৫. আসামে ভাষা আন্দোলন ওবাঙালির লড়াই: ১৯৬১, দ্বিতীয় ভাগ

পঞ্চম অধ্যায় – আসামে ভাষা আন্দোলন ওবাঙালির লড়াই: ১৯৬১, দ্বিতীয় ভাগ

১৯ মে ১৯৬১, শুক্রবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৩৬৮। সত্যাগ্রহ, স্বাধীন ভারতে পুনরায় ফিরে এল। লড়তে হচ্ছে মুখের বুলি, মাতৃভাষা বাংলার জন্যে। এ এক ঐতিহাসিক দিন আসামে বসবাসকারী বাঙালি তথা সর্বভারতীয় বাঙালিদের জন্য। আর একটু বড়ো করে চোখ মেললে বিশ্ববাঙালির কথা ভাবাটাও অন্যায় হবে না। এ দিন কাছাড়ে সত্যিই বাঙালিরা ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। ভেতো বাঙালি নন— বীর বাঙালি।

কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদের সদর দফতর ছিল করিমগঞ্জে। তাই শুরুটাও করিমগঞ্জ থেকেই করা যেতে পারে। ১৯৪৭ সালে সিলেট গণভোট এবং তারপরই ব্রিটিশদের সীমানা নির্ধারণ কমিশনের ফলাফলে করিমগঞ্জের অধিকাংশটাই পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সেখানকার মানুষ নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যদিয়েই পথ চলছিলেন। এবার মরার ওপর খাঁড়ার ঘা, ওরা মুখের ভাষাটাও কাইড়্যা নিতে চাইল। কিন্তু তারপরও খন্ডিত করিমগঞ্জ সেদিন রুখে দাঁড়িয়েছিল। সমকালীন সংবাদপত্র এ বিষয়ে জানাল: ‘পূর্বদিন রাত থেকেই সরকারি কতৃপক্ষ কোর্ট, পোস্ট অফিস, অন্যান্য সরকারি অফিস, রেলস্টেশনে অজস্র সৈন্য মোতায়েন করেন। ভোরবেলা থেকেই অসংখ্য, মিলিটারি গাড়ি রাজপথ পরিভ্রমণ করতে আরম্ভ করে এবং শান্তিপূর্ণ শহরে এক অস্বস্তিকর আবহাওয়ার সৃষ্টি করে। ভোরবেলা থেকেই পাঁচ শত মহিলাসহ দুই সহস্রাধিক সত্যাগ্রহী বিভিন্ন সরকারি আপিস, আদালত, স্টেটবাস ইত্যাদিতে অটুট মনোবলের সঙ্গে সত্যাগ্রহ চালিয়ে যেতে থাকেন। একদল সত্যাগ্রহীকে গ্রেপ্তার করার সঙ্গে সঙ্গেই অপরদল তৎপরতার সঙ্গে তাদের স্থান গ্রহণ করেন। এভাবে অসামান্য সাফল্যের সঙ্গে সত্যাগ্রহ চলতে থাকে, যার ফলে পোস্ট অফিসসহ কোনো অফিসেই একজন মাত্র কর্মচারীও কাজে যোগদান করতে পারেননি। ফৌজদারি এবং মুনসেফ কোর্টের কাজও সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে এবং ফৌজদারি কোর্টে বহুসংখ্যক সত্যাগ্রহীকে দলে দলে গ্রেপ্তার করা হয়। স্টেটবাসও সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকে। একটি দিনের জন্য শহরের সরকারি শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে সংগ্রাম পরিষদ তাদের ঘোষিত কার্যসূচিকে বাস্তবে রূপায়িত করেন।

কিন্তু এ দিন সত্যাগ্রহের মূল কেন্দ্র ছিল রেলওয়ে স্টেশন, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সরকারি কতৃপক্ষ তাদের সর্বাত্মক শক্তি রেলগাড়ি চালাবার কাজে নিয়োজিত করেন। এখানে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর নৃশংস এবং নারকীয় অত্যাচারের সঙ্গে কর্তব্যকর্মে স্থির, অবিচল সত্যাগ্রহীদের অটুট মনোবলের যে মহনীয় সংগ্রাম অনুষ্ঠিত হয়, তার তুলনা পাওয়া দুষ্কর। নারী এবং শিশুর ওপর লাঠিচালনার তান্ডব চালাবার যে দৃষ্টান্ত এই রেলস্টেশনে পুলিশ দেখিয়েছে, তা ব্রিটিশ আমলের নির্মমতম অত্যাচারকেও লজ্জা দিতে পারে। শুধু লাঠিচার্জ করেই পুলিশ ক্ষান্ত হয়নি শতাধিক রাউণ্ড টিয়ারগ্যাসও বর্ষণ করে। কিন্তু কোনো অত্যাচারই সত্যাগ্রহীদের বিচলিত করতে পারেনি। এদিন করিমগঞ্জ স্টেশন থেকে কোনো ট্রেন ছাড়া সম্ভব হয়নি। নিরস্ত্র এবং নিরুপদ্রব সত্যাগ্রহীদের ওপর পুলিশ মোট চারবার লাঠিচার্জ করে এবং অভিজ্ঞ মহলের মতে এই ধরনের নৃশংস লাঠিচার্জ তাঁরা খুবই কম দেখেছেন।’

সংবাদপত্রে আরও বলা হল: ‘নারী সত্যাগ্রহীদেরও নির্মমভাবে প্রহার করা হয়, বহু আহত নারী সত্যাগ্রহীকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। চতুর্থবারের লাঠিচার্জের সময় পুলিশ ভীত নারী-পুরুষদের পিছু ধাওয়া করে বহুদূর ছুটে যায় এবং নিকটবর্তী দু-টি বাড়ির দরজা ভেঙে ঢুকে পড়েও আশ্রিতদের ওপর লাঠিচার্জ করে। ওই বাড়িগুলির রেডিয়ো এবং অন্যান্য জিনিসপত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রেলস্টেশনে লাঠিচার্জের ফলে মোট তিন শতাধিক সত্যাগ্রহী আহত হয়েছে, তাদের মধ্যে ১৯৮ জনকে হাসপাতালে চিকিৎসা করা হয়। উল্লেখযোগ্য যে, লাঠিচার্জের পর কোনোরকম সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা ছিল না, সংগ্রাম পরিষদের পাঁচটি অ্যাম্বুলেন্স অবিশ্রান্ত পরিশ্রম করে আহতদের শুশ্রুষার বন্দোবস্ত করেন। এ দিন করিমগঞ্জ স্টেশন থেকে কোনো গাড়ি ছাড়েনি এবং কোনো গাড়ি পৌঁছোয়নি। দুর্লভছড়া, পাথারকান্দি, বদরপুরেও সমস্ত ট্রেন আটক করা হয়।

পত্রিকায় আরও বলা হয়, ‘করিমগঞ্জ শহরে এ দিন ছয় শতাধিক সত্যাগ্রহীকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে ৭১ জন ভিন্ন বাকি সকলকে শহর থেকে দূরে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। যাঁদের আটক রাখা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ছাত্র সংহতির প্রাক্তন সভাপতি শ্রীরবিজিৎ চৌধুরী অন্যতম।

পাথারকান্দিতে এ দিন মোট ৪৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। কমিউনিস্ট এম এল এ শ্রীগোপেশ নমঃশূদ্র, মণিপুরি নেতা পাথারকান্দি মন্ডল কংগ্রেস কমিটির সভাপতি শ্রী নরেন্দ্র সিংহ প্রমুখও এদের মধ্যে আছেন।

বদরপুরে পুলিশ মৃদু লাঠিচালনা এবং কাঁদুনে গ্যাস প্রয়োগ করে। সেখানে মোট ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। বদরপুর স্টেশনে আরও ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। রাতাবাড়িতে মোট ৩০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। করিমগঞ্জ মহকুমার মফসসলে এ দিন মোট ১১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়, এদের মধ্যে বহুসংখ্যক মণিপুরি, মুসলমান ও নারী সত্যাগ্রহীও আছেন। দীর্ঘ রাত পর্যন্ত মফসসলে ধৃত সত্যাগ্রহীদের পুলিশ ভ্যানে করে করিমগঞ্জ নিয়ে আসা হয়।’

আনন্দবাজার পত্রিকা-র করিমগঞ্জ সংবাদদাতা ১৯ মে সম্পর্কে জানালেন:

কাছাড় জেলা সংগ্রাম পরিষদের আহবানে আজ করিমগঞ্জ মহকুমার সর্বত্র পূর্ণ হরতাল পালিত হয়— এইরূপ সর্বাত্মক হরতাল এই সীমান্তবর্তী মহকুমার ইতিহাসে অভূতপূর্ব। করিমগঞ্জ, বদরপুর ও পাথারকান্দিতে একজন শিশুসহ ১০৯জন সত্যাগ্রহীকে গ্রেপ্তার করিয়া জেলহাজতে রাখা হইয়াছে। বদরপুর এবং করিমগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনে কাঁদুনে গ্যাস ও লাঠি চালনার ফলে প্রায় দুইশত জন লোক আহত হইয়াছে। করিমগঞ্জে পুলিশ লাঠি চালায়। প্রকাশ যে, লোকে যখন রেলকর্মীদের বাড়িতে গিয়া আশ্রয় লয়— তখন তাহাদের পশ্চাদ্ধাবন করিয়া তাহাদের প্রহার করা হয়, ওই সময় কয়েকটি বাড়ির জিনিসপত্রের ক্ষতি হয়। লাঠি চালনার সময় কর্মরত কয়েকজন রেলকর্মীও প্রহৃত হন। দূর-দূরান্তবর্তী গ্রামাঞ্চল হইতে লোকে করিমগঞ্জে আসিয়া সত্যাগ্রহী হইবার ইচ্ছা প্রকাশ করে। রেল কতৃপক্ষ ট্রেন চালাইবার যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁহারা একটি ট্রেনও চালাইতে পারেন নাই। সশস্ত্র পুলিশ রেললাইন পাহারা দিতেছিল; কিন্তু তৎসত্ত্বেও শত শত নারী ও পুরুষ সত্যাগ্রহী রেল লাইনের উপর বসিয়া ট্রেন চলাচল বন্ধ করিয়া দেয়। কাঁদুনে গ্যাস ও লাঠি-চালনার ফলে অনেকে আহত হয়, উহাদের মধ্যে কয়েকজনকে হাসপাতালে প্রেরণ করিতে হয়। সরকারি অফিসসমূহ বন্ধ ছিল। বিদ্যা প্রতিষ্ঠানগুলি গ্রীষ্মের ছুটি ঘোষণা করা হইয়াছে। প্রত্যুষ হইতেই সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীকে সরকারি অফিস ও আদালত প্রাঙ্গণে প্রেরণ করা হয়; কিন্তু জনসাধারণ সংগ্রাম পরিষদের আবেদন অনুযায়ী আজ অফিস কাছারিতে যোগদান করে নাই। রিকশা ও প্রাইভেট গাড়িগুলি রাস্তায় বাহির হয় নাই। দোকানপাট বন্ধ ছিল।

সংবাদে আরও জানা যায় যে, ‘একটি মাত্র ট্রেন ছাড়া (বদরপুর থেকে কালকা) জেলার সমস্ত যানবাহন আজ অচল অবস্থায় রয়েছে। বদরপুরে প্রায় পাঁচ হাজার নর-নারী আসামে বাংলাকে অন্যতম রাজ্যভাষারূপে স্বীকৃতি দেবার দাবি জানিয়ে রাস্তায় মিছিল করে।’

অপর আর এক সংবাদপত্র করিমগঞ্জে ১৯ মে ধরপাকড় বিষয়ে সংবাদ দিল। পত্রিকা জানাল, ‘অদ্য ভোরবেলা পুলিশ নিবর্তনমূলক আটক অনুসারে জেলা সংগ্রাম পরিষদ সম্পাদক শ্রী নলিনীকান্ত দাসকে গ্রেপ্তার করে। একই আইন অনুযায়ী আরও দু-ব্যক্তি— যথাক্রমে সংগ্রাম পরিষদের শ্রী রথীন্দ্রনাথ সেন ও ছাত্রনেতা শ্রীনিশীথ দাস। বাংলাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবীতে সংগ্রাম পরিষদ আহূত হরতাল শুরু হওয়ার প্রাক্কালে ভোরবেলা পুলিশ যুগশক্তি সম্পাদক শ্রী বিধুভূষণ চৌধুরী, কমিউনিস্ট পার্টি নেতা শ্রী যজ্ঞেশ্বর দাস ও আরও তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। ফৌজদারি আইনের ১০৭ ধারা অনুসারে পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করে। ধৃত ব্যক্তিদের শিলচর জেলে প্রেরণ এবং অন্যদের করিমগঞ্জ জেলেই আটক রাখা হয়।

একষট্টির ভাষা আন্দোলন সংবাদ ‘কভার’ করার জন্য কাছাড়ে আসেন বিশিষ্ট সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরী। এই মাটিরই সন্তান তিনি। তাঁকে করিমগঞ্জ মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে বলা হল:

মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় কলিকাতার সংবাদপত্রের সাহায্য আমাদের পাথেয়। আপনাকে আমাদের অনেক কিছু বলিবার আছে। অনুগ্রহ করিয়া যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি আপনি একবার আমাদের সহিত দেখা করিবেন।

শ্রী চৌধুরী জানিয়েছেন:

দুপুরবেলা ছুটলাম করিমগঞ্জে। পথে পড়ল ভাঙাবাজার। ওপারে টুকের গ্রাম। যার দখল নিয়ে বছর তিন আগে পাকিস্তান আর ভারতে জোর লড়াই বেঁধেছিল। … দু-পাশে যত সরকারি অফিস, হাই ইস্কুল চোখে পড়ল, সবই বন্ধ অনির্দিষ্ট কালের জন্য। সদর রাস্তা দিয়ে মিছিলের আনাগোনা তো আছেই।

করিমগঞ্জ পাক-সীমান্তের গায়ে-লাগা শহর। কিনার দিয়ে গিয়েছে কুশিয়ারা নদী। সুরমা, কুশিয়ারা বরাকের দুই শাখা। মাঝ নদীর স্রোত দুই রাষ্ট্রের সীমানা। করিমগঞ্জ থেকে দূরত্ব বড় জোর দুশো গজ। পরিষ্কার দেখা যায়, পাকিস্তানি এলাকা জকিগঞ্জের গাছপালা, ঘরবাড়ি। …

কুশিয়ারা থেকে লম্বা খাল বেরিয়েছে শহরের বুক চিরে। তার নাম নটী। … খাল পেরোতেই সংগ্রাম পরিষদের অফিস। এখানেই আসল ঘাঁটি। আন্দোলনের প্রথম প্রস্তুতি করিমগঞ্জেই। রাজধানী শিলং এ কথা ভালো করেই জানে। এবং জানে বলেই বোধ হয় করিমগঞ্জে অত্যাচার অমানুষিক। … মহিলা সমিতির লোকেরাই বর্ণনা করলেন মেয়েদের সম্ভ্রম-হরণের, অকথ্য অত্যাচারের তান্ডবলীলা। হাত ভেঙে, কোমর ফ্র্যাকচার করে এখনও অনেকে ধুঁকছেন সিভিল হাসপাতালে।

উনিশে মে ওরাও রেলগাড়ি আটক করে বসেছিল। লাঠি-পেটা করেও যখন পুলিশ ওঁদের সরাতে পারল না, উদ্যত রাইফেল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সত্যাগ্রহীদের মাঝখানে। খুলে ফেলল কমলা দাসের শাড়ি, ময়না মিঞাকে ছুড়ে ফেলল নর্দমায়। তলপেটে বুটের ঘায়ে অজ্ঞান কমলা দাস তিনদিন পর চোখ খুলেছেন হাসপাতালে। তলপেটে লাথি খেয়ে আশারানী দত্ত, শেফালি চক্রবর্তী, ভারতী চক্রবর্তী, শিপ্রা চক্রবর্তীর অবস্থাও তাই। বিবস্ত্রা শেফালি চক্রবর্তী সংজ্ঞাহীন পড়েছিলেন বিরাট এক গর্তে। ভাগ্যিস নজরে পড়েছিল অন্য এক সত্যাগ্রহীর নইলে এভাবেই হয়ত তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেন। … সত্যাগ্রহী পুষ্পরানি সরকার পুলিশের অত্যাচারে শয্যাশায়ী। প্রীতি দস্তিদার, সন্তোষ মজুমদার, সুখবিন্দু সেনগুপ্ত প্রমুখও তাই।

রেল-কোয়ার্টারে গেলাম। শুনতে পেলাম, রেলকর্মীদের আসবাবপত্র, বাড়িঘর ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে পুলিশ। তাঁদের অপরাধ, তাঁরা বাংলা ভাষায় কথা বলেন।

… করিমগঞ্জ-জেলের অবস্থা চমৎকার। জায়গা চুরাশি জনের। আমি যেদিন গেলাম, বন্দীর সংখ্যা তিনশো। বাইরে চাটাই বেঁধে থাকার জায়গা হয়েছে। গাদাগাদি করে আছে নারী, পুরুষ, ছেলে, বুড়ো। বিধুভূষণ চৌধুরী, নলিনী দাস প্রমুখ নেতারা এবং রথীন সেনের পঁচাত্তর বছরের মা চারুবালা সেন, আশী বছরের আকাশ চৌধুরী, পঁচাত্তর বছরের প্রিয়লাল চক্রবর্তী—সবাই জেলে।

করিমগঞ্জ থেকে পাথারকান্দি, কায়স্থগ্রাম, রামকৃষ্ণনগর ঘুরে সন্ধ্যের পর ফের রওনা দিলাম শিলচর। … মোটরকার ছুটল শিলচরের দিকে। … পুলিশের যা দাপট সকালে দেখে এসেছি! যুগান্তর, স্টেটসম্যান হয়ত সব খবর পাঠিয়ে দিয়েছে— জোরসে চালাও গাড়ি।

আসাম সরকারের পুলিশ ১৯ মে শিলচরে নিরস্ত্র, নিরীহ, শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহীদের ওপর বেপরোয়া গুলি চালিয়ে নারী, শিশুসহ ৯ জনকে হত্যা করে। সরকারের এই বীভৎস চন্ডনীতিতে হতবাক কাছাড়, হতবাক দেশের মানুষ। শিলচর ঘটনার যন্ত্রণাদায়ক বিবরণ পাওয়া যায় আনন্দবাজার পত্রিকা-য়। সেদিন বলা হল:

বাংলা ভাষাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের দাবিতে কাছাড় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, আজ প্রথম দিনেই সশস্ত্র পুলিশ শিলচর শহরে শান্তিপূর্ণ ও নিরস্ত্র সত্যাগ্রহীদের ওপর বেপরোয়া গুলী চালিয়ে…বালিকা ও শিশুসহ আটজনকে ঘটনাস্থলেই নিহত করেছে। শিলচর রেলওয়ে স্টেশন কম্পাউণ্ডে এই বর্বর ঘটনা অনুষ্ঠিত হয়। চারজন বালিকাসহ প্রায় ৩০ জন শরীরের ঊর্ধ্বাংশেগুরুতররূপে আহত হয়ে হাসপাতালে প্রেরিত হয়েছে। সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত কারফিউ জারি হয়েছে।

ভাষা আন্দোলনের সূচনায় আজ সমগ্র কাছাড় জেলায় অভূতপূর্ব ও স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়েছে। আজ সকালে পুলিশ সত্যাগ্রহীদের ওপর কাঁদুনে বোমা ছোড়ে ও লাঠিচার্জ করে। অনেকেই আহত হয়। তন্মধ্যে ৭ জন হাসপাতালে প্রেরিত হয়। ইতিমধ্যেই তিনশত সত্যাগ্রহী গ্রেপ্তার হয়েছে। গৌহাটি থেকে প্রাপ্ত সংবাদে জানা যায় যে, শিলচরে গুলীবর্ষণে নিহতের সংখ্যা নয় জন। …

কাছাড় জেলার ডাক ও তার বিভাগের কাজ আংশিকভাবে মাত্র চলে বলে জানা গেছে।

‘…আজ শিলং-এ প্রকাশিত গেজেটের এক অতিরিক্ত সংখ্যা প্রকাশ করে, আসাম সরকার ঘোষণা করেছেন যে, ভারতীয় দন্ডবিধির ১৮৮ ও ৫০৬ ধারার সমস্ত অপরাধ সমগ্র কাছাড় জেলায় জামিনের অযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। এই আদেশ দু-মাস বলবৎ থাকবে।’

সংবাদে আরও বলা হয়, ‘শুক্রবার ভোর চারটা থেকে কয়েকশত সত্যাগ্রহী রেলস্টেশনে সমবেত হন। অপরদিকে শান্তিরক্ষার জন্য পুলিশও বিরাট বাহিনী নিয়ে স্টেশন ঘেরাও করে রাখে। সত্যাগ্রহীরা ওই বেষ্টনীর বাইরে রেললাইনের ওপর অবস্থান সত্যাগ্রহ শুরু করে। ভোর ৫-২০ মিনিটে প্রথম ট্রেন শিলচর স্টেশন ছাড়ার কথা। ট্রেন চালাবার চেষ্টা হয়। কিন্তু সত্যাগ্রহীরা দলে দলে লাইনের ওপর শুয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে ডি আই জি ও ডি সি এসে নেতৃস্থানীয় সত্যাগ্রহীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। কিন্তু গাড়ি ছাড়া সম্ভব হয়নি। এভাবে সকাল সাড়ে আটটা পর্যন্ত চলার পর হঠাৎ কোনোরূপ উত্তেজনা ব্যতিরেকে সত্যাগ্রহীদের ওপর লাঠিচালনার আদেশ দেওয়া হয়। পুলিশ বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে নারী-পুরুষনির্বিশেষে সকলকে পিটাতে থাকে। তবু সত্যাগ্রহী দল অনড় থাকায় কাঁদুনে-গ্যাস ছাড়ার আদেশ দেওয়া হয়। এত অধিকসংখ্যক কাঁদুনে গ্যাস ছাড়া হয় যে, পুলিশ বাহিনী পর্যন্ত হটে যেতে বাধ্য হয়, কিন্তু সত্যাগ্রহীরা বিশেষভাবে মহিলা ও বালিকারা অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে রুমালে চোখ ঢেকে উপুড় হয়ে পড়ে থাকেন। কাঁদুনে গ্যাস দ্বারাও লাইন পরিষ্কার করা সম্ভব না হওয়ায় লাঠি ও বেয়নেট চালাবার আদেশ দেওয়া হয়— সৈন্যবাহিনী স্ত্রী-পুরুষনির্বিশেষে সত্যাগ্রহীদের ভীষণভাবে প্রহার করে ২২ জনকে আহত করে। এদের মধ্যে সাতজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। এই অবস্থায় ঘণ্টাঘানেক চলার পর ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মচারীরা পুনর্বার আবির্ভূত হন এবং স্টেশন প্ল্যাটফর্মের বাইরে একটা লাইন ঠিক করে তার ভেতরে না আসলে কোনো অত্যাচার করা হবে না স্থির করেন। সত্যাগ্রহীরাও গাড়ি আটকাবার জন্য এই লাইনের বাইরেই যথেষ্ট বলে উক্ত প্রস্তাবে সম্মত হন। সৈন্যবাহিনী লাইন ধরে স্টেশন ঘেরাও করে রাখে। কাউকেই ভিতরে যেতে দেওয়া হয় না। সত্যাগ্রহীরাও ওই ব্যুহের বাইরে লাইনের ওপর বসে থাকেন। সহস্রাধিক সত্যাগ্রহী ব্যাজ ধারণ করে লাইনের ওপর ও আশেপাশে সম্পূর্ণ শান্তভাবে বসে থাকে। এই শান্তিপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে নিরুপদ্রবে হরতাল কাল অতিবাহিত হয়ে যাবে বলে সকলেই আশা করতে থাকেন। ইতিমধ্যে প্রায় তিনশো সত্যাগ্রহীকে গ্রেপ্তার করে নেওয়া হয়। কোনোরূপ প্রতিরোধ বা আপত্তি উত্থাপিত হয়নি।

এ ভাবে চলতে থাকা অবস্থায় অপরাহ্ণ দু-টার সময় হাতকড়া বন্ধ কতিপয় সত্যাগ্রহীসহ একখানা ট্রাক কাটিগড়া অঞ্চল থেকে শহরে প্রবেশ করে অজ্ঞাত কারণে রেলস্টেশনের সন্নিকটে তারাপুরে জনসমাবেশের পাশে হঠাৎ থেমে যায়। জনসাধারণ উৎসুকভাবে ট্রাকের নিকটে গেলেই ড্রাইভারের পাশে উপবিষ্ট জনৈক অসমিয়া পুলিশ কর্মচারী ট্রাকের পেট্রোল ট্যাঙ্কে জ্বলন্ত দেশলাই নিক্ষেপ করে দ্রুত ট্রাক থেকে নেমে যায় বলে এক অভিযোগ পাওয়া যায়। ট্রাকে আগুন ধরে যাচ্ছে দেখে জনসাধারণ ও সত্যাগ্রহীরা বালি ইত্যাদি দিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই আগুন নিভিয়ে ফেলেন। ফায়ার ব্রিগেডও পরে ঘটনাস্থলে আসে। নিজকৃত দুষ্কর্মকে ঢাকার জন্য এবং সুযোগ-সন্ধানী রাজকর্মচারীরা তাদের জিঘাংসা প্রভৃতি চরিতার্থ করার জন্য একে একটি অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে হরতাল শেষ হওয়ার পূর্বমুহূর্তে আড়াইটা নাগাদ উক্ত ঘটনাস্থল থেকে দূরবর্তী স্টেশন কম্পাউণ্ডে সম্পূর্ণ শান্ত ও নিরুপদ্রব সত্যাগ্রহীর ওপর কোনোরূপ সতর্কতামূলক হুঁশিয়ারি ব্যতিরেকে গুলী চালাবার আদেশ দেওয়া হয়। সৈন্যবাহিনী নির্বিচারে গুলী চালিয়ে ঘটনাস্থলেই চারজন সত্যাগ্রহীকে হত্যা করে। আহত সত্যাগ্রহী দল প্রাক্তন পৌরপতি শ্রীসতীন্দ্রমোহন দেব ও ধীরেন্দ্রমোহন দেবের বাড়িতে ছুটে যান। সৈন্যদল সেখানেও তাড়া করে।

গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পথে আরও তিনজন মারা যায় এবং হাসপাতালে নেওয়ার পর সন্ধ্যায় আরও দুইজন মোট নয়-জন রাত পর্যন্ত এবং আজ আরও একজন মারা গেছেন। এ ছাড়া আরও ৪৯ জনকে গুলীতে আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

অতর্কিতে গুলী চালনা আরম্ভ হওয়ায় দৌড়িয়ে বহুলোক নিকটবর্তী পুষ্করিণীতে ঝাঁপিয়ে পড়েও রক্ষা পায়নি। সৈন্যবাহিনী বন্দুকের কোঁদা এবং সঙ্গীন দিয়ে আক্রমণ করে অনেককে আহত করে। এরূপ আহত চারজনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। পুষ্করিণীতে ডুবে কেউ মারা গেলেও তা উদ্ধারের এ পর্যন্ত ব্যবস্থা হয়নি।

সদর হাসপাতালের ডাক্তারেরা এবং বাইরের ডাক্তারেরা একযোগে আহতদের অধিক রাত পর্যন্ত সাহায্য দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শাসক কতৃপক্ষ থেকে অবহেলা ও অত্যাচার ছাড়া কিছু পাওয়া যায়নি। আহতদের স্থানান্তর, তাঁদের আত্মীয়স্বজনদের খবর দেওয়া বা অন্যপ্রকারের সুযোগসুবিধা দেওয়া ত দূরের কথা এই গুলী-চালনা সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত সান্ধ্য আইন জারির আদেশ ঘোষণা করে সম্পূর্ণ শান্ত শহরে জন-যান চলাচল সঙ্কুচিত করে দেওয়া হয়। আহতদের আত্মীয়স্বজনসহ জনসাধারণ বাড়িতে বন্ধ থেকে গুমরে মরতে থাকেন।

এত দ্রুত এই আদেশ জারি হয় যে, পূর্ব থেকেই আদেশ টাইপ করা ছিল বলে অনেকেই মনে করেন। মৃতদেহসহ শোভাযাত্রা বের করার জন্য ছাত্র-ছাত্রীরা যখন প্রস্তুত হচ্ছিলেন তখন পূর্বোক্ত সান্ধ্য আইনের আদেশ জারির এক ঘণ্টার মধ্যেই তা পরিবর্তন করে সাতদিনব্যাপী ২৪ ঘণ্টার জন্য সান্ধ্য আইন জারির আদেশ ঘোষিত হতে শুনে জনসাধারণ একেবারে হতভম্ব হয়ে পড়েন’। আনন্দবাজার পত্রিকা-র শিলচরস্থ নিজস্ব সংবাদদাতা আরও জানান: ‘…সর্ব প্রকার আবেদন নিবেদন ব্যর্থ হওয়ার পর বাংলা ভাষাভাষী কাছাড় জিলার অধিবাসীরা তাদের মাতৃভাষাকে যথাযোগ্য স্থানে বসাবার জন্য গত দু-মাস ব্যাপী যে সুদৃঢ় প্রস্তুতি চালিয়েছিল এবং পদযাত্রীদল গ্রামাঞ্চলে শত শত মাইল পরিভ্রমণের ফলে পল্লী অঞ্চলে জাতিবর্ণধর্মনির্বিশেষে যে অভূতপূর্ব জাগরণ দেখা দিয়েছিল— তা দেখে কতিপয় অত্যুৎসাহী অসমিয়া রাজকর্মচারীর নিদারুণ অন্তর্দাহ উপস্থিত হয়েছিল, সরকারও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে এই জাগরণকে বিনষ্ট করার জন্য সর্বপ্রকার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার ওপর আক্রমণাত্মক ও প্ররোচনামূলক ব্যবস্থাদি গ্রহণ করেছিলেন। জিলার আনাচে-কানাচে সৈন্যসমাবেশ, তাদের মহড়া জেল থেকে কয়েদি স্থানান্তরিত করে ও তাঁবু ইত্যাদি খাটিয়ে বন্দী সংরক্ষণের অতিরিক্ত ব্যবস্থা করে, হাসপাতালে বহুসংখ্যক অতিরিক্ত শয্যার ব্যবস্থা করে, চা-বাগানগুলির ট্রাক, যাহীবাহী বাসসমূহ সহ ট্যাক্সি ইত্যাদি এমনকি অনেকগুলি সাইকেল রিকশা হুকুম দখল করে সেগুলি সারিবদ্ধভাবে শহর ও মফসসলের বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন রেখে, সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে পূর্ব থেকেই বন্ধ করে দিয়ে, ছাত্র-শিক্ষক সরকারি কর্মচারী এমনকী গ্রাম পঞ্চায়েত প্রভৃতির ওপর উক্ত আন্দোলনে কোনোপ্রকার সংস্রব রাখলে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থার হুমকি দিয়ে সমগ্র কাছাড় জিলাকে রণসাজে সজ্জিত করে তুলেছিলেন। … পাকিস্তান যখন কাছাড়কে ক্রমাগত আক্রমণ করে যাচ্ছিল তখনও এর আংশিক প্রস্তুতিও পরিলক্ষিত হয়নি। বড় বড় সরকারি কর্মচারীরা ঘন ঘন জিলা পরিভ্রমণ করছিলেন। …

আন্দোলনের প্রারম্ভ দিবস ১৯ মে যতই ঘনিয়ে আসছিল এবং হাজারে হাজারে সত্যাগ্রহী যখন আন্দোলনে যোগদানের জন্য নাম লিখাতে আরম্ভ হল— তখন তারা একেবারে বেসামাল হয়ে পড়লেন— প্রথমে পুলিশ আইন অনুযায়ী রাস্তাঘাটে জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করা সত্ত্বেও যখন জনসাধারণ তা অমান্য করে সভা-শোভাযাত্রা করতে লাগল, তখন ১৭ই মে ১৪৪ ধারানুযায়ী সভা-শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করা হল— তাতেও কাজ না হওয়ায় ১৮ মে জিলার সর্বত্র নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা আরম্ভ হল— অথচ জনসাধারণ ও সত্যাগ্রহীগণ সর্বপ্রকার উত্তেজনা ও প্ররোচনা উপেক্ষা করে সম্পূর্ণ নিরুপদ্রব ও অহিংসভাবে কাজ করে যাওয়ায় এবং ভবিষ্যতেও সর্বপ্রকার হিংসা পরিহার করে নিরুপদ্রবভাবে অপ্রসার হয়ে যাওয়ার জন্য দৃঢ়সঙ্কল্প হওয়ায় অত্যাচার চালিয়ে আন্দোলন দমনের কোনো সুযোগ শাসকগণ করে উঠতে পারছিলেন না।

কাছাড় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ ক্রমাগত সভাসমিতি করে, জনসাধারণ সম্পূর্ণ নিরুপদ্রব ও অহিংস থেকে, শাসকগণকে অত্যাচারের সুযোগ না দিয়ে, আন্দোলনকে সফল করার জন্য আবেদন করে যাচ্ছিলেন এবং সর্বপ্রকার প্ররোচনা উপেক্ষা করে সকলেই অগ্রসর হচ্ছিলেন।’

‘১৯ মে গণ সংগ্রামের প্রারম্ভ দিবসে পূর্বঘোষিত জিলাব্যাপী সর্বাত্মক হরতাল পালনের জন্য এমন স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহ কাছাড়ের জীবনে অভূতপূর্ব। সমস্ত দোকানপাট, রেস্টুরেন্ট,পানবিড়ির দোকান— এমনকি ওষুধের দোকানও কেউ খোলেননি, একখানা রিকশাও রাস্তায় বের হয়নি। বাস, রেলস্টেশন প্রভৃতিতে একজন যাত্রীও আসেনি। এজন্য কাউকে কোনো প্রকার অনুরোধ-উপরোধ করার প্রয়োজন হয়নি। সরকারি অফিস-আদালতের সম্মুখে ছাত্র-ছাত্রীরা পিকেটিং করে— একজন কর্মচারীও অফিসে আসে নাই— ফলে, সমস্ত অফিস-আদালত তালাবন্ধ থাকে। এমনকি পোস্ট অফিস, টেলিগ্রাম অফিস প্রভৃতিও হরতালের নির্ধারিত সময় ৪টা পর্যন্ত বন্ধ থাকে।’

জয়তু কাছাড়বাসী। এমন ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, অফুরন্ত প্রাণশক্তি এবং সর্বোপরি মাতৃভাষা বাংলার প্রতি অনাবিল ভালোবাসা, আবেগ, উচ্ছ্বাস, প্রাণের আকুতি অভাবনীয়। তাঁরা যেকোনো পরিস্থিতির জন্য তৈরি। না, তাঁরা কোনো অস্ত্র হাতে তুলে নেননি, তাঁরা বলেননি বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলা ভাষার শৃঙ্খল মুক্ত করো। বরং তাঁরা বলেছেন: ‘জান দেব, জবান দেব না’, ‘মাতৃভাষা জিন্দাবাদ’, ‘বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ’। বাঙালিরা সশস্ত্র বিপ্লব বা বিদ্রোহও করেননি। কিন্তু তারপরও নিরস্ত্র, নিরুপদ্রব বাংলাভাষীদের স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারতে কেবল ভাষার জন্য জীবন দিতে হল। একজন নন, দুজন নন শেষপর্যন্ত ১১ জনকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হল। এরই নাম কি মহাত্মা গান্ধীজির অহিংস মহান ভারত! পন্ডিত জওহরলাল নেহরু, মহান ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তিনি তো হত্যাকান্ডের দিন অর্থাৎ ১৯ মে আসামে হাজির, জনসভায় ভাষণও দিলেন। কিন্তু তিনি রক্তাক্ত এই হত্যাকান্ড বিষয়ে ঢঁ-শব্দটি করলেন না, বরং আন্দোলনকারীদের আন্দোলন তুলে নিতে বললেন। আর একটি বিষয়, ষাট সালের ভাষা দাঙ্গায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞে, বাঙালি উৎসাদনে প্রধান পুরোহিত ছিলেন অসমিয়া সমাজ ও তাদের সঙ্গীরা। আর এবার স্বয়ং আসাম সরকার। পুলিশ কেবল নয়— সেনাবাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী— তাদেরকেও মাঠে নামানো হল বাঙালি শায়েস্তাকরণে। মুখ্যমন্ত্রী বি পি চালিহা নাকি গান্ধীজির অনুরাগী-অনুসারী! ভালো মানুষ! কিন্তু তাঁর হাত রঞ্জিত হল বাঙালির রক্তে।

আসাম সরকারকে শিলচরে কেন গুলি চালাতে হল— তার ব্যাখ্যা দিলেন তাঁরা ওই দিনেই। সংবাদে বলা হয় যে, ‘ন-জন ধৃত ব্যক্তিকে নিয়ে যাবার সময় একখানি পুলিসের গাড়ি দু’হাজার জনতা দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং জনতা ধৃতদের মুক্ত করে গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। সমস্ত সতর্কবাণী ব্যর্থ হবার পর পুলিশ গুলী চালায়।’ শিলং থেকে পাওয়া সংবাদে আরও বলা হয় যে, ‘১৯ শে মে কাছাড় জেলাব্যাপী যে হরতাল হয়, তাকে কেন্দ্র করে পুলিশ করিমগঞ্জ ও শিলচর মহকুমায় ‘‘মারমুখী জনতাকে’’ ছত্রভঙ্গ করবার জন্য কাঁদুনে গ্যাস প্রয়োগ ও লাঠি চার্জ করে। প্রকাশ, কাঁদুনে গ্যাস প্রয়োগ ও লাঠি চালনার ফলে বহুলোক আহত হয়েছে। কিছু পুলিশও প্রস্তরাঘাতে আহত অবস্থায় হাসপাতালে প্রেরিত হয়েছে।’

শিলচর পৌরসভার চেয়ারম্যান মহীতোষ পুরকায়স্থ একষট্টির ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন— যদিও তিনি কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদের লিখিত-পড়িত সদস্য ছিলেন না।

শ্রী মহীতোষ পুরকায়স্থ নিজেই শিলচরে মেহরোত্রা কমিশনে ৩০ নভেম্বর ৬১-তে সাক্ষ্য প্রদানকালে বলেন:

তিনি সংগ্রাম পরিষদের সদস্য নহেন, তবে সংগ্রাম পরিষদ যাহা কিছুই করেন তাহা তাঁহার জানা ছিল। গ্রেপ্তার বা লাঠি-চালনার সময় বাধা না দিতে সত্যাগ্রহীদের নির্দেশ দেওয়া ছিল। আসাম সরকারের কৌঁসুলি শ্রীনাগেশ্বর প্রসাদের জেরার উত্তরে শ্রীপুরকায়স্থ বলেন, সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলনের প্রতি তাঁহার পূর্ণ অনুমোদন ছিল। পরিষদের উদ্দেশ্য পূরণে তিনি শান্তিপূর্ণ ও অহিংস উপায়ে কাজ করিয়াছেন।

শিলচর পৌরসভা চেয়ারম্যান একষট্টি পরবর্তীকালে এক স্থানীয় সংবাদপত্রে ভাষা আন্দোলন বিষয়ে বলেন:

২৬ শে এপ্রিল পৌরসভার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছি। তখনই কাছাড়ের আনাচে-কানাচে ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতি চলছে। গ্রামে গ্রামে পদযাত্রা শুরু হয়েছে। স্বর্গীয় বিধুভূষণ চৌধুরী, স্বর্গীয় ব্যোমকেশ দাস, স্বর্গীয় মোহিতমোহন দাস, রথীন্দ্রনাথ সেন, নলিনীকান্ত দাস প্রমুখ খ্যাতনামা দেশকর্মী থেকে শুরু করে কত নাম জানা ও না জানা তরুণ এই পদযাত্রায় যোগ দিয়েছেন। শিলচরে যেদিন পরিতোষ পালচৌধুরীর নেতৃত্বে পদযাত্রীরা এসে পৌঁছোলেন— ওইদিন তারাপুরে পৌরসভার পক্ষ থেকে আমরা তাঁদের বরণ করলাম। পদযাত্রা ও রথীন্দ্রনাথ সেনের ভাষণ সারা জেলায় এক অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করে।

১৯ মে সকাল ৪টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত হরতাল ঘোষণা করা হয়। ১৯ মে-র সমর্থনে ১৮মে বিকালে নরসিংটোলার ময়দানে এক জনসভা হয়। সভার পর স্বর্গীয় গোলাম ছবির খানের নেতৃত্বে এক বিরাট শোভাযাত্রা ‘১৯ শে মে সফল করো’ এই ধ্বনি দিতে দিতে সারা শহর পরিক্রমা করে।

১৯ মে ভোর ৪টা থেকে সারা শহর সত্যাগ্রহীতে পূর্ণ হল। কয়েক হাজার সত্যাগ্রহী রেলস্টেশনে জড়ো হলেন। তাঁরা সবাই রেললাইনে বসে পড়লেন। সকাল ৬টা থেকে বেলা ১২টার মধ্যে কয়েকবার পুলিশ লাঠি চালাল, কয়েকশো সত্যাগ্রহীকে গ্রেপ্তার করল, কিন্তু সত্যাগ্রহীরা অনড় অটল। রেললাইন পুলিশ মুক্ত করতে পারল না। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সত্যাগ্রহীরা ধ্বনি দিয়ে চলেছেন ‘জান দেব, জবান দেব না, মাতৃভাষা জিন্দাবাদ।’

বেলা দুটো বেজে গিয়েছে। তখনকার মিউনিসিপ্যাল কমিশনার ডা. বিবেকানন্দ ভাওয়াল ও শঙ্করপ্রসাদ সিংহ আমার বাসায় এসে জানালেন অফিস-আদালতে শান্তিপূর্ণ পিকেটিং চলছে এবং রেলস্টেশনের পরিবেশও শান্ত। আমরা ভাবছি আর দু-ঘণ্টা গেলেই ওইদিনকার হরতাল শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হবে। ২টা ৩৫ মিনিটে তারাপুরের মিউনিসিপ্যাল কমিশনার সমরেন্দ্রমোহন দেব (সমীরবাবু) ফোন করলেন— স্টেশনে গুলী চলছে। তাড়াতাড়ি আসুন। স্টেশনে পৌঁছে দেখি এক উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থা। স্টেশনে ঢুকবার রাস্তা সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর লোকেরা ঘিরে রেখেছে আর উত্তেজিত তরুণরা বলছেন আমরা ভিতরে ঢুকবোই, তোমরা গুলী করো। সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা বুক উচিয়ে সঙ্গীনের সম্মুখীন হচ্ছেন। আমাদের সবাই পথ ছেড়ে দিলেন। ভিতরে গিয়ে দেখি গুলীবিদ্ধদের সত্যাগ্রহীরা সতীন্দ্রমোহন দেবের বাড়ির সম্মুখে যে রেডক্রসের অফিস খোলা হয়েছিল— সেখানে নিয়ে যাচ্ছেন। ডাক্তাররা বললেন, যাঁরাগুরুতর আহত তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হোক। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর একে একে কমলা ভট্টাচার্য, শচীন্দ্র পাল, সুকোমল পুরকায়স্থ, কানাই নিয়োগী, কুমুদ দাস, সুনীল সরকার, হিতেশ বিশ্বাস, চন্ডীচরণ সূত্রধর ও তরণী দেবনাথকে মৃত বলে ঘোষণা করা হল। গুরুতরভাবে আহত বীরেন্দ্র সূত্রধর ও কৃষ্ণকান্ত বিশ্বাস সম্পর্কে ডাক্তাররা বলেন এদের বাঁচানো শক্ত।

শহরে ১৪৪ ধারা ছিলই আবার কারফিউ জারি করা হল। কারফিউ কেউ মানতে রাজি নন। হাজার হাজার নর-নারী শহরের রাস্তায় রাস্তায়। হাসপাতালের চারিধারে কি উত্তেজনা। …

পরদিন সকালে সার্কিট হাউসে গিয়ে কমিশনার বীরেন্দ্রলাল সেনের সঙ্গে দেখা করলাম এবং জানালাম ন-জন শহিদের মৃতদেহ আমরা শোভাযাত্রা করে শ্মশানে নিয়ে যাব। এজন্য আবশ্যকীয় অনুমতি দিতে হবে। তিনি উচ্চপদস্থ পুলিশ ও সামরিক অফিসারদের সঙ্গে পরামর্শ করে জানালেন— এ অনুমতি দেওয়া হবে না। আমি বললাম, তাহলে নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করেই আমরা শোভাযাত্রা বের করব। আরেক দফা আলোচনার পর তারা অনুমতি দিলেন। বললেন, যদি হিংসাত্মক ঘটনা কিছু হয় সে-দায়িত্ব আমার। সে-দায়িত্ব নিয়ে আমি নিজেই সারা শহর ঘুরে মাইকযোগে ঘোষণা করলাম আগের দিনের গুলীর বিবরণ এবং সবাইকে আহ্বান জানালাম বেলা তিনটায় গান্ধীবাগে সমবেত হওয়ার জন্য। বেলা দুটোয় গান্ধীবাগ গিয়ে দেখি সেখানে লোকে-লোকারণ্য। তাই জায়গা পরিবর্তন করে ডিএসএ ময়দানে সকলকে জমায়েত হতে অনুরোধ করলাম। সে-এক অপূর্ব দৃশ্য। সারা শহরের স্ত্রী-পুরুষ বালক-বালিকা সকলেই সেদিনের মৌন শোভাযাত্রায় যোগ দিয়েছিলেন। সারা শহর ঘুরে আমরা শ্মশানে গেলাম। সেখানে ন-টি চিতা পাশাপাশি সাজিয়ে শহিদের নশ্বর দেহ ভস্মীভূত করা হল।

২১ মে-র ভোরে শহীদ সত্যেন্দ্র দেবের মৃতদেহ রেলস্টেশনের পুকুরে ভোসে উঠল। এই দিনই স্বাস্থ্যবান যুবক বীরেন্দ্র সূত্রধর মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করলেন। একুশে আবার ২০ মের অনুরূপ শোভাযাত্রা।১০

কাটিগড়া থেকে বন্দি সত্যাগ্রহীদের নিয়ে যে গাড়িটি শিলচর পৌঁছেছিল এবং যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে গুলি চলেছিল সেই বিষয়টি বিশেষত বন্দি সত্যাগ্রহীদের নাম, সংখ্যা কতজন ছিলেন— সে-সম্পর্কে সত্য তথ্য পাওয়াটা জরুরি। বলা হল: ‘… সেদিন ৯ জন সত্যাগ্রহীকে হাতকড়া পরিয়ে একটি বেডফোর্ড ট্রাকে করে শিলচরে আনা হয়েছিল। তাঁদের নাম হল : ক্ষেত্রমোহন মন্ডল, সুভাষ চক্রবর্তী, হরিমোহন দাস, নীরেন্দ্র পাল, অনিল মল্লিক, শ্যামাপ্রসাদ দে, দেবপ্রসাদ দত্ত, গোপেন্দ্র পাল এবং নীরেন্দ্র সিংহ। এই ন-জন সত্যাগ্রহীর নেতৃত্বে ছিলেন ক্ষেত্রমোহন মন্ডল। … ইমাদউদ্দিন বুলবুল জানিয়েছেন, ক্ষেত্রমোহন মন্ডল-এর বাড়ি কাটিগড়া বাজারের কাছেই। … ওই দিনই ৯ জন সত্যাগ্রহীকে পুলিশের কাছে হাজির করানো হয়েছিল এবং তাঁরা যথারীতি শিলচর জেলে ছিলেন অন্যান্য সত্যাগ্রহীদের সঙ্গে। তারপর একসময় সত্যাগ্রহীদের মুক্তি দেওয়া হলে ক্ষেত্রমোহনরাও মুক্তি পান। মুক্তি পেয়ে কাটিগড়া ফিরে যেতে বিকেল হয়ে যায়। স্থানীয় ‘সিদ্ধেশ্বর উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়’-এ তাঁদের বিপুলভাবে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়।১১

১৯ মে হাইলাকান্দির মানুষও পথে নেমে এসেছিলেন বাংলা ভাষার দাবিতে। এই মহকুমার সর্বত্রই হরতাল পালিত হয়। ‘১৩৪ জন সত্যাগ্রহীকে এ দিন গ্রেপ্তার করা হয়। বিভিন্ন স্থানে লাঠিচার্জের ফলে শতাধিক মানুষ আহত হন।’ করিমগঞ্জ থেকে প্রকাশিত যুগশক্তি পত্রিকায় বলা হল, ‘প্রাতঃকাল থেকেই সত্যাগ্রহীরা দলে দলে তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট অফিসাদির সম্মুখে জমায়েত হয়ে পিকেটিং আরম্ভ করেন। দোকানপাট, হাটবাজার এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলির কেউই তাঁদের দরজা খোলেননি। রাস্তায় কোনোপ্রকার যানবাহন বের হয়নি। ভোরে হাইলাকান্দি রেলওয়ে স্টেশনে ডাউন ট্রেনের সম্মুখে জোর পিকেটিং-এর সময় ত্রিশজন সত্যাগ্রহীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ওই ট্রেনটি পরে কাটাখাল জংশন স্টেশনে পিকেটিংয়ের জন্য আটক হয়ে পড়ে।

মিলিটারি ও সশস্ত্র পুলিশের এক বিরাট বাহিনী সত্যাগ্রহীদের ওপর লাফিয়ে পড়ে এবং বেপরোয়া লাঠি চালাতে থাকে। শতাধিক সত্যাগ্রহী আহত হন, কর্মচারীরা অফিস-আদালতে যোগ দেওয়ার আশা ত্যাগ করে গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। পোস্ট অফিসের প্রবেশদ্বারেও ছাত্রীগণ জোর পিকেটিং করেন। ফলে ওই অফিসে কেউ প্রবেশ করতে পারেননি। এখানে ছ-জন স্বেচ্ছাসেবিকাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

অফিসের সম্মুখে লাঠি চালনার সময় কিছুসংখ্যক সশস্ত্র পুলিশ রাস্তার নিকট কয়েকটি দোকানে ঢুকে কয়েকজন নিরীহ নাগরিক ও দোকানের মালিককে লাঠি ও রাইফেলের কুঁদো দিয়ে বেদম প্রহার করে— এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে। ওই দোকানের আসবাবপত্র ও অন্যান্য সম্পত্তি ভেঙেচুরে ক্ষতি করা হয়েছে। নিরস্ত্র অহিংস সত্যাগ্রহীদের ওপর অমানুষিক অত্যাচারের দৃশ্যে সমবেত জনসাধারণের মধ্যে দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল, তবু জনতা শান্ত ছিল এবং সত্যাগ্রহীদের সাহায্য করার উদ্দেশ্যে রাস্তার ওপর তারা বসে পড়েন।

লালা, কাটলিছড়া, মণিপুর, কাটাখাল প্রভৃতি অঞ্চলে সাফল্যজনকভাবে হরতাল প্রতিপালিত হয়েছে। ওই সব অঞ্চলে কোনো সরকারি অফিসের দরজা খোলা হয়নি। লালা অঞ্চলে প্রায় তিন হাজার লোকের এক বিরাট শোভাযাত্রার ওপর পুলিশ ও মিলিটারি দল বেপরোয়া লাঠি চালায়। প্রায় দেড় শতাধিক লোক ভীষণভাবে আহত হয়। আহতদের মধ্যে থেকেও বহু সত্যাগ্রহীকে গ্রেপ্তার করা হয়। মহকুমার অন্যতম বর্ধিষ্ণু বাজার কাটলিছড়া অঞ্চলেও প্রায় পাঁচ হাজার লোকের এক শোভাযাত্রা বের হয় এবং পরে এক সভায় মিলিত হয়। শোভাযাত্রায় নিকটস্থ বাগানসমূহের সমস্ত হিন্দুস্থানি শ্রমিকরা যোগদান করায় বাগানের কাজ অচল হয়ে পড়ে। সভায় মহম্মদ সফি আহমদ লস্কর সভাপতিত্ব করেন এবং বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাজ্যভাষার দাবি এবং পুলিশি জুলুমের তীব্র নিন্দা করে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। লালা ও কাটলিছড়া অঞ্চল থেকে শ্রমিকসহ ৮০ জন সত্যাগ্রহীকে গ্রেপ্তার করা হয়। কাটাখাল অঞ্চলেও হিন্দু-মুসলমানের সমবেত চেষ্টায় অত্যন্ত সাফল্যজনকভাবে সত্যাগ্রহ পালিত হয়।১২

কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা-তেও হাইলাকান্দির সংগ্রামমুখর মানুষের সংবাদ প্রকাশিত হয়। পত্রিকার হাইলাকান্দিস্থ সংবাদদাতা জানালেন,

‘সমগ্র হাইলাকান্দিতে আজ যেমন সর্বাত্মক হরতাল প্রতিপালিত হয় ইতিপূর্বে আর কখনো তেমন দেখা যায়নি। একজনও কাজে যোগ না দেওয়ায় আদালতসমেত সরকারের প্রতিটি দপ্তর বন্ধ ছিল। পুলিশ সত্যাগ্রহীদের লাঠিপেটা করে কর্মীদের পথ পরিষ্কার করে দেবার চেষ্টা করে, কিন্তু সে-চেষ্টা ব্যর্থ হয়। লাঠিচার্জের ফলে বহু সত্যাগ্রহী আহত হন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর। প্রকাশ, পুলিশ শুধু সত্যাগ্রহীদের নয়, আশপাশের দোকানে ঢুকেও মারপিট করে, জিনিসপত্র ভেঙে তছনছ করে ফেলে।

লালাবাজারেও পুলিশ লাঠি চালিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেল। লালাবাজার এখান থেকে ১১মাইল দূরে। সেখানে পুলিশের লাঠিতে নাকি শতাধিক লোক আহত হয়েছে। তার মধ্যে গুরুতররূপে আহত ছ-জনকে গ্রেপ্তার করে হাইলাকান্দিতে আনা হয়েছে।

ছ-জন বালিকাসমেত হাইলাকান্দিতে ধৃতের সংখ্যা ১৩২। পুলিশ গত রাতেই কয়েকটি স্থানে হানা দিয়ে পি এস পি-র জ্ঞান ব্যানার্জি, হরিদাস দেব, শক্তি চৌধুরী (সজাগ, সম্পাদক), ডা. বসাক, ডা. লালবিহারী নাথ, আমির লাল মোক্তার, হরেন্দ্র ভট্টাচার্য প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে যায়।

হাইলাকান্দিতে যুদ্ধের সময় সামরিক ঘাঁটি ছিল। কিন্তু কংগ্রেস আমলে আজ এখানে সৈন্য ও সশস্ত্র পুলিশের যেমন বিপুল সমাবেশ ঘটানো হয়েছে, সেদিনের ব্রিটিশ আমলেও তা দেখা যায়নি।’১৩

হাইলাকান্দির গণসংগ্রাম পরিষদ কার্যকরী কমিটির সদস্য অহিভূষণ চৌধুরী আরও কিছু তথ্য দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন: ‘… ১৮ মে রাত সাড়ে ন-টা দশটার দিকে শুনলাম শক্তিধর চৌধুরী ও হরিদাস দেব-কে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এই সংবাদে সমস্ত শহর যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। বিভাস পুরকায়স্থ এবং অন্যান্য আরও ৩/৪ জন ছাত্রনেতা বাসায় বাসায় গিয়ে মেয়েদের (ছাত্রীদের) কে, কোথায় পিকেটিং-এ থাকবে-সেই নির্দেশ দিয়ে আসেন। ভারতী চক্রবর্তী, অনিমা চৌধুরী, নন্দা দেব চৌধুরী এবং আরও কয়েকজন ছাত্রী মেয়েদের নেতৃত্ব দেন।

১৯ মে-র কর্মসূচি পর্যালোচনা করার জন্য রাত প্রায় দুটো পর্যন্ত আমি, রাজমোহন চক্রবর্তী, কিশোরমোহন নাথ, সন্তোষ মজুমদার ও আরও কয়েকজন ছাত্র আমাদের সংগ্রাম পরিষদ অফিসে ছিলেন। বড়োদের মধ্যে রবি সেন ও অফিস সম্পাদক উপেন্দ্র দত্তও ছিলেন। ওই রাতে আমরা কেউ আর নিজ নিজ বাড়িতে ঘুমোতে যাইনি। ওই রাতেই খবর পেলাম যে, কেশববাবুর নামে ওয়ারেন্ট বেরিয়েছে। এই খবর পাওয়ার পরই তাঁকে আত্মগোপনে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। ওঁর অজ্ঞাতবাসের ঠিকানা একমাত্র আমিই জানতাম।

১৯ মে ভোর হতেই দলে দলে ছাত্র-ছাত্রী টাউন হলে এসে জড়ো হন। আনুমানিক ২০০ জন মতো। ছাত্রীর সংখ্যা কম ছিল, কারণ ছাত্রীদের ১৮ মে রাতেই তাদের পিকেটিং স্থান জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

ঘণ্টাখানেক কোনো পিকেটারই টাউন হল থেকে বেরোতে পারেননি। কারণ টাউন হলের সামনের রাস্তায় মিলিটারি মোতায়েন করা হয়েছিল। মিলিটারিদের স্বয়ং এস ডি ও মি. খোসলা এবং অ্যাডিশনাল পুলিশ সুপার মি. বাসুমাতারি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। টাউন হলের রাস্তায় যাকে পায় তাকেই গ্রেপ্তার করে। ড. বসাক, কাঞ্চন গোস্বামী, দিলীপ সেনসহ আরও অনেককেই তখন গ্রেপ্তার করা হয়। উপায়বিহীন হয়ে টাউনহলের পিছনের জানালাগুলো দিয়ে পিকেটারদের পাঠানো হয়। … পাঁচগ্রাম ও কাটাখাল থেকেও অনেক পিকেটার এসেছিলেন। এ দিন পিকেটিং-এ উল্লেখযোগ্য মহিলাদের মধ্যে ছিলেন— শ্রী ভবতারণ ভট্টাচার্যের স্ত্রী ও ভারতী চক্রবর্তীর বড়ো বোন। … কোর্ট প্রাঙ্গণে পুলিশ অফিসার লায়নের নেতৃত্বে একদল পুলিশ পিকেটারদের ওপর লাঠিচার্জ করে এবং অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়। মনাছড়া, লালা থেকেও অনেককে গ্রেপ্তার করে হাইলাকান্দিতে নিয়ে আসা হয় এবং তাঁদের জেল হাজতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’১৪

বাংলা ভাষা আন্দোলন কেবল কাছাড় জেলার শহরগুলোতেই কেন্দ্রীভূত ছিল না— তা প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্তও পৌঁছে গিয়েছিল এবং সেটা সম্ভব হয়েছিল গণসংগ্রাম পরিষদের যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তার সফল বাস্তবায়নে। কর্মসূচি পদযাত্রা শুরুর মধ্য দিয়ে তিনটি মহকুমার গ্রামের মানুষের সঙ্গে নেতৃত্বদানকারীগণ আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। অভূতপূর্ব সাড়া পড়েছিল সমগ্র জেলাজুড়েই— যা আমরা ইতিমধ্যেই উল্লেখ করেছি। এ প্রসঙ্গে সুনির্দিষ্ট এক বা একাধিক গ্রামের কথা আমরা বলতে পারি। নিশুতি মজুমদার তখন একাদশ শ্রেণির ছাত্র। তিনি জানালেন, ‘১৯৬১ সালে আমি লালা হায়ার সেকেণ্ডারি ও মালটিপারপাস স্কুলের ইলেভেন ক্লাসের বিজ্ঞান শাখায় ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছি মাত্র। আমাদের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান পরীক্ষায় পাশ করা। দিনগুলি খুবই উৎকণ্ঠা ও উদবিগ্নতার মধ্যে কাটছিল। এ সময় ভাষা বিল নিয়ে নানা কথা আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম।

সে-সময় হাইলাকান্দি থেকে সতেরো কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছোটো শহর লালাবাজারেও ভাষা সংগ্রামের প্রস্তুতির কাজ শুরু হয়েছিল। লালবাজার অঞ্চলের প্রত্যেকটি গ্রামে গণসংগ্রাম পরিষদের শাখা অফিস খোলার ধুম পড়ে গিয়েছিল। লালাবাজারের এই ভাষা সংগ্রামে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ডা. লালবিহারী নাথ, চিতেন্দ্রনাথ মজুমদার, ভূপেশচন্দ্র দেব, বিপুলকান্তিনাথ মজুমদার, শিশিরনাথ মজুমদার, সাধন দেব, দিবাকরনাথ মজুমদার, মনোরঞ্জন সাহা, সুষেন নাথ, অনুলাল সাহা, সমরেন্দ্র দেব, পঙ্গজনাথ মজুমদার, অবিনাশ সাহা, পারিজাত পাল, কেতকীরঞ্জন নাথ, নীরদবিহারী নাথ, নিশুতি মজুমদার, রঞ্জিত নাথ, অমিয়নাথ মজুমদার, প্রতুলচন্দ্র নাথ, ক্ষিতীশচন্দ্র নাথ, ফণীন্দ্রনাথ ভৌমিক, সুবোধচন্দ্র দাস, বিজয় পুরকায়স্থ, অশোক বার্মা, রথীন্দ্র চৌধুরী, রণেন্দ্র চৌধুরী, বিনয় নাথ, তারাপদ দাস, পাঁচুগোপাল দত্ত, সতীন্দ্রমোহন দাস, নন্দলাল নাথ, ফণীভূষণ দেব, বীরচাঁদ সিংহ, নির্মলেন্দু নাথ, বীরেন্দ্র নাথ প্রমুখ।

আমাদের গ্রাম চন্দ্রপুরেও সংগ্রাম পরিষদের শাখা অফিস খোলা হয়েছিল। সমিতির সভাপতি ছিলেন সুবোধচন্দ্র দাস। সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলাম আমি অর্থাৎ নিশুতি মজুমদার। এ ছাড়া আমাদের গ্রামের আর যাঁরা কমিটি সদস্য এবং সত্যাগ্রহী ছিলেন তাঁদের মধ্যে যাঁদের নাম মনে পড়ছে তাঁরা হলেন সর্বশ্রী- কালিমোহন দাস, পরিমল দাস, সুষেনচন্দ্র দাস, রামমোহন দাস, মনমোহন দাস, পান্নালাল দাস, শশাঙ্ক দাস, মৃণালকান্তি দাস, কৃষ্ণমোহন দাস, কামিনী সিংহ, সমরজিৎ সিংহ, আলম চৌধুরী, মানিক চ্যাটার্জী, দীন দয়াল, রবি দাস প্রমুখ। আমরা গোপনে বেশ কয়েকটি সভায় মিলিত হয়েছিলাম।

আমরা সে-সময় ভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে লুকিয়ে গ্রামের বিভিন্ন স্থানে প্রচারপত্র বা পোস্টার লাগানোর ব্যবস্থা করেছিলাম।

পোস্টারগুলিতে ছিল:

১. ভাষা জননীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় আত্মবলি দিতে দলে দলে এগিয়ে আসুন।

২. সংগ্রাম, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে যোগ দিন, সত্যাগ্রহী তালিকায় নাম লেখান।

৩. আমাদের মাতৃভাষার অধিকার কেড়ে নিল যারা— তাদের সঙ্গে কোনো আপোশ নয়।

৪. মাতৃভাষা জিন্দাবাদ, বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ ইত্যাদি।

১৯৬১ সালের ১৯ মে আমরা লালাবাজার অঞ্চলের গণ সংগ্রাম পরিষদ সদস্যরা টার্মিনাস স্টেশন লালাঘাটে গিয়েছিলাম ট্রেন চলাচল বন্ধ করতে। লালাঘাট স্টেশন ছিল লালাবাজার থেকে তিন কিলোমিটার দূরে কাটাখাল নদীর তীরে অবস্থিত। আমরা লালাবাজারের সত্যাগ্রহীরা ভোর থেকেই দলে দলে উপস্থিত হয়েছিলাম স্টেশন চত্বরে। আমরা প্রায় সকলেই রেল ইঞ্জিনের সামনে লাইনের ওপর বসে পড়েছিলাম। আমরা সমস্ত দিন ধরে বদরপুরগামী ট্রেনকে এক ইঞ্চিও এগিয়ে আসতে দিইনি। সেদিন সত্যাগ্রহী ভাই বোনেরা একে অন্যকে জল ও ফলাহার বিতরণ করেছিল। মেয়েরা একযোগে গেয়েছিল অনেক স্বদেশ প্রেমের গান, আবৃত্তি করেছিল একযোগে—

উদয়ের পথে শুনি কার বাণী

ভয় নাই ওরে ভয় নাই

নি:শেষে প্রাণ যে করিবে দান

ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।

ওরা গান গেয়েছিল— ‘নাই নাই ভয় হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার’ অথবা ‘সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরা অপমান, বা ‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে।’

১৯ মে শিলচরে সত্যাগ্রহী হত্যাযজ্ঞের পর গণ সংগ্রাম পরিষদ ২৩ মে থেকে ২৯ মে পর্যন্ত যে প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করে আমরা সেই কর্মসূচি যথাযথভাবে পালন করেছি। অর্থাৎ প্রতিটি সরকারি কার্যালয়ে ধর্মঘট, পিকেটিং করা হয়। আমরা লালাবাজার অঞ্চলের ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতিদিন সত্যাগ্রহী মিছিলে যোগ দিচ্ছিলাম। লালাবাজারে এ সব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি প্রশাসন এর মোকাবিলার জন্য এক জোরদার শান্তি কমিটি গঠন করে। সেই কমিটিতে নিবারণ চন্দ্র মজুমদার, ললিতচন্দ্র সিংহ, প্রতাপচন্দ্র নাথ, গুরুপ্রসাদ মজুমদার, ধনু সিংহ, ডা. ভগীরথ বণিক, রসরাজ বণিক, তুলারাম রাঁকো ও মাড়োয়ারি সমাজের কয়েকজন ব্যক্তি ছিলেন। আমাদের মিছিলও অন্যান্য তৎপরতা থামানোর জন্য হাইলাকান্দি থেকে এস ডি পি ও তার দলবলসহ লালাবাজারে এসে উপস্থিত। আমরাও সেদিন মিছিলে ছিলাম। পুলিশের সঙ্গে শান্তি কমিটির সদস্যরাও ছিলেন। আমার পিতৃদেবও পুলিশের সঙ্গে ছিলেন। তিনি আমাকে ও আমার দিদিকে মিছিল থেকে ডাকিয়ে এনে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। সেদিন আমাদের মিছিলের নেতৃত্বদানকারী সত্যাগ্রহী ডা. লালবিহারী নাথ, ভূপেশ দেবসহ বেশ কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে হাইলাকান্দি নিয়ে যায়।’১৫

গ্রাম কাছাড়ের ভূমিকার কথা জানিয়েছেন সঞ্জীব দেব লস্কর। তিনি জানান:

আন্দোলনের বার্তা নিয়ে সংগ্রাম পরিষদের কর্মকর্তারা এসে বড়খলা রাজা গোবিন্দচন্দ্র মেমোরিয়াল উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে মিলিত হন। পরিতোষ পাল চৌধুরী এবং আরও কয়েকজন পদযাত্রা করে বড়খলা পৌঁছান এবং থানার নিকটবর্তী একটি ‘খালিঘরে’ একরাত্রি বাস করেন। এখানেই প্রথম সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। যে-সমস্ত ছাত্র ও যুবকরা এগিয়ে এসেছিলেন এরা হলেন— রাজকুমার কৈরী, সমীরণ চন্দ, অজয় দেব লস্কর, মিলন দেব, নীরেন্দু নন্দী, বলাই দাস, জয়ন্ত কর। তা ছাড়াও এগিয়ে এসেছিলেন দীপ্তজ্যোতি বর্মণ, ভাস্করপ্রতিম দে, সজল দেব লস্কর, জীবন চক্রবর্তী। অপেক্ষাকৃত কনিষ্ঠদের মধ্যে চঞ্চল চক্রবর্তী, কমল দত্ত, গোপী দত্ত, সুবল দেব, অসীম দেব লস্কর এবং রথীন্দ্র দাস-দের নাম পাওয়া যাচ্ছে।

