৫. কেন রাত আর দিন, শীত আর গ্রীষ্ম হয়?

পঞ্চম অধ্যায় – কেন রাত আর দিন হয়? কেন শীত আর গ্রীষ্ম হয়? 

আমাদের জীবনে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে দুটি প্রধান ছন্দ, যার একটি আরেকটির চেয়ে অনেক বেশি মন্থর। দ্রুত ছন্দটি হচ্ছে অন্ধকার আর আলোর দৈনন্দিন পরিবর্তন, প্রতি ২৪ ঘণ্টায় একবার যার পুনরাবৃত্তি হয়, আর ধীর ছন্দটি হচ্ছে শীত আর গ্রীষ্মকালের মধ্যে বাৎসরিক পরিবর্তন, যার পুনরাবৃত্তি হবার সময়কাল ৩৬৫ দিনের সামান্য একটু বেশি। সে- কারণে বিস্ময়কর নয় যে এই দুটি ছন্দই অসংখ্য পুরাণ-কাহিনির জন্ম দিয়েছে। দিন-রাত চক্রটি পুরাণ-কাহিনিতে বিশেষ করে সমৃদ্ধ কারণ যে নাটকীয়তার সাথে সূর্যকে মনে হয় পূর্ব থেকে পশ্চিমে সরে যাচ্ছে। অনেকেই সূর্যকে সোনালি রথ হিসেবে দেখেছিলেন, আকাশের প্রান্তর জুড়ে যেটি চালনা করেন একজন দেবতা। 

অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা তাদের দ্বীপ মহাদেশে কমপক্ষে ৪০,000 বছর পৃথিবীর বাকি অংশ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল, আর পৃথিবী সম্বন্ধে সবচেয়ে প্রাচীন কিছু পুরাণ আছে তাদের। সেগুলো বেশিরভাগই ঘটেছিল ‘ড্রিমটাইম’ নামের একটি রহস্যময় যুগে, যখন পৃথিবী শুরু হয়েছিল; নানা জীব ও দানবাকৃতির পূর্বসূরি একটি জাতির সৃষ্টি হয়েছিল। আদিবাসী গোত্রগুলোর প্রত্যেকটিরই ভিন্ন ভিন্ন পুরাণ আছে এই ড্রিমটাইম সম্বন্ধে। নিচে বর্ণিত প্রথমটি এসেছে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার ফিন্ডার্স রেঞ্জের আদিবাসীদের কাছ থেকে। 

এই ড্রিমটাইমে, দুটি গিরগিটি ছিল, যারা পরস্পরের বন্ধু ছিল। একটি ছিল গোয়ানা [লার্জ মনিটর লিজার্ড বা গিরগিটিদের অস্ট্রেলীয় নাম] আর অন্যটি ছিল একটি গেকো [একটি চমৎকার ছোট গিরগিটি যার পায়ে সাকশন প্যাড থাকে, যা ব্যবহার করে কোনো উল্লম্ব দেয়ালে এটি অনায়াসে উঠতে পারে]। দুই বন্ধু আবিষ্কার করেছিল ‘সান-উওম্যান’ ও তার হলুদ ডিঙ্গো কুকুরের দল তাদের অন্য কিছু বন্ধুকে হত্যা করেছে। 

‘সান উওমেনের’ ওপর তীব্র ক্ষুব্ধ হয়ে, বড় গোয়ানা তার বুমেরাংটি তার দিকে ছুড়ে মারে এবং যা আকাশ থেকে সান-উওম্যানকে ছিটকে ফেলে দেয়। সূর্য অদৃশ্য হয়ে যায় পশ্চিম দিগন্তের ওপারে এবং সারা পৃথিবী ডুবে যায় অন্ধকারে। ব্যাপারটি দেখে দুই গিরগিটি খুবই ভয় পেয়ে যায় এবং আলোর ধারা অব্যাহত রাখতে সূর্যটাকে আকাশে ফিরিয়ে আনতে তারা মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে, গোয়ানা আরেকটা বুমেরাং নেয় এবার সে পশ্চিম দিক বরাবর ছুড়ে মারে, যেদিকে সূর্য হারিয়ে গেছে। আপনি হয়তো জানেন যে বুমেরাং খুব চমৎকার একটি অস্ত্র, এটি যে ছুড়ে মারে তার কাছে আবার সেটি ফিরে আসে। সুতরাং গিরগিটিরা আশা করেছিল বুমেরাং সূর্যকে ধরে আকাশে ফেরত নিয়ে আসবে। এটি তা করেনি। এরপর সব দিকে বুমেরাং ছুড়ে তারা চেষ্টা করেছিল, ক্ষীণ একটি আশায় যে সূর্যকে ঠিকই তারা খুঁজে পাবে। অবশেষে গোয়ানা গিরগিটির কাছে যখন একটিমাত্র বুমেরাং অবশিষ্ট ছিল, মরিয়া হয়ে সেটি সে পূর্বদিকে ছুড়ে মারে, এইবার যখন বুমেরাংটি ফিরে এসেছিল, সূর্যকে সাথে করে নিয়ে এসেছিল। এরপর থেকে, সূর্য সেই একইভাবে পশ্চিমে হারিয়ে যায় আবার পূর্বদিকে ফিরে আসে। 

সারা পৃথিবী জুড়েই বহু পুরাণ ও কিংবদন্তির কাহিনির এই একই অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যটি আছে : কোনো একটি নির্দিষ্ট ঘটনা ঘটেছিল একবার এবং তারপর, কখনোই যা ব্যাখ্যা করা হয় না এমন কোনো কারণে সেই ঘটনাটির পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে অনন্তকাল। 

আরেকটি আদিবাসী পুরাণ হচ্ছে এ রকম। এবারেরটি দক্ষিণ-পূর্ব অস্ট্রেলিয়ার। একবার কেউ ইমু [এক ধরনের অস্ট্রেলীয় অস্ট্রিচ] পাখির একটি ডিম আকাশের দিকে ছুড়ে মেরেছিল। ডিম থেকে সূর্যের জন্ম হয়েছিল এবং সেটি একগুচ্ছ জ্বালানিকাঠে আগুন জ্বালিয়ে দেয়, [কোনো এক কারণে] যেগুলো সেখানে আগে থেকে মজুত ছিল। আকাশ দেবতা লক্ষ করেন যে আলো তো মানুষের জন্য বেশ উপযোগী এবং তিনি তাঁর ভৃত্যদের নির্দেশ দেন এরপর থেকে প্রতি রাতে আকাশে প্রচুর পরিমাণে জ্বালানিকাঠ জড়ো করে রাখতে, যেন এরপরের দিনটিকে আলোকিত করার জন্যে যেন আগুন জ্বালানো যায়। 

দীর্ঘতর ঋতুচক্রের বিষয়টি সারা পৃথিবী জুড়ে বহু পুরাণ-কাহিনির বিষয়। উত্তর আমেরিকার আদিবাসীদের পুরাণগুলোয়, অন্য অনেক পুরাণের মতো, প্রায়শই প্রাণীদের চরিত্রের উপস্থিতি থাকে। এই গল্পটি পশ্চিম কানাডার টাহলটান আদিবাসীদের : একবার একটি ঋতুর দৈর্ঘ্য কতটা লম্বা হওয়া উচিত সেটি নিয়ে সজারু আর বিভারদের মধ্যে ঝগড়া লেগেছিল। সজারু চেয়েছিল শীত পাঁচ মাস লম্বা হোক, সে-কারণে সে তার পাঁচটি আঙুল তুলে দেখায়, কিন্তু বিভার চেয়েছিল শীত আরো কয়েক মাস বেশি থাকুক, তার লেজের খাঁজে দাগের সংখ্যার সমান। সজারু রেগে যায় এবং দাবি করে আরো ছোট শীতকালের। সে নাটকীয়ভাবে তার বুড়ো আঙুল খেয়ে ফেলে এবং বাকি চারটি আঙুল তুলে দেখায় এবং তারপর থেকে শীতকালের স্থায়িত্ব চারমাস। 

আমার কাছে এই পুরাণটি হতাশাজনক মনে হয়েছে বরং, কারণ এটি ইতোমধ্যেই ধারণা করে নিয়েছিল শীত ও গ্রীষ্ম দুটি কাল থাকবে এবং মাত্র ব্যাখ্যা করেছিল কেবল কোনটি কতটা দীর্ঘ হবে, পার্সিফোনির সেই গ্রিক পুরাণ এক্ষেত্রে সুবিচার করেছে অবশেষে। 

পার্সিফোনি ছিল গ্রিক পুরাণের প্রধান দেবতা জিউসের কন্যা। তার মা ছিল ডিমিটার, পৃথিবীর উর্বরতা আর ফসলের দেবী। পার্সিফোনিকে খুবই ভালোবাসত ডিমিটার, যাকে সে সাহায্য করত ফসলের দেখাশোনা করার জন্য, কিন্তু হেডিস, পাতালজগতের দেবতা, মৃতদের যেখানে বাস, সে-ও পার্সিফোনিকে ভালোবাসত। একদিন, যখন সে ফুলে ঢাকা কোনো মাঠে খেলছিল, একটি বিশাল ফাটল উন্মুক্ত হয়েছিল, সেই ফাটল দিয়ে পাতাল থেকে তার রথে চড়ে বেরিয়ে এসেছিল হেডিস। এরপর পাতালপুরীর রানি বানাতে পার্সিফোনিকে অপহরণ করে সে তার অন্ধকার রাজ্যে নিয়ে যায়। তাঁর প্রিয় কন্যার এই অপহরণের ঘটনায় ডিমিটার এতটাই শোকাহত হয়েছিলেন, তিনি সব শস্যের বেড়ে-ওঠা বন্ধ করে দেন, সারা পৃথিবীর মানুষ খাদ্যের অভাবে অনাহারে মরতে শুরু করেছিল। একপর্যায়ে জিউস পাতালপুরীতে গিয়ে পার্সিফোনিকে উদ্ধার করে আনতে দেবদূত হার্মিসকে পাঠিয়েছিলেন, যেন সে আলোর ও জীবিতদের পৃথিবীতে বাস করতে পারে। দুঃখজনকভাবে দেখা গিয়েছিল যে, পাতালপুরীতে থাকার সময় পার্সিফোনি ছয়টি ডালিমের বীজ খেয়ে ফেলেছিল এবং এর মানে হল [পুরাণ-কাহিনিসংশ্লিষ্ট যুক্তির দ্বারা, যা আমরা ইতোমধ্যে অভ্যস্ত হয়েছি তাকে অবশ্যই পাতালপুরীতে ফিরে যেতে হবে প্রতি বছর ছয় মাসের জন্য [প্রত্যেকটি ডালিমের বীজের জন্য একমাস]। সুতরাং পার্সিফোনি মাটির উপর বাস করে বছরের একটি অংশ, যা শুরু হয় বসন্তে এবং অব্যাহত থাকে গ্রীষ্ম অবধি। এই সময়ে, সব গাছ আর শস্য খুব ভালোভাবে বৃদ্ধি পায় এবং সবকিছুই আনন্দের এবং শীতের সময়, যখন সে হেডিসের কাছে ফিরে আসে কারণ সে বিরক্তিকর ডালিমের বিচি খেয়েছিল, তখন মাটি হয়ে যায় শীতল, শূন্য, কিছুই সেখানে জন্মায় না। 

দিন থেকে রাত আর শীত থেকে গ্রীষ্ম আসলেই কি পরিবর্তন হয়? 

যখনই খুবই নির্ভুল ছন্দময়তার সাথে কোনোকিছু পরিবর্তিত হয়, বিজ্ঞানী সন্দেহ করেন হয় কোনোকিছু পেন্ডুলামের মতো দুলছে অথবা কোনোকিছু চক্রাকারে ঘুরছে। আমাদের দৈনন্দিন আর ঋতু-নির্ভর ছন্দগুলোর ক্ষেত্রে কারণ হচ্ছে দ্বিতীয়টি। ঋতুচক্রের ছন্দকে প্রায় ৯৩ মিলিয়ন মাইল দূরত্বে অবস্থান করে, সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর বাৎসরিক প্রদক্ষিণ দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়। আর দৈনন্দিন ছন্দটিকে ব্যাখ্যা করেছে নিজের অক্ষের উপর লাটিমের মতো পৃথিবীর ঘূর্ণন। 

প্রতিদিন সূর্য আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে অতিক্রম করছে এমন বিভ্রমটি আসলেই একটি বিভ্রম। এটি আপেক্ষিক গতির একটি বিভ্রম। আপনি এই ধরনের বিভ্রম প্রায়শই দেখেছেন। আপনি একটি ট্রেনে বসে আছেন, যে ট্রেনটি একটি স্টেশনে আরেকটি ট্রেনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে, হঠাৎ করে মনে হবে যেন আপনিও ‘নড়তে’ শুরু করেছেন, কিন্তু তারপর আপনি অনুধাবন করতে পারবেন যে আসলেই আপনি আদৌ নড়ছেন না, দ্বিতীয় ট্রেনটি নড়ছে, বিপরীত দিক বরাবর। আমার মনে পড়ে এই বিভ্রমটি আমাকে কৌতূহলী করেছিল যখন আমি প্রথমবারের মতো ট্রেনে চড়েছিলাম। [আমার বয়স খুবই কম ছিল নিশ্চয়ই, কারণ প্রথম ট্রেনভ্রমণের সময় আরেকটা জিনিসও আমি ভুল বুঝেছিলাম। আমরা যখন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিলাম, আমার বাবা-মা বারবার বলছিলেন, ‘আমাদের ট্রেন শীঘ্রই আসবে’ বা ‘এই যে আমাদের ট্রেন আসছে’ আর ‘এখন এটা আমাদের ট্রেন।’ এটি আমাদের ট্রেন ছিল বলে আমি খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম কারণ আমি করিডোর ধরে হাঁটছিলাম, সবকিছু বিস্ময়ের সাথেই দেখছিলাম এবং খুব গর্ব হচ্ছিল কারণ আমি ভেবেছিলাম, পুরো ট্রেনটা আমাদের ‘নিজস্ব’]। 

আপেক্ষিক গতির এই বিভ্রম অন্যভাবেও কাজ করে। আপনি ভাবছেন যে অন্য ট্রেনটি নড়ে উঠল, পরে হয়তো আবিষ্কার করবেন আপনার নিজের ট্রেনটাই আসলে নড়ছে। আপাতদৃষ্টির গতি আর সত্যিকারের গতির মধ্যে পার্থক্য চিহ্নিত করা খুব কঠিন হতে পারে। ব্যাপারটা সহজ হয় যদি আপনার ট্রেনটি একটি হঠাৎ ধাক্কা দিয়ে নড়তে শুরু করে, কিন্তু সেটি ঘটে না যদি আপনার ট্রেনটি খুব মসৃণভাবে নড়তে শুরু করে। যখনই আপনার ট্রেনটি অপেক্ষাকৃত কম গতিসম্পন্ন ট্রেনটি অতিক্রম করে; নিজেকে মাঝে মাঝে বোকা বানাতে পারেন হয়তো এমনকিছু চিন্তা করে, আপনার ট্রেনটি দাঁড়িয়ে আছে আর অন্য ট্রেনটি ধীরে পিছন দিকে সরে যাচ্ছে। 

সূর্য আর পৃথিবীর জন্যে বিষয়টি একই। সূর্য অবশ্যই আমাদের আকাশে পূর্ব থেকে পশ্চিমে অতিক্রম করে না। আসলেই যা ঘটে তা হল পৃথিবী, মহাবিশ্বের প্রায় সবকিছুর মতোই [সূর্য নিজেও, বলে রাখা দরকার, কিন্তু আমরা বিষয়টি উপেক্ষা করতে পারি আপাতত] ঘুরছে। আমরা আরো সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারি পৃথিবী ঘুরছে এর ‘অক্ষের’ উপর, আপনি হয়তো অক্ষকে মনে করতে পারেন খানিকটা অ্যাক্সল বা অক্ষদণ্ডের মতো, যা উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু অবধি পৃথিবীর পুরো ভূমণ্ডল বরাবর বিস্তৃত। আপেক্ষিকভাবে সূর্য প্রায় স্থির থাকে পৃথিবীর সাপেক্ষে যদিও মহাবিশ্বের অন্য সবকিছুর সাপেক্ষে নয়, কিন্তু পৃথিবীর উপর আমাদের কাছে এটি কেমন মনে হয় আমি শুধু সেটা লিখব] আমরা এত মসৃণভাবে ঘুরি যেন কোনো নড়াচড়া অনুভব করতে পারি না এবং যে বাতাসে আমরা নিশ্বাস নেই সেটিও আমাদের সাথে ঘুরছে। যদি এটি না ঘুরত তাহলে আমরা এটিকে শক্তিশালী ঝড়ো বাতাস হিসেবে অনুভব করতাম। কারণ আমরা ঘুরছি প্রতি ঘণ্টায় প্রায় হাজার মাইল বেগে। অন্তত বিষুবীয় অঞ্চলে এমন কোনো গতিতে পৃথিবী ঘুরছে। অবশ্যই আমরা অপেক্ষাকৃত ধীরে ঘুরি, যতই আমরা উত্তর কিংবা দক্ষিণ মেরুর দিকে অগ্রসর হই, কারণ যে মাটির উপর আমরা দাঁড়ানো, নিজ অক্ষের উপর একবার ঘুরে আসার জন্য সেটির অপেক্ষাকৃত কম দূরত্ব ঘুরতে হবে। যেহেতু আমরা পৃথিবীকে ঘুরতে অনুভব করতে পারি না এবং বাতাস আমাদের সাথে ঘোরে, এটি দুটি ট্রেনের সেই উদাহরণের মতো। একটিমাত্র উপায়ে বলতে পারি আমরা ঘুরছি, তা হল এমন কোনোকিছুর দিকে তাকানো যা আমাদের সাথে ঘুরছে না : যেমন নক্ষত্র আর সূর্যের মতো কিছু। আমরা যা দেখতে পাই সেটি আপেক্ষিক গতি এবং ঠিক ট্রেনের মতোই—দেখে যেন মনে হয় আমার স্থির দাঁড়িয়ে আছি আর সূর্য আর নক্ষত্রগুলো আকাশ অতিক্রম করে যাচ্ছে। 

একজন বিখ্যাত দার্শনিক, ভিটগেনস্টাইন একবার তাঁর এক বন্ধু আর ছাত্র এলিজাবেথ অ্যান্সকোম্বকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘পৃথিবী নিজের অক্ষের উপর ঘুরছে’ এমনকিছু ভাবার চেয়ে মানুষ কেন ‘সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে’—এমন ভাবনাটিকে খুব স্বাভাবিক মনে করে? মিস অ্যান্সকোম্ব উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমার মনে হয় এমন ভাবার কারণ হচ্ছে দেখলে এমন মনে হয় যে সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে।’ ‘বেশ, ভিটগেনস্টাইন উত্তর দিয়েছিলেন, ‘তাহলে কিসের মতো দেখতে মনে হবে, যদি দেখে মনে হত পৃথিবী এর নিজের অক্ষের উপর ঘুরছে?’ সেটির উত্তর দেয়ার জন্যে আপনি চেষ্টা করুন। 

যদি পৃথিবী ঘণ্টায় হাজার মাইল গতিতে ঘোরে, কেন তাহলে আমরা যখন উপরের দিকে লাফ দেই, আবার ঠিক সেই একই জায়গায় ফিরে আসি? বেশ, যদি আপনি ঘণ্টায় ১০০ মাইল গতি ছোটা কোনো ট্রেনে ভ্রমণ করেন, আর আপনি যদি সেখানে উপরে লাফ দিতে পারেন, দেখবেন আবার ঠিক একই জায়গায় ফিরে আসবেন। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন ট্রেনের কারণে আপনি সামনে ছিটকে পড়বেন যখন আপনি উপরে লাফ দেবেন, কিন্তু তেমন কিছু মনে ঘটে না, কারণ সবকিছুই একই গতিতে সামনে চলছে। আপনি ট্রেনে একটি বল উপরে ছুড়ে দিতে পারেন এটি আবার সরাসরি নিচে নেমে আসে, আপনি ট্রেনে কোনো সমস্যা ছাড়াই পিং পং খেলতে পারবেন। যতক্ষণ-না এটি মসৃণভাবে চলছে এবং গতির কোনো দ্রুত তারতম্য ঘটছে না বা বাঁক খাচ্ছে না [কিন্তু শুধুমাত্র বন্ধ কোনো রেলগাড়ির কামরায়, কারণ যদি আপনি খোলা ট্রাকে পিং-পং খেলতে যান, তাহলে বলটি বাতাসে উড়ে যাবে, কারণ বন্ধ কোনো কামরায় বাতাস আপনার সাথে আসে, খোলা ট্রাকে নয়]। আপনি যখন বদ্ধ লেকামরায় একটি স্থির গতিতে ভ্রমণ করবেন, যত দ্রুত হোক-না কেন, আপনি মোটামুটি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন, পিং-পং আর যা- কিছুই ঘটুক-না কেন ট্রেনে। তবে, যদি ট্রেনের গতি বাড়তে থাকে [অথবা গতি মন্থর হতে থাকে] এবং আপনি উপরে লাফ দেন, আপনি অন্য একটি জায়গায় এসে নামবেন। গতি দ্রুত বা ধীর হতে থাকা ট্রেনে পিং-পং খুবই অদ্ভুত একটি খেলা হবে, যদিও কামরার ভিতরের বাতাস মৃত সেই কামরা সাপেক্ষে। আমরা এই বিষয়টিতে পরে আলোচনায় আসব, মহাকাশ স্টেশনে আপনি যদি উপরে কিছু ছুড়ে মারেন সেটির কী হয় সেই সংক্রান্ত আলোচনার সংযোগে। 

ঘড়ি ধরে কাজ আর ক্যালেন্ডার 

রাত একসময় দিন হয়, দিনশেষে আবার রাত আসে, এটি ঘটে যখন পৃথিবীর যে অংশে আমরা বাস করি সেটি ঘুরে সূর্যের মুখোমুখি হয় আর তারপর আবার ঘুরে এর ছায়ার দিকে চলে যায়, কিন্তু অন্ততপক্ষে যাঁরা বিষুবরেখা থেকে দূরে বাস করেন, সেখানে গ্রীষ্মের উষ্ণ দিনে সংক্ষিপ্ত রাত আর দীর্ঘ দিন থেকে শীতকালের দীর্ঘ রাত আর শীতল সংক্ষিপ্ত দিনের ঋতুকালীন পরিবর্তন বেশ নাটকীয় মনে হয়। 

রাত আর দিনের পার্থক্যটি খুবই নাটকীয়—এতই নাটকীয় যে বেশিরভাগ প্রজাতির প্রাণী হয় দিনে নয়তো রাতে সফলভাবে তাদের জীবন কাটাতে পারে, কিন্তু দুটোতেই নয়। তারা সাধারণত ঘুমায় তাদের ‘অফ’ পর্বে। মানুষ আর বেশিরভাগ পাখি রাতে ঘুমায় দিনের বেলায় বেঁচে থাকার কাজটি করার জন্য। সজারু আর জাগুয়ার ও আরো অনেক স্তন্যপায়ী প্রাণী রাতে কাজ করে এবং দিনে ঘুমায়। 

একইভাবে, প্রাণীদেরও শীত-গ্রীষ্মের পার্থক্য আর পরিবর্তনের সাথে সাথে খাপ খাইয়ে নেবার জন্য ভিন্ন ভিন্ন উপায় আছে। বহু স্তন্যপায়ী প্রাণীদের, পুরু, লোমশ চামড়া থাকে শীতে ঠাণ্ডা মোকাবেলা করার জন্য, যা তারা বসন্তের সময় ঝরিয়ে ফেলে। বহু পাখি, স্তন্যপায়ীয়ও, মাইগ্রেট বা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাত্রা করে, কখনো বহু দূরে দেশান্তরী হয়, যারা তাদের শীতকালটা কাটায় বিষুবীয় অঞ্চলের কাছাকাছি। তারপর আবার তারা ফিরে আসে উচ্চ দ্রাঘিমায় [আরো উত্তরে অথবা আরো দক্ষিণে] গ্রীষ্মকাল কাটানোর জন্য। যখন দীর্ঘ দিন আর সংক্ষিপ্ত রাত প্রচুর পরিমাণে খাদ্যের সংস্থান করে। আর্কটিক টার্ন নামের একটি সামুদ্রিক পাখি এই বিষয়টিকে অস্বাভাবিক মাত্রায় নিয়ে গেছে। এরা উত্তর মেরুতে তাদের উত্তরের গ্রীষ্মকাল কাটায়, তারপর উত্তরে শরতের সময় এটা দক্ষিণে দিকে যাত্রা করে, কিন্তু তারা কোনো ক্রান্তীয় অঞ্চলে থামে না, তারা পুরো পথ উড়ে যায় দক্ষিণ মেরুর অ্যান্টার্কটিকায়। বইতে মাঝে মাঝে আন্টার্কটিকাকে বলা হয় আর্কটিক টার্ন পাখিদের উইনটারিং গ্রাউন্ড, শীত কাটাবার এলাকা, কিন্ত অবশ্যই সেটি ঠিক নয়। কারণ যখন তারা দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছায় তখন সেখানে দক্ষিণ গোলার্ধের গ্রীষ্মকাল। এই পরিযায়ী পাখিগুলো এত দূরে দেশান্তরী হয় যে এটা দুটি গ্রীষ্মকাল পায় : এদের শীতকাল কাটাবার এলাকা নেই, কারণ এর কোনো শীতকাল নেই। আমার এক বন্ধুর কৌতুক মন্তব্য আমার মনে পড়ে, যিনি গ্রীষ্মের সময় ইংল্যান্ডে কাটান, আর শীতকালের কঠিন সময় কাটাতে চলে যান ক্রান্তীয় আফ্রিকায়। 

অন্য আরেকটি উপায়ে প্রাণীরা শীতকে এড়িয়ে চলে, সেটি হচ্ছে শীতের পুরো সময়টি ঘুমিয়ে পার করে দেয়া, যাকে বলে ‘হাইবারনেশন’, ল্যাটিন শব্দ HIbernus থেকে উদ্ভূত এই শব্দটির অর্থ ‘শীত’। বহু স্তন্যপায়ীদের মধ্যে যেমন আছে ভালুক আর কাঠবিড়ালী, এছাড়াও আরো অনেক প্রাণী শীতকালটি ঘুমিয়ে কাটায়। কিছু প্রাণী পুরো শীতেই একটানা ঘুমায়, কেউ অধিকাংশ সময় ঘুমায় তবে মাঝে মাঝে জেগে ওঠে সামান্য একটি অলস কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে, তারপর তারা আবার ঘুমিয়ে পড়ে। সাধারণত তাদের শরীরের তাপমাত্রা নাটকীয়ভাবে হ্রাস পায়, তাদের শরীরের সব কর্মকাণ্ড ধীর হয়ে প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম হয় : তাদের ভিতরের ইঞ্জিন কোনো কাজ করে না বললেই চলে। আলাস্কায় একটি ব্যাঙ আছে যারা জমে কঠিন বরফ হয়ে যায়, কিন্তু বসন্তের সময় আবার গলে জীবন্ত হয়ে ওঠে। 

সেই প্রাণীগুলো, আমাদের মতো, শীত এড়াতে যারা হাইবারনেট বা মাইগ্রেট করে না তাদেরও খাপ খাইয়ে নিতে হয় ঋতু পরিবর্তনের সাথে। পাতা বেরিয়ে আসে বসন্তে, হেমন্তে পড়ে যায় [আর এ কারণে আমেরিকায় এই সময়টাকে ‘ফল’ বলা হয়ে থাকে], সুতরাং গ্রীষ্মে গাছ থাকে সমৃদ্ধ সবুজ এবং পাতাশূন্য হয়ে যায় যা শীতে। ভেড়ার বাচ্চার জন্ম হয় বসন্তে, যেন তারা উষ্ণ তাপমাত্রার সুফল পেতে পারে এবং নতুন ঘাস পায় যখন তারা বড় হতে থাকে। আমাদের গায়ে লোমশ কোনো চামড়া নেই, কিন্তু আমরা প্রায়ই সেগুলো পরি। 

সুতরাং ঋতু পরিবর্তন আমরা উপেক্ষা করতে পারি না, কিন্তু আমরা কি সেটি বুঝতে পারি? বহু মানুষই বোঝেন না। কিছু মানুষ বোঝেন না যে সূর্যের চারপাথে একবার ঘুরে আসতে পৃথিবীর সময় লাগে এক বছর এবং আসলেই সেটাই হচ্ছে ‘বছর’। জরিপ অনুযায়ী ১৯ শতাংশ ব্রিটিশ জানেন যে এর জন্য মাত্র ১ মাস সময় লাগে, ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোতে একই শতাংশ মানুষও তাদের অজ্ঞতার প্রমাণ দিয়েছেন। 

এক বছর বলতে কী বোঝায়, যাঁরা বোঝেন, তাঁদের মধ্যে বহু মানুষই আছেন যাঁরা ভাবেন, পৃথিবী গ্রীষ্মের সময় সূর্যের কাছাকাছি চলে আসে আর শীতে বহুদূরে সরে যায়। একজন অস্ট্রেলিয়ানকে এই কথাগুলো বলে দেখেন, যারা বিকিনি পরে ক্রিসমাস ডিনার বার্বিকিউ করে খায়। যে মুহূর্তে মনে হবে যে দক্ষিণ গোলার্ধে ডিসেম্বর হচ্ছে মধ্য-গ্রীষ্ম আর জুন হচ্ছে মধ্য-শীত, আপনি অনুধাবন করতে পারবেন যে ঋতু পরিবর্তনের কারণ সূর্যের কাছে পৃথিবীর আপেক্ষিক দূরত্বের ওপর নির্ভর করে না। নিশ্চয়ই অন্য কোনো ব্যাখ্যা আছে। 

কিন্তু সেই ব্যাখ্যায় আমরা বেশিদূর অগ্রসর হতে পারব না যতক্ষণ- না আমরা দেখব, প্রথমত হেভেনলি বডি বা মহাজাগিতক কোনো বস্তু অন্য আরেকটি মহাজাগতিক বস্তুর চারপাশে প্রদক্ষিণ করছে। সেটাই আমরা এরপর করব। 

কক্ষপথে 

কেন গ্রহগুলো সূর্যের চারপাশে ঘোরার সময় তাদের কক্ষপথে থাকে? কেনই-বা কোনোকিছু অন্য কোনোকিছুর চারপাশে ঘোরার সময় একটি কক্ষপথে থাকে? এটি প্রথম বুঝেছিলেন সপ্তদশ শতাব্দীতে স্যার আইজাক নিউটন, পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছেন এমন সেরা বিজ্ঞানীদের একজন। নিউটন দেখিয়েছিলেন যে সব কক্ষপথগুলোই নিয়ন্ত্রণ করে মাধ্যাকর্ষণ— সেই একই শক্তি যা পড়ন্ত আপেলকে মাটির দিকে টানে, তবে আরো বড় মাত্রায়। [হায়, মাথার উপর একটি আপেল পড়ার পর নিউটন এই ধারণাটি পেয়েছিলেন এমন কাহিনি সম্ভবত আসলেই সত্য নয়] 

নিউটন খুব উঁচু পাহাড়ের উপর রাখা একটি কামানের কথা ভেবেছিলেন, যেখানে এর ব্যারেলটি আনুভূমিকভাবে [ভূমির সমান্তরাল] সমুদ্রের দিকে মুখ করা আছে [পাহাড়টি সাগরতীরে অবস্থিত]। প্রতিটি কামানের গোলা, যা এর থেকে বের হয় প্রথমে এটি আনুভূমিকভাবে যাত্রা শুরু করে এবং একই সাথে এটি সমুদ্রের দিকে পড়তে থাকে। সমুদ্রের উপর এই গতি ও সমুদ্রের দিকে পড়ে যাওয়ার মিশ্রণ তৈরি করে একটি চমৎকার নিম্নমুখী বক্ররেখা, যা পানির মধ্যে গোলাটি পড়ার সাথে শেষ হয়। গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিসটি এখানে বুঝতে হবে সেটি হচ্ছে বলটি সবসময়ই নিচের দিকে পড়ছে, এর শুরুর অপেক্ষাকৃত আনুভূমিক অংশেও। এমন কিন্তু নয় যে এটি কিছুক্ষণ শুধুমাত্র আনুভূমিকভাবে এগিয়ে যায়, তারপর হঠাৎ করেই মন পরিবর্তন করে কার্টুনের কোনো চরিত্রের মতো, যে অনুধাবন করে যে তার এখন নিচে পড়া দরকার, সুতরাং সে নিচে পড়তে শুরু করে! 

কামানের গোলা যে মুহূর্তে এর কামান ত্যাগ করছে তখন থেকেই এটি নিচের দিকে পড়তে শুরু করে, কিন্তু, আপনি সেই নিম্নগামী গতিটি দেখতে পাবেন না কারণ বলটি [প্রায়] আনুভূমিকভাবে গতিশীল এবং বেশ দ্রুতগামী 

বেশ এবার আমাদের সেই কামানটিকে আরো বড় আর শক্তিশালী বানানো হোক, যেন গোলাটি বহু মাইল অতিক্রম করে যেতে পারে অবশেষে পানিতে পড়ার আগে। তখনো একটি নিম্নমুখী বক্রাকার পথ থাকবে, কিন্তু পরিবর্তনটি হবে খুব ধীর, খুব ‘সমতল’ একটি বক্ররেখা- পথ। গতির দিক প্রায় পুরোটাই আনুভূমিক অনেকটুকু পথ ধরে, কিন্তু তা সত্ত্বেও এটি সারাক্ষণই নিচের দিকে পড়ছে। 

আসুন, আমরা বড় থেকে আরো বড় আর আরো বেশি শক্তিশালী কামানের কথা কল্পনা করতে থাকি। এত শক্তিশালী যে বলটি সমুদ্রে পড়ার আগে আসলেই বহু দূর পথ অতিক্রম করতে পারে। এখন পৃথিবীর বক্রতা এর নিজেকে অনুভূত করাতে শুরু করে। পুরো সময়টি জুড়ে বলটি তখনো ‘নিচের দিকে পড়ছে’, কিন্তু যেহেতু গ্রহের পৃষ্ঠদেশ বাঁকা, ‘আনুভূমিক’ বিষয়টি এখন খানিকটা অদ্ভুত বিষয়ে রূপান্তরিত হয়। কামানের গোলাটি এখনো চমৎকার বাঁকা পথে যেতে থাকে, আগের মতো, কিন্তু এটি ধীরে ধীরে সমুদ্রের দিকে বাঁকা হয়ে যায়, কিন্তু সমুদ্র এর থেকে বাঁকা হয়ে দূরে সরে যায়, কারণ গ্রহ হচ্ছে গোলাকৃতির। সুতরাং কামানের গোলাটির অবশেষে মাটিতে পড়তে আরো অনেক বেশি সময় লাগে। এটি সারাক্ষণই পড়েছে, কিন্তু এটি পড়ছে গ্রহের ‘চারপাশে”। 

যুক্তিটি কিভাবে অগ্রসর হচ্ছে সেটি আপনি বুঝতে পারছেন, আমরা এখন এমন একটি কামানের কথা কল্পনা করব যে এটি এত শক্তিশালী হবে যে এর থেকে গোলাটি পৃথিবীর চতুর্দিকে তার ঘোরা অব্যাহত রাখে যতক্ষণ-না সেটি যেখান থেকে শুরু করেছিল সেখানে আবার ফিরে আসে। এটি কিন্তু তখনো নিচের দিকে ‘পড়ছে’, কিন্তু এর পতনের বক্রপথটির সাথে পৃথিবীর বক্রতাও মিলে যায় সুতরাং এটি গ্রহের চারপাশে ঘুরতে থাকে কখনোই সমুদ্রের কাছে না এসে। এখন এটি একটি ‘কক্ষপথে’ এবং এটি তার কক্ষপথে ঘোরা অব্যাহত রাখে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য, যদি আমরা মনে করে নেই, বাতাসের কোনো প্রতিরোধ নেই যা কিনা এর গতি মন্থর করে দিতে পারে [বাস্তবে সেটি যা করে] এটি তারপরও পড়তে থাকে, কিন্তু তার পতনের চমৎকার দীর্ঘ বক্রপথটি আরো দীর্ঘ হবে পৃথিবীর চারপাশে, যা এর চারপাশে প্রদক্ষিণ করবে বার বার। এটি এমনভাবে আচরণ করবে যেন ক্ষুদ্রাকৃতির কোনো চাঁদ। আসলেই এটাই হচ্ছে স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ, কৃত্রিম ‘চাঁদ’। তারা সবাই ‘পড়ে’ যাচ্ছে কিন্তু কখনোই আসলে পড়ে যাচ্ছে না। দীর্ঘ- -দূরত্বের টেলিফোন বার্তা আদানপ্রদান বা টেলিভিশন সংকেত সম্প্রচার করার জন্যে যে উপগ্রহগুলো ব্যবহার করা হয় সেগুলো একটি বিশেষ কক্ষপথে থাকে, যাকে ‘জিওস্টেশনারি অরবিট’ বলা হয়ে থাকে। এর মানে হচ্ছে যে হারে তারা পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে সেটি খুবই বুদ্ধিমানের সাথে সাজানো যেন পৃথিবীর এর নিজের অক্ষের উপর যে হারে ঘুরছে তার সাথে মিলে যায়। এর মানে, তারাও পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ১ বার। এর মানে আপনি যদি চিন্তা করে দেখেন, তারা সবসময়ই পৃথিবীপৃষ্ঠের ঠিক একই জায়গার উপরে স্থির হয়ে ভেসে আছে। এ কারণে আপনি আপনার স্যাটেলাইট ডিশ কোনো নির্দিষ্ট স্যাটেলাইটের দিকে ফেরাতে পারেন, যেগুলো টেলিভিশন সিগনাল নিচে পাঠাচ্ছে। 

