০৫.
অর্চনার বিয়ে হয়ে গেল।
সংসারে কর্ত্রী পিসিমা। সুখেন্দুর বাবারও বড়। বাবা অনেককাল বিগত। সুখেন্দুর ছাত্রজীবনের শেষ দু বছর এই পিসিমাই দূরে থেকে তার আর তার মায়ের ব্যয়ভার বহন করেছেন। নইলে বি. এ. পাশ করেই সুখেন্দুকে চাকরির চেষ্টা দেখতে হত, এম এ. পড়া হত না। বাবা মারা যাবার পর পিসিমা মাঝে মাঝে এই সংসারে এসে এক মাস দু-মাস থাকতেন। বি. এ. পাশ করার পর ভাইপোকে পড়া ছেড়ে শুকনো মুখে চাকরির কথা ভাবতে দেখে তিনিই জোর করে ওর আরো পড়ার ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন।
রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সময় সুখেন্দু পাকাপাকি ভাবে পিসিমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। শেষ জীবনটা পিসিমা হরিদ্বারে কাটাবেন স্থির করেছিলেন। সেখানকার এক আশ্রমে তার বড় জা থাকেন, বহুবার তিনি সেখানে আহ্বান জানিয়েছেন। পিসিমাকে কলকাতায় নিয়ে আসার সময় সুখেন্দুও তার হরিদ্বারে থাকার ইচ্ছেয় আপত্তি করেনি। কথা ছিল, তার মা কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলে তিনি যাবেন।
কিন্তু মা আর সুস্থ হননি। মস্ত একটা খেদ নিয়েই তিনি চোখ বুজেছেন আর পিসিমাকে ভাল হাতে আটকে রেখে গেছেন।
এই সব অর্চনা বেশির ভাগই সুখেন্দুর মুখে শুনেছে। শুধু শাশুড়ীর খেদের কথাটা পিসিমা নিজে বলেছেন। অর্চনা এ বাড়িতে পদার্পণ করার প্রথম সন্ধ্যাতেই পিসিমা তাকে দোতলায় সুখের ঘরে দেয়ালের গায়ে টাঙানো ছবিতে তার শাশুড়ীকে দেখিয়েছেন। প্রমাণ-সাইজের অয়েল-পেন্টিং ছবি–ফুলের মালা জড়ানো। পিসিমা বলেছেন, তোমার শাশুড়ী… আজ যেন হাসছে।
ছবিতে শাশুড়ী হাসুন আর না হাসুন, পিসিমা চোখ মুছছিলেন। রাশভারী মহিলাটি সেদিন আনন্দে অনেকবার হেসেছেন অনেকবার কেঁদেছেন। ছবি দেখিয়ে বলেছেন, বড় সাধ ছিল ছেলের বউ দেখবে নাতির মুখ দেখবে। শেষের দিন ক’টা তো এই এক আশা নিয়েই বেঁচে ছিল, কিন্তু গোঁয়ার ছেলে তো তখন–
আর বলেননি। শুভদিনে চোখের জল আটকাবার জন্যেই হয়তো ওকে বসিয়ে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। অনা তখন উঠে এসে ছবিটিকে নিরীক্ষণ করে দেখেছে। নিজের অগোচরে যুক্তকরে শাশুড়ীর উদ্দেশে প্রণামও করেছে।
বাড়িতে আর পাকা বাসিন্দা বলতে রাধুনী সাবি। একটা ছোকরা চাকর আছে, হরিয়া-সে ঠিকে কাজ করে, দু-বেলা এসে কাজকর্ম করে দিয়ে যায়। পিসিমার আপত্তি সত্ত্বেও সুখেন্দুর এই ব্যবস্থা, কোনভাবে যেন তাঁর অসুবিধে না। হয়। তাঁর পূজো-আর্চা আচার-অনুষ্ঠানের বিঘ্ন যত কম ঘটে।
বিয়ের পর সব থেকে স্বস্তির নিশ্বাস বোধ করি এই পিসিমাই ফেলেছিলেন। ভাইপোর মেজাজ তাঁর থেকে বেশি আর কে জানে! এই একরোখা ছেলে নিয়ে মন্ত দুর্ভাবনা ছিল তাঁর। যতবার বিয়ের কথা বলেছেন, ছেলের সাফ জবাব, অশান্তি বাড়াতে চাও কেন, মা যখন নেই আর দরকারও নেই–
পিসিমা অনুযোগ করেছেন, মা নেই বলে কি আমি নেই, আমি চিরকাল পড়ে থাকব এখানে?
