কেবল অনুর জন্যই যেন কোনো গন্ধ রইল না। না মায়ার, না মৃত্যুর। সে বাস করে সুবাসহীন এক জগতে। যেটুকুও আছে, তার পুরোটা জুড়ে জরা ও যন্ত্রণা, অন্ধকার আর একাকিত্ব।
অনেকগুলো দিন সে সেই জরা আর যন্ত্রণা, অন্ধকার আর একাকিত্বেই ডুবে রইল। তারপর আচমকা একদিন চাকরিটা ছেড়ে দিলো। তোহা অবশ্য বললেন, এটা কী ঠিক হচ্ছে?
হয়তো না।
তাহলে?
আমার জন্য কারো অশান্তি হলে আমার ভালো লাগে না ভাইয়া।
কিন্তু কিছু মানুষ অকারণেই আপনাকে অশান্তির কারণ ভাববে!
এটা অকারণ ছিল না।
কিন্তু কারণও তো ছিল না!
একটু হলেও হয়তো ছিল, এখন তাও রইল না।
কিন্তু একটা কিছু না পেয়ে ছেড়ে দিলে তো আপনি বিপদে পড়বেন।
অনু হাসলো, অভ্যেস হয়ে গেছে।
তোহা দুঃখী গলায় বললেন, আমি খুবই সরি অনু।
আমি কিছু মনে করিনি ভাইয়া।
আমি মনে করেছি। আমার প্রচণ্ড বাজে ফিলিং হচ্ছে। আসলে প্রথম যেদিন আপনি আমাকে ফোন করেছিলেন, আমি তা ভুলেই গিয়েছিলাম। কথাটা ওকে বলতেই অবাক হয়েছিল। বলেছিল, অনু কেন তোমাকে ফোন করবে? এরপর আপনার সাথে দেখা হওয়ার পর আমি ওকে জানালাম যে একটা জব খুব দরকার আপনার। সমস্যাটা এরপর থেকেই শুরু। কিন্তু এক্সট্রিম হয়েছে আপনাকে এপয়েন্টমেন্ট লেটার পাঠানোর পর।
আমি খুব সরি ভাইয়া, হয়তো আপনাদের সম্পর্কটাই নষ্ট করে দিলাম।
না, না। ইট উহল বি অলরাইট। কিন্তু অনু জব ছেড়ে দেয়াটাও কিন্তু সমাধান না। সে ভাবছে রেগুলার আমরা বাইরে দেখা করি, উই হ্যাভ এ সিক্রেট রিলেশন। তোহা বেশ বিব্রত ভঙ্গিতে কথাটা বলেলো।
তাহলে সমাধানটা কী ভাইয়া?
আমি জানি না অনু। আমি খুবই লজ্জিত।
আমি কী একদিন অদিতির সাথে কথা বলব?
কাজ হবে বলে মনে হয় না।
অনু পরের মাসে চাকরি ছেড়ে দিলো। তার হাতে টাকা বলতে একটা ডিপিএস। সালমা বেগম জোর করে ডিপিএসটা করেছিলেন। সংসারের এই নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা থেকেও তিনি নিংড়ে নিংড়ে সেখানে মাস শেষে টাকা জমা দিতেন, সেই টাকা ক’টা অনুর হাতে আছে। তবে সমস্যা তাতে কমলো না। বরং নতুন যে সমস্যাগুলো অনুর সামনে এলো, অনু তা ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করেনি। সেদিন দুপুর বেলা তনু এসে বলল, বড়’পু, একটা কথা।
কী কথা?
আমরা যে চাল খাই, তা এত মোটা আর চালভর্তি কাঁকড়ও অনেক।
অনু অবাক হলেও কিছু বলল না। তনু বলল, আমি সামনের দোকানদারকে বলে দিয়েছি এই মাস থেকে ভালো চাল দিতে।
অনু তনুর দিকে না তাকিয়েই বলল, আচ্ছা।
তনু বলল, তুই টাকার কথা চিন্তা করিস না, শামীম দোকানে টাকা দিয়ে দিবে। শ্বশুরবাড়িতে তো আর সে মাসের পর মাস এমনি এমনি খেতে পারে না, তারও তো একটা মান ইজ্জতের ব্যাপার আছে।
অনু এবার তনুর দিকে তাকালো। তারপর শান্ত গলায় বলল, তোর কী হয়েছে?
কী আর হবে? ঘরটা কী স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে, দেখেছিস? বিছানায় রাজ্যের ছারপোকা। এই ঘরে কোনো মানুষ থাকতে পারে! এতদিন তো বুঝতে পারিনি। হাফসা সারা রাত কাঁদে কেন? সেদিন রাতে শামীম একটা ছারপোকা পেল। সেই থেকে শামীমও ঘুমাতে পারে না।
বিছানা রোদে শুকাতে দে।
রোদে যে শুকাতে দেব, এ বাড়ির ছাদ আছে যে ছাদে দেব?
ছারপোকার ওষুধ আছে তো।
ওসবে কিছু হয় না। এ বাসায় থাকা যাবে না আপু, বাসা ছেড়ে দিতে হবে।
অনু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, এই ভাড়ায় আর কোথাও এত বড় বাসা এখন পাওয়া যাবে না, গেলে আরো বহু আগেই ছেড়ে দিতাম। অনেকবার চেষ্টাও করেছি।
তনু কিছুটা দ্বিধামিশ্রিত গলায় বলল, ভাড়া সমস্যা না আপু। শামীম মাশাআল্লাহ এখন ভালো টাকা আয় করে, সমস্যা অন্য জায়গায়।
কী সমস্যা?
আমরা অন্য জায়গায় বাসা নিলে তুই থাকবি কোথায়? সেইখানে অবশ্য তোকেও নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু তখন শামীমদের পরিবার থেকে নানান কথা উঠবে। সেগুলো তোর ভালো লাগবে না। তাছাড়া শামীমের মাও এসে থাকবে। মাঝেমধ্যে ওর আত্মীয় স্বজনও।
কেন? আমি এখানেই থাকব, এটা নিয়ে তোর চিন্তা করতে হবে না।
তনু খানিক ইতস্তত করে বলল, একটা সমস্যা আছে আপু।
আবার কী সমস্যা?
আমি বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলেছিলাম, উনি বলেছেন একা একটা মেয়ে মানুষকে তারা বাসা ভাড়া দিবেন না!
অনু ধাক্কা খাওয়া গলায় বলল, কে বলেছে এই কথা!
আজিজুল ভাই, বাড়িওয়ালার বড় ছেলে!
এই শহরে একা একটা মেয়ের বাসা ভাড়া পাওয়া কঠিন, অনু তা জানে। কিন্তু গত প্রায় কুড়ি বছরেরও বেশি সময় ধরে তারা এই বাসায় থাকে। এই বাসার মালিক আউয়াল মিয়ার সাথে অনুদের সম্পর্ক ছিল অনেকটা ঘরের মানুষের মতো। তিনি মারা যাওয়ার পর তার ছেলেদের সাথেও তাদের সম্পর্ক ভালো। তারা কেউ এমন কথা বলতে পারেন, অনুর সেটি বিশ্বাস হচ্ছে না।
সন্ধ্যায় সে বাড়িওয়ালার বাসায় গেল। আজিজুল মিয়া তখন খবরের কাগজ পড়ছিলেন। তার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। এই বাড়ি ভাড়া ছাড়া তার উপার্জনের আর কোনো উৎস নেই। তিনি কাজ বলতে যা করেন, তা হচ্ছে। সারাদিন বারান্দায় বসে পত্রিকায় খেলার খবর পড়েন, আর রাত জেগে ড্রইংরুমের পুরনো শব্দহীন টেলিভিশনে খেলা দেখেন। দুই মেয়ে আর স্ত্রী যে তাকে অতি কষ্টে সহ্য করেন, তা তিনি জানেন। আজিজুল মিয়ার ধারণা, তিনি ছোটবেলায় তার মাকে যতটা ভয় পেতেন, এই বড়বেলায় এসে তার স্ত্রীকে তিনি তার চেয়েও বেশি ভয় পান।
অনুর কথা শুনে আজিজুল মিয়া বললেন, তুমি তো সবই জানো। ঢাকা শহরে গত দশ বছরে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে কম করে হলেও দুই’শ গুণ। কিন্তু আব্বা বেঁচে থাকতে তোমাদের বাড়ি ভাড়া সেভাবে কখনো বাড়াননি। আব্বার মৃত্যুর পর যতটা সম্ভব আমরা চেষ্টা করেছি। এখন সমস্যা হয়েছে, আমার ছোট ভাই চাইছে, বাড়ি ডেভলপারদের দিয়ে দেয়া হোক। তো তখন তোমাকে বাড়ি এমনিতেই তো ছাড়তে হবে!
অনু বলল, কিন্তু ভাইয়া, এখন এই মুহূর্তে আমি এই বাসা ছেড়ে কোথায় যাব?
আশেপাশে দেখো, প্রচুর খালি বাসা আছে।
কিন্তু একা আমাকে কে বাসা ভাড়া দেবে?
এটাই আসল কথা অনু। শুনলাম তনুও তার স্বামীকে নিয়ে চলে যাবে, তখন একা তোমাকে আমরা কীভাবে রাখবো?
ভাইয়া, কুড়ি বছর ধরে আমরা এখানে আছি, এটা কোনো বিষয় না? ব্যাপারটা তো এমন না যে আমাকে আপনি চেনেন না, জানেন না!
চিনি বলেই তো এতদিন তোমরা এখানে ছিলে, নানা ঝুট ঝামেলার পরও কখনো বাসা ছাড়ার কথা বলিনি।
আপনাদের কাছে এই কারণে আমাদের অনেক কৃতজ্ঞতাও আছে ভাইয়া। কিন্তু আমি একা একটা মেয়ে এখন কোথায় যাব?
শোন অনু। এই জন্যই আমরা সবসময়ই তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, একটা বিয়ে করো। কত সম্বন্ধও আনলাম। কিন্তু তোমার সেই এক রা, তুমি এরকম বিয়ে করবে না। বাস্তবতাটা তুমি বুঝতেই চাইলে না। তোমার ভাবিও এইজন্য তোমার উপর কিছুটা বেজার। তখন বিয়েটা করে ফেললে, এই সমস্যাটা হতো? হতো না। মানুষ বিয়ে শাদি করে কী জন্য? বাচ্চা-কাচ্চা কেন জন্ম দেয়? এই যে, এই জন্যই। দিন শেষে সে একা হয়ে যাবে, তার আশে পাশে বন্ধু-বান্ধব, মা-বাবা, ভাই-বোন কেউ থাকবে না। তখন ওই নিজের স্বামী, সন্তানই তার সাথে থাকে, বুঝলে?
অনুর সাথে আজিজুল মিয়ার কথা আর এগুলো না। তবে পরদিন ভোর বেলা আজিজুল মিয়া বাসায় এলেন। তিনি অনুকে ডেকে বললেন, আসল সমস্যাটা অন্য।
কী সমস্যা?
আজিজুল মিয়া সামান্য ইতস্তত করে বললেন, আমরা চাইলেও এখানে তুমি একা থাকতে পারবে না অনু। তুমিও বিপদে পড়বে, আমরাও পড়বো।
কি বিপদ?
ওয়াসিমের কথাটা তুমি ভুলে গেছ?
অনু কথা বলল না, চুপ করে রইল। আজিজুল মিয়া বললেন, ওয়াসিম কেমন মানুষ তুমি জানো। আমার ঘরেও দুটো বড় মেয়ে আছে, এই অবস্থায় আমরাও ভয় পাচ্ছি।
অনু কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে রইল, এখানে দেয়ার মতো শক্ত কোনো যুক্তি তার কাছে নেই। আজিজুল মিয়া বললেন, তোমার সেই ঘটনাটা সবাইই কম বেশি জানে। তোমার মা নিজে ডেকে আমাকে বলেছিলেন। কিন্তু আমার কী সেই ক্ষমতা ছিল যে ওয়াসিমকে কিছু বলি?
অনু মাথা নাড়লো। আজিজুল মিয়া বললেন, যার ছিল সে বলেওছিল। ওয়াসিমকে এলাকা থেকে বেরও করে দিয়েছিল। কিন্তু সময় পাল্টাতেই ওয়াসিম আবার ফিরেও এসেছে। তুমি জানো, আগের চেয়ে তোমার প্রতি তার রাগটা এখন আরো বেশি। তাছাড়া এতদিন যার ভয়ে সে চুপচাপ ছিল, এখন। সেও তো আর নেই।
আজিজুল মিয়া সতর্ক ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে গলার স্বর নিচু করে বললেন, তুমি শুনেছ মনে হয়, জায়েদ মল্লিক খুন হয়েছে?
অনু মাথা নাড়লো, শুনেছি।
বুঝতে পারছ, জায়েদকে কে খুন করেছে?
অনু কথা বলল না। তার চোখে ভাসছে সেই রাতে কলাপসিবল গেটের সামনে ওয়াসিমের হাতের কাটা বীভৎস আঙুলগুলো।
রাতে দীর্ঘসময় অয়নের খাটটাতে একা বসে রইল অনু। এই ঘরে অয়ন নেই, মা নেই, অথচ ঘরটা দিব্যি রয়ে গেছে। সেই একইরকম ঘর, দরজা, জানালা, বিছানা, বিছানার চাদর। অয়নের টেবিল, টেবিলের ওপর থরে থরে সাজানো বই, সব অবিকল সেই আগের মতোই রয়ে গেছে। কেবল মানুষগুলোই নেই। কী অদ্ভুত, মানুষের জন্যই সব, অথচ মানুষই থাকে না, রয়ে যায় আর সবকিছু!