শ্রীদেব লস্কর জানিয়েছেন:

যে সমস্ত মেয়েদের নাম পাওয়া গেছে এরা হল— ছায়া নন্দী, চঞ্চলা বর্মণ, লীলা দাস, মালতি দাস, রমা কর, রত্না চক্রবর্তী, ঝর্ণা কর, স্বপ্না ভট্টাচার্য, নিভা চক্রবর্তী, যুথিকা দাস, সাথী আদিত্য, শান্তশ্রী দেবলস্কর এবং ছাত্রী সংগঠক রমা বোস। …

সরকারি কার্যালয় বলতে তখন বড়খলায় ছিল একটি ডাকঘর এবং থানা। থানার দারোগা দয়াল সিং-এর প্রতি আন্দোলনকারীদের যথেষ্ট আক্রোশ ছিল। মিছিল নিয়ে বেরোনো ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি রূঢ় আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে ওকে দেখলেই ওরা ‘পচা কাঁঠাল দূর হও’ বলে ধ্বনি দিত।

শিলচরে গুলীবর্ষণের অব্যবহিত পূর্ব থেকেই গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরাও এতে সমর্থন জানাতে শুরু করেন। প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং প্রাক্তন বিধান পরিষদের সদস্য যতীন্দ্রমোহন দেব লস্কর আন্দোলনের সাহায্যে এগিয়ে আসেন এবং তাঁর বাড়ি প্রকৃতপক্ষে হয়ে ওঠে আন্দোলনের কার্যালয়। অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন নগেন্দ্রচন্দ্র দাস, ঈশ্বরচন্দ্র দাস, বারীন্দ্র চক্রবর্তী, যঙ্গ বর্মণ, সম্পূর্ণ বর্মণ, ড. গজেন্দ্র বর্মণ, দেবীপ্রসাদ দাস, উমেশচন্দ্র দেব প্রমুখ।

… ইতিমধ্যে পাঁচ-ছ-জন স্বেচ্ছাসেবীর একটি দল থানা অবরোধ করলে এদের গ্রেপ্তার করে শিলচর জেলে প্রেরণ করা হয়।১৬

গ্রাম কাছাড়ের এই ইতিবাচক ভূমিকার পাশাপাশি অনেকে নেতিবাচক ভূমিকাও পালন করেছিল। সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরি করে বাংলাভাষা আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল।

এখানে যে বিষয়টি উদবেগের, তা-হল ‘সাম্প্রদায়িকতা’ নামক বিষবৃক্ষের অতিদ্রুত প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কোনো রাজশক্তির সাহায্য সহযোগিতা, আশ্রয়-প্রশ্রয় ব্যতিরেকে সাম্প্রদায়িক শক্তির বাড়বাড়ন্ত, তৎপরতা সম্ভব নয়। এ জন্য বেশিদূর যাওয়ার প্রয়োজন নেই, ১৯৬০ সালে আসামে সংঘটিত ‘বঙ্গাল খেদা’ অভিযানের দিকে চোখ ফেরালেই উত্তর পাওয়া সম্ভব। মানুষের বিপদটা এখানেই। হাইলাকান্দির উদাহরণও তো আমাদের চোখের সামনে। যথাস্থানে বিষয়টি আমরা তুলে ধরব।

১৯ মে শিলচরে যখন সরকারি বাহিনী গুলি চালিয়ে নিরস্ত্র সত্যাগ্রহীদের একে একে হত্যালীলায় মেতে উঠেছিল— সেদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরু গৌহাটিতে।* এ দিন সন্ধ্যায় এক বিরাট জনসমাবেশে ভাষণদানকালে শ্রী নেহরু বলেন:

ইহা দুঃখের কথা যে গৃহে অগ্নিসংযোগ করা হইয়াছে এবং আজ শিলচরে পুলিশকে গুলিবর্ষণও করিতে হয়। পুলিশের এই গুলীবর্ষণের ফলে যে নয়জন প্রাণ হারাইল, প্রধানমন্ত্রী তাঁহার ৭৫ মিনিটব্যাপী ভাষণে সে-সম্বন্ধে একবারও দুঃখপ্রকাশ করেন নাই। আসামের ভাষা সংক্রান্ত সমস্যা লইয়া এই যে আন্দোলন শুরু হইয়াছে, তাহা প্রত্যাহারের জন্য প্রধানমন্ত্রী ‘কাছাড়ের ভ্রাতা এবং ভগ্নীগণের উদ্দেশে আবেদন জানান এবং তিনি বলেন, হাঙ্গামা সৃষ্টি এবং বিক্ষোভ প্রদর্শনের দ্বারা যে পরিবেশ রচিত হইবে তাহা কল্যাণপরিপন্থী। …

তিনি বলেন, হিংসার আশ্রয় লইয়া ভাষার দাবিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা যায় না। বাংলাভাষার সহিত সহযোগিতার দ্বারা অসমিয়া ভাষা নিজেই লাভবান হইবে।১৭

প্রধানমন্ত্রীর এ বড়ো নিষ্ঠুর আচরণ। শিলচরের হত্যাকান্ডে নেহরু নির্বাক। যে কোনো হত্যা নিন্দাযোগ্য। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর মন টলেনি। বরং পরোক্ষে প্রধানমন্ত্রী সত্যাগ্রহীদের ওপরই দোষ চাপিয়েছেন।

এ দিন আরও একটি ঘটনা লক্ষ করার মতো। ‘কাছাড়ের তিনটি জেলা কংগ্রেস কমিটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে গৌহাটিতে প্রধানমন্ত্রী শ্রীনেহরু ভাষা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। আসামের সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতিদানের দাবি সম্পর্কে তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়। প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীকে এ সময় একটি স্মারকলিপিও পেশ করেন। স্মারকলিপিতে মূলত দু-টি বিকল্প প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এক, সরকারি ভাষারূপে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতিদান অথবা দুই, আসাম থেকে পৃথককরণ বা স্বতন্ত্রীকরণ। প্রকাশ, প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয় বিকল্প প্রস্তাব অনুমোদন করেননি।’১৮

কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ বাংলা ভাষার দাবির বিষয়টি আসাম সরকার তথা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে জানিয়ে চূড়ান্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেছেন এবং তারপরই নির্দিষ্ট দিন ১৯ মে তারিখ ধার্য করা হয়। কিন্তু আসাম সরকার বা কেন্দ্র বিষয়টিকে গণনায় আনেননি। কিন্তু তারপরও কাছাড়ের তিনটি জেলা কংগ্রেস প্রতিনিধি দলের আবেদন-নিবেদন যে প্রধানমন্ত্রীর টনক নড়াতে ব্যর্থকাম হয়েছেন তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আর কাছাড় কংগ্রেস নেতৃত্বের গৌহাটিতে ছুটে যাওয়া যে কোনো কাজের কাজ হয়নি তাও তো পরিষ্কার হয়ে গেল।

শিলচরে ১৯ মে হত্যাযজ্ঞ অনুষ্ঠানের পর দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রসেবী, শোকবিহ্বল হৃদয়ে তাঁদের কথা জানিয়েছিলেন। কী বলেছিলেন সেদিন? ‘বর্বরতার অভিযান’ শীর্ষক এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হল:

আসামের সাম্প্রতিক কলঙ্কময় ইতিহাসে আর একটি নূতন অধ্যায় যুক্ত হইয়াছে। শিলচরে গত শুক্রবার অসমিয়াদের ক্রোধের আগুনে আত্মাহুতি দিয়াছেন নয়জন হতভাগ্য বঙ্গভাষাভাষী, আসামের অধিবাসী। গত বৎসরের নরমেধ-যজ্ঞের সহিত এবারের নির্মম অভিযানের পার্থক্য এই যে, সেবারে বঙ্গভাষাভাষীদের নিগ্রহ ঘটিয়াছিল অসমিয়া জনতার হাতে: এ বারে নাটের গুরু স্বয়ং দন্ডধর পুলিশ বাহিনী। তাহাদেরই অতর্কিত হিংস্র আক্রমণের একদিনের বলি নয়টি জীবন। যাহাদের শোণিতে শিলচর স্টেশনের সম্মুখে রাজপথ রঞ্জিত হইয়া উঠিয়াছে— তাঁহারা নিষ্ঠুর দস্যু বা উচ্ছৃঙ্খল সমাজবিরোধী ব্যক্তি নয়। তাঁহারা নিরীহ সাধারণ মানুষ মাত্র। যে অপরাধে তাঁহাদের পুলিশ ক্ষিপ্ত পশুর মতো নিষ্করুণভাবে গুলী করিয়া মারিয়াছে তাহা আর কিছুই নয়— সেটা তাহাদের মাতৃভাষার মর্যাদা স্বীকারের জন্য গণতান্ত্রিক সরকারের নিকট দাবী, যে দাবী ভারতীয় গণতন্ত্রে স্বীকৃত ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত।

… প্রধানমন্ত্রীর আসাম পরিভ্রমণ এবার ঐতিহাসিক ঘটনা বলিয়া গণ্য হইবে। নয়টি জীবন প্রথম দিনেই তাঁহাকে অর্ঘ্য দেওয়া হইয়াছে। ইহার পরও কী তিনি তুষ্ট না হইয়া পারেন? তাই কী প্রাণহানির জন্য একটা মামুলি দুঃখ প্রকাশ করাও তিনি প্রয়োজন বোধ করেন নাই? এ-নৃশংস ব্যাপারের জন্য আসাম সরকারকে দোষ দেওয়া দূরে থাকুক তিনি আন্দোলনকারীদেরই সত্যাগ্রহ বন্ধ করিতে বলিয়াছেন। অথচ সকল সংবাদপত্রের রিপোর্টেই দেখিতেছি সত্যাগ্রহীরা নিরস্ত্র ও শান্ত, সংযত ছিল। অপর কোনো সভ্যদেশে অস্ত্রহীন নর-নারীর উপর এ ধরনের উন্মত্ত আক্রমণ চালাইলে সে-সরকারকে ধিক্কার দিতে শ্রী নেহরু কী এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট করিতেন? আজ স্বদেশে— তাঁহারই গোষ্ঠীভুক্ত ও অনুগ্রহভাজন সরকারের এ বর্বরসুলভ আচরণ দেখিয়াও শ্রীনেহরু নীরব কেন? এই মর্মন্তুদ ঘটনাত তাঁহার চক্ষুর সম্মুখে ঘটিয়াছে বলিলেই হয়। তবুও তিনি যে প্রকারান্তরে দোষটা নিহতদের উপর চাপাইতে চাহিতেছেন সমকালীন ভারতের ইতিহাসে এ এক নিদারুণ ট্র্যাজেডি।

অথচ দোষ যে কাহার তাহা বুঝিতে কী কোনো অসুবিধা আছে? সরকারি কৈফিয়তে বলা হইয়াছে আত্মরক্ষার জন্যই নাকি পুলিশ গুলী ছুড়িতে বাধ্য হইয়াছিল। … একটা নগণ্য শহরের অধিবাসীরা কোন-মারাত্মক ব্রহ্মস্ত্র সংগ্রহ করিয়াছিল যে, তাহাদের আক্রমণ ব্যর্থ করিতে পুলিশকে দিগবিদিকজ্ঞানশূন্য হইয়া গুলী ছুড়িয়া নয়জনকে হত্যা ও ত্রিশজনকে আহত করিতে হইয়া ছিল? একটা খন্ডযুদ্ধেও হতাহতের সংখ্যা এত বেশি হয় না— আর সামান্য সত্যাগ্রহীদের ঠেকাইতে গিয়া এ ধরনের নিষ্ঠুর ব্যাপার ত বর্বরতার চূড়ান্ত। পুলিশ বঙ্গভাষাভাষীদের শিক্ষা দিবে বলিয়াই ঠাণ্ডা মাথায় এই হত্যাকান্ড ঘটাইয়াছে এ সিদ্ধান্ত ভ্রান্ত বলিয়া মনে হয় না। … পুলিশ শিলচরে যাহা করিয়াছে তাহা সমগ্র ভারতের লজ্জা। কিন্তু তাহারা ত যন্ত্রমাত্র, আসল দোষ ত যন্ত্রীর। আর সে যন্ত্রী প্রত্যক্ষভাবে আসাম সরকার; পরোক্ষভাবে ভারত সরকার। কাছাড়ে সত্যাগ্রহীদের দমন করিবার জন্য বিরাট পুলিশ বাহিনী ও সেনানী সমাবেশের কী প্রয়োজন ছিল? আসলে কোনো একটা ছুতায় সত্যাগ্রহীদের নিগৃহীত করিয়া আন্দোলনের মেরুদন্ড ভাঙিয়া দিবার উদ্দেশ্যেই আসাম সরকার এত আয়োজন করিয়াছিলেন। পক্ষপাত-পক্ষাঘাতগ্রস্ত কেন্দ্রীয় সরকারও তাঁহাদের মতিগতি পরিবর্তনের কোনো চেষ্টা না করিয়া কপট নিদ্রায় মগ্ন ছিলেন। কিন্তু যে সহজ সত্যটা কাহারও মনে উদয় হয় নাই তাহা এই যে, নিপীড়নের দ্বারা যদি ন্যায়সংগত কোনো আন্দোলন দমন করা যাইত— হৃদয়হীন অত্যাচারে কোনো এক জনসমষ্টির মনোবল যদি ভাঙিয়া দেওয়া যাইত তাহা হইলে ইতিহাসের ধারা ভারতবর্ষে ভিন্ন পথ বাহিয়া চলিত— শ্রী নেহরু দিল্লির তখত-ই-তাউস আলো করিতে পারিতেন না, শ্রী চালিহার ভাগ্যেও আসামের গদি মিলিত না।১৯

সংক্ষেপিত নিবন্ধটির মধ্য দিয়ে ঘটনার মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার মাথায় পুরো বিষয়টি নিবন্ধকার যেভাবে উপস্থিত করেছেন— তাতে অনেক অপ্রিয় সত্যই আলোর মুখ দেখার সুযোগ লাভ করে। আসাম সরকার যে পরিকল্পিতভাবেই এই হামলা পরিচালনা করেছেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারও কোনো উচ্চবাচ্চ না করে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে আসাম সরকারকেই সমর্থন জানিয়েছেন— সে-বিষয়টিও নিবন্ধকার স্পষ্ট করেছেন।

২০ মে, শোকে মুহ্যমান শিলচর। নিষ্ঠুর গুলীর ঘায়ে রক্তমাখা ন-টি মৃতদেহ বুকে আঁকড়িয়ে সান্ধ্য-আইনের ফাঁস-পরা এই সীমান্ত-শহর প্রচন্ড বিক্ষোভে ফুঁসছে। ঝাঁপবন্ধ দোকানের ভেতরে, দুয়ার ভেজানো বাড়ির ভেতরে সহস্র সহস্র কন্ঠ ধ্বনি তুলেছে—‘নারীঘাতী শিশুঘাতীর বিচার চাই, অন্যায়ের, অত্যাচারের জবাব চাই।’ সকাল থেকেই বর্ষণ চলছে। রোরুদ্যমান আকাশের তলায় চল্লিশ হাজার শোকার্ত জনতা ভাষা আন্দোলনে নিহত ন-জন শহিদকে নিয়ে এক বিরাট মিছিল বের করে এবং পর পর ন-টি চিতা পাশাপাশি দাউ দাউ জ্বলতে থাকে। …শহরের প্রতি গৃহশীর্ষে কৃষ্ণপতাকা উত্তোলিত দেখা যায়। মিছিলেও কালো ব্যাজ পরিধান করে। কোথাও কোনো হাঙ্গামা হয়নি। সশস্ত্র পুলিশ আর সঙ্গীনধারী সেনাবাহিনী পথে পথে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। মিলিটারি গাড়ির দ্রুত-ধাবমান আর্তনাদ, হেলমেটধারী খাকি পোশাকির অভূতপূর্ব তৎপরতা প্রহরে প্রহরে বিভীষিকা বাড়িয়ে তুলেছে। আপাতত স্থির আছে, আগামী ২৫ মে পর্যন্ত শহরে সান্ধ্য আইন অষ্টপ্রহর বলবৎ থাকবে।

আজও সরকারি ও বেসরকারি সমস্ত অফিস, আদালত ও দোকানপাট বন্ধ আছে। সকালের ট্রেন তিনঘণ্টা বিলম্বে ছাড়ে বটে; কিন্তু তাতে যাত্রী ছিল না। বিভিন্ন চা-বাগান ও অন্যান্য স্থান থেকে প্রায় পাঁচশো ট্রাক সেনাবাহিনীর জন্য তলব করা হয়েছে। … মৃতদেহসহ শোভাযাত্রা, বের করার জন্য ছাত্র-ছাত্রীরা যখন প্রস্তুত হচ্ছিলেন, তখন পূর্বেকার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সান্ধ্য আইনের আদেশ জারির এক ঘণ্টার মধ্যেই তা পরিবর্তন করে সাতদিন ব্যাপী ২৪ ঘণ্টার জন্য সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। আমাদের কলিকাতাস্থ স্টাফ রিপোর্টার জানান, এ দিন দমদমে আগত শিলচরের বিমানযাত্রীদের মতে সর্বদলে গঠিত কাছাড় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ভাষা-আন্দোলনের প্রথম দিনে শুক্রবার রেল স্টেশনের নিকটে আসামের কংগ্রেসি রামরাজত্বের অহিংস বুলেটে নিহত ৯ জন ছাড়া আর যে ৫১ জন আহত হয়েছিলেন, তার মধ্যে আরও একজন আজ সকালে হাসপাতালে মারা গেছেন। এ নিয়ে এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল দশ।

শিলচর থেকে প্রেরিত স্টাফ রিপোর্টারের বিবরণে আরও বলা হয় যে, কাছাড় জেলার ইতিহাসে এ ধরনের নৃশংস হত্যাকান্ড আর কখনো হয়নি এবং স্বাধীন ভারতে বাংলা ভাষার জন্য এরূপ আত্মদানও এই প্রথম। … যে ক-জন নিহত হয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকের ঊর্ধ্বাঙ্গ বিশেষ করে মাথায় ও বুকে গুলী লেগেছে। আহত অনেকের আঘাতও ঊর্ধ্বাঙ্গে।

এ গুলী চালনা সম্পর্কে বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবী কংগ্রেসি, অকংগ্রেসি বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে উঠেছে। শিলচর পৌরসভার চেয়ারম্যান শ্রীমহীতোষ পুরকায়স্থ, কংগ্রেসি এম এল এ শ্রীমতী জ্যোৎস্না চন্দ প্রমুখ কয়েকজন ইতিমধ্যেই ওই দাবিতে প্রধানমন্ত্রী শ্রী নেহরুর নিকট তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন। …

আসামের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীবিমলাপ্রসাদ চালিহা আজ দুপুরে গৌহাটি থেকে শিলচর পৌঁছান। পৌঁছেই তিনি স্থানীয় সরকারি কতৃপক্ষের সঙ্গে এক বিশেষ বৈঠকে মিলিত হন।’২০

২০ মে শনিবার করিমগঞ্জেও পূর্ণ হরতাল পালিত হয়: ‘গৃহে গৃহে কালো পতাকা উড়ানো হয় এবং জনসাধারণ শোক চিহ্নের প্রতীক কালো ব্যাজ পরিধান করেন। ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে গতকাল করিমগঞ্জ মহকুমায় দুটি শিশুসন্তান কোলে ১৪ জন মহিলাসহ ১৮৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাংলাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকার করাবার এই আন্দোলন যাতে জয়যুক্ত হয়— তজ্জন্য হিন্দুরা স্থানীয় কালীবাড়িতে গীতা ও চন্ডীপাঠ করে ও যজ্ঞ করে সমবেত প্রার্থনা করেন।

রেলওয়ে স্টেশন ও সরকারি অফিসগুলিতে পিকেটিং করার সময় পুলিশ বহু সত্যাগ্রহীকে ভ্যানে তুলে ৬/৭ মাইল দূরে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়। …

সত্যাগ্রহের প্রথম দিনেই করিমগঞ্জে অহিংস সত্যাগ্রহী ও জনসাধারণের ওপর সশস্ত্র পুলিশের নৃশংস আক্রণে ১৯৮ জন আহত হয়েছে এবং তাদের করিমগঞ্জ সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। আরও বহুলোক আহত হয়েছেন— যাঁরা হাসপাতালে নিজেদের আঘাতের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেননি।

এদিকে কাছাড়ে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সীমান্তের ওপারস্থিত পাকিস্তানিদের মধ্যেও বেশ উৎসাহ দেখা গেছে। … গত পরশু শত শত পাকিস্তানি মুসলমান কুশিয়ারা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে ছাত্রদের শোভাযাত্রা দেখে। পাকিস্তান সীমান্ত করিমগঞ্জ শহর থেকে মাত্র ২০০ গজ দূরে।’২১

এ দিন করিমগঞ্জে দোকান-পাট, অফিস-আদালত সব বন্ধ থাকে। বাস, রিকশাসহ সকল প্রকার যানবাহন বন্ধ ছিল। একজন সরকারি মুখপাত্র এদিন বলেন, ‘করিমগঞ্জে মেন লাইনে প্রায় দু-হাজার ফুট রেললাইন অপসারিত হয়েছে। একটি ব্রাঞ্চ লাইনের কয়েকটি স্লিপারও সরানো হয়েছে। তবে এগুলি সারানো হয়েছে। বদরপুর, হাইলাকান্দি, কাটলিছড়া, লালাবাজার এবং পাথারকান্দিতে উত্তেজনা থাকলেও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।’২২

এ দিকে ১৯ মে রাতেই করিমগঞ্জ জেলা কংগ্রেস শিলচরে গুলীবর্ষণের প্রতিবাদে এক সভায় মিলিত হন। ‘সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে করিমগঞ্জে অহিংস সত্যাগ্রহীদের ওপর পুলিশের অত্যাচারের প্রতিবাদ করা হয়। প্রস্তাবে শিলচরে পুলিশের গুলীবর্ষণের প্রতিবাদ জানিয়ে হাইকোর্টের একজন নিরপেক্ষ বিচারপতি দ্বারা অবিলম্বে বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি করা হয়। জেলা কংগ্রেস প্রধানমন্ত্রীকে কাছাড় পরিদর্শনেরও আমন্ত্রণ জানান।’২৩

কমিউনিস্ট পার্টির শিলচর জেলা পরিষদ এ দিন এক বিবৃতিতে ১৯ মে শিলচরে পুলিশের গুলি বর্ষণের নিন্দা জানানো হয়। বিবৃতিতে ‘সশস্ত্র ফৌজ প্রত্যাহার, বিচারবিভাগীয় তদন্ত এবং এ সব এলাকায় দ্রুত ব্যক্তিস্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও ধৃত ব্যক্তিদের মুক্তি দাবি করা হয়। বিবৃতিতে শান্তিপূর্ণভাবে এই ব্যাপক গণহরতাল সংগঠনের জন্য জনসাধারণকে অভিনন্দন জানিয়ে তাদের কাছে এই মর্মে আবেদন জানানো হয় যে, তারা যেন সর্বপ্রকার প্ররোচনা উপেক্ষা করেন এবং হিংসাত্মক কার্যকলাপ বর্জন করেন। বিবৃতিতে শান্তিপূর্ণভাবে দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য সকলের কাছে আবেদন করা হয়।’২৪

আসাম বিধানসভায় কমিউনিস্ট দলের শ্রী গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন যে: ‘পুলিশের গুলীবর্ষণে একটি বালিকা ও একটি শিশুসহ ১১ জন নিহত হওয়ার সংবাদ অত্যন্ত মর্মান্তিক। শ্রী ভট্টাচার্য এ বিষয়ে বিচারবিভাগীয় তদন্ত এবং নিহত ব্যক্তিদের পরিবারবর্গকে ক্ষতিপূরণ দানের দাবি জানান।’

শিলচরে ভাষা আন্দোলনের অহিংস সত্যাগ্রহীদের ওপর পুলিশের বর্বরোচিত গুলি বর্ষণ সম্পর্কে সরকার পক্ষ থেকে যে তথ্য প্রচার করা হয়েছে, তার প্রতিবাদ করে কমিউনিস্ট পার্টির কাছাড় জেলা পরিষদ সম্পাদক শ্রীঅচিন্ত্য ভট্টাচার্য এক বিবৃতি দেন। শ্রীভট্টাচার্য বিবৃতিতে বলেন, ‘গত ১৯ মে সর্বাত্মক হরতালের সময় শিলচর রেলস্টেশনে সত্যাগ্রহী ও অপেক্ষমান জনসাধারণের ওপর পুলিশ গুলীবর্ষণ করে ১০টি তরুণ ও একটি তরুণীকে হত্যা করেছে। ৩০ জনের বেশি গুলীতে আহত হয়েছেন।

এই গুলীবর্ষণের কোনো সংগত কারণ ছিল না। পুলিশের পক্ষ থেকে যথেষ্ট ভীতি প্রদর্শন ও প্ররোচনা থাকা সত্ত্বেও জনগণ শান্তিপূর্ণ ছিল। এই হরতালে শুধু যে জেলার সব কিছুই বন্ধ ছিল তা নয়, প্রতিটি গ্রামেও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। জেলার বহুস্থানে লাঠি চালনা, কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ ও গ্রেপ্তার চলেছে।

গুলী চালনা সম্পর্কে সরকার যে ভাষ্য প্রচার করেছেন, আমি তার প্রতিবাদ জানাচ্ছি। সরকারি ভাষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। যদি সরকারের সাহস থাকে, তবে তাঁরা নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি মেনে নিন। শিলচরে গুলী চালনার জন্য কতৃপক্ষ গোড়া থেকেই সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু জনসাধারণ সতর্ক ছিলেন বলে প্ররোচনাকারীগণ সুযোগ পায়নি। নতুবা যে ক্ষেত্রে সমস্ত জেলায় কয়েক লক্ষ লোক সর্বত্র বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন, সে-ক্ষেত্রে বহু গোলযোগ ঘটার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তা হয়নি।

গভীর ক্ষোভের বিষয় যে, রেলস্টেশনে বা পাশের রাস্তাগুলিতে গুলী চালনার মতো কোনো গুরুতর অবস্থা দেখা না দেওয়া সত্ত্বেও পুলিশ কোনো হুঁশিয়ারি না দিয়ে আড়াই ঘটিকার সময় অকস্মাৎ ঘটনাস্থল থেকে দূরে রেলস্টেশনে গুলীবর্ষণ আরম্ভ করে দেয়। কেউ আইনমাফিক হুকুম দিয়েছেন কিনা তা সন্দেহজনক। রেলস্টেশনে লাইনের ওপর সত্যাগ্রহীরা শান্তিপূর্ণভাবে বসেছিলেন এবং সেখানে বেলা আড়াইটার সময় অবস্থা এমন শান্তিপূর্ণ ছিল যে, সত্যাগ্রহীদের সম্মুখে সশস্ত্র পুলিশের সংখ্যা ছিল নামমাত্র। বেলা আড়াইটার সময় দূরে বড়ো রাস্তায় ট্রাক পুড়েছে বলে পুলিশ একদল লোককে বেয়নেট, লাঠি ও বন্দুকের কুঁদা মেরে তাড়িয়ে নিয়ে আসে ও তাঁরা প্রহারের ফলে স্টেশনে ঢুকে সত্যাগ্রহীরা যেদিকে ছিলেন — সেদিকে ছুটে যেতে থাকেন। সত্যাগ্রহীরা শান্তভাবে রেললাইনে বসেছিলেন। কিন্তু সেই মুহূর্তে সত্যাগ্রহী লাইন লক্ষ করে গুলীবর্ষণ আরম্ভ হয়। বহু রাউণ্ড গুলী চালানো হয় ও সামনের দিকে অর্ধবৃত্তাকার এলাকা জুড়ে গুলী চালনা করা হয়। নিহতদের মধ্যে অন্তত দু-জন একাধিক বুলেটের আঘাত পেয়েছেন— যা থেকে গুলী চালনার তীব্রতা অনুমান করা সহজ। স্পষ্টত দেখা যায় যে, জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য নয়, হত্যা করার জন্যই তীব্রভাবে গুলী চালানো হয়েছে। গুলী চালাবার পর হতাহতদের ঘটনাস্থল থেকে কেবল সত্যাগ্রহীরা ও জনসাধারণ তুলে নিয়েছেন। অসীম সাহসে তাঁরা গুলীবর্ষণের মধ্যেই এ কাজ করে গেছেন। পুলিশ, জেলাশাসক, কেউই এই প্রাথমিক কর্তব্য করেননি এবং প্রাথমিক চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা করেননি। পুলিশের প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাব এ থেকেই প্রমাণিত।’

‘সরকারি প্রেসনোটে বলা হয়েছে যে, বন্দুক অনুসন্ধানরত চারজন কনেস্টবলকে জনতা মারপিট করতে থাকায় তারা সাহায্যের জন্য চীৎকার করতে থাকে ও পুলিশ প্রথম আত্মরক্ষার্থে গুলী চালায়; পুলিশদল স্টেশনে ফেরার সময় জনতা ঢিল ছুড়তে থাকায় পুলিশ আবার আত্মরক্ষার্থে গুলী চালায়। এই উভয় বিবৃতিই মিথ্যা ও বানানো।

যে ট্রাক পুড়িয়ে দেওয়ার কথা সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জনসাধারণই ট্রাকে চড়ে সেই আগুন নিভিয়ে দেয়। কেউ আগুন দিয়ে নিজেই নিভাতে যায় না। এই ঘটনা সহস্র সহস্র লোক দেখেছে। আগুন নিভে যাবার পর পুলিশের তান্ডব শুরু হয়। কেউ তখন পুলিশকে আক্রমণ করেনি। সমস্ত জেলায় কোনো পুলিশ নিহত হয়নি, ঘটনাস্থলেও কেউ নিহত হয়নি। যেকোনো ভাষাভাষী সরকারি কর্মচারীও আক্রান্ত বা অপমানিত হননি। পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনীর বহুসংখ্যক নিজস্ব মোটরের বাইরেও কমপক্ষে যে পাঁচ শতাধিক ট্রাক, বাস, জিপ ইত্যাদি পুলিশ ব্যবহার করেছে, তার মধ্যে এই ট্রাকটি বাদে একটিও নষ্ট হয়নি বা আক্রান্ত পর্যন্ত হয়নি। কোনো সরকারি অফিসবাড়ি আক্রান্ত হয়নি বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বলে জানি।

এ সব অবস্থা থেকে আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ রূপ সম্পর্কে কারও কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে না। ট্রাক পোড়ানোর ফলে বাধ্য হয়ে গুলী চালাতে হয়েছে অথবা আত্মরক্ষার জন্য সশস্ত্র পুলিশ গুলী চালিয়েছে, এই উভয় ও পরস্পরবিরোধী সরকারি ভাষ্য দু-টিই অগ্রাহ্য। আমি সরকারি ভাষ্যের সততা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করছি। গুলীবর্ষণের কোনো বাস্তব পরিস্থিতি কোনো সময়েই দেখা দেয়নি। আমি যা নিজে দেখেছি তাই-ই বিবৃত করছি।

আমি পার্টির পক্ষ থেকে পুনর্বার এই বর্বর ও অমানুষিক গুলীবর্ষণের তীব্র প্রতিবাদ করছি এবং অগৌণে তদন্ত দাবি করছি।’২৫

প্রত্যক্ষদর্শী এই কমিউনিস্ট নেতার বিবৃতি অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠ, ইতিহাস নির্ভর। কমিউনিস্ট পার্টির কামরূপ জেলা পরিষদ সেক্রেটারিও এক বিবৃতিতে কাছাড় জেলায় পুলিশি জুলুমের নিন্দা ও অবিলম্বে পুলিশের গুলীবর্ষণের বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি করেন। সেক্রেটারি অতিরিক্ত পুলিশ বাহিনীকে সরিয়ে নেবারও দাবি জানান।

প্রজা সমাজতন্ত্রী দলের নেতা লোকসভা সদস্য শ্রীহেম বড়ুয়াও এক বিবৃতিতে ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান এবং অবিলম্বে বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি করেন।২৬

অপরদিকে লোকসভার কংগ্রেসি সদস্য কাছাড়ের শ্রীসুরেশচন্দ্র দেব এক তারবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শ্রীনেহরু এবং মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বি পি চালিহাকে দমন নীতি বন্ধ করবার এবং জনগণের দাবি মেনে নেবার জন্য আবেদন জানান।২৭

২০ মে শিলচর মহকুমা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে আমাদের কথা শীর্ষক একটি প্রচারপত্র ডিক্টেটর শ্রীপরিতোষ পাল চৌধুরীর নামে প্রচারিত হয়। শিলচর, সাধনা প্রেস থেকে মুদ্রিত এই প্রচারপত্রের কয়েকটি দাবি ছিল এরকম:

১. ‘‘গতায়ু প্রত্যেকটি জীবনের মূল্য চাই। ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেকটি পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

২. আমাদের দাবি পরিপূর্ণভাবে হাতে না আসা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম থামবে না। কোনো ভাঁওতায় আমরা ভুলব না। আশ্বাসও চাই না। পূর্ণ ঘোষণা চাই।

৩. সত্যাগ্রহী ও জনসাধারণকে সংগ্রাম পরিষদের উপর আস্থা রেখে অগ্রসর হতে অনুরোধ করি। সংগ্রাম পরিষদ জাতির স্বার্থে কখনো দুর্বল হবে না।

৪. বেআইনি কারফিউ, ১৪৪ ধারা ও পুলিশ আইন উঠিয়ে নিতে সরকারকে আহ্বান জানাই। সংগ্রাম পরিষদ শান্তিপূর্ণ অহিংস পন্থায়ই লক্ষ্যে পৌঁছোতে চায়। সরকারি নীতি সংগ্রাম পরিষদের নীতির পরিপন্থী ও বিভ্রান্তি আনার সহায়ক বলে মনে করি।

৫. জনসাধারণ ও সংগ্রামীদের শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে অনুরোধ করি। সংগ্রাম পরিষদের ঘোষিত আন্দোলন ২৩ তারিখ থেকে নিয়মিত চলবে। সংগ্রামকে আরো তীব্র করে তুলুন। সপ্তাহব্যাপী শোক প্রকাশ, কালো ব্যাজধারণ, ঘরে ঘরে কালো পতাকা উড্ডীন করুন।

দমননীতির প্রতিবাদে এবং বন্দী মুক্তির দাবিতে অত্যাচারী ঘাতক পুলিশ-মিলিটারির সঙ্গে সর্বপ্রকারের বয়কট অব্যাহত রাখুন। পরবর্তী ঘোষণায় সমস্ত জেলায় শহিদ দিবস, পূর্ণ হরতাল ও অরন্ধনের দিন জানানো হবে। … আমাদের আওয়াজ— বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ, মাতৃভাষা জিন্দাবাদ, বাংলাকে সরকারি ভাষা করতে হবে, গুলী চালনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত চাই, অত্যাচারীর শাস্তি চাই, বন্দীদের বিনাশর্তে মুক্তি চাই, পুলিশি জুলুম বন্ধ করো, অত্যাচারী সরকার হুঁশিয়ার …।২৮

বলা প্রয়োজন যে, শিলচর সংগ্রাম পরিষদের ডিক্টেটর পরিতোষ পাল চৌধুরী এ সময় আত্মগোপনে থেকে ভাষা সংগ্রাম পরিচালনা করছিলেন।

২১ মে সত্যেন্দ্র দেব নামের একজন যুবকের মৃতদেহ তারাপুর রেলওয়ে পুকুর থেকে উদ্ধার করা হয়। হতভাগ্যের দেহে গুলীর আঘাতের চিহ্ন ছিল। গত রাতে হাসপাতালে বীরেন্দ্র সূত্রধর নামে আরও একজনের মৃত্যুর পর নিহতের সংখ্যা দাঁড়াল এগারো জন। ভাষা শহিদেরা হলেন—

১. কমলা ভট্টাচার্য, ২. কানাইলাল নিয়োগী, ৩. সুনীল সরকার, ৪. শচীন্দ্রচন্দ্র পাল, ৫. বীরেন্দ্র সূত্রধর, ৬. তরণীমোহন দেবনাথ, ৭. সুকোমল পুরকায়স্থ, ৮. চন্ডীচরণ সূত্রধর, ৯. সত্যেন্দ্র দেব, ১০. হীতেশ বিশ্বাস এবং ১১. কুমুদরঞ্জন দাস।

২১ মে তারিখেও ‘শিলচর শহরে শ্মশানের নীরবতা’ বিরাজ করে। সান্ধ্য আইন বলবৎ আছে। শহরের সর্বত্র থমথমে ভাব রয়েছে। সেনাদলকে শহরে টহল দিতে দেখা যায়।

এ দিন অপরাহ্ণে রেলওয়ে পুকুর থেকে উদ্ধার করা নিহত সত্যেন্দ্র দেব এবং পূর্বরাতে হাসপাতালে মৃত বীরেন্দ্র সূত্রধর-এর দেহ নিয়ে ‘ত্রিশ হাজার নর-নারীর এক নীরব শোকযাত্রা বের হয়। শোকযাত্রায় যোগদানকারী প্রত্যেকেই কালো ব্যাজ ধারণ করেছিলেন। শহর প্রদক্ষিণকালে প্রত্যেকের মুখে-চোখেই এক অব্যক্ত বেদনার ছায়া ফুটে ওঠে। মরণ-সাগর পারে যাঁরা চলে গেলেন, তাঁদের স্মৃতি যেন এক শোকের কালো ছায়া বিস্তার করে। তাদের কারো মুখে কথা ছিল না। ছিল এক চোখে আগুন আরেক চোখে জল। তিরিশ হাজার লোকের তিন মাইল লম্বা সুদীর্ঘ এক মিছিল সারা শহর প্রদক্ষিণ করে। তারপর অন্ধকার রাতে কাল যেখানে নটি শহিদের চিতা জ্বলেছিল— সেখানে আরো দু-টি চিতা আকাশে আগুন ছড়ায়।

মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন কংগ্রেস সভাপতি শ্রীনন্দকিশোর সিংহ এবং পৌরপতি শ্রীমহীতোষ পুরকায়স্থ। পিছনে ছিলেন কালো ব্যাজ পরা খালি পায়ে হাজার হাজার আবালবৃদ্ধবনিতা। এত মাত্র কয়েক হাজার, জেলার চোদ্দো লক্ষ লোক দূরে থেকেও ছিলেন এই মিছিলে। সকলের মুখে এক কথা:

বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষায় অগ্রগামী হে একাদশ শহিদ, তোমাদের ভুলব না, ভুলতে পারি না। তোমরা আমাদের মনে আরও বল দিয়েছ, বুকে আরও সাহস জুগিয়েছ। তোমাদের জয় হোক, বাংলা ভাষার জয় হোক। আমাদের দাবি পূরণের আগে আমরা এই আন্দোলন থামাব না, অত্যাচারী সরকারের বুলেটে ভয় পাব না।

ঘরে ঘরে শঙ্খ আর উলুধ্বনি সারা শহরের আকাশে প্রকম্পিত হয়ে সত্যাগ্রহীদের ওই শপথের সমর্থন জানায়।’২৯

আমরা জানি, গতকাল ন-জন শহিদের দেহ দাহ করা হয়। সে-সময় শ্মশানে সৃষ্টি হয়েছিল এক হৃদয় বিদারক করুণ দৃশ্যের।

সংবাদে বলা হল:

‘… গতকাল বিকালে কাছাড়ের ইতিহাসে অশ্রুতপূর্ব চল্লিশ সহস্রাধিক নর-নারীর নীরব শোকযাত্রা সহকারে বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রথম দফার বলি ন-জন শহিদের মৃতদেহ মিউনিসিপ্যাল শ্মশানঘাটে আনা হয়। সেখানে সন্ধ্যা ৭ টায় শিলচর মিউনিসিপ্যালিটি কতৃক এই বিশেষ উদ্দেশ্যে সারিবদ্ধভাবে নির্মিত ন-টি চিতায় একসঙ্গে উঠানো হয় এবং হরিধ্বনি ও বন্দেমাতরম, বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ ইত্যাদির মধ্যে একসঙ্গে আগুন দেওয়া হয়। সারিবদ্ধভাবে প্রজ্জ্বলিত ন-টি চিতার লেলিহান অগ্নিশিখার নিদারুণ দৃশ্য উপস্থিত অগণিত জনতাকে বিহ্বল করে ফেলেন— নীরবে সকলে নত মস্তকে অশ্রুবিসর্জন করতে থাকেন। মৃতদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের হাহাকার ধ্বনির মধ্যে অগ্নিদেব মৃতদেহগুলি গ্রাস করতে থাকেন। অনেকেরই বৃদ্ধ পিতা-মাতা দুদিনের উপবাস ক্লিষ্ট অবস্থায় অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে শ্মশানভূমিতে আগমন করেন— কারণ সৎকার না হওয়া পর্যন্ত মৃতের পরিবারে, হাঁড়ি চড়াবার রীতি নেই। এ সব হৃদয়বিদারক দৃশ্যাবলির মধ্যে রাত সাড়ে নটায় দাহকার্য শেষ হয়। ন-টি আধারে ন-জন শহিদের চিতাভস্ম স্থাপন করা হয় এবং শ্মশান-বন্ধুরা রাত দশটায় নীরবে শ্মশানভূমি ত্যাগ করেন। মিউনিসিপ্যাল চেয়ারম্যান শ্রীমহীতোষ পুরকায়স্থ— অন্যান্য কমিশনার ও মিউনিসিপ্যাল কর্মচারীগণসহ শেষপর্যন্ত শ্মশানঘাটে উপস্থিত থেকে যাবতীয় ব্যবস্থাদি অতিসুচারুরূপে নিষ্পন্ন করেন। এ উপলক্ষ্যে শ্মশান রোডের প্রবেশ দ্বারেও একটি শহিদতোরণ নির্মিত হয়েছিল।’৩০

অসুস্থতার জন্য বিপ্লবী শ্রী উল্লাসকর দত্ত শোকযাত্রায় যোগদান করতে পারেননি। শহিদ সত্যাগ্রহীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে শ্মশানঘাটে দু-টি মালা পাঠিয়ে দেন।

গতরাত থেকে শহরের শান্তিরক্ষার ভার সেনাবাহিনীর ওপর দেওয়া হয়েছে এবং তারা দিবারাত্র টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে, কোথাও কোনোরূপ গোলমালের চিহ্নমাত্র নেই।

এদিকে কাছাড় সংগ্রাম পরিষদ অনির্দিষ্টকালের জন্য হরতাল ঘোষণা করেন। কার্যত সোমবার থেকেই সমগ্র জেলায় আবার সত্যাগ্রহ শুরু করার কথা ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়। জেলার সর্বত্র আজও অর্থাৎ ২১ মে বন্ধ রয়েছে। ট্রেন চলাচলও বন্ধ।

সংগ্রাম পরিষদের একজন মুখপাত্র সূত্রে বলা হয় যে, আসাম রাজ্যে বাংলা ভাষা অন্যতম সরকারি ভাষারূপে গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের আন্দোলন চলতে থাকবে। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য হাজার হাজার লোক মৃত্যুর সম্মুখীন হতে প্রস্তুত, মৃত্যুতে তাঁরা ভীত নন।

‘আসাম বিধানসভার কংগ্রেসি সদস্যা শ্রীমতী জ্যোৎস্না চন্দ এবং শ্রীরণেন্দ্রমোহন দাস বিধানসভা স্পিকারের কাছে তাঁদের পদত্যাগপত্র পেশ করেন। বিধানসভার অপর সদস্য শ্রীবিশ্বনাথ উপাধ্যায়ও পদত্যাগ করেন। কাছাড় সংগ্রাম পরিষদ একযোগে বিধানসভার সকল সদস্যের পদত্যাগ দাবি করেন।

শ্রীমতী চন্দ তাঁর পদত্যাগ পত্রে বলেন:

১৯ মে শিলচরে শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহী এবং পথচারীদের ওপর পুলিশের অত্যাচার এবং বেপরোয়া গুলী চালনায় অনেক লোক হতাহত হয়েছে। যদিও আমি বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবী জানিয়েছি, তথাপি আমার মাতৃহৃদয়ে বারবার এই ঘটনার বীভৎসতার হানা দিচ্ছে। বিবেকের দংশনে তাই আমি লোমহর্ষক ঘটনার প্রতিবাদে পদত্যাগ করছি। অনুগ্রহপূর্বক আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করবেন।৩১

করিমগঞ্জ জেলা কংগ্রেস কমিটি সভাপতি ও আসাম বিধানসভা সদস্য শ্রীরণেন্দ্রমোহন দাস শিলং-এ অবস্থানরত প্রধানমন্ত্রী শ্রীনেহরুর নিকট প্রেরিত এক তারবার্তায় বলেন, ‘শিলচরে পুলিশের গুলীচালনা সম্পর্কে আমি তদন্ত করেছি। সত্যাগ্রহীগণ রেলওয়ে স্টেশনের কোনো বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেননি। আসাম সরকার আপনাকে মিথ্যা বিবরণ দিয়েছে। বিনা উত্তেজনাতেই তিন দিক থেকে গুলী চালনা করা হয়েছে। অসমিয়াদের নিয়ে গঠিত জি আর পি এবং বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স নারী ও শিশুসহ শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহীদের ওপর শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে যে বর্বরোচিত অত্যাচার করেছে, তাতে কাছাড় জেলায় গণ অভ্যুত্থান দেখা দিয়েছে।’৩২

শ্রীদাস সংবাদপত্রে এক বিবৃতিদানকালে বলেন, ‘শিলচরে পুলিশ গত ১৯ মে শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহীদের ওপর গুলী-চালনার ফলে ন-জন নিহত ও বহুলোক আহত হয়েছে। তিনি এজন্য আসাম বিধানসভার সদস্যপদ ত্যাগ করেছেন। এবং কাছাড় জেলাস্থ বিধানসভা ও সংসদ সদস্যদের, সকল স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন সংস্থার সভ্যদের পদত্যাগ করতে ও আসাম সরকারের, সঙ্গে অসহযোগিতা করার অনুরোধ জানান। শ্রীদাস সমগ্র আসামে বাংলা ভাষা স্বীকারের দাবি গ্রহণ করবার জন্য শক্তি নিয়োজিত করতে আবেদন করেন।’

এদিকে ‘বাংলা ভাষা আন্দোলনে ধৃত সত্যাগ্রহীগণ করিমগঞ্জ জেলে এক সভায় মিলিত হয়ে শিলচরে পুলিশের গুলীতে নিহতদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।

অপরদিকে করিমগঞ্জের উকিল ও মোক্তারগণ এক যুক্ত সভায় মিলিত হয়ে পুলিশের গুলীবর্ষণের নিন্দা এবং নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি করা হয়। আইনজীবীগণ ঘোষণা করেন যে, পুলিশের বর্বরতার প্রতিবাদে তাঁরা ২২ ও ২৩ মে আদালতে উপস্থিত থাকবেন না।’৩৩

বস্তুত শিলচরে গুলীবর্ষণের প্রতিবাদে সমগ্র কাছাড় জেলা জুড়েই মানুষ পথে নামে। শোভাযাত্রা, সভায় প্রতিবাদের পর প্রতিবাদ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শাসকের উদবেগ, উৎকন্ঠা যে বৃদ্ধি পেয়েছে— তা তাঁদের প্রশাসনিক পদক্ষেপেই স্পষ্ট। শান্তিরক্ষায় পুলিশের পরিবর্তে সৈন্য।

বদরপুরেও হরতাল পালিত হল। এক বিশাল শোভাযাত্রা সমগ্র শহরে পরিভ্রমণ করে এবং জনতা বাংলাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে মেনে নেওয়ার জন্য দাবি জানান।

এমন উথাল-পাথাল পরিবেশের মধ্যেই হাইলাকান্দিতে সত্যাগ্রহীদের শাস্তি ঘোষণা করা হল। আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ১৩৫ জন সত্যাগ্রহীকে হাইলাকান্দি পুলিশ গ্রেফতার করে। ম্যাজিস্ট্রেট শ্রী বি কে বড়ুয়া বন্দীদের মধ্যে ৯০ জনকে আদালতের কার্যবন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আটক থাকার শাস্তি ঘোষণা করেন। অপর ন-জনকে সাতদিন থেকে তিনসপ্তাহ পর্যন্ত বিভিন্ন দন্ডে দন্ডিত করেন।

ত্রিপুরা রাজ্যেও শিলচরে হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে হরতাল পালিত হয়। ২০ মে তারিখে আগরতলাসহ ধর্মনগর, কৈলাশসহর, কমলপুর এবং অন্যান্য মহকুমা শহরেও পূর্ণ হরতাল পালিত হয়।

১৯ মে হতাযজ্ঞে হতাহতের সংখ্যা কত? তাঁদের পরিচয় বা কী? এ বিষয়ে নিহত ১১ জনের কথা জানা যায়। কিন্তু আহত? এ পর্যন্ত ৩০ জনের একটি তালিকা বিভিন্ন গ্রন্থে মুদ্রিত, পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। আমরা আহতদের মধ্যে ৫২ জনের একটি নামের তালিকা তুলে ধরব। শিলচরে আনন্দবাজার পত্রিকা-র নিজস্ব সংবাদদাতা হাসপাতাল সূত্রে সেদিন জানিয়েছিলেন ঠিক এভাবে:

শিলচর, ২১ মে— ভাষা আন্দোলনে পুলিশের গুলীতে, লাঠির ও সঙ্গীনের আঘাতে আহত নিম্নলিখিত সত্যাগ্রহীগণ শিলচর সদর হাসপাতালে আছেন— ১. দীপালি দেব, পিতা শ্রী গিরিন্দ্র মোহন দেব, ওয়াটার ওয়ার্কস;২. রেণু সরকার, পিতা শ্রী জগদীশ সরকার; অম্বিকাপট্টি; ৩. গৌরী বিশ্বাস, পিতা অমরেশ বিশ্বাস, অম্বিকাপট্টি,৪. কল্পনারাণী দে, পিতা শ্রী রামমোহন দে, অম্বিকাপট্টি, ৫. অঞ্জলি রানি দেব, পিতা নগেন্দ্রচন্দ্র দেব, মেহেরপুর;৬. ছায়ারানি দেব, কে: অ: রামচরণ দেব, অম্বিকাপট্টি; ৭. কৃষ্ণকান্ত বিশ্বাস, পিতা কার্তিক বিশ্বাস, রাঙ্গির খাড়ি; ৮. মনোরঞ্জন পাল, পিতা প্রসন্নকুমার পাল, ধলাই স্কুল; ৯. মানিক মিয়া লস্কর, পিতা ফুরান আলি লস্কর, বেরোঙ্গী; ১০. রাজকুমার সরকার, পিতা চন্দ্রকুমার সরকার, সুভাষনগর; ১১. মোহনকুমার শুক্লবৈদ্য, প্রেমতলা;১২. প্রদ্যুন্ন কুমার চক্রবর্তী, পিতা প্রসন্ন চক্রবর্তী, কালীবাড়ি রোড, ১৩. রবীন্দ্রচন্দ্র ভদ্র, পিতা রাধিকামোহন ভদ্র, অরুণাচল; ১৪. অনিলচন্দ্র পাল, পিতা রামগোবিন্দ পাল, অরুণাচল, ১৫. নীরেন্দ্রচন্দ্র সূত্রধর, পিতা নীলচন্দ্র সূত্রধর, মেহেরপুর; ১৬. পঙ্কজচন্দ্র পাল, পিতা প্রমোদচন্দ্র পাল, তারাপুর; ১৭. মোহিত চৌধুরী, পিতা শ্রীশচন্দ্র চৌধুরী, জেইল রোড; ১৮. ভূপেন্দ্র পাল, পিতা রমনচন্দ্র পাল, তারাপুর; ১৯. নীরদচন্দ্র বর্ধন, টিকরবস্তি; ২০. বীরেন্দ্রকুমার রায়, পিতা প্রহ্লাদচন্দ্র রায়, তারাপুর; ২১. সন্তোষচন্দ্র কীর্তনিয়া, পিতা গোবিন্দচন্দ্র কীর্তনিয়া, দেশবন্ধু রোড; ২২. ধীরেন্দ্রচন্দ্র দাস, পিতা দুলালরাম দাস, হাওয়াল টিলা, মেহেরপুর; ২৩. রণজিৎ সরকার, পিতা যোগেন্দ্রচন্দ্র সরকার, তারাপুর; ২৪. গজেন্দ্রচন্দ্র কর, কে: অ: চন্দ্রমাধব ভট্টাচার্য, অম্বিকাপট্টি; ২৫. কানুলাল মজুমদার, পিতা গোবিন্দচন্দ্র মজুমদার, ২৬. গোপালচন্দ্র দেবনাথ, পিতা মোহনবাসী দেবনাথ, রাঙ্গীরখাড়ি; ২৭. সন্তোষচন্দ্র পাল, পিতা সুরেশচন্দ্র পাল, ধলাই বাজার; ২৮. শিবমোহন গোস্বামী, পিতা আনন্দমোহন গোস্বামী, তারাপুর; ২৯. বিধানচন্দ্র রায়, পিতা বিভূতিভূষণ রায়, সেন্ট্রাল রোড; ৩০. নিশিথেন্দ্রনারায়ণ ঠাকুর, পিতা নিতাইচন্দ্র পাটনী (?); ৩১. গোবিন্দচন্দ্র দাস, পিতা ভক্তচন্দ্র দাস, টিকরবস্তি; ৩২. জিতেন্দ্রকুমার দেব, পিতা নরেশচন্দ্র দেব, উকিলপট্টি; ৩৩. অনিলচন্দ্র দাস, পিতা রমেশচন্দ্র দাস, কালীবাড়ি রোড; ৩৪. মতিলাল পাল, পিতা মহেন্দ্রচন্দ্র পাল, পানপট্টি; ৩৫. গণেশচন্দ্র রায়, কে: অ: নৃপেন্দ্রচন্দ্র রায়; ৩৬. বীরেন্দ্র চক্রবর্তী, পিতা মহেন্দ্র চক্রবর্তী, প্রেমতলা; ৩৭. প্রণবদাস পুরকায়স্থ, পিতা হরিমোহন দাস পুরকায়স্থ, তুলাপট্টি; ৩৮. অনুকুল দেব, পিতা অচ্যুতচন্দ্র দেব (?), মিশন রোড; ৩৯. নিখিলচন্দ্র দেব, পিতা দীনদয়াল দেব, ইটখোলা, শিলচর; ৪০. রবীন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য, পিতা রাজচন্দ্র ভট্টাচার্য, সুভাষনগর; ৪১. মনোরঞ্জন সরকার, পিতা শশীমোহন সরকার, ইটখোলা; ৪২. জিতেন্দ্রকুমার দেব, কে: অ: নরেশচন্দ্র দেব, লক্ষ্মীপুর রোড; ৪৩. চিত্তরঞ্জন পাল, পিতা চূড়ামণি পাল, জানিগঞ্জ; ৪৪. রমেশচন্দ্র দাস, পিতা আদিত্যচন্দ্র দাস, রাঙ্গীরখাড়ি; ৪৫. সন্তোষবিলাস সেনগুপ্ত, কে: অ: প্রফুল্লবিকাশ সেনগুপ্ত, শিলচর; ৪৬. হিরন্ময় মিত্র, কে: অ: নগেন্দ্রনাথ মিত্র, সুভাষনগর; ৪৭. সানাওর আলি, পিতা ইদ্রিস আলি, কলকপুর;৪৮. শশধর চক্রবর্তী, পিতা শ্রীল চক্রবর্তী, বিলাসপুর, ৪৯. রঞ্জু দওরায়, কে: অ: বুলু দত্ত রায়, প্রেমতলা; ৫০. শান্তিশেখর ভট্টাচার্য, কে: অ: ডি এন চক্রবর্তী, অম্বিকাপট্টি; ৫১. বিকাশ রঞ্জন দেব, কে: অ: প্রফেসর বিনোদ দেব, পালপাড়া; এবং৫২. জ্যোতিষ ভট্টাচার্য, কে: অ: জগচ্চন্দ্র ভট্টাচার্য, রাঙ্গিরখাড়ি, শিলচর।৩৪

শিলচর সংবাদদাতা এ বিষয়ে আরও জানান, ‘১৯ মে …অনাচার, অত্যাচার ও গুলীবর্ষণের ফলে নিম্নলিখিত সংখ্যক মৃত ও আহতকে শিলচর সদর হাসপাতালে আনা হয়: মৃত অবস্থায় ৪ জন, হাসপাতালে আনার সঙ্গে সঙ্গে মারা যান ৪ জন, হাসপাতালে ভর্তির পর মারা যান ১ জন, অন্তর্বিভাগে ভর্তি করা হয় ৭৭ জনকে, (পুরুষ ৭০, মহিলা ৭ জন), ২০ মে ছাড়া হয় ৯ জনকে, ২১ মে হাসপাতালে আছে— ৬৭ জন, সংকটাপন্ন অবস্থায় আছেন— ৮ জন, বহির্বিভাগে চিকিৎসা গ্রহণ করেন ২৪ জন (পুরুষ ২২ জন, স্ত্রীলোক ২ জন)।’৩৫

সমকালীন সংবাদপত্রে প্রকাশিত এ সব তথ্য নিশ্চিতভাবেই প্রকৃত ইতিহাস নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

২১ মে আমরা আর একটি বিষয়ে দৃষ্টি দেব যা চলমান বাংলা ভাষার লড়াইয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ দিন শিলং-এ ‘প্রধানমন্ত্রী শ্রীনেহরু এবং সর্বদল পার্বত্য জাতি নেতা সম্মেলনের সংগ্রাম পরিষদের এক প্রতিনিধিদলের মধ্যে প্রায় ৮০ মিনিট ধরে আলোচনা চলে। আলোচনাকালে প্রতিনিধিদল এই দাবি করেন যে, ভাষা সমস্যার এমনভাবে সমাধান করতে হবে—যাতে সরকারি ও বেসরকারি চাকরি, শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে পার্বত্য অঞ্চলের লোকদের যেন কোনো প্রকার অসুবিধার সম্মুখীন না হতে হয়।’

‘প্রধানমন্ত্রী শ্রী নেহরু আজ বিকালে রাজ্যপাল জেনারেল এস এম শ্রীনাগেশ ও মুখ্যমন্ত্রী বিপি চালিহার সঙ্গে শিলং পৌঁছান। রাজভবনে পৌঁছেই প্রধানমন্ত্রী রাজ্যের বিভিন্ন সমস্যা, বিশেষ করে পৃথক পার্বত্য রাজ্য গঠন সম্পর্কিত সমস্যা নিয়ে মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করেন। আসামের মুখ্যমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী শ্রী ফকরুদ্দীন আলি আহমদ প্রধানমন্ত্রীর কাছে আসাম সরকারের অভিমত তুলে ধরেন।

পরে পার্বত্য জাতি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী সাক্ষাৎ করেন। প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব করেন ক্যাপ্টেন উইলিয়মসন সাংমা। আলোচনাকালে মুখ্যমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। আলোচনায় স্থির হয় যে, নয়াদিল্লি ও শিলং-এ যেসব আলোচনা হয়েছে তা লিখিত-পড়িত হবে; যাতে তা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য সর্বদল পার্বত্য নেতা সম্মেলনে উপস্থিত করা যেতে পারে। … এরপর শ্রী নেহরু একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগদান করেন।’৩৬

পার্বত্য প্রতিনিধিদলের সঙ্গে এই আলোচনা থেকে যে বিষয়গুলি আমাদের ভাবনার মধ্যে আসে তা হল— এক. বাংলা ভাষা আন্দোলন নিয়ে আসাম সরকার বা কেন্দ্র তথা প্রধানমন্ত্রী শ্রী নেহরুর বিন্দুমাত্র মাথা ব্যাথা নেই— এমনকী বাংলা ভাষার প্রতি, বাঙালির প্রতি কোনো অনুশোচনা বা দুঃখবোধ নেই, দুই. আসাম নেতৃত্ব বরং প্রধানমন্ত্রী শ্রীনেহরুকে সঙ্গে নিয়ে খানাপিনা আর ‘কালচারাল শো’-তে মেতে উঠলেন। না, চক্ষুলজ্জা বলে কিছু নেই। ১১ জন নিরপরাধ নিরস্ত্র বাঙালির হত্যাকান্ডও প্রধানমন্ত্রী শ্রী নেহরু ও তাঁর দলবলকে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা উপভোগ থেকে বিরত রাখতে পারেনি এবং তিন. পার্বত্যবাসীদের প্রতি যতটা নমনীয় ঠিক ততটায় কঠোর বাঙালি, বাংলাভাষীর প্রতি।

২২ মে মৃত্যুভয়হীন, দৃঢ়প্রত্যয়ী, বাংলা ভাষা পূজারি সংগ্রাম পরিষদ স্বেচ্ছাসেবক দল শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি বদরপুর প্রভৃতি অঞ্চলসহ সমগ্র কাছাড় জেলা তথা আসামে বাংলা ভাষাকে স্বকীয় মর্যদায় প্রতিষ্ঠিত করবার দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে আজ থেকে নবোদ্যমে পিকেটিং শুরু করেন।

‘শিলচরে সকাল দশটা থেকে প্রবল বর্ষণের মধ্যে স্বেচ্ছাসেবকগণ বাংলা ভাষাকে রাজ্য ভাষা হিসাবে স্বীকৃতির দাবিতে বিভিন্ন সরকারি অফিস ও আদালতের সম্মুখে সত্যাগ্রহ করতে আসেন। ফলে সরকারি কাজকর্ম অচল হয়ে পড়ে। অফিস-আদালতে লোকজন প্রায় ছিল না বললেই চলে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে এবং সরকারি দপ্তরগুলির সম্মুখে অসংখ্য সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন রাখা হয়।

আজ শিলচরে তিনদিন পর দোকানপাট খোলে। কিন্তু খুব কম লোকই কেনাকাটা করতে যায়। কয়েকটি বাস ও ট্রেন চলাচল শুরু করে বটে, কিন্তু যাত্রীসংখ্যা নগণ্য ছিল।

‘করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, বদরপুরসহ বিভিন্ন স্থানে পিকেটিং করার সময় পুলিশ অনেক সত্যাগ্রহীকে এ দিনও গ্রেপ্তার করে। করিমগঞ্জে ৫ জন সত্যাগ্রহী, হাইলাকান্দিতে ১৩ জন এবং বদরপুরে ৩ জন সত্যাগ্রহী এ দিন গ্রেপ্তার বরণ করেন। কিন্তু শিলচরে বিক্ষুব্ধ জনমত অত্যন্ত প্রবল থাকায় পুলিশ সেখানে কোনো সত্যাগ্রহীকে গ্রেপ্তার করেনি।’ সংবাদে বলা হয় শুধু শহর অঞ্চলেই নয়— ভাষা আন্দোলনের তীব্রতা গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। সর্বত্র হিন্দু-মুসলমান বাঙালিগণ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনসমিয়া অবাঙালিগণ সত্যাগ্রহ পিকেটিংয়ে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেন।’৩৭

‘করিমগঞ্জে এ দিন শিলচর থেকে ভাষা আন্দোলনে নিহত ১১ জন শহিদের চিতাভস্ম নিয়ে যাওয়া হয়। একাদশ শহিদের এই পূতাস্থি শোভাযাত্রা সহকারে নিয়ে আসা হয়। শ্রী ধীরেন্দ্রমোহন দেব-এর বাড়ি থেকে এক সুন্দর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শোভাযাত্রীদের করিমগঞ্জ অভিমুখে রওয়ানা করিয়ে দেওয়া হয়। প্রায় কুড়িহাজার লোক শহরের উপকন্ঠে উপস্থিত থেকে অশ্রু-সজল-নয়নে পূতাস্থি বরণ করে নেয়। তারপর প্রায় আড়াই মাইল ব্যাপী এক দীর্ঘ মিছিল পুষ্পমাল্য ও ধূপধূনা দিয়ে পূতাস্থি সাজিয়ে শহর পরিক্রমা করে। বৃষ্টিধারা উপেক্ষা করে বহু বৃদ্ধ, বালক, বালিকা এবং গৃহণীরা নগ্নপদে ওই মৌন মিছিলের অনুসরণ করেন। এ সময় প্রায় ৪০ হাজার মানুষ মিছিলে যোগ দেন।

মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন সদ্য পদত্যাগী বিধানসভা সদস্য রণেন্দ্রমোহন দাস ও বিশ্বনাথ উপাধ্যায় এবং তুলারাম ভূরা, মন্মথ দত্ত প্রমুখ। আজ সকালে শিলচর থেকে করিমগঞ্জ আসার পথে কাটাখাল এলাকায় দেখি, কালীনগর গ্রামের প্রায় এক হাজার লোক মিছিল করে কাটাখাল যাচ্ছে। কাটিগরা, বদরপুর, বদরপুরঘাট, শ্রী গৌরী, ভাঙাবাজার প্রভৃতি স্থানেও পিকেটিং চলে। প্রত্যেক সত্যাগ্রহীর বুকে ব্যাজ, তাতে গান্ধীজির ছবি এবং মুখে বুলি জয় বাংলাভাষীর জয়, বন্দেমাতরম।

সংগ্রাম পরিষদ সদস্য শ্রী সুখময় সিংহ এ দিন শিলচর থেকে একটি আধারে রক্ষিত এগারোজন শহিদের চিতাভস্ম বিমানযোগে কলকাতা নিয়ে যান। পশ্চিমবঙ্গ প্রজা-সমাজতন্ত্রী দলের সেক্রেটারি শ্রীবিদ্যুৎ বসু, শিলচর মিউনিসিপ্যাল বোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান শ্রীসতীন্দ্রমোহন দেব, শ্রীহট্ট সম্মিলনীর প্রাক্তন সভাপতি শ্রীদীনেশচন্দ্র দত্ত, শ্রীবিজনকুমার চৌধুরী, শ্রী দিলীপ চক্রবর্তী এবং অন্যান্য কয়েকজন দমদম বিমানবন্দরে চিতাভস্ম গ্রহণ করেন।’৩৮

এদিকে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বি এ অনার্স, বিএসসি পরীক্ষা ২২ মে থেকে শুরু হলেও শিলচর কেন্দ্রে কোনো পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দেননি। শিলচরে সত্যাগ্রহী হত্যার প্রতিবাদে এবং বাংলা ভাষার সরকারি স্বীকৃতির দাবিতেই এই পরীক্ষা বর্জন বলে জানা যায়। আর এক সংবাদে বলা হয়: ‘করিমগঞ্জ থেকে ৩০ মাইল দূরবর্তী আনিপুরে অন্যতম মণিপুরী নেতা শ্রীমদন মুখার্জির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পাঁচ হাজারেরও অধিক লোকের এক জনসভায় বাংলা ভাষাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষারূপে স্বীকারের দাবি জানিয়ে এবং শিলচরে পুলিশের গুলীবর্ষণ ও কাছাড় জেলার বিভিন্ন স্থানে পুলিশি জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে এক প্রস্তাব গৃহীত হয়। শ্রীমতিলাল দত্ত চৌধুরী, শ্রীআবদুস সোবহান, শ্রীপ্রফুল্ল নাথ, শ্রীজি মোহন কর, শ্রীদ্বিজেন্দ্র ভট্টাচার্য, শ্রীগিরীন্দ্ররঞ্জন ধর, শ্রীমতী সুরবালা মালাকার, শ্রীধীরেন্দ্রকুমার পাল (কংগ্রেস) এবং মণিপুরি নেতৃদ্বয় শ্রী মদনমোহন মুখার্জী ও শ্রীভরত মুখার্জী রামকৃষ্ণনগর আঞ্চলিক পঞ্চায়েত ও গাঁওসভার সদস্যপদ শিলচরে পুলিশের গুলীবর্ষণের প্রতিবাদে এবং বাংলা ভাষাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষারূপে ঘোষণা না করায় পদত্যাগ করেন। তাঁরা গতকাল পদত্যাগপত্র দাখিল করেন।’৩৯

