৫. এল্ডারদের বাসস্থান

এল্ডারদের বাসস্থান

রোবট… একাধিক গ্রহের প্রাচীন কিংবদন্তীতে ব্যবহৃত একটি শব্দ যা অটোম্যাটা হিসেবে অধিক পরিচিত। রোবট হলো মূলত মানুষের আকৃতিতে ধাতুর তৈরি যন্ত্র বিশেষ, যদিও ধারণা করা হয় যে কিছু কিছু ছিল সিউডো অর্গানিক। পালিয়ে বেড়ানোর সময় হ্যারি সেলডন সম্ভবত একটা সত্যিকার রোবট দেখেছিলেন। এই ধারণাটা অত্যন্ত জনপ্রিয় হলেও তার সপক্ষে জোরালো কোনো প্রমাণ নেই। সেলডনের সুবিশাল রচনাবলীতে কোথাও রোবটের কথা উল্লেখ করা হয়নি, যদিও…
—এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাক্টিকা

.

৫৬.

রাস্তায় চলাচলকারী মানুষগুলো তাদের দিকে কোনো মনোযোগই দিল না।

হ্যারি সেলডন এবং ডর্স ভেনাবিলি গতদিনের পথ ধরেই স্যাক্রাটোরিয়ামে যাচ্ছে। কেউ দ্বিতীয়বার তাদের দিকে তাকালো না। সত্যি কথা বলতে কী প্রথমবার তাকিয়েছে কী না তাও সন্দেহ। বারবারই হাঁটু সরিয়ে অন্যান্য যাত্রীদেরকে জায়গা করে দিতে হচ্ছে যেন তারা ভিতরের আসন থেকে সহজে নামতে পারে বা উঠে ভিতরের আসনে বসতে পারে। বারবারই ভাবলেন যে ভিতরের দিকে কোনো আসন খালি পেলেই সেখানে গিয়ে বসবেন।

কার্টলের গন্ধ অসহ্য লাগছে। কারণ কেনার পর ওগুলো ধোয়ার সময় ছিল না।

 যাইহোক নির্বিঘ্নেই গন্তব্যে পৌঁছলেন।

ওটাই বোধহয় গ্রন্থাগার, নিচু গলায় বললেন সেলডন।

বোধহয়, ডর্স বলল। মিশেলিয়াম সেভেন্টি টু ঐ বিল্ডিংটার কথাই বলেছিল।

অলস ভঙ্গিতে সেদিকে এগোল দুজন।

লম্বা করে শ্বাস নাও, বললেন সেলডন। এটাই আমাদের প্রথম বাধা।

সামনের দরজাটা খোলা, ভিতরে অনুজ্জ্বল আলো। প্রশস্ত পাঁচ ধাপ সিঁড়ি চলে গেছে দরজা পর্যন্ত। সবচেয়ে নিচের ধাপে পা দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল দুজন। শে অনেকটা মুহূর্ত পেরিয়ে যাওয়ার পর বুঝতে পারল যে নিজেদেরকেই সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হবে। সিঁড়িগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদেরকে নিয়ে যাবে না। পাতলা এক চিলতে হাসি ফুটল ডর্সের মুখে। সেলডনকে ইশারা করে নিজেও উপরে উঠতে লাগল।

সিঁড়ি ভাঙার সময় মাইকোজেনের এই দিনহীন অবস্থার কারণে নিজেরাই বিব্রত বোধ করতে লাগল।

দরজার ঠিক পাশেই একটা ডেস্ক। একটা লোক মাথা নিচু করে কী যেন করছে। ডেস্কের উপর একটা কম্পিউটার। এত প্রাচীন মডেলের এবং সরল কম্পিউটার সেলডন জীবনেও দেখেননি।

লোকটা ওদের দিকে তাকালো না। দরকারও নেই, ভাবলেন সেলডন। সাদা কার্টল, টাক মাথা–সারাদিন মাইকোজেনিয়ানরা এই ছবিই দেখছে। কাজেই তাদের দিকে ভালোভাবে তাকানোরও প্রয়োজন নেই। আর এটা ট্রাইবসপিওপিলদের জন্য বিশাল এক সুবিধা।

লোকটা সম্ভবত কিছু পড়ছিল। মাথা না তুলেই বলল, স্কলারস?

স্কলারস, বললেন সেলডন।

মাথা ঝাঁকিয়ে একটা দরজা দেখালো লোকটা, ভেতরে যান। সময়টা উপভোগ করুন।

ভিতরে ঢুকেই দুজন ছোটখাটো একটা ধাক্কা খেল। গ্রন্থাগারের এই অংশে মানুষ বলতে শুধু তারা দুজন, আর কারো ছায়া পর্যন্ত নেই। হয় গ্রন্থাগার এখানে জনপ্রিয় না অথবা স্কলারের সংখ্যা অতি নগণ্য–সম্ভবত দুটোই।

সেলডন ফিসফিস করে বললেন, আমি ভেবেছিলাম হয়তো বা কোনো ধরনের লাইসেন্স বা অনুমতি পত্র দেখাতে হবে এবং আমাকে ভান করতে হবে যে সেটা ভুল করে বাড়িতে ফেলে এসেছি।

লোকটা খুশি হয়েই আমাদের অনুমতি দিত। ডর্স বলল। এইরকম পাঠকহীন গ্রন্থাগার দেখেছ কখনো?

অধিকাংশই ছাপানো বই। শেলফগুলোর সামনে দিয়ে হাঁটছে ডর্স। বই দেখতে দেখতে বলল, প্রায় সবই পুরনো বই। কিছু ক্লাসিক। বাকিগুলো কোনো কাজেরই না।

বাইরের বই? মানে আমি বলছি নন-মাইকোজেনিয়ান বই?

হ্যাঁ। নিজেদের লেখা বই থাকলে ওগুলো নিশ্চয় অন্য দিকে রাখা আছে। এই সেকশনটা হচ্ছে গতকালের অহংকারী স্বশিক্ষিত স্কলারদের জন্য। এটা রেফারেন্স ডিপার্টমেন্ট। এই যে একটা ইম্পেরিয়াল এনসাইক্লোপেডিয়া… সম্ভবত পঞ্চাশ বছরের পুরনো।

একটা বই নামানোর জন্য হাত বাড়ালো ডর্স কিন্তু সেলডন বাধা দিলেন। এখানে দেরি করে লাভ নেই।

একটা পুরনো সাইন বোর্ডের দিকে ইশারা করলেন তিনি। উজ্জ্বল আলোতে লেখা স্যাক্রাটোরিয়াম। দ্বিতীয় বর্ণটার অবশ্য আলো জ্বলছে না। খুব সম্ভবত কিছুদিন আগেই নষ্ট হয়েছে অথবা কেউ এটা নিয়ে মাথাই ঘামায় না (এম্পায়ারের মৃত্যু ঘটছে, ভাবলেন সেলডন। পচন ধরেছে তার সারা দেহে। এমনকি মাইকোজেনেও)।

চারপাশে তাকালেন তিনি। এই গ্রন্থাগারটা সম্ভবত মাইকোজেনিয়ানদের গর্বের ধন। এল্ডাররা সম্ভবত এখান থেকেই তাদের বিশ্বাসের সপক্ষে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে। অথচ জায়গাটা পুরোপুরি ফাঁকা। তাদের দুইজনের পরে কেউ আসেনি।

এদিকে সরে এসো, বললেন সেলডন। ডেস্কের লোকটা যেন আমাদের দেখতে না পায়। তারপর স্যাশ পড়ে নাও।

স্যাক্রাটোরিয়ামে ঢোকার দরজার ঠিক সামনে থামলেন সেলডন। এটা দুই নম্বর বাধা এবং সবচেয়ে কঠিন। এক পা এগোলেই ফিরে আসার আর কোনো পথ থাকবে না। তাই বললেন, ডর্স, তুমি এসো না। থাকো এখানে।

ভুরু কুঁচকালো ডর্স। কেন?

বিপদ হতে পারে। আমি চাই না তুমি ঝুঁকি নাও।

আমি এখানে আছি তোমাকে রক্ষা করার জন্য। ডর্সের গলা মোলায়েম কিন্তু দৃঢ়।

 তুমি কী নিরাপত্তা দেবে। বিশ্বাস করো আর নাই করো, আমি নিজেকে রক্ষা করতে পারব। বরং তোমার উপর নির্ভর করতে হলে আমার হাত পা আরো বাঁধা পড়ে যাবে। বুঝতে পারছ না।

আমাকে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না, ওটা আমার দায়িত্ব।

কেন ঝুঁকি নিচ্ছ, হামিন বলেছে সেই জন্যই তো?

কারণ এটা আমার দায়িত্ব।

কনুইয়ের সামান্য একটু উপরে ধরলো ডর্স এবং বরাবরের মতোই তার গায়ের শক্তি অনুভব করে অবাক হলেন। যদিও আমার পছন্দ হচ্ছে না হ্যারি। কিন্তু যেহেতু তুমি যাচ্ছ তাই আমাকেও যেতে হবে।

ঠিক আছে। কিন্তু যদি এমন কিছু ঘটে যা তুমি সামলাতে পারবে না, তখন আমার জন্য চিন্তা না করেই তুমি দৌড়ে পালাবে।

তুমি সময় নষ্ট করছ, হ্যারি এবং তুমি আমাকে অপমান করছ।

মৃদু একটা ধাক্কা দিলেন সেলডন, আস্তে করে দরজা খুলে গেল। এক সাথে দুটো শরীর মিলেমিশে একটা শরীরের মতো হয়ে গেল–হেঁটে ভেতরে প্রবেশ করল দুইজন।

.

৫৭.

লম্বা একটা ঘর। বেশি লম্বা মনে হচ্ছে কারণ কোনো আসবাবপত্র নেই। চেয়ার টেবিল বা একটা বেঞ্চ পর্যন্ত নেই।

হালকা অনুজ্জ্বল এক ধরনের আলো ছড়িয়ে আছে পুরো ঘর জুড়ে। দেয়ালগুলোতে নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর বিভিন্ন উচ্চতায় অনেকগুলো দ্বিমাত্রিক টেলিভিশন। সবগুলোই চলছে।

মানুষও আছে। সংখ্যায় অতি নগণ্য। প্রত্যেকেই দাঁড়িয়ে আছে একা এবং এলোমেলো দূরত্বে। প্রত্যেকের পরিধানে সাদা কার্টল আর লাল স্যাশ।

কোনো শব্দ নেই। কেউ কোনো কথা বলছে না। দুএকজনের ঠোঁট নড়ছে। যারা হাঁটছে তারাও পা ফেলছে ধীরে, কোনো শব্দ না করে, চোখ মাটির দিকে নামানো।

পরিবেশটা পুরোপুরি শবযাত্রার মতো।

ডর্সের দিকে ঝুঁকলেন সেলডন। কিন্তু ডর্স ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে নিষেধ করল, তারপর একটা টেলিভিশনের দিকে ইশারা করল। মনিটরে চমৎকার ফুলে ফুলে সাজানো এক বাগানের দৃশ্য ফুটে উঠেছে।

অন্যদের ভঙ্গি নকল করে তারা মনিটরের কাছে এগিয়ে গেল। আধামিটার দূরে থাকতেই মনকে প্রশান্ত করে তোলার মতো কণ্ঠস্বর শুনতে পেল : এ্যান্টেনিন-এর বাগান, প্রাচীন ছবি এবং বই থেকে সাহায্য নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। ইওস-এর শেষ প্রান্তে এই বাগান অবস্থিত। স্মরণ রাখতে হবে যে-

ডর্স ফিসফিস করে কথা বলল। মনিটর থেকে ভেসে আসা শব্দের কারণে শুনতে বেশ বেগ পেতে হলো সেলডনকে। মনিটরের কাছে আসলে এটা চালু হয়ে যায় দূরে গেলে বন্ধ হয়ে যায়। তাই কাছাকাছি থাকলে আমরা কথা বলতে পারব, তবে আমার দিকে তাকাবে না আর কাউকে আসতে দেখলে কথা বন্ধ করে দেবে।

মাথা নিচু করে রেখেছেন সেলডন, হাত সামনের দিকে এনে বেঁধে রেখেছেন (অন্যদেরকেও তাই করতে দেখেছেন) বললেন, ভয় পাচ্ছি যেকোনো মুহূর্তে যে কেউ বিলাপ করে কাঁদতে শুরু করবে।

অসম্ভব কিছু না। ওরা লস্ট ওয়ার্ল্ডের জন্য শোক প্রকাশ করছে।

আশা করি মাঝে মাঝেই ওরা ফিল্মগুলো পরিবর্তন করে। প্রতিদিন একই জিনিস দেখা চরম বিরক্তিকর।

সবগুলোই আলাদা ডর্সের দৃষ্টি এক মনিটর থেকে আরেক মনিটরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হয়তো পরিবর্তন করে। আমি জানি না।

দাঁড়াও, কণ্ঠস্বর চুল পরিমাণ উঁচু করলেন সেলডন, তারপরই আবার নামিয়ে ফেললেন, এদিকে এসো।

ভুরু কুঁচকালো ডর্স, শুনতে পায়নি, কিন্তু সেলডন আস্তে করে মাথা নেড়ে ইশারা করলেন। আবার সেই ধিরস্থির শব্দহীন পদক্ষেপ। কিন্তু সেলডনের এবারের পদক্ষেপ দীর্ঘ। ডর্স হাত বাড়িয়ে তার কার্টলের কোণা ধরে খুবই মৃদু একটা টান দিল। গতি কমালেন তিনি।

রোবট, মনিটরের শব্দ শুরু হতেই বললেন তিনি।

ছবিতে একটা বাসস্থান দেখা যাচ্ছে। বিশাল এক লন, চারপাশে ঘিরে রেখেছে ছোট ছোট গাছ। এবং তিনটা রোবট। চেনা যাচ্ছে কারণ ওগুলো নিঃসন্দেহে ধাতুর তৈরি এবং মানুষের আকৃতির সাথে কোনো মিল নেই।

মনিটরে শোনা যাচ্ছে, এই দৃশ্যটি কিছুদিন আগেই তৈরি করা হয়েছে। এটা হলো তৃতীয় শতাব্দীর বিখ্যাত ওয়েনডন এস্টেট। ঠিক মাঝখানে যে রোবটটি দেখছেন, প্রচলিত ধারণা মতে তার নাম ব্যান্ডার। এবং রিপ্লেস করার আগে প্রায় বাইশ বছর সেবা প্রদান করে।

কিছুদিন আগে তৈরি করা হয়েছে। তার মানে ওরা ফিল্ম পাল্টায়। ডর্স বলল।

 যদি না ওদের কিছুদিন আগে বলতে একহাজার বছর আগে বুঝিয়ে থাকে।

আরেকজন মাইকোজেনিয়ান তাদের মনিটরের কাছে এসে দাঁড়ালো। বলল অভিনন্দন, ব্রাদারস। যদিও ডর্স এবং সেলডনের মতো অতটা ফিসফিস করে বলেনি।

কথা বলার সময় লোকটা তাদের দিকে একবারও তাকায়নি। সেলডন দ্রুত একবার আড়চোখে তাকালেন। ডর্স পাত্তাই দিল না।

ইতস্তত করছেন সেলডন। মিশেলিয়াম সেভেন্টি টু বলেছিল যে ভেতরে কেউ কারো সাথে কথা বলে না। হয়তো বাড়িয়ে বলেছিল। সে তো শৈশবের পর আর কখনো স্যাক্রাটোরিয়ামে আসেনি।

সিদ্ধান্ত নিলেন যে তারও জবাব দেওয়া উচিত। ফিসফিস করে বললেন, আপনাকেও অভিনন্দন ব্রাদার।

এটাই সঠিক নিয়ম কিনা তিনি জানেন না, তবে ব্রাদারকে দেখে মনে হলো সব ঠিক আছে।

অরোরার আশীর্বাদ বর্ষিত হোক আপনার উপর। বলল সে।

এবং আপনার উপরেও বর্ষিত হোক, মনে হলো লোকটা আরো কিছু আশা করছে। তাই বললেন, অরোরার আশীর্বাদ। সেলডন টের পেলেন তার কপাল ঘামছে।

চমৎকার! আমি এটা আগে দেখিনি। মাইকোজেনিয়ান বলল।

বেশ কৌশলে করা হয়েছে, বললেন সেলডন, তারপর কিছুটা বেপরোয়া হয়ে আবার বললেন, এমন একটা ক্ষতি কখনোই ভোলা সম্ভব নয়।

মাইকোজেনিয়ানের দেহ খানিকটা কেঁপে উঠল। অবশ্যই, অবশ্যই। বলেই চলে গেল সে।

হিস-হিস করে ডর্স বলল, উল্টাপাল্টা কিছু বলে বিপদ বাড়িও না।

যা স্বাভাবিক মনে হয়েছে সেটাই বলেছি। যাইহোক, এই ছবিগুলো নতুন। রোবটগুলো আমাকে হতাশ করেছে। যেমন কল্পনা করেছিলাম এগুলো ঠিক তেমনই অটোম্যাটা। কিন্তু আমি খুঁজছি একটা অর্গানিক হিউমেনয়েড রোবট।

যদি থাকে। খানিকটা দ্বিধা নিয়ে বলল ডর্স। আমার ধারণা সেইধরনের রোবট বাগানের কাজ করত না।

ঠিকই বলেছ। আমাদেরকে এল্ডারসদের বাসস্থান খুঁজে বের করতে হবে।

তাও যদি থাকে। আমার তো মনে হয় এই অন্ধকার গুহার ভেতর আরো অনেকগুলো গুহাই আছে।

চলো দেখা যাক।

দেয়াল ঘেঁষে হাঁটতে শুরু করল দুজন। মাঝে মাঝে দুই একটা স্ক্রীনের সামনে থামছে। ডর্স হঠাৎ সেলডনের বাহুতে খোঁচা মারল। দুটো স্ক্রীনের মাঝখানে বেশ হালকা ত্রিভুজ আকৃতির রেখা দেখালো।

একটা দরজা। বলল সে। তোমার কী মনে হয়?

অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন সেলডন। বিপদের কোনো সম্ভাবনা। নেই কারণ নিয়ম অনুযায়ী কেউ যদি স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে না থাকে তাহলে বিষণ্ণ চিত্তে মাথা নিচু করে রাখে।

দরজা খুলবে কীভাবে? বললেন সেলডন।

 কোনো ব্যবস্থা নিশ্চয়ই আছে।

দেখছি না তো।

চোখে পড়বে এমনভাবে হয়তো তৈরি হয়নি। কিন্তু এক জায়গায় রং যথেষ্ট হালকা। দেখেছ? বহুদিন ধরে বহু হাতের স্পর্শে নিশ্চয়ই ঐ জায়গার রং চটে গেছে।

আমি চেষ্টা করে দেখি। তুমি চারপাশে খেয়াল রাখো। যদি দেখো যে কেউ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে তখন লাথি মেরে সতর্ক করে দিও।

স্বাভাবিকভাবে দম নিলেন তিনি। রং চটে যাওয়া জায়গাটায় হাত রাখলেন, কিছু হলো না। এবার আঙ্গুলগুলো পুরো ছড়িয়ে মৃদু ধাক্কা দিলেন।

নিঃশব্দে দরজা খুলে গেল–সামান্য শব্দও হলো না। দ্রুত ভেতরে ঢুকে পড়লেন সেলডন। ডর্স অনুসরণ করল।

কথা হচ্ছে, ডর্স বলল, কেউ আমাদের দেখেনি তো?

