৫
অন্য কেউ হলে হয়তো মোবাইলে ড্রাইভারকে ডেকে আনতেন তারপরে ফেরার সময়ে গাড়ি করেই বাংলোতে ফিরতেন। কিন্তু গৌতমনারায়ণ যতক্ষণ বনে থাকেন ততক্ষণ প্রতিটি মুহূর্ত বনকে উপভোগ করেন। সঙ্গে সঙ্গিনী থাকলে, তাকেও।
বাংলোতে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসার আগে খুব ধীরে ধীরে একটি বিয়ার খেলেন। বিয়ার পুঁতে রেখেছিল কেরকেরে চম্পাঝরন নালার বালির নীচে। বালির উপর দিয়ে জল বয়ে যাচ্ছিল। পোঁতাটাও যেমন গোপনে সেরেছিল সেখান থেকে বিয়ারের বোতল তুলে আনাটাও তেমনই গোপনেই সেরেছিল। কেউ জানতে পারলে, রাতারাতিই সব বোতল হাপিস হয়ে যেত। যারা মহুয়া ছাড়া আর কিছু খেতে পায় না তাদের, শহর থেকে আসা সাহেবদের পানীয়ের প্রতি খুব লোভ। টাকা-পয়সা তারা চুরি করে না কিন্তু এসবের প্রতি তাদের লোভ খুবই তীব্র। এ লোভ তারা সংবরণ করতে পারে না।
তুমি কি শ্যাণ্ডি খাবে একটু, ধৃতি? লেমোনেড আছে কিন্তু।
না। থ্যাঙ্ক ইউ। আই অ্যাম ড্রাঙ্ক উইথ লাইফ। আমার বাবা এবং স্বামীও এসবের খুবই ভক্ত কিন্তু আমি নিজে কখনো টান বোধ করিনি। টান তো নেই-ই বরং বিতৃষ্ণা আছে। রিপালসন।
—ভালো।
—গৌতমনারায়ণ বললেন।
—ভালো কেন বলছ?
কিছু জিনিসের প্রতি বিতৃষ্ণা থাকা ভালো তাহলে অন্য অনেক কিছুর প্রতি তৃষ্ণাটা তীব্রতর হয়।
—অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলো তুমি।
—আমি নিজেই যে অদ্ভুত।
৬
অড়হরের ডালটা খুব ভালো রেঁধেছে কিন্তু ঝাণ্ডু।
—ধৃতি বলল।
খেয়ে কিন্তু মনে হচ্ছে এ ঝাণ্ডুর রান্না নয়। নিশ্চয়ই চিঞ্চিকেডে রেঁধেছে। বন বাংলোর চৌকিদারের রান্নাতে আলাদা স্বাদ থাকে। এদের মতো রুটি করতেও শহরের বাবুর্চিরা সচরাচর পারে না। বাসমতি চালের পোলাও এরা চমৎকার রাঁধে কিন্তু তুলাইপাঞ্জী চালের ভাত ঝাণ্ডু যেমন রাঁধবে তেমন চিঞ্চিকেডে হয়তো রাঁধতে পারবে না। আবার কাঁচা আমের চাটনি, ধনেপাতা আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে কেরকেরে এমন বানায় তেমন আর কেউই পারে না। তবে এখন তো কাঁচা আম আসেইনি গাছে। এখনও তো মুকুলই। আমের মুকুল আর কাঁঠালের মুচির গন্ধে এখন চারদিক ম-ম করে। ঘোর লেগে যায়।
ধৃতি বলল, তার সঙ্গে মহুয়ার গন্ধও থাকে।
তা ঠিক।
খাওয়ার টেবিলের পাশেই ঝাণ্ডু দাঁড়িয়েছিল। কী লাগবে না লাগবে দেখছিল।
রাতে কী রান্না হচ্ছে ঝাণ্ডু।
গৌতমনারায়ণ জিজ্ঞেস করলেন।
—কাল তো সীওনী থেকে কেরকেরে কচি পাঁঠা নিয়েই এসেছিল। সাঁতলে রেখেছি। আজকে দিদিমনি থাকবেন, ভাবছি রাতে বিরিয়ানি রাঁধব।
তুমি পাশের ঘরে ভালো করে বিছানা করে দিও। মশারি টাঙাতে হবে কি?
ও বাবা: মশারীর মধ্যে শুলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। পারি না শুতে। গ্রীষ্মকালটা তো এসি-ই চলে। নাগপুরে। ঝামেলা হয় শীতকালে।
ঝাণ্ডু বলল, সঙ্গে তো হিট নিয়ে এসেছি। ভালো করে হিট দিয়ে দেব। লাগবে না মশা। তা ছাড়া, এখনো ঠাণ্ডা আছে। খুব একটা নেইও মশা। রাত সাতটা-আটটার পরে ততটা থাকে না। অন্য জঙ্গলের চেয়ে মশা এখানে কমই আছে।
—বিরিয়ানির সঙ্গে আর কী রাঁধছিস?
খুশিভরা গলায় গৌতমনারায়ণ বললেন।
—আপনিই বলুন।
ঝাণ্ডু তার সাহেবের হঠাৎ খুশিতে নিজেও খুশি হয়ে বলল
—কী খাবে ধৃতি? চাঁপ?
—চাঁপ তো খাইই। ঝাণ্ডু কি কাবাব করতে পারবে?
সব কাবাব ভালো পারে না তবে শিক কাবাব আর শাম্মি কাবাবটা ভালো করে। যদিও সব কাবাবই ভালো পারে বলে দাবি করে। বড়া কাবাব খাবে? আমাদের নাগপুরে গন্ডোয়ানা ক্লাবের ইসমাইল। বাবুর্চি খুবই ভালো বানায়।
ক্লাবে তো আমরা যাই-ই না। বিয়ের আগেও যাইনি বিশেষ। বাবা মেম্বার বহুদিনের কিন্তু বাবার তো সময়ই নেই। রাত একটা অবধি তো মক্কেলদের গাড়ির লাইন লেগে থাকে। একমাত্র শুক্রবার সন্ধেবেলা কাজ করেন না, কিন্তু ওই একটি সন্ধে নানা নেমতন্ন থাকে পারিবারিক, সামাজিক, গানের অনুষ্ঠান।
—আর তোমার স্বামী?
সে তো ক্লাব-কালচারকে দু-চোখে দেখতে পারে না। বলে, গসিপ-মঙ্গারদের আড্ডা। অন্যে নিয়ে যেতে চাইলেও যায় না। তবে ওর বন্ধু কাশালকারে সঙ্গে কখনো কখনো রবিবার সকালে টেনিস খেলতে যায়। গেলে, অবশ্য গণ্ডোয়ানা ক্লাবেই যায়। তাই কোন ক্লাবে কী ভালো খাবার পাওয়া যায় তা আমার জানা নেই।
—কাবাবই যদি খেতে চাও তাহলে তোমাকে একবার লক্ষ্ণৌ যেতে হবে। টুণ্ডের দোকানের মুসলমানি খাবার না খেলে লক্ষ্ণৌ যাওয়াই বৃথা।
—মানুষটির নামই কি টুণ্ডে?