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক অজয় ঘোষ দিল্লি থেকে ২২মে এক বিবৃতিতে শিলচরের বর্বর হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা করে ঘোষণা করেন যে: ‘পুলিশের গুলীবর্ষণ সম্পর্কে বিচারবিভাগীয় তদন্তের যে সিদ্ধান্ত সরকার ঘোষণা করেছেন তা যথেষ্ট নয়। এই সঙ্গে তিনি সমস্ত বন্দীদের অবিলম্বে মুক্তিদান ও দমন ব্যবস্থা প্রত্যাহার এবং স্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টির জন্যও তিনি সরকারের কাছে দাবি জানান। বিবৃতিতে বলা হয়, শিলচরে পুলিশের নৃশংস গুলীবর্ষণে এগারোজনের মৃত্যু হয়েছে এবং বহু লোক আহত হয়েছেন। এই ঘটনায় আর একবার প্রমাণিত হল মানুষের জীবন সম্পর্কে সরকার একেবারেই উদাসীন এবং সমস্যা সমাধানে আলাপ-আলোচনার পরিবর্তে সন্ত্রাস সৃষ্টিই তাদের পদ্ধতি ও নীতি। সরকারকে অবিলম্বে আন্দোলনে ধৃত সমস্ত বন্দীকে মুক্তি দিতে হবে, সমস্ত পীড়নমূলক ব্যবস্থা প্রত্যাহার করতে হবে এবং ভাষা সম্পর্কিত বিরোধ মীমাংসার জন্য আলোচনার উপযোগী আবহাওয়া সৃষ্টি যাতে হতে পারে তজ্জন্য স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা সর্বান্তকরণে এই আশাই করি যে, মিথ্যা মর্যাদার মোহে যেন সরকার এই ব্যবস্থা অবলম্বনে বিরত না হন।’

‘কমিউনিস্ট পার্টি সাধারণ সম্পাদক নিহত ও আহতদের পরিবার-পরিজনের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করে বিরোধ মীমাংসার প্রচেষ্টা করার জন্য এবং রাজ্যের মধ্যে যে সন্দেহ, ঘৃণা ও বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে তার অবসান ঘটাবার জন্য আসামের জনগণের কাছে আবেদন জানান।’৪০

এদিকে কমিউনিস্ট পার্টি কাছাড় জেলা পরিষদ এই আন্দোলনকে সর্বাত্মক গণ অভিযানে রূপ দিতে পার্টির পক্ষ থেকে নিম্নলিখিত দাবিগুলি উত্থাপন করা হয়:

১. ‘কাছাড় জেলায় বাংলা ভাষার শর্তহীন অধিকার স্বীকার করা ও ভাষা আইনের ৫ ধারা লোপ করা;

২. বাংলা ভাষায় রাজ্যভিত্তিতে আইন বিল ও সরকারি নির্দেশ প্রচার করা;

৩. বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলার আইনত স্বীকৃতি ও কাছাড়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন;

৪. কাছাড়ে মৈতেই, বিষ্ণুপ্রিয়া, ডিমাছা ও হিন্দিভাষীদের জন্য নিজ নিজ মাতৃভাষায় উপযুক্ত স্তর পর্যন্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করা, শিক্ষার জন্য বিশেষ সাহায্য ও সরকারের কাছে নিজ নিজ ভাষায় আবেদন ও আপিল করার অধিকার;

৫. এই সমস্ত ব্যবস্থাসহ ভাষা আইনের পরিবর্তন;

৬. চাকরি, বৃত্তি, উন্নয়ন প্রভৃতি প্রশ্নে কাছাড়ের জনসাধারণের ন্যায়সংগত সুযোগ সুরক্ষিত করা এবং জাতি বা ভাষা নিয়ে নাগরিকদের মধ্যে পক্ষপাত করার দৃঢ় বিরোধিতা, অবাঙালি বাঙালি সমস্ত সংখ্যালঘুদের জন্য সমভাবে রক্ষাকবচের ব্যবস্থা এবং

৭. কাছাড়ে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন।’৪১

২৩ মে শিলচর থেকে ৫৩ মাইল দূরে পাথারকান্দিতে সাবডেপুটি কালেক্টরের অফিসের সম্মুখে বঙ্গভাষা আন্দোলন সত্যাগ্রহীদের ওপর সশস্ত্র পুলিশ অমানুষিকভাবে লাঠিচার্জ করে। এর ফলে ৩২ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে নারী সত্যাগ্রহীও রয়েছেন। আহতদের অধিকাংশের আঘাত গুরুতর বলে সংবাদে উল্লেখ করা হয়। দু-জনের অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় তাদের করিমগঞ্জের বড়ো হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। অন্যদের স্থানীয় হাসপাতালেই ভরতি করা হয়।

সংবাদে বলা হয়, সত্যাগ্রহীদের ওপর ব্যাপক লাঠিচার্জ ছাড়াও টানাহ্যাঁচড়া, সজোড়ে বুটের লাথি মারার অভিযোগও পাওয়া যায়। নারী সত্যাগ্রহীদের মাথার গোছাগোছা চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলার কথাও সংবাদে উল্লেখ করা হয়। এ সময় দু-জন পুলিশও আহত হয়। পুলিশ এখান থেকে এগারোজনকে গ্রেপ্তার করে।

এ দিন সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে সমগ্র কাছাড় জেলার বিভিন্ন স্থানে দলে দলে সত্যাগ্রহীরা সত্যাগ্রহ ও পিকেটিং চালিয়ে যান। বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতি এবং শিলচরে পুলিশের নৃশংস গুলিবর্ষণ ও তান্ডবের প্রতিবাদে পার্বত্য উপজাতি জনসাধারণও নানা স্থানে বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দেন। হাফলং-এ পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। আইজলে প্রধানত পার্বত্য উপজাতি জনসাধারণ নিয়ে গঠিত এক বিরাট মিছিল বের হয় এবং পরে এক সভায় মিলিত হয়ে শিলচরে নিরস্ত্র নিরীহ মানুষের ওপর পুলিশি নির্যাতনের তীব্র নিন্দা জানান হয়।৪২

এদিকে শিলচর পৌরসভা এক প্রস্তাবে ১৯ মে গুলিবর্ষণের নিন্দা জানিয়ে বিচারবিভাগীয় তদন্ত, ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার ও রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির জন্য, দাবি জানানো হয়।

সরকার সত্যাগ্রহী দমনে এ দিন শিলচরে আরও সৈন্য আনার ব্যবস্থা করেন। গৌহাটি থেকে আরও এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য আনা হল। ইতিমধ্যে শিলচরে মাদ্রাজ রেজিমেন্ট, আসাম পুলিশ, সেন্ট্রাল রিজার্ভ ফোর্স ও বর্ডার পুলিশ অবস্থান করছে। সেনা সদস্যদের থাকার জন্য বিভিন্ন স্কুল ও অফিস গৃহ রিকুইজিশন করা হয়।৪৩

এ দিন সকালে সার্কিট হাউসে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ রাজ্য সরকারের বিভিন্ন অফিসের ‘বড়োবাবুদের’ সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হয়ে অফিসগুলিকে সচল করতে প্রয়াসী হন।

এ দিন ‘দুপুরে প্রাক্তনমন্ত্রী শ্রীবৈদ্যনাথ মুখার্জি, ধীরেন্দ্রমোহন দেব শিলচর ও করিমগঞ্জ জেলে গিয়ে বন্দীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। হাইলকান্দির উদবাস্তু বাম নেতা অমিয় নন্দীও বন্দী হলেন। রাজ্যপালের পাঠানো শোকবার্তা শিলচরের মানুষ প্রত্যাখ্যান করেন। পৌরসভা সভাপতি শ্রী মহীতোষ পুরকায়স্থ রাজ্যপালের শোকবার্তা গ্রহণ করেননি। শিলচর মহকুমা পরিষদ সভাপতি শ্রীসনৎকুমার দাস পদত্যাগ করেন। গণসংগ্রাম পরিষদ সভাপতি আবদুর রহমান চৌধুরী এক বিবৃতিতে আন্দোলনে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান। পিটিআই সংবাদসূত্রে জানা যায় যে, পিকেটিং আরও জোরদার হয়েছে। সরকারি অফিসগুলিতে সশস্ত্র পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং ফৌজি গাড়িগুলি অবিরাম টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে।

এদিকে কাছাড় মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশন ও কাছাড় চেম্বার অব কমার্স এক জরুরি সভায় মিলিত হয়ে শান্ত ও নিরস্ত্র জনতার ওপর নৃশংস হামলা ও গুলীবর্ষণের তীব্র প্রতিবাদ জানান।

অন্যদিকে শিলচর বণিকসভা ও ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে গুলীবর্ষণের প্রতিবাদে এক তারবার্তা পাঠানো হয়। কাছাড়ের বিশিষ্ট নাগরিক শ্রীসত্যেন্দ্রনাথ সেন গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কাছে এক খোলা চিঠিতে তাঁর অবিলম্বে পদত্যাগ দাবী করেন।’৪৪

২৩ মে তারিখেই শিলচর পৌরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান এবং কাছাড়ের অন্যতম নেতা শ্রীসতীন্দ্রমোহন দেব এক সাংবাদিক বৈঠকে বলেন যে, ‘আসাম সরকারের নৃশংস আক্রমণ সত্ত্বেও এই আন্দোলন সমগ্র কাছাড়ের শহর ও গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের অর্ধেকই নারী। আন্দোলন পরিচালনার জন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে জনবলের প্রয়োজন নেই। কাছাড়বাসী পশ্চিমবাংলার নৈতিক ও অন্যান্য সক্রিয় সাহায্য কামনা করেন। শ্রীদেব আরও জানান যে, সংগ্রাম পরিষদ মূলত কাছাড়ের যুবশক্তি নিয়ে গঠিত হলেও তাঁরা বর্ষীয়ান নেতাদের নির্দেশ অনুসারেই অজস্র উসকানি সত্ত্বেও সম্পূর্ণরূপে শান্ত ও অহিংস ছিল। কিন্তু আসাম সরকারের কার্যাবলিতে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, কাছাড়বাসীদের ন্যায্য দাবি বুলেটের মুখে স্তব্ধ করে দেবার জন্য সরকার পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ীই প্রস্তুত ছিলেন। সমগ্র কাছাড়ে রিকশা, ট্রাক প্রভৃতি সরকার জবরদস্তি করে দখল করে রেখেছিলেন। জেলগুলি খালি করে রাখা হয়েছিল। গুলীবর্ষণের পর আহতদের কোনো শুশ্রুষার ব্যবস্থা করা হয়নি। প্রায় এক সপ্তাহকাল কারফিউ জারি করে জনসাধারণের খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করার পরিকল্পনাও ছিল সরকারের। সত্যাগ্রহীরা একমাত্র পুলিশ বিভাগ ছাড়া সরকারের অন্যান্য সমস্ত কাজকর্ম অচল করে দিয়েছে। শ্রীদেব জানান, কাছাড়বাসী অবিলম্বে এই গুলীবর্ষণের নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেন। তিনি আরও বলেন, শ্রীনেহরু জাতীয় সংহতির নামে কাছাড়বাসীদের দাবী মানতে রাজি হননি। কিন্তু তাঁর আশীর্বাদপুষ্ট আসাম সরকারের ভাষা-নীতি যে জাতীয় ঐক্যকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, এ সত্য তিনি উপলব্ধি করছেন না।৪৫

ইতিমধ্যে ১৪৪ ধারা সংশোধন করে রাস্তায় পাঁচজনের অধিক একত্রে সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং সান্ধ্য আইনের মেয়াদ কমিয়ে রাত ন-টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত করা হয়। এ দিনও শিলচরে মাইকে ঘোষণা করার অভিযোগে সকালে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদিকে ধুবড়ি উকিলসভা এক প্রস্তাব গ্রহণ করে শিলচরে নিরস্ত্র সত্যাগ্রহীদের ওপর অমানুষিক ও বেপরোয়া গুলীবর্ষণের নিন্দা জানিয়ে বলেন যে, দুমাসের জন্য সভাসমিতি নিষিদ্ধ করে যে আদেশ জারি করা হয়েছে তা অবিলম্বে প্রত্যাহার করা হোক। শিলচরে গুলীবর্ষণের প্রতিবাদে করিমগঞ্জ স্কুল বোর্ডের প্রেসিডেন্ট শ্রীঅরবিন্দু চৌধুরী মুখ্যমন্ত্রী বি পি চালিহার কাছে তাঁর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন।৪৬

২৩ মে শিলচরে পুলিশের গুলীবর্ষণে নিহত ব্যক্তিদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য শিলং-এ ছাত্র-ছাত্রী, বালক-বালিকাদের এক দীর্ঘ মৌন শোকযাত্রা শহরের বিভিন্ন পথ পরিক্রম করে। সকলে কালো ব্যাজ পরিধান করে। শিলং-এ এ দিন পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। হরতাল শান্তিপূর্ণ ছিল। আসামের অর্থমন্ত্রী জনাব ফকরুদ্দীন আলি আহমদ এ দিন বলেন যে, শিলচরের গুলীবর্ষণ সম্পর্কে কোনো কোনো সংবাদপত্র মিথ্যা সংবাদ পরিবেশ করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় উত্তেজনা সৃষ্টি করা হচ্ছে যা অনভিপ্রেত। তিনি বলেন, সরকার ইতিমধ্যেই কয়েকটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, প্রেস উপদেষ্টা কমিটিকে বিষয়টি খতিয়ে দেখে যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। যদি তাঁরা তাতে ব্যর্থ হন তাহলে সরকারই ‘আসাম বিশেষ ক্ষমতা আইন (প্রেস)’ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হবে।৪৭

২৪ মে শিলচরে ‘অন্যান্য দিনের মতো আজও সত্যাগ্রহীরা বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় শিলচর ও কাছাড় জেলার অন্যান্য স্থানে সরকারি অফিসগুলির সম্মুখে পিকেটিং ও সত্যাগ্রহ চালান। এ দিন ১৪৪ ধারার বিধিনিষেধ ভঙ্গ করে একদল সত্যাগ্রহী নানারূপ ধ্বনি করতে করতে শহরের বিভিন্ন রাস্তা পরিক্রমা করেন। এ সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে কেউ গ্রেফতার হননি। তবে আজ সন্ধ্যার পর সান্ধ্য আইন ভঙ্গের অভিযোগে বেশ কিছুসংখ্যক লোককে শিলচরে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে শিলচর মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার শ্রী দ্বিজেন সেন অন্যতম।

সত্যাগ্রহ ও পিকেটিংয়ের ফলে বিভিন্ন সরকারি অফিসের মতো ট্রেজারির কাজও ব্যাহত হয়। বিভাগীয় কমিশনার আজ ট্রেজারির কাজ চালাবার চেষ্টা করেন। প্রকাশ, বিভাগীয় কমিশনার মিউনিসিপ্যালিটি চেয়ারম্যান শ্রী মহীতোষ পুরকায়স্থকে এরূপ অনুরোধ করেন যে, তিনি যেন ট্রেজারি অফিসের সম্মুখ থেকে সত্যাগ্রহীদের সাময়িকভাবে অপসারণের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু শ্রীপুরকায়স্থ নাকি বিভাগীয় কমিশনারকে জানিয়ে দেন যে, সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে মিউনিসিপ্যালিটির সম্পর্ক নেই। সুতরাং, মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁর এ ব্যাপারে কিছুই করণীয় নেই।’

সংগ্রাম পরিষদও বসে নেই। ‘সত্যাগ্রহী হিসেবে যোগদানের জন্য ইতিমধ্যেই ২৫ হাজার আবেদনপত্র এসেছে, আরও আসছে। সমগ্র জেলার অধিবাসীরা যে কোনো দমননীতির সম্মুখীন হবার জন্য তৈরি। উপজাতীয় জনগণও সত্যাগ্রহীদের প্রতি সহানুভূতিশীল।

এ দিন করিমগঞ্জে বাংলা ভাষা আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করবার জন্য প্রায় সর্ব সম্প্রদায়ের মানুষ আজকের দিনটিকে একতা ও মিলনের দিন হিসেবে পালন করেন। মেয়েরা জাতিধর্মনির্বিশেষে পথেঘাটে সর্বত্র প্রত্যেকের হাতে রক্তবর্ণের রাখি বেঁধে দেন।’ সংগ্রাম পরিষদ আজ ‘রাখিবন্ধন দিবস’ হিসেবেই দিনটি পালন করেন ‘শিলচরস্থ কেন্দ্রীয় ঈদ উৎসব কমিটি আজ সারা জেলার সমস্ত মুসলমানদের ভাষা শহিদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য অনাড়ম্বরভাবে ঈদ উৎসব পালনের আহ্বান জানান। এক আবেদনে এ অনুরোধও জানানো হয় যে, সমস্ত উৎসবাদি বর্জন করে কেবল যেন ধর্মীয় অনুষ্ঠানটুকুই পালিত হয়।’৪৮

ঈদ উৎসব কমিটির মূল বিজ্ঞপ্তির বয়ান ছিল এরকম:

ভাষা আন্দোলনে বিগত ১৯ শে মে তারিখে পুলিশের গুলীতে হতাহতদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ও তাঁহাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপনের জন্য শিলচরস্থ ঈদ উৎসব কমিটি এই বৎসর পবিত্র ঈদুজ্জোহা উপলক্ষ্যে ধর্মীয় অনুষ্ঠান ব্যতীত অন্য সকল প্রকার আমোদ-উৎসব বর্জন করার সিদ্ধান্ত নিয়াছে। এতদসম্পর্কে মুসলমান জনসাধারণের সহযোগিতা কামনা করা হইতেছে। ইতি-২৩/৫/৬১ ইং/৪৯

এদিকে কাছাড়ের কংগ্রেস নেতৃত্ব কংগ্রেস সভাপতির ফতোয়া অগ্রাহ্য করলেন। ২৪ মে হাইলাকান্দিতে তিন জেলা কংগ্রেস কমিটির যৌথ সভায় জনপ্রতিনিধিগণ পদত্যাগ করে আন্দোলনে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিলেন। সংবাদে বলা হল: ‘শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দির কংগ্রেস কর্মী ও নেতৃবৃন্দ বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন সম্পর্কে নিখিল ভারত কংগ্রেস সভাপতি শ্রীসঞ্জীব রেড্ডি এবং আসাম প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শ্রী সিদ্ধিনাথ শর্মার ফতোয়ার নিকট মাথা নত করতে স্বীকৃত হননি।

আজ হাইলাকান্দিতে উপরিউক্ত তিনটি জেলা কংগ্রেস কমিটির সদস্যদের যে মিলিত সভা হয় তাতে কংগ্রেস নেতা ও কর্মীগণ বঙ্গভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য কাছাড় জেলায় যে ভাষা আন্দোলন চলছে—তাতে সরকারিভাবে যোগদানের সিদ্ধান্ত করেন।

বৈঠকে কাছাড় জেলার সমস্ত এম এল এ ও এম পি-র একযোগে পদত্যাগের সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়। এ ছাড়া জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের ও গ্রাম পঞ্চায়েতের কংগ্রেসি সদস্যদের পদত্যাগ করবার সিদ্ধান্তও করা হয়।’৫০

হাইলাকান্দির এই সভা সম্পর্কে সেদিন কাছাড় জেলা সফররত প্রখ্যাত সাংবাদিক শ্রী অমিতাভ চৌধুরী তাঁর গ্রন্থে লিখলেন:

ঊষার আলো দেখা দিল চব্বিশে মে। সেদিন দুপুরে হাইলাকান্দি হাজির হয়ে দেখি—কী ভীড়, কী ভীড়! এই হাইলাকান্দিতেও কম অত্যাচার হয়নি। লাঠির আঘাতে আহতের সংখ্যা অনেক। রাইফেলও প্রায় উদ্যত হয়েছিল।

তিন জেলা কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক সিনেমা হলে। জিপে, ট্রাকে, ট্রেনে, বাসে কংগ্রেস সদস্যরা হাজির হয়েছেন। হল উপচে পড়ছে।

শুরু থেকেই উত্তেজনা। রুদ্ধ নি:শ্বাসে আমরা ক-জন সাংবাদিক অপেক্ষা করছি। সভাপতি রণেন্দ্রমোহন দাস। বৈদ্যনাথ মুখুজ্জে এসেছেন। এসেছেন জ্যোৎস্না চন্দ, সতীন্দ্রমোহন দেব। জনা দুই বাদে বিধানসভার সকল সদস্য উপস্থিত। …

নন্দকিশোর সিংহ, রামপ্রসাদ চৌবে, নিবারণচন্দ্র লস্কর, তজম্মুল বড়লস্কর প্রমুখ এক এক করে উঠে দাঁড়ান, আর পদত্যাগের কথা ঘোষণা করেন। উপস্থিত জনতা করতালি ধ্বনি দেয়।

মামুদ আলি দাঁড়ালে উত্তেজনা উঠল চরমে। তিনি উঠে বললেন, ‘দেশবাসী যদি চায়, আমি পদত্যাগ করতে রাজি আছি।’ একসঙ্গে পাঁচশো লোক চেঁচিয়ে উঠল:

আমরাই দেশবাসী আপনি অনায়াসে পদত্যাগ করতে পারেন। অন্য বাজে কথা শুনব না।’ মামুদ আলি— আপনারা কী চান? জনতা— পদত্যাগ চাই, পদত্যাগ চাই। মামুদ আলি— আমি বিধানসভার সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করলাম। জনতা এবার উল্লাসধ্বনি দিল— মামুদ আলি সাহেব জিন্দাবাদ।

এই বৈঠকে গৃহীত এক প্রস্তাবে একযোগে সকলের পদত্যাগ পাকা হয়ে গেল। গঠিত হল কংগ্রেস ভাষা-আন্দোলন কমিটি। এই কমিটি সংগ্রাম-পরিষদের সহযোগিতা করবে। শুধু তাই নয়, এই বৈঠকেই পদত্যাগ করলেন, অঞ্চল পঞ্চায়েত, গ্রাম পঞ্চায়েত, মন্ডল কংগ্রেস প্রভৃতির অসংখ্য সদস্য। সহযোগিতা আর নয়, এখন থেকে অসহযোগের বিদ্রোহ। …

একটি প্রশ্নে কংগ্রেস, কমিউনিস্ট, প্রজাসমাজতন্ত্রী সকলের একযোগে পদত্যাগ? স্বাধীন-ভারতের আর কোথাও এ-ব্যাপার হয়নি। হয়েছে একমাত্র কাছাড়ে।৫১

করিমগঞ্জে পুলিশি নির্যাতন বিষয়ে সরকারের মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে, সংগ্রাম পরিষদ সভাপতি শ্রীব্যোমকেশ দাস তীব্র প্রতিবাদ জানান। সমকালীন সংবাদপত্রে বলা হয়: ‘করিমগঞ্জ রেল-স্টেশনে সত্যাগ্রহ করার সময় জনসাধারণ পুলিশ ও সৈন্যদের প্রতি ঢিল ছুড়ছিল বলে পুলিশকে কাঁদুনে গ্যাস ছাড়তে ও লাঠিচার্জ করতে হয় বলে কলকাতার গত ২০ মে তারিখের কয়েকটি সংবাদপত্রে শিলং থেকে পিটিআই সূত্রে যে সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে করিমগঞ্জ সংগ্রাম পরিষদ সভাপতি তার প্রতিবাদ করেন।’

শ্রীদাস এক বিবৃতিতে বলেন:

ইচ্ছাকৃত এইসব বিকৃত সংবাদ প্রচারের বিরুদ্ধে আমি তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। তিনি বলেন, সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী, যা প্রধানত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার লোক নিয়ে গঠিত, করিমগঞ্জ রেলস্টেশনে মোতায়েন ছিল। তারা নিজেরাই নিরুপদ্রব নারী ও পুরুষ সত্যাগ্রহী ও অন্যান্যদের প্রতি ঢিল ছুড়ে উসকানি দিতে থাকে। তাদের নিক্ষিপ্ত ঢিলেই সাব-ডিভিশন্যাল অফিসার ও কতিপয় পুলিশসহ বহুলোক আহত হয়। তাদের নির্বিচার প্রস্তর বর্ষণ ও লাঠিচার্জ থেকে নিরীহ জনসাধারণ, রেডক্রস কর্মী ও সংবাদপত্র প্রতিনিধিরাও রেহাই পাননি। সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী জি আর পি, ডি এস পি-র (অসমিয়া) প্ররোচনায় আক্রমণকারীর ভূমিকা গ্রহণ করে এবং ঢিল ছুড়ে লোককে উত্তেজিত করে।৫২

২৪ মে হাইলাকান্দিতে কাছাড়ের তিনটি জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাকে কেন্দ্র করে প্রচন্ড উত্তেজনা, উদবেগ, উৎকন্ঠা বিতর্ক জারি ছিল। এই সভা সম্পর্কে মানুষের আগ্রহও কম ছিল না। আমরা ইতিমধ্যে এবিষয়ে বেশকিছু তথ্য তুলে ধরেছি। বর্তমান এবং আগামী প্রজন্মের কথা বিবেচনা করে এবিষয়ে আরও কিছু তথ্য আমরা উপস্থাপন করব যা জরুরি, গুরুত্বপূর্ণও বটে। স্টাফ রিপোর্টার জানালেন: ‘আসাম প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির অনুরোধ অমান্য করে কাছাড়ের তিনটি জেলা কংগ্রেস কমিটি আজ এখানে এক ঐতিহাসিক যুক্ত অধিবেশনে ভাষা আন্দোলন দমনে পুলিশি বর্বরতার প্রতিবাদে ধিক্কার দিয়ে কাছাড়ের সকল বিধানসভা সদস্যের এবং রাজ্যসভা ও লোকসভা সদস্যের একযোগে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মনোনয়নপত্র দাখিল না করে এই পদত্যাগের ফলে সৃষ্ট উপনির্বাচনগুলি ‘বয়কট’ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি— এই তিন জেলা কমিটির ওই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে জেলার ভাষা-আন্দোলন নতুন মোড় নিল। উত্তেজনামুখর এই অধিবেশনে সভাপতির আসন গ্রহণ করেন করিমগঞ্জ জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতি রণেন্দ্রমোহন দাস।

প্রায় হাজার লোকের সম্মুখে উপস্থিত থেকে শ্রীনিবারণচন্দ্র লস্কর, এম পি, শ্রীরামপ্রসাদ চৌবে, এম এল এ, মৌলবী তজ্জামল আলি বড়লস্কর, এম এল এ, জনাব মাহমুদ আলী, এম এল এ, সকলের উল্লাস ও করতালি ধ্বনির মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে নিজ পদত্যাগের কথা ঘোষণা করেন।

এই জেলার ১৩ জন বিধানসভা সদস্যের মধ্যে একজন কমিউনিস্ট শ্রীগোপেশ নমঃশূদ্র এবং একজন প্রজাসমাজতন্ত্রী শ্রী বিশ্বনাথ উপাধ্যায়। তাঁরা উভয়েই ইতিপূর্বে ওই একই প্রশ্নে পদত্যাগ করেছেন। বাকি ১১ জন কংগ্রেসের। এর মধ্যে শ্রীজ্যোৎস্না চন্দ এবং শ্রীরণেন্দ্রমোহন দাস ইতিপূর্বে পদত্যাগ করেছেন।

অন্যান্য কংগ্রেসি সদস্যের মধ্যে আবদুল মতলিব মজুমদার, শ্রী গৌরীশঙ্কর রায়, কৃষিমন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী এবং মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা আছেন। তা ছাড়া শ্রীহেমচন্দ্র চক্রবর্তীর মৃত্যুতে কাটিগড়া কেন্দ্রের একটি আসন খালি আছে। শেষোক্ত চারজন এ দিনের অধিবেশনে অনুপস্থিত ছিলেন।

শ্রীনিবারণচন্দ্র লস্কর ছাড়া জেলার আর একজন লোকসভা সদস্য হচ্ছেন শ্রীদ্বারিকানাথ তেওয়ারি। একমাত্র রাজ্যসভা সদস্যের নাম শ্রীসুরেশচন্দ্র দেব। শেষোক্ত দু-জনও এ দিন আসতে পারেননি।

প্রকাশ, জেলা কংগ্রেস কমিটিগুলির তরফ থেকে আজ রাতে অনুপস্থিত সদস্যদের এ দিনের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়। শ্রী তেওয়ারি, শ্রীদেব এবং শ্রী গৌরীশঙ্কর রায় দু-একদিনের মধ্যেই তাঁদের পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেবেন বলে আশা করা যায়। তবে মুখ্যমন্ত্রী চালিহা, কৃষিমন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী এবং আবদুল মতলিব মজুমদার কী করবেন তা বোঝা যাচ্ছে না। আগ্রহাকূল জেলা কমিটি সদস্যদের সম্মুখে এক-এক জন বিধানসভা সদস্য দাঁড়ান এবং নিজ নিজ পদত্যাগের কথা ঘোষণা করেন।

জনাব মাহমুদ আলি দাঁড়িয়ে বলেন, ‘দেশবাসী যদি চায়, আমি পদত্যাগ করব।’

দর্শকগণ—আমরাই দেশবাসীর প্রতিনিধি। মাহমুদ আলি—আপনারা কী চান? দর্শকগণ—আমরা আপনার ও সকলের পদত্যাগ চাই। মাহমুদ আলি—আমি ঘোষণা করলাম পদত্যাগ করছি (তুমুল করতালি ধ্বনি)।

এভাবে শ্রীরামপ্রসাদ চৌবে, জনাব তজ্জামল আলি বড়লস্কর, শ্রীনন্দকিশোর সিংহ এবং শ্রী নিবারণচন্দ্র লস্কর পদত্যাগের কথা ঘোষণা করেন। শিলচর জেলা কংগ্রেস সভাপতি শ্রীসন্তোষ রায়, শ্রীমন্মথ দত্ত, শ্রীমতী জ্যোৎস্না চন্দ, শ্রীসতীন্দ্রমোহন দেব, শ্রীবৈদ্যনাথ মুখার্জি, জনাব আবদুল জলিল, জনাব আলতাফ হোসেন, শ্রী রবীন্দ্রকুমার সেন, শ্রী সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস, শ্রী জগন্নাথ প্রমুখ অধিবেশনে বক্তৃতা করেন।

এ দিনের সভায় কাছাড় জেলা ভাষা আন্দোলন কমিটিও গঠিত হয়। কমিটি আহ্বায়ক শ্রী রণেন্দ্রমোহন দাস। শ্রী দাস জানান, কংগ্রেসি এম পি শ্রী নিবারণচন্দ্র লস্কর এবং শ্রীনন্দ কিশোর সিংহ, হাজি মাহমুদ আলি, শ্রীরামপ্রসাদ চৌবে ও জনাব তজ্জামল আলি বড়লস্কর— এই কয়েকজন কংগ্রেসি এম এল এ পদত্যাগ করেছেন। শ্রী দাস বলেন, এ ছাড়া কাছাড়ের আঞ্চলিক পঞ্চায়েতের কয়েকজন সভাপতি ও সদস্যও তাঁর কাছে পদত্যাগপত্র দাখিল করেছেন। পদত্যাগ যাঁরা করেছেন— তাঁরা হলেন: করিমগঞ্জ আঞ্চলিক পঞ্চায়েত সভাপতি হাজি নুরুল হক চৌধুরী, করিমগঞ্জ পঞ্চায়েত সহকারি সভাপতি শ্রী প্রফুল্লকুমার চৌধুরী, বদরপুর আঞ্চলিক পঞ্চায়েত সভাপতি শ্রীরাকেশ চন্দ্র দাস, পাথারকান্দি আঞ্চলিক পঞ্চায়েত সভাপতি শ্রীগোপাল সিংহ, উত্তর করিমগঞ্জ আঞ্চলিক পঞ্চায়েত সহকারী সভাপতি শ্রীজ্ঞানেন্দ্র দাস, কাটাখাল আঞ্চলিক পঞ্চায়েত সহকারী সভাপতি শ্রীরজনীকান্ত দে, শিলচর মহকুমা পরিষদ সভাপতি শ্রী সনৎকুমার দাস, আঞ্চলিক পঞ্চায়েত এবং স্থানীয় সংস্থার আরও অনেক সদস্যও একই সঙ্গে পদত্যাগ করেছেন।

শ্রীদাস বলেন, ‘কাছাড় জেলা কংগ্রেস ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটি বর্তমানে কাছাড় জেলা ভাষা আন্দোলন কমিটি নামে পরিচিত হয়েছে। কাছাড়ে অহিংস এবং শান্তিপূর্ণভাবে অসহযোগ আন্দোলন চালাবার উদ্দেশ্যে এই কমিটিকে পরিকল্পনা এবং কর্মসূচি প্রণয়নের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। আরও স্থির হয়েছে যে, বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এই কমিটি জেলা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে একযোগে কাজ করবে এবং বাংলা ভাষার দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলতে থাকবে।’৫৩

২৫ মে শিলচরে ‘এক মাইল দীর্ঘ এক শোভাযাত্রা ১৪৪ ধারা অমান্য করে শহর পরিভ্রমণ করে। শোভাযাত্রীদের কন্ঠে ‘আমরা সরকারি নিষেধাজ্ঞা মানি না’ আওয়াজ এবং বন্দেমাতরম ধ্বনি। জেলা কতৃপক্ষ ও টহলদারি সেনারা এমন ঘটনায় হতভম্ব হয়ে পড়ে। দু-জন অশীতিপর বৃদ্ধার নেতৃত্বে বিদ্যালয়ের ছাত্রদের এই শোভাযাত্রায় কালো পতাকা ও কংগ্রেস পতাকা রয়েছে। শোভাযাত্রীরা ১৪৪ ধারা অমান্য করে গান্ধীবাগে সমবেত হন। সেখানে ব্যাপক কর্মতালিকা গ্রহণের সঙ্কল্প গ্রহণ করা হয়। মিউনিসিপ্যালিটি কমিশনার কমিউনিস্ট দ্বিজেন সেন সহ ৯ ব্যক্তি আজ গ্রেপ্তার হন। গত সাতদিন ধরে জেলায় শোভাযাত্রা চলছে। বিভিন্ন স্থানে সত্যাগ্রহী গ্রেপ্তার অব্যাহত। সরকার সকল সরকারি কর্মচারীকে অফিসে উপস্থিত হওয়ার জন্য সার্কুলার জারি করেছেন। সরকারি অফিসেও পিকেটিং চলছে। ইতিমধ্যে রামকৃষ্ণনগরে আঞ্চলিক পঞ্চায়েতের শ্রী রঞ্জিত দে, বসন্ত মিত্র, অনুকূলভূষণ দেব, ধীরেন্দ্র পাল, সতীন নমঃশূদ্র পদত্যাগ করেন। সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয় সমূহের শিক্ষকগণ এক প্রস্তাবে পুলিশের অত্যাচারের নিন্দা করেন।’

এদিকে ‘হাইলাকান্দিতে আইন অমান্য আন্দোলনের পঞ্চম দিন অর্থাৎ ২৫ মে শান্তিপূর্ণভাবে অতিবাহিত হয়। অফিস-আদালতের সম্মুখে পিকেটিং হয়েছে। কার্যত শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে এ দিন কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। রাস্তায় পুলিশ টহল দিচ্ছে।

গত ১৯ মে লালাতে পুলিশের লাঠিচার্জের ফলে শ্রীসুধীর পাল, শ্রীনৃপেন্দ্র পাল ও শ্রীরজনী পাল গুরুতর আহত হয়ে পুলিশের হেফাজতে হাসপাতালে রয়েছেন। স্পেশাল কোর্টে তাদের বিচার হবে। গতকাল অর্থাৎ ২৪ মে ম্যাজিস্ট্রেট শ্রী বি বড়ুয়ার আদালতে কাটাখালের আরও আটজন সত্যাগ্রহীর বিচার হয়। তাঁদের প্রত্যেককে তিনসপ্তাহ করে বিনাশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। দন্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন— ডা. কে সেনাপতি, শ্রীরমেন্দ্রকুমার দে, পঙ্কজ দে, আলাউদ্দিন চৌধুরী, পুলকেশ দত্ত।’৫৪

২৫ মে করিমগঞ্জের ফৌজদারি আদালত ও মহকুমা পরিষদ দপ্তরের সম্মুখে পিকেটিং করার অভিযোগে ৬ জন বালিকাসহ ২১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আজ সকাল থেকে ঝড়-বৃষ্টি সত্ত্বেও সমস্ত আদালত ও রাজ্য সরকারের দপ্তর সমূহের সম্মুখে পিকেটিং চলে। ফলে, অফিস-আদালতের কাজকর্ম স্থগিত থাকে। বদরপুর ও পাথারকান্দিতে আজও সরকারি দফতরগুলিতে শান্তিপূর্ণ পিকেটিং করা হয়।

২৫ মে তারিখে কমিউনিস্ট পার্টির আসাম রাজ্য পরিষদ সেক্রেটারি ফণী বরা এক বিবৃতিতে জানান যে, ‘গত ১৬ থেকে ২০ মে পর্যন্ত যোরহাটে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির আসাম রাজ্য পরিষদের বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তবলি ২০ মে সকালে যোরহাটে বিশেষভাবে আহূত সাংবাদিক সম্মেলনে প্রকাশ করা হয়। এই সংবাদ বিভিন্ন পত্রিকায় বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ফলে, জনসাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তি ও ভুলবোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। আমি তাই এই বিবৃতি দেবার প্রয়োজন বোধ করছি।’

তিনি জানান: ‘… কাছাড়ের কিছু নেতা কতৃক পরিচালিত সংগ্রাম পরিষদের দাবিগুলি অন্যরূপ। অসহযোগ আন্দোলন দ্বারা আসামকে বহুভাষী রাজ্য করার জন্য তারা যে সংগ্রাম পদ্ধতি ও কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন— কমিউনিস্ট পার্টি তা সমর্থন করে না। আমাদের পার্টি মনে করে, এ ধরনের আন্দোলনের ফলে কাছাড়ের জনগণ কখনো তাদের ন্যায্য ও বৈধ প্রাপ্য আদায় করতে পারবে না। সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুদের ঐক্য ও সম্প্রীতির সম্পর্কও এতে দৃঢ় হয় না। কাছাড় সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আমাদের পার্টির কোনো সম্পর্ক নেই; আমাদের দাবি ও আন্দোলন আলাদা। কাছাড়ের জনগণ কমিউনিস্ট পার্টির আন্দোলনকে সমর্থন করবে, তাদের আন্দোলনে অথবা ন্যায্য দাবি আদায়ে জনসাধারণের সমস্ত অংশের সমর্থন ও সহযোগিতা অর্জনের জন্য কোনো চেষ্টার ত্রুটি তারা করবেন না। জনগণ সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে সংশ্রব ত্যাগ করবেন কারণ তাদের দাবি ও কর্মসূচি রাজ্যের জনগণের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বকে বিঘ্নিত করে।’৫৫

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির এই অবস্থানে আসামে বসবাসকারী বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে উদবেগ, উৎকন্ঠা, ভীতি যে স্থায়ীভাবে বাসা বাঁধতে পারে— তা তো বলাই যেতে পারে। সংগ্রাম পরিষদের দাবি, বাংলা ভাষাকে রাজ্যের অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া এবং অন্যান্য অনসমিয়া ভাষাকেও যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে হবে। এ দাবি ন্যায় সংগত ও আইনানুগ বলেও বিভিন্ন মহলের দাবি। কেবল কাছাড় নয়— সমগ্র আসামেই বাঙালি জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য, পরিসংখ্যান সেটাই দাবি করে। রাজনৈতিক দল হিসেবে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ভিন্ন মত পোষণ করতেই পারে। কিন্তু সংগ্রাম পরিষদের দাবি ও কর্মসূচি ‘রাজ্যের জনগণের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বকে বিঘ্নিত করে’— এমন মন্তব্য কেবল অনভিপ্রেত নয়— সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতকেও মজবুত করে—যা গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক আধুনিক বোধসম্পন্ন কোনো দল বা ব্যক্তির কাম্য হতে পারে না।

২৬ মে ছিল মুসলিম সম্প্রদায়ের পবিত্র ঈদুজ্জোহা। এ দিন কাছাড় জেলার সমস্ত মুসলমান শিলচরে সত্যাগ্রহী হত্যার প্রতিবাদে ঈদের আনন্দ উৎসব বর্জন করেন। পি টি আই পরিবেশিত সংবাদ থেকে জানা যায় যে, ‘শিলচরে পুলিশের গুলীবর্ষণের ফলে যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে করিমগঞ্জে দশ হাজার মুসলমান শুক্রবার সকালে ঈদের নামাজের পর একটি নির্বাক শোকযাত্রা করে শহরের রাজপথ পরিভ্রমণ করে।’৫৬

এ দিন সরকারি ছুটি থাকা সত্ত্বেও স্থানীয় সরকারি অফিসগুলির সামনে সত্যাগ্রহীদের পিকেটিং অব্যাহত থাকে। বিক্ষুব্ধ জনগণ ১৪৪ ধারা অমান্য করে শহরে, বন্দরে, গ্রামে মিছিল বের করে। গতকাল রাতে অর্থাৎ ২৫ মে রাতে সান্ধ্য আইন অগ্রাহ্য করে মিছিল বের করা হয়। সর্বত্র পিকেটিং। সেনাবাহিনী এবং সশস্ত্র পুলিশের টহলদারি সমানতালেই চলেছে।

হত্যা, পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ অব্যাহত থাকল। করিমগঞ্জ জেলা প্রজাসমাজতন্ত্রী দলের সম্পাদক শ্রীকুমুদরঞ্জন লুহ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নেহরু আসাম সরকারের এই দমননীতির কাছে নতি স্বীকার করায় ভারতের গণতন্ত্রের সমর্থকদের মন বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। শ্রীলুহ কাছাড়ের জনগণকে এ সব অবস্থায়ও বিভ্রান্ত না হয়ে আসামে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাজ্য ভাষা করার দাবি আদায়ের জন্য শান্তিপূর্ণ অহিংস আন্দোলন চালিয়ে যাবার আবেদন জানান। শিলচরের শহিদগণ যে অপূর্ব দৃঢ়তা দেখিয়ে গেছেন, তা সকলের পাথেয় হোক।’৫৭

২৪ মে ধুবড়ির সাপটগ্রাম টাউনের মানুষও শিলচরে সত্যাগ্রহী হত্যার প্রতিবাদে পূর্ণ হরতাল পালন করেন। ‘সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল ভাষাভাষীনির্বিশেষে দোকানপাট, যানবাহন বন্ধ থাকে। এমনকি দিনমজুরগণ পর্যন্ত হরতাল পালন করেন। তাঁরা কোনো কাজে যাননি। স্মরণকালের মধ্যে এরূপ হরতাল এই অঞ্চলে দেখা যায়নি।’

ধুবড়ি বার অ্যাসোসিয়েশন ২৩ মে এক জরুরি সাধারণ সভায় মিলিত হয়ে ‘শিলচরে নিরস্ত্র শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহীদের ওপর আসাম সরকারের পুলিশি জুলুমের ফলে নারী ও শিশুনির্বিশেষে যে এগারোটি অমূল্য জীবনের অবসান ঘটেছে— তার প্রতিবাদে এই সভা সরকারের প্রতি প্রচন্ড ক্ষোভ প্রকাশ এবং শহিদদের পুণ্য স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন।’

এদিকে আসাম সরকার গোয়ালপাড়ায় সব ধরনের সভা, মিছিল দু-মাসের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ‘পুলিশ অ্যাক্টের ৩০ ধারা অনুযায়ী গোয়ালপাড়া জেলা পুলিশ সমগ্র গোয়ালপাড়া দু-মাসের জন্য লাইসেন্স ব্যাতিরেকে সর্বপ্রকারের জনসভা নিষিদ্ধ করেন।

পুলিশের এই আদেশকে গোয়ালপাড়ার মানুষ সম্পূর্ণ বেআইনি, আইনত অসিদ্ধ এবং ক্ষমতা বহির্ভূত বলে ঘোষণা করেন এবং অবিলম্বে এই আদেশ প্রত্যাহারের দাবি জানান।’

‘গোয়ালপাড়ার বিদ্যাপাড়া রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিক সমিতির উদ্যোগে এবং শ্রীরমনীকান্ত বসুর পৌরহিত্যে কাছাড়ে পুলিশি নির্যাতন হত্যার প্রতিবাদে ২৩ মে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সর্বশ্রী সুখেন্দু সেনগুপ্ত, কালীপদ ঘটক ও শান্তি রায় ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। বক্তাগণ শহিদদের স্মৃতিতর্পণ এবং আসামে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাজ্যিক ভাষারূপে স্বীকৃতি দেবার দাবি জানান।’৫৮

২৬ মে শিলং-এ ‘বিশিষ্ট খাসি নেতা অধ্যাপক জি জি সোয়েস-এর সভাপতিত্বে খাসি জাতীয় দরবার হলে অনুষ্ঠিত এক সভায় শিলচরে পুলিশের গুলীবর্ষণের তীব্র নিন্দা করা হয়। এই গুলীবর্ষণের ফলে ১১ জন সত্যাগ্রহী নিহত ও আরও বহু ব্যক্তি আহত হওয়ায় শোকপ্রকাশ করে ২৭ মে শনিবার আসামের রাজধানী শিলং-এ পূর্ণ হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত সভায় গৃহীত হয়।

জাতিধর্মনির্বিশেষে জনসাধারণকে এই হরতালে যোগদান করবার জন্য অনুরোধ করে অধ্যাপক সোয়েস তাঁর উদ্দীপ্ত ভাষণে শিলচরের শান্ত সত্যাগ্রহীদের ওপর পুলিশের নৃশংস গুলীবর্ষণের বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, চালিহা মন্ত্রিসভা তার নিজের দুষ্কৃতির ফলে শাসনের অধিকার হারিয়েছে। এটা কোনো বিশেষ উপলক্ষ্যে বিশেষ সম্প্রদায়ের ওপর আঘাত নয়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলিকে ধ্বংস করবার জন্য চালিহা সরকারের এটা সুপরিকল্পিত নীতি।

হরতাল ও শোভাযাত্রা সংগঠন কমিটির সভাপতি অধ্যাপক জি জি সোয়েস জাতিবর্ণধর্ম ও রাজনৈতিক দলনির্বিশেষে জনসাধারণকে শিলচরের গুলীবর্ষণের প্রতিবাদে হরতাল পালন করবার জন্য আহ্বান করেন। শনিবার সূর্যোদয় থেকে বেলা ৪টা পর্যন্ত এই হরতাল চলবে এবং তারপর বড়োবাজার থেকে একটি শোভাযাত্রা বের হয়ে নোগযুমাইয়ের মাঠে এসে মিলিত হবে। সেখানে এক জনসভায় নিহত ব্যক্তিদের জন্য শোকপ্রকাশ এবং আসাম সরকারের কাজের তীব্র প্রতিবাদ করা হবে।’৫৯

মে মাসে গৌহাটিতেও কাছাড়ে পুলিশি নির্যাতন ও হত্যাকান্ডের তীব্র প্রতিবাদ ও নৃশংস হত্যাকান্ডে শহিদদের পুণ্যস্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। সংবাদে বলা হয়, ‘গৌহাটি আটগাঁও পল্লির গঙ্গাচরণ ধনদা বিদ্যাশ্রমের শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ এক সভায় মিলিত হয়ে শিলচরে মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার জন্য যাঁরা আত্মবলিদান করেছেন তাঁদের অমর স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন এবং তাঁদের বিদেহী আত্মার কল্যাণ কামনা করে এক প্রস্তাব গ্রহণ করেন। প্রস্তাবে বিশেষভাবে শহিদ কমলা ভট্টাচার্যের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, যে, পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষা সংগ্রামের প্রথম নারী শহিদ হিসেবে তাঁর নাম চিরভাস্বর থাকবে।’

‘২৩ মে গৌহাটি বেঙ্গলি হাই স্কুলের ছাত্রগণ শিলচরে এগারো জন শহিদের পুণ্যস্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে ধর্মঘট পালন করেন। এ দিন গৌহাটির ফ্যান্সিবাজার, পানবাজার, তেওয়ারি মার্কেট, রাধাবাজার ও পল্টন বাজারের বহুসংখ্যক দোকান বন্ধ থাকে। পল্টনবাজারের মাছ ও তরকারির বাজার সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল।’৬০

ইতিপূর্বে ‘২৩ মে শিলংয়ে দশ হাজারের অধিক পার্বত্য জাতি খাসি ও বাঙালি ছাত্র-ছাত্রীরা কালো ব্যাজ ও পতাকাসহ এক মৌন শোভাযাত্রা বের করে শিলচরে হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে। গতকাল অধ্যক্ষ উইলসন রীডের সভাপতিত্বে শিলং অপেরা হলে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় গুলীবর্ষণের নিন্দা করে বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়ে এক প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভায় অধ্যাপক জি জি সুয়েস এবং এস সি সেনগুপ্ত বক্তৃতা করেন।’ এদিকে গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে হাফলং-এ এ দিন হরতাল প্রতিপালিত হয়। পরে শ্রী জয়ভদ্র হাগজ, এম পি-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ দিনের সভায় গুলিবর্ষণের কঠোর নিন্দা করা হয়।৬১

শিলচরে সত্যাগ্রহী হত্যার প্রতিবাদে ত্রিপুরাতেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। ত্রিপুরার প্রধাননগর আগরতলা, ধর্মনগরসহ প্রায় সমগ্র ত্রিপুরাতেই হত্যার প্রতিবাদে হরতাল পালিত হয়। ত্রিপুরার ধর্মনগরে পালিত একটি প্রতিবাদ সভার প্রতিবেদন থেকে আগরতলাসহ সমগ্র ত্রিপুরার একটি চিত্র বা জনমতের প্রতিফলন আঁচ করা যায়। সংবাদপত্রে বলা হল, ‘কাছাড়ের ভাষাভিত্তিক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বঙ্গভাষাভাষী নর-নারীর ওপর ক্ষমতামদোন্মত্ত অন্ধ আসাম সরকারের নির্মম অত্যাচারের প্রতিবাদে ও শহিদদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদানের উদ্দেশে সর্বশ্রী রবীন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য, নগেন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য, যোগেন্দ্র পাল, ডা. মাখনলাল দাশ চৌধুরী, অমূল্যচন্দ্র দেব, আইনবিদ বারীন বোস, হরেন্দ্র দেবনাথ প্রমুখের উদযোগে এবং স্থানীয় ব্যবসায়ী, মটর ও অন্যান্য অ্যাসোসিয়েশনের তৎপরতায় ২০ মে ভোর ছ-টা থেকে সন্ধ্যা ছ-টা পর্যন্ত ধর্মনগরে হরতাল পালিত হয়। এ দিন অপরাহ্ণ বেলা চারটায় প্রায় অর্ধ মাইল দীর্ঘ মিছিল শহরের বিভিন্ন রাস্তা পরিক্রমা করে প্রায় সাড়ে পাঁচটায় স্থানীয় মহেশ ময়দানে এক বিরাট জনসভায় মিলিত হয়। এই জনসভায় পৌরহিত্য করেন স্থানীয় জ্ঞানবৃদ্ধ ও বয়োবৃদ্ধ নাগরিক শ্রীকামিনীমোহন ভট্টাচার্য। সর্বশ্রী জিতেন মৈত্রেয়, ডা. পুলিনবিহারী রায়, দেবব্রত চক্রবর্তী, যোগেন্দ্র পাল ও ছাত্রনেতা হরেন্দ্রচন্দ্র দেবনাথ, শৈলেন কর, সত্যনারায়ণ ভৌমিক, রামকৃষ্ণ দেবনাথ প্রমুখ বক্তা আসাম সরকারের বর্বরতা ও একগুঁয়েমির তীব্র নিন্দা করেন। মৈনুজ খাঁ নামক একজন শিল্পীর স্বরচিত মর্মস্পর্শী একটি গান গাওয়ার পর শহিদদের উদ্দেশে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করা হয়। বিনা শর্তে বন্দীদের আশু মুক্তিদান, মুক্তির পূর্বসময় পর্যন্ত তাঁদের রাজবন্দী হিসেবে গ্রহণ, আসাম সরকারের গণতন্ত্র ও সংবিধান বিরোধী কাজের নিন্দা, কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদের দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থনসমূহ আরও বেশ কয়েকটি প্রস্তাব সভায় গৃহীত হয়। সভাপতি শ্রীভট্টাচার্যের সারগর্ভ ভাষণের পর সভার কাজ শেষ হয়।

শিলচরের গুলীবর্ষণের প্রতিবাদে ত্রিপুরার আগরতলা, বিলোনিয়া, সাবেরুম, কমলপুর, তেলিয়ামুড়া, অমরপুর, উদয়পুর ও কৈলাশসহরে ২০ মে পূর্ণ হরতাল পালন করা হয়।’৬২

২৭ মে শিলং-এ পূর্বঘোষণা অনুযায়ী পার্বত্য নেতৃবৃন্দ আহূত হরতাল অত্যন্ত সফলভাবে পালিত হয়। ‘মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় কাছাড়ের যে এগারোজন নর-নারী বীরের মৃত্যুবরণ করেন, শিলং আজ দিনব্যাপী হরতালের মধ্যে দিয়ে তাঁদের পুণ্য স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করে, সঙ্গে সঙ্গে তীব্র প্রতিবাদ জানায় গণআন্দোলন দমনে আসাম সরকারের পাশবিক দমননীতির বিরুদ্ধেও।

হরতালের ফলে রাজধানীর স্বাভাবিক কাজকর্ম অচল হয়ে পড়ে। কাছাড়ের মর্মান্তিক ঘটনায় এখানকার জনসাধারণও যে কতখানি বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছেন, তার আরও প্রমাণ পাওয়া যায় আজকের বিশাল মৌন মিছিলে। আনন্দবাজার পত্রিকা-র শিলং অফিস থেকে জানানো হয় যে, প্রায় পঞ্চাশ হাজার লোকের এই মিছিল বড়োবাজার থেকে শুরু হয়, নীরবে চার মাইল পথ অতিক্রম করে শহরের অপরপ্রান্ত নংথাইমাই-এ গিয়ে শেষ হয়। শোভাযাত্রার শেষে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় পৌরহিত্য করেন অধ্যাপক জর্জ গিলবার্ট। সভায় ভাষা আন্দোলন দমনে সরকারি দমন নীতির তীব্র নিন্দা করা হয়। … বৃষ্টিধারা উপেক্ষা করে শিলংয়ের আবালবৃদ্ধবনিতা যে প্রতিবাদ মিছিল বের করেছিলেন, তাও ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এত দীর্ঘ মিছিল এই শহরে আর কখনো হয়নি।’৬৩

শিলং-এ ২৭ মে-র হরতাল বিষয়ে কমিউনিস্ট পার্টি পত্রিকা স্বাধীনতা বিস্তারিত খবর দিয়েছে। পত্রিকা জানিয়েছে: ‘ভোর থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত সর্বাত্মক শান্তিপূর্ণ হরতাল পালিত হয়। বেলা একটায় বড়োবাজার থেকে এক বিরাট মৌন শোক মিছিল রওয়ানা হয় এবং শহরের প্রধান প্রধান রাস্তা পরিক্রমা করে নংথিমা ময়দানে এক বিশাল জনসমাবেশে এসে মিলিত হয়। শিলঙের ইতিহাসে এটা বৃহত্তম মিছিল। প্রতি সারিতে ৩ থেকে ৫ জন করে লোক ছিল। রাস্তার এক-একটা মোড় অতিক্রম করতে মিছিলের পুরো এক ঘণ্টা সময় লাগে। পূর্বে এখানে শিলচর সত্যাগ্রহীদের ওপর পুলিশি বর্বরতার প্রতিবাদে দু-টি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সকল দলমতের প্রধান প্রধান নাগরিকদের নিয়ে একটি জনসভা থেকে ‘নাগরিক কমিটি’ গঠিত হয়েছিল। উক্ত কমিটি হরতাল আহ্বান করে।

এক হাজারেরও ওপর খাসিয়া ও বাঙালি তরুণ-তরুণী আজ ভোর থেকেই প্রধান প্রধান রাস্তার মোড়ে পিকেটিং শুরু করেন। সকল সরকারি ও বেসরকারি অফিসসমূহ, স্কুল, কলেজ ও দোকান বাজার বন্ধ ছিল। কোনো যানবাহন চলাচল করেনি। রাজ্য পরিবহণের গাড়িগুলি বের করা হয়নি। ডাক বিলি হয়নি এবং কোনো সংবাদপত্রও এখানে আসেনি। মাঝে মাঝে মিলিটারি গাড়িকে ছুটে যেতে দেখা যায়। দু-একটা গাড়ি চোখে পড়ে। সর্বত্র মাঝরাতের নীরবতা বিরাজ করে। জনগণ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে সহযোগিতা করেন।

কয়েক জায়গায় ট্রাফিক মঞ্চের ওপর স্বেচ্ছাসেবকরা দাঁড়িয়ে আছেন চোখে পড়ে। কয়েক জায়গায় ছেলেরা রাস্তার ওপর বল খেলতে থাকে। এ সংবাদ লেখা পর্যন্ত কোনোরূপ অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। কর্মীরা সর্বত্র শান্তি রক্ষার কাজে সচেষ্ট ছিলেন। রাস্তায় খুব স্বল্পসংখ্যক পুলিশ দেখা যায়। কয়েকটা ওয়্যারলেস ভ্যান ও পুলিশের গাড়ি ইতঃস্তত ঘুরে বেড়াতে থাকে। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, শিলচরেও যদি পুলিশ অনুরূপ মনোভাব অবলম্বন করত, তাহলে সেখানে বিয়োগান্ত পরিণতি ঘটত না।

বেলা ১২টার পর মিছিল রওনা হয়। আবালবৃদ্ধবনিতার হাতে কালো পতাকা, গায়ে কালো ব্যাজ। গ্রামাঞ্চল থেকে অনেক খাসিয়া মিছিল ও জনসভায় অংশগ্রহণ করেন। প্রায় সমানসংখ্যক খাসিয়া ও বাঙালি মিছিলে যোগ দেন। নেপালি ও অন্যান্য ভাষার লোকেরাও মিছিলে যোগ দেন। মিছিলে অর্ধেকসংখ্যক নারী ছিলেন। অনেক মায়েদের কোলে ছিল শিশু সন্তান। মিছিল রওনা হবার সময় অসহ্য গরম ছিল। জনসভায় পৌঁছোবার অর্ধপথে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়। প্রবল বৃষ্টিপাত উপেক্ষা করে মিছিলের যাত্রা অব্যাহত থাকে। শোকমৌন মিছিলে কোনোরূপ শ্লোগানের ধ্বনি তোলা হয়নি। ‘শহিদের রক্ত ভুলব না’, ‘শিলচরে পুলিশের জুলুম চলবে না’, ‘সংখ্যালঘুদের সমানাধিকার চাই’ প্রভৃতি লিখিত পোস্টার শোভাযাত্রীরা বহন করেন। … গৃহশীর্ষে, ব্যক্তিগত গাড়ি, বাস, ট্রাক ও রিকশাতে কালো পতাকা উড়তে দেখা যায়।’৬৪

কাছাড়ে ভাষা আন্দোলন দমনে আসাম সরকার সত্যাগ্রহীদের ওপর যে নৃশংস আক্রমণ করেন— তার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আসাম গণনাট্য সংঘ এবং তিনসুকিয়ার নাগরিক অধিকার সমিতি দু-টি পৃথক বিবৃতি দেন ২৭ মে। গৌহাটি থেকে প্রচারিত বিবৃতিতে আসাম গণনাট্য সংঘের সাধারণ সম্পাদক শ্রী হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেন:

আসামে আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষাকর্তাদের কাছাড়ের নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহী জনতার ওপর প্ররোচনাহীন প্রতিহিংসামূলক আক্রমণকে নিন্দা করার ভাষা নাই। ব্রিটিশ রাজত্বেও আসামে এহেন নরহত্যার নজির পাওয়া যায় না। এই কাপুরুষোচিত আক্রমণ সমস্যাজর্জরিত আসাম রাজ্যের খন্ডীকরণের পথেই সহায়ক হইবে। কাছাড়ের এই ঘটনা ভারতবর্ষের জাতীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি কংগ্রেসের অনুসৃত নীতির এক চরম নির্লজ্জ প্রকাশমাত্র। যে নীতি সমগ্র ভারতবর্ষকে ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতার পথে লইয়া যাইতেছে।

ভাষার অধিকার, কর্মসংস্থানের, শিক্ষার এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক অধিকারের সহিত অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সুতরাং, সংখ্যালঘুদের উপর এই আক্রমণ জনসাধারণের জীবনধারণ এবং আত্মপ্রকাশের অধিকারের উপর আক্রমণ বলিয়া গণ্য করিতে হইবে। আমি বিশ্বাস করি, জাতিনির্বিশেষে আসামের জনসাধারণ রাইফেলধারী ‘অহিংস’ নেহরু সরকার দ্বারা আশ্রিত এবং পরিপোষিত চালিহা সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ প্রতিবাদের ধ্বনি তুলিবেন।

আসামের জনসাধারণের কাছে আমার আবেদন, আসুন মিলিতকন্ঠে দাবি করি—

১. অবিলম্বে এই গুলীবর্ষণের বিচারবিভাগীয় তদন্ত চাই;

২. নিহত ও আহতদের ক্ষতিপূরণ চাই;

৩. গতিবিধির উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞার অপসারণ এবং নাগরিক অধিকারের পুনর্বহাল চাই;

৪. ধৃত ব্যক্তিদের অবিলম্বে মুক্তি চাই;

৫. বাংলা ভাষা ব্যবহারে কাছাড়ের জনসাধারণের পূর্ণ ও অবাধ অধিকারের স্বীকৃতি চাই;

পরিশেষে, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণের নিকট আমার আবেদন যে, এই আন্দোলন যাহাতে উগ্র জাতীয়তাবাদের আত্মধ্বংসকারী খাতে পরিচালিত না হয়, এ বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখুন।৬৫

তিনসুকিয়া নাগরিক অধিকার সমিতি সভাপতি শ্রীরতন সিং এক বিবৃতিতে জানান, ভাষা আন্দোলন দমনে গ্রেফতার, লাঠিচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ এবং গুলীবর্ষণের মধ্যদিয়ে যে ত্রাসের রাজত্ব সরকার কায়েম করেছেন তাতে তাঁরা গভীর উদবেগ বোধ করেছেন।

২৭মে সন্ধ্যায় আসাম সরকারের মুখ্য সচিব এ এস কিদোয়াই শিলং-এ এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন:

‘শিলচরে গুলিবর্ষণের ফলে নিহত ব্যক্তিদের উদ্দেশে শোকজ্ঞাপনের জন্য রাজধানী শিলংয়ে আহূত হরতালের দিন পিকেটারদের ব্যবহারে সরকার গুরুতর মনোভাব অবলম্বন করেছেন। মুখ্যসচিব বলেন, জনগণ শোকার্তের ন্যায় ব্যবহার করবে এবং পূর্ণ শৃঙ্খলা বজায় রাখবে, এটাই তাঁরা আশা করেছিলেন।’৬৬

এ দিন করিমগঞ্জে পবিত্র ঈদ উপলক্ষে সরকারি ছুটি থাকলেও সকল সরকারি অফিস সম্মুখে পিকেটিং অব্যাহত থাকে। এই পিকেটিং করার অপরাধে এ দিন ২১ জনকে গ্রেফতার করা হয়। আটক সত্যাগ্রহীদের আদালতে পেশ করা হলে মাননীয় বিচারপতি আদালতের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের আটক রাখার নির্দেশ দেন। করিমগঞ্জে এ পর্যন্ত পিকেটিং করার অপরাধে মোট ১৪১ জন সত্যাগ্রহী দন্ডিত হন।৬৭

পি টি আই. সূত্রে জানা যায় এ দিন শিলচরে সরকারি ছুটি থাকায় অফিস সম্মুখে পিকেটিং বন্ধ ছিল। তবে গৃহশীর্ষে, মোটরগাড়ি, বাস, ট্রাকে এবং রিকশাতে কালো পতাকা লাগানো ছিল।

এ দিন শিলচরে করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি এবং শিলচর জেলা কংগ্রেস কমিটির সাধারণ সম্পাদকদের এক যুক্ত বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী বিপি চালিহা কাছাড় কংগ্রেস নেতৃত্বকে শিলং এসে ভাষা সমস্যা বিষয়ে আলোচনার জন্য যে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, কংগ্রেস নেতৃত্ব এ দিন বৈঠকে বিস্তৃত আলোচনার পর মুখ্যমন্ত্রীর আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন করিমগঞ্জ কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি শ্রীমণীন্দ্রকুমার দাস। সভায় কাছাড়ের ভাষা বিষয়ে আলোচনা করবার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে কাছাড়ে আসার অথবা তাঁর কোনো প্রতিনিধিকে পাঠাবার আমন্ত্রণ সিদ্ধান্ত আকারে গৃহীত হয়।

এ দিন রেলওয়ে উপমন্ত্রী শাহনওয়াজ খান এবং সংসদ সদস্য শীলভদ্র যাজী শিলচর পৌঁছান এবং তাঁরা রেলওয়ে স্টেশন পরিদর্শন করেন। তাঁরা ১৯ মে গুলিতে নিহত রেলওয়ে পার্সেল ক্লার্ক কানাইলাল নিয়োগী-র বিধবা স্ত্রীশান্তিকণার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং আহত সত্যাগ্রহীদের দেখার জন্য হাসপাতালেও যান।৬৮

২৮মে শিলচর থেকে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করলেন শিলচরের ডেপুটি কমিশনার, যদিও এখানে দু’মাসের জন্য এই ধারা জারি করা হয়েছিল। শিলচর শহরে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করায় এই প্রত্যাহার বলে ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়।

শিলচর তথা কাছাড়ের ‘গ্রামাঞ্চলে ভাষা আন্দোলন আরও জোরদার করার জন্য জেলা কংগ্রেস সমগ্র জেলায় মন্ডল কংগ্রেস পর্যায়ে ভাষা আন্দোলন কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত করেছে এবং ইতিমধ্যেই কয়েকটি কমিটি গঠিত হয়েছে।’