 সেলডন বললেন, এল্ডার্সরা প্রতিনিয়ত এই দরজা দিয়ে যাওয়া আসা করে।

হ্যাঁ। কিন্তু কেউ কী আমাদের এল্ডার মনে করবে?

খানিকক্ষণ ভাবলেন সেলডন, তারপর বললেন, কেউ যদি আমাদের দেখেই ফেলে এবং সে যদি মনে করে এখানে কোনো ঘাপলা আছে তাহলে পনেরো সেকেন্ডের ভেতর দরজাটা আবার খুলে যাবে।

সম্ভবত। অথবা দরজার এই পাশে আসলে দেখার কিছু নেই। তাই আমরা। ঢুকলাম না বেরোলাম তা নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই।

সেটা প্রমাণসাপেক্ষ।

কামরাটা তুলনামূলকভাবে ছোট এবং অন্ধকার। তবে আরেকটু সামনে বাড়তেই উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে পড়ল।

ভেতরে বেশ কয়েকটা চেয়ার। প্রশস্ত এবং আরামদায়ক। ছোট টেবিল, ছোট একটা রেফ্রিজারেটর।

এটা যদি কোনো এল্ডারের ঘর হয়, বললেন সেলডন, তাহলে বলতেই হচ্ছে। যে স্যাক্রাটোরিয়ামের নিয়ম যাইহোক না কেন তারা বেশ আরামেই থাকে।

স্বাভাবিক, বলল ডর্স। শাসকগোষ্ঠীর কৃচ্ছতা সাধন–দুর্লভ ঘটনা। যতটুকু করে তার সবটাই লোক দেখানো। সাইকোহিস্টোরির একটা নিয়ম হিসেবে পয়েন্টটা তুমি তোমার নোট বইয়ে টুকে রাখতে পারো। চারপাশে তাকালো। কোনো রোবট চোখে পড়ছে না।

মনে আছে, শব্দটার অর্থ ছিল উঁচু স্থানে নির্মিত বাসস্থান। তার মানে আমাদেরকে আরো উপরে উঠতে হবে। এবং সম্ভবত এদিক দিয়ে যেতে হবে। কার্পেট দিয়ে মোড়ানো একপ্রস্থ সিঁড়ি দেখালেন তিনি। তবে সেদিকে না গিয়ে চারপাশে দেখতে লাগলেন।

তিনি কী খুঁজছেন ডর্স অনুমান করতে পারল। বলল, অ্যালিভেটরের কথা ভুলে যাও। অতীতে পড়ে থাকাটা মাইকোজেনিয়ানদের কাছে ধর্মের মতো। তুমি নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি। অ্যালিভেটর নেই এবং এটাও চলমান সিঁড়ি নয়। আমাদেরকেই ধাপগুলো টপকে উঠতে হবে। অনেকগুলো ধাপ।

টপকে উঠব?

এছাড়া আর কী করবে? তুমি এল্ডারদের বাসস্থান দেখতে চাও নাকি চাও না?

দুজন একসাথেই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। কয়েক ধাপ পর পর একটা করে ল্যান্ডিং, উপরে উঠছেন আর আলো কমে আসছে। হাঁপাতে হাঁপাতে সেলডন বললেন, ভেবেছিলাম আমার স্বাস্থ্যটা ভালো, কিন্তু এখন দেখছি সেটা ঠিক নয়।

তুমি আসলে এইধরনের শারীরিক পরিশ্রমে অভ্যস্ত নও। ডর্স বলল। সে মোটেও ক্লান্ত হয়নি।

তৃতীয় ল্যান্ডিং-এ এসে সিঁড়ি শেষ হলো। সামনে আরেকটা দরজা।

যদি এটা বন্ধ হয়, অনেকটা স্বগতোক্তির মতো বললেন সেলডন। তখন কী ভেঙে ফেলার চেষ্টা করব?

কিন্তু ডর্স বলল, নিচের দরজাটা যখন খোলা ছিল তখন এই দরজাটা বন্ধ হবে কেন? এটা এল্ডারদের থাকার জায়গা হলে আমার ধারণা বাকি সবাই বিশ্বাস করে যে এখানে এল্ডাররা ছাড়া আর কেউ আসতে পারবে না। কারণ সামাজিক বিধিনিষেধ এবং সামাজিক বিধিনিষেধ তালাচাবির চেয়েও শক্তিশালী।

শুধু যারা এই বিধিনিষেধ মেনে চলে, বললেন সেলডন, কিন্তু ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলেন না।

এখনো ফিরে যাওয়ার সময় আছে। সত্যি কথা বলতে কী আমি ফিরে যাওয়ারই পরামর্শ দেব।

না, শুধু ভাবছি দরজার ওপাশে গিয়ে কী দেখব। যদি খালি হয়

তারপর জোর গলাতে বললেন, খালি হলে হবে, এবং দ্রুত এগিয়ে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিলেন।

নিঃশব্দে দরজাটা খুলে গেল। ভিতরের তীব্র আলোয় এক পা পিছিয়ে গেলেন সেলডন।

বস্তুটা তাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, চোখের জায়গায় আলো, হাতদুটো সামান্য উপরে উঠানো, একটা পা অন্যটার চেয়ে খানিকটা সামনে বাড়ানো, হলুদাভ ধাতুর তৈরি চকচকে দেহ কাঠামোটা মানুষের। প্রথমে মনে হলো বোধহয় আঁটোসাঁটো টিউনিক পরে রেখেছে। কিন্তু ভালোভাবে লক্ষ্য করতে বোঝা গেল টিউনিকটা বস্তুর কাঠামোরই অংশ।

এটাই সেই রোবট। বিস্ময়ে হতবাক গলায় বললেন সেলডন। কিন্তু ধাতব।

তারচেয়েও খারাপ কথা, ডর্স বলল। সে দ্রুত এপাশ থেকে ওপাশে হেঁটে গেল। ওটার দৃষ্টি আমাকে অনুসরণ করছে না, হাত নড়ছে না। এটা বেঁচে নেই। যদিও আমি জানি না রোবটের বেলায় বেঁচে থাকা বলাটা ঠিক হবে কী না।

এবং একজন মানুষ সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে সে মানুষ রোবটের পিছন থেকে বেরিয়ে এসে বলল, হয়তো বা, কিন্তু আমি জীবিত।

ডর্স চট করে এগিয়ে এসে সেলডন এবং লোকটার মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ালো।

.

৫৮.

ডর্সকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন সেলডন। বললেন, আমার প্রটেকশনের দরকার নেই। আর ইনি আমাদের পুরনো বন্ধু সানমাস্টার ফোরটিন।

মুখোমুখি দাঁড়ানো লোকটা একসাথে দুটো স্যাশ পড়েছে। সম্ভবত হাই এল্ডার বলেই। বললেন, আর আপনি ট্রাইবসম্যান সেলডন।

ঠিকই ধরেছেন।

আর এই ব্যক্তি যদিও পুরুষের পোশাক পরিহিত থাকলেও কোনো সন্দেহ নেই যে উনি ট্রাইবসওমেন ভেনাবিলি।

ডর্স কোনো জবাব দিল না।

আপনি ঠিকই ধরেছেন, ট্রাইবসম্যান। শারীরিক বিপদের কোনো ভয় অন্তত আমার কাছ থেকে নেই। বসুন দয়া করে। আপনিও ট্রাইবসওমেন। যেহেতু আপনি সিস্টার নন সেহেতু আপনার বেলায় আমাদের সব নিয়ম খাটে না। বসুন ঐ চেয়ারটায়। আপনিই প্রথম মহিলা যে ওখানে বসার সম্মান পেয়েছে।

এইধরনের সম্মানের কোনো মূল্য নেই আমার কাছে, প্রতিটি শব্দের উপর আলাদা জোর দিল ডর্স।

আপনার ইচ্ছে। তবে আমি বসব। কারণ আপনাদের কিছু প্রশ্ন করতে চাই দাঁড়িয়ে সেটা করা যাবে না।

বসার পরও রোবটের দিকে তাকিয়ে ছিলেন সেলডন।

রোবট! সানমাস্টার ফোরটিন বললেন।

জানি। সেলডনের সংক্ষিপ্ত জবাব।

সন্দেহ নেই, সানমাস্টারও একই সুরে বললেন, এবার মূল আলোচনা শুরু করা যাক। আপনারা এখানে কেন?

সানমাস্টারের চোখে চোখ রেখে সেলডন বললেন, রোবটটাকে দেখতে চেয়েছিলাম।

আপনি কী জানেন যে এল্ডার ছাড়া অন্য কেউ এখানে প্রবেশ করতে পারে না।

জানতাম না, তবে সন্দেহ করেছিলাম।

আপনি কী জানেন ট্রাইবসপিওপিলদের স্যাক্রাটোরিয়ামের ত্রিসীমানায় ঘেঁষা নিষেধ।

শুনেছি।

কিন্তু গুরুত্ব দেননি, তাই না?

বললাম তো রোবটটাকে দেখতে চেয়েছিলাম।

জানেন কোনো মহিলা এমনকি একজন সিস্টারও শুধু নির্দিষ্ট কিছু অনুষ্ঠানের জন্য স্যাক্রাটোরিয়ামে প্রবেশের অনুমতি পায়। সেই ধরনের অনুষ্ঠানের সংখ্যাও হাতে গোনা।

শুনেছি।

এবং আপনি কী জানেন কোনো মহিলা কখনোই কোনো কারণেই পুরুষদের পোশাক পরতে পারবে না? নিয়মটা শুধু সিস্টারদের জন্যই নয় মাইকোজেনে আসা প্রতিটা মহিলার জন্যও প্রযোজ্য।

না, এই কথা কেউ বলেনি, তবে আমি অবাক হইনি।

ভালো, আমি চাইছি আপনার মনে যেন কোনো সন্দেহ না থাকে। এবার বলুন। রোবটটাকে দেখতে চেয়েছেন কেন?

সেলডন কাধ নেড়ে বললেন, কৌতূহল। আমি কখনো রোবট দেখিনি। জানতামও না এইরকম কোনো বস্তু আছে।

আপনি কীভাবে জানলেন আছে এবং বিশেষ করে ঠিক এখানেই আছে?

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন সেলডন, তারপর বললেন, আমি এই প্রশ্নের উত্তর দেব না।

ট্রাইবসম্যান হামিন এই জন্যই আপনাকে মাইকোজেনে নিয়ে এসেছে। রোবটের বিষয়ে অনুসন্ধান করার জন্য?

না, ট্রাইবসম্যান হামিন আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে নিরাপত্তার জন্য। কিন্তু আমরা স্কলার, ড, ভেনাবিলি এবং আমি। জ্ঞান অন্বেষণই আমাদের কাজ। মাইকোজেন সম্বন্ধে গ্যালাক্সির মানুষ কিছুই জানে না। তাই আমরা আপনাদের জীবনযাত্রা এবং ধ্যান-ধারণা আরো পরিস্কারভাবে বুঝতে চেয়েছিলাম। এইরকম ইচ্ছে হওয়াটা স্বাভাবিক এবং আমাদের মতে ক্ষতিকর তো নয়ই বরং প্রশংসার যোগ্য।

তাই? কিন্তু আমরা চাই না অন্য সেক্টরের ট্রাইব্যূদের মাঝে বা অন্যান্য গ্রহের মাঝে নিজেদের প্রচার করতে। আমাদের এই ইচ্ছাটাও অতি স্বাভাবিক এবং কোনটা ক্ষতিকর কোনটা ক্ষতিকর নয় তার বিচার করব আমরা নিজেরা। তাই আবার জিজ্ঞেস করছি ট্রাইবসম্যান : আপনি কীভাবে জানলেন যে মাইকোজেনে একটা রোবট আছে এবং সেটা আছে এই কামরাতেই।

গুজব, সেলডন বললেন।

আপনি এই কথা আমাকে বিশ্বাস করতে বলেন?

হ্যাঁ।

 সানমাস্টার ফোরটিন-এর নীল চোখে বরফের শীতলতা ফুটে উঠল, কিন্তু কণ্ঠস্বর না চড়িয়েই বললেন, ট্রাইবসম্যান সেলডন, দীর্ঘদিন থেকেই আমাদের সাথে ট্রাইবসম্যান হামিনের ভালো সম্পর্ক। ট্রাইবসম্যান হলেও সে একটু অন্যরকম। যখন। সে আপনাদের আমাদের কাছে নিয়ে এসে নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিতে বলে তখন আমরা বন্ধুত্বের খাতিরে রাজি হই। কিন্তু ট্রাইবসম্যান হামিনের যতই ভালো গুণ থাকুক না কেন সে একজন ট্রাইবসম্যান। ফলে আমরা সন্দেহে পড়ে যাই তার আসল উদ্দেশ্যটা কী হতে পারে?

আমাদের উদ্দেশ্য জ্ঞান অন্বেষণ, বললেন সেলডন। ট্রাইবসম্যান ভেনাবিলি একজন ইতিহাসবিদ। আমারও খানিকটা আগ্রহ আছে এই বিষয়ে। তাহলে মাইকোজেনের ইতিহাস জানার চেষ্টা করলে ক্ষতি কী?

প্রথম কারণ আমরা তা চাই না–যাইহোক, আমাদের দুজন বিশ্বাসী সিস্টারকে আপনাদের কাছে পাঠানো হয়। তাদের দায়িত্ব ছিল আপনাদের সবরকম সহযোগিতা করা এবং কৌশলে আপনাদের উদ্দেশ্য জানার চেষ্টা করা, এবং ট্রাইবসম্যানরা। বোধহয় একটা শব্দ ব্যবহার করেন–ছলনা করা। তবে এমনভাবে যেন আপনারা তা বুঝতে না পারেন। সানমাস্টার ফোরটিন হাসলেন, খানিকটা বিষণ্ণ হাসি।

রেইনড্রপ ফরটি ফাইভ, সানমাস্টার ফোরটিন বলেই চলেছেন, ট্রাইবসওম্যান ভেনাবিলিকে নিয়ে কেনাকাটা করতে যায়। সেই সময় উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি। সব রিপোর্টই আমরা নিয়মিত পেয়েছি। ট্রাইবসম্যান সেলডন, আরেক সিস্টার রেইনড্রপ ফরটি থ্রি আপনাকে আমাদের মাইক্রোফার্ম দেখাতে নিয়ে যায়। চট করে আপনার সাথে একা যাওয়ার জন্য রাজী হলে আপনার সন্দেহ হতো। আমরা তা চাইনি, কিন্তু আপনি নিজেই আমাদের কাজটা সহজ করে দেন। যুক্তি দিয়ে তাকে রাজী করিয়েছেন। আপনার সাথে যেতে সে রাজী হয় অনেক ত্যাগের বিনিময়ে। এবং আপনি পবিত্র গ্রন্থ দেখতে চাইলেন। এখানেও সিস্টারকে একজন বিকৃত রুচির মানুষের অভিনয় করতে হয় যেন আপনার মনে কোনো সন্দেহ না ঢোকে। তার এই আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না–ধরে নিচ্ছি ট্রাইবসম্যান, পবিত্র গ্রন্থ এখনো আপনার সাথে আছে। আমি কী ওটা ফেরত পেতে পারি?

চুপ করে বসে আছেন সেলডন।

সানমাস্টার ফোরটিন তার লোলচর্মসর্বস্ব বয়সী হাতখানা বাড়িয়ে বললেন, আমার মনে হয় বল প্রয়োগ করার আগেই বইটা ফেরত দিলে ভালো হবে।

ফেরত দিলেন সেলডন। সানমাস্টার ফোরটিন চট করে পাতা উল্টিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিলেন যে বইটার কোনো ক্ষতি হয়নি।

ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সময়মতো যথাযথ নিয়মে বইটাকে নষ্ট করে ফেলা হবে। বিরাট অপচয়! যাইহোক, যেহেতু আপনি এই বই পড়েছেন তাই স্যাক্রাটোরিয়ামে আসলেন। আমরা অবাক হইনি। সবসময় চোখে চোখে রাখা হয়েছিল আপনাদের, যদিও টের পাননি। ব্রাদার এবং সিস্টাররা ট্রাইবসম্যান দেখলেই চিনতে পারে। স্কিন ক্যাপ দেখলেই আমরা বুঝতে পারি। এই মুহূর্তে প্রায় সত্তর জন ট্রাইবসপিওপিল মাইকোজেনে আছে। সবাই ব্যবসায়িক বা সরকারি কোনো কাজে এসেছে এবং অফিসিয়াল গ্রাউণ্ডের বাইরে যাওয়া তাদের জন্য নিষিদ্ধ। তাই আপনারা যখন রাস্তায় বেরোন সবাই যে শুধু বুঝেছে তাই নয় বরং চিনতেও পেরেছে যে আপনারা কারা।

যে বয়স্ক ব্রাদারের সাথে দেখা হয় সে কৌশলে আপনাদের কাছে স্যাক্রাটোরিয়াম এবং গ্রন্থাগারের কথা বলে, সেই সাথে ভেতরে ঢোকার ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়। কারণ আমরা আপনাদের ফাঁদে ফেলতে চাইনি। কিন্তু আপনারা শোনেন নি।

যে দোকান থেকে সাদা কার্টল এবং স্যাশ কেনেন সেই দোকানদার তৎক্ষণাৎ আমাদের খবর দেয়। তখন থেকেই আপনাদের উদ্দেশ্যের কথা পরিস্কার হয়ে যায়। গ্রন্থাগারটা সেদিন খালি রাখা হয়। লাইব্রেরিয়ানকে বলে দেওয়া হয় যেন আপনাদের দিকে না তাকায়। স্যাক্রাটোরিয়াম খালি রাখা সম্ভব ছিল না তবে সবাইকে জানিয়ে রাখা হয়। যে ব্রাদার আপনাদের সাথে কথা বলছিল সে যখন বুঝতে পারে যে আপনারা কে তখনই সরে পড়ে। তারপর আপনারা এখানে এই কামরায় চলে এলেন।

আপনাদের উদ্দেশ্যই ছিল এখানে আসার, আমরা যথাসাধ্য বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এখানে এসেছেন নিজের দায়িত্বে, নিজের ইচ্ছায় এবং আমি যা জিজ্ঞেস করতে চাই–আরেকবার সেটা হলো : কেন?

