৫. কানাইবাবু বেশ ইন্টারেস্টিং লোক

।। ৫৷৷

বিকেলবেলা অঞ্জনা আমাদের কানাইবাবুর কাছে নিয়ে গেলেন। কানাইবাবু বেশ ইন্টারেস্টিং লোক। চাকরি করেন রেলওয়ের বুকিং অফিসে-সেটা পেট চালানোর জন্য করতে হয়। ওঁর শখ হল ইলেকট্রনিক্সের জিনিস সারানো।

টেলিভিশন সেট, টেপ রেকর্ডার, ভিসিআর –হেন জিনিস নেই যাতে উনি হাত লাগান না। এ অঞ্চলের প্রায় সবাই আসে ওঁর কাছে।

পয়সা রোজগারের থেকে নতুন নতুন সার্কিট আর ডিজিটাল লজিকের প্যাঁচ উদ্ধার করেই উনি আনন্দ বেশি পান। আর ভালোবাসেন গল্প করতে।

আমরা যখন ওঁর বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলাম, তখন কানাইবাবু একটা সার্কিট ডায়াগ্রামের দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে ছিলেন।

অঞ্জনাকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে সার্কিট ডায়াগ্রামটা পাশে সরিয়ে রেখে বললেন,

“আয় মা, আয়। এঁরা কারা?”

অঞ্জনা পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমাদের আসার উদ্দেশ্যটা বললেন।

“ওরে বাবা, সে তো অনেকদিনের আগের ঘটনা।”

“সেইজন্যেই আপনার কাছে আসা স্যার। ম্যাডাম বললেন, যদি কেউ সে সময়ের কথা কিছু বলতে পারেন, তাহলে আপনি।”

“কথাটা ভুল বলেনি। কনকদা, অজয়দা, সুরেশদা –সবাই আমাকে ভাইয়ের মতো দেখতেন। কিন্তু জগদীশনারায়ণের ব্যাপারে আমি আর কী বলব। পুরোটাই একটা পাজল।”

“সুরেশবাবুর কেউ শত্রু ছিলেন স্যার?”

“সুরেশদার শত্রু?” একটু ভাবার চেষ্টা করলেন, কানাইবাবু। “তেমন তো কাউকে মনে পড়ছে না। তবে এইসব জায়গায় যেটা সাধারণত হয় সেটা হল জমিজমা নিয়ে গণ্ডগোল। সেরকম একটা গণ্ডগোল চলছিল কয়েকজনের সঙ্গে।”

“কাদের সঙ্গে স্যার?”

“জগদীশনারায়ণের জমিজমা দেখাশুনা করতেন সুরেশদা। বেশিরভাগ জমিই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। কয়েক বিঘা যা ছিল, সেগুলো চাষ করতে দিয়েছিলেন দু’জনকে। একজনকে ঘোষের পো বলেই সবাই চিনত, নাম বোধহয় কালীচরণ বা ওই ধরনের কিছু একটা। আরেকজন হল লালা লালা হালদার।” তারপর অঞ্জনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কানাইবাবু, “হ্যাঁরে, লালাকে কি তোর মনে আছে?”

“না,” মাথা নাড়লেন অঞ্জনা।

“মনে না থাকারই কথা, তুই তো তখন খুব ছোটো। ও হ্যাঁ, যা বলেছিলাম, লালা ছিল বেশ বাজে ক্যারেক্টারের লোক। ওর বৌ জদগীশনারায়ণের বাড়িতে কাজ করত, সেইজন্যেই বোধহয় জমিটা পেয়েছিল। লালা বা ঘোষের পো- কেউই ফসলের কোনো ভাগ জগদীশনারায়ণকে দিচ্ছিল না। সেই নিয়ে সুরেশদার সঙ্গে ওদের খুব ঝামেলা হয়। ঘোষের পো-কে চেষ্টাচরিত্র করে সুরেশদা গ্রামছাড়া করতে পেরেছিল, কিন্তু লালাকে নয়। কোর্ট কাছারির ভয় দেখিয়েও লাভ হয়নি। উলটে সুরেশদাকে মারধরের হুমকি দিয়েছিল ব্যাটাচ্ছেলে। একবার তো জগদীশনারায়ণের বাড়িতেও কয়েকজনকে নিয়ে চড়াও হয়েছিল-জগদীশনারায়ণ নাকি ওর বৌকে কুপ্রস্তাব দিয়েছে। সে এক যাচ্ছেতাই ব্যাপার। পরে অবশ্য একটা মিটমাট হয়েছিল।”

“কী রকম মিটমাট স্যার?”

