পঞ্চম পর্ব – অ্যাস্টেরয়েডের ভেতর দিয়ে
৩৭.নক্ষত্র
এখন ইউনিভার্স এতো দ্রুত চলছে যে একে কোনো কক্ষপথ ধরে চলা জিনিসের সাথেই তুলনা করা যাবে না। এমনকি সৌরজগতে কোনো বস্তু এতো দ্রুত চলে না-অবশ্য কখনো চলেনি সেকথা আর কেউ জোর গলায় বলতে পারবে না; এই ক্ষমতা মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে অর্ধশত বছর আগেই।
সূর্যের সবচে কাছের গ্রহ সবচে বেশি গতিতে সেকেন্ডে মাত্র পঞ্চাশ কিলোমিটার যেতে পারে। প্রথম দুদিন মহাকাশ অগ্নিরথটা এর দ্বিগুণ গতিতে চললেও আর কিছুক্ষণের মধ্যে কয়েক হাজার টন পানি কমে গেলে এটা হৃদকম্প ঘটানো গতি পাবে।
তারপর শুক্রের এলাকায় প্রবেশ; এখন তাকে লুসিফার আর সূর্যের মাঝে সবচে স্বর্গীয় ভুবন বলে ভুল হয়। ভোলা চোখে একটা গোলক দেখা গেলেও সবচে শক্তিশালী টেলিস্কোপ তেমন কোনো কাজে লাগবে না, ধারণার কোনো উন্নয়ন হবে না-কারণ ইউরোপাকে হিংসা করে সেও নিজেকে ঢেকে রাখে হাজার রহস্যে।
সূর্যের আরো কাছাকাছি যেতে যেতে ইউনিভার্স মোটেও মোহাবিষ্ট হবে না, বরং সৌর জগৎপতির কাছ থেকে বাড়তি শক্তি ছিনিয়ে নেবে, সৌর দোলনায় দোল খেয়ে এগিয়ে যাবে নতুন নক্ষত্রের দিকে।
কিন্তু একেবারে বিনামূল্যে প্রকৃতি শক্তি দেয় না। ঠিক রাখে নিত্যতার সূত্র। সূর্যের গ্র্যাভিটিশনাল ফোর্স কাজে লাগিয়ে ইউনিভার্স এগিয়ে যাবে ঠিকই, ঠিক সেটুকু শক্তি প্রকৃতি ছিনিয়ে নেবে শক্তির আধার সূর্যের কাছ থেকে। মানুষের জন্য পরিমাণটা অনেক অনেক বেশি হলেও সূর্যের জন্য একেবারে কম। আসছে হাজার হাজার বছরেও তার ফলে সূর্যের হয়ে যাওয়া ক্ষতির নগণ্য হিসাবটা বের করা যাবে না।
ক্যাপ্টেন স্মিথ বেশ কষ্টে তার একগুঁয়েমির ফলে হারানো মূল্যের কিছুটা ফিরিয়ে নিল।
“এখন আপনারা বুঝতেই পারছেন, সে বলল সবার উদ্দেশ্যে, কেন আমি শিপটাকে ওল্ড ফেইথফুলের ভিতর দিয়ে নিয়ে গেলাম। যদি শরীরের সবটা ময়লা ধুয়ে না নিতাম, তো এতোক্ষণে আমাদের বারোটা বেজে যাবার কথা। থার্মাল কন্ট্রোল যদি কাটিয়ে উঠতে পারতো তাহলেও পৃথিবীর চেয়ে দশগুণ চাপ পড়ার কথা।
এখনি কালো হয়ে যাওয়া ফিল্টারের দিকে তাকিয়ে সবাই তার কথা বিশ্বাস করে নিল। তারপর সবার স্বস্তি ফিরে এল মঙ্গলের অর্বিটে ঢোকার পরপর সেটা আবার আগের আকৃতি ফিরে পাওয়ায়।
ফেমাস ফাইভ তাদের জীবনে অত্যাশ্চর্য এবং অপ্রত্যাশিত পরিবর্তনে যার যার পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে এরিমধ্যে। মাইকেলোভিচ আবারো ব্যগ্রভাবে সশব্দে কম্পোজ করা শুরু করেছে, ফলে খেতে বেরুনো ছাড়া তার টিকিটির স্পর্শ পায়নি কেউ। তাই তার রীতিসিদ্ধ খোঁচায় আহত হতে থাকা সবাই খানিক স্বস্তি পেল, বিশেষত উইলিস।
গ্রিনবার্গ নিজেকে নিজেই নির্বাচিত করল একজন অনারারি ক্রু হিসেবে। কেউ প্রতিবাদ না করায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় স্বনির্বাচিত হওয়ার একটা মজা আছে। তার বেশিরভাগ সময় কাটছে ব্রিজে।
সমস্ত ব্যাপারকে ম্যাগি মবালা আন্তরিক তুষ্টির সাথে নিয়েছে অনেক আগেই।
লেখকেরা, তার মন্তব্য, সারা জীবন চোটপাট করে যায় একটা কথা বলে, কী নিশ্চিন্তে যে কাজ করতে পারতাম একটু নির্জনতা পেলে! কী পরিমাণ কাজ যে করতে পারতাম! এই কথার প্রমাণ চান আপনারা কেউ কেউ চ্যালেঞ্জ না করলেও তার উৎসাহে ভাটা পরার লক্ষণ নেই। বাতিঘর আর জেলখানা হল প্রমাণ। সুতরাং আমার কোনো অভিযোগ নেই। শুধু একটাই অভিযোগ, রিসার্চ ম্যাটেরিয়াল পেতে একটু দেরি হয়ে যাচ্ছে হাই প্রায়োরিটি মেসেজের কারণে।
এমনকি ভিক্টর উইলিসও মূল পথে চলে এসেছে, রবিবারের লম্বা প্রজেক্ট নিয়ে তার ব্যস্ততা দেখার মতো। কেবিনে বন্দী থাকার আরো কারণ আছে। দেখে মনে হতে পারে আরো কয়েক সপ্তাহেও সে শেভ করবে না। এবং আরো বেশ ক মাস লেগে যাবে পুরনো বনেদীয়ানা ফিরে পেতে।
ইভা মারলিন দিনের বেশ ক ঘণ্টা কাটিয়ে দেয় এন্টারটেইনমেন্ট রুমে, সবাই জানে সে সারাক্ষণ প্রিয় ক্লাসিকগুলো দেখছে। ভাগ্য ভাল বলতে হয়, অভিযানের আগে তড়িঘড়ি করে লাইব্রেরি আর প্রজেকশন সিস্টেম গড়ে তুলেছিল কর্তারা। এখনো লাইব্রেরিটা স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, কিন্তু যা আছে তা দেখে শেষ করতে কয়েক জীবন পেরিয়ে যাবে।
সিনেমার জগতের, সত্যি বলতে গেলে শিল্প জগতের সব কাজই সেখানে সযত্নে রাখা হয়েছে, সেসবের বেশিরভাগই ইভার চেনা এবং সে নিজের জ্ঞানের সাথে ব্যাপারটা মিলিয়ে দেখে বেশ মজা পাবে তাই স্বাভাবিক।
ফ্লয়েড সেসময় তার কথা শুনতেই বেশি ভালবাসে। স্বাভাবিক। তখনি ইভা রক্তমাংসের মানুষে পরিণত হয়, কোনো অতিমানব না। খুব আফসোস হয় ফ্লয়েডের, এই মহিলা বাস্তব জীবনে ফিরে আসে বাস্তব জীবন পাবার বদলে সিনেমার পর্দা পেলে।
ফ্লয়েড তার জীবনের অন্যতম ভয়াল অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিল একবার ইভার পেছনে বসে সত্যিকার গন উইথ দ্য উইন্ড দেখার সময়। তখনই সে ভিভিয়ান লিথের সাথে তার তুলনার সুযোগ পায় এবং মিলিয়ে দেখতে গিয়ে নিজের মনেই বেশ হেনস্থা হয়ে পড়ে।
আলো নেভার পর দেখতে পায় ইভার কান্না। সান্ত্বনার সুরে সে হাতটা তুলে নেয়, তারপর দরদমাখা কণ্ঠে বলে, বনির মৃত্যু দেখে আমিও কেঁদেছিলাম।
সাথে সাথে ইভা একটা মৃদু হাসি যোগাড় করেছিল।
“আমার কান্না ভিভিয়ানের জন্য। আমরা দ্বিতীয় পর্ব শু্যট করার সময় তার জীবন নিয়ে অনেক পড়াশোনা করি। বেচারীর জীবনটা অনেক কষ্টে কেটেছে। এখন, তাকে নিয়ে এই মহাকাশে কথা বলার সময়, সিনেমা দেখার সময় ল্যারির একটা কথা মনে পড়ে গেল। ভিভিয়ানের নার্ভাস ব্রেকডাউনের পর ল্যারি শ্রীলংকা থেকে ফিরে বলেছিল, আমি মহাকাশের একটা মেয়েকে বিয়ে করেছিলাম, আমাদের দুনিয়ার কোনো মেয়েকে না।
এক মুহূর্তের জন্য ইভা থামল, তারপর তার গাল বেয়ে গড়িয়ে গেল আরো এক বিন্দু অশ্রু।
ফ্লয়েড না ভেবে পারল না, এই অশ্রু গড়ানোও নাটকীয়।
আর দেখ, আরো অদ্ভুত ব্যাপার, সে জীবনের শেষ ছায়াছবিটাও করেছিল আজ থেকে শত বছর আগে, জান, কী নাম ছিল মুভিটার?
বলে যাও, আরো একটা চমক পাওনা হয়েছে আমার।
আশা করি নামটা ম্যাগিকে চমকে দেবে, যদি হুমকি অনুযায়ী বইটা লিখেই ফেলে-তার শেষ চলচ্চিত্রের নাম ছিল-শিপ অব ফুলস।
৩৮.মহাকাশের হিমবাহ
হাতে অযাচিত সময়। কী করা যায়? অবশেষে ভিক্টর উইলিসকে দেয়া ওয়াদা পূরণ করতে চাচ্ছে ক্যাপ্টেন স্মিথ। সে এখন ইন্টারভিউ দিতে পারবে। কিন্তু ভিক্টর বেশ ফুলে আছে, অবশ্যই, মাইকেলোভিচের করা সর্বশেষ অপমানটার কারণে। পাবলিক ইমেজ ফিরে পেতে (কিংবা চোয়ালে গজাতে) তার বেশ কমাস লেগে যাবে-কী আর করা, ইন্টারভিউটা ক্যামেরার বাইরেই নেয়া হোক। পৃথিবীর স্টুডিও তাকে নতুন শট নিয়ে মানিয়ে নিতে পারবে।
শিপের একমাত্র আংশিক সজ্জিত কক্ষে তারা বসে আছে। ক্যাপ্টেনের কেবিন ছাড়া আর কোথাও ফার্নিচার নেই। আর তাদের সামনে সৃষ্টি জগতের (এ নিয়ে এখন সবার সন্দেহ ওঠে) সবচে ভাল ওয়াইন পরিবেশিত। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইউনিভার্স মূল ড্রাইভ বন্ধ করে ভেসে চলা শুরু করবে, তাই আগামী দিন কয়েকের মধ্যে ক্যাপ্টেনকে বাগে পাওয়ার এই এক সুযোগ। এদিকে ওজনহীন মদ্যপানে কোনো রাজকীয় তৃপ্তি নেই, তাই ভিক্টর স্কুইজ বাল্ব দিয়ে তার আনা ভিনটেজ খেতে অস্বীকার করেছে।
“ভিক্টর উইলিস বলছি, মহাকাশ অগ্নিরথ ইউনিভার্সের বুকে শুক্রবার আঠারোটা ত্রিশ মিনিটে, দু হাজার একষট্টি সালের জুলাই মাসের পনের তারিখে। আমরা যদিও লক্ষ্যস্থলের কাছাকাছি যাইনি, তবু মঙ্গলের অর্বিটে আমাদের সর্বোচ্চ গতি উঠে যাবে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই। গতিটা কতো, ক্যাপ্টেন?
প্রতি সেকেন্ডে এক হাজার পঞ্চাশ কিলোমিটার।
একপল যেতে না যেতেই সহস্র কিলোমিটার পেরিয়ে যাব আমরা! অর্থাৎ ঘণ্টায় চল্লিশ লক্ষ কিলোমিটার!
ভিক্টর উইলিসের কথা শুনে মনে হবে সে এসব কিছুই জানতো না, অথচ অর্বিটাল মেকানিক্স সম্পর্কে ক্যাপ্টেনের চেয়ে তার জ্ঞান কিছু কম নেই।
এখানেই ভিক্টরের সার্থকতা, সে শুধু দর্শকদের মন পড়তেই জানে না, বরং তাদের প্রত্যাশিত ব্যাপার প্রত্যাশিত সুরে শুনিয়ে প্রত্যাশা আর উৎসাহকে জাগিয়ে তোলে।
কথাটা সত্যি। গর্বে ফুলে উঠেছে ক্যাপ্টেনের বুক, সৃষ্টির আদি থেকে আজ পর্যন্ত মানুষ সর্বোচ্চ যত গতি পেয়েছে তারও দ্বিগুণ আমাদের প্রাপ্তি।
এই কথাটা আমার লাইনে চলে আসছে-ভাবল ভিক্টর। সে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়াটাকে মোটেও ভাল চোখে দেখে না। কিন্তু ভাল পেশাদার আর কাকে বলে! দ্রুত কাটিয়ে উঠল সে।
নিজের কথাটাকে আরো একটু এগিয়ে রাখার জন্য সামনে জ্বলতে থাকা স্ক্রিনের তথ্য আউড়ে গেল নির্দ্বিধায়।
আমরা প্রতি বারো সেকেন্ডে পৃথিবীর পরিধির সমান দূরত্ব পেরুচ্ছি। আরো দশ-দশটা দিন লেগে যাবে বৃহস্পতি-আহ, লুসিফারে পৌঁছতে! এ থেকেই সৌর জগতের পরিমাপ পদ্ধতির ধারণা পাওয়া যায়…
এখন, ক্যাপ্টেন, ব্যাপারটা চমৎকার। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে আমার মনে এ নিয়ে অনেক প্রশ্ন ঘুরছে।
ওহ-না, বিব্রতকর প্রশ্ন ছাড়া আর কিছু পাওনা তোমরা? আবার জিরো গ্র্যাভিটি টয়লেট নিয়ে নাড়াচাড়া করোনা দাড়িওয়ালা বুড়ো ভাম! গর্জে উঠল স্মিথ, মনে মনে।
ঠিক এ মুহূর্তে আমরা গ্রহাণুপুঞ্জের বলয় পেরিয়ে যাচ্ছি।
(খোদা না খাস্তা, আর আমি কিনা ভেবেছিলাম টয়লেট, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল স্মিথ।)
–এবং এখনো কোনো স্পেসশিপ তেমন আঘাত পায়নি এখানে। তার পরও, আমরা কি খুব বড় কোনো রিস্ক নিচ্ছি না? হাজার হলেও, সেখানে আক্ষরিক অর্থেই বিচবলের আকারের লাখ লাখ কঠিন আকৃতি ভেসে বেড়ায়। তার মধ্যে মাত্র কয়েক হাজার চার্টে জায়গা পেয়েছে।
কয়েক নয়, একটু বেশিই হবে। দশ হাজারেরও অনেক বেশি।
কিন্তু আমাদের অজানা লাখ লাখ দেহ এখনো সনাক্ত হয়নি।
কথা সত্যি। কিন্তু আমরা চিনে রাখলেও খুব বেশি কাজে আসত না।
আপনি ঠিক কী বোঝাতে চাচ্ছেন?
এ নিয়ে আমাদের কিছুই করার নেই।
কেন?
ক্যাপ্টেন স্মিথ বুঝতে পারছে, তার হাজার অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটা জাল ঠিকই পাতা হয়ে গেল তার চারপাশে এবং সেটা গুটিয়ে আনছে বুড়ো ভামটা। শালার! এই ইন্টারভিউওয়ালারা মাছধরা জেলে হলেও জীবনে উন্নতি করতে পারত।
উইলিসের কথা সত্যি। হেড অফিস খুব সুন্দর করে গোছানো কোনো জবাব বানাতে পারত, কিন্তু এখন বেস কিছু মুখ গলে না বেরুলেই হল। কাস্টমার ক্ষ্যাপানো কোনো কাজের কথা নয়।
স্পেসের হৃদয় এত বড় যে, এমনকি এই এখানেও, অ্যাস্টেরয়েড বেল্টের ঠিক মাঝখানে সংঘর্ষের সম্ভাবনা আক্ষরিক অর্থে নগণ্য, যার অর্থ গুনে বের করা সহজ নয়। আমরা আপনাকে একটা অ্যাস্টেরয়েড দেখানোর আশা করতে পারি। সবচে বেশি সম্ভাবনা আছে হনুমানকে দেখার। সে মাত্র তিনশো মিটার লম্বা। কিন্তু এর । পেছনেই যেটা আছে সেটা আড়াই লাখ কিলোমিটার দূরে।
ক্যাপ্টেন স্মিথের ইন্টারভিউ ক্যামেরার সামনে ভিক্টর উইলিসের সাথে ব্যক্তিত্বের সংঘাতে যাওয়া উচিত হয়নি। উইলিস দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বলছে, ব্যাটা, কথা ঘোরাও, না? দেখাচ্ছি তোমাকে হনুমানের আসল রূপ।
কিন্তু হনুমান বেশ বড়। দানবীয়ই বলা যায়। তা ছাড়াও আর লাখ ছোট ঘোঁট অ্যাস্টেরয়েড ঘুরে বেড়াচ্ছে, এদের নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
তোর উপর ঠাঠা পড়ুক, তোর দাড়ি পুড়ে মিশকালো হয়ে যাক, তুই নির্বংশ হ। ভাল গ্যাড়াকলে পড়া গেল!
ঠিক আপনার মতো চিন্তা আর ভয় আমার মনে। পৃথিবীতে মাথায় বজ্রপাত হবার সম্ভাবনা যতটুকু, ততটুকু।
অ্যাজ এ ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট, কলোরাডোের পাইক পর্বতের চূড়ায় একবার আমি অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছিলাম… (কেন মরলি না তুই তখন?)
…আলো আর শব্দ একই সাথে আঘাত করেছিল। আর আপনি স্বীকার করছেন যে সেই হন্তারা এদিক-সেদিকই আছে। আমরা কি এতো গতিতে চলাচল করে প্রচণ্ড ঝুঁকি নিচ্ছি না? ইন ফ্যাক্ট, একেই বলে জীবন হাতে নেয়া।
উইলিস কাঁটায় কাঁটায় জবাবটা জানে। আবারো সে স্পেস সম্পর্কে অজ্ঞ দর্শকের সামনে নিজের আসন উঠিয়ে রাখছে, এবং দর্শকরা প্রতি সেকেন্ডে পিছিয়ে যাচ্ছে হাজার কিলোমিটার। (ইউনিভার্স থেকে, এখানে ওঠার আগ্রহ এবং বর্তমান গতি, দু অর্থেই।)।
মনে মনে বকায় এক ধরনের বিমল আনন্দ আছে, অন্তত ঝাঁঝটা একটু কমে যায়, তাই বকা চালিয়ে গেল ক্যাপ্টেন-ব না, তোর উপর এটম বোমা পড়ক, তোর চান্দি মিশে যাক হাওয়ার সাথে, আরেকটু তেড়িবেড়ি করলেই ইন্টারভিউর খেতা পুড়ব, গুষ্ঠি খিলাব।
গণিত ছাড়া ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা কষ্টকর। বলল ক্যাপ্টেন স্মিথ (জীবনে কতবার সে এই কথা বলে উতরে গেছে? কোনো লেখাজোকা নেই। এমনকি যেখানে প্রয়োজন নেই সেখানেও দারুণ কাজে লাগে।) “কিন্তু সত্যি, গতির সাথে ঝুঁকির কোনো সম্পর্ক নেই। বলতে চাচ্ছি, গতি বাড়ালে বাড়বে, কমলে কমবে-এমন সমানুপাতিকতা অথবা উল্টো ধরে নিয়ে ব্যস্তানুপাতিকতার কোনো মানে হয় না। ব্যাপারটা এমন, আপনার পাশে যদি কোনো আণবিক বোমা পড়ে, এবং সেটা যদি ফাটে, তাহলে তার হিসাবটা কিলোটনে নাকি মেগাটনে তা ভাবা নিতান্তই হাস্যকর।
এবং জিতে যাচ্ছে উইলিস। এই কথায় আর যাই হোক, স্বস্তি পাওয়া যায় না, মহাকাশ ভ্রমণের সাথে পাশে নিউক্লিয়ার বোমা পড়ার তুলনা! কিন্তু কী আর করা? গতস্য শশাচনা নাস্তি। যা বলার বলে ফেলেছ বাছা, এবার আগে বাড়ো, কথাটাকে ধামাচাপা দাও। উইলিস ভামটা যেন এনিয়ে আর কচলাতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখ।
আর একটা কথা আপনাকে মনে করিয়ে দিতে দিন-যত বড়… না, মানে সামান্য রিস্ক নিলেও আমরা কিন্তু জীবন বাঁচানোর জন্যই ছুটে যাচ্ছি। একটা ঘন্টা বাঁচাতে পারলেও তা অনেক জীবন রক্ষা করার কাজে লাগতে পারে। আর ইউরোপার বুকে…
হ্যাঁ, আমি শিওর। তাছাড়া আমরা সবাই ব্যাপারটায় গর্ববোধ করি। একটু থামল ভিক্টর, আরো কিছু কথা যোগ করতে হবে, অবশ্যই, আমিও একই নৌকার যাত্রী।
আর সেই যাত্রীর যাত্রার কথা সবার সুবিদিত! সবার যাবার সম্মতির মুখে তুমি না গিয়ে করতেটা কী? নৌকা থেকে স্পেসে নেমে ডুব সাঁতার দিয়ে বাড়ি ফিরতে? এসেছে আমার রামরাজত্বের শ্রীরাম, মহা পরোপকারী!
এই সব ব্যাপার আমাকে আরেকটা কথা মনে করিয়ে দিল। উইলিস এখনো নিজের কথা বলে যাচ্ছে, আপনি কি মাত্র দেড়শো বছর আগে উত্তর আটলান্টিকে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটার কথা জানেন?
উনিশো এগার সালের কথা?
ভাল, আসলে উনিশো বার
ক্যাপ্টেন স্মিথ এগুতে থাকা মারটার কথা চিন্তা করছে। নিজে ভেবে বের করতে পারলেই সবচে ভাল হয়, গা বাঁচানো যায়।
আমার ধারণা, ভিক্টর, আপনি টাইটানিকের কথা বলছেন…
“ঠিক তাই, এবারও ব্যাটা কাপ্তান আগে আগে ধরে ফেলল! কিন্তু আর নয়, ছক্কা হাঁকাবে ভিক্টর উইলিস, যেজন্য তার এ্যাদ্দিনের প্রস্তুতি, আমি অন্তত বিশজনের কাছ থেকে কথাটা শুনেছি। তাদের সবার দাবী, মিলটা তারাই প্রথম দেখতে পায়।
কোন মিল? টাইটানিক অসম্ভব সব ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রে নেমেছিল। শুধু রেকর্ড ভাঙার তালে…।
তারপর প্রায় বলেই বসছিল ক্যাপ্টেন স্মিথ, এমনকি তাদের পর্যাপ্ত লাইফবোটও ছিল না। কিন্তু স্রষ্টাকে সহস্রবার ধন্যবাদ, তিনি স্মিথের কোনো জনমের পুণ্যের বদৌলতে যেন এ যাত্রা বাঁচিয়ে দিলেন। কথাটা শুধু মুখ ফস্কে বেরুলেই হত, ক্যারিয়ার-জীবন দু-ই নিয়ে টানাটানি।
তাদের এই শিপের সবেধন নীলমণি শাটলটা সাকুল্যে মাত্র পাঁচজন যাত্রী বইতে পারে, এবং সেই শাটল নিয়ে সৌর জগতের খোলা আকাশে ভেসে পড়া আর প্রশান্ত মহাসাগরের ঠিক মাঝখানে ডুবন্ত জাহাজ থেকে উদ্ধার পাবার আশায় রবারের ডিঙি নিয়ে নেমে যাওয়া একই কথা।
আরো অনেক কথা বলা যেত, ক্যাপ্টেন স্মিথ, তবু সময় নষ্ট না করে মানছি, মেনে নিচ্ছি টাইটানিকের সাথে এই অত্যাধুনিক শিপ ইউনিভার্সের আকাশ পাতাল ফারাক। তবু একটা ব্যাপারে সবার মন খুঁতখুঁত করছে, ক্যাপ্টেন। এ যুগেও মানুষ অতিকল্পনা বা কুসংস্কার-আপনি এটাকে যাই বলুন না কেন, ব্যাপারটাকে প্রশ্রয় দেয়।
ক্রমেই তেতে উঠছে স্মিথের মন-মগজ। যা ডোবানোর ডুবিয়েছিসততা ব্যাটা, বলনা, কী বলবি, বল?
আপনি কি টাইটানিকের প্রথম ও একমাত্র ক্যাপ্টেনের নামটা জানেন?
না, আমি অবশ্য একটু মনে করার চেষ্টা… আর কথা যোগাল না স্মিথের মুখে, * ইংরেজি ভাষায় নামের দুপ্রাপ্যতা এবং একই নামে হাজার মানুষের সহজপ্রাপ্যতা
অন্তর্চক্ষুতে দেখে ঝুলে পড়ল চোয়াল, আচ্ছন্ন হয়ে গেল দৃষ্টি।
ক্যামেরার পেছনে, এতোক্ষণে, স্বনামখ্যাত উপস্থাপক, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাক বিদগ্ধদের একজন, ভিক্টর উইলিস, তার সাক্ষাৎকার নেবার আসল মজার একটু একটু পেতে শুরু করেছে।
ঠিক তাই, ক্যাপ্টেন স্মিথ, ঠিক তাই। ও! একটা ব্যাপার, মানুষ এখনো তার স্বাভাবিক দৈহিক ঝামেলা কাটিয়ে উঠতে পারেনি এবং মহাকাশের ওজনহীন পরিবেশে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়াটাকে তারা…
৩৯. কাপ্তানের টেবিল
আফসোস! পৃথিবীর (পৃথিবীর বাইরের) দর্শকরা ইউনিভার্সের অধিকতর তা অনানুষ্ঠানিক এবং খোলামেলা আলোচনায় ঠিক জুত পায়নি। শিপের জীবন এখন অনেকটা সহজ ও স্বাভাবিক। অনেক পদক্ষেপের কারণে এই বন্ধুসুলভ আবহাওয়ার জন্ম। তার মধ্যে সবচে কার্যকর এবং দীর্ঘজীবী পদক্ষেপ ছিল ঐতিহ্যবাহী কাপ্তানের টেবিল।
ঠিক আঠারোটায় ছ যাত্রী এবং ডিউটিতে না থাকা পাঁচ অফিসার ক্যাপ্টেন স্মিথের সাথে খেতে বসে। এখানে উত্তর অতলান্তিকের বুকে ভেসে চলা প্রাসাদগুলোর মতো জাক-জমক আর পোশাকী রীতি না থাকলেও অনেক বেশি আভিজাত্য লুকিয়ে আছে। ইভা ডিনারটাকে আরো সুন্দর করে তোলে নিত্য নতুন ব্রেসলেট, আঙটি, নেকলেস, চুলের ফিতা বা সুগন্ধির সৌকর্যে। (এসবের সরবরাহ কোত্থেকে আসে এই একলা মহাকাশে আল্লা মালুম, প্রায়ই ভাবে যাত্রীরা বিশেষত মুগ্ধ ফ্লয়েড)
ড্রাইভ চালু থাকলে সাধারণত খাবারটা স্যুপ দিয়েই শুরু করে তারা। নাহলে, ওজনহীন অবস্থায় অন্য ব্যবস্থা আসে। সেই সাথে ক্যাপ্টেন সর্বশেষ খবর জানায়; অথবা পৃথিবী-গ্যানিমিড থেকে প্রচারিত সর্বশেষ গুজবের ঘোমটা নিয়ে টানাটানি করে।
দুনিয়া ডুবে আছে গুজবে। আর সবচে মজার মজার তত্ত্ব বেরুচ্ছে গ্যালাক্সির হাইজ্যাকিং নিয়ে। প্রতিটি গোপন সংস্থার উপরই সবাই খড়গহস্ত। আরও নানা সম্ভাবনা নিয়ে হা-পিত্যেশ করে মরছে সবাই। তবে, সব গুজবেরই দুটো ক্ষেত্রে মিল পাওয়া যায়, সেগুলো গুজব, এবং সেগুলোর কোনোটারই নির্ভরযোগ্য কোনো ব্যাখ্যা নেই।
একটা সত্যি বেরিয়েছে, এবং গুজববিদরা সেটা হাতড়ে আরো জল ঘোলা করার ধান্ধায় আছে দিনমান। অ্যাস্ট্রোপোলের গোয়েন্দারা রোজি ম্যাককোলেন এর আসল নামটা বের করেছে টেনে। রুথ ম্যাসন। সে উত্তর লন্ডনে জন্মানো বিচ্ছ মেয়ে। মেট্রোপলিটন পুলিশে তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ যখন উঁকি দিচ্ছিল তখনই নীতিহীন কাজের জন্য তাকে বাদ দেয়া হয়। আফ্রিকায় ইমিগ্রেশন নিয়েই সে হাওয়া হয়ে যায়। নিশ্চই বেচারী সেই হতভাগা মহাদেশটার অন্ধকার রাজনীতিতে তলিয়ে গিয়েছিল। একইভাবে শাকার কথা উঠেছিল-এবং, একইভাবে, ইউ এস এস এ সেকথা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে অস্বীকার করেছে।
ইউরোপা নিয়ে কী করা যায় সে চেঁচামেচি টেবিলজুড়ে সমাপ্তিহীনভাবে ও ফলহীনভাবে চলছিল সর্বক্ষণ। বিশেষত তর্কাতর্কি শুরুর লেখিকার এক কথা থেকে। ম্যাগি মবালা যখন স্বীকার করল যে সে শাকা নিয়ে একটা উপন্যাসের কথা ভাবছিল তার সহস্ৰ-পত্নীর কারো না কারো দৃষ্টিকোণ থেকে, তখনই পরিবেশ বদলে গেল। কিন্তু প্রজেক্টটা নিয়ে সে যতই এগিয়েছে, ততই দেখা গেল জল ঘোলা।
আমার শাকার ধারণা বাদ দেয়া ছাড়া কোনো গতি ছিল না। আজকের আধুনিক কোনো জার্মান হিটলার সম্পর্কে কী ভাবে তাতো আমরা সবাই জানি।
এভাবেই, মিশন এগিয়ে যাবার সাথে সাথে ব্যক্তিগত দিকগুলো এগিয়ে আসছিল ইউনিভার্সের বুকে। জমে উঠছিল আসর। এমনকি খানাপিনা শেষ হবার পরও একটা গ্রুপকে আধঘণ্টার জন্য সময় বরাদ্দ করতে হত। এই এটুকু আতেই অন্তত এক ডজন বিদগ্ধ জীবনের অভিজ্ঞতা আর একই পরিমাণ স্বর্গীয় মানুষ উপস্থিত থাকাতো কম কথা নয়!
সুতরাং, খাবার পরে আলোচনা-গালগল্প চালানোর এমন সুন্দর উৎস আর কোথায়?
মজার ব্যাপার, সবচে কম প্রভাবশালী বক্তার নাম ভিক্টর উইলিস। সে কথাটা মানতে মোটেও লজ্জা পায় না, আর তার কারণও বলে সহজেই।
আমি লাখো লোকের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করতে করতে এমন প্রাণবন্ত ছোট্ট আসরে বন্ধুদের মধ্যে নিজের জায়গা দখল করার ক্ষমতা হারিয়ে বসেছি।
আসরটা যদি… অবন্ধুসুলভ হয়, তাহলে কি তুমি একটু ভালভাবে কথা বলতে পারতে? মাইকেলোভিচের গলা সব সময় বন্ধুর সাহায্যে উদারহস্ত, চাইলেই তেমন করে ভোলা যায়।
ইভার এখানে তেমন কার্যকর হওয়ার কথা নয়; কিন্তু সেও বেশ চটপটে। অবশ্য তার সমস্ত স্মৃতি শুধু বিনোদন কেন্দ্রীক। সে এমিতে বিখ্যাত-অখ্যাত পরিচালকদের কথা ঘটাতেই বেশি পছন্দ করে। বিশেষ করে ডেভিড গ্রিফিন।
কথাটা কি সত্যি, প্রশ্ন করল ম্যাগি, নিশ্চই শাকার কথা ভাবছিল, যে লোকটা নারী বিদ্বেষী ছিল?।
অবশ্যই না। সে শুধু অভিনেতাদের ঘেন্না করত। তার মতে ঐ শ্ৰেণীটা মানুষের মধ্যেই পড়ে না।
মাইকেলোভিচের কথকতাও একটা ছোট গন্ডিতে বাঁধা। মহান অর্কেস্ট্রাবাদক, ব্যালে নর্তকী, সুখ্যাত কম্পোজার আর তাদের কাজের প্রতি অমর ক্ষুধাই তার কথার ক্ষেত্র। কিন্তু মিউজিকের সাথে নিজস্ব হাস্যরস আর কথার জাদুকে এমনভাবে মেশাতে জানে সে, যার ফলে সব সময় বাড়তি সময় দিতেই হয়।
আর কর্নেল গ্রীনবার্গ সারাক্ষণ মহাকাশ চষে বেড়াচ্ছে টেবিলে বসে থেকেই। বুধের তপ্ত দক্ষিণ মেরুতে ল্যান্ড করার ঘটনা এতোবার এ টেবিলের সবাই সংবাদ মাধ্যমগুলোতে শুনেছে যে নতুন করে এ নিয়ে কিছু শোনার নেই।
সাধারণত প্রতিদিন তারপরই সবার আকর্ষণ চলে যায় একটা প্রশ্নের দিকে, ফিরব কখন বাড়ি?
এবং সাথে সাথেই জবাব আসে কারো না কারো কাছ থেকে, আসলেই কি তোমরা বাড়ি ফিরতে চাও?
তারা বললে আমি অবশ্যই যাব। আজকে বলল গ্রিনবার্গ, কিন্তু চিন্তা করে দেখ, বুধের বেলায় একই ব্যাপার হবে। চাঁদে আমরা প্রথম যাই উনিশো উনসত্তুরে। তারপর পঞ্চাশ বছর পা বাড়াইনি। এখন? অবশ্য বুধকে চাঁদের মতো গুরুত্বপূর্ণ বলা যায় না, কিন্তু অর্ধশত বছর পরে? পানি নেই, তা সত্যি। কিন্তু কে জানতো চাঁদের উপর পানি পাওয়া যাবে… নাকি বলতে হবে চাঁদের ভিতর?
মার্কারীতে নামার মতো অ্যাত্তো বিখ্যাত না হলেও অ্যারিস্টার্কাসে মিউল-ট্রেন বসানো আমার জীবনের এক বিশাল অভিজ্ঞতা।
মিউল-ট্রেন?
হুম! নিরক্ষীয় অঞ্চলের বড় উৎক্ষেপকটা বসানোর আগে বরফ এমন সোজা কক্ষপথে ছুঁড়ে দেয়া যেত না। আমাদের সময়ে বরফকে বয়ে আনতে হত ইম্বিয়াম স্পেস পোর্টে। তার মানে কিন্তু খুব জটিল। লাভায় ঢাকা এবড়োথেবড়ো বিস্তীর্ণ এলাকা সমান কর, জ্বালামুখ আর উপত্যকাগুলোয় বসাও ব্রিজ। অনেক ঠেলা সামলে আইস রোড বানালাম। নামটা সুন্দর না? শুনতে মনে হয় মাত্র তিন শত কিলোমিটার, কিন্তু গড়ার সময় অনেক জীবন কেড়ে নেয় এটা…
খচ্চরগুলো আসলে আট চাকার বিশাল ট্রাক্টর। একেকটা টায়ার বিকট-দর্শন এবং চলাচলও স্বাধীন। একশ টন বরফ ভরা ডজনখানেক ট্রেইলার টেনে নিতেও তাদের তেমন কষ্ট পোয়াতে হয়নি সেসময়ে। চলত রাতেই, ঢাকনার প্রয়োজন হত না তাই।
সেগুলোতে চড়েছি অনেকবার। যাত্রাতে ছঘণ্টা লেগে যেত গড়পড়তা। হাজার হলেও, স্পিড রেকর্ড ভেঙে ফেলার কোনো ধান্ধা থাকত না আমাদের মনে। নিয়ে আসার পর বরফটা ইয়া পেটমোটা এক প্রেশার ট্যাঙ্কে ফেলে সূর্যোদয়ের আশায় বসে থাকা।
গলে যাবার সাথে সাথেই স্পেসশিপগুলো শুষে নেবে।
আইস রোড এখনো সচল। কিন্তু ব্যবহার করে শুধু ট্যুরিস্টরা। তারা যদি কোনো পুরনো ঘ্রাণ খুঁজতে চায় তো রাতে চড়লেই সবচে ভাল করবে, নাহলে মেকি হয়ে যাবে তাদের ভ্রমণ। মাথার উপর বিশাল পৃথিবী নির্দ্বিধায় আলো বর্ষাচ্ছে, একে জোছনা বলা যায় না। আপন মনে হয়, যেন আপনজন পাঠাচ্ছে দূরের আত্নীয়ের খাতিরে। আমরা প্রায়ই লাইট ব্যবহার করতাম না। এমনকি নিয়মিত চেক আউটের জন্য বন্ধুরা যদি রেডিও যোগাযোগের চেষ্টা করত তাহলে আমরা অটো জবাবের হাতে ছেড়ে দিতাম। একা থাকতে চাওয়াটা দোষের কিছু নয়, তার উপর চলন্ত অবস্থায় আকাশে পৃথিবীকে দেখতে কেমন লাগে তা পৃথিবীর চন্দ্রিমাপ্রিয় লোকজন বেশ বলতে পারবে।
এখন সেখানে টেরাভোল্টের কোয়ার্ক ভাঙার কল বসানো হচ্ছে। নিরক্ষীয় অঞ্চলেই। তার উপর আবাসিক ডোমে ডোমে ছেয়ে গেল চাঁদের বুক। কিন্তু আমরা একেবারে নিখাদ চন্দ্রদেবীকে দেখেছিলাম-কুমারী, অসূর্যস্পর্শা। ঠিক যেমন দেখেছে নিল আর্মস্ট্রং আর অনি, ঠিক তেমন-আপনাদের বর্তমান ঐ কী যেন বলে, ট্রাংকুইলিটি বেস থেকে “যদি তুমি থাকতে হেথায় টাইপের কার্ড কেনেন, তেমন স্যুটকোট পরা চাঁদ নয়।
৪০. পৃথিবীর দানবেরা
…শত জন্মের কোন্ পূণ্যে যেন তুমি বাৎসরিক ভোজনটা মিস করেছ। বিশ্বাস করতে পার আমার কথায়, একেবারে গতবছরের মতোই বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা এবারও। এবং আবারও আমাদের প্রিয় হস্তিনী মিসেস উইলকিনসন তার ড্যান্স পার্টনারের পা জীবনের তরে বিকল করে দিয়েছে হাফ-জি ড্যান্স ফ্লোরের উপর নেচেই।
“পরচর্চা অনেক হল, কাজের কথায় আসি। তুমি হপ্তা কয়েকের বদলে মাসের পর মাস বাইরে থাকবে শুনে প্রশাসন তোমার ফ্ল্যাটের দিকে কুনজর দিচ্ছে। তোমার ফ্ল্যাটের অবস্থানটা হাজার হলেও, আকর্ষণীয়, ডাউন টাউনের খোলামেলা পরিবেশ-সেইসাথে পৃথিবী দেখার লোভ। ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলে, তুমি ফেরার আগ পর্যন্ত সাবলেট দেয়ার তালে আছে। প্রস্তাব শুনে খারাপ লাগেনি, অনেক পয়সাকড়ি আসবে তোমার, মুফতে, কী বল? যে কোনো পার্সোনাল ব্যাপারে কথা জানার থাকলে বলবে, সগ্রহ করব…
“এখন, শাকা না কী ছাই নিয়ে কথা উড়ছে হাওয়ায়। আমি জানি, তুমি ঠ্যাঙ ভেঙে দেয়ার কাজ বেশ পছন্দ করেই কর। কিন্তু সত্যি, আমি আর জেরি সিম্পলি ভয় পেয়ে গেছিলাম। বোঝাই যায় কেন ম্যাগি মবালা তাকে এমন ঠেস দিল, তার অলিম্পাসের পিপাসা পড়েছি আমরা প্রায় সবাই। বইটা একটু বেশি নারীবাদী, আমাদের জন্য…
“কী দানবরে বাবা! বোঝাই যায় কেন তার পেছনে আফ্রিকান গুন্ডা লেলিয়ে দিয়েছিল কেউ একজন। কী হিংসুটে! দলের কোনো যোদ্ধা বিয়ে করলেই সোজা ফাঁসিকাষ্ঠে। তার এলাকায় কোনো গরুও ছিল না-একমাত্র দোষ ওগুলো ফিমেল । আর তার আবিষ্কার করা স্পিয়ারগুলো কী ভয়ংকর ছিল, চেনা অচেনা যে কোনো মানুষের গলায় ফুঁ দিয়ে গেঁথে দিত বিষাক্ত ছোট্ট তীর, বেশিদূর থেকে দেখলে মনে হবে নলটা কোনো চুরুট… ।
“আর আমাদের জন্য কী লজ্জাজনক প্রচারণা, আল্লা মাবুদ! কোনো মানুষকে হিংস্র করার জন্য যথেষ্ট। আমি সব সময় দাবী করে আসছি যে আমরা ভদ্র, সদয় (এবং পাগলের মতো মেধাবী ও সৃষ্টিশীল, অবশ্যই। আর আজকে কিনা তোমরা আমাদের চোখের সামনে তথাকথিত যোদ্ধার স্পিরিট আনতে চাচ্ছ! যেন মানুষ মারার মধ্যে মহান কোনো ভাব লুকিয়ে আছে। আমরা আমাদের এই সঙ্গত কারণেই লজ্জিত..
“হ্যাঁ, আমরা হ্যাঁড্রিয়ন আর আলেকজান্ডারের কথা জানি ঠিকই; কিন্তু অবশ্যই রিচার্ড দ্য লায়ন হার্ট আর সালাদিনের গল্পটা ভুলে যাবার চেষ্টা করি এবং হারিয়ে ফেলি। ভুলে যাই জুলিয়াস সিজারের কথা-অবশ্য অ্যান্টনি আর ক্লিও সে কথা ভুলতে দেয় না। অথবা ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেটের কাহিনীগুলো…
যখন জেরিকে বললাম যে অন্তত নেপোলিয়ন একজন ব্যতিক্রমী মানুষ তখন তার বলা সেই উক্তির কথাও মনে করিয়ে দিই। আমি বাজি ধরতে রাজি যে যোসেফাইন আসলে একটা ছেলে ছিল। ব্যাপারটা ইভার উপর প্রয়োগ করার চেষ্টা করো।
“তুমি আমাদের মনোবল গুঁড়িয়ে দিলে! হতভাগা। আমাদের অবহেলা করে খুশি রাখাই উচিত ছিল তোমার…
এবং, এতোকিছু সত্ত্বেও আমি সেবাস্টিয়ানের মতো ভালবাসা পাঠালাম। যে কোনো ইউরোপানের সাথে দেখা হলেই শুভেচ্ছা জানিও। গ্যালাক্সির পাঠানো রিপোর্ট দেখে মনে হল তারা মিসেস উলকিন্সের সাথে বেশ খাপ খাবে।
৪১. অশীতিপরের জীবনকথা
এম্নিতে ড. ফ্লয়েড বৃহস্পতির প্রথম মিশনটার কথা বলতে চায় না সব সময়। এবং দশ বছর পরে, লুসিফার অভিযানের কথাও তার পেট থেকে বেরোয় না।
কারণও আছে, কংগ্রেশনাল কমিটি, স্পেস কাউন্সিল বোর্ডগুলো আর ভিক্টর উইলিসের মতো মিডিয়ার লোকের কাছে সে প্রতিটি পল অনুপলের কথা নানা সুরে নানা সময়ে কমপক্ষে একশোবার করে বলেছে।
তারপরও তার সাথীদের প্রতি একটু দায়িত্ব আছে তার, সেটা এড়ানো কঠিন। নতুন এক নক্ষত্র আর সৌর জগতের সৃষ্টিকালে নিজের চোখে যে কজন ব্যাপারটা দেখেছে তাদের মধ্যে একমাত্র জীবিত ব্যক্তিটিকে তারা সে সময়ের কথা শোনার জন্য চাপাচাপি করতেই পারে; বিশেষত যখন তারা সেই লক্ষ্যটার দিকে অনির্বচনীয় গতিতে এগুচ্ছে।
এই গ্যালিলীয় জগতের গ্রহ-উপগ্রহের নাড়ী-নক্ষত্রের খবর সে সেখানে কাজ করা ইঞ্জিনিয়ার আর বিজ্ঞানীদের চেয়ে অনেক কমই বলতে পারবে। যখন প্রশ্ন উঠল, ইউরোপায় থাকাটা আসলে ঠিক কেমন? (অথবা গ্যানিমিডে, বা আইওতে, কিংবা ক্যালিস্টোতে…)
সে নাঙা গলায় প্রশ্নকর্তাকে শিপের লাইব্রেরির রিপোের্ট ঘাটতে বলে সাথে সাথে । কিন্তু এখনো একটা ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতা আর সবার চেয়ে এগিয়ে। আজ অর্ধশত বছর পরে সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না সেই অনির্বচনীয় অপার্থিব অভিজ্ঞতাটাকে। ডিসকভারিতে ডেভিড বোম্যান আসার সময় সে কি আসলেই জেগে ছিল, দেখেছে সেসব ঘটনা? ব্যাপারটা ভেবে নেয়া খুবই সহজ যে দশ বছরের পরিত্যক্ত ধুলোমলিন স্পেসশিপ ভুতুড়ে হয়ে যেতে পারে….
কিন্তু, সে তখন ঘুমায়নি-মানে ঘুমাতে পারে না। স্পষ্ট, সে দেখল সেই মানুষটার মুখ-যে এই বিরান আকাশে হারিয়ে গেছে একযুগ আগেই, দেখল কামরার সবটুকু ধুলাকে একত্রিত হতে, দেখল ভেসে থাকা ধূলিকণা মিলেমিশে কী করে ত্রিমাত্রিক একটা মুখ-অবয়ব গড়ে তোলে।
অস্বীকার কী করে করে সে? সেই মুখের সাবধানবাণীতেই পুরো লিওনভ আর তার সমস্ত ক্রু বৃহস্পতি-বিস্ফোরণের হাত থেকে বেঁচে যায়। এখনো কী স্পষ্টভাবে তার মনে পড়ে, ঠোঁটগুলো একেবারে অনড় ছিল, আর শব্দ এসেছিল স্পিকার কনসোল থেকে!
এক ডিনার টেবিলে বসে অবশেষে একদিন মুখ খুলল অশীতিপর ডক্টর হেউড ফ্লয়েড, খুলে গেল আধ-শতাব্দীর বন্ধ দুয়ার।
“কেন সে করল কাজটা, কেন? আজ পঞ্চাশ বছর, আমি প্রশ্নটা বুকে নিয়ে মরছি। সে ডিসকভারির স্পেসপোড নিয়ে মনোলিথটা দেখতে বেরুনোর পর যা-ই হয়ে গিয়ে থাকনা কেন, মানুষের সাথে কোথায় যেন তার একটা সম্বন্ধ থেকে গেছে। তখনো একেবারে ভিন্ন সত্তা হয়ে যায়নি। তার সেই পৃথিবী ভ্রমণ থেকেই কথাটার প্রমাণ মেলে। ভ্রমণটা ছোট ছিল, কিন্তু প্রমাণ ছিল অনেক। তার মধ্যে আণবিক বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাটা সবচে শক্ত। সে তার মা আর পুরনো গার্লফ্রেন্ডের বাসায় যায়, এমন প্রমাণও নিশ্চিত। যা-ই হয়ে থাক না কেন সে, তার আবেগ উবে যায়নি।
কী মনে হয়, সে এখন কী হয়ে গেছে? প্রশ্ন তুলল উইলিস, বহু পুরনো প্রশ্ন, আর, কোথায় আছে এখন?
হয়তো শেষ প্রশ্নটার কোনো অর্থ নেই-এমনকি মানুষের ক্ষেত্রেও কথাটা প্রযোজ্য। তোমার সচেতনতা ঠিক কোথায় লুকিয়ে আছে তা কি তুমি জান?
আমি অধিভৌতিকতা নিয়ে কোনো দর্শন কপচাচ্ছি না। সচেতনতা? আমার ব্রেনের কোনো না কোনো স্থানে, হয়ত।
আমি যখন তারুণ্যে টগবগ করছি, যেন লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠল বাদ্যযন্ত্রবিদ মাইকেলোভিচের চেহারা, যে সব সিরিয়াস আলোচনায় আসল কথাটা বলে বসে, তখন আমারটা মাথা থেকে মিটারখানেক নিচে ছিল…।
আচ্ছা, ধরে নিই সে এখন ইউরোপায়। আমরা জানি ঐ মরার জায়গাটাতেও একটা মনোলিথ ঘাপটি মেরে বসে আছে। ধরা যাক সে কোনো না কোনো মহাসাগরের প্রতিনিধিত্ব করছে, ওয়ার্নিংটা কীভাবে প্রচার করল তা নিয়ে একটু কথা বলা যাক।
তোমার কি মনে হয় সে দ্বিতীয় সাবধান বাণীটাও উচ্চারণ করেছে, আমাদের দূরে থাকতে বলে?
যে সাবধানবাণীটা আমরা থোড়াই পরোয়া করতে যাচ্ছি।
-বেশ ভাল একটা কারণ থাকাতে
ক্যাপ্টেন স্মিথ সাধারণত আলোচনাটাকে গন্তব্যের দিকে নিয়ে যায়। কখনো যা করে না সেটাই করল এবার, কথা বলে উঠল মাঝ থেকে।
“ড. ফ্লয়েড, আপনি এক অসাধারণ পর্যায়ের মানুষ, আর সেই সুযোগটা নেয়া উচিত আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে। একবার বোম্যান আপনাকে সাহায্য করতে এসেছিল। আশপাশে থেকে থাকলে আবারও সে একই কাজ করবে বলে আমার ধারণা। আমি সেই–এখানে নামার কোনো চেষ্টাই করো না–আদেশ নিয়ে চিন্তিত। সে যদি একবার জানায়, আদেশটা সাময়িকভাবে স্থগিত হয়েছে, তাহলে নিশ্চিন্ত হই।
ফ্লয়েড জবাব দেয়ার আগেই শুনে নাও, পুরোটা শুনে নাও ধ্বনি উঠল আশপাশ থেকে।
আমিও একই পথ ধরে হাঁটছি। আমি এরই মধ্যে গ্যালাক্সিকে বলেছি-যেকোনো, যেকোন-অস্বাভাবিক ব্যাপারের দিকে নজর রাখ। যদি সে যোগাযোগের চেষ্টা করে।
অবশ্যই, বলল ইভা, সে এরিমধ্যে মরে গেছে যদি ভুতেরা আদৌ মরে।
এমনকি মাইকেলোভিচও এ কথার যুতসই জবাব পেল না। কিন্তু যথারীতি আর সবার চেয়ে আগে পাগলাটে কথাটা বলে বসেছে অভিযাত্রী।
কিন্তু তার যেন আজ জোয়ার এসেছে।
উডি, ডিয়ার, সে বলল স্বাভাবিক কণ্ঠে, তুমি কেন তাকে রেডিওতে একটা কল করছ না? এ কাজের জন্যই রেডিওটা বানানো হয়েছে, তাই নয় কি?
আইডিয়াটা ফ্লয়েডের কাছে ভাল লাগল। রেডিও দিয়ে সৌরজগৎ এফোড় ওফোড় করে ফেলা সম্ভব। তাতে, সত্যি যদি সাবেক কমান্ডার, বৃহস্পতি জগতে পা রাখা প্রথম জীবিত মানব ডেভিড বোম্যানের অস্তিত্ব এ জগতের কোথাও থাকে, সে বুঝতে পারবে, ঠিকই বুঝবে। কিন্তু ইভার খোঁচাটাকে তেমন গুরুত্ব দিল না সে।
ডাকব। আশা করি তাতে কোনো বিশেষ ক্ষতি হয়ে যাবে না।
৪২. ঘুমঘোরে এলে মনোহর
এবার ফ্লয়েড একেবারে নিশ্চিত; সে স্বপ্ন দেখছিল…
সে এই জীবনে কখনো ভালভাবে ঘুমাতে পারেনি জিরো গ্র্যাভিটির শিকার থাকা অবস্থায়। এখন, ইউনিভার্স সর্বোচ্চ গতিতে চলছে, কিন্তু ইঞ্জিন বন্ধ। তাই মাধ্যাকর্ষণও অনুপস্থিত। এই গতির কারণে অনেক সময় লাগবে থেমে যেতে। সপ্তাহখানেক সময় নিয়ে থামবে স্পেসশিপটা, তারপর মিলিত হবে ইউরোপার সাথে ।
জীবনভর সে বাঁধার বেল্ট এটে নিয়েছে শরীরের সাথে, এবং জীবনভর সেগুলো হয় অতি শক্ত নয় অতি নরম হয়ে এটে গেছে-কখনো ঠিকঠাক থাকেনি। হয় শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে মরার যোগাড় হয় নয়তো জেগে দেখে নিজের শরীর ভাসছে বাঙ্ক জুড়ে।
একবার দেখে ভাসছে কোথায় যেন, দেখেও বোঝা যায়নি। পরে দেখা গেল ভেন্টিলেটরের কাছাকাছি। কারণ সেখানে একটু হলেও বল কাজ করে। জেগে প্রতিবারই নিখাদ আতঙ্ক ছাড়া আর কোনো অনুভূতি হয়নি সেসব বিরক্তিকর সময়ে। একজন সত্যিকার অনিয়মিত মহাকাশযাত্রী হিসেবে সব সময় তার এসব ভেজাল পোয়াতে হয়।
কিন্তু আজ রাতে তার সবই ঠিকঠাক ছিল-অম্ভত দেখেশুনে তেমনি মনে হয়। বরং ওজন ফিরে এলে সে ওজনে অভ্যস্ত হতে সময় নেবে। ডিনারের আলাপ আলোচনার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুম এসে গেল কখন, সে বলতেও পারবে না।
স্বপ্নে সে টেবিলের কথা চালিয়ে গেল। যথারীতি অবাক করা কিছু উপাদান ছিল স্বপ্নটায়, উইলিস নিজের দাড়ি ফিরে পেয়েছে টাইপের, তাও আবার মুখের একপাশে। স্বপ্নে মানুষের যে ক্ষমতাটা কেড়ে নেয়া হয়, তার নাম অবাক হওয়া। সে মোটেও অবাক হয়নি কারবার দেখে। যেন উইলিস নিত্যদিন আধমুখ দাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ফ্লয়েডের মনে হল কোনো এক রিসার্চের কাজে তাকে এমন মুখ করতে হয়েছে-কিন্তু কেন আল্লা মালুম। সম্ভবত হেলমেটের ব্যবহার মনে পড়ে গেছে, অবচেতন মন সেটাকেই অর্ধেক করে দেখাচ্ছে।
কিন্তু তার সেই পুরনো ব্যথাগুলো ফিরে এসেছে। সে স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেটর মিলসনের প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে জারজার হচ্ছে। কীভাবে যেন লোকটা এখানে এসে এই ছোট্ট পার্টিকে কলঙ্কিত করল। মিলসন চল্লিশ বছরেরও আগে মারা গেছে, তথ্যটার যেন কোনো গুরুত্বই নেই।
হেউড, তার পুরনো শত্রু খুশিমনে বলছে, হোয়াইট হাউস তোমার উপর মোটেও খুশি নয়। মহা নারাজ।
আমি ভেবে পাই না কেন তারা আমার উপর নারাজ হতে যাবে।
যে রেডিও মেসেজটা তুমি এইমাত্র ইউরোপার দিকে পাঠালে সেটার কারণে। স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে ক্লিয়ারেন্স নিয়েছ?
প্রয়োজন বোধ করিনি। সহজে আমি মাটি থেকে আদেশ কুড়াই না।
ও! কিন্তু সেটাই তোমাকে এখন কুড়াতে হচ্ছে। কাকে জিজ্ঞেস করে নিয়েছিলে তাহলে? আমরা কি একটুও বুঝতে পারছি না যে সরকার প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন বর্তমানে? কী জানি, এতো সবকিছু অগোছালো থাকলে…
মিলসন ভদ্র ভাষায় গালাগালি করতে করতে হারিয়ে গেল… আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া, স্বপ্ন দেখছি। এখন কী দেখব আবার?
ভাল। হয়ত আমি এটাই আশা করছিলাম। হ্যালো, ওল্ড ফ্রেন্ড! তুমি সব আকৃতি নিয়েই এসেছ, আসনি কি? আমি নিশ্চিত, টি এম এ-১ ও আমার কেবিনে গা গলাতে পারবে না। আর তার বড় ভাইতো উল্টো পুরো ইউনিভার্সকেই এক লহমায় গিলে নিতে পারবে, আমার কেবিনে আসবে কী?
তার বাঙ্ক থেকে মাত্র দু মিটার দূরে কালো মনোলিথটা দাঁড়িয়ে আছে, অথবা আছে ভেসে। হঠাৎ, আহত হয়ে ফ্লয়েড দেখল, শুধু আকৃতিতে নয়-আকারেও জিনিসটা অতি সাধারণ কবরফলকের মতো। এ মিলের কথা তার কাছে অনেকেই বলেছিল এককালে; কিন্তু চোখের সামনে দেখে ব্যাপারটাকে অন্যরকম লাগছে-বাস্তব বাস্তব। এই প্রথমবারের মতো সে দেখল, মিলটা শুধু অস্বস্তিকরই নয়, বরং ভয় ধরানো।
আমি জানি, এ এক ড্রিম, কিন্তু এ বয়সে আর নতুন করে সাবধানবাণী শুনতে চাই না…
যাই হোক, কী চাই তোমার এখানে? তুমি কি ডেভ বোম্যানের কাছ থেকে কোনো খবর নিয়ে এসেছ? তুমিই কি ডেভ বোম্যান?
যাক, আমি কিন্তু আসলে কোনো জবাব চাই না। অতীতে তুমি খুব একটা বাঁচাল ছিলে না-নাকি মিথ্যা বললাম?
কিন্তু তোমার দেখা পেলেই সব ভজঘট হয়ে যেত।
টাইকোতে, আজ থেকে ষাট বছর আগে, তুমি বৃহস্পতির দিকে চিৎকার করে তোমার স্রষ্টাদের জানিয়েছিলে, আমরা উন্নত, আমরা ফুল ফুটিয়েছি মরুর বুকে।
আর দেখ, একযুগ পরে বৃহস্পতির দিকে যখন গেলাম, সেটার কী হাল করলে এই তুমিই!
এখন, ঠিক এখন, তুমি কোন্ ভাঙনের পথে এলে, সুপ্ত রাতে?