সুখেন্দু বলেছে, পড়ে থাকবে কেন, যখন যেখানে ভাল লাগবে সেখানে থাকবে।
পিসিমার দুর্ভাবনা গেছে। মুখে না বলুক মনে মনে অর্চনার ওপরেও খুশী–এই ছেলের জন্য ও-রকম মেয়েই দরকার ছিল।
পিসিমার উপলব্ধি মিথ্যে নয়, সুখেন্দুর গুরুগম্ভীর ভারী দিকটা অর্চনা যেন দুদিনেই হালকা করে ফেলেছিল। এমন যে, নিজের পরিবর্তনে সুখেন্দু নিজেই মাঝে মাঝে অবাক হত। সপ্তাহে তিন দিন সকালে প্রাইভেট এম. এ. পরীক্ষার্থিনী এক বিবাহিতা ছাত্রী পড়াতে যায়, দেড়শ’ টাকা মাইনে। সেখানে ঘড়ি ধরে হাজিরা দিয়ে এসেছে এতদিন। ওই তিন দিন সকালে বাড়িতে চা খাওয়ার অবকাশ বড় হত না। বিয়ের তৃতীয় দিনেই অর্চনা সেইখানে জুলুম কর, আর সেটা যে এত মিষ্টি লাগতে পারে সুখেন্দু কোনদিন কল্পনাও করেনি।
তখন সাতটাও নয় সকাল, অর্চনা নিচে। ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই তাড়াতাড়ি জামা গায়ে গলিয়ে নিচে নামতে যাবে, দেখে চায়ের পেয়ালা হাতে অর্চনা ওপরে উঠে আসছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতেই সুখেন্দু ব্যস্তভাবে বলল, এখন নয়, এসে খাব’খন দেরি হয়ে গেছে–
অর্চনা কিছু বলেনি, চায়ের পেয়ালা হাতে মাঝ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পড়েছিল শুধু। সুখেন্দু নাগালের মধ্যে আসতেই খপ করে জামার বুকের কাছটা ধরে হিড়হিড় করে আবার তাকে ওপরে টেনে এনেছে। সুখেন্দু অনুনয় করেও রেহাই পায়নি। ওই অবস্থায় ওপরে উঠতেই বারান্দার অন্য কোণ থেকে পিসিমার সঙ্গে চোখাচোখি। জামা ছেড়ে দিয়ে অর্চনা দৌড়ে ঘরে পালিয়েছে। ব্যাপারটা বুঝে পিসিমা মনে মনে বলেছেন, এই রকমই দরকার ছিল। এক মিনিট দেরি হলে কতদিন ছেলে সাবির মুখ কালো করে দিয়ে ভাত না খেয়েই কলেজে চলে গেছে ঠিক নেই। কেউ ডাকতে সাহস পর্যন্ত করেনি। এখন চা না খেয়েও বেরুনো বন্ধ।
রাতে খাবার টেবিলে সেদিন এমন গম্ভীর দাদাবাবুর কাণ্ড দেখে আড়ালে গিয়ে সাবি রাঁধুনীও আনন্দে ক’বার জিব কেটেছে ঠিক নেই। ফাঁক বুঝে সুখেন্দু জোরজার করে অর্চনার মুখে কিছু খুঁজে দেবেই। অর্চনা তার হাত থেকে খাবে না, সুখেন্দু নাছোড়। শেষে বাহুবলে সেই চেষ্টা করার উপক্রম দেখে অর্চনা হঠাৎ এস্তে বলে উঠেছিল, এই, পিসিমা!
হকচকিয়ে গিয়ে সুখেন্দু নিজের জায়গায় বসে ফিরে দেখে প্লেটে, আরো ভাত নিয়ে দোরগোড়ায় সাবি লজ্জায় ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে।
সুখেন্দু অপ্রস্তুত, হাসতে হাসতে অর্চনার বিষম খাবার দাখিল।
শোবার ঘরের ঠিক পাশের ঘরটিতে বসে সুখেন্দু পড়াশুনো করে। দুই ঘরের মাঝখান দিয়েও দরজা আছে একটা। রাতের আহারের পর খানিক বই নিয়ে বসাটা বরাবরকার অভ্যাস। বিয়ের কয়েকদিন বাদে সেই অভ্যাসটাই বজায় রাখতে চেষ্টা করেছিল সেদিন। কিন্তু পড়ায় মন বসছে না, তবু অর্চনা ঠাট্টা করবে বলেই জোরজার করে বসে আছে। ওর সঙ্গে ছদ্ম রেষারেষি করেই পড়তে বসেছিল।
বই থেকে মুখ না তুলেই বুঝল পা-টিপে অর্চনা মাঝের দরজাটা নিঃশব্দে বন্ধ করে দিচ্ছে। খুব সন্তর্পণে দরজা বন্ধ করে আস্তে আস্তে শিকল তুলে দিয়েই অর্চনা চমকে ফিরে তাকাল। এরই মধ্যে বারান্দার দরজা দিয়ে সুখেন্দু ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়ে ঘড়ঘড় করে নাক ডাকাচ্ছে। জব্দ হয়ে অর্চনা হেসে ফেলে ঝন করে শিকলটা ফেলে দরজা খুলে দিয়েছে আবার।–থাক, আর নাক ডাকাতে হবে না, বিছানায় গা ঠেকালে ও-নাক আপনি ডাকে।
অনুযোগটা মিথ্যে নয়। শুয়ে পড়লে ঘুমুতে তার দু মিনিটও লাগে না। তৎক্ষণাৎ উঠে বসে সুখেন্দু নিরীহ মুখে ঘোষণা করেছে, আজ আর বিছানায় গা ঠেকাবো না ভেবেছি।
