৫. উনচল্লিশ বছর, পাঁচ মাস, চব্বিশ দিন
শেষ পর্বের শুরু এবার। আশঙ্কিত হৃদয় নিয়ে আমরা চলেছি ৪ জুলাই ১৯০২-এর দিকে।
কিন্তু এ দেশের সনাতন চিন্তাধারায় স্মরণীয় মানুষদের তিরোধান দিবস সম্পর্কে আমাদের বিশেষ উৎসাহ নেই।
“আবির্ভাব নিয়েই আমাদের আনন্দোৎসব, মৃত্যু সে তো বাসাংসি জীর্ণানি, পুরনো বস্ত্র ছেড়ে নতুনে চলে যাওয়া”, আমাকে বলেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের নামাঙ্কিত মঠ ও মিশনের এক প্রবীণ শ্রদ্ধেয় সন্ন্যাসী। এর অর্থ, ৪ জুলাই ২০০২ যে বীরসন্ন্যাসী বিবেকানন্দর তিরোধান দিবস নিয়ে তেমন ব্যস্ততা নেই তাদের মধ্যে, যাঁরা শতবর্ষের বেশি সময় ধরে এই মহাপুরুষের বাণীকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার বিরামহীন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তবু এদেশের সংখ্যাহীন মানুষের মনে ৪ জুলাই নাড়া দিয়ে যায়, আজও মনে প্রশ্ন ওঠে, যে অলৌকিক শরীরের তিরোধান ঘটেছিল ১৯০২ সালে, সেই শরীর যদি ৩৯ বছর ৫ মাস ২৪ দিনের বেশি স্থায়ী হত, তা হলে এদেশের ভাগ্যাকাশে আরও কী কী পরিবর্তন লক্ষ্য করা যেত? আমরা জগৎবাসীরা আরও কী কী উপহার পেতে পারতাম সেই অমৃতপুত্রের কাছ থেকে?
একথাও সত্য যে এই পৃথিবীতে ঈশ্বরপুত্ররা প্রায়ই দীর্ঘজীবী হননি খ্রিস্ট ও শঙ্করাচার্যের সংক্ষিপ্ত জীবনের কথা তো আমাদের অজানা নয়। কিন্তু সেই সঙ্গে ভগবান বুদ্ধও তো আছেন। একজন বিদেশিনী তো সস্নেহে বিদগ্ধ বিবেকানন্দকেও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, বুদ্ধ তো চল্লিশ বছর থেকে আশি বছর পর্যন্ত বিশ্বসংসারকে কম সেবা করেননি।
স্মরণীয় দিনে মৃত্যুকে এই যে উপেক্ষা, বিশেষ করে মহামানবদের তিরোধান, তারই পিছনে সত্যিই কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে কিনা তার প্রারম্ভিক অনুসন্ধান করতে গিয়েই এই অধ্যায়ের সূচনা।
কিন্তু সেই সঙ্গে অন্য কিছু প্রসঙ্গও এসে পড়ে, আর স্মরণে আসে–যাঁকে নিয়ে এই অনুসন্ধান তিনি নিজেই একবার বলেছিলেন : “চিন্তা করো, উপাদান সংগ্রহ করো, সমস্ত অলৌকিকত্ব বাদ দিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের একটা জীবনী রচনা করো।” অর্থাৎ অলৌকিকত্ব থাকলেও তা নিয়ে বিভোর হওয়ার প্রয়োজন নেই। তিনি ইচ্ছে করেই এসেছিলেন অতি অল্পদিনের জন্য এবং ইচ্ছা করেই বিবেকানন্দ অতি অল্প সময়ের মধ্যে চলে গিয়েছেন, এসব সত্য হলেও, পৃথিবীর অন্য মহাপুরুষদের প্রদর্শিত পথেই করতে হবে তাঁর অনুধ্যান।
বিবেকানন্দ বিষয়ের চলমান বিশ্বকোষ শঙ্করীপ্রসাদ বসু মহাশয় আমাকে উৎসাহ দিলেন। ৪ জুলাই ১৯০২ সম্বন্ধে তিনি ইতিমধ্যেই কিছু হৃদয়গ্রাহী ছবি এঁকেছেন, বিদেশিনী ভক্তিমতীরাও নিরন্তর অনুসন্ধানের পরে উপহার দিয়েছে নানা অমূল্য তথ্য, তবু লোভ হয়–আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি বসি পড়িছ আমার শেষদিনের কথা?
ব্যস্ত জীবনযাত্রার স্রোতে ভেসে যেতে যেতে শতবর্ষ পরের মানুষ জানুক, যাকে আমরা আজ প্রায় দেবতার সিংহাসনে বসিয়ে পূজা করছি, কত কঠিন ছিল তার জীবনসংগ্রাম। খ্যাতির হিমালয়শিখরে আরোহণ করেও কেন শেষ হয়নি তার প্রতিদিনের সংগ্রাম? কেন স্বামীজি বলেছিলেন,সতত প্রতিকূল অবস্থামালার বিরুদ্ধে আত্মপ্রকাশ ও আত্মবিকাশের নামই জীবন? এবং সেই সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কৌতূহল, সনাতন ভারতবর্ষ জন্মদিবস অপেক্ষা মৃত্যুদিবসকে কেন এতো কম গুরুত্ব দিয়েছে?
শেষ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গিয়েছে এবং সেই উত্তর এই লেখার পরিসমাপ্তিতে উল্লিখিত হবে। কিন্তু তার আগে আমার অতি সংক্ষিপ্ত অনুসন্ধানের একটা ছোট্ট ছবি তাড়াতাড়ি এঁকে ফেলা যাক।
নানা প্রশ্ন অবশ্যই জড়ো হয়ে আছে। কেন এবং কীভাবে বিবেকানন্দ এত কম বয়সে চলে গেলেন? মহামানুষদের জীবনপথ নিরন্তর কণ্টকিত করতে সমকাল কেন দ্বিধা করে না? এবং কেমন করে তিলেতিলে অতিপরিশ্রমে নিজেকে ক্ষয় করে ক্ষণজন্মা পুরুষরা এই বিশ্বসংসারকে চিরঋণে আবদ্ধ করে যান? আর সেই সঙ্গে একজন জার্মান দার্শনিকের সেই বিখ্যাত উক্তি–যদি কোনও মহাপুরুষকে সত্যিই শ্রদ্ধা করে থাক তবে তার তিরোধানে ক্রন্দন করো না, বরং তার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্যে লেগে পড়।
আমাদের প্রথম কৌতূহল, প্রথম যুগের বিবেকানন্দকে আমরা তো প্রবল প্রতাপান্বিত শরীরের অধীশ্বর হিসেবেই দেখেছি। তার শরীর হঠাৎ এমনভাবে ভেঙে পড়ল কেন? একালের মানুষের শরীর তো এইভাবে জীর্ণ হয় না। পূর্বসূরীদের নির্দেশিত পথেই আমার এই অনুসন্ধান, তেমন কোনও অপ্রকাশিত তথ্য আমার হাতে নেই, কিন্তু বিভিন্ন সূত্র থেকে কুড়িয়ে নিয়ে একটা মালা গাঁথার চেষ্টা চালানো গেল।
অসীম শারীরিক শক্তি নিয়েই নরেন্দ্রনাথ সন্ন্যাসের দুর্গম পথে যাত্রা করেছিলেন। আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি, অনেকেরই ধারণা স্বামীজির অনেক অসুখবিসুখই শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগের পর বরানগরের কঠিন দারিদ্র্য ও পরিব্রাজক জীবনে ভিক্ষান্নে ভোজনং যত্রতত্র এবং শয়নং হট্টমন্দির থেকে উদ্ভূত। এ-বিষয়ে অবশ্যই আরও অনুসন্ধানের প্রয়োজন থেকে গেল। কিন্তু সেই সঙ্গে সিমুলিয়ার দত্তদের পারিবারিক অসুখবিসুখগুলোর দিকে নজর দেওয়াটাও প্রয়োজন।
আমরা বিবেকানন্দর ছোটভাই ভূপেন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানতে পারি, পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্ত অল্পবয়সেই ডায়াবিটিসের রোগী হন। এই রোগ পরবর্তী সময়ে শুধু নরেন্দ্রনাথকে নয়, তার অন্য দুই ভাই মহেন্দ্রনাথ ও ভূপেন্দ্রনাথকেও আক্রমণ করে। মহেন্দ্র ও ভূপেন্দ্র অবশ্য দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন। কিন্তু এঁদের অন্তরঙ্গ শ্রী রঞ্জিত সাহার কাছে শুনেছি, ভূপেনবাবু মিষ্টি এড়িয়ে চলতেন। দু’জনেরই হাইপারটেনশন ছিল, যা নরেন্দ্রনাথের মধ্যেও অল্পবয়স থেকে থাকতে পারে। কারণ কম বয়সেও মাথার যন্ত্রণার উল্লেখ রয়েছে পারিবারিক স্মৃতিতে।
আরও বলা যাক। স্বামীজির পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্ত বাহান্ন বছর পেরোননি। মৃত্যুর মাসখানেক আগে তার হার্টের রোগ হয়েছিল। বহু বছর পরে ৫ জুলাই ভোরবেলায় যখন উত্তর কলকাতার বাড়িতে স্বামীজির দেহরক্ষার সংবাদ এল তখন শোকবিহ্বলা জননী জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ কী হল? তখন কনিষ্ঠ পুত্র বললেন, “বাবার যা হয়েছিল।” পিতার মৃত্যুও রাত ন’টা নাগাদ, খাবার পরে বাঁ হাতে তামাক খাচ্ছিলেন, বমি করলেন, তারপরেই হৃদযন্ত্র বন্ধ।
কৌপীনধারী অবস্থায় ভিক্ষান্নে জীবন অতিবাহিত করে নরেন্দ্রনাথের শরীরে বেশ কয়েকটি রোগের আবির্ভাব বা সূত্রপাত হয়েছিল একথা আমরা আগেই জেনেছি।
সন্ন্যাসজীবনে পেটের অসুখ নিত্যসাথী হওয়ায় সদা চলমান সন্ন্যাসীর খুবই অসুবিধা হয়েছিল। বারবার টয়লেটে ছোটার তাগিদে, ট্রেনের নিচু ক্লাসে ভ্রমণ প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। ছাত্রাবস্থায় আমাদের ইস্কুলে বারবার শুনেছি, পরিব্রাজক সন্ন্যাসীকে দয়াপরবশ হয়ে কেউ কেউ ট্রেনের টিকিট কেটে দিতে চাইলে, নরেন্দ্রনাথ তাকে তখনকার উচ্চশ্রেণীর (সেকেন্ড ক্লাস) টিকিট দিতে অনুরোধ করতেন।
এই পেটের গোলমালের জন্য একবার এদেশের মহা উপকার হয়েছিল। এমন দাবিও অন্যায় হবে না! প্রথমবার আমেরিকা যাবার সময় কম খরচে ডেকের যাত্রী হওয়া তার পক্ষে অসম্ভব ছিল। খেতড়ির মহারাজা তাঁকে জাহাজের ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট কিনে না দিলে সে যাত্রায় তাঁর সঙ্গে টাটা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জামশেদজী টাটার পরিচয় হত না।
টাটা দেশলাই আমদানির জন্য জাপানে গিয়েছিলেন। ধনপতি ব্যবসায়ীকে কাছে পেয়ে স্বামীজি তাঁকে স্বদেশে শিল্প স্থাপন করার অনুপ্রেরণা দেন এবং সেই সঙ্গে স্বদেশে বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। জামশেদজী পরবর্তীকালে টাটা স্টিল ও ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স প্রতিষ্ঠার জন্য এগিয়ে আসেন। টাটা-বিবেকানন্দ পত্রাবলীর পুনর্সন্ধান করে সাম্প্রতিক গবেষকরা এদেশের মানুষের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন।
মার্কিন দেশের সংগ্রাম ও রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠা বিবেকানন্দের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক অবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ মার্কিন গবেষকদের দয়ায় আমাদের হাতের গোড়ায় রয়েছে। সেখানে তাঁর অসুখবিসুখ এবং খাওয়াদাওয়া সম্পর্কেও যথেষ্ট খবরাখবর রয়েছে। আমরা দেখেছি তার স্মোকিং বেড়েছে; নতুন আকর্ষণ নবাবিষ্কৃত আমেরিকান আইসক্রিম। আধুনিক চিকিৎসা এবং আজব চিকিৎসা দুটোর কাছেই তিনি আত্মসমর্পণ করেন, তবে অমানুষিক পরিশ্রমের মতন শরীর তখনও তার রয়েছে।
বহুদিন পরে জীবনের শেষ পর্বে অসুস্থ স্বামীজিকে একজন অনুরাগী জিজ্ঞেস করেছিলেন, “স্বামীজি, আপনার শরীর এতো তাড়াতাড়ি ভেঙে গেল, আগে যত্ন নেননি কেন?” স্বামীজি উত্তর দিয়েছিলেন, “আমেরিকায় আমার শরীরবোধই ছিল না।”
তা হলে প্রথম বড় অসুখের ইঙ্গিত আমরা কোথায় পেলাম? বিশ্বাসযোগ্য উপাদান রয়েছে ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ দত্তর লেখায়। ১৮৯৬ সালে আমেরিকা থেকে দ্বিতীয়বার ইংলন্ডে এসেছেন বিবেকানন্দ।
এই পর্বেই কিন্তু বড় আকারের দুঃসংবাদের ইঙ্গিত। লন্ডনেই আমরা প্রথম স্বামীজির হার্ট অ্যাটাকের খবর পেয়েছি। লন্ডনে একদিন মধ্যাহ্ন ভোজনের পর স্বামীজি বসে ভাবছিলেন। সামনে আমেরিকান অনুরাগী জন পিয়ার ফক্স ও মহেন্দ্রনাথ।
মহেন্দ্রনাথের বর্ণনা অনুযায়ী “হঠাৎ যেন তাঁহার মুখে বড় কষ্টের ভাব দেখা গেল। খানিকক্ষণ পরে তিনি নিশ্বাস ফেলিয়া ফক্সকে বলিলেন, দেখ ফক্স, আমার প্রায় হার্ট ফেল করছিল। আমার বাবা এই রোগে মারা গেছেন, বুকটায় বড় যন্ত্রণা হচ্ছিল, এইটা আমাদের বংশের রোগ।” অর্থাৎ তেত্রিশ বছর বয়সেই অকাল দেহাবসানের সুনিশ্চিত ইঙ্গিত।
এখন প্রশ্ন, পরবর্তী সময়ে স্বামীজির হার্টের অবস্থা কেমন ছিল? ১৮৯৮ সালে অমরনাথ তীর্থ দর্শনের সময় আবার একটা অস্বস্তিকর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। পাহাড়-ভাঙার অবর্ণনীয় ধকলের পরে ডাক্তার বলছেন, ওঁর হৃদয়যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারত। চিকিৎসকের সাবধানবাণী, স্বামীজির হার্টের আকার বিপজ্জনকভাবে বড় হয়ে গিয়েছে। বেলুড়ে ফেরার কয়েকদিন পরে স্বামী-শিষ্য সংবাদের স্মরণীয় লেখক শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর সঙ্গে যখন স্বামীজির দেখা, তখন তাঁর বাঁ চোখের ভিতরটা লাল হয়ে রয়েছে। আর ডাক্তারদের সাবধানবাণী : ওই চোখে ব্লাড ক্লট হয়েছে। শেষপর্বে আমরা দেখছি, তার ডান চোখটিও নষ্ট হয়ে গেছে, অর্থাৎ জীবন দীর্ঘতর হলে সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন হওয়ার প্রবল আশঙ্কা ছিল। মানুষটি কিন্তু এমনই রসিক যে নিজেকে একচক্ষু শুক্রাচার্যের সঙ্গে তুলনা করেও আনন্দ পাচ্ছেন!
কিন্তু ধারাবাহিকতায় ফেরা যাক এবার। আমাদের স্বামীজিকে নিয়ে ইতালীয় জাহাজ রুবাত্তিনোবোম্বাই বন্দরে পৌঁছে গিয়েছে।
রুবাত্তিনো হয় ৬ অথবা ৭ ডিসেম্বর ১৯০০ বোম্বাই বন্দরে ফিরেছিল আমাদের স্বামীজিকে নিয়ে। শেষ হলো তার বিদেশ ভ্রমণপর্ব। হাওড়াগামী ট্রেনের জন্য স্বামীজিকে স্টেশনে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
ট্রেনে দৈবক্রমে পূর্বপরিচিত বন্ধু মন্মথনাথ ভট্টাচার্যর সঙ্গে স্বামীজির দেখা হয়ে গিয়েছিল। বিদেশি পোশাকে সজ্জিত স্বামীজিকে তিনি প্রথমে চিনতেই পারেননি, পরে দু’জনে খুব আমোদ-আহ্লাদ হয়েছিল।
বম্বে-হাওড়া এক্সপ্রেসে স্বামীজি একা হাওড়া স্টেশনে নামলেন, ওখান থেকে সন্ধ্যায় গাড়িভাড়া করে আচমকা বেলুড়ে আগমন। সে এক মধুর প্রত্যাবর্তন–আমরা জানি ডিনারের ঘণ্টা শুনে, গেটের তালা খোলার জন্যে অপেক্ষা না করে সায়েবী সাজসজ্জায় যে মানুষটি মালপত্তর সমেত দেওয়াল টপকে ভোজনের আসরে সানন্দে বসে পড়ে প্রাণভরে প্রিয় খিচুড়ি খেয়েছিলেন রবিবার ৯ ডিসেম্বর ১৯০০র সন্ধ্যায়, সে মানুষটির মধ্যে গুরুভাইরা গুরুতর অসুস্থতার কোনও ইঙ্গিত লক্ষ্য করেননি।
স্বয়ং বিবেকানন্দও তখন প্রবলভাবে সহাস্য। বেলুড়ের সবাইকে তিনি বলছেন, “তোদের খাবার ঘণ্টা শুনেই ভাবলুম, এই যাঃ, এখনি না গেলে হয়তো সব সাবাড় হয়ে যাবে, তাই দেরি করলাম না।”
.
কিন্তু পত্রাবলীর আলোকে এতদিন পরে পরিস্থিতি খুঁটিয়ে দেখলে শরীর সম্পর্কে কিছু কিছু অস্বস্তিকর ইঙ্গিত ছ’মাস আগে থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। জুন মাসে বিবেকানন্দ তাঁর চিঠিতে বদহজম ও ডিসপেপসিয়া নিয়ে রসিকতা করছে। প্রায় একই সময় স্নেহের ক্রিশ্চিনকে স্বামীজি লিখেছেন নিউইয়র্ক থেকে, “কিডনির অসুখের ভয়টা কেটে গেছে, এখন দুশ্চিন্তাই আমার প্রধান অসুখ, এই রোগটাও আমি দ্রুত জয় করার চেষ্টা চালাচ্ছি।” কিন্তু দু’মাস পরেই আগস্ট মাসে মার্কিন অনুরাগী জন ফক্সকে স্বামীজি জানাচ্ছেন, “আমার শরীর দ্রুত ভেঙে যাচ্ছে। মহিমকে (ভাই) মাকে এবং সংসারকে দেখার ভার নেবার জন্যে তৈরি হতে হবে। আমি যে কোনও সময়ে চলে যেতে পারি।”
স্বদেশে আচমকা ফিরে এসে, বেলুড় মঠের সন্ন্যাসী ভাইদের সঙ্গে হৈহৈ করে খিচুড়ি খাওয়ার আনন্দে বিভোর বিবেকানন্দ তার প্রিয় খেতড়ির নরেশকে লিখছেন : “আমার হার্ট খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে।…আমার মনে হচ্ছে, এজীবনে যা করার ছিল তা শেষ হয়েছে। এর আগে প্যারিস থেকে (আগস্ট ১৯০০) প্রিয় হরিভাইকে (স্বামী তুরীয়ানন্দ) স্বামীজি লিখছেন, “আমার কাজ আমি করে দিয়েছি বস্। গুরু মহারাজের কাছে ঋণী ছিলাম–প্রাণ বার করে আমি শোধ দিয়েছি। সে কথা তোমায় কি বলব?..দলিল করে পাঠিয়েছি সর্বেসর্বা কত্তাত্তির। কত্তাত্তি ছাড়া বাকী সব সই করে দিয়েছি।”
*
জীবন নাটকের যবনিকাপাতের সত্যিই আর দেরি নেই, আর মাত্র আঠারো মাস। কিন্তু পায়ের তলায় সরষে নিয়ে যাঁদের জন্ম তারা ভগ্নশরীরেও ঘুরে বেড়াতে চান চরকির মতন।
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে আমরা দেখছি বিবেকানন্দকে মায়াবতী আলমোড়ার পথে। কাঠগোদামে স্বামীজির জ্বর জ্বর ভাব। সেখানে একদিন বিশ্রাম করলেন। মায়াবতীতে পৌঁছে শিষ্য বিরজানন্দকে বলছেন, “শরীরটাকে বেজায় কষ্ট দিয়েছি, তার ফল হয়েছে কি?না জীবনের যেটা সবচেয়ে ভাল সময় সেখানটায় শরীর গেল ভেঙে। আর আজ পর্যন্ত তার ঠেলা সামলাচ্ছি।”
১৯০১ জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে বেলুড়ে ফিরে মিসেস ওলি বুলকে পরমানন্দে স্বামীজি জানাচ্ছেন, “বাংলাদেশে, বিশেষত মঠে যে মুহূর্তে পদার্পণ করি, তখনি আমার হাঁপানির কষ্টটা ফিরে আসে, এস্থান ছাড়লেই আবার সুস্থ। আগামী সপ্তাহে আমার মাকে নিয়ে তীর্থে যাচ্ছি…তীর্থদর্শন হলো হিন্দু বিধবার প্রাণের সাধ; সারাজীবন সব আত্মীয়স্বজনদের কেবল দুঃখ দিয়েছি। তাদের এই একটি ইচ্ছা অন্তত পূর্ণ করতে চেষ্টা করছি।”
এর আগে মায়াবতী থেকে ধীরামাতা মিসেস বুলকে (৬ জানুয়ারি ১৯০১) স্বামীজি লিখেছেন, “কলকাতায় প্রথম দিনের ছোঁয়াতেই আমার হাঁপানি আবার দেখা দিয়েছিল। সেখানে যে দু-সপ্তাহ ছিলাম প্রতি রাত্রেই রোগের আক্রমণ হত।”
মার্চের শেষে অসুস্থতার তোয়াক্কা না করে ঢাকা চললেন স্বামী বিবেকানন্দ। সেখান থেকে চট্টগ্রাম, কামরূপ, কামাখ্যা এবং শিলং।
হাঁপানিও যে স্বামীজির সঙ্গের সাথী তার প্রমাণ অনেক রয়েছে। ঢাকায় এক বারাঙ্গনা করুণভাবে তার কাছে নিবেদন করল, সে হাঁপানিতে ভুগছে, স্বামীজির কাছে সে ওষুধ ভিক্ষা চাইছে। অসহায় স্বামীজি সস্নেহে বললেন, “এই দেখ, মা! আমি নিজেই হাঁপানির যন্ত্রণায় অস্থির, কিছুই করতে পারছি না। যদি আরোগ্য করবার ক্ষমতা থাকতো, তা হলে কি আর এই দশা হয়!”
ঢাকাতে স্বামীজির ডায়াবিটিসও বেড়েছিল। গৌহাটিতে হাঁপানি বাড়ে, আর শিলং-এ তো খুব খারাপ অবস্থা। যখন হাঁপানির টান বাড়ত তখন কতকগুলো বালিশ একত্র করে বুকের ওপর ঠেসে ধরতেন এবং সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করতেন। শিলং-এ অ্যালবুমেন। বেড়েছিল এবং শরীর দ্বিগুণ ফুলে গিয়েছিল।
কিন্তু বেলুড় মঠে ফিরতেই স্বামীজির রোগের প্রকোপ কমে গেল। এই সময়কার চিঠিতে বাংলার পাহাড়ের মৃদু নিন্দা করেছেন আমাদের পরমপ্রিয় সন্ন্যাসী। জোসেফিন ম্যাকলাউডকে স্বামীজি লিখছেন, “আমাদের পার্বত্যস্বাস্থ্যনিবাস শিলং-এ আমার জ্বর, হাঁপানি ও অ্যালবুমেন বেড়েছিল এবং শরীর দ্বিগুণ ফুলে গিয়েছিল। যাহোক, মঠে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে রোগের লক্ষণগুলি হ্রাস পেয়েছে।” শিলং-এ চিফ কমিশনার স্যর হেনরি কটন স্থানীয় সিভিল সার্জনকে তার চিকিৎসার ভার নিতে বলেছিলেন এবং দু’বেলা নিজে খবর নিতেন।
পরের বছরে (১৯০২) জানুয়ারির শেষে আবার পথের ডাক। এবার জাপানিদের সঙ্গে বোধগয়ায়, সেখান থেকে পরের মাসে ট্রেনে বারাণসী। চলার শেষ টানতে রাজি নন সন্ন্যাসী, শরীর অশক্ত হলেও কী আসে যায়? মন তো আছে।
অনুসন্ধিৎসুরা এইসব ভ্রমণ বৃত্তান্তর বিবরণ যথাস্থানে পড়ে নিতে এখন আমাদের সময় নেই, আমাদের সামনে সেই দুঃখময় শুক্রবার ৪ জুলাই। মোদ্দা কথা, পাখি তার শেষ আশ্রয় বেলুড় মঠে ফিরে এসেছে–হয় ৭ মার্চ ১৯০২ অথবা পরের দিন,দু’জন শ্রদ্ধেয় মানুষ দু’রকম তারিখ লিখে রেখে গিয়েছেন। পণ্ডিতরা বিবাদ করুন লয়ে তারিখ সাল, আমরা বরং খোঁজ করি স্বামীজির শরীর স্বাস্থ্যের।
শেষ পর্বে নিজের শরীরের কথা কর্তা স্বয়ং প্রায় নিয়মিতভাবেই লিখে গিয়েছেন তার প্রিয় শিষ্যা ক্রিশ্চিনকে। এই চিঠিগুলি সম্প্রতি প্রকাশিত ইংরিজি রচনাবলির নবম খণ্ডে স্থান করে দিয়েছেন পরম নিষ্ঠাবান ও সাবধানী প্রকাশক অদ্বৈত আশ্রম।
.
এইসব চিঠিতে আমাদের প্রিয় বিবেকানন্দ নিরন্তর আশা-নিরাশার দোলায় দুলছেন। কখনও লিখছেন, খুব ভাল ঘুম হচ্ছে, জেনারেল হেথ মোটেই খারাপ নয়। আবার কখনও লিখছেন, বঙ্গজননী আমাকে মাঝে মাঝে হাঁপানি উপহার দেন, কিন্তু হাঁপানি এবার পোষ মানছে। তবে সর্বনাশা রোগ ডায়াবিটিস ও ব্রাইটস ডিজিজ একেবারেই উধাও।
দ্বিতীয় অসুখটি কিডনি সংক্রান্ত, ডায়াবিটিস অনেক সময় একে সঙ্গে নিয়ে আসে, সাধারণ ভাষায় বোধ হয় নেফ্রাইটিস। শুকনো জায়গায় গেলে হাঁপানি যে ঠিক হয়ে যাবে, সে বিষয়ে মহানায়ক বিবেকানন্দ সুনিশ্চিত। কিন্তু রোগের ধাক্কা যখন আসে তখন শরীর আধখানা করে দিয়ে যায়। “তবে আবার শরীরে একটু মেদ জড়ো করতে আমার সময় লাগে না,” আশ্বস্ত করছেন বিবেকানন্দ তাঁর এক মানসকন্যাকে।
আরও একটি চিঠিতে দারুণ গরমে ঘামাচির বিরুদ্ধে সরস মন্তব্য করেছেন স্বামীজি। শরীরের নানা অংশে দগদগে ঘামাচি–আর সেই সঙ্গে তিক্ত মেজাজ। নার্ভ উত্যক্ত, বুঝছেন বিবেকানন্দ, স্বীকার করছেন মাঝে মাঝে ধৈর্যচ্যুত হয়ে এতই রাগারাগি করছেন যে একজনকেও কাছাকাছি দেখতে পাচ্ছেন না যে ধৈর্যময় হয়ে তাকে সহ্য করবে। কিন্তু এবার তিনি রাগ কমিয়ে ফেলতে কৃতসংকল্প, “দেখো, এবার আমি ভেড়ার মতন শান্ত হয়ে উঠবো।”
অক্টোবরের চিঠিতে গরমের বিরুদ্ধে স্বামীজির প্রবল অভিযোগ– আমার গায়ের রঙ এখন কালা আদমিদের থেকেও কালো! স্বামীজির শারীরিক লক্ষণ বিচার করে, খ্যাতনামা চিকিৎসক ডাক্তার সুব্রত সেন আমাকে বললেন, “ব্যাপারটা সুবিধের নয়, কারণ ওটা রেনাল ফেলিওরের লক্ষণও হতে পারে।” ঐতিহাসিক পুরুষদের শরীর স্বাস্থ্য সম্পর্কে নতুন বৈজ্ঞানিক আলোকপাতের চেষ্টা ইদানীং দেশে দেশে চালু হয়েছে, আমরা অবশ্য একেবারেই পিছিয়ে আছি।
নভেম্বরে সিস্টার নিবেদিতাকে স্বামীজি লিখছেন, দুর্গাপূজার সময় থেকে শরীরটা মোটেই ভাল নয়। একই দিনে সিস্টার ক্রিশ্চিনকে আর একখানা চিঠি– কয়েকদিনের মধ্যেই কলকাতা এবং বাংলা ছাড়তেই হবে বর্ষার পরেই ম্যালেরিয়ার প্রকোপ ভীষণ বেড়ে যায়। এরপর তিনি বর্ণনা করেছেন, বেলুড়ে পোষা জন্তু জানোয়ার পাখিদের সঙ্গে তার শিশুসুলভ আনন্দময় জীবনের কথা। মজার মন্তব্য আছে, “আমার চিড়িয়াখানায় মুরগি নেই, ওই জীব এখানে নিষিদ্ধ!”
নভেম্বরের শেষে পরপর দুটি খারাপ খবর “ডান চোখটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।” (মনে হয় ডায়াবিটিসের ফল।) বিবেকানন্দ বুঝেছিলেন কিনা জানি না, তবে লোকে তাকে বলছে কলকাতায় গিয়ে চোখের ডাক্তার দেখাও। স্বামীজি অবশ্যই যাবেন, কিন্তু এই মুহূর্তে সর্দিতে তিনি বিছানাবন্দী। স্বামীজির পরের চিঠিতে সর্দিকাশির সঙ্গে হাঁপানির পুনরাবির্ভাব ঘোষণা।
দুসপ্তাহ পরে বিবেকানন্দ নিজেই শরীর সম্বন্ধে আরও খারাপ খবর দিচ্ছেন শিষ্যা ক্রিশ্চিনকে তিন বছর ধরে তিনি অ্যালবুমিন-ইউরিয়ায় জর্জরিত। মাঝে মাঝে প্রবল ধাক্কা আসে, আবার চলে যায়–তবে কিডনি বোধহয় সুস্থ আছে। বিবেকানন্দ নিজেই ব্যাখ্যা করছেন, ডায়াবিটিস থেকেও খারাপ এই অ্যালবুমিন, রক্ত বিষাক্ত হয়, হার্ট আক্রমণ করে এবং আরও নানারকম বিপদ ঘটায়। সর্দি হলে এর প্রকোপ বেড়ে যায়। এবার আমার ডান চোখটায় ব্লাড ভেসেল ফাটিয়ে দিয়েছে, ফলে আমি প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।…
ডাক্তাররা একসময় আমাদের বিবেকানন্দকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছেন। মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ, হাঁটাচলা এমনকি দাঁড়িয়ে থাকাও বারণ। এখানে আয়ুর্বেদ চিকিৎসার ইঙ্গিত আছে, কবিরাজরা টন টন সোনাচাদি এবং মুক্তা গিলতে বাধ্য করছেন রোগীকে।
এইভাবে জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ এসে গেল। আশানিরাশার দোলায় দুলছে পত্রলেখক বিবেকানন্দ। কখনও বলছেন, ঘুম হচ্ছে, কোনো অসুবিধা নেই, একটু বিশ্রাম নিলেই দুরাত্মা ডায়াবিটিস ও অ্যালবুমিন দূর হয়ে যাবে। কখনও লিখছেন, সম্ভব হলে ভাল আমলকী পাঠাও, কলকাতার আমলকী সুবিধের নয়। ক্রিশ্চিনকে লেখা স্বামীজির শেষ চিঠি : আমার সম্বন্ধে একটুও উদ্বিগ্ন হয়ো না। সেই সঙ্গে সুখবর, শরীর ইদানীং এতই ভাল যে শীর্ণতা কাটিয়ে মধ্যপ্রদেশে একটু ভুঁড়ির ইঙ্গিতও দেখা যাচ্ছে!
কিন্তু দুঃসময় তো সুদূর নয়। বিভিন্ন সূত্র থেকে আমরা দেখছি, বারাণসীতেও তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তিনজন সেবক পালা করে সারারাত বিনিদ্র বিবেকানন্দকে হাত পাখার হাওয়া করছেন।
স্বামীজি বারাণসী থেকেই নিবেদিতাকে লিখছেন : বসতে পর্যন্ত পারছি না। সবসময় ঘুসঘুসে জ্বর, সেই সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। কয়েকদিন পরে পা এমন ফুলে ওঠে যে হাঁটতে পারছেন না।
জীবনের শেষ কয়েক মাস স্বামীজির রোগজীর্ণ শরীরকে কেন্দ্র করে অনেক ডাক্তারি হয়েছে।
অন্যতম চিন্তার কারণ শোথ বা ড্রপসি। কবিরাজ মহানন্দ সেনগুপ্ত এলেন। তার নির্দেশ, কয়েক সপ্তাহ জল ও নুন একেবারেই খাওয়া চলবে না। প্রতিজ্ঞা করলেন বিবেকানন্দ, তাই হবে। কী অসীম মনোবল থেকে এই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা যায়, তা আমাদের মতন মানুষের চিন্তার বাইরে। তরল পদার্থের মধ্যে একটু দুধ। এমন দুর্জয় মনোবল যে মুখে জল দিয়ে মুখ কুলকুচি করছেন কিন্তু এক বিন্দু তৃষ্ণার জল গলা দিয়ে শরীরে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না। শুধু কবিরাজী নয়, প্রিয় গুরুভাইরা বড় বড় অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তারের কাছেও ছুটছে। একজনের নাম পাওয়া যাচ্ছে–ডাক্তার সন্ডার্স।
মহাসমাধির কয়েকদিন আগে হাওয়া বদলাতে স্বামীজি কলকাতার কাছে বড় জাগুলিয়া গিয়েছিলেন প্রথমে ট্রেনে, পরে গোরুর গাড়িতে সাত মাইল। আনন্দিত বিবেকানন্দ তার চিঠিতে লিখলেন, এমন ধকলের পরেও ড্রপসি ফিরে এল না, পা ফুলল না।
এরই মধ্যে নানা চিন্তায় বিপন্ন এবং বিব্রত আমাদের বিবেকানন্দ। অর্থাভাব। নিবেদিতার কাছে চিঠি, ইউরোপ থেকে সামান্য যে অর্থ নিয়ে এসেছিলাম তা মায়ের অন্নসংস্থান ও দেনা শোধে খরচ হয়ে গিয়েছে। সামান্য যা পড়ে আছে তা আমি স্পর্শ করতে পারব না, কারণ আত্মীয়দের সঙ্গে পৈত্রিক বাড়ির মামলায় খরচ যোগাতে হবে।
এই সময় গুরুভাই রামকৃষ্ণানন্দ মাদ্রাজ থেকে স্বামীজির সঙ্গে দেখা করতে এসে, অবাক কাণ্ড করলেন। তার সারাজীবনের ব্যক্তিগত সঞ্চয় ৪০০ টাকা জোর করে তার প্রিয় গুরুভাইকে দিয়ে গেলেন। বিবেকানন্দ বিমোহিত–এমন ভালবাসা কে কোথায় দেখেছে? সেই টাকা গ্রহণ করলেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিবেদিতাকে লিখলেন, ওই টাকা আমি মঠে রেখে দিয়েছি। যদি হঠাৎ আমার দেহাবসান হয় তা হলে অবশ্যই দেখো ওই টাকা যার সে যেন ফেরত পায়।
প্রায় এক বছর রাত্রে স্বামীজির চোখে ঘুম নেই। বিনিদ্র বিবেকানন্দর শরীর তখন এমন যে অসাবধানে স্পর্শ করলেও প্রবল যন্ত্রণা হয়। প্রিয় শিষ্যকে স্বামীজি বললেন, “আর কেন শরীর সম্পর্কে প্রশ্ন? প্রতিদিন দেহটা আরও বিকল হয়ে যাচ্ছে। বাংলায় জন্মে, এই শরীরটা কোনও দিনই অসুখ থেকে মুক্ত ছিল না। স্বাস্থ্যের পক্ষে এই প্রদেশটা মোটেই ভাল নয়। একটু বেশি পরিশ্রম করতে চাইলেই, চাপ সহ্য করতে না পেরে দেহটা ভেঙে পড়ে।”
কাজ করতে করতে চলে যেতে চান কর্মযোগী বিবেকানন্দ। কুঁড়েমি করে বসে থাকার জন্যে তো এই মানব শরীরের সৃষ্টি হয়নি।
শেষ পর্বে স্বামীজির রোগের তালিকায় নতুন সংযোজন উদরী, অর্থাৎ পেটে জল হওয়া। তিরোধানের কিছু আগে রোগাক্রান্ত, বিনিদ্র, ধৈর্যচ্যুত, তিতিবিরক্ত যে বিবেকানন্দকে আমরা দেখতে পাই, তিনি প্রায়ই প্রিয়জনদের এমন বকাবকি করেন যে তাদের চোখে জল পড়ে।
*
আমরা আগেই দেখেছি, স্বামীজির অন্যতম সমস্যা ছিল বিনিদ্রা। ঈশ্বর এই মানুষটির চোখে ঘুম দিতে চাইতেন না, ফলে প্রায়ই সারারাত ধরে চলত নিদ্রাদেবীর চরণে হৃদয়বিদারী সাধাসাধি।
স্বামী অখণ্ডানন্দ লিখেছেন, “বেলুড়ে তখনও রাত আছে, উঠে পড়েছি, উঠেই স্বামীজিকে দেখতে ইচ্ছে হল। স্বামীজির ঘরে গিয়ে আস্তে আস্তে টোকা দিচ্ছি, ভেবেছি স্বামীজি ঘুমোচ্ছেন, উত্তর না আসলে আর জাগাবো না। স্বামীজি কিন্তু জেগে আছেন–ঐটুকু টোকাতেই উত্তর আসছে গানের সুরেনকিং নকিং হু ইজ দেয়ার? ওয়েটিং ওয়েটিং ও ব্রাদার ডিয়ার।”
মঠে এমন দিনও গিয়েছে যে আলোচনা করতে গিয়ে রাত দুটো বেজে গিয়েছে, স্বামীজি বিছানায় শোননি, চেয়ারে বসেই রাতটা কাটিয়েছেন। একবার নীলাম্বর মুখুজ্যের বাগানে নানাবিষয়ে রাত দুটো পর্যন্ত সন্ন্যাসীদের প্রাণবন্ত আলোচনা চললো। চারটে না বাজতেই অখণ্ডানন্দকে স্বামীজি সবাইকে তুলে দিতে বললেন–”লাগা ঘণ্টা, সব উঠুক, শুয়ে থাকা আর দেখতে পারছি না।”
অখণ্ডানন্দ বললেন, “এই দুটোর সময় শুয়েছে, ঘুমোক না একটু।”
স্বামীজি : “কি দুটোর সময় শুয়েছে বলে ছ’টার সময় উঠতে হবে নাকি? দাও আমাকে, আমি ঘণ্টা দিচ্ছি–আমি থাকতেই এই! ঘুমোবার জন্য মঠ হল না কি?”
বিনিদ্র বিবেকানন্দ সম্বন্ধে এত কথা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে যে তা ধৈর্য ধরে সংগ্রহ করতে পারলে বোঝা যাবে মানুষটা জীবনের প্রতি মুহূর্তে কত কষ্ট সহ্য করেছেন, কিন্তু কিছুতেই পরাজয় মেনে নিতে চাননি। যে ৪ জুলাই (১৯০২) তার মহাসমাধি হলো, সেদিনও তিনি দিবানিদ্রার নিন্দা করলেন। সাধুদের বলেন, বললেন, “তোরা ঘুমোবি বলে মঠ হল নাকি?”
স্বামীজিকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে স্বামী অখণ্ডান মন্তব্য করেছেন, স্বামীজি কখনও রাগতেন না, তবে বকাবকি করতেন খুব। পান থেকে চুন খসবার উপায় ছিল না। যার উপর তার যত বিশ্বাস, যে যত আপনজন সে তত বেশি বকুনি খেত তাঁর কাছ থেকে। অন্তলীলা পর্বে এই বকুনির পরিমাণ বেশ বেড়ে গিয়েছিল, কারণ তিনি চাইছিলেন এমন এক মঠজীবন তৈরি করে যাবেন যার কোনও তুলনা থাকবে না। শুধু অধ্যাত্মজীবন ও শাস্ত্ৰপঠন নয়, মঠের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাও হবে ত্রুটিহীন। তাই বিশ্ববিজয় করে বেলুড়ে ফিরে এসেও তিনি মঠের বড় বড় হান্ডা মেজেছিলেন–এক ইঞ্চি পুরু ময়লা।
শুনুন স্বামী অখানন্দের মুখে : “তিনি মঠের খাটা পায়খানা পরিষ্কার করেছেন–তা জানো? একদিন গিয়ে দেখেন খুব দুর্গন্ধ। বুঝতে আর বাকি কিছু রইল না। স্বামীজি গামছাটা একটু মুখে বেঁধে দু’হাতে দুটো বালতি নিয়ে যাচ্ছেন! তখন সবাই দেখতে পেয়ে ছুটে আসছে, বলছে, স্বামীজি আপনিস্বামীজির হাসি হাসি মুখ, বলছেন, এতক্ষণে স্বামীজি আপনি।”
এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, স্থানীয় বালি মিউনিসিপ্যালিটি বেলুড় মঠকে বিদেশপ্রত্যাগত নরেন্দ্রনাথ দত্তের আমোদ-উদ্যান বলে নির্ধারিত করে মোটা ট্যাক্সো বসিয়ে দেন এবং এ নিয়ে শেষপর্যন্ত স্বামীজিকে আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়। এই পর্বে মঠের পায়খানা পরিষ্কার বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সমকালের কোনও অবিচার, অবজ্ঞা ও অপমান কিন্তু বিবেকানন্দকে স্পর্শ করতে, স্তব্ধ করতে, অথবা বিরক্ত করতে পারেনি। তার যত কিছু মান-অভিমান ও বকাবকি সব তার প্রিয় গুরুভাই ও শিষ্যদের প্রতি। শেষপর্বে সবচেয়ে বেশি ধাক্কা সামলেছেন তার চিরবিশ্বস্ত সখা স্বামী ব্রহ্মানন্দ। যাঁর ডাকনাম রাখাল। স্বামীজি ছিলেন রাখালের থেকে নয়দিনের বড়। বিশ্বসংসারের সমস্ত আঘাত, আর সেইসঙ্গে রোগজর্জর শরীরের সমস্ত যন্ত্রণা নিঃশব্দে সহ্য করে, স্বামীজি বকতেন তার অতি প্রিয়জনদের, তাদের কাছে আশা করতেন পান থেকে চুন খসবে না, সবকিছু হয়ে উঠবে সর্বাঙ্গসুন্দর।
হরিমহারাজের স্মৃতি থেকে (স্বামী তুরীয়ানন্দ) আমরা জানতে পারি, স্বামীজি একদিন মঠ থেকে রেগে বেরিয়ে গেলেন। বললেন, “তোরা সব ছোটলোক, তোদের সঙ্গে থাকতে আছে! তোরা সব আলু-পটল শাক পাতা নিয়ে ঝগড়া করবি।”
বলাবাহুল্য রাগতেও যত সময় ঠাণ্ডা জল হয়ে যেতে তার থেকেও কম সময় নিতেন স্বামীজি। কিন্তু সন্ন্যাসীদের কাছে তার প্রত্যাশা ছিল সীমাহীন। “তোরা সব বুদ্ধিমান ছেলে, হেথায় এতদিন আসছিস। কী করলি বল দিকি? পরার্থে একটা জন্ম দিতে পারলি না? আবার জন্মে এসে বেদান্ত-ফেদান্ত পড়বি। এখন পরসেবায় দেহটা দিয়ে যা, তবে জানব আমার কাছে আসা সার্থক হয়েছে।”
রামকৃষ্ণ মঠের প্রথম অধ্যক্ষ রাজা মহারাজ (ব্রহ্মানন্দ) একবার বলেছিলেন, “স্বামীজিকে কে বুঝেছে, কে বুঝতে পারত? তাঁর বই পড়ে, তাকে বোঝা, আর তার কাছে থেকে তাকে বোঝা এক জিনিস নয়। তার কাছে থাকা, তাকে সহ্য করা যে কত কঠিন ছিল তা এরা জানে না। তার বকুনি সহ্য করতে না পেরে আমারই কতবার মনে হয়েছে মঠ ছেড়ে চলে যাই। একদিন বকুনি খেয়ে দুঃখে অভিমানে দরজা বন্ধ করে কাঁদছি, কিছুক্ষণ পরেই স্বামীজি দরজায় টোকা মারছেন, দরজা খুল্লম। চোখে জল দেখে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘রাজা, ঠাকুর তোমাকে কত আদর করতেন, ভালবাসতেন, সেই তোমাকেই আমি বকি, কত কটু কথা বলি, আমি আর তোমাদের কাছে থাকবার যোগ্য নই।
বলতে বলতে স্বামীজির চোখে জল ঝরছে, আমি তখন তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে দিতে বললাম, তুমি ভালবাস বলেই বকো, বুঝতে পারি না বলে অনেক সময় কান্না পায়।
স্বামীজি বলতে লাগলেন, আমি কী করব, আমার শরীরটা চব্বিশ ঘণ্টাই জ্বলছে, মাথার ঠিক থাকে না। আমি বেঁচে থাকলে তোমাদের হয়ত বৃথা কষ্ট দেব। দেখ রাজা, একটা কাজ করতে পারো? ওদের রেসিং হর্স যখন অকেজো হয়ে পড়ে তখন কী করে জানো? তাকে বন্দুকের গুলিতে মেরে ফেলে। আমি তোমাকে একটা রিভলবার জোগাড় করে দেব, তুমি আমাকে গুলি করে মারতে পারবে? আমাকে মারলে কোনও ক্ষতি হবে না, আমার কাজ ফুরিয়ে গেছে।”
এই রাজা মহারাজ বেলুড়ে পাঁচটি চারা বাতাবি লেবু গাছ। লাগিয়েছিলেন, কারণ ডাক্তাররা বিবেকানন্দকে বাতাবি লেবু খেতে বলেছিলেন।
স্বামীজির শরীর থাকতে থাকতে কেবল গাছগুলিতে ফুল দেখা দিয়েছিল বলে পরবর্তী সময়ে স্বামী ব্রহ্মানন্দ খুব দুঃখ করতেন। শোনা যায়, রাজা মহারাজকে স্বামীজি শেষের দিকে একবার বলেছিলেন, “এবার যা হয় একটা এপার ওপার করব, হয় শরীরটা ধ্যান, জপ করে সারিয়ে কাজে ভাল করে লাগব, না হয় তো এ ভাঙা শরীর ছেড়ে দেব।”
রোগজর্জরিত সিংহের আর এক মর্মস্পর্শী ছবি পাওয়া যায় স্বামী গম্ভীরানন্দর বর্ণনায়। “স্বাস্থ্য ভাল না থাকায় তিনি সবসময় নিচে নামিতে পারিতেন না–তখন শয্যাতেই শায়িত থাকিতেন–অসুখ কম থাকিলে তিনি নিচে নামিয়া ভ্রমণে বাহির হইতেন…কখনও কেবলমাত্র কৌপীনপরিহিত হইয়া মঠের চতুর্দিকে ভ্রমণ করিতেন, অথবা একটা সুদীর্ঘ আলখাল্লায় দেহ আবৃত করিয়া পল্লীর নিভৃত পথে একাকী বিচরণ করিতেন।…অনেক সময় রন্ধনশালায় গিয়া রন্ধনাদি পর্যবেক্ষণ করিতেন, অথবা স্বয়ং শখ করিয়া দুই-একটি উৎকৃষ্ট দ্রব্য প্রস্তুত করিতেন।”
এই পর্বে তিনি যে সামাজিক আদব-কায়দার ধার ধারতেন না তা এখন আমাদের অজানা নয়।
যেমন ইচ্ছা তেমন ঘুরে বেড়াতেন–”কখনও চটিপায়ে, কখনও খালি গায়ে, কখনও গেরুয়া পরিয়া, কখনও বা খালি কৌপীন আঁটিয়া, অনেক সময় হাতে থাকিত হুঁকা বা লাঠি।…তিনি থাকিতেন আপন নির্জন মানসভূমিতে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বচ্ছন্দ।”
একাধিক স্মৃতিকথায় দেখা যাচ্ছে, শেষ দিকটায় স্বামীজি মানুষের সংস্রব একরকম ছেড়ে দিয়েছিলেন।
স্বামী অখণ্ডানন্দ বলেছেন, “বরং গোখরো সাপ পোষ মানে, তবে মানুষ বসে আসে না। স্বামীজিও শেষ দিকটায় মানুষের উপর বিরক্ত হয়ে, শরীর ছাড়বার আগে মায়ার বন্ধন কাটাতে মানুষের সংস্রব একরকম ছেড়ে দিয়েছিলেন।”
অন্য এক দৃষ্টিকোণ থেকে–মানুষের উপর বিশ্বাস মোটেই টলেনি, কিন্তু বাল্যের কিছু অভ্যাস ফিরে আসতে চাইছিল তার মধ্যে। যেমন পশুপক্ষীর প্রতি প্রবল আগ্রহ।
পায়রার শখটা স্বামীজি পেয়েছিলেন তার মামাহীন মামার বাড়ির দিক থেকে। জননী ভুবনেশ্বরীও পায়রা ভালবাসতেন বলে বাড়িতে বরাবর পায়রা থাকতো। ছোটবেলায় স্বামীজির খেয়াল হল ময়ূর, ছাগল, বাঁদর ইত্যাদি পুষবেন। তিনি নিজের হাতে এদের খাওয়াতেন। ময়ূরটিকে পাড়ার লোকরা ঢিল মেরে মেরে শেষ করল। বাঁদরটি এমন উৎপাত করত যে তাকে বিদায় করার পথ রইল না। মেজভাই মহেন্দ্রনাথ লিখেছেন, ছাগলটি গৌরমোহন স্ট্রিটের ঠাকুরদালানের নিচে কিছুদিন ছিল।
স্বামীজির বেশ কিছু বাল্যস্বভাব দুর্জয়ভাবে ফিরে এল মহাসমাধির কিছু আগে। স্বামীজি নিজে দাঁড়িয়ে সব জানোয়ারকে খাবার খাওয়াতেন। “কতকগুলো চিনেহাঁস, রাজহাঁস, পাতিহাঁস একদিকে, ছাগল-ভেড়া একদিকে, পায়রা একদিকে এবং গরু একদিকে।”
স্বামীজি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এদের খাওয়া দেখতেন। বেলুড়ের চিড়িয়াখানায় আরও সভ্য ছিল–যেমন কুকুর, সারস, বেড়াল, গাভী, ভেড়া ও হরিণ। এদের সঙ্গে তিনি শুধু কথা বলতেন তা নয়, এদের সুন্দর সুন্দর নাম দিয়েছিলেন। যেমন চিনা হাঁসের নাম যশোবতী, রাজহাঁসের নাম বম্বেটে, ছাগলের নাম হংসী, ছাগলছানার নাম মটরু। প্রিয় কুকুরের নাম বাঘা, আর দুটি কুকুরের নাম মেরি ও টাইগার।
মটরুর গলায় তিনি ঘুঙুর পরিয়ে দিয়েছিলেন। সে স্বামীজির পায়ে পায়ে ঘুরত, স্বামীজিও ছোট ছেলের মতো তার সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করতেন।
মটরু মরে গেলে স্বামীজি দুঃখ করেছিলেন, “কী আশ্চর্য, আমি যেটাকে একটু আদর করতে যাই, সেটাই যায় মরে।” আর একদিন বলেছিলেন, “মটরু নিশ্চয় আর জন্মে আমার কেউ হত!”
মাঝে মাঝে ছাগলী হংসীর কাছে গিয়ে তিনি চায়ের দুধের জন্য এমনভাবে অনুনয়-বিনয় করতেন, যেন দুধ দেওয়া না-দেওয়া হংসীর ইচ্ছাধীন।
স্বামীজির এই সময়কার চিঠিপত্রে তাঁর প্রিয় পশুপাখিদের অনেক খবর পাওয়া যাচ্ছে। স্বামী গম্ভীরানন্দ তাঁর বইতে নিবেদিতাকে লেখা স্বামীজির চিঠির উল্লেখ করেছেন। “আমার সেই বিশালাকায় সারসটি এবং হংস হংসীগুলি খুবই স্ফুর্তিতে আছে। আমার পোষ কৃষ্ণসারটি মঠ থেকে পালিয়েছিল এবং তাকে খুঁজে বার করতে আমাদের দিনকয়েক বেশ উদ্বেগে কাটাতে হয়েছে। আমার একটি হংসীদুর্ভাগ্যক্রমে কাল মারা গেছে। প্রায় এক সপ্তাহ যাবৎ তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল।…একটি রাজহংসীর পালক খসে যাচ্ছিল। আর কোন প্রতিকার জানা না থাকায় একটা টবে খানিকটা জলের সঙ্গে একটু কার্বলিক এসিড মিশিয়ে তাতেই কয়েক মিনিটের জন্য তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।…তা হংসীটি এখন ভাল আছে।”
১৯০২ সালে স্বামীজি স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য কাশী গিয়েছিলেন, কিন্তু তখন তার শরীরের অবস্থা খুব খারাপ। ডায়াবিটিসের দাপটে একটি চোখ প্রায় নষ্ট। তখনও কিন্তু তিনি চিঠিতে বেলুড়ে ব্রহ্মানন্দকে অনুরোধ করছেন, “ছাগলটাকে একটু দেখো।”
সিস্টার ক্রিশ্চিনকে বেলুড় মঠ থেকে স্বামীজি এক চিঠিতে (২৭ মে ১৯০২) জানাচ্ছেন, “দুটি ছাগলছানা ও তিনটি ভেড়া সদ্য আমার ফ্যামিলির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আরও একটি ছাগলছানা ছিল, কিন্তু সে হলদে রঙের মাছের চৌবাচ্চায় ডুবে মরেছে।”
ডাক্তারের নির্দেশনা মেনে পরিবারের নতুন সদস্যদের দেখতে বেরোবার আগে বিবেকানন্দ লিখছেন, “একটা রাজহাঁস একেবারে বোকা এবং ভীতু সবসময় হতাশ আর কাতর। সে একলা থাকতে চায়, বেচারা বড্ড দুঃখী।”
পশুপালন সম্পর্কে জুন ১৯০১ সালের শেষদিকে বেলুড় মঠ থেকে স্বামীজি তাঁর স্নেহের শিষ্যা ক্রিশ্চিনকে আর একটি চিঠি লেখেন। “আমার এখানে কয়েকটি ছাগল ভেড়া গোরু কুকুর এবং সারস রয়েছে। সারাদিন ধরে আমি তাদের দেখাশোনা করছি। আমার সুখের জন্যে এই চেষ্টা নয়–তার প্রয়োজন কী? আমরা অসুখীও বা হব না কেন? দুটোরই কোন মানে হয় না। আমি স্রেফ সময় কাটাবার চেষ্টা চালাচ্ছি।”
কয়েকমাস পরে ক্রিশ্চিনের কাছে লেখা চিঠিতে জানা যাচ্ছে, নবজাত দুটি শাবককে বাঁচাবার জন্য তাদের গোরুর দুধ খাওয়াচ্ছেন স্বামীজি, কিন্তু রাতের অন্ধকারে তারা মারা গেল।
“আমার দুটি হাঁস তাদের ডিমে তা দিচ্ছে। যেহেতু এ দুটি তাদের প্রথম সন্তান এবং যেহেতু পুরুষ হাঁসের কাছ থেকে কোনওরকম সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে না, সেহেতু আমি নিজেই খাইয়ে-দাইয়ে তাদের শক্তি অটুট রাখার চেষ্টা চালাচ্ছি। এখানে চিকেন প্রতিপালন হয় না–এই বস্তুটি এখানে নিষিদ্ধ।”
স্বামী অখণ্ডানন্দ কিন্তু নিজের মত পরিবর্তনে রাজি নন। তিনি বলে যাচ্ছেন : “স্বামীজি শেষটায় মানুষের সঙ্গে ব্যবহারে হতাশ হয়ে জীবজন্তু নিয়ে থাকতেন।…দস্তুরমতো একটা চিড়িয়াখানা তৈরি করেছিলেন। নিজের সেবার টাকা থেকে তাদের জন্য ১০০ টাকা খরচ করতেন।”
স্বামী ব্রহ্মানন্দের উপর ছিল বাগানের ভার এবং পশুদের হাত থেকে বাগানের ফসল রক্ষার জন্য যে বেড়া দেওয়া হচ্ছে তাও বিদেশিনী ভক্তরা স্বামীজির চিঠি থেকে নিয়মিত জানতে পারছেন। দুই গুরুভাই প্রায়ই বাগান ও গোচারণভূমির সীমা-বিভাগ নিয়ে মধুর কলহে প্রবৃত্ত হতেন এবং তাতে মঠবাসীরা খুব আমোদ উপভোগ করতেন।
স্বামীজির অতিপ্রিয় সারমেয় বাঘা নিতান্ত সাধারণ কুকুর নয়, সে মঠের জনসংযোগ অধিকর্তার দায়িত্ব পালন করত, বিশিষ্ট অতিথিদের মঠের গেট থেকে কর্তৃপক্ষের কাছে এনে দিত। এ-বিষয়ে শঙ্করীপ্রসাদ বসু যে বিবরণ সংগ্রহ করে দিয়েছেন তা পাঠকদের আনন্দ দেবে।
স্বামীজির শেষদিনগুলিতে বুঝতে গেলে বাঘাকেও জানা দরকার। “একবার অত্যধিক দুষ্টুমির জন্য তাহাকে গঙ্গার পরপারে নির্বাসনে যাইতে হয়। কিন্তু বাঘা এই ব্যবস্থা মানিয়া লইতে সম্মত ছিল না–সে মঠকে ভালবাসিত, বিশেষত স্বামীজিকে ছাড়িয়া থাকিতে পারিত না। সারাদিন অতীব দুঃখে কাটাইয়া সে সন্ধ্যাকালে এক ফন্দি আঁটিল এবং খেয়া নৌকায় উঠিয়া বসিল। নৌকার মাঝি ও আরোহীরা তাহাকে তাড়াইতে চেষ্টা করিলেও সেনামিলনা,বরং দন্ত বাহির করিয়া ও গর্জন করিয়া ভয় দেখাইতে লাগিল।…এপারে আসিয়া সে রাত্রিটা এদিক-ওদিক লুকাইয়া কাটাইল। ভোর চারিটায় স্বামীজি স্নানাগারে যাইতেছেন, এমন সময় পায়ে কী একটা ঠেকায় তিনি চমকিয়া উঠিলেন ও চাহিয়া দেখিলেন বাঘা! বাঘা তাহার পায়ে লুটাইয়া মিনতিপূর্ণ কণ্ঠে ক্ষমাভিক্ষা ও পুনঃপ্রবেশাধিকার ভিক্ষা করিতে লাগিল।…স্বামীজি তাহার পিঠ চাপড়াইয়া আদর করিলেন ও আশ্বাস দিলেন, অধিকন্তু সকলকে বলিয়া দিলেন, বাঘা যাহাই করুক, আর তাহাকে তাড়ানো চলিবে না।”
স্বামী অখণ্ডানন্দর স্মৃতি থেকে আমরা স্বামীজির দেহাবসানের পরে পশুশালার শেষ পরিণতির কিছু দুঃখজনক খবরও পাই। অন্য কোথাও এই বিবরণ আমার চোখে পড়েনি। স্বামী অখণ্ডানন্দ লিখেছেন, “আশ্চর্যের বিষয়, স্বামীজির দেহরক্ষার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ভক্ত পশুপাখী সব মরে যায়। তিনি যাকে যা দিয়ে গিয়েছিলেন, তার একটিও বেশিদিন বাঁচেনি। ভক্তেরা বলেন, তারা সব উদ্ধার হয়ে গেল।”
স্বামীজির দেহাবসানের পর খোকা মহারাজ (স্বামী সুবোধানন্দ) কয়েকটি পশুপক্ষী স্বামী অখণ্ডানন্দকে দিয়েছিলেন। শুনুন তাদের শেষ পরিণতির কথা। “একটি বেড়াল স্বামীজির পায়রাটিকে লুকিয়ে লুকিয়ে খায়। অমূল্য মহারাজ (স্বামী শঙ্করানন্দ) সেইসময় আশ্রমে ছিলেন। তিনি বিড়ালটিকে এমন ঘুষি মেরেছিলেন যে তাঁর হাত থেতলে গিয়েছিল।”
একমাত্র প্রিয় বাঘাই অপেক্ষাকৃত দীর্ঘজীবী হয়েছিল। স্বামীজির লীলাসংবরণের অনেককাল পরে বাঘার মৃত্যু হইলে তাহার দেহ গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হইল। জোয়ারের সময় সে শরীর ভাসিয়া চলিয়া গেলেও ভাটার সময় সকলে সবিস্ময়ে দেখিলেন, উহা মঠের সীমানার মধ্যেই গঙ্গার পলিমাটির উপর পড়িয়া আছে। ইহাতে মঠের প্রতি বাঘার প্রাণের টানের পরিচয় পাইয়া মঠবাসী একজন ব্রহ্মচারী অপরদের অনুমতিক্রমে ওই দেহ ওই স্থানেই সমাধিস্থ করিলেন।”
ডায়াবিটিস ধরা পড়ার সামান্য কিছুদিনের মধ্যে স্বামীজির শরীর কীভাবে ভেঙে পড়ে তার নানা ইঙ্গিত ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন চিঠিপত্রে এবং নানা স্মৃতিকথায়। মহাসমাধির কিছুদিন আগে কলকাতার বলরাম বসুর বাড়িতে সেকালের একজন প্রখ্যাত চিকিৎসককে ডাকা হয়েছিল স্বামীজিকে দেখতে। বিভিন্ন চিকিৎসায় স্বামীজি তখন যে কতখানি ক্লান্ত ও হতাশ হয়ে পড়েছিলেন তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে বড় ডাক্তার সম্পর্কে তার মন্তব্যে। তিনি বলেন, “কী ছাই জানে! দু’চারখানা বই পড়ে ভাবে–আমরা সব মেরে দিয়েছি। আমরা সব জানি। আমরা সব বুঝি।”
দেহত্যাগের এক সপ্তাহ আগে উত্তর কলকাতার বাগবাজারে শিষ্য অসীম বসুর সঙ্গে স্বামীজির দেখা হলো। শিষ্যের বাড়ির সামনে দিয়েই যাচ্ছিলেন স্বামীজি। অসীম বসু জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন আছেন?” স্বামীজি বললেন, “আরে তুমিও যেমন। ডাক্তার বদ্যিতে তো অনেক কথাই বলে। কিন্তু আমার মৃত্যুরোগ। তারা কী করবে?”
.
এই সময়ের বিবেকানন্দর আর একটা ছবি : “কখনও কখনও তিনি কেবলমাত্র কৌপীন পরিহিত হয়ে মঠের চতুর্দিকে ভ্রমণ করতেন। অথবা একটা সুদীর্ঘ আলখাল্লায় দেহ আবৃত করে পল্লীর নিভৃতপথে একাকী বিচরণ করতেন।”..আবার কখনও বইয়ের পাতা উল্টোতেন বা ছবি দেখতেন।
আর এক বিবেকানন্দকে তাঁর প্রিয় শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী একবার দেখেছিলেন নদীর অপর পারে আহিরীটোলা ঘাটে। স্বামীজির বাঁহাতে শালপাতার ঠোঙায় চানাচুর ভাজা, বালকের মতন খেতে খেতে ঘাটের দিকে চলেছেন। শিষ্যকে তিনি বললেন, “চল, তুই মঠে যাবি? চারটি চানাচুর ভাজা খা না, বেশ নুন-ঝাল আছে।”
*
সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের শেষ দিনটিকে তার শ্রদ্ধেয় জীবনীকাররা মহামুক্তির দিন বলে বর্ণনা করেছেন। তার কয়েকদিন আগেও কিছু অবিস্মরণীয় এবং কিছু কৌতুকময় ঘটনা ঘটেছে যার বিস্তারিত বিবরণ অবশ্যপাঠ্য। সিস্টার নিবেদিতার এই কয়েকদিনের বর্ণনা রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ সাহিত্যের মহামূল্যবান সম্পদ।
এই পর্বে স্বামীজি তার পৈত্রিক বাড়ি নিয়ে সমস্যার একটা সমাধান করতে পেরে নিজেকে দায়মুক্ত মনে করেছিলেন। নিবেদিতাকে একাদশীর দিনে পরম যত্নে খাইয়ে তার হাতে জল ঢেলে দিয়েছিলেন। একই সময়ে চলছিল প্রবল উৎসাহে মঠে পাঁউরুটি তৈরির পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
মৃত্যুর আগের দিন স্বামীজি দূত মারফত নিবেদিতার বাগবাজারের বাড়িতে নিজের তৈরি করা ব্রাউন ব্রেড পাঠিয়েছিলেন।
এর আগে ৭ এপ্রিল মহানন্দ কবিরাজ রোগী দেখে মাছ, তেল ও নুন খেতে অনুমতি দিলেন। এরপর জুন মাসের শেষের দিকে কবিরাজী চিকিৎসার ওপর পূর্ণ নির্ভর না করে বরানগরের ডাঃ মহেন্দ্রনাথ মজুমদারকে ডাকা হয়।
ইতিমধ্যে এপ্রিলের একদিনে সবার আড়ালে অনুরাগিনী জোসেফিন ম্যাকলাউডকে স্বামীজি বললেন, “জগতে আমার কিছুই নেই; নিজের বলতে আমার এক কানাকড়িও নেই। আমাকে যখন যা কেউ দিয়েছে তা সবই আমি বিলিয়ে দিয়েছি।”
শুক্রবার, ৪ জুলাই ১৯০২। শেষের সেই দিনের হৃদয়গ্রাহী ছবি কয়েকটি বইতেই অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে অবিস্মরণীয়ভাবে আঁকা হয়েছে।
এই প্রচেষ্টার শুরুতে স্বয়ং নিবেদিতা, তারপর রামকৃষ্ণে নিবেদিতপ্রাণ সন্ন্যাসীলেখকবৃন্দ।
তারই একটি নিতান্ত সংক্ষিপ্তসার এইখানে দেবার চেষ্টা করা যাক ব্যস্ত পাঠক-পাঠিকাদের একনজরে অবগতির জন্যে। স্বামী প্রেমানন্দর এক চিঠি থেকে : “কিছুদিন হতে বৈরাগ্যের ভাব খুব প্রবল দেখতাম…জিজ্ঞেস করতেন, হারে ঠাকুর কোন দুটি গান শেষে শুনতে ভালবাসতেন বলে ‘ভুবন ভুলাইলি মা ভবমোহিনী’ ও ‘কবে সমাধি হব শ্যামাচরণে এই গানগুলি গাইতেন..শেষের দিনেও বেদ সংক্রান্ত পুস্তক আনাইবার জন্য পুণা ও বোম্বাই নগরে তিনখানি চিঠি লেখা হয়।”
• খুব সকালে : ঘুম থেকে উঠে, স্বামীজি মন্দিরে গেলেন উপাসনার জন্য। তার মধ্যে অসুস্থতার কোনও লক্ষণ নেই।
• ব্রেকফাস্টের সময় : সকলের সঙ্গে বেশ হাসি ঠাট্টা হল। যেমন গরম দুধ, ফলাদি খান সেইরূপ খেলেন ও স্বামী প্রেমানন্দকে খাওয়াবার জন্যে কত আগ্রহ করলেন। চা কফি যেরকম খেয়ে থাকেন তাই খেলেন। গঙ্গার একটি ইলিশ মাছ এ বছর প্রথম কেনা হল, তার দাম নিয়ে স্বামী প্রেমানন্দের সঙ্গে কত রহস্য হল! একজন বাঙালকে বললেন, তোরা নতুন ইলিশ পেলে নাকি পুজো করিস? কী দিয়ে পুজো করতে হয় কর।
• প্রভাতী ভ্রমণ : বেড়াতে বেড়াতে স্বামী প্রেমানন্দকে বললেন, আমায় কেন নকল করবি? ঠাকুর নকল কত্তে বারণ করতেন। আমার মতন উড়নচড়ে হবি নে।
• সকাল ৮.৩০ : প্রেমানন্দকে বললেন, “আমার আসন ঠাকুরের শয়নঘরে করে চারিদিকের দরজা বন্ধ করে দে।” ঠাকুরঘরে স্বামীজির ধ্যান শুরু।
• সকাল ১১টা : ধ্যানভঙ্গ। স্বামীজি গুন গুন করে গাইছেন–মা কি আমার কালো, কালোরূপা এলোকেশী, হৃদিপদ্ম করে আলো। ধ্যানান্তে স্বামীজি নিজের হাতে ঠাকুরের বিছানা ঝেড়ে দিলেন।
• সকাল ১১.৩০ : নিজের ঘরে একলা না খেয়ে সকলের সঙ্গে একত্র মধ্যাহ্নভোজন–ইলিশ মাছের ঝোল, ভাজা, অম্বল ইত্যাদি দিয়ে ভাত খেলেন। “একাদশী করে খিদেটা খুব বেড়েছে, ঘটিবাটিগুলো ছেড়েছি কষ্টে!”
• দুপুর ১২.৩০ : ১৫/২০ মিনিট ঘুমিয়ে নিলেন স্বামীজি। স্বামী প্রেমানন্দকে বললেন, “চল পড়িগে। সন্ন্যাসী হয়ে দিবানিদ্রা পাপ।”
“আমার আজ ঘুম হলো না। একটু ধ্যান করে মাথাটা খুব ধরেছে–ব্রেন উইক হয়েছে দেখছি।”
• অপরাহু ১-৪ : অন্যদিনের তুলনায় ঘণ্টা দেড়েক আগে লাইব্রেরি ঘরে সাধু-ব্রহ্মচারীদের ক্লাস নিলেন স্বামীজি। তার পড়ানোর বিষয় : পাণিনী ব্যাকরণ। ক্লাস নেওয়ার পরে স্বামীজি একটু ক্লান্ত হয়ে পড়লেন।
• বিকাল ৪টা : এক কাপ গরম দুধ খেয়ে বেড়াতে বেরোলেন। স্বামী প্রেমানন্দকে সঙ্গী করে বেলুড় বাজার পর্যন্ত গেলেন। প্রায় দু’মাইল ভ্রমণ ইদানীং এতটা যেতেন না।
• বিকাল ৫ : স্বামীজি মঠে ফিরলেন। আমগাছের তলায় বেঞ্চে বসে বললেন, আজ শরীর যেমন সুস্থ, এমন অনেকদিন বোধ করি না। তামাক খেয়ে পায়খানা থেকে এসে বললেন, আমার শরীর আজ খুব ভাল আছে। স্বামী রামকৃষ্ণানন্দের পিতৃদেব শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র চক্রবর্তীর সঙ্গে কিছু কথা বললেন।
• সন্ধ্যা ৬.৩০ : কয়েকজন সন্ন্যাসী চা খাচ্ছিলেন, স্বামীজি নিজে এককাপ চা চাইলেন।
• সন্ধ্যা ৭.০০ : সন্ধ্যারতির ঘণ্টা বাজতেই স্বামীজি নিজের ঘরে চলে গেলেন। সঙ্গে বাঙাল ব্রজেন্দ্র। “আমাকে দু’ছড়া মালা দে, যা, বাইরে গিয়ে জপধ্যান কর। না ডাকলে আসবি না।” স্বামীজি জপে বসলেন দক্ষিণেশ্বরের দিকে মুখ করে।
• সন্ধ্যা ৭.৪৫ : স্বামীজি ব্রজেন্দ্রকে বললেন, “গরম বোধ হচ্ছে। জানলা খুলে দাও।” মেঝের বিছানায় বিবেকানন্দ শুয়ে পড়লেন, হাতে জপমালা। একটু পরে বললেন, “আর বাতাস করতে হবে না। একটু পা টিপে দে।”
• রাত ৯.০০ : এতক্ষণ স্বামীজি চিৎ হয়েছিলেন, এবার বাঁপাশে ফিরলেন। কয়েক সেকেন্ডের জন্যে তার ডান হাত একটু কাপল। স্বামীজির কপালে ঘামের ফেঁটা। এবার শিশুর মতন কান্না।
• রাত ৯.০২ থেকে ৯.১০: গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। মিনিট দুই স্থির, আবার গভীর দীর্ঘশ্বাস। মাথা নড়ে উঠল, মাথা বালিশ থেকে পড়ে গেল। চোখ স্থির, মুখে অপূর্ব জ্যোতি ও হাসি।
• রাত ৯.৩০ : সবাই ছুটে এলেন, ভাবলেন সমাধি হয়েছে। স্বামী বোধানন্দ নাড়ি ধরে কিছুক্ষণ দেখে, দাঁড়িয়ে উঠে কেঁদে ফেললেন। একজন বললেন, “যাও ছুটে যাও মহেন্দ্র ডাক্তারকে ডেকে আনো।” ডাক্তার মজুমদার থাকেন নদীর ওপারে বরাহনগরে। প্রেমানন্দ ও নিশ্চয়ানন্দ সমাধি ভাঙাবার জন্য কানে রামকৃষ্ণ নাম শোনাতে লাগলেন।
• রাত ১০.৩০ : ডাক্তার মজুমদার, স্বামী ব্রহ্মানন্দ ও সারদানন্দ প্রায় এক সঙ্গে বেলুড়ে উপস্থিত হলেন। এলেন বৈকুণ্ঠ সান্যাল।
ডাক্তার মজুমদার দেখলেন, হৃদযন্ত্র বন্ধ। স্বামীজির দু’হাত অর্ধচন্দ্রাকারে সামনে-পিছনে ঘোরাতে বললেন। কৃত্রিম উপায়ে হার্ট সচল করবার সবরকম চেষ্টা চললো।
•১২.০০ : ডাক্তার জানালেন, না, স্বামীজি আর ইহলোকে নেই। হঠাৎ হার্ট বন্ধ হওয়াই দেহাবসানের কারণ।
বিবেকানন্দ ইহলোক ত্যাগ করেছেন ৩৯ বছর ৫ মাস ২৪ দিন বয়সে। তিনি কথা রেখেছেন, বলেছিলেন, আমি ৪০ দেখবো না।
দেহত্যাগের কিছুদিন আগে (২৮ মার্চ ১৯০২) নিবেদিতাকে স্বামীজি বলেছিলেন, “আমার যা দেবার ছিল তা দিয়ে ফেলেছি, এখন আমাকে যেতেই হবে।”
মহাপ্রস্থানের দুদিন আগে তিনি বলেছিলেন, “এই বেলুড়ে যে আধ্যাত্মিক শক্তির ক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা দেড় হাজার বছর ধরে চলবে–তা একটা বিরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ নেবে।”
১লা জুলাই মঠের মাঠে ভ্রমণ করতে করতে গঙ্গার ধারে একটা জায়গা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে স্বামীজি গম্ভীরভাবে বলেছিলেন, “আমার দেহ গেলে ঐখানে সৎকার করবি।”
পরের দিন সকাল : ৫ জুলাই : দেখা গেল চোখ দুটি জবাফুলের মতন রক্তবর্ণ, নাকমুখ দিয়ে অল্প রক্ত বেরুবার চিহ্ন রয়েছে। একজন ডাক্তার (ডাক্তার বিপিন ঘোষ) বললেন, সন্ন্যাস রোগে দেহত্যাগ হয়েছে। মহেন্দ্র ডাক্তার বলে গিয়েছিলেন, হৃৎক্রিয়া বন্ধ হওয়াই মহাপ্রয়াণের কারণ। অন্য ডাক্তাররা ভিন্ন মত প্রকাশ করলেন। “মাথার ভেতর কোনও শিরা ছিঁড়ে গিয়েছে।”
নিবেদিতা এলেন সকাল সাতটায়, দুপুর একটা পর্যন্ত একটানা পাখার হাওয়া করলেন। গর্ভধারিণী ভুবনেশ্বরী দেবী খবর পেলেন সকালবেলায়। ভগ্নীপতিকে নিয়ে ছোটভাই ভূপেন্দ্রনাথ বেলুড় মঠে এলেন, কিছুক্ষণ পরে বিলাপ করতে করতে দৌহিত্র ব্রজমোহন ঘোষকে নিয়ে জননী ভুবনেশ্বরী বেলুড়ে এলেন।
সাধুরা অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে মাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। চিতায় যখন আগুন দেওয়া হল তখন এলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ। স্বামী নিরঞ্জনানন্দ বললেন, “নরেন চলে গেল।” গিরিশ বললেন, “চলে যাননি, দেহত্যাগ করলেন। এবার একটি সাদা রুমালে স্বামীজির লাল পদচিহ্ন তুলে নেওয়া হল।
নিবেদিতা একসময় গিরিশচন্দ্রকে জিজ্ঞেস করলেন, মাকে ওরা বাড়ি পাঠিয়ে দিল কেন? ভূপেন্দ্রনাথ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, “তাঁকে বিষয়টি বুঝিয়ে দেওয়া হল।”
মঠভূমিতে পদচারণ করতে করতে বেলতলার নিকট দাঁড়িয়ে স্বামীজি একদিন বলেছিলেন, ঐ দেখ শরৎ, সামনেই ঠাকুরের চিতাস্মৃতি শ্মশান। আমার মনে হয় সমস্ত মঠভূমির মধ্যে এই স্থানটি সর্বোৎকৃষ্ট। সেই কথা মনে পড়ায় স্বামী সারদানন্দ দেহ সৎকারের জন্য ঐ জায়গাটি মননানীত করে স্থানীয় পৌরপ্রতিষ্ঠানের কর্তার নিকট চিঠি পাঠালেন এবং দু-তিনবার পত্রবিনিময়ের পর তার অনুমতি সংগ্রহ করতে পারলেন।
দাহকার্য সম্পন্ন হল সন্ধ্যা ছ’টার সময়। শেষ মুহূর্তেও কিছু বিস্ময়। নিবেদিতার পত্রাবলীতে যার উল্লেখ রয়েছে। শঙ্করীপ্রসাদ বসুর অনুবাদ ব্যবহার করলাম। মিস ম্যাকলাউডকে লেখা নিবেদিতার চিঠি : “দুটোর সময়ে আমরা সকলে দাঁড়িয়ে আছি বিছানার উপর পাতা একটি বস্ত্রখণ্ডের দিকে তাকিয়ে আমি সারদানন্দকে জিজ্ঞেস করলাম–”ওটাও কি পোড়ানো হবে? ওটাই যে শেষবার আচার্যদেবকে আমি পরতে দেখেছি। সারদানন্দ সেই কাপড়টি আমাকে দিতে চাইলেন। আমি নিতে পারলাম না; শুধু বললাম, যদি মিস ম্যাকলাউডের জন্য পাড়ের কাছে। কোণের একটুকু কেটে নিতে পারি। কিন্তু ছুরি বা কাচি কিছুই ছিল না আমার কাছে। তাছাড়া কাজটা দেখতেও ভাল হত কিনা সন্দেহ। সুতরাং কিছু করলাম না। ছ’টার সময় হঠাৎ কে যেন আমার জামার হাতায় টান দিল। চোখ নামিয়ে দেখি–অগ্নি ও অঙ্গার থেকে অনেক দূরে আমার পায়ের কাছে উড়ে এসেছে ঠিক সেই দুই-তিন ইঞ্চি বস্ত্রখণ্ড–আমার প্রার্থিত। সমাধির ওপর পার থেকে সে যেন তার পত্র, তোমার জন্য।”
শেষ হল স্বামীজির মহাপ্রয়াণপর্বের অতি সংক্ষিপ্ত কথাসংগ্রহ।
*
শতাব্দীর দূরত্বকে সমীহ করেও কয়েকটি প্রশ্ন মনের মধ্য থেকে মুছে ফেলতে এখনও কষ্ট হয়।
• স্থানীয় মিউনিসিপ্যালিটি কেন মঠপ্রাঙ্গণে স্বামীজির শেষকৃত্যের অনুমতি দিতে প্রাথমিক ভাবে বিলম্ব করেছিলেন? এল। দুজনেই নিন্দন হাইকোর্ট জজকে
• শ্রীরামকৃষ্ণের ডেথ সার্টিফিকেট অনেকেই দেখেছেন, কিন্তু বিবেকানন্দের ডেথ সার্টিফিকেট কেউ দেখেছেন কি?
• বিশ্ববন্দিত পুরুষ–সন্ধ্যায় দেহাবসান হল, কিন্তু পরের দিনের কলকাতার সংবাদপত্রে খবরটা ছাপা হল না কেন?
• তিরোধানের পরে বিবেকানন্দ স্মরণসভার দু’জন হাইকোর্ট জজকে সভাপতিত্বের অনুরোধ করা হয়েছিল। দু’জনেই নিন্দাসূচক মন্তব্য করে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। একজন তো বলেছিলেন, হিন্দু রাজা দেশ শাসন করলে বিবেকানন্দকে ফাঁসি দেওয়া হত। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত তার স্মৃতিকথায় এব্যাপারে চাপা দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
• স্বামীজির সমাধিস্থলে ছোট্ট একটি মন্দির তৈরির জন্য অতি সামান্য অর্থ সংগ্রহ করাও সহজ হয়নি কেন? জেনে রাখা ভাল, সামান্য এই কাজটির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে মঠ কর্তৃপক্ষের সময় লেগেছিল পুরো বাইশ বছর। মন্দিরের কাজ শুরু হয় জানুয়ারি ১৯০৭, প্রতিষ্ঠাকার্য সম্পন্ন হয় ২ জানুয়ারি ১৯২৪।
একটা কঠিন সত্য এইসব প্রশ্নর ভিতর থেকে আজও উঁকি দেয়। এক সময় বিশ্বজোড়া আলোড়ন তুললেও স্বামী বিবেকানন্দকে সম্পূর্ণ গ্রহণ করতে আমরা যথেষ্ট সময় নিয়েছি। যুগনায়ক বিবেকানন্দকে ভারতবন্দিত করে তোলার পিছনে সব চেয়ে বড় অবদান বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের। সন্ন্যাসী-সন্তানরা এই প্রতিষ্ঠানকে একশ বছর ধরে প্রাণবন্ত না রাখলে, স্বামী বিবেকানন্দ আজও এইভাবে স্মরণীয় থাকতেন কিনা সন্দেহ হয়।
.
স্বামীজির দেহাবসানের পরের দিনের বিবরণের জন্য আমরা মূলত নির্ভরশীল নিবেদিতার কয়েকটি চিঠি ও ছোটভাই ভূপেন্দ্রনাথের স্মৃতিকথার ওপর। মেজভাই মহেন্দ্রনাথ তখনও কলকাতায় ফিরে আসেননি।
আরও একজনের মূল্যবান অথচ বিষাদময় স্মৃতিচারণ সম্প্রতি ভক্তজনের নজরে এসেছে। প্রত্যক্ষদর্শীর নাম শ্রীচন্দ্রশেখর চট্টোপাধ্যায়। স্বামীজির দেহাবসানের প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে বিশ্ববাণী পত্রিকায় (ভাদ্র ১৩৫৪) তিনি একটি স্মৃতিকথা লেখেন। তার সামান্য অংশ এখানে উদ্ধৃত করলে একালের পাঠকের কৌতূহল কিছুটা নিবৃত্ত হতে পারে।
“…আমাদের আহিরীটোলার বাটীতে স্বামীজির শিষ্য কানাই মহারাজ (স্বামী নির্ভয়ানন্দ) আসিয়া শোকসংবাদটি জানাইয়া গেলেন। তখন আমি কোনও দেবমন্দিরে ঠাকুরের সেবাপূজাদি কার্যে নিযুক্ত ছিলাম। ৯টার পূর্বে বাড়িতে ফিরিয়া দেখিলাম আমার জননী শোকবিহ্বল চিত্তে উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করিতেছেন। কারণ জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেন : “বাবা! তোদের সর্বনাশ হয়েছে–মঠের স্বামীজি আর নেই, দেহ রেখেছেন, আমাকে একবার তাঁকে দেখালি নি!” আমি বলিলাম : “মঠের সকল সাধুই ‘স্বামী, তুমি কোন্ স্বামীজির কথা বলছো? তুমি বোধ হয় ভুল শুনেছো”-”ওরে, কানাই ভোরে এসে খবর দিয়ে গেছে–বড় স্বামীজি কাল রাত ৯টায় শরীর ছেড়ে চলে গেছে। কানাই তোদের মঠে যেতে বলেছে।”
রোরুদ্যমান জননীকে আশ্বস্ত করিয়া বলিলাম : “সাধুর দেহত্যাগে শোক করতে নেই।” ঠিক সেই সময়ে বন্ধু নিবারণচন্দ্র (শ্রীশ্রীমার শিষ্য) উপস্থিত হওয়াতে সেদিন (৫ জুলাই শনিবার) আপিসে না যাইয়া স্বামীজিকে শেষ দর্শন করিবার জন্য আমি ভক্ত নিবারণকে এবং আমার কনিষ্ঠ সহোদর শ্রীমান দুলালশশীকে সঙ্গে লইয়া আহিরীটোলার ঘাটে নৌকায় গঙ্গা পার হইয়া সালিখা ঘুসুড়ির পথে পদব্রজে তিনজনে বেলা দশটায় বেলুড় মঠে গিয়া পঁহুছিলাম।
তখন সামান্য বৃষ্টিপাত হইতেছিল। দেখিলাম পশ্চিম দিকে নীচেকার ছোট দালানে (বারান্দায়) পূজ্যপাদ শ্রীরাখাল মহারাজ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) প্রমুখ কয়েক জন সন্ন্যাসী একখানি সুন্দর খাটে পুষ্পশয্যা রচনায় রত। আমাদের দেখিয়া শ্রীরাখাল মহারাজ কাঁদিয়া ফেলিলেন, তাহার বাক্যস্ফূর্তি হইল না–সিঁড়ির দিক দেখাইয়া উপরে যাইতে ইঙ্গিত করিলেন।
স্বামীজির ঘরে যাইয়া দেখিলাম–একখানি সুন্দর গালিচার উপর শয়ান তাঁহার দিব্যভাবদীপ্ত দেহ বিভূতি-বিভূষিত, মস্তক পুষ্প-কিরীট ভূষণে এবং সর্বাঙ্গ নবরঞ্জিত গৈরিকবসনে সুসজ্জিত; প্রসারিত দক্ষিণ হস্তের অঙ্গুলিতে রুদ্রাক্ষের জপমালাটি জড়িত এবং ধ্যানমগ্ন মহাদেবের ন্যায় অক্ষিতারা অন্তর্মুখী ও অর্ধনিমীলিত–দুই পার্শ্বে ধূপদানি হইতে ধূপের মধুর সৌরভে তাহার ঘরটি আমোদিত।
স্বামীজির বামদিকে ভগিনী নিবেদিতা অপূর্ণনেত্রে বসিয়া হাত-পাখার দ্বারা স্বামীজির মাথায় অনবরত বাতাস করিতেছেন আর অজস্র অশ্রুধারা তাঁহার গণ্ডদেশ বহিয়া ঝরিতেছে। স্বামীজির মস্তকটি পশ্চিমদিকে এবং দুখানি পা পূর্বদিকে গঙ্গাভিমুখে স্থাপিত। তাঁহার পদপ্রান্তে নন্দলাল ব্রহ্মচারী বিষাদ মৌনমুখে নীরবে বসিয়া রহিয়াছেন। আমরা তিনজনে মস্তক অবনত করিয়া স্বামীজির পাদপদ্ম স্পর্শ ও প্রণাম করিয়া সেখানে বসিলাম। স্পর্শ করিয়া অনুভব করিলাম স্বামীজির দেহবরফের মতনই ঠাণ্ডা হইয়া গিয়াছে।
স্বামীজির দক্ষিণকরের অঙ্গুলিতে রুদ্রাক্ষের মালার দানাগুলিতে আমি গুরুদত্ত মন্ত্র জপ করিয়া লইলাম। ইতিমধ্যে কলিকাতা এবং অন্যান্য স্থান হইতে সমাগত বহু ভদ্রলোক এবং ভক্ত উপরের ঘরে আসিয়া স্বামীজিকে শেষ দর্শন এবং প্রণামাদি করিয়া একে একে চলিয়া গেলেন–রহিলাম কেবল আমরা তিনজন, ব্রহ্মচারী নন্দদুলাল এবং ভগিনী নিবেদিতা।
আমার জপ সাঙ্গ হইলে, ভগিনী নিবেদিতা আমাকে ডাকিয়া চুপি চুপি বলিলেন : “Can you sing, my friend? Would you mind singing those songs which our Thakur used to sing?” ওই বিষয়ে আমার। অক্ষমতা জানাইলে, ভগিনী পুনরায় অনুরোধ করেন : “will you please request your friend on my behalf?”
তখন বন্ধু নিবারণচন্দ্র সুমধুর স্বরে কয়েকখানি গান প্রাণ খুলিয়া গাহিতে লাগিলেন : যতনে হৃদয়ে রেখো আদরিণী শ্যামা মাকে’, ‘গয়াগঙ্গাপ্রভাসাদি কাশী কাঞ্চী কেবা চায়’, ‘কে বলে শ্যামা আমার কালো, মা যদি কালো তবে কেন আমার হৃদয় করে আলো’, ‘মজলো আমার মন ভ্রমরা, শ্যামাপদ নীলকমলে’, ‘মন আমার কালী কালী বলনা, কালী কালী বললে পরে, কালের ভয় আর রবে না ইত্যাদি।…
বেলা প্রায় একটার সময় শ্রীশরৎ মহারাজ (স্বামী সারদানন্দ) দোতলায় স্বামীজির ঘরে আসিয়া আমাদের তিনজনকে এবং ব্রহ্মচারীকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন : “বাবা! স্বামীজি চলে যাওয়াতে আমরা ভেঙে পড়েছি তামাদের বল টুটে গেছে। তোরা সকলে ধরাধরি করে স্বামীজির দেহখানি নীচে নামিয়ে আনতে পারবি?”
তৎক্ষণাৎ আমরা তিনজন গৃহী ভক্ত এবং উক্ত নন্দলাল ব্রহ্মচারীজি স্বামীজির দেহখানি বহন করিয়া ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়া নামিয়া আসিয়া নীচের দালানে পুষ্পসজ্জিত পালঙ্কের উপরে স্থাপন করিলাম। সেই সময়ে গোটাকতক বেদানা, আপেল, ন্যাসপাতি, আঙুর, স্বামীজির বক্ষের উপরে সাজাইয়া দেওয়া হইল। তখন বুড়ো গোপাল দাদা (স্বামী অদ্বৈতানন্দ) ব্রহ্মচারীজিকে বলিলেন : “ওরে নন্দলাল! আমাদের সকলের চেয়ে স্বামীজি তোকেই বেশি ভালোবাসিতেন। আজ তাঁর শেষ পূজা তোর হাতেই হোক।”
এই প্রস্তাব শ্রীমৎ রাখাল মহারাজ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) প্রমুখ সাধুবৃন্দ অনুমোদন করাতে, নন্দলাল স্বামীজিকে পুষ্পমাল্যাদি দানে এবং নানাবিধ ফল ও মিষ্টান্ন প্রভৃতি নিবেদনের পর আরতি করিয়া স্তোত্রপাঠ করিলেন।
এই সময়ে স্বামীজির শেষ ফটো (আলোকচিত্র) তুলিবার প্রস্তাব করা হইলে, শ্রীরাখাল মহারাজ নিষেধ করিয়া বলিলেন : “স্বামীজির কতো রকমের ভাল ফটো রয়েছে, এই বিষাদ মাখা ছবি সকলের হৃদয়কে বিদীর্ণ করবে।”
তাহার পরে শ্রীরাখাল মহারাজ প্রমুখ সন্ন্যাসীবৃন্দ ও ব্রহ্মচারিগণ স্বামীজির চরণে পুস্পাঞ্জলি দিলেন। অবশেষে স্বামীজির সহাধ্যায়ী বন্ধু হরমোহন মিত্র প্রভৃতি গৃহীভক্তবৃন্দ অঞ্জলি দিলেন। পরে স্বামীজির চরণতল অলক্তকে (আস্তায়) রঞ্জিত করিয়া তাহার পায়ের ছাপ লওয়া লইল। ভগিনী নিবেদিতাও একখানি নূতন রুমালে স্বামীজির চরণের ছাপ তুলিয়া লইলেন। একটি বড় বিকাশোন্মুখ ‘মার্শাল নীল’ জাতীয় গোলাপ ফুল চন্দনে চর্চিত করিয়া স্বামীজির চরণতলে বুলাইয়া আমি সেই স্মৃতিচিহ্নটি বুকপকেটে রাখিয়া দিলাম।
স্বামীজির পূজাদি কার্য সমাধানের পর শ্রীশরৎ মহারাজ ঐ পালঙ্কখানি বহন করিয়া যে স্থানে স্বামীজির দেহে অগ্নিসংস্কার করা হইবে সেখানে লইয়া যাইবার জন্য আমাদেরই চারিজনকে পুনরায় অনুমতি দিলেন। তাহার পরে উঁহারা সকলে শবানুগমন করিতে লাগিলেন।
সেইদিন পূর্বাহ্নে বৃষ্টিপাত হওয়াতে মঠের পিচ্ছিল চোরপুলি কাঁটায় পূর্ণ বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ ধীরে ধীরে সন্তর্পণে পার হইয়া আমরা পালঙ্কখানি চন্দনকাষ্ঠের চিতার উপরে স্থাপন করিলাম। সেই সময়ে কলিকাতা সিমলা পল্লী হইতে একখানিগাড়িকরিয়াস্বামীজিরকাকীমা এবং জ্ঞাতিভ্রাতাহাবুদত্তসপরিবারে আসিয়া কিছুক্ষণ উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন ও বিলাপ করিতে লাগিলেন।
তাহার পরে শ্রীশরত্মহারাজ উপস্থিত সকলকে বলিলেন:”তোমরা এক এক বাণ্ডিল পাকাটি আগুনে ধরিয়ে নিয়ে এই বেদীকে সাতবার প্রদক্ষিণ করে শেষে খাটেরনীচে স্বামীজির পায়ের তলায় জ্বলন্ত আগুন রেখে প্রণাম কর।”
তাঁহার আদেশমত স্বামীজির শরীরকে চন্দন কাষ্ঠে প্রজ্বলিত অগ্নিতে আহুতি প্রদানের পর শোকসন্তপ্ত ভক্তগণ প্রজ্বলিত চিতাকে বেষ্টন করিয়া প্রস্তর মূর্তির ন্যায় বসিলেন। চিতাবহ্নি ক্রমে ক্রমে লেলিহ্যমান্ ঊর্ধ্বমুখী বহু জিহ্বা বিস্তার করিয়া ধূ ধূ করিয়া জ্বলিতে লাগিল। সেই সময়ে মহাকবি গিরিশচন্দ্র, বসুমতী’র উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, সাহিত্যিক জলধর সেন, মাষ্টার মহাশয় (শ্রীম), অক্ষয়কুমার সেন (শাঁখচুন্নী মাষ্টার) প্রভৃতি গৃহীভক্তগণ বেলতলার সন্নিকটে রকের উপর বসিয়া এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখিতে লাগিলেন।
গিরিশবাবু ভগ্নহৃদয়ে আক্ষেপ করিয়া বলিলেন : “নরেন! কোথায় তুমি বেঁচে থেকে আমার কথা লোকের কাছে বলে ঠাকুরের মহিমা প্রচার করবে, কিন্তু সে সাধে পোড়া বিধি হোল বাদী, আমি বুড়ো বেঁচে রইলুম তোমার এই দৃশ্য দেখবার জন্যে? তুমি তো ঠাকুরের ছেলে, ঠাকুরের কোলে গিয়ে উঠলে, বল দেখি এখানে আমাদের কি দশায় ফেলে অকালে চলে গেলে? নিশ্চয়ই আমাদের কপাল ভেঙেছে।”
ইহা শুনিয়া ভগিনী নিবেদিতা শোকোচ্ছ্বাস চাপিয়া রাখিতে পারিলেন না। তিনি জ্বলন্ত চিতার সন্নিকটে চারিপার্শ্বে পরিক্রমণ করিতে লাগিলেন। পাছে তাহার গাউনে (পরিচ্ছদে) আগুন ধরিয়া যায় এই আশঙ্কায় মহারাজজী (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) কানাই মহারাজকে বলাতে, তিনি ভগিনীর হাত ধরিয়া তফাতে গঙ্গার ধারে লইয়া গিয়া বসাইলেন এবং কোনমতে। তাঁহাকে প্রবোধ দিতে লাগিলেন।
স্বামীজির নারায়ণী তনুখানির নিম্ন অর্ধাংশ অনুকূল বায়ুর হিল্লোলে সেই হোমাগ্নি মধ্যে অল্পক্ষণেই ভস্মে পরিণত হইল। কিন্তু আশ্চর্য, তাহার বুকে, মুখে এবং মস্তকের কেশে অগ্নিস্পর্শ না করাতে সেই মুখভঙ্গী, আয়ত নেত্রের দৃষ্টি কী সুন্দর দেখাইতে লাগিল!
এমন সময়ে জানি না কোন্ প্রেরণায় পরমহংসদেবের কোনো এক বিশিষ্ট গৃহীভক্তের মুখ হইতে অত্যন্ত মর্মান্তিক একটি মন্তব্য বাহির হইল। ইহা নিতান্তকঠোর ও পরিতাপের বিষয় বলিয়া লিপিবদ্ধ করা হইলনা। তাহা শ্রবণে সকলেই মর্মাহত হইলেন এবং স্বামীজির সন্ন্যাসী শিষ্য শ্রীনিশ্চয়ানন্দ উত্তেজিত হইয়া বলিলেন, “যো কোই স্বামীজিকা শির’পর লাঠি মারেঙ্গে, উকো শির লাঠিসে হাম্ তোড়েঙ্গে, যেতনা কাঠ লাগে গাছ তোড়কে হাম্ আভি দেঙ্গে।” এই বলিয়া অদূরবর্তী এক প্রাচীন বৃক্ষে আরোহণ পূর্বক তিনি শাখা ছেদন করিয়া প্রচুর কাষ্ঠ সংগ্রহ করিবার পর জ্বলন্ত চিতার উপর তাহা সাজাইয়া স্বামীজির মুখোনি আবৃত করিয়া দিলেন।
এই সময়ে রাখাল মহারাজ আমাকে একটু তফাতে লইয়া গিয়া হাতে দশটাকার একখানি নোট দিয়া বলিলেন : “তুমি নিবারণকে সঙ্গে নিয়ে গিরিশবাবুর নৌকায় ওপারে, বরানগরে গিয়ে বাজার থেকে কিছু সন্দেশ ও খাবার কিনে আনো। কাল রাত্তির থেকে সাধুরা কেউ মুখে জল দেয়নি–আর উপস্থিত ভক্তদেরও অনেকেরই খাওয়া হয়নি।”
মহারাজজীর আদেশমত কার্য করিতে আমাদের উভয়কে যাইতে দেখিয়া বরানগরনিবাসী ভক্ত বিপিন সাহা উহার উপর পাঁচ টাকা দিয়া আমাদের সঙ্গে ওপারে যাইয়া দোকানে গরম লুচি কচুরি সন্দেশ প্রভৃতি। তৈয়ারি করাইয়া ঝুড়ি নিজে বহিয়া আমাদের সঙ্গে পুনরায় মঠে ফিরিলেন। সন্ধ্যার কিছু পূর্বে আমরা যখন মঠে পঁহুছিলাম, তখন চিতা নির্বাপণের পর স্বামীজির দেহাবশেষ সঞ্চয় করিয়া সন্ন্যাসিবৃন্দ এবং ভক্তগণ স্নানান্তে গঙ্গাসলিলে তৰ্পণ করিতেছিলেন।…
সমস্ত দিনের পর ঠাকুরের এই প্রথম সান্ধ্যজলপানি ভোগওআরতিহইয়া যাইলে নীচের তলার সমবেত সাধু এবং ভক্তমণ্ডলীর মধ্যে চা, সরবৎ এবং প্রসাদ বিতরিত হইল। তাহার পরে গৃহীভক্তেরা একে একে ভগ্নহৃদয়ে বিদায় লইলেন।
স্বামীজির অন্তিম ইচ্ছা পূরণের জন্য ৪ জুলাই-এর (২০ আষাঢ়) পরবর্তী অমাবস্যার রজনীতে বেলুড় মঠে শ্ৰীশ্ৰীকালী পূজার অনুষ্ঠান হইয়াছিল। তাহাতে বাহিরের কাহাকেও আমন্ত্রিত করা হয় নাই। কেবল স্বামীজির কনিষ্ঠ সহোদর শ্রীভূপেন্দ্রনাথ দত্ত মহাশয় আসিয়াছিলেন।…
রাত্রি দশটার পর মঠের দোতলায় ঠাকুর-ঘরে শ্রীশ্রীকালীপূজা আরম্ভ হইলে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দের পিতৃদেব প্রাচীন তান্ত্রিক সাধক ঈশ্বরচন্দ্র চক্রবর্তী মহাশয় পূজকের আসন গ্রহণ করিলেন। সাধু ও ব্রহ্মচারিগণ ঠাকুর প্রণাম করিয়া স্বামীজির ঘরে যাইয়া…বসিলেন। তাহার পূর্বে ঠাকুরের সন্ধ্যাকালীন ভোগ হইবার পরে পূজনীয় মহারাজজী স্বামী প্রেমানন্দ মহারাজকে বলিলেন : “ভূপেনকে আর এদের দুজনকে ঠাকুরের প্রসাদ খেতে দাও, আমাদের সকলের আজ উপবাস।”
প্রসাদ পাইবার পরে আমরা তিনজনে নীচেকার পশ্চিমদিকের বড় ঘরে শয়ন করিলাম, রাত্রিতে মধ্যে মধ্যে স্বামীজির বৃদ্ধ শিষ্য নিত্যানন্দ স্বামীর সকরুণ ক্রন্দন-ধ্বনিতে মঠ যেন মুখরিত হইয়া উঠিল।
রাত্রি ৩টার পরে শ্রীশরৎ মহারাজ নীচেকার ঘরে আসিয়া আমাদের তিনজনকে জাগাইয়া তুলিয়া উপরের..ঘরে যাইতে বলিলেন। সেখানে যাইলে মহারাজজী… আমাকে… আচমন করিয়া জপ করিতে বলিলেন। কিছুক্ষণ পরে মহারাজজীর আজ্ঞায় সকলে নীচের তলায় আসিয়া পশ্চিম দিকের দালানের সম্মুখস্থিত প্রাঙ্গণে বৃহৎ হোমকুণ্ডের চারিধারে বসিয়া জপ করিতে লাগিলেন।
হোমক্রিয়া সমাপনের পরে যে স্থানে স্বামীজির দেহে অগ্নি-সংস্কার করা হইয়াছিল সেইস্থানে সকলে যাইয়া সাতবার প্রদক্ষিণের পর প্রণত হইলেন এবং কিছুক্ষণ বেলতলায় বসিয়া জপ করিয়া ফিরিয়া আসিয়া ঠাকুর-ঘরে প্রণামের পর নীচে আসিয়া প্রসাদ গ্রহণ করিলেন।”
*
যে প্রশ্ন মাথায় রেখে স্বামীজিকে নিয়ে এই অনুসন্ধানের সূচনা করেছিলাম এবার সেখানেই ফিরতে হবে।
মহামানবদের জন্মদিন পালনে সনাতন ভারত সতত উৎসাহী, কিন্তু মৃত্যুদিনের স্মৃতিভার বহন তেমন প্রয়োজনীয় নয় কেন? স্বামী বিবেকানন্দর অন্ত্যলীলার অনুসন্ধান করতে গিয়ে তার উত্তর মিলে গিয়েছে। এই পৃথিবীতে অতি সাধারণ মানুষকে “মরিয়া প্রমাণ করিতে হয় সে মরে নাই।” মরার সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু হয় অন্য সব মানুষের। কিন্তু মহামানবদের প্রকৃত বাঁচা শুরু হয় মৃত্যুদিন থেকে। সেই হিসেবে ৪ জুলাই ২০০২ মৃত্যুঞ্জয়ী বিবেকানন্দর প্রথম শতবর্ষপূর্তি।
ভগিনী নিবেদিতাকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দর মধ্যে তফাত কী? নিবেদিতা উত্তর দিয়েছিলেন, অতীত পাঁচ হাজার বছরে ভারতবর্ষ যা কিছু ভেবেছে তারই প্রতীক শ্রীরামকৃষ্ণ, আর আগামী দেড় হাজার বছর ভারত যা কিছু ভাববে তারই অগ্রিম প্রতিনিধি স্বামী বিবেকানন্দ।
নিবেদিতার কথা যদি সত্য হয়, তা হলে স্বামী বিবেকানন্দর তিরোধান দিবস পালন সত্যই প্রয়োজনহীন।
মহাসমাধির দু’বছর আগে (এপ্রিল ১৯০০) স্বামীজি তাঁর অনুরাগিণী মার্কিনী বান্ধবী মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডকে আশ্চর্য এক চিঠি লিখেছিলেন আলমোড়া থেকে।
আসন্ন বিদায়ের কথা মনে না থাকলে এমন চিঠি লেখা যায় কি না তা বিবেচনার ভার পাঠকের ওপরেই ছেড়ে দিতে চাই। কতবার যে স্বামীজির লেখা এই কটা লাইন পড়েছি তার হিসেব নেই, কিন্তু প্রতিবারেই বাণীটা নতুন মনে হয়। মনে হয় সমকালের ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়ে মৃত্যুঞ্জয়ী সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ অনন্তকালের সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন।
স্বামীজি লিখছেন : “আমি যে জন্মেছিলাম–তাতে খুশি; এতে যে কষ্ট পেয়েছি তাতেও খুশি; জীবনে যে বড় বড় ভুল করেছি–তাতেও খুশি। আবার এখন যে নির্বাণের শান্তি-সমুদ্রে ডুব দিতে যাচ্ছি–তাতেও খুশি। আমার জন্যে সংসারে ফিরতে হবে, এমন বন্ধনে আমি কাউকে ফেলে যাচ্ছি না; অথবা এমন বন্ধন আমি কারও থেকে নিয়ে যাচ্ছি না। দেহটা গিয়েই আমার মুক্তি হোক, অথবা দেহ থাকতে থাকতেই মুক্ত হই, সেই পুরনো ‘বিবেকানন্দ’কিন্তু চলে গেছে, চিরদিনের জন্য চলে গেছে–আর ফিরছেনা! শিক্ষাদাতা, গুরু, নেতা, আচার্য বিবেকানন্দ চলে গেছে পড়ে আছে কেবল সেই বালক, প্রভুর সেই চিরশিষ্য, চিরপদাশ্রিত দাস।”
এই বিবেকানন্দই বোধহয় মানুষের হৃদয়মন্দিরে অনন্তকাল ধরে পূজিত হবেন।
——–
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
অচেনা অজানা বিবেকানন্দকে খুঁজতে গিয়ে একাল ও সেকালের জীবিত ও মৃত, চেনা-অচেনা কত ভক্ত এবং কত গবেষকদের দিকে ভিক্ষাপাত্র এগিয়ে দিয়েছি এই মুহূর্তে তার পুরো হিসেব দেওয়া সম্ভব নয়। অনুসন্ধানের কাজটা প্রাথমিকভাবে সম্পন্ন করে মনে হচ্ছে, এও একধরনের মাধুকরী। কারণ কোনো নতুন তথ্য আমি আবিষ্কার করতে সক্ষম হইনি। যা চেষ্টা করেছি তা হলো, জীবননাটকের রঙ্গমঞ্চে একটু নতুনভাবে আলোকসম্পাত।
প্রথমেই বলি, অনুপ্রেরণার উৎসমূলে রয়েছেন বহু গ্রন্থের লেখক সন্ন্যাসীগবেষক স্বামী প্রভানন্দ এবং ভক্তগবেষক আমার সাহিত্যগুরু শঙ্করীপ্রসাদ বসু! বসুমহাশয়ের মহাভারত ‘বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ’, ‘লোকমাতা নিবেদিতা’ ও ‘লেটারস্ অফ নিবেদিতা’ এই ভিক্ষাজীবীকে বহুবার উপাদানের অনশন থেকে রক্ষা করেছে।
এর পরেই রয়েছে বহুখণ্ডে বিভক্ত বাংলা ও ইংরিজি স্বামী বিবেকানন্দর বাণী, রচনা ও পত্রাবলী। বাংলা সংস্করণে পত্রাবলীর অংশটি এখনও অসম্পূর্ণ। ইংরিজি সংস্করণের পত্রাবলীতেও যে অপরিপূর্ণতা আছে তার কিছুটা পূরণ হয়েছে বেণীশঙ্কর শর্মার গবেষণায় এবং মেরি লুইস বার্ক সম্পাদিত ৬ খণ্ডে সম্পূর্ণ স্বামী বিবেকানন্দ ইন দ্য ওয়েস্ট নামক দিকদর্শন গ্রন্থমালায়।
আরও আছে এক স্বর্ণভাণ্ডার। স্বামী বিবেকানন্দর মধ্যম ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ দত্তর অর্ধশতাধিক গ্রন্থ। এই সুযোগে তাঁর রচনার মধ্য দিয়ে মহেন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করলাম এবং বুঝলাম কেন তাকে ‘পুণ্যদর্শন’ বলা হতো। আর এক মহামূল্যবান লেখক স্বামীজির কনিষ্ঠ ভ্রাতা ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, তার একটি বই ছাড়া (আমার আমেরিকার অভিজ্ঞতা) প্রায় সব বই পড়েছি। ভূপেন্দ্ররচনাও একালের বাঙালির অবশ্যপাঠ্য।
আর আছে ইংরিজি ও বাংলায় বেশ কিছু আকর গ্রন্থস্বামী সারদানন্দের শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ, ভগিনী নিবেদিতা গ্রন্থাবলী, রোমাঁ রোলাঁর বিবেকানন্দর জীবন, স্বামী গম্ভীরানন্দের যুগনায়ক বিবেকানন্দ, প্রমথনাথ বসুর বিবেকানন্দ এবং দ্য লাইফ অফ স্বামী বিবেকানন্দ, ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্যর বর্ণাঢ্য রচনাবলী, এস এন ধরের এ কমপ্রিহেনসিভ বায়োগ্রাফি অফ বিবেকানন্দ ইত্যাদি বেশ কয়েক ডজন গ্রন্থ। আরও রয়েছে বিভিন্ন গ্রন্থে বিভিন্ন সন্ন্যাসীর ও সংসারীর অমূল্য স্মৃতিকথা ও দিনলিপি কিছু ইংরিজিতে, কিছু বাংলায়। আদালতী ব্যাপারে সাহায্য পেয়েছি চিত্রগুপ্ত বিরচিত ছোট্ট বাংলা বই থেকে। স্বামী প্রভানন্দের ধৈর্যপূর্ণ গবেষণাগ্রন্থগুলি সামনে না থাকলে আমার মতন ভিক্ষাজীবী লেখকের মনে সাহস জুটতো না।
আর এক মহামূল্যবান খবরাখবরের খনি ব্রহ্মবাদিন পত্রিকার পুরনো সংখ্যাগুলি। সেই সঙ্গে প্রবুদ্ধ ভারত পত্রিকার পুরনো সংখ্যাগুলি। এবং অবশ্যই উদ্বোধন পত্রিকা এবং শ্ৰীসারদা মঠ প্রকাশিত অপেক্ষাকৃত কম বয়সের নিবোধত পত্রিকা।
আরও বেশ কিছু কৃতজ্ঞতা-স্বীকারের প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে মিস। জোসেফিন ম্যাকলাউড ও মিসেস ওলি বুলের সাম্প্রতিক জীবনীকার প্রব্রাজিকা প্রবুদ্ধপ্রাণা। এই বিদেশিনী সন্ন্যাসিনী আমার পরিচিত না হলেও তাকে দূর থেকে প্রণাম জানাই। সেই সঙ্গে বাংলাভাষায় শঙ্করাচার্য ও শ্রীচৈতন্যের জীবনী লেখকদের। আরও আছেন মার্কিন মুলুকের প্রাণবন্ত লেখক স্বামী চেতনানন্দ।
কিছুটা নেশার ঘোরেই শ’ দুয়েক বইয়ের অরণ্য থেকে অচেনা বিবেকানন্দ সম্বন্ধে সামান্য যা খুঁজে পেলাম তা এই বইতে একত্রে সংগ্রহ করে রাখা গেল, এই আশায় এবং এই বিশ্বাসে যে নানা দিক থেকে নানাভাবে খোঁজ খবর না করলে কোনো মহামানবকেই পুরো জানা যায় না।
ব্যক্তিগতভাবে উপদেশ দিয়ে এবং তথ্যসন্ধানে সাহায্য করেছেন রামকৃষ্ণ মিশনের পূজ্যপাদ স্বামী রমানন্দ, স্বামী বিশোকানন্দ, স্বামী সর্বগানন্দ, অদ্বৈত আশ্রমের স্বামী বোধসারানন্দ, স্বামী সত্যময়ানন্দ, গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার গ্রন্থাগারের গোপা বসুমল্লিক, ডাক্তার সুব্রত সেন, ডাক্তার তাপস বসু, বিশিষ্ট গবেষক সুনীলবিহারী ঘোষ, শ্রীহর্ষ দত্ত, শ্রীদিলীপ দে, শ্রীসুবীর মিত্র, শ্ৰীবাদল বসু, শ্রীরাকেশ দাস, শ্রীবঙ্কিম কোনার, নীরব অনুসন্ধানী শ্রীশিবশঙ্কর ঘোষ, শ্রীবিশ্বরূপ মুখোপাধ্যায় এবং আরও অনেকে। এঁদের সকলকে কৃতজ্ঞতা জানাই।
কৃতজ্ঞতা জানাই বিশ্বভারতীর অধ্যাপক ডক্টর মানস রায়, আনন্দবাজার পত্রিকার দিল্লি সংবাদদাতা জয়ন্ত ঘোষাল, সুখী গৃহকোণ পত্রিকার সুযোগ্যা সম্পাদিকা শুভা দত্ত এবং সংবাদ প্রতিদিন-এর সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এঁরা সারাক্ষণ উৎসাহ না দিলে এই বইয়ের শেষপ্রান্তে পৌঁছনো বেশ কঠিন হতো। আর একজন সর্বদা লুকিয়ে থাকতে চান–তার উল্লেখ উৎসর্গপত্রে করেছি।
সবার শেষে শতসহস্র ধন্যবাদ এই বইয়ের প্রকাশক শ্রীনির্মলকুমার সাহা ও তার সুযোগ্য পুত্র বিবেকানন্দ-অনুরাগী শ্রীপ্রদীপ সাহাকে। একই সঙ্গে ধন্যবাদ উৎসাহী কর্মী শ্রীসুখেন সাহাকে।
আরও একজন পাঠকের কাছে আমি ঋণী হয়ে রইলাম আমার প্রথম প্রকাশক নিউ এজ পাবলিশার্সের তরুণ কর্ণধার শ্রীশিলাদিত্য সিংহরায় সম্পাদনার কাজে নানাভাবে সাহায্য করেছেন।
এবার আসা যাক ছবির প্রসঙ্গে। অদ্বৈত আশ্রম বেশ কিছুদিন ধরে অশেষ ধৈর্য ও বিপুল নিষ্ঠার সঙ্গে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সংক্রান্ত অনেক ছবি ডিজিটাল পদ্ধতিতে উদ্ধার করে চলেছেন। তাদের কাছে আমার বিশেষ কৃতজ্ঞতা। সেই সঙ্গে দুই প্রবীন ও নবীন দিকপাল চিত্রসাংবাদিক মোনা চৌধুরি ও অশোক মজুমদার। এঁরা নানাভাবে উপকার করেছেন। এঁদের জয় হোক।
শংকর
পু: শেষ মুহূর্তে দু’জন নিষ্ঠাবান পাঠকের কাছে গভীর ঋণে আবদ্ধ হলাম। এঁদের নাম শ্রীঅরুণকুমার দে ও শ্রীসোমেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। যতদিন এঁদের মতন সাবধানী পাঠকরা আছে ততদিন বাংলাভাষার লেখকদের কোন চিন্তা নেই।