৫
কাজির সঙ্গে মহাপ্রভুর এই সাক্ষাৎকারের বিষয়টি আমরা সামান্য একটু বিস্তারিতভাবে বললাম এই কারণে, যেহেতু এই ঘটনা থেকে দুটি তত্ত্ব খুব পরিষ্কারভাবে বেরিয়ে আসে। এক, মহাপ্রভু যে তত্ত্বদর্শন জীবন দিয়ে অনুভব করেছিলেন, সেটাকে তিনি সর্বসাধারণের হৃদয়ের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। জাতিবর্ণের সমস্ত উচ্চতা থেকে বঞ্চিত যেসব মানুষেরা মহাপ্রভুর ধর্ম আত্মসাৎ করেছিল—সেটা সমাজের বড়ো মানুষেরা ভালো চোখে না দেখলেও এ প্রশ্নটা থেকেই যায় যে, কেমন করে এক বিরাট তত্ত্ব-নিগূঢ় দর্শনকে তিনি সর্ব-সাধারণের উপযোগী করে তুললেন? এর পিছনে রহস্যটা কী? অনেকেই আমাকে বলেছেন এবং অনেকেই সভা-সমিতিতে এমন সহজবোধিনী বক্তৃতা দিয়ে বলেন—চৈতন্য যে সমাজে জন্মেছিলেন, তখন হিন্দু-মুসলমানের উদার সহাবস্থান চলছিল। সুলতান হুসেন শাহ বহুতর হিন্দুকে নিজের মন্ত্রীসভায় ঠাঁই দিয়ে নিজের উদার চেতনার পরিচয় দিয়েছিলেন। বিশেষত তখন মরমিয়া সুফি-সাধকেরা বঙ্গদেশে ধর্মসাধনার এক উদার ধারা তৈরি করেছিলেন এবং সেই মরমিয়া সুফিদের মরমি স্পর্শ লেগেছিল চৈতন্যের ধর্মে; অর্থাৎ চৈতন্য-জন্মের পূর্ব-পটভূমিতে যে উদারতা ছিল, তাই চৈতন্যকে উদার করেছে।
আমরা সবিনয়ে জানাচ্ছি—সভা-সমিতিতে এই অতি সরলীকৃত প্রাণঢালা বক্তৃতার সব কথা আমরা মানতে পারি না, পারি না, তার কারণ—এগুলি অল্পশ্রুত মানুষের গলায় গলা-মেলানো কথা যা কণ্ঠ-পরম্পরায় হাওয়ায় উড়িয়ে-দেওয়া গানের মতো শোনায়। ব্যাপারটা খুব ‘ক্যাটিগরিক্যালি’ বলতে গেলে এইভাবে বলা যায় যে, মহাপ্রভু চৈতন্য হিন্দু সমাজেরই এমন একটা ‘প্ল্যাটফর্ম’ ব্যবহার করেছেন, যেখানে উদারতার বীজ কিছু থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু সে বীজও খুব কঠিন আবরণে নিহিত ছিল। অন্যদিকে হুসেন-শাহী যুগের যে উদার প্রশ্রয়টুকু তিনি পেয়েছেন, সেটা হুসেন শাহর প্রয়োজনেই তৈরি, সেই সমাপতনটুকু তাঁর কাজে লেগেছে মাত্র। সর্বশেষ কথা হল, চৈতন্যের এই উদার ধর্ম একান্তভাবে চৈতন্যেরই সৃষ্টি। এখানে সুফিদের বিন্দুমাত্রও প্রভাব নেই। আমি জানি—এই সব কটি প্রস্তাব এই সামান্য পরিসরে কিছু বোঝানো সম্ভব নয়, তবু তার সূত্রমাত্র উচ্চারণ না করলে আমার প্রবন্ধের ত্রুটি থেকে যাবে।
কথাটা হুসেন শাহকে দিয়েই শুরু করি। হুসেন শাহকে অনেক ঐতিহাসিক বাংলার ‘আকবর’ নামে চিহ্নিত করেছেন। হয়তো তাঁর মন্ত্রীসভায় বহুতর হিন্দুদের দেখে অথবা তাঁর আমলে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কে যথেষ্ট স্থিরতা ছিল বলেই ঐতিহাসিকদের এমন মত সৃষ্টি হয়েছে। জিজ্ঞাসা তবু থেকেই যায়। জিজ্ঞাসা হয়—আচ্ছা! তখনকার হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক এখনকার রাজনীতি এবং সমাজের নিরিখে কিন্তু বিচার করা যায় না। বঙ্গদেশে মুসলমান অধিকার কায়েম হওয়ার পর শাসিত হিন্দুরা শাসকের বিরুদ্ধে বিরাট বিক্ষোভ করেছে—এমন ঘটনা রাজা গণেশের আমলের পরে আর একটাও প্রায় হয়নি। অন্যদিকে তখনকার রাজনৈতিক পটভূমিকায় একপক্ষ শাসক, অন্যপক্ষ শাসিত।
সুলতান হুসেন শাহর যে নানান উদারতা, বিশেষত রাজকার্যে হিন্দুদের নিয়োগের মতো আপাত উদারতাও কোনোভাবে পরবর্তী ইলিয়াস শাহী বা মাহমুদ শাহী বংশের কুলতিলক রুকনুদ্দিন বারবক শাহর সঙ্গে তুলনীয় নয়। রুকনুদ্দিন বারবক শাহ-ই বাংলার প্রথম সুলতান, যিনি রাজকার্যে বহুতর হিন্দু মন্ত্রী নিয়োগ করেছিলেন এবং রাজকার্যের বাইরেও বহুতর হিন্দুর পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। এখানে তাঁর উদারতাই বেশি কাজ করেছে এবং সেই উদারতা নানাভাবেই প্রমাণ করা যায়। কিন্তু রুকনুদ্দিনের পরম্পরায় যাঁরা ভাবেন সৈয়দ হুসেন শাহও একইরকম উদার ছিলেন, তাঁরা ভুল করবেন। বরঞ্চ বলা উচিত— হুসেন শাহর প্রখর রাজনৈতিক বুদ্ধিই তাঁকে রাজকার্যে হিন্দু মন্ত্রী নিয়োগ করতে শিখিয়েছিল নিজের প্রয়োজনে।