পরদিন তাকে হাসান ফোন করে বলল, আপনি একদম চুপচাপ হয়ে গেলেন।
বলার মতো কিছু না থাকলে মানুষ চুপচাপই হয়ে যায়।
আমার তো উল্টোটাই মনে হয়। মনে হয়, যাদের বলার থাকে না, তারাই বরং বেশি বলে, আর যাদের অনেক কিছু বলার থাকে, তারা থাকে চুপচাপ।
অনু কথা বলল না। হাসান বলল, আলতাফ ভাইয়ের ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে জানেন?
না তো!
উনি না-কি বছর কয়েক আগে এক মেয়েকে লুকিয়ে বিয়ে করে রেখেছিলেন, সেই খবর বের হয়েছে এখন। এই নিয়ে ঝামেলা। উনার স্ত্রী
অফিসে কমপ্লেইন করেছেন। সম্ভবত উনার জব নিয়েও ঝামেলা হবে।
অনু এই বিষয়ে কোনো আগ্রহ দেখালো না। সে বিরস কণ্ঠে বলল, আমার একা থাকার একটা বাসা দরকার। কিন্তু এ শহরে মেয়েদের একা বাসা পাওয়া না-কি নিষিদ্ধ। কী করি বলুন তো?
বিয়ে করে ফেলুন।
ঘর ভাড়া পেতে বিয়ে করতে হবে, কী বিশ্রি না বিষয়টা?
বিশ্রী কেন হবে? ঘর মানেই তো সংসার, পরিবার। আর পরিবারের জন্য বিয়েটা সবচেয়ে বেশি দরকার।
ঘর মানেই সংসার? সংসার বা পরিবার ছাড়া ঘর হয় না?
হয়, কিন্তু তা অনেকটা মেস বাসার মতো। সেখানে থাকা যায়, কিন্তু তাকে ঘর বলা যায় না। থাকার জায়গা অনেক হতে পারে। কিন্তু ঘর তো একটাই।
তার মানে একা মানুষের জন্য ঘর নেই?
দিন শেষে যেখানে মানুষের বারবার ফিরে আসতে ইচ্ছে হয়, সেটাই ঘর। এখন একটা দরজা, জানালা, দেয়াল কিংবা ছাদের জন্য তো আর মানুষের ফিরে আসতে ইচ্ছে হয় না। মানুষের ফিরে আসতে ইচ্ছে হয় মানুষের জন্য। ঘরে যদি মানুষই না থাকল, তাহলে সেখানে তো মানুষের ফিরে আসার ইচ্ছেটাই থাকে না। আর যেখানে ফিরে আসতে ইচ্ছে হয় না, সেটা ঘর হয় কী করে!
কথাটা খুব ভাবালো অনুকে। একটা ঘর! এই ঘর কী অদ্ভুত এক শব্দ। কোথায় যেন স্নিগ্ধ, মিহি একটা মায়া লেগে আছে। এই যে ঘর, এই ঘরটায় সেই মায়া লেগেছিল। ওখানে অয়ন থাকত, এখানে বিছানার পাশে মা। ওই। পাশের ঘরটায় তনু, হাফসা। অনু যেখানেই থাকত, জানতো, মা তার অপেক্ষায়। আছে। ওখানে দরজাটা খুলতেই অয়নের বিছানাটা, এখানে মায়ের। এখনো। তেমনই আছে সব, কেবল মা নেই, অয়ন নেই। বুকের ভেতরটা কেমন করে। অনু অবশ্য কেমন করে ওঠার আগেই চাপা দিয়ে রাখে। কিন্তু হাসান তো ভুল। কিছু বলেনি। এই যে ঘর, এই ঘরে তো তার আর ফিরে আসতে ইচ্ছে হয় না। এখনো ঘরের কথা ভাবলেই তার মাথায় ভাসে সেই আগের ঘরখানা। অথচ দুটো একই ঘর। সেই একই দরজা, দরজার খিল, বিছানা, বালিশ। কিন্তু এখানে তার আর ফিরে আসতে ইচ্ছে হয় না। এই ঘরখানা যেন ঘর নয়, এ যেন আসলেই কেবলই থাকার জায়গা।
অনু এতদিন চাকরি খোঁজা নিয়ে খুব তটস্থ ছিল। কিন্তু এখন একটা থাকার জায়গা হয়ে গেল তার আসল দুশ্চিন্তা। সে পরদিন আজিজুল মিয়ার কাছে গিয়ে বলল, আমাকে কী আরেকটা মাস সময় দেয়া যায়?
আজিজুল মিয়া চিন্তিত মুখে বললেন, তোমার ভাবিকে ম্যানেজ করতে হবে। সে ওয়াসিমের বিষয়টা নিয়ে খুব চিন্তিত। জায়েদকে খুনের সন্দেহে পুলিশ তাকে খুঁজছে, এই জন্য আপাতত কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে আছে সে। তোমার ভাবি চাইছিল, এই সময়টাতেই যদি বিষয়টা চুকে যেত!
রাতভর ঘুম হয় না অনুর। কী সব এলোমেলো ভাবনা সারাক্ষণ মাথার ভেতর ঘুরতে থাকে। সবচেয়ে বাজে যেটা হয় সেটা হলো প্রায়ই ঘুমের ঘোরে সে ডান হাত বাড়িয়ে মাকে ধরতে চায়। আর ঠিক সেই মুহূর্তে তার খেয়াল হয়, মা নেই! একটা বিশ্রী কাঁপুনি দিয়ে ঘুমটা ভেঙে যায় তখন। তারপর বাকি রাত। আর ঘুম হয় না। মার সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে হয় তখন। অয়নের সাথেও। আচ্ছা, অয়ন আর মায়ের কী এখন কথা হয়? অনুর মাঝেমধ্যে মরেও যেতে। ইচ্ছে হয়। ইচ্ছে হয় মা আর অয়নের পাশে শুয়ে থাকতে। সে কোনো কথা। বলবে না, কেবল শুনবে, দেখবে, মা আর অয়ন কী করে!
সেদিন মাঝরাতে ঘুম ভাঙতেই উঠে ধীর পায়ে অয়নের ঘরটাতে গেল সে। অনু আচমকা মনে হলো অয়ন খাটে শুয়ে আছে। প্রথম ভাবলো, সে ভুল ভাবছে, কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হলো, ঘটনা সত্যি। কিন্তু অয়নের খাটের কাছে যেতে সাহস হলো না অনুর। অয়ন আছে, এই অনুভূতিটা যদি তখন না থাকে!
অন্ধকারে দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে রইল অনু। বাইরে তারস্বরে কুকুর ডাকছে। আজকাল এই বিষয়টা খুব খেয়াল করছে অনু, রাতের একটা নির্দিষ্ট সময় পাড়ার সব কুকুরগুলো যেন একসাথে ডাকতে শুরু করে। এর কোনো কারণ আছে কি-না কে জানে। কিন্তু অনুর কারণগুলো জানতে খুব ইচ্ছে করে।
ভোরে আজিজুল মিয়া এলেন। তিনি এসে চুপিচুপি বললেন, শোন, তোমার ভাবির কাছে বলবে না যে তুমি এখনো অন্য কোথাও বাসা পাওনি। বলবে যে বাসা পেয়ে গেছ। কিন্তু উঠতে মাসখানেক সময় লাগবে। বুঝেছ?
অনু বলল, না, বুঝিনি।
আজিজুল মিয়া বললেন, বুঝতে হবে না। এই মাসের মধ্যে চাকরির ব্যবস্থা করো। চাকরির ব্যবস্থা না করলে সামনে মাসে কই যাবে, আমি জানি না।
অনুর অবশ্য সেই মাসেও চাকরি হলো না। মাসের শেষের দিকে আজিজুল মিয়া আবার এলনে, আর ছয়দিন আছে, সে খেয়াল আছে?
অনু বলল, আছে।
বাসা জুটেছে? চাকরির কী হলো?
অনু ম্লান হেসে বলল, কিছুই হলো না।
কিছু না হলে কেমনে হবে? এই মাসে বাসা না ছাড়লে কিন্তু তোমার ভাবি আমাকেসহ বের করে দিবে।
সমস্যা ছোট না বড় অনু জানে না, তবে বাসা ভাড়া পাওয়াটা তার জন্য বড় একটা সমস্যা হয়েই দেখা দিলো। আজিজুল মিয়া অবশ্য মাসের ঊনত্রিশ তারিখে আবার এলেন। বললেন, টেনশনের কিছু নেই। আমি আসলে তোমার ভাবিকে আরো দুইমাসের কথাই বলেছিলাম, জানি তো হুটহাট বাসাভাড়া যেমন পাওয়া যায় না, তেমনি চাকরিও পাওয়া যায় না। কিন্তু তোমাকে বলেছিলাম এক মাস, যাতে তুমি একটু সিরিয়াসলি খোঁজো। টেনশন নিয়ো না, ব্যবস্থা একটা হয়েই যাবে।
অনুর মনে হলো, সারাক্ষণ চোখের সামনে থেকেও একদম অলক্ষে রয়ে যাওয়া এই মানুষটার কোথায় যেন তার জন্য খানিকটা বিশুদ্ধ মায়া লেগে আছে। কিন্তু সেই মায়া বা মানুষ, কোনোটাকেই সে আগে কখনো খেয়াল করে দেখেনি।
বহুকাল পরে হাসানের সেই কথাটা মনে হলো অনুর। হাসান তাকে ঠিক এই কথাটিই একদিন বলেছিল। জীবন জুড়ে অনুর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা, যে অজস্র দুঃসহ স্মৃতি, তা তাকে ধীরে ধীরে এমন একটা মানুষে পরিণত করেছে যে এখন আর সত্যিকারের ভালোবাসা পুষে রাখা মানুষটাকেও সে চিনতে পারে না।
*
অনেকদিন বাদে তোহার সাথে দেখা হয়ে গেল অনুর। সে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল মহাখালি রেলগেট, এই সময়ে তোহা তার সামনে গাড়ি থামালেন। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললেন, কোথায় যাবেন?
অনু বলল, বাসার দিকেই যাব।
যা ভিড়, বাস কখন পাবেন তার ঠিক নেই, আমার সাথে আসুন, আমি অনেকটা দূর এগিয়ে দিতে পারব।
অনু হেসে বলল, বাস পেয়ে যাব ভাইয়া, আপনি ভাববেন না।
আমি কম ভাবি অনু। ভাবলে কতকিছু করাই যে আটকে যেত, আপনি আসুন। কিছু কথাও ছিল।
অনু কী মনে করে গাড়িতে উঠল। তোহা বলল, চাকরির কিছু হলো?
হয়ে যাবে।
আমাকে বলতে ভয় পাচ্ছেন? ভয় পাবো কেন?
হয়তো ভাবছেন, জোর করে একটা চাকরি দিয়ে দেব। তোহা হাসলেন, এই যে অদিতির কারণে আপনি জবটা ছেড়ে দিলেন। এটা কিন্তু আপনার সাথে গেল না।
কেন?
কারণ, আপনি তো জানেনই যে মানুষ জীবনভরই আপনাকে নিয়ে নানাকিছু বলবে, নানান কিছু ভাববে। আপনি চাইলেও মানুষের সেই ভাবনা বদলাতে পারবেন না। পারবেন?
অনু জবাব দিলো না। তোহা বললেন, আপনি তো জানেনই তাদের ভাবনাটা ঠিক নয়। সো এত গুরুত্ব দেয়ার তো কিছু নেই!
অনু হাসলো, চাইলেই কি সবকিছু ইগনোর করা যায়?
তা যায় না, কিন্তু আমাদের নিজেদের ভালো-মন্দটা শেষ পর্যন্ত আমাদেরই দেখতে হয়, অন্য কেউ দেখে দেয় না।
হুম, তা ঠিক।
একটা কথা বলি?
জি, ভাইয়া।
আমি আপনাকে বলতে ঠিক কমফোর্ট ফিল করছিলাম না বলেই বলা হয়নি। আপনি চাইলে আমি আপনার জন্য অন্য কোনো একটা জবের ব্যবস্থা করতে পারি। অদিতি জানবে না।
অনু হাসলো, আমি চেষ্টা করছি, একদম নিরুপায় হলে বলব।
তোহা খানিকটা ইতস্তত করে বললেন, আপনাকে নিয়ে আমি এত কনসার্ন কেন, নিশ্চয়ই এটা ভাবছেন?
অনু কথা বলল না। তোহা বললেন, সেটাই স্বাভাবিক। আপনাকে বলতে চাইনি, আজ বলছি। আমার আর অদিতির বিয়ের পরপরই আপনার সাথে একবার আমাদের দেখা হয়েছিল, তো সেদিন বাসায় ফিরে অদিতি আপনার অনেক গল্প করলো আমার কাছে। আপনার স্ট্রাগলের গল্প, পরিবারের গল্প, নানান কিছু। সেদিন আমার মনে হচ্ছিল, আমি যদি আপনার জন্য কিছু করতে পারতাম, এমন হয় না আমাদের? অনেকের জন্য একটা চমৎকার অনুভূতি হয়। এটা আসলে এক ধরনের সমীহ থেকে। আপনার প্রতি সেই সমীহটা আমার আছে অনু। কিন্তু তখন আমার সামর্থ্য ছিল না, এখন আমার সেই সামর্থ্যটা আছে, অথচ দেখেন…।
ইচ্ছেটা কিন্তু অনেক বড় ব্যাপার ভাইয়া। করার ইচ্ছেটাও এক ধরনের করাই। এমনিতেও আমি আপনার প্রতি নানাভাবে কৃতজ্ঞই।
এটা কৃতজ্ঞতা-অকৃতজ্ঞতার ব্যাপার নয় অনু, এটা এক ধরনের দায়।
অনু হাসলো, দায় হলে বিপদ, এমন কতজনের দায় আপনি কাঁধে নেবেন?
তোহা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, সব দায় কী আমাদের দায় মনে হয়, অনু? হয় না। কারো জন্য হয়তো অনুভূতিটা একটু আলাদা হয়। আপনার প্রতি সেটা আমার আছে। তবে এই অনুভূতিটা আপনার প্রতি এক ধরনেরও প্রবল শ্রদ্ধাবোধও।
.