ছুটির দিনে অর্চনার বাবা মা বরুণা সকলেরই নিয়মিত প্রত্যাশা, ওরা আসবে। কিন্তু প্রথম কটা দিন সে-সময়ও হয়নি ওদের। মা মনে মনে অসন্তুষ্ট হন জেনেও অর্চনা নিরুপায়। ছুটির দিন এলেই দেখা যায়, সুখেন্দু আগে থাকতেই কোথাও না কোথাও প্রোগ্রাম করে বসে আছে। সিনেমা থিয়েটার নয়, দশ-বিশ মাইল দূরে কোথাও বেরিয়ে পড়ার প্রোগ্রাম। আর সত্যি কথা, তখনকার সেই আনন্দের মধ্যে অর্চনারও বাড়ির কথা বা মায়ের কথা মনে থাকত না। এমন কি, সেদিন ডায়মন্ড হারবার থেকে ঘুরে আসার পর মনের আনন্দে মায়ের ঘরোয়া চায়ের আমন্ত্রণে যেতে না-পারার খেদও ভুলতে সময় লাগেনি। অর্চনা যাবে কথা দিয়েছিল, আর মিসেস বাসু তো ওর আসতে না পারার কথা ভাবতেও পারেন না। আগেও দুই-একবার আসবে বলে আসেনি। এটা তার থেকে একটু স্বতন্ত্র ব্যাপার। আরো দু-চারজন ভদ্রলোক ভদ্রমহিলার আসার কথা। কিন্তু দেখা গেল ওকে হঠাৎ খুশী করার জন্য সুখেন্দু আগে থাকতেই ডায়মণ্ড হারবার যাবার ব্যবস্থা ঠিক করে রেখেছে। অর্চনার ভিতরটা খুঁতখুঁত করছিল, মা অসন্তুষ্ট হবেন। কিন্তু সুখেন্দু আমলই দেয়নি।
সেখানে গিয়ে পড়ার পর অর্চনা নিজেই সব ভুলেছিল। সূর্যাস্তের পর ছোট একটা নৌকো ভাড়া করেছিল দুজনে। মাঝির কাছ থেকে নৌকোর হাল ধরতে গিয়ে সুখেন্দু নৌকো ঘুরপাক খাইয়েছে। অর্চনা ঠাট্টা করেছে, টিপ্পনী কেটেছে। হাল আর বৈঠা নিয়ে খানিক দাপাদাপি করে সুখেন্দু ঠাণ্ডা হয়ে বসেছে। বিকালের সূর্যাস্তের শেষ রঙে গোটা নদীটাই যেন অদ্ভুত রাঙানো। চলন্ত নৌকোয় সুখেন্দু একটা হাত জলে ডুবিয়ে বসে ছিল, আর জলের বুকে লম্বা একটা দাগ পড়ছে তাই দেখছিল।
সামনে থেকে কৃত্রিম মোটা গলা শোনা গেল, সুখেন্দুবাবু, ও কি হচ্ছে?
হাত আর মুখ দুই-ই তুলে দেখে, অর্চনা তার দিকে চেয়ে মিটি মিটি হাসছে। সুখেন্দু ভুরু কোঁচকালো।
সঙ্গে সঙ্গে অর্চনাও–ওখানে হাত কেন, একটা কিছুতে ধরে টান দিলে–?
তা বলে তুমি আমার নাম ধরে টান দেবে। দাঁড়াও পিসিমাকে বলছি–
অর্চনা ঘটা করে নিশ্বাস ফেলেছে একটা।-আহা, কি খাসা নাম। সুখেন্দু … মুখের সঙ্গে তো কোনকালে কোন সম্পর্ক ছিল বলে মনে হয় না।
সুখেন্দুর মতলব অন্যরকম, কাছে আসার উদ্যোগ করেছে, হয় না বুঝি…?
ভাল হবে না বলছি। সঙ্গে সঙ্গে জল ছিটিয়েই অর্চনা তাকে বাধা দিতে চেষ্টা করেছে আর তার সেই বিব্রত অবস্থা দেখে খিলখিল করে হেসেছে।
স্বপ্নের ঘোরে দিন কাটছিল যেন।
এই ঘোটা মাঝে মাঝে অর্চনার মা-ই ভেঙেছেন। মেয়ের সাংসারিক ব্যাপারে আর তার কোন দায়িত্ব নেই, এটা তিনি একবারও ভাবতে পারেননি –ভাবতে রাজীও নন। বরং এই অপ্রিয় দায়িত্ব তার আরো বেড়েছে বলেই মনে করেন। মেয়ের বিচার-বুদ্ধি এই বিয়ের থেকেই বুঝে নিয়েছেন। তাই কিছু একটা মনে হলেই তিনি দাশুর হাতে চিঠি দিয়ে মেয়েকে ডেকে পাঠান। অর্চনা না গিয়েও পারে না। না গেলে পরামর্শ দেবার জন্য জন নিজেই এসে হাজির হন। অর্চনা শোনে, শুনতে হয় বলেই শোনে। ভিতরে ভিতরে অস্বস্তি, আর, না কেউ শুনে ফেলে। ফাঁক পেলে জামাইকেও সাংসারিক বিষয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটু আধটু উপদেশদানে কার্পণ্য করেন না মহিলা। ফলে জামাই শাশুড়ীটির ধারেকাছে ঘেঁষতে চায় না। অর্চনাকে বলে, তোমার মা-টি আমাকে তেমন পছন্দ করেন না।
অর্চনা হেসে উড়িয়ে দেয়। কখনো ছদ্ম সহানুভূতি দেখায়, আহা, এমন পছন্দের মানুষকে পছন্দ করে না…! কখনো বিব্রত বোধ করেও ছদ্মকোপে চোখ রাঙায়, তার মেয়ের পছন্দয় মন ভরছে না?