বাংলায় ইলিয়াস শাহী, মাহমুদ শাহী এবং হাবশি রাজত্বের ইতিহাস যদি খেয়াল থাকে, তবে মানতেই হবে যে, হুসেন শাহ তাঁর পূর্ববর্তী রাজবংশের ক্রিয়াকলাপ থেকে অদ্ভুত প্রয়োজনীয় একটি শিক্ষা নিয়েছিলেন এবং সেই শিক্ষাই তাঁর কাছে রাজকার্যে হিন্দু-মন্ত্রীর নিয়োগবার্তা পৌঁছে দিয়েছে। ইলিয়াস শাহী বা মাহমুদ শাহী সুলতানদের মধ্যে সেই রুকনুদ্দিন বারবক শাহ-ই কিন্তু বহু হাবশি অনুচর আমদানি করেছিলেন। এই হাবশিরা তাঁর আমলেই বহুতর রাজকার্যে নিযুক্ত হয়েছে এবং প্রাসাদের প্রহরী হিসাবেও তাদের নিযুক্তি ঘটেছে বহুতর ক্ষেত্রে। বারবক শাহের পরে যাঁরা বাংলার সুলতান-পদে অধিষ্ঠিত হন, তাঁরা অনেকেই সুলতান হওয়ার সময় হাবশিদের সাহায্য গ্রহণ করেন এবং অনেকে হাবশিদের প্রতিপক্ষ হিসেবেও ভাবতে শুরু করেন। একটা সময় আসে যখন এই দাসভাবাপন্ন হাবশিরাই মূলস্রোতের রাজাদের সরিয়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজেরাই রাজা হয়ে বসেন। চার কি পাঁচ বছর এই হাবশি রাজত্ব চলে এবং হুসেন শাহ শেষ হাবশি রাজা মুজাফফর শাহকে হত্যা করেই বাংলার সুলতান হয়ে বসেন।
লক্ষণীয় ব্যাপার হল, সিংহাসনে বসার পর থেকেই হুসেন শাহ হাবশিদের বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করতে আরম্ভ করেন। হাবশিদের রাজকার্যে নিয়োগ করার যে কুফল শেষ ইলিয়াস শাহী রাজারা পেয়েছিলেন, সেই কুফল থেকেই হুসেন শাহ হিন্দুদের রাজকার্যে নিয়োগ করার শিক্ষা গ্রহণ করেন— কারণ অবশ্যই সেই মুঘল বাবরের বাণী— সিংহাসনে-বসা যে কোনো সুলতান-আমির-ওয়াজিরদের কাছেই বাঙালি বশ্যতা স্বীকার করে, তারা ever obedient to any changing Sultan coming to power by whatever means, তাদের রাজভক্তি এতটাই। আসলে হুসেন শাহরও সেই রাজনৈতিক বুদ্ধি বা ‘পোলিটিক্যাল অ্যাকুইমেন’ ছিল, যাতে আপন স্বজনদেরও তিনি মন্ত্রীপদে বহাল করেননি, হাবশি দাসদের তো দূরের কথা। অতএব রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক স্বার্থেই বিশিষ্টবুদ্ধি হিন্দুদের তিনি আপন শাসনকার্যে নিয়োগ করেছেন। শাসনের বহিরঙ্গে যখন হুসেন শাহ এই প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছিলেন, সেখানে যখন-তখন পরমতে অসহিষ্ণু হয়ে হিন্দু-সমাজের ওপর তিনি প্রত্যক্ষ অত্যাচার চালাবেন— এত নির্বোধও তিনি ছিলেন না।
বস্তুত মুসলমান শাসক হিসেবে শাসিত হিন্দু-সমাজের যে চরিত্র হুসেন শাহর কাছে কাম্য হবার কথা, সে চরিত্রটা পূর্বেই সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল এবং তা হয়ে গিয়েছিল হুসেন শাহর অনেক আগেই—তাঁর পূর্ব পূর্ব সুলতানদের সময়ে। ইতিহাসের ইঙ্গিত যদি মনে রাখেন, তাহলে দেখবেন—এই শ্যাম বঙ্গদেশে আমরা দু-দুটো বহিরাগতের শাসন পেয়েছি—মুসলমান শাসন এবং ইংরেজ শাসন। দুই ক্ষেত্রেই নিজস্ব ধর্ম-ঘোষণা এবং প্রচারের ধরনটা কিন্তু একই। অর্থাৎ দুই ক্ষেত্রেই বহিরাগতের রাজনৈতিক শাসন আরম্ভ হওয়ার পর ধর্মের শাসন, ধর্মান্তকরণ আরও দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হতে থাকে সমাজের মধ্যে। অন্যদিকে হিন্দু-সমাজের ধর্মীয় সংস্কারগুলিও এমনভাবে জাতিবর্ণের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল, যাতে দরিদ্র এবং নিম্নবর্ণের মানুষগুলিকে ধর্মান্তরিত করাও অনেক সহজ ছিল। তাছাড়া হিন্দুধর্মের নিজস্ব সংরক্ষণশীলতা এবং গোঁড়ামিও নিতান্ত প্রত্যক্ষভাবেই অন্য ধর্মের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে তুলেছিল।
বঙ্গদেশে মুসলমান সুলতানদের রাজনৈতিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সমান্তরালভাবে ইসলাম ধর্মের প্রভাবও বাড়তে থাকে। দলে দলে সুফি সাধকেরাও আসতে থাকেন আপন সাধন প্রচারের জন্য। চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ পাদে বসে মির সইয়দ আশরফ জাহাঙ্গির সিমনানি-র মতো প্রসিদ্ধ সুফি সাধক লিখেছেন— বঙ্গদেশে এমন গ্রাম অথবা শহর আর একটিও নেই, যেখানে পবিত্র সুফি সাধকেরা আসেননি অথবা অবস্থান করছেন না। তার মানে রাজার শাসন এবং ধর্মের অনুশাসন একই সঙ্গে চলছে। ইলিয়াস শাহী সুলতানরা যখন বঙ্গদেশে রাজত্ব করছেন, তখন সুফি-দরবেশরা স্বধর্ম প্রচারের সুযোগ পেয়েছেন যথেষ্ট। সেই রাজশাসনের ওপর দরবেশদের প্রভাব খুব কম ছিল না এবং সব সময় যে তাঁরা খুব মরমিয়া সাধক ছিলেন, রাজনৈতিক কোনো ব্যাপারে কখনও মাথা ঘামাতেন না, তাও নয়।