—না। তার নাম যে কী তা বোধহয় সবাই ভুলে গেছে। ঠুঁটোর এমনই প্রতাপ। বিরিয়ানিও খারাপ করে না।
—যদি, আবারও যাও তবে তুমি নিয়ে যেও আমাকে ‘মাধুকরী’র ঠুঁটা বাইগার মতো।
—নিশ্চয়ই নিয়ে যাব। মাই প্লেজার। ওখানের বাসুদেব ব্যানার্জি আছে বেঙ্গলি ক্লাবের কেউকেটা। বলরামপুর চিনি মিলের সর্বেসর্বা। ওদের চমৎকার গেস্ট হাউস আছে। তবে মহারাষ্ট্রের বনবাংলোর মতো, একমাত্র অসুবিধা এই যে, নিরামিষ। কিন্তু বাঙালি রাধুনি। মাড়োয়ারি রান্নাতে ওস্তাদ। কাড়হিটা যা করেনা, কী বলব! মাড়োয়ারিদের বাড়িতেও অত ভালো কাড়হি হয় না।
তারপর বললেন, তুমি যদি সত্যিই যাও তাহলে লক্ষ্ণৌ থেকে তোমাকে দুধোয়া ন্যাশানাল পার্কেও নিয়ে যাব।
—বিলি আর্জান সিং-এর দুধোয়া? সেই মানুষটি নিশ্চয়ই অনেকদিন আগেই পটল তুলেছেন।
—বালাই ষাট। গত গ্রীষ্মেও গেছিলাম। সিং সাহেবের বয়স এখন মোটে পঁচানব্বই। এখনো নিজে মারুতি জিপসি চালিয়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান এবং সত্তর কিমি-র কমে চালান না। তবে আগের চেহারা আর নেই। কার চেহারাই বা চিরদিন একই রকম থাকে। আমিও যখন আয়নার সামনে দাঁড়াই তখন নিজেকে চিনতে পারি না। কী বিচ্ছিরি হয়ে গেছি।
তুমি ভাবছ তাই। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে, কী পুরুষ কী নারী দুইয়েরই চেহারা এক দীপ্তি পায়, অভিজ্ঞতার দীপ্তি তাঁদের উজ্জ্বল করে তোলে। তোমাকে তো আমি দেখছি গত পঁচিশ বছর। তোমাকে একটা কথা বলি, তোমার অভিজ্ঞতা, যশ, প্রতিপত্তি তোমাকে আগের থেকে অনেক সুন্দর করেছে। ছেলেদের কথা জানি না, মেয়েদের চোখে তুমি আগের থেকেও অনেক সুন্দর হয়েছ।
—তোমার চোখে?
—অবশ্যই।
—নাগপুরে ফিরেই চোখের ডাক্তারের কাছে যাও। তোমার চোখ নিশ্চয়ই খারাপ হয়েছে।
—এ তর্ক থাক। দুধোয়াতে লক্ষ্ণৌ থেকে কীভাবে যেতে হয়?
—কেন? গাড়িতে। বাসেও যাওয়া যায়। তুমি কোন দুঃখে বাসে যাবে? যেতে হয় লখিমপুর খিরি হয়ে। আখেরই রাজত্ব সেখানে। একটার পর একটা চিনির মিল।
—সত্যিই নিয়ে যাবে একবার?
—মিথ্যে বলব কেন? তুমি তারিখ ঠিক করে বলবে আমি অমিতাভকে আগাম জানাব।
—এইতো বললে বাসুদেব ব্যানার্জি। অমিতাভ কে?
—ক্লাবের অমিতাভ সিনহা। ওরা সবাই বেঙ্গল ক্লাব-এর সঙ্গে যুক্ত। অমিতাভর সুন্দরী স্ত্রী এনাক্ষী ওই ক্লাবের লিটারারি সেক্রেটারি।
—দ্যাখো, রাতের মেনু ঠিক করতে গিয়ে কোথায় চলে গেলে তুমি। বিশ্বভ্রমী মানুষদের নিয়ে এই বিপদ।
—তা, কী রাঁধবে বিরিয়ানির সঙ্গে? বড়া কাবাবই তো?
—তাই হোক। নাই বা হল নাগপুরের গণ্ডোয়ানা ক্লাব-এর ইসমাইল বাবুর্চির মতো উমদা।
গৌতমনারায়ণ বললেন, আসলে বড়া কাবাব ভালো হয় গোরুর।
—না থাক। আমার ওই বিফ-স্টেক পর্যন্তই দৌড়। তাও ওভারডান করে। অন্যরকমভাবে রান্না আমি খেতে পারি না।
—গোরুর ডালনা? না বাবা:। রক্ষা করো।
—কচি বাছুরের বা veel এর স্টেক খাবে, তা লানডানে। দেখবে কী জিনিস।
—সারা পৃথিবী ঘোরার এই দোষ।
—সব কিছুর মধ্যেই দোষগুণ মিলিয়েই থাকে। কী করব! এক কথা থেকে অন্য কথা মনে পড়ে যায়। নিজেকে সবজান্তা প্রতিপন্ন করার জন্যে এরকম করি না। আসলে, আমি ভীষণই খাদ্যরসিক। তবে কোয়ালিটিতে বিশ্বাসী, কোয়ানটিটিতে নই।
—তুমি জীবনরসিকও বটে। আর তোমার অনন্ত যৌবন। তুমি কখনোই বুড়ো হবে না।
—অমন অভিশাপ দিও না। বুড়ো হওয়ার মজা শুধু বুড়োরাই জানে।
তারপরেই বললেন, তুমি বেঁচে গেছ যে আমার বাবার খপ্পরে পড়নি। তিনি অনেকদিন আগেই গত হয়েছেন। তাঁর বন্ধুবান্ধবেরা বাবা সম্বন্ধে বলতেন, ‘মিস্টার নারায়ণ বিলিভস দ্যাট দ্যা ওনলি ওয়ে টু দ্যা হার্ট ইজ থ্রু দ্যা স্টমাক’।
ধৃতি হেসে উঠল গৌতমনারায়ণের কথা শুনে।
গৌতমনারায়ণ বললেন, আর কী রেঁধেছিস রে ঝাণ্ডু?
—আলুপোস্তটা তো খেলেনই না স্যার। পাতের পাশে বাটিতে পড়ে রইল। খান এবারে।
—আর কী আছে?
—ডিমের কারি করেছি। কাঁচালঙ্কা, গরমমশলা আর কারিপাতা দিয়ে। তারপরে আমড়ার টক আছে আর রাবড়ি।
—ধৃতি বলল, রাবড়ি এখন খাব না আমি। রাতের বেলা ডিনারে মুচমুচে পরোটা দিয়ে খাব। আগে কাবাব পড়ে রাবড়ি।
—যা তোমার খুশি।
—ধৃতি বলল, এই জঙ্গলে কারিপাতা কোত্থেকে পেলে ঝাণ্ডু?
চম্পাঝরন বস্তিতে হাটে ওঠে। যদিও কেরকেরে এনেছে সীওনী থেকে। ধনেপাতাও এনেছে। কাবাবে দেবে। তবে শীতকাল ছাড়া টাটকা ধনেপাতা পাওয়া যায় না। এখানকার ফুলকপিও বিখ্যাত। এখনকার ধনেপাতাতে তেমন স্বাদ নেই। ও জানত না যে এ বাংলোর বাবুর্চিখানার পাশেই দুটি কারিপাতা গাছ আছে। পাতা ছেঁড়ো, ধোও আর রান্নায় দাও।
—ধনেপাতার চাটনি করলে না কেন?
—রাতে করব এখন। কাঁচালঙ্কা আর সামান্য চিনি দিয়ে এবং একটু কাঁচা টমেটো।
ঝাণ্ডু বলল, হ্যাঁ দিদিমণি। পাকা টমেটো দিলে ভ্যাদভেদে হয়ে যায়।
ধৃতি হেসে উঠল।
বলল, বাবা: কতই জান। এখানে তিন দিন থাকলে আমিও নির্ঘাৎ রাঁধুনি হয়ে যাব।
—তুমি রান্না কর না?
