এইবার কাহিনি মুখ ফেরাবে কলকাতার দিকে। বর্ধমানে মঞ্চ প্রস্তুত। আবির্ভূত হবেন দক্ষিণারঞ্জন। তিনি এখনও রাজা হননি। কলকাতার উচ্চ আদালতে আইন ব্যবসা শুরু করেছেন। আগেই বলা হয়েছে ছাত্র অবস্থায় তাঁর বিবাহ হয়েছিল হরচন্দ্র ঠাকুরের সুন্দরী কন্যা জ্ঞানদাসুন্দরীর সঙ্গে। তাঁর একটি মাত্র কন্যাসন্তান মুক্তকেশী। এই মেয়েটি হওয়ার পরই জ্ঞানদাসুন্দরীর মাথা খারাপ হয়ে গেল। দক্ষিণারঞ্জনের দাম্পত্য জীবন খুবই দুঃখের। ওদিকে বর্ধমানে আর একটি মেয়ের জীবনও তথৈবচ। তাঁর নাম মহারানি বসন্তকুমারী। পিতা পরাণবাবুর লোভের বলি। বৃদ্ধ রাজার কাছে মেয়েটিকে সমর্পণ করে ছেলের ভবিষ্যৎ তৈরি করলেন। যুবতী বসন্তকুমারীর কী হল তা দেখার দরকার নেই। বৃদ্ধ রাজা প্রয়াত, বসন্তকুমারীর জীবনে কিছুই জুটল না। বর্ধমানে বসন্তপঞ্চমীতে সেইসময় বিরাট উৎসব হত। এখনও হয়। বহু বড় বড় মানুষ নিমন্ত্রিত হতেন। একটি উৎসবে দক্ষিণারঞ্জনও নিমন্ত্রিত হলেন। তিনি সাদরে সেই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে কিছুদিনের জন্য বর্ধমানে গেলেন। মহাতাব চাঁদ তখনও সাবালক হননি। রাজকার্য চালাচ্ছেন কমলকুমারী আর তাঁর কুখ্যাত ভ্রাতা পরাণবাবু। বলা যায় পরাণবাবুই রাজা। দক্ষিণারঞ্জনের জীবনীকার মন্মথনাথ ঘোষ লিখছেন, মহারানি বসন্তকুমারী বিষয়ী পিতার স্বার্থসিদ্ধির জন্য নামে দুইদিনের জন্য মহারানি হইলেন বটে কিন্তু তাঁহার ন্যায় দুঃখিনী আর কে ছিল। আইনজ্ঞ দক্ষিণারঞ্জনের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই প্রেম। বসন্তকুমারী অতি সুন্দরী। দক্ষিণারঞ্জনও কিছু কম যান না। জীবনীকার লিখছেন, তেজচন্দ্র বসন্তকুমারীর নামে কিছু সম্পত্তি রাখিয়া গিয়াছিলেন। কিন্তু সেই বিষয়ের উপস্বত্বও তিনি ভোগ করিতে পাইতেন না। দক্ষিণারঞ্জনকে সদর আদালতের উঁকিল জানিয়া মহারানি বসন্তকুমারী তাঁহার সহিত গোপনে বিষয় উদ্ধারের পরামর্শ করিলেন। স্থির হইল, মহারানি বসন্তকুমারী কলিকাতায় আগমন করিয়া বিষয়ের জন্য সদর আদালতে আবেদন করিবেন। মহারানি কমলকুমারী তখন বর্ধমানের সর্বময়ী কত্রী। তিনি বসন্তকুমারীর সঙ্কল্পের কথা জানিতে পারিলে অনর্থ ঘটিবে এইজন্য মহারানী বসন্তকুমারী গোপনে দুইজন বিশ্বস্তা দাসী ও একজন পুরুষ আত্মীয় সমভিব্যাহারে বর্ধমান পরিত্যাগ করিলেন।