অনু বাসার গেটের কাছে এসে থমকে গেলা, আজিজুল মিয়া ভয়ার্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। অনুকে দেখেই ছুটে এসে বললেন, এতক্ষণে এলে?
কেন, কী হয়েছে?
বাড়িতে পুলিশ এসেছে।
পুলিশ! পুলিশ কেন? অনু যেন আকাশ থেকে পড়লো।
তোমার সাথে কথা বলতে চায়!
অনু হতভম্ব গলায় বলল, আমার সাথে? আমার সাথে পুলিশের কী কথা!
মনে হয় জায়েদের খুনের বিষয়ে কথা বলতে চায়।
অনু সত্যি সত্যি ভড়কে গেছে। সে বলল, জায়েদের খুনের ব্যাপারে আমার সাথে কী কথা!
তা তো আমি জানি না, তোমার ভাবি আমার উপর রেগে আগুন। তার ধারণা আমার জন্যই এসব হচ্ছে, আমার কারণেই তোমাকে এখনো এখানে থাকতে দেয়া হচ্ছে।
অনু নিজেকে খানিকটা ধাতস্ত করে নিয়ে বলল, ওনারা এখন কোথায়?
আমার বাসায়।
অনুকে পুলিশের সাথে থানায় যেতে হলো। স্ত্রীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে হলেও আজিজুল মিয়া গেলেন অনুর সাথে। পুলিশ অফিসারের নাম ফোরকান আলী। ফোরকান আলীর মাথার চুল ছোট করে ছাটা। চিমসানো মুখে হালকা দাড়ি। চেহারার সাথে বেমানান ভূরি। তবে সে পুলিশ অফিসার হিসেবে যথেষ্টই বিনয়ী ও হাসিখুশি। সে বলল, ওয়াসিমের সাথে আপনার সম্পর্ক কতদিনের?
অনু বলল, ওনার সাথে আমার সম্পর্ক থাকবে কেন?
সম্পর্ক মানেই বিশেষ কিছু না। চেনাজানাও তো একটা সম্পর্ক। সেই চেনাজানার সম্পর্ক কতদিনের?
বছর তিনেক।
কীভাবে হলো চেনাজানাটা?
অয়নের মাধ্যমে।
অয়ন কে?
অয়ন আমার ছোট ভাই।
সে কোথায়?
নেই, মারা গেছে।
কীভাবে?
ক্যান্সার হয়েছিল।
ফোরকান আলী কিছুক্ষণ আফসোসের ভঙ্গি করলেন। তারপর বললেন, তার সাথে ওয়াসিমের পরিচয় কীভাবে?
ওনার একটা কোচিং সেন্টার ছিল, সেখানে অয়ন পড়ত।
পড়তে গিয়ে পরিচয়, না পরিচয়ের সূত্র ধরে পড়তে যাওয়া?
অনুর ভয়ের চেয়ে বিরক্ত লাগছিল বেশি। সে বলল, দুটো একই সাথে।
একই সাথে মানে? ঘটনা কী খুলে বলা যাবে?
অনু বলল, যাবে। অয়ন তখন কেবল ক্লাস টেনে উঠেছে। তাকে তখন কোচিং বা প্রাইভেট টিউশন দেয়ার মতো অবস্থা আমাদের নেই। সেই সময়ে একদিন সন্ধ্যাবেলা বাসায় এসে অয়ন বলল, আমাদের পাশের বাসার ওয়াসিম ভাই নামে একজন তাকে তার কোচিংয়ে বিনা টাকায়ই ভর্তি করিয়ে নিয়েছে। কোচিংয়ের একটা ব্যাগও দিয়েছে ফ্রি, এই নিয়ে সে খুব এক্সাইটেড ছিল।
আপনি ছিলেন না?
আমি কেন থাকব?
না মানে, ওরকম অবস্থায় এমন একটা সুযোগ পাওয়া তো কম কিছু নয়!
নাহ্, আমি বরং কিছুটা সতর্কই ছিলাম।
কেন?
আমার বাবা নেই, বাবা নেই মেয়েদের সতর্ক থাকতে হয়।
তারপর কী হলো?
তারপর আর কী হবে?
দেখুন অনু, একদম এমনি এমনিই তো আর আপনাকে আমরা ডেকে আনিনি। কিছু খোঁজ খবর তো আমরাও নিয়েছি, তাই না? সমস্যা হচ্ছে, অনেক সময় এমন হয় না যে, যা শুনেছি তাতেও অনেক ফাঁক-ফোকড় থেকে যায়? আপনাকে এইজন্যই ডাকা, আপনার ইনফর্মেশনের সাথে আমাদের ইনফর্মেশনগুলো একটু মিলিয়ে দেখা।
ফোরকান আলী থামলেও অনু কথা বলল না। ফোরকান আলীই আবার বললেন, আপনি হয়তো শুনেছেন যে জায়েদ মল্লিক খুন হয়েছে। পুলিশ সন্দেহ করছে, এতে ওয়াসিমের ইনভলভমেন্ট আছে। কিন্তু পুলিশের কাছে শক্ত কোনো এভিডেন্স নেই। আর ওয়াসিমও লাপাত্তা। এখন আপনার সাথে এই দুইজনেরই একটা ভালো যোগাযোগ ছিল, তাই আপনাকে ডাকা। হয়তো আপনি কোনোভাবে আমাদের হেল্প করতে পারবেন। কারণ, আমরা যদুর জানি, এই দুজনের মধ্যে আপনাকে নিয়েই একটা বড় কনফ্লিক্ট তৈরি হয়েছিল!
অনু কী বলবে বুঝতে পারছে না। তবে এটা বুঝতে পারছে, সে বড় একটা ঝামেলার সাথে জড়িয়ে পড়েছে।
ফোরকান আলী বললেন, ওয়াসিমের মতো একটা মানুষ আপনার ভাইকে বিনা পয়সায় কোচিংয়ে ভর্তি করিয়ে নিলো। আর তার পরপরই আপনার সাথে তার একটা সম্পর্কও তৈরি হয়ে গেল। আপনি তার সম্পর্কে ভালো-মন্দ কিছু খোঁজ খবর নেবেন না? কিছু জানাশোনার চেষ্টা করবেন না?
আপনি বারবার একই কথা বলছেন।
কী?
আমার সাথে ওনার সম্পর্ক নিয়ে। আমি আগেই বলেছি, ওনার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না। ওই চেনাজানাটুকুই। অয়ন আমাকে বলেছিল যে উনি আমাদের পাশের বাসারই। তবে প্রায় বছর দশ বারো আগে মালয়েশিয়া চলে গিয়েছিলেন। দেশে ফিরে এসে কোচিং সেন্টার দিয়েছেন। সাথে নানান ধরনের বিজনেসও।
আপনাদের পাশের বাসার হওয়া সত্ত্বেও আপনি তাকে চিনতেন না?
না, চিনতাম না, হয়তো আগে কখনো খেয়াল করিনি। আমি আমার নিজের জীবন, নিজের ফ্যামিলি নিয়ে নানা ঝামেলায় থাকি। তাছাড়া শুনেছি উনি দীর্ঘদিন দেশের বাইরেও ছিলেন।
উনি যে আগে একাধিক বিয়ে করেছিলেন, একজন স্ত্রী মারাও গেছিলেন, সে বিষয়ে কিছু জানতেন? মানে লোকটা যে ভায়োলেন্ট, সেটা জানতেন কি না?
ওটা পরে শুনেছি। অয়নের সাথে পরিচয়ের পর থেকে উনি হুটহাট আমাদের বাসায় চলে আসতেন। বিষয়টা আমার পছন্দ ছিল না। মা, আমি তাকে নানাভাবে বারণও করেছিলাম, কিন্তু উনি শোনেননি।
শুনতেন না কেন?
আপনার তো জানার কথা যে, উনি খুবই প্রভাবশালী। এলাকায় ওনার ইনফ্লুয়েন্সও খুব। তো আমরা তাকে ভয়ও পেতাম। একদিন আমাদের নিচতলার ভাড়াটিয়া আপু আমাকে ডেকে সতর্ক করে দিলেন। তিনি বললেন, এই লোক কিন্তু ভয়ংকর খারাপ লোক। যতটা পারো এর থেকে দূরে থাকো। মেয়েদের দেখলেই ছোঁকছোঁক স্বভাব, আর এর আগে একাধিক বিয়েও করেছিলেন। প্রথম বউকে জোর করে তুলে এনে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু সে বউ শেষ অব্দি থাকেনি। আর দ্বিতীয় স্ত্রী আত্মহত্যা করেছিল।
কীভাবে আত্মহত্যা করেছিল?
শুনেছি ফ্যানের সাথে গলায় ফাঁস লাগিয়ে।
ফোরকান আলী পকেট থেকে ম্যাচের কাঠি বের করলেন। তারপর চোখ বন্ধ করে কান খোঁচাতে খোঁচাতে বললেন, এটা শোনেননি যে উনার স্ত্রীর মাথায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল?
সেটা জানি না, তবে আপু বলেছিলেন যে পুলিশ সন্দেহ করেছিল ওটা সুইসাইড ছিল না, খুন ছিল।
হুম, তার বিরুদ্ধে খুনের মামলাও হয়েছিল। কিন্তু তার আগেই সে পালিয়ে মালয়েশিয়া চলে যায়।
জি।
ফোরকান আলী অনেকক্ষণ আর কোনো কথা বললেন না। চোখ বন্ধ করে আরাম করে কান খোঁচাতে থাকলেন তিনি। তারপর দীর্ঘসময় পর কান থেকে বের করা কাঠিটা নাকের সামনে নিয়ে ঘ্রাণ নিলেন। দৃশ্যটা দেখে বমি পেয়ে গেল অনুর। কিন্তু যতটা সম্ভব ভাবলেশহীন হয়ে বসে রইল সে।
ওয়াসিম আপনাকে রেপ করেছিল কেন? মানে কীভাবে, ঘটনাটা জানতে চাই?
মানে! ফোরকান আলী প্রশ্ন শুনে অনু রীতিমত চমকে উঠল।
মানে, আমরা যদুর জানি ওয়াসিম আপনাকে রেপ করেছিল। যদিও অনেকে বলেন, ঘটনাটা মিউঁচুয়াল ছিল। কিন্তু আপনি ওয়াসিমকে ফাঁসাতে এটা বলেছিলেন। ঘটনাটা শুনতে চাই।
অনু কিছু বলতে যাবে, এই মুহূর্তে ফোরকান আলীর টেবিলের কোণে রাখা টেলিফোনটা বেজে উঠল। তিনি হন্তদন্ত হয়ে টেলিফোনটা ধরলেন। কিছুক্ষণ নৈর্ব্যক্তিক কথাবার্তা হলো ওপারের মানুষটির সাথে। তারপর ফোন রেখেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আমাকে এখুনি জরুরি একটা কাজে বের হতে হবে। আমি আপনাকে আবার ডাকবো। আপনার কাছ থেকে পূর্ণ সহযোগিতা আশা করছি অনু।
*
অনু ভেবেছিল পরদিনই হয়তো আবার থানা থেকে তাকে ডাকা হবে। তবে পরের এক সপ্তাহে আর তেমন কিছু ঘটলো না। শামীম বা তনুর সাথে এই নিয়ে কোনো কথা না হলেও বিষয়টি নিয়ে সবাই-ই যে কম বেশি আতঙ্কগ্রস্ত তা বোঝা যাচ্ছিল। একদিন সন্ধ্যায় আজিজুল মিয়ার স্ত্রী এলেন বাসায়। অনু ভেবেছিল হয়তো খুব কড়া বা আজেবাজে কোনো কথা শোনাবেন তিনি। তবে তেমন কিছুই হলো না। অনুর হাতে কেবল গত মাসের ভাড়া আর ইলেক্ট্রিক বিলের কাগজটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আমাদের দিকে একটু ভেবো অনু, বড় বিপদে আছি আমরা। তুমি বাসাটা ছেড়ে দিলে খুব উপকার হয়।
অনুর নতুন বাসা পাওয়ার অপেক্ষায় আছে তনু আর শামীমও। অনুর থাকার একটা ব্যবস্থা হলেই তারা চলে যবে। শামীমের সাথে আজকাল অনুর কথা হয় না, দেখাও হয় না। সেদিন হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। অনু বসেছিল অয়নের খাটে। তার সামনের টেবিলে এখনো অয়নের বই খাতা সারিসারি সাজানো। শামীম ঘরে ঢুকেই অনুকে দেখে সালাম দিয়ে বলল, বাসা পেলেন আপু?
এখনো পাইনি।
তাহলে?
ভাবছি হোস্টেলে উঠে যাব।
হোস্টেল? কিসের হোস্টেল?
ঢাকায় প্রচুর মহিলা কর্মজীবী হোস্টেল আছে।
শামীম একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, হোস্টেলে কেন যাবে আপু? আপনি বরং আমাদের সাথেই চলুন। তনু অবশ্য বলছিল, আপনি ওখানে হয়তো কমফোর্ট ফিল করবেন না। এইজন্য আমিও কিছু বলতে সাহস পাইনি।
অনু হাসলো, সমস্যা নেই শামীম, একটা না একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে।
আপু আরেকটা কথা।
হ্যাঁ বলো?
হাফসার জন্মদিন তো সামনেই। ভাবছি এবার জন্মদিনটা একটু ভালোভাবে পালন করব। আগে তো কখনো সেভাবে করতে পারিনি।
আচ্ছা, তোমার বিজনেস ভালো যাচ্ছে?
আলহামদুলিল্লাহ ভালো আপু, এতটা ভালো আশা করিনি।
তুমি কিন্তু আমাকে চমকে দিয়েছ শামীম। আমি একদম ভাবিনি, বরং ভয়েই ছিলাম।
শামীম হাসলো, পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই আপু। তাছাড়া আপনার দোয়াও তো আছে।
হাফসার জন্মদিন পালনের জন্য শামীম কতগুলো রেস্টুরেন্টের নাম বলল। অনু মৃদু হেসে বলল, আমি তো এইসব রেস্টুরেন্ট সম্পর্কে জানি না শামীম। তুমিই খোঁজ নাও। খোঁজ নিয়ে দেখো, কোথায় ভালো হয়।
শামীম বলল, আচ্ছা আপু।
.