জবাব দিল ডর্স, দৃঢ় কণ্ঠ, চোখে কঠিন দৃষ্টি। আমরাও আরেকবার জবাব দিচ্ছি, মাইকোজেনিয়ান। আমরা স্কলার, যাদের কাছে জ্ঞান অত্যন্ত পবিত্র এবং জ্ঞানের অন্বেষণই জীবনের একমাত্র ব্রত। আপনি আমাদেরকে এখানে আসতে বলেন নি কিন্তু বাধাও দেননি। এই বিল্ডিং-এর আশেপাশে পৌঁছার আগেই আপনি সেটা করতে পারতেন। বরং আমাদের আসাটাকে আরো সহজ করে দিয়েছেন এবং এইভাবেই আপনি আমাদের প্রলুব্ধ করেছেন। আর আমরা কী ক্ষতি করেছি? আমরা কাউকে বিরক্ত করিনি। এই ভবন বা আপনার বা অন্য কিছুর কোনো ক্ষতি করিনি।

রোবটের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলল, ওটা একটুকরা ধাতু ছাড়া আর কিছুই না, অথচ এটাকেই আপনি এখানে লুকিয়ে রেখেছেন। আমাদের যা জানার দরকার ছিল জেনেছি। এখন আমরা জানি ওটা মৃত, কোনো কাজ করে না। ভেবেছিলাম গুরুত্বপূর্ণ কিছু পাবো। কিন্তু হতাশ হয়েছি। যাইহোক, এখন আমাদের চলে যেতে কোনো আপত্তি নেই। আপনি যদি চান তাহলে একবারে মাইকোজেন ছেড়েই চলে যাব।

নির্বিকার ভঙ্গিতে কথাগুলো শুনলেন সানমাস্টার ফোরটিন। ডর্সের কথা শেষ হওয়ার পর তিনি শুধু সেলডনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এই রোবট, যাইহোক না। কেন, একটা প্রতীক, আমরা যা হারিয়েছি যা আমাদের কাছে এখন আর নেই তার প্রতীক। হাজার হাজার বছর ধরে আমরা সেই হারানো দিনের কথা স্মরণ করেছি এবং বিশ্বাস করি একদিন সেই সব ফিরে পাব। শুধু এই একটা জিনিসই আমাদের কাছে আছে এবং এটা আমাদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। অথচ আপনার মেয়েমানুষের কাছে এটা। শুধু এক টুকরা ইস্পাত। আপনিও কী তাই মনে করেন, ট্রাইবসম্যান সেলডন?

আমরা এমন এক সমাজে বাস করি, বললেন সেলডন, সেই সমাজ হাজার বছরের পুরনো অতীত নিয়ে মাথা ঘামায় না। অতীতে যা ছিল সেটা ভালো হোক মন্দ। হোক তার সাথে আমরা নিজেদের জীবন যাত্রাকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেলি না। আমরা সবসময় বর্তমানকে নিয়ে বাঁচি। আমরা বুঝতে পেরেছি এই রোবট আপনাদের। কাছে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ এবং আপনাদের ধ্যান-ধারণাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমরা বিচার করি আমাদের দৃষ্টিতে যেমন আপনারা বিচার করেন আপনাদের দৃষ্টিতে। আমাদের কাছে এটা এক টুকরা ইস্পাত ছাড়া আর কিছুই না।

এবং এখন, ডর্স বলল, আমরা যাব।

না, আপনারা যাচ্ছেন না। এখানে এসে আপনারা অপরাধ করেছেন। আপনার কথামতো, শুধু আমাদের দৃষ্টিতেই তা অপরাধ–ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন সান মাস্টার ফোরটিন–কিন্তু এটা আমাদের টেরিটোরি এবং এর ভিতরে আমরাই নিয়ম তৈরি করব। আপনারা যে অপরাধ করেছেন তার শাস্তি মৃত্যু।

আপনি আমাদের হত্যা করবেন? রাগের সাথে বলল ডর্স।

সানমাস্টার ফোরটিন-এর চেহারাতেও রাগের আভাস ফুটল এবং এখনো তিনি। শুধু সেলডনকে উদ্দেশ্য করেই কথা বললেন, আমাদেরকে আপনি কী মনে করেন। ট্রাইবসম্যান সেলডন? আমাদের ঐতিহ্য আপনাদের ঐতিহ্যের মতোই প্রাচীন, মানবসভ্যতার মতোই উন্নত এবং জটিল। আমি নিরস্ত্র। আর আপনারা যেহেতু অপরাধী তাই আইনের মাধ্যমেই বিচার করা হবে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে দ্রুত এবং যন্ত্রণাহীন পদ্ধতিতে।

আপনারা বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে আমি বাধা দেব না, কিন্তু নিচে অসংখ্য ব্রাদার জমায়েত হয়েছে, যখন ঢুকেছিলেন তখনকার চেয়ে অনেকগুণ বেশি। আপনারা যা করেছেন তার জন্য ভীষণ ক্ষিপ্ত। একা পেলে হয়তো একযোগে আপনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। মাইকোজেনের ইতিহাসে এইরকম জনরোষের মুখে অনেক ট্রাইবসম্যানের মৃত্যু হয়েছে এবং তা যন্ত্রণাহীন নয় মোটেই।

আপনাদের অতি উন্নত সমাজের এই নিয়মের কথা স্কাইস্ট্রিপ টু আমাদের জানিয়েছিল। ডর্স বলল।

মানুষ যেকোনো মুহূর্তে হিংস্র হয়ে উঠতে পারে। শান্ত গলায় বললেন সানমাস্টার ফোরটিন। কথাটা যেকোনো সমাজের জন্যই প্রযোজ্য। আপনার মেয়েমানুষ নিশ্চয়ই তা জানে, যেহেতু তিনি একজন ইতিহাসবিদ।

আমরা বরং যুক্তি দিয়ে ফায়সালা করার চেষ্টা করি, সানমাস্টার ফোরটিন। সেলডন বললেন। হয়তো মাইকোজেনের স্থানীয় বিষয়ে আপনিই আইন। কিন্তু আমাদের উপর তা খাটবে না। আমরা দুজন নন-মাইকোজেনিয়ান এবং এম্পায়ারের নাগরিক। শুধু সম্রাট বা তার নিয়োজিত কোনো অফিসার ক্যাপিটাল অফেন্সের বিচার করার অধিকার রাখে।

হয়তো কাগজে কলমে বা হলোভিশনের স্ক্রীনে তা সত্যি, কিন্তু আমরা এখন তাত্ত্বিকতা নিয়ে আলোচনা করছি না। বহুদিন থেকেই হাই এল্ডাররা রাজশক্তির কোনোরকম বাধা ছাড়াই যেকোনো ধরনের ভ্রষ্টাচারের বিচার করার অধিকার ভোগ করে আসছে।

যদি অপরাধী আপনার নিজের সমাজের লোক হয়, বললেন সেলডন। কিন্তু তারা যদি বাইরের লোক হয় তখন আর সেই নিয়ম খাটবে না।

এই ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। ট্রাইবসম্যান হামিন আপনাদেরকে উদ্বাস্তু হিসেবে এখানে নিয়ে আসে। আমরা তো এত বোকা নই যে বুঝতে পারব না আপনারা আসলে সম্রাটের হাত থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আমরা যদি তার বোঝা সরিয়ে দেই তিনি আপত্তি করবেন কেন?

কারণ, তিনি আপত্তি করবেন। হয়তো আমরা তার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি, হয়তো তিনি আমাদের ধরে শাস্তি দেবেন, কিন্তু তিনি সেটা নিজের হাতে করতে চান। কোনো মাইকোজেনিয়ান নিজস্ব আইনে আমাদের বিচার করলে তার অর্থ হবে সম্রাটের কর্তৃত্বকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো এবং কোনো অবস্থাতেই তিনি তা ঘটতে দেবেন না। মাইক্রোফুডের প্রতি যতই লোভ থাকুক না কেন সবার আগে তিনি ইম্পেরিয়াল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বিষয়ে গুরুত্ব দেবেন। আপনি কী চান যে আমাদের মেরে ফেলার পর এক ডিভিশন ইম্পেরিয়াল সৈন্য এসে আপনাদের ফার্ম বাসস্থানে লুট পাট চালাবে, স্যাক্রাটোরিয়ামের গোপনীয়তা ফাঁস করে দেবে? ভেবে দেখুন?

সানমাস্টার ফোরটিন হাসলেন, কিন্তু তার মুখের ভাবে কোনো নমনীয়তা নেই। আসলে এগুলো আমি সবই ভেবেছি এবং একটা বিকল্প পথও তৈরি করে রেখেছি। বিচারের পর আপনাদের রায় কার্যকর করতে দেরি করব। সেই ফাঁকে আপনারা। সম্রাটের কাছে আপীল করবেন। এতে সম্রাট বুঝতে পারবেন যে আমরা সবসময়ই। তার অনুগত এবং আপনাদের পেয়ে তিনি খুশী হবেন–মাইকোজেন লাভবান হবে। আপনারা তাহলে এটাই চান, সম্রাটের কাছেই বন্দী হবেন?

সেলডন এবং ডর্স আড়চোখে পরস্পরের দিকে তাকালেন, কিছু বললেন না।

সানমাস্টার ফোরটিন বললেন, মৃত্যু অবধারিত, আপনাদের শুধু বেছে নিতে হবে কোথায় মরবেন।

সত্যি কথা বলতে কী, নতুন একটা কণ্ঠস্বর বলল, আমার মতে দুটো বিকল্পের কোনোটাই গ্রহণযোগ্য নয় বরং তৃতীয় কোনো বিকল্প দেখতে হবে।

.

৫৯.

ডর্সই প্রথম চিনতে পারল কারণ সে সম্ভবত আগন্তুককে আশা করছিল।

হামিন, বলল সে, খুঁজে পেলে তাহলে আমাদের। তোমার সাথে দেরী না করেই যোগাযোগ করি যখন বুঝতে পারি যে আমি হ্যারিকে-এর, হাত দুপাশে ছড়িয়ে পরিস্থিতি বোঝালো সে–এর থেকে বিরত রাখতে পারব না।

সামান্য একটু হাসল হামিন এবং তাতে তার মুখের চিরস্থায়ী গাম্ভীর্য অটুটই থাকল। তার দেহ থেকে অতি সূক্ষ্ম ক্লান্তির আভা ফুটে বেরুচ্ছে।

ডর্স, বলল সে, আমি অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলাম। সব সময়ই তো আর মুহূর্তের নোটিশে চলে আসতে পারি না। তাছাড়া ভেবেছিলাম যে তোমাদের কাছ থেকেই সাদা কাটল আর স্যাশ যোগাড় করে নেব। স্কিনক্যাপের কথা অবশ্য তখন জানতাম না। আরো আগে আসলে হয়তো থামাতে পারতাম, তবে খুব বেশি দেরী নিশ্চয়ই হয়নি।

সানমাস্টারকে দেখে মনে হলো তার চোয়ালে কেউ বেমক্কা ঘুষি মেরেছে, তবে হতচকিত ভাবটা কাটিয়ে উঠলেন তিনি। কথা বলার সময় অবশ্য কণ্ঠস্বরে সেই বহুচর্চিত গাম্ভীর্য আর ফুটে উঠল না। আপনি এখানে কীভাবে এসেছেন, ট্রাইবসম্যান হামিন?

খুব একটা সহজ হয়নি, হাই এল্ডার, কিন্তু এখানেরই কয়েকজন আমাকে চিনতে পেরেছে। মনে রেখেছে মাইকোজেনের জন্য আমি কী করেছি এবং যার জন্য আমাকে একজন অনারারী ব্রাদারের সম্মান দেওয়া হয়েছে। আপনি সব ভুলে গেছেন, সানমাস্টার ফোরটিন।

আমি কিছুই ভুলিনি, হাই এল্ডার জবাব দিলেন, কিন্তু তাতেও সব অপরাধ ক্ষমা করা যায় না। একজন ট্রাইবসম্যান এবং ট্রাইবসওম্যান এখানে এসেছে। আপনি যত উপকার করেছেন তার সব মিলিয়েও এটা মেনে নেওয়া যায় না। আমার জনগণ অকৃতজ্ঞ নয়। অন্য কোনো উপায়ে আপনাকে প্রতিদান দেওয়া হবে। কিন্তু এই দুজনকে এখানেই মরতে হবে অথবা সম্রাটের কাছে হস্তান্তর করা হবে।

আমিও তো এখানে এসেছি, শান্ত সুরে বলল হামিন। তাতে কোনো অপরাধ হয়নি?

আপনার জন্য… যেহেতু আপনি একজন অনারারি ব্রাদার, আমি অন্তত একবারের জন্য… এই অপরাধ দেখেও না দেখার ভান করতে পারি। কিন্তু এই দুজনের বেলায় তা সম্ভব নয়।

কারণ সম্রাটের কাছ থেকে আপনি একটা প্রতিদান বা সম্রাটের কৃপা বা অনুগ্রহ পাবেন বলে আশা করছেন। নিশ্চয়ই এরই মধ্যে তার সাথে বা বলা ভালো যে তার চীফ অব স্টাফ ইটো ডেমারজেলের সাথে যোগাযোগ করেছেন?

এই বিষয়ে আমি কথা বলতে চাই না।

তার মানে সত্যি। শুনুন, সম্রাট কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেটা আমি জিজ্ঞেস করব না। তবে এই বিশৃঙ্খল সময়ে বেশি কিছু দিতে পারবেন না তিনি। বরং আমি একটা প্রস্তাব দেই। এই দুজন নিশ্চয়ই বলেছে যে তারা স্কলার?

অনেকবার।

ঠিকই বলেছে। ট্রাইবসওম্যান ইতিহাসবিদ আর ট্রাইবসম্যান গণিতবিদ। নিজেদের মেধা একত্র করে ওরা ম্যাথমেটিক্স অব হিস্টোরি তৈরি করার চেষ্টা করছে এবং এই সম্মিলিত বিষয়ের নাম দিয়েছে সাইকোহিস্টোরি।

সাইকোহিস্টোরির ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না, জানার আগ্রহও নেই। ট্রাইবাল জ্ঞান ভাণ্ডারের কোনোকিছুই আমি জানতে চাই না।

আমার কথা শুনলে আপনারই লাভ হবে।

মাত্র পনেরো মিনিটে হামিন ব্যাখ্যা করে বোঝালো যে সমাজের স্বাভাবিক। নিয়মগুলোকে এমনভাবে সমন্বিত করা যায় যার ফলে অসংখ্য সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ অনুমান করে নেওয়া যাবে।

ভাবলেশহীন মুখে সব শুনলেন সানমাস্টার ফোরটিন। হামিনের কথা শেষ হওয়ার পর বললেন, আমার মতে পুরোটাই অস্বাভাবিক হিসাব নিকাশ।

সেলডন তার সাথে একমত হওয়ার জন্য কথা বলতে গেলেন কিন্তু হামিন হাঁটুতে চাপ দিয়ে নিষেধ করল।

সম্ভবত, হাই এল্ডার হামিন বলল। কিন্তু সম্রাট তা মনে করেন না। আসলে আমি বলতে চাইছি যে ডেমারজেল তা মনে করে না। এবং তার ব্যাপারে আপনাকে নতুন করে কিছু বলার নেই। সম্রাট এই দুই স্কলারকে নিজের স্বার্থ হাসিল করার কাজে ব্যবহার করতে চায়। সেজন্যই তাদের নিরাপত্তার জন্য এখানে নিয়ে এসেছিলাম। আমি এটা মোটেই আশা করিনা যে স্কলারদের ধরিয়ে দিয়ে আপনি ডেমারজেলের উপকার করবেন।

ওরা এমন এক অপরাধ করেছে।

জানি আমি। কিন্তু আপনি বলছেন বলেই তা অপরাধ। সত্যিকার কোনো ক্ষতি তো করেনি।

ওরা আমাদের বিশ্বাস, আমাদের অনুভূতিতে আঘাত করেছে-

কিন্তু চিন্তা করে দেখুন সাইকোহিস্টোরি যদি ডেমারজেলের হাতে চলে যায় তাহলে কী ভীষণ ক্ষতি হবে। হ্যাঁ, স্বীকার করছি যে সাইকোহিস্টোরি সম্ভব নাও হতে পারে। কিন্তু অন্তত একবারের জন্য ধরে নিন যে সম্ভব হবে এবং ইম্পেরিয়াল গভর্নমেন্ট সেটা নিজের স্বার্থে ব্যবহার করবে, ভবিষ্যতে কী হবে জানতে পারবে, তার ভিত্তিতে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারবে–যা অন্য কেউ করতে পারবে না। সত্যি কথা বলতে কী তারা নিজেদের পছন্দনীয় বিকল্প ভবিষ্যৎ তৈরি করে নেবে।

তো?

এই বিষয়ে কী কোনো সন্দেহ আছে, হাই এল্ডার, যে ইম্পেরিয়াল গভর্নমেন্টের পছন্দনীয় ভবিষ্যৎ হবে অনেক বেশি কেন্দ্রীভূত। আপনি ভালো করেই জানেন যে কয়েক শতাব্দী ধরেই এম্পায়ারে একটা ভাঙ্গন চলছে। অনেক গ্রহই শুধু মুখে মুখে সম্রাটের অনুগত কিন্তু বাস্তবে তারা নিজেরাই নিজেদের শাসন করছে। এমনকি ট্র্যান্টরের ভিতরেও ভাঙতে শুরু করেছে। মাইকোজেন তো শুধু একটা উদাহরণ। এরকম অসংখ্য আছে। মাইকোজেনের উপর কোনো ধরনের ইম্পেরিয়াল কর্তৃত্ব নেই। আপনি হাই এল্ডার হিসেবে এই সেক্টর শাসন করছেন অথচ আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এখানে কোনো ইম্পেরিয়াল অফিসার নেই। ডেমারজেল যখন ভবিষ্যৎ নিজের ইচ্ছামতো নির্ধারিত করে দিতে পারবে তখন এই সুবিধা আপনি কতদিন ভোগ করতে পারবেন?

এখনো সব অবিশ্বাস্য হিসাব নিকাশ সানমাস্টার ফোরটিন বললেন, তবে এবার কিছুটা ভাবনায় পড়ে গেছি, স্বীকার না করে উপায় নেই।

অন্যদিকে এই দুই স্কলার যদি তাদের কাজ সুসম্পন্ন করতে পারে, আপনি হয়তো বলবেন যে অসম্ভব, কিন্তু যদি পারে–তখন নিশ্চয়ই মনে পড়বে যে আপনি তাদের জীবন দান করেছিলেন, আপনার দৃষ্টিতে ভয়ংকর অপরাধ করার পরেও এবং কঠিন শাস্তি দেওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। এবং যেহেতু ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার হাতিয়ার ওদের কাছে থাকবে হয়তো মাইকোজেনকে নিজের মতো থাকার সুযোগ তৈরি করে দেবে যেন ধীরে ধীরে লস্টওয়ার্ল্ডের হুবহু না হলেও কাছাকাছি প্রতিকৃতিতে রূপান্তরিত হতে পারে। আর মনে না থাকলেও আমি ওদের মনে করিয়ে দেব।

আসলে-

শুনুন, আপনি কী ভাবছেন তা অনুমান করা কঠিন কিছু না। ট্রাইবসপিওপিলদের মাঝে আপনি ডেমারজেলকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করেন। যদিও সাইকোহিস্টোরির সম্ভাবনা অনেক কম কিন্তু শূন্য নয়; যদি এটা আপনাকে লস্ট ওয়ার্ল্ড পুনর্গঠনে সাহায্য করে তাহলে জীবনে আর কী আশা করার আছে? সম্ভাবনা যত ক্ষুদ্রই হোক আপনি সুযোগ নেবেন না কেন? আমি আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। এবং আমি সবসময়ই তা রক্ষা করি। ছেড়ে দিন এই দুজনকে আর বহুদিনের লালিত স্বপ্নকে পূরণের একটা সুযোগ নিয়ে দেখুন।

কিছুক্ষণ নীরব থেকে সানমাস্টার ফোরটিন বললেন, জানি না কীভাবে, ট্রাইবসম্যান হামিন, প্রতিবারই আমি যা করতে চাই না সেটা করতে আপনি আমাকে রাজী করিয়ে ফেলেন।

আমি কী আপনাকে কখনো ভুল পরামর্শ দিয়েছি, হাই এল্ডার?