—না:। বিয়ের আগে তো আমি ব্যাঙ্গালোরে পোস্টেড ছিলাম। একটি মাল্টিন্যাশানাল অ্যাডর্ভার্টাইজিং কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট—কপি রাইটিং ডিপার্টমেন্ট-এ। ব্যাঙ্গালোরে কাজের লোক পাওয়া ভারী অসুবিধে। আমার কোনো লোক ছিল না। একজন ঠিকে লোক ঘরদোর ঝাড় দিয়ে পুঁছে দিত। আমি মাইক্রো ওয়েভ আভেনে ভাত কিংবা খিচুড়ি বানাতাম। আমার কলিগরা কেউ যদি কাজে নাগপুরে যেত তখন টিফিন ক্যারিয়ারে করে মা নানারকম রান্না করে পাঠিয়ে দিতেন আর আমি সেগুলো ফ্রিজে রেখে একটু একটু করে বের মাইক্রো ওয়েভ আভেনে গরম করে নিয়ে নিজের তৈরি ভাত দিয়ে মেখে খেতাম।
—কী খাবার পাঠাতেন?
—নানারকম। চিংড়ি মাছের মালাইকারি, চিতল মাছের মুঠা, দইমাংস, ইলিশের পাতুরি। নাগপুরে মা যে, এমন মাছ কেমন করে যোগাড় করতেন তা মা-ই জানে। বাবার নানা জায়গার মক্কেলরা যোগাড় করে দিতেন নানা জায়গা থেকে। সবাই জানতেন যে মেয়ে ব্যাঙ্গালোরে কাজ করে।
—রান্না, মেয়েদের একটি মস্ত গুণ।
—জানি তো।
—জানোই যদি তো মায়ের কাছ থেকে শিখলে না কেন কিছু কিছু রান্না?
—শিখলেই পারতাম। কিন্তু…
—নিজে রান্না করলে বেশি করে খাওয়া যায় না।
—তাই?
—আমার তো তাই মনে হয়। যারা অ্যাফোর্ড করতে পারে তারা বই পড়বে, গান শুনবে, টিভিতে ভালো প্রোগ্রাম দেখবে—রান্না করে সময় নষ্ট করবে কেন?
—তুমি কি পার রান্না করতে? গৌতম দা?
—শুধু পারিই না, খুবই আনন্দ পাই রান্না করে, তবে নিজের জন্যে নয় মানুষকে খাওয়াতে।
—সেই ভাগ্যবতী মানুষদের মধ্যে আমি কি কখনোই পড়তে পারি না?
—অবশ্যই পারো। এখানেই তোমাকে রান্না করে খাওয়াতাম। দেখি, এবারে তোমাকে কিছু করে খাওয়াতে পারি কি না!
৭
খেয়েদেয়ে উঠে ওরা বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে ছিল। গৌতমনারায়ণ আজকাল দুপুরের খাওয়ার পরে একটু শুয়ে নেন, অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি হওয়ার পর থেকে। ঘণ্টাখানেক। ধৃতি একটু গড়িয়ে নিল তার ঘরে। ধৃতির ঘরটা থেকে আন্ধারপানির পথটা দেখা যায়। লালরঙা পথটা, নানা গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে একটা হঠাৎ বাঁক নিয়ে বাঁদিকে বসন্তবনের মধ্যে ঢুকে গেছে। কোথায় যে গেছে তা বাঁক নেওয়ার পরে আর দেখা যায় না। পথের মোড়েই পাশাপাশি চার-পাঁচটা শিমূল গাছ। লাল লাল হয়ে রয়েছে। পথের উপরেও পড়ে রয়েছে অনেক ফুল। শিমূল তো আছেই পলাশেরও রীতিমতো জঙ্গল। পলাশের গালিচা পাতা বনের মধ্যে। ছেলেবেলাতে বাবার সঙ্গে বসন্তোৎসবে শান্তিনিকেতনে যাবার সময়ে জিটি রোড ছেড়ে ডানদিকে কাঁচা লাল পথে যেতে যেমন থাকত। টায়ারের নীচে ফুল দলে দলে সেই পথ দিয়ে যেতে খুবই অপরাধী লাগত।
দিনের এই সময়েও ঝিঁঝি ডাকছে করতালের মতো আওয়াজ করে। কী বিচিত্র লীলাখেলা প্রকৃতির। ধৃতি জানত ঝিঁঝি বুঝি শুধু রাত নামার পরেই ডাকে।
মুগ্ধ হয়ে চেয়েছিল বাইরে জানালা দিয়ে ধৃতি। কতক্ষণ যে কেটে গেছে খেয়াল ছিল না। নাগপুরের এত কাছে যে এত সুন্দর জায়গা থাকতে পারে ও ভাবতেই পারেনি। এমন সময়ে গৌতমনারায়ণ ডাকলেন বারান্দা থেকে, আমি উঠে গেছি। তোমার ইচ্ছে করলে এসো।
—আসছি। ধৃতি বারান্দাতে এসেই বলল, এই ‘ইচ্ছের’ কথাতেই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতার কথা মনে পড়ে গেল।
—কোন কবিতা?
—‘সকাল থেকে আমার ইচ্ছে এক ধরনের সাহস দিচ্ছে, উড়ে না যাই।’
গৌতমনারায়ণ একটু হাসলেন, বললেন বেচারি অনেকই কষ্ট পেয়েছেন সমসাময়িক কবিদের কাছ থেকে। তবু অন্যদের সমতায় নিজেকে নামিয়ে আনেননি কখনো। অন্য উচ্চতাতে অবস্থান করতেন। এতদিনে সরল পাঠকেরা বুঝতে পারছেন। কবির পোষাক পরা অ-কবিরা বুঝেও না-বোঝার ভান করে রয়েছেন। তবে এটা ঠিকই বুঝেছেন যে, প্রকৃত কবি হওয়া আর পদ-বাগানো এক নয়।
তারপর আর কথা না বলে সেই বসন্ত বনের দুপুরে সামনে চেয়ে বসে রইলেন।
ধৃতি বুঝতে পারল এখন কথা বলার সময় নয়, বনবানী শোনার সময়। ও’ও তাঁর পাশের চেয়ারে চুপ করে বসে রইল।
ও ভাবছিল, যাঁদের শ্রদ্ধার আসনে বসিয়ে রেখেছে তাঁরাও যে সাধারণ মানুষ এ কথা না জানাই ভালো। গৌতমনারায়ণ শক্তির যেসব সমসাময়িক কবিদের কথা বলছিলেন তাদের উপেক্ষা করাই বোধহয় ভালো। না করলে নিজেকেও কলুষিত করতে হয়।
হঠাৎ গৌতমনারায়ণ বললেন, তাঁদের মধ্যে অন্তত দু-একজন ব্যতিক্রম ছিলেন।
—কে কে?
—নাম না করাই ভাল। তাতে বিতর্ক উঠতে পারে।
—তাই?
—আমার তো তাই মনে হয়। আমার ভুলও হতে পারে।
কিছুক্ষণ পরে গৌতমনারায়ণ বললেন, সন্ধের পরে আমরা যখন বনে যাব তখন জিনস পরে যেওনা, শাড়ি পরেই যেও।
তারপরে বললেন, আর যা যা বলেছিলাম মনে আছে তো?