অনুকে থানা থেকে ডাকা হলো তার পরদিন। ফোরকান আলী কোনো ভূমিকা না করে সরাসরি বললেন, রেপের ঘটনাটা বলুন, আপনি কেন পুলিশের কাছে না এসে অভিযোগটা জায়েদ মল্লিকের কাছে করলেন?
অনু জবাব দেয়ার আগে দীর্ঘক্ষণ চুপ করে রইল। ফোরকান আলী আবার বললেন, পুলিশের কাছে কিছু লুকাবেন না প্লিজ। আপনাকে একটা কথা বলি, জায়েদ মল্লিকের খুন খুবই বড় একটা ইস্যু। আমরা এতদিন ইনভেস্টিগেশন করেছি। এই ঘটনার সাথে অনেক কিছুই ইনভলভড, আপনিও। আমরা চাই না, এ নিয়ে আপনি কোনো বিপদে পড়েন। তবে আমরা আপনার কাছ থেকে সত্যিটা জানতে চাই।
রেপের ঘটনা সত্যি না।
সত্যি না?
না।
তাহলে আপনি জায়েদ মল্লিকের কাছে ওয়াসিমের বিরুদ্ধে রেপের অভিযোগ কেন করেছিলেন?
আমি রেপের অভিযোগ করিনি। কারণ এই ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
কিন্তু আমাদের কাছে তথ্য আছে, আর তাতে এমনটাই আছে। আপনাকে আপনার বাসায়ই একা পেয়ে ওয়াসিম রেপ করে। আর সেই অভিযোগ আপনি করেছিলেন জায়েদ মল্লিকের কাছে। জায়েদ মল্লিক তখন পাওয়ারফুল ছাত্র নেতা। দল ক্ষমতায়। তিনি আপনার অভিযোগের কারণেই ওয়াসিমের সাথে কনফ্লিক্টে যান?
রেপের ব্যাপারটা সত্যি না এবং আমি এমন অভিযোগও করিনি।
দেখুন অনু, পুলিশের কাছে এসে লজ্জায় কিছু লুকিয়ে রাখা, অনেকটা ডাক্তারের কাছে গিয়ে রোগ লুকিয়ে রাখার মতো ব্যাপার। এতে রোগ না সেরে বরং বাড়বে।
আমি কিছু লুকাচ্ছি না। তাছাড়া…।
তাছাড়া কী?
তাছাড়া কেউ রেপড হলে, সেটি তার জন্য লজ্জার কিছু হওয়ার কথা না, লজ্জার হওয়ার কথা রেপিস্টের জন্য।
ফোরকান আলী হাসলেন, ওসব তত্ত্বের কথা বাদ দিন। আপনিও জানেন, আমিও জানি, বাস্তবতা ভিন্ন। রেপিস্ট বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়, আর ভিকটিম লজ্জায় সুইসাইড করে বা মুখ দেখাতে পারে না, তাই না?
অনু কথা বলল না। ফোরকান আলী বললেন, আপনি যদি রেপডই না হবেন, তাহলে এমন কথা রটলো কেন? কিছু না কিছু নিশ্চয়ই ঘটেছিল, সেটা কী?
অনু বুঝতে পারছে, যতই অস্বস্তিকর হোক, তাকে পুরো ঘটনাই খুলে বলতে হবে। সে বলল, ওয়াসিমের কোচিং সেন্টার নিয়ে অনেক আজেবাজে কথা শোনা যেত, জানেন বোধহয়?
কী কথা?
এই যে তার কোচিং সেন্টারটা আসলে একটা আই ওয়াশ ছিল, এমনকি অন্যান্য বিজনেসও। উনি আসলে এসবের আড়ালে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিগুলোতে ইয়াবা সাপ্লাই দিতেন, নানান ড্রাগস বিক্রি করতেন?
আচ্ছা?
তাছাড়া নিচতলার আপুর কাছ থেকে ওনার সম্পর্কে ওসব শোনার পর থেকে আমার খুব ভয়ও হতে লাগল। আমি তখন হঠাৎ একদিন অয়নের কোচিংয়ে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। সমস্যাটা সেই থেকে তৈরি। উনি এরপর যখন তখন যেখানে সেখানে পথ আটকাতেন। জানতে চাইতেন অয়নের কোচিং কেন বন্ধ করে দিলাম। নিশ্চয়ই লোকজনের কাছ থেকে ওনার সম্পর্কে অনেক আজেবাজে কথা শুনেছি, সেসব আমাকে বিশ্বাস করতে নিষেধ করলেন।
আপনি কী বললেন?
আমি কিছু বলিনি। কিন্তু অয়নকে আর কোচিংয়ে দেইনি। এরমধ্যে একদিন সন্ধ্যায় উনি আমাকে বাসার সামনে পথ আটকালেন। বললেন, আমার নামেও উনি না-কি কীসব আজেবাজে কথা শুনেছেন। কিন্তু সে সব কথা তো উনি বিশ্বাস করেন না। তাহলে আমি কেন তার নামে শোনা কথা বিশ্বাস করি?
আপনার নামে কি আজেবাজে কথা শুনতেন?
অনু এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে সামান্য থমকালো। তারপর বলল, আমি যখন অনেক ছোেট তখন আমার বাবা মারা যান। আমার ছোট আরো দুই বোন আর ভাই অয়ন। তো অনেক বছর থেকেই ওদের পড়াশোনা, পরিবারের সকল রেসপিন্সিবিলিটি সবকিছু আমাকেই দেখতে হয়। দিনরাত খাটতে হতে, সকাল সন্ধ্যা পরিশ্রম করতে হতো। এমনও হয়েছে সারাদিন অফিস শেষ করে রাতে এসে আবার টিউশন করিয়েছি। বাসায় ফিরতে ফিরতেও অনেক রাত হয়ে যেত। তো উনি খুব বাজে ইঙ্গিত করে বললেন, আমি কীভাবে কী করি, কী করে সংসার চালাই, কীভাবে টাকা উপার্জন করি, এসব উনি জানেন। চাইলে ওনার কাছ থেকেও আমি টাকা নিতে পারি!
আচ্ছা, তো সেদিন সন্ধ্যায় আসলে কী ঘটেছিল?
বলছি, তো এরপর থেকে ওনার যন্ত্রণা বাড়তেই থাকল। সেদিন সন্ধ্যায় আমি বাসায় একা। অয়ন আর মা মামার বাসায় গিয়েছিল বিকেলে। কলিংবেলের শব্দ শুনে আমি ভাবলাম ওরা বোধহয় চলে এসেছে। কিন্তু দরজা খুলতেই দেখি ওয়াসিম দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। আমাকে দেখেই বললেন, বাসায় তো কেউ নাই, আপনি একা, তাই সঙ্গ দিতে এলাম।
ওয়াসিম কী করে জানলো যে আপনি বাসায় একা?
অয়ন গলির মুখে সিএনজি আনতে গিয়েছিল, তখন তার কাছ থেকে শুনেছে যে ও আর মা মামার বাসায় যাবে, ফিরতে রাত হবে। অয়ন তখন কেবল ক্লাস টেন-এ পড়ে। অতকিছু বোঝেওনি। ওনাকে দেখে আমি খুবই ভয় পেয়ে গেলাম। দু’হাতে দরজা আগলে দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু উনি এক পা বাড়িয়ে দিয়ে দরজার পাল্লা আটকে দিলেন।
তারপর?
আমি বুঝতে পারছিলাম, আমাকে শান্ত থাকতে হবে। মা আসা অব্দি যতটা সম্ভব সময় কাটাতে হবে। আমি ওনাকে খুব স্বাভাবিকভাবেই ড্রইংরুমে বসিয়ে রান্না ঘরে চা বানাতে গেলাম। আমি চেষ্টা করছিলাম সময় নষ্ট করতে। কিন্তু এটা উনি আঁচ করতে পেরেছিলেন। আচমকা রান্না ঘরে গিয়ে আমাকে জাপটে ধরলেন। উনি ভেবেছিলেন আমি চিৎকার চেঁচামেচি কিছু করব। কিন্তু আমি তেমন কিছুই করলাম না।
কেন?
কারণ বাইরে তখন কোনো বাড়িতে প্রচণ্ড শব্দে মাইক বাজছিল। আর আমি জানতাম উনার সাথে শারীরিক শক্তিতে আমি পারব না। ফলে ধস্তাধস্তি করে লাভ নেই। অন্য কোনো উপায় খুঁজে বের করতে হবে। আমি যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছিলাম। আমি ওনাকে খুব স্বাভাবিকভাবে বললাম, আপনি ড্রইংরুমে গিয়ে বসুন, আমি আসছি।
উনি শুনলেন?
নাহ্। উনি আমাকে টেনে হিঁচড়ে ড্রইংরুমে নিয়ে গেলেন। তবে আমার আচরণে উনি কিছুটা কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলেন। উনি ভেবেছিলেন, আমি উনার সাথে শক্তি খাটাবো, ধস্তাধস্তি করব। কিন্তু আমি সেসব কিছু না করায় উনি বেশ কনফিউজড ছিলেন। আমাকে ধাক্কা দিয়ে ড্রইং রুমের বিছানাটায় ফেলে দিলেন। হঠাৎ টেবিলের কোণায় লেগে আমার কপাল অনেকটাই কেটে গেল। আমার মুখ, কপাল, সাদা বিছানার চাদর রক্তে মাখামাখি হয়ে যাওয়ায় উনি কিছুটা ভড়কে গেলেন।
তারপর?
আমি সেন্সলেসের মতো পড়ে রইলাম, উনি অনেকবার ডাকলেন। কিন্তু আমি সাড়া দিলাম না। আমি আসলে তখনো চাইছিলাম, যতটা সম্ভব সময় কাটিয়ে দিতে, যদি এর মধ্যে মার আর অয়ন ফিরে আসে। কিন্তু ততক্ষণে তিনি অধৈর্য আর হিংস্র হয়ে উঠতে শুরু করলেন। ওই অবস্থায়ই আমাকে তুলে বসালেন, তারপর মুখে আঘাত করতে করতে বললেন, ভান করে লাভ নেই, এইটুকুতে কিছু হয় না। কিন্তু আমার মুখের একপাশটা তখন রক্তে মাখামাখি হয়ে ঢেকে গেছে। দেখতে বীভৎস লাগছিল। উনি চাইছিলেন আগে পানি দিয়ে আমার মুখটা ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে। কিন্তু টেবিলের জগে পানি ছিল না বলে পানির জন্য উনাকে যেতে হলো রান্না ঘরে।
এই সুযোগে আপনি বের হয়ে গেলেন?
নাহ্, এটা ওনার মাথায়ও ছিল। উনি আমাকে একহাতে ধরে রান্নাঘরের দরজায় নিয়ে দাঁড় করালেন। আরেক হাতে কল থেকে জগে পানি ঢালতে লাগলেন। রান্না ঘরের দরজার সাথেই আমার ঘরের দরজা। উনি সম্ভবত ভাবছিলেন আমি সুযোগ পেলে দৌড়ে বাইরে চলে যাব, এইজন্য উনি এটা নিয়ে খুৰ সতর্ক ছিলেন, সুযোগটা আমি নিলাম। আমি আচমকা উনার হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে আমার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। শুধু যে ঘরের দরজা বন্ধু করলাম তা না, আমি এরপর বাথরুমে ঢুকে বাথরুমের দরজাটাও বন্ধ করে দিলাম। তারপর পানিভর্তি ড্রামটা টেনে এনে সেটা দিয়েও দরজা আটকে দিলাম। আমি জানতাম, উনি দুটো দরজা ভাঙার চেষ্টা করলেও ততক্ষণে আমার হাতে অনেক সময় থাকবে। এর মধ্যে মা আর অয়ন হয়তো চলে আসবে।
ফোরকান আলী যেন খানিকটা নড়েচড়ে বসলেন। সাধারণ চেহারার সাদাসিধে এই মেয়েটার কাছ থেকে তিনি সম্ভবত এমন একটা ঘটনা আশা করেননি। তিনি বললেন, ওয়াসিম দরজা ভাঙার চেষ্টা করেনি?
না করেনি। তবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নানান ভয় ভীতি দেখালেন। তারপর চলে গেলেন।
ফোরকান আলী পানির জগটা অনুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, চা খাবেন?
আমি চা খাই না।
আচ্ছা, অন্য কিছু?
অনু মাথা নেড়ে না বলল। ফোরকান আলী বললেন, কিন্তু জায়েদের কাছে আপনি তাহলে রেপের অভিযোগ কেন করলেন? আর পুলিশের কাছেই বা কেন এলেন না?
অনু প্রায় এক ঢোকে একগ্লাস পানি খেয়ে ফেলল। তারপর দম নিয়ে বলল, জায়েদের কাছে আমি রেপের অভিযোগ করিনি। ওকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। বয়সে ছোট হলেও ওর তখন খুব একটা ভালো পলিটিক্যাল ইনভলভমেন্ট ছিল। দেখা হলে ভীষণ ভদ্র ব্যবহার করত। মানে ওর প্রতি আমার একটা আস্থার জায়গা তৈরি হয়েছিল। মনে হয়েছিল, বিপদে পড়লে ওকে বললে হয়তো একটা হেল্প-টেল্প পাওয়া যাবে। আর সেই সন্ধ্যার ঘটনার পর ওয়াসিম রীতিমত হিংস্র হয়ে উঠল। সে যেখানে সেখানে ভয় ভীতি দেখানো শুরু করলো, নানান নম্বর থেকে ফোনে আজেবাজে মেসেজ দিত। হুমকি দিত। আরো অনেক বাজে বাজে ব্যাপার ছিল, অসহনীয়। থানা পুলিশের অভিজ্ঞতা আমার কখনো ছিল না। আমি জাস্ট ভাবলাম বিষয়টি জায়েদকে জানিয়ে রাখি। এতে হয়তো একটু হলেও এই যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাবো। এইজন্যই তাকে বলা। আমি রেপের অভিযোগ করিনি। কিন্তু কথাটা পরে জায়েদই ছড়িয়েছে।
জায়েদই ছড়িয়েছে! কেন? সে তো আপনার উপকারই করেছিল?