দক্ষিণারঞ্জনের শত্রুর অভাব ছিল না। এবং তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রু ছিলেন টমাস এডওয়ার্ডস। তিনি ডিরোজিওর জীবনী লিখেছিলেন। বসন্তকুমারী ও দক্ষিণারঞ্জনের মধ্যে গভীর একটি প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল এই উৎসবের রাতেই। দুজনের মধ্যে বিষয়সম্পত্তি সম্পর্কে আলোচনাও হয়েছিল। সেই রাতের পর ঘন ঘন দেখা সাক্ষাৎ হওয়াও স্বাভাবিক। আর লোকমুখে সেটি পল্লবিত হয়েছিল। রাজবাড়ির মুচমুচে কুৎসা হিসেবে, ছোটরানির প্রেম। দক্ষিণারঞ্জন ধোয়া তুলসীপাতা ছিলেন না। আবার একজন জঘন্য চরিত্রহীন মানুষও নন। তাঁর শরীরেও বনেদি রাজরক্ত। এই টমাস সাহেব দক্ষিণারঞ্জনের। এই পর্বটিকে যেভাবে চিত্রিত করেছেন তার মধ্যে সত্যের চেয়ে মিথ্যাই বেশি। তিনি একটি সুযোগ নিয়ে সম্পূর্ণ বাজারে কাহিনি পরিবেশন করে গেছেন। সেই কাহিনিটির অনুবাদ এইরকম: মহারানি বসন্তকুমারী অতি অল্প বয়সে বিধবা ও লিতচরিত্র হন,তাঁহার দেওয়ান দক্ষিণারঞ্জনের সহিত অবৈধ প্রেমে আবদ্ধ হন এবং একদিন সুযোগ পাইয়া তাঁহার সহিত রাজবাড়ি ত্যাগ করেন। কিন্তু পথিমধ্যে রাজানুচরগণ কর্তৃক ধৃত হইয়া পুনরায় রাজপ্রাসাদে আনীত হন। কিছুকাল পরে মহারানি তাঁহার বিষয়সংক্রান্ত কোনও মোকদ্দমার জন্য কলিকাতায় আগমন করেন এবং দক্ষিণারঞ্জনের সহিত মহারানি বসন্তকুমারীর তথাকথিত বিবাহ হয়। মহারানি বসন্তকুমারী তাঁহার মৃত্যুকাল পর্যন্ত দক্ষিণারঞ্জনের সহিত সহধর্মিণীর ন্যায় বাস করিয়াছিলেন। দক্ষিণারঞ্জনের অসৎ চরিত্রের জন্য তাঁহার সতীর্থগণ তাঁহার সংস্রব পরিত্যাগ করিয়াছিলেন।
ইম্পিরিয়্যাল লাইব্রেরির ভূতপূর্ব সুপারিন্টেন্ডেন্ট ইলিয়ট ওয়াল্টার ম্যাজও এডওয়ার্ডসের বই অবলম্বন করে লিখলেন, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় যখন দেওয়ান ছিলেন সেইসময় যুবতী বিধবা রানির অনুগ্রহভাজন হন এবং অবশেষে তাঁহাকে লইয়া পলায়ন করেন। রাজবাটি হইতে প্রেরিত কয়েকজন অশ্বারোহী পলাতক দম্পতির পশ্চাদ্ধাবন করে এবং পথিমধ্যে দক্ষিণারঞ্জনকে গ্রেপ্তার করিয়া গুরু প্রহারে জর্জরিত করিতে আরম্ভ করে, তাহারা বোধহয় তাঁহাকে হত্যা করিত কিন্তু ঘটনাক্রমে এইসময় তিনজন ইউরোপীয় ধর্মপ্রচারক ডাকগাড়িতে কলিকাতা হইতে অন্যত্র যাইতে ছিলেন, ইঁহারা ভয় প্রদর্শন করাতে অশ্বারোহীরা দক্ষিণারঞ্জনকে ছাড়িয়ে দেয় এবং রানিকে লইয়া রাজবাড়িতে প্রত্যাবৃত্ত হয়। কিন্তু অনতিকাল পরে কোনও মোকদ্দমার জন্য রানি কলিকাতায় আগমন করেন এবং দক্ষিণারঞ্জনের সহিত মিলিত হন। যেরূপ প্যারিনগরে নেপোলিয়ান পোপ সপ্তম পায়াসকে তাঁহার অভিষেকক্রিয়া করিতে বাধ্য করিয়াছিলেন সেইরূপ হিন্দু আচারানুসারে বিধবা রানির বিবাহ অসম্ভব হইলেও দক্ষিণারঞ্জন তাঁহার এক বেতনভোগী ব্রাহ্মণের দ্বারা রানির সহিত বিবাহিত হইয়াছিলেন।
দক্ষিণারঞ্জনের জীবনীকার মন্মথনাথ ঘোষ এই দুটি বিবরণই অস্বীকার করেছেন। প্রকৃত ঘটনাকে বিকৃত করা হয়েছে। এডওয়ার্ডস লোকটি বিশেষ সুবিধের ছিলেন না। তিনি যত বড় ঐতিহাসিক তার চেয়ে বেশি মিথ্যাবাদী। যে-কোনও প্রতিষ্ঠিত মানুষ সম্পর্কে কুৎসা রটনা করে বাজার গরম করতে ভালোবাসতেন। দক্ষিণারঞ্জন যখন লখনউতে ছিলেন তখন এই এডওয়ার্ডস তাঁর এবং অন্য আর একজন কমিশনারের নামে যাচ্ছেতাই অপপ্রচার করেছিলেন। দক্ষিণারঞ্জন তখন এডওয়ার্ডসকে তিরস্কার করে উপযুক্ত শাস্তি পাইয়ে লখনউ ছাড়তে বাধ্য করেছিলেন। সেই রাগ তিনি এই সুযোগে উগরে দিলেন। দ্বিতীয় কথা, কোন ভিত্তিতে তিনি দক্ষিণারঞ্জন সম্পর্কে যা তা লিখলেন তার কোনও উল্লেখ করতে পারেননি। একটি কথাতেই সেরে দিয়েছেন–জনশ্রুতি। বাঙালির স্বভাবই হল পরনিন্দা। যে-কোনও সামান্য ঘটনাকে পল্লবিত করে এমন পর্যায়ে পৌঁছে দেয় যখন তা আর প্রকৃত ইতিহাস না। হয়ে সুস্বাদু উপন্যাস হয়ে দাঁড়ায়। এডওয়ার্ডসের বর্ণনা পড়লেই বোঝা যায়, পুরোটাই তাঁর ইচ্ছাকল্পিত। দক্ষিণারঞ্জন যে কত বড় মানুষ, কত ভালো ভালো কাজ করেছেন তার কোনও উল্লেখ নেই। রানি বসন্তকুমারীর সঙ্গে তাঁর ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু দক্ষিণারঞ্জন একজন লম্পট এমন কথা তো ইতিহাস স্বীকার করবে না। একের পর এক মিথ্যা কথা বলেছেন। প্রথম, দক্ষিণারঞ্জন কখনও বর্ধমান রাজের দেওয়ান ছিলেন না। এডওয়ার্ডসের বইটি প্রকাশিত হয় ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে। তিনি লিখছেন, মহারানি বসন্তকুমারীর মৃত্যুকাল পর্যন্ত তিনি ও দক্ষিণারঞ্জন স্বামী-স্ত্রীর ন্যায় বাস করিতেন। ঐতিহাসিক এডওয়ার্ডস খবরই রাখতেন না, কে আগে মারা গেছেন। দক্ষিণারঞ্জনের মৃত্যুর পর রানি বসন্তকুমারী ১৫/১৬ বছর জীবিত ছিলেন। সেই সময় দক্ষিণারঞ্জনের সতীর্থদের সঙ্গে তাঁর অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক ছিল। দক্ষিণারঞ্জনের একজন বাল্যবন্ধুই তাঁর সংস্রব ত্যাগ করেছিলেন। তিনি কে তা সহজেই অনুমান করা যায়। সেই আচার্য কৃষ্ণমোহন। বন্দ্যোপাধ্যায়। দক্ষিণারঞ্জন অল্পবয়সেই উত্তরাধিকার সূত্রে প্রচুর সম্পত্তি লাভ করেছিলেন। বিদ্যায় ও বুদ্ধিতে তাঁর বিখ্যাত সতীর্থদের চেয়ে কোনও অংশে কম ছিলেন না। ডেভিড হেয়ার, ডিরোজিও ও ডক্টর ডফ তাঁকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। কৃষ্ণমোহনের এইটাই হয়েছিল গাত্রদাহ। এডওয়ার্ডস তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় যে স্বীকারোক্তি করেছেন সেইটিই তাঁর বিরুদ্ধে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। তিনি লিখছেন, I have to acknowledge with many thanks, the very kind manner in which I have been aided in this bit of work by the revd Krishna Mohun Banerjea, L.L. D. & C. & C.93 স্বীকারোক্তিটি দেখে দক্ষিণারঞ্জনের প্রকৃত বন্ধুরা বুঝতেই পেরেছিলেন কৃষ্ণমোহন পণ্ডিত ও জ্ঞানী ব্যক্তি হলেও অত্যন্ত অকৃতজ্ঞ। দক্ষিণারঞ্জন ছিলেন তাঁর বিপদের বন্ধু ও আশ্রয়দাতা। সে কথা তিনি মনে রাখেননি। এর পরেও এডওয়ার্ডসের আর একটি উক্তি। তিনি লিখেছেন, দক্ষিণারঞ্জনের সঙ্গে পরিচয়ের আগেই রানির চরিত্র লন হয়েছিল। অসাধারণ সিদ্ধান্ত। রাজ অন্তঃপুরের অসূর্যম্পশ্যা। তিনি ঐতিহাসিক এডওয়ার্ডদের কৃপায় চরিত্রহীনা হলেন। ইচ্ছে। করলে মহারানি মানহানির মামলাও করতে পারতেন। কিন্তু উপায় ছিল না।
জীবনীকার মন্মথবাবু সমস্ত অনুসন্ধান করে প্রকৃত যা ঘটেছিল তার একটি বিবরণ রেখে। গেছেন। দক্ষিণারঞ্জন কখনও বর্ধমান রাজের দেওয়ান ছিলেন না। বসন্ত পঞ্চমীতে বর্ধমানে তখন মহাউৎসব হইত এবং এখনও হইয়া থাকে। এইরূপ এক উৎসবে নিমন্ত্রিত হইয়া দক্ষিণারঞ্জন বর্ধমানে গমন করেন এবং কিছুকাল তথায় অবস্থিতি করেন। এরপরে যা লিখছেন তা সঞ্জীবচন্দ্রের লেখারই উদ্ধৃতি। পুনরুল্লেখের প্রয়োজন নেই। পরবর্তী অংশটি উল্লেখ করতেই হয় প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য। এখানেও বিশেষ কয়েকটি দিক পরপর তুলে। ধরলেই হবে। যেমন–১) তেজচন্দ্রবসন্তকুমারীর নামে কিছু সম্পত্তি রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই বিষয়ের উপস্বত্ব তিনি ভোগ করতে পাননি। ২) মহারানি কমলকুমারী তখন রাজপরিবারের সর্বময়ী কত্রী। ৩) তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন কুচক্রী ভ্রাতা। ৪) দক্ষিণারঞ্জন। সদর আদালতের উঁকিল। তিনি রাজ অতিথি। ৫) মহারানি বসন্তকুমারী গোপনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। উদ্দেশ্য বিষয়ের অধিকার অর্জনের উপায় বের করা। ৬) স্থির হল মহারানি বসন্তকুমারী কলকাতায় যাবেন, বিষয়ের জন্য সদর আদালতে আবেদন করবেন। ৭) বসন্তকুমারী জানতেন, কমলকুমারীর অনুমতি নিয়ে বর্ধমান ত্যাগ করা সম্ভব নয়। ৮) দক্ষিণারঞ্জনের সঙ্গে পরামর্শ করে স্থির হল বসন্তকুমারী গোপনে দুজন বিশ্বস্ত দাসী ও একজন পুরুষ আত্মীয়কে নিয়ে বর্ধমান ত্যাগ করবেন। দক্ষিণারঞ্জনও মহারানির অনুগমন করবেন।
মহারানি বসন্তকুমারী দক্ষিণারঞ্জনের মধ্যে এক বিশ্বস্ত বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছিলেন। রাজপরিবারে যাঁদের তিনি দেখেছিলেন তাঁরা কেউই যথেষ্ট শিক্ষিত ও উদার মানুষ ছিলেন না। বিষয়ই ছিল তাঁদের বিষয়। জমিদারি, খাজনা, লাঠালাঠি, মামলা-মোকদ্দমা এবং ভোগ। ইন্দ্রিয় বুদ্ধি প্রবল। সমাজ সংস্কার, দিঘি খনন, ফুলবাগান তৈরি, মন্দির প্রতিষ্ঠা–এইসব হল সামাজিক প্রতিপত্তি লাভের উপায়। ইংরেজ তত তাদের শাসন ক্ষমতায় স্থান দেবে না। তাই এইভাবে নিজেদের জন্য সম্মানের ব্যবস্থা করা। রাজপরিবারে পুরুষের চেয়ে নানা বয়সের মহিলার সংখ্যাই বেশি। বসন্তকুমারীর পিতা একেবারেই সুবিধের মানুষ ছিলেন না। জাল প্রতাপচাঁদ মামলার সূত্র ধরে তাঁর বদনাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। বসন্তকুমারী এক ক্যাপটিভ লেডি। অতি অসহায়। বালিকা থেকে যখন যুবতী হলেন তখন স্বাভাবিকভাবেই তাঁর মধ্যে ভালোবাসা এল। দীর্ঘদেহী সুস্থ, সুন্দর এক রমণী। তিনি ভালোবাসতে চান এমন কোনও মানুষকে যাঁর মধ্যে প্রেম আছে, দায়িত্ববোধ আছে। শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান, উচ্চবংশীয়। কারণ তাঁর মধ্যে আভিজাত্য ছিল। দক্ষিণারঞ্জন ঈশ্বরপ্রেরিত, ডিরোজিওর প্রিয় ছাত্র। ধর্মবিশ্বাসী, উদার। সমাজসংস্কারক, শিক্ষার প্রসার বিশেষত স্ত্রী শিক্ষা ও স্বাধীনতার যাজ্ঞিক। বসন্তকুমারী যেন একটি দুর্গের আশ্রয় পেলেন। এখন প্রয়োজন রাজকারাগার থেকে মুক্তি। তিনি হয়তো পলাতকা, কিন্তু এমন নয় যে দক্ষিণারঞ্জন মধ্যযুগীয় কোনও ডন। জুয়ানের মতো তাঁকে অপহরণ করতে চেয়েছিলেন। বসন্তকুমারী একবারও বলেননি, আমি তোমাকে ভালোবাসছি বলেই রাতের অন্ধকারে পালাতে চাইছি। তাঁর প্রথম উদ্দেশ্য ছিল। চক্রান্তকারীদের হাত থেকে নিজের যোগ্য প্রাপ্যটুকু বুঝে নেওয়া। প্রথমবারের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল। দক্ষিণারঞ্জন কলকাতায় ফিরে গেলেন, এই আশ্বাস দিয়ে মামলা করব এবং তোমার প্রাপ্য আদায় করে দেব। এই তুমি কোনও সাধারণ মক্কেল নয়। সুন্দরী, স্বাধীনচেতা এক রমণী। বসন্তকুমারী যেমন এক নায়ককে দেখলেন, নায়কও দেখলেন এক সুযোগ্য নায়িকাকে। কর্মতৎপর এক মানুষ। সারা ভারত তাঁর কর্মক্ষেত্র। সুবক্তা, সুলেখক, সর্বোপরি সমাজদরদি এক মানুষ।
দক্ষিণারঞ্জন কলকাতায় ফিরেই একটি মামলা দায়ের করলেন মহারানির হয়ে। সদর আদালত থেকে একটি আদেশনামা বের করলেন। যাতে বসন্তকুমারী বিনা বাধায় কলকাতায় এসে তাঁর মামলা পরিচালনা করতে পারেন। এই আদেশবলে বসন্তকুমারী রাজপরিবারের সমস্তরকমের অসভ্যতা পাশ কাটিয়ে কোনওরকম বাধা ছাড়াই কলকাতায় এলেন। দক্ষিণারঞ্জন তাঁর উঁকিল। বসন্তকুমারী তাঁর ক্লায়েন্ট। দক্ষিণারঞ্জনের সহানুভূতি ও সমবেদনা, মহারানির গভীর বিশ্বাস ও কৃতজ্ঞতা। দুটি নদীর দুটি ধারা মিলিত হয়ে তৈরি হল একটি সংগম। কোনওরকম দেরি না করে তাঁরা এই আলগা সম্পর্ককে একটি স্থায়ী মর্যাদা দেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহী হলেন। সিদ্ধান্তটি সেকালের প্রেক্ষিতে ভয়ঙ্কর রকমের সাহসী এক ব্রাহ্মণ পুরোহিতকে আহ্বান করে হিন্দুমতে দুজনে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন। দক্ষিণারঞ্জন আইন জানতেন, নিজের সমাজকে চিনতেন। এই অনুষ্ঠান যে যথেষ্ঠ আইনসিদ্ধ নয় তাও তিনি জানতেন। কারণ হিন্দু সমাজে অসবর্ণ বিধবাবিবাহ অসিদ্ধ। দক্ষিণারঞ্জন কলকাতার তদানীন্তন পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ বার্চকে সাক্ষী রেখে সিভিল ম্যারেজ করলেন। অর্থাৎ রেজিস্ট্রি হল। এই বিবাহ সম্পর্কে স্বয়ং রাজনারায়ণ বসু লিখছেন, দক্ষিণারঞ্জন বলিতেন যে, তিনি যেমন ধর্মসংস্কারক তেমনি সমাজসংস্কারক। রানি বসন্তকুমারীকে বর্ধমান হইতে কলিকাতায় আনিয়া কলিকাতার পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট বার্চ সাহেবের সম্মুখে Civil Marriage নামক বিবাহ করেন। ভাস্কর সম্পাদক গুড়গুড়ে পণ্ডিত তাহার সাক্ষী থাকেন। গুড়গুড়ে পরিতের প্রকৃত নাম গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য। লক্ষ্ণৌ অবস্থিতিকালে তিনি (দক্ষিণাবাবু) একদিন আমাকে বলিলেন যে তিনি বিধবাবিবাহ, অসবর্ণ বিবাহ ও সিভিল বিবাহ এককালে করিয়াছেন। তাঁহার ন্যায় সমাজসংস্কারক আর কে আছে? দক্ষিণারঞ্জন ব্রাহ্মণের সহিত ক্ষত্রিয় কন্যার বিবাহ ও বিধবাবিবাহ সম্পূর্ণরূপে হিন্দুশাস্ত্রানুমোদিত জ্ঞান করিতেন। আমি যখন লক্ষৌ-এ ছিলাম তাঁহার পূর্বে তাঁহার পুত্রবিয়োগ হইয়াছিল, কেবল পৌত্র বিদ্যমান ছিল। তিনি উইল না করিলেও এই পৌত্রের বিষয় পাওয়ার প্রতি তাঁহার কিছুমাত্র সন্দেহ ছিল না।
গুড়গুড়ে পণ্ডিত, ডাঃ ডি গুপ্ত এবং দক্ষিণারঞ্জনের আরও কয়েকজন বন্ধুর স্বাক্ষরযুক্ত বিবাহ সম্বন্ধীয় দলিলটি মহারানি বসন্তকুমারী তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত সযত্নে রক্ষা করেছিলেন। মহারানি ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের কোনও একসময়ে পরলোকগমন করেন। দক্ষিণারঞ্জনের জীবনীকার লিখছেন, রাজনারায়ণ বসুর মতো মানুষ যখন এই কথা লিখছেন তখন ওই কটা সাহেবের কুৎসাপূর্ণ বর্ণনার যে-কোনও ভিত্তি নেই, শুধুমাত্র চরিত্র হননের উদ্দেশ্যেই করা তা সাব্যস্ত হল। দুজনেই বড় সুখে দিন কাটিয়েছিলেন একথা ভাবতেও ভালো লাগে। এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা বলা দরকার, বিবাহের পর আদালতে রানির মোকদ্দমাটিও আপসে নিষ্পত্তি হল। কলকাতার কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তি যেমন মতিলাল শীল, রমাপ্রসাদ রায় এবং আরও কয়েকজন মধ্যস্থতা করে দুটি ব্যবস্থা আদায় করে দিলেন–দক্ষিণারঞ্জনের বিবাহিত স্ত্রী মহারানি বসন্তকুমারী তাঁর সঙ্গে বাস করবেন। আর মহারানি তাঁর বিষয়ের উপস্বত্ব স্বরূপ বর্ধমান রাজকোষ থেকে আজীবন পাঁচশত টাকা মাসিক বৃত্তি পাবেন। বসন্তকুমারী মৃত্যুকাল পর্যন্ত এই মাসোহারা পেয়েছিলেন।