মহাপ্রভুর জন্মের পূর্বে একশো বছরেরও বেশি সময় জুড়ে ইলিয়াস শাহী, মাহমুদ শাহী এবং হাবশি রাজত্ব চলেছে বাংলাদেশে। ইলিয়াস শাহী রাজাদের মধ্যে স্বয়ং ইলিয়াস শাহ তো বটেই এবং আরও দু-একজন— হয়তো বা রাজনৈতিক কারণেই যথেষ্ট হিন্দু-বিরোধী ছিলেন। হিন্দুদের যে তাঁরা অনেক সময় প্রয়োজনে রাজকার্যে বহাল করেননি তা নয়, তবে রাজকার্যে হিন্দুদের এই কদর দরবেশ-সুফিরাই পছন্দ করেননি। ইলিয়াস শাহী বংশের তৃতীয় সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ বহু হিন্দু নিয়োগ করেছিলেন রাজকার্যে, কিন্তু সুফি দরবেশরা এই নিয়োগ পছন্দ করেননি। বিহারের মুজাফফর শামস বলখির মতো পণ্ডিত দরবেশ, যাঁকে গিয়াসুদ্দিন যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতেন, সেই তিনিও কিন্তু একটি বিশ্বস্ত চিঠিতে সুলতানকে লিখেছেন—তোমাদের শ্রেণির বাইরের কারো সঙ্গে অন্তরঙ্গতা স্থাপন কোরো না। কাফের এবং অপরিচিত লোকদের বিশ্বস্ত কর্মচারী বা মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করা মুসলমানদের উচিত নয় এবং কাজের সুবিধে হলেও তা অনুচিত। হ্যাঁ কাফেরদের কিছু কাজ দেওয়াই যেতে পারে, কিন্তু তাদের ‘ওয়ালি’ (প্রধান তত্ত্বাবধায়কের কাজ) নিযুক্ত করা ঠিক নয়, কারণ তা করলে তারা মুসলমানদের ওপর কর্তৃত্ব লাভ করবে।
মুজফফর শামস বলখির এক বিরাট চিঠির অংশমাত্র আমরা দেখিয়েছি এবং এই চিঠি আবিষ্কার করেছিলেন সৈয়দ হাসান আসকারি যিনি বলখি-কে সুফি সাধক হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। এই চিঠিটি ১৯৫৬ সালের ইতিহাস সম্মেলনে পড়বার সঙ্গে সঙ্গে আসকারি সাহেব বক্তব্য করেছেন— শামস বলখি-র এই চিঠি পাওয়ার কিছুদিন পরেই হিন্দু মন্ত্রী রাজা গণেশের হাতে এই ইলিয়াস শাহী সুলতাদের যা পরিণতি ঘটেছিল, তাতে মুজাফফর শামস বলখি-র ওই সতর্কবাণী একেবারে দৈববাণী বলে মনে হয়—The warning given by the saint of Bihar of Ghiyasuddin Azam Shah appears to be rather prophetic. তার মানে আসকারি-সাহেবের মতো একজন প্রাজ্ঞ ঐতিহাসিকও মনে করেন যে, বিধর্মী কাফের হিন্দুদের রাজকার্যে নিয়োগ করাটা ঠিক হয়নি। কিন্তু এটাও তো ভাবা দরকার ছিল যে, প্রয়োজন এবং বাধ্যতা ছাড়া প্রায় কোনো মুসলমান রাজাই হিন্দুদের রাজকার্যে নিয়োগ করেননি, যদিও সেই ভাবনাটাও দরবেশ বলখি-র সুপরামর্শের অন্তর্গত ছিল, কেননা তিনি লিখেছিলেন যে, প্রয়োজন বা সুবিধের কারণেও হিন্দুদের কোনো গুরুতর কাজে নিযুক্ত করা উচিত নয়, তাতে বিদ্রোহ বা গোলযোগের সম্ভাবনা থেকে যায়।
আমাদের বক্তব্য হল— পণ্ডিতজনেরাই জানিয়েছেন যে, গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ তাঁর শাসনের প্রথম কল্পে বহুতর হিন্দুকেই রাজকার্যে নিযুক্ত করেছিলেন, কিন্তু সুফি দরবেশদের প্রতি শ্রদ্ধাবশত এক সময় সম্ভবত সব হিন্দুকেই তিনি রাজকার্য থেকে সরিয়ে দেন। এতে অন্যরা ক্ষুদ্ধ হলেও কেউই কিছুই করতে পারেননি, কিন্তু রাজা গণেশ— যিনি সম্ভবত আজম শাহের মন্ত্রীর কাজ করেছিলেন কোনো সময়—সেই গণেশ যে একদিন গিয়াসুদ্দিন আজম শাহের বংশধরদের রাজত্ব টলিয়ে দিয়ে নিজে সিংহাসন দখল করেছিলেন, তার কারণ কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা নয়। তার কারণ রাজা গণেশের নিজস্ব শক্তি এবং সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল শেষ ইলিয়াস শাহী সুলতানদের অক্ষমতা এবং দুর্বলতা। না হয় দরবেশ বলখির দৈববাণী ফলেই গেল এবং আমরাও রাজা গণেশের উত্থান-কাহিনির রাজনৈতিক নিদান নিয়ে ভাবনা-বিস্তার নাই ঘটালাম এখানে, কিন্তু একজন সুফি-সাধক—যাঁদের সর্বত্রই প্রায় ‘মরমিয়া’ উপাধি জুটেছে—সেই সুফি সাধকের পরমতসহিষ্ণুতা কতটুকু! বলখি-র চিঠিখানা পুরো উদ্ধার করতে পারলে দেখতেন—হিন্দু-সমাজের প্রতি যে কোনো উদারতার চিহ্নকেই ঈশ্বরকে অবজ্ঞার প্রমাণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বলখি।
যাঁরা চৈতন্যের ওপর সুফি-প্রভাব নিয়ে বেশি বক্তৃতা দেন, তাঁরা পড়েছেন এবং শুনেছেন অনেক বেশি, কিন্তু বুঝেছেন কম। বাংলার সুলতানি শাসনে একবার, মাত্র একবারই রাজা গণেশের মতো ভয়ংকর বিরোধিতা সহ্য করতে হয়েছে শাসক-মুসলমানদের, কিন্তু তাঁর এই বিরোধিতাই অনেক বিখ্যাত সুফি-দরবেশদের তথাকথিত মরমিয়া চরিত্র উন্মোচন করে দিয়েছে। রাজা গণেশ খুব সম্ভবত গিয়াসুদ্দিন আজম শাহর মিত্র এবং সেবকের মধ্যেই পরিগণিত ছিলেন কিন্তু মুজাফফর শামস বলখি-র প্ররোচনায় স্থানচ্যুত হয়ে আপন সামরিক ক্ষমতায় তিনি সুলতানকে রাজ্যচ্যুত করে হত্যা করান এবং তাঁর বংশধরদের এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়ে রাজ্য দখল করেন।