পি টি আই-র সংবাদে প্রকাশ, ‘সমগ্র কাছাড় জেলার গ্রামে গ্রামে অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান দেখা দিয়েছে। … রাজ্য ভাষা হিসাবে বাংলাকে স্বীকৃতিদানের আন্দোলন আজ কাছাড়ে অষ্টম দিবসে পদার্পণ করল। সোমবার অর্থাৎ ২৯মে শহিদ দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। … সত্যাগ্রহীগণ রেলওয়ে লাইনের সম্মুখে পিকেটিং করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।’ রেল কতৃপক্ষ সোমবার ট্রেন না চালাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন বলে জানা যায়। এ দিন শহিদ দিবসের কর্মসূচিতে বলা হয়, পবিত্র গীতা, কোরান ও বাইবেল থেকে পাঠ, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অরন্ধন, সন্ধ্যায় নাগরিকবৃন্দকে প্রত্যেক গৃহের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ১১টি প্রদীপ প্রজ্জ্বলন, শহিদদের চিতাভস্ম নিয়ে শোকযাত্রা এবং তাঁদের উদ্দেশে তর্পণ ও শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান এবং বিকাল পাঁচটায় গান্ধীবাগে শোকসভা অনুষ্ঠিত হবে।’৬৯

২৮মে ‘করিমগঞ্জে ১৪৪ ধারা অমান্য করে শতাধিক সত্যাগ্রহী ‘বাংলা ভাষা আমাদের ভাষা’ প্রভৃতি ধ্বনি দিতে দিতে শোভাযাত্রা সহকারে শহর পরিভ্রমণ করেন। পিকেটিংও অব্যাহত থাকে সকল সরকারি অফিসগুলির সম্মুখে।’

এ দিন করিমগঞ্জ মহকুমা গণসংগ্রাম পরিষদ সভাপতি শ্রীব্যোমকেশ দাস এক আবেদনে বলেন,

‘… অসহযোগ করুন ন্যায়হীন, বিচারবিহীন অসমিয়া শাসনের সঙ্গে, অশুচি বস্ত্রের মতো পরিত্যাগ করুন সরকার পরিচালিত সংস্থাসমূহ, পদত্যাগ করুন প্রত্যেকটি সরকারি সংস্থার সদস্যপদ থেকে। অচল হয়ে পড়ুক সমস্ত বোর্ড, আঞ্চলিক পরিষদ, গাঁওসভা, মহকুমা পরিষদ ও স্কুল বোর্ড, ছেড়ে আসুন বিধানসভা, রাজ্যসভা ও লোকসভা।

আসাম সরকারের নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে রাজ্য বিধানসভা সদস্যা শ্রীমতী জ্যোৎস্না চন্দ, শ্রী বিশ্বনাথ উপাধ্যায় ও শ্রীরণেন্দ্র মোহন দাস এবং করিমগঞ্চ স্কুলবোর্ডের চেয়ারম্যান শ্রী অরবিন্দ চৌধুরী পদত্যাগ করেছেন। সরকারের সঙ্গে চূড়ান্ত অসহযোগিতার মাধ্যমে এই ভাষা সংগ্রামকে জয়যুক্ত করুন।’৭০

এ সময় কাছাড় জেলা গণ-সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকেও এক আবেদন প্রচারিত হয়। আবেদনে বলা হয়:

‘… সমস্ত জাতি আজ শ্রদ্ধাবনত শিরে কৃতজ্ঞতা জানায় সেইসব সত্যাগ্রহীদের, যাঁরা চরম আত্মত্যাগে চির দেদীপ্যমান করে রেখে গেল জাতির অবহেলিত সম্মানকে। আসাম সরকারের বর্বরোচিত অত্যাচারের সম্মুখেও আমাদের সত্যাগ্রহীগণ যে অনমনীয় মনোভাব, শৃঙ্খলাবোধ এবং কর্তব্যপরায়ণতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন, বিশেষত, নারী-সমাজ এই ভাষা সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যে আদর্শ স্থাপন করেছেন— জাতি তাঁদের কাছে চিরকাল ঋণী হয়ে থাকবে।

আজ জেলা সংগ্রাম পরিষদ এই নির্দেশ দিচ্ছে যে, সত্যাগ্রহী ভাই-বোন নিজ নিজ এলাকাস্থিত মহকুমা ব্যাপী কেবল রাজ্য সরকারের যাবতীয় অফিস-আদালত সম্মুখে নিরুপদ্রব সত্যাগ্রহ করে যাবেন, যে পর্যন্ত না আমাদের দাবি স্বীকৃত হয়। আরও নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে যে, উত্তেজনার কারণ বিদ্যমান থাকলেও সর্বাবস্থায় অহিংস ও শান্তিপূর্ণ থেকে সত্যাগ্রহ সংগ্রামকে সাফল্যমন্ডিত করে তুলবেন।’৭১

২৮ মে শিলং-এ বিক্ষুব্ধ জনতা থানা ঘেরাও করে হরতালের দিন আটককৃত ৮ ব্যক্তির মুক্তির দাবি জানান। সংবাদে বলা হয়, গতকালের হরতাল সম্পর্কে আটককৃত আট ব্যক্তির মুক্তির জন্য আজ এখানে দেড় হাজার থেকে দু’হাজার লোকের এক জনতা একটি থানা ঘেরাও করে এবং থানার ওপর আধ ঘণ্টাকাল ইট-পাথর ছোঁড়ে।

পুলিশ সূত্রে বলা হয় যে, পদস্থ পুলিস অফিসারগণের ও জনগণের কয়েকজন নেতার হস্তক্ষেপের পর ধৃত কয়েকজনকে জামিনে মুক্তি দিলে জনতা ছত্রভঙ্গ হয়।’

এ দিন বিকালে শিলং-এ এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতাদানকালে অধ্যাপক সোয়েল থানা ঘেরাও প্রসঙ্গের উল্লেখ করে বলেন, থানা থেকে একজন পুলিশ অফিসার বন্দুক ও লাঠি উঁচিয়ে ধরলে জনতা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। পুলিশ অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। জনগণকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আমিই থানার সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে আসি। অধ্যাপক সোয়েল বলেন, আপনারা হাঙ্গামা-সৃষ্টিকারীদের হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হবেন না। সকল অবস্থায় শান্তি ও অহিংসানীতি বজায় রেখে চলতে হবে।

সভায় অধ্যাপক কপিল ভট্টাচার্য ও জনৈক খাসি নেতা বক্তৃতাকালে জনগণকে শান্ত ও অহিংস থাকার পরামর্শ দেন।’৭২

রাজধানী শিলং-এ পাহাড়ি জনগোষ্ঠী এবং বাঙালিদের সম্মিলিত প্রয়াসে একের পর এক সভা, মিছিল, হরতালের মধ্য দিয়ে আসাম সরকারের স্বৈরাচারী পদক্ষেপের কঠোর প্রতিবাদ জ্ঞাপনকে কোনোভাবেই ছোটো করে দেখার সুযোগ নেই।

সুতরাং এই ভাষা আন্দোলন কেবল ‘বরাকভ্যালি’র মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল কিংবা কেবল বরাকবাসীর আন্দোলন— এমনটা বলার সুযোগও নেই।

‘২৯ মে, আজ শোক দিবস। শহিদ দিবসও। ‘মাতৃভাষার দাবিতে ১১ জন শহিদের স্মৃতি দিবস। সমগ্র কাছাড় জেলা এ দিন সর্বাত্মক হরতাল পালন করে। জেলার হিন্দু ও মুসলমান, বাঙালি ও অবাঙালি এতে যোগ দেয়।’ সংবাদদাতা জানান : ‘শহরে, গ্রামে, জনপদে জনপদে হরতালের এমন ব্যাপকতা আর দেখি নাই। শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, পাথারকান্দি, বদরপুর, লক্ষ্মীপুর, কাটিগড়া ইত্যাদি অঞ্চল ঘুরে দাবির তীব্রতা এবং জনসাধারণের অনমনীয় দৃঢ়তা দেখে বিস্মিত হয়েছি। কোথাও তেমন কোনো হাঙ্গামা হয়নি।

ভোর চারটা থেকে দুপুর দু’টা পর্যন্ত ছিল হরতাল। সমগ্র জেলা ওই ১০ ঘণ্টার জন্য একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে যায়। কোনো অফিস, আদালত খোলে নাই, ট্রেন চলে নাই। বিমান নামে নাই। বাস চলে নাই এবং দোকানপাট, বাজারহাট খোলে নাই। সকলের মুখে সমবেত কণ্ঠে শোনা যায় একটিমাত্র কথা— ‘জান দিব, জবান দিব না।’’ শহরের সব বাড়ি খালি। গ্রামের সব বাড়ি খালি। রাতে সকলে ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখেন। চারটা বাজতে না বাজতে বাড়ি খালি করে সকলে পথে বের হয়ে পড়েন। তবে স্কুলের ছেলে-মেয়েদের আধিপত্য বেশি। পিকেটিং করতে কেউ যান অফিসে, কেউ যান বাসস্ট্যাণ্ড, কেউ রেলস্টেশনে।

জেলা কতৃপক্ষ আজ থেকে ১৪৪ ধারা তুলে দিয়েছেন। ভোরবেলা রাতের অন্ধকার মিলাতে না মিলাতে যখন বের হলাম, দেখতে পাই, শিলচর শহরটা যেন পরিত্যক্ত, শুধু ভিড় অফিস আদালতে।

সবচেয়ে বেশি ভিড় শিলচর স্টেশনে। প্রায় দু’হাজার ছেলে-মেয়ে কালো পতাকা হাতে নিয়ে রেল লাইনের ওপর পিকেটিং চালায়। কোনো রেলগাড়ি বেলা দু’টো পর্যন্ত জেলার কোথাও চলতে পারেনি। পাকিস্তান থেকে আগত গাড়ি লাতু স্টেশনে আটক থাকে এবং ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার গাড়িকে বিহারা স্টেশনে থামিয়ে দেওয়া হয়। সর্বত্র কড়া পুলিশ পাহারা ছিল।

শিলচর রেলস্টেশন এক তীর্থস্থানে পরিণত হয়। এখানে ১৯ মে গুলি চলে। ১১ জন শহিদ হয়। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সেখানে হাজার হাজার লোক যায় আর আসে। অনেকে আশঙ্কা করেছিল, না জানি আবার কিছু এখানে ঘটে। কিন্তু এখানে কেন, কোথাও কিছু ঘটেনি। মৃত্যুর মুখে নিজেকে সমর্পণ করতে ছোটো ছোটো বালক-বালিকা রেললাইনের ওপর বসেছিল। কিন্তু সরকার নীরব থাকায় তারা হতাশ হয়ে বাড়ি ফেরে।

শিলচর শহর থেকে ১৫ মাইল দূরে কুম্ভীরগ্রাম বিমানঘাঁটিতে রানওয়ের ওপর অনেক সত্যাগ্রহী এ দিন শুয়ে পড়ে। তাই কোনো বিমান নামতে পারেনি। টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, বিমান, জীবনবিমা অফিসের সম্মুখে এবং রাজ্য সরকারি অফিসের সম্মুখে সত্যাগ্রহ হয়। এক সরকারি বিবরণে বলা হয়, করিমগঞ্জ মহকুমার আনীপুর— দুর্লভছড়া লাইনে কারা যেন কয়েকগজ রেললাইন তুলে নেয়। কোনো শহরেই যানবাহন ছিল না। শুধু কালো ব্যাজ পরে লোকেরা ঘুরে বেড়ায় এবং মাঝে মাঝে ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি দেয়। ছোটো ছোটো ছেলেরা মিছিল নিয়ে বের হয়। গণ-সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সত্যাগ্রহীদের ট্রাকে করে শরবৎ ও ফলমূল বিতরণ করা হয়। গ্রামাঞ্চল থেকে বহু মিছিল আসে। শ্রীগৌরী গ্রাম থেকে এক বিরাট মিছিল মহাকাল, মালুয়া ইত্যাদি গ্রাম ঘুরে আসে।’

‘আজ অরন্ধন। জেলার কোনো বাড়িতেই আজ দুপুরে রান্নাবান্না হয়নি। বাড়ির মেয়েরা রান্নাঘর ছেড়ে অবাধে সত্যাগ্রহ করতে বের হয়। গতকাল বিকাল থেকে শহরের সকল চিড়ামুড়ির দোকানে লম্বা লম্বা লাইন পড়ে। আজ সকালে তাই সবাই খেয়েছে। শিলচরের নাজিরপট্টিতে এক অসুস্থ বালক সত্যাগ্রহে বের হতে না পেরে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। শিলচর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত সত্যাগ্রহীরা আজ বের হতে না পেরে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে থাকে। শহিদের আত্মীয়স্বজনরাও আজ পথে নামে। তাঁরা আন্দোলন সফল করার জন্য নতুন করে শপথ গ্রহণ করেন। শোচৌর গ্রামের সর্বত্র শহিদ বেদি নির্মাণ করা হয়। শিলচরের তুলাপট্টির এক শহিদ বেদি ছেলেরা কয়েক ঘণ্টা নীরবে ধরে থাকে। অনেক জায়গায় টেলিগ্রাফের খুঁটিকে শহিদ বেদিতে রূপান্তরিত করা হয়। ….জেলার শাসনভার যেন গণ-পরিষদের হাতে গিয়ে পড়ে। তারা পাস না দিলে কোনো কাজ চলছে না। হরতাল ও অরন্ধনের পর স্থানে স্থানে বড়ো মিছিল বের হয়। শিলচরের গান্ধীবাগে প্রায় ১০ হাজার লোকের এক জনসমাবেশ হয়। জেলার অন্যান্য জায়গায় শহিদদের আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করা হয়। গীতা, কোরান ও বাইবেল পাঠ করা হয়। এগারোজন শহিদের আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করা হয়। জেলার অন্যান্য জায়গায় শহিদদের চিতাভস্ম শোভাযাত্রা সহকারে মধুরামুখ নদীতে বিসর্জন দেওয়া হয়। জনতা বন্দেমাতরম ধ্বনি দিতে দিতে অগ্রসর হয়। এগারোজন শহিদের স্মৃতিতে এগারোটি প্রদীপ জ্বালানো হয় এবং রাত আটটায় গান্ধীবাগ থেকে একটি নগর সংকীর্তন বের করা হয়। গির্জা ও মসজিদে বিশেষ প্রার্থনা করা হয়। করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতেও অনুষ্ঠান হয়।’৭৩

এ দিন শিলচর সন্ধ্যায় শহিদদের উদ্দেশে দীপশিখার প্রণতি জানাল। ‘তোমাদের ভুলিনি আমরা—তাই তো প্রতি সন্ধ্যায় তোমাদের কথা মনে করে এই দীপ শিখার প্রণতি রেখে যাচ্ছি’— ‘এগারোটি জীবনের উদ্দেশে আজ সন্ধ্যায় এখানকার প্রতি গৃহে ও প্রতিটি বিপণিতে এগারোটি করে দীপ-শিখা কেঁপে ওঠে। মৃত্যুর পরপারে যাঁরা চলে গেছেন, সেই ১১ জন শহিদের কথা স্মরণ করে এখানে আলোকসজ্জার আয়োজন করা হয়।

জানা গেছে, এখানে মোট এক লক্ষ মোমবাতি বিক্রি হয়েছে, শেষ পর্যন্ত দোকানে আর মোমবাতি না পাওয়ায় অনেকে মাটির প্রদীপ জ্বেলেছেন। শোকম্লান শহর সন্ধ্যায় দীপালোকে যেন স্নান করে উঠল।’

‘হরতাল শেষ হওয়ার পর ৩০ হাজার নরনারীর এক নীরব শোভাযাত্রা বরাক ও মধুরা নদীর মিলন স্থলে গমন করে এবং সেখানে একাদশ শহিদের চিতাভস্ম বিসর্জন দেওয়া হয়। বহু গ্রামবাসী বহু পথ হেঁটে এসে শোক শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন।’৭৪

এ দিন করিমগঞ্জেও শহিদ দিবস পালিত হয়। ‘বদরপুর, রামকৃষ্ণনগর, নীলামগঞ্জ, পাথারকান্দি, দুর্ল্লভছড়া, লাতু, ভগবানবাজার— এই মহকুমার প্রায় সকল গ্রামে শ্রাদ্ধ দিবস অনুষ্ঠিত হয়। এখানে আজ সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। কলকলিঘাট, বদরপুর, দুর্ল্লভছড়া ও করিমগঞ্জ থেকে কোনো ট্রেন ছাড়েনি। রেলওয়ে অফিসারগণ বদরপুরে রেলওয়ের উপমন্ত্রী শাহনেওয়াজ খানকে এ সম্পর্কে জানালে তিনি বলেন, আপনারা মানুষের দেহের ওপর দিয়ে ট্রেন চালাতে পারেন না।’

এ দিন করিমগঞ্জে ‘কুশিয়ারা নদীর জলে শিলচরে গুলীবর্ষণের একাদশ শহিদের চিতভস্ম বিসর্জন দেওয়া হয়। নদীর উভয়তীরে দাঁড়িয়ে সব সম্প্রদায়ের বহুসংখ্যক লোক এই বিসর্জন দৃশ্য দেখেন। কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে এই বিসর্জন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়।

বাঁশ ও কাঠ দিয়ে প্রস্তুত একটি ভেলার ওপর একাদশ শহিদের ভস্মাধার রেখে তা নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। ভস্মাধারের ওপর লিখে দেওয়া হল— ‘জান দিব, জবান দিব না।’ ভস্মাধারের নীচে এক আবেদন লিখে তাতে নদীর উভয় তীরবর্তী জনগণকে এই অনুরোধ জানানো হয় যে, শহিদগণের আত্মার শান্তির জন্য এই ভেলা যাতে সমুদ্রে গিয়ে পড়তে পারে, তার জন্য তাঁরা যেন এটি চালিয়ে দেন। এই নদীর অপর পারে পূর্ব পাকিস্তান।’৭৫

অপরদিকে করিমগঞ্জ থেকে প্রকাশিত যুগশক্তি পত্রিকার ২ জুন, ১৯৬১ সংখ্যায় এ দিনের অর্থাৎ ২৯মে-র ঘটনা সম্পর্কে বলা হয়: শিলচর মহকুমা গণ-সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ২৯ মে সোমবার ভাবগম্ভীর পরিবেশের মধ্যে শোকদিবস পালন করা হয়। ভোর চারটে থেকে বেলা দুটো পর্যন্ত সর্বাত্মক হরতাল অভূতপূর্ব সাফল্যের সঙ্গে প্রতিপালিত হয়। দ্বিপ্রহরে অরন্ধনের আহ্বান গৃহে গৃহে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা হয়। বহু বাড়িতে ছোটো ছোটো শিশুরাও অন্নগ্রহণ করতে অস্বীকৃত হয়। বেলা আড়াইটায় গান্ধীবাগের বিরাট জনসমাবেশে পন্ডিত শ্রীবলেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় পাঠ করেন এবং বাইবেলের অংশ পাঠ করেন শ্রীসুরেশচন্দ্র নন্দী। শহিদদের আত্মার শান্তির জন্য দু’মিনিট কাল নীরব প্রার্থনার পর পবিত্র চিতাভস্মসহ বিরাট মৌন শোভাযাত্রা মধুরামুখ ঘাটের দিকে রওনা হয়।

ভোর চারটে থেকেই সংগ্রাম পরিষদের স্বেচ্ছাসেবকগণ দলে দলে রাস্তায় বের হয়ে পড়েন। স্টেট ট্রান্সপোর্ট, প্রাইভেট বাস সার্ভিস, রিকশা ট্যাক্সি ইত্যাদি কর্মবিরত ছিল। এয়ার লাইনস করপোরেশনে বিমানবন্দরের চতুর্দিক ঘিরে সত্যাগ্রহীগণ পিকেটিং করতে থাকায় কর্মচারীগণের পক্ষে সিগন্যাল টাওয়ারে ওঠাই সম্ভব হয়নি। অনেক কষ্টে আগরতলার সঙ্গে টেলিফোন সংযোগ স্থাপন করে কোনো বিমান যাতে কুম্ভীরগ্রাম বিমানবন্দরের উদ্দেশে না আসে তার নির্দেশ দেওয়া হয়। এর ফলে সোমবার দিন কলকাতার কোনো যাত্রী আসেন নি। সংবাদপত্র কিংবা ডাক কিছুই শিলচরে আসতে পারেনি।

ভোর চারটে থেকেই প্রায় দুশো স্বেচ্ছাসেবক শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে লাইনের ওপর বসে পড়েন। মিলিটারি এবং পুলিশি ব্যবস্থা যথেষ্ট ছিল। এ দিন কোনো রেলগাড়ি চালাবার চেষ্টা করা হয়নি। বেলা দুটোয় সত্যাগ্রহের অবসান ঘোষণা করে সত্যাগ্রহীগণ স্থান ত্যাগ করেন। যাওয়ার পূর্বে তাঁরা রেলস্টেশনে উপস্থিত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী, পুলিশ এবং সামরিক বিভাগের লোকদের প্রত্যেকের হাতে রাখী বেঁধে দেন।

বেলা আড়াইটেয় প্রায় ত্রিশ হাজার লোকের সমাবেশে গীতাপাঠ, বাইবেল পাঠ ও নীরব প্রার্থনার পর সুসজ্জিত জিপ কারে পবিত্র চিতাভস্ম স্থাপন করে গান্ধীবাগ থেকে দীর্ঘ মৌন শোকযাত্রা মধুরামুখের দিকে রওনা হয়। শ্রী মহীতোষ পুরকায়স্থ শোকযাত্রার নেতৃত্ব করেন। শিলংপট্টি, জেলরোড, প্রেমতলা, সেন্ট্রাল রোড, দেওয়ানজী বাজার, জানিগঞ্জ, তুলাপট্টী, ক্লাব রোড, ইটখলার রাস্তা ধরে সুশৃঙ্খলভাবে অগ্রসর হয়ে শোভাযাত্রা মধুরামুখে পৌঁছে এবং সেখানে চিতাভস্ম বরাকের জলে বিসর্জন দেওয়া হয়। গ্রামাঞ্চল থেকে দলে দলে লোক শোভাযাত্রা করে শহরে এসে শোকযাত্রার অনুগমন করেন।

পৌর প্রধান শ্রীমহীতোষ পুরকায়স্থের সভাপতিত্বে অপরাহ্ন পাঁচটায় গান্ধীবাগে বিশহাজার নরনারীর এক বিরাট সভা অনুষ্ঠিত হয়। ‘মোদের গরব মোদের আশা-আ-মরি বাংলা ভাষা’ উদবোধন সংগীতের পর সংগ্রাম পরিষদের ছাত্রকর্মী শ্রীবিজন শঙ্কর রায় বলেন, শহিদগণের প্রত্যেকটি রক্তের ফোঁটার মূল্য আদায় করে নিতে হবে, কমলার রক্তের মূল্য চাই। আসাম সরকারের শত অত্যাচার সত্ত্বেও আমরা আমাদের আদর্শে অটুট থাকব। শিলচর সংগ্রাম পরিষদের ডিক্টেটর শ্রীপরিতোষ পাল চৌধুরী বলেন, পরিপূর্ণ দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলতে থাকবে। তিনি ঘোষণা করেন যে, ৩০ মে মঙ্গলবার থেকে আপাতত কয়েকদিন পিকেটিং বন্ধ থাকবে। কাছাড় কংগ্রেস প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনা ক্রমে পরবর্তী কার্যক্রম স্থির করে যথাসময়ে তা ঘোষণা করা হবে। শ্রীমতী গায়ত্রী বিশ্বাস ও মণীন্দ্র রায়ের বক্তৃতার পর কমিউনিস্ট এম পি শ্রীযুক্তা রেণু চক্রবর্তী এক উদ্দীপনাময়ী ভাষণ দানের মধ্যদিয়ে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন।

তিনি আরও বলেন যে, শিলচরে যেভাবে নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড অনুষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীনতালাভের পর এ পর্যন্ত আর কোথাও সেরূপ হয়নি। সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের পূর্ণ সমর্থনের কথা ঘোষণা করে তিনি কাছাড়বাসীর কাছে এই আন্দোলনকে আরও জোরদার করে তুলবার আবেদন করেন। সংগ্রাম পরিষদের কর্মী শ্রীঅহীন্দ্র চক্রবর্তী শহিদগণের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করে কাছাড়ের সকল অধিবাসীকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলবার আহ্বান জানান।

পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট এম পি মহম্মদ ইলিয়াস পশ্চিমবঙ্গের সাড়ে তিন কোটি বাঙালি অবাঙালির পক্ষ থেকে একাদশ শহিদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। মহম্মদ ইলিয়াস বলেন, কুচক্রী আসাম সরকার টাকা দিয়ে দালালদের বশীভূত করে কাছাড়ে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির প্রয়াস করছেন। কাছাড়ের মুসলমান সমাজ বাংলাভাষাকে নিজ মাতৃভাষা জেনে এই সংগ্রামে পরিপূর্ণ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। দালালদের কার্যকলাপ ধরা পড়ে যাচ্ছে। কুচক্রীদের সমস্ত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে কাছাড়ের হিন্দু, মুসলমান, মণিপুরি, বাঙালি, হিন্দুস্থানি সকল সম্প্রদায় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সাহায্যে বাংলাভাষার দাবি আদায় করে নেবেন। এভাবে আন্দোলনের ফলে সারা ভারতে কাছাড়ের মর্যাদা হিমালয়ের সমান উঁচু হয়ে উঠেছে।

সভাপতির ভাষণে শ্রীমহীতোষ পুরকায়স্থ বলেন, ‘শিলচরের গুলিবর্ষণ পূর্ব পরিকল্পিত। পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীগণ বিদ্রোহী হয়ে উঠেছেন, তাঁদের সাবধান করে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই কাছাড়ে এই চরম অত্যাচার অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু কাছাড়ের আন্দোলন সরকারের এই রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেছে। ১৪৪ ধারা উঠিয়ে নিতে বাধ্য করা হয়েছে। সরকার নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। এখন পিছনদিক থেকে ছোরা মারার যে ষড়যন্ত্র চলছে—তাকে ব্যর্থ করতে হবে।’

করিমগঞ্জের শোক দিবস পালন সংবাদও একই পত্রিকায় একই তারিখে প্রকাশিত হয়। যুগশক্তি জানাল:

‘২৯ মে সোমবার করিমগঞ্জে শান্ত ভাবগম্ভীর পরিবেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় শহিদ দিবস প্রতিপালিত হয়। এ দিন কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের প্রত্যেকটি অফিসে বেলা দুটো পর্যন্ত সত্যাগ্রহীরা পিকেটিং করে। ওই সময়ের মধ্যে কোনো রিকশা, সাইকেল বা অন্যান্য কোনো যানবাহন দেখা যায়নি। বেলা দুটো পর্যন্ত কোনো দোকানপাট খোলেনি। কেবল মিলিটারি ও পুলিশের গাড়িগুলি রাস্তায় রাস্তায় টহল দিতে থাকে। টাউন ব্যাঙ্কে সুদৃশ্য বেদী নির্মাণ করে তাতে এগারোজন শহিদের নাম লেখা ফেস্টুন টাঙিয়ে দেওয়া হয়। বেলা দু’টোয় শহিদ বেদিতে পুষ্প, মাল্য দ্বারা অনেকে অর্ঘ্য দান করেন। বেলা ২-৩৫ মিনিটে শিলচরে পুলিশের প্রথম গুলিতে প্রথম শহিদ কমলা ভট্টাচার্যের বক্ষ ভেদ করে। তাই ২-৩৫ মিনিটের সময় দু’মিনিট দশ হাজার মানুষ নীরবতা পালন করেন। ২-৪০ মিনিট থেকে ৪টা পর্যন্ত গীতা, কোরান, বাইবেল প্রভৃতি পবিত্র গ্রন্থ থেকে পাঠ করা হয়।

বিকালে শ্রীরণেন্দ্রমোহন দাসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় দশহাজারেরও অধিক নরনারী শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সংগ্রাম পরিষদ সভাপতি শ্রীব্যোমকেশ দাস, রেভা. ডি. কে. বাদশা, শ্রী ননীগোপাল স্বামী, শ্রীমুনীন্দ্রকুমার দাস, শ্রীভ্রমরলাল বক্সী, জনাব আবদুল হামিদ চৌধুরী, শ্রীঅরবিন্দ চৌধুরী, শ্রীনৃপতি চৌধুরী, ডা: নীরোদভূষণ দে, শ্রী সতু রায়, শ্রীবিলঙ্গময়ী কর ভাষণ দান প্রসঙ্গে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং শহিদদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ভাষা আন্দোলনকে সার্থক করে তোলার আহ্বান জানান। সভাপতির ভাষণের পর সভার কাজ সমাপ্ত হয়।

সন্ধ্যায় শহরের প্রতিটি গৃহে ও দোকানে একাদশ শহিদের স্মৃতিতে একাদশটি প্রদীপ প্রজ্বলিত করা হয়। বিকাল চারটায় দরিদ্র নারায়ণকে চাল বিতরণ করা হয়।

রাত ৯-৩০টায় কালীবাড়ি থেকে চিতাভস্ম নিয়ে এসে নদীর জলে এক ধ্যানগম্ভীর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিসর্জন দেওয়া হয়। এ সময় হাজার হাজার নরনারী নদীর উভয় তীর থেকে এই পূত অনুষ্ঠানটি দর্শন করেন। এক বিরাট সুসজ্জিত ভেলা তৈরি করে তাতে একাদশ শহিদের নাম লিখে নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। ভেলায় ১১টি প্রদীপও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।

শহরের প্রতি গৃহে এ দিন অরন্ধন ব্রত পালন করা হয়। বদরপুর, পাথারকান্দি, শিলচর, হাইলাকান্দি, দুর্লভছড়া প্রভৃতি স্টেশনে জোরদার পিকেটিং-এর ফলে কোনো স্থানেই রেলগাড়ি চালানো সম্ভব হয়নি। করিমগঞ্জেও বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দের পরিচালনায় স্টেশনে জোর পিকেটিং চালানোর ফলে ট্রেন ছাড়েনি।’

হাইলাকান্দিতেও যথাযোগ্য মর্যাদায় শোকদিবস পালিত হয়। ২ জুন ১৯৬১ তারিখের যুগশক্তি পত্রিকাতে বলা হল: ‘২৯ মে হাইলাকান্দিতে মফস্বলের এবং শহরের বিশ সহস্র নরনারী শিলচরের ভাষা আন্দোলনের শহিদদের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ইতিপূর্বে একটি রৌপ্য আধারে করে একাদশ শহিদের চিতাভস্ম যথোপযুক্ত মর্যাদার সঙ্গে নিয়ে আসা হয় এবং টাউন হলের সম্মুখে নির্মিত শহিদ বেদীমূলে তা রক্ষিত হয়। বহু প্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালী ব্যক্তির পক্ষ থেকে উক্ত বেদীকে পুষ্পশোভিত করা হয়।

পুষ্পাঞ্জলি প্রদানের পর দুই মাইল দীর্ঘ একটি শোভাযাত্রা ‘বন্দেমাতরম’, ‘বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ’ ইত্যাদি ধ্বনি সহকারে চিতাভস্মসহ শহর প্রদক্ষিণ করে এবং পরে ধলেশ্বরী নদীতে পূত পরিবেশে চিতাভস্ম বিসর্জন দেওয়া হয়। সংগ্রাম পরিষদ শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনার্থে ঘোষিত শোক-দিবস হাইলাকান্দিতে শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হয়। এ দিন পূর্ণ হরতালও পালন করা হয়। অতিপ্রত্যুষেই রেলওয়ে স্টেশনে, পোস্ট অফিস, টেলিগ্রাফ, টেলিফোন অফিসে পিকেটিং করার ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কোনো ট্রেন, স্টেটবাস কিংবা প্রাইভেট বাস এ দিন চলাচল করতে পারেনি। রাস্তাঘাটে কোনো প্রাইভেট কার কিংবা রিকশা দেখা যায়নি। দোকান, বাজার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সমস্ত দিন বন্ধ ছিল। সত্যাগ্রহীদের পিকেটিং-এর ফলে স্টেট ব্যাঙ্ক ও কোর্টসহ কোনো সরকারি ভবনেরই দ্বার খোলেনি। কার্যত সরকারি ব্যবস্থা-ই অচল হয়ে পড়ে এ দিন।

জনসাধারণ এ দিন সম্পূর্ণ অরন্ধন পালন করেন এবং সন্ধ্যায় একাদশ শহিদের স্মৃতিতে একাদশটি প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করা হয়। কালীবাড়িতে গীতা পাঠ করা হয় এবং সংকীর্তনের কতকগুলি দল শহর প্রদক্ষিণ করে।

লালাবাজার, কাটাখাল ও কাটলীছড়ায় শান্তিপূর্ণ সর্বাত্মক হরতাল পালন করা হয়।’

এদিকে ২৯ মে নগাঁও জেলার প্রধানত বাংলা ভাষাভাষী অধ্যুষিত লামডিং জংশনে প্রবল উত্তেজনা বিরাজ করে। এ কারণে রাতে এখানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। উত্তেজনার কারণ সম্পর্কে সরকারিভাবে কিছু বলা না হলেও শিলচরে গুলিবর্ষণে একাদশ শহিদের চিতাভস্ম এখানে নিয়ে আসা এবং শহিদ স্মরণে একটি স্মৃতি-স্তম্ভ নির্মাণে উদ্যোগ গ্রহণকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় বলে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়।

হাইলাকান্দি স্টেশনের অনতিদূরে রেললাইনের ক্ষতিসাধনের কথা জানা গেল। সরকারি ভাবে বলা হল, ‘কাছাড় জেলার হাইলাকান্দি রেলওয়ে স্টেশনের নিকটবর্তী বিভিন্ন স্থানে প্রায় একশো ত্রিশফুট দীর্ঘ রেললাইনের ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। এ সম্পর্কে দশজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। টেলিফোন কর্মীগণকে তাঁদের কর্তব্য পালনে বাধা দেওয়ার অভিযোগে এই এলাকায় আরও আটজনকে গ্রেফতার করা হয়।’৭৬

২৯ মে নিখিল আসাম বঙ্গ ভাষাভাষী সমিতি এক বিবৃতিতে কাছাড়ের ভাষা আন্দোলনকে সমগ্র আসামে প্রসারের আহ্বান জানান। শিলং-এ দুদিন ব্যাপী সমিতির ওয়ার্কিং কমিটির অধিবেশন গতকাল শেষ হয়। বলা হয়, ‘বাংলাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসাবে ঘোষণার দাবিতে কাছাড়ে যে শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন আরম্ভ হয়েছে, তা আসামের অন্যত্র সম্প্রসারিত করার জন্য জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায় ও মতবাদ নির্বিশেষে সকলকে বিশেষভাবে আসামের বঙ্গভাষীদের আহ্বান জানানো হয়। কমিটি আগামী ৪ জুন বাংলাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে নিখিল আসাম দাবি দিবসরূপে পালনের জন্য আবেদন করে। এ দিন কালো পতাকা তুলতে হবে, কালো ব্যাজ ধারণ করতে হবে, শোভাযাত্রা বের করতে হবে এবং সভার আয়োজন করে প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতে হবে।’৭৭

আসাম সরকারের নিরাপত্তাবাহিনী গত ১৯মে শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহী অবস্থানে বিনা প্ররোচনায় বেপরোয়া গুলি চালিয়ে একজন নারীসহ এগারোজনকে হত্যা করে। এই হত্যার প্রতিবাদে আসামসহ সমগ্র ভারতজুড়ে নিন্দার ঝড় ওঠে। ফলে, সরকার জনমতের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি মেনে নেন। এ দিন শ্রীগোপালজী মেহরোত্রাকে নিয়ে ইতিমধ্যে গঠিত এক সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিশনের বিচার্য বিষয় সম্বলিত ঘোষণা প্রচার করা হয়। কমিশন তদন্ত করবেন:

১. ‘সংগ্রাম পরিষদের ভাষা-আন্দোলন শুরু হবার পর কাছাড়ে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয় এবং যার ফলে ১৯মে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে; ২. ১৯ মে কাছাড় জেলার করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি প্রভৃতি স্থানে, বিশেষ করে শিলচর ও তার পার্শ্ববর্তী স্থানে কি পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল; ৩. শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য স্থানীয় কতৃপক্ষ যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল কি না; ৪. কি পরিস্থিতিতে পুলিশ গুলীবষর্ণ করে; ৫. পুলিশের গুলীবর্ষণ ও তার মাত্রা ন্যায়সংগত ছিল কিনা; এবং ৬. কমিশনের কাজে প্রয়োজনীয় সংশ্লিষ্ট অন্য কোনো অবস্থার তদন্ত। আসাম সরকার আরও জানান যে, ১৯৫২ সালের তদন্ত কমিশন বিলের ৫ ধারা থেকে ৫ উপধারাও প্রযোজ্য হবে।’৭৮

ভাষা আন্দোলন বানচাল করার লক্ষ্যে কাছাড়ে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা বাঁধিয়ে দেবার হীন চক্রান্তের সংবাদ পাওয়া গেল ৩০মে। সংবাদে বলা হল: ‘কাছাড়ের ঐক্যবদ্ধ ভাষা আন্দোলন বানচাল করার জন্য ইদানীং কয়েকজন সরকারি কর্মচারী অত্যন্ত তৎপর হয়ে উঠেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগে প্রকাশ, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে লক্ষাধিক টাকা এই অঞ্চলে এসেছে এবং অসমিয়া ভাষা সংক্রান্ত কোনো একটি ‘সাহিত্য সভা’ ও অন্যান্য ব্যক্তি মারফত অকাতরে বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

গতকাল অর্থাৎ ২৯ মে শিলচর সার্কিট হাউসে জেলা কতৃপক্ষ স্থানীয় নেতৃবর্গের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। ওই বৈঠকে নেতৃবর্গ পরিষ্কার ভাষায় অভিযোগ করেন যে, সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা সৃষ্টির জন্য উসকানি দিতে অজস্র টাকা ঢালা হচ্ছে। জনৈক কংগ্রেসি নেতা এ সম্পর্কে এক অসমিয়া অফিসারের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেন।’৭৯

ঐক্যবদ্ধ ভাষা আন্দোলনে উদবিগ্ন সরকার এবং তাঁদের অনুসারীবৃন্দ অর্থমন্ত্রী ফকরুদ্দীন আলি আহমদ প্রমুখ কয়েকজন অসমিয়া নেতা ‘পূর্ব থেকেই ‘গীত’ গেয়ে রাখেন যে, কাছাড়ের এই আন্দোলন সাম্প্রদায়িক বিভেদ ছড়াতে পারে এবং ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ক্ষতিকর অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে। তলে তলে ওইসব নেতারা ইন্ধনও জোগাতে থাকেন।’৮০

সংবাদে আরও বলা হয়, ‘…গ্রামাঞ্চলে তলে তলে অপপ্রচার করার চেষ্টা হচ্ছে যে, শহরের বাঙালী উদ্বাস্তুরা নিজেদের সুবিধার জন্য এবং মণিপুরীদের ওপর আধিপত্য বিস্তারের জন্য উদগ্রীব হয়েই আন্দোলন শুরু করেছেন।’

অভিযোগে আরও বলা হয়, ‘প্রথমে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা হয়। কিন্তু ভাষার দাবিতে মুসলমানরাও হিন্দুর সঙ্গে একজোট। …. মণিপুরীদের একাংশ ও চা-বাগানের শ্রমিকদের উসকিয়ে দেবার চেষ্টা হচ্ছে। এ কথাও প্রচার করা হচ্ছে যে, এই আন্দোলন ‘পূর্বাচলের’। এই আন্দোলন বারো বছর পূর্বের যে দাবির অস্তিত্ব এখন আর নেই।’

এরই মধ্যে এ বিষয়ে কয়েকটি সংবাদ পাওয়া যায়। শিলচর থেকে ‘১৫ মাইল দূরে লাবক চা-বাগানের তিন-চারজন ছাঁটাই ও বেকার কর্মচারীদের দিয়ে শ্লোগান দেবার ব্যবস্থা হয় যে, তারা ‘বাংলা ভাষা চায় না।’ গতকাল অর্থাৎ ২৯ মে শালচাপরা অঞ্চলে ১০/১২ জন মণিপুরীদের দিয়েও একই ধরনের চেষ্টা হয়। অথচ উভয় দলই শ্লোগান দেয় বাংলা ভাষাতেই।’

সংবাদে আরও বলা হয়, ‘জেলা কতৃপক্ষ ওই অকিঞ্চিৎকর দুটি ঘটনাকে ফাঁপিয়ে ফুলিয়ে বড়ো করার চেষ্টা করছেন এবং জেলায় যে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার উপক্রম হয়েছে, তা বোঝাবার চেষ্টা করছেন। কংগ্রেসি নেতারা জেলা কতৃপক্ষকে বলেন, জেলায় কোনো সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা নেই, তবে যদি কোথাও সামান্য একটু দেখা দেয়, তা হলে তজ্জন্য দায়ী সরকারই।

তাঁরা আরও বলেন, ‘নানাভাবে টাকা বিলির ব্যবস্থাও অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। তবে ‘টাকার খেলায়’ যে আন্দোলন থামানো যাবে না, তাও তাঁরা জানিয়ে দেন। কংগ্রেস এবং গণ-সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, আজ ৩০ মে থেকে ৬ জুন পর্যন্ত তাঁরা গ্রামে গ্রামে মুষ্টিমেয় বিভেদসৃষ্টিকারীদের সংযত করবেন এবং এই আন্দোলন যে পূর্ববঙ্গীয় উদ্বাস্তুদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য নয়—তাও পুনর্বার ঘরে ঘরে বলে দেওয়া হবে।’৮১

এ সব সংবাদে কেবল কাছাড় নয়—সমগ্র ভারতের শুভবোধসম্পন্ন মানুষই শঙ্কিত না হয়ে পারবেন না।

এদিকে শিলচরে প্রায় পঁচিশ হাজার মানুষের এক সভায় শিলচর মহকুমা সংগ্রাম পরিষদ ‘ডিক্টেটর শ্রী পরিতোষ পাল চৌধুরী বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন, ‘আসামের অন্যতম রাজ্য ভাষা হিসাবে বাংলার স্বীকৃতি আদায়ের জন্য পরিষদ যে আন্দোলন আরম্ভ করেছে, আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত তা চলতে থাকবে। ভাষা আন্দোলন স্থগিত রাখার জন্য দুর্গাপুর থেকে প্রধানমন্ত্রী শ্রীনেহরু যে আবেদন জানান তা তিনি অগ্রাহ্য করেন। তিনি বলেন, শ্রীনেহরু বহু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কিন্তু পরে তিনি তা পূরণ করেননি।

শ্রীচৌধুরী জানান, আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায় স্থির না হওয়া পর্যন্ত পরিষদ সরকারি অফিসসমূহে পিকেটিং বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত করেছেন। আত্মগোপন করার পর পরিষদ নেতা এই প্রথম জনসমক্ষে উপস্থিত হওয়ায় বিপুলভাবে সংবর্ধিত হন।’৮২

৩০ মে ‘সর্বোদয় নেতা আচার্য বিনোবাভাবে শিলচরে পুলিশের গুলীবর্ষণের নিন্দা করেন এবং একে একটি লজ্জাকর ব্যাপার বলে বর্ণনা করেন। আচার্য ভাবে আরও বলেন যে, সত্য ও ন্যায় বিচারের জন্য অহিংস ও শান্তিপূর্ণভাবে যেকোনো আন্দোলন চালান যায়। তিনি তার বিরোধী নন।’৮৩

১ জুন করিমগঞ্জ জেলা কংগ্রেস সভাপতি ও কাছাড় জেলা কংগ্রেস ভাষা-আন্দোলন কমিটি আহ্বায়ক দাঙ্গা শঙ্কায় উদবিগ্ন শ্রীরণেন্দ্রমোহন দাস শিলং-এ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আসামের মুখ্যমন্ত্রী এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডা: বি. সি. রায়, শ্রী ইউ. এন. ডেবর, কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সভাপতি ও নয়াদিল্লিতে প্রধামন্ত্রী শ্রীনেহরুর কাছে এক তারবার্তা প্রেরণ করেন। তারবার্তায় বলা হয়:

আমাদের দাবী বানচাল করার উদ্দেশ্যে কাছাড়ে এখন অসমিয়া প্রবর্তনের জোর চেষ্টা চলিতেছে। দাগী গুণ্ডাদের গোপনে টাকা দিয়া উসকানি দেওয়া হইতেছে এবং বিশেষ শ্রেণির অফিসার ও এজেন্টগণ তাহাদের প্ররোচিত করিতেছে। এইরূপ ষড়যন্ত্রের ফলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামার সৃষ্টি হইতে পারে এবং গত দুই দিনে ইতস্তত কয়েকটি ঘটনা ঘটিয়া গিয়াছে। এই ষড়যন্ত্র প্রতিরোধের জন্য অবিলম্বে ব্যবস্থা অবলম্বিত না হইলে অবস্থা গুরুতর আকার ধারণ করিতে পারে।৮৪

শ্রীদাস কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী শ্রীচালিহার কাছে প্রেরিত তারবার্তায় তাঁদের কাছাড়ে আসতে অনুরোধ জানান।

‘প্রায় ৪৮ ঘণ্টা ধরে খারাপ আবহাওয়া ও প্রবল বৃষ্টিপাত সত্ত্বেও কাছাড়ের শহর ও গ্রামাঞ্চলে সভা ও শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। একদল ব্যাণ্ডবাদক নিয়ে ‘‘বাংলা ভাষা আমাদের ভাষা’’ ধ্বনি করতে করতে আজ সকালে অর্থাৎ ১ জুন এক শোভাযাত্রা বৃষ্টির মধ্যে করিমগঞ্জের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে।’

আসামের ভাষা সমস্যা সমাধানে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীলালবাহাদুর শাস্ত্রী ১ জুন শিলং রাজভবনে আসামের কৃষিমন্ত্রী জনাব মইনুল হক চৌধুরীর সঙ্গে দু’দফা বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক শেষে জনাব হক চৌধুরী পি. টি. আই-কে বলেন, ‘তাঁরা কোনো সম্ভাব্য সমাধান সম্পর্কে আলোচনা করেননি। তাঁদের আলোচনা এখনও ওই পর্যায়ে পৌঁছায়নি।’

এর আগেই আসামের ‘ভূতপূর্ব মন্ত্রী শ্রীদেবেশ্বর শর্মা এ দিনই শ্রীলালবাহাদুর শাস্ত্রীর সঙ্গে একঘণ্টাব্যাপী আলোচনা করেন।’ গত দাঙ্গায়, বাঙালি উৎসাদনে, নির্যাতনে বহুল আলোচিত, বিতর্কিত নাম ছিল শ্রীদেবেশ্বর শর্মার। তাঁর সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একঘণ্টাকাল আলোচনায় জনমনে গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়।

এদিকে গতকাল রাতে অর্থাৎ ৩১মে নিখিল আসাম আন্তঃকলেজ ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি শ্রীদুলালচন্দ্র বড়ুয়ার নেতৃত্বে ছাত্রদের এক প্রতিনিধি শ্রীলালবাহাদুর শাস্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা ৪ জুন ‘নিখিল আসাম বঙ্গ ভাষাভাষী সমিতি’ আহূত আসাম দাবি দিবস’ যাতে পালন করতে না পারে তার জন্য দাবি দিবস পালন নিষিদ্ধ করার অনুরোধ জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর কাছে। ছাত্র প্রতিনিধি বলেন যে, এই আন্দোলনের ফলে গত বৎসরের ন্যায় এবারও গুরুতর অশান্তি ঘটবার সম্ভাবনা আছে।

ছাত্র প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রী শ্রীনেহরুর বারো মাস স্থিতাবস্থার প্রস্তাবকে নাকচ করে দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়— এর কোনো প্রয়োজন নেই। শ্রীশাস্ত্রী তাঁদের জানিয়ে দেন যে, ‘উভয়পক্ষ ব্যবস্থা অবলম্বন বন্ধ রাখলে পরিস্থিতির উত্তেজনা হ্রাস পাবে এবং এর ফলে অবস্থা ঠাণ্ডা হলে একটি সমাধান খুঁজে বের করা সম্ভবপর হবে।’

এ দিন সকালে রাজভবনে একদল মহিলা সম্মুখে বক্তৃতা প্রসঙ্গে শ্রীলালবাহাদুর শাস্ত্রী রাজনৈতিক নেতাদের দোষারোপ করে বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতৃবর্গ সাধারণ মানুষকে তাঁদের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের এবং অন্যান্য হাঙ্গামার শিকারে পরিণত করেছেন। …তিনি বলেন, ইচ্ছায় হোক, কিংবা অনিচ্ছায় হোক সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক নেতাদের খপ্পরে পড়ে আবহাওয়া বিষাক্ত করে তুলছে। ভাষা সমস্যা সম্পর্কে শ্রীশাস্ত্রী আসামের মন্ত্রীদের সঙ্গে দ্বিতীয়বার আলোচনা করেন। সভায় রাজ্যপাল শ্রীনাগেশ, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শ্রীসিদ্ধিনাথ শর্মাও উপস্থিত ছিলেন।

শ্রীশাস্ত্রী নিখিল আসাম বঙ্গ ভাষাভাষী সমিতির নেতাদের কাছাড়ের ভাষা আন্দোলনকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় সম্প্রসারণ বন্ধ করার পরামর্শ দেন। সমিতির নেতা শ্রীশান্তিরঞ্জন দাশগুপ্ত তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ কথা বলেন। শ্রীদাশগুপ্ত শ্রীশাস্ত্রীকে একটি স্মারকলিপি দেন।

এ দিন খাসি ও জয়ন্তিয়া পাহাড় জেলা পরিষদের চিফ একজিকিউটিভ মেম্বর শ্রী এ. কাজীও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। শ্রীশাস্ত্রী এ দিন ট্যালেন্টস ক্লাবে এক বক্তৃতা প্রসঙ্গে মহিলাদের রাজনীতি থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেন। শিলংয়ের মহিলাদের এই প্রতিষ্ঠানে মহিলাদের অধিক পরিমাণে সমাজসেবা কাজে আত্মনিয়োগ করা উচিত বলে শ্রীশাস্ত্রী মন্তব্য করেন।’৮৫

১জুন শিলচরের অনতিদূরে উদবাস্তু কলোনিতে তিনশো পূর্ব পাকিস্তানি চা শ্রমিকসহ সশস্ত্র দূর্বৃত্ত দলের হামলার সংবাদ পাওয়া যায়। সংবাদে বলা হয়, ‘চা-বাগানের বহু সংখ্যক পূর্ব পাকিস্তানি শ্রমিকসহ প্রায় তিন শত লোক ৩০ মে শিলচর থেকে ১৩ মাইল দূরবর্তী ডুবাবাদ উদবাস্তু কলোনিতে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হানা দেয়। তারা মহিলাদের নির্মমভাবে মারধোর করে গৃহের ক্ষতিসাধন ও টাকা-গহনা লুট করে নানাপ্রকার ধ্বনি দিতে দিতে অন্য গ্রামে প্রবেশ করে। এ সময় মিলিটারি ঘটনাস্থলে পৌঁছে দূর্বৃত্তদের বাধা দিলে তারা সরে পড়ে।

এদিকে অপর দুটি স্থানেও হাঙ্গামা হয়। এখান থেকে পাঁচ মাইল দূরে আরকুট্টিপুরে উদ্বাস্তুদের বহু গৃহ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে ত্রিশটি পরিবার নিরাশ্রয় হয়ে পড়ে।

এখান থেকে ন’মাইল দূরবর্তী সাচাপাড়া থেকেও হাঙ্গামার সংবাদ পাওয়া যায়। সেখানে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের লোকেরা অন্যান্য ব্যক্তিদের বাড়িঘর ছেড়ে চলে যাবার জন্য ভীতি প্রদর্শন করে। সেখানে দ্রুত মিলিটারি হাজির হলে ঘটনা আর বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি।’৮৬

উদবাস্তুদের ওপর নতুন করে এই হামলাকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করার কারণ বর্তমান। আমরা ইতিমধ্যে প্রত্যক্ষ করেছি যে, বাংলা ভাষা আন্দোলন নাকি পূর্ববঙ্গের উদবাস্তুদের আন্দোলন এবং সেই লক্ষ্যে অপপ্রচারের কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে ও তার ফলও গ্রামে গ্রামে ফলতে শুরু করেছে ‘বাংলা ভাষা চাই না, অসমিয়া ভাষা চাই’। আর এর পশ্চাৎভাগে যে রাজশক্তির আশীর্বাদ বর্তমান, তাও তো ক্রমশ স্পষ্ট হয়।

ভাষা আন্দোলন দমনে, বানচালে সরকারি ষড়যন্ত্র প্রকাশ্যে চলে আসে। ২ জুন শিলচর থেকে স্টাফ রিপোর্টার পাঠানো সংবাদে বলা হল: ‘সরকারি থানাগুলি এবং কয়েকজন অসমিয়া অফিসারের প্ররোচনায় ভাষা-আন্দোলনকে দমানোর জন্য কাছাড়ে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা সৃষ্টির অপচেষ্টা চলছে।

অভিযোগে প্রকাশ যে, অসমিয়া ভাষার জন্য কেউ হল্লাবাজি করলেও কিছু না করার জন্য কয়েকটি থানায় সম্প্রতি এক গোপন সার্কুলার পাঠানো হয়েছে। স্থানীয় অনেকে মনে করেন, শান্তিরক্ষার জন্য জেলার কয়েকজন সরকারি কর্মচারীকে অবিলম্বে বদলি করা দরকার।

জেলার বিশিষ্ট আঠাশজন মুসলমান নেতা গতকাল এক আবেদনে উসকানিদাতাদের বিরুদ্ধে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেন এবং বলেন,

আমরা মনে করি মাতৃভাষার দাবিতে আমাদের যে আন্দোলন তাহা সকল সম্প্রদায়ের ঐক্য ও সম্প্রীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। এই ঐক্য ও সম্প্রীতি যাহাতে ব্যর্থ না হয় সেজন্য আমাদের সদা সতর্ক ও জাগ্রত দৃষ্টি রাখিতে হইবে।

আবেদনে আরও বলা হয়:

আমরা মনে করি, আসাম ভাষা আইনে আসামের বিভিন্ন সংখ্যালঘুর ভাষার উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া হয় নাই। ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা গত ১৯ মে বাংলা ভাষার সমর্থনে যে অভূতপূর্ব গণজাগরণ এবং তজ্জনিত ১১টি প্রাণের আত্মাহুতি দেখিয়াছি তাহাতে আমাদের মন শ্রদ্ধায় অবনত হইয়াছে। মাতৃভাষার দাবিতে আমরা সবাই এক।

এই আবেদনে স্বাক্ষর করেন সর্বশ্রী এন আলি লস্কর, আর্জান আলি মজুমদার, গোলাম ওসমানি, আলতাফ হোসেন মজুমদার, কামরুল ইসলাম লস্কর, জি মিঞা চৌধুরী, নুরুল হক, এম আহমেদ লস্কর, লুৎফর রহমান এবং আরও কয়েকজন।৮৭

এদিকে ২ জুন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীলালবাহাদুর শাস্ত্রী ভাষা সমস্যা সমাধানে তৃতীয় দিনে কাছাড় জেলা কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী শ্রীবিমলাপ্রসাদ চালিহার শিলংস্থ বাসভবনে প্রায় একঘণ্টা কাল আলোচনা করেন। আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, নেতৃবৃন্দের মনোভাব ভালো এবং যুক্তিসংগত। আলোচনায় মুখ্যমন্ত্রীও অংশগ্রহণ করেন।

কাছাড়ের নয়জন কংগ্রেস নেতা আলোচনায় যোগদান করেন। এঁদের মধ্যে শ্রীমতী জ্যোৎস্না চন্দ, শ্রীনন্দকিশোর সিংহ, জনাব তোজাম্মল আলী বড়লস্কর এবং শ্রীনিবারণ চন্দ্র লস্করও ছিলেন। কাছাড় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার পর আসাম প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শ্রীসিদ্ধিনাথ শর্মা শ্রীশাস্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেন। রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী শ্রীকামাখ্যা প্রসাদ ত্রিপাঠীও আলোচনা কালে উপস্থিত ছিলেন।

সাংবাদিকরা শ্রীশাস্ত্রীকে প্রশ্ন করেন, কাছাড়ের নেতাদের মধ্যে কিছুটা নম্র মনোভাব বা অনুশোচনার ভাব লক্ষ করেছেন কি? শ্রীশাস্ত্রী বলেন, কাছাড়ের নেতৃবৃন্দের মনোভাব ভালো এবং যুক্তি সংগত।’

‘মুখ্যমন্ত্রী শ্রীচালিহা বলেন, কাছাড়ের নেতৃবৃন্দ কীরূপ পরিস্থিতির মধ্যে সংগ্রাম পরিষদকে সমর্থন করতে বাধ্য হয়েছেন তিনি তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন যে, জনমতের চাপে পড়ে তাঁরা আন্দোলনে যোগদান করতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁরা আরও বলেন, অবস্থা চরমে উঠেছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেই সমস্যা সমাধানের উপায় বের করতে হবে এবং তাঁরা তা বিবেচনা করবেন।’৮৮

কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক শ্রীঅজয় ঘোষ আসাম সফর শেষে ২ জুন কলকাতা পৌঁছান। দমদম বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, কাছাড়ে সাম্প্রতিক যে আন্দোলন চলছে তার গভীরতা ও তীব্রতার দিক থেকে সত্যিই ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। তিনি বলেন, আন্দোলন আর শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, এখন তা গ্রাম-গ্রামান্তরেও ছড়িয়ে পড়েছে।

শ্রীঘোষ কাছাড়ের শিলচরে গুলীবর্ষণের নিন্দা করে বলেন, গুলীবর্ষণ সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ছিল এবং গুলীবর্ষণের মতো কোনো পরিস্থিতিও ছিল না। শান্তিপূর্ণ জনসাধারণের ওপরে যেভাবে গুলী চালানো হয়েছে—তাতে মনে হয় যে, আসাম সরকার ইচ্ছাকৃত প্রতিশোধমূলক ভাবে জনসাধারণকে শিক্ষা দেবার মনোভাব নিয়েই এ কাজ করা হয়েছে।৮৯

‘কাছাড় জেলা কংগ্রেস ভাষা-আন্দোলন কমিটি, কাছাড়, গণ-সংগ্রাম পরিষদ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এক সভা করিমগঞ্জে ২ জুন অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আইন অমান্য আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে বিস্তৃত আলোচনার পর কাছাড়ে পরবর্তী পর্যায়ের কার্যসূচি স্থির করা হয়। ৬ জুন থেকে সপ্তাহকাল পর্যন্ত এই আন্দোলন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আইনসভা, সংসদ, পঞ্চায়েত এবং অন্যান্য সংস্থায় নির্বাচিত অথবা সরকার মনোনীত সদস্যগণ অবিলম্বে পদত্যাগ করবেন এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে অসহযোগ করবেন।

সমাজ বিরোধীদের সহায়তায় কোনো কোনো স্বার্থসংশ্লিষ্ট দল মিথ্যা প্রচার কাজ চালিয়ে গ্রামবাসীদের বিভ্রান্ত করে আন্দোলন নষ্ট করার চেষ্টা করছে। এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ করার জন্য সভা বিভিন্ন সংস্থার কর্মী ও নেতৃবৃন্দকে গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে তাঁদের দাবি পরিষ্কারভাবে গ্রামের মানুষদের বুঝিয়ে দিতে বলা হয়। সভায় ঘোষণা করা হয়, তাঁদের দাবি মাত্র একটি এবং তা হচ্ছে বাঙলাকে অসমিয়া ভাষার সঙ্গে আসামের দ্বিতীয় সরকারি ভাষারূপে স্বীকার করা। সভায় বলা হয় যে, কাছাড়কে আসাম থেকে পৃথক করার অথবা পূর্বাঞ্চল প্রদেশ গঠন অথবা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে কাছাড়কে যুক্ত করা সম্পর্কিত বিষয়ের সঙ্গে এই আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই।৯০

‘কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীলালবাহাদুর শাস্ত্রী ভারতীয় বিমান বাহিনীর এক বিশেষ বিমান যোগে গৌহাটি থেকে শিলচর পৌঁছান ৩ জুন। শিলচর থেকে ১৫ মাইল দূরবর্তী কুম্ভীরগ্রাম বিমানক্ষেত্রে এ দিন বিকাল ৩টায় পৌঁছান তিনি। তিন দিন ব্যাপী প্রবল বর্ষণের পর আজ ওই সময় আকাশ রৌদ্র ঝলমলে ছিল।

আসামের কৃষিমন্ত্রী জনাব মইনুল হক চৌধুরী এবং কাছাড় কংগ্রেস প্রতিনিধিবৃন্দও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে এখানে এসে পৌঁছান। শিলচর মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান শ্রীমহীতোষ পুরকায়স্থ এবং গণসংগ্রাম পরিষদের দু’জন সত্যাগ্রহী বিমান ক্ষেত্রে শ্রীশাস্ত্রীকে স্বাগত জানান। দু’জনের মধ্যে একজন সত্যাগ্রহী গত ১৯ মে পুলিশের লাঠি চালনার ফলে আহত হয়েছিলেন। তাঁর কপালে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা ছিল। এই সত্যাগ্রহীর কপালে ব্যাণ্ডেজ কেন শ্রীশাস্ত্রী তা জানতে চাইলে শ্রীপুরকায়স্থ বলেন: ‘ইহা অহিংস পুলিশ দলের অত্যাচারের চিহ্ন।’

শ্রীশাস্ত্রী বিমানক্ষেত্র থেকে মোটরগাড়ি যোগে শিলচর রওনা হন। ওই সময়ে বরাক নদীর তীরে প্রায় দু’হাজার নির্বাক নর-নারীর এক জনতা দাঁড়িয়ে ছিল। তারা কোনো ধ্বনি উচ্চারণ করেনি, কিন্তু তাদের হাতে যে পোস্টার ছিল তাতে লেখা ছিল যে,—‘পুলিশ কতৃক ধৃত ব্যক্তিদের মুক্তি চাই।’ জনতার মধ্যে সকলের দেহে-ই যে ব্যাজ ছিল— তাতে লেখা ছিল—‘ভাষা অথবা বুলেট’।

শ্রীশাস্ত্রী সদরঘাটে খেয়া নৌকায় নদী পার হন এবং রাস্তার উভয় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে প্রায় এক ফার্লং পথ হেঁটেই অতিক্রম করেন। এ সব লোকের হাতেও পোস্টার এবং শরীরে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা ছিল। এরপর শ্রীশাস্ত্রী মোটরগাড়ি যোগে সোজা সার্কিট হাউস গমন করেন।’

‘সার্কিট হাউসে উপনীত হবার পর পরই শ্রীশাস্ত্রী করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি এবং শিলচর— এই তিন জেলা কংগ্রেস কমিটির নেতৃবর্গের সঙ্গে সার্কিট হাউসে এক রুদ্ধদ্বারকক্ষে আলোচনা করেন। শ্রী শাস্ত্রী বলেন, তিনি খোলা মন নিয়েই এসেছেন। আলোচনাকালে কাছাড় নেতৃবৃন্দ সুস্পষ্ট ভাষায় এবং সমস্বরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে এই কথা বলেন যে, তাঁদের দাবি অতিশয় সুস্পষ্ট। বাংলাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষা বলে ঘোষণা করতে হবে এবং ভাষা আইনে অসমিয়া ভাষাকে যে মর্যাদাদান করা হয়েছে, বাঙলা ভাষাকেও সেই মর্যাদা দান করতে হবে— শুধু এইটুকুই তাঁদের দাবি।

অসমিয়াদের সাম্রাজ্যবাদী সুলভ মনোভাবের কথা উল্লেখ করে কাছাড়ের নেতৃবর্গ শ্রীশাস্ত্রীকে বলেন যে,

‘অসমিয়াদের জন্য অসমিয়া ভাষা’— এই ধুয়া তুলবার ফলে বৎসরের পর বৎসর সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। কেবল কাছাড় জেলা নয়— ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অন্যান্য জেলাতেও বাঙলা ভাষার প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ করা হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় লক্ষ লক্ষ বাঙালি পুরুষানুক্রমে বসবাস করে আসছেন।

এক বৎসরের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য শ্রীনেহরু যে প্রস্তাব করেছেন, শ্রীশাস্ত্রী সেই প্রস্তাবের উল্লেখ করলে কাছাড় নেতৃবর্গ তাঁকে বলেন যে, এই প্রস্তাব কখোনই সমস্যার সমাধান হবে না। সংবিধানের ৩৪৭ ধারা অনুসারে কেন্দ্রীয় সরকারকে অবশ্যই ভাষা সমস্যা সমাধানের জন্য হস্তক্ষেপ করতে হবে বলেও তাঁরা দাবী করেন।

সংবাদে বলা হয়, ‘শ্রীশাস্ত্রী ধীরভাবে একের পর একের বক্তব্য শুনে সহানুভূতি প্রকাশ করেন। … আলাপ-আলোচনা থেকে এ কথা জানতে পারা গেছে যে, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার নেতৃবর্গ বাঙলাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষা বলে মেনে নেবার প্রস্তাব আদৌ গ্রহণ করতে সম্মত নন। খুব বেশি হলে কাছাড়ের সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশে অসমিয়া নেতারা ভাষা আইন থেকে মহকুমা পরিষদ সংক্রান্ত ধারাটি বাদ দিতে পারেন।

জানা যায় যে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অসমিয়া নেতাদের কাছে এই প্রস্তাব করেছিলেন যে, তাঁরা যেন বাংলা ভাষাকে কাছাড়ের অন্যতম সরকারি ভাষা বলে নেন। তিনি সংখ্যালঘুদের জন্য কয়েকটি রক্ষা কবচের ব্যবস্থা করবারও প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু অসমিয়ারা বাঙালিদের ওপর প্রভুত্ব স্থাপন করতে পারে— এরূপ আশঙ্কা করে কাছাড়ের নেতৃবর্গও শ্রীশাস্ত্রীর এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে সম্মত হননি। তাঁরা শ্রী শাস্ত্রীকে জানান যে, ভাষা আইন বাতিল করা না হলে কিংবা আইনটিকে ঢেলে সাজানো না হলে জনসাধারণ কোনো আশ্বাসেই আশ্বস্ত হতে পারবে না।

আসামে বাঙালি ছেলেমেয়েদের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে শ্রীশাস্ত্রী কাছাড়ের নেতৃবর্গকে বলেন যে, গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সমস্ত স্তরে যাতে বাঙলাভাষা শিক্ষা দেওয়া হয় এবং বাঙলাভাষাকে শিক্ষার অন্যতম বাহন বলে গণ্য করা হয় কেন্দ্রীয় সরকার তার প্রতি লক্ষ রাখবেন। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙলাভাষা ও সাহিত্য পঠন-পাঠনের জন্য শীঘ্রই এম এ ক্লাস খোলা হবে বলেও শ্রীশাস্ত্রী জানান।’৯১

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির আসাম শাখা কর্মপরিষদের অধিবেশন গৌহাটিতে ৩১ মে ও ১ জুন অনুষ্ঠিত হয়। অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক শ্রীঅজয় ঘোষ। ‘কর্মপরিষদ দৃঢ়তার সঙ্গে তাঁদের পূর্ব গৃহীত সিদ্ধান্ত সমর্থন করে বলেন যে, অসমিয়া, বাংলা ও পাহাড়ি ভাষাভাষী আসাম রাজ্যে অসমিয়াকেই সরকারি ভাষা হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। কর্মপরিষদ তাঁদের সিদ্ধান্তে আরও বলেন যে, কাছাড়ে বাংলা ভাষা এবং পার্বত্য জেলাগুলিতে পাহাড়ি ভাষা সরকারি ভাষার মর্যাদা পাবে। এ ছাড়া বাংলা ভাষা ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভাষা বিশেষ বিশেষ সরকারি কাজে কোন কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হবে তা সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে স্থির করা হবে।৯২