ধৃতি মৃদু হেসে বলল আছে। তারপর মনে মনে বলল, জঙ্গলে তুমিই রাজা। যাই-ই বলবে তাই-ই শুনব। তা ছাড়া, তুমি যে-মান দিয়েছ আমাকে সে তো সম্পূর্ণ আমারই। এ আমার অনেক প্রাপ্তির ধন। অসাধারণদের চাওয়া-পাওয়ার রকমই আলাদা। যে এই মানের স্বরূপ বুঝতে না পারল সেইই অভাগী। অমন বোকা আমি নই।
এখন ঝাণ্ডুরা খেয়েদেয়ে চিঞ্চিকেডের কোয়ার্টারে চলে গেছে বাংলোর পেছনের সব দরজা লাগিয়ে দিয়ে। বাংলোটার সামনেটা রাস্তার দিকে না হয়ে পেছন দিকে রয়েছে। কেন, তা ঠাহর করার চেষ্টা করেই বুঝতে পারল ধৃতি। বাংলোটার মুখ পুব দিকে। শীতকালে যখন খুব শীত পড়ে তখনকার কথা ভেবেই নিশ্চয়ই পুবমুখো করা হয়েছে বাংলোটাকে।
৮
বেশ অনেকক্ষণ পরে গৌতমনারায়ণ বললেন, এবার কথা বলতে পারো। চিঞ্চিকেডের কোয়ার্টারের পেছনেই যে টাঁড়টি আছে, বেলা পড়লেই সেকান থেকে লাগাতার তিতিরের ডাক শোনা যাবে। স্থানীয় মানুষেরা ওই টাঁড়কে বলে, ‘তিতির কান্নার মাঠ’। বলেই, বললেন, রমাপদ চৌধুরীর একটি বিখ্যাত ছোটো গল্প আছে যার নাম ‘তিতির কান্নার মাঠ’।
—তাই?
—হ্যাঁ।
রমাপদবাবুর ছোটো গল্পের জন্যে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। টাঁড়-এর পেছনে যে বন আছে সেখান থেকে এবং রাস্তার ওপার থেকেও শেষ বেলাতে ময়ূর আর জংলি মুরগিও ডাকতে থাকবে। ওই ক্যাকোফোনির মধ্যেই দিনটা মরে যাবে, সূর্য বিদায় নেবে। অনেকক্ষণ লালের আভা থাকবে। একদিকে সূর্য ডুববে অন্যদিকে চাঁদ উঠবে শাল আর সেগুনবনের মাথাতে। মহুয়ার গন্ধ, আমের মুকুলের গন্ধ আর কাঁঠালের মুচির গন্ধ ঘিরে ধরবে চম্পাঝরন বাংলোটাকে চারদিক থেকে।
—মহানন্দে সময কাটাচ্ছি বটে কিন্তু মনের মধ্যে একটা ভয় কাল রাত থেকেই মাঝে মাঝে জেগে উঠছে।
ধৃতি বলল।
—কীসের ভয়?
—ওই যে। যে-ভয়ের জন্যে পোঁটলা-পুটলি নিয়ে আজ চম্পাঝরণ বস্তি থেকে চলে এলাম তোমার কাছে।
—কী ভয়?
—ওই যে সেই কাল রাতের আগন্তুকদের ভয়। তারা তো তোমাকে খুঁজতেই এসেছিল। আজ যদি এখানে আসে?
—এলে, আসবে। ওরা যদি শিক্ষিত হয় তাহলে তো ওরা জানবেই যে মনে মনে আমি তাদের সমর্থন করি। আমার নানা লেখাতে আমি ওদের সমর্থন করেছি।
—ওরা সবাই কি আপনার লেখা পড়েছে?
—হয় তো নয়। এইটাই মুশকিল। বুঝলে, সমস্ত রাজনৈতিক দলেই বিভিন্ন ধরনের কর্মী থাকেন। সব দলেই দেখা যায় যে ক্যাডারেরা বিশেষ পড়াশুনো করে না। তারা হুজুগে মেতে তাদের ক্রিয়াকাণ্ড করে। এর ফলে এদের হাতে কত নিরপরাধ মানুষের যে প্রাণ যায় সব রাজ্যেই, তা বলবার নয়। মানুষের মনে ভয় জাগিয়ে রাখাকেই যারা দলীয় নীতির পরম উৎকর্ষ বলে মনে করে তাদের নিয়েই হয় বিপদ। তার প্রধান কারণ পড়াশুনোর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। দল বড়ো হয়ে গেলে উপরের দিকের নেতাদের সঙ্গে, তাদের রাজনীতির সার কথা সম্বন্ধে তাদের যোগাযোগ ও জ্ঞান থাকে না। তা ছাড়া, নানা ব্যক্তিগত স্বার্থও কাজ করে, ধরো আমার কোনো প্রতিযোগী কোনো ঈর্ষাকাতর মানুষ বা গোষ্ঠী আমাকে মেরে দিতে পারে। আমি যেমন বছরের মধ্যে অর্ধেক সময়েই নির্জন বনে বনে কাটাই, সেখানে তাদের নিয়োজিত গুণ্ডারাও আমাকে খুন করতে পারে অনায়াসে। তবে তাদের বা তার নিজের হাতে রক্ত লাগে না। আগেই বলেছিলাম না, এটা ‘সুপারির’ যুগ। মানুষ যতই আত্মসম্মানজ্ঞান রহিত হচ্ছে, মানুষ যতই অর্থাকাঙ্ক্ষী এবং নির্গুণ হয়েও ফলাকাঙ্ক্ষী হচ্ছে, ততই সুপারি প্রথার জয়জয়কার হচ্ছে।
—তাহলে, কী হবে? আপনি কোনো আর্মস আনেননি সঙ্গে?
— গৌতমনারায়ণ হাসলেন।
বললেন চিরদিনই জঙ্গলে এলে সঙ্গে কোনো স্মল-আর্মস থাকেই।
এখন না-হয় বুড়ো হয়েছি বলে, ড্রাইভার, খিদমতগার সবাই সঙ্গে থাকে। এই সেদিন পর্যন্ত তো নিজে গাড়ি চালিয়েই আসতাম। সঙ্গে অন্য কেউই থাকত না। তবে যেখানেই যেতাম সেখানের জঙ্গলেই চ্যালাচামুন্ডা জুটে যেত। তারাই সব কিছু করত। তখন অবশ্য স্মল-আর্মসই নয়, সঙ্গে শটগান এবং রাইফেলও আনতাম। তবে শিকার তো বেআইনি হয়ে গেছে ১৯৭২ থেকে। শিকার করিই না বলতে গেলে, তবে জঙ্গলের মানুষদের অনুরোধে কখনো কখনো তাদের ফসল নষ্ট করা বুনো শুয়োর বা শজারু মেরে দিতাম। কখনো বা গোরু-খেকো বাঘ, বিশেষ করে বর্ষার সময়ে। নইলে ক্কচিৎ কদাচিৎ শম্বর বা নীলগাই।
আসলে বেচারারা ত কোনোরকম মাংসই খেতে পায় না। ওদের কাছে ভেনিসন-এর আরেক নামই শিকার। ভাতও ওরা খায়, বছরে দু-একবারই। কোনো বিয়ে বা অন্য উৎসবে। তাই কাছের হাট থেকে ওদের মোটা চাল, যা পাওয়া যায়। এবং মহুয়াও আনিয়ে দিতাম। চম্পাঝরণেও দিয়েছি। অ্যানিম্যাল প্রোটিন বলতে শিকার করা মাংস ছাড়া আর কোনো কিছুই এরা খেতে পায় না।
—মারতেন কি বেআইনি করেই?
—হ্যাঁ। কখনো কখনো। আমাদের দেশের মুশকিলটা কোথায় জান? যাদের ভালোর জন্যে গাদা গাদা আইন প্রণীত হয় তারা মরল কী বাঁচল তা নিয়ে কারোর মাথাব্যথা নেই। তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস করে দেখো ল্যাটিন ভাষাতে একঢা ম্যাক্সিম আছে ‘IgnoraNtia juris non-Excusat’ মানে, আইন না-জানা কোনো মান্য অজুহাত নয়। এই অশিক্ষিত, অভুক্ত, নিপীড়িত মানুষদের কাছে আইন জানার কোনো অবকাশ নেই। আমি এদেরই জন্যে যতটুকু আইন-ভেঙেছি তাকে আমি অপরাধ মনে করিনি কখনো। তাতে আমার শাস্তি হলে হোক।
—তাহলে? এখন তো বন্দুক রাইফেল আনেন না। মাওবাদীরা আক্রমণ করলে কী হবে?
কী আর হবে? আজকাল, পিস্তল বা রিভলবার বা স্পোটিং বন্দুক রাইফেল কোনো অস্ত্রই নয়। তারা সব অটোমেটিক ওয়েপনস নিয়ে আসে চাইনিজ এ কে ফর্টিসেভেন, ইজারায়েলি উজি সাব-মেসিন গান। ট্রিগার টিপে রাখলে ঝর্নার মতো গুলি বেরোয়।
—এসব ওরা পায় কোথায়?
কী করে জানব? চীনও হতে পারে। পাকিস্তানও হতে পারে। পয়সা দিয়ে কিনতে পারে। এসব বেআইনি অস্ত্র বাইরে থেকে পাচার হয়ে আসে। দামও অনেক। কিন্তু ওদের টাকার অভাব নেই। কারা যোগায় জানি না। ওরা নিজেরাও লুটপাট করে আনে। ‘হিন্দি-চিনি’ ভাই ভাই করে নেহেরুর সময় থেকে চীনেরা ভণ্ডামির পরাকাষ্ঠা করে আসছে। নেহরুর পেয়ারের মানুষ কৃষ্ণ মেননের সময় ডিফেন্স ফ্যাক্টরিতে কফি-পার্কোলেটর তৈরি হত আর হাজার হাজার ভারতীয় জোয়ান বিনা অস্ত্রে, বিনা গরম পোষাকে বরফের মধ্যে প্রাণ দিয়েছে। যশোবন্ত সিং-এর জিন্নার উপরে লেখা বইয়ে পড়লাম যে জিন্না নাকি পাকিস্তান চানইনি— নেহেরু আর প্যাটেল সাহেবই নাকি ভেট দিয়েছিলেন ইংরেজদের। ন্নি-পিস-স্যুট পরা নেহেরু সাহেব কত তাড়াতাড়ি প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসতে পারেন তাই তাঁর একমাত্র মতলব ছিল। আর এখন তাঁর পুতি রাহুল গান্ধিকেও সেই গদিতে বসানোর তোড়জোর চলছে। প্রথমে নেহেরু। তারপরে তাঁর কন্যা, তার পরে তাঁর নাতি এখন তাঁর পুতি। দেশে অন্য কোনো পরিবার ছিলও না। আজও নেই। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রে এ কোন নির্লজ্জতা চলেছে যুগের পর যুগ—তার বিরুদ্ধে কেউই কি মুখ খুলেছে? সাংসদরা সবাই কি তাঁদের নিজেদের এবং পরিবারের সম্পত্তির হিসেব দিয়েছেন আজ অবধি? তাঁদের আয়ের সূত্র জানিয়েছেন? আরো কত প্রশ্ন আছে তার উত্তর দিচ্ছে কে? এই দেশে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা থাকবে কী করে?
তারপর বললেন, আমাদের বাংলার বঙ্কিমচন্দ্র বট্টোপাধ্যায়, আনন্দমঠের লেখক, ‘বন্দেমাতরম’ গানের যিনি রচয়িতা তিনি কমলাকান্তের দপ্তরে লিখে গেছিলেন ‘আইন! সে তো তামাশা মাত্র। বড়োলোকেরাই কেবল পয়সা খরচ করিয়া সেই তামাশা দেখিতে পারে’।
এ কথা আজকে একশো বছরের পরেও এ দেশে প্রযোজ্য। অথচ বঙ্কিমচন্দ্র নিজে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। এ দেশের আইনের কথা না বলাই ভালো।
—তুমি এসব বলে আমার ভয় আরো বাড়িয়ে দিলে।
—ভায়ের কী আছে? ওরা আমাকে মারলে ওদেরই ক্ষতি। তা ছাড়া, ওদের জন্যে আমি এ পর্যন্ত যা করেছি তার জন্য ওদের উচিত আমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা।
—নাগপুর শহরে তো মাওবাদীদের কোনো উপদ্রবের কথা শুনিনি।
—নাগপুর তো বিদর্ভের রাজধানী ছিল। এখনো মহারাষ্ট্রের বিধানসভা। তিনমাস নাগপুরেই বসে। ওরা বুদ্ধি রাখে বলেই নাগপুর শহরকে এড়িয়ে চলে। তুমি মহারাষ্ট্রের লাগোয়া ছত্তিশগড়ে যাও, দেখবে ওদের খুব দাপট। কাগজে নিশ্চয়ই পড়েছ। মহারাষ্ট্রের কিছু এলাকাতে যেমন গড়াচিরোলি ও আল্লাপাল্লির জঙ্গলেও এদের প্রকোপ খুব। আর ছত্তিশগড়ের দান্ত্যেওয়াড়া নামও শুনছে নিশ্চয়ই। রংকিনী আর শঙ্কিনী নদীর সংগমস্থলে দেবী দন্ত্যেশ্বরীর মন্দির। দন্ত্যেশ্বরী হিন্দুদের একটি পীঠ। মা দুর্গার দাঁত পড়েছিল নাকি ওখানে। আরও নানা জায়গা আছে ছত্তিশগড়ে। যেখানে যত দারিদ্র সেখানেই এই আন্দোলন মাটি পেয়েছে।
তারপর বললেন, পালামৌতেও এখন যাওয়াই যায়না। তুমি কি ‘কোজাগর’ পড়েছ। ওঁরাও দের জীবন নিয়ে লেখা। তাতেও মাওবাদীদের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন আছে। আমিও লেখকের সঙ্গে একমত। বন্দুক রাইফেল সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে এই সমস্যার মোকাবিলা করা যাবে না। এইসব রাজশক্তি নিরন্তর অপমানিত এবং ব্যর্থই হবে। আসলে সমস্যার মূলে যতক্ষণ না পৌঁছানো যাবে ততক্ষণ এর সুরাহা হবে না।
—সমস্যার মূলটা কী?
—হতদরিদ্র মানুষদের খাদ্যসংস্থান করতে হবে, পরনের বস্ত্র দিতে হবে। পানীয় জল, বিজলি আলো, স্কুল এসবের বন্দোবস্ত করতে হবে। ঝাড়খণ্ডের পালাম্যুতে য়ে মাওবাদী আন্দোলন—যার জন্যে অমন সুন্দর জায়গাতে এখন পর্যটকদের যাওয়াও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে, তাও আমি বলব প্রশাসনেরই তৈরি করা। এখন জঙ্গলের মধ্যে নানা পুলিশ ক্যাম্প, পাকা বাড়ি, অগণ্য পুলিশের গাড়ি এবং পুলিশ দিয়েও সমস্যার কোনো সুরাহা হচ্ছে না। ‘কোয়েলের কাছে’ পড়ে হাজার পর্যটক এ-অঞ্চলে যেতেন একসময়ে। ‘একটু উষ্ণতার জন্যে’ পড়ে হাজার হাজার মানুষ যেতেন ‘ম্যাকলাস্কিগঞ্জে’। তাঁরা আজকাল নিরাপদে অমন সুন্দর সব জায়গাতে যেতে পারেন না।
বলেই বললেন, তোমাকে একটা ঘটনার কথা বলি। বছর পনেরো আগে এপ্রিলের গোড়াতে একবার পালামৌর কেঁড় বাংলোতে গিয়ে ছিলাম একটি উপন্যাস শেষ করার জন্য। তখন মাওবাদী আন্দোলন সেখানে শিকড় পেয়ে গেছে। ওই বাংলোতে জেনারেটরও ছিল কিন্তু সে-বছর গরমের গোড়াতেই এমন গরম পড়ে গেছিল যে জংলি জানোয়ারও ভীষণ জলকষ্টে পড়েছিল।
পালামৌ এমনিতে খুব রুখ জায়গা। রোজ সকালে বনবিভাগের লোকেরা ট্রাক নিয়ে জেনারেটরকে ট্রাকে উঠিয়ে জঙ্গলের মধ্যের ছোটো নদীর কাছে নিয়ে গিয়ে জেনারেটরে সেই পাম্প চালিয়ে জঙ্গলের মধ্যে জল ফেলত কোনো ডোবা মতো জায়গাতে। সেখানে একটু জল জমলে বনের প্রাণীরা ভয় ভুলে প্রাণের তাগিদে এসে লোকজনের সামনেই সেই জল খেত। তাদের কাজ হয়ে গেলে জেনারেটরটিকে বাংলোতে ফিরিয়ে এনে চালু করে দিত।
এই ধ্বস্তাধ্বস্তিতে তিনদিনের মধ্যেই জেনারেটর খারাপ হয়ে গেল। ফলে, সূর্য ওঠার আগে উঠতাম এবং বাইরের বারান্দাতে চেয়ার টেবিল লাগিয়ে লিখতে বসতাম। চৌকিদারের বউ রুটি আর তরকারি করে দিত আর অপেয় চা। তাই খেয়ে দুপুর একটা অবধি লিখতাম। তারপরে আবার ডাল ভাত খেয়ে ঘণ্টা দুয়েক বিশ্রাম করতাম। যতক্ষণ দিনের আলো থাকে লিখতাম। আলো মরে গেলে, চানঘরে গিয়ে বাথটবে জমিয়ে রাখা ঠাণ্ডা জলে চান করতাম। তারপর চৌকিদারকে দিয়ে এক বোতল মহুয়া আনিয়ে ইজিচেয়ারে শুয়ে বারান্দার থামে দু-পা তুলে দিয়ে আস্তে আস্তে মহুয়া খেতাম। প্রথম যৌবন থেকে স্কচ খাওয়া অভ্যেস। মহুয়া-টহুয়া আমাদের চলত না। কষ্টে-সৃষ্টে আধবোতল খেয়ে চৌকিদার রামলগনকে দিয়ে দিতাম। রামলগন উদয়াস্ত মহুয়া খেয়েই থাকত। তার চেহারাটাও ছিল আফ্রিকানদের মতো। বিশেষ করে Torso। তারপরে রাত আটটা অবধি ওর সঙ্গে নানা গল্প করতাম। বাংলোর ডানদিকে জঙ্গলের মধ্যে বহুদূরে একটি মার্কারি খেভপার ল্যাম্প জ্বলত। বনজঙ্গল পেরিয়ে বহুদূর থেকে সেই আলোর আভাস এসে পৌঁছোত কেঁড় বাংলোর বারান্দায়।
প্রতিদিনই সন্ধেবেলা আমি চান করে ওঠার পর, তখনো আলোর আভাস থাকত বাইরে, শুনতাম একদল ছেলে হাতে তালি দিয়ে দিয়ে সম্মেলক গান গাইছে। প্রত্যেকের গলাতে সুর ছিল এবং সে গান প্রভূত মহড়া দেওয়া বলেই মনে হত।
রামলগনকে জিজ্ঞেস করলে ও বলত, ওরা মাওবাদী। ওরা গ্রামের অদূরে জঙ্গলের মধ্যে থেকে সে-গান গাইত। দূর থেকে গানের ভাষা বুঝতাম না, কাছ থেকে গাইলেও বুঝতাম না, কারণ সে-গান ওরা গাইত ওঁরাও ভাষায়।
রামলগনকে জিজ্ঞেস করতাম, আমি যে এই বিজলি-হীন বাংলোতে একা আছি ওরা আমার কোনো ক্ষতি করবে না?
রামলগনকে বলত না, ওরা আপনার পরিচয় জানে। আপনার কোনো ক্ষতিই করবে না।
আটটা বেজে গেলে আমি আবার দুটি রুটি খেয়ে শুয়ে পড়তাম। পরদিন অন্ধকার থাকতে উঠতে হবে বলে।
তারপর বললেন, তোমরা যে এক একটি উপন্যাস পড়, তা লিখতে একজন লেখকের যে কতদিনের পরিশ্রম লাগে সে-সম্বন্ধে তোমাদের কোনো ধারণাই নেই। তা ছাড়া, লেখাটা, সব লেখাই আমার কাছে পুজোর মতো।
ঘটনাটা ঘটেছিল তিন-চার দিন পরে। কেঁড় থেকে ডালটনগঞ্জ খুব একটা দূর নয়। চিপাদোহর বলে একটা জায়গা আছে কেঁড় এর খুব কাছে। সেখানে থেকে একটা শর্টকাট কাঁচা পথ বেরিয়ে গেছে পিচ রাস্তার দিকে যে-রাস্তা ডালটনগঞ্জের দিকে গেছে। চিপাদোহরে সে-রাতে নাকি বনবিভাগ এবং পুলিশ সাহেবদের একটি ডিনার পার্টি ছিল। পার্টি শেষে পুলিশের ভ্যান—আর্মড পুলিশ ভরতি এবং দুটো জিপ, একটা বনবিভাগের আর একটি পুলিশের, ডালটনগঞ্জের দিকে ফিরছিল। দলে-দলে থাকলে মনোবল বাড়ে। মনোবলের প্রয়োজন ছিল কারণ ওঁরা সকলেই জানতেন যে সেখানে এমসিসির ছেলেরা অত্যন্তই সক্রিয়।
পথে একটি নালা ছিল। তার উপরের কালভার্ট। ওঁদের কনভয় যখন কালভার্ট এর উপরে তখন রাত সাড়ে দশটা-এগারোটা হবে। কালভার্টের নীচ থেকে মাইন ফাটল। ট্রাকটা উল্টে গেল। পুলিশের জিপও ক্ষতিগ্রস্ত হল। দুজন পুলিশ মারাও গেছিলেন।
ঘরে পাখা নেই তাই গরাদহীন মস্ত মস্ত জানালা খুলেই শুয়েছিলাম। হঠাৎ দূরে বিস্ফোরণের শব্দ কানে আসাতে ঘুম ভেঙে গেল। রামলগনও তার কোয়ার্টারে গভীর ঘুমে ছিল। পরদিন সকালে জিজ্ঞেস করব ভেবে আমি কোলবালিশ জড়িয়ে পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন ব্রেকফাস্টের সময়ে বিস্তারিত খরব পেলাম।
ভেবে অবাক হচ্ছিলাম যে আমি অত বড়ো বাংলোতে বিজলিহীন অবস্থাতে শোবার ঘরে একটি ফিতে-কমানো লন্ঠন ভরসা করে ঘুমিয়ে আছি—সঙ্গে না কোনো আগ্নেয়াস্ত্র না কোনো সঙ্গী অথচ মাওবাদী ছেলেরা একদিনের জনেও আমাকে বিন্দুমাত্র বিরক্ত করেনি।
পলাম্যুতে কেন এমসিসির প্রকোপ এমন তীব্র হয়েছে তা এখন তোমাকে বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে। তবে এক কথাতে বলি, পালাম্যু টাইগার প্রজেক্টই এজন্যে দায়ী। বিশদে কখনো বলব তোমাকে পরে।
ধৃতি বলল, আমরা কখন বেরুব? রাতেও কি পায়ে হেঁটে যাব? না কি গাড়ি নেব? ড্রাইভার থাকলে অবশ্য প্রাইভেসি থাকবে না।
তার জন্যে নয়। ড্রাইভারেরই বা কী দরকার। গাড়ি তো দু-জনের মধ্যে যে-কেউই চালিয়ে যেতে পারি। কিন্তু গাড়িতে গেলে শুক্লাপক্ষের রাতকে উপভোগ করবে কী করে। একমাত্র বিপদ হচ্ছে ভাল্লুক ভায়ারা। তারা অবশ্য এমন মহুয়াতলিতেই ব্যস্ত থাকবে।
কটাতে বেরোব?
চা-টা খেয়ে পাঁচটার পর বেরোব। এখানে সন্ধে নামতে নামতে ছ-টা বাজবে। তা ছাড়া, সন্ধে নামলেও অন্ধকার তো থাকবে না। চাঁদ তো থাকবেই।
তুমি যা বলবে। এই চম্পাঝরণ আমার জীবনে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। অথচ আশ্চর্য। আগে যে কেন বেরিয়ে পড়িনি তোমার সঙ্গে।
বারবার এমন করে বেরোলে তোমার ডিভোর্স হয়ে যেত।
লোকভয়ের কথা বাদ দিলে ডিভোর্সে এ ভয়ের কী আছে? হলে, হত। লোকভয় আর একটুও নেই। তা ছাড়া, আমার তো ছেলে মেয়েও নেই। আমিই আমার মালিক। আমার যা ভালো লাগে আমি করি, করবও।
নিজের সর্বনাশ নিজে করবে বলে মনস্থির করলে তোমাকে কে বাঁচাবে বলো?
বিকেলে ঝাণ্ডু ওদের ফ্রেঞ্চটোস্ট করে দিয়েছিল চায়ের সঙ্গে। না খেলেও চলত। অত বেলায় লাঞ্চ খেয়ে খিদেও ছিল না একটুও। তবু, অভ্যেস। তা ছাড়া ঝাণ্ডুও জোর করল।
বেরুবার আগে ঝাণ্ডু বলল, আপনারা ফিরবেন ক-টা নাগাদ। স্যার?
—কেন?
—যখন ফিরি না কেন, খাব কখন তাই জিজ্ঞেস করো।
—হ্যাঁ হ্যাঁ তাই।
—রাত দশটার আগে খাব না। তবে যদি খাই তো জানাব। সব তৈরি করতে তোমার কতক্ষণ লাগবে?
—এই আধ ঘণ্টা খানেক।
— তোমাকে আধঘণ্টা আগে বলে দেব।
—সঙ্গে একটু খাবার জল নিলে হত না? আমরা তো গাড়ি নিয়েও যাচ্ছি না।
—ভালোই বলেছ। একটি ফ্লাস্ক ভরতি করে জল দিয়ে দাও ঝাণ্ডু।
—ঠিক আছে স্যার।
ঝাণ্ডু জল নিয়ে এলে ফ্লাস্কটা ওর হাত থেকে নিয়ে নিজের কাঁধে ঝোলালেন গৌতমনারায়ণ।
মুখে বললেন চলো। দুগগা দুগগা করে বেরুনো যাক এবার।
—ধৃতি হেসে বলল, তোমার মুখে বুড়িদের মতো দুগগা দুগগা রব মানায় না।
—অভ্যেস।
তারপর বললেন, আমার মা বলতেন। কোথাও বেরুবার আগে দেওয়ালের মা দুর্গার ছবিতে প্রণাম করে যেতে বলতেন। বলতেন, বাড়ি ফিরেও দুগগা মাকে প্রণাম করবি। সেটা কৃতজ্ঞতা। মা একটা কথা বলতেন, যা আর কাউকে বলতে শুনিনি। বলতেন সকলেই মা দুগগার কাছে কত কিছু প্রার্থনা করে। রোগের আরোগ্য, শত্রুর বিনাশ, পরীক্ষাতে ভালো ফল ইত্যাদি। ইত্যাদি কিন্তু যখন তার সময় ভালো যায়, মান সম্মান যশ বৃদ্ধি পায়, দেহ সুস্থ থাকে তখন কিন্তু কেউই মা দুগগার নামও করেন না, বলেন না, থ্যাঙ্ক ইউ। বিপদগ্রস্ত হয়ে চার আঙুলের চারটি আংটি পরতে দেখবি অনেককেই কিন্তু ভালো থাকার সময়ে করোকে কোনো গ্রহ ধারণ করতে দেখেছিস? না, কখনোই দেখবি না। তাই-ই মা বলতেন বিপদ এবং সম্পদে, যাওয়া এবং আসার সময়ে মনে করবে মাকে।
—তারপর?
—তারপর আর কী। সেই থেকে অভ্যেস হয়ে গেছে।
—ভালোই তো। কু-অভ্যাসের এর চেয়ে সু-অভ্যাস তো ভালোই।
তারপর বলল, আপনার মায়ের বুঝি পুজো আচ্চার বাতিক ছিল?
—না না, একদমই নয়। এমনকি দুর্গা পুজোতে মা অঞ্জলি পর্যন্ত দিতেন না কিন্তু অত্যন্ত ভক্তিমতী রমণী ছিলেন। দানশীল ছিলেন। উচিত-অনুচিত বোধ তাঁর মধ্যে অত্যন্ত প্রবল ছিল। যা বিশ্বাস করতেন তা বলতে কখনো ভীত হতেন না। মায়ের এই স্পষ্ট বক্তা স্বভাবের কিছুটা হয়তো আমার মধ্যে বর্তেছে এবং তাই আমার শত্রুসংখ্যা অগণ্য।
ধৃতি বলল, শত্রুসংখ্যা দিয়েই তো একজন মানুষের কৃতিত্ব ও জনপ্রিয়তার বিচার হয় আজকে। খাঁটি মানুষের বিচারও তা দিয়েই হয়। পৃথিবীটা দু-নম্বরি আর জালি মানুষে ভরে গেছে।
ওঁরা বাংলোর গেট পেরিয়ে পথে পড়লেন এবং হাঁটতে লাগলেন। ধৃতি একটা সাদা-কালো হালকা প্রিন্টের মুর্শিদাবাদ সিল্ক-এর শাড়ি পরেছে। শিমুলতলিতে পথের বাঁকটা পেরুতেই ওঁরা বাংলোর নজরের বাইরে চলে গেলেন। গৌতমনারায়ণ বললেন একটু দাঁড়াও তো ধৃতি, তোমাকে জম্পেস করে একটা চুমু খাই। তুমি বড়ো সুন্দর দেখতে। বলেই ওকে বুকে টেনে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে চুমু খেলেন উনি।
ধৃতি বলল, বাবা: চুমু না যেন কুস্তি। তোমার কাম যে কখন বিনা নোটিশে ঝরনার মতো উৎসারিত হয় তা আগের মুহূর্তেও বোঝা যায় না।
গৌতমনারায়ণ বললেন, আমার বাবা বলতেন, সৌন্দর্য হচ্ছে ঈশ্বরের দান। তোমার যদি কোনো গুণও না থাকত শুধুমাত্র সৌন্দর্য দিয়েই তুমি বিশ্বজয় করতে পারতো। বুঝেছি ধৃতি।
—বেশি বেশি বলো তুমি।
দেখতে দেখতে সূর্য মুছে গিয়ে চাঁদ উঠল। ওঁরা যখন দিন-পাখিদের রাজত্ব পেরিয়ে রাত-পাখিদের রাজ্যে প্রবেশ করলেন তখন চাঁদ অনেকটা উপরে উঠে এসেছে। গন্ধ-জর্জর বনমর্মরের মধ্যে শুকনো পাতা মাড়িয়ে ধীরে ধীরে ওরা সকালবেলায় যে বড়ো কালোপাথরের উপরে ধৃতি বসেছিল সেখানে এসে পৌঁছোলেন। চম্পাঝরণ নালাটার বালিময় বুক চাঁদের আলোতে সাদা দেখাচ্ছিল। এক জোড়া টিটি পাখি নদীর বুকের উপর ডিড-ড্য-ডু-ইট, ডিড-ড্য-ডু-ইট করে ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে ডাকতে ডাকতে উড়ছিল। এক জোড়া প্যাঁচা কিঁচি-মিঁচি-কিঁচির করে ঝগড়া করছিল উড়ে উড়ে।
—দেখো, সাবধানে উঠো, পড়ে যেও না যেন।
গৌতমনারায়ণ বললেন।
—পতনের আর বাকি কী রইল। আমার অধঃপতন তো সম্পূর্ণই হল।
—পতন তো চিরদিন অধো:লোকেই হয়, কে আর কবে ঊর্ধ্বলোকে পড়েছে বলো?
গৌতমনারায়ণ বললেন।
তারপর বললেন, তোমার কি বিবেক দংশন হচ্ছে। স্বামীর কথা মনে হচ্ছে? বলো?
বিবেককে ঠিক মতো ঘুম পাড়িয়েই এসেছি। বিবেকের দাঁতকে নোড়া দিয়ে ভেঙেই এসেছি। তার কামড়াবার শক্তি আর নেই।
—তোমার শাড়িটি এবারে খুলে ফ্যালো। আমার কাঠবিড়ালিকে একবার দেখি, স্পর্শ করি।
তারপর গৌতমনারায়ণ বড়ো আদরে যতনে কোমলাঙ্গী ধৃতির নরম, রোমশ এবং মসৃন কাঠবিড়ালিতে পরম আদরে হাত বুলোতে লাগলেন।
তারপর বললেন, তুমি আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘ফর হুম দ্যা বেল টোলস’ বইটি পড়েছ?
পড়েছি। অর্ধোস্ফুট স্বরে উত্তেজিত ধৃতি বলল। কিন্তু ওকথা এখন কেন?
হোমিংওয়ের ‘র্যাবিট’ যা, আমার কাঠবিড়ালিও তাই। দর্শন এবং স্পর্শনে যা সুখ থাকে তা কি ঘর্ষণে থাকে?
—তা ঠিক অধিকাংশ পুরুষই বড়ো আনরোম্যান্টিক। তোমার মতো পুরুষ যদি সকলেই হত!
বলে, ধৃতি গৌতমনারায়ণের চওড়া রোমশ বুকে মুখ গুঁজে চুপ করে গেল।
উপরের চাঁদভাসি আকাশে পিউ-কাঁহা আর কোকিল পাগলের মতো ডাকতে ডাকতে উড়তে লাগল। ঘোর-লাগা কামার্ত ধৃতির বড়ো বড়ো উষ্ণ নি:শ্বাস গৌতমনারায়ণের বুকের মধ্যে, বুকের বাইরে ও ভিতরে আলোড়ন তুলতে লাগল। কথা না বলে দুজনেই দুজনের মধ্যে পরিপ্লুত হয়ে রইল। গৌতমনারায়ণের ডান হাতের সবকটি আঙুল ধৃতির কাঠিবিড়ালির সবটুকুকে আদরে ভরিয়ে দিতে লাগল।
এমন সময়ে বাইরের পথে একটি গাড়ির হেডলাইটের আলো দেখা গেল। গাড়িটা ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর হেডলাইটটা নিভে গেল। গাড়ির ইঞ্জিনও বন্ধ হয়ে গেল। হেডলাইট নিভে যেতেই সেই শুক্লা-অষ্টমীর ঘোর লাগা ছমছমে জ্যোৎস্না ভেজা রাত আবার ফিরে এল।
পথ ছেড়ে জঙ্গলের মধ্যে নদী পেরিয়ে আসার সময় গৌতমনারায়ণ একটি শালগাছের চারার উপরে জলের ফ্লাস্কটা ঝুলিয়ে রেখে এসেছিলেন। গাড়ির আরোহীরা সম্ভবত সেটিকে দেখতে পেয়েই গাড়ি দাঁড় করিয়েছিল।
কে যেন কর্কশ গলাতে মারাঠিতে বলল, এরই আশে পাশে হবে বুর্জোয়ার বাচ্চা। গাড়ি থেকে নেমে টর্চ নিয়ে খোঁজ চারপাশে।
ওরা দুজনেই মারাঠি ভাষা বুঝত। তাই কথা বুঝতে অসুবিধে হলো কোনো।
গাড়িটা ওদের কাছে থামতেই ধৃতি তাড়াতাড়ি শাড়ি পরে নিল। যতক্ষণ উত্তেজনায় ও কাঁপছিল থরথর করে। এখন কাঁপতে লাগল ভয়ে। প্রাণ যাবার ভয়ের চেয়েও আরো বড়ো ভয় থাকে মেয়েদের।
গৌতমনারায়ণ বললেন, তুমি এখানেই থাকো। আমি দেখছি এগিয়ে গিয়ে।
ধৃতি বলল, নানা, তুমি যেও না।
গৌতমনারায়ণ কোমর থেকে পিস্তলটা খুলে নিয়ে পাথরটা থেকে নেমে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। ভয়ার্ত ধৃতিকে সেখানেই বসিয়ে রেখে। ততক্ষণে দু-তিনটি পাঁচ ব্যাটারির টর্চের আলো সমস্ত জঙ্গল চিরে এদিক-ওদিক করতে লাগল। সেই তীব্র আলোর ঝলকানিতে অষ্টমীর চাঁদের আলোও ম্লান হয়ে গেল।
গৌতমনারায়ণ আরও কয়েকপা এগোতেই একটি আলো তাঁর গায়ে এসে পড়ল।
উনি আর একটু এগিয়ে গিয়ে ডান হাতে কক-করা পিস্তলটি ধরে মারাঠিতে বললেন, তোমরা কারা? কী চাও?
—তোমাকেই চাই।
বলার সঙ্গে সঙ্গে এক ঝাঁক গুলি এসে তার উপর পড়ল।
পিস্তল চালাবার সুযোগও তিনি পেলেন না। চম্পাঝরন নদীর পাশেই গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়া তাঁর শরীর মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
সেই মৃতদেহের উপর আরো একঝাঁক গুলি এসে পড়ল নিশ্চিত হবার জন্যে যে তিনি মৃত। তারপরে একজন এসে তার হাত থেকে তাঁর পিস্তলটা ছিনিয়ে নিল।
সেই কর্কশ স্বরের নেতা গৌতমনারায়ণ-এর ড্রাইভারকে অর্ডার করল। গাড়ি ঘোরাও ড্রাইভার। তারপর আমাদের রেললাইনের লেভেল ক্রসিং-এ ছেড়ে দিয়ে এসো। তারপর ফিরে এসে তোমার মনিবকে তুলে নিয়ে যেও। ডাক্তার বা সার্জেনের করার আর কিছুই নেই। এখানে ডাক্তার বা সার্জন নেইও। পাততাড়ি গুটিয়ে নাগপুরেই ফিরে গিয়ে পুলিশে রিপোর্ট কোরো।
এমন সময়ে বাইরের পথে একটি গাড়ির হেডলাইটের আলো দেখা গেল।
একজন বলল, মেয়েটার কী করবে? তাকে এমনিই ছেড়ে রেখে যাব?
—সে ভয়ে কোথায় পালিয়েছে তার কোনো কী ঠিক আছে?
—তাকে যদি খুঁজেও পাও—
সেই কর্কশ-কন্ঠ বলল, একেবারে হাত ছোঁয়াবে না কেউই তার গায়ে। যে হাত ছোঁয়াবে তাকে আমি নিজে মারব কুকুরের মতো। আমরা কি সাধারণ ডাকু-বদমাস?
গাড়ি ঘুরিয়ে ওরা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে ধৃতি খুব আস্তে আস্তে নামল নীচে। তারপর গৌতমনারায়ণের কাছে পৌঁছে উন্মাদিনীর মতো হাউহাউ করে কেঁদে উঠল।
চম্পাঝরন নালার উপর টিটি পাখি দুটো চমকে চমকে উড়তে উড়তে ডাকতে লাগত : ডিড-উ্য-ড্যু-ইট? ডিড-উ্য-ড্যু? ডিড-ড্য-ড্যু ইট?