় গান শেখে। বাবা জবাব দিয়েছিল।

পুটু আমাকে একটা চেয়ার দেখিয়ে বলেছিল, বোস দুদে।

আমি জানতাম, পুটু গান ভাল গায়। কিন্তু কলকাতায় গান শেখার সঙ্গে বাবার কাছে আসার সম্পর্ক কী ছিল? আমি পুটুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কোথায় গান শিখিস তুই?

আমার এখানেই শেখে। বাবা জবাব দিয়েছিল, আমিই ওর জন্য মাস্টার রেখে দিয়েছি।

পুটু ওর আগোছালো শাড়ি গুছিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল। বয়স আমার যাই হোক, ব্যাপারটা আমার মোটেই ভাল লাগেনি। আমি আবার পুটুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুই কি রোজ আসিস নাকি?

না, ও এখানেই থাকে। বাবা জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, তুই কেন এসেছিস, সে কথা বল।

সেই অবহেলা আর মানুষ বলে গণ্য না করা। আমি বলেছিলাম, সংসারের খরচের জন্য কিছু টাকা নিতে এসেছি।

তা হলেই তো মুশকিল। ব্যবসার অবস্থা মোটেই ভাল যাচ্ছে না। বাবা বলেছিল।

আমি বলে উঠেছিলাম, একটা মেয়েকে মাস্টার রেখে, নিজের কাছে রেখে গান শেখাতে পারো, আর সংসারের টাকা দিতে পারো না?

না, পারি না। বাবা ঝেঁজে বলে উঠেছিল।

আমি খাটের দিকে দু পা এগিয়ে চিৎকার করে উঠেছিলাম, পারি না বললে চলবে না, পারতে হবে।

দুদে! পুটু ছুটে আমার আর বাবার মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছিল।

আমার ইচ্ছা করছিল পুটুর গালেই কষে একটা থাপ্পড় কষাই। বাবা লাফ দিয়ে খাট থেকে নেমে বলেছিল, কী করবি তুই, আমাকে মারবি?

আমি তোমাকে কিছুই করতে চাই না। আমি চাই সংসার খরচের টাকা। আমি বলেছিলাম।

 বাবা লুঙ্গির কষি কষতে কষতে বলেছিল, টাকা নেই, দিতে পারব না।

টাকা তোমাকে দিতেই হবে। আমি চিৎকার করে বলেছিলাম।

বাবাও চিৎকার করেছিল, দেব না।

ধানুকাকা!’ পুটু বাবার গায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, বড় বড় চোখে তাকিয়েছিল।  

বাবা যেন হঠাৎ একটু শান্ত হয়ে গিয়েছিল। পুটু আবার বলেছিল, আশেপাশে লোক আছে, ঝি-টা কাজ করছে।

বাবা তাড়াতাড়ি আলমারির কাছে সরে গিয়ে, পাল্লা খুলে কয়েকটা দশ টাকার নোট মেঝেতে ছুঁড়ে দিয়েছিল, বলেছিল, মেজাজ দেখিয়ে আমার কাছ থেকে টাকা আদায় করা যাবে না।

পুটু মেঝে থেকে নোট কয়েকটা তুলে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল, নে দুদে।

আমার মাথা দপদপ করছিল। জীবনে সেই আমি প্রথম বাবার সঙ্গে চিৎকার করে রেগে কথা বলেছিলাম। কিন্তু পুটুর হাত থেকে টাকাগুলো না নিয়ে আমার উপায় ছিল না। মুঠো করে নোট কয়েকটা নিয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে বলেছিলাম, আমি আবার আসব।

আসতে হলে, মাথা নিচু করে আসবি। বাবা পিছন থেকে কথা ছুঁড়ে দিয়েছিল।

রাস্তায় বেরিয়ে আমি সব কিছুই ঝাপসা দেখেছিলাম। অর্থহীন। আমার চোখ জলে ভেসে গিয়েছিল। বাঁ হাতের কনুই দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ডান হাতে প্যান্টের পকেটের মধ্যে আমি নোট কটা গুনেছিলাম। চারটে নোট ছিল। চারটে দশ টাকার নোট। আমি আগে গিয়েছিলাম ভবানীপুরে পিসিমার কাছে, বাবার কথা সব বলতে। পিসিমা অবাক হননি, বরং এমন ভাবে দুঃখীর মতো হেসেছিলেন, যেন সব ঘটনাই তার জানা। সেখান থেকে গিয়েছিলাম গড়িয়ায় জ্যাঠাইমার কাছে। জ্যাঠাইমাও অবাক হননি। তারপরে বাড়ি ফিরে যখন মাকে বলেছিলাম, মা-ও অবাক হয়নি। সেইদিনই রাত্রে আমি পুটুদের বাড়ি গিয়ে নগুকাকাকে সব জিজ্ঞেস করেছিলাম। দরিদ্র কেরানি মানুষ, সাত-আটটি ছেলে-মেয়ে, মিনমিনে স্বরে, যেন কঁদো কাদো ভাবে বলেছিল, কী করব দুদে, তোর বাবার ইচ্ছে হয়েছে, তাই পুটুকে নিয়ে নিজের কাছে রেখেছে, গান শেখাচ্ছে।

আপনার লজ্জা করে না, এত বড় মেয়েকে একটা লোকের কাছে রেখে দিয়েছেন? আমি কেঁজে বলেছিলাম।

নগুকাকা আরও কঁদো কাঁদো স্বরে বলেছিল, ধানু বলে, নিজের ভাইঝির মতন মানুষ করবে, আর আমি নিশ্চিন্ত, তবু তো একটা মুখের খাবার সংসারে বেঁচে যাচ্ছে। সে আমার হাত ধরে বলেছিল, দুদে, আমার ওপর রাগ করিসনে বাবা। আমার মেয়েকে যা খুশি কলঙ্ক দিতে পারিস, আমি কিছু ভাবব না।

নগুকাকার সেই পুরনো পোড়ো বাড়িটার থেকে একরকম পালিয়ে বেঁচেছিলাম। কে জানে, চক্রবর্তীদের কোন বংশ কবে সেই বাড়িটা তৈরি করেছিল। নোনা আর শ্যাওলা ধরা ভাঙা বাড়ি, উঠোন আর আশপাশ জুড়ে জঙ্গল আর লতাপাতার জটলা। গোটা বাড়িতে একটা মাত্র হ্যারিকেন জ্বলছিল। কাকিমাকে দেখে মনে হয়েছিল, একটা ধবধবে সাদা কঙ্কালের গায়ে জ্যালজেলে একটা কাপড় জড়ানো, কঙ্কালের কপালে একটা সিঁদুরের টিপ। ছেলেমেয়েগুলোকে ভূতের মতো দেখাচ্ছিল, অথচ পুটুর পরের বোন দুটোর শরীরে তাল তাল মাংস কেমন করে জমেছিল?

আমি তারপরেও বেশ কিছুকাল বাবার কাছে যাতায়াত করেছিলাম, আর ঝগড়া বিবাদ মাথা গরম না করে, ভিক্ষের মতোই যা পেতাম, তা নিয়ে আসতাম। অবিশ্যি আমাদের আসল ভরসা ছিলেন পিসিমা, জ্যাঠাইমা, বড়দা আর মেজদা। মেজদাও চাকরি পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বছর খানেকের মধ্যেই পুটুকে আর আমি বাবার সেই বাড়িতে দেখতে পাইনি, অন্য মেয়েদের কয়েকজনকে দেখেছি। তারা কারা, বাবার সঙ্গে কী সম্পর্ক, কী করে সেই বাড়িতে, এ সব জিজ্ঞাসা আমার মনে আসত, আর জবাবে আমার মাথাটা কেবল দপদপ করত। পরে শুনেছিলাম, পুটু মারা গিয়েছে। কেন, কী অসুখে, কিছুই জানতাম না, কবে নাকি নার্সিংহোমে পুটু মারা গিয়েছিল।

ঠাকুরদা মারা যাবার চার বছর পরে ঠামা মারা গিয়েছিলেন। তখন বাবা বাড়িতে এসেছিল। পানতু মানুষ হচ্ছিল কৃষ্ণনগরে বড় পিসিমার বাড়িতে। বড় পিসেমশাই খরচ করে পানতুর বিয়ে দিয়েছিলেন। তারপরে বাবার আরও দুটি অক্ষয় কীর্তি ছিল। একটি ঠাকুরদার সই জাল করে আমাদের বাড়ি বিক্রি করে দেবার চেষ্টা–পারেনি, ধরা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু জ্যাঠামশাই, মা, বড়দা, মেজদা, পিসিমারা। কেউ-ই বাবার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। বাবা মহাশয়ের অবস্থা সেই সময় থেকে ঢিলে হতে আরম্ভ করেছিল। প্রথমে বুঝতে পারিনি। সিক্সসটির গোড়ার দিকে প্রায় দিনই বাড়িতে কাটাত, মাঝে মাঝে কলকাতায় যেত। সিক্সসটি থ্রি থেকে শুরু হয়েছিল বাইরের ঘরে প্লাস্টিকের দড়ি ফিতের কারবার।

আমি পৃথিবীর কিছুই বুঝি না, কিন্তু ত্রিলোচন চাটুয্যেকে নিজের হাতে ঝুড়ি আর ব্যাগ বুনতে দেখে, আমার নিজের মাথার ঠিক ছিল কি না, সন্দেহ হয়েছিল। লোকে আঙুল গুনে বলে, পৃথিবীতে কটা বিস্ময় আছে। আমার বাবাকে কোন নম্বরে ফেলা যায়, সেই হিসাবটা আমার জানতে ইচ্ছা হয়েছিল। তারপরেই শেষ অক্ষয় কীর্তি, বসিরহাটের দাদুর বিষয় সম্পত্তি মায়ের কাছ থেকে লিখিয়ে নেওয়া। আবার বাড়ি ছাড়া, ফের ফিরে আসা। জানি না, এখনও কোনও বড় রকমের কীর্তি বাকি আছে কি না।