এদিকে আসাম সরকারের অর্থমন্ত্রী জনাব ফকরুদ্দীন আলি আহমদ কলকাতা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ কালে বলেন যে, বাংলাভাষাকে রাজ্যের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসাবে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ কোনো জেলায় ব্যবহৃত ভাষাকে যদি রাজ্যের অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়— তাহলে অন্যরাও তাদের নিজ নিজ ভাষাকে রাজ্যের অন্যতম সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দাবি করবে।৯৩

শিলচর সার্কিট হাউসে ৪ জুন সকালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীলালবাহাদুর শাস্ত্রী ভাষা সমস্যা সমাধানে পুনরায় কাছাড় কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হন। আলোচনা চলে প্রায় তিন ঘণ্টা। কংগ্রেস নেতৃত্ব ‘বাংলা ভাষাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দানের দাবী পুনরায় উত্থাপন করেন। শ্রীশাস্ত্রী নাকি নেতৃবৃন্দকে জানান যে, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা এই দাবি কখনোই মেনে নেবে না।

অপরপক্ষে কাছাড় কংগ্রেস নেতৃত্ব সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন যে, বাঙলা ভাষাকে স্বীকৃতি দানের মূল দাবীতে তাঁরা অবিচলিত থাকবেন। আলোচনাকালে অবশ্য সমস্যা সমাধানকল্পে কয়েকটি বিকল্প প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। বিকল্প প্রস্তাবে বলা হয়, বাংলাভাষাকে জেলা পর্যায়ে স্বীকৃতি দিতে হবে। সরকারি দপ্তরের সঙ্গে কাছাড়ের সরকারি কাজকর্ম ইংরেজি ভাষায় হবে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় কোনো জেলায় শতকরা অন্তত ১৫ ভাগ অধিবাসী যদি দাবী করে তাহলে বাঙালি ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা বাঙলা ভাষার মাধ্যমে করতে হবে।

কিন্তু কাছাড় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ পুনরায় শ্রীশাস্ত্রীকে জানিয়ে দেন যে, তাঁরা মূল দাবী অর্থাৎ আসাম রাজ্য পর্যায়ে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি, সেখান থেকে সরছেন না।’৯৪

আজ বিকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীশাস্ত্রী গৌহাটির উদ্দেশে রওনা হন। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনাকে ‘নিরাশাজনক’ বলে মন্তব্য করেন। শ্রীশাস্ত্রী গণসংগ্রাম পরিষদের কোনো নেতার সঙ্গে কথা বলেননি। শিলচর থেকে গৌহাটি যাত্রার পূর্বে ৪ জুন এক বিবৃতিতে শ্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী বলেন, ‘আসাম সরকার ও আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আলোচনার জন্য তিনি গৌহাটি ও শিলং যাচ্ছেন।

তিনি বলেন, কাছাড় জেলার কংগ্রেস কর্মীগণ তাঁর ওপর আস্থা প্রকাশ করেছেন এবং তাঁদের পক্ষ থেকে কোনোরূপ মীমাংসায় উপনীত হবার অধিকার দিয়েছেন। এই অবস্থায় সকলের পক্ষে সন্তোষজনক মীমাংসায় উপনীত হতে বিলম্ব হবার কোনো কারণ থাকতে পারে না। শ্রীলালবাহাদুর বলেন, কাছাড়ের অধিবাসীদের মনোভাব সুস্পষ্ট। তাঁর অবস্থানকালে কাছাড়ের অধিবাসীরা যে সংযমের পরিচয় দিয়েছেন, তা খুবই প্রশংসনীয়। খুব তাড়াতাড়িই মীমাংসা হবে এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে বলে কিছু আশা নিয়ে তিনি জেলা ত্যাগ করে যাচ্ছেন।

কাছাড় সংগ্রাম পরিষদ সম্পর্কে কিছু বলার আছে কি না এই প্রশ্নের জবাবে শ্রীশাস্ত্রী বলেন, পরিষদ অবস্থা পুনরায় পর্যালোচনা করে দেখবেন বলেই তিনি আশা করেন।

শ্রীশাস্ত্রী বলেন, কাছাড় জেলায় যাতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে এবং যাতে শান্ত ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভাষা সমস্যা ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক সম্বন্ধে আলোচনা করা যায়, সেজন্য একটি মীমাংসায় উপনীত হতে সাহায্য করার জন্যই প্রধানত তিনি আসামে এসেছেন।

তিনি বলেন, কাছাড়ে আসার আগেই আসামের মুখ্যমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী এবং আসাম প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি ও কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে তাঁর আলোচনা হয়েছে। কাছাড়ের কয়েকজন কংগ্রেস নেতার সঙ্গেও তাঁর আলোচনা হয়েছিল। কাছাড়ের উক্ত নেতৃবৃন্দ শিলং-এও এসেছিলেন। গত দু’দিনে বিভিন্ন শ্রেণির প্রতিনিধিদের সঙ্গেও তাঁর আলোচনা হয়েছে।

প্রকাশ, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলোচনাকালে প্রতিনিধিদের আশ্বাস দেন যে, শিলং-এ আসামের মন্ত্রিসভা এবং পরে প্রধানমন্ত্রী শ্রীনেহরুর সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনাকালে কাছাড়ের অধিবাসীদের অভিমত তিনি মনে রাখবেন।’৯৫

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ১৯ মে পুলিশের গুলিতে আহত ব্যক্তিদের খোঁজ খবর নেবার জন্য শিলচর সিভিল হাসপাতালে যান। পুলিশের গুলিতে ১১ জন নিহত এবং ৭৫ জন আহত হওয়ার সংবাদ পাওয়া যায়। আহতদের মধ্যে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহেও সিভিল হাসপাতালে তখনও ৩০ জন চিকিৎসাধীন ছিলেন। সংবাদপত্র সূত্রে জানা যায়, ‘সিভিল সার্জন ডা: এ. মুখার্জী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে নিয়ে যান। শ্রীশাস্ত্রী আহত ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ খবর নেন। সিভিল সার্জন শ্রীশাস্ত্রীকে একজন আহত ব্যক্তির কাছে নিয়ে গিয়ে বলেন, বুলেট যদি আর সিকি ইঞ্চি গভীরে প্রবেশ করতো— তাহলে তাঁর মৃত্যু হত। শ্রীশাস্ত্রী মহিলাদের ওয়ার্ড পরিদর্শনকালে আহত মহিলাদের মধ্যে একজনকে দুর্বল দেখেন। ডাক্তারকে তিনি জিজ্ঞাসা করেন যে, যথোচিত যত্ন নেওয়া হচ্ছে কি না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে ডাক্তার জানান, আহতদের জন্য যা কিছু প্রয়োজন তা করা হচ্ছে।’৯৬

লালবাহাদুর শাস্ত্রী শিলচর থেকে ৪ জুন রাতে গৌহাটি এবং সেখান থেকে শিলং পৌঁছান। ‘আসামের ভাষা সমস্যা সম্পর্কে কাছাড়ের কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধানের যে সূত্র তিনি উদ্ভাবন করেছেন, আগামীকাল অর্থাৎ ৫ জুন তিনি মুখ্যমন্ত্রী বি পি চালিহা এবং অন্যান্য মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে তাদের অনুমোদন লাভের চেষ্টা করবেন। শ্রীশাস্ত্রী ৬ জুন শিলং থেকে দিল্লি পৌঁছবেন। তারপূর্বে তিনি এক সাংবাদিক বৈঠকে তাঁর দৌত্যের ফলাফল জানাবেন’ বলে পি.টি. আই সূত্রে উল্লেখ করা হয়।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গৌহাটি পৌঁছে সরাসরি প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভায় যোগ দেন। সভায় শ্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী বলেন, ‘সংখ্যালঘুদের বক্তব্য বুঝা ও মানিয়ে চলা সংখ্যাগরিষ্ঠদেরই কাজ। শ্রীশাস্ত্রী কংগ্রেস সদস্যদের বলেন, অসমিয়া ভাষার সরকারি ভাষা হবার ন্যায়সংগত অধিকার আছে, কিন্তু ভাষাগত সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে উদার মনোভাব অবলম্বন করা এবং শিক্ষা ও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ভাষার জন্য যাতে তারা অসুবিধায় না পড়ে তার প্রতি লক্ষ রাখা সংখ্যাগরিষ্ঠদের কর্তব্য। শ্রীশাস্ত্রী আসাম সরকারি ভাষা বিলের উল্লেখ করে বলেন, অতি দ্রুত এই আইন বলবৎ করা হয়েছে।

আসাম প্রদেশ কংগ্রেস সভায় বক্তৃতার পর শ্রীশাস্ত্রী শিলং রওনা হয়ে যান। তাঁর সঙ্গে অর্থমন্ত্রী ফকরুদ্দীন আলী আহমদ, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সিদ্ধিনাথ শর্মা, কৃষিমন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী এবং শ্রম ও শিল্পমন্ত্রী কে পি ত্রিপাঠিও সঙ্গী হন। খারাপ আবহাওয়ার কারণে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গৌহাটি পৌঁছোতে কয়েকঘণ্টা দেরী হয়।’৯৭

ভাষা আন্দোলন বানচালে শিলচরে পুনরায় সাম্প্রদায়িক শক্তির উপস্থিতি লক্ষ করা গেল। শিলচর থেকে ৪ জুন স্টাফ রিপোর্টার জানালেন: ‘এ-এস-সি ১৭০৪ নম্বরের গাড়িটি কার? অভিযোগে প্রকাশ, উপরোক্ত নম্বরের গাড়ি পুলিশের এবং কোনো কোনো থানার সঙ্গে যোগসাজসে সাম্প্রদায়িকতাবাদী একদল দুষ্কৃতকারীদের নিয়ে ইদানীং যাতায়াত করছে। কেবল তাই নয়, ওই গাড়িতে করে গতকাল একদল লোককে হাইলাকান্দি থেকে আনা হয় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্মুখে ভাষা-আন্দোলন বিরোধী বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে। অভিযোগে আরও প্রকাশ, শালচাপরায় ওই গাড়ি দিয়ে লোক আনিয়ে হাঙ্গামা সৃষ্টির চেষ্টা হয়।’

কাছাড়ের নতুন ডেপুটি কমিশনার শ্রী আর. কে. শ্রীবাস্তব সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের কার্যকলাপের কথা এক বিবৃতিতে স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন:

এই জেলার কোন কোন স্থান হইতে এরূপ সংবাদ পাওয়া যাইতেছে কতিপয় ব্যক্তি দুরভিসন্ধিমূলক অপপ্রচার দ্বারা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সখ্য ও প্রীতির হানি ঘটাইতেছে। ইহাও শুনা যায় যে, গ্রামাঞ্চল ও চা-বাগানে জনসাধারণকে এরূপ বোঝান হইতেছে যে, কতৃপক্ষ নাকি উদবাস্তুগণকে এ দেশ হইতে তাড়াইয়া দিতে ইচ্ছা করেন। সম্ভবত এরূপ অপপ্রচারের ফলে, শিলচর মহকুমায় কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটিয়া গিয়াছে-যেখানে উদবাস্তুদের গৃহাদি জ্বালাইয়া দেওয়া বা লুটপাট করা হইয়াছে। এই ঘটনা উপলক্ষে কয়েক ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করিয়াছে।

আমি সুস্পষ্টভাবে জানাইয়া দিতে চাই যে, কতৃপক্ষ উদ্বাস্তুদিগের অথবা কোনো সম্প্রদায়ের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হইতে দেন নাই অথবা দিতে পারেন না। অথবা কোন প্রকারের অবৈধ কার্যকলাপও সহ্য করিতে পারিবেন না।

এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি আইনানুগ ও শান্তিপ্রিয় নাগরিকদিগকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাইতেছি যে, তাহারা যেন এরূপ অপপ্রচারে কর্ণপাত না করেন অথবা কোন মূল্য না দেন, এবং সরকারকে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখিতেও জিলার ভিতর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতি বজায় রাখিতে সাহায্য করেন।

এতদসঙ্গে দূরভিসন্ধিমূলক অপপ্রচারে এবং অবৈধ কার্যকলাপে লিপ্ত দুষ্কৃতকারীগণকে সাবধান করিয়া দেওয়া যাইতেছে যে-সরকার তাহাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।৯৮

এ দিন করিমগঞ্জে সন্ধ্যায় এক বিশাল জনসভায় ড. প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ ভাষণ দেন। করিমগঞ্জ থেকে পাঠানো সংবাদে জানানো হয়, ‘পশ্চিমবঙ্গের প্রজা সমাজতন্ত্রী দলের নেতা ড. প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ আজ সন্ধ্যায় করিমগঞ্জে এক বিরাট জনসমাবেশে ভাষণদানকালে বলেন, ভারতের প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার এবং সমান সুযোগসুবিধা আছে এবং নিজস্ব অধিকার ও ভাষার দাবি পূরণে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করবার অধিকারও প্রত্যেকের আছে।

শিলচরে পুলিশের গুলীবর্ষণের ফলে ১১ জনের মৃত্যু সম্পর্কে ড. ঘোষ বলেন, এই ঘটনা জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ। তিনি বলেন, স্বাধীনতা লাভের পর এই জাতীয় গুলীবর্ষণকে তীব্র ভাষায় নিন্দা করা উচিত। এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে বালিকারা যে সাহসের পরিচয় দিয়েছে তা প্রশংসনীয়।

কাছাড়ে বাংলা ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে ড. ঘোষ বলেন, বাংলা ভাষা আসামের সরকারি ভাষা হওয়া উচিত। তিনি বলেন, অবিলম্বে ভাষা সমস্যার সমাধান না হলে দেশে ঐক্য প্রতিষ্ঠা বিঘ্নিত হবে।

শ্রীনেহরুর স্থিতাবস্থা প্রস্তাব সম্পর্কে ড. ঘোষ মন্তব্য করেন যে, আগামী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত কাল হরণের চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি বলেন, এরূপ প্রচেষ্টাকে কোনমতেই সমর্থন করা যায় না। ভাষাগত সমস্যার সমাধান অবিলম্বে হওয়া দরকার বলে তিনি মনে করেন।

শ্রীত্রিদিব চৌধুরী এম.পি (পঃ বঙ্গ) বলেন, শিলচর-কাছাড়ের ভাষা আন্দোলন আজ দেশের প্রত্যেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠার জন্য এই যে আন্দোলন তা ভারতীয় সংবিধানের বিরোধী নয়।

ঐক্য বজায় রাখবার জন্য শিলচর মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান শ্রীমহীতোষ পুরকায়স্থ সকলের উদ্দেশে আবেদন জানান। এবং আসামের অন্যতম সরকারি ভাষারূপে বাংলা ভাষাকে স্বীকার না করে নেওয়া পর্যন্ত সকলকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাবার আহ্বান জানান।

করিমগঞ্জের বিশিষ্ট নাগরিক শ্রীইন্দ্রকুমার দত্ত সভাপতির আসন গ্রহণ করেন।’৯৯

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীশাস্ত্রী ৫জুন শিলং-এ আসাম সরকারের মন্ত্রী এবং প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক যৌথ বৈঠকে দু’ঘণ্টাকাল আলোচনা করেন। এরপর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের নির্দেশ যথাসম্ভব কাজে পরিণত করবার চেষ্টা করেছি এবং আগামীকাল দিল্লি যাত্রা করবার পূর্বে সরকারি ভাষা সংক্রান্ত সমস্যার চূড়ান্ত মীমাংসা করতে পারব আশা করি।’

‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গত ছ’দিন যাবৎ আসামে রয়েছেন। দুর্গাপুর এ আই সি সি অধিবেশন শেষে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ তাঁকে গৌহাটি, শিলচর ও শিলং পরিদর্শনে পাঠান।’

মুখ্যমন্ত্রী শ্রী চালিহা সাংবাদিকদের বলেন, আসাম সেক্রেটারিয়েট এবং বাংলা ভাষা-ভাষী কাছাড়ের প্রশাসনিক ব্যবস্থার মধ্যে পত্রালাপে ইংরেজি এবং পরে ইংরেজির পরিবর্তে হিন্দি গ্রহণে আসাম গভর্নমেন্টের কোনো অসুবিধা নাই। শ্রী চালিহা বলেন, আগামীকাল শ্রীলাল বাহাদুর শিলং ত্যাগ করবার পূর্বে কোনোরূপ সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে বলে তিনি আশা করেন।

তিনি আরও বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কাছাড় নেতৃবৃন্দকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, বাংলা ভাষাকে রাজ্যের সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকার করে নেবার যৌক্তিকতা তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি এবং আসাম সরকারের কাছে তিনি তা সুপারিশও করবেন না। কিন্তু ভাষা সংক্রান্ত নীতি কাজে পরিণত করার ফলে কাছাড় জেলা এবং ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বাংলা ভাষাভাষীদের যে অসুবিধা হবে— তিনি তা বিবেচনা করতে সম্মত আছেন।

শ্রীচালিহা বলেন, লালবাহাদুর মন্ত্রীদের এবং কংগ্রেস নেতৃবৃন্দকে বলেছেন যে, আইনে কাছাড়ের প্রশাসনিক ভাষা বাংলা থেকে অসমিয়াতে পরিবর্তন সম্পর্কে মহকুমা পরিষদকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে— তা পরিত্যক্ত হওয়া উচিত। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, এ ছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অন্যান্য যে সমস্ত প্রস্তাব করেছেন, তাতে গত বৎসর গৃহীত ভাষা সংক্রান্ত আইনের কোনো সংশোধনের প্রয়োজন হবে না।

১৯৫৬ সালে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের এক ইস্তাহারে ভাষা সংক্রান্ত সংখ্যালঘুদের সুযোগসুবিধা দান সম্পর্কে যা বলা হয়েছিল, সে সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের এক বৈঠকে ওই সকল সুযোগসুবিধা স্থিরীকৃত। সুতরাং কাছাড় ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাংলা ভাষাভাষীদের সম্পর্কে আসাম গভর্নমেন্ট তা মানতে বাধ্য।

মুখ্যমন্ত্রী বলেন, প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে নিজ নিজ মাতৃভাষার মাধ্যমে যাতে শিক্ষালাভের সুযোগ পায়, সে বিষয়টি তিনি নিশ্চিত করবেন।’১০০

এ দিনের সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী শ্রী চালিহা ব্যতীত প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শ্রীসিদ্ধিনাথ শর্মা, সহ-সভাপতি শ্রী প্রফুল্ল গোস্বামী, সম্পাদক শ্রীশরৎচন্দ্র সিংহ এবং সংসদে আসামের সদস্য শ্রীভগবতীও উপস্থিত ছিলেন। এ দিন অর্থাৎ ৫ জুন নয়াদিল্লিতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক শ্রীঅজয় ঘোষ প্রধানমন্ত্রী শ্রীজওহরলাল নেহরুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। উভয়ের মধ্যে আলোচনা ৪০ মিনিট স্থায়ী হয়। আলোচনার মূল বিষয় ছিল বর্তমান আসাম পরিস্থিতি। এই আলোচনাকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বলে উল্লেখ করে শ্রীঘোষ জানান যে: ‘আসামে বর্তমানে যে ভাষা আন্দোলন চলছে, শীঘ্রই এর মীমাংসার একটা উপায় বের করতেই হবে। এ বিষয়ে শ্রীনেহরু তাঁর সঙ্গে এক মত।’ ‘শ্রীঘোষ সম্প্রতি আসাম পরিদর্শন করে এসেছেন। আসাম রাজ্যের অবস্থা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে তিনি তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেন। প্রকাশ, শ্রীঘোষ শ্রীনেহরুকে বলেছেন যে, এক বৎসরের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য তিনি (শ্রীনেহরু) যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা কার্যকরী হবে না। কারণ, সাধারণ নির্বাচনের আর বেশি দেরী নেই।’১০১

৬ জুন গণ-সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে সাতদিন বিরতির পর সত্যাগ্রহীগণ শিলচরসহ সমগ্র কাছাড়ে এ দিন পিকেটিং করেন। শিলচরে আদালত ও রাজস্ব অফিসগুলিসহ রাজ্য সরকারের অফিসগুলির সামনে পিকেটিং করা হয়।

গতকাল সন্ধ্যায় শিলচরে শিশুদের একটি শোভাযাত্রা রাজপথ পরিভ্রমণ করে। তারা সমবেত কণ্ঠে আওয়াজ তোলে ‘বাংলাকে স্বীকার কর, অথবা গদি ছাড়।’

সংগ্রাম পরিষদ সভাপতি জনাব আবদুর রহমান চৌধুরী এ দিন বলেন যে: ‘কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবককে ইতিমধ্যেই গ্রামাঞ্চলে প্রেরণ করা হয়েছে। কিছু কিছু লোক এরূপ প্রচার করছে যে, কাছাড়কে আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন করা হবে, অথবা কাছাড়কে নিয়ে, ‘পূর্বাঞ্চল’ গঠন করা হবে। প্রেরিত স্বেচ্ছাসেবকগণ এই প্রচারের বিরোধিতা করবেন। জনাব চৌধুরী বলেন যে, আসামের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসাবে বাংলাভাষা স্বীকৃতি লাভ করুক—সংগ্রাম পরিষদ শুধু এটাই চায়, আর কিছু করা তাদের উদ্দেশ্য নয়।’১০২

৬জুন শিলং থেকে রওয়ানা হওয়ার পূর্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীলাল বাহাদুর শাস্ত্রী সাংবাদিকদের জানালেন, ‘আলোচনার ফলে, এমন কতকগুলি প্রস্তাব উদ্ভাবিত হয়েছে, যা, আমার মনে হয়, কেবল কাছাড়ের পক্ষেই নয়, সমগ্র রাজ্যের পক্ষেই সন্তোষজনক। প্রস্তাবগুলিতে বলা হয়, ১. মহকুমা পরিষদ সংক্রান্ত ধারাটি তুলে দেবার জন্য ভাষা সম্পর্কিত আইনটির সংশোধন করতে হবে; ২. রাজ্য সরকারের হেডকোয়ার্টার্স এবং কাছাড় ও স্বয়ংশাসিত জেলাগুলির মধ্যে সংবাদ আদান-প্রদানের ব্যাপারে ইংরেজির পরিবর্তে হিন্দির প্রচলন না হওয়া পর্যন্ত ইংরেজি ভাষাই চালু থাকবে; ৩. রাজ্য সরকারের স্তরে আপাতত ইংরেজি ভাষাই চালু থাকবে এবং পরে অসমিয়া ভাষার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি ভাষাও ব্যবহৃত হবে; ৪. ১৯৫৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তারিখের ভারত সরকারের স্মারকপত্রে যে সকল রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করা হয়েছে, আসামে ভাষাগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলিকেও সেই সমস্ত রক্ষাকবচের সুযোগ দেওয়া হবে; ৫. সমস্ত আইন ও বিল প্রভৃতি ইংরেজিতেই প্রকাশিত হবে; ৬. কাছাড়ের আন্দোলন প্রত্যাহার করতে হবে এবং ৭. আন্দোলন পুনরায় শুরু হবে না বুঝতে পারলে হিংসাত্মক এবং অন্তর্ঘাতী কাজে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া আন্দোলন সম্পর্কে ধৃত ব্যক্তিদের মুক্তিদান সম্পর্কে আসাম সরকার বিবেচনা করতে পারেন।

শ্রী শাস্ত্রী বলেন, ‘আসাম প্রদেশ কংগ্রেসের কার্যনির্বাহক সমিতি এবং চালিহা সরকার উভয়েই সরকারী ভাষা সংক্রান্ত আইনের ৫নম্বর ধারায় বর্ণিত মহকুমা পরিষদ সম্পর্কিত বিধানটি বাদ দিতে সম্মত হয়েছেন।’১০৩

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই ফর্মুলায় সমগ্র কাছাড় জুড়ে জনমনে চরম নৈরাশ্য, হতাশা পরিলক্ষিত হয়। ক্ষুব্ধ কাছাড় নেতৃত্ব আসামে শাস্ত্রীফর্মুলা, শাস্ত্রী-দৌত্য ব্যর্থ বলে উল্লেখ করলেন। তাঁরা পর্বতের মূষিক প্রসব বলেও উল্লেখ করেন। শাস্ত্রীজীর সমগ্র ফর্মুলায় বা ঘোষণায় কোথাও বাংলা ভাষার প্রতি বিন্দুমাত্র সম্মান প্রদর্শন করা হয়নি। তাঁর ঘোষণায় ইংরেজি থাকতে পারে, হিন্দি থাকতে পারে, আর অসমিয়া তো বটেই। কিন্তু বাংলা! নৈব নৈব চ। ফলে, কাছাড়ে বিভিন্ন মহলে বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হয়। নিখিল আসাম বঙ্গ ভাষাভাষী সমিতি সভানেত্রী, রাজনীতিক, সদ্য পদত্যাগী বিধায়ক শ্রীমতি জ্যোৎস্না চন্দ এ দিন এক তারবার্তায় ‘কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়ে দেন যে, শাস্ত্রী-ফর্মুলার যে ভাষ্য তিনি বেতারে শুনেছেন,তা সমিতির পক্ষে আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। শ্রীযুক্তা চন্দ সরকারি ছাপ মারা ফর্মুলাটা তাঁর কাছে অবিলম্বে পাঠাবার অনুরোধ করেন।’ গণ সংগ্রাম পরিষদের এক নেতা জানান, শাস্ত্রী ফর্মুলা কাছাড়বাসীর কাছে অত্যন্ত নৈরাশ্যজনক এবং এতে তাদের দাবি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

‘শিলঙে শাস্ত্রী-ফর্মুলা ঘোষণার পর কাছাড়ের কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের সম্মতি নেওয়া হয়েছে কিনা— এই প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাকি বলেন, এ সম্পর্কে চেষ্টা হচ্ছে এবং তাদের প্রতিনিধি শ্রীবৈদ্যনাথ মুখার্জি এবং কৃষিমন্ত্রী জনাব মইনুল হক চৌধুরী ফর্মুলায় সম্মতি জানিয়েছেন।

এ সম্পর্কে শিলচরের জনৈক বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা টেলিফোনে জানান, কাছাড় কংগ্রেস কাউকে তাদের প্রতিনিধি হিসাবে শিলং-এ পাঠাননি। শ্রীমুখার্জি ও জনাব হক চৌধুরী যদি সত্য সত্যই শাস্ত্রী-ফর্মুলায় মত দিয়ে থাকেন, তবে তা তাঁদের ব্যক্তিগত মত,—কাছাড় কংগ্রেসের অভিমত নয়।’১০৪

পিটিআই সূত্রে বিস্তৃতভাবেই শাস্ত্রী-ফর্মুলা জানা যায়। বলা হয়:

১. মহকুমা পরিষদ সংক্রান্ত ধারাটি তুলে দেবার জন্য আসাম সরকারি ভাষা আইন সংশোধিত হতে পারে।

২. রাজ্য সরকারের হেডকোয়ার্টার্স এবং কাছাড় ও স্বয়ংশাসিত জেলাগুলির মধ্যে সংবাদ আদান-প্রদানের ব্যবস্থা ইংরাজির পরিবর্তে হিন্দির প্রচলন না হওয়া পর্যন্ত ইংরেজি ভাষার মারফতেই চলতে থাকবে।

৩. রাজ্য সরকারের স্তরে আপাতত ইংরেজি ভাষাই ব্যবহৃত হবে। এরপর অসমিয়া ভাষা ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি ভাষাও ব্যবহৃত হতে থাকবে।

৪. ১৯৫৬ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তারিখে ভারত সরকারের স্মারকপত্রে যে সমস্ত রক্ষা কবচের ব্যবস্থা করা হয়েছে, আসাম রাজ্যের ভাষাগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলিকে সেই সমস্ত রক্ষা কবচের সুবিধা দেওয়া হবে।

৫. সরকারি ভাষা আইনের তৃতীয় ধারার দ্বিতীয় বিধান অনুসারে যে সমস্ত ক্ষেত্রে সমস্ত আইন, বিল, অর্ডিন্যান্স, রেগুলেশন এবং আদেশসমূহ অসমিয়া ভাষায় প্রচার করার ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেই সমস্ত ক্ষেত্রেও এই সমস্ত আইন, বিল ইত্যাদি ইংরেজি ভাষাতেই প্রকাশিত হবে এবং এ সম্পর্কে সংবিধানের ৩৪৮(৩) ধারা অনুসারে এই সমস্ত বিষয় সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা প্রকাশিত হতে পারে।

৬. জিলা পর্যায়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা যাতে কাজে পরিণত হয় এ জন্য ব্যবস্থা করতে হবে।

৭. কাছাড়ের আন্দোলন প্রত্যাহার করতে হবে।

৮. পুনরায় আন্দোলন আরম্ভ হবে না— এটা বুঝলেই গভর্নমেন্ট হিংসা ও অন্তর্ঘাতী কাজের জন্য যারা অভিযুক্ত হয়েছে— তারা ব্যতীত এই আন্দোলন সংক্রান্ত অন্যান্য সকল কয়েদীকে মুক্তি দেওয়া সম্পর্কে বিবেচনা করতে পারেন।’১০৫

৭ জুন শিলচরে এক অভিনব সত্যাগ্রহ প্রত্যক্ষ করলেন সকলে। শিলচর থেকে আনন্দবাজার পত্রিকা-র নিজস্ব সংবাদদাতা ৭ জুন জানিয়েছিলেন:

পিকেটিং-এর পরিবর্তে সত্যাগ্রহীরা আজ এখানে এক অভিনব পন্থায় সত্যগ্রহ করেন।

বেলা নয় ঘটিকায় তাঁহারা জেলা জজের ঘরে প্রবেশ করেন এবং সওয়া দুই ঘণ্টা কাল নিজেদের ‘আদালত’ চালাইয়া যান। ব্যবস্থার এতটুকুও ত্রুটি হয় নাই বা ‘আদালতের’ মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় নাই। ‘বিচারপতি’ গম্ভীরভাবে আসন গ্রহণ করেন। ‘করণিকরা’ কাজ চালাইয়া যায়। ‘উকিলরা’ সওয়াল জবাব করেন। ‘চাপরাশীরা’ যথা নিয়মে দন্ডায়মান থাকে। ‘সাক্ষীরা’ সাক্ষ্য দেয়, পেশকার কলম লইয়া বসিয়া থাকেন। ‘অভিযুক্ত’ ব্যক্তিরা করজোড়ে দাঁড়াইয়া থাকে। ‘আর্দালিরা হাজির থাকে। মায় ‘রায়ও’ প্রদত্ত হয়।

জজ সাহেবের ‘রায়’ পুরোপুরি নিয়মমাফিক। তিনি ঘোষণা করেন, ‘অদ্য হইতে বাঙলা আসামের অন্যতমা সরকারি ভাষারূপে গৃহীত হইল।’

ওই ‘রায়ে’ আরও বলা হইয়াছে, ‘বাঙলাকে সরকারি ভাষারূপে স্বীকার না করার অপরাধে শ্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা ও ফকরুদ্দীন আলি আহমদের শাস্তিস্বরূপ মৃত্যুদন্ড দেওয়া হইল।’

এদিকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সাহেব ও ফৌজি কর্তারা সদলবলে হাজির। তাহারা আসিয়া ‘জজ’ ও অন্যান্যদের আদালত ত্যাগ করিবার জন্য অনুরোধ করিলেন। সশস্ত্র পুলিশ আদালত-ভবন ঘেরাও করিল। অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হইলে ‘বেআইনি প্রবেশের’ এক নালিশ রুজু করা হইল এবং শেষ পর্যন্ত সপারিষদ ‘জজ সাহেব’ গ্রেপ্তার হন। অতঃপর ‘জজ সাহেব’-কে পুলিশ ভ্যানে উঠিতে বলা হয়। তাঁহার ‘পদমর্যাদায়’ উহা বাধে বলিয়া তিনি অভিমত প্রকাশ করেন। অগত্যা কতৃপক্ষ তাঁহার জন্য ট্যাক্সির ব্যবস্থা করেন।

‘জজ সাহেব’ বা ‘জজ সাহেবাণীর’ নাম শ্রীমতী গোপা দত্ত। তিনি শিলচর কলেজেরই ছাত্রী এবং তাঁহার পিতা শিলচরের একজন অবসরপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট। পেশকার হিসেবে কাজ করেন শ্রী মণীন্দ্র রায়।

পুলিশ মোট ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করিয়াছে। তন্মধ্যে ‘জজসাহেবানী’ শ্রীমতী দত্তসহ মহিলা তিনজন। তাঁহাদের নাম শ্রীমতী আরতি চক্রবর্তী ও শ্রীমতী মিনতি চক্রবর্তী।১০৬

সত্যাগ্রহীদের জেলা জজকোর্ট দখলের এই অভিনব পথকে নি:সন্দেহে অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপ বলতে হবে। কেবল জজ আদালত দখল নয়— বিচারকার্যও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা হয়, যেখানে মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা এবং অত্যন্ত প্রভাবশালী অর্থমন্ত্রী ফকরুদ্দীন আলি আহমদকে অপরাধী সাব্যস্ত করে শাস্তিস্বরূপ মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়। জজ সাহেব ছিলেন একজন নারী, কলেজ ছাত্রী, গোপা দত্ত। এ সাহসের তুলনা হয় না। গোপা একা নন, সঙ্গে আরও দু’জন নারী। সত্যাগ্রহী কলেজ ছাত্রগণও তো কম সাহসের পরিচয় রাখেননি, হোক না প্রতীকী বিচার। আর এই অভিনব জেলা আদালত দখলের মূল পরিকল্পক ছিলেন শিলচর মহকুমা গণসংগ্রাম পরিষদ ‘ডিক্টেটর’ পরিতোষ পাল চৌধুরী। রীতিমতো গোপন ডেরায় শ্রীপাল চৌধুরী দলনেত্রী গোপা দত্তকে ডেকে এনে সমস্ত পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মণীন্দ্র রায়ের মতো ত্যাগী সত্যাগ্রহীসহ অন্যান্য সাহসী সহযোদ্ধা।

সেদিনের পেশাকার মণীন্দ্র রায় পরবর্তীতে ৭ জুনের ঘটনা সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে জানান: ‘…জজকোর্ট দখলের আন্দোলনে আমাদের যাত্রা শুরু হল দেওয়ানজী বাজার সংগ্রাম পরিষদ কার্যালয় থেকে। একজন, দু’জন করে আগে পিছে। আমাদের গোপন যাত্রা এগিয়ে চলল গভর্নমেন্ট হাইস্কুলের সামনের পথে। ন’টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম শিলচর মিউনিসিপ্যালিটি অফিস চত্বরে। বেলা দশটা নাগাদ কোর্টের ঝাড়ুদার কোর্ট প্রাঙ্গণের প্রতিটি আদালত কক্ষ ঝাড়ু দিয়ে যখন জজকোর্টের কক্ষটি ঝাড়ু দিয়ে চলে যায়, সেই খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা এজলাসের ভেতরে গিয়ে যে যার আসন দখল করে বসে পড়লাম। গোপা জজ সাহেবের আসন দখল করল। আমি বসলাম পেশাকারের আসনে। সত্য ঘোষ কাঠগড়ায় দাঁড়াল করজোড়ে আসামি চালিহা সেজে। বাদীর ভূমিকায় তুষার, বাবুল, সুব্রত। জুরির ভূমিকায় হীরেন দেব, পরেশ পাল এবং নির্মল চক্রবর্তী। উকিল, ব্যারিস্টারের ভূমিকায় সমর দেব, মিহিরকান্তি চৌধুরী, শরদিন্দু বিশ্বাস, রঞ্জিত ভট্টাচার্য, নিয়তি চক্রবর্তী ও বাসন্তী চক্রবর্তী। আমরা নকল আদালত সাজালাম। সবার বুকে তখন সংগ্রাম পরিষদের দেওয়া সত্যাগ্রহী ব্যাজ। বিচার শুরু হল।

ওদিকে যথাসময়ে পেছনের কোঠা থেকে জজ সাহেব এজলাস ঘরে পা দিয়েই হতবাক। তিনি পিছনের কোঠায় ফিরে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ছুটে আসলেন এস পি সাহেব। পাশের কোঠায় পরামর্শ হল। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন এজলাস ঘরে এস পি, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং জজ সাহেব। এস পি গোপাকে আসন ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করলেন। গোপা আসন ছাড়ল না। তাঁরা বিফল হয়ে চলে গেলেন পেছনের কোঠায়।

এবার গোপার মা এলেন গোপাকে নিয়ে যেতে। আমি সচকিত হলাম। গোপার মা গোপার পাশে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের ফোন পেয়ে এসেছি। তোমার বাবা খুব অসুস্থ, তুমি চলে এসো।’ সাক্ষী পর্ব শেষ করে জজ সাহেবা বিচারের রায় দিলেন—‘অদ্য হইতে বাংলা আসামের অন্যতম সরকারি ভাষারূপে গৃহীত হইল এবং বাংলা ভাষাকে স্বীকার না করার অপরাধে বিমলাপ্রসাদ চালিহা ও ফকরুদ্দীন আলি আহমেদকে শাস্তিস্বরূপ মৃত্যুদন্ড দেওয়া হইল আর শাস্ত্রীজীকে দেওয়া হইল কারাবাস দন্ড।’ ততক্ষণে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী আদালত ভবন ঘেরাও করে ফেলেছে। আদালত দখলকারী সত্যাগ্রহীরা গ্রেপ্তার বরণ করল।

জজ সাহেবা ধীর পদে এগিয়ে এলেন বাইরে। এজলাসের চৌকাঠ পেরোতে ভিড় সামলাতে হিমসিম খেতে হল পুলিশকে। জজ সাহেবা এগিয়ে যান। আমি তাঁকে অনুসরণ করি। পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা চলেন পেছনে পেছনে। এ যেন এক মহান নেত্রীর উষ্ণ সংবর্ধনা। বাইরে এলে জজ সাহেবাকে পুলিশ ভ্যানে উঠতে বলা হল। জজ সাহেবা তৎক্ষণাৎ গর্জে উঠলেন। বললেন, ‘আমি প্রথম শ্রেণির গাড়ি ছাড়া চলি না।’ অগত্যা এস পি নিজের গাড়িতেই তুললেন জজ সাহেবাকে।’১০৭

সেদিন জজকোর্ট দখলে অপর সত্যাগ্রহী ছিলেন কলেজ ছাত্র শরদিন্দু বিশ্বাস। এ সম্পর্কে তিনি জানান,

…৭ জুন ১৯৬১ সাল। সকাল ঠিক দশটায় জজকোর্ট দখল করা হল। জজের আসনে বসল গোপা দত্ত। পেশকার সাজে আমারই সহপাঠী মণীন্দ্র রায়। ব্যারিস্টার সেজেছে নিয়তি, বাসন্তী, সমর দেব, শরদিন্দু বিশ্বাস, রঞ্জিত ভট্টাচার্য প্রমুখ সত্যাগ্রহী। জুরির ভূমিকায় হীরেন দেব, পরেশ পাল, নির্মল চক্রবর্তী। আসামির কাঠগড়ায় বিমলাপ্রসাদ চালিহা সেজে দাঁড়ান সত্য ঘোষ। বিচারে বাংলাভাষাকে আসামের অন্যতম রাজ্যভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হল। চালিহা ও ফকরুদ্দীন আলি আহমদকে শাস্তিস্বরূপ প্রাণদন্ডের আদেশ দেওয়া হল। লালবাহাদুর শাস্ত্রীকে দেওয়া হল কারাবাস দন্ড।

সত্যাগ্রহীরা এজলাস দখলের অব্যবহিত পরেই আসাম সরকারের জেলা জজ এসে হাজির হলেন। সাথে পুলিশ বাহিনী, এজলাস ছাড়তে হুকুম দিলেন সত্যাগ্রহীদের। সত্যাগ্রহী জজ সাহেবা গোপা দত্ত কোনো হুকুমের তোয়াক্কা না করে বিচার কাজ চালিয়ে যান। জেলা জজ পুলিশসহ ফিরে যান। কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এসে গোপা দত্তকে এজলাস ছাড়ার আদেশ দেন। কিন্তু গোপা নিজ সিদ্ধান্তে অটল এবং ধমক দিয়ে বলে বিচার চলছে, বিচারে বাধা দেওয়া অমার্জনীয় অপরাধ এবং আইনত দন্ডনীয়, রায়দান করা পর্যন্ত উত্যক্ত করবেন না। ক্রমে গোপার মা, মাসিকে দিয়ে অনুরোধ করিয়েও যখন গোপাকে বাগে আনা গেল না—তখন সত্যাগ্রহীদের গ্রেফতারের আদেশ দিল প্রশাসন। এজলাসে গ্রেফতার করার বাধা নিষেধ আছে কি না, জানি না, তবে এজলাসে ঢুকে পুলিশ গ্রেফতার না করে বাইরে অপেক্ষা করতে থাকল। দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ রায়দান সমাপ্ত হলে বাইরে বেরিয়ে আসলে পুলিশ আমাদের গ্রেফতার করে জেলে চালান দেয়। সবার শেষে গ্রেফতার হয় গোপা দত্ত এবং মণীন্দ্র রায়। ১৪ জুন আমাদের বিচার হল। আমাদের মাথাপিছু একশো টাকা করে জরিমানা ও ৭ দিনের কারাদন্ডের হুকুম হল এবং গোপা দত্তের জরিমানা হল দুশো টাকা এবং ১৫ দিনের কারাবাস। কিন্তু ১৭ জুন আচমকা সবাইকে মুক্ত করে দেওয়া হল।’১০৮

জেলা জজ আদালত দখলে যাঁকে নিয়ে ভারতজুড়ে হৈ চৈ, যে নারীর নেতৃত্ব সকলকে বিস্মিত করেছে— সেই কলেজ ছাত্রী শ্রীমতী গোপা দত্ত এ বিষয়ে কী বলেছেন— সে বিষয়টি, সেই শিহরণ জাগানো কাহিনিটি বর্তমান এবং আগামী প্রজন্মের অবগতির জন্য তুলে ধরব। গোপা দত্ত নিজে জানিয়েছেন: ‘৭ জুন, সকাল সাতটা। ৬ জুন ভোর থেকে সন্ধ্যা অব্দি পিকেটিং করে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছি। ‘সংগ্রাম পরিষদ’ থেকে জানান হয়েছে পরদিন কোনো পিকেটিং নেই। তাই নিশ্চিন্ত মনে সাতটা পর্যন্ত ঘুমুচ্ছিলাম। এমন সময় পাশের ঘরে টেলিফোন ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠল। ঘুমের রেশটা যেন কেটে গেল। বুঝলাম বাবা টেলিফোন ধরেছেন—। কানে এল বাবার কণ্ঠস্বর ‘‘গোপা তো ঘুমুচ্ছে—। আচ্ছা উঠলে বলব।’’ তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম। বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, কোত্থেকে আমাকে ডাকছে—? বাবা বললেন, এইট টু নম্বর থেকে সংগ্রাম পরিষদের একজন তোমার খোঁজ করছে। টেলিফোন ধরলাম। ওপাশ থেকে ভেসে এল একটা কন্ঠস্বর, ‘‘আমি পরিতোষ পালচৌধুরি বলছি। তুমি কি গোপা?’’ বল্লাম, ‘হ্যাঁ’। পরিতোষদা বললেন, ‘‘তোমার সঙ্গে জরুরি কাজ আছে। আধ ঘন্টার মধ্যে আমাদের অফিসে আসতে হবে। সঙ্গে আরও দু’জন মেয়েকেও নিয়ে আসতে হবে।’’

বললাম, ‘‘ঠিক আছে সময় মতো হাজির হচ্ছি। কিন্তু ব্যাপারটা কী?’’ কানে এলো দুটি শব্দ ‘‘অভিনব পিকেটিং।’’ ব্যাস, ওই টুকুই। লাইন কেটে গেল। তাড়াতাড়ি তৈরি হ’লাম, আমার দু’বন্ধু নিয়তি চক্রবর্তী ও বাসন্তী চক্রবর্তীকে খবর দিয়ে আনালাম। ঠিক সাড়ে সাতটা নাগাদ আমরা সংগ্রাম পরিষদের অফিসে পৌঁছলাম। আমাদের তিনজনকে নিয়ে যাওয়া হল একেবারে পেছনের দিকে কালো পর্দা ঘেরা এক গোপন কক্ষে। ছোটো ঘরটা—একটা ছোটো বেঞ্চিতে আমরা তিনজন বসলাম। সামনে একটুখানি ফাঁকা জায়গা। ওপাশে ছোট্ট একটা টেবিল এবং আর একটা বেঞ্চি। তাতে বসে আছেন পরিতোষদা স্বয়ং এবং প্রতুলদা, মণীন্দ্র রায় ও আরও কয়েকজন। সকলের চোখেই যেন কি এক নাম না জানা রহস্য। কানে এলো ফিসফিস একটা আওয়াজ। চোখ তুলে তাকালাম।

শুনলাম পরিতোষদা বলছেন যে আজ জজকোর্টে নুতন ধরনের পিকেটিং হবে—। সত্যাগ্রহীদের মধ্যে যে যেমন পারে কৃত্রিম জজ থেকে উকিল জুরি আর্দালি এমন কি আসামি পর্যন্ত হতে হবে এবং আজকের জজকোর্ট সত্যাগ্রহীদেরই চালাতে হবে—। আর এই অভিযানে লীডার করা হবে আমাকেই—। অর্থাৎ জজের আসনে বসে আজকের বিচার আমাকেই চালাতে হবে—।

হঠাৎ বুকটা ঢিপ ঢিপ করে উঠল। আমার বাবা ম্যাজিস্ট্রেট। তাই আসন দখলের পরিণাম চিন্তা করে কেমন যেন একটু মিইয়ে গেলাম। সমস্ত ঘরটা যেন আশ্চর্য্যভাবে চুপ করে গেছে। অদ্ভুত এক নীরবতায় সমস্ত ঘরটা ডুবে গেছে। চোখ তুলে তাকালাম। দেখলাম সবাই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমারই মুখের দিকে। তাদের চোখের তারায় দেখতে পেলাম অদ্ভুত এক নির্ভীকতার দীপ্তি! যে দীপ্তি দেখা গিয়েছিল আমাদের একাদশ শহীদ ভাইবোনদের চোখে! যে দীপ্তিকেই চিরদিনের মতো নিভিয়ে দেওয়ার জন্য পুলিশ নিষ্ঠুরভাবে গুলি করেছিল আমাদের শহীদ বোন কমলার চোখে। সে দীপ্তির ছোঁয়া যেন আমার চোখেও লাগল—।

ঝিমিয়ে যাওয়া মনে যেন ফিরে এল এক অদ্ভুত শক্তি। বললাম,— ‘‘আমি রাজী। কিন্তু আমার বাড়ীতে যেন কোনো খবর দেওয়া না হয়—।’’

আরও কয়েকজন মেয়েকে খবর দিয়ে আনান হল। কিন্তু বাড়ি থেকে অনুমতি পাবে না বলে সবাই বিদায় নিল। শেষ পর্যন্ত আমরা তিনজন মেয়েই রইলাম। যথাসময়ে আমাকে লীডার ব্যাজ এবং অন্যান্যদের সত্যাগ্রহীর ব্যাজ লাগিয়ে দেওয়া হল। সাড়ে আটটা নাগাদ আমরা ‘‘বন্দেমাতরম’’ বলে কোর্টের দিকে রওনা হলাম। কোর্টে পৌঁছে একটা গোপন ঘরে অপেক্ষা করতে থাকলাম। একসময় খবর এল এজলাসের ঘর খোলা হয়েছে। তাড়াতাড়ি আমরা গিয়ে হাজির হলাম। নির্দেশমত যে যার জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল। আমিও সটান গিয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমার আসনের কাছে। নিজের অজ্ঞাতেই পা দুটো একটু কেঁপে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই ফিরে পেলাম এক অসীম শক্তি। মনে মনে ‘বন্দেমাতরম’ স্মরণ করে আসন গ্রহণ করলাম। সঙ্গে সঙ্গে অন্য সবাই স্ব-স্ব আসনে বসল। শুরু হল আমাদের কৃত্রিম আদালত কার্য। আসনে বসার সঙ্গে সঙ্গে ভুলে গেলাম সব। ভুলে গেলাম নিজেকে। ভুলে গেলাম আমার বয়স, ভুলে গেলাম আমি একজন কলেজ ছাত্রী, ভুলে গেলাম আমি আমার মা বাবার কথা, ভুলে গেলাম আমি একজন সত্যাগ্রহী—। সত্যিকারের জজসাহেবের কাঠিন্য ফুটে উঠল আমার মুখে চোখে। সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে চলতে লাগল আমাদের কাজ। আমার পেশকারের কাজ করছিলেন শ্রীমনীন্দ্র রায়। উকিলের দলে ছিলেন, নিয়তি চক্রবর্তী, বাসন্তী চক্রবর্তী, সমর দেব, শরদিন্দু, রঞ্জিত ভট্টাচার্য, মিহির কান্তি চৌধুরী। জুরির ভূমিকায় ছিলেন হীরেন দেব, পরেশ পাল, নির্মল চক্রবর্তী। আসামির কাঠগড়ায় শ্রীচালিহা সেজে হাত জোড় করে দাঁড়ালেন আমাদের সত্যাগ্রহী ভাই সত্য ঘোষ। আর্দালি দারোয়ান-রূপে অন্যান্য সত্যাগ্রহী ভাইরাও উপস্থিত ছিল—। ব্যবস্থার এতটুকু ত্রুটি হয়নি। আদালতের মর্যাদা সম্পূর্ণ বজায় ছিল। করনিকরা কাজ চালিয়ে যায়। উকিলরা সওয়াল জবাব করেন। ‘চাপরাসীরা’ যথা নিয়মে দন্ডায়মান থাকে। সাক্ষীরা সাক্ষ্য দেয়। পেশকার গম্ভীর মুখে কাজ চালিয়ে যান। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা করজোড়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। বিচার শেষে ‘জজ’ হিসেবে আমি রায় দিলাম, ‘‘অদ্য হতে বাঙলা আসামের অন্যতম সরকারি ভাষারূপে গৃহীত হইল এবং বাঙলা ভাষাকে স্বীকার না করার অপরাধে শ্রীবিমলা প্রসাদ চালিহা ও ফকরুদ্দিন আহমেদকে শাস্তিস্বরূপ মৃত্যুদন্ড দেওয়া হল আর শাস্ত্রীজীকে দেওয়া হল কারাবাস দন্ড।’’ ইতিমধ্যে হঠাৎ চোখ পড়ল দরজার দিকে। দেখলাম কোর্টের চারিদিকে লোকে লোকারণ্য। এদিকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সাহেব ও ফৌজি কর্তারা সদল বলে হাজির। সশস্ত্র পুলিশ আদালত ভবন ঘেরাও করল। কর্তাদের চোখে দেখলাম বিহ্বলতার ছাপ। অনেকজন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমাদের দিকে। ঘটনার আকস্মিকতায় তাঁরা যেন সব বিমূঢ় হয়ে গেছেন। ধীরে ধীরে কর্তা ব্যক্তিরা সব পাশের ঘরে প্রবেশ করলেন এবং অনেকক্ষণ নিজেদের মধ্যে আলাপ করলেন। আমাদের কাজ যথারীতি চলতে লাগল। সবাই চুপ। হঠাৎ কানে গেল আমার মার গলার আওয়াজ। তাকিয়ে দেখলাম মা দাঁড়িয়ে আছেন পাশে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বাড়িতে টেলিফোন করে মাকে আনিয়েছেন। মা বললেন, ‘‘গোপা, চলে এস। তোমার বাবা খুব অসুস্থ।’’

বললাম: যে দায়িত্বপূর্ণ কাজে বসেছি তা থেকে চলে যাওয়া যায় না মা। তা ছাড়া আজ চালিহার গুরুত্বপূর্ণ বিচার। বেশিক্ষণ থাকব না, রায়টা শেষ করেই চলে যাব। মা আর কথা বললেন না। নেমে গেলেন। ইতিমধ্যে বাবাকে আনানোর চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু বাবা আসেন নি। তারপর মাসীমাকে আনান হল। আমি ওই এক উত্তর দিলাম তারপর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সাহেব এবং ফৌজি কর্তারা একে একে এসে আসন ছাড়বার জন্য আমাকে অনুরোধ করলেন। আমি উত্তর দিলাম, ‘দেখুন আজ আমার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। চালিহার বিচারে অনেক ভেবেচিন্তে রায় দিতে হবে। বিরক্ত করবেন না। বিচার শেষ করেই আমরা এজলাস থেকে উঠে যাব।’ ওরা বললেন, ‘জানেন আপনাদের গ্রেপ্তার করা হবে।’ হেসে বললাম, ‘বলছেন জজ সাহেবকে গ্রেপ্তার করবেন আপনারা? উল্টো আদেশটা যদি আপনাদের উপর চাপাই—?’

আর কথা বললেন না কেউ। প্রায় সাড়ে এগারোটা নাগাদ সব অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হল এবং শেষ পর্যন্ত সপারিষদ জজসাহেবকে গ্রেপ্তারের আদেশ দেওয়া হল। পুলিশ সাহেব এসে সকলকে উঠতে বললেন। আমি বললাম, ‘দেখুন এখন কাউকে নিতে পারবেন না। আমাদের বিচারটা শেষ হোক। তারপর—।’ ওরা অপেক্ষা করলেন।

ঠিক বারোটায় রায় দেওয়া শেষ হলে সকলকে গ্রেপ্তার করে তুলে নেওয়া হয়। একমাত্র আমি বসে তখনও কাজ করছিলাম। সকলেই এসে আমাকে উঠে যেতে বললেন। কিন্তু আমি একটা নাগাদ সমস্ত শেষ করে জজকোর্ট বন্ধের হুকুম দিয়ে বিচারকের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। বাইরে আসার পর আমাকে পুলিশ ভ্যানে উঠতে বলা হয়। কিন্তু আমি প্রথম শ্রেণির গাড়ি ছাড়া যাব না বলে আপত্তি করি। অবশেষে পুলিশ সাহেবের গাড়িতে করে আমাকে আনা হয়। আসবার পথে হাজার লোকের জয়ধ্বনি, করমর্দন আর শুভেচ্ছায় আমাদের মন ভরে গেল। যথাসময়ে জেলে এসে পৌঁছোলাম। এখানকার সবাই আমাদের সঙ্গে ভদ্রব্যবহার করেছেন। জেলের বন্দি সত্যাগ্রহী ভাইরাও আমাদের ফুল ইত্যাদি দিয়ে শুভেচ্ছা জানালেন। আর আমাদের নেতা রথীনদা জড়িয়ে ধরে আমাদের প্রাণভরা আশীর্বাদ জানালেন।

এই নূতন ধরনের অভিজ্ঞতা লাভের কোনোদিনই হয়ত সুযোগ পেতাম না। পেয়ে ধন্য হলাম।

গত ১৪ জুন আমাদের বিচার হল। সকলে সেইদিন মুক্তি পেল শুধু জজকোর্টের সত্যাগ্রহীদের একশো টাকা জরিমানা অথবা সাতদিন কারাবাস এবং আমার দুশো টাকা জরিমানা অনাদায়ে পনের দিন কারাবাস। কিন্তু আকস্মিকভাবে গত সতেরই জুন সমস্ত রাজবন্দিই মুক্তি পেলেন।’১০৯

এ দিন অর্থাৎ ৭ জুন ‘কাছাড়ের সকল স্তরের, সকল শ্রেণির ও সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে একযোগে দাবি ওঠে যে শাস্ত্রী ফর্মুলা বাতিল করতে হবে। মাতৃভাষার স্বীকৃতিদানের দাবিতে করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, বদরপুর, ভাঙ্গা, রামকৃষ্ণনগর প্রভৃতি স্থানে এ দিন বিভিন্ন অফিসসমূহের সামনে শান্তিপূর্ণ পিকেটিং চলে। বিনা বিচারে আটক রাখার জন্য ও দ্রুত বিচার নিষ্পত্তির সম্ভাবনা না থাকার জন্য করিমগঞ্জ জেলে ভাষা আন্দোলনে ধৃত ৮৬ জন বন্দি অনশন শুরু করেছেন বলে জানা যায়।

কাছাড় জেলা কংগ্রেস কমিটি সভাপতি এবং পদত্যাগী বিধানসভা সদস্য শ্রী রণেন্দ্রমোহন দাস জানান— ‘শাস্ত্রী-ফর্মুলায় আমি সুখী হই নাই।’

এ দিন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা শিলচরে মিউনিসিপ্যাল চেয়ারম্যান শ্রীমহীতোষ পুরকায়স্থকে শিলং থেকে টেলিফোন করলে শ্রীপুরকায়স্থ বলেন, ‘শাস্ত্রী-ফর্মুলা জেলাবাসীকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি।’ শ্রীপুরকায়স্থ ভাষা আন্দোলনে ধৃত বন্দিদের বিনা শর্তে অবিলম্বে মুক্তিদানের দাবিও তাঁকে জানান।

শিলচর জেলা কংগ্রেস কমিটি এ দিন এক জরুরি সভায় শাস্ত্রী ফর্মুলার বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। গণসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকেও বলা হয় যে, শাস্ত্রী-ফর্মুলা আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়।

এ দিন শিলচর শহরে শিলচর জেলা কংগ্রেস কমিটির জরুরি বৈঠকে শাস্ত্রী-ফর্মুলা আলোচনার পর এক গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়: ‘আসামের অন্যতম সরকারি ভাষারূপে বাঙলাকে স্বীকার করার যে দাবি আমরা তুলেছিলাম, তার তুলনায় ওই ফর্মুলা অত্যন্ত নগণ্য।’ এই ফর্মুলা সম্পর্কে বিশদ আলোচনার জন্য আগামী ৯ জুন কাছাড়ের তিনটি জেলা কংগ্রেস কমিটির বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে।

শিলচর জেলা কংগ্রেস সভাপতি ও পদত্যাগী বিধানসভা সদস্য শ্রীনন্দকিশোর সিংহের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ দিনের বৈঠকে গৃহীত প্রস্তাবে আরও বলা হয় যে, কাছাড় কংগ্রেস শাস্ত্রী-ফর্মুলা সম্পর্কে মতামত দেওয়ার জন্য কাউকে এখন পর্যন্ত কোনো অধিকার দেয়নি। ফর্মুলার সরকারি ভাষ্য অবিলম্বে পাওয়ার জন্য আসাম সরকারকে অনুরোধ করা হবে বলেও বৈঠকে স্থির হয়।’

‘সংগ্রাম পরিষদ জানিয়ে দেয় যে, তাদের একমাত্র দাবি—বাংলাকে অন্যতম সরকারি ভাষারূপে গ্রহণ না করা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। আগামী ৯ জুন পরিষদের বৈঠকে ১২জুন থেকে আন্দোলনের ধরন, প্রকৃতি স্থির করা হবে।

জেলা বার, মিউনিসিপ্যাল কমিশনারগণ এবং অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সংস্থার মুখপাত্রগণ একবাক্যে বলেন, শাস্ত্রী-ফর্মুলা আসামের ভাষা সমস্যার সমাধান তো করেই নাই বরং ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ বসিয়েছে। এদিকে শিলচর বণিকসভার সভাপতি শ্রীদীপেন্দ্রচন্দ্র চৌধুরি এক বিবৃতিতে বলেন, শাস্ত্রী-ফর্মুলা কাছাড়বাসীকে সম্পূর্ণ হতাশ করেছে।

বঙ্গীয় ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শ্রী নন্দগোপাল ভট্টাচার্যের সভাপতিত্বে এ দিন গান্ধীবাগে ছাত্রদের এক বিরাট সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় শ্রীঅহীন্দ্র চক্রবর্তীও বক্তৃতা করেন। সভায় গৃহীত প্রস্তাবে পরিষ্কার করে বলা হয় যে, শাস্ত্রী-ফর্মুলা গ্রহণযোগ্য নয়।’১১০

এদিকে করিমগঞ্জে ‘সংগ্রাম পরিষদ সত্যাগ্রহীরা সরকারি অফিসগুলির সামনে পিকেটিং চালিয়ে যান। বদরপুর ও পাথারকান্দিতেও পিকেটিং চলে। সংগ্রাম পরিষদ নেতৃত্ব বলেন, পরিষদ ভাষা-আন্দোলন শুরু করেছিলেন অথচ শ্রীশাস্ত্রী পরিষদ নেতৃত্বের সঙ্গেই যোগাযোগ করতে চাননি। তাঁরা বলেন, যে-দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে শ্রীশাস্ত্রী আসামের ভাষা-সমস্যার সমাধান করতে চাচ্ছেন—তা ভ্রমাত্মক।

তাঁরা বলেন, পূর্ণ দাবি আদায় না-হওয়া পর্যন্ত তাঁদের অসহযোগ আন্দোলন চলবে। সংগ্রাম পরিষদ নেতা আরও বলেন যে, সেক্রেটারিয়েট পর্যায়ে বাংলাভাষাকে স্বীকৃতি কথাটিও শ্রীশাস্ত্রী এড়িয়ে গেছেন। অন্যান্য সুযোগসুবিধাগুলির বিষয়ও শ্রীশাস্ত্রী মৌনতা অবলম্বন করেছেন।’

৮ জুন শিলচরে সরকারের শ্যেনদৃষ্টির মধ্যেও সত্যাগ্রহীরা কয়েকটি অফিস দখল করে নেয়। সংবাদে বলা হয়, ‘স্থানীয় সরকারি কতৃপক্ষের সতর্ক দৃষ্টি সত্ত্বেও সংগ্রাম পরিষদের স্বেচ্ছাসেবকগণ সরকারি অফিসগুলিতে পুনরায় সত্যাগ্রহ চালায়। অধিকাংশ সরকারি অফিস বিশেষত আদালত কক্ষগুলিতে সৈনিকরা পাহারা দেয়। গতকাল জেলা জজের আদালতে যে সত্যাগ্রহ করা হয়, তার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।’

করিমগঞ্জের সংবাদেও জানা যায় যে, এ দিন দু’হাজার লোকের একটি মিছিল ‘বাঙলা আমাদের ভাষা’ এই ধ্বনি দিতে দিতে শহরের রাস্তা পরিভ্রমণ করে। মিছিলে বহু বালক-বালিকাও ছিল।

সংবাদে বলা হয়, ‘শিলচরে সত্যাগ্রহীরা বিশেষ তৎপরতার সঙ্গে সরবরাহ বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর ও সুপারিন্টেণ্ডেন্ট সমবায় সমিতির সহকারী রেজিস্ট্রার, বিভাগীয় ফরেস্ট অফিসার ও সাব ডিভিসন্যাল অফিসার এবং পি ডব্লিউ ডি-এর অফিস অধিকার করেন। অফিসারগণ এসে পৌঁছবার পূর্বেই সত্যাগ্রহীগণ তাঁদের ঘর দখল করে বসেন। কুমারী দীপ্তি ভরদ্বাজ অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আসন দখল করেন। সব অফিসের সমস্ত আসনে সত্যাগ্রহীগণ বসে ‘বিচার কার্য’ করেন। অবশেষে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপারিন্টেণ্ডেট ও সামরিক কর্মচারিগণ এসে পৌঁছান এবং অধিকৃত অফিসের দৃশ্য দেখতে থাকেন। বিভিন্ন অফিসে পুরুষ সত্যাগ্রহীগণকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং জিপে করে তাঁদের জেলে পাঠান হয়। তাঁরা ‘বন্দে মাতরম’ ও ‘মাতৃভাষা জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিতে থাকেন। মহিলা সত্যাগ্রহীগণকে অপসারিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ এখানে নারী পুলিশ নেই। স্থানীয় কতৃপক্ষ নারী সত্যাগ্রহীদের প্রতি বলপ্রয়োগ করতে অনিচ্ছুক বলে মনে হয়।

সত্যাগ্রহীদের ‘অফিসের কাজকর্ম’ দেখবার জন্য এক বিরাট জনতা অফিসের সম্মুখে উপস্থিত হয়। পুরুষ সত্যাগ্রহীগণকে অপসারিত করা হলে সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ করে দেওয়া হয়। নারী সত্যাগ্রহীগণ তাঁদের আসনে বসে থাকেন।’১১১ পরে অবশ্য নারী সত্যাগ্রহীরাও গ্রেপ্তার হন। এদিকে করিমগঞ্জ থেকে পি টি আই সংবাদদাতা জানান: ‘বর্তমান অবস্থায় ভাষা আন্দোলন প্রত্যাহারের কোনো প্রশ্নই আর ওঠে না।’— এক সাক্ষাৎকারে করিমগঞ্জ মহকুমা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শ্রীনৃপতি চৌধুরী উপরোক্ত মন্তব্য করেন।

শ্রীচৌধুরী বলেন, বাংলা ভাষাকে আসামের অন্যতম রাজ্যভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতেই একাদশটি প্রাণ উৎসর্গিত হয়েছে। সেই পরম ও চরম উৎসর্গের কথা আমরা ভুলতে পারি না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই দাবির স্বীকৃতি সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। সুতরাং, এখন আন্দোলন প্রত্যাহারের কোনো প্রশ্নই আর ওঠে না।

সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলন দ্বিতীয় পর্যায়ের তৃতীয় দিন আজ অতিক্রান্ত হল। ভবিষ্যৎ কার্যক্রম সম্পর্কে পন্থা নির্ধারণের জন্য এবং সমগ্র পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য কাছাড় জেলা সংগ্রাম পরিষদ আগামীকাল এক বৈঠকে মিলিত হবে বলে সংবাদে উল্লেখ করা হয়।’১১২

এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীনেহরু নয়াদিল্লিতে ৮ জুন পালাম বিমানবন্দরে দশদিন ছুটি ভোগের জন্য মানালি যাত্রার পূর্বে সাংবাদিকদের জানালেন: ‘শ্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী যে ফর্মুলার কথা বলেছেন, তা খুব ভালো। এতে কাছাড়ের সংশ্লিষ্ট সংখ্যালঘুদের ভাষার ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা, শাসনকার্য পরিচালনা এবং রাজ্য হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে বাংলা ব্যবহারের পূর্ণ স্বাধীনতা তাদের রয়েছে। এর বেশি কিছু কেউ-ই আশা করতে পারেন না।’১১৩

৯ জুন করিমগঞ্জে কাছাড় জেলা সংগ্রাম পরিষদ কর্ম সমিতি এক সভায় মিলিত হয়ে আসামে ভাষা সমস্যা সমাধানকল্পে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী যে সমাধান সূত্র বা ফর্মুলা দিয়েছেন, কমিটি সেটি গ্রহণযোগ্য নয় বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগ্রাম পরিষদ সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুর রহমান চৌধুরী। প্রস্তাবে বলা হয় যে:

শ্রীশাস্ত্রী ‘সমস্যার মূল প্রশ্নকেই পাশ কাটিয়ে গেছেন। অপর আর এক প্রস্তাবে ভাষা আন্দোলনে জাতিধর্মবর্ণনির্বিশেষে সকলের অকুন্ঠ সহযোগিতা লাভ করার জন্য কাছাড়বাসী জনসাধারণকে এবং সংগ্রাম পরিষদের কর্তব্যপরায়ণ হাজার হাজার সত্যাগ্রহীগণকে আন্তরিক অভিনন্দন জ্ঞাপন করা হয়। সভা বিভিন্নভাবে সহযোগিতার জন্য সংবাদপত্র, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, নেতৃবৃন্দ এবং সেবা প্রতিষ্ঠানগুলিকেও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। সংগ্রাম পরিষদের এই জরুরি সভায় আন্দোলনের ভবিষ্যৎ প্রকৃতি ও কার্যক্রম সম্পর্কে কয়েক ঘণ্টা আলোচনার পর স্থির হয় যে, সত্যাগ্রহের আগামী পর্যায় আরও ব্যাপক ও তীব্রতর করা হবে।