“তা সঠিক করে বলতে পারব না। ব্যাপারটা নিয়ে সুরেশদা কিছু বলতে চাইতেন না। তবে জমির ঝামেলাটা মিটেছিল কারণ লালা তার বৌকে নিয়ে এখান থেকে চলে যায়। মনে হয় টাকাপয়সা দিয়ে কিছু একটা রফা করা হয়েছিল।”

“জগদীশনারায়ণ কি দুশ্চরিত্র ছিলেন স্যার?”

“বড়লোকদের ব্যাপার, সব খবর কি আর কানে আসে। তবে ওই ঘটনা ছাড়া আর তো কিছু শুনিনি। লালার বৌ চলে যাবার পর গ্রামেরই এক কমবয়সি বিধবাকে ওই কাজে বহাল করা হয়। অনেকে ভেবেছিল, আবার হয়তো কিছু ঘটবে, কিন্তু না। আসলে আগে যেটা বললাম, লালার ক্যারেক্টার ভালো ছিল না। পরে শুনেছি এরকম তোলাবাজি আগেও নাকি এক আধবার করেছিল।”

“এসব জেনেও সুরেশবাবু লালাবাবুকে কাজ দিয়েছিলেন স্যার!”

“হয়তো এগুলো জানতেন না। এ ধরনের ব্যাপার নিয়ে তো কেউ মুখ খোলে না। তবে লালা যে একটু গুণ্ডা টাইপের –সেটা অজানা থাকার কথা নয়।”

“জমিজমা ছাড়া সুরেশবাবুর সঙ্গে কি লালাবাবুর কোনো সমস্যা হয়েছিল স্যার?”

“তেমন তো কিছু শুনিনি।”

“লালাবাবু এদিকে আর আসেননি স্যার?”

“এসেছিল শুনেছি, আমার সঙ্গে দেখা হয়নি। যেটা জানি, সেটা হল গজলাল ধরা পড়ার কয়েকদিন পর কনকদা আর অজয়দার কাছে অনেক কান্নাকাটি করে গিয়েছিল। সুরেশদার সঙ্গে অন্যায় ব্যবহার করেছিল বলে ক্ষমা চেয়েছিল সবার কাছে। এমনকী জগদীশনারায়ণের ব্যাপারটাও যে ভুল বোঝাবুঝি-সেটাও স্বীকার করেছিল।”

“একটা কথা জিজ্ঞেস করি স্যার, সেই সময়ে রাজা জগদীশনারায়ণের আর সুরেশবাবুর মৃত্যু নিয়ে অন্য কোনো লোককে কি কেউ এখানে সন্দেহ করতো?”

“এই প্রশ্নটা আমি নিজেও অনেক করেছি। কিছুদিন আগে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক এই আপনাদেরই মতো আমার কাছে এসে একই প্রশ্ন করেছিলেন। তাঁকে যা বলেছিলাম, আপনাদেরও তাই বলছি। হ্যাঁ, গজলালকে আমরা কেউই পছন্দ করতাম না। একটা ঝাঁকা মাথায় নিয়ে এখানে এসে পাঁচ বছরের মধ্যে যে লোকটা দুটো বড় দোকানের মালিক হয়ে লাখ লাখ টাকার কারবার করতে পারে, সে কখনওই ধোয়া তুলসীপাতা নয়। শুনতাম একটা স্মাগলিং রিং–এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। তাই ক্রিমিনালদের সঙ্গে তার দোস্তি থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু সুরেশদাকে ওভাবে বেঁধে রেখে তিলে তিলে খুন করার কারণটা কী? গুলি করে ওঁকেও তো ফিনিশ করে দেওয়া যেত!”

“হয়তো ওঁকে খুন করার ইচ্ছে ছিল না স্যার।”

“হ্যাঁ, সেটাই পরে খবরের কাগজগুলোতে বেরিয়েছিল। ভয় দেখিয়ে জগদীশনারায়ণের হিরে আর সোনাগুলোকে হাতানোই ছিল গজলের লোকদের প্ল্যান। ওইদিন সুরেশদা থাকবেন না, বুড়ো জগদীশনারায়ণকে সহজেই ভয় দেখিয়ে কবজা করা যাবে –এই ভেবে লোকগুলো এসেছিল। কিন্তু হঠাৎ ওদের কেউ নিশ্চয়ই দেখে সুরেশদা ওখানে আসছে। সুরেশদা ওখানে একবার এসে পড়লে ঝামেলা হবে। তাই আচমকা ওঁর ওপর চড়াও হয়ে বেঁধে কাজের লোকদের চোখ এড়িয়ে আউটহাউসে রেখে এসেছিল। কাউকে খুনের উদ্দেশ্য নিয়ে ওরা আসেনি, কিন্তু তাড়াহুড়োর মধ্যে সেটা ঘটে গেছে। ফলে একজনের নয় –দু’-দু’জনের প্রাণ গেছে।”

“আপনি এই থিওরিতে বিশ্বাস করেন স্যার?”

“কে জানে! আসলে … থাক সে কথা।”

“থাকবে কেন স্যার!”

“আসলে এই নিয়ে কনকদা, অজয়দা আর আমি বহুদিন আলোচনা করেছি, কিছুই এগোয়নি। অজয়দা বলতেন, আমাদের থিওরি কে শুনবে বল, পুলিশের কাছে কেস ইজ ক্লোজড।”

“আপনাদের থিওরি কী ছিল স্যার?”

“থিওরি মানে –পুলিশ লালাকে অনেক জেরা করেও পরে ছেড়ে দিয়েছিল, কারণ লালা নাকি খুনের দিন মেদিনীপুরে ওর শ্বশুরবাড়িতে ছিল। সেটা সত্যি নাও হতে পারে। ওকে নাকি বনগাঁয় এক চায়ের দোকানে কেউ দেখেছিল। বনগাঁ এখান থেকে বড়জোর মাইল দশেক দূরে।”

“মাই গড!”

“কোনটে সত্যি কে জানে! তবে শুনেছি খুনিদের পরে অনেক অনুশোচনা হয়। সেইজন্যেই হয়তো পরে এসে এখানে অনেক কান্নাকাটি করে গিয়েছিল। বিশেষ করে বাণীবউদির কাছে।”

নামটা নতুন। আমরা একটু অবাক হয়েছি দেখে অঞ্জনা বললেন, “আমার শাশুড়ি।”

.

কানেকশনটা বুঝতে পারলাম। ইনিই ছিলেন সুরেশবাবুর স্ত্রী, যিনি পরে অজয়বাবুকে বিয়ে করেন। আমি হলে এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করতাম না। কিন্তু একেনবাবু সে পাত্তর নন।

“বুঝেছি স্যার, উনি সুরেশবাবুর স্ত্রী ছিলেন, পরে অজয়বাবুকে বিয়ে করেন।”

“ঠিক। সুরেশদার সংসারটা ভেসে যাচ্ছিল। অজয়দাই হাল ধরেন। ছোট্ট ছেলেটাকে মানুষের মতো মানুষ করেন। কীরে ঠিক বলেছি?” বলে সস্নেহে অঞ্জনার দিকে তাকালেন কানাইবাবু।

অঞ্জনা সলজ্জে হাসল।।

এক্কেবারে রাইট স্টেটমেন্ট স্যার, সুবীরবাবু একজন পারফেক্ট জেন্টলম্যান। ভালো কথা, অজয়বাবু কী করতেন?”

“অজয়দা হাবড়ায় একটা কারখানায় ফোরম্যান ছিলেন। পরে কনকদা যখন ওর সাইকেল সারাইয়ের ব্যবসা বেচে দিয়ে লরির ব্যবসায় নামেন তখন অজয়দাও বন্ধুর সঙ্গে যোগ দেন। দুজনে মিলে ব্যবসাটা বেশ বড় করে ফেলেছিলেন। এখানকার প্রায় সব ব্যবসায়ীই ওঁদের লরি ব্যবহার করতেন। তারপর বছর পাঁচেক আগে অজয়দা আর বউদি গাড়ি করে বেনারস যাবার পথে অ্যাকসিডেন্টে মারা যান। সে বছরই তো তোদের বিয়ে হবার কথা ছিল –তাই না?”

“হ্যাঁ,” অনুচ্চস্বরে অঞ্জনা বলল।

“ওদের বিয়েটা এক বছর পিছিয়ে গেল। তারপর কনকদাও ব্যবসা গুটিয়ে ফেললেন। তারপর তো গত বছর উনিও চলে গেলেন, নাতি-নাতনি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারলেন না।”

অঞ্জনা দেখলাম একটু লাল হলেন। বললেন, “আপনারা গল্প করুন, আমি যাই রাত্রির রান্নার জোগাড় করি।”

“আমরাও এখুনি উঠব ম্যাডাম।”

“না, না, আপনারা কথা বলুন না,’ বলে অঞ্জনা বিদায় নিলেন।

অঞ্জনা চলে যাবার পর একেনবাবু বললেন, “আপনারা সময় আর বেশি নষ্ট করব না স্যার- লালাবাবু ছাড়া আর কারোকে সন্দেহ হয়?”

“তেমন তো কাউকে মনে করতে পারছি না। আর সত্যি কথা বলতে কী, লালার ব্যাপারটাও নিতান্তই সন্দেহ। পুলিশ নিশ্চয়ই ওর অ্যালিবাই ভেরিফাই করেছিল।”

“করা তো উচিত ছিল স্যার। অ্যালিবাই যাঁর ছিল না, তিনি হলেন গজলালবাবু। ঠিক কি না স্যার?”

“তা ঠিক। গজলালের বিরুদ্ধে প্রমাণের অন্ত নেই। কিন্তু সুরেশদাকে গজলাল পছন্দ করত। কে না করত। গান পাগলা লোক ছিলেন। কথায় কথায় গানের কলি আওড়াতেন। প্রায়ই বলতেন গান গেয়ে যদি পেটে ভাত জুটত, তাহলে চাকরি বাকরি ছেড়ে শুধু গান নিয়েই পড়ে থাকতেন। ওগুলো অবশ্য কথার কথা। হিসেবিও ছিলেন যথেষ্ট। জদগীশনারায়ণের চাকরিটা ওঁর না নিলেও চলত। আমরা খ্যাপাতাম, বুড়ো মরলে সুরেশদা টু-পাইস পাবেন –সেইজন্যেই সুরেশদা কাজ নিয়েছেন। যাক সে কথা, সুরেশদার কথা বলতে শুরু করলেই আমি ইমোশনাল হয়ে পড়ি। তবে হ্যাঁ, গজলালের ব্যাপারে আমার আরও একটা খটকা ছিল।”

“কী স্যার সেটা?”

“সুরেশদা অনেককে ভুল নামে ডাকতেন। গজলালকে উনি বরাবর জগলাল ডেকে এসেছেন। যেমন লালাকে ভালা। ভুল ধরিয়ে দিলেও একবার দু’বার ঠিক বলতেন, তারপর আবার সেই এক ভুল। এমনকী লালা যখন সুরেশদাকে এসে হুমকি দেয়, আমরা সুরেশদাকে থানায় ডায়রি করতে বলি। সুরেশদা সেই ডায়রি করে এসেছিলেন ভালার নামে। সেই নিয়ে আমরা খুব হাসাহাসি করেছিলাম। সেইজন্যেই আমার মনে হয়েছিল– উনি জগলাল না লিখে গজলাল লিখলেন কেন। হতে পারে উনি অনেক ভাবনাচিন্তা করে ঠিক নামটাই লিখেছিলেন। তাও একটা খটকা থাকে।”

“ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট স্যার। ও হ্যাঁ, আপনি তো জানেন, উনি সাংকেতিকভাবে গজলালবাবুর নাম লিখেছিলেন।”

“হ্যাঁ, তাতে আমি আশ্চর্য হইনি। উনি জানতেন, আর কেউ না হোক-কনকদা বা অজয়দা ওটা বুঝবেন। নিজেদের মধ্যেও ওঁরা গোপনে এইভাবে কথা চালাচালি করতেন।”

“আপনি কী করে জানলেন স্যার?”

“সেটা একটা মজার ব্যাপার। একবার কনকদার কাছে গ্রামের কয়েকটা ছেলে এসেছিল সুরেশদার লেখা চিঠি নিয়ে। চিঠিতে ছিল, ‘ভাই কনক, আমার হয়ে ওদের হাতে একশো টাকা দিও, পরে তোমায় আমি দিয়ে দেব বা ওই রকম কিছু। কনকদা চিঠি পড়ে টাকা না দিয়ে ছেলেগুলোকে ভাগিয়ে দিল। ওরা চলে যাবার পর আমি বললাম, “তাড়িয়ে দিলেন ছেলেগুলোকে –সুরেশদা নিশ্চয়ই দুঃখ পাবেন।’ ‘কেন দুঃখ পাবে। ওই তো লিখেছে –NO। দেখলাম নীচে সুরেশ নামের পেছনে লেখা 14 15। অ্যালফাবেটের ১৪ নম্বরে N আর ১৫ নম্বরে O।” ।

“ভেরি ক্লেভার স্যার। আচ্ছা, জগদীশনারায়ণ যেদিন মারা যান, সেদিন তো ১৫ই অগাস্ট ছিল তাই না?”

“ঠিক তাই।”

“পুলিশ রিপোর্টে দেখেছিলাম স্যার, কাজের লোকেরা সুরেশবাবুর খোঁজে স্কুলে গিয়েছিল। সেখানে সুরেশবাবু ছিলেন না। স্কুলের পাশে এক মাস্টারমশাই থাকতেন, তিনিই পুলিশকে খবর দেন। সেই মাস্টারমশাই কে আপনি জানেন?”

“অনাদিবাবু, তিনিও গত হয়েছেন।”

“১৫ই অগাস্ট ছুটির দিন –কাজের লোকগুলো স্কুলে সুরেশবাবুর খোঁজ করতে গিয়েছিল কেন?” একেনবাবু নিজেকেই যেন প্রশ্নটা করলেন।

“আমার ধারণা ওরা ভেবেছিল সুরেশবাবু তখনও ওখানে আছেন। ওই দিন স্কুলে সকালবেলা ফ্ল্যাগ তোলা হতো, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হতো। একটা ফাংশনও হতো। স্কুলে ছাত্রদের গান সুরেশদাই শেখাতেন। ফাংশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত সুরেশদা ওখানে থাকতেন। দুপুরের একটু আগে বাড়ি ফিরতেন। কিন্তু সেদিন সেখান থেকে সুরেশদা আর বাড়ি ফেরেননি। কোনো কাজে জগদীশনারায়ণের কাছে গিয়েছিলেন। সেটাই কাল হল।”

“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ।”

.

বাড়ি ফেরার পথে দেখি একেনবাবু একটু পিছিয়ে পড়েছেন। এক মনে ডায়েরি বার করে কাগজে কী সব আঁকিবুকি কাটতে কাটতে হাঁটছেন।

“কী বুঝছেন?” ঘাড় ঘুরিয়ে একবার জিজ্ঞেস করলাম।

উত্তর নেই।

“কী মশাই, একেবারে মৌনীবাবা হয়ে গেলেন যে!” প্রমথ ধমকের সুরে বলল।

“ভাবছি স্যার।”

“কী ভাবছেন এত?” আমি প্রশ্ন করলাম।

“ছাড়ান দে,” প্রমথ বলল। “এখন নানারকম নকশা চলবে ওঁর।”

যখন বাড়ি ফিরলাম, তখন সুবীরবাবু ফোনে জানি কার সঙ্গে কথা বলছেন।

“না, কালকে এখানে কোনো জায়গা নেই। আপনারা নেক্সট উইকে আসবেন বলেছিলেন… আমি বুঝতে পারছি তিন মাস আপনারা থাকবেন, কিন্তু গেস্টদের তো আমরা চলে যেতে বলতে পারি না।”

হঠাৎ একেনবাবু সুবীরবাবুকে ইশারা করলেন। সুবীরবাবু ফোনের মুখে হাত দিয়ে বললেন, “কী?”

“ওঁদের আসতে বলুন স্যার, আমরা কাল সকালেই চলে যেতে পারি।”

“না, না, সে কী কথা, আপনারা দু’দিনের জন্য থাকবেন ঠিক করে এসেছেন।”

“প্লিজ স্যার, বলুন –আপনার এই ক্ষতি আমরা হতে দেব না।”

সুবীরবাবু কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে একেনবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “ঠিক আছে কাল বিকেলে ঘর খালি হবে, আপনারা আসুন।”

ফোনটা নামিয়ে সুবীরবাবু বললেন, “ছি, ছি, এটা কী বিশ্রী হল।”

“কিচ্ছু বিশ্রী হল না স্যার। তিন মাসের জন্য আপনি গেস্ট পাচ্ছেন, এক রাতের জন্য তাকে খোয়াবেন, এটা একটা কথার কথা হল?”

একেনবাবু ব্যাপার দেখে আমি অবাক। এর মধ্যেই ওঁর তদন্ত শেষ!

“আপনার তদন্তের কী হল?” অঞ্জনা প্রশ্ন করলেন।

“বুঝলেন, ম্যাডাম, বাইশ বছরের পুরনো রহস্যের উদঘাটন দু’দিনে হবে না। তবে কানাইবাবু বেশ ইন্টারেস্টিং লোক-আর আপনাদের খুব ভালোবাসেন মনে হল।”

“হ্যাঁ, আমাদের আপন কাকার মতো। কিন্তু আপনারা কালই চলে যাবেন ভাবতে ভীষণ খারাপ লাগছে। কিছুই খাওয়াতে পারলাম না।”

“সে কী কথা!” প্রমথ বলল, “কানাইবাবুর কাছে যাওয়ার জন্য মেনু কম হল নাকি?”

“তা হল না। তবে কালকের মেনু তো বাদ পড়ল।”

সুবীরবাবু বললেন, “সত্যি, আপনারা আসাতে ও খুব খুশি হয়েছে।”

“খুশি তো আমাদের হবার কথা। উনি খাটছেন আর আমরা খাচ্ছি।”