খ্রিস্টীয় তেরো শতাব্দী থেকে আরম্ভ করে আঠেরো শতাব্দী পর্যন্ত মুসলমান শাসনের মধ্যে মাত্র একবারই এ-রকম অসাধারণ উত্থান সম্ভব হয়েছিল এবং তা সম্ভব হয়েছিল রাজা গণেশের জন্যই। তাঁর রাজত্বকাল বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, কারণ তাঁর ছেলে মুসলমান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন রাজ্যের লোভে এবং পিতার বিরুদ্ধ-পক্ষীয় মুসলমান শাসককে টাকা খাইয়েই তিনি রাজ্য লাভ করেছিলেন। তবু সমস্ত ঘটনার মধ্যে এটাই উজ্জ্বল সংবাদ হয়ে ওঠে, যখন শুনি—গণেশ রাজা হওয়ার পর যখন একটু প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেছেন, তখন বাংলার মুসলমান আমির-ওমরাহরা কিছুই করতে পারেননি এবং গণেশকে শাসন করার জন্য গৌড়-মিথিলা পেরিয়ে জৌনপুর থেকে সুলতান ইব্রাহিম শর্কিকে ডেকে আনতে হয়েছিল এবং বাংলার এই উদ্যমী কাফের-কে ধ্বংস করার যে আহ্বান ইব্রাহিম শর্কির কাছে গিয়েছিল, সে আহ্বানও করেছিলেন একজন দরবেশ তথা সুফি-সাধক নূর কুৎব আলম।
আমরা পূর্বে যে গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ-র কথা বলেছি, উক্ত সুফি শাধক নূর কুৎব আলম তাঁর সহপাঠী ছিলেন। রাজা গণেশের রাজ্য-শাসন যতখানি না তাঁকে ক্রুদ্ধ করেছিল, তার চেয়ে বেশি আঘাত করেছিল সুফি দরবেশের ওপরে গণেশের অত্যাচার। বস্তুত গণেশ খুব ভোলেভালা মানুষ ছিলেন না। যে কোনো কারণেই হোক, তাঁর এটা মনে হয়েছিল যে, মুসলমান শাসকের চেয়েও দরবেশরা শাহের রাজবৃত্তি অনুসন্ধান করতে গিয়ে সুফিদের প্রসঙ্গে এসে বলেছিলাম যে, হুসেন শাহের অভীষ্ট কাজ সুফি দরবেশরাই করে দিয়েছিলেন, ফলত তাঁকে আলাদা করে ইসলামের প্রসার ঘটাতে পরিশ্রম করতে হয়নি।
বস্তুত শুরু থেকেই তাই হয়েছে, এবং রাজা গণেশ এটা মর্মে-মর্মে অনুভব করেছিলেন বলেই তাঁর সবচেয়ে বেশি ক্রোধ ছিল দরবেশ সুফিদের ওপরেই। একটা নিমিত্ত ধরেই ক্রোধ চরমে ওঠে এবং একদিন সেই ঘটনানিমিত্ত ঘটল—যার বিবরণ আছে রিয়াজ-উস-সালাতিনে। সেদিন এক দরবেশ বদর-উল-ইসলাম এসেছিলেন রাজা গণেশের সভায়। গণেশ তখন রাজসভায় বসেছিলেন। বদর-উল-ইসলাম সভায় এসে রাজাকে কোনো অভিবাদন না করেই বসে পড়লেন অতিথির নির্দিষ্ট আসনে। গণেশ দরবেশকে এই অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ জিজ্ঞাসা করতে বদর-উল-ইসলাম বললেন— শিক্ষিত লোক বিধর্মীকে অভিবাদন করে না। কথাটা শুনে ভয়ংকর রাগ হলেও গণেশ সেদিন তাঁকে কিছু বললেন না বটে, কিন্তু অনুরূপ অপমান আর একদিন যখন ঘটল, তখন তিনি তাঁকেই শুধু হত্যা করেই স্তব্ধ হলেন না, পাণ্ডুয়ার অন্যান্য বহু দরবেশ এবং উলেমাকেও তিনি জলে ডুবিয়ে মারার আদেশ দেন।
আমরা গণেশের এই আচরণ সমর্থন করি না, যেমন সমর্থন করি না এখনকার দিনের বাবরি মসজিদ এবং রামমন্দির নিয়ে অহেতুক এবং প্রতিশোধমূলক সংঘর্ষ। কিন্তু ঘটনা হল—একটি ক্রুদ্ধ ক্ষুব্ধ আচরণ আরও একটি দুর্দমনীয় ক্রোধাগ্নির জন্ম দেয় এবং সেই অগ্নি-সৃষ্টিতে পীর-দরবেশ-সুফিরাও শামিল হন, ঠিক এখন যেমন হিন্দু সাধু-মহান্তদের রাজনীতিতে শামিল হতে দেখেছি। যাই হোক, রাজা গণেশের এই দমন-নীতির ফলেই হোক অথবা মুসলমানদের পূর্বভুক্ত বা পূর্বশাসিত ভূমিখণ্ডের ওপর একজন হিন্দু রাজার আধিপত্যের কারণেই হোক, দরবেশ নূর কুৎব আলম আর সহ্য করতে না পেরে চিঠি লিখলেন জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কিকে—যাতে তিনি গৌড়বঙ্গকে বিধর্মী হিন্দুদের হাত থেকে রক্ষা করেন। ইব্রাহিম শর্কি দরবেশ নূর কুৎব আলমের মর্যাদা জানতেন, তবুও হঠাৎ বাংলা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে জৌনপুরের আর এক দরবেশের কাছে কুৎব আলমের চিঠিটি পাঠিয়ে দিলেন এবং বাংলা আক্রমণের ব্যাপারে তাঁর মত চাইলেন।
জৌনপুরের এই দরবেশের নাম আহরফ সিমনানি। ইনি পূর্বোক্ত কুৎব আলমের পিতার শিষ্য। গুরুপুত্রের চিঠি দেখে তিনি ক্রোধে অধীর হয়ে উঠলেন। কুৎব আলম এবং আশরফ সিমনানি— দুজনেই রাজা গণেশের নাম ঠিকমতো উচ্চারণ করতে না পেরে তাঁকে ডেকেছেন কাফের কানস বা কানস রায়। নূর কুৎব আলমের বক্তব্য ছিল— প্রায় তিনশো বছর মুসলমান-শাসনের পর বাংলায় আবার কাফেরদের কালো ছায়া দেখা যাচ্ছে এবং কানস রায় ইসলাম এবং প্রকৃত শিক্ষার জ্যোতি নিভিয়ে দিয়েছেন। ইব্রাহিম শর্কির উচিত কাজ হল, এখনই তাঁর প্রবল সৈন্য নিয়ে বাংলা আক্রমণ করা এবং ধর্মের সাহায্যে এগিয়ে আসা। কুৎব আলম মনে করেন—তৈমুরলঙ যে দিল্লির মতো জনাজীর্ণ শহর অতর্কিত আক্রমণে জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন, তার পিছনে নাকি ধর্মের ফতোয়াই আসল কারণ ছিল। অতএব ইব্রাহিমের উচিত আর এক ঘণ্টাও যেন তিনি সিংহাসনে বসে না থেকে বিধর্মীকে তলোয়ার দিয়ে কেটে ফেলেন।