অনু ম্লান গলায় বলল, ওটা উপকার ছিল না, বরং ওটা ছিল আমার জন্য একটা ট্র্যাপ। জায়েদ আমাকে বলল পার্টি ক্লাবে একটা অভিযোগ করতে, আমি করলাম। কিন্তু এটাকে সে তার নিজের স্বার্থে ব্যবহার করলো।
কীভাবে?
আমার ধারণা এগুলো আপনি জানেন।
তারপরও বলুন।
জায়েদ আগে থেকেই চাইছিল ওয়াসিম এলাকায় না থাকুক।
কেন?
আমি স্পষ্ট বলতে পারব না, তবে হতে পারে পলিটিক্যাল বা প্রফেশনাল কোনো বিষয়। শুনেছি বিজনেস রিলেটেড বিষয়-টিসয়ও ছিল।
হুম, নানান ধরনের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আগে থেকেই দুজনের মধ্যে একটা ঝামেলা ছিল। কিন্তু তাতে আপনার ঘটনার সম্পর্ক কী? এমন তো না যে ওয়াসিমের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আগে আর ছিল না!
হয়তো ছিল। কিন্তু অনেকদিন পর দেশের বাইরে থাকায় সেসব হয়তো চাপা পড়ে গিয়েছিল। জায়েদ চাইছিল আমার ঘটনাটা রংচং মাখিয়ে প্রচার করে ওয়াসিমকে পলিটিক্যালি কোণঠাসা করে ফেলতে।
ফোরকান আলী আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আচ্ছা, গট ইট। তখন তো কিছুদিন পরই নির্বাচন ছিল, সো ইমেজটা দলের জন্য খুব ইম্পর্ট্যান্ট ছিল। হুম, বলুন।
তো এই নিয়ে তখন দুজনের দ্বন্দ্ব চরমে। ওয়াসিমের লোকজন একবার জায়েদের গায়ে হাত তুললো। বিষয়টা কেউই ভালোভাবে নেয়নি…।
আর এর পরপরই ওয়াসিম একদম গুম হয়ে গেল?
একদম হয়নি, কিছুদিনের জন্য হয়েছিল। পরের নির্বাচনে জায়েদের দল হেরে যাওয়ার পর পরই তো ওয়াসিম আবার ফিরে এলো।
সেদিন এই অব্দিই কথা হলো। আজিজুল মিয়াকে ডেকে ফোরকান আলী বললেন, আপনার স্ত্রী বলছিলেন ওনাকে আপনারা বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিয়ে দিয়েছেন?
জি স্যার।
আপাতত কিছুদিনের জন্য নোটিশ তুলে নিন। আমরা না বলা পর্যন্ত উনি এখানেই থাকুন। ঠিক আছে?
আজিজুল মিয়া মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। অনু উঠে দাঁড়াতেই ফোরকান আলী বললেন, আপনি আরেকটু বসুন।
অনু আবার বসলো। আজিজুল মিয়া ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই ফোরকান আলী বললেন, একটা কথা বলি অনু?
জি?
পুলিশের চাকরি করতে এসে আমরা অনেকটা জড় পদার্থের মতো হয়ে গেছি। পার্সোনাল কোনো অনুভূতি আর কাজ করে না। আপনার কথা শুনে একটা ঘটনার উল্টোপিঠটাও জানা হয়ে গেল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আপনাকে নিয়ে আমরা সন্দেহমুক্ত না।
অনু অবাক গলায় বলল, কিসের সন্দেহ? আমি জায়েদকে খুন করেছি?
না, তেমন কিছু না। তবে বিষয়টা আরো জটিল। আর তাতেও কোনো না। কোনো ভাবে আপনার একটা ভূমিকা আছে।
অনু হতাশ ভঙ্গিতে বলল, আমি যা জানতাম সবই আপনাদের বলেছি।
হয়তো বলেছেন। কিন্তু দিন শেষে আমরা তো পুলিশ। ইনভেস্টিগেশনে সহজে কারো কথা বিশ্বাস হয় না। তাছাড়া আমাদেরও তো কিছু বোঝাবুঝির বিষয় আছে, আছে না?
তা আছে। কিন্তু আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না, এখানে আমার ইনভলভমেন্ট কোথায়?
সেটা আমরাও বুঝতে পারছি না। তবে এই পুরো ঘটনায় আপনার একটা কিছু ইনভলভমেন্ট যে আছে, সে তো আপনি নিজেই আমাদের বললেন, তাই না?
অনু জবাব দিলো না। সে ঘর থেকে বের হওয়ার আগে ফোরকান আলী বললেন, প্রত্যেকটা বড় অপরাধের পেছনে অসংখ্য ছোট অপরাধ লুকিয়ে থাকে। বড় গাছের মাটির তলায় যেমন অসংখ্য শেকড় ছড়িয়ে থাকে তেমন। এই খুনটার পেছনেও তেমনি অনেক ছোট ঘটনা লুকিয়ে আছে।
অনু আর কথা বলল না। বাসায় ফিরে সেই সারাটা সন্ধ্যা, গভীর রাত অব্দি চুপচাপ বসে রইল সে। মাঝরাতে কী মনে করে মায়ের ট্রাঙ্কটা হঠাৎ খুললো। ট্রাঙ্ক খুলতেই ধক করে উঠল অনু বুকের ভেতর, একটা নোটবুক যত্ন করে রাখা। নোটবুকটা অয়নের! সে আলতো হাতে নোট বুকটা ছুঁয়ে দেখলো, অয়নের হাতের ছোঁয়া কী কোথাও লেগে আছে? অনু নোটবুকটা তুলে নিয়ে চুপচাপ বসে রইল। তার নোটবুকটা খুব খুলে দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হচ্ছে যদি সে খুলে দেখে এই নোটবুকটা জুড়ে কেবল সাদা ধবধবে পাতা, কোথাও কিছু লেখা নেই, তাহলে তার চেয়ে এমন বন্ধই থাকুক নোটবুকটার পাতা। সে অন্তত ভেবে নেবে অয়নের না বলা অনেক কথাই এখানে লেখা আছে। অয়ন তার সাথে আছে। কোনো একদিন না একদিন সেই কথাগুলো সে চাইলেই শুনতে পাবে। অয়ন থাকুক তার সাথে।
*
শামীম আর তনু বাসা বদলে ফেলল। পুরো বাড়িতে অনু একদম একা। দু মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি পড়েছে। অনু অবশ্য দুটো টিউশন জুটিয়ে নিয়েছে। তবে বেশিরভাগ সময়ই সে একাই থাকে। সেদিন ঠিক দুপুর বেলা আজিজুল মিয়া এলেন। তার হাতে একটা খাম। তিনি খামটা অনুর হাতে দিয়ে বললেন, তোমার ভাবি খুব খেপে আছে, আজই বাড়ি ভাড়াটা দিয়ে এসো।
অনু খামটা খুললো, খামের ভেতর অনেকগুলো টাকা। আজিজুল মিয়া বললেন, আমার কাছে তো তেমন টাকা-পয়সা থাকে না, এই টাকা কটাই ছিল। এই টাকায় এক মাসের পুরো বাড়ি ভাড়া হবে না, তাও কী আর করা?
আপাতত এইটুক দিয়ে একটা বুঝ দাও। পরেরটা পরে দেখা যাবে।
কিন্তু…।
অনুকে কথা শেষ করতে দিলেন না আজিজুল মিয়া, তিনি অনুর হাত চেপে ধরে বললেন, যখন চাকরি-বাকরি হবে, ফেরত দিয়ে দিও, সাথে চড়া সুদও দিও। হা হা হা।
অনু টাকার খামটা হাতে দাঁড়িয়ে রইল। আজিজুল মিয়া চোরের মতো লুকিয়ে সন্তর্পণে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলেন। অনুর বুকের ভেতর কেমন একটা ব্যথা হচ্ছে। সেই ব্যথাটা বুক থেকে দলা পাকিয়ে গলায় উঠে এসে আটকে রইল। সম্ভবত কান্না পাচ্ছিল অনুর। কিন্তু সে কাঁদলো না। চুপচাপ গিয়ে বিছানায় বসে রইল। তার বালিশের পাশে অয়নের নোটবুকটা। একবার হাত বাড়িয়ে নোট বুকটা ছুঁয়ে দেখলো সে। বুকটা কেমন ঠান্ডা হয়ে আসছে।
.
ফোরকান আলী অনুকে ডাকলেন আরো বেশ কিছুদিন পর। তিনি ডেকে বললেন, আমরা খুবই দুঃখিত আপনাকে বারবার বিরক্ত করতে হচ্ছে বলে। কিন্তু জায়েদের খুনটা একটা পলিটিক্যাল ইস্যু হয়ে উঠছে। প্রশাসনও বিব্রত বোধ করছে। আচ্ছা, ওয়াসিমের সাথে আপনার লাস্ট দেখা হয়েছিল কবে?
অনু সেই রাতে কলাপসিবল গেটের সামনে ওয়াসিমের সাথে তার দেখা হওয়ার ঘটনা খুলে বলল। ফোরকান আলী বললেন, তার মানে সরকার চেঞ্জ হবার পর সে ফিরে এসেও অনেক দিন আপনার সামনে আসেনি?
না। তবে ওই যে বললাম, জানালাটা সবসময় খোলা থাকত।
আচ্ছা। ফোরকান আলী উঠে দাঁড়িয়ে খানিক পায়চারি করে আবার বসে পড়লেন। তারপর বললেন, একটা বিষয়, জায়েদ আপনার এত বড় উপকার করার পরও, তার সাথে আপনার সম্পর্কটা খারাপ হবার কারণ কী? ওয়াসিম হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার পরতো আপনার তাহলে নিশ্চিন্ত হয়ে যাওয়ার কথা, তাই না?
অনু ম্লান হাসলো, আসলে আমার ভাগ্যে নিশ্চিন্ত হওয়া বলতে কিছু নেই। আমার অবস্থা হচ্ছে, ডাঙায় বাঘ দেখে বাঁচার জন্য পানিতে লাফিয়ে পড়ার মতো। যেখানে পড়ে দেখি সেখানে হাঁ করে আছে কুমির।
মানে কী?
জায়েদ। ওই যে বললেন উপকার, তার ধারণা সে আমার উপকার করেছে, এখন তাকে আমার উপকারের প্রতিদান দিতে হবে। ওয়াসিমের মতো না হলেও পরের ছ-সাতটা মাস আমার জীবনটা প্রায় অতিষ্ঠ করে দিলো জায়েদ।
আচ্ছা। তারপর?
ততদিনে নির্বাচন চলে এসেছে। এসব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে। আর নির্বাচনে তো তার দলের ভড়াডুবি হলো। সাথে সাথে গা ঢাকা দিতে হলো তাকেও।
আর তারপরই আবার ফিরে এলো ওয়াসিম এবং সে এসেও আপনাকে কিছু বলেনি, যতদিন না জায়েদ খুন হলো!
জি।
ফোরকান আলী দীর্ঘসময় চুপ করে থেকে কী ভাবলেন। তারপর ধীর এবং শান্ত কণ্ঠে বললেন, এই পর্যন্ত হলে ঘটনা ঠিকই ছিল। কিন্তু ঘটনা এরপরও আছে অনু।
অনু অবাক গলায় বলল, এরপর কী ঘটনা?
এরপরের ঘটনা হচ্ছে, শামীম।
শামীম! কোন শামীম?
আপনার মেজো বোন তনুর হাজবেন্ড।
শামীম!
জি।
এখানে শামীম আবার কোথা থেকে এলো?
ফোরকান আলী হাসলেন, দ্যাটস দ্য কোয়েশ্চেন, সে এর মধ্যে এলো কী। করে! আপনি এতক্ষণ যা বললেন, তার কম বেশি আমরা আগেই জানি। ওই পর্যন্ত আমাদেরও খুব একটা সমস্যা ছিল না। সমস্যা হলো এর পর থেকে। যখন দৃশ্যপটে শামীম হাজির হলো।
অনু কিছুই বুঝতে পারছে না। এর সাথে শামীমের সম্পর্ক কোথায়! এমনকি এইসব ঘটনা শামীম জানেও না। সে বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমরাও না।
তাহলে?
তাহলে আর কী! যখন আমরা কিছুই বুঝতে পারি না, তখন ধারণা করে নেই।
কী ধারণা?
ঘটনার পূর্বাপর কী ছিল?
কী ছিল?
শামীম আপনাদের বাসায়ই থাকে, রাইট?
ছিল, কিছুদিন হলো আলাদা থাকে।
দীর্ঘদিন থেকেই তো একসাথে ছিলেন?
জি।
কিন্তু শামীম যে একটা বইয়ের দোকান দিয়েছে সেটি কী আপনি জানেন না?
জানবো না কেন? জানি।
সেই বইয়ের দোকান করতে আপনিই তাকে টাকা দিয়েছেন?
আমি টাকা দেবো কেন? আর অত টাকা আমি পাবোই বা কোথায়?
কিন্তু শামীম তো জানিয়েছে, ওই টাকা আপনি দিয়েছেন।
ইম্পসিবল। অত টাকা আমি কী করে দেব?
সেটাই, আপনার ভাষ্যমতে আপনাকে খুব কষ্ট করেই সংসার চালাতে হতো, সেক্ষেত্রে শামীমকে এত টাকা আপনি কোত্থেকে দিবেন, তাই তো?
জি।
কিন্তু অনু, আপনি কী জানেন যে শামীম যেই স্কুলের সামনে বইয়ের দোকান দিয়েছে, ওটার পাশে একটা কলেজও আছে?
জি।
আরো একটু পাশেই একটা বড় প্রাইভেট ইউনিভাসিটিও আছে?
জি।
তো অমন ব্যস্ত একটা জায়গায়, অত বড় দোকান নেয়ার জন্য যে টাকা লাগে, সেই টাকা সে পেল কোথায়?
সে বলেছিল, তার বন্ধুরা মিলে দিয়েছিল।
আর সেটি আপনি বিশ্বাস করেছেন?
অনু এবার আর কথা বলল না। ফোরকান আলী বললেন, এবং বন্ধুদের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে সে বইয়ের বিজনেস শুরু করলো, আর দিন না ফুরাতেই সেই বইয়ের দোকান থেকে সে লক্ষ লক্ষ টাকা প্রফিট করতে থাকল? কী সহজ বিষয়টা, তাই না? আর এটি আপনি বিশ্বাসও করছেন?
অনু বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে। তবে কোথাও যে একটা বড় ধরনের ঝামেলা রয়ে গেছে, সেটি স্পষ্ট। নিজেকে হতবিহ্বল লাগছে অনুর। সে বলল, আমি সত্যি বুঝতে পারছি না। আপনি কী শামীমের বিষয়টা আমাকে একটু খুলে বলবেন?
নিশ্চয়ই বলব। আপনি যদি বলেন যে একই ঘরে, একই ছাদের নিচে থেকেও আপনি আপনার আপন মেজো বোনের হাজবেন্ড সম্পর্কে কিছু জানেন না, তাহলে তো এটা আমাদের ইমানি দায়িত্ব যে তা আপনাকে জানানো।
ফোরকান আলীর কণ্ঠে বিদ্রুপাত্মক সুর। তিনি বললেন, কোচিংয়ে বিজনেসের আড়ালে ওয়াসিমের যে ইয়াবার বিজনেস ছিল, সেটি আপনি জানতেন?
শুনেছিলাম, আর সেটি আপনাকে বলেছিও।
ফোরকান আলী হাসলেন, দেখেন, সেটি পর্যন্ত আপনি জানতেন, আর আপনি এটি জানতেন না যে আপনার ব্রাদার ইন ল’ শামীম ওয়াসিমের এই বিজনেসের সাথে যুক্ত? সে তার একজন নতুন স্ট্রং হ্যান্ড?
ওয়াসিমের? শামীম! অনুর নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না, কী বলছেন আপনি?
ফোরকান আলী আবারো হাসলেন, আমি আরো অনেক কিছুই বলব, আপনি হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবেন না। কিংবা আপনি যে আগে থেকেই জানতেন, সেটি স্বীকার করতে চাইবেন না।
কী?
শামীমের ওই বইয়ের দোকানটা আসলে বইয়ের দোকান নয়। ওটা বইয়ের আড়ালে ওখানকার স্টুডেন্টদের জন্য ড্রাগস সাপ্লাইয়ের একটা সেফ জোন। কেউ কিছু বুঝছে না, জানছে না। স্কুল কলেজের সামনে নরমাল একটা বইয়ের দোকান। নানারকম বই খাতা কলম পাওয়া যাচ্ছে, ফটোকপি মেশিন আছে, প্রিন্টিং মেশিন আছে। মোবাইল ফোনে টাকা লোড করা যাচ্ছে। সবকিছুই খুব সহজ, স্বাভাবিক। বাট আসলে তো ওটা একটা ইয়াবা স্পট!
অনু হা করে তাকিয়ে আছে। ফোরকান আলী বললেন, আপনি নিশ্চয়ই বলবেন যে এই ঘটনা আপনি জানতেন না?
না বললে আপনি বিশ্বাস করবেন?
প্রশ্নটা আমার ছিল।
আমি আসলেই জানতাম না, ঘুণাক্ষরেও না। হ্যাঁ, শামীমের রাতারাতি এত টাকা ইনকামের ব্যাপারটা আমার কাছেও খানিকটা অস্বাভাবিকই লেগেছে। কিন্তু সেটা যে এভাবে হতে পারে, আনবিলিভেবল!
আমাদের কাছেও আনবিলিভেবলই ছিল।
কী?
এই পুরো বিষয়টিতে আপনার সম্পৃক্ততা।
আমার?
হুম।
কীভাবে?
ধরুন, ওয়াসিমের সাথে আপনার এত বড় একটা ঝামেলা হলো, সেই ঝামেলার কারণে আপনি জায়েদকে দিয়ে ওয়াসিমকে শায়েস্তা করালেন। আবার এরপর ঠিক একইভাবে জায়েদও আপনার সাথে ঝামেলা শুরু করলো, আর আপনি ঠিক আগের মতোই এবার আবার ওয়াসিমকে দিয়ে জায়েদকে শায়েস্তা করালেন। আই মিন যেটা আসলে ঘটনাচক্রে খুন পর্যন্ত গড়িয়েছে!
অনু কী বলবে ভেবে পেল না, তার নিজেকে পুরোপুরি দিশেহারা লাগছে। সে বলল, আপনি কী বলছেন এসব? আমি এর কিছুই জানতাম না!
নিশ্চয়ই আপনি কিছুই জানতেন না। আপনার বোনের হাজবেন্ড ওয়াসিমের অবর্তমানে তার ড্রাগস বিজনেস দেখাশোনা করছে, সেটাও আপনি জানতেন না। আবার ওয়াসিম যে আপনার সাথে সেই সন্ধ্যায় কী অঘটন ঘটিয়েছিল, দিনের পর দিন আপনার সাথে কী আচরণ করেছিল, তার কিছুই আপনার বোনের হাজবেন্ড শামীম জানতো না! অথচ, আর সবকিছুই ঠিকঠাক জানাশোনা, বোঝাঁপড়া চলছে, একে অন্যের সম্পর্ক, বিজনেস, লক্ষ লক্ষ টাকা, সবকিছুই। কী ইন্টারেস্টিং না বিষয়টা?
ফোরকান আলী থামলেও অনু কথা বলতে পারল না। ফোরকান আলীই আবার বললেন, অনু, কিন্তু পুলিশের ধারণা আপনি অনেক কিছুই জানতেন। শামীম আপনার কনসার্ন ছাড়া কিছুই করেনি। ইনফ্যাক্ট সেটি সম্ভবও না। ওয়াসিমের সাথে তার ইনভলভমেন্টও আপনার নির্দেশেই। আমরা ধারণা করছি, পুরো বিষয়টিই আপনি জানতেন। এমনকি জায়েদের খুনের বিষয়টাও। হ্যাঁ, হতে পারে আপনি চাননি, জায়েদ খুন হয়ে যাক। কিন্তু আপনি তো এটাও চাননি যে জায়েদ করাতকলের করাতে ওয়াসিমের আঙুল কেটে ফেলুক। কিন্তু সেটাও তো ঘটেছে! মানে আপনি কিছু একটা চেয়েছিলেন, সেখানে অন্য কিছু একটা ঘটেছে। তা এখানেও কী তেমন কিছু একটা ছিল?
অনু কথা বলল না। সে কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। তার চিন্তা শক্তি কাজ করছে না। ফোরকান আলী বললেন, জায়েদের খুনটাও তাই যতটা সহজে দেখা যায়, বিষয়টা ততটা সহজ না।
অনু বাসায় ফিরে তার করণীয় নিয়ে ভাবতে বসলো। জীবনভর কত কত কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি যে সে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু তারপরও আজ এই মুহূর্তে এসে তার মনে হচ্ছে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে তার মুক্তি নেই। নিজের অজান্তেই একটা দুর্ভেদ্য মাকড়সার জালে সে আটকে গেছে। এই জাল কেটে বের হবার পথ তার জানা নেই। তবে এখন নিজেকে নিয়ে অনু। যতটা না চিন্তিত, তার চেয়েও বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েছে তনু আর হাফসাকে নিয়ে। সেই প্রথম থেকেই শামীমকে নিয়ে একটা অস্বস্তি, একটা সন্দেহ কাজ করলেও নিঃসংশয় হতে পারছিল না অনু। কিন্তু যখন নিঃসংশয় হয়ে সে সব জানলো, তখন সেখান থেকে বের হবার আর কোনো পথ কী খোলা আছে শামীমের? সম্ভবত নেই, কিংবা থাকলেও শামীম সেখান থেকে বের হতে চাইবে কি-না সেটিও একটা প্রশ্ন। সমস্যা হচ্ছে শামীম নিজে নিজে যে বিপদে পড়েছে, সেই বিপদ এখন একে একে গ্রাস করবে তাদের সবাইকে।
সাদা চোখে দেখলে হয়তো বিষয়টিকে এতটা জটিল মনে হবে না। কিন্তু ফোরকান আলীর পুলিশি তদন্তের চোখ বিষয়টিকে যেভাবে মিলিয়েছে, তাতে তাকে মিথ্যে প্রমাণ করাও সহজ নয়। অনুর নিজেরও এখন মনে হচ্ছে, শামীমের সাথে ওয়াসিমের সম্পর্কটা যদি সত্যিই এমন হয়ে থাকে, তবে পুরো ঘটনায় অনুর ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেখা পুলিশের জন্য সবচেয়ে সহজ এবং স্বাভাবিক ব্যাপার। তাছাড়া শামীম দীর্ঘদিন তার সাথে একই বাসায়, একই ছাদের নিচে থাকছে। সে সম্পর্কে তার বোনের স্বামীও। চাইলেই যে কেউ যে কোনোভাবে হিসেবটা মিলিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু অনু তার নিজের হিসেবটা মেলাতে পারছে না। এই বিপদ থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় তার জানা নেই। সে একবার ভাবলো শামীমের সাথে কথা বলবে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হলো, এই মুহূর্তে সেটি ঠিক হবে না। বহু ভেবেচিন্তে পরদিন ভোরে সে ফোন করলো তনুকে। তনু ফোন ধরেই বলল, বাসা পেয়েছিস?
অনু বলল, না।
বাড়িওয়ালার বউ কিছু বলেনি?
এখনো বলেনি। আচ্ছা, হাফসা কেমন আছে? অনু প্রসঙ্গ পাল্টালো।
রাতের কান্নাটা কমেছে। আর এখানে ওর দাদি আছে, ফুপিরা আছে, সবাই খুব আদর করে। কোল থেকে নামাতেই চায় না, জানিস?
আচ্ছা। তুই কেমন আছিস?
শোকর আলহামদুলিল্লাহ। বিয়ের এতদিন পর এসে মনে হচ্ছে নিজের একটা সংসার হলো। আমার শাশুড়ি তো এতদিন আমাকে দুই চক্ষে দেখতে পারত না। কিন্তু এখন পারলে মাথায় তুলে রাখে। সবই টাকা বুঝলি, সবই টাকা। জানিস, শামীম কী বলেছে?
কী?
আমাকে একটা আড়াই ভরি সোনার হার কিনে দিবে। বিয়ের পর তো এখন পর্যন্ত কিছু দিতে পারেনি।
সোনার তো অনেক দাম এখন।
তাতে কী হয়েছে, ওর এখন আয় রোজগার মাশাল্লাহ ভালো।
কেমন ভালো?
অত কী আর আমাকে বলে? তবে ভালোই, কত কিছু করার যে প্ল্যান পরিকল্পনা করছে! বলেছে নেক্সট ইয়ারে আমাদের নিয়ে বাইরে কোথাও ঘুরতে যাবে। তনুর গলা আনন্দে ঝলমল করছে।
অনু বলল, কেমন কী আয়, তা তোকে বলে না?
এত জেনে কী হবে বল? পুরুষ মানুষের সবকিছু ঘরের বউকে বলার দরকারও নেই। বউ যখন যা চাইবে, তা দিতে পারলেই তো হলো, তাই না?
হুম, কিন্তু তুই কখনো জানতে চাসনি যে হঠাৎ করেই এত অল্প সময়ে সে। এত টাকা কোথায় পেল?
কেন, তুই ওর বিজনেসের কথা ভুলে গেছিস?
আমি ভুলে যাইনি, তুই ভুলে গেছিস।
আমি আবার কী ভুলে গেলাম?
তুই ভুলে গেছিস যে, ওই বইয়ের বিজনেস থেকে কেন, কোনো স্বাভাবিক বিজনেস থেকেই এই এত অল্পসময়ে এই পরিমাণ টাকা আসা সম্ভব না।
এতক্ষণে যেন অনুর অভিপ্রায় বুঝতে পারল তনু। সে গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, তুই কী বলতে চাচ্ছিস বড়পু, স্পষ্ট করে বলবি?
অনু স্থির গলায় বলল, স্ত্রীর দায়িত্ব শুধু স্বামীর টাকা খরচ করাই না। স্বামীর ভালো-মন্দ দেখাও। সে কীভাবে কোথা থেকে টাকা আয় করছে সেটাও দেখা।
তনু শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে বলল, তোর কাছ থেকে নিশ্চয়ই স্ত্রীর দায়িত্ব শিখতে হবে না আমাকে! আজ সাত বছরেরও বেশি আমার বিয়ে হয়েছে বড়পু, তোর চেয়ে স্ত্রীর দায়িত্ব আমার কম জানার কথা না।
অনু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তনু তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, শোন বড়’পা, সেই বিয়ের পর থেকেই তো আর কম কথা শুনিনি। কম কষ্টও করিনি। খেয়ে না খেয়ে থেকেছি, কারো সামনে গলা উঁচু করে কথা পর্যন্ত বলতে পারিনি। সবসময় মাথা নিচু করে থেকেছি। এখন শামীম ভালো করছে দেখে কারো সহ্য হচ্ছে না, সেটা বুঝি। টাকা-পয়সা হাতে না থাকলে শামীমের মাথার ঠিক থাকে না। হাফসা হবার সময় এইজন্যই তার মাথা ঠিক ছিল না। আমার সাথে অনেক আজেবাজে ব্যবহারও করেছে। তাই বলে ভাবিস না, সে ওরকমই।
তনু থামলেও অনু কথা বলল না। ফোন কানে চেপে ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তনু আবার বলল, তোদের কাছ থেকেও তো কম অপমান অপবাদ সে। সহ্য করেনি। নিজের বড় বোনের মতো সে ভাবতো তোকে। কিন্তু তার বদলে কী করেছিস তোরা, কিছুই ভোলেনি সে। শোন বড়পু, হাফসা হওয়ার সময় থেকে এই পর্যন্ত তুই আমাদের পেছনে কত কী খরচ করেছিস, তার একটা হিসাব দিস, শামীম টাকাটা দিয়ে দিবে।
অনু শান্ত গলায় বলল, আচ্ছা।
আর কিছু বলবি আপু?
হুম।
বল?
মা’র একটা ডিপিএস ছিল, সেখানে অল্প কিছু টাকা জমেছে। টাকাটা আমি তোকে দেবো। তুই যত দ্রুত সম্ভব হাফসাকে নিয়ে শামীমদের গ্রামে বাড়ি চলে যাবি, আর ঢাকায় ফিরবি না।
তোর কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
অনু তনুর কথা গ্রাহ্য করলো না। সে আগের মতোই শান্ত ভঙ্গিতে বলল, আর যদি সম্ভব হয়, শামীমকেও বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে যাবি। ওই টাকায় গ্রামে ছোট খাটো কিছু একটা হলেও সে করে খেতে পারবে। যদিও আমার মনে হয় না সে যাবে, তবে সেই চেষ্টাও করতে হবে। আরেকটা কথা, ছোট বেলায় যতটা গর্দভ ছিলি, ভেবেছিলাম বড় হলে সেটা কমবে। কিন্তু মানুষ যে বড় হতে হতে দিন দিন আরো বড় গর্দভ হয়, সেটার উৎকৃষ্ট প্রমাণ তুই।
অনু ফোন রেখে দিয়ে চুপচাপ বসে রইল। তার কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু কি করা দরকার তা সে ভেবে পাচ্ছে না।
সে পরদিন ভোরবেলা তনুকে দেখে অবাক হলো না। জিজ্ঞেস করলো, কী সিদ্ধান্ত নিলি?
তনু বিচলিত গলায় বলল, কী হয়েছে আমাকে খুলে বলবি প্লিজ?
শামীমের সাথে কোনো কথা হয়েছে?
হ্যাঁ।
কী কথা হয়েছে?
কাল রাতে বাসায় ফিরলে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম।
সে কী বলল?
হঠাৎ রেগে গেল।
আমার কথা কিছু বলেছিলি?
নাহ্।
অনু যতটা সম্ভব ঘটনা খুলে বলল। তনু ঘটনা শুনে হতবুদ্ধের মতো বসে রইল। সে বলল, এখন আমি কী করব বড়’পু?
তোর আর এখন কিছু করার নেই। শামীম এখন কারো কথা শুনবে না।
শামীমকে সবকিছু খুলে বলব?
বুঝতে পারছি না, আমার ধারণা সে কিছুই শুনবে না।
শুনবে বড়পু।
অনু বেশ কিছু সময় চুপ করে বসে রইল। তারপর বলল, শামীম খুব বোকা একটা মানুষ। কিন্তু বোকা হওয়াটা কোনো সমস্যা না। সমস্যা হচ্ছে। বোকা মানুষ যখন নিজেকে খুব বুদ্ধিমান ভাবা শুরু করে তখন। এদের কারণে তাদের নিজেদের যতটা না ক্ষতি হয়, তারচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় তার আশেপাশের মানুষের।
আমার হাত-পা কাঁপছে বড়পু।
অনু হাত বাড়িয়ে তনুর হাত ধরলো। তারপর বলল, ভয় পাস না, বিপদ আপদ মানুষের জীবনেই আসে।
কিন্তু তোর কী হবে?
আমাকে নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। তুই তোর নিজেকে আর হাফসাকে নিয়ে ভাব।
তনু দীর্ঘসময় অনুর হাত ধরে চুপচাপ বসে রইল। সে নিঃশব্দে কাঁদছে। তার দুই গাল বেয়ে কান্না ঝরেছে। অনু যেন অভয় দিতেই তনুর হাতটা আরো শক্ত করে চেপে ধরলো। তনু আচমকা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। তারপর কান্নাজড়ানো গলায় বলল, আরো একজনকে নিয়ে যে ভাবতে হবে বড়পু?
অনু অবাক গলায় বলল, আরো একজনটা আবার কে?
তনু হঠাৎ অনুর হাতখানা টেনে নিয়ে তার তলপেটে চেপে ধরে বলল, আরো একজন এইখানে আছে বড়’পু। ভাবছিলাম সে আমার সৌভাগ্য নিয়ে এসেছে, কিন্তু…।
তনু তার কথা শেষ করতে পারল না। বাঁধ ভাঙা জলোচ্ছ্বাসের মতো কান্নায় তার গলা বুজে এলো। অনু কী বলবে ভেবে পেল না। সে শূন্য এবং অসহায় চোখে তনুর দিকে তাকিয়ে রইল।
*
শামীম বসে আছে ওয়াসিমের সামনে। জায়গাটা টেকনাফে মায়ানমার বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি। ছোট টিলার উপর কাঠের বাংলোর মতো ঘর। প্রচণ্ড শীত পড়েছে বলে ওয়াসিম হাতে পায়ে মোজা পরে বসে আছে। ঘন কুয়াশার কারণে বাইরে হাত দেড়েক দূরের জিনিসও দেখা যায় না। সেই দুর্ভেদ্য কুয়াশা দেখতেই খোলা বারান্দায় বসে আছে সে। শামীম অবশ্য শীতে কাঁপছে, এত শীত হবে ধারণা ছিল না তার। ওয়াসিম বলল, খুব ঝামেলা হচ্ছে?
মোটামুটি।
কী ঝামেলা?
নানারকম ঝামেলা।
পুলিশের?
তা আছে কিছু, তবে অন্য ঝামেলা বেশি?
অন্য ঝামেলা কী?
আপনি স্বশরীরে নেই, এটা অনেকের জন্যই সুযোগ। তাছাড়া অনেকেই আছে বহুদিন থেকে আপনার হয়ে কাজ করছে। হঠাৎ করে আমার সিদ্ধান্ত, মতামত তারা মানতে চায় না। আমি তো তাদের তুলনায় নতুন।
কেন? আজম তো আছেই। আজমকে তো আমি বলেই এসেছি সে যেন বিষয়গুলো হ্যাঁন্ডেল করে।
শামীম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, আজম ভাই নিজেও খুব একটা হিসাব নিকাশ দেয় না!
ওয়াসিম চেয়ারে হেলান দিয়ে বসা ছিল। শামীমের কথা শুনে সে খানিক সোজা হয়ে বসলো। শামীম বলল, গত দুই মাসে আজম ভাইয়ের স্পটের কোনো সেল রিপোর্ট পাইনি। কত কী বিক্রি হয়েছে কিছু জানিও না।
টাকাও জমা দেয়নি?
শামীম আমতা আমতা করে বলল, না।
তুমি আমাকে জানাওনি কেন?
আপনার এখানে ফোনে নেটওয়ার্ক থাকে না বেশিরভাগ সময়। চাইলেও পাওয়া যায় না।
এরকম আর কে কে আছে?
সব স্পটেই কম বেশি আছে। আসলে সঠিক হিসাবটা তো আমার কাছে নাই। কী পরিমাণে মাল কার কাছে যায়, সেই হিসাব তো থাকে আজম ভাইয়ের কাছে। আমি শুধু সবার কাছ থেকে টাকা পেয়ে আপনার একাউন্টে জমা দেই, আর আমার স্পটের বিক্রিটা দেখি।
ওয়াসিম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, এখন থেকে মাল দেয়ার আগে টাকা নিয়ে নিবে। মাল হিসেব করে একহাতে দিবে, আরেক হাতে টাকা নিবে। প্রিপেইড সিস্টেম। এই ইয়াবা জিনিসটা ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছানো সহজ কথা না। মায়ানমার থেকে আসে এই টেকনাফ সীমান্ত হয়ে। তারপর যে কত সিস্টেম করতে হয়, কতজনকে পয়সা দিতে হয় ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছাতে। তা শুধু আমি জানি। বিক্রি করে টাকা দিবে, আগের সিস্টেম এখন থেকে বাদ।
শামীম বলল, আচ্ছা।
আর পুলিশ কী ঝামেলা করে? এইগুলা নিয়ে তো পুলিশের ঝামেলা করার কথা না।
স্কুল-কলেজের সামনের স্পট নিয়ে সমস্যা, অন্য জায়গা নিয়ে সমস্যা নেই।
কী সমস্যা? তুমি তো আর দোকানের তাকভর্তি বয়ামে বয়ামে ইয়াবা সাজিয়ে নিয়ে বিজনেস করতে বসো নাই। তুমি তাকভর্তি বই সাজিয়ে নিয়ে বসেছ!
সেটা তো আমি জানি না। আজকাল পুলিশের আচার-আচরণ একটু পাল্টে গেছে। মাঝে মধ্যে দোকানে এসেও চোটপাট দেখায়।
ওয়াসিম গম্ভীর গলায় বলল, আচ্ছা, বিষয়টা আমি দেখছি। তুমি পাশের ঘরে রেস্ট নাও, বাকি কথা পরে হবে।
সন্ধ্যায় ওয়াসিমের সাথে শামীমের আবার কথা হলো। ওয়াসিম বলল, আমি গ্রিন সিগন্যালের অপেক্ষায় আছি। আশা করছি, যে-কোনো মুহূর্তেই গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে যাব। আর সাথে সাথেই ঢাকা চলে আসবো। তখন আর এইসব সমস্যা থাকবে না।
একটু চেষ্টা করেন, যত দ্রুত সম্ভব।
তুমি এত টেনশন করছ কেন শামীম? এসব লাইনে এত অল্পতেই অস্থির হলে চলে না।
শামীম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, কোথাও একটা ঝামেলা হচ্ছে।
ওয়াসিম হাসতে হাসতে বলল, কী ঝামেলা হবে? কোনো ঝামেলা নেই। আর একটু আধটু ঝামেলা না হলে মজাটাও পাওয়া যায় না।
শামীম কথা বলল না। দূরের পাহাড় থেকে নাম না জানা প্রাণীর চিৎকার ভেসে আসছে। কেমন একটা গা ছমছমে ব্যাপার চারপাশে। ওয়াসিম হঠাৎ শামীমের কাঁধে হাত রেখে বলল, তোমার বউ কেমন আছে?
জি ভালো।
একা এলে কেন? বউকেও সাথে নিয়ে আসতে। সুন্দর জায়গা, একটা টুরও হয়ে যেত।
ওর শরীরটা একটু খারাপ।
আরে ধুর, মেয়ে মানুষের তো ওই এক… শরীর খারাপ। এছাড়া আর কী! এরা হচ্ছে ঘোড়ার মতো, যখনই ঝিমাবে, পাছায় বাড়ি মারলেই দেখবে আবার দৌড়ানো শুরু করেছে।
ওয়াসিমের এই কথাটা শামীমের পছন্দ হলো না। তনুকে নিয়ে কথার মাঝখানে ওয়াসিমের কাছ থেকে এমন শব্দ সে আশা করেনি। ওয়াসিম বলল, তোমার বউকে কিন্তু আমি চিনি। ছোটবেলায় দেখেছি। তখন নেংটি পরে ঘুরে বেড়াতো। হা হা হা। একটা বয়সের পর মেয়েদের চেহারা ছবি হঠাৎ ভালো হয়ে যায়। তোমার বউকেও তো দেখলাম দেখতে টেখতে এখন বেশ হয়েছে। তুমি কিন্তু নিয়ে আসতে পারতে। কী সুন্দর নিরিবিলি জায়গা দেখেছ? এই শীতে গরম হওয়ার জন্য এমন জায়গার তুলনা হয়, বলো?
শামীম জবাব দিলো না। ওয়াসিম হাসতে হাসতে বলল, পুরুষ মানুষের অবশ্য মৌজ মাস্তিতে নিজের বউ ভালো লাগে না। ভালো লাগে অন্যের বউ। শোনন নাই, বাঙালি না-কি পরস্ত্রী আর পরশ্রীকাতর, হা হা হা। তা, তোমার বড় আপার খবর কী?
কোন বড় আপা?
অনু ছাড়া আরো বড় আপা আছে না-কি তোমার?
নাহ্, তা নেই। হঠাৎ যেন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মনে পড়েছে, এমন ভঙ্গিতে শামীম বলল, উনাকে যে পুলিশ থানায় নিয়ে গিয়েছিল জানেন?
ওয়াসিম ভারি অবাক হলো, থানায় নিয়ে গিয়েছিল!
হুম। একবার না, একাধিকবার।
কী বলো! ঘটনা কী?
তা তো জানি না।
তোমার বউকে জিজ্ঞেস করোনি?
আমি ওর সাথে বাইরের বিষয় নিয়ে কথা বলি না। তাছাড়া থানা পুলিশ বিষয়টাকে আমি এড়িয়েই চলতে চাই।
ওয়াসিম শামীমের কাঁধে হাত রেখে বারান্দার ডান প্রান্তের খোলা রেলিং দেয়া জায়াগাটাতে এলো। তারপর বলল, সবকিছু এড়িয়ে যেতে নেই। কিছু জিনিস জানা থাকা দরকার। ধরো তুমি সাপ ভয় পাও, তাই বলে যে পথে যাচ্ছ, সে পথে সাপ আছে কি-না সেটা দেখে নেবে না?
শামীম মাথা নাড়লো। ওয়াসিম বলল, অনুর সাথে এই বিষয়ে কথা বলার দরকার নেই। তুমি বরং তোমার স্ত্রীর সাথে বিষয়টা নিয়ে কথা বলো। যতটা সম্ভব ঘটনাটা জানো। আমার এখন মনে হচ্ছে তোমার কথাই ঠিক। ঢাকায় কোনো একটা বড়সড় ঝামেলা পাকছে।
অনুর কাছ থেকে ফেরার পর থেকে তনু একদম চুপচাপ হয়ে গেছে। সে প্রবল সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। কখনো কখনো অনুর কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। আবার কখনো কখনো মনে হচ্ছে শামীমকে ছেড়ে-ছুঁড়ে হাফসাকে নিয়ে কোথাও চলে যাবে। এই সময়টা তার জন্য খুবই সংবেদনশীল সময়। পাঁচ মাস হলো সে আবার গর্ভধারণ করেছে। অথচ এখন তাকে ভাবতে হচ্ছে অপেক্ষমান এক মহাপ্রলয় নিয়ে। শামীম টেকনাফ থেকে ফিরল দু’দিন বাদে। রাতে তনু তাকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি যশোর গিয়েছিলে?
একবার তো বললাম।
যশোর কেন গিয়েছিলে?
কেন গিয়েছিলাম, সেটা তোমার না জানলেও চলবে।
কিছু জিনিস জেনে রাখা ভালো। বলা তো যায় না কখন কোন বিপদ চলে আসে।
আমার বিপদ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।
তাহলে কার বিপদ নিয়ে ভাবতে হবে?
নিজের বিপদ নিয়ে।
আমার আবার কী বিপদ?
এই যে সারাক্ষণ আমি কী করছি, কোথায় যাচ্ছি, এই নিয়ে গোয়েন্দাদের মতো লেগে থাকো, এটাই তোমার বিপদ।
তুমি মিথ্যে না বললেই তো হয়।
আমি কী মিথ্যে বলছি?
তুমি তো যশোর যাওনি। গিয়েছিলে কক্সবাজার।
আমি কক্সবাজার গিয়েছিলাম তোমাকে কে বলল?
তোমার প্যান্টের পকেটে কক্সবাজার টু ঢাকা বাস টিকেট আছে। তোমার নামে, আজকের ডেটেই কাটা।
আমাকে না জানিয়ে আমার প্যান্টের পকেট ঘেটেছ কেন?
ঘাটিনি। হুট করে কাউকে কিছু না জানিয়ে এক কাপড়ে চলে গেলে। জামা কাপড়ের অবস্থা দেখেছ? ধুতে গিয়ে দেখলাম।
দেখেছ ভালো করেছ। এই নিয়ে আর কথা বাড়িয়ো না।
কিছু কথা বাড়ানো দরকার শামীম।
কোনটা দরকার আর দরকার না, সেটা আমি বুঝব, তুমি না।
কেন? তুমি উপার্জন করো বলে?
শামীম কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, হ্যাঁ, পয়সা উপার্জন ঘরে বসে দুই বেলা ভাত রান্নার মতো কোনো বিষয় না। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিনরাত পরিশ্রম করার বিষয়।
এত পরিশ্রম কার জন্য করছ?
শামীম আবার চুপ করে গেল। তারপর বলল, তোমার কী হয়েছে বলে তো? ইদানীং মনে হয় তোমার গলার স্বর আর সাহসটা খুব বেড়েছে!
ভীতু মানুষের সাহস কখন বাড়ে জানো? যখন তার সামনে আর কোনো পথ থাকে না। আমার সামনেও এখন তোমার মুখোমুখি হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
শামীম শ্লেষাত্মক ভঙ্গিতে বলল, তুমি তাকিয়ে আছ ওইদিকে মুখ করে, আর বলছ মুখোমুখি হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই!
তনু শামীমের দিকে ঘুরে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, তুমি যে এই কিছুদিন আগেও রোজ আমার গায়ে হাত তুলতে, আমি কিছু বলতাম? বলতাম না। কেন বলতাম না জানো? কারণ তখন তোমার হাতে টাকা-পয়সা ছিল না। আর টাকা না থাকলে তুমি অন্য মানুষ হয়ে যাও। সেটা আমি জানতাম। কিন্তু শামীম টাকা-পয়সা কিসের জন্য? আমাদের জন্যই তো? এই যে হাফসা, আমি, আমরা সবাই। আর এই যে নতুন একজন আসছে, এদের জন্যই, তাই না?
শামীম কোনো কথা বলল না। তনুই বলল, আমাদের সবার জন্যই তুমি এত পরিশ্রম করছ, কষ্ট করছ। কিন্তু তোমার সেই পরিশ্রমের কারণেই যদি তুমি বড় কোনো বিপদে পড়? আর তুমি বিপদে পড়া মানে কিন্তু আমরা সবাই-ই বিপদে পড়া শামীম।
শামীম ঝট করে তনুর মুখের দিকে তাকালো, কী বিপদে পড়বো?
তুমি ভালো করেই জানো শামীম কী বিপদ পড়বে?
না আমি জানি না। তুমি বলো কী বিপদ? শামীমের কণ্ঠ হঠাৎ খানিকটা উত্তপ্ত হয়ে উঠল।
তুমি কিসের বিজনেস করছ?
কিসের বিজনেস করছি মানে? তুমি নিজ চোখে গিয়ে দেখে আসোনি?
দেখে এসেছি শামীম। কিন্তু সবকিছু কি খালি চোখে দেখা যায়? যায় না। তুমিও যেমন খালি চোখে দেখতে পাচ্ছ না কী ভয়াবহ বিপদে তুমি পড়তে যাচ্ছ। কী ভয়ংকর ট্র্যাপে তুমি পা দিয়ে বসে আছ!
শামীম হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল, এত ভনিতা না করে কী হয়েছে বলো, কার কাছে তুমি কী শুনেছ!
তনু খানিক সময় নিলো, তারপর বলল, তুমি যে বইয়ের দোকানের আড়ালে স্কুল কলেজগুলোতে ড্রাগস সাপ্লাই করো, এটা পুলিশ জানে।
তনুর কথা শুনে শামীম ছোটোখাটো একটা ধাক্কার মতো খেলো। পুলিশ জানে বলে নয়, ঘটনাটা তনু জানে বলে সে অবাক হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছে পুলিশের জানাশোনা সংক্রান্ত বিষয়ে তনুর কথা শুনে। তনু সাধারণত ঘর থেকে বের হয় না। বাইরের মানুষের সাথেও মেশে না। ফলে এই ঘটনা তনুর জানার কথা নয়, বিশেষ করে পুলিশ সংক্রান্ত ঘটনা। সে শান্ত ভাবেই জিজ্ঞেস করলো, এসব কথা তোমাকে কে বলেছে?
কে বলেছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ না। আমি যেটা বলেছি সেটা সত্য কি-না, তা গুরুত্বপূর্ণ।
শামীম হঠাৎ কাতর কণ্ঠে বলল, তনু, আমাকে রাগিয়ে দিও না… প্লিজ।
শামীমের বলার ভঙ্গি শুনে তনু স্থির হয়ে গেল। শামীম তাকিয়ে আছে সাপের মতো ঠান্ডা চোখে। তার কপালের কাছের শিরাটা শুধু সামান্য নড়ছে। বহুদিন সে এই শামীমকে দেখেনি। এই শামীম করতে পারে না, এমন কোনো কাজ নেই। আপাতদৃষ্টিতে আপাদমস্তক সহজ সরল, বিনয়ী শামীম এই সময়টাতে অন্য মানুষ হয়ে যায়, সেই মানুষটা ভয়ংকর! শামীম একই গলায় বলল, বলো?
তনু জানে অনুর নাম সে লুকিয়ে রাখতে পারবে না। সে কাঁপা গলায় বলল, বড়’পু।
সে জানলে কী করে?
বড়’পুকে পুলিশ থানায় নিয়ে গিয়েছিল।
থানায় নিয়েছিল কেন?
জায়েদ মল্লিকের খুনের বিষয়ে তথ্য জানতে।
শামীম যেন আকাশ থেকে পড়লো, কী? জায়েদ মল্লিকের খুনের সাথে তার কী সম্পর্ক?
পুলিশ সন্দেহ করছে খুনটা করেছে ওয়াসিম।
কিন্তু তার সাথে ওনার কী সম্পর্ক?
তনু যতটা পারল সংক্ষেপে ঘটনা খুলে বলল। শেষে বলল, জায়েদ মল্লিককে ওয়াসিম খুন করেছে, এই বিষয়ে পুলিশ নিঃসন্দেহ। কিন্তু তারা সন্দেহ করছে এর সাথে কোনো না কোনোভাবে বড়পুরও ভূমিকা আছে, এমনকি তোমারও।
আমি!
হুম।
কীভাবে?
তনু ঘটনা ব্যাখ্যা করলো। শামীম অবশ্য তারপরও মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলো, কিন্তু এখানে আমি কোথা থেকে এলাম?
পুলিশের ধারণা, বড়পুর সাথে যে ঘটনা ঘটানোর কারণে ওয়াসিমকে মেরে জায়েদ এলাকা থেকে বের করে দিয়েছিল, তার বিজনেস টিজনেস বন্ধ করে দিয়েছিল, এর প্রতিশোধ নিতেই জায়েদকে ওয়াসিম খুন করে ফেলেছে।
এই কারণে কেউ কাউকে মেরে ফেলবে?
সেটাই। পুলিশ এখন সেই পেছনের আরো কারণ খুঁজছে। খুঁজতে গিয়েই তাদের মনে হয়েছে, ওয়াসিমের সাথে জায়েদের আরো নানান বিষয়ে আগে থেকেই ঝামেলা ছিল। যার একটা হলো ড্রাগসের বিজনেসটা পুরোপুরি নিজের একার কন্ট্রোল নেয়া। আর জায়েদ মল্লিক খুন হওয়ার ঠিক কয়েক মাস আগেই। তুমি হঠাৎ ওয়াসিমের সাথে এই বিজনেসে ইনভলভড হয়েছ। পুলিশ বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি। তাদের ধারণা…।
কী?
তারা নিশ্চিত করে কিছু বলছে না। কিন্তু সন্দেহ করছে যে বড়পুর সাথে ওয়াসিমের এতকিছু হয়ে যাওয়ার পরও তুমি তার ছোট বোনের হাজবেন্ড হয়ে, বছরের পর বছর একই বাসায় একই ছাদের নিচে থেকেও কীভাবে আবার সেই ওয়াসিমের সাথেই যুক্ত হলে! শুধু তাই-ই না, ওয়াসিমের অবর্তমানে তার এতবড় ড্রাগসের বিজনেসেটাও দেখছ তুমি! খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা সন্দেহ। করছে, বিষয়টা বড়’পু জানতো কি-না? মানে তাদের কাছে বিষয়টা ক্লিয়ার না, বরং যষ্টেই সন্দেহজনক। কিন্তু তারা এখনো ফাইনাল কোনো ডিসিশনে আসতে পারছে না।
শামীম রীতিমত হতবাক হয়ে গেছে। সে দীর্ঘসময় স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। একটা সাধারণ ঘটনা যে এতটা জটিল হতে পারে তা তার দূরতম কল্পনাতেও ছিল না। সেই সারাটা রাত একটা অদ্ভুত অস্থিরতা নিয়ে কাটলো শামীমের। মানুষ হিসেবে সে কেমন, তা শামীম নিজেও জানে না। নিজেকে তার নিজের কাছেই অনিশ্চিত, অনির্দেশ্য মনে হয়। কিন্তু আজ এই প্রথম তার মনে হলো সে তার পরিবার নিয়ে সবসময়ই চেতনে-অবচেতনে উদ্বিগ্ন ছিল। প্রায়শই তনুর প্রতি তার যে নির্দয় কঠিন আচরণ, তা বরং কোনো না কোনোভাবে পরিবারের প্রতি নিজের দায়িত্ব ঠিকঠাকভাবে পালন করতে না পারার হতাশা থেকেই উদ্ভূত। অন্ধকারেই হাত বাড়িয়ে ঘুমন্ত হাফসার মাথা আলতো করে ছুঁয়ে দিলো শামীম। তার খুব ইচ্ছে করছে তনুর পেটের উপর হাত রেখে পেটের ভেতরের নতুন অস্তিত্বটাকে অনুভব করতে। কিন্তু তনু যদি জেগে যায়, সে যদি টের পেয়ে যায়, তবে এর থেকে বড় লজ্জার আর কিছু হবে না।
শামীমের আচমকা মনে হলো, প্রতিটি মেয়ে যতটা সরবে, যতটা সচেতনভাবে নিজের ভেতর একজন মা পুষে রাখে, প্রতিটি ছেলে ঠিক ততটাই নীরবে, অবচেতনে তার ভেতর একজন বাবা পুষে রাখে। মেয়েরা আগেভাগেই তার এই মাতৃসত্তা টের পেলেও ছেলেরা তার এই পিতৃসত্তার টের পায় বহু পরে। ফলে সত্যিকারের বাবা হয়ে উঠবার আগ অব্দি সে তার এই অনাবিষ্কৃত সত্তা সম্পর্কে থাকে আশ্চর্যরকম নির্লিপ্ত। কিন্তু বাবা হয়ে উঠবার পর থেকে তার এই নির্লিপ্ততা ক্রমশই উধাও হয়ে যেতে থাকে। সে হয়ে উঠতে থাকে প্রচণ্ড স্নেহশীল, সর্বপ্লবী এক পিতা।
শেষ রাতের দিকে শামীম বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। জানালার বাইরে দিনের আলোর আভাস দেখা যাচ্ছে। একেকটা দিনের শুরু যেন একেকটা সদ্যোজাত শিশুর মতোই নিষ্কলুষ, নিষ্পাপ। সেই সদ্যোজাত নিষ্কলুষ ভোরের আলোয় শামীমের আচমকা হাফসার জন্য, অনাগত সন্তানের জন্য খুব ভয় হতে লাগল।