আপনি কখনো এত ক্ষুদ্র সম্ভাবনার পরামর্শ দেননি।

কিন্তু তার সম্ভাব্য প্রতিদান অনেক বড়ো। ফলে কাটাকাটি।

সানমাস্টার ফোরটিন মাথা নেড়ে বললেন, ঠিকই বলেছেন। এই দুজনকে নিয়ে মাইকোজেন ছেড়ে চলে যান। আমি আর ওদের চেহারা দেখতে চাই না। অন্তত সেই সময় পর্যন্ত কোনো সন্দেহ নেই যে আমি বেঁচে থাকতে সেই সময় আসবে না।

সম্ভবত আসবে না, হাই এল্ডার। কিন্তু আপনার জনগণ প্রায় বিশ হাজার বছর অপেক্ষা করেছে। আর মাত্র–ধরা যাক–দুইশ বছর অপেক্ষা করলে কী আপনি আপত্তি করবেন?

আমি এক মুহূর্তও অপেক্ষা করতে চাই না। কিন্তু আমার জনগণ যতদিন প্রয়োজন অপেক্ষা করবে।

এবার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি পথ করে দিচ্ছি। ওদেরকে নিয়ে চলে যান।

.

৬০.

নতুন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে টানেল দিয়ে পথ চলা শুরু হলো আবার। হামিন আর সেলডন ইম্পেরিয়াল সেক্টর থেকে স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় এয়ার ট্যাক্সিতে চড়ে এমনই একটা টানেলের ভেতর দিয়ে গিয়েছিলেন। আর এখন যাচ্ছেন… সেলডন জানেন না কোথায়। হামিনের মুখ দেখে মনে হচ্ছে গ্রানাইট পাথরের তৈরি এবং কথা বলার কোনো ইচ্ছেই নেই। তাই জিজ্ঞেস করারও সাহস হচ্ছে না।

সামনে পিছনে দুটো করে মোট চারটি আসন। হামিন সামনে বসেছে একা। ডর্স আর সেলডন পিছনে।

ডর্স ভীষণ মনমরা হয়ে বসে আছে। তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে হাসলেন সেলডন। নিজেদের পোশাক পড়ে বেশ আরাম লাগছে, তাই না?

আমি কখনোই, যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে কথাগুলো বলল ডর্স, কার্টলের মতো দেখতে কোনো পোশাক পরবও না দেখবও না। আর এখন কোনো স্বাভাবিক টেকো লোককে দেখলেও আমার অস্বস্তি হবে।

এবং ডর্সই সেলডনের মনের প্রশ্নটা হামিনকে জিজ্ঞেস করল। চ্যাটার, খানিকটা বিরক্ত সুরে বলল সে, কোথায় যাচ্ছি বলছ না কেন?

একটু কাত হয়ে বসল হামিন। গম্ভীরভাবে তাকালো ডর্স আর সেলডনের দিকে। যাচ্ছি এমন জায়গায়, সে বলল, যেখানে তোমরা সহজে কোনো সমস্যায় পড়বে না–যদিও সেইরকম কোনো জায়গার কথা আমার জানা নেই।

ডর্স সাথে সাথেই হড়বড় করে বলতে লাগল, আসলে দোষটা আমার, চ্যাটার। স্ট্রিলিং-এ আমি হ্যারিকে একা আপারসাইডে যেতে দিয়েছিলাম। মাইকোজেনে সাথে ছিলাম ঠিকই কিন্তু স্যাক্রাটোরিয়ামে ঢুকতে বাধা দিতে পারিনি।

আমি নিজেই যাওয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। রাগের সাথে বললেন সেলডন। ডর্সের কোনো দোষ নেই।

এসব কথায় কান দিল না হামিন, শুধু বলল, আপনি রোবটটাকে দেখতে চেয়েছিলেন। কোনো কারণ ছিল? আমাকে বলা যাবে?

সেলডনের চেহারা খানিকটা লাল হলো। এই ক্ষেত্রে আমার ভুল হয়েছে, হামিন। যা দেখেছি তা আমি আশা করিনি। যদি জানতাম এল্ডারদের বাসস্থানে আসলে কী আছে তাহলে কখনোই যেতাম না। এটাকে চরম বোকামী বলতে পারেন।

কিন্তু, সেলডন, আপনি আসলে কী দেখবেন বলে আশা করেছিলেন সেটাই বলুন। আমাদেরকে অনেকটা পথ যেতে হবে। কাজেই সময় লাগলেও অসুবিধা নেই আর আমি শুনতে আগ্রহী।

আসলে হামিন, আমার ধারণা হয়েছিল যে এক সময় হিউম্যানিফর্ম রোবট ছিল, ওগুলো বাচত অনেকদিন, অন্তত একটা এখনো বেঁচে আছে এবং আছে এল্ডারদের বাসস্থানে। রোবট একটা ঠিকই ছিল কিন্তু সেটা ধাতব এবং মৃত। যদি জানতাম-

হ্যাঁ, যদি আমরা সবাই জানতাম। তাহলে আর এত প্রশ্নের জন্ম হতো না, এত অনুসন্ধান চলত না। হিউম্যানিফর্ম রোবট সম্বন্ধে আপনি কীভাবে জানলেন? যেহেতু কোনো মাইকোজেনিয়ানই এই বিষয়ে আপনার সাথে আলোচনা করত না তাই একটা উৎসের কথাই আমার মাথায় আসছে–মাইকোজেনিয়ানদের পবিত্র গ্রন্থ–একটা পাওয়ারড প্রিন্ট বই–প্রাচীন অরোরান এবং আধুনিক গ্যালাক্টিক ভাষায় লেখা। ঠিক বলেছি?

হ্যাঁ।

আপনি সেই বই কীভাবে পেলেন?

 কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলেন সেলডন, তারপর বিড়বিড় করে বললেন, ঘটনাটা অত্যন্ত বিব্রতকর।

আমি সহজে বিব্রত হই না, সেলডন।

শোনার সময় মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠতে দিল হামিন। বলল, আপনার কাছে কী একবারও মনে হয়নি যে ঘটনাটা সাজানো। কোনো সিস্টারই নির্দেশ ছাড়া এবং যথার্থ কারণ ছাড়া এই কাজ করবে না।

ভুরু কুঁচকালেন সেলডন এবং বিরক্ত সুরে বললেন, মোটেই না। মানুষের রুচি যখন তখন বিকৃত হয়ে যেতে পারে। আপনার মুখে তো হাসি আসবেই। আপনার বা ডর্সের কাছে যে তথ্য আছে আমার কাছে তা নেই। আমাকে ফাঁদে ফেলার ইচ্ছে না থাকলে আগেই সতর্ক করে দিতে পারতেন।

ভুল হয়েছে। আমার মন্তব্য ফিরিয়ে নিলাম। যাইহোক, বইটা আপনার কাছে নেই, তাই না?

না, সানমাস্টার ফোরটিন নিয়ে গেছে।

আপনি কতখানি পড়েছিলেন।

সামান্য অংশ। আমার হাতে সময় ছিল না। যথেষ্ট বড়ো বই এবং জঘন্য রকম নীরস।

হ্যাঁ, আমি জানি। কারণ আমি আরো বেশি পড়েছি। এটা শুধু নীরসই নয় বরং ভিত্তিহীন। পুরোটাই হচ্ছে মাইকোজেনিয়ানদের একপেশে দৃষ্টিভঙ্গির বর্ণনা। দুএকটা জায়গায় ইচ্ছে করেই অস্পষ্টতা তৈরি করা হয়েছে যেন বাইরের কেউ যদি এই বই হাতে পেয়েই যায় তাহলে যেন বুঝতে না পারে সে কী পড়ছে। আপনি কী পড়ে রোবটের বিষয়ে আগ্রহী হলেন?

বইতে হিউম্যানিফর্ম রোবটের কথা লেখা ছিল। এমন রোবট বাইরে থেকে দেখে মানুষের সাথে কোনো পার্থক্য করা যেত না।

কতগুলো ছিল?

সংখ্যাটা বলেনি–অন্তত আমি সেইরকম কিছু পড়িনি। হয়তো অল্প কয়েকটাই ছিল, কিন্তু সেগুলোর একটা, বইতে সেটার নাম বলেছে রেনিগেড। এই রোবটটা বোধহয় ভীষণ কোনো ক্ষতি করেছিল। তবে আমি পরিস্কার বুঝতে পারিনি।

এটাতো আমাকে আগে বলনি, মাঝখানে বলল ডর্স। আসলে এটা কোনো নাম না, প্রাচীন একটা শব্দ যার অর্থ এমন এক ব্যক্তি যে স্বজাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বিরোধীপক্ষকে সাহায্য করে।

প্রাচীন ভাষার বিষয়টা আমি তোমার উপরই ছেড়ে দিলাম, ডর্স, কিন্তু যদি এই রেনিগেডের অস্তিত্ব সত্যি সত্যি থাকত তাহলে বিশ্বাসঘাতক এবং শত্রু হিসেবে তাকে এল্ডারদের বাসস্থানে সংরক্ষণ করা হতো না।

অর্থটা তো আমি প্রথমে জানতাম না, সেলডন বললেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল যে সে শত্রু এবং তাকে পরাজিত করা হয়। মাইকোজেনিয়ানদের বিজয় চিহ্ন হিসেবে এটাকে সংরক্ষণ করা হয়ে থাকতে পারে।

রেনিগেড পরাজিত হয়েছিল সেরকম কোনো আভাস বইতে আছে?

না, কিন্তু সেটা হয়তো আমার চোখ এড়িয়ে গেছে।

না, বোধহয়। মাইকোজেনিয়ানদের যেকোনো বিজয়ের কথা বইতে পরিস্কার উল্লেখ থাকত এবং বারবার তার পুনরাবৃত্তি ঘটত।

রেনিগেড সম্বন্ধে বইতে আরেকটা কথা বলা আছে। আমতা আমতা করে বললেন সেলডন। আমি বোধহয় ঠিকমতো বুঝতে পারিনি।

আপনাকে তো বলেছি… হামিন বলল, কিছু কিছু জায়গায় ইচ্ছে করেই অস্পষ্টতা তৈরি করা হয়েছে।

আমার মনে হয়েছে ওরা বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে রেনিগেড কোনোভাবে মানুষের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারত… ইচ্ছা অনুযায়ী পরিচালিত করতে পারত।

যেকোনো রাজনীতিবিদই তা পারে। যখন সেটাতে কাজ হয় তখন তাকে বলা হয় ক্যারিশমা।

বেশ। বইতে এত কথা বলা হয়েছে যার দরুন আমি বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছি যে একসময় হিউম্যানিফর্ম রোবট ছিল এবং ওগুলোর একটা এখনো বেঁচে আছে। আমি সেটাকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারতাম।

কী লাভ হতো?

প্রাগৈতিহাসিক গ্যালাকিক সমাজের অনেক কিছুই জানতে পারতাম যখন মাত্র গুটিকয়েক গ্রহে মানুষ বাস করত। ফলে সাইকোহিস্টোরি তৈরি করা অনেক সহজ হতো।

যা শুনতেন তা কী বিশ্বাস করতে পারতেন? বহু হাজার বছর পরে আপনি একটা রোবটের প্রথম জীবনের স্মৃতির উপর নির্ভর করতে পারতেন? রোবটও তো যন্ত্র। তার স্মৃতি নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

ঠিকই বলেছে, ডর্স বলল। কম্পিউটারাইজড রেকর্ডের মতোই রোবটের মেমোরির তথ্যগুলো ধীরে ধীরে এলোমেলো হয়ে যাবে, নষ্ট হয়ে যাবে, মুছে যাবে। যত চেষ্টাই করো না কেন খুব বেশি উদ্ধার করতে পারতে না।

মাথা নাড়ল হামিন, আমি শুনেছি এটাকে বলা হয় তথ্যের অনিশ্চয়তার নীতি।

কিন্তু এমনও তো হতে পারে, সেলডন বললেন, বিশেষ কোনো তথ্য বিশেষ কোনো কারণে দীর্ঘস্থায়ী উপায়ে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে।

মূল কথাটা হচ্ছে বিশেষ তথ্য। বইতে যে তথ্যটা বিশেষভাবে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে হয়তো আপনার কাছে সেটা মূল্যহীন। রোবট যে তথ্যটা খুব ভালো ভাবে মনে রেখেছে সেটা হয়তো আপনার কোনো প্রয়োজনই নেই।

সেলডন হতাশ সুরে বললেন, আমি যেদিক দিয়েই চেষ্টা করছি সেদিকেই পরিস্থিতি এমনভাবে গুলিয়ে যাচ্ছে যার ফলে আমি নিশ্চিত যে সাইকোহিস্টোরি বাস্তবসম্মত করে তোলা অসম্ভব। তাহলে আর চেষ্টা করে লাভ কী?

হয়তো এই মুহূর্তে অর্থহীন মনে হচ্ছে, নিরাবেগ সুরে হামিন বলল, তবে যথাযথ প্রতিভাবান ব্যক্তির হাতে পড়লে হয়তো সাইকোহিস্টোরির একটা পথ তৈরি। হবে। নিজেকে আরো সময় দিন। আমরা একটা রেস্ট এরিয়ায় পৌঁছেছি। ডিনারটা এখানেই সেরে নেওয়া যাক।

ভেড়ার রান আর বিস্বাদ রুটি (অন্তত মাইকোজেনের অতি সুস্বাদু খাবারের পর এগুলোকে বিস্বাদ মনে হতেই পারে) খাওয়ার ফাঁকে সেলডন জিজ্ঞেস করলেন, হামিন, আপনি ধরে নিয়েছেন আমার মাঝে যথেষ্ট প্রতিভা আছে। আমি তো প্রতিভাবান নাও হতে পারি।

সত্যি কথা। হয়তো আপনার সেই প্রতিভা নেই। কিন্তু এই পদের জন্য বিকল্প কোনো প্রার্থীও আমার হাতে নেই। কাজেই আপনাকেই আমার ধরে রাখতে হবে।

সেলডন বড়ো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বেশ করব। কিন্তু আমি তো আশার আলো দেখছি না। সম্ভব কিন্তু অবাস্তব, শুরু থেকেই এই কথা বলছি এবং এখন সেই বিশ্বাস আরো জোরালো হয়েছে।

.

হিটসিঙ্ক

এমারিল, ইউগো–গণিতবিদ। সাইকোহিস্টোরিতে হ্যারি সেলডনের ঠিক পরেই তার অবস্থান। তিনি…
যে অবস্থাতে তিনি জীবন শুরু করেছিলেন সেটা তার গাণিতিক অবদানের চাইতেও অনেক বেশি নাটকীয়। প্রাচীন ট্র্যান্টরের ডাহল প্রদেশের সীমাহীন দারিদ্র্যের মাঝে তার জন্ম। হয়তো জীবনটা একজন সাধারণ মানুষের মতোই কেটে যেত, যদি না সেই সময় দুর্ঘটনাক্রমে হ্যারি সেলডনের সাথে তার দেখা হতো…
—এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাক্টিকা

.

৬১.

পুরো গ্যালাক্সির সম্রাট ক্লান্ত বোধ করছেন–শারীরিকভাবে ক্লান্ত। নিয়মিত ব্যবধানে বারবার মুখে রাজকীয় হাসি ফুটিয়ে তোলার কারণে ঠোঁট বাঁকা হয়ে গেছে। বারবার মাথা নাড়ানোর কারণে ঘাড় শক্ত হয়ে গেছে। উঠে দাঁড়ানো, আবার বসা, শরীর ঘুরানো, হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়ানো এগুলো করতে করতে তার পুরো শরীরটাই যেন অবশ হয়ে গেছে।

এটা একটা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান। এখানে তাকে ট্র্যান্টরের এদিক সেদিক থেকে আসা এবং সবচেয়ে যা খারাপ তা হলো অন্যান্য গ্রহ থেকে আসা মেয়র, ভাইসরয়, মন্ত্রী এবং তাদের স্ত্রী বা স্বামীর সাথে দেখা করতে হয়।

অতিথির সংখ্যা মোটামুটি এক হাজার হবে। প্রত্যেকের পরিধানে তাদের নিজস্ব ঢংয়ের পোশাক। মুখে হাজারো ধরনের গ্যালাক্টিক বাচনভঙ্গি। সেটা আরো খারাপ হয়ে উঠে যখন তারা সম্রাটের বাচনভঙ্গি নকল করার চেষ্টা করে। সবচেয়ে খারাপ সম্রাটকে সবসময় মনে রাখতে হচ্ছে। যেকোনো প্রতিশ্রুতি দেওয়া যাবে না কাউকে।

পুরো অনুষ্ঠানটাই শব্দ এবং দৃশ্য সহকারে রেকর্ড করা হচ্ছে। এবং ইটো ডেমারজেল লক্ষ্য রাখছে সম্রাট যথাযথ আচরণ করতে পারছেন কী না।

ডেমারজেল আসলে ভাগ্যবান!

সম্রাট এই প্রাসাদ এবং এর সংলগ্ন এলাকা ছেড়ে বাইরে বেরুতে পারেন না কিন্তু ডেমারজেল ইচ্ছে করলেই পুরো গ্যালাক্সি চষে বেড়াতে পারে। সম্রাট সর্বদাই সামনে থাকেন, সবসময়ই বাধ্য হন গুরুত্বপূর্ণ গুরুত্বহীন সকলকে দেখা দিতে। ডেমারজেল সবসময় আড়ালে থাকে, প্যালেস গ্রাউন্ডে তাকে কখনো দেখা যায় না। শুধু তার নামটাই সবার মনে ভীতির সঞ্চার করে এবং সে অনেকটা অদৃশ্য মানুষের মতো আর এটাই সবচেয়ে ভীতিজনক।

সম্রাট ভেতরের মানুষ, ক্ষমতার বেড়াজালে বন্দী এবং ক্ষমতার নির্যাসটুকু উপভোগ করছেন। ডেমারজেল বাইরের মানুষ, তার কোনো উপাধি নেই, প্রতিদানের আশা না করেই শ্রম দিয়ে যাচ্ছে। সে শুধু একটা জিনিসই চায় পরিপূর্ণ ক্ষমতা।

একটা কথা ভেবে সম্রাট প্রায়ই বেশ মজা পান। তিনি যেকোনো মুহূর্তে বানোয়াট কোনো অভিযোগে বা কোনো অভিযোগ ছাড়াই ডেমারজেলকে গ্রেফতার করতে পারেন, বন্দী করে রাখতে পারেন, নির্বাসন দিতে পারেন, নির্যাতন করতে পারেন, মেরে ফেলতে পারেন। যে কঠিন বিশৃঙ্খল সময় চলছে তাতে করে এম্পায়ারের বিভিন্ন গ্রহ এমনকি ট্র্যান্টরের সেক্টরগুলোর উপর সম্রাটের কর্তৃত্ব খাটানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে কিন্তু অন্তত প্রাসাদ চত্বরে তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী; প্রশ্ন করার কেউ নেই।

অবশ্য ক্লীয়ন জানেন যে এটা তার দিবাস্বপ্ন। ডেমারজেল তার বাবার আমলেও একই পদে বহাল ছিল এবং তিনি এমন কোনো সময়ের কথা বলতে পারেন না যে সময় তাকে পরামর্শের জন্য ডেমারজেলের কাছে যেতে হয়নি। ডেমারজেল সব জানে, সব পরিকল্পনা করে, সব বাস্তবায়িত করে। সবচেয়ে বড়ো কথা কোনো ভুল হলে ডেমারজেলকেই অভিযুক্ত করা হয়, সম্রাট থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তিনি সকল সমালোচনার ঊর্ধ্বে। অবশ্য প্রাসাদ বিদ্রোহ বা ঘনিষ্ঠ জনের হাতে নিহত হওয়ার ভয় সবসময়ই থাকবে। কাজেই প্রমাণ হয় যে তিনি ডেমারজেলের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল।

ডেমারজেলকে ছাড়া কীভাবে চলবেন সেটা বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে সম্রাট ক্লীয়ন একটু কেঁপে উঠলেন। অনেক স্মার্টই একা একা শাসন করেছেন, অনেকেই আবার বারবার চীফ অব স্টাফ বদলিয়েছেন। তাদের সবাই অযোগ্য ছিল না এবং কিছুটা সফলও হয়েছে।

কিন্তু তিনি পারবেন না। ডেমারজেলকে তার প্রয়োজন। এটা পরিস্কার বুঝতে পেরেছেন যে ডেমারজেলের হাত থেকে তিনি ছাড়া পাবেন না। যত কৌশল প্রয়োগ করেন, ডেমারজেল আগে থেকেই সব বুঝে ফেলবে। তখন আরো বেশি কৌশল খাঁটিয়ে একটা প্রাসাদ বিদ্রোহ ঘটাবে। তিনি মারা যাবেন আর ডেমারজেল পরবর্তী সম্রাটকে একইভাবে সেবা করে যাবে–নিয়ন্ত্রণ করবে।

নাকি ডেমারজেল একই খেলা খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এখন সে নিজেই সম্রাট হতে চায়।

কখনোই না! নিজেকে আড়ালে রাখার অভ্যাসটা তার ভেতর অত্যন্ত প্রবল। সকলের সামনে নিজেকে প্রকাশ করলে তার ক্ষমতা, বুদ্ধি, দক্ষতা সব শেষ হয়ে যাবে। ক্লীয়ন মনেপ্রাণে তা বিশ্বাস করেন।

কাজেই ডেমারজেলকে যতক্ষণ তার মতো থাকতে দেওয়া হবে তিনি নিরাপদ। নিজের কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছাড়াই ডেমারজেল বিশ্বাস অক্ষুণ্ণ রেখে তার সেবা করে যাবে।

ঐ তো ডেমারজেল, সাধাসিধে পোশাক পরিধানে, নিজের মূল্যবান পাথর খচিত জৌলুসপূর্ণ রাজকীয় পোশাকের পাশে কত সাধারণ এটা ভেবে ক্লীয়ন খানিকটা লজ্জা পেলেন। দুজন ভৃত্য তার পোশাক খুলতে সাহায্য করল। পুরোপুরি একা হওয়ার পরই ডেমারজেল সামনে এসে দাঁড়ালো।

ডেমারজেল, সমগ্র গ্যালাক্সির সম্রাট বললেন, আমি ভীষণ ক্লান্ত।

রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানগুলো সবসময়ই ক্লান্তিকর, সায়ার। বিড়বিড় করে বলল ডেমারজেল।

তাহলে প্রতিদিনই সেগুলোতে যোগ দেওয়ার কোনো দরকার আছে?

প্রতিদিন না হলেও চলবে তবে এটা গুরুত্বপূর্ণ। এই অনুষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে ওরা আপনাকে দেখতে পারে, আপনার কথা শুনতে পারে। এগুলো এম্পায়ারকে মসৃণভাবে চালাতে সাহায্য করে।

সাধারণত এম্পায়ার ভালোভাবে চালানোর জন্য বল প্রয়োগ করতে হতো। গম্ভীর গলায় বললেন সম্রাট। কিন্তু এখন চালাতে হবে মিষ্টি হাসি, মধুর কথা আর আপ্যায়নের মাধ্যমে।

যদি শান্তি বজায় থাকে, সায়ার, তাহলে এগুলো অবশ্যই করতে হবে। আর আপনি যথেষ্ট ভালোভাবে শাসন করছেন।

কেন জানো–কারণ তুমি আছো আমার পাশে। আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি হলো যে আমি তোমার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছি। ধূর্ত চোখে ডেমারজেলের দিকে তাকালেন তিনি। আমার একটি পুত্র সন্তান আছে। তাকে আমার উত্তরাধিকার নির্বাচন না করলেও চলে। কারণ তার তেমন কোনো যোগ্যতা নেই। কেমন হয় যদি তোমাকে আমার উত্তরাধিকার নির্বাচন করি।

শীতল গলায় জবাব দিল ডেমারজেল, সায়ার, সেটা অসম্ভব। আমি সিংহাসনে বসতে চাই না। আপনার বৈধ উত্তরাধিকারের কাছ থেকে তার অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার কোনো ইচ্ছাই আমার নেই। আমার কোনো কাজ যদি আপনাকে অসন্তুষ্ট করে তাহলে শাস্তি দিন আমাকে। অবশ্য আমি এমন কিছু করিনি বা করব না যাতে করে সম্রাট অসন্তুষ্ট হয়ে শাস্তি দেবেন।

হাসলেন ক্লীয়ন। সিংহাসনে বসার আসল মজাটা বুঝতে পেরেছ বলে তোমাকে শাস্তি দেওয়ার চিন্তা আপাতত বাদ দিলাম। এসো, বরং কোনো বিষয়ে কথা বলা যাক। ঘুমাব, তবে বিছানায় শোয়ার আগে যে আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয় তার জন্য এখনো প্রস্তুত নই। কথা বলা যাক।

কোন বিষয়ে সায়ার?

যেকোনো বিষয়ে।–তোমার সেই গণিতবিদ আর তার সাইকোহিস্টোরি নিয়েই কথা বলা যাক। তার কথা আমি সবসময়ই ভাবি। আজকে ডিনারের সময়ও মনে হয়েছে। যদি তার সাইকোহিস্টোরিক্যাল বিশ্লেষণ এমন কোনো পথ বাৎলে দিতে পারত যাতে করে সীমাহীন আনুষ্ঠানিকতা বাদ দিয়েই সম্রাট হওয়া যেত।।

আমার মতে, সায়ার, সবচেয়ে চতুর সাইকোহিস্টোরিয়ানও সেটা করতে পারবে না।

বাদ দাও, সর্বশেষ খবর কী বল। এখনো কী সে মাইকোজেনের টাকমাথা লোকগুলোর ভেতর লুকিয়ে আছে? তুমি কথা দিয়েছিলে যে ওখান থেকে তাকে বের করে আনবে।

জি, সায়ার সব ব্যবস্থাই আমি করেছি, তারপরেও বলতে হচ্ছে যে আমি ব্যর্থ।

ব্যর্থ? ভুরু কুঁচকালেন সম্রাট। শব্দটা শুনতে আমার ভালো লাগে না।

আমারও লাগে না, সায়ার। আমার পরিকল্পনা ছিল কোনো একটা উপায়ে গণিতবিদকে ধর্মবিরোধী অপরাধ করতে উৎসাহিত করা যার জন্য কঠিন শাস্তির বিধান রয়েছে। একজন বহিরাগত মাইকোজেনে সেই ধরনের অপরাধ খুব সহজেই করে ফেলতে পারে। গণিতবিদ তখন সম্রাটের কাছে আপিল করতে বাধ্য হত। আমরা তাকে নিজেদের কজায় নিয়ে আসতে পারতাম। এমনভাবে পরিকল্পনা করেছিলাম যাতে আমরা যে জড়িত কেউ বুঝতে পারত না। আমি নিজেও সরাসরি জড়িত ছিলাম না।

তারপরেও ব্যর্থ হয়েছ, বললেন ক্লীয়ন। মাইকোজেনের মেয়র-

হাই এল্ডার, সায়ার।

উপাধি নিয়ে বেশি মাথা ঘামানোর দরকার নেই। হাই এল্ডার প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করেছে?

বরং উল্টোটা, সায়ার, সে রাজী হয় এবং সেলডন সহজেই ফাঁদে পা দেয়।

তাহলে?

তাকে সসম্মানে ছেড়ে দেওয়া হয়।

কেন? রাগে বিস্ফোরিত হলেন ক্লীয়ন।

আমি জানি না, সায়ার, তবে সন্দেহ করছি আমাদেরই কোনো প্রতিপক্ষ আমাদের উপর টেক্কা দিয়ে তাকে নিয়ে গেছে।

কে? ওয়ির মেয়র?

হতে পারে, সায়ার, তবে নিশ্চিত নই। ওয়ির উপর আমি সর্বক্ষণ নজর রাখার ব্যবস্থা করেছি। গণিতবিদ যদি ওদের হাতে ধরা পড়ত তাহলে এতক্ষণে আমার কাছে খবর চলে আসত।

এখন সম্রাটের শুধু ভুরু কুঁচকানোই নয় বরং রাগে চেহারা প্রচণ্ড লাল হয়ে উঠেছে। ডেমারজেল, আমি ভীষণ অখুশি হয়েছি। এভাবে আরেকবার ব্যর্থ হলে আমি ভাবতে বাধ্য হব তুমি কী সেই পুরনো ডেমারজেল যে কী না কোনো কাজে। ব্যর্থ হয়নি। সম্রাটের সরাসরি বিরোধিতা করার জন্য মাইকোজেনের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে?

প্রচণ্ড তোপের মুখে ডেমারজেল মাথা নিচু করল, কিন্তু দৃঢ় গলায় বলল, এই মুহূর্তে মাইকোজেনের বিরুদ্ধে কিছু করা ভুল হবে, সায়ার। ওয়ি তখন সুযোগ পেয়ে যাবে।

কিন্তু আমাদের কিছু একটা অবশ্যই করতে হবে।

বোধহয় না, সায়ার। পরিস্থিতি যত খারাপ হওয়ার কথা তত খারাপ হয়নি।

তার মানে?

নিশ্চয়ই মনে আছে, সায়ার, এই গণিতবিদ বিশ্বাস করে যে সাইকোহিস্টোরি কখনো বাস্তব হতে পারে না।

অবশ্যই মনে আছে, কিন্তু সেটা কোনো ব্যাপার না, ঠিক? অন্তত আমাদের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য?

হয়তো না। কিন্তু তার এই কৌশলটাকে যদি বাস্তবে পরিণত করা যায় তাহলে আমাদের উদ্দেশ্য আরো ভালোভাবে পূরণ হবে, সায়ার। আর আমি জানতে পেরেছি যে গণিতবিদ এখন সাইকোহিস্টোরি বাস্তব করে তোলার জন্য চেষ্টা শুরু করেছে। মাইকোজেনে সে যে অপরাধ করেছে তা সাইকোহিস্টোরির সমস্যা সমাধানের একটা প্রচেষ্টা। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাকে নিজের মতো কাজ করতে দিলে আমরাই লাভবান হব। যখন সে তার লক্ষ্যে পৌঁছবে বা লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছবে তখনই তাকে ধরে আনাটা ভালো।

যদি না ওয়ি আমাদের আগেই তাকে ধরে নিয়ে যায়।

আমি দেখব যেন সেরকম কিছু না ঘটে।

ঠিক একইভাবে যেভাবে তুমি গণিতবিদকে মাইকোজেন থেকে বিতাড়িত করেছ?

আমি দ্বিতীয়বার একই ভুল করব না, সায়ার। শীতল গলায় বলল ডেমারজেল।

সম্রাট বললেন, না করলেই ভালো করবে, ডেমারজেল। আর কোনো ভুল আমি সহ্য করব না। তারপর কিছুটা বিরক্ত সুরে যোগ করলেন, রাতের ঘুম হারাম করে দিলে তুমি।

.

৬২.

ডাহ্ল সেক্টরের জর্ড টিসালভার বেটে মানুষ। তার মাথার সর্বোচ্চ চূড়া টেনেটুনে সেলডনের নাক পর্যন্ত পৌঁছবে। এটা নিয়ে সুদর্শন হাসিখুশি লোকটার অবশ্য কোনো মাথা ব্যথা নেই। ঠোঁটের উপর পাতলা গোফ, মাথায় কোঁকড়ানো চুল।

স্ত্রী এবং কোলের মেয়েকে নিয়ে একটা অ্যাপার্টমেন্টে বাস করে। অ্যাপার্টমেন্টে সাতটা ছোট কামরা। প্রতিটি কামরাই অত্যন্ত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন কিন্তু আসবাবপত্র বলতে কিছু নেই।

আমি ক্ষমাপ্রার্থী, মাস্টার সেলডন এবং মিস্ট্রেস ভেনাবিলি, টিসালভার বলল, আপনারা যে ধরনের আরাম আয়েশে অভ্যস্ত আমি তার কোনো ব্যবস্থাই করতে পারিনি। ডাল অত্যন্ত দরিদ্র সেক্টর, আর আমি তার ভেতর আরো দরিদ্র মানুষ।

আর ঠিক এই কারণেই, জবাব দিলেন সেলডন। আমাদেরই ক্ষমা চাওয়া উচিত, কারণ আমরা এসে আপনাকে ঝামেলায় ফেলে দিয়েছি।

কোনো ঝামেলা না, মাস্টার সেলডন। আমাদের কোয়ার্টারের ভাড়া হিসেবে মাস্টার হামিন যথেষ্ট ক্রেডিটের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আপনারা যদি নাও থাকেন তারপরেও আমরা ক্রেডিটগুলো নেব।

ডাহলে পৌঁছে দিয়ে ফিরে যাবার সময় হামিন যে কথাগুলো বলেছিল সেগুলো মনে পড়ল সেলডনের।

সেলডন, সে বলেছিল, এটা হচ্ছে তিন নম্বর জায়গা যেখানে আপনাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলাম। প্রথম দুটো ছিল ইমপেরিয়াম-এর ধরাছোঁয়ার বাইরে। হয়তো সেই কারণেই তাদের মনোযোগ সেদিকে আকৃষ্ট হয়েছে; অন্তত আপনার পালিয়ে থাকার জন্য ওগুলোই ছিল উপযুক্ত জায়গা। কিন্তু এই জায়গাটা অন্যরকম। দরিদ্র, অখ্যাত, গুরুত্বহীন এবং নিরাপত্তাহীন। আপনি এখানে লুকিয়ে থাকবেন এটা সহজে কেউ ভাবতে পারবে না, তার ফলে সম্রাট এবং তার চীফ অব স্টাফ হয়তো। এদিকে নজর দেবে না। আশা করি এবার আপনি নিজেকে ঝামেলা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবেন।

চেষ্টা করব, হামিন, আত্মরক্ষার সুরে জবাব দিয়েছিলেন সেলডন। দয়া করে বোঝার চেষ্টা করুন যে আমি ঝামেলা খুঁজে বেড়াই না। আমি শুধু তাই পাবার চেষ্টা করছি যা সাইকোহিস্টোরি সমন্বিত করতে সাহায্য করবে। নইলে হয়তো ত্রিশ জনম সাধনা করেও সফল হতে পারব না।

বুঝতে পেরেছি। শেখার প্রচেষ্টা স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনাকে নিয়ে গিয়েছিল আপারসাইডে, মাইকোজেনে এল্ডারদের বাসস্থানে, আর ডাহলে কোথায় যাবেন কে জানে। আর ড. ভেনাবিলি, আমি জানি তুমি চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখনি, কিন্তু তোমাকে আরো চেষ্টা করতে হবে। একটা কথা সবসময় মনে রাখবে যে সেলডন ট্র্যান্টরের সবচেয়ে মূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি–সত্যি কথা বলতে কী পুরো গ্যালাক্সির। আর তাই যেকোনো মূল্যে তাকে নিরাপদ রাখতে হবে।

আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করব। কাষ্ঠ গলায় জবাব দিয়েছিল ডর্স।

আর আপনারা যাদের সাথে থাকবেন একটু অদ্ভুত হলেও অত্যন্ত ভালো মানুষ, দেখবেন ওদের যেন কোনো বিপদ না হয়।

কিন্তু টিসালভার তার নতুন ভাড়াটেদের কাছ থেকে কোনো ঝামেলাই আশা করছে না। বরং তাদের সঙ্গ পেয়ে ভীষণ খুশি। বাড়ি ভাড়ার পাশাপাশি এটাকে সে বাড়তি পাওনা হিসাবে ধরে নিয়েছে।

জীবনে কখনো ডাহল ছেড়ে বাইরে যায়নি সে। তাই বোধহয় দেশ বিদেশের গল্প শুনতে ভীষণ পছন্দ করে। তার স্ত্রীও হাসিমুখে আসরে যোগ দেয়। এমনকি তাদের বাচ্চা মেয়েটা পর্যন্ত মুখে বুড়ো আঙ্গুল পুরে গল্প শোনার অনুমতি পেয়ে গেছে।

সাধারণত ডিনারের পরে পুরো পরিবার জমায়েত হয়, সেখানে সেলডন বা ডর্সের কাছ থেকে প্রতিদিন নতুন নতুন গল্প আশা করে। খাবারের পরিমাণ যথেষ্ট হলেও সেগুলোতে দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। অবশ্য মাইকোজেনের অতি সুস্বাদু খাদ্যের পর যেকোনো খাবারই বিস্বাদ লাগবে। খাবারের টেবিল বলতে দেয়ালের সাথে লাগানো একটা তাক। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেতে হয়।

সেলডনের দুএকটা শিষ্টাচারপূর্ণ প্রশ্নে প্রকাশ পেল যে ডালাইটরা এতেই অভ্যস্ত। যদিও এখানে দারিদ্র্যের কোনো হাত নেই। মিস্ট্রেস টিসালভার অবশ্য জানালো যে সরকারের উঁচুপদে যারা কাজ করে তারা বিলাসী বস্তু যেমন চেয়ার মহিলা অবশ্য বলল, বডি শেলভস–ব্যবহার করে, কিন্তু সাধারণ মধ্যবিত্তরা তা পছন্দ করে না।

অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতা পছন্দ না করলেও টিসালভাররা তার গল্প শুনতে ভালোবাসে। চমৎকার পোশাক, গহনা, চাদর, টেবিল ক্লথের কথা শুনতে শুনতে তাদের চোখ বড়ো হয়ে যায়।

মাইকোজেনের নিয়ম কানুনও শুনল তারা, জর্ড টিসালভার আনমনে নিজের চুলে হাত বুলাল, ভাবখানা এমন যেন পৌরুষ দেখানোর জন্য খুব শিগগিরই মাথার সব চুল ফেলে দেবে। মেয়েদের অবমাননার কথা শুনে মিস্ট্রেস টিসালভার প্রচণ্ড রেগে উঠল এবং বিশ্বাসই করতে চাইল না যে মাইকোজেনের মেয়েরা স্বেচ্ছায় এই দাসত্ব মেনে নিয়েছে।

সেলডন যখন অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ইম্পেরিয়াল গ্রাউন্ডের কথা বললেন ওরা সত্যিকার অর্থেই অবাক হয়ে গেল। আর সম্রাটের সাথে দেখা করেছেন শুনে তো পুরোপুরি হতবাক হয়ে গেল। কথাই বলতে পারল না অনেকক্ষণ। তারপর শুরু হলো প্রশ্নবান এবং সেলডন বুঝতে পারলেন যে টিসালভার পরিবারকে সন্তুষ্ট করা যাবে না। কারণ তিনি নিজেই ভালোমতো দেখতে পারেন নি।

সেলডন সম্রাটের সাথে দেখা করেছেন কিন্তু ডর্স কখনো ইম্পেরিয়াল গ্রাউন্ডের ধারে কাছেও যায়নি সেটা তাদের বিশ্বাসই হতে চাইল না। আর মুখের উপর তো বলেই দিল যে সম্রাট তার সাথে একজন সাধারণ মানুষের মতোই কথা বলেছেন সেটা একেবারেই অসম্ভব।

তিনটা দিন এভাবেই পার হলো। তারপর থেকে ক্লান্ত বোধ করতে লাগলেন সেলডন। ঠিক করলেন যে ডর্সের বাছাই করে দেওয়া কয়েকটা ইতিহাসের বুক-ফিল্ম দেখা ছাড়া আর কিছু করবেন না (অন্তত দিনের বেলাটা)। টিসালভাররা খুশি মনেই তার বুক ভিউয়ার ব্যবহার করতে দিল। বাচ্চা মেয়েটা অবশ্য খুশি হলো না। তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো প্রতিবেশীর অ্যাপার্টমেন্টে। তাদের ভিউয়ার ব্যবহার করে স্কুলের বাড়ির কাজ করবে সে।

কোনো লাভ হচ্ছে না, নিজের ঘরে বসে কথাগুলো বললেন সেলডন। প্রথমে অবশ্য হালকা মিউজিক ছেড়ে দিয়েছেন যেন দরজায় কান পেতে রাখলেও কেউ কিছু শুনতে না পারে। বুঝতে পারছি কেন তুমি ইতিহাস পছন্দ করো, কিন্তু এগুলো সবই সীমাহীন বর্ণনা। এগুলো হচ্ছে পাহাড় প্রমাণ না, গ্যালাক্সি প্রমাণ–তথ্যের সমাহার অথচ আমি এই তথ্যগুলোর ভেতর কোনো সমন্বয় খুঁজে পাচ্ছি না।

মানবজাতি প্রথমে নক্ষত্রগুলোর মাঝে কোনো সমন্বয় পায়নি, ডর্স বলল, কিন্তু পরবর্তীকালে গ্যালাক্সির কাঠামো ঠিকই বের করে নিয়েছিল।

এবং আমি নিশ্চিত যে সেটা এক দুই সপ্তাহে হয়নি। তার জন্য প্রজন্মের পর প্রজন্মকে শ্রম দিতে হয়েছে। প্রাকৃতিক নিয়মগুলো আবিষ্কারের আগে পদার্থ বিজ্ঞান ছিল শুধু কতগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষণের সমাহার। এবং তার জন্যও অনেকগুলো প্রজন্মকে শ্রম দিতে হয়েছে–টিসালভারদের ব্যাপারটা কী?

কী আবার হবে? আমার কাছে তো চমৎকার ভালোমানুষ মনে হয়েছে?

ওরা ভীষণ কৌতূহলী।

হ্যাঁ অবশ্যই। ওদের জায়গায় থাকলে তুমিও কৌতূহলী হতে।

কিন্তু শুধুই কী কৌতূহলী? সম্রাটের সাথে আমার সাক্ষাৎকারের বিষয়টি নিয়ে ওরা অস্বাভাবিকরকম আগ্রহী।

ডর্সকে অধৈর্য মনে হলো। আবারো… এটাই তো স্বাভাবিক। তুমি হলেও একইরকম আচরণ করতে।

আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে।

হামিন আমাদেরকে এখানে নিয়ে এসেছে।

হ্যাঁ, কিন্তু সে তো আর সবজান্তা না। প্রথমে আমাকে নিয়ে গেল বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখানে কৌশলে আমাকে আপারসাইডে টেনে নিয়ে গেল অদৃশ্য কোনো প্রতিপক্ষ। সানমাস্টার ফোরটিন-এর কাছে নিয়ে গেল, সেই লোক আমাদের ফাঁদে আটকে ফেলল। আমার আসলে আর এগুলো ভালো লাগছে না।

তুমি কী তাহলে ডাহল-এর ব্যাপারে আগ্রহী নও?

অবশ্যই আগ্রহী। প্রথমে বলো ডাল সম্বন্ধে তুমি কী জানো?

কিছুই না। এটা ট্র্যান্টরের আট শতাধিক সেক্টরের একটা। তাছাড়া আমি ট্র্যান্টরে বাস করছি বড়োজোর দুবছর হবে।

ঠিক। গ্যালাক্সিতে পঁচিশ মিলিয়ন গ্রহ আছে আর আমি এই সমস্যা নিয়ে কাজ করছি দুবছরও হবে না। আমার কী ইচ্ছে জানো? ইচ্ছে হচ্ছে এই মুহূর্তে হ্যালিকনে ফিরে গিয়ে ম্যাথমেটিক্স অব টার্বুলেন্স নিয়ে গবেষণা করি, ওটা ছিল আমার পি.এইচ.ডি.-র মূল সমস্যা কখনো ভাবিনি যে টাবুলেন্স মানব সমাজের জটিলতাকে তুলে ধরবে।

কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় টিসালভারকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, মাস্টার টিসালভার, আমি এখনো জানি না আপনি কী কাজ করেন?

টিসালভারের পরিধানে ছোট হাতার পাতলা একটা টি-শার্ট। নিজের বুকে আঙ্গুল রেখে বলল, আমি? তেমন কিছুই না। হলোভিশন স্টেশনে কাজ করি। নীরস কাজ হলেও পেট চলে।

তবে সম্মানজনক কাজ। মিস্ট্রেস টিসালভার বলল। এর অর্থ আমার স্বামীকে হিটসিঙ্কে কাজ করতে হবে না।

হিটসিঙ্ক? একটা ভুরু সামান্য উঁচু করে বলল ডর্স, সেই সাথে মুখে একটা মুগ্ধতার ভাব ফুটিয়ে তুলল।

হ্যাঁ, টিসালভার বলল। এটার জন্যই ডাহল বিখ্যাত। হয়তো বেশি না, কিন্তু ট্র্যান্টরের চল্লিশ বিলিয়ন মানুষের যে পরিমাণ এনার্জি প্রয়োজন হয় আমরা তার বড়ো একটা অংশ সরবরাহ করি। আমাদের এই কাজের যথাযথ মূল্য কখনো পাইনি, কিন্তু আমাদের সরবরাহকৃত এনার্জি ছাড়া বড়ো লোকদের বেশ কয়েকটা সেক্টর পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়বে।

দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে গেলেন সেলডন। জিজ্ঞেস করলেন কক্ষপথে স্থাপিত সৌরশক্তি কেন্দ্র থেকে ট্র্যান্টর তার এনার্জি সংগ্রহ করে, তাই না?

সামান্য কিছু। এছাড়াও রয়েছে নিউক্লিয়ার ফিউশন স্টেশন, মাইক্রোফিউশন স্টেশন, আপারসাইডে বসানো উইন্ড স্টেশন, কিন্তু অর্ধেক বক্তব্যের উপর জোর দেওয়ার জন্য একটা আঙ্গুল তুলল টিসালভার, তার চেহারা অত্যন্ত গম্ভীর–অর্ধেক এনার্জি আসে হিটসিঙ্ক থেকে। অনেক সেক্টরেই হিটসিঙ্ক আছে, কিন্তু কোনোটাই ডাহল-এর সমকক্ষ নয়। আপনারা কী আসলেই এটা জানতেন না?

দ্রুত জবাব দিল ডর্স, আপনি তো জানেন, আমরা আউটওয়ার্ল্ডার। (তার মুখে প্রায় চলে এসেছিল, ট্রাইবসপিওপিল কিন্তু ঠিক সময়ে সামলে নিল)। বিশেষ করে ড. সেলডন। তিনি ট্র্যান্টরে এসেছেন মাত্র দুই মাস।

সত্যি? মিস্ট্রেস টিসালভার বলল। মহিলা স্বামীর চেয়েও খাটো। গোলগাল কিন্তু শরীরে চর্বি নেই। কালো চুলগুলো মাথার পেছনে শক্ত করে বাঁধা। অসম্ভব সুন্দর। কালো চোখ। স্বামীর মতোই তার বয়সও ত্রিশের কোঠায়।

(মাইকোজেনে যদিও অল্প কয়েকদিন ছিল, তারপরেও কোনো মহিলাকে অনুমতি। ছাড়া কথা বলতে দেখলে ডর্সের কাছে এখন অদ্ভুত লাগে। স্থানীয় আচার ব্যবহার কত দ্রুত মানুষের মনে গেড়ে বসে, ভাবল সে এবং মনে মনে ঠিক করে রাখল কথাটা সেলডনকে জানাতে হবে–সাইকোহিস্টোরির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারে এটা)।

হ্যাঁ, সে বলল, ড. সেলডন হ্যালিকন থেকে এসেছেন।

 মিস্ট্রেস টিসালভার নির্দোষ ভঙ্গিতে জানতে চাইল, কোথায় সেটা?

কেন সেটা শুরু করল ডর্স, তারপর সেলডনের দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করল, কোথায় হ্যারি?

লজ্জা পেলেন সেলডন। সত্যি কথা বলতে কী কো-অর্ডিনেটস ছাড়া আমিও গ্যালাক্টিক মডেলে গ্রহটা খুঁজে বের করতে পারব না। যতদূর জানি ট্র্যান্টর থেকে একটু দূরে যে সেন্ট্রাল ব্ল্যাক হোল আছে তার উল্টোপাশে অবস্থিত। হাইপারশিপে গেলেও অনেক ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়।

আমরা জীবনে কখনো হাইপারশিপে চড়তে পারব না।

একদিন, ক্যাসিলিয়া, টিসালভার তার স্ত্রীকে হাসি মুখে বলল, আমাদেরও সুযোগ হবে।

আপনি আমাদেরকে হ্যালিকনের গল্প শোনান, মাস্টার সেলডন।

বলার মতো তেমন কিছু নেই। অন্যান্য গ্রহের মতোই হ্যালিকনে হিটসিঙ্ক নেই বোধ হয় কোনো গ্রহেই নেই–ট্র্যান্টর ছাড়া। আমাকে ওগুলোর কথা বলুন।

 (শুধু ট্র্যান্টর বাকি সবগুলো থেকে আলাদা, সেলডনের মাথার ভেতর কথাটা বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটতে লাগল। হঠাৎ কেন জানি ডর্সের হ্যান্ড-অন-থাই স্টোরির কথা মনে পড়ল তার। কিন্তু চিন্তাটা যেমন চট করে এসেছিল তেমনি চট করেই চলে। গেল। কারণ তার মেজবান কথা শুরু করেছে। সেদিকে মনোযোগ দিলেন তিনি)।

টিসালভার বলছে, আপনি যদি হিটসিঙ্ক সম্বন্ধে জানতেই চান, তাহলে আমি আপনাকে দেখাতে পারি। তারপর স্ত্রীর দিকে ঘুরে বলল, ক্যাসিলিয়া, আগামীকাল বিকেলে মাস্টার সেলডনকে নিয়ে আমি হিটসিঙ্কে যাই?

এবং আমাকে, দ্রুত বলল ডর্স।

এবং মিস্ট্রেস ভেনাবিলিকে নিয়ে?

ভুরু কুঁচকালো মিস্ট্রেস টিসালভার, তীক্ষ্ম গলায় বলল, আমার মনে হয় না সেটা উচিত হবে। অতিথিরা কষ্ট পাবেন।

আমার তা মনে হয় না, মিস্ট্রেস টিসালভার, উৎসাহের সাথে বললেন সেলডন। আমরা হিটসিঙ্ক দেখতে আগ্রহী। আপনি সাথে গেলে ভীষণ খুশি হব… এবং আপনাদের মেয়েও যেতে পারে–যদি সে চায়।

মিস্ট্রেস টিসালভার নাক কুঁচকে বলল, হিটসিঙ্কে যাব! কোনো ভদ্রমহিলা ওখানে যায় না।

বিব্রত বোধ করলেন সেলডন। আমি আপনাকে অপমান করতে চাইনি।

না, না। অপমানের কিছু নেই। টিসালভার বলল। ক্যাসিলিয়া মনে করে জায়গাটা আমাদের মতো ভদ্রলোকদের জন্য উপযুক্ত নয়। আসলেই তাই। তবে যেহেতু ওখানে আমি কাজ করি না তাই অতিথি নিয়ে বেড়াতে গেলে কোনো দোষ নেই। তবে জায়গাটা ভীষণ অস্বস্তিকর।

গুটিসুটি মেরে বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ালো সবাই। ডাহলাইটদের চেয়ার প্লাস্টিক গলিয়ে তৈরি করা কাঠামো, ছোট চাকার উপর বসানো, সেগুলো সেলডনের হাটু দুটো সাড়াশির মতো আটকে রেখেছে আর মনে হচ্ছে যেন দেহের ভারে ভেঙে পড়বে। টিসালভাররা অবশ্য এই চেয়ারে উঠা বা বসাতে ভীষণ দক্ষ। এমনকি ডর্সেরও কোনো সমস্যা হচ্ছে না। যেকোনো পরিবেশে তার নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা দেখে আরো একবার অভিভূত হলেন সেলডন।

নিজ নিজ কামরায় ঢোকার আগ মুহূর্তে সেলডন ডর্সকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী আসলেই হিটসিঙ্কের কথা জানতে না? মহিলার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে অত্যন্ত বাজে জায়গা।

নিশ্চয় অতটা বাজে নয়। হলে টিসালভার আমাদের নিয়ে যেত না। দেখা যাক কী হয়।

.

৬৩.

উপযুক্ত পোশাক পরতে হবে আপনাদের, টিসালভার বলল। আর মিস্ট্রেস টিসালভার পেছন থেকে সবাইকে দেখিয়েই মুখ বাঁকালো।

কার্টলেস-এর কথা মনে হতেই দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন সেলডন। সাবধানে জিজ্ঞেস করলেন, উপযুক্ত পোশাক বলতে কী ধরনের পোশাক?

হালকা ধরনের, আমি যেমন পরেছি। ছোট হাতার টি-শার্ট, ঢোলা পাজামা, মোজা এবং স্যান্ডেল। সব নিয়ে এসেছি আমি।

ভালো। শুনে তো খারাপ মনে হচ্ছে না।

মিস্ট্রেস ভেনাবিলির জন্যও একই জিনিস নিয়ে এসেছি। আশা করি গায়ে লাগবে।

পোশাকগুলো টিসালভারের নিজের, চমৎকারভাবে গায়ে লাগল। তৈরি হওয়ার পর মিস্ট্রেস টিসালভারকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়ল তিনজন। মহিলা যদিও ওদের যাওয়াটা পছন্দ করছে না, তারপরও ওরা চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত দরজায় দাঁড়িয়ে থাকল।

সন্ধ্যা নামছে, চারপাশে ছড়িয়ে আছে গোধূলির আলো। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই রাত নামবে ডাহলে। মৃদু তাপমাত্রা। কোনো যানবাহন দেখা যাচ্ছে না; সবাই হাঁটছে। দূর থেকে ভেসে আসছে এক্সপ্রেসওয়ের গমগম শব্দ, ট্র্যান্টরের সবখানেই এই শব্দ সবসময়ই শোনা যায়, হঠাৎ হঠাৎ সেগুলোর চকচকে শরীর বা আলো চোখে পড়ছে।

সেলডন খেয়াল করলেন ডাহ্‌লাইটরা কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছার জন্য হাঁটছে না। বরং মনে হচ্ছে তারা বৈকালিক পদভ্রমণে বেরিয়েছে। সম্ভবত বিনোদনের জন্য। টিসালভার বারবারই বলেছে ডাহল অত্যন্ত দরিদ্র অঞ্চল। এখানে বিনোদনের ব্যবস্থাও নিশ্চয়ই কম ব্যয়বহুল এবং বিকালে হেঁটে বেড়ানোর চেয়ে আনন্দদায়ক এবং কম ব্যয়বহুল–বিনোদন আর কী হতে পারে?

সেলডন টের পেলেন তিনি নিজেও কখন জানি বৈকালিক ভ্রমণের আনন্দ উপভোগ করতে শুরু করেছেন। পরিবেশটা অত্যন্ত উষ্ণ বন্ধুত্বপূর্ণ। সবাই সবাইকে অভিনন্দন জানাচ্ছে, দাঁড়িয়ে দুএকটা কথা বলে খোঁজ খবর নিচ্ছে। চারপাশে শুধু বিভিন্ন আকৃতি আর ঘনত্বের কালো গোঁফ। সম্ভবত ডাহলাইট পুরুষদের গোঁফ রাখাটা বাধ্যতামূলক। মাইকোজেনে যেমন মাথার চুল ফেলে দেওয়াটা ছিল বাধ্যতামূলক।

পরিবেশে এক ধরনের স্বস্তির ভাব ছড়িয়ে আছে, যেন সবাই বুঝতে পেরেছে যে শেষ হয়ে গেল একটা দিন এবং বন্ধুবান্ধব আত্মীয় স্বজন সবাই সুস্থ আছে ভালো। আছে। ডর্স খুব সহজেই সবার নজর কেড়ে নিল। গোধূলির আলোয় তার চুলের রং আরো গাঢ় হয়েছে। মনে হলো যেন রাশি রাশি কয়লার মাঝখান দিয়ে একটা স্বর্ণ মুদ্রা হেঁটে চলেছে।

চমৎকার, সেলডন বললেন।

হ্যাঁ, তাই। টিসালভার বলল। সাধারণত স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বিকেলে হাঁটতে বেরোই। এক কিলোমিটারের ভেতরে এমন একজনও নেই যাকে সে চেনে না। তাদের নাম, পেশা, কার সাথে কী সম্পর্ক সব জানে। আমি অত কিছু মনে রাখতে পারি না। রাস্তায় যে কয়জনের সাথে কথা বললাম… তাদের একজনেরও নাম বলতে পারব না আমি। যাইহোক, এত আস্তে হাঁটলে চলবে না। আমাদেরকে অ্যালিভেটরে উঠতে হবে। লোয়ার লেভেলে আমাদের সেক্টরটা যথেষ্ট ব্যস্ত।

অ্যালিভেটরে চড়ে নিচে নামার সময় ডর্স জিজ্ঞেস করল, আমার মনে হয়, মাস্টার টিসালভার, হিটসিঙ্কে ট্র্যান্টরের অভ্যন্তরীণ তাপ ব্যবহার করে বাষ্প উৎপাদন করা হয়। সেই বাষ্পের সাহায্যে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।

না। অত্যন্ত উন্নত মানের বিশালাকৃতির থার্মোপাইলস বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করে লাভ নেই, বলতে পারব না। আমি শুধু একজন হলোভিশন প্রোগ্রামার। সত্যি কথা বলতে কী কাউকেই জিজ্ঞেস করবেন না। পুরো ব্যবস্থাটাই হচ্ছে এটা ব্ল্যাক বক্স। কাজ করছে, কিন্তু কেউ জানে না কীভাবে।

যদি কোনো সমস্যা হয়?

সাধারণত হয় না, যদি হয় তাহলে কোত্থেকে যেন কিছু এক্সপার্ট লোক যারা কম্পিউটার বোঝে এসে ঠিক করে দিয়ে যায়। এখানে সবকিছুই হাইলি কম্পিউটারাইজড।

অ্যালিভেটর থামার পর সবাই বেরোল। প্রচণ্ড উত্তাপ ঘুষির মতো এসে আঘাত করল শরীরে।

অত্যন্ত গরম, অপ্রয়োজনীয় ভঙ্গিতে বললেন সেলডন।

হ্যাঁ, টিসালভার বলল। আর এটাই ডাহলকে সবচেয়ে সমৃদ্ধিশালী এনার্জি উৎসে পরিণত করেছে। গ্রহের অন্যান্য স্থানের চেয়ে এখানে ম্যাগমালেয়ার সারফেসের অনেক আছে। তাই আপনাকে প্রচণ্ড গরমের ভেতরে কাজ করতে হবে।

এয়ার কন্ডিশনের ব্যবস্থা করা যায় না? জিজ্ঞেস করল ডর্স।

দুই একটা জায়গায় করা হয়েছে, তবে এটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, শরীর যাতে না ঘামে তারও ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এর চেয়ে বেশি কিছু করতে গেলে প্রচুর এনার্জি প্রয়োজন। তখন পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়াটাই অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়াবে।

একটা দরজার সামনে থেমে শব্দ করল টিসালভার। বিড়বিড় করে বলল, এখানের কাউকে সঙ্গে নিতে হবে। নইলে… বিশেষ করে পুরুষদের কাছ থেকে মিস্ট্রেস ভেনাবিলিকে অনেক বাজে মন্তব্য শুনতে হবে।

বাজে মন্তব্য শুনে আমি বিব্রত হই না।

আমি হই।

দরজা খোলার পর এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস দেহে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিল। তরুণ এক লোক বেরিয়ে এসে নিজের পরিচয় দিল হ্যাঁন লিন্ডার বলে। সেও দেখতে অনেকটা টিসালভারের মতোই, খর্বাকৃতির এবং কালো গোফ।

লিন্ডর বলল, আমি খুশী হয়েই আপনাদেরকে চারপাশে ঘুরিয়ে দেখাব। যদিও জায়গাটা বেড়াবার জন্য আদর্শ স্থান নয়। কথা বলছে সবাইকে উদ্দেশ্য করে কিন্তু তার চোখ সেটে আছে ডর্সের উপর। আমরা সবাই শার্ট খুলে নিলেই ভালো হবে।

এখানে তো চমৎকার ঠাণ্ডা। সেলডন বললেন।

অবশ্যই, তার কারণ আমরা এক্সিকিউটিভ। পদমর্যাদার কিছু সুবিধা আছে। কিন্তু এই কামরার বাইরে প্রচণ্ড গরম। আর তাই ওখানে যারা কাজ করে তাদের বেতন আমার চেয়ে বেশি। শুধু বেশি বেতনের জন্যই এখানে কাজ করার জন্য শ্রমিক পাওয়া যায়। আসলে এটাই ডাহলের সবচেয়ে বেশি আয়ের চাকরি, তারপরেও আমরা সবসময় হিটসিঙ্কার পাই না। লম্বা দম নিল সে। ঠিক আছে, গরম স্যুপের বাটি থেকে ঘুরে আসা যাক।

নিজের শার্ট খুলে কোমরের বেল্টে ঝোলালো সে। টিসালভার এবং সেলডন তার দেখাদেখি একই কাজ করল।

ডর্সের দিকে তাকিয়ে লিন্ডর বলল, আপনার সুবিধার জন্যই বলছিলাম… তবে ইচ্ছে না হলে থাক।

ঠিক আছে। বলে শার্ট খুলল ডর্স। শার্টের নিচে সাদা ব্রেসিয়ার পরেছিল সে। তারপরেও বুকের প্রায় সবটাই উন্মুক্ত হয়ে গেল।

মিস্ট্রেস, লিন্ডর বলল, ওটাও কিছুক্ষণ চিন্তা করে কাঁধ নেড়ে বলল, ঠিক আছে। চলুন যাওয়া যাক।

প্রথমে সেলডন শুধু কম্পিউটার, যন্ত্রপাতি, কাঁপাকাঁপা আলো, স্ক্রীনের আলোর দ্যুতি এগুলোই লক্ষ্য করলেন।

সামগ্রিকভাবে আলো অত্যন্ত কম। শুধু যন্ত্রপাতির সেকশনগুলো যথেষ্ট আলোকিত, উপরে তাকিয়ে দেখলেন ভীষণ অন্ধকার। জিজ্ঞেস করলেন, পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা নেই কেন?

যেখানে প্রয়োজন সেখানে যথেষ্ট আলোর ব্যবস্থা রয়েছে। মনস্তাত্ত্বিক কারণেই এই ব্যবস্থা। অতিরিক্ত উজ্জ্বলতা মানুষের মনে অতিরিক্ত উত্তাপের অনুভূতি তৈরি করে। আলো কমিয়ে দেওয়ার পর তাপমাত্রাও উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। তারপরেও অনেক অভিযোগ শুনতে হয়েছে আমাদের।

যথেষ্ট দক্ষভাবে কম্পিউটারাইজড করা। ডর্স বলল। আমার কাছে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বলে মনে হচ্ছে।

ঠিক ধরেছেন। তারপরেও আমাদের মানব কর্মী প্রয়োজন। যদি কোনো সমস্যা দেখা দেয়। কম্পিউটার যদি উল্টোপাল্টা কাজ করে তাহলে দুই হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত সমস্যা তৈরি করবে।

মানুষের ভুলেও সেটা হতে পারে, তাই না? সেলডন বললেন।

অবশ্যই পারে। কিন্তু আমরা কোনো ঝুঁকি নিতে পারি না। কম্পিউটারের ভুল হলে মানুষ তা দ্রুত উঘাটন করে সংশোধন করতে পারে। একইভাবে মানুষের ভুল হলে কম্পিউটার তা দ্রুত সংশোধন করতে পারে। মানুষ এবং কম্পিউটার একই সাথে ভুল না করলে ভয়ংকর কোনো বিপদ হবে না। এবং সেইধরনের ঘটনা খুব কমই ঘটেছে। কম্পিউটার বা মানুষ তাদের কাছ থেকে আশানুরূপ কাজ কখনোই পাওয়া যায় না।

কম কিন্তু একেবারে যে ঘটেনি সেটা বলা যাবে না, ঠিক?

হ্যাঁ, কম ঘটেছে কিন্তু একেবারে ঘটেনি সেটা বলা যাবে না।

সবাই এই কথাই বলে। মুচকি একটু হাসলেন সেলডন।

না না, আমি পুরনো স্বর্ণযুগের কথা বলছি না, আমি পরিসংখানের কথা বলছি।

 হামিন যে অবক্ষয়ের কথা বলেছিল সেটা আবার মনে পড়ল সেলডনের।

আমি যা বলছি তার প্রমাণ ঐ যে। গলা নামিয়ে লিন্ডর বলল। C-3 লেভেলে বেশ কয়েকজন কর্মী দল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে অথচ ওদের নিজ নিজ পোস্টে থাকার কথা, তা না করে পান করছে।

কী পান করছে? জিজ্ঞেস করল ডর্স।

বিশেষ ধরনের তরল, দেহ থেকে যে ইলেক্ট্রোলাইট বেরিয়ে যায় তা পূরণ করার জন্য। ফলের রস।

ওদের আপনি দোষ দিতে পারেন না, পারেন কি? এইরকম প্রচণ্ড গরমে কিছুক্ষণ পরপরই পানি খেতে হবে।

আপনি কী জানেন কর্মীরা এক গ্লাস পানি খেতে কত সময় লাগিয়ে দেয়? অবশ্য কিছু করারও নেই। বাধা দিলেই ধর্মঘট শুরু করে দেবে।

কর্মীদের গ্রুপে নারী-পুরুষ উভয়ই আছে (ডাহলে সম্ভবত নারী-পুরুষের সমান অধিকার, কোনো বৈষম্য নেই)। নারী পুরুষ কারো পরনেই শার্ট নেই। মেয়েরা বুকে একটুকরা কাপড় বেঁধে রেখেছে। সেটার মূল উদ্দেশ্য বাতাশ চলাচল এবং ঘাম প্রতিহত করা। টুকরাটা বুকের কিছুই ঢেকে রাখেনি।

সেলডনের কানে ফিসফিস করে ডর্স বলল, আমার শরীরের ওই জায়গাটা ঘামে জব জব করছে।

তাহলে ব্রেসিয়ার খুলে ফেল। আমি বাধা দেব না।

আমি জানি তুমি বাধা দেবে না। ব্রেসিয়ার যেখানে ছিল সেখানেই রেখে দিল ডর্স। বলল, ওরা কোনো মন্তব্য করলে আমি সহ্য করে নেব।

ধন্যবাদ লিন্ডর বলল। মন্তব্য করবে না সেরকম প্রতিশ্রুতি আমি দিতে পারব না। কিন্তু আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। যদি মনে করে আপনারা আসলে পরিদর্শক তখন আরো বেশি খারাপ ব্যবহার করবে।

দুই হাত উপরে তুলে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল সে, হিটসিঙ্কারস্, আমাদের এখানে কিছু অতিথি এসেছেন–দুজন আউটওয়ার্ল্ডার এবং স্কলার। উনাদের গ্রহে এনার্জির ভীষণ অভাব। তাই ডাহলে দেখতে এসেছেন আমরা কীভাবে এনার্জি উৎপাদন করি। আমাদের কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে চাইছেন।

কীভাবে ঘামতে হয় সেটাই শিখবে, একজন হিটসিঙ্কার বলল, কর্কশ হাসিতে ফেটে পড়ল পুরো দলটা।

এরই মধ্যে ওর বুক ঘামে জব জব করছে, মেয়েদের একজন চিৎকার করে বলল, যেভাবে ঢেকে রেখেছে।

পাল্টা চিৎকার করে জবাব দিল ডর্স, আমি এখনই খুলে ফেলতে পারি কিন্তু আমার বুক তোমারটার মতো চমৎকার না, মুহূর্তেই একটা আন্তরিক পরিবেশ তৈরি হয়ে গেল।

কিন্তু তরুণদের একজন সামনে বাড়ল, গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেলডনের দিকে। রুক্ষ নির্দয় চেহারা তার। বলল, আমি আপনাকে চিনি। আপনি গণিতবিদ।

ভালোভাবে দেখার জন্য আরেকটু সামনে বাড়ল সে। ডর্স ঝট করে সেলডনের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। তার সামনে দাঁড়ানো লিন্ডর বলল, সরে যাও, হিটসিঙ্কার সংযত হও।

দাঁড়াও, বললেন সেলডন। ওকে কথা বলতে দাও। সবাই এভাবে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কেন?

নিচু স্বরে লিন্ডর বলল, আরেকটু কাছে আসলে আপনি টের পাবেন যে ওর গা থেকে ফুলের গন্ধ আসছে না।

সেটা আমার মাথা ব্যথা, বিরক্ত সুরে বললেন সেলডন। ইয়ং ম্যান, কী চাও তুমি?

আমার নাম এমারিল, ইউগো এমারিল। আমি আপনাকে হলোভিশনে দেখেছি।

দেখতেই পারো, কী হয়েছে তাতে?

আপনার নামটা আমার মনে নেই।

মনে রাখার দরকারও নেই।

আপনি সাইকোহিস্টোরি বা এই ধরনের কী একটা নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছিলেন।

তুমি তো জান না কত বড় ভুল করেছি।

কী?

কিছু না, তুমি কী চাও?

একটু কথা বলতে চাই, এখুনি। লিন্ডরের দিকে তাকালেন সেলডন। সে দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়ল, শিফট চলাকালীন সম্ভব হবে না।

তোমার শিফট কখন শুরু হয়, মিস্টার এমারিল? জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।

ষোলশ ঘণ্টায়।

 আগামীকাল চৌদ্দশ ঘণ্টায় আমার সাথে দেখা করতে পারবে?

নিশ্চয়ই, কোথায়?

এবার ঘুরলেন টিসালভারের দিকে, ওকে আপনার বাড়িতে আসতে বলি?

টিসালভারকে অসন্তুষ্ট দেখালো। তার কোনো প্রয়োজন নেই। ও তো একটা হিটসিঙ্কার ছাড়া আর কিছু না।

যাইহোক, আমাকে সে চিনতে পেরেছে। তার ভেতরে নিশ্চয়ই কিছু অসাধারণত্ব আছে। নিজের কামরায় ওর সাথে আমি দেখা করব। তারপরও টিসালভারের চেহারা থেকে অখুশি ভাবটা দূর হলো না দেখে আবার বললেন, নিজের কামরায়, যার জন্য আপনাকে ভাড়া দিচ্ছি। তাছাড়া সেই সময় আপনি কাজে থাকবেন, এপার্টমেন্টের বাইরে।

নিচু গলায় টিসালভার বলল, আমার কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা আসলে আমার স্ত্রী ক্যাসিলিয়াকে নিয়ে। ও মেনে নেবে না।

আমি কথা বলব, হাসিমুখে বললেন সেলডন। উনাকে মানতেই হবে।

.

৬৪.

কথাটা শুনেই মিস্ট্রেস টিসালভারের চোখ দুটো বিশাল আকৃতি ধারণ করল, হিটসিঙ্কার? আমার বাড়িতে!

অসুবিধা কী? তাছাড়া সে তো আমার ঘরে আসবে। বললেন সেলডন। চৌদ্দশ ঘণ্টায়।

কোনোদিনও না। জানতাম হিটসিঙ্কে গেলে একটা বিপত্তি ঘটবেই। জর্ড একটা বোকা।

মোটেই না, মিস্ট্রেস টিসালভার। আমাদের অনুরোধেই তিনি গিয়েছিলেন এবং আমরা কিন্তু বেশ আনন্দ পেয়েছি। এই লোকটার সঙ্গে আমার কথা বলতেই হবে যেহেতু এটা আমার কাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

হলেও আমার কিছু করার নেই। দুঃখিত। কিন্তু এখানে কোনো হিটসিঙ্কারকে আমি ঢুকতে দেব না।

হাত তুলল ডর্স, হ্যারি, আমাকে সামলাতে দাও। মিস্ট্রেস টিসালভার ড. সেলডন যদি আজ বিকালে কারো সাথে নিজের কামরায় দেখা করে, তাহলে অতিরিক্ত একজন লোকের জন্য স্বাভাবিকভাবেই অতিরিক্ত ভাড়া পাবেন আপনি। তাই শুধু আজকের জন্য ড. সেলডনের ঘরের দ্বিগুণ ভাড়া দেব আমরা।

কিছুক্ষণ চিন্তা করল মিস্ট্রেস টিসালভার। সেটা আপনাদের দয়া। কিন্তু ক্রেডিটই সবকিছু না। প্রতিবেশীরা দেখবে। নোংরা, ঘামে ভেজা

আমার মনে হয় না চৌদ্দশ ঘণ্টায় সে নোংরা আর ঘামে ভেজা থাকবে। কিন্তু পরিস্থিতিটা আমি আপনাকে বুঝিয়ে বলছি। যেহেতু লোকটার সাথে ড. সেলডনকে দেখা করতেই হবে, সেহেতু এখানে না হলে অন্য কোথাও যেতে হবে। অথচ এদিক সেদিক ছুটে বেড়ানোটা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। কাজেই আমাদেরকে অন্য কোথাও ঘর ভাড়া নিতে হবে। জানি কাজটা কঠিন এবং আমরা তা করতেও চাই না কিন্তু বাধ্য হব। আজ পর্যন্ত যত ভাড়া হয়েছে সেটা পরিশোধ করে দিয়েই আমরা চলে যাব এবং অবশ্যই মাস্টার হামিনকে আমাদের চলে যাওয়ার কারণটা ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে।

দাঁড়ান। মনে মনে হিসাব কষতে লাগল মহিলা। মাস্টার হামিনকে আমরা অসন্তুষ্ট করতে চাই না… আপনাদেরকেও না। জঘন্য প্রাণীটা কতক্ষণ থাকবে?

আসবে চৌদ্দশ ঘণ্টায়। ষোলশ ঘণ্টায় কাজে যেতে হবে। দুই ঘণ্টারও কম সময় থাকবে সে এখানে। আমরা দুজন একসাথে তাকে ভেতরে নিয়ে আসব, সোজা চলে যাব ড. সেলডনের ঘরে। প্রতিবেশীদের কেউ দেখলে মনে করবে সে আমাদেরই আউটওয়াল্টার বন্ধু।

মাথা নাড়ল মিস্ট্রেস টিসালভার। ঠিক আছে। আপনারা যেভাবে বলছেন সেভাবেই হবে এবং হিটসিঙ্কারটা শুধু এই একবারই আসবে।

একবারই আসবে, প্রতিশ্রুতি দিল ডর্স।

পরে নিজেদের কামরায় বসে ডর্স জিজ্ঞেস করল, তুমি লোকটার সাথে কেন। দেখা করতে চাও, হ্যারি? সাইকোহিস্টোরির জন্য গুরুত্বপূর্ণ?

সেলডন ভাবলেন ডর্স তাকে ব্যঙ্গ করছে। বিরক্ত সুরে বললেন, আমার এই বিশাল প্রজেক্টে সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত করার দরকার নেই এবং এই প্রজেক্ট সফল হবে সেটাও আমি বিশ্বাস করি না। আমি সাধারণ একজন মানুষ, আমারও কৌতূহল আছে। হিটসিঙ্কাররা কেমন হয় তুমি তো দেখলেই। একেবারেই অশিক্ষিত। অথচ তাদেরই একজন আমাকে চিনতে পেরেছে। এমনকি সে। সাইকোহিস্টোরী শব্দটাও মনে রেখেছে। লোকটাকে আমার অন্যরকম মনে হয়েছে মনে হয়েছে গোবরে পদ্মফুল আর আমি লোকটার সাথে কথা বলতে চাই।

কারণ ডাহল-এর একজন হিটসিঙ্কার পর্যন্ত তোমাকে চিনতে পেরেছে এজন্য তুমি আসলে প্রচণ্ড খুশি।

বেশ… হয়তো তুমি ঠিকই বলেছ। তবে আমি একই সাথে কৌতূহলী।

কিন্তু ভেবে দেখেছ যে লোকটাকে কেউ হয়তো শিখিয়ে দিয়েছে যেন তোমাকে আবার কোনো সমস্যার দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে।

নাক কুঁচকালেন সেলডন। আমার চুল স্পর্শ করার সুযোগও তাকে দেব না। আর এবার আমরা তৈরি থাকব, তাই না। তাছাড়া, তুমি আমার সাথে থাকবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। অর্থাৎ, তুমি আমাকে আপারসাইডে একা যেতে দিয়েছ, রেইনড্রপ ফরটি থ্রির সাথে একা মাইক্রোফার্মে যেতে দিয়েছ, কিন্তু এবার আর সেটা করবে না, তাই না।

তুমি একশ ভাগ নিশ্চিত থাকতে পারো যে এবার তোমাকে আমি সেই সুযোগ দেব না।

বেশ, লোকটার সাথে আমি কথা বলব আর তুমি খেয়াল রাখবে সে ফাঁদে ফেলার কোনো চেষ্টা করছে কী না। তোমার উপর আমার পরিপূর্ণ আস্থা আছে।

.

৬৫.

চৌদ্দশ ঘণ্টার কয়েক মিনিট আগেই পৌঁছে গেল এমারিল। লাজুক দৃষ্টিতে চোখ বুলাচ্ছে চারপাশে। চুলগুলো সুন্দরভাবে আচড়ানো, গোঁফেও চিরুনি বুলিয়েছে, দুই ঠোঁটের প্রান্তে এসে সেগুলো আবার সামান্য বাঁকা হয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে। তার হাতে একটা ব্যাগ।

সেলডন আর ডর্স অপেক্ষা করছিলেন বাইরে। এমারিল পৌঁছতেই দুজন দুপাশ থেকে ধরে তাকে নিয়ে দ্রুত অ্যালিভেটরে উঠলেন। নির্দিষ্ট লেভেলে পৌঁছে একটার পর একটা এপার্টমেন্ট পেরিয়ে চট করে ঢুকে পড়লেন সেলডনের কামরায়।

বাড়িতে কেউ নেই? নিচু এবং ভীতু স্বরে জিজ্ঞেস করল এমারিল।

সবাই ব্যস্ত, স্বাভাবিক সুরে বললেন সেলডন। কামরার একমাত্র চেয়ারটাতে বসতে বললেন।

না, এমারিল বলল। আমার দরকার নেই। আপনাদের দুজনের একজন ওটাতে বসতে পারেন। হাঁটু ভেঙ্গে সরাসরি মাটিতে বসে পড়ল সে।

ডর্সও অনুরূপ ভঙ্গিতে বসল, কিন্তু সেলডন বসতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে গেলেন।

তো, ইয়ং ম্যান, আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছ কেন? জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।

কারণ আপনি একজন গণিতবিদ। আপনি প্রথম গণিতবিদ যাকে আমি প্রথম দেখেছি–এত কাছ থেকে স্পর্শ করার মতো কাছ থেকে।

গণিতবিদরা সবার মতোই মানুষ।

আমার কাছে না, ড. … ড. সেলডন।

ওটাই আমার নাম।

এমারিলকে খুশি দেখাল। শেষ পর্যন্ত মনে পড়েছে। জানেন, আমিও গণিতবিদ হতে চেয়েছিলাম।

বেশ ভালো কথা। হলে না কেন?

 ভুরু কুঁচকালো এমারিল। আপনি সত্যিই জানতে চান?

নিশ্চয়ই কোনো কারণে হতে পারনি। হ্যাঁ, আমি সত্যিই জানতে চাই।

হতে পারিনি কারণ আমি একজন ডাহলাইট। ডাহল-এর একজন হিটসিঙ্কার। প্রকৃত শিক্ষা লাভের অর্থ আমার কাছে ছিল না, কখনো হবেও না। ওরা শুধু আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে পড়তে হবে, সাইফার করতে হবে, আর কম্পিউটার চালাতে হবে। হিটসিঙ্কারের জন্য এই যথেষ্ট। কিন্তু আমি আরো জানতে চাই। তাই নিজে নিজেই শিখেছি।

অনেক ক্ষেত্রে এটাই হচ্ছে জ্ঞান অর্জনের সবচেয়ে ভালো উপায়। কীভাবে শিখেছ?

একজন লাইব্রেরীয়ানকে চিনতাম। তিনি আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। চমৎকার একজন মহিলা। আমাকে শিখিয়েছেন কীভাবে কম্পিউটারের সাহায্যে গণিত শিখতে হয়। একটা সফটওয়্যার তৈরি করে দিয়েছিলেন যেন অন্যান্য গ্রন্থাগারের সাথেও যোগাযোগ রাখতে পারি। ছুটির দিনে বা শিফটের আগে সকালে আমি তার ওখানে যেতাম। মাঝে মাঝে নিজের কামরায় আমাকে রেখে বাইরে থেকে তালা দিয়ে যেতেন যেন কেউ আমাকে বিরক্ত না করে। মহিলা ছিলেন বৃদ্ধ। আমাকে বোধহয় নিজের ছেলে ভাবতেন। তার নিজের কোনো সন্তান ছিল না।

(অন্য কোনো কারণও থাকতে পারে, ভাবলেন সেলডন। পর মুহূর্তেই মাথা থেকে বের করে দিলেন। তার কোনো ব্যাপার না)।

সংখ্যাতত্ত্ব আমার খুব ভালো লাগে, এমারিল বলল। বুক-ফিল্ম এবং কম্পিউটার থেকে যা শিখেছি তার সাহায্যে আমি সম্পূর্ণ নতুন ধরনের কিছু সমাধান বের করেছি যা কোনো বুক ফিল্মেই নেই।

একটা ভুরু উঁচু করলেন সেলডন। চমৎকার। কী রকম সমাধান?

আপনাকে দেখাব বলে নিয়ে এসেছি। এর আগে কাউকেই দেখাইনি। আমার চারপাশে যে মানুষরা আছে তারা হয় হাসবে নয়তো বিরক্ত হবে। এক বান্ধবীকে বলার চেষ্টা করেছিলাম। সে রাগ করে সম্পর্কই শেষ করে দেয়। আপনাকে দেখালে কিছু মনে করবেন?

কিছু মনে করব না। দাও।

এমারিল সামান্য একটু দ্বিধা করে সাথে নিয়ে আসা ব্যাগটা সেলডনের বাড়ানো হাতে তুলে দিল।

দীর্ঘ সময় নিয়ে এমারিলের কাগজগুলো দেখলেন তিনি। কাঁচা হাতের কাজ। কিন্তু মুখে হাসি ফুটতে দিলেন না। প্রতিটি ডেমনস্ট্রেশন মনোযোগ দিয়ে দেখলেন। কোনোটাই নতুন নয়–এবং গুরুত্বহীন। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। দেখা শেষ করে মুখ তুললেন তিনি। তুমি নিজে সবগুলো করেছ? নার্ভাস ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল এমারিল।

বেশ অনেকগুলো পৃষ্ঠা উল্টে একটা গাণিতিক সমাধানের উপর আঙ্গুল রাখলেন সেলডন, তুমি এভাবে সমাধান করেছ কেন?

এমারিল সামনে ঝুঁকে দেখল, কিছুক্ষণ চিন্তা করে কেন এভাবে সমাধান করেছে সেটা ব্যাখ্যা করল।

জিজ্ঞেস করলেন সেলডন, এ্যাজেন্ট বাইজেল-এর লেখা কোনো বই পড়েছ কখনো?

সংখ্যা তত্ত্ব নিয়ে লেখা?

বইটার নাম হচ্ছে ম্যাথমেটিক্যাল ডিডাকশন। শুধু সংখ্যাতত্ত্বই নয় আরো অনেক কিছুই আছে।

না, পড়িনি।

তিনশ বছর আগে এই সমাধানগুলো তিনি করে গেছেন।

এমারিলকে দেখে মনে হলো কেউ তার পেটে প্রচণ্ড ঘুষি মেরেছে। আমি জানতাম না।

সেই বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। অবশ্য তুমি বেশ বুদ্ধিমত্তার সাথে সমাধান করেছ। যাইহোক সবগুলোর অনেকগুলো কপি তৈরি করবে। খেয়াল রাখবে যেন অন্তত একটা সেঁটে কোনো অফিসিয়াল কম্পিউটারের তারিখ এবং সিল থাকে। আমার বন্ধু মিস্ট্রেস ভেনাবিলি তোমাকে স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেবে। টিউশন ফী লাগবে না বরং বৃত্তি পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। সব প্রথম থেকে শুরু করতে হবে তোমাকে। গণিতের পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়ও-

কিন্তু এরই মধ্যে এমারিল-এর দম বন্ধ হয়ে গেছে। স্ট্রিলিং বিশ্ববিদ্যালয়ে? ওরা আমাকে নেবে না।

কেন? ডর্স, তুমি ব্যবস্থা করতে পারবে না?

অবশ্যই পারব।

না, পারবেন না, রেগে গেল এমারিল। ওরা আমাকে নেবে না। কারণ আমি ডালাইট।

তো?

ডাহলের কাউকেই ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ দেওয়া হয় না।

ডর্সের দিকে তাকালেন সেলডন, কী বলছে।

মাথা নাড়ল ডর্স। আমি নিজেও বুঝতে পারছি না

আপনি তো আউটওয়ার্ল্ডার, মিস্ট্রেস। স্ট্রিলিং এ কতদিন আছেন?

তা প্রায় দুবছর, মি. এমারিল।

এর মাঝে কোনো ডালাইটকে কখনো দেখেছেন–খর্বাকৃতির, কোঁকড়ানো চুল, বিরাট গোঁফ।

ওখানে নানা বর্ণের নানা চেহারার শিক্ষার্থী আছে।

কিন্তু কোনো ডাহলাইট নেই। আবার যখন ওখানে যাবেন তখন ভালোভাবে খেয়াল করবেন।

কেন নেই? জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।

ওরা আমাদের পছন্দ করে না, আমাদের গোঁফ পছন্দ করে না। আমরা দেখতে অন্যরকম।

আপনি প্রতিদিন শেভ- কিন্তু ডাক্লাইটের আগুন-ঝরা দৃষ্টির সামনে মিইয়ে গেলেন তিনি।

কখনোই না। কেন করব। গোঁফ হচ্ছে আমার পৌরুষের প্রতীক।

আপনি তো দাড়ি কামান। ওটাইতো পৌরুষের প্রতীক।

আমাদের কাছে গোঁফটাই পৌরুষের প্রতীক।

ডর্সের দিকে ঘুরে বিড়বিড় করে সেলডন বললেন, টাক মাথা, গোঁফ… পাগলামি।

কী? প্রচণ্ড রেগে গেল এমারিল।

 কিছু না। ডাহলাইটদের আর কী ওরা পছন্দ করে না।

ওরাই ঠিক করে নেয় কোনটা পছন্দ করবে না। ওরা বলে আমাদের গায়ে দুর্গন্ধ, আমরা নোংরা, আমরা চুরি করি, আমরা মারামারি করি, আমরা কানে শুনি না।

কেন বলে?

কারণ বলা সহজ আর এসব বলে মনে শান্তি পায়। আমাদের যেহেতু হিটসিঙ্কে কাজ করতে হয় সেহেতু দুর্গন্ধ হবেই, নোংরা লাগবেই। আমরা যেহেতু দরিদ্র এবং সুবিধা বঞ্চিত সেহেতু দুএকজন তো চুরি করবেই, মারামারি করবেই। ইম্পেরিয়াল সেক্টরের লম্বা, হলুদ চুলের ফুল বাবুরা কী করে। নিজেদের মনে করে গ্যালাক্সির মালিক–হয়তো তাই। কিন্তু ওরা কী কখনো চুরি করে না, মারামারি করে না? আমার মতো কাজ করলে ওদের গায়েও দুর্গন্ধ হতো। আমার মতো বাস করলে ওদের গায়েও নোংরা লাগত।

সব জায়গাতে সব ধরনের মানুষই থাকে। এটা কী কেউ অস্বীকার করতে পারবে?

এই বিষয়ে তো কেউ তর্ক করে না! ওরা ধরেই নিয়েছে যে আমরা অসভ্য, বর্বর। মাস্টার সেলডন, আমাকে ট্র্যান্টর ছেড়ে যেতে হবে। এখানে ক্রেডিট উপার্জন। করার কোনো সুযোগ আমার নেই, লেখা পড়া শেখার কোনো সুযোগ নেই, গণিতবিদ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। শুধু হতে পারব… মূল্যহীন একজন মানুষ। শেষ। কথাটায় প্রচণ্ড হতাশা এবং ক্ষোভ ঝরে পড়ল।

যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলেন সেলডন, যার কাছ থেকে এই ঘর আমি ভাড়া নিয়েছি সেও ডাহলাইট তার ভালো একটা চাকরি আছে। সে শিক্ষিত।

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। অবজ্ঞার সাথে বলল এমারিল। দুই একজনকে সুযোগ দেয় যেন বলতে পারে যে আমরা কাউকে ঠকাই না। আর দুই একজনও ভালোভাবেই জীবনযাপন করতে পারবে যতক্ষণ ওরা ডালে থাকবে। ডাল ছেড়ে বাইরে যাক দেখবেন কেমন ব্যবহার পায়। আর এখানে যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ ওরাও নিজেদেরকে হলুদ চুলের ফুলবাবু মনে করে আর আমাদেরকে মনে করে নোংরা জীবাণু। আপনি একজন হিটসিঙ্কারকে নিয়ে আসছেন শুনে আপনার বাড়িওয়ালা কী বলেছিল?

জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালেন সেলডন। তোমার কথা আমি ভুলব না। চেষ্টা করে দেখব আমার নিজের গ্রহ হ্যালিকনে তোমার জন্য কোনো ব্যবস্থা করা যায় কী না। আমি যখন ওখানে ফিরব।

আপনি কথা দিচ্ছেন? মনে থাকবে তো? ডালাইট হওয়ার পরেও আপনি আমাকে সাহায্য করবেন?

তুমি ডাহলাইট সেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তুমি এরই মধ্যে গণিতবিদ হয়ে উঠেছ। কিন্তু এখনো বুঝতে পারছি না তোমাদের মতো সরল সহজ মানুষের সাথে কীভাবে এত দুর্ব্যবহার অন্যরা করে।

তিক্ত স্বরে এমারিল বলল, কারণ আপনি কখনো জানতে আগ্রহী হননি। আপনার নাকের নিচেই এধরনের ঘটনা ঘটে যাবে অথচ কিছুই খেয়াল করবেন না।

মি. এমারিল আপনাকে বুঝতে হবে যে ড. সেলডন একজন গণিতবিদ। সব সময় বিভিন্ন রকম হিসাব নিকাশ নিয়ে তার মাথা বোঝাই হয়ে থাকে। অনেক কিছুই তিনি খেয়াল করেন না। কিন্তু আমি ইতিহাসবিদ। আমি জানি যে মানুষে মানুষে এমন রেষারেষি সবসময়ই ছিল এবং অনেক সময় তা এত ভয়ংকর হয়ে উঠে যে ইতিহাসই পাল্টে যায়। এটা খুবই খারাপ।

খুবই খারাপ এটা বলা খুবই সহজ। বলছেন পছন্দ করেন না এটা আপনার ভালো মনেরই পরিচয় দেয়। কিন্তু এখান থেকে যখন চলে যাবেন, নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। সব ভুলে যাবেন আপনি। খুব খারাপ বলার চেয়ে এটা আরো জঘন্য। আমরা সবাই এক। হলুদ চুল, কালো চুল, লম্বা-বেটে, ইস্টার্নার, ওয়েস্টার্নার, সাউদার্নার, আউট ওয়ার্ল্ডার সবাই সমান। আমরা সবাই, আমি, আপনি, এমনকি সম্রাট নিজেও পৃথিবীর মানুষের বংশধর, তাই না?

কীসের বংশধর? জিজ্ঞেস করলেন সেলডন। বিস্ফারিত চোখে তাকালেন ডর্সের দিকে।

পৃথিবীর মানুষের। চিৎকার করল এমারিল। সেই একমাত্র গ্রহ যেখানে মানব জাতির উৎপত্তি হয়েছিল।

একমাত্র গ্রহ? একটাই গ্রহ?

একমাত্র গ্রহ। কোনো সন্দেহ নেই। পৃথিবী।

পৃথিবী অর্থাৎ অরোরা, তাই না?

অরোরা, সেটা আবার কী?–আমি বলছি পৃথিবী। আপনি শোনেন নি কখনো?

না।

কিংবদন্তীর এক গ্রহ। শুরু করল ডর্স, সেটা-

মোটেই কিংবদন্তীর গ্রহ নয়। সত্যিকারের গ্রহ।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সেলডন। এরকম কথা বহুবার শুনেছি। ঠিক আছে আবার শোনা যাক। নিশ্চয়ই কোনো ডালাইট বুক আছে যেখানে পৃথিবীর গল্প বলা হয়েছে?

কী?

তাহলে নিশ্চয়ই কম্পিউটার সফটওয়্যার?

কী বলছেন বুঝতে পারছি না।

ইয়ং ম্যান, পৃথিবীর কথা তুমি কীভাবে জেনেছ?

আমার বাবা বলেছে, সবাই তো জানে।

এমন কেউ কী আছে যে বিশেষ করে পৃথিবীর কথাই জানে? এগুলো কী স্কুলে তোমাদের শেখানো হয়েছে?

স্কুলে এক বর্ণও শেখানো হয় না।

তাহলে তোমরা কীভাবে জানো?

এমারিল এমনভাবে কাধ নাড়ল যেন আজেবাজে বিষয় নিয়ে সময় নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। জানে সবাই। আরো বেশি গল্প শুনতে চাইলে মাদার রিটার কাছে যেতে পারেন। বুড়ি মারা গেছে বলে শুনি নি।

তোমার মা? অথচ তুমি জান না।

বুড়ি আমার মা নয়। সবাই তাকে এই নামেই ডাকে–মাদার রিটা। থাকে বিলিবটনে। অন্তত থাকত এটাই জানতাম।

কোথায় সেটা?

ওই ওদিকে। অস্পষ্টভাবে একটা দিকে ইশারা করল এমারিল।

 কীভাবে যেতে হবে?

ওখানে যাবেন? কাজটা ঠিক হবে না। গেলে আর ফিরে আসতে পারবেন না।

কেন?

বিশ্বাস করুন। গেলে আর কোনোদিন ফিরে আসতে পারবেন না।

কিন্তু মাদার রিটার সাথে আমাকে দেখা করতে হবে।

 মাথা নাড়ল এমারিল। আপনি ছুরি চালাতে পারেন?

কেন? কী ধরনের ছুরি?

এটার মতো। বেল্টের খাপ থেকে একটা ছুরি বের করল সে।

ডর্স ঝট করে তার কব্জি চেপে ধরল।

হাসল এমারিল। আপনাদের মারার জন্য বের করিনি। ছুরিটা আবার জায়গামতো রেখে দিল। শুধু দেখানোর জন্য বের করেছি। আত্মরক্ষার জন্য আপনাদেরও এই জিনিস লাগবে। যদি আপনাদের কাছে এইরকম ছুরি না থাকে বা থাকলেও যদি না জানেন কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তাহলে বিলিবটন থেকে বেঁচে ফিরতে পারবেন না। যাইহোক- হঠাৎ ভীষণ গম্ভীর হয়ে উঠল সে–আমাকে সাহায্য করার ব্যাপারে আপনি সত্যি সিরিয়াস, মাস্টার সেলডন?

অবশ্যই সিরিয়াস। আমি তোমাকে কথা দিয়েছি। তোমার নাম আমাকে লিখে দাও আর কীভাবে তোমাকে হাইপার কম্পিউটারে খুঁজে পাব বল। নিশ্চয়ই কোনো কোড আছে?

হিটসিঙ্কের একটা নাম্বার আছে। চলবে তাতে?

হ্যাঁ।

বেশ, আন্তরিক দৃষ্টিতে সেলডনের দিকে তাকালো এমারিল। আমার ভবিষ্যৎ পুরোপুরি নির্ভর করছে আপনার উপর, মাস্টার সেলডন। দয়া করে বিলিবটনে যাবেন না। এই মুহূর্তে আপনাকে হারালে আমার ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে। এবার করুণ দৃষ্টিতে তাকালো ডর্সের দিকে। আপনার কথা উনি শুনবেন, মিস্ট্রেস ভেনাবিলি। উনাকে বিলিবটনে যেতে দেবেন না। প্লিজ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *