৫. একটি ঘাসের
শিশির নিজেকে জাহির করেছে ঋষিদের বংশধর বলে । আর ওই ধুমসি মেয়েটা, ম্যাডেলিন, নিজেকে বলেছে ভাইকিং । ভাইকিং ব্যাপারটা ঠিক জানি না । কিং-টিং মানে তো রাজারানির ব্যাপার । ওই মোটা মাগি কি না রানি । গাঁজার ধোঁয়ায় মগজে কত যে খেলা তৈরি হয় ! আমি তাহলে অক্ষয়-অব্যয় অপ্সরা, মধুবালা আর মাধুরী দীক্ষিতের মতন সমুদ্র মন্হন থেকে উঠেছি , তপস্যা নষ্ট করতে এক্সপার্ট । ঋষিগুলোও তো মুখিয়ে থাকত যাতে কোনো ল্যাংটো অপ্সরা এসে উইঘুম ভাঙায় । কিন্তু উর্বশী, মেনকা, রম্ভা, কাঞ্চনমালা অপ্সরারা কি বুক নাচিয়ে জিয়ারা ধক-ধক করে কিংবা চোলিকে পিছে কেয়া হ্যায় নাচতে পারত । কক্ষনো না । আমি পারি , আজও, যখন পঞ্চাশ পেরিয়েছি, দিদিমা হয়ে গেছি । তখন তো কথাই ছিল না । বেনারসে তখনও নকল আই ল্যাশ আসেনি । তাতে কী । আমার গায়ের রঙ আহ্লাদী পুতুল ম্যাডেলিনের মতন নয় । তাতে কী । আমি এমন পোড়খাওয়া অপ্সরা যার মুঠোয় আছে শকুনির পাশা । মুকখু চাষা শিশির কিছুই আঁচ করতে পারেনি । ম্যাডেলিনের শেখানো এলকুমি-বেলকুমিই পুঁজি ।
উৎপাদন ব্যাপারটাহয়ে উঠেছে সতত পরিবর্তনরত । আন্তর্জাতিক শ্রমবিভাজনের কারণে, প্রাযুক্তিক দ্রুতির কারণে, শ্রমের তুলনায় পুঁজি থেকে সর্বাধিক লাভের কারণে, এবং অবশ্যই ভোগ্যবস্তুর বিশ্বায়নের কারণে । আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদের আদলটাই প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়ে চলেছে । বহুজাতিক সংস্হা ও তার মালিকদের স্বদেশ বলে কিছু থাকছে না । আবির্ভাব হয়েছে বিশ্বব্যাপী মাফিয়া-ভাতৃত্বের । বাজারের কতৃত্ব হয়ে চলেছে বিকেন্দ্রিত । অথচ বহুজাতিকগুলোর কর্মকাণ্ড কেবলমাত্র পুঁজি, মাল এবং উৎপাদনের আনাগোনায় সীমাবদ্ধ নয় । তারা বিশ্বের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাম্প্রদায়িক, সাংস্কৃতিক নকশাগুলোর হেরফেরকারীও বটে । ব্যক্তিমালিকের পক্ষে আর ঊৎপাদনের বিশাল কারবার চালানো সম্ভব নয় বলে, সমাজ-সম্প্রদায়-রাষ্ট্রের হাতে উৎপাদনকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সীমিত । নিয়ন্ত্রণ, নিয়ম, নীতি এক্ষেত্রে হয়ে দাঁড়ায় টলমলে । সেহেতু সংস্কৃতির সনাতন ভৌগলিক বাঁধন আলগা হয়ে যায় । সংস্কৃতি হয়ে যায় ভাসা-ভাসা । সংস্কৃতি হয়ে গেছে ধাবমান ও যাযাবর । ক্লাব, সমিতি, গোষ্ঠী, যারা সংস্কৃতির ধারক-বাহক বলে নিজেদের মনে করে, আসলে তারা উত্তরদার্শনিকতার প্রতিভূ।
উৎপাদনের আন্তঃরাষ্ট্রিকতা একযোগে হয়ে উঠেছে অভূতপূর্ব বিশ্ব একতার সুত্র, আবার পুঁজিবাদের ইতিহাসে অচিন্ত্যনীয় ভঙ্গুরতার উৎস । পুঁজিবাদের এখনকার জায়মান গল্পটি আর ইউরোপীয় ইতিহাসের প্রসারিত গল্প নয় । এই গল্পের আর কেন্দ্র থাকছে না । অর্থনৈতক ভঙ্গুরতার শক্তিবিকিরণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এসেছে সাংস্কৃতিক ভঙ্গুরতা বা বহুসাংস্কৃতিকতা । এর ফলে ঘটছে সাংস্কৃতিক দেশান্তরণ, সীমানাগুলোর ( ভাষা, দেশ, জাতি, ধর্ম, গোষ্ঠী, লিঙ্গ ইত্যাদি ) অপলকাভাব, পার্থক্য ও অসাম্যের তৃণমূল পর্যন্ত প্রসার, সমাজের ভেতরে-বাইরে ওই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে সমরূপী হবার চাপ, স্হানিক ও বিশ্বের পরস্পরের মধ্যে অনুপ্রবেশ । এগুলো উত্তরদার্শনিকতার লক্ষণ ।
শিশিরে বন্ধুনি ম্যাডেলিন করিয়েট যে কে, তা এখন মনে পড়ে গেছে । বানোয়ারি গুপ্তার দুটো বাড়িতে কোনো ঘর খালি ছিল না বলে মেয়েটাকে সঙ্গে এনেছিল আমার মন্দির চত্ত্বের ঘর ফাঁকা আছে কিনা খোঁজ করতে । একটাও ঘর তখন খালি ছিল না । শীত-বসন্তে এমনিতেই হাউসফুল যায় ।
মেয়েটা তো দানবকন্যা, খাবলা মারলে গা থেকে বাড়তি মাংস উঠে আসবে, এমনতর । শিশির সামলালো কীভাবে ! তবে এ-ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে পাকিয়ে বিপাকে ফেলার কায়দা-কসরত, বেহেড-বেতাল কুলুপতোড় হামলা-হামলি, বেধড়ক এলোপাথাড়ি ধামসাধামসি, ইচ্ছুক-ইচ্ছুকনির তারিয়ে-তারিয়ে খোলতাই মেলতাই ধরতাই, সবই ওশিখেছে ময়াডেলিন করিয়েটের কাছে । ওসব না শিখলে মানুষ কি আর নিজেকে অপরিশোধিত তেল ছাড়ার বিরামহীন কারখানা বানিয়ে ফেলতে পারে !
আমাকে তো হিপি ছেলেছোকরাগুলো কখনো আকর্ষণ করেনি । মরদ বলে মনেই হয়না । পুরুষ মানুষ বলতে বোঝায় হিন্দি ফিলিমের ধর্মেন্দ্র, যেমন অনুপমায় । বিদেশিদের মধ্যে আমায় বাছতে বললে আমি বেছে নেব শক্তসমর্থ নিগ্রো । বেনারসে নিগ্রো হিপি মেয়ে একাধটা এসে পড়ে, আর দেখেছি একলাই ঘুরে বেড়ায় , কিংবা বুড়ো ধরণের খ্যাংরা সায়েব যোগাড় করে ফোঁকাফুঁকির টাইমপাস করে । নির্মলদের দলটার কাউকে দেখিনি ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে, ফাঁসানো তো দূরের কথা । চৌকাঠেই যখন ফর্সা মেম হত্যে দিচ্ছে তখন কেলোকুচ্ছিতকে কেনই বা পুছবে !
বাংলা উপন্যাসে পড়িচি বেনারসে বাঙালি পরিবার কলকাতা থেকে বা বাংলাদেশ থেকে এসেছে । সেসব শুধুই দুঃখি-দুঃখি গল্প । আমার মতনও যে গল্প হতে পারে লেখকরা বোধহয় ভাবতেই পারে না । লেখকগুলো কি হিপি-হিপিনি দেখেছে ? মিশেছে ওদের সাথে ? শুয়েছে ওদের সঙ্গে ? ফুঁকেছে গাঁজা চরস হ্যাশিশ ওদের সঙ্গে ? নাহ , মনে তো হয় না ।
সিস্টেমকে উপড়ে ফেলার জন্য বিপ্লব জরুরি । ত্ত্বকে আঁকড়ে ধরলে বিপ্লবের সমূহ ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী , কেননা নিখাদ হঠকারীতা ছাড়া বিপ্লব সম্ভব নয় । বিপ্লবে প্রাথমিক বিপর্যয় অনিবার্য ।
পোশাক ত্যাগ করিয়া, মগে টয়লেট পেপার ভিজাইয়া ভাইকিং রমণীর গোপনাঙ্গ ও বাহুমূল পরিষ্কার করিলাম । অভূতপূর্ব চুনিখচিত স্বর্ণখন্ড, যদ্দর্শনে হৃৎপিণ্ড চলকাইয়া উঠিল । স্পর্শের রকমফেরে দরাজ হইয়া উঠিল দেহকানাচ । আত্মনিয়ন্ত্রণ করিব মনস্হ করিয়া অটুলস ফ্যাগের অবশিষ্টাংশ ধরাইয়া দুফুঁক মারিলে, ফল বিপরীত হইল ।
নেশাচ্ছন্ন ম্যাডেলিনের দেহ বেশ ভারি । তবুও, চুনিখচিত স্বর্ণখণ্ডের দিকে দেখিব না ভাবিয়া দুই হাতে উপুড় করিয়া দিলাম । নিস্তার পাইলাম না । মাংসের ঢেউ আমাকে নৌকা ভাসাইতে আহ্বান করিল । কোনও দূর প্রান্ত হইতে সর্বসন্মত শরীরে ম্যাডেলিন কহিল, টিকটিকিটি এখনও ঘাড় কামড়ায় নাই কেন ! আমি ঘাড় কামড়াইয়া টিকটিকি-পুরুষের ভূমিকা পালন করিলাম , এবং মাংসল বিছানায় ঘুমাইয়া পড়িলাম ।
ঘুম ভাঙিল অন্ধকারে ; সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়া থাকিবে । আমার মাথা কোলে লইয়া বসিয়া আছে ভাইকিং নারী ; ভারতীয় ধরণের কোল নহে, দুই পা ছড়ানো কোল । আমাদের মতো পা মুড়িয়া কোল গঠন করিতে পারেনা ম্যাডেলিন, বোধহয় কোনও বিদেশিনী । চোখ মেলিতে, মাদকে শুস্ক মুচমুচে ঠোঁটের স্পর্শের সহিত উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলিয়া শুধাইল, বহুক্ষণ যাবৎ তোমায় দেখিতেছি , এবং আফশোষ করিতেছি যে , রবিবার স্বদেশে রওনা দিব, অথচ আমার আগমনের প্রথম দিনই তোমার সহিত সাক্ষাৎ হইল না কেন ! চার বৎসর হইল প্রতি শীতে আমি দেড়-দুই মাসের জন্য বিশ্বভ্রমণ করি । কত যুবকের সহিত দেহসম্পর্ক ঘটিয়াছে, কিন্তু তোমার ন্যায় কেহ এইরূপ সম্পর্ক গড়িতে চাহে নাই । সে-সকল পুরুষগণের যেন প্লেন ধরিবার তাড়া ; দ্রুত কর্ম সমাধা করিয়া, নিজেকে তৃপ্ত করিয়া, অন্তর্ধান করিয়াছে ।
আমি বলিলাম, কোলে শুইয়া প্রশংসা শুনিতে বেশ ভালো লাগিতেছে ; অন্ধকারও আলোকিত হইয়া উঠিয়াছে তোমার উপস্হতির জন্য ।
আমার মুখমণ্ডল সুন্দর নহে , আমার দেহকাঠামোও আদর্শ নহে । তুমি প্রেমে পড়িয়া গিয়াছ ; উহার কার্যকারণ প্রয়োজন হয় না । তোমার মুখ দেখিয়া তো বটেই, টয়লেটে গিয়া, ঘরগোছানো দেখিয়া, পাউডার ও লোমনাশক প্রয়োগ দেখিয়া এই নির্ণয়ে আসিয়াছি । ইতোপূর্বে অন্যান্য পুরুষ আমার অগোছালো অভ্যাসে বিরক্ত হইয়াছে , আমার দেহকে মনে করিয়াছে নোংরা । আমি চলিয়া গেলে, আমার অনুপস্হিতির ফাঁক ভরাট করিতে না পারিলে, আত্মযন্ত্রণার সংকটে পড়িবে তুমি । মৃদুকন্ঠে কথাগুলি বলিল ম্যাডি ।
আমি তাই আমার অস্তিত্বে তোমাকে শুষিয়া লইতে চাই , বলিলাম ।
ম্যাডি কহিল, আমি সতত প্রস্তুত, আরও কয়েকটি আঙ্গিকের সহিত তোমার পরিচয় করাইব । নির্ভর করিতেছে তোমার শরীর কতটা দিতে পারিবে । উঠিয়া পুংযন্ত্র ধৌত করিয়া লও । সময় নষ্ট করিয়া লাভ কী । প্রাতঃকালের পূর্বে দুইটি আঙ্গিক অনায়াসে সম্ভব হইবে ।
বলিলাম, সত্যই, বাৎসায়ন গ্রন্হ লিখিয়াছিলেন ভারতীয়গণের জন্য ; আমি ভারতীয় হইয়া পশুর ন্যায় একটিমাত্র আঙ্গিকে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখিয়াছিলাম । মানবমাংস যে মানুষের মস্তিষ্ক নির্দেশিত হইতে পারে, আহ্লাদের উৎসসূত্র খুলিয়া দিতে পারে, গতানুগতিকতা অতিক্রম করিয়া দৈবত্বে তুলিয়া লইয়া যাইতে পারে, তাহা তোমার কাছেই শিখিলাম । শিখিলাম যে মাংসই প্রেমকে ক্ষুদ্রতায় আবদ্ধ করে ; সে-ক্ষুদ্রতা হইতে নিষ্কৃতি পাইতে হইলে মাংসের উপর মস্তিষ্ক প্রয়োগ করিয়া তাহাকে নবাঞ্চলে লইয়া যাইতে হইবে ।
রবিবার সকাল পর্যন্ত পালাক্রমে অগরু ও কান্তা এবং নব নব আঙ্গিকে দেহকে যতবার প্ররোচিত করা সম্ভব হইল, এমনকি চব্বিশ ঘন্টায় ছয়বার, উন্মাদনায় কাটিল । ইহার পূর্বে এমন স্বতঃস্ফূর্ত আত্মবিশ্বাস জাগ্রত হয় নাই, বুঝিতে পারি নাই যে বিশেষ নারীসঙ্গ নিজেকেও ভালোবাসিতে শিখায়, নিজের সীমাকে লঙ্ঘন করিতে শিখায়, মাংসকে ঔদার্য প্রদান করে ।
শুক্রবার দ্বিপ্রহরে গৃহহ কর্তা আসিয়াছিল, ভাড়া উসুল করিতে ও অটুলস ফ্যাগ বিক্রয় করিতে । প্রায় পঞ্চাশটি চারমিনার প্যাকেট দেখিলাম । প্রচুর টাকা কামাইতেছে অতুল । ভাগ্য ভালো যে টয়লেটে গিয়াছিল বলিয়া গৃহকর্তার সন্মুখে ম্যাডির উর্ধ্ব-নিম্ন ঢাকা ছিল ।
গৃহকর্তা বানোয়ারি গুপ্তা ম্যাডির প্রদত্ত অগ্রিম ভাড়ায় আমাকে মাসের শেষ পর্যন্ত থাকিবার অনুমতি দিয়া কহিল, আমি যেন নতুন কোনও বিদেশিনী ফাঁসাইয়া উহার ঘরটিতে আমদানি করি; স্টেশানে, মণিকর্ণিকায়, দশাশ্বমেধে একা নিঃসঙ্গ বিদেশিনীর দেখা মেলে । আমি ফাঁসাইয়া আনিলে উহার সুবিধা, নতুবা আবার ভাড়াটে খুঁজিতে হইবে ; যতদিন এই বিদেশী-বিদেশিনীগণ বেনারসে আসিতেছে, ততদিন কামাইয়া লইবার সুযোগ আছে । বানোয়ারি গুপ্তার মতে এই বিদেশী যুবক-যুবতীরা সারস ঝাঁকের ন্যায়, কখন কোন দেশে যে দল বাঁধিয়া উড়িয়া চলিয়া যাইবে তাহা কেহই নিশ্চিত বলিতে পারে না । হয়তো কিয়দ্দিন পরে উহারা সুটবুট পরিয়া চুল কাটাইয়া স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়া আবার টুরিস্ট সাহেব-মেমে রূপান্তরিত হইয়া যাইবে এবং ধনীগণের হোটেলে গিয়া উঠিবে ।
গৃহকর্তার কথাগুলি ম্যাডির কানে তুলিলে সে খিলখিল করিয়া, নগ্ন বুক কাঁপাইয়া, এবং আমার রক্ত সঞ্চালন দ্রুত করিয়া বলিল, তোমার বন্ধু নির্মল, মোহিত, প্রণব এবং কতিপয় স্হানীয় লেখক-চিত্রশিল্পী এই উদ্দেশ্যে হিপি অধ্যুষিত বাড়িগুলিতে যাতায়াত করে । কেহ-কেহ স্বগৃহে লিভ টুগেদার করিয়াছে অথবা হিন্দুমতে বিবাহ করিয়া বিদেশে চলিয়া গিয়াছে । তোমরা যেমন শ্বেত ও পীতাভ চামড়ার প্রতি আকৃষ্ট হও, আমরাও বাদামি ও পীতা্ভ বর্ণের পুরুষে আকৃষ্ট হই । এই স্বাধীনতা বিজ্ঞানের অবদান । নূতন গর্ভনিরোধক নারীকে নূতন দিগন্ত খুলিয়া দিয়াছে ।
নির্মলের সংস্পর্শে কি করিয়া আসিলে ? আমার প্রস্নের জবাবে ম্যাডি বলিল, সে আমার মুখের উপর বলিয়াছিল, আমি যূন আকর্ষণের অনুপযুক্ত । সত্য কথা । স্বদেশি-বিদেশি বহু নিখুঁত নগ্নিকাকে বসাইয়া বা দাঁড় করাইয়া সে অনেকানেক ছবি আঁকিয়াছে । প্যারিসেই নাকি এক বৎসর ছিল, ফরাসি কোনও সংস্হার স্কলারশিপ পাইয়া গিয়াছিল । উহার নিকট আমার ত্বকের রং চিত্রশিল্পীর জন্য চ্যালেঞ্জ হিসাবে প্রতিভাত হইয়াছিল ।
শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন আঙ্গিক এবং চরস, আফিম, মারিহুয়ানা, এল এস ডি ক্যাপসুল এবং অটুলস ফ্যাগের পরিচয় করাইয়াছে ম্যাডি । মাদকগুলি আমাকে মধ্যবিত্তের নীতিবোধের ভ্রান্তি হইতে মুক্তি দিতে সাহায্য করিয়াছে । ম্যাডিই প্রস্তাব দিয়াছিল, সজ্ঞানে তো বহুবার হইল ; মাদকের অপার্থিব জগতে প্রবেশ করিয়া অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করা উচিত আমার । বালকসুলভ যৌনতার সীমা অতিক্রম করা সম্ভব হইবে তদ্বারা ।
সে কি আলো বিচ্ছুরণ ! নিঃশব্দ ফুলকির বৃষ্টিফোঁটা রূপান্তরিত হইয়াছে নানা প্রকার ফুলে । ম্যাডিকে কখনও মনে হইয়াছে পালক, কখনও মাখন, কখনও অশরীরী অট্টালিকা, যাহার ভিতর প্রবেশ করিয়া পথ হারাইয়া সাঁতার কাটিতেছি ।
জিন্সের উপর সুতির রক্তবর্ণ টপ পরিয়া, পিঠে নীল রাকস্যাক বাঁধিয়া, ঘরে পরিত্যক্ত বস্তুগুলির দিকে তাকাইয়াও দেখিল না ম্যাডেলিন । জন্মনিয়ন্ত্রণের ট্যাবলেট, বন্ধ বিয়ার বোতল, বিভিন্ন মাদক, টেবিল ফ্যান, বৈদ্যুতিক উনোন, আমার গোছানো উহার নিজস্ব পোশাক, সবই পড়িয়া রহিল । লইয়াছে কেবল রেশমের চাদরটি ।
রবিবার প্রাতঃকালে আমরা গতানুগতিক মিশনারি আঙ্গিক অবলম্বনের পর আমি জোরাজুরি করিয়া ম্যাডিকে সাবান ও শ্যাম্পু মাখাইয়া স্নান করাইলাম । কত ময়লা যে চুলে ও ত্বকে জমিয়াছিল । ত্বকের ঔজ্জ্বল্যে চোখ ধাঁধাইয়া গেল । স্নানের পর একত্রে বাহির হইয়া পথে-পথে হাত-ধরাধরি করিয়া কিছুক্ষণ হাঁটিলাম । ম্যাডি নিশ্চুপ । আমি বলিলাম, চুপ করিয়া আছ কেন, আমার হাহাকার কি তোমাতে সঞ্চারিত হইয়াছে ?
আমার দিকে তাকাইল না ম্যাডি । স্বগতোক্তির ঢঙে বলিল, তোমার স্মৃতি আমার অঙ্গ হহিতে ধুইয়া দিয়া উপকার করিয়াছ । তৎসত্বেও এই সংক্ষিপ্ত সঙ্গদানের ভার আমাকে আজীবন বহিতে হইবে ।
স্টেশানে, দিল্লি অভিমুখী ট্রেনে চাপিয়া, আমি যখন শেষ বিদায় জানাইয়া নামিতে উদ্যত, একঝটকায় আমাকে লইয়া টয়লেটে প্রবেশ করিয়া, জড়াইয়া, কাঁদিতে লাগিল দীর্ঘাঙ্গী ভাইকিং রমণী । আমি দাঁত দিয়া উহার ঘাড়ে একটি রক্তাক্ত স্মৃতিচিহ্ণ আঁকিয়া দিলাম, তবু উঃ করিল না । কেন যে আমি অমন আচরণ করিলাম তাহা নিজের কাছেও অস্পষ্ট । বোধহয় এই প্রথম টের পাইলাম যে ম্যাডেলিন আমার চেয়ে উচ্চতায় বড় ।
চলিয়া গেল ম্যাডেলিন । ট্রেনের দরজায় দাঁড়াইয়া হাতও নাড়িল না । স্টেশান হইতে বাহির হইয়া, পথে নামিয়া, হাঁটিতে লাগিলাম । একটি নেড়ি পিছন-পিছন চলিতে আরম্ভ করিয়াছিল, হয়তো কিছু খাইবার আশায় ; কিয়ৎক্ষণ যাইবার পর মনোভঙ্গ হইতে আরেকজনের পিছু লইল । ভাবিলাম, ঘরে ফিরিয়া, মাসের শেষ পর্যন্ত অন্তত উহার অজস্র পোশাকের গন্ধের রঙের নকশার সহিত সময় কাটাইয়া দিব ।
ঘরে ফিরিয়া আরও ভারাক্রান্ত বোধ করিতে লাগিলাম । বিয়ার খাইলাম । পোশাকগুলি ঘাঁটিলাম । তবু মুহ্যমান রহিলাম । বড়ই বোকা-বোকা লাগিল নিজেকে । শুইয়া, মন যখন ইতি-উতি, হঠাৎ মনস্হির করিলাম ম্যাডেলিনকে আমার অস্তিত্বে জীবন্ত রাখিবার জন্য কাশীর স্মৃতি লিখিব , তাহাই লিপিবদ্ধ করিয়া সময় অতিবাহিত করি ।
নির্মলের গেস্টরুম হইতে উহার পিতার যে জার্নালবহি বা ডায়েরিখানি হাতসাফাই করিয়াছিলাম, তাহা সুটকেস হইতে লইয়া এই রচনাটি লিখিতে বসিলাম । এই জার্নালবহির পৃষ্ঠায় আত্মস্খালন করিব, ঘটনাশৃঙ্খলা বর্ণনার দ্বারা নিজের মুখোমুখি হইব, নিজেকে বুঝিবার প্রয়াস করিব । অতুলের পোস্টকার্ড প্রাপ্তি হইতে শুরু করিয়াছি । পৃষ্ঠা উলটাইয়া দেখিয়াছি, ইহা নির্মলের প্রয়াত পিতার । কোনও কোনও পৃষ্ঠায় তিনি নিজস্ব জ্ঞানবাক্য লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, পাতা ছাড়িয়া-ছাড়িয়া কেন লিখিয়াছেন তাহা অজ্ঞাত । বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপনা করিতেন ।
এক নাগাড়ে লিখিয়া ক্লান্ত হইলে, পথে নামিয়া যত্রতত্র ঘোরাঘুরি করি । চাঙ্গা বোধ করিলে পুনরায় লিখি । তিন দিনে এতটা লিখিয়াছি । এখানেই শেষ করিয়া দিব । খাতাটিই বা কাহাকে দিব ? কেহ যদি পায়, ভাবিবে যে ইহা নির্মলের পিতার জীবনের সহিত জড়িত । কোনও হিপিনি শিকারের চেষ্টা করি নাই । করিলে হয়তো একজন প্রৌঢ়া হিপিনিকে শিকার করা যাইত ; সে যেভাবে আমাকে দেখিতেছিল, মনে হইল যে কোনো খুঁটি খুঁজিতেছে । আকৃষ্ট হইতে পারিলাম না ।
লেখা শেষ করিতে পারিলাম না । অদ্ভুত এক অবিস্মরণীয় ঘটনা ঘটীয়া গেল । ঘটনাটি ঘটিলে, মনে হইল, এইপ্রকার উপশমমূলক নাটকের জন্য আমি একটি সুপ্ত মঞ্চ পাতিয়া আড়ালে উদগ্রীব অপেক্ষা করিতেছিলাম ।
বিছানায় শুইয়া চিন্তা করিতেছি যে ফিরিয়া যাইব বটে, কিন্তু স্বগৃহে এই ডায়েরিটি লইয়া যাওয়া বিপজ্জনক । একমাত্র উল্লাসই ছন্নছাড়া নহে , যাহার নিকট নিশ্চিন্ত হইয়া এই খাতাটি গচ্ছিত রাখা যায় । কিন্তু নকশাল আন্দোলনকারী ভাইদের লইয়া সে হয়ত এমন বিপর্যস্ত যে তাহাকে বলা এই মুহূর্তে দায়িত্বজ্ঞানহীন ঠেকিবে ।
প্রাতঃকালের নয়টা-দশটা হইবে । লাল তাঁতের শাড়ি-ব্লাউজ পরিহিত, সম্পূর্ণ সিক্ত, চুল হইতেও জল ঝরিতেছে, এক ভারতীয় রমণী ঘরে প্রবেশ করিয়াই খিল তুলিয়া দিল । গঙ্গায় ডুব দিয়া ভিজিয়া গিয়াছি , শুকাইতে হইবে, বলিয়া এক-এক করিয়া সবকিছু পরিত্যাগ করিল, এবং আমার তোয়ালে লইয়া গা-মাথা পুঁছিতে লাগিল ।
এতই বিস্ময়াহত হইলাম যে, উঠিয়া, স্হিতি বোধগম্য হইতে সময় লাগিল । আত্মস্হ হইলে কন্ঠ ্ইতে নির্গত হইল, কেকা বোউদি, করিতেছেন কী, করিতেছেন কী ! বহিলা বলিল, বউদি শব্দটি বাদ দাও , এবং এগুলি ছাদে শুকাইয়া দিয়া আইস , তারপর বলিতেছি ।
শুকাইতে দিয়া ঘরে ফিরিয়া দেখিলাম , অতুলের স্ত্রী বিছানায় শুইয়া সিগারেট ফুঁকিতেছে । নারীর বহু পোশাক ঘরে মজুত । অথচ সে নগ্ন, কোনো লজ্জা-সংকোচ নাই । বুঝিতে পারিলাম আমার কন্ঠ শুকাইয়া গিয়াছে , মুখ দিয়া কথা ফুটিতে সময় লাগিবে ।
গত দুই দিন তোমাকে অনুসরণ করিয়া তোমার আস্তানা সম্পর্কে নিশ্চিত হইয়াছি ; নিজের সহিত ষড়যন্ত্র করিয়াছি কী করিলে তুমি তৎক্ষণাৎ ঘর হইতে তাড়াইতে পারিবে না , নগ্ন হইয়া তোমাকে আকৃষ্ট করিব । এই দেহ দেখিতেছ , বারো-তেরো বৎসর পূর্বে অতুল নামে এক অনভিজ্ঞ তরুণ সাত-আট দিন ভোগ করিয়াছে । অতুল আমাকে মন্দির বাড়িতে আনার পূর্বে এক অবাঙালি তরুণীর সহিত প্রেম করিয়াছে, প্রেম মানে ওই শোয়াশুয়ির সুযোগ লইয়াছে, যাহার-তাহার সহিত শয়ন করিয়াছে । এখন জুটিয়াছে বিদেশিনীগণ । আমাকে সে কেন কাম্য মনে করে নাই তাহা আমার জ্ঞানাতীত । সে আমাকে স্পর্শ করিতে ভয় পায় । জানি, তুমি ভাবিতেছ তোমার জন্যই কেন টোপটি ফেলিলাম , এবং এতকাল কাহাকেও গাঁথিয়া তুলি নাই কেন ? আমার এই ধ্যাবড়া সিঁদুর, টিপ, শাঁখা-পলা দেখিতেছ ? এই ভাবমূর্তি বিক্রয় করিয়া মন্দিরগৃহের শিবঠাকুরকে জীবনদান করিয়াছি । মাদকের ব্যবসায়ের পূর্বে মন্দিরের আয় হইতে ব্যয় নির্বাহ হইত । অদ্য আমার কাঁচা টাকা প্রচুর । অতুলকে মুম্বাই পাঠাইয়াছি জোড়া-ফ্ল্যাট অনুসন্ধান করিতে, কুহুর ও আমার নামে কিনিব । স্হানীয় কোনো যুবককে গাঁথিয়া ধরা পড়িয়া গেলে আমার ভাবমূর্তি বিধ্বস্ত হইত । এখনই সুবর্ণ সুযোগ, অতুল অন্তত পক্ষকাল আসিবে না । চিত্রকর-সাহিত্যিক-সাংবাদিকগণের গোঢ়্ঠীটি বেনারস ত্যাগ করিয়া পাটনা দিল্লি ভুপাল পলাইয়াছে , কেন না নকশাল নামে বদনাম দিয়া স্হানীয় পুলিশ কয়েকজনের উপর অত্যাচার করিয়া কলিকাতা পুলিশের হাতে তুলিয়া দিতেছে , এবং কয়েকদিনের অন্তরালে মিলিতেছে তাহাদের ছিন্নভিন্ন শব । অতুলের জারজ সন্তান কংকে পোষ্যরূপে গ্রহণ করিয়া আমার বাঁধ ভাঙিয়া গিয়াছে । তুমি মাত্র কিছু দিনের জন্য এই তীর্থক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়াছ, অচিরে মিলাইয়া যাইবে । তোমার প্রতি দুই দিন লক্ষ্য রাখিয়া বুঝিয়াছি কোনও নারী জুটাইতে সক্ষম হও নাই, বা হয়তো জুটাইয়াছিলে, এখন ফসকাইয়া গিয়াছে ; ওই বিপুল পোশাক-আশাক হয়ত এক বা একাধিক নারীর । সে যাহাই হউক, এখন তুমি টোপ গিলিবার উপযুক্ত । সিক্ত শাড়ি-ব্লাউজের জন্য চিন্তা করিও না । ষড়যন্ত্রের অঙ্গরূপে একসেট শাড়ি-ব্লাউজ আমার থলেতে ভরিয়া আনিয়াছি । কব্জিতে হাতঘড়ি দেখিতেছ ? উহা থলেতে ছিল । তুমি আর কতদিন আছ ?
কেকার কথা শুনিতে-শুনিতে মনে হইতেছিল, বহুকাল যাবৎ তাহা পূঞ্জীভূত ছিল, এবং ছিল শ্রোতার অপেক্ষায় । বা এমনও হইতে পারে যে যৌনসংসর্গের আকাঙ্খায় গল্প ফাঁদিতেছে । আমার নিকট তাহার দ্বারা উপস্হাপিত বক্তব্যের সত্য-মিথ্যার কোনো গুরুত্ব নাই । এই নারীদেহেটির রহস্য উদ্ঘাটনই সত্য । কাঙ্খিত । বলিলাম, মাসের শেষ পর্যন্ত থাকিব । বলিয়া প্রশ্ন করিলাম, আপনার হাতে এক্ষণে কত সময় আছে ?
ওঃ! ওয়ান্ডারফুল , উঠিয়া বসিয়া কেকা আহ্লাদ ব্যক্ত করিল, এবং যোগ করিল, আপনি-আজ্ঞে করিও না ; নগ্নতার ঘনিষ্ঠতায় উহা বেমানান । কুহুর স্কুল তিন ঘটিকা পর্যন্ত ; কংকে মা-ই ভালো সামলাইতে পারে । প্রতিদিন দুই ঘটিকা পর্যন্ত থাকিব । কুহুর যেদিন ছুটি থাকিবে, আড়াই ঘটিকা হহিতে সাড়ে ছয় ঘটিকা পর্যন্ত থাকিব । আমি হিন্দি ফিলিমের ম্যাটিনি শো দেখিতে ভালোবাসি , সবাই জানে । মাসের শেষ পর্যন্ত না হয় নায়িকার ভূমিকা আমিই পালন করি । তুমি নায়কের ভূমিকা পালন করিবে , খলনায়ক হহিতে পারিলে আরও ভালো, তাহারা অমিতবিক্রমে রেপ করিতে পারে । মন্দিরে যাহারা পূজা দিতে আসে তাহারা অনেকেই বলে আমাকে দেখিতে অনেকটা ওয়াহিদা রহমানের ন্যায় । তুমি গাইড ফিলিম দেখিয়াছ ? প্রশ্নের জবাবের অপেক্ষা না করিয়া , হাত দোলাইয়া নগ্ন নারী গাহিয়া উঠিল, আজ ফির জিনে কি তমন্না হ্যায়, আজ ফির মরনে কা ইরাদা হ্যায়…।
আমার দেহরসায়নে সাজো-সাজো রব পড়িয়া গিয়াছিল । আলিঙ্গনের ফাঁকা পরিসর ভরাট করিতে বারো বৎসর যাবৎ হাহাকারপূর্ণ আরেক আলিঙ্গন নিজেই ধরা দিতে আসিয়াছে । ম্যাডেলিনের অনুপস্হিতির ধ্বনি প্রতিধ্বনি হইয়া ফিরিয়া আসিয়াছে কেকার উদোম উপস্হিতিতে ।
সিঁড়ির দরজায় তালা দিয়া ছাদ হইতে শাড়ি শায়া অন্তর্বাস আনিয়া ঘরে রাখিলাম ; হিপি অধ্যুষিত গৃহের ছাদে শাড়ি-শায়া সন্দেহের উদ্রেক করিতে পারে কোনো প্রতিবেশির । ঘরের কপাট ভিতর হইতে বন্ধ করিয়া পোশাকমুক্ত হইলাম এবং সিক্ত শীতল নারীদেহে অগরু ও কান্তা শিশির তলানি ছিটাইয়া সুগন্ধিত করিলাম ।
আমার তপ্ত দেহ জড়াইয়া, চক্ষু মুদিয়া ফোরপ্লে উপভোগ করা কালে অবরুদ্ধ কন্ঠে কেকা কহিল, আমারই দেহে আহ্লাদের যে এতগুলি কেন্দ্র আছে , তাহা নিজেই জানিতাম না ; কাশী বিশ্বনাথকে শতকোটি প্রণাম যে তিনি তোমাকে আমার নিকট সঁপিয়াছেন । ফোরপ্লের মাধ্যমেই কেকাকে চরমে লইয়া গেলাম । সে কহিল , এইরূপে দেহ যে আনন্দময় হয় তাহা অজ্ঞাত থাকিয়া যাইত যদি তোমাকে না জোটাইতাম ; জীবনকে তোল্লাই দিবার কোনো প্রয়োজন নাই , যেমন-যেমন পাও তেমন তেমন নিতে থাকো ।
প্রথম দিন বলিয়া আমরা গতানুগতিক মিশনারি আঙ্গিক অবলম্বন করিলাম । কেকাকে ক্রমশ উন্মোচন করিয়া লইব ; পরিচয় করাইব অনেকানেক আঙ্গিকের সহিত । অপরিচিত আঙ্গিকে ভয় পাইতে পারে, শরীরে দাগ তুলিলে বাড়ি প্রশ্নের মুখে পড়িবে ।
যাহা ফুঁকিতেছিল তাহা কি অটুলস ফ্যাগ ? প্রশ্ন করিতে কেকা উত্তর দিল, অটুলস ফ্যাগের সহিত পরিচয় ঘটিয়া গিয়াছে দেখিতেছি ; না, ইহা কেকাস ফ্যাগ, পানামা নামক একটি সিগারেট, মন বিক্ষিপ্ত হইলে দু-একটি পান করি । অটুলস ফ্যাগ বড়ই তীব্র এবং তাহা মাদক সেবনেচ্ছুগণের জন্য । তোমার গন্ধ লাগিতেছে ? কল্য হইতে কর্পূর জলে কুলকুচি করিয়া আসিব ।
আমি বলিলাম, প্রয়োজন নাই ; নারীর মুখগহ্বর হইতে সিগারেটের গন্ধও ভিন্ন জগতে তুলিয়া লয়, সোহাগ তো কেবল মাংসের সহিত মাংসের নহে, তাহা গন্ধের স্বাদের স্পর্শের শ্রবণের চাহিয়া দেখিবারও । কেকা প্রত্যুত্তর করিল না । শুনিয়া মোহিত হইয়া গেল ; বলিল, আহা, আহা, প্রাণ জুড়াইবার মত এমন কথা কেহ তো কহে নাই। অনেক কিছুই জানো , আমি এতদ্বিষয়ে সম্পূর্ণ আকাট ।
নামিয়া, বিয়ার বোতল খুলিয়া কেকাকে দিলে ঢকঢক করিয়া পান করিল, থামিল, গিলিল, থামিল, গিলিল, খালি করিয়া বলিল, সাঁইত্রিশ বৎসরের জীবনে এই প্রথম বিয়ার পান করিলাম । কখনও মদ্য পান করি নাই । দশ ঘটিকায় পান করিলে দুই ঘটিকায় নেশা কাটিয়া যায়, এমন মদ্য কল্য আনিও, কেমন ? মদ মাংস মাগি মরদের ঘূর্ণিতে দুইজনে তলাইয়া যাইব এই কয়দিন । অধঃপতিত হইতে কেমন স্বর্গীয় অনুভূতি ঘটে তা অনুভব করিতে চাই ।
এক-দু পেগ পান করিলে প্রভাব থাকিবে না ; রাম হুইস্কি ব্র্যান্ডি জিন ভোদকা প্রতিটির কোয়ার্টার এবং সোডা লইয়া আসিব ; প্রতিদিন এক-এক প্রকারের নেশা করিও , তুমি বড়া কাবাব চানাচুর ডিম ইত্যাদি জাতীয় টাকনা আনিও । বাৎসায়নের নাম শুনিয়াছ তো ? তোমাকে সেই মিলনানন্দগুলির সহিত পরিচয় করাইব, যদিও সময় বড় কম, তবু যতগুলি সম্ভব হয় । কথাগুলি বলিয়া নিজের ইচ্ছাটি স্পষ্ট হইল । মাতাল আলিঙ্গনে মাতাল বাঙালি নারীদেহের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের লিপ্সা ।
কেকা বলিল, আমার শরীরে এখনও যথেষ্ট সহনশক্তি আছে ; তিরিশ পার করা কোনো বয়স নহে, অনেক খাটুনি খাটিতে পারি । সবই টাইট আছে এখনও, কোনো অঙ্গ ঢিলা হয় নাই । বলিয়া, দাঁড়াইয়া নিজেকে প্রদর্শন করিল ।
দেড়টা নাগাদ কেকাকে বলিলাম, তোষকটি মাটিতে নামাইতে সাহায্য করিতে । কারণ জানিতে চাহিলে ঘোটক-ঘোটকীর আঙ্গিক ব্যাখ্যা করিতে তৎক্ষণাৎ প্রস্তুত হইল । কর্ম সমাপনান্তে কহিল, কৈশোরে ব্লিস শব্দটি শুনিয়াছিলাম । অদ্য তাহার অর্থ বোধগম্য হইল । ঈশ্বর কেন বিভিন্ন প্রকারের প্রাণীর জন্ম দিয়াছেন তাহার যে ভিন্ন একটি রহস্য আছে , জানিলাম তোমার নিকট হইতে । আমার সতীত্ব যৎসামান্য সার্থক হইল ।
যাইবার সময়ে ম্যাডেলিনের উর্ধ্বাঙ্গের অনেকগুলি পোশাক নিজের ও আমার থলেতে ঠুসিয়া বলিল, এইগুলি যাইবার পথে ভিখারিদের বিলাইব । নিজের সিক্ত পোশাক লইল না ।
আমি বলিলাম, কল্য থলেগুলি আনিয়া নিম্নাঙ্গের পোশাকগুলিও বিতরণ করিয়া দিও । তোমার তো জন্মনিরোধক প্রয়োজন ? ওই যে, খাইবার ও প্রবিষ্ট করিবার দুই-ই আছে ।
চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া আমার দিকে সরাসরি তাকাইল কেকা । পাতলা ঠোঁটের এককোণে ক্রুর হাসি মাখাইয়া কহিল, ওই ব্যাপারে চিন্তা করিও না ; আমি জানি কী করিতে হয় । পোশাকের বিষয়েও চিন্তা করিও না ; জানি না কোন মাগির ঢ্যাপলা পোশাক একত্রিত করিয়া ঘরটিকে নরক করিয়া রাখিয়াছ , যাহা তোমার নহে সবই এই ঘর হইতে লইয়া গিয়া বিলি করিয়া দিব । এঘরে এখন শুধু আমি আর তুমি ; ইচ্ছুক আর ইচ্ছুনি ।
কেকা চলিয়া গেলে স্নানাদি সারিয়া রেস্তরাঁয় ভাত-মাছ আহার করিলাম। হিন্দুস্হানি মশলা দেয়া রগরগে মাছ । পুনরায় একটি থলে কিনিয়া লোকমুখে মদ্যবিপণির পথনির্দেশ জানিয়া— তীর্থস্হান বলিয়া মদ্যবিপণীর প্রশ্নে যে লোকে ভ্রূভঙ্গী করিবে তাহা মনে হইল না— সকল প্রকার মদ্যের কোয়ার্টার, কয়েক বোতল সোডা ও লেমনেড, দুইটি গ্লাস ও বিভিন্ন চানাচুর তাহাতে ভরিয়া যখন ফিরিলাম, বেশ ঘুম পাইতেছিল । ম্যাডেলিনের পরিত্যক্ত একটি অটুলস ফ্যাগ সম্পূর্ণ ফুঁকিয়া সম্ভবত জ্ঞান হারাইলাম । মধ্যরাত্রে ঘুম ভাঙিলে বা জ্ঞান ফিরিলে, ম্যাডেলিনের মাংসল ঔজ্জ্ব্ল্যের অনুপস্হিতির হাহাকারে আক্রান্ত হইয়া পুনরায় ঘুমাইয়া পড়িলাম । স্বপ্নে অথবা নেশার প্রভাবে দেখিলাম সে নগ্ন হইয়া পরিরূপে মোগল সম্রাটের প্রাসাদে উড়িতেছে, দেয়ালগাত্রের কুচি-কুচি আয়নায় তাহার দেহবল্লরী প্রতিফলিত হইতেছে , মিহি-মিহি সুরে সানাই বাজিতেছে ।
দরজায় কড়া নাড়ানাড়ির শব্দে ঘুম ভাঙিতে কপাট খুলিয়া দেখি কেকা । আমাকে সরাইয়া ঘরে দ্রুত প্রবেশ করিল ও হাতের দুইটি থলে হইতে নানাবিধ বস্তু মেঝেয় রাখিয়া মাটিতে পাতা তোষকে বসিয়া কহিল, ব্রেকফাস্টের জন্য টোস্ট কলা ও ডিম সিদ্ধ আছে , এই হরলিক্সের শিশিতে বাদাম-পেষা দুধ, এবং দ্বিপ্রহরের জন্য পরোটা, আলুর দম ও কাবাব । তোমার দুর্বল হইলে চলিবে না ; শরীরকে বলশালী রাখিতে হইবে । তোমার কথা চিন্তা করিতে-করিতে আমার ভালো ঘুম হয় নাই ।
বলিতে-বলিতে তোষকে শুইয়া পড়িল আদুড়চুলি কেকা । স্পষ্ট যে রাতের সাধারণ শাড়ি বদলাইবার সময় পায় নাই । কহিল, সকালে সিগারেট খাই নাই, দাঁত মাজিয়া কর্পূরজলে কুলকুচি সারিয়া আসিয়াছি । আমি জানি, তোমারা নিমেষে নিজেকে অতিদাহ্য করিয়া কাজ সারিতে পারো । নাও, তাড়াতাড়ি করো । আমাকে চরমে না লইয়া গেলেও এখন চলিবে ।
নিমেষে অতিদাহ্য হওয়া স্বাভাবিক ছিল । কী করিতে হইবে নির্দেশ দিয়া টিকটিকি আঙ্গিক অবলম্বন করিয়া, তপ্ত নারীদেহ ও সংসর্গের মসৃণতায় বুঝিলাম, আসিবার সময় সত্যই আমার কথা চিন্তা করিয়া শরীরকে আগেভাগে প্রস্তুত করিয়া আনিয়াছে । বলিলাম, দাঁড়াও উঠিও না, লোমনাশক লাগাইয়া দিতেছি, স্নানের সময় ধুইয়া লইও ।লোমনাশক লাগাইয়া দিবার পর কেকা পুনরায় ইশারাপূর্ণ হাসিটি হাসিল ।
সমাজচিন্তার বহু এলাকায় ইতিহাসকে পুরুষের একচেটিয়া বলে মেনে নেয়া হয়েছিল, এবং নারীকে আবদ্ধ করা হয়েছিল অপরিবর্তনীয় গার্হস্হ জীবনে । যে-কোনো প্রসঙ্গই হোক না কেন, লিঙ্গবৈষম্যকে ওড়ানো হয়েছে তুড়ি মেরে । ইদানিংকালের কয়েকজন ভাবুক তাঁদের আলোচনায় লিঙ্গবৈষম্যকে বিশ্লেষণ করেছেন, কেবলমাত্র সন্দর্ভকে ব্যাপক করার উদ্দেশ্যে নয় । বহু নতুন প্রশ্ন তুলে, সমস্যাগুলো সর্বসমক্ষে তুলে ধরে, পূর্বানুমানকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে, চালু জ্ঞানকে সন্দেহ করে, বিষয়টিকে করে তুলেছেন বৈপ্লবিক । রমাবাঈ রাণাডে এবং লক্ষ্মীবাঈ তিলক তাঁদের রচনায় জানিয়ে গেছেন যে, তাঁদের স্বামী জনজীবনে ছিলেন আধুনিক, অথচ বাড়ির ভেতর ব্যক্তিগত সংসারে ছিলেন সনাতনপন্থী ও রক্ষণশীল ।
তবে কি তর্কটি রাজনৈতিক ? আমি বলব , হ্যাঁ । কেননা এই ধরণের আলোচনায় নিপীড়ন, দমন, নিগ্রহ ও অসাম্যের প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ উৎসকে শনাক্ত করার চেষ্টা রয়েছে । ভারতবর্ষে এমন কোনও সমাজ, সম্প্রদায়, বর্ণ, ভাষাভাষী নেই যেখানে নারী পুরুষের অধীন নয় , মানবিক গোলামক নয় । এই সূত্রে পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোটি সম্পর্কে গবেষণা ও বর্তমান ব্যবস্হার প্রতিকার জরুরি হয়ে উঠেছে ।
প্রথম দিনের ব্যাপারটা লিখতে গিয়ে শিশির কিছুটা বাদ দিয়ে ফেলেছে , বোধহয় উত্তেজনার বশে কিংবা নেশার ঘোরে লিখেছে বলে । আমার মনে হয়, ও হুহু করে লিখে গেছে, তারপর আর পড়ে দেখেনি । তার ওপর মাস্টারি-মার্কা বাংলা ।
ও যখন ঘরে ঢুকে খাটের পাশে এসে দাঁড়ালো, মুখচোখ দেখে বুঝলুম ভীষণ অপ্রস্তুত, কী করবে কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না । একেবারে অস্হিরপঞ্চক । ওকে স্বাভাবিক করে তুলতে আমি সিগারেটের ধোঁয়ায় পর-পর দুটো রিং ওর দিকে উড়িয়ে বললুম, এই নাও বরমাল্য, তোমায় স্বয়ম্বর-সভায় বরণ করে নিচ্ছি ।
শিশির কিছুটা স্বাভাবিক হল , কিন্তু জিগ্যেস করে বসল, তুমি আর গান গাও না ? এরকম গাড়লপুরুষ যে হতে পারে জানতুম না । সামনে শুয়ে রয়েছে এক নগ্ন মহিলা , সেদিকে নজর দেবে, প্রশংসা করবে, তা নয়, গান ! তবে বুঝে নিতে অসুবিধা হল না যে বঙড়শিতে মাছ আটকে পড়েছে, এখন যদি আমি মুখ থেকে বঁড়শি খুলে নিই তবেই ছাড়া পাবে, নয়তো আটকে নিয়ে খেলাবো, খেলাতে থাকবো । পুরুষরা ভাবে যে তারাই বুঝি ছিপ ফেলে গিঁথে তুলতে পারে ।
প্রসন্নর বাড়িতে, তখনও কুহু হয়নি, বোরডাম কাটাবার জন্যে দুপুরে বা সন্ধ্যায় হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতুম , রবীন্দ্রসঙ্গীত আর অতুলপ্রসাদ । সেই সূত্রেই ওর প্রশ্ন, যে প্রশ্নের মধ্যে শিশির আমাকে কচি যুবতী হিসেবে দেখতে পাচ্ছিল, হয়তো আমার নগ্ন দেহ থেকে গান ভেসে যাচ্ছিল ওর মাথাটাকে ঘিরে । গান সাধা কবেই চুকে-বুকে গেছে । বেনারসে আসার পর ইন্দি ফিলিম দেখতে-দেখতে গান বলতেই মাথায় আসে লতা মঙ্গেশকর-আশা ভোঁসলে ।
হিন্দি ফিলিমের গানে শিশির কতটা সড়গড় জানা না থাকায়, আমি উঠে বসে আরম্ভ করেছিলুম, আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে…। শিশির আঁৎকে উঠল, না না না না না, এইভাবে কোনও জামাকাপড় না পরে, সিগারেট হাতে, ওই গান, বাপরে, গেও না, গেও না ।
না গাইবার কি কারণ জানি না , ঘরে তো কেবল আমরা দুজন, আমি তো ওকে বলছিলুম আগুনের পরশমণিটা দিয়ে আমায় ছুঁতে, তাও বুঝতে পারেনি কেন ক্যাবলাটা ! তাছাড়া আমার গলায় সাতভরি সোনার হার, হাতে শাঁখা-পলা, সোনার বালা, আর পায়ে রুপোর মল ছিল । মন্দিরগুলোয় তো এরকমই মূর্তি থাকে সেকালের মেয়েদের । তবে, আমি যা চাইছিলুম, ওকে টেনশানমুক্ত করতে, তাতে পুরোপুরি সফল । বাংলা গানও আর ওকে শোনাতে হয়নি ; আমরা দুজনেই তো হয়ে উঠেছিলুম বাজনার অর্কেস্ট্রা , ওই বাজনায় কেমন আস্তে সুরু হয়ে একেবারে ওপরে উঠে যায় । হিন্দি ফিলিমের গান আমার মগজে এমনভাবে ঢুকে গেছে যে মন্দিরের গর্ভগৃহে দাঁড়িয়ে, ভক্ত-ভক্তিমতীদের অর্ঘ্যদানের মাঝে মনে-মনে গুন-গুন করেছি, কভি আর কভি পার লাগা তীরে নজর, কিংবা জানে কেয়া তুনে কহা জানে কেয়া ম্যায়নে শুনা … । এতে আমি দোষ দেখি না , দেবী-দেবতাদেরও বলা যায় অমনকথা । আর আমি তো কালীঠাকুর পূজকদের বাড়ির মেয়ে, বিয়ে করলুম যাকে তাদের বাড়িতে সিংহবাহিনীর পুজো হয়, পালালুম যার সঙ্গে সে তো বোষ্টম, নিজে প্রতিষ্ঠা দিলুম শিবলিঙ্গকে, শিশির তো যা বুঝেছি কোনো দেবী-দেবতায় বিশ্বাস করে না ।
শিশির আমায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরতেই, প্রথম দিন প্রথম বার, একটা ভয়ংকর চিন্তার ঝাপটায় আমি অবাক হয়ে গেলুম । বুঝতে পারলুম, অতুলকে আমার অসহ্য মনে হয়, আমার জীবন থেকে ওকে তাড়াতাড়ি বিদায় করতে হবে ; ও মরে গেলেই ভালো হয়, ও স্রেফ একটা পরগাছা । শিশিরের গায়ের গন্ধে আমার শরীরের ভেতর কত রকমের রঙিন পরি যে উড়তে আরম্ভ করল তার কুলকিনারা নেই । অতুলের গায়ের গন্ধে আজকাল আমার বমি পায় ।
যতবার শিশির আমায় জড়িয়ে ধরেছে, এই ভাবনাটা খেলেছে মাথায় । কিছু-কিছু ভাবনা সারা পৃথিবীকে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করে কিন্তু কাউকে বলা চলে না । অতুল এমনিতেই অটুলস ফ্যাগের নেশায় আটক । মাদকের মাত্রা বাড়িয়ে-বাড়িয়ে ওর স্বাস্হ্য খারাপ করে দিতে হবে । ওর জন্যে আলাদা ফ্যাগ বানাবো ।
মুম্বাইতে যে দুটো ফ্ল্যাট কেনার তোড়জোড় চলছে, তার একটা কুহুর আর একটা আমার নামে কেনার জন্যে রাজি করিয়েছি অতুলকে । ও ভেবেছিল দুটোতেই ও নিজের নাম ঢোকাবে । যখন বললুম, যে ও অতুল দাস না অতুল মুখার্জি না অতুলপ্রসাদ মুখার্জি, কোনটা ? শেষে কেউ কোথা থেকে এসে গোলমাল বাধালে সেই বিপত্তি সামলানো কঠিন হবে । ব্যাস, আর গুঁইগাঁই করেনি । প্রভাদেবী এলাকায় দুটো ফ্ল্যাট আমার আর কুহুর নামেই বুক করে ফিরবে । আমার নাম থাকবে অমুকের কন্যা শ্রীমতী কে মুখার্জি । অতল মরে গেলে তারপরেই পাত্তাড়ি গুটিয়ে মুম্বাই যাবো । মন্দিরচত্তরটা বেচে দিয়ে যাব ; মোটা টাকা পাওয়া যাবে ।
সিগারেট খাওয়াটা আমি ছাড়তে পারিনি । ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনারের পর একটা করে খাই । জামাই কিনে আনে, ফিলটারটিপ বিদেশি । ভালো জামাই পেয়েছি, ঘরজামাই, ওর মা-বাবা নাসিকে বাড়ি করেছে । জামাইয়ের বাবা এচ এ এল-এ ইনজিনিয়ার ।
আজ ত্তত্ব ব্যাপারটিও সংকটমুক্ত নয় । প্রকৃতির জীব মানুষ এত জটিল ও তার কার্যকলাপ এমন ব্যাখ্যাহীন যে, তাকে নিয়ে কোনো সর্বজনীন তত্ব ফাঁদা যায় না । কেবল যে জ্ঞানই অনিশ্চিত, সেটুকুতে থেমে নেই সন্দেহের উপপাদ্য । জ্ঞানের বিভিন্ন আদলকে ও এলাকাকে কীভাবে বৈথতা দেয়া যায়, জ্ঞানের বিষয়বস্তুকে অকৃত্রিম বলে গ্রহণ করা যায় , সেসব সুদূরপ্রসারী প্রশ্ন মাথা চাড়া দিচ্ছে । জ্ঞানতাত্ত্বিক বৈধতার কোনও একটিমাত্র সন্তোষজনক উপায় হিসেবে তো আর কিছু, কোনও চিন্তা-নকশা, অবশিষ্ট নেই । মনোবিশ্লেষণের নিত্যনব ধারণার আঘাতে জর্জরিত বিষয়বস্তুরূপে চেতনা ব্যাপারটি আজ ঘোর সন্দেহে আক্রান্ত । কেউ কি আজ দাবি করতে পারেন যে অমুক বিষয়বস্তুটি স্পষ্টভাবে ও সম্পূর্ণরূপে আমার বোধগম্য ?
‘আমি’ নামক নিবাসটি তো যাবতীয় সমস্যার আগার । তাকে সংজ্ঞায়িত করা অসম্ভব । কতরকম ‘আমি’ যে আছে — সবই অনির্ণেয়, তার ইয়ত্তা নেই ।
প্রথম দিনের লাল শাড়ি-ব্লাউজ-শায়া ভেতরের জামা আমি ফেরত নিয়ে যাইনি । ওগুলো কী করল শিশির ?
আমি শিশিরের প্রেমিকা নই । শিশির আমার প্রেমিক ছিল না । তাহলে আমরা পরস্পরের কী ? আমি শিশিরের দেহটাকে ভালোবেসেছি । শিশির আমার দেহটাকে ভালোবেসেছে । সত্যি কথা বলতে কি, আমরা দুজনে যে-যার নিজেকে ভালবেসেছি । অথচ আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা নই । এরকম কাণ্ড তো সিনেমাতেও সম্ভব নয় । দেখাতেই পারবে না । আমি সত্যিই অপ্সরা, ঝড় দিয়ে গড়া অপ্সরা । আর শিশির হল বরফের মতন ঠান্ডা অন্ধকার দিয়ে গড়া বিশ্বামিত্র ।
সনাতন সমাজে মানুষের পরিচয় ও আত্মপরিচয় ছিল স্হির, অপরিবর্তনীয়, দৃঢ় ও বলিষ্ঠ । সংস্কৃত সাহিত্য, লোককথা, মিথ ইত্যাদি থেকে তা-ই মনে হয় । পূর্বনির্ধারিত সামাজিক ভূমিকা এবং সমাজসংসারে কৌমব্যক্তির স্হান নির্ণয়কারী ধার্মিক ও ঐতিহ্য-বিধিবিধানের বাধানিষেধ ইত্যাদির দ্বারা কেলাসিত হতো তার আত্মপরিচয় । ব্যক্তির চিন্তা ও আচরণকে এই প্রক্রিয়া সারাজীবন নিয়ন্ত্রণ করত । জাত, ধর্ম, ভাষা, গোষ্ঠী তাকে যে কৌমের অন্তর্গত করে রাখত, তার চৌহদ্দিতে সে জীবনযাপন করত । অর্থাৎ জীবন-পরিসরের মর্মার্থ অনিশ্চয়তায় আক্রান্ত হয়নি । সমাজে ও দর্শনে, পরিচয় ও আত্মপরিচয় ছিল সমাধানযোগ্য, বিতর্কবর্জিত ও মীমাংসিত ।
বৌদ্ধধর্মে আত্মপরিচয়কে বলা হয়েছিল অলীক ; ব্যক্তির বাস্তবসত্তা হয় না । রাম, শ্যাম, যদু, মধুর গঠণ হয় তাদের কর্মের কারণে । অদ্বৈত বেদান্ত ও তাওবাদ পুরোপুরি ঐকিকে সীমাবদ্ধ ছিল । এই সমস্ত ধর্মভাবনা, বৌদ্ধবিহার ও আশ্রম থেকে চুঁয়ে-চুঁয়ে সাধারণ কৌমসমাজের স্তরে আত্মপরিচয়কে ব্যক্তির নিজের কাছে সমস্যা হয়ে উঠতে দেয়নি ।
ব্যক্তির আত্মপরিচয়কে আবছা করে তুলতে অভিজ্ঞতার বিশিষ্ট উপাদান হিসেবে উদ্বেগ কবে থেকে স্হান করে নিল, তা নিয়ে অনেক ভেবেছি । কূল;কিনারা পাইনি ।
উল্লসিত হইয়া উঠিল কেকার মুখশ্রী । ঘড়ি দেখিয়া কহিল, সাড়ে সাতটা বাজে, এগারোটায় আসিব । শ্যাম্পু করিয়া , আবছামত লিপস্টিক লাগাইয়া আসিব , সতীত্বের কোনো ফাঁক রাখিব না । গয়নাগাটি কিচ্ছু পরিব না, কেবল খোঁপায় ফুল ও গলায় রুদ্রাক্ষের মালা থাকিবে । তুমি কোথাও যাইবে না , ঘরেই থাকিবে । কথা কয়টি বলিয়া, থলের ভিতর ম্যাডেলিনের কিছু পোশাক ঠুসিয়া লইয়া চলিয়া গেল । কেকা বোধহয় প্রতিদিন নিজের মুখ নতুন করিয়া আয়নায় দেখিতেছে ; এতকাল সে সম্ভবত আয়না-উপোসী রাখিয়াছিল নিজেকে । অন্তত অন্যের চোখে সুন্দরী প্রতিভাত হইবার আকাঙ্খা নবীকরণ করিয়াছে আমার স্পর্শে ও সোহাগে ।
এত ভোরে আগমন , অনুমান করিলাম, সন্দেহ নিরসনের জন্য যে এই ঘরে উহার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী রাত্রিবাস করে না । দখলিস্বত্বের একাগ্র আত্মচর্চায় শরীরকে উত্তপ্ত করিয়া ফেলিয়াছে । প্রতিদ্বন্দ্বী যদি থাকিত তাহা হইলে সেই মেয়েটিকে বোধহয় খুন করিতেও ইতস্তত করিত না কেকা, এমনই চক্রান্তে সে নিজেকে ঘিরিয়া ফেলিয়াছে ।
কোথাও ব্রেকফাস্ট করিতে যাইতে হইলে পোশাক পরো, পথে নামো, রেস্তরাঁয় যাও, অর্ডার দাও, অপেক্ষা করো, ইত্যাদি বহুবিধ প্রক্রিয়া । কেকার আনা স্বাস্হ্যবর্ধক ব্রেকফাস্ট করিয়া, এই ডায়েরি এই পর্যন্ত লিখিয়া ঘুমাইয়া পড়িলাম ।
খুটখাট শব্দে ঘুম ভাঙিতে দেখি কেকা, সবুজ শাড়ি-ব্লাউজ পাট করিয়া খাটের উপর রাখিয়া নগ্ন অবস্হায় গ্লাস, সোডা, কাবাব, চানাচুর সাজাইয়া বসিয়া আছে । চক্ষু মেলিয়াছি দেখিয়া কহিল, সিঁড়ির দরজায় তালা দিয়াছি, রাতের জন্য ফ্রায়েড রাইস ও মাংস আনিয়াছি ; কোন বোতলটি খুলিব ?
তোমার তো মদ্যপানের প্রথম দিন , রাম সহযোগে লেমোনেড পান করো, প্রস্তাব দিলাম । এক চোঁয়ে গ্লাস খালি করিয়া কেকা বিস্ময় প্রকাশ করিল, কই কিছু হইতেছে না তো , ইহার তুলনায় ছিলিমের নেশা অনেক দ্রুত মস্তিষ্কে ঘোর তোলে । পুনরায় এক-এক পেগ লইলাম । মদের স্বাদগন্ধে অভ্যাস নাই বলিয়া, অধিকাংশ চানাচুর ও কাবাব সে-ই খাইল । কিয়ৎক্ষণ পর নেশাচ্ছন্ন কন্ঠে কেকা কহিল, আমি বাঘিনী, আমার বাঘ আমাকে খাউক, হালুম, হালুম ; না আমি ঠগিনী আর তুমি আমার ঠগ, কেমন ঠকাচ্ছি নিজেদের, কেউ কিচ্ছুটি জানতে পারছে না, বলিতে-বলিতে আমার উপর ঝাঁপাইয়া পড়িল ।
মাতাল রমণীর পক্ষে বাঘের আঙ্গিক সম্ভব ছিল না । পোশাকমুক্ত হইয়া আমি তাহাকে শক্ত আলিঙ্গনে লইলাম । বলিলাম, অক্টোপাস সামুদ্রিক প্রাণির কথা জানো ? আমি অষ্টভূজা অক্টোপাস হইয়া তোমাকে পিষিয়া নিজের সহিত একাত্ম করিব । সে কহিল, আরও জোরে, আরো জোরে, হাড়-পাঁজর ভাঙিয়া দাও , চুলের মুঠি ধরিয়া টানো, যত্রতত্র দাঁতের দাগ বসাও, লিপ্সটিক লেহন করিয়া লও, আইস, শিশির, অবোধ-শিশু, তুমি কোথায়, আইস, আট হাতের ঝড়ে বেষ্টন করিয়া চুরমার করিয়া ফ্যালো, ধ্বংস করিয়া ফ্যালো আমাকে, আট-হাতের আকাটপেষণ, আইস, ব্র্হ্মরন্ধ্র পর্যন্ত তোমার বিষ বিছাইয়া দাও ।
এই সময় তৃতীয় কোনো ব্যক্তি আমদের দেখিলে অক্টোপাসই মনে করিত, মানুষের দুই হাত ও দুই পা যুক্ত একটি মানব-অক্টোপাস, যাহার দ্বৈত বোধ ছড়াইয়া পড়িতেছে দুই দায়-দায়িত্বহীন মানুষ-মানুষীর কর্মকাণ্ডে । অন্যের দেহের তাপের জন্য আমরা দুইজনেই লালায়িত । আরেকজন জড়াইয়া ধরিয়া থাকুক, ইহাই প্রধান চাহিদা ; সেই সূত্রে যৌনকর্ম ঘটিয়া যাওয়া তত গুরুত্বপূর্ণ নহে ; প্রাণীজগতে জড়াইয়া ধরিয়া আদর আদানপ্রদান করিবার সুযোগ-সুবিধা প্রকৃতি তাবৎ জীবকে দেয় নাই ।
ফোরপ্লে করিয়া বুঝিলাম দেহ ভালোই সাড়া দিতেছে । অবচেতনে যে ইচ্ছাগুলি সে ঝিমকিনি অবস্হায় প্রকাশ করিয়াছে , তাহা চেতনা না ফিরিলে পূরণ করা বৃথা । গতানুগতিক আবাথাবা প্রথা অবলম্বন করিয়া, ঘন্টাখানেক পরে কেকা প্রকৃতিস্হ হইলে, দুইজনে আহার করিবার সময় উহার প্রলাপোক্তিগুলি ফাঁস করিলে কেকা দাবি জানাইল যে অদ্যই, যাইবার পূর্বে, উহা পূরণ করিতে হইবে । বুঝিতে পারিলাম যে জীবনের একটি পর্ব ফুরাইয়া যাইতে চলিয়াছে বলিয়া কেকা গোপন দুঃখে আক্রান্ত হইয়াছে ।
কিয়ৎক্ষণ পর এলোকেশ দুইহাতে ফাঁপাইয়া, মৎস্যকুমারীর ভঙ্গীতে পায়ের গোছের উপর পা রাখিয়া বলিল, আমার ঠোঁট দেখিতেছ, গাল দেখিতেছ, আমি মধুবালা । তুলনা এইখানেই শেষ হইল না ; অকস্মাৎ উচ্চস্বরে গাহিয়া উঠিল, পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া, পেয়ার কিয়া কোই চোরি নহিঁ কি, ছুপছুপ আহেঁ ভরনা কেয়া , পেয়ার কিয়া তো…
কন্ঠস্বরটি মধুর, সঙ্গীতশিক্ষকের নিকট নিয়মিত তালিম লইলে গায়িকার মর্যাদা পাইত । কন্ঠস্বর উচ্চগপঅমে উঠিতেছিল বলিয়ে মুখ চাপিয়া ধরিলাম । দ্বিতলের ভাড়াটেগণ শুনিতে পাইলেও ক্ষটি নাই, কিন্তু অন্যান্য বাড়ির হিন্দিভাষী প্রতিবেশিগণ শুনিতে পাইলে কেলেঙ্কারি । এতদঞ্চলের প্রতিবেশিগণের অন্তঃকলহকে প্রাণবন্ত রাখিবার জন্য গায়ে-গা বাড়ি ।
মুখে হাত-চাপা অবস্হাতেই কেকা কহিল, মুখ বাঁথিয়া দাঁতের কামড় দাও, এইখানে, এইখানে, বলিয়া বুক, উরু, নিতম্ব, কাঁধ, গাল, ঠোঁট নির্দেশ করিতে লাগিল । চকিতে মনে হইল, প্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের প্রহারের প্রতিশোধ এই প্রক্রিয়ায় লইতেছে নাকি এই নারী , যে কেবল নিজেকে ভালোবাসিয়াছে , অন্য পুরুষের আয়ত্বে নিজেকে সঁপিয়াছে নিজেকে ভালোবাসিবার উপায় হিসাবে । কিন্তু প্রসন্ন নামটি এই পরিবেশে, সম্পর্কে, ট্যাবু ; তাহা উথ্থাপনই আত্মঘাতী । সম্পর্ক শব্দটি লিখিয়া আশ্চর্য লাগিল । কী সম্পর্ক এই নারীর সহিত ? মস্তিষ্কের ভিতরে একটি গহ্বর তৈরি করিয়া চলিয়া যাইবে, এমনই এই মানবিক সম্পর্ক, সমাজের বাহিরে, লোকচক্ষুর অগোচরে । দৈহিক স্বাধীনতার সুখে সে নিজেকে ভালোবাসিতে আরম্ভ করিয়াছে , এবং আমার ফাঁকা আলিঙ্গনকে ভরাট করিতেছে । করুক, করুক ।
অন্যত্র কেহ দেখিতে পাইবে না, কিন্তু ঠোঁট ও গালের দাগ দৃষ্টি আকর্ষণ করিবে , মুখ হইতে হাত সরাইয়া আমি এভাবে নিরস্ত করিতে চাহিলে কেকা বলিল, তোমায় ওসব চিন্তা করিতে হইবে না , আমার দেহ আমি বুঝিব । আমার দেহে কে কবে আঁচড়-কামড় দিল তাহার জন্য অন্য লোকের মাথা ঘামাইবার প্রয়োজন নাই ; তোমাকে আদেশ করিয়াছি, অনুরোধ করি নাই ।
প্রসঙ্গ ভিন্নপথে ঘুরাইবার জন্য আমি প্রস্তাব দিলাম, আমরা রাজকাপুর-নার্গিসের আর-কে ব্যানার আঙ্গিক অবলম্বন করিব । উছলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল কেকা ; বলিল, আমার দৃষ্টি লক্ষ করো, উহা নার্গিসের ন্যায় মাদকতাপূর্ণ ; কল্য পাতলা করিয়া কাজল পরিয়া আসিব । দম ভর যু উধর মু ফেরে, এককলি গাহিয়া সংযত হইল । হিন্দি ফিল্মসমূহের বায়বীয় চরিত্রগুলির ভিতর প্রবেশ করিয়া নিজের একটি প্রথক সত্তা গড়িয়া তোলে কেকা , এবং এই সত্তাটির রহস্য সে উপভোগ করে ।
যাইবার সময়ে থলে হইতে অঢেল পেস্তা, আখরোট, আঞ্জির, খোবালি, কাগজি বাদাম, কাজু, কিসমিস তোষকে উপুড় করিয়া কেকা কহিল, ফুরাইলে আরও আনিব ; দেওয়ালিতে যজমানগণ আমার ধর্মপরায়ণা পদপ্রান্তে রাখিয়া যায় । তুমি ভক্ষণ করিয়া দেহকে সুস্হ-সবল রাখিবে । কল্য দশটায় আসিয়া সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত থাকিব, কোনকোন ক্রীড়ায় লিপ্ত হইব, তাহা পরিকল্পনা করিয়া রাখিও ।
পরের দিন দশটা বাজিয়া গেলে, নিজের উৎকন্ঠার সহিত পরিচয়ে আশ্চর্য বোধ করিলাম যে কেকার অপেক্ষায় আমি উদগ্রীব । কেন ? ম্যাডেলিনের ক্ষত তো দূরীভূত হয় নাই । ভালোবাসা হইতে দেহের দিকে নাকি দেহ ইতে ভালোবাসার দিকে— এই দুই নারী আমাকে একটি হলাহলের স্বরূপের সহিত পরিচয় করাইয়া দিল । কতগুলি শিশির দত্তকে আমার অস্তিত্বে পুষিতেছি জানি না ।
রাস্তায় নেড়েদের জুলুস বেরিয়েছিল বলে শিসিরের ঘরে পৌঁছোতে আমার দেরি হয়ে গিয়েছিল সেদিন । ইহুদিরা নাকি মাত্র ছ’দিন যুদ্ধ করে নেড়েদের দেশের অনেকটা জায়গা-জমি দখল করে নিয়েছিল ; সেসব আর ছাড়বার নাম নেই । বেশ লেগেছিল শুনে । আমরা মন্দিরচত্ত্বর দখল করে নিয়েছি আর ওরা একটা দেশের অনেক জমি-জায়গা খামচে-খামচে নিয়ে নিয়েছে । যাদের জায়গাজমি দখল করেছিল তাদেই নাকি সেসব মোটা দামে বেচবে ।
শিশির আমার জন্যে অপেক্ষা করত জেনে এই লাইনগুলো অনেকবার পড়েছি ; ভিজিয়ে-দেয়া কথাবাত্রা । কয়েকটা কারণে রাগও হয়েছে । ম্যাডেলিন করিয়েটকে সাবান মাখিয়ে চান করিয়েছে অথচ আমাকে করায়নি। বাথরুমে দৈত্যকন্যাকে চান করাবার সময়ে কী-কী করেছে তা-ও লেখেনি । ও তো আর ওই দানবকন্যার দেহ পাঁজাকোলা করে তুলতে পারেনি, যেমনটা আমায় তুলত । দানবকন্যাই ওকে তুলে ক্যারদানি-কসরতগুলো শিখিয়েছে । ইংরিজিতে বলিয়ে-কইয়ে হবার পুরো ফায়দা লুটেছে কামুকটা ।
আর কী স্বপ্ন দেখেছে ও ? মোগল দরবারে পরি হয়ে উড়ছে ম্যাডেলিন ! তুই বাদলা পোকার মতন টুসকি মেরে ডানা খসিয়ে লুফে নিলে পারতিস তো । জাহাঙ্গিরের বউ নিশ্চয়ই ম্যাডেলিনের চেয়ে হাজারগুণ সুন্দরী ছিল আর ফরসাও ছিল গোলাপিহলুদ। তবে ?
আতুলতো প্রায় বলতেই জানে না ইংরিজি ; তা সত্ত্বেও হিপিনি দেখলেই কীভাবে জাল বেছায় জানি না । জালে আটকেও যেত কেউ কেউ । শিশিরের লেখা পড়ে বুঝতে পারছি যে জাল না বিছিয়েও কাজ হাসিল হয়েছে ।
নির্মল-প্রণবরা বেনারসি ইংরিজি বলত । ওদের সুবিধা ছিল যে ওরা চিত্রশিল্পী । পুলিশের ধরপাকড়ের ভয়ে উপেন সর্দার পাটনায় গিয়ে রঙিন মাছের দোকান খুলেছিল ; তারপর বউবাচ্চা নিয়ে চলে গেছে দিল্লি । প্রণব একজন আমেরিকান বিয়ে করে চলে গিয়েছিলো, এখন শুনি একজন জার্মান মহিলার সঙ্গে দিল্লিতে থাকে । উল্লাসকে ধরে নিয়ে গিয়ে খুন করে দিয়েছে কলকাতার পুলিশ। আমি বেনারস ছাড়ার সময় ওরা কেউই ফেরেনি।
নকশাল আন্দোলন নিয়ে কত হ্যাঙ্গাম হয়েছিল , অথচ কিছুই তো হল না । কং নকশালবাড়ি গ্রামটায় গিয়েছিল, কোনো সিরিয়ালের শুটিং করতে । ফিরে এসে বলেছিল, কালো পাথরের থামে চারটে মূর্তি আর একটা নোংরা কাদামাখা শ্বেতপাথরে দশবারোজন শহিদের নাম লেখা । বাংলাদেশিরা রোজ লুকিয়ে-চুরিয়ে ঢুকে-ঢুকে, যারা আন্দোলন করেছিল সেসব বাড়ির লোকজনকে এলাকাছাড়া করেছে । কে জানে, তারা হয়তো কলকাতার কোনো বন্ধ কারখানার গেটে দাঁড়িয়ে আন্দোলন করে এখন ।
কী লিখব বলে ভেবে কী সব আবোল তাবোল লিখছি ; ছবি আঁকিয়েদের মতন হয়ে গেছে কলমখানা, নিজেই নিজের ভাবনা লিখে চলেছে । যখন বেনারস ছাড়ি, কাশী-বেনারস একেবারে বদলে গিয়েছে । বাড়ির বাইরে টুকটাক চুমু খেতে দেখলে বজরং দলের পালোয়ানরা আস্ত রাখবে না । নেড়ে পাড়ায় বোরখা পরে না গেলে মেয়েরা হেনস্হার একশেষ হবে ।
হলুদ-বেগুনি ফুল-আঁকা শাড়ি, স্লিভলেস হলুদ ব্লাউজ, উপরদিনে যুঁইফুল জড়ানো ফাঁপানো খোঁপা, চোখে কাজল, ঢোঁটে গল্সি লিপ্সটিক, কেকা এগারটা নাগাদ ঘরে প্রবেশ করিয়া গাহিয়া উঠিল, আজা, আআআ আজা, আব তো আজা, আআআ আজা, আবতো আ, আজা পেয়ার মেরা…। গান থামাইয়া, মেঝেয় থলে নামাইয়া কহিল, অদ্য আমি আশা পারেখ । আইস, আমরা কলেজ ছাত্রছাত্রীর ন্যায় পোশাক ত্যাগ না করিয়াই দ্রুত মিলিত হই ।
আমাকে জড়াইয়া নিজে দেয়ালে পিঠ দিয়া দাঁড়াইতে, বুঝিলাম সিগারেট ফুঁকিয়া আসিয়াছে । হয়ত আমার মুখে গন্ধের প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হইল, যাহা দেখিয়া কেকা মন্তব্য করিল, তোমার মনে ভয়, অথচ দেহ অকুতোভয়, এইরূপ কেন ? ভয় পাইবার কথা তো আমার !
মনে যে ভয় নাই তাহা অকুতোভয় দেহ দ্বারা অতিদ্রুত প্রমাণ করিয়া মুদ্রিতচক্ষু কেকাকে বলিলাম, আমি একটি খাতায় কাশীবাসের স্মৃতি লিখিতেছি । শুনিয়া, দপ করিয়া ভাস্বর চোখ মেলিল রুদ্রাক্ষ মালাধারিণী কেকা, মুখমণ্ডলে আতঙ্কমিশ্রিত বিচলন ছড়াইয়া পড়িয়াছে । শুধাইল, আমার কথাও লিখিতেছ ? প্রতিদিন যাহা করিতেছি সব সব সব ?
শক্ত আলিঙ্গনে আবদ্ধ রাখিয়া যখন বলিলাম, হ্যাঁ, সব, কিন্তু চিন্তা করিও না , একটি বন্ধ প্যাকেটে উহা উপহার দিয়া যাইব, কখনও সময় হইলে পড়িও ; উহা তোমার পক্ষে যতটা বিস্ফোরক, ততটা আমারও ।
আশ্বস্ত হইল কেকা, দ্বিধা-সংশয় ব্যক্ত করিল, না বাবা, আমি লইয়া কী করিব, কোথায় রাখিব ! বলিয়াই , সম্ভবত অনুধাবন করিল যে অন্যের হাতে পড়িলে ভয়ংকর বিপদ ঘটিতে পারে ; তাহার চেয়ে উহা নিজের নিয়ন্ত্রণে লওয়া শ্রেয় , সুযোগ বুঝিলে সংরক্ষণ করিয়া নিরালায় পাঠ করা যাইবে ; বিপদাশঙ্কা ঘটিলে খাম ছিঁড়িয়া মন্দির চত্ত্বরের কুয়ায় বিসর্জন দেয়া যাইবে । বলিল, ঠিক আছে, দিও, শেষ দিন শেষ শিশিরফোঁটাগুলি ও স্মৃতিকথাটি দিও , সযত্নে রাখিব ।
সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় ছিল বলিয়া সোডা সহযোগে ভোদকা পান করিয়া নিজেকে উদ্দাম করিয়া তুলিল কেকা । প্রণয় নিবেদনের গানের যে কলিগুলি মাছভাত খাইতে-খাইতে গাহিল, তাহা কোনও না কোনো হিন্দি ফিল্মের । এটি লিখিতে বসিয়া স্মৃতি হাতড়াইতেছি , লাইনগুলির সুর মনে পড়িতেছে, কথাগুলি মনে নাই । এমনকী সিংহ আঙ্গিকে সংসর্গের সময়ও গাহিতেছিল । সিংহ সংসর্গ বাঘ হইতে পৃথক ; সিংহকে একটি সিংহিদলের দায় লইতে হয় ; বাঘ কেবল এক সময়ে একজন বাঘিনীর । আমার পালে দুইটি সিংহী লইয়া প্রেমের সমগ্র সাভানাভূমি আয়ত্ব করিয়া ফেলিয়াছি ।
যাইবার দিন পর্যন্ত এইরূপই চলিল প্রতিদিন । আমার স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন যত নিকটতর হইতেছে , ততই তাহার আনন্দ উথলিয়া উঠিতেছে । আসিয়া এমন জোরাজুরি করিতেছে , যেন আমাকে সম্পূর্ণ নিংড়াইয়া লইবে । কুমকুম, মীনাকুমারী, শ্যামা, শাকিলারূপে ঘরে অবতীর্ণ হইয়াছে । একদিন স্তম্ভিত করিয়াছে পোশাক পরিত্যাগ করিয়া টু-পিস বিকিনিতে তোষকের উপর নর্তকীর ন্যায় অঙ্গভঙ্গী প্রকাশিয়া, যখন নিজেকে শর্মিলা ঠাকুররূপে ঘোষণা করিল । আমার বিস্মিত চাউনির প্রতি এইভাবে ব্যাখ্যা দিয়াছে , এই ইজের ও বডিস জোসেফিনের, সে পরার সুযোগ পায় নাই , প্যাকের ভিতর আনকোরা ছিল । স্পষ্টতই জোসেফিনের বুকের তুলনায় কেকার বুক ছোট ।
বিকিনি জিনিসটি ভারতের বাজারে এখনও আসে নাই । আসিলে নারীকে আমরা নবতর একটি কমনীয় নমনীয় বিস্ময়বাহী প্রাণীরূপে সমাদর করিব ।
আমার ভিতর যতগুলি শিশির দত্ত রহিয়াছে, মনে হইল, কেকার ভিতর তাহার বহুগুণ অধিক কেকা বিরাজ করিতেছে । প্রসন্নর প্রেমিকা কেকা, প্রসন্নর প্রহারে বিদ্রোহী কেকা, অতুলকে আঁকড়াইয়া মা হইবার প্রয়াসী কেকা, গৃহত্যাগী কেকা, শিবমন্দিরের পূজারিণি কেকা, ভক্তবৃন্দের শোষণকারিণি কেকা , বাড়িউলি কেকা, মাদক প্রস্তুতকারিণী কেকা, বৈভব সঞ্চয়প্রয়াসিনী কেকা, অতুলের রক্ষিতা হইয়াও না থাকা কেকা, টিপ সিঁদুর আলতা নোয়া পরিহিতা সতীসাধ্বী কেকা, উদ্দাম যৌনতায় আক্রান্ত কেকা, মদ্যপানে বেপরোয়া কেকা, সিগারেটপায়ী কেকা , যৌনসঙ্গীর প্রতি মমতাময়ী কেকা, যৌনসঙ্গীর অবর্তমান সঙ্গিনী সম্পর্কে ঈর্ষান্বিত কেকা এবং আরও গোপন কেকা হয়ত আছে যাহা আমার অজ্ঞাত । রক্তমাংসে গড়া আমরা দুইজন বায়বীয় আত্মপরিচয়ের বাহক ।
ম্যাডেলিনের সমস্ত পোশাক ভিখারিদের বিতরণ সমাধা হইলে, ফ্যান বিজলি-উনোন ও বিয়ার বোতলগুলিও একে-একে বিক্রয় করিয়া ঘরটিকে নিজস্ব শূন্যতা দ্বারা ভরাট করিয়াছে কেকা । সেই শূন্যতায় আছে কেবল গন্ধের সঙ্গীত ; রহস্যময়ী নারীর জিভের ঠোঁটের বুকের পাছার যোনির বাহুমূলের হাতের চেটোর গোড়ালির গন্ধের সঙ্গীত ।
ভিন্ন-ভিন্ন রূপগ্রহণকারিণী কেকা আমাকে মনে রাখিবে কিনা জানি না । কখনও আমার এই টুকরো-করা রচনা পড়িলে দুইজনে যে উনিশটি দিন একত্রে অতিবাহিত করিলাম, তাহা উহার স্মৃতিগহ্বরে আনন্দ বা গ্লানির ঘুর্ণি লইয়া জাগিয়া উঠিবে , হয়ত জলস্তম্ভের ন্যায় পাকাইয়া তুলিয়া দিবে অতীতের জটিলতাগুলিতে । উহার গঙ্গা-স্নান সিক্ত আগমনের পূর্বে কাশীতে আমার কার্যকলাপ পড়িয়া, আমি নিশ্চিত, একযোগে ক্ষুব্ধ বিস্মিত ঈর্ষান্বিত ও উদাসীন একাকীত্বে নিক্ষিপ্ত হইবে ।
ডাকিয়াছিল অতুল, অথচ উহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে পারিলাম না । অতুল ও কেকার সহিত আর কখনও দেখা হইবে না , কেননা কাশীতে পুনরায় আসিব না । পরস্পরের ঠিকানা লওয়া হয় নাই বলিয়া ম্যাডেলিন করিয়েটের সহিত সাক্ষাতের সম্ভাবনা নাই । গেরিলা পেইনটার্স গোষ্ঠীর সদস্যগণ পশ্চিমবঙ্গ ব্যতীত অন্যান্য রাজ্যে পলাইয়াছে ; তাহাদের কারোর সহিত ভবিষ্যতে কোনও শহরে আকস্মিক মুখোমুখি হইতে পারি ।
কল্যই শেষদিন । কেকা ঘরে প্রবেশ করিলে তৎক্ষণাৎ এই স্মৃতিকাহন ও অতুলের লিখিত পোস্টকার্ডটি উহার হস্তে অর্পণ করিব , নয়ত ভুলিয়া যাইতে পারি ।
নির্মল রক্ষিতের বাবার এই বাঁধানো খাতাটা, যাকে শিশির কখনও বলছে ওনার জার্নাল আর কখনও ডায়েরি, শেষদিন একটা খামে ভরে দিয়ে দিয়েছিল বলে, ওই দিনকার ব্যাপার-স্যাপার লেখার সুযোগ-সময় ও পায়নি । এতদিন পর যা মনে পড়ছে লিখছি । তাছাড়া আমারও নিজের কিছু কথা বলার আছে । অতুল মরে আপদ গেছে । লিখে, ওরই তোরঙ্গে রেখে দেব খাতাটা । এখন আর ভয়-ফয় করি না কাউকে ; কখনও করেছিলাম বলে তো মনে হয় না । ভয় জিনিসটায় গান নেই, সঙ্গীত নেই, অন্ধকারময় । যা প্রকাশ্যে করা যায় না তাকেই তো ভয় পাবার কথা। আমার জীবনকে আমি চুবিয়ে নিয়েছি আলোয়-গানে-সঙ্গীতে ।
শেষদিন আমি বৈজবন্তীমালা সেজে গিয়েছিলুম । ঘরে ঢুকে গেয়েছিলুম, হোঁঠোপে অ্যায়সি বাত ম্যায় দাবাকে চলি আয়ি, খুল যায়ে ওয়হি বাত তো দুহাই হ্যায় দুহাই । অকূলকান্ডারী শিশু, বোকা-গঙ্গারাম, জানতে চাইল না যে সেইরহস্যটা কী !
ও যাকে বলে মিশনারি আঙ্গিক, আমরা সেই অলছ-তলছ কায়দায় খানিক কাদায় ঘামা রাক্ষুসে মাগুর সাজলুম । খানিক শালিক পাখির দ্বৈরথ । হিমসিমের মণ্ডামেঠাই খেয়ে খানিক জিরোবার পর ওকে আমি বললুম , চলো তোমায় বেনারস শহরটা দেখাই , তোমার তো তীর্থক্ষেত্র দেখাই হল না , আর মোগরসরাই রওনা দেবে তো চারটেতে ।
আমি সারাদিনের জন্যে একটা টাঙ্গা ভাড়া করলুম । আমার উদ্দেশ্য ছিল কাশী-বিশ্বনাথ ঘুরে অতুলের পরিচিত কয়েকজনের বাসায় ঢুঁ মারা , যাতে অতুল শুধু একজনকেই সন্দেহ করে । অতুল আমার কোলে ওর বাচ্চা কংকে ধরিয়েছে ; আমি ওর কোলে শিশিরের বাচ্চা বংকে ধরাব ।
কাশী-বিশ্বনাথে আমার জীবনের প্রথম সত্যিকার পুজো দিয়ে, পুরুতকে বলেছিলুম, আমরা দত্ত দম্পতি । গলি থেকে বাইরে বেরিয়ে ভাত-লস্যি খেলুম । গলিতে মুখচেনা কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হয়ে ভালই হল । তারপর এক-এক করে গেলুম গেরিলা পেইনটার্সদের বাড়ি । তখনই জানলুম, উল্লাসকে কলকাতা পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে খুন করেছে , আর বাদবাকি সবাই গা-ঢাকা দিয়েছে । সবায়ের আত্মীয়স্বজনের চোখমুখ থমথমে ।
উল্লসের বাবা বললেন, ওদের গেরিলা পেইনটার্সের হ্যাপেনিং আসলে ছিল রাতদুপুরে নকশালদের সভা । শুনে, মুখ চুপসে গেল শিশিরের । ও বোধহয় ভেবেছিল হইচই ধরণের আনন্দ । ম্যাডেলিনকে ধন্যবাদ দিই যে শিশিরকে বাঁচিয়ে নিজে টাকনা দিয়ে খেয়েছে, আর আমার জন্যে অক্ষত রেখে গেছে, শিখিয়ে-পড়িয়ে তৈরি করে দিয়ে গেছে ।
লোকাল ছাত্ররা কেউ-কেউ অতুলকে আমাকে চেনে বলে হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্ত্বরটা খানিক ঘুরে বানোয়ারি গুপ্তার বাড়ি গিয়ে ম্যাডেলিনের ছাদের চাবি দিয়ে দিলুম গুপ্তাজির বউকে । শিশুকে দেখিয়ে বললুম, অতুলের আত্মীয় , ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে, যাতে বুঝতে পারে যে শিশির মোটেই আমার আত্মীয় নয় । গুপ্তাজির বউ ফেরত-হাসি হাসল । বেশ, অন্তরটিপুনি কেউ না কেউ তো ফাঁস করবে ।
ম্যাডেলিন ট্রেনের টয়লেটে শিশিরকে টেনে নিয়ে গিয়ে কাঁদো-কাঁদো বিদায় জানিয়েছিল । আমি টাঙ্গায় বসে শিশুকে জড়িয়ে ধরলুম, রাস্তা-জোড়া লোকের সামনে । এত আনন্দ আমার আর কখনও হয়নি । ওকে মাত্র ক’দিন পেয়ে, ব্যবহার করে, আমি আমার বাকি জীবনটা নিজের নিয়ন্ত্রণে করে ফেললুম ।
গায়নাকের কাছে অতুলকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলুম । ছেলে হবে শুনে সেই যে ভাঙাস্বাস্হ্য ডিপ্রেশানের খোলসে অতুল ঢুকল, তা থেকে ওকে বেরোতে দিইনি আমত্যু । আমি ভেবে রেখেছিলুম যে ছেলে হলে নাম রাখব বং । বম্বে এসে আশ্চর্য হলুম শুনে যে ওর স্কুলের বন্ধুরা ওকে বং বলে ডাকে । আসলে বাঙালিদের অবাঙালিরা বলে বং । আমার নতুন নামকরণ হল কং-বং এর মা।
অতুলের শ্রাদ্ধতে আমি একশো ব্রাহ্মণ আর দুশো কাঙালি খাইয়েছিলুম । মন্দিরচত্ত্বর জুড়ে শাদা ফুল আর শাদা শামিয়ানা । লোকদেখানোপনার কোনও কসুর রাখিনি । মুখও এমন করে রেখেছিলুম যান মাদার ইনডিয়ার নার্গিস ।
মন্দির আর চত্ত্বরটার দখলিসত্ত্ব বেচতে সাহায্য করেছিল বানোয়ারি গুপ্তা । ও-ই বলল যে, একা মেয়েমানুষ আমি, অতুলের অবর্তমানে, সামলাতে পারব না এতবড় দেবোত্তর সম্পত্তি, কেন না বেনারসের উঠতি মাফিয়াদের অনেকের নজরে আছে সম্পত্তিটা । তার কারণ এ–রাজ্য তো কাতলা-মারার দেশ হয়ে গেছে ।
বিক্রি হয়ে গেলে, ব্যাংকগুলো থেকে টাকাকড়ি ঝেড়েমুছে তুলে, সবাই মিলে চলে এলুম বম্বে । পাশের ফ্ল্যাটটা ভাড়া দিয়ে আরামে কেটে গেল জীবন । নির্মলের বাবার বাঁধানো খাতার মধ্যে অতীতকে ঢুকিয়ে রেখে দিচ্ছি । যদি কেউ কখনও পড়ে, আমার পরিবারের কেউ, তাহলে ওই অতীতরহস্য তাকেই বিষদাঁতে আক্রমণ করবে , আমাকে নয় ।
শিশির যে গিটারটা সঙ্গে এনেছিল, সেটা নির্মলের বাড়ি গিয়ে চেয়ে নিয়ে এসেছিলুম । আমার ঘরের দেয়ালে টাঙিয়ে রেখেছি । কাউকে হাত দিতে দিই না । শিশিরের ছেলেকেও নয় ।
ইন্দিরা : তাহলে ?
সুবীর : তাহলে কী ?
ইন্দিরা : দুটো অপশান আছে । আমাদের বিয়ের আগে, এই স্মৃতিকথা, এখনই গিয়ে ওরলির সমুদ্রে বিসর্জন দেয়া । কিংবা বিয়ের পর, এটাকে চুপচাপ স্বস্হানে রেখে দেয়া ।
সুবীর : দ্বিতীয় অপশানটাই প্রেফারেবল । আমাদের ছেলেমেয়ে হলে তাদেরও তো জানা দরকার যে তাদের শরীরে প্রেমিক-প্রেমিকাদের রক্তবীজ বোনা আছে । তাছাড়া আমরা দু’জনে এক নতুন মানবপ্রজাতির জন্ম দিতে চলেছি।