মায়ের সমস্যাটা কোথায় বা কাকে নিয়ে, অর্চনা মনে মনে সেটা খুব ভাল করেই জানে।
মায়ের সমস্যা পিসিমা।
প্রথমত মেয়ের সংসারের এই সেকেলে পরিবেশটাই মায়ের পক্ষে বরদাস্ত করা কঠিন। একজন গ্রাম্য বিধবা সেখানে কর্তৃত্ব করবেন আর মেয়ে তার কথায় উঠবে বসবে সেটা সহ্য করা আরো শক্ত। তার ধারণা, মেয়ে যে ডাকা মাত্র আসে না বা আসতে পারে না, তার কারণও ওই পিসিমা। পিসিমার কথা উঠলেই মেয়ে তাড়াতাড়ি সে-প্রসঙ্গ চাপা দিতে চায়, সেটা লক্ষ্য করেও তিনি মনে মনে চিন্তিত এবং ওই মহিলাটির ওপর বিরূপ। এর ওপর গোড়ায় গোড়ায় দিদির বাড়ি থেকে ঘুরে গিয়ে বরুণা সপুলকে মাকে ঠাট্টা করেছে, দিদিটা যে মা একদম গেঁয়ো হয়ে গেল, বসে ব্রতকথা শোনে, ছাই দিয়ে নিজের হাতে বাসন মাজে।
কখনো এক আধটা রেকাবি-টেকবি মাজতে দেখে থাকবে। কিন্তু এরই থেকে মা মেয়ের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল দেখেননি। তার ওপর অর্চনা আর য়ুনিভার্সিটিতে যাচ্ছে না শুনে তো রীতিমত ক্রুদ্ধ তিনি। অর্চনা পড়বে না সেটা সুখেন্দুরও আদৌ ইচ্ছে ছিল না, আর সেজন্য তাগিদও কম দেয়নি। তবু মিসেস বাসু সেই বেচারার সঙ্গেই এক-হাত বোঝাপড়া করতে ছাড়েননি। অর্চনা অবশ্য বলেছে, তার ভাল লাগে না। কিন্তু মা সেটা বিশ্বাস করেননি, এও সেই পিসিমারই অনুশাসনের ফল বলে ধরে নিয়েছেন। কোন্ সেকেলে বিধবা চায় ঘরের বউ এম. এ. পড়তে যাক–
অর্চনার পড়া ছাড়াটা ডক্টর বাসুও ঠিক পছন্দ করেননি। বলেছেন, পড়াটা ছাড়লি কেন, ওঁরা আপত্তি করেন?
অর্চনা তাড়াতাড়ি বলেছে, না বাবা, ওঁদের তো পড়ছি নে বলেই রাগ দেখি সামনের বছরে যদি হয়।
গৃহিণী তাকে অন্য কথা শুনিয়েছেন।–পড়বে কি করে, তার থেকে পাঁচালী আর ব্রতকথা শুনলে কাজ হয় না!
কেমন ঘরে মেয়ে পড়েছে স্ত্রীর সেই অভিযোগ বাবাকে ওর বিয়ের পর থেকেই শুনতে হচ্ছে। কিন্তু তিনি বড় গায়ে মাখেননি বা চিন্তিত হননি। নিজের সূক্ষ্ম দৃষ্টির ওপর ভদ্রলোকের আস্থা আছে। মেয়ের ব্যাপারে স্ত্রী অভিযোগ করতে এলেই একদিনের পরিপূর্ণতার একটা মূর্তি ভাসে তার সামনে। সেটাই তিনি বিশ্বাস করে খুশী আর নিশ্চিন্ত। সুখেন্দুর বন্ধু-বান্ধব ওদের বিয়ে উপলক্ষেই ছোটখাটো একটা আয়োজন করেছিল। সেখান থেকে সুখেন্দুকে নিয়ে অর্চনা এখানে এসেছিল। এ কদিনের মধ্যে ভদ্রলোক নিরিবিলিতে দুটো কথা বলার সুযোগ পাননি। সুখেন্দুকে বরুণা আটকেছে, অর্চনা সোজা বাবার ঘরে চলে এসেছিল। তার গলায় সুখেন্দুর বন্ধুদের দেওয়া মোটা ফুলের মালা, হাতে ফুলের বালা আর রজনীগন্ধার ঝড়।
প্রণাম করে উঠতেই ডক্টর বাসু তার দিকে চেয়ে মহা খুশী।-বাঃ! কোথাও পেছলি বুঝি?
অর্চনা জানাল কোথা থেকে আসছে।
বিয়ের পর ডক্টর বাসু সেই প্রথম যেন ওকে ভাল করে দেখছেন। তৃপ্তিতে দু-চোখ ভরে গেছে তাঁর। ওকে কাছে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন, বেশ, তুই কেমন আছিস বল।
অৰ্চনা মাথা নেড়েছে, অর্থাৎ ভাল।
খুব ভাল?
মায়ের কারণে বাবার ভিতরে ভিতরে সংশয় একটু থাকাই স্বাভাবিক। অর্চনা এবারে আরো বেশি মাথা হেলিয়ে হেসে ফেলেছিল।
সেই থেকে ডক্টর বাসু একেবারে নিশ্চিন্ত।
কিন্তু মাকেও একটু খুশী করতে গিয়ে অর্চনা মাঝে মাঝে দু-নৌকোয় পা দিতে লাগল। এ বাড়িতে এলে সাজগোজ চালচলন আদব-কায়দা আর একটু বাড়ে। একটু আধটু রঙ-চঙ মেখে মায়ের সঙ্গে কালচারাল অনুষ্ঠানেও যোগ দেয় আগের থেকে বেশি। অর্থাৎ মাকে সে বোঝাতে চায়, তার স্বাধীনতা একটুও খর্ব হয়নি বা নিজেও একটুও বদলায়নি। আর তাই দেখে সুখেন্দুরই খটকা লাগত একটু আধটু। বাড়িতে পিসিমার সামনে যে অর্চনাকে দেখে, নিজের মায়ের সামনে সে ইএকেবারে বিপরীত। এই নিয়ে অনেকদিন ঠাট্টা-বিদ্রূপও করেছে। অর্চনা জবাব দিয়েছে, যেখানে যেমন রীতি, তুমি যদি আর এক রকম চাও, আর এক রকমও হতে পারে।
ক’টা মাসের এই একটানা ছন্দে ছোটখাটো একটা তালভঙ্গ হয়ে গেল সেদিন।
দিনের শুরুটা কিন্তু অন্যরকম হয়েছিল। অবসর সময়ে শেভ করার পর নাকের নিচের একটুখানি গুম্ফরেখা তদারকের অভ্যাস সুখেন্দুর অনেক দিনের। আর সেই নিবিষ্টতায় সময়ও একেবারে কম কাটত না। অর্চনা পিছনে লেগে লেগে সেই তোয়াজের গুম্ফরেখা নির্মূল করিয়েছিল। এরই মধ্যে একদিন দিদির কড়া শাসন প্রসঙ্গে এই নিয়ে বরুপার ঠাট্টার জবাবে দুজনকেই জব্দ করার জন্য সুখেন্দু ক’টা দিন নাকের নিচে ব্লেড ছোঁয়ায়নি। অর্চনাকে বলেছে, ফুসকুড়ির মত কি একটা উঠেছে, কাটতে গেলে লাগবে। কটা দিন ছুটির পর আজ কলেজ। একটু তাড়াতাড়িই চান খাওয়া-দাওয়া সেরে এসে ধীরেসুস্থে সে আগের মতই গু-বিন্যাস সম্পন্ন করে নিল। অর্চনা এ-সময়টা পিসিমার কাছে। কলেজের সময় হলে তার ডাক পড়বে জানে। সুখেন্দুর সংকল্প, কলেজ থেকে ফোনে বরুণাকে কোন একটা কারণ দেখিয়ে বিকেলে বাড়ি আসতে বলবে।
কিন্তু সেই দিনই শাশুড়ীর যে একটা জোর তলব এসে আছে সেটা তখনো জানত না। সে তখন চানের ঘরে ছিল, ড্রাইভার অর্চনার হাতে মায়ের চিঠি দিয়ে গেছে। মর্ম, গত সন্ধ্যায় ভাগলপুর থেকে তার মাসিমা আর মেসোমশাই এসেছেন, আগামী কালই আবার চলে যাবেন–মেয়ে-জামাইকে দেখতে চান। অবশ্য যেন বিকেলে তারা আসে, তার ওখানেই বিকেলে চায়ের ব্যবস্থা।
জামাইয়ের ডাক পড়লেই অর্চনা বিব্রত বোধ করে একটু। কারণ খুব স্বেচ্ছায় সে ওখানে যেতে চায় না। তার জন্য বেশ সাধ্য-সাধনা করতে হয়। তাছাড়া, মা-ও অনেক সময় আভাসে ইঙ্গিতে এমন কিছুই বলে বসে যা আরো বিসদৃশ। যাই হোক, মাসিমা মেসোমশাই এসেছেন, না গেলেও নয়। বছর খানেক আগে এই মাসিরই ঘটা করে মেয়ের বিয়ে হয়েছে, তার মেয়ে-জামাই এখন আমেরিকায় না কোথায়। কথায় কথায় মাসিমার জামাইয়ের গর্ব দেখে অর্চনা বরুণা একসময় অনেক হাসাহাসি করেছে।
চিঠিটা ড্রেসিং টেবিলে চাপা দিয়ে বারান্দার কোণে বসে অর্চনা থালায় ছড়ানো চালের কাঁকর বাছছিল আর পিসিমার কথা শুনছিল। কুলোয় চালের কুঁড়ো ঝাড়তে ঝাড়তে পিসিমা সুখেন্দুর ছেলেবেলার দাপটের কথা শেষ করে এই চা বাছার প্রসঙ্গে এসে থামলেন।–ছেলের রাগ তো জান না, দুটোর বেশি তিনটে কাঁকর দাতে পড়ল কি উঠে চলল ভাত ফেলে–আমি এক এক সময় না বলে পারি নে, এত রাগ তোর, তুই ছেলে পড়াস কি করে?
অর্চনা শুনছিল আর মুখ টিপে হাসছিল।
সাবি রাঁধুনী একগোছা চাবি ঝন করে সামনে ফেলে দিয়ে গেল, ভাঁড়ারের চাবি নিচে ফেলে এসেছিলে
আর আমার মনেও থাকে না বাপু অত, চাবিটা তোলো তো বউমা, যেভাবে ফেলে গেল যেন গায়েই লাগে না–
থেমে দুই এক মুহূর্ত কি-একটু ভেবে নিলেন তিনি। তার পর বললেন, আচ্ছা, ওটা এখন থেকে তোমার কাছেই রাখো বউমা–খুব যত্ন করে রাখবে।
আমার কাছে!