শিলচর, হাইলাকান্দি ও করিমগঞ্জের সংগ্রাম পরিষদ সভ্যরা এই সভায় যোগদান করেন। সভাকক্ষের বাইরে এক বিরাট জনতা সভার সিদ্ধান্ত জানার জন্য অপেক্ষমান ছিলেন।’১১৪

এদিকে করিমগঞ্জ মহকুমা কংগ্রেস ভাষা আন্দোলন কমিটিও শাস্ত্রীজীর প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। কমিটি আজ করিমগঞ্জে এক সভায় মিলিত হয়ে জানালেন, ‘ভাষাগত প্রশ্নে এই ফর্মুলা কোনো সমাধান করতে পারে নাই।’ আসামের প্রাক্তন মন্ত্রী হাজী মহম্মদ আলি এই সভায় পৌরহিত্য করেন। ভাষা প্রশ্ন নিয়ে জনাব আলি রাজ্য বিধানসভার সদস্যপদ ত্যাগ করেছেন।

অন্যদিকে করিমগঞ্জ থেকে অপর এক সংবাদে জানা যায় যে, এ দিন অর্থাৎ ৯ জুন ‘দশহাজারেরও অধিক কিষাণ ও মজদুরের এক শোভাযাত্রা প্রাচীরপত্রসহ করিমগঞ্জের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে বন্দীদের মুক্তি, দমননীতি প্রত্যাহার এবং বাংলাভাষার স্বীকৃতির দাবি জানায়। পরে শোভাযাত্রীগণ এক জনসভায় মিলিত হন। ১৫ হাজার লোকের এক সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন কাছাড়ের কিষাণ নেতা শ্রী যজ্ঞেশ্বর দাস। পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র ফেডারেশন সম্পাদক শ্রী নন্দগোপাল ভট্টাচার্য ও ডা. নীরদভূষণ দে সভায় বক্তৃতা করেন।’

শিলচর থেকে সংবাদে জানা যায় যে, এ দিন সত্যাগ্রহীগণ ছ’টি অফিস দখল করে নেন। অথচ অফিস নির্দেশে বলা হয়েছিল যে, সকাল ১০টায় যখন অফিস ঘরের দরজা খোলা হবে, সে সময় তাঁদের অফিস সম্মুখে উপস্থিত থাকতে হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা তাঁদের নির্দিষ্ট আসনে বসে পড়বেন। এই সরকারি নির্দেশের ফলে অফিসগুলিতে কড়া প্রহরাও মোতায়েন করা হয়েছিল। কিন্তু সত্যাগ্রহীরা নাছোড়বান্দা। তাঁরা এই জেলা শহরের অন্তত ছ’টি অফিস দখল করে নেন। সত্যাগ্রহীদের পুলিশ সুপারিনটেণ্ডেন্ট-এর অফিস দখল ছিল শিলচরে সংঘটিত আজকের ঘটনার সর্বাধিক চাঞ্চল্যকর অপ্রত্যাশিত সংবাদ। পুলিশ যখন সত্যাগ্রহীদের হাত থেকে অন্যান্য সরকারি অফিসসমূহ রক্ষায় ব্যাপৃত, সে সময় পুলিশের নিজের অফিসভবন সত্যাগ্রহীদের দখলে চলে যায়। পুলিশ সুপার অফিস প্রাঙ্গণে যে সকল সত্যাগ্রহী ছিলেন— তাঁদের সকলকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের সংখ্যা ছিল ৩০। বিভিন্ন অফিসে সম্মুখে সত্যাগ্রহ করার অপরাধে এ পর্যন্ত ১৭ জন নারী ও ৪১ জন পুরুষ সত্যাগ্রহীকে গ্রেফতার করা হয় বলে সংবাদে উল্লেখ করা হয়। গতকাল কুমারী বিন্দুধর চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হলে তিনি ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।’১১৫

এ দিন ‘শিলচরে পুনরায় ধরপাকড় শুরু হয়। সত্যাগ্রহীদের সঙ্গে সহযোগিতা করার অপরাধে একজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার অফিসের এক চৌকিদার ও অফিস ক্যান্টিনের এক কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এ ছাড়াও ছ-জন মহিলা সত্যাগ্রহী ও সাতাশজন পুরুষ সত্যাগ্রহীকে আটক করা হয়।

সংগ্রাম পরিষদের জন্য চাঁদা সংগ্রহকালে নীলামবাজারে দু-জন সত্যাগ্রহীকেও এ দিন গ্রেপ্তার করা হয়।’১১৬

১০ জুন সন্ধ্যায় শিলচরের গান্ধীবাগে এক বিশাল জনসভায় ‘যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর কাছাড়ের মানুষ ড. ত্রিগুণা সেন ভাষণদানকালে বলেন যে, কাছাড়ের যুবসমাজ মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় জাতিবর্ণ নির্বিশেষে যে আদর্শ স্থাপন করেছেন— তা তাঁকে অভিভূত করেছে। তিনি বলেন, এখানে হিন্দু, মুসলমান, মণিপুরী, হিন্দুস্থানী, ব্রাহ্মণ, শূদ্র, বাঙালি, কাছাড়ী, কংগ্রেসি, কমিউনিস্ট কোনো প্রশ্ন নেই— সকলেই একযোগে অগ্রসর কাছাড়ের জনসাধারণ যে গণশক্তির পরিচয় দিয়েছেন তা অতুলনীয়। গুলী চলার সময় মানুষ যে বুক পেতে দাঁড়াতে পারে, তা ভারতে কাছাড় ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় নাই।

তিনি বলেন, গত ১৯ মে তারিখে কাছাড়ে অনুষ্ঠিত নৃশংস অত্যাচারে বাংলার যুব সমাজ ক্ষুব্ধ হয়েছিল, মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় এগিয়ে আসতে বহু যুবক অস্থির ছিল— স্বাধীন ভারতে এরূপ অত্যাচার প্রতিরোধের জন্য প্রাণ দিতে তাঁরা উদ্যত। যিনি নিজে অসমিয়া ভাষায় কথা পর্যন্ত বলতে পারেন না— ক্ষমতার জন্য অসমিয়া ভাষার রক্ষক সেজে বাঙালিকে নিষ্পেষণে নিয়োজিত সেই ব্যক্তিকে সমুচিত শাস্তি দিতে তারা উদগ্রীব।

শ্রী সেন আরও বলেন, ‘আমি আমার ইউনিভার্সিটিতেও যুবসমাজকে উপদেশ দেই না। তাই করজোড়ে কাছাড়ের যুব সমাজকে নিবেদন করব—সর্বদা সত্যাগ্রহীর আদর্শ নিয়ে এগিয়ে যাও। সজাগ-সতর্ক দৃষ্টি রাখ, যাতে দুশমনরা বিপথগামী করতে না পারে। প্রবীণদের কাছে অনুরোধ—এই পবিত্র সংগ্রামে ক্ষমতার লড়াই যেন কোনোপ্রকার প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করতে না পারে।’

শ্রীসেন রাশিয়ার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে বলেন যে, রাশিয়ার ৬০টি জাতি ১৬টি ভাষা। প্রত্যেকটি মানুষ তার মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা লাভ করতে পারে। জওহরলালজী রাশিয়া পরিভ্রমণান্তে বলেছিলেন যে, সেখানে ভাষা সমস্যার কি সুন্দর মীমাংসা। সেখানে যদি হয়— তবে এখানে কেন হবে না? শ্রীসেন মাতৃভাষার জন্য সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন যে, আবেদন-নিবেদনে কাজ হয় না— সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলনেই দিল্লির টনক নড়েছে।

এই বিশাল জনসভায় সভাপতিত্ব করেন শ্রীসনৎকুমার চক্রবর্তী। সংগ্রাম পরিষদের শ্রী পরিতোষ পাল চৌধুরী, শ্রীমতী গায়ত্রী বিশ্বাস ও বিজন শঙ্কর রায়ও বক্তৃতা করেন।

শিলচর মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান শ্রী মহীতোষ পুরকায়স্থ তাঁর ভাষণে বলেন, শাস্ত্রী মহাশয় আমাদের দাবি যুক্তিসঙ্গত বলে স্বীকার করেও সীমান্তে শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় অসমিয়াদের অযৌক্তিক দাবির কাছে নতিস্বীকার করেছেন। কিন্তু তাঁর জানা উচিত যে, সীমান্তের একশত মাইলের মধ্যেও কোনো অসমিয়া নেই।

তিনি বলেন, সংগ্রাম শেষ হয়নি। লড়াই দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং তা আরও তীব্রতর করা হবে।’১১৭

১১ জুন করিমগঞ্জ থেকে ৮ মাইল দূরবর্তী স্থান ঝিলামবাজার অঞ্চল থেকে পাঁচ হাজারের অধিক গ্রামবাসী আজ পায়ে হেঁটে করিমগঞ্জ শহরে এসে পৌঁছান এবং বাংলাভাষাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষা করার দাবি জানিয়ে ধ্বনি দিতে দিতে তাঁরা রাজপথ পরিভ্রমণ করেন। বিক্ষোভকারীরা দুপুরে এক জনসভায় মিলিত হন এবং কয়েকজন বক্তা বাংলাভাষার পক্ষে জোরাল বক্তব্য রাখেন। সভাশেষে তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবে নিজ গ্রামে ফিরে যান।১১৮

এ দিনও সকালে করিমগঞ্জ শহরে দুটি বিরাট মিছিল ধ্বনি দিতে দিতে শহরের রাজপথ প্রদক্ষিণ করে। এ দিন রবিবার থাকায় সরকারি অফিস সম্মুখে পিকেটিং হয়নি।

সরকার পরিচালনাধীন করিমগঞ্জ মিউনিসিপ্যালিটির সাধারণ নির্বাচন ১৯ জুলাই অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। গতকাল ছিল মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ। কিন্তু কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ ও কংগ্রেস ভাষা আন্দোলন কমিটি ওই নির্বাচন বর্জন করার আহ্বান জানালে শেষ দিনে কোনো মনোনয়নপত্রই জমা পড়েনি।

এদিকে ১১ জুন কাছাড় জেলার সোনাবাড়িঘাটে শাস্ত্রী-ফর্মুলার সমর্থনে শ্রী পুলকেশী সিংহের সভাপতিত্বে প্রায় পঁচিশ হাজার লোকের এক জমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় বক্তব্য রাখেন— হাজী লোকমান আলি বড়ভুঁইয়া ,ভজনলাল বারুই, সোনাচাঁদ সিংহ, মো. জালালউদ্দিন আহমদ বড়লস্কর, হাজী আবদুল ছাত্তার কারী, কালাসেনা সিংহ, ডা. ইলিয়াছ আলি বড়লস্কর, লক্ষ্ণণ নুনিয়া, মো. কুতুব আলি এবং জনাব গোলাম জিলানী চৌধুরী।

সভায় মোট পাঁচটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভার দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলা হয়, ‘এই সভা জেলা কর্তার ৪/৬/৬১ ইং তারিখের বিবৃতিতে গভীর উদ্বেগবোধ করছে। জেলাকর্তা এমনই এক দুঃসময়ে জেলার শাসনভার হাতে গ্রহণ করেছেন— যখন তাঁর পক্ষে সব কিছু তদারক করে নিরপেক্ষ অভিমত গঠন করার পর্যাপ্ত পরিমাণে সময় ও সুযোগ পান নাই। এই সুযোগে স্বার্থসম্পন্ন মহল জেলাকর্তাকে প্রকৃত খবরাখবর না দেওয়াতেই সম্ভবত জেলাকর্তা এরূপ অনুমান করে নিয়েছেন যে, কাছাড়ের গ্রাম ও বাগান এলাকাবাসী উদ্বাস্তুদের এ জেলা থেকে তাড়িয়ে দিতে চায় এবং এজন্য উক্ত বিবৃতিতে তিনি তাদের শাসিয়েছেন। একদিকে সংগ্রাম পরিষদ ব্যাপকভাবে আইন অমান্য আন্দোলন চালিয়ে শহরে অরাজকতা সৃষ্টি করছে, দিনের পর দিন অফিস আদালতে হামলা করে জনসাধারণের অশেষ দুর্গতি বাড়িয়ে তুলছে। গ্রামাঞ্চলে তারা ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক জিগীর তুলে এক সম্প্রদায়কে অন্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তোলার চেষ্টা করছে। অথচ অফিস-আদালতে তাদের নিজেদের লোকজন থাকাতে নিরপরাধ গ্রামবাসীদের ওপর সমূহ দোষ চাপিয়ে দেবার সুবিধা পেয়ে বসেছে।

এই সভা আশা করে যে, সংগ্রাম পরিষদ জনস্বার্থে তাদের বে-আইনি ও উচ্ছৃঙ্খল আন্দোলন অবিলম্বে প্রত্যাহার করে নেবে নতুবা সরকার এই প্রতিষ্ঠানকে বেআইনি ঘোষণা করত তাদের কার্যকলাপ কঠোর হস্তে দমন করে অরাজকতার বিভীষিকা থেকে দেশকে অবিলম্বে মুক্ত করবেন।’১১৯

উল্লিখিত ওই একটি সিদ্ধান্ত থেকেই আয়োজকদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করা যায়। আমরা ইতিমধ্যেই লক্ষ করেছি যে, জুন মাসের গোড়া থেকেই চলমান অহিংস ভাষা আন্দোলনকে স্তব্ধ করার লক্ষ্যে এক শ্রেণির মানুষ নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছেন। আর একটি বিষয়, উদ্যোক্তারা জেলাশাসককেও কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে কুন্ঠাবোধ করেননি। রাজশক্তির আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়া কি এটা সম্ভব?

সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে শ্রী পরিতোষ পাল চৌধুরী এক প্রচারপত্র মারফত পরিষদের বক্তব্য জনমানসে প্রচার করেছেন। সংগ্রাম পরিষদের বক্তব্য শীর্ষক প্রচার পত্রের চতুর্থ সংখ্যক বক্তব্যে জানালেন, ‘স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মহল যেভাবে টাকা ছড়িয়ে গ্রামাঞ্চলে সাধারণ সরল মানুষের দারিদ্র্যতার সুযোগ নিয়ে বিভ্রান্তি তথা কাছাড়ের শান্ত, নির্মল, সমাজজীবনকে বিপর্যস্ত তথা বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা করছেন—জনসাধারণকে এ সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে ও সমাজদ্রোহীদের উপর কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে।’১২০

এর ফলে বিভাজন নিশ্চিত হয়ে পড়ে এবং কাছাড়ে সহিংসতার ছায়াও স্পষ্ট হতে শুরু করে যার লক্ষণ ইতিমধ্যেই প্রত্যক্ষ করা গেছে।

১২ জুন সন্ধ্যায় শিলচরে করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি এবং শিলচর এই তিন জেলা কংগ্রেস কমিটি এক সভায় মিলিত হন। একই সঙ্গে কাছাড় জেলা ভাষা আন্দোলন কমিটির সদস্যগণও মিলিত হন। এই যৌথ সভায় শাস্ত্রী-সূত্র অগ্রাহ্য করা হয়।

‘বাংলাভাষাকে অন্যতম সরকারি ভাষারূপে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য সত্যাগ্রহ চালিয়ে যাওয়ার যে সিদ্ধান্ত পূর্বে গৃহীত হয়েছিল, বৈঠকে তা পুনরায় অনুমোদিত হয় এবং বারোজন সদস্য নিয়ে একটি সংযোগরক্ষাকারী কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি সংগ্রাম পরিষদ ও অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে গণআন্দোলনের সমন্বয় সাধন করবে। ইতিপূর্বে হাইলাকান্দিতে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন কমিটির যুক্ত সভায় যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল, তদনুযায়ী এখনও কাছাড়ের যেসব সংসদ ও বিধানসভা সদস্য, পঞ্চায়েত সভাপতি ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনমূলক সংস্থার সদস্য পদত্যাগ করেননি, বৈঠকে তাঁদের আন্দোলন জোরদার করার উদ্দেশ্যে অবিলম্বে পদত্যাগ করার আহ্বান জানান হয়।

শিলচর কংগ্রেস কমিটি সভাপতি শ্রীনন্দকিশোর সিংহ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। শিলচর কংগ্রেস ভবনে সভা অনুষ্ঠিত হয়। শ্রীরবীন্দ্রমোহন দেব, শ্রীহরিসাধন চক্রবর্তী, শ্রী সুরেশ বিশ্বাস, জনাব আলতাফ হোসেন মজুমদার, শ্রীমহীতোষ পুরকায়স্থ, জনাব আবদুল হালিম চৌধুরী ও শ্রী সজীবরাজ মজুমদার প্রমুখ সভায় উপস্থিত ছিলেন।

পিটিআই সূত্রে বলা হয়, আজ করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি ও শিলচর কংগ্রেস কমিটি এবং ভাষা আন্দোলন কমিটির সম্মিলিত বৈঠকে আসামে ভাষা সমস্যা মীমাংসায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীলালবাহাদুর শাস্ত্রীর ফর্মুলা ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীনেহরুর এক বছর-মেয়াদী স্থিতাবস্থা বজায় রাখার প্রস্তাব মেনে নিতে অক্ষমতা প্রকাশ করা হয়। গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয় যে, গত ১৯ মে গৌহাটিতে কাছাড়ের প্রতিনিধিমন্ডলীর কাছে শ্রীনেহরু যে আশ্বাস দিয়েছিলেন, শ্রীশাস্ত্রীর প্রস্তাব অনুযায়ী তা পূরণ হওয়ার নয়। সুতরাং শাস্ত্রীসূত্র ও নেহরু প্রস্তাব উভয়ই অগ্রাহ্য করা হল।’১২১

১২ জুন সকালে শিলচরে ভাষা সত্যাগ্রহীরা সদর থানায় ‘হানা’ দিয়ে কিছুকালের জন্য তা ‘দখল’ করে থাকে। কিন্তু তাঁদের টানা হ্যাঁচড়া করে থানার বাইরে বের করে দেওয়া হয় এবং পুলিশ ৩৮ জনকে গ্রেফতার করে। ধাক্কাধাক্কি, টানা হ্যাঁচড়াতে ৫ জন সত্যাগ্রহী এ সময় সামান্য আহত হয়।

প্রকাশ, সংগ্রাম পরিষদ অফিস থেকে যাত্রা করে সত্যাগ্রহীরা থানার দিকে এগিয়ে যায়। থানার দেউড়িতে সশস্ত্র প্রহরী মোতায়েন ছিল। কিন্তু সত্যাগ্রহীরা তাদের ধোঁকা দিয়ে থানায় ঢুকে পড়ে এবং সত্যাগ্রহীদের মধ্যে শ্রীবেণীমাধব চৌধুরী, শ্রীচন্দন ঘোষ ও শ্রীরজত চৌধুরী বন্দেমাতরম ধ্বনির মধ্যে থানা অফিসারদের আসনগুলি দখল করে নেয়। পরে তাদের টেনে অফিসের বাইরে বের করে এনে হাজতে পাঠিয়ে দেয়।

এ দিন পূর্বাহ্নে শহরে প্রবল বৃষ্টিপাতের মধ্যে এক বিশাল শোভাযাত্রা বাদ্যভান্ড নিয়ে বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। তাঁরা মিছিলে বিভিন্ন স্বদেশী সঙ্গীত গাইতে থাকে। শহরের বাইরে থেকে আগত দুটি শোভাযাত্রীদল শহরের মিছিলের সঙ্গে যোগ দেয়।১২২

করিমগঞ্জে চারজন বিচারাধীন বন্দি ১২ জুন থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। করিমগঞ্জ থেকে ১৩ জুন পাঠানো সংবাদে বলা হল,

‘গত ১৯মে রেল স্টেশনে পিকেটিং করার অভিযোগে শ্রীরবিজিৎ চৌধুরী, শ্রী অরবিন্দ নাথ, শ্রী চিত্তরঞ্জন চক্রবর্তী ও শ্রী প্রফুল্লনাথ করিমগঞ্জ ও বদরপুরে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাঁরা তাঁদের মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির আশ্বাস চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই আশ্বাস না পাওয়ায় তাঁরা গতকাল থেকে অনশন ধর্মঘট আরম্ভ করেছেন। করিমগঞ্জ জেলে আটক ভাষা আন্দোলনের অন্যান্য বিচারাধীন বন্দীরাও ওই দাবিতে অনশন ধর্মঘট আরম্ভ করবেন বলে জানা যায়।

করিমগঞ্জের মহকুমা হাকিম, জেলা কংগ্রেস সভাপতি শ্রী রণেন্দ্রমোহন দাস, সংগ্রাম পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটি কোষাধ্যক্ষ বিশিষ্ট সাংবাদিক, স্বাধীনতা সংগ্রামী শ্রী বিধুভূষণ চৌধুরী ও কম্যুনিস্ট নেতা শ্রী যজ্ঞেশ্বর দাস জেলে অনশনব্রতীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অনশন ত্যাগের জন্য আবেদন জানান। কিন্তু এ দিন পর্যন্ত তাঁদের আবেদনে অনশনরত সত্যাগ্রহীরা সাড়া দেননি।’১২৩

এ দিন ‘সকালে প্রবল বৃষ্টিপাতের মধ্যে প্রায় ছ’হাজার নরনারীর এক বিরাট শোভাযাত্রা ব্যাণ্ডবাদ্যসহ করিমগঞ্জ শহরের বিভিন্ন রাস্তা পরিক্রমা করে। তাঁদের মুখে শ্লোগান ছিল, ‘বাংলা ভাষা আমাদের ভাষা’, ‘জান দিব জবান দিব না’ ইত্যাদি। মুষলধারে বৃষ্টি সত্ত্বেও শোভাযাত্রীরা শহর পরিক্রমা সম্পূর্ণ করে।’

করিমগঞ্জের সিনিয়র ম্যাজিস্ট্রেট এ দিন নাবালক বলে আটক পাঁচজন সত্যাগ্রহীকে মুক্তি দেন। তারা রেল লাইনে পিকেটিং করার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।

এদিকে করিমগঞ্জে আজ সংগ্রাম পরিষদ নেতৃত্ব জন সংযোগে নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করেন। সংবাদে বলা হল:

‘গ্রামবাসীদের কাছে শাস্ত্রী প্রস্তাবের অসারতা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য এবং ১৯ মে সংগ্রাম পরিষদের আরব্ধ অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সক্রিয় সহযোগিতা প্রার্থনা করে তাদের কাছে আবেদন জানাবার জন্য আজ সকালে সাইকেলযোগে ৪৩ জন সত্যাগ্রহী বদরপুরের দিকে যাত্রা করেন। মাইকযুক্ত একটি মোটরগাড়িতে করে আরও ৮ জন সত্যাগ্রহীর একটি দলও তাঁদের সঙ্গে যান। সংবাদে বলা হয়, সাইকেল-আরোহী সত্যাগ্রহী দল ছোটো ছোটো সভায় বক্তব্য রাখবেন। গ্রামবাসীদের মধ্যে অনুপ্রেরণা সঞ্চারে তাঁরা বাংলা গানও গাইবেন।’১২৪

আমরা ইতিমধ্যে শিলচর সদর থানা অভিযানের সংক্ষিপ্ত কথা বলেছি। এ বিষয়ে আরও কিছু তথ্য আমাদের হাতে এসেছে—যা বলা প্রয়োজন সেদিনের সত্যাগ্রহী আত্মজনদের কথা ভেবে। সমকালীন সংবাদপত্রে বলা হল: ‘শিলচর সদর থানায় সত্যাগ্রহ করার জন্য ১২ জুন সংগ্রাম পরিষদের ৩৮জন সত্যাগ্রহীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে হাজতে প্রেরণ করে। সকাল ৯টায় সত্যাগ্রহীগণ সংগ্রাম পরিষদের অফিস থেকে মার্চ করে এগিয়ে যান এবং জানিগঞ্জ রাস্তা দিয়ে থানা এলাকায় ঢুকে পড়েন। তাঁদের এরূপ অপ্রত্যাশিত আগমনে সেখানকার পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী হতভম্ব হয়ে পড়ে। কিছু বুঝে উঠবার পূর্বেই বন্দেমাতরম, মাতৃভাষা জিন্দাবাদ প্রভৃতি ধ্বনির মধ্যে দলপতি শ্রী বেণীমাধব চৌধুরি, শ্রী চন্দন ঘোষ ও রজত চৌধুরীসহ থানার অফিস কোঠায় প্রবেশ করে তিনটি চেয়ারে বসে পড়েন। উপস্থিত পুলিশবাহিনী ততক্ষণে সম্বিৎ ফিরে পায় এবং সত্যাগ্রহীদের পোর্টিকোতে ঘেরাও করে রাখা হয়। টানা হ্যাঁচড়ার সময় সত্যাগ্রহী শ্রীক্ষিতীশচন্দ্র নাথ, বেণীমাধব চৌধুরী, চন্দন ঘোষ ও হরিপদ দাস সামান্য আঘাত পান।’১২৫

১৩ জুন ভোরেও ‘স্বদেশী যুগের গান গাইতে গাইতে প্রভাতফেরির দলসমূহ শিলচর শহরের বিভিন্ন রাস্তা পরিভ্রমণ করে। প্রভাতফেরিতে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে যোগদান করে। গত কয়েকদিন যাবৎ সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে প্রত্যেকদিন ভোরে শোভাযাত্রা বা প্রভাতফেরি বের হচ্ছে। অতিভোরেই দলে দলে ছেলেমেয়েরা শহরের সকলঅঞ্চল থেকেই গান্ধীবাগের দিকে অগ্রসর হতে দেখা যায়। তাদের কলকাকলিতে শহরের সমস্ত রাস্তা মুখরিত হয়ে ওঠে। সংবাদে বলা হয়, শোভাযাত্রা এতই সুশৃঙ্খল ও ভাবগম্ভীরভাবে বের করা হয় যে, সকলেই শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকেন।’

এদিকে ১১ জুন কাছাড়ের মণিপুরী সম্প্রদায়ের এক বিশেষ সভায় বাংলাভাষার প্রতি সমর্থন জানানো হয়। সংবাদে বলা হয়, ‘পাথারকান্দি, দুর্লভছড়া, রিষাড়া, বিক্রমপুর, কাটাখাল ও শিলচর মহকুমার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সম্প্রদায়ের প্রায় ছশো প্রতিনিধি সভায় যোগদান করেন।

ভূতপূর্ব এম এল এ শ্রীনন্দকিশোর সিংহ, কাটাখালের বিশিষ্ট মণিপুরী নেতা শ্রী টিকেন্দ্র সিংহ, রিষাড়ার শ্রীরামরাজ সিংহ, পাথারকান্দির শ্রী সোনাচন্দ্র সিংহ ও শম্ভূ সিংহ বাংলাভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবিতে কাছাড়ে যে আন্দোলন চলছে—তার সমর্থনে বক্তৃতা করেন।

কাছাড়ের কোনো কোনো স্থানে অনুষ্ঠিত সমাজবিরোধী কাজের তীব্র নিন্দা করে ও মণিপুরী সমাজকে এসব আন্দোলন থেকে দূরে থাকার অনুরোধ জানিয়ে প্রস্তাব গৃহীত হয়। বাংলাভাষার দাবি প্রতিষ্ঠায় যে আন্দোলন চলছে—তার প্রতি সমর্থন জানিয়েও সভায় প্রস্তাব গৃহীত হয়।১২৬

‘১৯ মে ভাষা সত্যাগ্রহীদের ওপর শিলচর রেলস্টেশনে পুলিশের গুলীবর্ষণে নিহতদের পরিবারবর্গকে সাহায্যের জন্য পশ্চিমবঙ্গের ছাত্রসমাজ সংগৃহীত অর্থ ১২ জুন পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র ফেডারেশন সম্পাদক শ্রী ননীগোপাল ভট্টাচার্য বিতরণ করেন। তাঁকে সাহায্য করেন শহীদ স্মৃতি ও সাহায্য সমিতি সহ-সম্পাদক শ্রী মৃণালকান্তি দত্ত বিশ্বাস, করিমগঞ্জ কলেজ ইউনিয়ন সম্পাদক শ্রী জ্যোতি দাস, হাইলাকান্দি ছাত্র ফেডারেশন সম্পাদক, শ্রী বিষ্ণুপাল ও সহ-সম্পাদক জনাব মইনুল হক লস্কর এবং শিলচর সংগ্রাম পরিষদ প্রতিনিধি শ্রী বিজনশঙ্কর রায়।’১২৭

১৩জুন বিকালে হাইলাকান্দিতে একদল বি এস এফ ছাত্রদের ওপর আকস্মিকভাবে আক্রমণ চালিয়ে তাদের জখম করে। এই ঘটনার কথা শহরময় ছড়িয়ে পড়লে শহরে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সংবাদপত্র সূত্রে জানা যায়: ‘বিকাল প্রায় সাড়ে চারটার সময় কয়েকজন ছাত্র এন ই এস ব্লকের কাছ দিয়ে যখন যাচ্ছিল—তখন সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু সদস্য ছাত্রদের প্রতি অশ্লীল উক্তি করে অকারণে নির্মমভাবে তাদের আক্রমণ করে। নিখিলেন্দু ভট্টাচার্য, রণবীর চক্রবর্তী, পরিমল দক্ষিণা ভৌমিক, জগদীশ ভট্টাচার্য ও অন্যান্য কয়েকজন নির্মমভাবে প্রহৃত হয়।’

‘এই সংবাদ শহরে ছড়িয়ে পড়লে ছাত্ররা এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে। তারা মিছিল করে এসডিও দপ্তরে গিয়ে তাঁর কাছে প্রতিকার দাবী করে।

গণসংগ্রাম পরিষদ সভাপতি জনাব আবদুর রহমান চৌধুরী, শ্রীলোকেন্দ্রমোহন চক্রবর্তী, শ্রী ত্রৈলোক্যমোহন মোহান্ত, ডা. অমূল্য সেনগুপ্ত, জেলা কংগ্রেস কমিটি প্রেসিডেন্ট শ্রী সন্তোষকুমার রায়, শ্রী রামমোহন চক্রবর্তী, ছাত্র ইউনিয়ন সেক্রেটারি শ্রী বিভাস পুরকায়স্থ প্রমুখ এস ডি ও-র সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সকল ঘটনা তাঁকে বলেন। এস ডি ও নেতৃবর্গকে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন। এরপর শোভাযাত্রীরা রাত ন’টায় ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।’১২৮

এই সংবাদে কাছাড়ের ডেপুটি কমিশনার পুলিশ সুপারকে সঙ্গে নিয়ে শিলচর থেকে দ্রুত হাইলাকান্দি পৌঁছে যান। তাঁরাও ঘটনার আশু প্রতিকারের আশ্বাস নেন। প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য কংগ্রেস ও সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবর্গ— শ্রীমতী জ্যোৎস্না চন্দ, সর্বশ্রী বিধুভূষণ চৌধুরী, ভূপেন্দ্র সিংহ এবং পরিতোষ পাল চৌধুরীও হাইলাকান্দি পৌঁছান।১২৯

হাইলাকান্দির ঘটনার প্রতিবাদে ১৪ জুন শিলচরে ১২ হাজার লোকের এক বিশাল প্রতিবাদ মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে। সংবাদে বলা হয়: ‘১৪ জুন শিলচরে হাইলাকান্দিতে শান্তিপূর্ণ ও নিরুপদ্রব পথচারীদের ওপর সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর কতিপয় সদস্যের নির্মম অত্যাচারের প্রতিবাদে সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে আজ শিলচর শহরে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল বয়সের প্রায় ১২ হাজার লোকের এক শোভাযাত্রা দুপুরের প্রচন্ড রৌদ্রের মধ্যে শহরের বিভিন্ন রাস্তা পরিক্রমা করে। বজ্র নির্ঘোষে ‘মাতৃভাষা জিন্দাবাদ’, ‘আসাম সরকার হুঁশিয়ার, জান দিব, জবান দিব না’, ‘বুলেটকে ভয় করি না’ প্রভৃতি ধ্বনি দিতে দিতে শোভাযাত্রা গান্ধিবাগ থেকে বের হয় এবং শোভাযাত্রা অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘতর হতে থাকে।’১৩০

এদিকে কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদ করিমগঞ্জ থেকে এ দিন ঘোষণা করেন যে, আগামী ১৯ জুন জেলা জুড়ে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হবে। এ দিন কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের অফিসগুলির সামনে, রেল স্টেশনে এবং রাজ্য পরিবহণ বাস সার্ভিস স্টেশনগুলিতে পিকেটিং চালানো হবে। সব ধরনের যানবাহন চলাচল, বাজার এবং দোকানপাট বন্ধ থাকবে বলেও সংগ্রাম পরিষদ সূত্রে উল্লেখ করা হয়।

সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আজ ভোরে অর্থাৎ ১৪ জুন সাইকেল আরোহী সত্যাগ্রহীদের এক শোভাযাত্রা বের হয়। ‘প্রথমে বিরাট জাতীয় পতাকা, দু’পাশে দুটি স্কুটার, তার পেছনে সারিবদ্ধভাবে দু’টো করে সাইকেল—শত শত সাইকেল আরোহীর এই সুশৃঙ্খল শোভাযাত্রা ‘বন্দে মাতরম’ ‘মাতৃভাষা জিন্দাবাদ’, ‘সংখ্যালঘুদের ভাষা জিন্দাবাদ’, ‘জান দিব— জবান দিব না’, ‘শহিদের রক্ত— ভুলব না’ প্রভৃতি ধ্বনিসহকারে যখন শিলচর শহরের রাস্তাসমূহ দিয়ে অগ্রসর হতে থাকেন— তখন মানুষের চোখেমুখে ছিল এক অবর্ণনীয় দৃশ্য।’

১৩ জুন সন্ধ্যায় শিলচর গান্ধীবাগে কমিউনিস্ট পার্টি এক বিশাল জনসভার আয়োজন করে। সভায় ৬/৭ হাজার লোক উপস্থিত ছিল। এতে সভাপতিত্ব করেন কমিউনিস্ট নেতা শ্রী বীরেশচন্দ্র মিশ্র।১৩১

১৫ জুন তারিখেও শিলচরে সহস্রাধিক সাইকেল আরোহী সত্যাগ্রহী পথ পরিক্রমা করেন। সংবাদে বলা হয়: ‘সংগ্রাম পরিষদের ঘোষণা অনুযায়ী আজ ভোর পাঁচটায় সহস্রাধিক সাইকেলারোহী সত্যাগ্রহী প্রচারের উদ্দেশ্যে শোভাযাত্রা করে শিলচর শহরের বিভিন্ন রাস্তা পরিভ্রমণান্তে কালাইন রাস্তার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। আজ তাঁরা শহর থেকে ছ’মাইল দূরবর্তী মাছিমপুর পর্যন্ত যাবেন। সকাল থেকে অবিরাম বৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও সত্যাগ্রহীদের উদ্যম এতটুকু হ্রাস পায়নি— অতি উৎসাহের সঙ্গে অগণিত সাইকেল সারিবদ্ধভাবে বিভিন্ন ধ্বনি দিতে দিতে অগ্রসর হতে থাকেন। শোভাযাত্রার পুরোভাগে জাতীয় পতাকাসহ দু’পাশে দুটি স্কুটার তার পেছনে মধ্য রাস্তায় একটি ট্রাকে গায়কদল লাউড স্পীকার সহযোগে স্বদেশি গানসমূহ গেয়ে চলেন। ট্রাকের বনেটে বিরাট জাতীয় পতাকা— তার পেছনে সারিবদ্ধ সাইকেলের বিরাট শোভাযাত্রা এক অপূর্ব শোভা ধারণ করে।

গতকালও সাইকেলারোহী সত্যাগ্রহী দল এক শোভাযাত্রা বের করে শিলচর—হাইলাকান্দি রাস্তায় শহর থেকে ছ’মাইল দূর পর্যন্ত গিয়েছিলেন।

মাতৃভাষার উপযুক্ত মর্যাদা আদায়ের জন্য যুব সমাজের উদগ্র আকাঙ্খা ও উৎসাহ সকলকে অভিভূত করে।

এদিকে শিলচর মহকুমা গণসংগ্রাম পরিষদ ডিক্টেটর শ্রীপরিতোষ পাল চৌধুরী আজ শিলচরে ঘোষণা করেন, সংগ্রাম পরিষদের ভাষা আন্দোলনে যাঁদের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং আন্দোলনের এক মাস পূর্তি উপলক্ষে আগামী ১৯ জুন সমগ্র জেলাব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়েছে।’১৩২

অপর সংবাদে বলা হয়: শিলচর থেকে ২০ মাইল দূরে লক্ষ্মীপুরে আজ সমস্ত সরকারি অফিসে পিকেটিং করা হয়। অন্যদিকে গতকাল সন্ধ্যায় শিলচর জেল থেকে কংগ্রেস নেতা শ্রী গোলাম ছবির খান, আদিবাসী নেতা শ্রীঅনিলচন্দ্র বর্মণ, বি এল এবং যুবনেতা শ্রী নরেশচন্দ্র ভৌমিকসহ ৫৩ জন সত্যাগ্রহীকে মুক্তি দেওয়া হয়। নেতৃবৃন্দ ১৮ মে ১০৭ ধারা অনুযায়ী গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এবং অপর সত্যাগ্রহীরা পিকেটিং-এ গ্রেপ্তার হন। অফিসে সত্যাগ্রহকারী শ্রীমতী দীপ্তি ভরদ্বাজ ও শ্রীমতী নীলিমা চক্রবর্তীও তাঁদের মধ্যে আছেন।১৩৩

গতকালই লক্ষ্মীপুরে ‘সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে সত্যাগ্রহ করার জন্য শ্রী রণজিৎ রাউত, প্রশান্ত কুমার দে, নারায়ণচন্দ্র রায়, শেখরচন্দ্র নাথ, কৌশিকচন্দ্র দে, হারাধন গুপ্ত, গোপালচন্দ্র দাস, মনোরঞ্জন রায়, ক্ষীরোদচন্দ্র রায় চৌধুরী, অঞ্জন ভট্টাচার্য, কামাখ্যা ভট্টাচার্য ও প্রণয় দেব নামক ১২ জন পুরুষ ও শ্রীমতী বীরবালা দত্ত, শ্রীমতী প্রভারাণী রায় ও শ্রীমতী রেণুকা রায়কে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাঁদের মোটর বাসযোগে শিলচরে পাঠানোর প্রাক্কালে এক বিরাট জনতা সমবেত হয়ে বিভিন্ন ধ্বনি সহকারে তাঁদের বিদায় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে। এরপর ওই বিশাল জনতা মিছিল সহকারে লক্ষ্মীপুর বাজার ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল পরিভ্রমণ করে। মিছিলে হিন্দু-মুসলমান, মণিপুরী, হিন্দুস্থানীসহ সকল সম্প্রদায়ের লোকই যোগদান করেন।

করিমগঞ্জে এ দিন অর্থাৎ ১৫ জুন তারিখেও বিভিন্ন সরকারি অফিস ও আদালত ভবনগুলির সামনে সংগ্রাম পরিষদের স্বেচ্ছাসেবকগণ পিকেটিং করেন। কিন্তু তঁরা অফিস অভ্যন্তরে প্রবেশ করেননি।’১৩৪

অবশেষে কাছাড়ের মানুষের সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলনের চাপে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী নতুন করে আলোচনায় বসার সম্মতি জানালেন। প্রকাশ, ‘কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তর হিংসাত্মক কাজে ধৃত বন্দিগণ ছাড়া আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত সকল বন্দিকে অবিলম্বে মুক্তিদানের নির্দেশ দেন। তদনুযায়ী করিমগঞ্জ জেলে ‘হিংসাত্মক কার্যে অভিযুক্ত’ ২৮ জন বন্দী ছাড়া শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দির সকল বন্দিকে এ দিন রাতে অর্থাৎ ১৬ জুন রাতে মুক্তিদানের ব্যবস্থা হয়। শিলচর জেলের সম্মুখে দশ হাজার লোকের এক জনতা এবং শহরের পথে পথে অসংখ্য নাগরিক মুক্ত বন্দিদের অভ্যর্থনা জ্ঞাপনের জন্য সমবেত হন। কিন্তু করিমগঞ্জের ওই ২৮ জনকে মুক্তিদান করতে সরকার তখন পর্যন্ত সম্মত না হওয়ায় শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি— এই তিনটি জেলের কোনো বন্দীই জেল ত্যাগ করতে রাজী হননি। তবে প্রকাশ, আজ শনিবার ওই ২৮ জন সহ সকল বন্দীর মুক্তিলাভের সম্ভাবনা আছে।

খবরে আরও বলা হয়, ‘কংগ্রেস ভাষা আন্দোলনের আহ্বায়ক শ্রী রণেন্দ্রমোহন দাস শ্রী শাস্ত্রী বরাবর এক তারবার্তায় জানান, নতুন প্রস্তাব মতো বন্দিগণের মুক্তিদানের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা ও সংগ্রাম পরিষদ ১৯ জুনের সর্বাত্মক হরতাল ও আন্দোলন সাময়িকভাবে স্থগিত রাখতে রাজী আছেন। এ দিন রাতে করিমগঞ্জে সংগ্রাম পরিষদের এক জরুরি বৈঠক বসে।’১৩৫

পি টি আই-এর সংবাদে বলা হয়, ‘কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদ আজ সমগ্র জেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য সত্যাগ্রহ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

সংগ্রাম পরিষদ ১৯ জুন সমগ্র জেলাব্যাপী যে হরতাল আহ্বান করেছিলেন, তাও প্রত্যাহার করা হয়েছে। কাছাড়ের ডেপুটি কমিশনার শ্রী আর কে শ্রীবাস্তব এই সংবাদ ঘোষণা করে বলেন, কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে আজ অপরাহ্নে তাঁর ও কাছাড় জেলা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের মধ্যে সুদীর্ঘ আলোচনার পর উক্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। শ্রীবাস্তব বলেন, আলোচনাকালে স্থির হয় যে, কাছাড়ে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে যে সমস্ত সত্যাগ্রহী বর্তমানে বিচারাধীন ও বন্দী আছেন এবং যাঁদের নিবারক নিরোধ আইন অনুযায়ী গ্রেফতার করা হয়েছে, তাঁদের সকলকে আজ মুক্তি দেওয়া হবে। অন্তর্ঘাতী ও হিংসাত্মক কার্যকলাপের অভিযোগে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদেরও মুক্তি দেওয়া হবে।

তিনি বলেন, ‘পরিষদ অবিলম্বে সমগ্র জেলার অনির্দিষ্টকালের জন্য সত্যাগ্রহ আন্দোলন স্থগিত রাখতে সম্মত হয়েছেন। তিনি বলেন, এর ফলে পরিষদের নেতৃবৃন্দের সন্তোষজনকভাবে ভাষা সমস্যার সমাধানের উদ্দেশ্যে সুবিধা অনুযায়ী দিল্লিতে গিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীলালবাহাদুর শাস্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার সুবিধা হবে।’১৩৬

১৭জুন অবশেষে প্রায় তিনশো সত্যাগ্রহী শিলচর, করিমগঞ্জ এবং হাইলাকান্দি জেল থেকে মুক্তিলাভ করেন। সংবাদে বলা হল: ‘শিলচরে আজ বেলা দেড়টা নাগাদ ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের স্থানীয় জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।

এই সংখ্যা ১৫৭ জন, তার মধ্যে ১৭ জন মহিলা। ভাষা আন্দোলনে নিরাপত্তা বন্দী শ্রী রথীন্দ্রনাথ সেন, এবং কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শ্রী নলিনীকান্ত দাসও অন্যান্য বন্দীদের সঙ্গে আজ মুক্তি লাভ করেন।

এ ছাড়া করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি জেল থেকেও ভাষা আন্দোলনে ধৃত সমস্ত বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়। শিলচর, হাইলাকান্দি ও করিমগঞ্জ এই তিন জেল থেকে তিন শতাধিক বন্দী মুক্তিলাভ করেন।’১৩৭

অপর সংবাদপত্র কাছাড় জেলা ডেপুটি কমিশনারকে উদ্ধৃত করে জানালেন, ‘করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি ও শিলচরের জেলা জেল থেকে মোট ২৯০ জন সত্যাগ্রহী বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়। সংগ্রাম পরিষদ নেতা শ্রী রথীন্দ্রনাথ সেন, শ্রী নলিনীকান্ত দাস এবং শ্রী নিশীথরঞ্জন দাসকে নিবর্তনমূলক আটক আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাঁদেরও বিনা শর্তে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তিলাভের পর সত্যাগ্রহীদের নিয়ে দশ হাজারেরও অধিক লোকের এক বিরাট শোভাযাত্রা জেলগেট থেকে শিলচর গান্ধীবাগের উদ্দেশ্যে রওনা হন। সেখানে জনগণের উদ্দেশ্যে শ্রী রথীন্দ্রনাথ সেন বলেন, তাঁরা যেন অতিমাত্রায় পুলকিত না হন। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার ন্যায়সঙ্গত দাবী পূরণের জন্য প্রয়োজনবোধে তাঁদের বৃহত্তর সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

এরপরে শোভাযাত্রীরা শ্মশানঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা হন। সেখানে সত্যাগ্রহীরা পুলিশের গুলীতে নিহত শহিদদের সমাধিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন।’১৩৮

অপর সংবাদে জানা যায়, ১৭ জুন তিনটি জেল থেকে মুক্ত সত্যাগ্রহীদের সংখ্যা এরকম: ‘শিলচর জেল থেকে ১৭৯ জন, করিমগঞ্জ থেকে ৮২ জন এবং হাইলাকান্দি থেকে ২৯ জন। এ ছাড়া নিবর্তনমূলক আটক আইনে ধৃত তিনজনকেও এ দিন মুক্তি দেওয়া হয়। ‘হিংসাত্মক কার্যকলাপের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে বিচারের জন্য অপেক্ষারত ৫৯ জনকেও ব্যক্তিগত মুচলেকায় মুক্তি দেওয়া হয়েছে।’১৩৯

বন্দী সত্যাগ্রহীদের মুক্তি দেওয়ায় এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কাছাড় সংগ্রাম পরিষদ এবং কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে নতুন করে আলোচনায় সম্মত হওয়ায় আন্দোলন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হল ১৭ জুন তারিখে। পরিস্থিতি ছিল শান্ত।

কিন্তু তারপরও ১৯ জুন হাইলাকান্দিতে ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয়। আর এ দিনেই শিলচরে পালিত হল একাদশ শহীদ স্মরণ উৎসব। মে মাস থেকেই দাঙ্গার নমুনা লক্ষ করা গেছে। এমনকী জেলা কর্মকর্তা শ্রী আর কে শ্রীবাস্তব বিবৃতি দিয়ে কাছাড় জেলায় সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার কথা স্বীকার করেন। কার্যত দাঙ্গা অনিবার্য ছিল। এ দিনের ঘটনা সম্পর্কে সংবাদে বলা হয়, ‘ভাষা আন্দোলনকে বানচাল করার জন্য গত মাসাধিককালব্যাপী বিভিন্নমুখী চেষ্টা গতকাল অর্থাৎ ১৯ জুন শিলচর থেকে ৩০ মাইল দূরবর্তী মহকুমা শহর হাইলাকান্দিতে উচ্ছৃঙ্খল আকারে দেখা দেয়। জনতা গৃহদাহ, লুঠতরাজ ইত্যাদি এমন ব্যাপক আকারে আরম্ভ করে যে, পুলিশকে দু’বার গুলী চালাতে হয় এবং তার ফলে এ দিন রাত ৯টা পর্যন্ত অন্তত ৭ জন নিহত এবং ৩০/৪০ জন আহত হয়। সান্ধ্য আইনের মধ্যেও রাত ৭টায় জনতা পুনর্বার আক্রমণ চালালে পুলিশ দ্বিতীয়বার গুলিবর্ষণ করে। শহরে সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। একই সঙ্গে ১৪৪ ধারাও বলবৎ থাকে।’

প্রকাশ, সকাল এগারোটায় একই সময়ে তিন দিক থেকে দশ সহস্রাধিক লোকের জনতা শহরের উপকন্ঠে উপনীত হয়। মহকুমা প্রশাসক তাদের শহরের ভেতরে প্রবেশ করতে নিষেধ করেন। জনতা শহরের ভেতরে মসজিদে নামাজ পড়বার জন্য জেদ করতে থাকলে হাইলাকান্দি শহরে উপস্থিত আসামের আই জি পি হায়দার হোসেনের চাপে মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট তাদের শহরে প্রবেশের অনুমতি দেন।

তিন দিকের জনতা ‘‘আল্লাহো আকবর’’, ‘‘চালিহা সরকার জিন্দাবাদ’’, ‘‘অসমীয়া ভাষা শিখতে হবে’’ ইত্যাদি একই প্রকারের ধ্বনি সহকারে শহরে প্রবেশ করে কোর্ট ময়দানে সমবেত হয় এবং নিকটবর্তী পথিপার্শ্বস্থ স্টলসমূহে লুঠপাট চালায়। মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের ক্রমাগত চেষ্টার ফলে সমবেত জনতা বিভিন্ন দলে শহরের বাইরের দিকে রওনা হয়। উত্তরদিকে রওনা হয়ে সরকারি ডাক্তারখানার পার্শ্ববর্তী রাস্তায় অগ্রসর হয়ে শহরের প্রায় সীমান্তবর্তী মসজিদে কতকলোক প্রবেশ করে এবং অল্পক্ষণ পরেই লাঠিসোটায় সজ্জিত হয়ে বের হতে থাকে এবং সঙ্গে সঙ্গেই বাইরের জনতাকেও নিকটবর্তী মুসলমান দোকানসমূহ থেকে লাঠি সরবরাহ হতে থাকে। এভাবে লাঠিসোটায় সজ্জিত হয়ে এই বিরাট জনতা ‘‘আল্লাহো আকবর,’’ ‘‘আসাম সরকার জিন্দাবাদ’’ ইত্যাদি ধ্বনি দিতে দিতে হিন্দু দোকানসমূহ লুঠ করতে করতে অগ্রসর হতে থাকে এবং উদ্বাস্তু কলোনীতে প্রবেশ করে ব্যাপক লুঠতরাজ ও গৃহদাহ আরম্ভ করে দেয়। এরূপ অতর্কিতভাবে বিপুল জনতার আক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব না হওয়ায় দূর্বৃত্ত দল অব্যাহত গতিতে দুষ্কার্য চালাতে থাকে।’

‘হাইলাকান্দি থেকে ছ’মাইল দক্ষিণে মনাছড়ায় গৃহদাহ, লুঠতরাজ ইত্যাদির খবর পেয়ে মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট পূর্বেই সেখানে চলে গিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে বিভাগীয় কমিশনার ও পুলিশের ডি আই জি-ও হাইলাকান্দি উপস্থিত হন। কিন্তু কোনো সক্রিয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা গৃহীত হয় না, দারুণ এক অরাজকতা চলতে থাকে।… পুলিশ ও মিলিটারি নির্বাক নিষ্ক্রিয় দর্শকের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে।

মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীকে বিমানে উঠিয়ে দেওয়ার জন্য ‘ডেপুটি কমিশনার শ্রী আর কে শ্রীবাস্তব কুম্ভীরগ্রাম বিমানবন্দরে চলে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে প্রায় দু’টার সময় তিনি শিলচর ফিরে অঘটনের খবর পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে হাইলাকান্দি রওনা হয়ে যান। অবস্থা সম্পূর্ণ আয়ত্তের বাইরে চলে যাওয়ায় প্রথমে কাঁদুনে গ্যাস ছেড়ে জনতা ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তা নিষ্ফল হওয়ায় গুলী চালান হয়। ঘটনাস্থলে দু-জন মারা যায় ও ৬/৭ জন আহত হয়। জনতা তখনকার মতো ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

উপস্থিত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাগণ এ সময় শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের এক সভা ডেকে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন। শহরে সান্ধ্য আইন সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত বলবৎ করা হয়। মহকুমার সর্বত্র ১৪৪ ধারা অনুসারে সভাসমিতি ও মিছিল করা এবং অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চলাফেরা নিষিদ্ধ করা হয়। অবস্থা অনেকটা আয়ত্তের মধ্যে আসে।

কিন্তু সন্ধ্যার পর সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে পুনর্বার এক বিরাট জনতা পূর্ববর্তী উদ্বাস্তু কলোনিতে পুনরায় আক্রমণ করে। পুলিশ এই মারমুখী জনতাকে কোনোপ্রকারে ছত্রভঙ্গ করতে না পেরে পুনরায় গুলী চালাতে বাধ্য হয় এবং কিছুসংখ্যক লোক হতাহত হয়। উদ্বাস্তু কলোনির নিকটবর্তী হাইলাকান্দি কলেজভবনও আক্রান্ত হয়।

হাইলাকান্দি কাটাখাল রাস্তার ওপর বোয়ালীপার লক্ষ্মীরবাদ ও জানকীবাজার অঞ্চলে হিন্দুদের গৃহসমূহ বিশেষভাবে উদ্বাস্তুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। হাইলাকান্দির ৬ মাইল দক্ষিণে মনাছড়ায় দূর্বৃত্তরা মনাছড়া পোস্ট অফিস লুঠ করে এবং স্টেশনের নিকটবর্তী হিন্দুদের দোকানসমূহ লুঠ করে জ্বালিয়ে দেয় বলে সংবাদ পাওয়া গেছে।’১৪০

হাইলাকান্দিতে শেষপর্যন্ত ১০ জনের মৃত্যু সংবাদ জানা যায়। এদের মধ্যে ছ’জনের গুলির আঘাতে এবং দু-জনের অন্য অস্ত্রের আঘাতে মৃত্যু হয় বলে খবরে উল্লেখ করা হয়। ১৪ জন আহত ব্যক্তিকে হাইলাকান্দি হাসপাতালে ভরতি করা হয়েছে। এদের মধ্যে আটজনের দেহে গুলির আঘাতে জখম রয়েছে। বিশিষ্ট কংগ্রেসসেবী শ্রীরবীন্দ্রকান্ত সেনসহ বাকি ছ’জন অন্য অস্ত্রের আঘাতে আহত। শ্রীসেন জনতাকে শান্ত করতে গিয়ে জখম হন।

শ্রী গৌরীশঙ্কর রায় এম এল এ’র ভাই শ্রী শিবশঙ্কর রায়ের একটি ট্রাক আক্রান্ত হয় এবং উক্ত ট্রাকে যে দু-জন শ্রমিক ছিল—তাদের হত্যা করা হয়। মুসলিম জনতা প্রধানত উদ্বাস্তু উপনিবেশগুলিতেই হানা দেয়, মহকুমার সর্বত্র প্রায় দুশো গৃহ ভস্মীভূত হয়। পুলিশের ইনস্পেকটর জেনারেল হায়দার হোসেন, ডিভিশন্যাল কমিশনার শ্রী বি এল সেন এবং ডি আই জি লালা বি কে দে সকলেই গতকাল অর্থাৎ ১৯ জুন সকাল থেকেই হাইলাকান্দিতে উপস্থিত ছিলেন।

প্রায় পনেরো হাজার মুসলমান একই সঙ্গে শহরের তিন দিক থেকে অগ্রসর হয়।’

‘আসামের রাজ্যপাল জেনারেল এস এম শ্রী নাগেশ কাছাড় জেলার হাইলাকান্দি মহকুমাকে ১৯ জুন থেকে দু-মাসের জন্য ‘উপদ্রুত এলাকা’ বলে ঘোষণা করেছেন। আসাম সরকারের গেজেটের এক অতিরিক্ত সংখ্যায় এই ঘোষণা করে বলা হয়, ‘কাছাড় জেলার হাইলাকান্দি মহকুমায় এত উপদ্রুত ও বিপজ্জনক অবস্থা দেখা দিয়েছে যে, অসামরিক প্রশাসনের সাহায্যার্থ সশস্ত্র সেনাবাহিনী ব্যবহারের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।’১৪১

দূর্বৃত্ত দল শিলচরেও হামলা চালাতে অগ্রসর হয়। কিন্তু প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বনের ফলে শেষপর্যন্ত দাঙ্গাকারীদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ঘটনার বিবরণে বলা হয়: ১৯ জুন রাতে অসমীয়া ভাষার সমর্থনে ধ্বনি দিতে দিতে এক শ্রেণির বহুসংখ্যক লোক শিলচর শহরে প্রবেশ করার চেষ্টা করলে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী ও পুলিশ ফোর্স প্রবেশপথগুলি আগলে থাকে। ২০ জুন সকালে সরকারি কর্মচারিগণ জানান, উত্তেজিত জনতা তারাপুর, সোনাই রোড, শিলকুড়ি রোড ও লক্ষ্মীপুর রোড— এই চারটি রোড দিয়ে শিলচর শহরে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেনাবাহিনী তাদের দূরে সরিয়ে রাখে। অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার জনাব এ আহমেদ সামরিক সাহায্য চেয়ে পাঠান এবং লাউডস্পীকার মারফৎ জনতাকে সাবধান করে দেন যে, তারা শহরে প্রবেশের চেষ্টা করলে সেনাবাহিনী গুলী চালাবে।’১৪২ ফলে, অধিক রাতে মারমুখী ক্রুদ্ধ জনতা শহরে ঢুকতে না পেরে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। শিলচরের মানুষ ধনে-প্রাণে বাঁচে। এখানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।

হাইলাকান্দি হামলাকে কেন্দ্র করে পুনরায় আসাম সরকারের কৃষি ও সরবরাহ মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীর নাম বিভিন্ন মুখে ফিরতে থাকে। অতীতে বিভিন্ন সময়ে গোয়েন্দা খাতায় তাঁর নাম রয়েছে। তিনি ১৯৫০ সালে গৃহবন্দী এবং কারারুদ্ধও হন। মুক্তির পর আসাম সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী পরবর্তীতে ভারতের রাষ্ট্রপতি জনাব ফকরুদ্দীন আলি আহমদ মুসলিম লীগের গোঁড়া সমর্থক পাকিস্তানের জনক কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর এককালীন পি এ মইনুল হক চৌধুরীকে কংগ্রেসে যোগদানের লিখিত আহ্বান জানান এবং তিনি তাঁর কিছু সংখ্যক অনুসারী নিয়ে কংগ্রেসে যোগদান করেন। এহেন মইনুল হক চৌধুরীর রহস্যময় গতিবিধির একটি খতিয়ান তুলে ধরা যেতে পারে। সংবাদপত্র মন্ত্রী মহোদয়ের নাম না করে জানাল:

হাইলাকান্দির ঘটনার পটভূমিকায় আসামের জনৈক মন্ত্রীর রহস্যজনক গতিবিধি বিভিন্ন মহলে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। দিন সাত আগে শিলং থেকে পি টি আই প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, উক্ত মন্ত্রী কাছাড় কংগ্রেসের আমন্ত্রণে কাছাড় সফরে যাচ্ছেন। কাছাড় কংগ্রেসের মুখপাত্র পরদিনই সংবাদপত্র মারফৎ প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, ওই মন্ত্রী মহোদয়কে তাঁরা কেউই আমন্ত্রণ জানাননি, তিনি স্বেচ্ছায় তথায় আসছেন।

তারপর সবই রহস্যময়। উক্ত মন্ত্রীর শিলং থেকে সোজা শিলচর যাওয়ার কথা। কিন্তু ১৬ জুন শুক্রবার সন্ধ্যায় হঠাৎ তাঁকে দেখা গেল, কলকাতার চৌরঙ্গীপাড়ায়। ১৭ জুন অর্থাৎ শনিবার ভোরেই তাঁর অন্তর্ধান। তিনি ওই দিনই বিমানে শিলচর পাড়ি দিয়েছেন। শিলচর পৌঁছেই মন্ত্রী মহোদয়কে অত্যন্ত কর্মব্যস্ত দেখা যায়। তিনি দিনের বেলা জেলার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরতে লাগলেন এবং রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কয়েকজন মুসলমান নেতার সঙ্গে তাঁর রুদ্ধদ্বার গোপন বৈঠক চলে।

১৭ এবং ১৮ জুন এভাবেই কাটে। ১৯ জুন সকালে মোটর গাড়িতে বদরপুর— জোয়াই রোড হয়ে তাঁর শিলং ফেরার কথা। কিন্তু কী আশ্চর্য, বেলা ১১টায় তিনি কুম্ভীরগ্রাম বিমানঘাঁটি রওনা হন। অর্থাৎ তিনি কলকাতা যাবেন। কাছাড়ের ডেপুটি কমিশনার তাঁকে বিমান ঘাঁটিতে পৌঁছে দিতে গেলেন। শিলচর শহরে বেলা ২টায় ডিসি ফিরে শোনেন, ঘণ্টাখানেক আগে হাইলাকান্দিতে আগুন জ্বলেছে।

১৯ জুন সন্ধ্যায়ই মন্ত্রী মহোদয় কলকাতায় পৌঁছলেন। পরদিন তাঁর শিলং যাওয়ার কথা। রাতে পি টি আই মারফত বিভিন্ন সংবাদপত্র অফিসে তাঁর এক বিবৃতি আসল। কি ব্যাপার? পড়ে জানা গেল এতে আছে হাইলাকান্দির গুলিচালনা সম্পর্কে মন্ত্রী মহোদয়ের প্রতিক্রিয়ার বিবরণ। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, মূল ঘটনার কোনো বিবরণ তখনও কাগজের অফিসে পি টি আই পাঠাননি। এই বিবরণ আসে মন্ত্রী মহোদয়ের বিবৃতি প্রচারের কিছু পরে। ওই বিবৃতিতেই আরও জানা গেল, তিনি শিলং যাত্রা বাতিল করে ২০ জুন, মঙ্গলবার সকালে কাছাড় যাচ্ছেন।

আরও জানা যায়, উক্ত মন্ত্রী গত শনিবার (১৭ জুন) শিলচর পৌঁছানোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আসামের আই জি পি হায়দার হোসেন কাছাড়ে উপস্থিত হন।’১৪৩

মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীর কলকাতায় দেওয়া বিবৃতির প্রতিবাদ জানালেন শিলচর মিউনিসিপ্যালিটি চেয়ারম্যান শ্রীমহীতোষ পুরকায়স্থ। তিনি ১৯ জুন হাইলাকান্দিতে সংঘটিত ঘটনা সম্পর্কে এক বিবৃতি দেন ২০ জুন। শ্রীপুরকায়স্থ বিবৃতিতে বলেন: ‘ওই ঘটনার সঙ্গে বাংলাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণার দাবিতে কাছাড়ের আন্দোলনের যোগ নেই। বাংলা ভাষা আন্দোলনের সমর্থক ও তার বিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষের ফলেই হাইলাকান্দির ঘটনার উদ্ভব হয়েছে বলে আসামের কৃষিমন্ত্রী জনাব মইনুল হক চৌধুরী গতকাল কলকাতায় যে বিবৃতি দেন—তার প্রতিবাদ করে শ্রীপুরকায়স্থ বলেন যে, সংগ্রাম পরিষদ তিনদিন আগে সত্যাগ্রহ আন্দোলন স্থগিত রেখেছে। কৃষিমন্ত্রীর বিবৃতি ‘ভিত্তিহীন ও ভ্রান্ত’ বলে তিনি মন্তব্য করেন।’১৪৪

২০ জুন আগ্নেয়াস্ত্র সজ্জিত দুর্বৃত্তগণ ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিতে দিতে এ দিন পুনরায় উদ্বাস্তু কলোনী আক্রমণ করে। সংবাদে বলা হয়, ‘রাত প্রায় ১১টা, সাড়ে ১১টায় আসামের কৃষিমন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীর স্বগ্রাম সোনাবাড়িঘাট থেকে আরম্ভ করে শিলঢুবী পর্যন্ত মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলের ৪/৫শো দুর্বৃত্ত বন্দুক ও অন্যান্য মারাত্মক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ‘‘আল্লা হো আকবর’’, ‘‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’’ ইত্যাদি ধ্বনি দিতে দিতে শিলঢুবীর সন্নিকটবর্তী পানি ভরা (পিতল বিল) উদ্বাস্তু কলোনী আক্রমণ করে।

দূর্বৃত্তরা ৪/৫টা বন্দুক থেকে ক্রমাগত গুলী করতে করতে অগ্রসর হতে থাকায় কলোনীবাসীরা প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও, কোনোরূপ প্রতিরোধ করতে পারেনি। দুর্বৃত্তেরা গ্রামে প্রবেশ করে চতুর্দিকে ছড়িয়ে ক্ষণিকের মধ্যে কলোনীস্থিত ২৬টি বাড়ির সমস্ত দ্রব্যাদি লুঠপাট করে ক্রমাগত আগুন ধরাতে থাকে— ১৬টি বাড়ির প্রায় ৪০ খানা ঘরে আগুন দিয়ে লুন্ঠিত দ্রব্যসহ তারা গ্রাম ত্যাগ করে। মেয়ে ও শিশুরা চতুর্দিকস্থ জঙ্গলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরে নরসিংপুর আঞ্চলিক পঞ্চায়েতের প্রেসিডেন্ট শ্রী জিতেন্দ্রনাথ চৌধুরি মিলিটারিসহ ঘটনাস্থলে গিয়ে শিশু ও মেয়েদের নতুনবাজারে স্থানান্তরিত করেন। পুরুষেরা গ্রামে আছে। কন্ট্রাক্টার বিহারীলাল পালের ক্যাম্প-আসবাবপত্র মোটর টায়ার ও অন্যান্য সামগ্রী জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।… এরা সকলেই সোনাবাড়িঘাট থেকে শিলঢুবীর মধ্যবর্তী স্থানের অধিবাসী এবং তারা শিলঢুবীর তেমোহনীতে জড় হয় এবং সেখান থেকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বন্দুকের আওয়াজ করতে করতে অগ্রসর হয়।

শিলচর মহকুমার বিভিন্ন স্থান থেকেও অনুরূপ প্রচেষ্টার খবর ক্রমাগতই পাওয়া যায়। এদিন শিলচরে সান্ধ্য আইন জারি করা হল। শিলচর শহর ও এর চতুর্দিকস্থ ১ মাইল এলাকা আজ ২১ জুন সন্ধ্যা ৭টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত এক সপ্তাহের জন্য কারফিউ বলবৎ থাকবে।’১৪৫

এদিকে কেন্দ্রের কতিপয় মন্ত্রী আসামের তৎকালীন পরিস্থিতিতে উদবেগ প্রকাশ করেন। তাঁরা ২১ জুন অপরাহ্নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী শ্রী অশোককুমার সেন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন।

আলোচনাকালে ‘পুর্তকার্য, গৃহ নির্মাণ এবং সরবরাহ বিভাগের সহকারী মন্ত্রী শ্রী অনিলকুমার চন্দও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।’

বলা হয়, ‘সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ তাঁদের আন্দোলন স্থগিত রাখার পরে এবং তাঁরা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁদের দাবি সম্পর্কে আলোচনার জন্য নয়াদিল্লিতে আসার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারও পরে হাইলাকান্দিতে এই দাঙ্গাহাঙ্গামা হওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকার এই দাঙ্গাহাঙ্গামার গুরুত্বের প্রতি বিশেষভাবে অবহিত হয়েছেন বলে জানা গেছে।

এ কথাও বলা হয়েছে যে, মুসলমানেরা হাইলাকান্দিতে যে গুণ্ডামি করেছে, তা স্বাধীনতালাভের পূর্ববর্তীকালে মুসলিমলিগের কার্যকলাপের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং এটা সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারা গেছে যে, মুসলমানদের জন্য সমগ্র আসাম দখল করবার উদ্দেশ্যে হাইলাকান্দির দাঙ্গাহাঙ্গামাকারীরা মুসলিমলিগপন্থীদের অনুরূপ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

আরও মনে করা হয় যে, শিলচরে এবং হাইলাকান্দিতে কয়েকজন দায়িত্ববোধশূন্য মুসলিম লিগপন্থী নেতা এই বিপজ্জনক খেলায় মেতে উঠেছে। তাদের কার্যকলাপের ফলে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলিতে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে— তাঁরা সেকথা ভুলে গেছে। আজ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার বৈঠকে জনৈক মন্ত্রী হাইলাকান্দির দাঙ্গাহাঙ্গামার কথা উল্লেখ করেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শ্রীনেহরু নাকি এরূপ অভিমত প্রকাশ করেন যে, বর্তমানে তাঁদের পক্ষে এ বিষয়ের আলোচনা না করাই ভাল।’১৪৬

হাইলাকান্দিতে ১৯ এবং ২০ জুন ভয়াবহ দাঙ্গাহাঙ্গামার পরও ষড়যন্ত্র থেমে যায়নি। ষড়যন্ত্রের জাল আরও সুবিস্তৃত করতেই এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে জোর তৎপরতা লক্ষ করা গেল। শিলচর থেকে প্রেরিত সংবাদে বলা হল:

কাছাড় মুসলমানদের গোপন সভা হইতেছে। গত পরশু মেহেরপুরে (?) মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীর নিকট আত্মীয় জনাব গোলাম জিলানী চৌধুরীর গৃহে অনুষ্ঠিত এক সভায় কাছাড় কল্যাণ সমিতি গঠিত হইয়াছে।

মুসলমানদের শিলচর বাজারের হিন্দুদের দোকান বর্জন করার জন্য প্ররোচিত করা হইতেছে এবং কাছাড়ের পাকিস্থানভুক্তি সাপেক্ষ মুসলমানদের অন্য পৃথক দোকান ও বাজার স্থাপনের সিদ্ধান্ত হইয়াছে। কাছাড়ে পাকিস্থানি মুসলমানবাসীদের সংখ্যা প্রায় এক লক্ষ, তাঁহারা ‘পাকিস্থান জিন্দাবাদ’ জিগীর তুলিয়া অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজে নেতৃত্ব করিতেছে।১৪৭

শিলচর মিউনিসিপ্যালিটি চেয়ারম্যান শ্রীমহীতোষ পুরকায়স্থ হাইলাকান্দি পরিদর্শন করে শিলচর ফিরে এসে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘দাঙ্গা আরম্ভ হওয়ার কিছু পূর্বে হাইলাকান্দিতে অনেক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারি উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও ওইরূপ হাঙ্গামা আরম্ভ হওয়া বিস্ময়কর।

কৃষিমন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য হাইলাকান্দি গিয়েছিলেন। শ্রী চৌধুরী হাইলাকান্দি ত্যাগ করার ঠিক দু’ঘণ্টা পরেই হাঙ্গামা আরম্ভ হওয়ায় শ্রীপুরকায়স্থ বিস্ময় প্রকাশ করেন।’১৪৮

এদিকে চন্দ্রপুর গ্রাম থেকেও অগ্নিসংযোগের সংবাদ পাওয়া গেছে। সংবাদে জানা যায়, ‘মোহনপুরের হুকুম দখল করা এলাকার সমস্ত হিন্দু বাড়ি সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত হয়েছে এবং ৭৫০ জন লোক গৃহহারা হয়েছে। ঐ এলাকায় প্রায় তিনশো উদ্বাস্তু এবং ৪৫ জন স্থানীয় তপশিলি শ্রেণীর লোক বাস করত। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা কয়েকজন মুসলমানকে মারাত্মক অস্ত্রসহ ধরে ফেলে।’

অপর সংবাদে জানা যায়, গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক অরাজকতা দেখা দেওয়ায় মানুষজন গৃহত্যাগ করে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পথে নেমেছেন। ‘নারী-পুরুষসহ কয়েক শত নির্যাতিত লোক ইতিমধ্যেই শিলচর শহরে এসে পৌঁছেছেন। যেসব নিরাশ্রয় নরনারী শিশু শিলচর অভিমুখে আসছেন— তাদের নিয়ে আসার জন্য সরকারি পরিবহণ বাসগুলি পাঠান হয়েছে বলে সংবাদে উল্লেখ করা হয়।’১৪৯

হাইলাকান্দিতে ২০ জুন রাতে উদবাস্তুদের ৩৮৭টি গৃহে অগ্নিসংযোগ করা হয় বলে করিমগঞ্জের দু-জন কংগ্রেস নেতা সাংবাদিকদের কাছে উল্লেখ করেন। সংবাদে বলা হয়, ‘করিমগঞ্জ জেলা কংগ্রেস কমিটি সভাপতি শ্রী রণেন্দ্রমোহন দাস এবং সহ-সভাপতি জনাব আবদুল হামিদ চৌধুরী আজ অর্থাৎ ২২ জুন এই দাবি জানান যে, সাম্প্রদায়িক অশান্তি সৃষ্টির জন্য যারা দায়ী তাদের খুঁজে বের করবার উদ্দেশ্যে ভারত সরকার যেন অবিলম্বে হাইলাকান্দির দাঙ্গাহাঙ্গামা সম্পর্কে তদন্তের ব্যবস্থা করেন।

কংগ্রেসের এই দুই নেতা গতকাল উপদ্রুত অঞ্চলগুলি পরিভ্রমণ করবার পর আজ সাংবাদিকদের কাছে বলেন যে, ‘গত ২০ জুন রাতে হাইলাকান্দি মহকুমার জনতা উদবাস্তুদের ৩৮৭খানি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছিল। তাঁরা আরও বলেন যে, প্রায় দু’হাজার উদবাস্তুকে হাইলাকান্দি, মনাছেরা, ও লালাছেরা শিবিরে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শিলং এবং করিমগঞ্জ শহরেও অনেক উদবাস্তুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। আসাম সরকার দুঃস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে খয়রাতি সাহায্য দানের ব্যবস্থা করেছেন।’১৫০

২৩ জুন সমগ্র কাছাড় জেলাকে ‘উপদ্রুত এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হল। আসামের রাজ্যপাল জেনারেল এস এম শ্রীনাগেশ ‘১৯৫৫ সালের আসাম উপদ্রুত এলাকা আইনের তিন নম্বর ধারা অনুসারে আজ থেকে তিন মাসের জন্য সমগ্র কাছাড় জেলাকে ‘উপদ্রুত এলাকা’ রূপে ঘোষণা করেন।

ইতিপূর্বে কাছাড় জেলার কেবল হাইলাকান্দি-মহকুমা ‘উপদ্রুত এলাকা’ রূপে ঘোষিত হয়েছিল। আজকের বিজ্ঞপ্তির ফলে ১৯ জুনের ওই বিজ্ঞপ্তি বাতিল বলে গণ্য হবে। শিলং-এ আজ বিকালে গেজেটের এক অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় যে, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মনোমালিন্যের ফলে সমগ্র জেলায় ব্যাপক আকারে এমন সব ঘটনা ঘটছে যাতে জনসাধারণের প্রচুর সম্পত্তি নাশ হয়েছে, শান্তিভঙ্গ হয়েছে এবং লোকের ধনপ্রাণ বিপন্ন হয়ে উঠেছে।

আসামের রাজ্যপাল সমস্ত অবস্থা অনুধাবন করে বুঝতে পেরেছেন যে, গুণ্ডামি দমন ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার এবং লোকের ধনপ্রাণের নিরাপত্তার জন্য কাছাড় জেলাকে ১৯৫৫ সালের আসাম উপদ্রুত এলাকা আইন অনুসারে তিন মাসের জন্য উপদ্রুত এলাকারূপে ঘোষণা করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।’১৫১

কাছাড়ের হাইলাকান্দি মহকুমার চা-বাগান এলাকা থেকে ব্যাপক লুটতরাজের সংবাদ জানা যায়। শিলচরের নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, ‘২২ জুন রাতে কয়েকশো গুণ্ডা হাইলাকান্দি মহকুমার অন্তর্গত গাগলাচেরা চা-বাগান ম্যানেজার বাংলো এবং কর্মচারিদের কোয়ার্টার আক্রমণ করে বেপরোয়া লুটতরাজ চালায়। ম্যানেজার ও তাঁর সহযোগীদের গুণ্ডারা ভীতি প্রদর্শন করে। আজ অর্থাৎ ২৩ জুন তাঁরা পরিবারবর্গ নিয়ে শিলচর এসে পৌঁছান। ঘটনাস্থলে ১২ জন দুর্বৃত্তকে গ্রেপ্তার করা হয়।

১৩ বৎসর বয়স্ক রবীন্দ্রকুমার ঘোষের মৃতদেহ আজ শিলচরে আনা হয়। এখান থেকে ১৩ মাইল দূরে ইরিমুরার রবীন্দ্রকুমার ঘোষকে হত্যা করা হয়। বালকটির আত্মীয়বর্গ একদল পুলিশ নিয়ে বস্তি এলাকায় বালকটির মৃতদেহ অর্ধকবরস্থ অবস্থায় উদ্ধার করে। ওই গ্রামের নবাব আলি ও তার পুত্র শেখ নূরকে এ সম্পর্কে গ্রেফতার করে।

ছোটোজলেঙ্গায় অগ্নিসংযোগের জন্য ব্যাটন সিং নামে এক মণিপুরীকে গ্রেফতার করা হয়। শ্রী সিং অপরের প্ররোচনায় অগ্নিসংযোগের কথা স্বীকার করে।

২১ জুন রাতে ফণিবোরা শিবিরে অগ্নিসংযোগের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে শিলধুবী এলাকায় ২৫ জন মুসলমানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ কয়েকটি বন্দুক উদ্ধার করে। গাগলাচেরা চা-বাগান, লালামুখ চা-বাগান, বাগবাজার প্রভৃতি বাগানগুলিতে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বাংলো ও কোয়ার্টারগুলি লুন্ঠিত হয়।’১৫২

কাছাড়ের ঘটনাবলীতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী উদ্বেগ প্রকাশ করে তাঁর পূর্ব সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে কাছাড় সংগ্রাম পরিষদ নেতৃত্বকে ১ অথবা ২ জুলাই নয়াদিল্লিতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের আমন্ত্রণ জানান। এই মর্মে একটি বার্তাও শ্রী শাস্ত্রী প্রেরণ করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনে করেন কাছাড়ের বর্তমান পরিস্থিতিতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আলোচনা শুরু করা প্রয়োজন। সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবর্গ যখন দিল্লিতে আসবেন তখন তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করবেন।১৫৩

২ জুলাই নয়াদিল্লিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও কাছাড় নেতৃবৃন্দের মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে বলে দিন স্থির হয়েছে। প্রকাশ, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কাছাড় সংগ্রাম পরিষদ নেতা শ্রীরথীন সেনকে জানান যে, পরিষদ নেতৃবৃন্দ ব্যতীত অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিগণ যদি এই সমস্যা সম্পর্কে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতে চান— তবে তাঁদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করতে রাজি আছেন।’১৫৪

আসাম সরকার তথা কেন্দ্রীয় সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুল প্রদর্শন করে দুর্বৃত্তদল হাইলাকান্দিতে ভীতি প্রদর্শন, লুন্ঠন, গৃহদাহ, হিন্দু পল্লি আক্রমণ, উদ্বাস্তু কলোনী আক্রমণ আজ পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। বড়পেটা, করিমগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার পাকিস্থানি মুসলমানের আগমন সংবাদও পাওয়া যাচ্ছে। ২৫ জুন সরকারি সূত্রে বলা হয়, কেবল বড়পেটা মহকুমার বিভিন্ন গ্রামেই গত ৪/৫ মাসে দশ হাজার পাকিস্তানি মুসলমান অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে।১৫৫

এ প্রসঙ্গে আমরা একটি ঘটনা তুলে ধরব। করিমগঞ্জ থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা ২৫ জুন জানালেন:

‘তসলিম আলি নামে এক পাকিস্তানি মুসলমানকে ঔরঙ্গাবাদে গ্রেপ্তার করা হয়। মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এক বিবৃতিতে সে বলে যে, ৪ মাস পূর্বে বিনা পাসপোর্টে ভারতে প্রবেশ করে সে মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীর গৃহে কাজ করছিল।

শুক্রবার তিনজন পাকিস্তানি কুশিয়ারা নদী পার হয়ে ভারতীয় অঞ্চলে প্রবেশ করলে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের করিমগঞ্জ মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে হাজির করা হলে তিনি তাদের ২ জনের প্রত্যেককে ২ মাস করে সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করেন। তৃতীয় ব্যক্তিকে জেল হাজতে রাখা হয়।

এই তৃতীয় ব্যক্তির নাম তসলিম আলি। তাকে ঔরঙ্গাবাদের কাছে গ্রেফতার করা হয়। মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে এক বিবৃতিতে সে বলে যে, চারমাস পূর্বে বিনা পাসপোর্টে সে জীবিকাঅর্জনের জন্য ভারতে প্রবেশ করে। ভারতে আসবার ২ মাস পর সে সোনাবাড়িঘাটে যায় এবং মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীর গৃহে কাজ করতে থাকে। গত ২২ জুন সে গৃহত্যাগ করে। সে পাকিস্তানে যাচ্ছিল। তার মাসতুত ভাই হাইলাকান্দি দাঙ্গায় আহত হয়েছে। এখন সে হাইলাকান্দি হাসপাতালে আছে।’১৫৬

এই ঘটনা নিশ্চিতভাবেই উদবেগজনক। এরপরও কিন্তু ভারত সরকারের টনক নড়েনি। বরং সরকারের তরফ থেকে আশ্রয় প্রশ্রয়ই দেওয়া হয়েছে। বিশেষত প্রধানমন্ত্রী শ্রী জওহরলাল নেহরু জনাব হকের প্রতি বড়োই সদয়।

নয়াদিল্লিতে ৩০ জুন এক সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শ্রী নেহরু কাছাড়ে পাক মুসলিম অনুপ্রবেশ, মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ—সব অস্বীকার করলেন। কেবল তাই নয়— বাংলার সংবাদপত্রগুলিই মিথ্যা সংবাদ ছাপাচ্ছে তাও জোর দিয়ে জানালেন।

পূর্ব পাকিস্তান থেকে মুসলিম অনুপ্রবেশ প্রসঙ্গে শ্রীনেহরু জানান:

…পূর্ব পাকিস্তান হইতে ব্যাপকভাবে আসামে মুসলমানদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়াছে ভারত সরকারের এইরূপ মনে করিবার কোনো কারণ নাই বলিয়া নেহরু মন্তব্য করেন। …পাকিস্তান লক্ষ লক্ষ ব্যক্তিকে ভারতে বাস করিবার জন্য পাঠাইতেছেন এইরূপ কোনো তথ্য আমার জানা নেই। কিছু লোক আসিতে পারে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক পাকিস্তান হইতে আসিয়াছে বলিয়া আমার মনে হয় না। আমি যতদূর জানি পাকিস্তান সরকার তাহাদিগকে পাঠাইয়াছেন এইরূপ মনে করিবার কোনো সঙ্গত কারণ নাই।১৫৭

মন্ত্রী হক চৌধুরী সম্পর্কে শ্রীনেহরু জানান:

আসামের কৃষিমন্ত্রী শ্রী মইনুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইয়াছে তাহা উল্লেখ করিয়া শ্রীনেহরু বলেন যে, ওই অভিযোগের পক্ষে এক ছিটা সাক্ষ্য-প্রমাণও নাই। মুসলমান বলিয়াই শ্রীহক ওই আন্দোলনের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন তাহা আমি বিশ্বাস করি না। ও দোষী নয়। আমি শ্রী হকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত কোনো অভিযোগ গ্রহণেই রাজী নই।১৫৮

এই হচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী জওহরলাল নেহরু। অথচ তাঁরই আওতাধীন ‘গোয়েন্দা রিপোর্ট’ ভিন্ন কথা বলে। আমরা ইতিপূর্বে এ সংক্রান্ত বেশ কিছু গোপন রিপোর্ট উপস্থাপন করেছি। আমাদের হাতে এখনও প্রচুর গোপন রিপোর্ট রয়েছে যা প্রয়োজনে উপস্থাপন করা সম্ভব।

আসলে হাইলাকান্দির দাঙ্গাহাঙ্গামা পূর্ব পরিকল্পিত, উদ্দেশ্য প্রণোদিত। এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন থেকে সে কথা জানা যায়। প্রতিবেদনে ‘It happened in Hailakandi’

শিরোনামে বলা হয়:

…At that time some people were thinking in terms of seperating Cachar from Assam and this was reflected in the newspapers. But such a thing would have been most inconvenient for the Muslims in Assam— because the present high percentage of Muslims in Assam is largely due to the Muslim population in Cachar. Increasing Muslim population in Assam is the pivot of the Muslim strategy in this province. If Cachar were merged with Bengal, Assam would be rid of lacs of Muslims who, however, would not count for very much in Bengal. This thing was clearly stated by the Goalpara Muslims also before the State Re-organisation Commission. When Bengali Hindus demanded that Goalpara should go to West Bengal, Muslims in Goalpara opposed the move and the leader of the Muslim deligation at that time clearly stated that if Goalpara was transferred to West Bengal the percentage of Muslims would be decreased and so they want it to remain in Assam.

As if to discuss this matter on 10th June, Mahiuddin Barbhuyan of Matijuri, Shaukat Ali Laskar of Ganirgaon and Siddique Ahmed of Karimganj secretly met the I.G.P., Haider Hussain, and D.I.G., Imdad Ali, at shillong. After this meeting the Cachar Muslims were staunch supporters of Bengali language till the previous day, over-night became enthusiastic lovers of Assamese language. So-called Shanti Parishad branches were overnight established at various places to oppose Sangram Parishad. ‘Down with Shastri Formula’ became the pet demand. (Because this formula was to settle the dispute once for all and the Muslims did not wish to allow this flaming torch to be extinguished so soon. Out of this came the Hailakandi invasion.

Hailakandi is a small sub-divisional town. Muslim mobs began to gather round Hailakandi from early morning of June 19. Ten thousand Muslims gathered. On getting this information at 10 a.m. the S.D.O. attempted to stop them outside the town and he posted police force at three or four places. Haider Hussain, I.G.P. was in Hailakandi since 17th June. The mob increased and strangely enough he allowed the mob to hold peaceful (!) demonstrations inside the town. The Muslims entered by four different routes. “Refuse Shastri Formula” “One must learn Assamese to live in Assam” were the slogans raised. Funnily enough the slogans were shouted in Bengali and not in Assamese. At 12 O’ clock, the station road mob began pelting stones and Looting. But the S.P. used tear gas and dispersed the crowd. At 1.30 p.m. the mob coming from the Hospital area towards compound and Cachari Road began loot and plunder and arson. Haider Hussain, I.G.P., was only 200 feet away from the point of disturbance but he did not take any step. At 2-30 p.m. this mob attacked Lakshmisahar, Nutanpara and College Colony. Refugees houses were set on fire and loot, plunder and murder were let loose. Theoretically the town was under 144 Cr. P.C. Assam Government had issued orders to police and Military to ‘shoot at sight’ any violent mob. Still this naked dance of atrocities continued till 4 P.M. The D.C. was busy giving a send-off to Moinul Huq. When he heard the news, he motored to Hailakandi and when the crowd refused to disperse he ordered firing. In this firing eight Muslim goondas were killed.

The fleeing mob began to set fire to Hindu houses and loot shops on way. At algapur, eight miles from Hailakandi 21 houses were burnt and 5 shops looted. Shouts of “Allah-ho-Akbar” and “Pakistan Zindabad” rent the sky. On June 20, 14 houses at chandrapur, 7at Banskari, 9 at Barband and 42 at Government sponsered Mohanpur Refugee colony were burnt and looted. Rangouti was attacked seven times but the assaults were not successful.

On 19th a mob of seven thousand also marched on Silchar but the town was saved by the careful handling of the local authorities. Many Muslims were arrested carring daggers after the incident. At Hailakandi nearly 200 houses were burnt. At Algapur, Kalacherra and Monacherra also nearly 150 refugee houses were burnt. In Hailakandi some 30/40 Hindus were injured. Anukulnagar Refugee Colony was attacked on the same night and four Hindus were grievously hurt. Shri Rabindra Sen of Congress and Shri Debendra Deonath of P.S.P. also sustained injuries. Some 2,200 refugees have now taken shelter in Hailakandi town. Panilbora Refugee Colony in Silchar sub-division also had the same fate of arson, loot and plunder. At Sonabarighat, the village Moinul Huq comes from, a mob of 200 Muslims stopped passenger buses and looted their properties. Same thing happened at North Krishnapur also. At Civitavisia, 13 miles from Silchar, 80 refugee houses were burnt. And all this was done with the Bengali slogan ‘Assame Thakte Assamiya Bhasha Shikhte Hobe”! (To live in Assam, Assamese must be learnt.)

ETERNAL VIGILANCE

Significantly enough, Radio Pakistan, which was giving delailed minute-to-minute account of disturbances in far off Nowgong and Lakhimpur Districts, was completely silent about this Hailakandi incident merely 15 miles across the border. No doubt the whole thing was pre-planned on a very high level. But this time this garb of Assamese was no longer successful, Hindus could judge the communal meaning behind the plot. Infuriated Hindus denounced the incident in meetings held at Hailakandi, Karimganj, Silchar, Gauhati and other places. At Karimganj, in a joint telegram by Congress, P.S.P., Jana Sangh, Sangram Parishad, Merchants Association and Bar Library the public requested the Centre to take proper steps to check the communal atrocities, demanded inquiry and charged Moinul Huq and Haider Hussain with being involved in the incident. Mentioning their suspicious movements the telegram stated that the attackers had the support of high officials.১৫৯

কাছাড়ে ইতিমধ্যেই ‘শান্তি পরিষদ’ গঠিত হয়। পরিষদ ১৯৬১ সালে ২১ মে থেকে ‘সেবাভার গ্রহণ করিয়া স্থানীয় ব্যবস্থাদি প্রায় সমাপ্ত করিয়াছে।’ কাছাড় জেলা শান্তি পরিষদ ২ জুন এক ‘আবেদন’ পত্রে জানাল:

আপনারা অবগত আছেন যে কিছুদিন যাবৎ এক বিশেষ শ্রেণির লোক আসাম রাজ্যভাষা বিলের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করিয়াছে। শেষ পর্যন্ত তাহারা কাছাড় জেলা কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের শাসন সংক্রান্ত কার্যকলাপ এবং পরোক্ষে জনসাধারণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অচলাবস্থা সৃষ্টির সংগ্রামে অবতীর্ণ হইয়াছে। যাহার অশুভ পরিণাম সম্পর্কে জনসাধারণ সকলেই অনুধাবন করিতে সক্ষম হইয়াছে।

কাছাড় জেলার সরলপ্রাণ গ্রামবাসী জনসাধারণ এবং বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহ ওই ভাষা সংগ্রামের তাৎপর্য ও নিহিত অভিসন্ধি অনুধাবন করিতে অক্ষম থাকিয়া এই অবৈধ সংগ্রাম পরিহার করায় সুবুদ্ধি ও দুরদর্শিতার প্রমাণ দিয়াছে বলিয়া আমরা মনে করি। কিন্তু তাহারা নীরব থাকিয়াও সংগ্রামকারীদের ভর্ৎসনা, জোরজুলুম ও ভীতি প্রদর্শন হইতে মুক্ত হইল না। ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা বিঘ্নের আশঙ্কায় তাহারা উদ্বিগ্ন হইয়া পড়িয়াছে। কাছাড় কংগ্রেসের মৌন অবলম্বন জন প্রতিনিধি এম এল এ-গণের এস্তেফা এবং এক শ্রেণির ক্ষমতাসীন সরকারি কর্মচারিদের বৈষম্যমূলক আচরণে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহের সন্ত্রাস ও অসহায়তাবোধ (বুধ?) আজ তিলে তিলে বাড়িয়া চলিয়াছে।

শুনা যাইতেছে যে, সংগ্রামকারীরা সংগ্রাম বিরতির এক সপ্তাহ পর আবার ভীষণ ধরণের সংগ্রাম চালাইতে বদ্ধপরিকর। যাহার অশুভ পরিণতি সম্পূর্ণ অনিশ্চিত।

এই অশুভ মুহূর্তে কাছাড় জেলার সন্ত্রস্ত ও অসহায় জনসাধারণের অবর্ণনীয় দুর্দশা কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের গুচরিভূত (?) করার উদ্দেশ্যে আমরা কাছাড় জেলা শান্তি পরিষদ নামে একটি সংগঠন গড়িয়া তুলিতে সক্ষম, (অক্ষম?) হইয়াছি। উক্ত পরিষদ গত ২১/৫/৬১ ইং তারিখ হইতে সেবাভার গ্রহণ করিয়া স্থানীয় ব্যবস্থাদি প্রায় সমাপ্ত করিয়াছে। সময়, সম্পদ ও নিরাপত্তার অভাবে যথাসময় জেলার সর্বত্র যোগাযোগ স্থাপনে অক্ষম থাকিলেও অনতিবিলম্বে আমরা সক্ষম (অক্ষম?) হইব বলিয়া আশা রাখি।

শান্তি পরিষদের উদ্দেশ্য

১. কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের সর্বপ্রকার আইন ও শৃঙ্খলার সহিত পূর্ণ সহযোগিতা রাখিয়া কাছাড় জেলার সন্ত্রাসগ্রস্ত জনসাধারণের সেবা করা।

২. সংগ্রাম পরিষদের অস্বস্তিকর কার্যকলাপের সংশ্রব হইতে জনসাধারণকে এবং বিশেষভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহকে বিরত রাখার ব্যবস্থা করা।

৩. আসাম রাজ্যভাষা বিলের পূর্ণ সহযোগিতা করা।

৪. কাছাড় জেলাকে আসাম রাজ্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গরূপে বহাল রাখার সর্বপ্রকার ব্যবস্থা অবলম্বন করা।

৫. কাছাড় জেলার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহের অভাব অভিযোগ ও সংবিধান সম্মত সর্বপ্রকার দাবীদাওয়া সরকারের গুচরিভূত (?) করা এবং ন্যায়সঙ্গত উপায়ে উদ্ধারের ব্যবস্থা করা।

৬. কাছাড় জেলার সর্বত্র শান্তি শৃঙ্খলা স্থাপনে সরকারের সহযোগিতা করা।

৭. সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সর্বপ্রকার বৈধ ব্যবস্থা অবলম্বন করা।

৮. সন্ত্রাসগ্রস্ত জনসাধারণের মনে শান্তির বাণী প্রচার করা।

অতএব কাছাড় জেলার সন্ত্রাসগ্রস্ত ও অসহায় জনসাধারণের নিকট কাছাড় জেলা শান্তি পরিষদের বিনীত নিবেদন এই যে, আপনারা উক্ত পরিষদের সহিত যোগাযোগ স্থাপনক্রমে, জাতি ও দেশের কল্যাণ সাধনে সহায়তা করতে অগ্রসর হউন।১৬০

শান্তি পরিষদের পক্ষে— দেওয়ান মহবুবুর রব চৌধুরি, প্রেসিডেন্ট, পাথারকান্দি আঞ্চলিক পঞ্চায়েত, ইব্রাহিম আলি, করিমগঞ্জ, আলাউদ্দিন চৌধুরি, রাতাবাড়ি, বসিরউদ্দিন চৌধুরি, রাতাবাড়ি, হাজী আবদুল আজিজ, নীলাম বাজার, আবদুর রসিদচান্দপুর, শ্রী গয়াপ্রসাদ কৈরী, হাতীখরা চা-বাগান, আবদুল লতিফ, মেম্বার, পাথারকান্দি আঞ্চলিক পঞ্চায়েত, মৌলভী তাহির আলি, হাজী মকদ্দছ আলি, গোলাপ সিংহ, ভাইস প্রেসিডেন্ট, পাথারকান্দি আঞ্চলিক পঞ্চায়েৎ, মৌলভী নজিব আলি, সাং আঙ্গুরা, শ্রী বিশ্বনাথ গোয়ালা, প্রেসিডেন্ট, মেদনী চা-বাগান, শ্রী লালমোহন গঞ্জু, বালুরবন্দ চা-বাগান, শ্রী গণেশ উড়িয়া, পুতনী চা-বাগান, হাজী আবদুর রউফ, সাং হাটখোলা সহ মোট ৪৫ জনের নাম রয়েছে— যেখানে কেবল মুসলমান নন অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষের নামও রয়েছে। এ সব নাম কতটা সত্য নির্ভর আজ আর তা যাচাই বাছাই করার সুযোগ নেই। তবে আবেদনের বয়ান থেকে ‘শান্তি পরিষদ’ নামক সংগঠনটি যে সরকার ও তাঁদের অনুগামীদের অনুসারী সে বিষয়ে আমরা নি:সন্দেহ। এমনকী পরিষদ উচ্চপদস্থ কিছুসংখ্যক সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। আর সংগ্রাম পরিষদ তো তাদের ‘টার্গেট’।

শান্তি পরিষদের বিস্তৃতি সমগ্র কাছাড় জেলাতে ছড়িয়ে দেবার লক্ষ থাকলেও হাইলাকান্দিতেই পরিষদ তাদের আসনকে পাকাপোক্ত করে ফেলে। ইমাদ উদ্দিন বুলবুল জানিয়েছেন:

সোনাই সমষ্টিতে এক বিরাট জনসভার আয়োজন করেন প্রয়াত গোলাম জিলানী চৌধুরি এবং প্রাক্তন বিধায়ক শ্রী পুলকেশী সিংহ। সেই সভায় বরাক উপত্যকার জন্য অসমীয়া ভাষাকে সমর্থন করে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় এবং পাল্টা শান্তি পরিষদ গঠন করা হয়। এরপর শুরু হয়ে যায় বর্তমান কাছাড় ও হাইলাকান্দি জেলায় শান্তি পরিষদ গঠনের হিড়িক। কয়েক হাজার বাঙালি মুসলমানের কন্ঠে ধ্বনি উঠে—‘বাংলা ভাষা চাইনা, অসমীয়া ভাষা চাই।

বাঙালি হয়ে অসমীয়া ভাষা সবচেয়ে বেশি করে চেয়েছিল উত্তর হাইলাকান্দির মানুষ।… ১৯ জুন তারা দলবদ্ধভাবে অসমীয়া ভাষার পক্ষে শ্লোগান দিতে থাকে এবং হাইলাকান্দি শহরে মিছিল নিয়ে এগিয়ে যায়। এ সময় মহকুমার এস ডি ও ছিলেন শ্রী জি ডি খোসলা। হাইলাকান্দিতেও এগারজন প্রাণ হারাল, কিন্তু তারা অসমীয়া ভাষার দাবিতে প্রাণ দিল। …বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি প্রতিরোধ ছিল হাইলাকান্দি জেলার বাঙালি মুসলিম সমাজে।… কাছাড় ও হাইলাকান্দির তুলনায় করিমগঞ্জ জেলার বাঙালি মুসলিমরা এভাবে কোনো প্রতিরোধ খাড়া করেননি।১৬১

বাংলা ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বরাক উপত্যকার মানুষ বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায় প্রধানত দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েন। এক. আধুনিক জীবনবোধজাত, গণতান্ত্রিক, মানবমুখী, মাতৃভাষার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসাসম্পন্ন ধারা এবং দুই. উগ্র জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী, অগণতান্ত্রিক, সুযোগ সন্ধানী, সুবিধাবাদী, অর্থ এবং পেশীশক্তি নির্ভর ধারা। রাজশক্তির আশীর্বাদপুষ্ট দ্বিতীয় ধারাটিই বর্তমান আসামে বেশ তৎপর, ক্রিয়াশীল।

গণতান্ত্রিক ধারার নেতৃস্থানীয় বাঙালি মুসলিম ‘প্রয়াত আলতাফ হোসেন মজুমদার, প্রয়াত হুরমত আলি লস্কর, সাবির খান, গোলাম কিবরিয়া, মাহমুদ আলি বড় ভুঁইয়া, আবদুর রহমান চৌধুরী, শরাফত আলি, মওলানা আবদুল জলিল চৌধুরী, শিল্পী খালেক চৌধুরী প্রমুখ বাংলা ভাষা আন্দোলনে যোগ দেওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে নানা কুৎসা, অপপ্রচার, সামাজিক বয়কট, নির্যাতন— এমনকী জীবনের ওপর পর্যন্ত আক্রমণ একাধিকবার নেমে আসে। তারপরও তাঁরা তাঁদের লক্ষ্যে স্থির থাকেন স্বসমাজের গরিষ্ঠ মানুষের কাছ থেকে প্রাণনাশের হুমকি সত্ত্বেও।’১৬২

এ সময় দ্বিতীয় ধারার মানুষেরা প্রচারপত্র বিলির মধ্যদিয়ে প্রাগ্রসর গণতান্ত্রিক মানবমুখী মানুষগুলোকে তীব্র আক্রমণের পথ বেছে নেয়। আমরা এ বিষয়ে উভয় ধারার কয়েকটি প্রচারপত্র তুলে ধরব।

অসংখ্য অভিযোগে অভিযুক্ত আসাম সরকারের কৃষি ও সরবরাহ মন্ত্রী এম ময়ীনুল হক চৌধুরী ২১ জুন এক ‘নিবেদন’-এ জানালেন:

আমি গভীর পরিতাপের সহিত লক্ষ্য করিতেছি যে, কিছুসংখ্যক সমাজবিরোধী লোকের কার্যকলাপের কারণে কাছাড় জিলার শান্তি, সংহতি এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হইতে চলিয়াছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি লজ্জাকর ও দুঃখজনক ঘটনা কয়েক স্থানে ঘটিয়াছে এবং তাহার ফলে ও শান্তি স্থাপনের জন্য বাধ্য হইয়া পুলিশের গুলী চালনার দরুন অনেকগুলি অমূল্য জীবন নষ্ট হইয়াছে। মৃত ব্যক্তিদের পরিজনের জন্য ও আহতদের জন্য আমি পুনরায় গভীর সমবেদনা জানাইতেছি। কাছাড় জেলা আসামের প্রশাসন হইতে বিচ্ছিন্ন করা হইবে না। গভর্নমেন্ট এরূপ কোনো প্রস্তাব বিবেচনা করিতেছেন না। ইহা লইয়া চিন্তিত বা উত্তেজিত হওয়ার কোনো কারণ নাই। ভাষা সমস্যারও শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান হওয়া উচিত।

এই সম্পর্কে ভারত গবর্নমেন্টের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী যে সমাধান দিয়াছেন তাহা আসাম গভর্নমেন্ট গ্রহণ করিয়াছেন। এমতাবস্থায় ভাষা সমস্যা লইয়া অহেতুক উত্তেজনার কোনো যুক্তি থাকিতে পারে না। সুখের বিষয় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ ইতিমধ্যে সমস্ত আন্দোলন স্থগিত রাখিয়াছেন। যাঁহারা সংগ্রাম পরিষদের বিরুদ্ধ মত পোষণ করেন এবং তাহার জন্য আন্দোলন করিতেছেন, তাঁহাদের নিকটও আমার অনুরোধ তাঁহারাও যেন বর্তমান পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করিয়া তাঁহাদের আন্দোলন সম্পূর্ণভাবে স্থগিত রাখেন। উদ্বাস্তু ভাইরা এই দেশের নাগরিক। তাঁহারা এদেশে মান সম্মান লইয়া বসবাস করার সম্পূর্ণ অধিকারী। যাহারা তাহাদের বিরুদ্ধে প্রচার করিতেছেন—তাহাদের কার্যকলাপ বেআইনি এবং সরকার তাহা দৃঢ়ভাবে দমন করিতে কৃত সঙ্কল্প।

আমি পরিষ্কারভাবে জানাইয়া দিতেছি যে, গবর্নমেন্ট কোনো ব্যক্তির বা কোনো সম্প্রদায়ের শান্তি ও শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে কোনোপ্রকার বেআইনি কার্যকলাপ সহ্য করিবেন না এবং এবম্বিধ কার্য দমনের জন্য কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করিবেন। আমি কাছাড় জিলার অধিবাসীদের নিকট শান্তি, শৃঙ্খলা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপন ও রক্ষা করার জন্য এবং এই কার্যে কতৃপক্ষকে সর্বতোভাবে সহায়তা করার জন্য অনুরোধ জানাইতেছি। অযথা গুজবে কর্ণপাত না করার জন্য সকলকে অনুরোধ জানাইতেছি।’’

ইতি—

এম. ময়ীনুল হক চৌধুরী

আসাম সরকারের কৃষি ও সরবরাহ মন্ত্রী

শিলচর

২১/৬/৬১ ইং.১৬৩

এই ধারার অপর সাতজন ব্যক্তি— এম রহমত উল্লা মজুমদার, প্রেসিডেন্ট, লক্ষ্মীপুর আঞ্চলিক পঞ্চায়েত, শ্রীপুলকেশী সিংহ, এম এ, এল এল বি চিফ কনভেনর, কাছাড় কল্যাণ সমিতি, জেনারেল সেক্রেটারি, অল আসাম মণিপুরী অ্যাসোসিয়েশন, গোলাম জিলানী চৌধুরি, প্রেসিডেন্ট, সোনাই আঞ্চলিক পঞ্চায়েত, ভাইস প্রেসিডেন্ট, শিলচর মহকুমা পরিষদ ও প্রেসিডেন্ট ঘুংঘুর মন্ডল কংগ্রেস কমিটি, শ্রী সুরেন্দ্র কুমার সিংহ, নৃত্য বিশারদ, মেম্বার সোনাই আঞ্চলিক পঞ্চায়েত, শ্রী রজনীকান্ত বড়ভুঁইয়া, ভাইস প্রেসিডেন্ট, সোনাই আঞ্চলিক পঞ্চায়েত, শ্রী সোনাচাঁদ সিংহ, প্রেসিডেন্ট, শান্তি পরিষদ, কাছাড় এবং শ্রী সুখময় সিংহ, সেক্রেটারি, শান্তি পরিষদ, কাছাড়।’ সমাজের উভয় সম্প্রদায়— মুসলিম এবং মণিপুরী সম্প্রদায়ের একাংশ মানুষ একই লক্ষ্যে হাতে হাত মিলিয়ে ‘নিবেদন’ শীর্ষক প্রচারপত্র মারফত জনগণকে জানালেন:

বিশেষ উদ্বেগের সহিত লক্ষ্য করা যাইতেছে যে, আজ কয়েকদিন যাবত কতিপয় স্বার্থান্বেষী ও সমাজ-বিরোধী লোকের অপপ্রচার ও কার্যকলাপের দরুন এ জেলার শান্তি ও শৃঙ্খলা ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। এমন কী কোনো কোনো জায়গায় উহার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ কয়েকটি বিক্ষিপ্ত অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটিয়া গিয়াছে। আমরা এহেন সমাজবিরোধী ও অপপ্রচারকারীদের এরূপ গর্হিত কার্যকলাপের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা করিতেছি।

কলিকাতা হইতে প্রকাশিত কয়েকটি সংবাদপত্রে বিদ্বেষপ্রসূত, ভিত্তিহীন ও অতিরঞ্জিত সংবাদ ও গুজব প্রচার করিয়া নিরীহ জেলাবাসীদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ যেভাবে নষ্ট করা হইতেছে, তাহাতেও আমরা অত্যন্ত বেদনাবোধ করিতেছি এবং জেলাবাসী জনসাধারণকে অনুরূপ ভিত্তিহীন সংবাদ বা গুজবে বিশ্বাস না করিয়া আমাদের পূর্ব সুনাম ও পারস্পরিক ঐক্য অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য এবং বিভেদ সৃষ্টিকারীদের গুজবে কর্ণপাত না করার জন্য সানুনয় অনুরোধ জানাইতেছি।

কাছাড় জিলার শান্তিপ্রিয় জনগণের বেদনা জনপ্রিয় সরকার উপলব্ধি করিয়াছেন। নিরীহ ও শান্ত জীবনযাপনই আপনাদের জয় নিশ্চিত জানিবেন। ইতি—৫/৭/৬১ ইং.

কেবল উল্লিখিত দুটি প্রচারপত্র থেকেই এর অন্তরগত চেতনা, ভাবনা, দৃষ্টি অনুধাবনে বিন্দুমাত্র বেগ পাওয়ার কথা নয়।

অন্যদিকে গণতান্ত্রিক মানবমুখী বাংলাভাষা তথা মাতৃভাষার প্রতি কর্তব্যনিষ্ঠ ২৮ জন শিলচরের বিশিষ্ট বাঙালি মুসলিম এক বিবৃতি প্রচার করেন। দীর্ঘ বিবৃতির অংশবিশেষ আমরা বর্তমান এবং আগামী প্রজন্মের জন্য উপস্থাপন করব। বিবৃতিটির বয়ান ছিল এরকম:

আসামের ভাষা আন্দোলনের এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা গত ১৯ মে তারিখের বাংলা ভাষার সমর্থনে যে অভূতপূর্ব গণজাগরণে এবং তদজনিত এগারোটি প্রাণের আত্মাহূতি অবলোকন করিয়াছি তাহাতে আমাদের মন, শ্রদ্ধায় অবনত হইয়া আছে।

কাছাড়কে পৃথকীকরণের যে কোনো আন্দোলন কাছাড়বাসীর পক্ষে সর্বতোভাবে ক্ষতিকর ইহা সর্ববাদীসম্মত। এইরূপ পৃথকীকরণের ধুয়া তুলিয়া ভাষা আন্দোলনকে বানচাল করিবার চেষ্টাও তেমনি কাছাড়বাসী তথা সমস্ত আসামবাসী বাঙালিদের পক্ষে সমানভাবে ক্ষতিজনক। ইহার পিছনে কোনো যৌক্তিকতা থাকিতে পারে না। আপনারা জানেন কাছাড়কে পৃথকীকরণের প্রচেষ্টাকে আমরা অতীতে সর্বতোভাবে বাধা দিয়াছি এবং প্রয়োজন হইলে ভবিষ্যতেও এজন্য সর্বশক্তি নিয়োজিত করিতে প্রস্তুত।

…এই সমস্ত বাজে গুজব হইতে ইহা অনুমান করা যাইতেছে যে, বিভ্রান্তকারীরা হিন্দু-মুসলমান, হিন্দুস্থানি, মণিপুরী, বর্মণ ইত্যাদি সাম্প্রদায়িক দোহাই দিয়া বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ জাগাইবার চেষ্টা করিতেছে। আমরা এই কথা বলিতে চাই যে, মাতৃভাষা সম্বন্ধীয় প্রশ্নে কাছাড়বাসীর মধ্যে অনৈক্য থাকা উচিৎ নয়। মাতৃভাষার দাবিতে আমরা সবাই এক। ওই প্রকার সাম্প্রদায়িকতা প্রশ্রয় পাইয়া বিস্তৃতি লাভ করিলে ভাষা আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হইয়া যাইবে এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মনোমালিন্য ও তিক্ততার সৃষ্টি হইবে।

আমরা মনে করি যে মাতৃভাষার দাবিতে আমাদের যে আন্দোলন তাহা সকল সম্প্রদায়ের ঐক্য ও সম্প্রীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। এই ঐক্য ও সম্প্রীতি যাহাতে ব্যর্থ না হয় তাহার জন্য আমাদের সদাসর্বদা সতর্ক ও জাগ্রত দৃষ্টি রাখিতে হইবে। ইতি—৩১/৫/৬১ ইং’’ ১৬৪

এই বিবৃতিতে যাঁদের নাম মুদ্রিত হয়েছে—তাঁরা হলেন—

১. নামওয়ার আলি বড়ভুঁইয়া, এক্স এম এল এ, ২. মকব্বির আলি মজুমদার, এক্স এম এল এ, ৩. মেহরাব আলি লস্কর, এক্স এম এল এ ৪. আরজান আলি মজুমদার, এক্স এম এল সি, ৫. ওয়াজিদ আলি বড়ভুঁইয়া, উকিল, ৬. সুলতান আলি মজুমদার, ৭. খান সাহেব জি., এম, চৌধুরী, ৮. ডা. লুৎফুর রহমান, এম বি বি এস, ৯. সাজিদ মিয়া মজুমদার, ১০. আবদুর রেজ্জাক মজুমদার, ১১. এ কে নুরুল হক, ১২. আরজান আলি, মিউনিসিপ্যালিটি কমিশনার, ১৩. আম্বর আলি সদিয়ল, মিউনিসিপ্যালিটি কমিশনার, ১৪. মসাইদ আলি মজুমদার, ১৫. এ এফ জি ওসমানী, ব্যারিস্টার অ্যাট-ল, ১৬. আলতাফ হোসেন মজুমদার, অ্যাডভোকেট, ১৭. নুরুল হোসেন মজুমদার, অ্যাডভোকেট, ১৮. কামরুল ইসলাম লস্কর, উকিল, ১৯. গোলাম ওয়াজিদ মজুমদার, উকিল, ২০. মসরফ আলি, উকিল, ২১. রহমতুল্লা মজুমদার, উকিল, ২২. নামওয়ার আলি বড়ভুঁইয়া, মোক্তার, ২৩. মুদাচ্ছির আহমদ লস্কর, মোক্তার, ২৪. ছদ্দাদ আলি খাঁ বড়ভুইয়া, মোক্তার, ২৫. মুজিবুর রহমান মজুমদার, মোক্তার, ২৬.ফরিদ আহমদ মজুমদার, মোক্তার, ২৭. মতিউর রহমান বড়ভুঁইয়া, মোক্তার এবং ২৮. সাহাব উদ্দিন লস্কর, মোক্তার।’ ১৬৫

বলা প্রয়োজন যে, এঁরা সকলেই শিলচরের মানুষ।

মৌলানা আবদুল জলিল, আলতাফ হোসেন মজুমদার, আবদুর রহমান চৌধুরীর বিরুদ্ধেও কুৎসা, অপপ্রচার চালানো হয় প্রচারপত্র প্রচারের মধ্য দিয়ে। মো: আবদুল লতিফ, গণির গ্রাম, আকদ্দছ আলি, আলগাপুর, শ্রীরাজমোহন নাথ, মোহনপুর, আলহাজ আরজুমন্দ আলি লস্কর, মধুরবন্দ ও শ্রী তনুগোপাল সিং, পাথারকান্দি একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করেন যেখানে তারিখ এবং প্রেস কোনোটির উল্লেখ নেই। প্রচারপত্রে প্রধানত মৌওলানা আবদুল জলিলের বিরুদ্ধেই বিষোদগার করা হয়।

অভিযোগে বলা হয়,

মৌলানা আবদুল জলীল সাহেব পাকিস্তানি মুসলমান রিফিউজি। দেশ বিভাগের পর তিনি কাছাড়ে আসিয়াছে।…সেই পাকিস্তানি গন্ধ দূর করার জন্য তিনি সংগ্রাম পরিষদী আতর মাখিয়াছেন, তাহাতে সন্দেহ কি?

জনাব গোলাম সবির খান সাহেবের বাড়ি আজও ঢাকা, পাকিস্তানে। কাছাড়ের বুকে অর্জিত পয়সা দ্বারা তিনি তাহার ছেলেকে মানুষ করিয়া পাকিস্তানে চাকুরিতে পাঠাইয়াছেন ও নিজের বাড়িতে প্রেসে এক ডজন খানেক পাকিস্তানি কর্মচারি রাখিয়াছেন তাহা কে না জানে।১৬৬

আলতাফ হোসেন মজুমদার এবং জনাব আবদুর রহমান চৌধুরী সম্পর্কে পাকিস্তানে পড়াশুনা ও বিধায়ক হওয়ার উচ্চাশার উল্লেখ করা হয়।

এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জনাব মৌলানা আবদুল জলিলের কয়েকজন অনুসারী যথাক্রমে— হাফিজ আহমদ আলি হাজারী, শিলচর, ২. মকবিবর আলি মজুমদার, শিলচর, ৩. খলিলুর রহমান মজুমদার, আকাই, শিলচর, ৪. হারুন রসিদ লস্কর, শিলচর, ৫. নিজাম উদ্দিন হাজারী, শিলচর এবং ৬. মো. নিছাব আলি বড়ভুঁইয়া, গণির গ্রাম যৌথভাবে ‘অপপ্রচারের প্রতিবাদ’ শীর্ষক শিরোনামায় এক বিবৃতিতে জানান:

আমরা দৃঢ়তার সহিত বলিতে চাই যে, জনাব মৌলানা আবদুল জলিল সাহেব শুধু যে কাছাড়ের ধর্মীয় নেতা তাহা নহে, তিনি সমগ্র আসাম তথা ভারত বিখ্যাত একজন বিশিষ্ট আলেম। স্বাধীনতা প্রাপ্তির বহু পূর্ব হইতে তিনি একজন বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা এবং অসহ্য যাতনার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাঁহার রাজনৈতিক উদার দৃষ্টি এবং মনোভাব পরিবর্তন করেন নাই ও দেশ বিভাগের পর তিনি স্থায়ীভাবে বদরপুরে বসবাস আরম্ভ করেন।… ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে যখন নানা বিভ্রান্তিমূলক প্রচারাদি আরম্ভ হয় তখন আমি অন্যতম স্বাক্ষরকারী হাফেজ আহমদ আলি হাজারী আরও কয়েকজন বিশিষ্ট আলেম সাহেবগণকে লইয়া মৌলানা আবদুল জলিল সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করি। তিনি বলেন, ‘বাংলা ভাষা আমাদের মাতৃভাষা বা মাদরী জবান এবং মাতৃভাষাকে রক্ষা করা আমাদের একান্ত কর্তব্য বা ‘ফরজ’।…

কাছাড়কে পৃথকীকরণ বা আসাম হইতে বিচ্ছিন্ন করার প্রশ্নের উত্তরে তিনি দৃঢ়তার সহিত বলেন যে, ‘‘কাছাড়কে আসাম হইতে পৃথকীকরণের কোনো প্রশ্নই উঠে না এবং যদি কোনোপ্রকার পৃথকীকরণের প্রশ্ন উঠে তাহা হইলে আমি আমার শেষ রক্তবিন্দু দিয়া তাহার প্রতিরোধ করিব।’…

মৌলানা সাহেবের বিরুদ্ধে কয়েকজন স্বার্থান্বেষী লোক … প্রচার কার্য চালাইতেছেন যে, বিগত ১৯ মে পুলিশেরগুলী চালনার ফলে যে ১১টি বাঙালি সন্তান নিহত হইয়াছে তাঁহাদের সম্মানার্থে মৌলানা আবদুল জলিল সাহেব পূজা পাঠ করেন। এই বিষয়ের সত্যতা সম্পর্কে আমি এবং উধারবন্দ নিবাসী আলহাজ্জ মৌলানা আবদুল খালেক সাহেব, গণিরগ্রাম নিবাসী মৌলানা হবিবুর রহমান সাহেব ও আলহাজ্জ মৌলানা কুতুবউদ্দিন সাহেব শান্তিপুরী এই বিষয়ে তাঁহার দৃষ্টি আকর্ষণ করিলে তিনি বলেন যে:

আপনারা এই সমস্ত বিষয়ে যদি কোনো সামান্যতম প্রমাণ পান তাহা হইলে শরীয়তের বিচারমতে আমাকে যে শাস্তি দিবেন তাহা আমি মান্য করিব। কিন্তু আমি দৃঢ়তার সহিত বলিতেছি যে, ‘আমি শরীয়তের গর্হিত এরূপ কোনো কাজ করি নাই।’ সুতরাং মৌলানা সাহেবের উপরোক্ত বক্তব্য হইতে ইহাই প্রমাণিত হয় যে, এই সমস্ত মিথ্যা অপপ্রচার ইচ্ছাকৃত এবং সমাজের নিকট সমগ্র ভারত তথা বিশ্ব বিখ্যাত মরহুম মৌলানা হজরত হুসেন আহমদ মদনী সাহেবের অতিপ্রিয় খলিফা মৌলানা আবদুল জলিল সাহেবকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য কয়েকজন স্বার্থান্বেষী লোকের চক্রান্ত।…আমরা ইহার তীব্র প্রতিবাদ করিতেছি। কাছাড়ের নিরীহ জনসাধারণের নিকট আমাদের বিনীত আবেদন এই যে, আপনারা কু-চক্রান্তকারীদের প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হইবেন না এবং আপনারা সকলে এইরূপ অপপ্রচারের তীব্র প্রতিবাদ করুন। ইতি—খোদা হাফেজ ২৫/৭/৬১ ইং..১৬৭

এ সময় এমন বহু প্রচারপত্র উভয় ধারার মানুষের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়েছে—যা দেখে অলক্ষ্যে আসাম সরকার তথা কেন্দ্র খুবই উপভোগ করেছেন বলেই মনে হয়। আর তাইতো ইমাদউদ্দিন বুলবুল জানিয়েছেন, ‘আসামের চালিহা সরকার বসে বসে বরাকের অপরিণামদর্শী বাঙালি মুসলিমদের বেশিরভাগের কান্ডকারখানা দেখে সেদিন বিস্তর আত্মতুষ্টি লাভ করেছিলেন।’ তিনি আরও জানিয়েছেন, ‘মইনুল হক চৌধুরী নিজের ওপর উপত্যকার জনগণ অর্পিত দায়িত্ব পালন না করে বরং বাংলা ভাষা আন্দোলনের বিপক্ষে ইন্ধন জুগিয়েছেন, যার পরিণতিতে আজও বাঙালি মুসলমানের একাংশের ওপর মাতৃভাষার প্রতি বেঈমানিজনিত কলঙ্কের ছাপ রয়ে গেছে।’১৬৮

বাংলাভাষা আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য হাইলাকান্দির দাঙ্গাহাঙ্গামার মধ্য দিয়েই ষড়যন্ত্র শেষ হয়ে যায়নি। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা যাঁরা তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে, কাছাড়ে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় যত্নবান হয়েছিলেন—তাঁদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের এক চাঞ্চল্যকর সংবাদ সমকালীন সংবাদপত্রে মুদ্রিত হয়েছে। আমরা এ বিষয়টিও ইতিহাসের উপাদান বা উপাত্ত হিসেবে তুলে ধরব। সংবাদপত্রে বলা হল এভাবে:

হাইলাকান্দি-দাঙ্গার সহিত জড়িত সন্দেহে অভিযুক্ত এক ফেরারি সম্প্রতি কীভাবে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করিয়াছেন, তাহার এক গোপন দলিল আমাদের হাতে আসিয়াছে। এই দলিল সদাশয় আসাম সরকারের কর কমলে উপহার দিতে চাই।

শিলং-শৈলে অধিষ্ঠিত মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা অবগত আছেন কি না, জানি না; তবে এই দলিলে তিনি পরিষ্কার দেখিতে পাইবেন, তাঁহার সরকারেরই কয়েকজন উচ্চপ্রদস্থ অফিসারকে অপদস্থ করার প্রয়াসে কাছাড়ের ঐ ফেরারী শিলঙের সহিত কী চমৎকার যোগাযোগ রাখিয়া চলিয়াছেন। আমাদের সংবাদ, এই ব্যাপারে চালিহা-সরকারের কয়েকজন প্রভাবশালীত ব্যক্তির হাত কলকাঠি নাড়িতেছে।

কর্তব্য নিষ্ঠা কি অপরাধ?

কাছাড়ের ভাষা-আন্দোলন এবং হাইলাকান্দির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জের এখনও মেটে নাই। জেলার ডেপুটি কমিশনার শ্রী আর কে শ্রীবাস্তব ও হাইলাকান্দির মহকুমা হাকিম শ্রী খোশলার বিরুদ্ধে গত কিছুকাল যাবৎ এক শ্রেণীর লোক উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছেন।

শ্রীবাস্তবের অপরাধ, তিনি গত ১ জুন কার্যভার লইয়াই জেলার শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রশংসনীয় কৃতিত্বের পরিচয় দিতেছেন। শ্রীখোশলার অপরাধ, গত ১৯ জুন হিংস্র উত্তেজিত জনতাকে হাইলাকান্দি শহরে প্রবেশে তিনি বাধা দিয়াছিলেন। এই দুই কর্তব্যনিষ্ঠ অফিসারের ‘স্পর্ধা’ জেলার স্বার্থান্বেষী একদল লোকের মনোভঙ্গের কারণ হইয়া দাঁড়ায় এবং প্রকাশ, ইদানীং তাঁহারা শ্রীখোশলা ও শ্রীশ্রীবাস্তবকে সরকারের দৃষ্টিতে হেয় প্রতিপন্ন করার উল্লাসে মাতিয়াছেন।

দুঃসাহসের উৎস কোথায়?

নিম্নের এই চিঠি সেই হীন চক্রান্তের নগ্ন প্রকাশ। চিঠিখানা তথাকথিত শান্তি পরিষদের জনৈক নেতার লেখা। তাঁহার নাম শ্রীতজম্মুল আলি লস্কর। ইনি তজই মিঞা নামে পরিচিত। পুলিশ ওয়ারেন্টের তাড়নায় আত্মগোপনে থাকিয়া তিনি চিঠিতে লিখিতেছেন— ‘‘এস ডি-ও, ডি-সি, আরও কয়েকজন অফিসার সম্বন্ধে শিলং গিয়া আন্দোলন চালাইতে হইবে।’’— একই চিঠির অন্য জায়গায় লেখা— ‘‘আমার উপর আবার ওয়ারেন্ট।’’

ওয়ারেন্ট মাথায় নিয়ে শিলঙে ‘‘আন্দোলন’’ চালাইবার এত দুঃসাহস তজই মিঞা কোথা হইতে পাইলেন? অনুমান করি, তিনি এই ব্যাপারে শিলঙের কাহারও নিকট আশ্বাস পাইয়া থাকিবেন।

জুন মাসের প্রথমদিকে তজই মিঞাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আসাম সরকারের ‘বিশেষ নির্দেশে’ তিনি কিছুদিন পরই মুক্তি পান। তাঁহার বিরুদ্ধে আবার অভিযোগ উঠে। তিনি নাকি গত ১৯ জুন হাইলকান্দি দাঙ্গার অন্যতম প্রধান সংগঠক ছিলেন। তাঁহার নামে ওয়ারেন্ট বাহির করা হয়। তিনি তৎক্ষণাৎ আত্মগোপন করেন। কিন্তু ফেরারী হইলে কি হইবে, তজই মিঞা এখনও আসাম সরকারের উচ্চমহলের সহিত গোপন যোগাযোগ রাখিয়া চলিয়াছেন বলিয়া অভিযোগ পাওয়া গিয়াছে। ইদানীং তিনি কাছাড়ের ডেপুটি কমিশনার ও হাইলাকান্দির মহকুমা হাকিমকে ‘শায়েস্তা’ করার জন্য রাজধানী শিলঙ পর্যন্ত ধাওয়া করিতেছেন। ‘আত্মগোপনের’ এমন চমৎকার দৃষ্টান্ত সচরাচর পাওয়া যায় না।

গোয়েন্দা রিপোর্ট কি বলে?

এই চিঠি করিমগঞ্জের কানিশাইল গ্রামের শ্রী ইব্রাহিম আলি চৌধুরীকে লেখা। আলি সাহেবের কিঞ্চিৎ পরিচয় দান আবশ্যক। তিনিও শান্তি পরিষদের অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য। পাকিস্তানী চর হিসেবে কাজ করার অভিযোগে তাঁহাকে ইতিপূর্বে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁহার সম্পর্কে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা রিপোর্টের একাংশ এই প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ওই গোপন রিপোর্টে বলা হইয়াছে: ‘‘কাছাড়ের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইব্রাহিম আলি চৌধুরী নামক ‘আজাদ কাছাড় পার্টি’র একজন সদস্যকে নিবারক নিরোধ আইনে আটক রাখার যে আদেশ দেন, তাহাতে বলা হয়— আপনি পাকিস্তানী মুসলমানদের করিমগঞ্জ সীমান্তের অনুমোদিত পথ দিয়া বৈধ ছাড়পত্র ছাড়া গোপনে ভারতে অনুপ্রবেশে উৎসাহ ও সাহায্য দিতেছেন এবং তাহাদের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করিতেছেন। রাজ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিসন্ধিতে আপনি তাহাদিগকে আসামের বিভিন্ন স্থানে পাঠাইতেছেন।’’

ফেরারীর ফৌজ

ইব্রাহিম আলি চৌধুরীকে লেখা তজম্মুল আলি লস্করের চিঠিখানা হুবহু দেওয়া হইল। চিঠির উপরে লেখা ‘আর্জেন্ট’। রচনাস্থল শালচাপরা (শিলচরের নিকটে)। তারিখ গত ১৩ জুলাই। চিঠিখানা এইরূপ:

My Dear Nanajee,

সালাম পর এই যে জানিবেন, গতকল্য শিলচর গিয়া জানিতে পারিলাম আপনি গত পরশু release হইয়াছেন। ইহা শুনিয়া খুবই উৎসাহিত হইয়াছি। আগামীকল্য ৭টার গাড়িতে বদরপুর হইতে আমরা পুলকেশী সিংহসহ কয়েকজন শিলং রওয়ানা (হইব)। আপনি বিছানাপত্রসহ আসিয়া পড়িবেন। Gulab Singha, S. Raja Chaudhuri সহ আসিলে খুবই ভালো হইবে। যদি আগামী কল্য আসিতে না পারেন, তবে কবে রওনা হবেন, কোথায় দেখা হবে— তাহা জানাইবেন। অনেক জরুরী বিষয় আছে— দেখা হলে বিস্তারিত আলাপ হবে। মৌলভী আব্দুল লতিফও শিলং-এ আছেন। কাহেরও আসিতেছে। SDO, DC আরও কয়েকজন অফিসার সম্বন্ধে শিলং গিয়া আন্দোলন চালাইতে হবে। আমার উপর আবার Warrent, বিশেষ কি দেখা হলে বিস্তারিত আলাপ হবে। আমি শালচাপরায় আছি। ষ্টেশনের ধারে ইস্তাকির আলী সাহেবের বাড়িতে। সম্ভব হলে ট্যাক্সি করে চলে আসবেন। আমি ভাড়া দিয়া দিব। আমি ভাল আছি। ইতি—

তজম্মুল আলি লস্কর,

হাইলাকান্দি।

চিঠির বামদিকে, ‘পুনশ্চ’ হিসেবে লেখা আছে— ‘Gulap Babu J Salik Sahib গেলে আরও ২/৩ দিন অপেক্ষা করিতে পারি।’ তজই মিঞার নেতৃত্বে সদলবলে শিলং-যাত্রার উদ্দেশ্য পরিষ্কার। জেলার কয়েকজন সরকারি অফিসারের বিরুদ্ধে ‘আন্দোলন’। এই ‘আন্দোলন’ পরিচালনার অপচেষ্টা সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী শ্রীচালিহার কোনো বক্তব্য আছে কী?১৬৯

দলিলদস্তাবেজ অংশে চিঠিটির মূলকপি আমরা অন্তর্ভুক্ত করেছি। বাংলা ভাষা আন্দোলনকে বানচাল করার লক্ষ্যে আসাম সরকার কোনো পথই বাদ রাখেননি। আর এসব যে কেন্দ্রের নজরের বাইরে ঘটেছে— এমনটাও মনে করার কারণ নেই।

এই দাঙ্গার ফলে হাইলাকান্দিতে আবারও ঘরছাড়া মানুষ। অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, বাসস্থান নেই, চিকিৎসা নেই। এদের সংখ্যা চার হাজারের অধিক— যাদের ঠাঁই নেই, প্রাণরক্ষা সমস্যা। এদের মধ্যে নারী, পুরুষ, শিশু সবাই রয়েছে।

এইসব উৎখাত নিরস্ত্র মানুষের সেবায় এগিয়ে আসলেন ‘ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ’ এবং স্থানীয় সংগঠন ‘মাতৃভাষা শহিদ স্মৃতি ও সাহায্য সমিতি’, এবং শিলচরসহ আরও বেশ কিছু স্থানের মানুষ। শিলচরের এই সংগঠনের শাখা হাইলাকান্দিতেও ছিল। মোট ৩৬ জন সদস্য ছিলেন এই কমিটিতে। তবে কার্যকরী কমিটিতে ছিলেন ৯ জন সদস্য। এঁরা হলেন— ‘প্রমোদ রঞ্জন ভট্টাচার্য (বি এল), সভাপতি, যশোদারঞ্জন শিকদার (বি এ), সম্পাদক, তুলসী রায়, কোষাধ্যক্ষ, অমিয় কুমার নন্দী, সন্তোষ কুমার রায়, সুধীরচন্দ্র নাথ, বজরঙ্গ সারদা, কেশবচন্দ্র চক্রবর্তী এবং কিশোরীমোহন নাথ।’

হাইলাকান্দির দাঙ্গায় বিপন্ন মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবার জন্য সম্পাদক যশোদারঞ্জন শিকদার এক আবেদন জানালেন। যশোদারঞ্জন জানালেন:

Matri Bhasha Shaheed Smriti O Sahajya Samiti, Hailakandi branch requests the generous public and organisations in India to contribute their mite for the distressed people of Hailakandi. Inview of the communal disturbance of 19th June, 1961, Cachar in general and Hailakandi in particular, more than 600 houses only in Hailakandi Sub-division of Hindus have been gutted in fire by the Muslim Goondas apart from indiscriminate looting. 80% Hindu families in urbancent percent in rural areas are passing their days only on starvation and half starvation as a result of proclamation of curfew in Town & panicky in Village area. Hindus in Village area are not allowed to sell & purchase of their requirements. Thus entire Sub-division in particular is passing through faminery condition.১৭০ আবেদনপত্রটি ১৯৬১ সালের ১ জুলাই প্রচারিত হয়।

এই সংগঠন বেশ কিছু নগদ অর্থ ও নানা সাহায্য সামগ্রী কাছাড় জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। শিলচর পৌরসভা সভাপতি মহীতোষ পুরকায়স্থ, হাইলাকান্দির বীরেন্দ্রকুমার পালসহ কাঠলিছড়া, লালাবাজার এবং মনাছড়া এলাকা থেকে নগদ অর্থ ও বিভিন্ন সাহায্য সামগ্রী দুর্গতদের জন্য পাঠিয়েছিলেন।১৭১

৮ জুলাই তারিখেও সেনাবাহিনী শিলচর থেকে হাইলাকান্দি পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৩০ মাইল টহল দেয়। এ থেকে পরিষ্কার যে, পরিস্থিতি তখনও স্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছায়নি। আর তা ছাড়া প্রতিদিনের সংবাদপত্রের পাতা উল্টালেই দাঙ্গাহাঙ্গামার খবর কাছাড়ের কোথাও না কোথাও ঘটছেই।

উৎখাতে মানুষের সেবার জন্য হাইলাকান্দিতে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ পৌঁছে যায়। সংবাদে বলা হয়:

‘ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের পক্ষ থেকে দুর্গত অঞ্চলসমূহে সেবা কার্যের ব্যবস্থার জন্য স্বামী বিজয়ানন্দ গত ১ জুলাই, শিলচর এসে পৌঁছেছেন। স্বামীজি শিলচরে ডেপুটি কমিশনার, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপার, মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান এবং হাইলাকান্দির ম্যাজিস্ট্রেট এবং মহকুমা শাসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সঙ্ঘের সেবা কার্যের বিষয় আলোচনা করেছেন।

শিলচর, হাইলাকান্দি, লালাবাজার, চিবিটাবিছিয়া মোহনপুর, নরসিংপুর প্রভৃতি স্থানে প্রায় ৪ হাজার বিপন্ন নরনারী সর্বস্বান্ত হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। ক্যাম্পসমূহ ছাড়াও আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে বহু আশ্রয়প্রার্থী রয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে ক্যাম্পে অবস্থানকারী শরণার্থীদের মধ্যে রান্না উপযোগী চাল, ডাল, সরিষার তেল প্রভৃতি দেওয়া হয়।

ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ থেকে এই সমস্ত ক্যাম্পে আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে চিড়া, গুড়, পাঁউরুটি, বস্ত্রাদি, কাঁচা তরিতরকারী, মশলাপত্র বিতরণ করা হয়।

শিলচরে প্রধান কেন্দ্র স্থাপন করে প্রতিদিন ৩০/৪০ মাইল দূরে গিয়ে স্থানীয় একদল সেচ্ছাসেবকের সহায়তায় সঙ্ঘ কর্মিগণ সান্ধ্য আইনের মধ্যেও সাহায্য বিতরণ করছেন। শিলচরে ডেপুটি কমিশনার শ্রী আর কে শ্রীবাস্তব, হাইলাকান্দির ম্যাজিস্ট্রেট শ্রী বড়ুয়া এবং এস.ডি.ও শ্রী খোসলা সঙ্ঘ কতৃপক্ষকে তাঁদের সাধ্যমত সবরকমের জিনিসপত্র দিয়ে সাহায্য করবার আবেদন জানিয়েছেন। যে সমস্ত দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিস সরকারের পক্ষ থেকে বিতরণ করা সম্ভব হচ্ছে না— সেই সমস্ত দ্রব্য যথা— বস্ত্র, মশারি, কম্বল, বিছানা, বাসনপত্র, কাঁচা তরিতরকারী, মশলা, চিড়া, গুড়, শিশু উপযোগী খাদ্য ইত্যাদি বিতরণের জন্য সঙ্ঘ কর্মিদের অনুরোধ জানান। তদনুযায়ী সঙ্ঘ থেকে বর্তমানে উপরোক্ত দ্রব্যাদি বিতরণ করা হয়।’১৭২

‘হাইলাকান্দির কংগ্রেস সভাপতি, স্থানীয় রিলিফ কমিটি কতৃপক্ষ এবং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ ৮ জুলাই ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের স্বামী বিজয়ানন্দের সঙ্গে দেখা করে সঙ্ঘের সাহায্য কেবল আশ্রয়প্রার্থী শিবিরসমূহেই সীমাবদ্ধ না রেখে, বিপন্ন সর্বশ্রেণির নরনারীর মধ্যে প্রসারের জন্য আবেদন জানান।

গত ২ জুলাই অধিক রাতে প্রাপ্ত সংবাদে প্রকাশ যে, সেবাকাজের ব্যাপকতা লক্ষ্য করে শিলচরসহ সঙ্ঘের সেবাকেন্দ্র থেকে কলকাতায় টেলিফোনযোগে অধিকসংখ্যক কর্মিসহ সঙ্ঘের যুগ্ম সম্পাদক স্বামী যোগানন্দজীকে অবিলম্বে কাছাড়ে আসার অনুরোধ জানান।’

এ সময় হাইলাকান্দির নিম্নবিত্তের মানুষেরা কেমন ছিলেন— তারও একটি চিত্র সমকালীন সংবাদপত্রে পাওয়া যায়। সংবাদে প্রকাশ:

‘হাইলাকান্দি শহরে গত দু’সপ্তাহ যাবৎ, কোনো সময় সারা দিনরাত, কোনো সময় বেলা ২টা থেকে সকাল পর্যন্ত সান্ধ্য আইন জারি থাকায়, দিন মজুরি করে যারা জীবিকা নির্বাহ করতেন, তাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠেছে। ছোটো ছোটো দোকানদার, তরিতরকারী বিক্রয়কারী, তন্তুবায় সম্প্রদায়, দুগ্ধ বিক্রেতা, রিক্সাচালক এবং কৃষক শ্রেণির অবস্থা অবর্ণনীয়। স্থানীয় লোকের ধারণা যে, এই অবস্থা আর কিছুদিন চললে এখানকার দৈনন্দিন পারিবারিক বা সমাজ জীবনে এক ঘোরতর বিপর্যয় ডেকে আনবে।’১৭৩

মানুষ সৃষ্ট এই দাঙ্গাহাঙ্গামা মানুষকে যে কোথায় নিয়ে গিয়েছিল বা কোথায় নিয়ে যেতে পারে— তার পরিচয় তো অর্ধশতাব্দীরও অধিক কালের সংবাদপত্র থেকে আঁচ পাওয়া যায়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিরাশ্রয় শিশু, পুরুষদের হাইলাকান্দি ইন্দ্রকুমারী গার্লস স্কুল আশ্রয় শিবিরে আশ্রিতদের ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের তরফ থেকে খাদ্য বিতরণের যে দৃশ্য পত্রিকায় মুদ্রিত হয়েছে— সেইসব শিশুমুখ আজও কেউ দেখলে দু-ফোঁটা চোখের জল না ফেলে পারবেন না। এসব শিশুদের অপরাধ কী? আসাম সরকার কি কখনও ভেবেছেন? বাঙালি হয়ে জন্মগ্রহণই কি তাদের পাপ?

বহু প্রতীক্ষিত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের উদ্যোগে ২৭ জুন মঙ্গলবার কলকাতায় দু-জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর উপস্থিতিতে কাছাড় নেতৃবৃন্দের ভাষা সংক্রান্ত আলোচনার ‘আশাব্যাঞ্জক’ সংবাদ পাওয়া গেছে বলে সংবাদে উল্লেখ করা হয়। আলোচনাকালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শ্রীঅশোক সেন ও শ্রী অনিল চন্দ উপস্থিত ছিলেন। জানা যায়, শাস্ত্রী সূত্রের ভিত্তিতেই তাঁদের মধ্যে কথাবার্তা চলে। তবে প্রয়োজনবোধে শাস্ত্রীসূত্রের কয়েকটি ধারা পরিবর্তনের প্রস্তাব বিবেচনার আশ্বাস পাওয়া যায় বৈঠকে।

‘ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার জেদের ফলে কেন্দ্রীয় সরকার বাঙলাকে আসামের রাজ্যভাষারূপে পূর্ণ স্বীকৃতি দেওয়া ছাড়া বাঙলা ভাষার অনুকূলে অন্যান্য নানাপ্রকার সুযোগসুবিধা দিতে প্রস্তুত। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের আইনমন্ত্রী শ্রী অশোক সেন নাকি আলোচনাকালে জানিয়েছেন, শাস্ত্রীসূত্রের পরিবর্তন যাই-ই হোক না কেন, তা আসাম সরকার ও কাছাড়বাসী উভয়ের মত নিয়েই করা হবে।

এ প্রসঙ্গে ১৯৫৬ সালে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের সংখ্যালঘুদের রক্ষাকবচ সংক্রান্ত স্মারকলিপি বাধ্যতামূলক করা এবং কাছাড়ের সঙ্গে শিলঙের আদানপ্রদানের অন্যতম ভাষা বাঙলা করার কথাও ওঠে।’

এ দিনের আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আলোচনা আশাব্যঞ্জক হয়েছে কি না তা তাঁর পক্ষে বলা অনুচিত। তবে আবহাওয়া ‘ঠাণ্ডাই।’

বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে দীর্ঘ আশি মিনিটব্যাপী এই আলোচনার প্রথম ভাগে কাছাড় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে শ্রী নন্দকিশোর সিংহ, শ্রী আলতাফ হোসেন মজুমদার, মৌলভী আবদুল জলিল এবং শ্রী উৎপল রায় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেন। কিয়ৎকাল পর গণসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সর্বশ্রী আবদুর রহমান চৌধুরী, রথীন্দ্রনাথ সেন, বিধুভূষণ চৌধুরী, গোলাম ছবির খান, জিতেন্দ্র চৌধুরী, অনিল বর্মণ ও ভূপেন্দ্র সিংহ আলোচনায় যোগ দেন।

কাছাড়ের প্রতিনিধিদল প্রথমে তাঁদের বক্তব্য পেশ করেন এবং কী কী কারণে শাস্ত্রীসূত্র তাঁরা প্রত্যাখ্যান করেছেন, তা জানান। তবে তাঁরা বলেন, জাতীয় সংহতির খাতিরে নতুনভাবে যেকোনো প্রকার আলোচনা করতে তাঁরা প্রস্তুত।

আলোচনাকালে শাস্ত্রীসূত্রের দুটি ধারা পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। ১৯৫৬ সালে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের সংখ্যালঘুদের রক্ষাকবচ সংক্রান্ত স্মারকলিপি আসামের সর্বত্র বাধ্যতামূলক করার এবং কাছাড়ের সঙ্গে শিলং-এর আদানপ্রদানের ভাষা বাংলা করার প্রস্তাব আলোচিত হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে আইনমন্ত্রী শ্রী সেন জানান, আইনগত কোনো বাধা না থাকলে ওই দুটি সংশোধন বিবেচনা করা যেতে পারে। মোটকথা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার জেদের ফলে সোজাসুজি বাংলাকে রাজ্যের দ্বিতীয় ভাষারূপে স্বীকার না করে কেন্দ্রীয় সরকার নাকি বাংলা ভাষাকে আর যত প্রকার সুযোগসুবিধা দিতে প্রস্তুত। তবে সেন নাকি বলেন, পরিবর্তন যাই-ই হোক না কেন, আসাম সরকারের মত ছাড়া কিছুই হবে না।

মুখ্যমন্ত্রী বলেন, বর্তমান পরিস্থিতির পটভূমিকায় তাঁর পক্ষে কোনো উপদেশ দেওয়া অনুচিত। কাছাড়বাসীরা নিজেরাই যেন ভাষার প্রশ্নে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত নেয়।

আরও প্রকাশ, ডা রায়ের বহুভাষী রাজ্যগঠনের ফর্মুলা আলোচনায় বিশেষ ওঠেনি। কারণ সেটি সর্বভারতীয় বিষয়।’১৭৪

এদিকে ‘নিখিল আসাম বঙ্গভাষাভাষী সমিতির দুদিনব্যাপী কার্যনির্বাহক সমিতির সভা ২৭ জুন লামডিং-এ শেষ হয়। সমিতি গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়, ‘কাছাড়ে পাইকারী গুণ্ডামির কারণ নির্ণয় এবং গুণ্ডামির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানাচ্ছে।

বাংলাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি পূরণের জন্য সমস্ত সম্প্রদায়ের সম্মিলিত উদ্যোগে আরম্ভ গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বানচাল করার সুস্পষ্ট উদ্দেশ্যেই ১৯ জুন হাইলাকান্দিতে হাঙ্গামা ঘটান হয় বলে প্রস্তাবে উল্লিখিত হয়।

প্রস্তাবে আরও বলা হয় যে, কুচক্রী ও ভারত বিরোধী শক্তিসমূহ সমগ্র কাছাড়কে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামায় নিমজ্জিত করতে চাচ্ছে। সমিতি বিশ্বাস করেন যে, বহুসংখ্যক পাকিস্তানি নাগরিকদের বেআইনিভাবে রাজ্যে অনুপ্রবেশ করার ফলেই কাছাড়ে সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব আরম্ভ হয়েছিল। প্ররোচনা সত্ত্বেও অবিচলিত থাকার জন্য সমিতি বাংলা ভাষা আন্দোলনের সমস্ত সম্প্রদায়ভুক্ত নেতৃবর্গকে অভিনন্দিত করেন।…

বাংলা একটি জেলার ভাষা বলে তাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়া যেতে পারে না বলে আসামের অর্থমন্ত্রী শ্রী ফকরুদ্দীন আলি আহমদ গত ৩ জুন দমদমে যে মন্তব্য করেন সমিতি তার প্রতিবাদ করে বলেন যে, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ও পার্বত্য জেলাগুলিতে লক্ষ লক্ষ লোকের মাতৃভাষা বাংলা।’১৭৫

কলকাতায় শাস্ত্রীসূত্র নিয়ে ২৮ জুন দ্বিতীয় দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। ‘বুধবার সকাল ৮টায় কাছাড়ের চারজন কংগ্রেস নেতা সর্বশ্রী নন্দকিশোর সিংহ, জ্যোৎস্না চন্দ, মৌলানা আবদুল জলিল ও আলতাফ হোসেন মজুমদার কেন্দ্রীয় উপমন্ত্রী শ্রী অনিল চন্দের সঙ্গে পৃথকভাবে দুঘণ্টা আলোচনা করেন। বেলা ১০টায় সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিদল কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী শ্রী অশোক সেনের সঙ্গে পৃথকভাবে এক ঘণ্টাকাল আলোচনা করেন। এর পর উপমন্ত্রী চন্দসহ কাছাড়ের কংগ্রেসি নেতৃবৃন্দ শেষোক্ত বৈঠকে এসে যোগ দেন।

তা ছাড়া কাছাড়ের চারজন কংগ্রেস নেতা এ দিন বিকাল ৪-৩০টায় রাইটার্স বিল্ডিংয়ে মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে দেখা করে আধঘণ্টা আলোচনা করেন। এই আলোচনায় শ্রী চন্দও উপস্থিত ছিলেন।

এই দিনের তিনদফা আলোচনার পর কাছাড় প্রতিনিধিদলের জনৈক মুখপাত্র বলেন, কলকাতা-বৈঠকে কিছুটা সুফল পাওয়া গেছে এবং বাংলা ভাষার দাবীর অনুকূলে কেন্দ্রীয় সরকার বিবেচনা করতে পারেন বলে তাঁরা এখন আশান্বিত।…মুখপাত্র জানান, বাংলাকে আসামের অতিরিক্ত সরকারি ভাষারূপে স্বীকৃতির দাবীতে তাঁরা এখনও অনড় আছেন এবং আশা করেন সংশোধিত শাস্ত্রী-সূত্রে তাঁদের মূল দাবীর পনের আনাই কার্যত মেনে নেওয়া হবে।’

‘কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে নাকি আসাম সরকারের অনুমতি সাপেক্ষ শাস্ত্রী-সূত্র কিছুটা সংশোধনের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। নয়াদিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর ওই সংশোধন রূপ পাকাপাকি জানা যাবে বলে আশা করা যায়।

কলকাতার বৈঠকে কাছাড় নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে ১৯৫৬ সালের সংখ্যালঘুদের রক্ষাকবচ সংক্রান্ত স্মারকলিপি আইনত কার্যকরী ছাড়াও কাছাড়ের সঙ্গে সদর দপ্তরের আদানপ্রদানের ভাষা বাংলা করার এবং আইন বিল ইত্যাদি অসমিয়া ও ইংরেজির মতো বাংলাভাষায় রচনা করার দাবি দৃঢ়তার সঙ্গে জানান হয়েছে। … জানা গেছে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে ১৯৫৬ সালে সংখ্যালঘুদের রক্ষাকবচ সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তরের স্মারকলিপি আবশ্যিকভাবে কার্যকর করার অনুকূলে মত দেওয়া হয়েছে।

সংগ্রাম পরিষদ প্রতিনিধিদল বুধবার রাতে নয়াদিল্লি রওয়ানা হন। কাছাড় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ আজ অর্থাৎ ২৯ জুন নয়াদিল্লি রওনা হবেন।’১৭৬

এদিকে আসাম সরকারের সরবরাহ মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী কাছাড় জেলায় দশদিন পরিভ্রমণ শেষে ২৭ জুন শিলং ফিরে আসেন। মন্ত্রী কাছাড়ের পল্লি অঞ্চলে মোট ২৭টি জনসভায় বক্তৃতা করেন। ২৮ জুন শিলং-এ আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে মইনুল হক চৌধুরী তাঁর বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে এবং কয়েক ব্যক্তি যে অনিষ্টকর সংবাদ প্রচার করেন— তার বিস্তৃত ব্যাখ্যা দেন। তিনি ‘ভাষা-সমস্যা সমাধানের জন্য শ্রী হকচৌধুরী সমাজের সকল স্তরের লোকের কাছে আন্দোলনের পথ পরিহার করার অনুরোধ জানান। (এবং তাহলেই) অবিলম্বে কাছাড় জেলায় পূর্ণ শান্তি বিরাজ করবে। এ বিষয়ে শ্রী হক চৌধুরী সুনিশ্চিত। তিনি দুঃখ করে বলেন যে, এখন পর্যন্ত কিছু লোক কাছাড়ে শান্তি চান না। এক শ্রেণির সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ থেকেই এটা স্পষ্ট।

শ্রীমইনুল হক চৌধুরী বলেন যে, তাঁর মতে কাছাড়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব ঘটেছে এবং এর পরিণতি সম্পর্কে তিনি সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্ক করেন। তিনি বলেন যে, একাধিকবার তিনি কাছাড়ের তিনজন কংগ্রেস সভাপতিকেই তাঁদের নীতি পুনর্বিবেচনা করতে এবং ‘শাস্ত্রী-সূত্র’ মেনে নিতে অনুরোধ করেছেন। তিনি আরও বলেন যে, শিলচর ও হাইলাকান্দির কংগ্রেস সভাপতিদ্বয়কে অনুরোধ করা সত্ত্বেও পল্লী অঞ্চলে জনসভায় তাঁকে (শ্রীহক) তাঁর অভিমত ব্যক্ত করতে দেওয়া হয়নি। শ্রীহক কংগ্রেস সভাপতিগণকে বলেন যে, কেউ যদি কংগ্রেস ও প্রশাসনিক দিক থেকে কাছাড়ের পৃথকীকরণ এবং সেইসঙ্গে শাস্ত্রী ফর্মুলার পক্ষে বলতে না পারেন, তবে পল্লী অঞ্চলে কেউ তাঁর কথা শুনবেন না। এই শর্তে তারা সভার ব্যবস্থা করতে সম্মত না হয়ে চলে যান। এরপরই গুজব প্রচারিত হয় এবং ইচ্ছা করেই সংবাদপত্রে প্রচার করা হয় যে, কংগ্রেস কমিটিগুলি তাঁকে আহ্বান করেনি।’১৭৭

পূর্ব প্রতিশ্রুত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ নেতৃত্ব এবং কাছাড় কংগ্রেস নেতৃত্ব ২ জুলাই নয়াদিল্লিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

১৬ সদস্যবিশিষ্ট কাছাড় সংগ্রাম পরিষদ প্রতিনিধিগণ আজ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীশাস্ত্রীকে জানান যে, ‘তাঁরা আগামী তিন মাসের মধ্যে ভাষা আন্দোলন শুরু করবেন না।

প্রয়োজন হলে তাঁরা ওই আন্দোলন আরও বেশিদিন বন্ধ রাখবেন এবং আসাম সরকার ভাষাগত সংখ্যালঘুদের রক্ষাকবচ সংক্রান্ত ১৯৫৬ সালের স্মারকলিপি ঠিকভাবে কার্যকর হচ্ছে কি না তা লক্ষ করবেন।

তাঁরা শ্রী শাস্ত্রীকে আরও বলেন যে, ওই সময়ের মধ্যে রক্ষাকবচগুলি কার্যকর করার ব্যাপারে তাঁরা যদি সন্তুষ্ট না হতে পারেন তবে বাংলাকে আসামের অতিরিক্ত রাজ্য ভাষা হিসেবে গ্রহণের জন্য আন্দোলন আবার শুরু করবেন। তবে ওই আন্দোলন শুরু করার পূর্বে তাঁরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানাবেন। সেই আন্দোলন কেবল কাছাড়েই সীমাবদ্ধ থাকবে না বলেও তাঁরা জানান।

প্রতিনিধিদল আজ দুবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দ্বিতীয় সাক্ষাৎকার প্রায় রাত ১২টা পর্যন্ত চলে। এরপর প্রতিনিধিগণ বলেন যে, আলোচনার ফলাফলে তাঁরা সন্তুষ্ট হতে পারেননি এবং সংগ্রাম পরিষদ তাঁদের কোনো দাবীই পরিত্যাগ করেননি।

১৯৫৬ সালের মেমোরেণ্ডামে যে সমস্ত নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আসাম গভর্নমেন্ট এর সমস্ত শর্ত মেনে নেবেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রতিনিধিদলকে এই প্রতিশ্রুতি দিতে পারেননি। প্রধানত এই কারণেই আলোচনা সফল হয়নি বলে প্রতিনিধিদল মনে করেন।

প্রকাশ, পরিষদ নেতৃবৃন্দ এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি চেয়েছিলেন, কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বলা হয় যে, কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে এরূপ প্রতিশ্রুতি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিরোধী। পরিষদ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দুবার সাক্ষাৎ করবার মধ্যবর্তীকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসামের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্রকাশ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রতিনিধিদের জানান যে, বাঙ্গলা ভাষায় কাছাড়ের সঙ্গে কাজকর্ম চালাতে আসাম সরকার সম্মত নয়। শাস্ত্রী প্রস্তাব অনুযায়ী কাজকর্ম ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে হবে।

কিন্তু তিনি বলেন যে, কাছাড় সংক্রান্ত সমস্ত বিল, অর্ডিন্যান্স, গেজেটের নোটিশ প্রভৃতি বাঙ্গলা ভাষায় প্রচারিত হবে এবং কাছাড় থেকে পত্রাদি শিলং-এ বাঙ্গলায় প্রেরিত হতে পারে, এতে আসাম সরকার সম্মত হয়েছেন।

প্রতিনিধি নেতৃবৃন্দ মনে করেন যে, আলোচনায় মোট ফল এই যে, এটা ব্যর্থ হয়েছে। এজন্য তাঁরা তাদের দাবি পরিত্যাগ করেননি। যদি তাঁরা মনে করেন যে, আসাম সরকার পূর্বের ন্যায় ১৯৫৬ সালের মেমোরেণ্ডামের শর্তাদি পূরণ করবেন না, তবুও মীমাংসার ঐকান্তিক ইচ্ছা হেতু আন্দোলন পুনরায় এক্ষণে আরম্ভ করে হবে না।’

কাছাড় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দও আজ সকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। মধ্যরাতের পর তাঁরা পুনরায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। কংগ্রেস প্রতিনিধিদল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাবার পূর্বে উভয় প্রতিনিধিদলের মধ্যে তাড়াহুড়ো করে এক আলোচনা হয়।

আগামীকাল সকালে উভয় প্রতিনিধিদল স্বতন্ত্রভাবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।

২ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে প্রতিনিধিদলের বৈঠকে কাছাড়ের ভাষা সমস্যা যে সমাধানের পথে অগ্রসর হচ্ছে, আজ সকালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীলালবাহাদুর শাস্ত্রী ও কাছাড় সংগ্রাম পরিষদ প্রতিনিধিদের মধ্যে ৯০ মিনিটকাল বৈঠকের পর এরূপ ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

প্রতিনিধিদলের নেতা শ্রী আবদুর রহমান চৌধুরী বৈঠকের পর সাংবাদিকদের জানান, এই সমস্যার সমাধান হইবে বলিয়া আমরা আশা করি। আলাপ আলোচনা এখনও সমাপ্ত হয়নি। তিনি বলেন যে, প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিকট তাঁদের অন্যতম দাবী পেশ করে জানান হয় যে, কাছাড় জেলা ও আসামের সরকারি দপ্তরখানার মধ্যে বাংলার মাধ্যমে সংযোগ সাধনের ব্যবস্থা করতে হবে।

শ্রীআবদুর রহমান চৌধুরী জানান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংগ্রাম পরিষদের দাবী পর্যালোচনা করার জন্য কিছু সময় চান।

সংগ্রাম পরিষদের সেক্রেটারি ও প্রতিনিধিদলের সদস্য শ্রী নলিনীকান্ত দাস বলেন যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন যে, প্রতিনিধিবৃন্দ আগামীকাল প্রধানমন্ত্রী শ্রীনেহরুর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হবেন এবং এই গোলটেবিল বৈঠকে এ সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে।’১৭৮

৩ জুলাই পুনরায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কাছাড় কংগ্রেস নেতৃত্ব এবং সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ পৃথক পৃথকভাবে বৈঠকে মিলিত হন। দুটি সংগঠনের নেতৃবৃন্দই মনে করেন যে, ‘সরকারকে শাস্ত্রী-সূত্র কার্যকর করার সুযোগ দিতে হবে।’

সংবাদে বলা হয়, ‘উভয় প্রতিনিধিদলের মুখপাত্র আজ বলেন যে, প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, কেন্দ্রীয় সরকারের ১৯৫৬ সালের মেমোরেণ্ডাম কার্যে পরিণত করা হবে। এই মেমোরেণ্ডামে ভাষাগত সংখ্যালঘুদের রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং শাস্ত্রী সূত্রের এটা উল্লেখযোগ্য বিষয়। সংগ্রাম পরিষদের প্রেসিডেন্ট জনাব আবদুর রহমান চৌধুরী এবং জেনারেল সেক্রেটারী শ্রীনলিনীকান্ত দাস এক বিবৃতিতে বলেন, ‘তিন সপ্তাহ পূর্বে আমরা শাস্ত্রীসূত্র প্রত্যাখ্যান করেছিলাম, কিন্তু কয়েকটি অতিরিক্ত রক্ষাকবচের প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় আমরা পূর্ব সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে সম্মত হয়েছি।’ পরিবর্তনের ফলে কাছাড় থেকে রাজ্য হেড কোয়ার্টারে চিঠিপত্র বাংলাভাষায় প্রেরিত হবে এবং বিলসমূহ ও গেজেটের নোটিশ প্রভৃতি ইংরেজি ও অসমিয়া ব্যতীত বাংলাভাষাতেও প্রকাশিত হবে। শাস্ত্রীসূত্রে বলা হয় যে, ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারত সরকারের মেমোরেণ্ডাম কাজে পরিণত করা হবে। এই মেমোরেণ্ডামে বলা হয়েছে যে, প্রাথমিক শিক্ষা মাতৃভাষায় দেওয়া হবে এবং চাকরিতে নিয়োগ সম্পর্কেও রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

প্রকাশ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রতিনিধিদের বলেন যে, সর্বভারতীয় ভিত্তিতে ভাষাগত সংখ্যালঘু সমস্যা সমাধানই গভর্নমেন্ট চাচ্ছেন। দক্ষিণাঞ্চল ১৯৫৬ সালের মেমোরেণ্ডাম কাজে পরিণত করবার ব্যবস্থা অবলম্বন করেছে।

পরিষদ নেতৃবৃন্দ তাঁদের বিবৃতিতে জানিয়ে দিয়েছেন যে, বাংলাভাষাকে আসামের দ্বিতীয় সরকারি ভাষা করবার দাবী পরিত্যক্ত হয় নাই। বিবৃতিতে আরও বলা হয় যে, দেশের সংহতি রক্ষাকল্পে এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আন্তরিকতা হেতু গভর্নমেন্টকে শাস্ত্রীসূত্র কাজে পরিণত করবার সুযোগ দেওয়ার জন্য আমরা সত্যাগ্রহ আন্দোলন কিছুদিন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

সংযোগ-ব্যবস্থা, শিক্ষা, চাকরি, উন্নয়ন এবং শিল্প-প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আমাদের যে-সকল দাবী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মেনে নিয়েছেন, তা যাতে বাস্তবায়ন হয় সেজন্যই এটা করা হয়েছে।

প্রতিনিধি দল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, সত্যাগ্রহ প্রয়োজন হলে বেশ কিছুদিন স্থগিত থাকবে, কিন্তু যদি অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি হয় এবং ১৯৫৬ সালের মেমোরেণ্ডাম যথাযথভাবে কাজে পরিণত না হয়, তাহলে তাঁরা আন্দোলন পুনরায় আরম্ভ করতে দ্বিধা করবেন না।

কংগ্রেস প্রতিনিধি দলের নেতা শ্রীরণেন্দ্রমোহন দাস এক বিবৃতিতে বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী যেরূপ বিশ্লেষণ করেছেন এবং যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাতে আমরা মনে করি যে, শাস্ত্রী-সূত্র এখন যেরূপ আছে, তা কার্যে পরিণত করবার সুযোগ দেওয়া উচিত। প্রকাশ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, ১৯৫৬ সালের মেমোরেণ্ডাম পুরোপুরিভাবে কার্যে পরিণত করা হবে।’১৭৯

‘৩ জুলাই সকাল সাড়ে এগারোটায় কাছাড় গণ সংগ্রাম পরিষদের ষোলো সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর অফিসে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। একঘণ্টা দশ মিনিট আলোচনা চলে এবং নিম্নলিখিত বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়:

১. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে পরিষদ প্রতিনিধিদের আলোচনার ফলাফল;

২. ৩০ জুন তারিখে প্রধানমন্ত্রীর সাংবাদিক বৈঠক এবং ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলন ও আসাম সমস্যা সম্পর্কে মন্তব্য;

৩. সংগ্রাম পরিষদের স্মারকলিপির বিষয়সমূহ।

প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব করেন জনাব আবদুর রহমান চৌধুরী এবং তাঁকে সহায়তা করেন শ্রীনলিনীকান্ত দাস ও শ্রী দিলীপ চক্রবর্তী। প্রথমে পরিষদের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, যদিও গতদিনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় কোনো গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়নি, তবুও পরিষদ নেতৃবৃন্দ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আন্তরিকতায় সুখী হয়েছেন এবং তাঁদের দাবী অনুসারে শাস্ত্রী ফর্মুলা যেভাবে সংশোধিত হয়েছে, তা প্রয়োগের সুযোগ দানের জন্য আন্দোলন সাময়িকভাবে স্থগিত রাখতে স্বীকৃত হয়েছেন।

১৪ বছর কাল যাবত আসাম সরকার অসমিয়া এবং অনসমিয়া সমাজের মধ্যেও বিভেদমূলক নীতি অবলম্বন করেছেন, প্রধানমন্ত্রীকে তার পূর্ণ বিবরণ দেওয়া হয়। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে তদানীন্তন গভর্নর আকবর হায়দারী আসাম বিধান সভায় যে উদ্বোধনী বক্তৃতা দান করেন, তাও প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা হয়। বলা হয় যে, দীর্ঘকালের অত্যাচারে নিরুপায় হয়েই সংগ্রাম পরিষদ তাঁদের আন্দোলন শুরু করেন।

প্রধানমন্ত্রীকে বলা হয় যে, ১৯৫৬ সালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে স্মারকলিপি প্রদান করেছিলেন, তার ৮ নম্বর অনুচ্ছেদের অমর্যাদা করে, আসাম সরকারি ভাষা আইন পাশ করা হয়।

প্রধানমন্ত্রীকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, সংগ্রাম পরিষদ অসমিয়া ভাষা কিংবা অসমিয়া জাতির বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনা করে নাই, এর একমাত্র উদ্দেশ্য রাজ্যের অনসমিয়া অধিবাসীদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।’১৮০

‘ … প্রতিনিধিদল পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করেন যে, তাঁরা কাছাড়কে আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চান না, বরং ভারতীয় নাগরিক হিসেবে সমস্ত অধিকার নিয়েই আসামে বাস করতে চান। আসামে নতুন ধরনের (আসাম হাঙ্গামা) উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক আশ্বাসকে পর্যন্ত সম্পূর্ণ কার্যকরী করার চেষ্টা হয়নি। পক্ষান্তরে যে সমস্ত ব্যক্তি লুঠতরাজ অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, ইত্যাদির মতো কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল এরূপ কোনো কোনো ব্যক্তিকে পুনর্বাসন ঋণ দেওয়া হয়েছে। ১৯৪৮ সাল থেকে আসামে চারটি হাঙ্গামা হয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো দুষ্কৃতিকারীরই শাস্তি হয়নি। এর ফলে সমাজবিরোধীদের সাহস বেড়েছে এবং নিরীহ অনসমিয়াভাষী জনসাধারণের মনে তাদের নিরাপত্তা সম্পর্কে সন্দেহের সঞ্চার হয়েছে।

আসামে ক্রমাগত যে বৈষম্যমূলক আচরণ এবং সরকারি অবিচার অনুষ্ঠিত হচ্ছে তার উল্লেখক্রমে সংগ্রাম পরিষদ প্রতিনিধিদল দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেন যে, আসাম সরকারের ওপর তাঁদের বিন্দুমাত্র আস্থা নেই এবং এই সরকারের শুভবুদ্ধির ওপর কোনো কিছুই ছেড়ে দিতে তাঁরা রাজী নন। আরও বলা হয় যে, সংগ্রাম পরিষদ বাংলাকে রাজ্যভাষার সম্মানদান এবং অন্যান্য অনসমিয়া ভাষার যোগ্য মর্যাদা দেওয়া সংক্রান্ত তাঁদের মূল দাবি থেকে অণুমাত্র বিচ্যুত হননি। পরিষদ কেন্দ্রীয় সরকারকে কিছু সময় দেবেন এবং তারপর প্রয়োজনবোধে আবার আন্দোলন শুরু করবেন। গত এক বছরে আসামে কখনও স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজিত ছিল না। …

আলোচনা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী পরিষদের দাবীর যৌক্তিকতা স্বীকার করে বলেন যে, কলকাতার পত্রিকা দাবীর ক্ষতি করেছে। প্রতিনিধিরা বলেন যে, তাঁরা কলকাতার পত্রিকার পক্ষ সমর্থন করতে আসেননি, কিন্তু তাঁরা কলকাতার সংবাদপত্রের কাছে কৃতজ্ঞ, কারণ এই সমস্ত পত্রিকার সাহায্য ছাড়া তাঁদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বহু সত্য ঘটনাই প্রকাশিত হতে পারত না। প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, যে পদ্ধতিতে কলকাতার পত্রিকাসমূহ সংবাদ প্রকাশ করেছে, তা সমর্থনযোগ্য নয়। প্রতিনিধিরা বলেন, কী পদ্ধতিতে সংবাদ পরিবেশন করা উচিত তা সংশ্লিষ্ট পত্রিকাসমূহের কর্মকর্তারাই স্থির করবেন, এটা অন্যদের বিচার্য নয়। প্রসঙ্গক্রমে আসাম উপত্যকার সংবাদপত্রসমূহ এবং গৌহাটির পি টি আই যে ন্যক্কারজনক ভূমিকা গ্রহণ করেছে, তার প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।

প্রধানমন্ত্রীকে জানান হয় যে, নওগাঁ জেলার লামডিং-এ চল্লিশ হাজার বাঙালির বাস, কিন্তু সেখানেও আসাম সরকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও স্থাপন করেন নাই।

পাকিস্তানি অনুপ্রবেশের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী হেসে বলেন যে, আসামের মুখ্যমন্ত্রী সীমান্তে বেড়া দেওয়ার কথা চিন্তা করছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন হয়ত অর্থনৈতিক কারণেই কিছু অনুপ্রবেশ হচ্ছে। কিন্তু প্রতিনিধিরা বুঝিয়ে দেন যে, এর পেছনে একটা সুপরিকল্পিত উদ্দেশ্য আছে, তা শুধু আসামের নয়— সমগ্র ভারতের নিরাপত্তার পক্ষেই বিপজ্জনক।’১৮১

‘উভয় প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাৎকার শেষে প্রধানমন্ত্রী শ্রীনেহরু সাংবাদিকদের বলেন, আলোচনা খুবই ভালো হয়েছে। তিনি আশ্বাস দেন শাস্ত্রী-সূত্র ঠিকমত কার্যকরী করা হবে।

পরিষদ প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য অধ্যাপক দিলীপ চক্রবর্তী সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, আলোচনা কতকাংশে ফলপ্রসু হয়েছে। ভারত সরকার সহানুভূতিশীল বলেই আমাদের মনে হয়েছে।’১৮২

২ ও ৩ জুলাই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কাছাড় গণ-সংগ্রাম পরিষদ এবং কাছাড় কংগ্রেস নেতৃত্ব উভয় সংগঠনই শাস্ত্রী-সূত্র কার্যকর করতে কেন্দ্রকে অন্তত তিন মাস সময় দিতে চান এবং এ সময় তাঁরা সত্যাগ্রহ আন্দোলন স্থগিত রাখবেন। আর একটি বিষয়, ১৯৫৬ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্মারকলিপি— যেখানে ভাষাগত সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় বা রক্ষাকবচ রক্ষিত হয়েছে— তার যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না তা লক্ষ রাখবেন। এই রক্ষাকবচে প্রধান বিষয়টিই হচ্ছে, মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাইমারি বা প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা সংরক্ষণ। কাছাড় নেতৃত্বের বক্তব্য আসাম সরকারের ওপর কোনোভাবেই আস্থা রাখা যায় না। কারণ অতীতে এবং এখনও হামেশাই মুখ্যমন্ত্রী চালিহা তাঁর মত পাল্টিয়ে চলেছেন। এ প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী উভয়ে কথা দিয়েছেন যে ১৯৫৬ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের স্মারকলিপির যথাযথ বাস্তবায়ন যাতে হয়— তার প্রতি তাঁরা দৃষ্টি রাখবেন। কেন্দ্রীয় সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বের কথার ওপর আস্থা রেখে ভাষা আন্দোলনের বিষয়টি আপাতত স্থগিত রাখা হয়। তবে কাছাড় নেতৃত্ব কেন্দ্রীয় সরকারকে এ কথা বলতেও দ্বিধা করেননি যে, পরিস্থিতি যদি অসহনীয় হয় এবং ১৯৫৬ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের স্মারকলিপির যথাযথ বাস্তবায়ন না হয়— তবে তাঁরা পুনরায় আন্দোলন শুরু করবেন।

আর এরই ফলস্বরূপ আসাম বিধানসভায় ২৬ সেপ্টেম্বর মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বি পি চালিহা মহকুমা পরিষদ সম্পর্কিত ধারা বর্জনে আসাম রাজ্যভাষা (সংশোধন) বিল উপস্থাপন করেন। এ বিষয়ে সংবাদে বলা হল: ‘২৬ সেপ্টেম্বর— মহকুমা পরিষদ সংক্রান্ত বিতর্কমূলক ধারাটি বর্জনের উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্রী শ্রী চালিহা আসাম বিধানসভায়, আসাম রাজ্যভাষা (সংশোধন) বিলটি উপস্থাপন করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, মূল আইনটি গত অক্টোবর মাসে অনুমোদিত হয়েছিল।

কাছাড় জেলায় ভাষা আন্দোলনের পর, শাস্ত্রী ফরমূলা অনুযায়ী উপরোক্ত ধারাটি বর্জনের ব্যাপারে আসাম মন্ত্রিসভা ও প্রদেশ কংগ্রেস একমত হন।

ওই ধারায় এরূপ বলা হয়েছিল যে, মহকুমা পরিষদ ও মিউনিসিপ্যাল বোর্ডগুলির যুক্ত বৈঠকে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাধিক্য লাভ করলে জেলার ভিত্তিতে কাছাড়ে প্রশাসন ও অন্যান্য সরকারি কাজকর্মে বাংলার বদলে সরকারি ভাষা ব্যবহৃত হতে পারবে।

সংশোধনে মহকুমা পরিষদ সম্পর্কিত ধারাটি বর্জনের সঙ্গে এরূপ প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয় যে, কাছাড়েও সরকারি ভাষা ব্যবহারের ব্যাপারে কোনো বাধা থাকবে না।

মুখ্যমন্ত্রী বিলটি উত্থাপনের অনুমতি প্রার্থনা করলে, বিরোধীপক্ষের নেতা শ্রীহরেশ্বর গোস্বামী অধ্যক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন যে, তিনি নিজে অনুরূপ মর্মে একটি বিল ইতিপূর্বেই আলোচনার জন্য নোটিশ দিয়ে রেখেছেন।

শ্রীচালিহা বলেন যে, তাঁর ও শ্রী গোস্বামীর বিল ঠিক এক নয়। শ্রী গোস্বামীর বিলটি গেজেটে প্রকাশিত হলেও বিধানসভার ‘অর্ডার পেপার’-এ এখনও প্রকাশিত হয়নি।

অধ্যক্ষ শ্রী গোস্বামীর আবেদন অগ্রাহ্য করেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন যে, কাছাড়ের অধিবাসীদের মনে ধারাটি সম্পর্কে যে আপত্তি আছে তা দূর করবার জন্য এবং সেইসঙ্গে কাছাড়ে সরকারি ভাষা যাতে অবাধে ব্যবহৃত হতে পারে তার জন্য বিলটির প্রয়োজন ছিল।’১৮৩

আসলে সরকার সংশোধিত মহকুমা পরিষদ সংক্রান্ত ধারাটিতে কী বলা হয়েছিল? আমরা এ বিষয়ে সেদিনের একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধের সহায়তা নেব। ‘চালিহা সরকারের খেল’ শীর্ষক নিবন্ধে বলা হল: ‘ক্ষমতামদমত্ততা যে একটি ভাষাগোষ্ঠীকে সঙ্কীর্ণতার কোন স্তরে নিয়ে যেতে পারে, আসামের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা গত ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে সরকারি ভাষা বিলের যে সংশোধন উত্থাপন করেছেন, তাতে তার প্রমাণ মিলবে। কাছাড়ের অধিবাসীদের ‘শঙ্কা’ দূরীকরণের উদ্দেশ্যে মহকুমা পরিষদ সংক্রান্ত ধারাটি বাতিল করার ভাওতা দিয়ে এই সংশোধনটি দাখিল করা হয়েছে; কিন্তু অত্যন্ত নিপুণভাবে এর মাধ্যমে অসমিয়া ভাষাকে কাছাড়ে জোর করে অনুপ্রবিষ্ট করাবার ষোল আনা ব্যবস্থা করা হয়েছে। কাছাড় জেলা সম্পর্কে ভাষা আইনের ৫নং বিধিতে বলা হয়েছিল:

Notwithstanding anything in Section 3, the Bengali language shall be used for administrative and other official purposes up to and including the district level in the district of Cachar until the Mohakuma Parishads and Municipal Boards of the district in a joint meeting by a majority of not less than two-thirds of the members present and voting decide in favour of adoption of the official language for use in the district for the aforesaid purposes.

কাছাড়বাসীর সন্তুষ্টি বিধানার্থ এখান থেকে মহকুমা পরিষদের ফ্যাকড়াটি বর্জনের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু বর্তমানে তা বদলিয়ে করা হয়েছে:

Without prejudice to the provision contained in Section 3, the Bengali language shall be used for administrative and other official purposes upto and including the district level in the district of Cachar.

(ভাষা আইনের ৩নং ধারায় অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যের সরকারি ভাষার মর্যাদা দিয়ে তার প্রয়োগাদি সম্পর্কে বিধান দেওয়া হয়েছে।)

বলাবাহুল্য অসমিয়া ভাষা যাতে বঙ্গভাষাভাষী কাছাড়ে অনধিকার প্রবেশ না করতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীলালবাহাদুর শাস্ত্রীর নির্দেশমতো ভাষা আইনের উক্ত সংশোধনের ব্যবস্থা হয়েছিল, অথচ কার্যত তার বিপরীত উদ্দেশ্যেই এখন বিলটি সংশোধন করা হয়েছে। শ্রী চালিহা অত্যন্ত সচেতনভাবেই এটা করেছেন; কারণ বিল উত্থাপনকালে তিনি বলেছেন যে, অনেকেরই ধারণা ছিল এই সংশোধনের ফলে কাছাড়ে অসমিয়া ভাষা প্রবেশের পথ রুদ্ধ হইয়া যাইবে, কিন্তু বাস্তব প্রস্তাবটি দেখার পর আশা করি এই ভুল ধারণা প্রশমিত হইবে। আমার বিশ্বাস বিধানসভার সকল দলই ইহা মানিয়া নিবেন।১৮৪

কাজেই এটা সুস্পষ্ট যে, অসমিয়া ভাষা-সম্প্রসারণবাদীদের সন্তোষ-সাধনই এই সংশোধনের মুখ্য উদ্দেশ্য।

ভাষা আইন সংশোধনের নামে কাছাড়ে বিনা বাধায় সরকারি ভাষা হিসেবে অসমিয়া ভাষা প্রবর্তনের মতলববাজির বিষয়টি অনেকেরই চোখে পড়েছে।

কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদ এই মতলববাজির প্রতিবাদে ১ অক্টোবর করিমগঞ্জে এক সভার আয়োজন করেন। শ্রী পি সি চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ‘ভাষা আইন সংশোধনের নামে কাছাড়েও অসমিয়া ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে প্রবর্তনের যে চেষ্টা চলছে, তার প্রতিবাদ করে এক প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং বলা হয় যে, মহকুমার ধারাটি উচ্ছেদ করে, ‘‘আসাম সরকার কাছাড়ে বিনা বাধায় অসমিয়া ভাষা প্রবর্তনের দ্বার উন্মুক্ত করেছেন।’’ এমতাবস্থায় পরিষদ প্রস্তাবিত সংশোধনের প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাঁকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বনের অনুরোধ জানাচ্ছে।

অপর প্রস্তাবে বলা হয় করিমগঞ্জে যথা সত্ত্বর সম্ভব পরিষদের সদস্যবৃন্দ এবং সমর্থকদের একটি সম্মেলন আহ্বান করা হোক। পরিষদ সম্পাদক শ্রী নলিনীকান্ত দাসকে এই সম্মেলন আহ্বানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

অপর আর এক প্রস্তাবে বলা হয়, ভাষা সংশোধনী বিলের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কোনো একটি আদালতে সেটি উত্থাপনের জন্য শ্রীনলিনীকান্ত দাসকে আহ্বায়ক মনোনীত করে একটি আইনসঙ্গত ব্যবস্থা অবলম্বন সাব-কমিটি গঠন করা হয়।’১৮৫

শেষপর্যন্ত ৭ অক্টোবর আসাম বিধানসভায় আসাম সরকারি ভাষা (সংশোধন) বিল গৃহীত হয়। বিলের ৫নং ধারা থেকে মহকুমা পরিষদ ও মিউনিসিপ্যাল বোর্ড সংক্রান্ত ব্যবস্থা বর্জিত হয়।

‘বিরোধী দলের নেতা শ্রীহরেশ্বর গোস্বামী ও কম্যুনিস্ট নেতা শ্রী গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য উভয়েই তাঁদের বক্তৃতায় বলেন যে, ভাষাকে অত্যাচার বা উৎপীড়নের হাতিয়াররূপে ব্যবহার করা চলবে না। তাঁরা আরও বলেন, ভাষাকে কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়া বা আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ দেওয়া যাবে না।

শ্রী গোস্বামী বলেন, কারও পক্ষে কোনো ভাষাকে নিন্দা করা উচিত নয় এবং বাংলাভাষাকে কেউ ধ্বংস করতে পারবে না। মুখ্যমন্ত্রী শ্রী চালিহা বলেন, আসামকে শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ করাই এই বিলের উদ্দেশ্য। মুখ্যমন্ত্রী বিরোধীদলের সদস্য কতৃক উত্থাপিত সংশোধনী প্রস্তাব দুটি সম্পর্কে তাদের মনোভাবের প্রশংসা করেন।’১৮৬

কাছাড়ের চারজন কংগ্রেসসেবী দলীয় নির্দেশ অমান্য করে ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় তিনজন কংগেস এমএলএ ও একজন বিশিষ্ট কংগ্রেস কর্মীকে ‘এক বছরের জন্য কংগ্রেসের কোনো নির্বাচনমূলক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না বলে কংগ্রেস সভাপতি শ্রী সঞ্জীব রেড্ডী ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ওয়ার্কিং কমিটির কাছে সুপারিশ করেন। যে চারজনের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা অবলম্বিত হয়— তাঁরা হলেন— শ্রীমতী জ্যোৎস্না চন্দ, শ্রী নন্দকিশোর সিংহ, শ্রীরণেন্দ্রমোহন দাস ও জনাব আবদুর রহমান চৌধুরী। এই চারজন ব্যতীত আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি কাছাড়ের আর যে ১৩ জন কংগ্রেসকর্মীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অবলম্বনের প্রস্তাব করেছিলেন, সে সম্পর্কে কংগ্রেস সভাপতি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিছুটা উদার দৃষ্টিভঙ্গী অবলম্বনের পরামর্শ দেন। কংগ্রেস হাইকম্যাণ্ড আরও জানান, যে তিনজন এমএলএ এবং একজন এমপি তাঁদের আসনে ইস্তফা দিয়েছেন— …তাঁরা শৃঙ্খলাভঙ্গের গুরুতর অপরাধে অপরাধী।’১৮৭

বাংলাকে আসামের অন্যতম রাজ্যভাষা করার দাবী পুনরায় উত্থাপিত হল। সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা শ্রী পরিতোষ পাল চৌধুরীর নেতৃত্বে ২৫ জন যুবক ৪ ডিসেম্বর অপরাহ্নে শিলচর থেকে ধুবড়ি যাত্রা করেন। ধুবড়িতে বিভিন্ন স্থান থেকে মোট ৮০ জন বাঙালি যুবক সমবেত হবেন এবং ১০ ডিসেম্বর তাঁরা পদব্রজে দিল্লি যাত্রা করবেন। দিল্লিতে তাঁরা প্রধানমন্ত্রী শ্রী নেহরু এবং অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন এবং বাংলাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকার করে নেবার দাবি জানাবেন। সংবাদে বলা হয়, ‘৪ ডিসেম্বর শিলচর স্টেশন প্রাঙ্গণে ‘নিখিল আসাম বঙ্গভাষাভাষী সমিতি’র সহসভাপতি বিশিষ্ট জাতীয়তাবাদী নেতা, সাংবাদিক মো. হুরমত আলি বড়লস্করের সভাপতিত্বে নয়াদিল্লিযাত্রী বাঙালি যুবকদের বিদায় সংবর্ধনা জানানো হয়। শ্রী পরিতোষ পাল চৌধুরী বক্তৃতা প্রসঙ্গে এই যাত্রাকে ঐতিহাসিক যাত্রা বলে অভিহিত করেন এবং জনসাধারণকে এই উদ্দেশ্য পূরণে সহায়তা করবার আহ্বান জানান।

যুবনেতা বিজন শঙ্কর রায় এবং শিলচর মিউনিসিপ্যালিটি চেয়ারম্যান শ্রীমহীতোষ পুরকায়স্থ বিদায় সংবর্ধনা সভায় ভাষণ দান করেন। প্রায় দু’হাজার নারী-পুরুষ বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে এই যাত্রীদলকে সংবর্ধনা জানান। দলটি ১১ জন শহীদের পূতাস্থি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে যাবেন এবং সেখান থেকে দিল্লি রওনা হবেন।’১৮৮

করিমগঞ্জে ২৪ ডিসেম্বর ‘কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় এক প্রস্তাবে বলা হয় যে, অনসমিয়া ভাষাভাষীদের দাবি যদি আসাম সরকার পূরণ না করেন, তবে পরিষদ ‘দ্বিতীয়বার আর একটি অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলন আরম্ভ করতে বাধ্য হবে’।

প্রস্তাবে আরও বলা হয় যে, এরূপ একটি আন্দোলনের পূর্বে পরিষদ আসামের ভাষা সমস্যা সম্পর্কে একটা আপোষ রফার জন্য প্রধানমন্ত্রী শ্রী নেহরুর নিকট একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করবেন।

পরিষদ সম্মেলনে ঘোষণা করেন যে, আগামী বছর ১৪ এপ্রিলের মধ্যে যদি আপোষ-মীমাংসার সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, তবে সংগ্রাম পরিষদকে একটা নতুন আন্দোলন আরম্ভের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবে আরও বলা হয় যে, সংগ্রাম পরিষদ আসাম থেকে কাছাড়কে বিচ্ছিন্ন করার জন্য এরূপ কোনো আন্দোলন আরম্ভ করবেন না। সম্মেলনে আরও স্থির হয় যে, পরিষদ আগামী সাধারণ নির্বাচনে কোনো প্রার্থী দাঁড় করাবেন না।’১৮৯

কার্যত ১৯৬১ সালে ৫ ফেব্রুয়ারি করিমগঞ্জে অনুষ্ঠিত জন সম্মেলনে গঠিত ‘কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ’ বাংলা ভাষাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষা করার দাবিতে যে দীর্ঘ আন্দোলন, ১১ জন সত্যাগ্রহীর প্রাণদান, অসংখ্য মানুষের পঙ্গুত্ব বরণ, প্রায় চারশো স্বেচ্ছাসেবী-সত্যাগ্রহীর কারাবরণ, পুলিশ-সেনাবাহিনীর নারকীয় নির্যাতন ভোগের পর শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামায় গৃহদাহ, নির্যাতন, ধ্বংস।

১৯৬১ সালের ২ ও ৩ জুলাই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শ্রী নেহরুর মধ্যে কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ এবং কাছাড় কংগ্রেস নেতৃত্বের মধ্যে যে আপোশ সমঝোতা হয়, তারপর আর নতুন করে যে বিক্ষিপ্ত কিছু প্রয়াস লক্ষ করা গেছে—তা গতি লাভ না করায় ইতিবাচক ফল বয়ে আনেনি। প্রকৃতপক্ষে দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে কাছাড় বা বরাকের মানুষের নিট লাভ ‘আসাম সরকারি ভাষা আইন সংশোধন করে কাছাড়ে বাংলাভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দান। ‘কেবল এইটুকু পাওয়ার জন্য ১১ জন বাঙালির প্রাণদান। এত রক্ত? এত ক্ষতি? মানতে কষ্ট হয়।

তথ্যনির্দেশ:

১. যুগশক্তি (সাপ্তাহিক), করিমগঞ্জ, ১৯ মে, ১৯৬১

২. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা ২০ মে, ১৯৬১

৩. স্বাধীনতা, কলকাতা, ২০ মে, ১৯৬১

৪. দৈনিক বসুমতী, কলকাতা, ২০ মে, ১৯৬১

৫. অমিতাভ চৌধুরি, মুখের ভাষা বুকের রুধির, কলকাতা: নভেম্বর ১৯৬১, গ্রন্থ প্রকাশ, পৃ. ৫৬—৬০

৬. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২০ মে, ১৯৬১

৭. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২১ মে, ১৯৬১

৮. স্বাধীনতা, কলকাতা, ২০ মে, ১৯৬১ এবং দৈনিক বসুমতী, কলকাতা, ২০ মে, ১৯৬১

৯. যুগান্তর, কলকাতা, ১ ডিসেম্বর, ১৯৬১

১০. যুগশঙ্খ, শিলচর, ১৯ মে, ১৯৮১, উদ্ধৃত কলোকোল, বিশেষ সংকলন, কানু আইচ সম্পাদিত (শিলচর ২০০৪, কলোকোল) পৃ. ৬৪-৬৫

১১. দৈনিক প্রান্তজ্যোতি, শিলচর, ৬ জুন, ২০১০, উদ্ধৃত-বিজয় কুমার ভট্টাচার্য, ‘১৯ শে-র খোঁজে’, (শিলচর : ২০১০, শিল্পী ভট্টাচার্য) পৃ. ২০

১২. যুগশক্তি, করিমগঞ্জ, ২৬ মে, ১৯৬১

১৩. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২০ মে, ১৯৬১

১৪. অহিভূষণ চৌধুরি, ১৯-এর ভাষা সংগ্রামে হাইলাকান্দি সংগ্রাম পরিষদের সাংগঠনিক রূপ ও তার ভূমিকা, উনিশে মে-র ইতিহাস, দিলীপকান্তি লস্কর সম্পাদিত, করিমগঞ্জ : ২০০২, লালন মঞ্চ প্রকাশনী, পৃ.-১৫৩—১৫৫

১৫. নিশুতি মজুমদার, অবসরপ্রাপ্ত চিফ ইঞ্জিনিয়ার, পি ডব্লিউ ডি আসাম, দিসপুর, গুয়াহাটি, লিখিত প্রতিবেদন, তারিখ : ৩১ মে, ২০১৩। বর্তমান লেখকের কাছে ডাকযোগে প্রেরণ।

১৬. সঞ্জীব দেব লস্কর, ‘একষট্টির ভাষা-আন্দোলনে গ্রাম কাছাড়ের ভূমিকা’, উদ্ধৃত উনিশে মের ইতিহাস, দিলীপকান্তি লস্কর সম্পাদিত, করিমগঞ্জ : ২০০২, পৃ. ১৪১—১৪৩

১৭. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২০ মে, ১৯৬১

১৮. প্রাগুক্ত

১৯. আনন্দবাজার পত্রিকা, ২১ মে, ১৯৬১

২০. প্রাগুক্ত

২১. প্রাগুক্ত

২২. প্রাগুক্ত। আরও দেখুন দৈনিক বসুমতী, কলকাতা, ২১মে, ১৯৬১

২৩. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২০ মে, ১৯৬১

২৪. স্বাধীনতা, কলকাতা, ২১ মে, ১৯৬১

২৫. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৩ মে, ১৯৬১

২৬. প্রাগুক্ত

২৭. স্বাধীনতা, কলকাতা, ২১ মে, ১৯৬১

২৮. উদ্ধৃত পরিতোষ পাল চৌধুরি, রক্তাঞ্জলি, পৃ. ১২৫-২৬

২৯. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২২ মে, ১৯৬১

৩০. প্রাগুক্ত

৩১. প্রাগুক্ত

৩২. প্রাগুক্ত

৩৩. প্রাগুক্ত

৩৪. প্রাগুক্ত

৩৫. প্রাগুক্ত

৩৬. প্রাগুক্ত

৩৭. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৩ মে, ১৯৬১

৩৮. প্রাগুক্ত

৩৯. প্রাগুক্ত

৪০. স্বাধীনতা, কলকাতা, ২৩ মে, ১৯৬১

৪১. প্রাগুক্ত

৪২. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৪ মে, ১৯৬১

৪৩. প্রাগুক্ত

৪৪. প্রাগুক্ত

৪৫. দৈনিক বসুমতী, কলকাতা, ২৪ মে, ১৯৬১

৪৬. প্রাগুক্ত

৪৭. প্রাগুক্ত

৪৮. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৫ মে, ১৯৬১

৪৯. বিজ্ঞপ্তি, প্রচারপত্র, ২৩.৫.১৯৬১ তারিখে পপুলার প্রেস লক্ষ্মীপুর রোড, শিলচর থেকে মুদ্রিত,

৫০. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৫ মে, ১৯৬১

৫১. অমিতাভ চৌধুরি, মুখের ভাষা বুকের রুধির, পৃ. ৪৫—৪৭

৫২. আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৫ মে, ১৯৬১

৫৩. আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬ মে, ১৯৬১

৫৪. আনন্দবাজার পত্রিকা, এবং স্বাধীনতা, কলকাতা, ২৬ মে, ১৯৬১

৫৫. স্বাধীনতা, কলকাতা, ২৬ মে, ১৯৬১

৫৬. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৭ মে, ১৯৬১

৫৭. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৭ মে, ১৯৬১

৫৮. প্রাগুক্ত

৫৯. প্রাগুক্ত

৬০. যুগশক্তি, করিমগঞ্জ, ২৬ মে, ১৯৬১

৬১. প্রাগুক্ত

৬২. প্রাগুক্ত

৬৩. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৮ মে, ১৯৬১

৬৪. স্বাধীনতা, কলকাতা, ২৮ মে, ১৯৬১

৬৫. প্রাগুক্ত

৬৬. দৈনিক বসুমতী, কলকাতা, ২৮ মে, ১৯৬১

৬৭. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৮ মে, ১৯৬১

৬৮. প্রাগুক্ত

৬৯. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৯ মে, ১৯৬১

৭০. দৈনিক বসুমতী, কলকাতা, ২৯ মে, ১৯৬১

৭১. প্রাগুক্ত

৭২. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৯ মে, ১৯৬১

৭৩. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৩০ মে, ১৯৬১

৭৪. প্রাগুক্ত

৭৫. প্রাগুক্ত

৭৬. প্রাগুক্ত

৭৭. আনন্দবাজার পত্রিকা এবং দৈনিক বসুমতী, ৩০ মে, ১৯৬১

৭৮. স্বাধীনতা, কলকাতা, ৩০ মে, ১৯৬১ এবং দৈনিক বসুমতী, কলকাতা, ৩০ মে, ১৯৬১

৭৯. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৩১ মে, ১৯৬১

৮০. প্রাগুক্ত

৮১. প্রাগুক্ত

৮২. প্রাগুক্ত

৮৩. প্রাগুক্ত

৮৪. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২ জুন, ১৯৬১

৮৫. প্রাগুক্ত

৮৬. প্রাগুক্ত

৮৭. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৩ জুন, ১৯৬১

৮৮. প্রাগুক্ত

৮৯. স্বাধীনতা, কলকাতা ৩ জুন, ১৯৬১

৯০. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৪ জুন, ১৯৬১

৯১. প্রাগুক্ত

৯২. প্রাগুক্ত

৯৩. প্রাগুক্ত

৯৪. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৫ জুন, ১৯৬১

৯৫. প্রাগুক্ত

৯৬. প্রাগুক্ত

৯৭. প্রাগুক্ত

৯৮. প্রাগুক্ত

৯৯. প্রাগুক্ত

১০০. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৬ জুন, ১৯৬১

১০১. প্রাগুক্ত

১০২. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৭ জুন, ১৯৬১

১০৩. আনন্দবাজার পত্রিকা এবং দৈনিক বসুমতী, কলকাতা, ৭ জুন, ১৯৬১

১০৪. প্রাগুক্ত

১০৫. প্রাগুক্ত

১০৬. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৮ জুন, ১৯৬১

১০৭. সাক্ষাৎকার—মনীন্দ্র রায়, কলোকোল, বিশেষ সংস্করণ, শিলচর, ২০০৪, কানু আইচ সম্পাদিত, পৃ. ১২৩-১২৪

১০৮. সাক্ষাৎকার-শরদিন্দু বিশ্বাস, কলোকোল, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩২—১৩৩

১০৯. গোপা দত্ত, একদিনকার জজিয়তি, উদ্বৃত পরিতোষ পাল চৌধুরী, রক্তাঞ্জলি, পৃ. ১৫৬—১৫৮

১১০. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৮ জুন, ১৯৬১

১১১. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৯ জুন, ১৯৬১

১১২. প্রাগুক্ত

১১৩. প্রাগুক্ত

১১৪. যুগশক্তি, করিমগঞ্জ, ৯ জুন, ১৯৬১

১১৫. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১০ জুন, ১৯৬১

১১৬. প্রাগুক্ত

১১৭. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১২ জুন, ১৯৬১

১১৮. দৈনিক বসুমতী, কলকাতা, ১২ জুন, ১৯৬১

১১৯. পরিতোষ পাল চৌধুরী, রক্তাঞ্জলি, পৃ. ১৫৯—১৬১

১২০. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬২

১২১. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৩ জুন, ১৯৬১

১২২. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৪ জুন, ১৯৬১

১২৩. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৪ জুন, ১৯৬১

১২৪. প্রাগুক্ত

১২৫. প্রাগুক্ত

১২৬. প্রাগুক্ত

১২৭. প্রাগুক্ত

১২৮. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৫ জুন, ১৯৬১

১২৯. প্রাগুক্ত

১৩০. প্রাগুক্ত

১৩১. প্রাগুক্ত

১৩২. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৬ জুন, ১৯৬১

১৩৩. প্রাগুক্ত

১৩৪. প্রাগুক্ত

১৩৫. আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ জুন, ১৯৬১

১৩৬. প্রাগুক্ত

১৩৭. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১৮ জুন, ১৯৬১

১৩৮. দৈনিক বসুমতী, কলকাতা, ১৮ জুন, ১৯৬১

১৩৯. স্বাধীনতা, কলকাতা, ১৮ জুন, ১৯৬১

১৪০. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২১ জুন, ১৯৬১ এবং যুগশক্তি, করিমগঞ্জ, ২৩ জুন, ১৯৬১

১৪১. আনন্দবাজার পত্রিকা, ২১ জুন, ১৯৬১

১৪২. প্রাগুক্ত

১৪৩. প্রাগুক্ত

১৪৪. প্রাগুক্ত

১৪৫. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২২ জুন, ১৯৬১

১৪৬. প্রাগুক্ত

১৪৭. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৩ জুন, ১৯৬১

১৪৮. প্রাগুক্ত

১৪৯. প্রাগুক্ত

১৫০. প্রাগুক্ত

১৫১. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৪ জুন, ১৯৬১

১৫২. প্রাগুক্ত

১৫৩. প্রাগুক্ত

১৫৪. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৬ জুন, ১৯৬১

১৫৫. প্রাগুক্ত

১৫৬. প্রাগুক্ত

১৫৭. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১ জুলাই, ১৯৬১

১৫৮. প্রাগুক্ত

১৫৯. Organiser, (Weekly), Delhi, July ১৭, ১৯৬১

১৬০. প্রচারপত্র, কাছাড় জেলা শান্তি পরিষদের পক্ষ থেকে ২ জুন, ১৯৬১ তারিখে প্রচারিত। স্থানের উল্লেখ নেই। প্রচুর ভুল বানানও ছিল যা পাঠকের সুবিধার্থে শুদ্ধ করা হয়েছে।

১৬১. ইমাদ উদ্দিন বুলবুল, দেশী ভাষা বিদ্যা যার, শিলচর : ১৯৯৫, মিলন প্রকাশনী, পৃ. ৩, ১২

১৬২. প্রাগুক্ত, পৃ. ৫

১৬৩. প্রচারপত্র নিবেদন মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীর বিবৃতিটি শিলচর থেকে ২১ জুন,’ ৬১-তে প্রচারিত। প্রেসের উল্লেখ নেই।

১৬৪. উদ্ধৃত ইমাদ উদ্দিন বুলবুল, দেশী ভাষা বিদ্যা যার, পৃ. ২২—২৩

১৬৫. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৩—২৪

১৬৬. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮

১৬৭. প্রচারপত্র, ২৫ জুলাই, ১৯৬১ তারিখে শিলচর পপুলার প্রেস থেকে মুদ্রিত এবং হাফিজ আহমদ আলি হাজারী, মধুরবন্দ, শিলচর কতৃক প্রকাশিত।

১৬৮. ইমাদ উদ্দিন বুলবুল, দেশী ভাষা বিদ্যা যার, পৃ. ৪

১৬৯. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২১ জুলাই, ১৯৬১

১৭০. উদ্ধৃত বিজয়কুমার ভট্টাচার্য, ১৯ শে-র খোঁজে, শিলচর ২০১০, পৃ. ২৯—৩০

১৭১. প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০—৩১

১৭২. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ১০ জুলাই, ১৯৬১

১৭৩. প্রাগুক্ত

১৭৪. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৮ জুন, ১৯৬১

১৭৫. প্রাগুক্ত

১৭৬. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ২৯ জুন, ১৯৬১

১৭৭. প্রাগুক্ত

১৭৮. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৩ জুলাই, ১৯৬১

১৭৯. আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৪ জুলাই, ১৯৬১

১৮০. যুগশক্তি, করিমগঞ্জ, ১৪ জুলাই, ১৯৬১

১৮১. যুগশক্তি, করিমগঞ্জ, ২১ জুলাই, ১৯৬১

১৮২. আনন্দবাজার পত্রিকা, ৪ জুলাই, ১৯৬১

১৮৩. আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৬১

১৮৪. যুগশক্তি, করিমগঞ্জ, ২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৬১

১৮৫. যুগান্তর, কলকাতা, ২ অক্টোবর, ১৯৬১

১৮৬. যুগান্তর, কলকাতা, ৮ অক্টোবর, ১৯৬১

১৮৭. যুগান্তর, কলকাতা, ২৫ অক্টোবর, ১৯৬১

১৮৮. যুগান্তর, কলকাতা, ৫ ডিসেম্বর, ১৯৬১

১৮৯. যুগান্তর, কলকাতা, ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৬১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *