কান ছেঁদা করবার সময়ে হয়তো তার মন ভুলাবার জন্যে জারুনার মা সুর করে নূতন একটা ছড়া কেটেছিল : পোপাড়া কাঁপাল জোড়া লাগে না, কালো জামাই ভালো লাগে না। অনেক সন্তান-সন্ততির গর্ভধারিণী জারুনার মার স্বামীকে সকিনা খাতুন কখনো দেখ নি। সে ভাবে, স্বামীটি বিদ্ঘুটে কালো হবে। তার ভবিষ্যৎ স্বামীর কথাও একবার ভাবে এবং ক্ষুদ্র যে অলঙ্কারটি সে পেয়েছিল তারই রঙে কল্পনার স্বামীর রঙও সোনাবরণ রূপ ধারণ করে। তবে কল্পনার স্বামীর কথাও কাউকে বলে নি; তা গোপন রেখে সে পুলকিত বোধ করে। তারপর বকরিদের সময় দশম কি দ্বাদশ সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে জারুনার মার মৃত্যু ঘটে। প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে অব্যর্থভাবে কয়েকদিনের জন্যে সে অদৃশ্য হয়ে যেত। কোনোবার লিকলিকে হাড়সম্বল নবজাত একটি শিশু কোলে নিয়ে, কোনোবার মৃতপ্রসূত শিশুকে কবর দিয়ে শূন্যকোলে প্রত্যাবর্তন করত, মুখটা কিছু ফ্যাকাসে, কিছু শীর্ণ, ঠোঁটটা নীরস, ফাটা-ফাটা। সেবার সে আর ফিরে আসে নি। আগে প্রসব ঘরের কথা ভাবলেই সকিনা খাতুন কেবল জারুনার মার হাসিমুখটি দেখতে পেত। যে-প্রসবঘরে আজরাইল দেখা দিয়েছিল তার জান নেবার জন্যে, সে-প্রসবঘরেও সুপরিচিত হাসিটি দেখতে পায়-আকর্ষণ হাসি, যে-হাসির বেগে কখনো-কখনো বুক থেকে শাড়ির আঁচল সরে গেলে পালান-সদৃশ মস্ত দুটি স্তন প্রকাশ পেত; কবরে নয়, মাটির ওপরে সূর্যালোকের নিচে ঘাসফুলের মতো বিস্তৃত হয়ে সে হাসি খেলা করছিল যেন। তারপর কখন তার হাঁটার ভঙ্গিতে ঈষৎ মাজা-ভাঙ্গা ভাব আত্মপ্রকাশ করে, হাড়গোড় না বাড়লেও দ্বিতীয়া চাঁদের মতো অতি সঙ্গোপনে যৌবনও এসে দেখা দেয়, অবশেষে একদিন দেখতে পায় নানাবিধ রোগব্যাধিতে তার মা বার বার শয্যাশায়িনী হতে শুরু করেছে বলে সংসারের কাজ-কর্মে গভীরভাবে লিপ্ত হয়ে পড়েছে সে : ঘাটে খেয়ানৌকা এসে ভিড়লে যাত্রী যেমন সহসা জীবন্ত হয়ে উঠে আপন পথে চলতে শুরু করে তেমনি সহসা এবং সহজেই সে সাংসারিক জীবনে লিপ্ত হয়ে পড়ে। কেবল একটা কাঠের পুতুল বেশ কিছুদিন সঙ্গ ছাড়তে চায় নি। ততদিনে পুতুলটির রঙ উঠে এমন দশা যে চোখ-মুখ বলে আর কিছু নেই, বিবর্ণ দেহটি অক্ষতও নয়। একদিন সেটিও হারিয়ে যায় ছড়াগুলির মতো, তার মনের গোপন কুঠুরির মতো, এবং তার অভাব বোধ করে না বলে সেটির সন্ধানও করে না। সন্ধান করার সময়-বা কোথায়? দিনগুলি ঘূর্ণাবর্তের মতো হয়ে উঠেছে, যে-ঘূর্ণাবর্ত প্রতিদিন সূর্যোদয়ের সাথে-সাথে দেখা দিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত ঘিরে থাকে এবং যা ভেদ করে পশ্চাতে বা সম্মুখে তাকানো সম্ভব হলেও তাকাবার সাধ আর হয় না। হয়তো তাকালে কিছু দেখতেও পাবে না, যেমন কুয়াশার দিনে নদীর মধ্যখানে পৌঁছুলে পেছনের তীর সম্মুখের তীর উভয়ই আর চোখে পড়ে না। তখন থেকে মায়ের কাছে লুকাবার মতো। তেমন কিছু দেখতে পায় নি। লুকাবার কিছু নেই, লুকাবার সময়ও নেই। তার কাজ কি কখনো শেষ হয়? সারা দিন স্কুলে পড়ানো, মায়ের সেবা-শুশ্রূষা করা, ঘরদোর সাফ করা, সন্ধ্যার আগে বাপের জন্যে ভেতরের বারান্দার প্রান্তে বদনা ভরে অজুর পানি রাখা, সকলের অলক্ষে ঘরের কোণে আবচা অন্ধকারে নামাজটাও পড়ে নেওয়া, পরে উঠানের শেষে তিনদিক-খোলা গোয়ালঘরে মধুবিবি নাম গাইটিকে দানা-পানি দেওয়া, সময় করে ছোট ভাইবোনদের পড়াটা দেখিয়ে দেওয়া, সকলের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা, আরো পরে বাসন-পাতিল ঘষে-মেজে সাফ করা-অনেক তার কাজ যা সে নিত্য নিঃশব্দে একটির পর একটি করে যায়। অনেক রাত করে সে যখন শুতে যায় তখন বিছানায় আশ্রয় নেবা মাত্র ঘুমটা ঝট করে এসে যায়। প্রথমে সহসা সমস্ত দেহে যে গভীর অবসাদ বোধ করে সে-অবসাদের সঙ্গে মিশে ভেতরটা কেমন ফাঁকা-ফাঁকা হয়ে ওঠে, দৈনন্দিন সাংসারিক কথা বা স্কুলের চুটিচাটি কথা হাল্কা মেঘের মতো তার মনের সীমানায় কয়েক মুহূর্ত উড়ে বেড়ায় কোথাও ছায়া না ফেলে, তারপর সে-সব কথা কখন স্বপ্নের প্রান্তে গিয়ে পৌঁছায়, আবার স্বপ্ন গভীর নিদ্রায় অন্তর্হিত হলে নিদ্রার নিরাকার বিস্মৃতির মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কেবল ক্বচিৎ কখনো ঘুম আসতে ঈষৎ দেরি হলে অদৃশ্য নিশাচর পাখির মতো রাতের অন্ধকার থেকে উড়ে এসে অন্যান্য কথা মনে নিঃশব্দে ডানা ঝাপটায় : জীবন-মৃত্যুর কথা, বেহেস্ত-দোজখের কথা, সূর্য-চন্দ্র নক্ষত্রের রহস্যের কথা, মানুষের কথা সে-সব সে ভাবেই কেবল, কোনো উত্তর সন্ধান করে না : উন্মুক্ত মাঠের শেষে দিগন্তের দিকে গ্রাম্যবধু যেমন অস্কুট কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকে তেমনি তার মনও আস্তে-আস্তে চোখ মেলে সে-সব রহস্যময় কথাগুলির বিষয়ে ভাবে মনে একটু ভয় বা বিহ্বলতা বোধ না করে, যেন যে-দুর্বোধ্য দিগন্তের দিকে তাকায় সেখানে যদি ভয়ের বা বিহ্বলতার কিছু থেকে থাকে তা তাকে স্পর্শ করবে না। সে-সব বিষয়ে কোনো কারণে জরায়ুস্থিত জীবের মতোই সে নিরাপদ বোধ করে। সে কখনো কোনো অভাব বোধ করে না, কিছু কামনাও করে না। তার ঈষৎ কৌতূহলও যখন শেষ হয় তখন সে রাতের আওয়াজ শোনে : কোথাও ইঁদুরের সাবধানী সঞ্চারণ, রাতপাখির ডাক, কাঠের ক্ষীণ আকস্মিক আর্তনাদ। সে-সব আওয়াজ শুনতে-শুনতে কোনো-কোনোদিন তার মনে প্রশ্ন জাগে, মৃত্যুর পরে যে-জীবন সে-জীবনের না জানি কী রকম আওয়াজ। গভীর রাতে ঘুমন্ত মানুষেরা অতর্কিতভাবে আর্তনাদ করে ওঠে তীক্ষ্ম, নিঃসঙ্গ কণ্ঠে, কী-একটা অজানা বিস্ময়ে। সে-জীবনের আওয়াজ কী সে-রকম? কখনো হাওয়া যেমন বেচইন হয়ে গোঙ্গাতে শুরু করে। তেমনই কি তার আওয়াজ? কখনো হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ বুকের পিঞ্জর থেকে বেরিয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, সর্বত্র তারপর ধকধক করে প্রচণ্ড আওয়াজে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়। অজানা জগতের আওয়াজটি কি তেমনি কিছু? তবে সকিনার এ-কৌতূহলও স্থায়ী হয় না; এ-জীবনই তাকে তেমন কৌতূহলী করে না, সে-অজানা জীবন কেন তাকে কৌতূহলী করবে? তাছাড়া রাত শীঘ্র সুগভীর নদীর মতো অতল হয়ে ওঠে যাতে সে দ্রুতগতিতে নিমজ্জিত হতে থাকে, যাতে তার ক্ষীণখর্ব দেহটি সহসা ভারী হয়ে তলিয়ে যায়। এমনিভাবে সে নিদ্রাভিভূত হয়ে পড়ে, বুকের দিকে মাথা গুঁজে হাঁটু দুটি তুলে সে-বুকের দিকে টেনে একত্র করা দুটি হাত উরুর মধ্যে স্থাপন করে, মুখটা ঈষৎ খুলে। কোনো-কোনোদিন দেহটি অবশ হয়ে পড়ার আগে অর্ধঘুমন্ত অবস্থায় কানে আঙ্গুল দিয়ে সে-আঙ্গুলটি বিষমভাবে কিছুক্ষণ নাড়ে; রাতের বেলায় কানের খলি কখনো-কখনো সুড়সুড় করে। হয়তো মনে যে-সব অবান্তর কথা জাগে, তাদেরই তাড়ায়।
অকস্মাৎ একদিন একটি বিচিত্র কান্নার আওয়াজ শোনার পরও সকিনা খাতুনের মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখা দেয় না বা তার নিত্যনৈমিত্তিক কর্মজীবনে কোন ব্যতিক্রম ঘটে না : পূর্বের মতো সে যথাবিধি স্কুলে পড়িয়ে যায়, বিবিধ সাংসারিক দায়িত্ব নিপুণহস্তে নির্বাহ করে চলে, যেন যে-কান্নার ধ্বনি থেকে-থেকে শুনতে পায় তা হাওয়ার গোঙ্গানি মানুষের জীবনধারায় টোল ফেলে না, তার পদক্ষেপ মুহূর্তের জন্যেও শ্লথ করে না। কখনো-কখনো নিজেই বুঝতে পারে, বিচিত্র দুর্বোধ্য কান্নাটির জন্যে সে অপেক্ষা করছে। কিন্তু মানুষ তারই অজান্তে অলক্ষিতে কত সময়ে কত কিছুর জন্যে অপেক্ষা করে : মেঘসঞ্চারের জন্যে, গাছের চূড়ায় মর্মরধ্বনির জন্যে, যে-ফিরিওয়ালার কাছে কিছু কেনবার নেই সে-ফেরিওয়ালাও ডাকের জন্যে, অকস্মাৎ কোথাও একটি হাসি বা শুধুমাত্র একটি কণ্ঠস্বর শোনার জন্যে। তারপর আপদ-বিপদের জন্যে অপেক্ষা করে : রোগব্যাধি দুঃখ-কষ্টের জন্যে, বন্যা-দুর্ভিক্ষ-মহামারীর জন্যে, সর্বস্বান্ত-করা অগ্নিকাণ্ডের জন্যে মৃত্যুর জন্যে কেয়ামতের জন্যে। দুনিয়া একটি সুনিয়ন্ত্রিত চক্রে আবর্তিত হয় জেনেও যে-সব ঘটনা ঘটা সম্ভব নয় সে-সব ঘটনার জন্যে অপেক্ষা করে: বিনামেঘে বজ্রাঘাত, কবর থেকে মৃতদের পুনরুত্থান, পাখিতে মানুষের রূপান্তরপ্রাপ্তি, এমন দিন যেদিন সকালে সূর্য উঠবে না। সচেতন-অচেতনভাবে জেনে-না-জেনে সম্ভব অসম্ভব কত কিছুর জন্যে, মানুষ অপেক্ষা করে, সকিনা খাতুন কান্নাটির জন্যে অপেক্ষা করবে তা বিচিত্র কী। তবে শীঘ্ৰ সে বুঝতে পারে কিছু ভয়-আশঙ্কার সঙ্গেই যেন অপেক্ষা করে, যে-কান্না সাধারণের গণ্ডিতে এবং সম্ভাব্যের বেড়িতে আবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করেছে, সে-কান্না যেন আর সাধারণ ব্যাপার বলে মনে হয় না। কান্নাটি যে অন্য কেউ শুনতে পায় না, তা তার বুঝতে দেরি হয় নি। কিন্তু অন্য কেউ কেন শোনে না? কুমুরডাঙ্গা একটি ক্ষুদ্র শহর হলেও কত লোক সে-শহরে, তবু বিচিত্র দুর্বোধ্য কান্নাটি শোনার জন্যে একমাত্র সে-ই কেন নির্বাচিত হয়েছে, কেন সে-ই এই অদ্ভুত সৌভাগ্যের অধিকারিণী হয়েছে? যে-অধিকার অনন্যসূলভ, যাতে একজন বিশেষ মানুষ ছাড়া আর কারো হিস্সা নেই, যা থেকে আর সবাই বঞ্চিত, সে-অধিকার কঠিন অধিকার। কিন্তু বিচিত্র কান্নাটির অর্থ কী, কোথায়-বা তার উৎস? এ প্রশ্ন করতে সাহস হয় না। না ভেবেই সে বুঝতে পারে, কোথাও সহসা কান্না শুনলে কে কাঁদছে কেন কাঁদছে এমন যে-সব প্রশ্ন মানুষের মনে স্বাভাবিকভাবে জেগে ওঠে, সে-সব প্রশ্ন বিচিত্র কান্নাটির বিষয়ে আপন মনেও জিজ্ঞাসা করা সম্ভব নয়, যেন জিজ্ঞাসা করলে প্রশ্নটি এ-ঘর থেকে সে-ঘর, ঘর থেকে পথ, পথ থেকে মাঠ পর্যন্ত গিয়েই থেমে যাবে না, হয়তো নিক্ষিপ্ত হবে মহাশূন্যে যেখান থেকে কিছু ফিরে আসে না, ক্ষীণতম প্রতিধ্বনিও নয়। তাছাড়া সে-বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করলে বা একটু ভাবলে সে হয়তো ভয়ানকভাবে বিস্মিত হয়ে পড়বে, যে-বিস্ময়ের ধাক্কায় সে তখন ধন্ধবৎ গুহাগহ্বরের মধ্যে দিয়ে এমন কোনো স্থানে উপস্থিত হবে যেখানে তার জরায়ুস্থিত নিরাপত্তার অবসান ঘটবে, যেখানে সুপরিচিত ছেঁড়া কাঁথার সোঁদালো গন্ধ বা মুখভাঙ্গা কলসিটা নেই, বাপের খড়ম-পরা পায়ের উচ্চ-কঠিন আওয়াজ শোনা যায় না। কান্নাটি সত্যি বিচিত্র। কেউ কোথায় অপরিচিত কণ্ঠে কাঁদছে শুনলে আপনা থেকেই মানুষের মন আর্দ্র হয়ে ওঠে। কিন্তু বিচিত্র কান্নাটি তেমন কোনো আর্দ্রতা সৃষ্টি করে না, যেন বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু গাছের শাখা পল্লব অসিক্ত রয়ে গিয়েছে। সেজন্যেই কি কান্নাটি শুনলেও ক-দিন ধরে ঠিক শোনে না, কেমন যেন কানেই ঠেকিয়ে রাখে, অন্তরে প্রবেশ করতে দেয় না?
তারপর একদিন তার মা জিজ্ঞাসা করে, থেকে থেকে মনে হয় কেমন যেন কান পেতে থাকিস, যেন কি শুনছিস। কী শুনিস?
মা সে-দিন ভালোই বোধ করেছিল। বারান্দায় বেরিয়ে একটি মাদুর পেতে বসেছিল। চমকিতভাবে সকিনা খাতুন একবার মায়ের দিকে দৃষ্টি দেয়, তারপর কোনো উত্তর না দিয়ে উঠানটি অতিক্রম করে যায়। কেবল উঠানের শেষপ্রান্তে পৌঁছাবার পর সহসা সে বুঝতে পারে বিচিত্র কান্নার কথা আর গোপন করে রাখার শক্তি তার নেই। মায়ের দিকে না তাকিয়ে সে বলে, রাতদিন কী যেন সে শুনতে পায়, কে যেন কোথাও সর্বক্ষণ কাঁদে।
তবে বছর দুই আগে একটি ঘটনা ঘটে। ছুটির দিন বলে মুহাম্মদ মুস্তফা দেশের বাড়িতে। একদিন অপরাহ্নের দিকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে হাঁটতে শুরু করে, পরনে বোতাম-খোলা সাদা কোর্তা এবং হাল্কা রঙের লুঙ্গি। গ্রাম ছেড়েও সে হাঁটতে থাকে, উদ্দেশ্যহীনভাবে তবু দ্রুত পদে যেন সহসা হাঁটার নেশা ধরেছে তার। সে অকারণে বড় একটা হাঁটে না, তবু কালেভদ্রে একবার হাঁটতে শুরু করলে অনেকক্ষণ হাঁটতে পারে। দুই ক্রোশে মতো অতিক্রম করার পর একবার পূর্বদিকে তাকালে সে দেখতে পায় দিগন্তের কাছাকাছি মেঘ জমতে শুরু করেছে কিন্তু তবু তার পদক্ষেপ শ্লথ হয় না, যেন সে হাঁটতে শুরু করেছে বলে প্রয়োজন হলে মেঘই তার পথের সামনে থেকে সরে যাবে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে এমন সময় তাল-সুপারি গাছপালা বেষ্টিত একটি গ্রাম সহসা তার পথ আগলে দাঁড়ায়। সামনে শুধু গ্রাম নয়, একটি খালও। সরু খাল, তবে পায়ে হেঁটে পার হবার মতো অগভীর নয়। এবার কী করবে তাই ভাবছে মুহাম্মদ মুস্তফা, এমন সময় সহসা ঝড় শুরু হয়। কিছুক্ষণ পরে খালের পানিতে স্থানে-স্থানে রোলার চাপা মসৃণতা, আবার কোথাও ঢেউ জাগিয়ে প্রবল বেগে হাওয়া বইতে থাকে যেন পশ্চাদ্ধারী দুরন্ত কালো মেঘের আলিঙ্গন থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্যে সে-হাওয়ার অধীরতার শেষ নেই। তবে দ্রুতগামী মেঘ শীঘ্র তাকে ধরে ফেলে, এবং তারপর হাওয়া আর মেঘে হাতাহাতি হয় বলে বিশৃঙ্খল ধরনের বৃষ্টি নাবে। অবশেষে তাদের মধ্যে সন্ধি হলে, অথবা মেঘের কাছে হাওয়া হার মানলে নির্বাধায় মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়, হঠাৎ থেমে যাওয়া হাওয়া আর বাধা সৃষ্টি করে না। সে-বৃষ্টির মধ্যে অনিশ্চিতভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মুহাম্মদ মুস্তফা অবশেষে নদী পশ্চাতে রেখে সরু খালের পাড় দিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করে অনেকটা অন্ধের মতো, কারণ ততক্ষণে সূর্যাস্ত ঘটেছে, চারিদিকে বেশ অন্ধকারও হয়ে উঠেছে। বেশ খানিক্ষণ হাঁটার পর সে হাতলিয়া নামক গ্রামে এসে পৌঁছায়। এবার সে-গ্রাম ছেড়ে কারো ক্ষেতের পাশ দিয়ে পায়ে-হাঁটা পথ ধরে চলতে থাকে। শীঘ্র সে গরুর গাড়ির পথের মতো একটা দো-নালা সড়কে এসে উপস্থিত হয়। অন্ধকার ততক্ষণে বেশ ঘনীভূত হয়ে উঠেছে, বৃষ্টির ধারাও শ্লথ হয় নি, তবু সে বুঝতে পারে সে-সড়কটা অতিক্রম করে ডান দিকে হাঁটতে শুরু করলে চোখ বুজে কুমুরডাঙ্গায় ফিরতে পারবে। পথটি অতিক্রম করে একটা আইল ধরে আবার সে অগ্রসর হয়, পায়ের কাছে লঙ্গিটা কাদায়-পানিতে সপ-সপ করে, গায়ের লম্বা সাদা পাঞ্জাবিটা ভিজে একাকার।
আবার বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর সহসা সে দেখতে পায় অন্ধকারের মধ্যে সামনে বৃহৎ ঘন-কালো কিছু একটা দাঁড়িয়ে : কালোর ওপর কালোর প্রলেব-এমন কালো যার চেয়ে আর কালো কল্পনা করা যায় না। তবে বস্তুটি তার চিনতে দেরি হয় না। সেটি মুক্তাগাছি গ্রামের প্রসিদ্ধ বটগাছ। চাঁদবরণঘাটে বাস করার সময় সমবয়সী বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মধ্যে-মধ্যে দুই ক্রোশ পথ হেঁটে ঐ গাছটি দেখতে আসত। গাছটি যে প্রকাণ্ড শুধু তাই নয়, লোকদের ধারণা তার বয়স কয়েক শত বছরের কম নয় : কত রাজরাজ্যের উত্থানপতন হয়েছে, কত নদী পুরাতন খাত ছেড়ে নূতন খাতে ধারা স্থানান্তরিত করেছে, যত ঝড়ঝঞ্ঝা তুফান বয়ে গিয়েছে, সে-গাছটির কিছু হয় নি, সময়কাল উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থেকেছে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে। গাছটির প্রাচীনতাই ছেলেদের আকর্ষণের কারণ ছিল। স্কুলে পঞ্চম কি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পাঠ্য পুস্তকে পড়েছিল, গাছপালাউদ্ভিদ জড়পদার্থ নয়, তাদের প্রাণ আছে, তার জীবজন্তুর মতো ক্ষুধাতৃষ্ণা বোধ করে, নিবৃত্ত করে, নিদ্রা যায়, নিঃশ্বাস নেয়। মুহাম্মদ মুস্তফা এবং অন্যান্য ছেলেদের মনে হত, গাছপালার চোখ-কানও থেকে থাকবে, এবং ঘনপল্লবের আব্রুর ভেতর থেকে তারা নীরবে সব কিছু দেখে, শোনে। যে গাছ শত শত বছর ধরে জীবিত সে-গাছ যুগে-যুগে কত কিছু না দেখেছে শুনেছে। বৃহৎ বটগাছটির স্নিগ্ধশীতল গভীর ছায়ার নিচে এসে দাঁড়ালে তাদের মন নিমিষের সুদূর অতীতে চলে যেত, ঘনপাতার অস্ফুট মর্মরধ্বনির মধ্যে শুনতে পেত সে-সব মানুষের হাসি-কান্না যারা কবে কোন কুক্কটিকাময় রঙ আকারহীন দিনে জীবনের খেলা সাঙ্গ করে চিরতরে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। তারপর গাছটি দেখার সুযোগ হয় নি, কারণ বাপ খেদমতুল্লার মৃত্যুর পর। চাঁদবরণঘাট ছেড়ে চলে গিয়েছিল বলে এ-পথে আর আসে নি। তবু অনেকদিন সেটি তার মনে কেমন ছায়া বিস্তার করে রেখেছিল।
বৃষ্টি তখনো থামে নি, তবে ধারাটি মিহিন হয়ে উঠেছে। হয়তো বটগাছটি তাকে তার বাল্যজীবনের স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেয় বলে অনেকটা যন্ত্রচালিতের মতো গাছটির দিকে এগিয়ে যায়, তারপর তার তলায় পৌঁছে অল্প সময়ের জন্যে সেখানে দাঁড়াবার লোভ সম্বরণ করতে পারে না বলে একটু ইতস্তত করে দাঁড়িয়ে পড়ে, এ-সময় ভিজে কাপড়চোপড় সহসা ক্ষিপ্রগতিতে যতখানি সম্ভব নিঙড়েও নেয়।
কয়েক মুহূর্ত এমনিভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর সহসা একটি কথা তার মনে পড়ে, যে-কথা তাকে প্রচণ্ড আঘাতই দেয়। তবে সে কি কালু মিঞার বাড়ির সামনে এসে উপস্থিত হয় নি? বটগাছটি, তারপর পাঁচ-কোণা পানিতে টুইটুম্বর পুকুরটি, ওপাশে যে বাহিরঘর এবং তার পশ্চাতে যে-আটচালা অঘর এবার অন্ধকারের মধ্যেও পরিষ্কার দেখতে পায়, সে-সব কি কালু মিঞার সম্পত্তি নয় যে-কালু মিঞার নাম বাপ খেদমতুল্লার মৃত্যুর পর প্রায়ই শুনতে পেত? লোকেরা, বিশেষ করে বাড়ির লোকেরা বলত কালু মিঞাই বাপ খেদমতুল্লাকে খুন করেছিল এই কারণে যে লোকটি কলাকৌশলে অসদুপায়ে অন্যায়ভাবে যে-সব জায়দাদ জোতজমি আত্মসাৎ করেছিল। সে-সব জায়দাদ-জোতজমি থেকে তাকে বঞ্চিত করতে উদ্যত হয়েছিল বাপ খেদমতুল্লা।
মুহাম্মদ মুস্তফা বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়ে, তার মনে হয় কিছুই যেন বুঝতে পারছে।। তবে সে কি তারই অজান্তে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়েছিল? সে যে ভেবেছিল ঠিক পথেই হাঁটছে, এমন-কি এক-সময়ে হাতলিয়া গ্রামটিও চিনতে পেরেছে-সবই কি ভুল? তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে চতুর্দিকে তাকিয়ে দেখে সে। না, নিঃসন্দেহে সে ঘোর ঝড়-বৃষ্টিতে এবং দ্রুতগত রাত্রির অন্ধকারের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলেছিল, কারণ কালু মিঞার বাড়িঘর পুকুর সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ থাকলেও সমগ্র অঞ্চলের সুপ্রসিদ্ধ বটগাছটি সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র দ্বিধা অনিশ্চয়তার অবকাশ নেই।
আরো কয়েক মূহুর্ত দাঁড়িয়ে থাকার পর মুহাম্মদ মুস্তফা কিছু প্রকৃতিস্থ হয়, এবং তখন একথাও বুঝতে পারে যে সে স্থানে এমনভাবে আর দাঁড়িয়ে থাকা সমীচীন হবে না। চতুর্দিকে নীরবতা, বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। এবার ভেজা মাটির ভেজা ঘাস লতাপাতার সোঁদালো গন্ধ তার নাকে এসে লাগে। সে সহসা সজোরে একবার নিঃশ্বাস নেয়।
বটগাছের আশ্রয় ত্যাগ করবে এমন সময়ে মুহাম্মদ মুস্তফা হঠাৎ একটা আওয়াজ শুনতে পায়। কখন তারই অজান্তে সে পুকুরের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, যেন ওপাশে বাড়িঘরের দিকে তাকাবার সাহস নেই। এবার সভয়ে ওপাশে তাকালে প্রথমে অন্ধকারের মধ্যে শূন্য মাঠে আলেয়ার মতো কিছু দেখতে পায়, তারপর মানুষের মূর্তির মতো অস্পষ্ট কী-একটা ছায়াও নজরে পড়ে। ততক্ষণে আকাশটা কিছু পরিষ্কার হয়ে উঠে থাকবে, কারণ আকাশের মধ্যখানে কতকগুলি ঝর্মকে তারা দেখা দিয়েছে যেন। তবে নীরবতা মাত্রাতিরিক্তভাবে গম্ভীর হয়ে উঠেছে। মুহাম্মদ মুস্তফা সে-নীরবতার মধ্যে এর খসরুদ্ধ করে নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শূন্য মাঠে আলেয়ার দিকে, মানুষের মূর্তির মতো ছায়াটির দিকে। হয়তো বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটে আলেয়াটি এবং ছায়াটি নিশ্চল। তারপর এক সময়ে সে বুঝতে পারে সামনে কোনো শূন্য মাঠ নেই। এবার কালু মিঞার বাহিরঘর, পশ্চাতে মস্ত আটচালা বাড়ি-সে-সব সহসা অতি নিকটেই মনে হয়। আলেয়াটি আলেয়াও নয়, কুপি মাত্র, এবং কুপিটি ধরে একটি লোক দাঁড়িয়ে।
শীঘ্র কুপির আলো নড়ে ওঠে, মানুষটিও আর নিশ্চল থাকে না। সে যেন বটগাছের দিকেই আসছে। লোকটি আরেকটু এগিয়ে এলে বাহিরঘরের আলোয় প্রথমে তার দেহের মধ্যদেশ, তারপর সমস্ত দেহ নির্দিষ্ট আকৃতি ধারণ করে। সে কি বাহিরঘরের খোলা দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। নিঃসন্দেহে বাহিরঘরটি নির্জন হয়।
লোকটি কিন্তু সে-ঘরে ঢোকে না, ঘরের ভেতরে কোনো লোক থাকলে তার সঙ্গেও কথা বলে না; গভীর নীরবতা অক্ষুণ্ণ থাকে। তবে এবার মুহাম্মদ মুস্তফা চমকে ওঠে, কারণ সে বুঝতে পারে বাহিরঘরের সামনে দাঁড়িয়ে লোকটি তারই দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তাহলে লোকটি তাকে দেখতে পেয়েছে। চাঁদশূন্য রাত হলেও তাকে দেখতে পাওয়া শক্ত নয়। দূরত্বটা মন্দ নয়, কিন্তু ভিজে একাকার হলেও মুহাম্মদ মুস্তফার পরনে সাদা কোর্তা, লুঙ্গিটাও হাল্কা রঙের। বটগাছের তলে তাকে নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লোকটি বিস্মিত হয়ে থাকবে। ঝড়-বাদলে পথিকের পক্ষে গাছের তলায় আশ্রয় নেয়া অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু এখন ঝড় নেই, বৃষ্টিও থেমে গিয়েছে। তাকে চোর ডাকাত বলে কেউ ভুল করবে তাও সম্ভব নয়; এমন সাদা ধরনের পোশাক-পরিচ্ছদ পরে চোর-ডাকাত চুরিচামারি বা ডাকাতি করতে বের হয় না। হয়তো সে-জন্যে লোকটি কেবল বিস্মিতই হয়েছে, ভয় পায় নি।
লোকটি আবার হাঁটতে শুরু করে, ধীরে-ধীরে, সন্তর্পণে, তবু নিশ্চিত পদে। সে কি এবার তার দিকেই আসছে? তাই মনে হয়। সে ধরা পড়ে গিয়েছে, পালাতে চাইলেও পালানো সম্ভব নয়, পা-দুটিও যেন গাছের গুঁড়ির মতো অনড় হয়ে পড়েছে। এবার মুহাম্মদ মুস্তফার মনে নিদারুণ ভয় জেগে উঠে তাকে প্রায় অসাড় করে ফেলে, হৃৎপিণ্ড প্রচণ্ড আওয়াজে ধকধক করে বুকের মধ্যে বাড়ি খেতে থাকে, গলার ভেতরটা রোদে ঝলসানো জ্যৈষ্ঠ-মাসের জমির মতো শুকিয়ে কাঠ হয়ে ওঠে। নিথর নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে সে অপেক্ষা করে, এবং সচল মূর্তিটির দিকে একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বলে। মূর্তিটির তার চোখের সঙ্গে যেন খেলা করে; কখনো তা দেখতে পায় কখনো পায় না। তারপর একবার মূর্তিটি অদৃশ্য হয়ে গিয়ে অদৃশ্য থাকে, এবং কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার। পর মুহাম্মদ মুস্তফার ভীতবিহ্বল মস্তিষ্ক অবশেষে বুঝতে পারে কুপিটাও অন্ধকারের মধ্যে সহসা মিশে গিয়েছে। তবে লোকটি বাড়ির ভেতরে চলে গিয়েছে কি?
মুহাম্মদ মুস্তফার সমগ্র দেহ টানা-ধনুকের মতো শক্ত-কঠিন হয়ে উঠেছিল, হঠাৎ এবার শিথিল হয়ে পড়ে, সঙ্গে-সঙ্গে পা-দুটিতে অপরিসীম দুর্বলতা দেখা দেয়। তবে সে মনে-মনে বলে, আর বিলম্ব নয়, এবার পথ ধরা উচিত। সে বিলম্বও করে না। কেবল পা বাড়িয়েছে কি অমনি আবার একটি আওয়াজ শুনতে পেলে দ্বিতীয়বার থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। সে দেখতে পায় কালু মিঞার বাহিরঘরের পাশে কুপি নিয়ে নয়, লুণ্ঠন নিয়ে কে দাঁড়িয়ে, পাশে আরেকটি লোক। হয়তো দ্বিতীয় লোকটি আগের লোকই, কেবল তার হাতে এখন কুপিটি নেই। লোক দুটি নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে, নিঃসন্দেহে তাদের দৃষ্টি তার ওপর নিবদ্ধ। কয়েক মুহূর্ত এমনি কাটে, যেন কিছু ঘটবে না। তবে মুহাম্মদ মুস্তফা এবার অপেক্ষাকৃতভাবে শান্ত বোধ করে; তার মনের ভয় যেন কিছু কমেছে, যেন অদূরে লোক দুটি বা তাদের পেছনে গভীর অন্ধকারে-ঢাকা কালু মিঞার বাড়িঘর তাকে আর ভীত করে না।
তারপর একটি বিকট কণ্ঠ রাত্রির নীরবতাকে খণ্ডবিখণ্ড করে।
বটতলায় কে?
হয়তো লণ্ঠন-হাতে দাঁড়িয়ে-থাকা লোকটি কথাটা জিজ্ঞাসা করে। সে কালু মিঞার বাড়ির মিঞামানুষ হবে। অন্য লোকটি হয়তো রাখাল মানুষ। প্রশ্নকারীর বিকট কণ্ঠের অন্তরালে কেমন ভয়ের আভাস। হয়তো ভূতে তার গভীর বিশ্বাস, এবং তাই সে নিশ্চিত হতে পারে না বটগাছের তলে মূর্তিটি রক্তমাংসের মানুষ না ভূতপ্রেত কিছু। হয়তো তার এই ভয় হয়, মূর্তিটি সহসা উত্তর দেবে সে অমুক মানুষের আত্মা তমুক গাছে বাস করে, যে-উত্তর নিঃসন্দেহে সচক্ষে ভূত দেখার চেয়েও অধিকতর ভীতিজনক শোনাবে।
মুহাম্মদ মুস্তফা বুঝতে পারে নিরুত্তরে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়, কিন্তু উত্তর দেওয়া কি সহজ? কী বলবে সে? আত্মপরিচয় দেওয়া যে এত শক্ত তা পূর্বে কখনো জানত না।
অবশেষে সে উত্তর দেয়। গলার স্বর যেন বুকের গহ্বরে কোথাও আশ্রয় নিয়েছিল, সেখান থেকে কণ্ঠনালী দিয়ে বেরিয়ে আসতে সময় নেয়।
আমি মুহাম্মদ মুস্তফা।
একটু নীরবতা। লণ্ঠন হাতে লোকটি নিশ্চল। লণ্ঠনের আলোয় তার চৌকা নকশার লাল লুঙ্গিটি স্পষ্টভাবে নজরে পড়ে।
কে মুহাম্মদ মুস্তফা?
লোকটি পূর্ববৎ বিকট কণ্ঠেই আবার জিজ্ঞাসা করে, তবে এখন তার কণ্ঠে ভয় নয়, কী একটা ভাব। হয়তো ইতিমধ্যে মুহাম্মদ মুস্তফা কে তা সে বুঝে নিয়েছে, কেবল কথাটি তার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়।
মুহাম্মদ মুস্তফা কী উত্তর দেবে? কে সে? বাপ খেদমুতুল্লার পরিচয় ছাড়া তার কি, স্বতন্ত্র কোনো পরিচয় আছে?
আমি খেদমতুল্লার ছেলে মুহাম্মদ মুস্তফা।
আবার গভীর নীরবতা নাবে-এমন নীরবতা যে তাতে কণ্ঠস্বর সহসা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সে কি সত্যিই কোনো উত্তর দিয়েছিল? সে নিশ্চিত হতে পারে না। সে অপেক্ষা করে। নিকটে কোথাও একদল কোলাব্যাঙ উচ্চস্বরে ডাকতে শুরু করে। পুকুরের পাড়ে কোথাও তারা মজলিশ বসিয়েছে। আকাশের মধ্যস্থলে অনেকখানি মেঘমুক্ত হয়ে পড়েছে বলে সেখানে অজস্র তারা দেখা দিয়েছে; তারাগুলি বৃষ্টিধৌত আকাশে নির্মল উজ্জ্বলতায় ঝলমল করে।
মুহাম্মদ মুস্তফা অবশেষে বুঝতে পারে, উত্তরটি সত্যিই দিয়েছিল, এবং বেশ উচ্চকণ্ঠেই; লণ্ঠন-হাতে দাঁড়িয়ে-থাকা লোকটির গভীর নীরবতা তার প্রমাণ। বটগাছের তলা থেকে বেরিয়ে সে যখন কালু মিঞার বাড়িঘর পশ্চাতে রেখে পুকুরের পাড় দিয়ে উল্টো পথ ধরে, তখনো লোকটি কিছু বলে না। মুহাম্মদ মুস্তফা ধীরস্থিরভাবে হাঁটে, পায়ের ভেজা জুতায় ভসভস্ আওয়াজ হয়।
তবারক ভুইঞা মোক্তার মোছলেহউদ্দিনের মেয়ে সকিনা খাতুনের কথা বলছিল।
মেয়েটি যখন স্কুলে যায় বা স্কুল থেকে বাড়ি ফেরে তখন দু-পাশের বাড়িঘর, দোকানপাট থেকে অনেক লোক তাকে চেয়ে-চেয়ে দেখে; সেটি তাদের একটি নিত্যকার অভ্যাস। তবে সে-দিন যেভাবে তার দিকে তাকায় সেভাবে কখনো তাকায় নি।
প্রতিদিন বেলা সাড়ে নটার দিকে নদীর ধারের বাড়ি থেকে সকিনা খাতুন বেরিয়ে আসে। মাথায় কালো ছাতা, পিঠের কাছাকাছি বেণীর শেষাংশে জীর্ণ কালো ফিতার প্রজাপতি-বন্ধন, পরনে সাদা শাড়ি যে-শাড়ির পাড় কোনোদিন লাল কোনোদিন পিঙ্গল হলেও কখনো নূতনত্বের ধবধবে চেহারা গ্রহণ করে না; পায়ে স্যাণ্ডেল যা শুষ্কদিনে ক্রমশ ধুলাচ্ছন্ন এবং বৃষ্টির দিনে শীঘ্র কর্দমাক্ত হয়ে পড়ে। তার হাঁটার ধরনটি ধীর মন্থর, কেমন একটু মাজা-ভাঙ্গাও। খোঁড়া ন্যাংড়া নয়, হাঁটার একটা ঢঙ কেবল। হয়তো শরীরের গঠনের দোষ, বা লোকসমক্ষে দেহে-মনে গভীর লজ্জা দেখা দেয় বলে তারই অজান্তে হাঁটার ঢঙটা ঐ রকম হয়ে পড়ে। তবে নিত্য যারা তাকে চেয়ে-চেয়ে দেখে তারাও ঠিক বলতে পারবে না মেয়েটির চেহারা কী রকম, সেটা খাটো, লম্বা, কি মাঝারি ধরনের। কেবল দূর থেকে যাকে দেখতে পাওয়া যায়, তার মুখের ধরন বা উচ্চতা সম্বন্ধে সঠিক ধারণা করা কি কখনো সম্ভব? এমন মানুষ যার হাল্কা-পাতলা অস্থিতে মাস-মাংস বলে কিছু নেই, তাকে দূর থেকে রোগা মনে না-ও হতে পারে, অন্য কেউ রোগা না-হলেও কোথায় সে যেন তার স্থূলতা লুকিয়ে রাখে, দূরত্বে তা ধরা পড়ে না। আবার দূর থেকে যাকে বেশ লম্বা দেখায় সে হয়তো লম্বা নয়, যাকে খাটো মনে হয় সে পাশাপাশি এসে দাঁড়ালে বোঝা যায় তার উচ্চতার বিষয়ে ধারণাটি চোখের ভুল মাত্র। দূর থেকে মানুষের মুখ সম্বন্ধেও কখনো-কখনো তেমনি ভ্রম হতে পারে। কোনো মুখ দূরত্বের অস্পষ্টতায় আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, আবার কোনো মুখ যৌবন-লাবণ্য বা সতেজ স্বাস্থ্যের জন্যে নিকটে সুশ্রী মনে হলেও দূরে গিয়ে রেখাসর্বস্ব হয়ে পড়লে সে মুখের গরঠিক, অসুন্দর রেখাই ধরা পড়ে কেবল। তবে সকিনা খাতুনের মুখ কদাচিৎ দেখা যায়, কারণ সে-মুখ বরাবর একটি বড় ধরনের ছাতার তলে অদৃশ্য হয়ে থাকে। ছাতাটি তার জন্যে পর্দার মতো, তাই মেঘাচ্ছন্ন আকাশ নিবর্ষণে গুমোট মেরে থাকলেও বা শীতের দিনে রোদটা মিঠেমিঠে হয়ে উঠলেও মাথা থেকে ছাতাটি কখনো সে নাবায় না। কোনোদিকে সে তাকায়ও না। হয়তো একরকমের চক্ষুহীন মাছের মতো ছায়া দেখে সামনের বাধা-প্রতিবন্ধক এড়িয়ে চলে। অথবা তার ধারণা হয়তো এই যে, তাকে দেখতে পাওয়া, তারপর তার জন্যে পথ করে সরে যাওয়া-এসব দায়িত্ব অন্যদের, তার নয়। গলি থেকে বেরিয়ে নদীর ধারের পথটি ধরে সকিনা খাতুন তার স্বাভাবিক ঈষৎ মাজা-ভাঙ্গা ধীর-মন্থর গতিতে হাঁটতে শুরু করলে ডাক্তার বোরহানউদ্দিনের বৃদ্ধ পিতা তাকে সর্বপ্রথম দেখতে পায়। বৃদ্ধ মানুষটি তখন সকালের দীর্ঘ এবাদতের পর কাষ্ঠবৎ নিশ্চলতার মধ্যে কাকনিন্দ্রা সম্পন্ন করে শিক-দেয়া জানালার ভেতর দিয়ে বাইরে দৃষ্টি মেলে বসেছে : আধাপাকা ঝুলে-পড়া জ্বর নিচে তার জ্যোতিহীন চোখ ছায়াচ্ছন্ন, ভাবশূন্য। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে মেয়েটি যখন তার দৃষ্টিপথে দেখা দেয় তখন সে কেবল একটি নিরাকার শুভ্র ছায়াই দেখতে পায়, যে-ছায়া নিতান্ত নিস্পৃহভাবে সে অনুসরণ করে এবং তা অদৃশ্য হয়ে গেলে এবার বেদনাদায়ক অনিপুণতার সঙ্গে দেহবস্ত্রের অভ্যন্তর থেকে কম্পিতহস্তে একটি জেব-ঘড়ি বের করে সময়টা যাচাই করে। নেয়; সে বুঝতে পারে ঘরে-তৈরি দুটি সন্দেশের সঙ্গে একটি দাওয়াই খাবার সময় হয়েছে। তার জীবনটা নিয়মানুবর্তিতার দাস, ছেলে ডাক্তার বলে যার কড়াকড়িটা বেশ মাত্রাতিরিক্ত; বৃদ্ধ বাপের দীর্ঘ জীবনটা দীর্ঘতর করার জন্যে ডাক্তার-ছেলের চেষ্টার অন্ত নেই। এবং সকিনা খাতুন তাকে দাওয়াইর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ডাক্তার-ছেলের পরিকল্পনায় সাহায্য করে যেন।
সেদিন বৃদ্ধের চোখে মেয়েটি সহসা একটি স্পষ্ট আকার ধারণ করে, সে দেখা দিলে বৃদ্ধের চোখে অতিশয় বিরল একটি সচেতন-ভাবও জাগে, তারপর সে অদৃশ্য হয়ে গেলে জেব-ঘড়িটা বের করতেও তার দেরি হয়।
ডাক্তার বোরহানউদ্দিনের বৃদ্ধ-পিতার চোখের বাইরে যাবার আগেই সকিনা খাতুন আরেকটি মানুষের দৃষ্টিপথে ধরা দেয় : সে-মানুষ ডাক্তার-প্রতিবেশী উকিল আফতাব খানের বাড়িতে আশ্রিত খয়রাত মৌলভি। নিত্য এ-সময়ে ঘরের বারান্দায় বসে বাড়ির দুটি ছোট মেয়েকে সে কোরানপাঠ শেখায়,এবং সকিনা খাতুনকে যখন নিষ্পলক। দৃষ্টিতে অনুসরণ করে তখন তার চোখে এমন একটি ভাব দেখা দেয় যেন এতদিন দেখেও মেয়েটির বেপর্দা-বিচরণ অনুমোদন করতে সক্ষম হয় নি। কিন্তু হয়তো সে বিস্মিতই হয়। বিস্মিত হয় এই কারণে যে তার মনে যুবতী-নারীর বেপর্দা বিচরণের বিরুদ্ধে যে-নিষেধাজ্ঞার কঠিন প্রাচীর তার পটভূমিতে মেয়েটিকে এত নিরীহ এত অনলোভনীয় মনে হয় যে সে-নিষেধাজ্ঞার প্রাচীরই সশব্দে ভেঙ্গে পড়ে। নিঃসন্দেহে সে-আওয়াজ তাকে চমকিত করে। তবে সেদিন মনে হয় খয়রাত মৌলভি অবশেষে সরল উন্মুক্ত দৃষ্টিতে মেয়েটির প্রতি তাকাতে সক্ষম হয়েছে। তার মুখটা খুলে থাকলেও তার কণ্ঠস্বর হঠাৎ থেমে যায়; সে নিস্পলকদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেয়েটির দিকে।
উকিলের বাড়ির পাশে গাছপালা-ঢাকা পড়োজমি। তার পশ্চাতে কাছারির নাজির রহমত মিঞার কাঁচা বাড়িটি পথ থেকে কেবল আলিঝলি নজরে পড়ে। নাজিরের অল্পবয়স্কা পুত্রবধূ তাহেরা বানু স্নেহশীলা শ্বাশুড়ির হাতে সাংসারিক কাজকর্ম ছেড়ে যখন-তখন বাড়ির খিড়কিপথে-বাড়িটির মুখ নদীর দিকে নয়-এসে দাঁড়ায় গাছপালার মধ্যে দিয়ে পথে লোকচলাচল, অদূরে নদী বা খোলা আকাশের রঙের খেলা দেখবার জন্যে। তাহেরা স্বামীসঙ্গ থেকে বঞ্চিত, কারণ তার স্বামী শিক্ষার্থে অন্যত্র বাস করে এবং কেবল ছুটিছাটাতে বাড়ি আসে। তাহেরা বানুও মাজারের শিক্ষয়িত্রী মেয়েটিকে নিত্য চেয়ে-চেয়ে দেখে, স্বাধীনভাবে যে-মেয়ে চলাফেরা করে তার প্রতি একটি ঈর্ষাজনিত কৌতূহল বোধ করে সে। তবে সেদিন সহসা সে-কৌতূহলের রূপটা যেন ঘোরতরভাবে বদলে যায়; দূর থেকে দেখা মেয়েটির অস্পষ্ট ক্ষীণতনুটি অকস্মাৎ যেন রহস্যময় হয়ে উঠেছে-যে-রহস্য যুগপৎ আকর্ষণ করে এবং মনে কেমন একটা ভয়ও জাগায়। বস্তুত পথের মেয়েটিকে দেখলে দুর্বোধ্য কারণে তাহেরা বানুর বুকটা দুরদুর করে কেঁপে ওঠে।
মোছলেহউদ্দিনের মেয়ে তারপর ছেলেদের হাই ইস্কুলের সামনে উপস্থিত হয়। লম্বা ধরনের মাঠের শেষে লম্বা ধরনেরই টিনবাশের স্কুল-বাড়ি যেখানে সে-সময়ে ছাত্রদের না হলেও দু-একজন শিক্ষকের বিশেষ করে তরুণ শিক্ষক সুলতানের আগমন হয়ে থাকে; নিকটে কোথাও একটি গৃহস্থ পরিবারের বাহিরঘরে সুলতানের আস্তানা। সে-জন্যে শুধু নয়, অন্য এক কারণে সে সকালে-সকালে এসে স্কুলে উপস্থিত হয়। কারণটি সকিনা খাতুন। মেয়েটির প্রতি তার আকর্ষণটি হয়তো স্বাভাবিক নয়, কারণ মেয়েটি তার মনে কোনো মোহ বা ভাবাবেগ সৃষ্টি করে না। বস্তুত তরুণ বয়সেও নারীর প্রতি তার কোনো মোহ নেই এবং অত্যাশ্চর্য স্বচ্ছতার সঙ্গেই সে তাদের পানে তাকাতে পারে, ভালো-মন্দ যা দেখবার তাও প্রথমদৃষ্টিতে নির্ভুলভাবে দেখে নেয়। সে জানে সকিনা খাতুনের চেহারায় বা দৈহিক গঠনে দেখবার তেমন কিছু নেই, বস্তুত কল্পনার আদর্শ রূপবতী নারীর তুলনায় তার দোষঘাট অজস্র। তবে তাতে দুঃখের কিছু সে দেখতে পায় না; কখনো এ-কথা তার মনে জাগে নি যে মেয়েটিকে সে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে একদিন ঘরে নিয়ে আসবে। যে-কারণে নিত্য তাকে চেয়ে চেয়ে দেখে সেটা তাই ঠিক আকর্ষণ নয়, বরঞ্চ বলা যেতে পারে এক রকমের গবেষণা; সকিনা খাতুন তার গবেষণার পাত্রী। তার বিশ্বাস একদিন মেয়েটির মধ্যে সহসা এমন কিছু সে দেখতে পাবে যার সাহায্যে তার প্রশ্নের উত্তর পাবে। প্রশ্নটি এই : যে-মেয়ে নিত্য একাকী পথে বের হয় সে-মেয়ে এখনো অক্ষতদেহ কুমারী কিনা। কৌতূহলটা যে নিতান্ত অশ্লীল তা নিজেই বোঝে এবং সেজন্যেই গবেষণাটি একরকমের ভয়ানক নেশার মতো তাকে পেয়ে বসেছে।
তবে সেদিন গবেষণাটি সহসা অন্য, এবং নিতান্ত শ্লীল রূপ ধারণ করে। পূর্বের মতোই মেয়েটির আপাদমস্তক তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে দেখে তবে তার মধ্যে অন্য এক প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করে, এবং কোনো উত্তর খুঁজে না পেলেও শীঘ্র একটু আশ্বস্ত হয়; মেয়েটির মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখতে পায় না।
শীঘ্র সকিনা খাতুন দুই রাস্তার সংযোগস্থলে এসে উপস্থিত হয়। সোজা পথটি যায় কাছারি-আদালতের দিকে। যেটি মোড় নেয় ডান দিকে নদীকে পশ্চাতে রেখে সেটি শহরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। সকিনা খাতুন দ্বিতীয় পথটি ধরে। সামনে দোকানপাট পথটি ক্ষুদ্র মফস্বল শহরের প্রধান ব্যবসাকেন্দ্রের মধ্যে দিয়ে যায়। প্রথমে পড়ে সারিবাঁধা চার-পাঁচটি হোটেল যে-সব হোটেলে ব্যবসা-মামলা-মকদ্দমা সংক্রান্ত ব্যাপারে কুমুরডাঙ্গায় এসে গ্রামবাসীরা দু-এক রাতের জন্যে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করে। এত বেলাতেও সে-সব হোটেলে কেউ-না-কেউ অলসভঙ্গিতে এবং নির্বিকারচিত্তে গড়াগড়ি দেয়। অপরিচিত অজানা লোকদের সান্নিধ্য যতটা সম্ভব এড়াবার জন্যে সকিনা খাতুন হোটেলগুলির সামনে পৌঁছাবার আগে রাস্তাটা অতিক্রম করে ওপাশে চলে যায়, এ-সময়ে অজ্ঞাতসারেই বুকের কাপড়টা আরো টেনে নেয়, পদক্ষেপটা একটু দ্রুত করে তোলে; দোকানপাটের লোকদের সঙ্গে পরিচয় না থাকলেও তারা একই শহরের বাসিন্দা বলে তাদের তেমন লজ্জা হয় না, কিন্তু হোটেলের মক্কেলদের সামনে বড় লজ্জা হয়। তাছাড়া একদিন একটি হোটেলে একজোড়া চোখ দেখতে পেয়েছিল : পাথরের মতো নিশ্চল নিথর চোখ। সে-চোখে সে কী দেখেছিল জানে না, কিন্তু তখন থেকে হোটেলগুলির পাশ দিয়ে যাবার সময়ে তার পিঠটা যেন শিরশির করে ওঠে।
হোটেলগুলির পরে আসে মুদিখানা, যেখান থেকে চাল-ডাল রসুন-পেঁয়াজের ঝাঁজালো-মধুর গন্ধ ভেসে আসে। সে-দোকান থেকে পাল্লায় চাল-ডাল ওজন করতে করতে দোকানের মালিক ফনু মিঞা তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। তবে বেশিক্ষণের জন্যে নয়, কয়েক মুহূর্ত শোনদৃষ্টিতে তাকিয়েই আপন কাজে মনোনিবেশ করে। তবু সে-সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে কালো ছাতার নিচে চিবুক হতে শুরু করে পা পর্যন্ত মেয়েটির সর্বাঙ্গ দেখে নেয়। মেয়েটিকে নিত্য তাকিয়ে দেখা যাদের অভ্যাস তাদের মধ্যে মুদিখানার মালিকই তার ঈষৎ মাজা-ভাঙ্গা ধরনের হাঁটার কারণ সন্ধান করে। চাল ডালের ব্যবসা করে বলে সকলের বাড়ির হাঁড়ির খবর সে রাখে। সে জানে, দেশের বাড়ির আত্মীয়-স্বজনের দাবি-দাওয়ায় সদা উত্ত্যক্ত নেক সন্তান-সন্ততির বাপ মোক্তার মোছলেহউদ্দিনের আর্থিক অবস্থা আদৌ সচ্ছল নয়। মেয়েটা তাই মাইনর স্কুলে ছাত্রী পড়িয়ে সামান্য পয়সা কামিয়ে সংসারের অনটন কিছু নাঘব করার চেষ্টা করে, নিজে প্রায় অনাহারে থেকে বিশ্রাম না নিয়ে। মুদির বিশ্বাস, মেয়েটির মাজা-ভাঙ্গা ধরনের হাঁটার কারণ তার শারীরিক দুর্বলতা। তবে আজ সে সকিনা খাতুনকে দেখতে পেলে সে তার স্বাস্থ্যের কথা ভাবে না, অন্যদিনের মতো তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি সরিয়েও নেয় না, বরঞ্চ তার দিকে তাকিয়ে প্রস্তরবৎ নিশ্চল হয়ে থাকে।
মুদিখানার কিছু দূরে পথের ডান ধারে সে-পথের একমাত্র ঔষধালয় দেখা যায়। নানা রঙের রহস্যময় পানিতে ভরা বড়-বড় কতগুলি কাঁচের পাত্র, দাওয়াইর শিশি প্যাকেট ইত্যাদিতে সজ্জিত পুরানো কয়েকটা আলমারি, দেয়ালে বিভিন্ন ওষুধের বিজ্ঞাপন-একটি বিবর্ণ ঈষৎ ছেঁড়া বিজ্ঞাপনে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল বিদেশিনী নারী দাঁত বের করে হাসছে আজ ক-বছর ধরে তার ইয়ত্তা নেই-এবং সে-সবের মধ্যে বসে যুগপৎ কম্পাউণ্ডার-ওষুধবিক্রেতা রুকুনুদ্দিন শেখ সকিনার দিকে যখন তাকায় তখন কখনো কখনো তার কথা নয় তার মায়ের কথা সে ভাবে; মুদি যেমন মানুষের হাঁড়ির খবর রাখে সে তেমনি মানুষের নাড়ির খবর রাখে। সে জানে মেয়েটির মায়ের শরীর বড়ই খারাপ, পায়ে ভর দিয়ে একদিন উঠে দাঁড়ায় তো তিন দিন শয্যাশায়িনী হয়। ইদানীং সে-বাড়ি থেকে ওষুধপত্রের জন্যে কেউ আসে নি। মোক্তারের স্ত্রীর চিকিৎসার অবহেলাই হয়ে থাকবে। সে যে সহসা আরোগ্য লাভ করেছে তা সম্ভব নয়; তার ব্যাধি একটি নয়, এবং সর্দিকাশির মতো তুচ্ছ জিনিসও নয়; কোনো-কোনোদিন মুদির দোকানের মালিকের মতো সে সকিনা খাতুনের স্বাস্থ্যের কথাও ভাবে, তবে তার মাজা ভাঙ্গা ধরনের হাঁটার ভঙ্গির মধ্যে দোষের কিছু দেখতে পায় না। সে জানে দৈহিক গঠনের ওপর মানুষের হাঁটার ভঙ্গি নির্ভর করে, কিন্তু মেয়েটি যেভাবে ধীরে-ধীরে নিস্তেজভাবে হাঁটে তাই দেখে তার ধারণা হয়, এখনো সে সুস্থতার বাহ্যিক রূপ নিয়ে চলাফেরা করলেও সহসা একদিন তার স্বল্পপুঁজি স্বাস্থ্য নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং তখন তার মায়ের ক্ষেত্রে যেমন হয়েছে তেমনি নানাপ্রকার রোগব্যাধি দ্বিরুক্তি না করে তাকে আক্রমণ করবে।
তবে সেদিন রুকুনুদ্দিন মেয়েটির স্বাস্থ্যের কথা বা তার অসুস্থ মায়ের কথা ভাবে, বস্তুত ঔষধালয়ে বসে থাকলেও মানুষের জীবন-মরণ ব্যাধি-যন্ত্রণার কথা তার স্মরণ হয় না, কারণ সহসা এমনই স্থানে তার মন নিক্ষিপ্ত হয় যেখানে সবই যেন দুর্বোধ্য, যেখানে কোথাও কুলকিনারাও নজরে পড়ে না।
কুমুরডাঙ্গার একটি লোকই গভীর স্নেহমমতার সঙ্গে সকিনা খাতুনের প্রতি তাকায়: সে মোহনচাঁদ। চা-মিষ্টির দোকানের পর রতন নামক বোবা লোকটির কাঠগোলার পাশে কাপড়ের দোকানগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় যেটি, সেটি মোহনচাঁদের। অনেক দিন আগে ইংরেজ-হিন্দুদের আধিপত্যের সময়ে পশ্চিমের কোনো অঞ্চল থেকে তার পূর্বপুরুষ এ-মফস্বল শহরে এসে গুড়ের ব্যবসা খুলেছিল যা পরে কী-করে থানকাপড়ের ব্যবসায় পরিণত হয়। বংশানুক্রমে তাদের ভাষা স্থানীয় জবানের সঙ্গে এমনভাবে মিশ্রিত হয়ে পড়েছে যে আজ তা না-দেশী না-বিদেশী, না-বাঙলা না-বিহারি মাড়োয়ারী। তবে ভাষাটা জগাখিচুড়ির মতো হলেও মোহনচাঁদ যখন হাঁপর-হাসি হেসে শ্লেষ্মঘনকণ্ঠে কিছু বলে তখন তার মনোভাব বুঝতে কারো বেগ পেতে হয় না এই কারণে যে প্রতিটি শব্দ যেন গোলাবারুদের মতোই নিঃসৃত হয় তার মুখ থেকে। যে মানুষের পিতা-পিতামহ হরি-হরি করে ভাজন গান ধরে সকালে দোকান খুলত, তাদেরই বংশধর কোনো-কোনোদিন সে-গানের সুরে বা কথায় কোনো পরিবর্তন না এনে কেবল হরির স্থলে খোদার নাম বসিয়ে শুভকাজ শুরু করে। সেদিন তার উদাত্ত কণ্ঠ দোকানপাটের রাস্তার এ-মাথা থেকে সে-মাথা পর্যন্ত শোনা যায়। মধ্যে-মধ্যে মস্ত মস্ত ফোকলা দাঁত দেখিয়ে দিলদরিয়াভাবে হেসে সে বলে, লোকেরা যেন তাকে মোহনচাঁদ নয়, মামুনচাঁদ বলেই ডাকে। কিন্তু সে-নাম কারো মুখে আসে না : লোকটির বিশাল দৈহিক আকারে এবং তার মুখের খাঁজে-খাজে যে-শাশ্বত প্রাচীনতা অপনেয়ভাবে লিখিত-তা উপেক্ষা করা সহজ নয়।
সকিনা খাতুন যখন দোকানের সামনে দেখা দেয়, তার ঘণ্টাকয়েক আগেই মোহনাদ লোহার বেড়ি-দেয়া কাঠের মস্ত দরজা খুলে বহুব্যবহৃত শীতলপাটিতে আবৃত প্রশস্ত চৌকিতে আসনাধীন হয়ে বসেছে। মধ্যে-মধ্যে বেশ সকালেই তার দোকানে খদ্দেররা এসে উপস্থিত হয়। মামলা-মকদ্দমার জন্যে শহরে উপস্থিত গ্রামবাসীদের অনেকে আদালত বসার আগে কেনাকাটা করে ফেলতে চায়। তবে খদ্দের-পরিবেষ্টিত থাকলেও সকিনা খাতুন থানকাপড়ের দোকানের মালিকের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারে না। দেড় বছর আগে মেয়েটি যখন প্রথম এ-পথে দেখা দেয় তখন মোহনাদের মনে হয়েছিল, সে যেন ইঁদুরের ছা, এবং পরদিন মোহনচাঁদ যখন জানতে পারে সে স্কুলে পড়তে না গিয়ে পড়াতে যায় তখন তার বিস্ময়ের অবধি থাকে নি। কথাটি সে যথাসময়ে তার স্ত্রীকেও বলেছিল, এবং দোতলা-বাড়ির ওপর তলার জালি-ঢাকা জানলা থেকে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে তার স্ত্রীও বিস্মিত না হয়ে পারে নি, হয়তো স্বামীর মতো মেয়েটির প্রতি একটা দরদভাবও সে বোধ করে তখন। মোহনচাঁদের স্ত্রী তার স্বামীর মতো বিশালকায় নারী; তার উচ্চপ্রশস্ত কাঠামোর ওপর নিয়মিতভাবে অকৃপণ। মাত্রায় মেদের সঞ্চার চলছে বলতে গেলে আজন্ম থেকে, যার মাত্রা যৌবনোত্তরকালে আরো বেড়ে যায়। তার বিশাল নরম দেহে কিন্তু স্নেহের অন্ত নেই।
একদিন মোহনচাঁদ স্থির করে মেয়েটিকে একটি শাড়ি উপহার দেবে। মধ্যে-মধ্যে শহরের নেতৃস্থানীয় লোকদের দু-একটা শাড়ি বা কিছু থানকাপড় দিয়ে থাকে। কখনো সরাসরিভাবে উপহার হিসেবে দেয়, কখনো আবার বাকিতে দিয়ে পয়সার কথা আর তোলে না; কোনো-কোনো মানুষের বিবেকের জন্যে শেষোক্ত উপায়ে উপহার গ্রহণ করা সহজ। একদিন মোহনাদ সকিনা খাতুনের জন্যে একটি টুকটুকে লাল শাড়ি তুলে রাখে এবং বিনা মতলবে নিঃস্বার্থভাবে কাউকে কিছু উপহার দেবে এ-কথায় গোপনে গোপনে বেশ পুলকিত বোধ করে। তবে কীভাবে মনষ্কামনাটি পূর্ণ করে তা বুঝতে না পারলে শেষ পর্যন্ত শাড়িটা দেওয়া হয় নি। মেয়েটা যদি কিছু মনে করে, বা ফিরিয়ে দেয়? অকারণে উপহার দেওয়া যেন শক্ত কাজই। কারণ যে নেই তা নয়, কিন্তু কারণটা বলা যেন কঠিন : মেয়েটিকে এ-পথ দিয়ে যেতে দেখি প্রতিদিন। আহা, ছোট এইটুকু মেয়ে মাষ্টারনিগিরি করে, কেমন মায়া হয়। তারপর গ্রাম থেকে এক জোতদার এসে শাড়িটা কিনে নিয়ে গেলে সেখানেই ব্যাপারটা শেষ হয়। তবে সাময়িকভাবে, কারণ সম্প্রতি আবার খেয়ালটা ফিরে এসেছে। একটা শাড়িও হাতে পেয়েছে যা মেয়েটির কথা মনে করে খদ্দেরের সামনে বের করে নি এখনো : মিহিন সুতার শাড়ি, হাল্কা নীল রঙ, রক্তজবার মতো লাল পাড়।
সেদিন মেয়েটি পথে দেখা দিলে মোহনচাঁদ কিন্তু শাড়ির কথা ভুলে অস্পষ্ট কৌতূহলের সঙ্গে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর সে অদৃশ্য হয়ে গেলে হঠাৎ কেমন লজ্জিত বোধ করলে আপন মনে স্থির করে, হরি খোদা বলে আজই পাঠিয়ে দেবে শাড়িটা।
কাপড়ের দোকানগুলি শেষ হলে এবার পড়ে দুটি মনোহারী দোকান যে-দোকান দুটির দিকে তাকালে মনে হয়, তারা জোর করে গা-ঠেলাঠেলি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দুটির কোনোটাতেই সামগ্রী বিশেষ কিছু নেই, খদ্দেরও তেমন নেই বলে বেচাকেনাও বিশেষ হয় না।
তারপর সাইকেলের দোকান, যে-দোকানের ঝপ উঠলে নিত্য কয়েকটি সাইকেল আত্মপ্রকাশ করে। এ-শহরে সাইকেল-ক্রেতা বিরল, তাই দীর্ঘদিন ক্রেতার আশায় দাঁড়িয়ে থেকে-থেকে দোকানের সাইকেলগুলি এতদিনে বেশ রঙচটা হয়ে উঠেছে। তবে সে-বিষয়ে দোকানের মালিকের অবজ্ঞা ভিন্ন কিছু নেই। দোকানদার ছলিম মিঞাও মোটা সোটা ধরনের মানুষ, যেন ব্যবসায়ের দরিদ্র অবস্থার সঙ্গে স্বাস্থ্যের কোনো সম্বন্ধ নেই। আরেকটি ব্যাপারেও একটু অসামঞ্জস্যতা দেখা যায়। সেটি দোকানদারের মেজাজ, কারণ স্কুল মানুষ সম্বন্ধে সদা হাসিখুশি মেজাজের প্রচলিত জনমতকে মিথ্যা প্রমাণ করে লোকটি সর্বদা রুক্ষ মেজাজ প্রকাশ করে থাকে। তার কপাল জুড়ে বিরক্তিভাব কয়েকটি গভীর রেখায় স্থায়ীভাবে অঙ্কিত, চোখে সমগ্র জগতের প্রতি অবিশ্বাস-বিদ্রূপ, এবং কখনো যদি মুখে হাসি ফোটে সে-হাসি ব্যাঙ্গমূলক মুখব্যাদানের মতো দেখায়। ধূলাচ্ছন্ন দোকানটিতে পরিচিত কেউ দু-খণ্ড কথালাপের জন্যে এসে হাজির হলে মধ্যে-মধ্যে সে কটুক্তি বা মুখবিকৃতি করে তিক্তরসসিঞ্চিত মতামত প্রকাশ করা ব্যতীত অধিকাংশ সময়ে জকুটি-সহকারে রাস্তার দিকে তাকিয়ে নীরব হয়ে থাকে; সে ফালতু কথালাপের পক্ষপাতী নয়। সকিনা খাতুন যখন তার দোকানের সামনে দেখা দেয় তখন সে ভ্রূকুটি-সহকারেই তার দিকে তাকায়। তবে কখনো এক পলকের বেশি নয়। দেখামাত্র চোখ সরিয়ে নেয়, যেন প্রতিদিন তার দিকে একবার তাকানো একটি অভ্যাস হলেও অভ্যাসটি তার নিজেরই মনঃপূত নয়, মেয়েটির প্রতি তার কোনো কৌতূহলও নেই। তবে সেদিন মেয়েটি তার দোকানের সামনে দেখা দিলে অনেকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকে, ভ্রূকুটিটা তেমন সুস্পষ্ট মনে হয় না।
দোকানপাট শেষ হলে অল্পক্ষণের মধ্যে জাঙ্গার-পড়া তারের বেড়া এবং সারি বাধা গাছ-গাছালিতে ঘেরা একটি জায়গা পড়ে। ভেতরে লম্বা-লম্বা ঘাস, বনকাটা-ঝোপঝাড়, এক কোণে কলাবাগান। স্থানটি পতিতজমি বলে মনে হয়। গাছ-গাছালির ভেতর দিয়ে তাকালে পেছনে একটি পরিত্যক্ত দালানবাড়ির মতো নজরে পড়ে, কিন্তু ভালো করে তাকালে বোঝা যায় সেটি দালানবাড়ি নয়, কারণ সেটি এত ছোট যে তা মানুষের বাসস্থানের যোগ্য হতে পারে না। বস্তুত সেটি কুমুরডাঙ্গার সরকারি শবঘর।