থাক, তোমার কাছেই থাক–তোমার শাশুড়ীর চাবি। এই এক চাবি দিয়ে হতভাগী এতকাল আমাকে এখানে আটকে রেখেছে–আর কতকাল টানব।
বিগত শ্বশুর বা শাশুড়ীর কথা উঠলেই পিসিমার চোখ ছলছল করে। আজও ব্যতিক্রম হল না। অর্চনা তার আঁচল টেনে নিয়ে চাবির গোছা বেঁধে দিতে দিতে বলল, আপনি কোনকালে ছাড়া পাবেনও না পিসিমা।
পিসিমা খুশী হয়েই হাল ছাড়লেন।
ছোকরা চাকর হবিয়া এসে খবর দিল, দাদাবাবু কাপড় মাঙছেন। পিসিমা তাড়া দিলেন, যাও, কি চাই দেখে এসো।
ঘরে ঢুকে অর্চনা আলমারি খুলে জামা-কাপড় বার করতে গেল। সুখে ইচ্ছে করেই অন্যদিকে ফিরে বসে আছে। জিজ্ঞাসা করল, পিসিমা কি বলছিলেন?
একটা জামা টেনে বার করতে করতে অর্চনা আলতো জবাব দিল, বলছিলেন, তুমি এক নম্বরের গোঁয়ার।
কেন?
আরো আগে বিয়ে করোনি কেন?
সুখেন্দু ফিরে ওকেই দোষী করল, আরো আগে তুমি আসনি কেন?
কেন, আমি ছাড়া কি আর–
হাসিমুখে কথাটা শেষ করবার আগেই জামাটার ওপর ভাল করে চোখ পড়তে থেমে গিয়ে ভুরু কোচকালো। মোটা জামা কালচে দেখাচ্ছে কাপড়টাও সেই রকমই। আরো দুই একটা নাড়াচাড়া করে দেখল একই অবস্থা। বিরক্ত হয়ে, যা বার করেছিল তাই নিয়ে সুখের সামনে রাখল সে।–আচ্ছা প্যান্ট কোট পরে কলেজ না করতে পার নাই করলে, তা বলে জামা কাপড়ের এই ছিরি!
কি হল…? সুখেন্দু তার দিকে ফিরল এবার।
আজই বিকেলে বেরিয়ে–ও কি!…অর্চনা বিষম অবাক।
সুখেন্দু নিরীহ মুখে জিজ্ঞাসা করল, কি?
কি! নাকের নিচে কালির মত এক পোঁচ, এই জন্যেই ক’দিন– আবার হাসছে? কি টেস্ট গো তোমার! পিসিমা ঠিক বলেন, তুমি গোঁয়ার গোবিন্দ!
কাপড়টা টেনে নিয়ে সুখেন্দু হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াল।–ওই জন্যেই তো তোমার এত পছন্দ।
অর্চনা আর পারে না যেন।–না সত্যি, তুমি আমার কোন কথা শোন না।
কাপড় পরা শেষ করে সুখেন্দু জামাটা টেনে নিল।–সব কথা শুনি, বলে দেখো।
রাগ ভুলে অর্চনার দরকারী কথাটাই মনে পড়েছে, মায়ের চিঠির কথাই বলা হয়নি এখনো। সুযোগ পেল।–সত্যি?
জামা গায়ে গলিয়ে সুখেন্দু মাথা নাড়ল।
অর্চনা এগিয়ে গিয়ে নিজের হাতে জামার বোতাম লাগাতে লাগাতে আবারও বলল, ঠিক?
এবার একটু ভয়ে ভয়েই মাথা নাড়ল সুখেন্দু।
কলেজ থেকে ফিরছ ক’টায়?
সাতটায়–
ভাল হবে না বলছি, ক’টা পর্যন্ত ক্লাস?
কেন?
জবাব না দিয়ে অর্চনা ড্রেসিং টেবিল থেকে মায়ের চিঠিটা এনে তার হাতে দিল। চিঠি পড়ে সুখেন্দু বড় নিশ্বাস ছাড়ল একটা।–তাই হবে।
কিন্তু তাই হলেও ঠিক সময়ে হয়নি। সুখেন্দুর গড়িমসিতে এমনি দেরি হয়েছিল একটু, তার পর তৈরি হবার আগেই বাড়িতে সস্ত্রীক তার এক বন্ধু এসে হাজির। তাদের আদর-অভ্যর্থনায় কম করে ঘণ্টাখানেক গেছে আরো। ওরা যখন বেরুলো, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। ট্যাক্সিতে উঠে অর্চনা শুধু বলল, মা দেবে’খন চলো–
সুখেন্দুর ছদ্ম ত্ৰাস, তাহলে এখানেই নেমে পড়ি আমি।
অর্চনা মুখে যাই বলুক, সত্যিই উতলা হয়নি। কিন্তু ওদিকে মা-টি তার যথার্থই রাগে জ্বলছিলেন। বোনের আড়ালে এরই মধ্যে বরকতক তার স্বামীকে ঠেস দেওয়া হয়ে গেছে। মেয়ে-জামাইয়ের আসতে দেরি হচ্ছে বলে ভদ্রলোকটিই দায়ী যেন। শেষে সন্ধ্যাও পেরুতে দেখে হাল ছাড়লেন। ফলে মেজাজ আরো চড়ল। ঘরে এসে শেষদা ফেটে পড়লেন তিনি-আমি বলছি ‘ও-মেয়ের কপালে সুখ নেই। অত করে লিখলাম, তোর মাসিমা মেসোমশাই দুদিনের জন্যে এসেছে, জামাইকে নিয়ে একবার দেখা করে যা–আসতে পারল? আসবে কি করে মেয়ের কি কোন স্বাধীনতা আছে, সেখানে তো পিসিই সব।
ডক্টর বাসু স্ত্রীকে ঠাণ্ডা করতে চেষ্টা করলেন, হয়তো কোন কাজে আটকে গেছে, আজ না আসুক কাল সকালেই আসবে।
গৃহিণীর রাগ এতে বাড়ল বই কমল না!–তুমি তো সবই বোঝে–এই পিসিই ওকে আসতে দেয়নি, নইলে আমি ডাকলেও আসে না। মেয়েটাকে তুমি হাত-পা বেঁধে জলে ফেলেছ
ক্রুদ্ধমুখে গজগজ করতে করতে নিচে নেমে মুখের ভাব বদলে বোন আর ভগ্নীপতি সন্নিধানে এলেন। বোনটি পান চিবুচ্ছেন আর বরুণা এবং রাণুদেবীর সঙ্গে গল্পসল্প করছেন। ভগ্নীপতি ঈজিচেয়ারে লম্বা হয়ে একের পর এক সিগারেট টানছে। মিসেস বাসু ঘরোয়া খোঁজখবর নিতে বললেন, ভগ্নীপতিকে জিজ্ঞাসা করলেন, মেয়ে-জামাই তাহলে কিছুকাল এখন আমেরিকাতেই থাকবে।
হ্যাঁ…তা আরো বছর খানেক তো বটেই।
জামাইয়ের কথা উঠতে বোন দিদির দিকে ফিরলেন। ওদিকে ওপর থেকে ডক্টর বাসুও নেমে এসে বসলেন একটু। তাকে দেশে একে একে মেয়ে বউ দুজনেই উঠে গেল। দিদির আশায় এতক্ষণ ধরে বসে বসে আর মাসিমার তত্ত্বকথা শুনে শুনে বরুণার হাঁপ ধরে গেছে। রাণুদেবীর আশা, নিরিবিলিতে সদ্য-আন। উপন্যাসখানা এবারে একটু উল্টেপাল্টে দেখার সুযোগ হবে।
জামাই প্রসঙ্গেই কথা চলল। বোনের দিকে চেয়ে মিসেস বাসু বললেন, তা তুই খরচও যেমন করেছিস, জামাইও তেমনি পেয়েছিস–এ আর ক’জন পারে।
শেষের খোঁচাটুকু স্বামীর উদ্দেশে। কারো কথায় খুশী হলে ফিরে আবার খুশী করারও একটু দায়িত্ব থাকে বোধহয়। বোন ফিরে প্রশংসা করলেন, তুমিই বা খারাপ কি এনেছ দিদি, কতবড় স্কলার হীরের টুকরো ছেলে। বেশ বিয়ে দিয়েছ।
ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেলাও চলে না, আবার স্বামীর সামনে বসে এই প্রশংসা …হজম করাও সহজ নয়। মিসেস বাসু দ্ব্যর্থক উক্তি নিক্ষেপ করলেন।আমি কিছু করিনি রে ভাই, ওঁর সঙ্গে আগে থাকতেই ছেলেটির জানাশোনা ছিল, পাকে চক্রে হয়ে গেল। যা করার তোর ভগ্নীপতিই করেছেন
ডক্টর বাসু স্ত্রীর এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে প্রচ্ছন্ন কৌতুকে আলাপটা আর একটু রসিয়ে তুলতে ছাড়লেন না। যেন সত্যিই প্রশংসাই করা হয়েছে ঠার, বললেন, জানাশোনা থাক আর নাই থাক, তোমার পছন্দ না হলে কি আর কিছু হত?
শুধু পলকের দৃষ্টিবাণে যতটুকু আহত করা চলে তাই করলেন মিসেস বাসু। কিন্তু ভদ্রলোক আর বসে থাকাটা যুক্তিযুক্ত বোধ করলেন না। কাজের অছিলায় তাঁদের গল্প করতে বলে প্রস্থান করলেন।
ভগ্নীপতি জিজ্ঞাসা করলেন, জামাই বাবাজী কতদিন প্রফেসারি করছেন?
বাড়ির কেউ না থাকাতে মিসেস বাসু স্বস্তি বোধ করলেন। এক প্রশ্নের জবাবে অনেক কথা বললেন। খুব বেশিদিন নয়, তবে উপযুক্ত ছেলে তো, চট করেই উন্নতি করেছে–এই শিগগিরই ভাইস-প্রিন্সিপাল হবে শোনা যাচ্ছে, তারপর থিসিস-টিসিস্ লিখছে, বিলেতও যাবে ফিরে এলেই প্রিন্সিপালও হবে আর কি…।
বেশ, বেশ—। ভগ্নীপতির খুশীর অভিব্যক্তি।
মাসি বললেন, খুব ভাল।
একটু বাদেই বাইরে গাড়ি থামার শব্দ শোনা গেল। মিসেস বাসু গম্ভীর হলেন। বোন জিজ্ঞাসা করলেন, ওরা এলো নাকি?
জবাব নিষ্প্রয়োজন, অর্চনা উৎফুল্ল মুখে দৌড়েই ঘরে ঢুকেছে। পিছনে সুখেন্দু। মাসি সানন্দে বলে উঠলেন, এই তত! আয় আয়, আমরা সেই কাল থেকে তোদর জন্য বসে আছি
অর্চনা হাসিমুখে মাসি আর মেসোকে প্রণাম করল।–বসে না থেকে একবার গিয়ে হাজির হলেও তো পারতে?
মিসেস বাসু সুখেন্দুকে বললেন, তোমার মেসোমশাই আর মাসিম, প্রণাম করো।
যথা-নির্দেশ।
মাসিমা আশীর্বাদ করতে করতে জামাই যাচাই করে নিলেন। মেসোমশাই বললেন, বোসো। বাবা বসে–তোমার কথাই হচ্ছিল এতক্ষণ, বড় খুশী হয়েছি।
খুশীর খবরে সুখেন্দুর বিড়ম্বিত মূর্তিটি দেখে অর্চনা হাসি গোপন করল। মাসি বললেন, আমি ভাবলাম আজ আর এলিই না বুঝি
তোমরা এসেছ শুনেও আমি আসব না। একটু দেরি হয়ে গেল অবশ্য—
একটু …মায়ের ঠাণ্ডা বিরক্তি, দেরিটা হল কেন?
বাড়িতে লোক এসে গেল।-এক নিশ্বাসে মাসির যাবতীয় খবরাখবর নিয়ে অৰ্চনা উঠে দাঁড়াল।-বাবা কোথায় মা? ওপরে? মাসিমা, আমি আসছি
.
কিছুটা হেঁটে এসে সুখেন্দু ইশারায় একটা ট্যাক্সি থামাল।
অর্চনা অবাক। বাবা বাড়ির গাড়ি দিতে চেয়েছিলেন, নেয়নি। বাবার সঙ্গে গল্প করে, বরুণা আর বউদির সঙ্গে হৈ-চৈ করে, ঘণ্টাখানেক বাদে নিচে নেমে মানুষটার মুখের দিকে চেয়েই অৰ্চনা বুঝেছিল গোযোগর ব্যাপার কিছু ঘটেছে। কিন্তু মাসি-মেসোর সামনে কি আবার হতে পারে। জামাই শরীর ভাল নেই বলে চাটুকুও মুখে দিল না, তাই তারা চিন্তিত। অর্চনাকে দেখে মাসি বলেছেন, একজন ডাক্তার-টাক্তার দেখা–এই বয়সে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হলে চলবে কেন?
অৰ্চনা আরো খানিক বসে মাসির সঙ্গে গল্প করত হয়তো, কিন্তু তাকে দেখেই সুখেন্দু যাবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছে। বাবা গাড়ি নিয়ে যেতে বলায় মাথা নেড়েছে, গাড়ির দরকার নেই, হাঁটবে একটু
ও-পাশে ধার ঘেঁষে বসে আছে। ট্যাক্সিতে ওঠার আগে অর্চনা বারকতক জিজ্ঞাসা করেও কি হয়েছে জবাব পায়নি। এখনো চুপচাপ রাস্তার দিকেই চেয়ে আছে। খানিক অপেক্ষা করে আবারও সেই এক কথাই জিজ্ঞাসা করল, এরই মধ্যে কি হল? অ্যাঁ?
গম্ভীর মুখে সুখেন্দু একবার তার দিকে ফিরে তাকাল শুধু!
কথা বলছ না কেন? বলবে তো কি হয়েছে?
কিছু না।
কাছে সরে এসে অর্চনা হাত ধরে নিজের দিকে ফেরাতে চেষ্টা করল তাকে। –বা রে! কিছু না বললে আমি বুঝব কি করে? সেই থেকে ভাবছ কি?
সুখেন্দু ঘুরেই বসল। বলল, ভাবছি আমার মত এমন একজন গরীব মাস্টারের হাতে তোমার মা তোমাকে কেন দিলেন?
ঠাট্টার সময় হলে অর্চনা ফিরে বলত, মা দিতে যাবে কেন–। কিন্তু এখন হতভম্ব। –তার মানে…মা কিছু বলেছে?
যা বলেছেন তার অর্থ এই দাঁড়ায়। রাগ আর ক্ষোভে গলার চাপা স্বর ব্যঙ্গের মত শোনাল।–আমি শিগগিরই ভাইস-প্রিন্সিপাল হব, থিসিস লিখছি, বিলেত যাব, ফিরে এসে প্রিন্সিপালও হব–তোমার মায়ের মুখে এসব শুনে তোমার মাসিমা মেসোমশাই অবশ্য খুশী হয়েছেন।
এবারে গোটা ব্যাপারটা অনুমান করা গেল। খানিক চুপ করে থেকে অর্চনা বিব্রত মুখে হাসতেই চেষ্টা করল একটু।-তুমি এভাবে নিচ্ছ কেন, আপনজনের আশাও তো করে…
এ-রকম আশা তুমিও করো বোধ হয়?
হঠাৎ উষ্ণ হয়ে সুখেন্দু ঘুরে বসল আরো একটু, আশা করে কি না তাই যেন দেখল। অর্চনা নিরুত্তর।
এর নাম আশা নয়। আমি গরীব মাস্টার, এটা তোমার মায়ের সেই লজ্জা ঢাকার চেষ্টা।
বাড়ির দরজায় গাড়ি থামতে সশব্দে দরজা খুলে নেমে এসে ভাড়া মেটাল। তারপর কোনদিকে না তাকিয়ে হনহন করে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেল।
অর্চনার নিরুপায় অস্বস্তি আবারও হাসির মত দেখাচ্ছে।