নূর কুৎব আলমের চিঠিতে আরও অনেক উত্তেজনার কথা আসে এবং তাঁর চিঠি পেয়ে দ্বিগুণ উত্তেজনায় আশরফ সিমনানি ইব্রাহিম শর্কিকে অবিলম্বে বাংলা আক্রমণের পরামর্শ দিয়ে বললেন— ধার্মিক মুসলমান সুলতানের এই তো কাজের সময়। কেননা বাংলার ছোটো-বড়ো সমস্ত শহরে দরবেশদের ছড়াছড়ি। অনেক দরবেশই এতদিনে পরলোকগমন করেছেন, কিন্তু এখনও যা আছেন তার সংখ্যাও নেহাৎ কম নয়।
বাংলাদেশে চৈতন্য মহাপ্রভুর কালে এবং হুসেন শাহর রাজত্বকালে পীর-সুফি-দরবেশদের কতদূর আনাগোনা এবং সন্নিবেশ ছিল এবং সুলতান-আমিরদের ওপর তাঁদের প্রভাব কতটা ছিল, সেই প্রসঙ্গে আমরা আশরফ সিমনানি, নূর কুৎব আলম এবং ইব্রাহিম শর্কির কথায় এসেছিলাম। হ্যাঁ, ইব্রাহিম শর্কি বাংলা আক্রমণ করে কাফের কানস অর্থাৎ গণেশকে সিংহাসনচ্যুত করেছিলেন। কিন্তু রাজা গণেশও অসাধারণ কূটবুদ্ধির পরিচয় দিয়ে তাঁর সঙ্গে তেমন কোনো যুদ্ধই করেননি। মাঝখানে ছিল অন্য খেলা। গণেশের ছেলে যদুসেন ইব্রাহিম শর্কির প্রলোভনে ধর্মান্তরিত হয়ে জালালুদ্দিন নামে সিংহাসনে অভিষিক্ত হয়েছিলেন। কাফের কানসের উপযুক্ত শাস্তি না হওয়ায় দরবেশ আশরফ সিমনানি মোটেই খুশি হননি এবং জানিয়ে রাখি—ইব্রাহিম শর্কি চলে যেতেই রাজা গণেশ আবার রাজ্য দখল করেছিলেন। তবে তাঁর রাজত্বকালও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। পুত্র জালালুদ্দিন আবারও সুলতান হয়ে বসেন।
নিজের রাজত্বকালে রাজা গণেশ মুসলমান দরবেশদের ওপর যত অত্যাচার করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে তাঁর পুত্র জালালুদ্দিন হিন্দুদের ওপর তার চেয়ে অনেক বেশি অত্যাচার করেছিলেন এবং জোর করে ধর্মান্তরিত করাটা তাঁর ক্রীড়া-কৌতুকের অন্তর্গত ছিল। জালালুদ্দিনের রাজত্বকাল শেষ হলে বাংলাতে পুনরায় উচ্ছিন্ন ইলিয়াস শাহী বংশের সূচনা হয়, চলতে থাকে মাহমুদ শাহী বংশের শাসন-পরম্পরা—যার অবশেষে আসে হাবশি রাজত্ব এবং তারপর সৈয়দ হুসেন শাহ। আমরা বলেছিলাম— হুসেন শাহ যে রাজকার্যে বহুতর হিন্দু মন্ত্রী নিয়োগ করেছিলেন, তার কারণ যতখানি না সর্বংসহা উদারতা তার চেয়ে অনেক বেশি হল বাস্তব প্রয়োজন—যে প্রয়োজন এক সময় জালালুদ্দিনের মতো ভয়ংকর হিন্দুবিদ্বেষীকেও হিন্দু মন্ত্রী নিয়োগ করতে বাধ্য করেছিল। হুসেন শাহের এই রাজনৈতিক কৌশলের অন্তরালে তাঁর অভীপ্সিত ইসলাম ধর্মের প্রচার এবং ধর্মান্তরকরণের কাজটা চালিয়ে যাচ্ছিলেন পীর-সুফি-দরবেশরাই। সামগ্রিকভাবে শাসকদের এই কৌশল ধরা পড়েছে এখনকার ঐতিহাসিকের লেখাতেও। তিনি লিখছেন—Generally speaking, they did not take much interest in the spread of Islam in Bengal but rather promoted the interests of Muslims and protected them. It was the patronage they offered to the Sufis that they could immigrate ot Bengal and preach Islam.
আমরা দেখেছি—পঞ্চদশ শতকের প্রথম পাদেই এ-দেশের গ্রামে শহরে সুফি-দরবেশদের বহুতর সন্নিবেশ ঘটে গিয়েছিল, কিন্তু রাজশাসনের সঙ্গে তাঁদের সম্পৃক্তি এবং ধর্মান্তকরণের প্রতি অতিরিক্ত আবেশ তাঁদের এতটাই নিবিষ্ট রেখেছিল যে, তাঁদের সেই তথাকথিত মরমিয়া চরিত্র সামগ্রিক হিন্দু সমাজকে কতটা প্রভাবিত করেছিল সেই সময়—সে সম্বন্ধে সন্দেহ থেকেই যায়। বিশেষত চৈতন্য মহাপ্রভু, যিনি কবে কার সঙ্গে কথা বলেছেন, কোন বাজারে গিয়ে কার মোচা-থোড় ছিনিয়ে নিয়েছেন, কার বাড়িতে গিয়ে শীতল জল পান করেছেন—যাঁর প্রতিটি তুচ্ছ ক্রিয়াকর্মও চরিতকারদের বয়ানে ধরা পড়েছে, সেখানে একজন সুফি-সাধকের সঙ্গেও তাঁর পরিচয় হতে দেখিনি, একজন মুসলমান দরবেশের মরমিয়া অনুবাদও তাঁকে গ্রহণ করতে দেখিনি। সেখানে কেন এবং কোথা থেকে এই প্রচার হয়ে ওঠে যে, তাঁর ওপরের সুফিদের প্রভাব ছিল এতটাই যাতে তাঁর একান্ত উদার ধর্মমত প্রভাবিত হয়েছিল? তার ওপরে বঙ্গে সুলতানি অধিকারে নূর কুৎ আলম, আশরফ সিমনানি বা মুজফফর বলখি-র মতো মাননীয় সুফিদের যে চরিত্র আমাদের কাছে ধরা পড়েছে এবং আশরফ সিমনানির চিঠিতে যেসব দরবেশ গোষ্ঠীর নাম আছে—সোহরওয়ার্দি, রুহানি, আলাইয়া এবং খলিদিয়া—সেই সব গোষ্ঠীর একজনের সঙ্গেও মহাপ্রভু এবং তাঁর পার্ষদদের কারও পরিচয় হতে দেখিনি। সেখানে কেনই বা এক অন্য ধর্ম—যে ধর্ম অনীপ্সিত শাসক গোষ্ঠীর আনুকূল্যে বাইরে থেকে চাপানো—সেই ধর্মের দ্বারা মহাপ্রভু প্রভাবিত হতে যাবেন?
হ্যাঁ এ কথা মানি, অবশ্যই মানি যে, সতত তরবারি উঁচিয়ে অথবা ক্রোধরক্ত মুখে রাজার অনুশাসন চাপিয়ে দিয়ে সুফি সাধকেরা সততই এমন এমন ভাব প্রকাশ করেননি যেন ধর্মান্তর গ্রহণ না করলে বিষম বিপদ হবে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ-কথাও মানতে হবে যে, রাজার প্রশাসন এবং উদ্যত দণ্ডের ভয়টুকু যেখানে জিয়ানো থাকে, সেখানে শুধু সুফি-সাধকদের মরমিয়া টানেই সবাই ধর্মান্তরিত হননি, ধর্মান্তরের ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগের ঘটনাও সেখানে যথেষ্টই ঘটেছে এবং অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই যে, এমন ঘটাটাই খুব স্বাভাবিক। ভিনধর্মী শাসক সম্প্রদায় যখন আপন ধর্ম নিয়ে একটা নতুন সমাজের ওপর চেপে বসে, তখন স্বাভাবিকভাবেই বলপ্রয়োগের ঘটনা কিছু ঘটবেই। তাছাড়া হুসেন শাহের প্রত্যক্ষ প্ররোচনায় সুবুদ্ধি রায় বা রামচন্দ্র খান যেভাবে বলপূর্বক ধর্মান্তরিত হন, ইতিহাস তার সাক্ষী দেয়, কেননা হুসেন শাহের মতো বড়ো মানুষ সেখানে জড়িত এবং তিনি জড়িত বলেই তেমন ঘটনা নথিভুক্ত হয়। কিন্তু এমন দুটি ঐতিহাসিক ধর্মান্তরের ঘটনা বাদ দিলে আরও যে আটানব্বইটা ধর্মান্তরের ঘটনা ঘটে বা ঘটেছিল, ইতিহাস তা মনে রাখে না। সবচেয়ে বড়ো কথা, সেই আটানব্বইটা ঘটনার মধ্যে অনেক ঘটনাই কিন্তু বলাৎকৃত নয়। সেখানে ধর্মান্তর ঘটেছে হিন্দু-সমাজের আভ্যন্তরীণ কারণে এবং ঠিক সেইখানেই চৈতন্য মহাপ্রভুর কথা এসে পড়বে।
মনে রাখা দরকার, সমাজের নিম্নস্তরের মানুষেরা, যাঁরা স্বভাবতই সংখ্যায় অনেক বেশি, তাঁরা যেহেতু অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কারণে হিন্দু-সমাজের মধ্যেই বিপর্যস্ত ছিলেন, ফলে তাঁদের মধ্যে ধর্মান্তরের প্রবণতা এমনিতেই ছিল। লক্ষণীয়, ইসলাম ধর্মেই হোক অথবা খ্রিস্টধর্মে—এমনকী পুরাতন হিন্দুধর্মের ক্ষেত্রেও—দেখা গেছে যে, সমাজের কারণে বা অর্থনৈতিক কারণে বহু মানুষ যখন ধর্মান্তর গ্রহণ করেছেন, তার প্যাটার্নটা সব সময় একইরকম হয়। বাংলার মধ্যযুগের সামাজিক মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, স্বচ্ছন্দ ধর্মান্তর গ্রহণের পিছনে কারণ হিসেবে সমকালীন সুলতানি শাসনের ভয় অথবা সুফি সাধকদের উদ্যম যতখানি দায়ী, তার থেকে অনেক বেশি দায়ী তৎকালীন হিন্দু-সমাজের আভ্যন্তরীণ গঠন। হিন্দু-সমাজের উচ্চকোটির মানুষ যাঁরা, বিশেষত ব্রাহ্মণ সমাজ— তাঁরা তাঁদের ধর্ম-কর্ম-আচার এবং বিশ্বাস কখনোই এমন স্তরে পৌঁছে দিতে পারেননি যাতে নিম্নকোটির মানুষেরাও ভাবতে পারেন যে, এটা আমারও ধর্ম অথবা এ-ধর্ম আমরাও বুঝি কিংবা অনুভব করি। আবার যদি বা এমনও হয়েছে যে, সেই ধর্ম, সেই দর্শন কেউ বুঝেও থেকে থাকেন, তবু সামাজিক দিক থেকে তাঁর এমন উপায় ছিল না, যাতে তিনি সমাজের উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ্য আচার আত্মসাৎ করতে পারেন। ফলে সমাজের একটা বড়ো অংশ ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে যতই ভয়-মিশ্র ভাবনায় বহিরঙ্গে শ্রদ্ধা করে থাকুন, তাঁরা এটাকে একান্ত আপনার বলে ভাবতে পারেননি।
সমাজের এই রন্ধ্রপথেই বৌদ্ধ-জৈনরা যেমন এককালে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতিপালিত সমাজকে কেড়ে নিয়েছিলেন, সেই রন্ধ্রপথেই কিন্তু ইসলাম এবং আরও পরবর্তীকালে খ্রিস্টধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। ইসলামের সাধক সুফিরা এবং তাঁদের স্থাপক সুলতানেরা হিন্দুধর্মের এই দুর্বলতার অংশটা বুঝে নিয়েই সাধারণ মানুষের বঞ্চিত অভিমানকে আন্দোলিত করেছেন ইসলামের ধর্মাচারের সমতা প্রচার করে, নিজেদের ‘বেরাদারি’ স্থাপন করে। বর্ণশ্রেষ্ঠ ভূমিদেব ব্রাহ্মণদের কাছে যাঁরা আজ্ঞা-পালনের অধিকার ছাড়া আর কিছুই পাননি, তাঁদের কাছে ভিন্নধর্মীদের রাজনৈতিক শাসন তেমন কোনো দুর্ভাবনাই বয়ে আনেনি, বরঞ্চ ইসলামের ঘোষিত সামাজিক সমতা তাঁদের প্ররোচিত করেছে ধর্মান্তর গ্রহণ করতে। পণ্ডিত জেমস ওয়াইজ, যিনি পূর্ববঙ্গের জাতি, বর্ণ, ব্যবসা নিয়ে গবেষণা করেছিলেন, তিনি আরও ভালো করে বলেছিলেন—নিম্নবর্ণের যে হিন্দু এককালে উচ্চবর্ণের সামাজিক উৎপীড়ন অথবা বৈষম্যের ঘোষণা সহ্য করেছে, তারা যখন ধর্মান্তর গ্রহণ করল, তখন তাদের পিছনে ইসলাম ধর্মের পুষ্টি এবং মুসলমান শাসনের রাজনৈতিক তথা প্রশাসনিক মদত থাকায় তারা তাদের পূর্বের উৎপীড়ক বর্ণশ্রেষ্ঠ প্রভুদেরও খানিকটা চাপে রাখার সুযোগ পেত। এমনকী সময়-সুযোগ বুঝে এই মানসিক আরামটুকু নিম্নবর্গের মানুষেরা অনেকেই বেশ উপভোগ করেছেন।
ওই যে সামাজিক বঞ্চনার রন্ধ্রপথের কথাটুকু বললাম, মহাপ্রভু চৈতন্য কিন্তু সচেতনভাবে সেই রন্ধ্রপথ খুঁজে সেখানে প্রবেশ করেননি। তিনি সেই রন্ধ্র আপন ধর্মের মধুরতার প্রলেপ দিয়ে বুজিয়ে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের পণ্ডিত ঐতিহাসিক মমতাজুর রহমান লিখেছেন— ইসলামে যে বিশাল পরিমাণ ধর্মান্তর ঘটছিল, চৈতন্য-ধর্মের উত্থানের পর সেই প্রবণতা অনেকটাই কমে যায়। তার কারণ অবশ্যই চৈতন্যধর্মের অন্তর্গত উদারতা এবং সেখানে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বহিরঙ্গ আচারের অবহ্রাসন এবং শিথিলায়ন। চৈতন্যদেবের সবচেয়ে বড়ো শক্তি হল— তিনি ব্রাহ্মণ্যধর্মের মধ্যে থেকেই সেই ধর্মের উদারতার জায়গাগুলি স্পষ্টভাবে খুঁজে বার করেছেন এবং আরও সুস্পষ্টভাবে তা প্রচার করেছেন। আর ঠিক এইখানেই মুসলমান সুফিদের সমস্ত প্রভাবের কথা এক্কেবারে নিরাকৃত হয়ে যায়। কেননা ধর্মমতের প্রবক্তা হিসেবে চৈতন্যদেব নতুন কোনো আবিষ্কারক নন বটে, কিন্তু ভীষণ রকমের একজন সংস্কারক বটে—ভীষণ রকমের সংস্কারক এইজন্যই যে, তাঁকে প্রায় আবিষ্কারক বলে মনে হয়। সঙ্গে এ-কথাও মনে রাখতে হবে যে, চৈতন্যের প্রধান পরিচয়—তিনি এক বিশিষ্ট ধর্মের প্রবক্তা এবং সেই ধর্মের প্রচারে তাঁকে যে সাহসের পরিচয় দিতে হয়েছিল, সেখানে তিনি একা। যেহেতু তিনি প্রথমত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রাণপুরুষ, তার পরে অন্য কিছু, তাই প্রথমত সেই ধর্ম এবং দর্শনের নিরিখেই তাঁকে বিচার করতে হবে, কেননা তাঁর সমাজ-সংস্কারের ভূমিকাটুকু সেই ধর্ম-দর্শনের গৌণ ফল মাত্র। ঠিক এই দৃষ্টিতে যদি দেখা যায়, তবে পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, চৈতন্যদেব তাঁর সমসাময়িক কালের ধর্মীয় এবং সামাজিক সংস্কার অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন, যা রামচন্দ্রের মতো অবতার-প্রমাণ নরচন্দ্রমাও পারেননি। আবার একদিকে ভগবান বুদ্ধের চেয়েও তিনি বড়ো, কেননা, বুদ্ধ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের পূর্ণ পরম্পরা এবং সংস্কারের মধ্যে লালিত হয়েও আপন পরম্পরাগত ধর্ম তিনি মানেননি, ‘অখিল-ধর্মমূল’ বেদকেও তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু চৈতন্য তাঁর নিজের ধর্ম-দর্শনের পরম্পরার প্রতিপক্ষে পৃথক কোনো ধর্মমত গঠন করেননি, এবং নিজের পরম্পরাগত বেদ-উপনিষদ-পুরাণ থেকেই তিনি তাঁর—উদার ধর্মের মর্ম সংগ্রহ করেছেন। অপ্রাসঙ্গিক হলেও ঠিক এইখানেই জানাতে হবে যে, তাঁর ওপরে কোনো ধরনের সুফি-প্রভাবের প্রশ্নই আসে না। কেননা, যেসব ধর্মীয় উদারতার কথা তিনি বলেছেন— সেগুলি বেদমূলক পুরাণগুলির মধ্যেই পাওয়া যাবে এবং সেগুলি সুফি-সাধনার পর্যায় থেকে অনেক অনেক প্রাচীন।
কী করেছিলেন চৈতন্য, যাতে তাঁর উদার উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ইসলামে ধর্মান্তর গ্রহণের প্রবণতা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল? কী করেছিলেন চৈতন্য, যাতে বাংলার সমাজ এবং সংস্কার সমস্ত সংকীর্ণতা ছেড়ে এক নতুন প্রগতির পথে বাহিত হয়েছিল? এক কিংবা দুই কথায় বলা যায়—তিনি নতুন এক আরাধ্য দেবতা দিয়েছিলেন বাঙালিকে এবং সেই সাধ্যের সাধন হিসেবে দিয়েছিলেন ভক্তিকে। তিনি উপহার দিয়েছেন কৃষ্ণকে এবং কৃষ্ণভক্তিকে। বৈদিক যুগে যাগযজ্ঞের জটিলতার সঙ্গে দেবতার সংখ্যাও ছিল বহু। যার ফলে শতেক দেবতার কাছে শতরকম ঐহিক ফল চাইতে চাইতে ক্লান্ত ঋষির মনে এই ভাবনার উদয় হয়েছিল যে, কতবার কত ঘৃতাহুতি দিয়ে আর কত দেবতাকে তুষ্ট করব—কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেমঃ। এই রকম একটা জটিলতার পরেই কিন্তু ব্রহ্মবাদী ঋষিদের সৃষ্টি হয়, যাঁরা অদ্বয় ব্রহ্মের কথা বোঝাতে লাগলেন বিচিত্র কঠিন দার্শনিকতায়। তিনি অণুর থেকেও ছোটো এবং বৃহতের চেয়েও বৃহৎ, তিনি এটাও নন, তিনি ওটাও নন, অথচ তিনি সব, তিনি সর্বব্যাপ্ত—এই যে চরম, পরম দার্শনিকতা—এই কঠিন প্রতিপাদ্য কিন্তু সাধারণ মানুষের বোধগম্য হয়নি, তাঁদের অন্তরে প্রবেশ করা তো দূরের কথা। পুনশ্চ ব্রহ্ম-জিজ্ঞাসার জন্য যে সর্বোপরি-বিনিমুক্ত জ্ঞানযোগের কথা বলা হয়েছে, তাও তো একজন সাধারণ মানুষের কাছে একেবারেই বোধগম্য ছিল না। তাহলে অবাঙ্মানসগোচর ব্রহ্মের সাযুজ্য লাভ করার জন্য সুখ-দুঃখ, লাভ-অলাভের ঊর্ধ্বে উঠে জ্ঞানসাধনা করা, সেও কোনো সাধারণের বোধগম্য বস্তু নয়।
ঠিক এ রকম একটা জ্ঞানকাণ্ডের মধ্যে চৈতন্য এমন এক ভগবানের কথা শোনালেন যাঁর মধ্যে বৈদিক দেবতার রূপটুকু ধরা পড়ে, আবার উপনিষদের ব্রহ্মের যে অনির্বচনীয়তা তাও শাস্ত্রানুসারে তাঁর মধ্যে নিহিত হয়েছে। উপনিষদের পরের কালে আদি পুরাণগুলির মধ্যেই কৃষ্ণের ভগবত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেদ-উপনিষদের সমস্ত মর্ম তাঁর মধ্যে আধান করে। বারবার বলা হয়েছে— সমস্ত বেদের প্রতিপাদ্য বস্তু হল কৃষ্ণ এবং উপনিষদিক ব্রহ্মের তিনি মূর্তিমান বিগ্রহ। এইরকম একটা ভগবান সাধারণের বোধগম্য হয়ে ওঠেন— এক কথায় তিনি যাজ্ঞবল্ক্য-শ্বেতকেতুর মতো দার্শনিকের ধ্যানগম্য জ্যোতিঃস্বরূপ নন, তিনি খোলাবেচা শ্রীধর, যবন হরিদাস অথবা মুকুন্দ দত্তের অনুভবযোগ্য এবং বোধগম্য ভগবান।
এই কৃষ্ণ ভগবানকে পাওয়াও যায় খুব সহজে। যাগ-যজ্ঞের বালাই নেই, ধ্যান-জ্ঞানের বালাই নেই, শুধু তাঁর নাম করলেই তাঁকে পাওয়া যায়, তাঁকে ভক্তি করলেই তিনি সদয় হন। এই তত্ত্বটা বোঝানোর জন্য চৈতন্যকে বেদ-উপনিষদের দ্বারস্থ হতে হয়নি। গীতা-ভাগবত এবং অন্যান্য পুরাণের বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করেই তিনি কৃষ্ণ এবং কৃষ্ণভক্তি —অর্থাৎ সাধ্য এবং সাধনের সহজ প্রতিপত্তি ঘটাতে পেরেছেন। তার মধ্যে আবার ছিল মহাপ্রভুর নিজস্ব ভগবদনুভূতি—যা তাঁর সন্ন্যাস-পরবর্তী সময় থেকে তাঁর তিরোভাব-কাল পর্যন্ত তাকে আপ্লুত রেখেছে এবং যা আমি আরও একশো পাতা লিখলেও এই সংকীর্ণ পরিসরে কিছুতেই বোঝতে পারব না। শুধু এইটুকু বলি যে, ভক্তি জিনিসটাকেও তিনি আর সাধারণ শরণাগতির পর্যায়ে রাখেননি, তিনি সেটাকে রসায়িত করে ভক্তি-রসায়ন করে তুললেন। সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর ভগবান যে ভক্তমনের মাধুরীতে পুত্রভাবে, সখাভাবে, দয়িত প্রিয়ের মতো মানুষের কাছে নেমে আসতে পারেন—এই রসায়নটুকু যেমন চৈতন্যের সন্ন্যাসোত্তর জীবনে সার্বিক অনুষঙ্গ, তেমনই সাধারণ মানুষের কাছেও এই রস-ভাবের আবেদন ভগবানের ওপর তাঁদের অধিকার-বোধ জাগ্রত করেছে।
আমি যে এই প্রবন্ধের প্রথমে সেই শিব-ভক্তের রসায়িত ভক্তির প্রসঙ্গ তুলেছিলাম, তা সুফি-সাধকদের আগমণের পূর্ববর্তী শ্লোক-ভাবনা। আবার চৈতন্য মহাপ্রভু যেভাবে কৃষ্ণভক্তিকে রসায়িত করেছেন, তাও সুফি-ভাবুকদের বহু পূর্ববর্তী পৌরাণিক ভাব— যা বেদ-উপনিষদের পরম্পরায় শাস্ত্র হিসেবে পুরাণগুলির অন্তর্বর্তী হয়েছে, বিশেষত ভাগবত-পুরাণ এবং আরও প্রাচীন বিষ্ণু পুরাণ-এ এই রসময়ী প্রথম বিস্তার। মহাপ্রভু তাঁর আত্মানুভবেই বুঝেছিলেন— এই ভক্তি মানুষের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করে, ফলে সমস্ত অন্তরঙ্গ পার্ষদকে তিনি এই পৌরাণিকী ভক্তির প্রচার-নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন— সর্বত্র প্রমাণ দিবে পুরাণ-বচন। তার মানে, বেদ-উপনিষদের তাত্ত্বিকতা নয়, বরঞ্চ তৎকালীন লোকধর্মী পুরাণগুলির প্রমাণে কৃষ্ণ এবং কৃষ্ণভক্তির সরসতা প্রচার করে একদিকে তিনি জাতিবর্ণ-দীর্ণ সমাজের অন্তরে প্রবেশ করেছেন, তেমনই অন্যদিকে প্রশাসনিক সুরক্ষায় চলা ইসলাম-ধর্মে সাধারণের ধর্মান্তর গ্রহণের প্রবণতাও রুদ্ধ করে দিয়েছিলেন। এমন মানুষই মানুষের প্রাণের মানুষ এবং ভগবান বলে চিহ্নিত হন যুগে যুগে।