যখন কোনো একটি বস্তু, যেমন—একটি স্পেস স্টেশন, কক্ষপথে থাকে, এটি সবসময়ই ‘নিচে পড়েছে’ এবং সেই স্টেশনে থাকা সবকিছু, যাদের ভারী কিংবা হালকা যা কিছ আমরা ভাবি-না কেন, তারাও একটি হারে নিচে পড়ছে। কিছুক্ষণের জন্যে বিরতি নেয়ার ভালো মুহূর্ত এটি এবং এখানে, ভর আর ওজনের মধ্যে পার্থক্যটি ব্যাখ্যা করা দরকার, আগের অধ্যায়ে যেমন আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। 

কক্ষপথে ঘুরতে থাকা কোনো স্পেস স্টেশনের সবকিছুই ওজনহীন, কিন্তু তারা ভরশূন্য নয়। তাদের ভর, যেমন আমরা দেখেছিলাম আগের অধ্যায়ে, নির্ভর করে প্রোটন আর নিউট্রনের সংখ্যার ওপর যা তারা ধারণ করে। আর ওজন হচ্ছে এই ভরের ওপরই মাধ্যাকর্ষণের টান। পৃথিবীতে আমরা ওজন ব্যবহার করতে পারি ভর মাপার জন্য কারণ এই টানটা [কম-বেশি] একই সবজায়গায়। যেহেতু বড় গ্রহগুলোর শক্তিশালী ম্যাধ্যাকর্ষণ শক্তি আছে, আর সে-কারণে আপনি কোন গ্রহের উপর আছেন তার ওপর নির্ভর করে আপনার ওজনও বদলে যায়, কিন্তু আপনার ভর আপনি যেখানেই থাকুন-না কেন একই থাকছে, যখন আপনি কক্ষপথে ঘুরতে থাকা কোনো স্পেস স্টেশনে সম্পূর্ণ ওজনহীন। স্পেস স্টেশনে আপনি ওজনহীন হবেন কারণ আপনি ও ওয়েট মেশিন উভয়ে একই হারে নিচে পড়েছে [যাকে বলা হয় ‘ফ্রি ফল’], সুতরাং আপনার পা ওয়েট মেশিনের উপর কোনো চাপ প্রয়োগ করতে পারবে না, যে যন্ত্রটি আপনাকে ওজনহীন দেখাবে। 

কিন্তু যদিও আপনি ওজনহীন হবেন, কিন্তু আপনি ভরশূন্য হবেন না। আপনি যদি জোরে স্পেস স্টেশনের ‘মেঝে’ থেকে লাফ দেন, আপনি ‘ছাদের’ দিকে চলে যাবেন [কোনটি মেঝে আর কোনটি ছাদ, সেটি খুব বেশি স্পষ্ট হবে না] আর ছাদ যতদূরেই থাকুক-না কেন আপনার মাথা সেখানে বাড়ি খাবে, আপনি ব্যথাও পাবেন, ঠিক তেমনভাবেই, যদি আপনি আপনার মাথার উপর পড়তেন এবং স্পেস স্টেশনের বাকি সবকিছুর নিজস্ব ভর থাকবে তখনো। যদি কোনো কামানের গোলা আপনার সাথে কেবিনে থাকে, এটি ওজনহীনভাবে উড়ে বেড়াবে, যা হয়তো আপনাকে চিন্তা করতে বাধ্য করাবে যে এটি হয়তো একই আকারের কোনো ছোট বলের মতো হালকা। কিন্ত যদি আপনি সেটি ছোড়ার চেষ্টা করেন, খুব তাড়াতাড়ি আপনি জানতে পারবেন এটি বিচ বলের মতো এটি হালকা কিছু নয়। আপনি চেষ্টা করলে হয়তো দেখবেন এটি ছোড়া বেশ কঠিন কাজ, আপনি যেদিকে চেষ্টা করছেন, হয়তো দেখা যাবে আপনি এর উল্টোদিকে ছিটকে পড়েছেন। কামানের গোলাটিকে ভারী অনুভূত হবে, যদিও এটি কোনো বিশেষ প্রবণতা দেখাবে না স্পেস স্টেশনের মেঝে বরাবর নিচে যাবার। সেই কেবিনের মধ্যে আপনি যদি সফল হন এটিকে ছুড়ে মারতে, এটি আর যে-কোনো একটি ভারী বস্তুর মতোই ব্যবহার করবেন যখন সেটি তার গতিপথে কোনোকিছুকে আঘাত করবে, আর বিষয়টি ভালো হবে না, সরাসরি অথবা দেয়াল থেকে ধাক্কা খেয়ে ফেরার সময় যদি সেটি আপনার সহযাত্রী নভোচারীর মাথায় আঘাত করে। যদি এটি আরেকটি কামানের গোলাকে আঘাত করে, তাহলে এটি একটার সাথে ধাক্কা খেয়ে সরে যাবে সঠিক ভারী কোনো অনুভূতি নিয়ে এবং ধরুন, পিং-পং বলের ব্যতিক্রম, যারা পরস্পরের সাথে ধাক্কা খাবে হালকাভাবে। আমি আশা করছি সেটি আপনাকে ওজন আর ভরের মধ্যে একটি পার্থক্য সম্বন্ধে অনুভূতি দেবে। স্পেস স্টেশনে, একটি কামানের গোলার ভর একটি বেলুনের চেয়ে অনেক বেশি, যদিও দুজনের ওজন একই—শূন্য। 

ডিম, উপবৃত্ত আর মাধ্যাকর্ষণ থেকে পালানোর মুক্তিবেগ 

পাহাড়চূড়ায় আমাদের সেই কামানের কাছে ফেরা যাক আবার এবং এটিকে আরো বেশি শক্তিশালী করি আমরা। কী হতে পারে? বেশ, বিখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী ইয়োহানেস কেপলারের আবিষ্কারের সাথে নিজেদের পরিচিত করানো এখন প্রয়োজন, যিনি বেঁচে ছিলেন নিউটনের জীবনের ঠিক আগে অবধি। তিনি দেখিয়েছিলেন যে চমৎকার সেই কার্ভ বা বক্রপথগুলো যার মাধ্যমে কোনোকিছু মহাশূন্যে তাদের কক্ষপথে ঘোরে, সেগুলো আসলে বৃত্তাকার নয় বরং এমনকিছু যা প্রাচীন গ্রিক গণিতজ্ঞদের কাছে পরিচিত ছিল EllIpse বা উপবৃত্ত নামে। উপবৃত্ত বা এলিপস’রা খানিকটা ডিম্বাকৃতির [শুধুমাত্র খানিকটা, কারণ ডিম নিখুঁত এলিপস নয়]। একটি বৃত্ত হচ্ছে বিশেষ ধরনের একটি এলিপস। একটি খুব ভোঁতা ডিমের কথা ভাবুন, এতই ছোট আর চ্যাপ্টা যে এটি দেখতে একটি পিং-পং বলের মতো। 

এলিপস বা উপবৃত্ত আঁকার একটি সহজ উপায় আছে, একই সাথে যখন আপনি নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারবেন যে বৃত্ত আসলেই একটি বিশেষ ধরনের এলিপস। একটুকরো সুতো নিন এবং এটি দিয়ে একটি লুপ তৈরি করুন এর দুটি প্রান্ত জোড়া লাগিয়ে, আপনার পক্ষে যতটা সম্ভব ছোট আর পরিষ্কার একটি গিঁট দিয়ে। এবার কাগজের এটি প্যাডে একটি পিন লাগান, এরপর পিন-এর চারপাশে সুতার লুপটি রাখুন, লুপের অন্য প্রান্তে একটি পেন্সিল রেখে টেনে ধরুন এরপর পিনের চারপাশে পেন্সিলের দাগ দিন লুপটিকে সবচেয়ে দূরে টেনে ধরে। অবশ্যই আপনি একটি বৃত্ত আঁকবেন। 

এরপর, দ্বিতীয় আরেকটি পিন নিয়ে প্যাডের উপর লাগান, প্রথম পিনের কাছেই যেমন তারা গায়ে গায়ে লেগে থাকে। এবারো একইভাবে আপনি যা আঁকবেন সেটিও বৃত্ত হবে, কারণ দুটি পিন এত কাছাকাছি তাদের একটি পিন হিসেবে বিবেচনা করা যায়, কিন্তু এখন মজার অংশটি হচ্ছে এটি, পিন দুটি কয়েক ইঞ্চি দূরত্বে রাখুন, এখন যখন সুতাটা সর্বোচ্চ টেনে আপনি আকারটি আঁকবেন, সেটি বৃত্ত হবে না, এটি ‘ডিম্বাকৃতির একটি এলিপস হবে। আপনি যত দূরে পিনগুলো রাখবেন ততই সংকীর্ণ হবে এলিপসটি। আর যত কাছে রাখবেন, আরো বিস্তৃত আর আরো বৃত্তাকার হবে, সেই উপবৃত্তটি, যখন দুটি পিনই এক হয়ে যাবে—এলিপস হবে বৃত্তাকার—একটি বিশেষ কেস। 

এখন যখন আমরা উপবৃত্তটির সাথে পরিচিত হয়েছি আমরা সেই অতি-শক্তিশালী কামানের কাছে ফিরে যেতে পারি। এটি ইতোমধ্যে একটি কামানের গোলাকে কক্ষপথে ছুড়ে মেরেছে, যা আমরা মনে করে নিচ্ছি প্রায় বৃত্তাকার। এখন যদি আমরা এটিকে আরো শক্তিশালী করি, যা ঘটে তা হল কক্ষপথটি আরো বেশি ‘প্রসারিত’ হয়ে যায়, একটি কম বৃত্তকার উপবৃত্ত। এটিকে বলে একটি ‘একসেন্ট্রিক’ বা কেন্দ্রাপসারী কক্ষপথ। আমাদের সেই কামানের গোলাটি পৃথিবী থেকে বহু দূরে চলে যাবে, তারপর এটি ঘুরে আবার ফিরে আসবে পেছনের দিকে। পৃথিবী এখন দুটি ‘পিনের’ একটি। কঠিন কোনো পদার্থ হিসেবে অন্য পিনটির কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই, মহাশূন্যে আপনি এটিকে কাল্পনিক একটি পিন হিসেবে ভেবে নিতে পারেন। কাল্পনিক পিন কিছু মানুষের জন্য গণিতকে বোধগম্য করে তোলে কিন্তু যদি এটি আপনাকে সংশয়গ্রস্ত করে তাহলে বিষয়টি ভুলে যান। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে অনুধাবন করা পৃথিবীর অবস্থান এই ‘ডিমের’ কেন্দ্রে নয়। কক্ষপথটি পৃথিবী থেকে একদিকে অনেক দূর অবধি বিস্তৃত [কাল্পনিক পিনের দিকে] অন্য দিকে তুলনায় [ যে দিকে পৃথিবী নিজেই একটি পিন]। 

আমরা আমাদের সেই কামানকে আরো বেশি শক্তিশালী করা অব্যাহত রাখি। কামানের গোলাটি এখন পৃথিবী থেকে অনেক অনেক দূর পথ অতিক্রম করে এবং শুধুমাত্র পেছনের দিকে ঘুরছে পৃথিবীর দিকে পড়ে যাবার জন্য। উপবৃত্তটি আসলেই এখন অনেক দীর্ঘ আর প্রলম্বিত এবং একসময় এমন এটি মুহূর্ত আসবে, যখন এটি আর কোনো উপবৃত্ত থাকবে না : আমরা যদি কামানের গোলাটি আরো দ্রুতগতিতে ছুড়তে পারি, তাহলে বাড়তি গতিটি এটিকে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে যাবে, যেখান থেকে আর এটি ফিরতে পারবে না, যেখানে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ এটিকে তার দিকে ডেকে আনতে পারবে না। এটি সেই ‘এসকেপ ভেলোসিটি’ বা মুক্তিবেগে পৌঁছায় এবং চিরকালের জন্য অদৃশ্য হয়ে যায় [অথবা আবার এটিকে অন্য কোনো মহাজাগতিক বস্তুর মাধ্যাকর্ষণ না ধরে ফেলে, যেমন—সূর্য]। 

আমাদের ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকা কামান প্রদর্শন করেছে যে- কোনো একটি কক্ষপথ প্রতিষ্ঠা হবার আগের ও পরের সব পর্যায়গুলো। প্রথমে গোলাটি শুধুমাত্র পানিতে পড়ে যাবে, তারপর, যখন আমরা ক্রমশ আরো শক্তি আর দ্রুততার সাথে কামানের গোলা ছুড়ে মারতে থাকব, তাদের গতিপথের বক্ররেখাটি ক্রমেই আরো আনুভূমিক হবে যতক্ষণ-না অবধি বলটি সেই প্রয়োজনীয় গতিতে না পৌঁছায় একটি প্রায় বৃত্তাকার কক্ষপথে প্রবেশ করার জন্য [মনে রাখবেন যে বৃত্ত হচ্ছে একটি বিশেষ ধরনের উপবৃত্ত]। তারপর, গোলার গতি যখন আরো আরো বেশি বাড়বে, তখনো কক্ষপথটি ক্রমেই কম বৃত্তাকার আর লম্বাটে হতে থাকবে, আরো বেশি উপবৃত্তাকার। অবশেষে, উপবৃত্ত এত বেশি লম্বাটে হয়ে যাবে যে এটি আর উপবৃত্তও থাকবে না, গোলাটি এসকেপ ভেলোসিটিতে পৌঁছাবে এবং পুরোপুরি হারিয়ে যাবে। 

সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর কক্ষপথ কারিগরিভাবে একটি উপবৃত্ত, কিন্তু এটি প্রায় বৃত্তেরই বিশেষ একটি রূপ। এটাই সত্য বাকি সব গ্রহের জন্য শুধুমাত্র প্লুটো ছাড়া [যাকে অবশ্য এখন কোনো গ্রহ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না]। একটি কমেট বা ধূমকেতুর কক্ষপথ খুব লম্বা পাতলা ডিমের মতো। যে পিন আপনি ব্যবহার করবেন এই ধরনের উপবৃত্ত আঁকতে তারা আসলেই বহু দূরে অবস্থিত। 

ধূমকেতুর জন্য দুটি ‘পিনের’ একটি হচ্ছে সূর্য। আবারো, অন্য ‘পিনটি’ মহাশূন্যে সত্যিকারের কোনো বস্তু নয় : আপনাকে সেটি অবশ্যই কল্পনা করে নিতে হবে। যখন কোনো ধূমকেতু সূর্য থেকে এর সবচেয়ে দূরে [যাকে বলে AphelIon – যার উচ্চারণ অ্যাপ-হি-লিওন- অ্যাপহিলিয়ন], এটি ধীরে প্রদক্ষিণ করে। সবসময়ই এটি নিচের দিকে পড়ছে, কিন্তু কখনো এটি সূর্য থেকে অন্যদিকে বাইরে পড়ে যায়, এটির দিকে না পড়ে। ধীরে ধীরে এটি অ্যাপহেলিওনের কোনাটা ঘুরে আসার পর আবারো এটি সূর্যের দিকে পড়তে থাকে, দ্রুত থেকে দ্রুততর যতক্ষণ- না এটি সূর্যের চারপাশে ঘুরে না আসে [অন্য ‘পিনটি’] এবং সর্বোচ্চ গতিতে পৌঁছায় যখন এটি সূর্যের সবচেয়ে কাছে পৌঁছায়, যাকে বলে পেরিহেলিওন [পেরিহেলিওন আর অ্যাপহেলিওন নামদুটো এসেছে গ্রিক সূর্যদেবতা হেলিওসের কাছ থেকে’পেরি’ হচ্ছে গ্রিক শব্দ যার মানে কাছে, আরে ‘অ্যাপো’ হচ্ছে দূর]। ধূমকেতু খুব দ্রুত সূর্যের চারপাশে ঘুরে যায় পেরিহেলিওনে এবং এখান থেকে পেরিহেলিওনের অন্যদিকে ছুটে যায় দ্রুতবেগে। গুলতির মতো এর সূর্যের চারপাশে নিজেকে ঘুরিয়ে, ধূমকেতু ক্রমশ তার গতি হারাতে থাকে যখন সে সূর্যের কাছ থেকে দূরে সরে যায় অ্যাপহেলিওন অবধি, যখন এটি সবচেয়ে ধীর তার গতিতে এবং এই চক্রটির পুনরাবৃত্তি হতে থাকে অবিরাম। 

মহাশূন্য-প্রকৌশলীরা মাঝে মাঝে এই ‘স্লিং-শট ইফেক্ট’ ব্যবহার করেন, যা তাঁদের রকেটের ফুয়েল ইকোনমি বাড়ায় বা জ্বালানি বাঁচাতে সাহায্য করে। ক্যাসিনি স্পেস প্রোব, দূরের গ্রহ শনির জন্যে যা পরিকল্পিত করা হয়েছিল, সেখানে এটি পৌঁছেছিল এ রকমই একটি ঘুরপথে, কিন্তু সেটি আসলে এই স্লিং-শট প্রভাবটি কাজে লাগানোর লক্ষ্যে খুবই বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিকল্পনা করে হয়েছে। সরাসরি শনিতে যেতে যে পরিমাণ জ্বালানি ব্যবহার করা দরকার, তারচেয়ে অনেক কম জ্বালানি ব্যবহার করে ক্যাসিনি তার সেই যাবার পথে তিনটি গ্রহের কক্ষপথের মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে ব্যবহার করেছে : শুক্র গ্রহ [দুইবার], এরপর পৃথিবীর চারপাশে একটি ফিরতি ঘুরপাক, তারপর অবশেষে বৃহস্পতি গ্রহ থেকে শক্তিশালী ধাক্কা। প্রতিটি ক্ষেত্রে এটি গ্রহের চারপাশে একটি ধূমকেতুর মতো পড়েছে, সূর্যের চারপাশে ঘোরা গ্রহগুলোর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ব্যবহার করে সে গতি বৃদ্ধি করেছে। এই চারটি স্লিং-শট বুস্ট ধাক্কা দিয়ে ক্যাসিনিকে নিয়ে গেছে রিং ও ৬২টি চাঁদের শনি গ্রহের সিস্টেমের দিকে। যেখান থেকে সেটি অসাধারণ সব ছবি পাঠানো অব্যাহত রেখেছে। 

অধিকাংশ গ্ৰহ, যেমন আমি বলেছিলাম, সূর্যের চারপাশে ঘোরে প্রায় বৃত্তাকার উপবৃত্তে। ব্যতিক্রম শুধু প্লুটো, শুধুমাত্র আকারেই অনেক ছোট বলে তাকে আর গ্রহ বলা হচ্ছে না, এছাড়াও এর লক্ষ করার মতো অদ্ভুত একটি কক্ষপথ আছে। অন্য সব গ্রহের তুলনায় এটি খুব বেশি উপবৃত্তাকার, দুপাশে চ্যাপটা হয়ে যাওয়া বৃত্তের মতো একটি কক্ষপথে এটি ঘুরছে, এছাড়াও এটি বেশি বাঁকানো, প্রায় ১৭ ডিগ্রি] বেশিরভাগ সময়ই এটি নেপচুনের কক্ষপথের বাইরে থাকে, কিন্তু পেরিহেলিওনে এটি দ্রুত ভিতরে ঢোকে ও আসলেই নেপচুনের চেয়েও সূর্যের কাছাকাছি অবস্থান করে, এর প্রায় বৃত্তাকার কক্ষপথ ব্যবহার করে। প্লুটোর কক্ষপথও কোনো ধূমকেতুর মতো অদ্ভুত নয়। সবচেয়ে বিখ্যাত ধূমকেতু হচ্ছে হ্যালির ধূমকেতু। শুধুমাত্র এর পেরিহেলিওনে এটি আমরা দেখতে পাই, যখন এটি সূর্যের সবচেয়ে কাছে অবস্থান করে এবং সূর্যের আলোকে এটি প্রতিফলিত করে। এর উপবৃত্তাকার কক্ষপথ এটিকে বহু দূরে নিয়ে যায় এবং এটি কাছাকাছি আসে প্রতি ৭৫ থেকে ৭৬ বছর পর পর। আমি ১৯৮৬ সালে এটি দেখেছি, আমার শিশুকন্যা জুলিয়েটকেও সেটি দেখিয়েছি। আমি তার কানে কানে বলেছিলাম [অবশ্যই সে বুঝতে পারেনি আমি কী বলেছিলাম তখন, কিন্তু আমি তারপরও জোর করে বলেছিলাম] আমি এটি আর কখনোই দেখতে পাব না, কিন্তু সে আরেকবার এটি দেখার সুযোগ পাবে যখন ২০৬১ সালে এটি আবার ফিরে আসবে। 

প্রসঙ্গক্রমে, ধূমকেতুর ‘লেজ’, আসলেই ধুলা ছড়া কিছু নয়, এটি ধূমকেতুর মাথার পেছন থেকে বের হয়ে আসছে এমনকিছু নয় যেমনটা আমরা হয়তো ভাবতে পারি। বরং সূর্য থেকে আসা কণাদের ধাক্কার মাধ্যমে এটি এভাবে ফুলে ওঠে, যেন সেখানে ফুঁ দেয়া হয়েছে। এ কারণে ধূমকেতুর লেজ সবসময়ে সূর্যের বিপরীত দিকে মুখ করা থাকে, ধূমকেতু যেদিকে যাক-না কেন। একটি চমৎকার প্রস্তাবনা আছে, যা একসময় সীমিত ছিল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতে, যা এখন বাস্তব রূপ দেয়ার চেষ্টা করছেন জাপানি প্রকৌশলীরা, সোলার উইন্ড ব্যবহার করে সুবিশাল ‘পালের’ সাহায্যে মহাকাশযান চালনা করা। সমুদ্রে সত্যিকারের বাতাস ব্যবহার করে যেমন জাহাজ চলত, তাত্ত্বিকভাবে সোলার উইন্ড পরিচালিত এই মহাকাশ-যানগুলো খুব দক্ষ উপায়ে জ্বালানি সাশ্রয় করে দূর মহাশূন্যে পাড়ি দেয়ার সুযোগ করে দিতে পারে। 

একপাশ থেকে গ্রীষ্মকে দেখা 

এখন যখন আমরা কক্ষপথ কী জিনিস বুঝতে পেরেছি, আমরা এখন সেই প্রশ্নে ফিরে যেতে পারি, কেন আমরা শীত আর গ্রীষ্ম ঋতু পাই। আপনি মনে করতে পারবেন, কিছু মানুষ ভ্রান্তভাবে মনে করেন এর কারণ হচ্ছে, গ্রীষ্মের সময় আমরা সূর্যের কাছাকাছি অবস্থান করি এবং শীতে সূর্য থেকে বেশ দূরে। এটি ভালো একটি উদাহরণ হতে পারত যদি পৃথিবীর কক্ষপথ প্লুটোর মতো হত। আসলেই প্লুটোর শীত আর গ্রীষ্ম [দুটোই আমরা পৃথিবীতে যা অনুভব করি তার চেয়ে অনেক বেশি শীতল] দুটোই ঘটে ঠিক সে-কারণে। 

পৃথিবীর কক্ষপথ তবে কিছুটা ভিন্ন, প্রায় বৃত্তাকার, সুতরাং সূর্যের কাছাকাছি আসার কারণটি কখনোই ঋতু পরিবর্তনের কারণ হতে পারে না। তারপরও যদি বলতে হয়, পৃথিবী আসলে সূর্যের সবচেয়ে কাছে থাকে জানুয়ারিতে [পেরিহেলিওন] ও সবচেয়ে দূরে থাকে জুলাই মাসে [অ্যাপহেলিওন], কিন্তু উপবৃত্তাকার এই কক্ষপথ বৃত্তের এত কাছাকাছি যে এটি আসলেই প্রত্যক্ষযোগ্য কোনো পার্থক্যের কারণ হয় না। 

বেশ, শীত থেকে গ্রীষ্ম, এই পরিবর্তনের কারণ তাহলে কী? এমনকিছু, যা সম্পূর্ণ ভিন্ন। পৃথিবী তার নিজ অক্ষের উপর ঘুরতে থাকে, আর এই অক্ষটি খানিকটা হেলানো। এই হেলানো অক্ষই হচ্ছে সত্যিকারের কারণ কেন আমরা ঋতু পরিবর্তনের ঘটনা দেখি। আসুন দেখি কিভাবে এটি কাজ করে। 

যেমন আমি আগে বলেছি, আমরা অক্ষকে একটি ‘অ্যাক্সল’ বা অক্ষদণ্ড হিসেবে কল্পনা করতে পারি, একটি ‘রড’ যা পুরো পৃথিবীর মধ্যে দিয়ে এপাশ থেকে ওপাশে চলে গেছে বলে আমরা কল্পনা করতে পারি; উত্তর আর দক্ষিণ মেরু হচ্ছে যার দুটি প্রান্ত। এবার কল্পনা করুন, সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর প্রদক্ষিণ আরো বড় আকারের একটি চাকা, যার নিজেরও একটি অ্যাক্সল আছে, এবার সেটি অতিক্রম করেছে সূর্যের ঠিক মধ্য দিয়ে, যা বের হয়ে আছে সূর্যের ‘উত্তর’ আর ‘দক্ষিণ’ মেরুপ্রান্ত দিয়ে। এই দুটি ‘অ্যাক্সল’ পুরোপুরিভাবে পরস্পরের সমান্তরাল হতে পারত, সুতরাং পৃথিবীর কোনো ‘হেলানো’ অক্ষ থাকত না। যেক্ষেত্রে দুপুরবেলার সূর্য বিষুবরেখায় ঠিক মাথার উপর থাকত এবং দিন-রাতের দৈর্ঘ্য সব জায়গায় সমান হত। কোনো ঋতুই থাকত না। বিষুবাঞ্চল সবসময়ই উষ্ণ থাকত এবং ক্রমশ শীতল থেকে আরো শীতলতর হত, যদি বিষুবরেখা থেকে দুই মেরুর দিকে আপনি যতই সরে যেতেন, কিন্তু আপনাকে শীতের জন্য অপেক্ষা করতে হত না, কারণ অপেক্ষা করার জন্য কোনো শীতই থাকত না সেক্ষেত্রে। কোনো গ্রীষ্ম, কোনো ঋতু, যে-কোনো ধরনের, কিছুই থাকত না। 

কিন্তু বাস্তবে, এই দুটি অক্ষদণ্ড [অ্যাক্সল] সমান্তরাল নয়। পৃথিবী নিজের অক্ষের চারদিকে ঘোরার অ্যাক্সল সূর্যের চারপাশে এর ঘোরার অ্যাক্সল সাপেক্ষে খানিকটা একপাশে হেলানো। এই হেলে থাকার পরিমাণ খুব বেশি নয়, প্রায় ২৩.৫ ডিগ্রি। যদি এটি ৯০ ডিগ্রি হত [ইউরেনাসের অক্ষের হেলে থাকার পরিমাণ এতটাই] তাহলে উত্তর মেরু বছরের এক সময় সরাসরি সূর্যের দিক বরাবর থাকত [যাকে আমরা বলতে পারি উত্তরের মিডসামার] এবং উত্তরের মধ্য-শীতে সরাসরি এর বিপরীতে থাকত। যদি পৃথিবী ইউরেনাস হত, মিডসামার সূর্য সবসময় উত্তর মেরুতে আমাদের মাথার উপর থাকত [সেখানে কোনো রাত হত না] এবং এর বিপরীতে দক্ষিণ মেরু দিনের কোনো চিহ্ন ছাড়াই হত বরফশীতল এবং অন্ধকার এবং এটাই ঘটত পালাক্রমে প্রতি ছয় মাসে একবার। 

যেহেতু আমাদের গ্রহ আসলে ৯০ ডিগ্রির পরিবর্তে মাত্র সাড়ে তেইশ ডিগ্রি হেলে আছে, আমরা প্রায় এক-চতুর্থাংশ পরিস্থিতিতে আছি, কাত হয়ে না থাকা কোনো অক্ষের চূড়ান্ত ঋতুহীনতা থেকে ইউরেনাসের প্রায় চূড়ান্ত কাত হয়ে থাকা অক্ষের পরিস্থিতির দিকে। 

এটি যথেষ্ট বোঝানোর জন্য যে, ইউরেনাসে যেমন—পৃথিবীর উত্তর মেরুর উপর মধ্য-গ্রীষ্মে [মিডসামার] সূর্য কখনোই ডোবে না। একটি ক্রমাগত দিন, কিন্তু, ইউরেনাসের ব্যতিক্রম, সূর্য ঠিক মাথার উপর থাকে না, এটিও আকাশে ঘোরে লুপ তৈরি করে যখন পৃথিবী ঘুরতে থাকে। কখনোই এটি দিগন্তরেখার নিচে নেমে যায় না। এটাই সত্যি পুরো আর্কটিক চক্র জুড়ে। আপনি যদি আর্কটিক চক্রে দাঁড়িয়ে থাকেন, ধরুন আইসল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিম কোনায়, মিডসামার ডে’তে, আপনি দেখবেন সূর্য উত্তরের দিগন্ত ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে কিন্তু কখনোই পুরোপুরিভাবে অস্তে যায় না। এরপর মধ্যদিবসে সেটি আবার ঘুরে সর্বোচ্চ বিন্দুতে এসে পৌঁছায় [খুব বেশি উঁচুতে নয়]। 

উত্তর স্কটল্যান্ডে, যা আর্কটিক চক্রের কিছুটা বাইরে, মধ্য-গ্রীষ্মের সূর্য দিগন্তরেখার যথেষ্ট পরিমাণে নিচে নেমে আসে আর রাতের মতো কিছু আমরা সেখানে দেখতে পাই, যদি খুবই গভীর অন্ধকার রাত নয়, কারণ দিগন্তরেখার খুব বেশি নিচে সূর্য অবস্থান করে না। 

সুতরাং, পৃথিবীর অক্ষের এই হেলে থাকার বৈশিষ্ট্যটি ব্যাখ্যা করে কেন আমরা শীত [গ্রহের যে অংশে আমরা বাস করি তখন সেটি সূর্যের বিপরীত দিকে হেলে থাকে] এবং গ্রীষ্ম [যখন এটি সূর্যের দিকে হেলে থাকে] ঋতু পাই এবং শীতকালে কেন আমরা সংক্ষিপ্ত রাত আর গ্রীষ্মে দীর্ঘ দিন পাই, কিন্তু এটি কি ব্যাখ্যা করে কেন শীতে আমাদের এত ঠাণ্ডা লাগে আর গ্রীষ্মে এত গরম? 

কেন সূর্য এত গরম অনুভূত হয় যখন এটি ঠিক মাথার উপরে থাকে, আরো নিচে থাকার তুলনায়, যেমন দিগন্তের কাছে? একই তো সূর্য, যে কোণেই থাকুক-না কেন এর তো একইরকম গরম হওয়া উচিত তাই না? না। 

আপনি সেই বাস্তব সত্যটি ভুলে যেতে পারেন যে আমরা খানিকটা সূর্যের নিকটে অবস্থান করি যখন পৃথিবীর সেই অংশটি সেদিকে হেলে থাকে। এই পার্থক্যটি খুবই সামান্য পার্থক্য [মাত্র কয়েক হাজার মাইল] যদি পুরো দূরত্বের সাথে কল্পনা করা হয় [প্রায় ৯৩ মিলিয়ন মাইল] এবং তা-ও নগণ্য যদি পেরিহেলিয়নে সূর্যের দূরত্বের সাথে অ্যাপহেলিয়নের সূর্যের দূরত্বের মধ্য-পার্থক্য তুলনা করেন [প্রায় ৩ মিলিয়ন মাইল]। না, যা গুরুত্বপূর্ণ, আংশিকভাবে সেটি হচ্ছে সেই কোণটি, যে কোণে সূর্যের আলোকরশ্মি আমাদের কাছে এসে পৌঁছায় এবং আংশিকভাবে এর কারণ যে গ্রীষ্মে দিনের দৈর্ঘ্য অপেক্ষাকৃত বড় এবং শীতে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রতর এবং এই কোণটি বিকালের তুলনায় মধ্য-দিবসে সূর্যকে আরো উষ্ণতর অনুভব করায় এবং এই কোণটির কারণে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে, বিকালের চেয়ে দুপুরবেলায় আপনার বেশি সানস্ক্রিন ব্যবহার করা উচিত। এই কোণ আর দিনের দৈর্ঘ্যের একটি মিশ্রণ, শীতের তুলনায় গ্রীষ্মের সময় উদ্ভিদের দ্রুত বাড়ার কারণ এবং সেইসাথে আরো কিছু যা-কিছু ঘটে তার কারণে। 

কিন্তু কোণ কেন এত গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য সৃষ্টি করে? ব্যাখ্যা করার একটি উপায় হচ্ছে এমন। কল্পনা করুন আপনি মধ্য-দিবসে সূর্যস্নান করছেন গ্রীষ্মের ঠিক মাঝামাঝি কোনো সময়ে, আর আপনার মাথার উপরে সূর্য। আপনার পিঠের কোনো একটি নির্দিষ্ট বর্গইঞ্চি এলাকা ফোটন কণা [আলোর ক্ষুদ্র কণা] কী পরিমাণে আঘাত করে তা আপনি নির্ণয় করতে পারবেন একটি লাইট মিটার ব্যবহার করে। এখন যদি আপনি মধ্য-শীতে রৌদ্রস্নান করেন, সূর্য আকাশে অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতায় অবস্থান করবে পৃথিবীর অক্ষের হেলানো অবস্থার জন্য, পৃথিবীতে সূর্যের আলো পৌঁছাবে আরো অগভীর ও একপাশ থেকে আসা রশ্মির মাধ্যমে, সুতরাং একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ফোটন আপনার চামড়ার একটি অপেক্ষাকৃত বড় এলাকা জুড়ে ‘ভাগাভাগি’ হয়ে যাবে, এর মানে চামড়া সেই একই বর্গইঞ্চি এলাকায় লভ্য ফোটনদের অপেক্ষাকৃত কম ভাগ পাবে, যদি মধ্য-গ্রীষ্মের যতটা পেয়েছিল তার সাথে আপনি তুলনা করে দেখেন। আপনার চামড়ার জন্য যা সত্য, সেটি গাছের পাতার জন্যেও সত্য। আর এটি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ কারণ উদ্ভিদরা তাদের খাদ্য তৈরি করার জন্য সূর্যের আলো ব্যবহার করে। 

রাত ও দিন, শীত ও গ্রীষ্ম : এগুলো বিশাল পালাক্রমে ঘটা ছন্দ, যা আমাদের আর পৃথিবীর সব জীবিত প্রাণীর জীবনকেও নিয়ন্ত্রণ করে, হয়তো শুধুমাত্র যারা অন্ধকারে, আর সমুদ্রের শীতল গভীরতায় বাস করে, তারা ছাড়া। আরেকগুচ্ছ ছন্দ যা আমাদের জন্য তত বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয় ঠিকই, কিন্তু যারা সমুদ্রতীরে বাস করে, তাদের জন্যে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হচ্ছে পৃথিবীর চারপাশে ঘোরা চাঁদের আরোপিত ছন্দ, জোয়ারের মাধ্যমে যা মূলত কাজ করে। লুনার [চাঁদ] সাইকেল বহু প্রাচীন আর ভীতিকর পুরাণের বিষয়, যেমন—ওয়্যারউলভ কিংবা ভ্যাম্পায়ার। আমি অনিচ্ছাসত্ত্বেও সেই বিষয়টি এখানে ছেড়ে যাচ্ছি এবং পরের অধ্যায়ে সূর্যকে নিয়ে আলোচনা করব। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *