সৌভাগ্যলক্ষ্মী যেন দু হাত উজাড় করে উপহার দিতে শুরু করেছেন মধুসূদনকে। এক সঙ্গে এতদিকের সার্থকতা খুব কম মানুষের জীবনেই আসে।
মাত্র তিন বছর সাহিত্য রচনা করেই এত সুনাম, এত যশ কে কবে পেয়েছে? পুলিস-আদালতের এই দোভাষীটির নাম এখন সকলের মুখে মুখে। সকলেরই কৌতূহল, কে এই মাইকেল মধুসূদন। এই ম্লেচ্ছের রচিত কবিতা পাঠ করে অন্তঃপুরবাসিনী হিন্দু রমণীদেরও চক্ষু অশ্রুসিক্ত হয়। তাঁর জনপ্রিয়তা যে কতদূর পৌঁছেচে তা একদিন নিজের চোখেই দেখলেন মধুসূদন। চীনেবাজার দিয়ে তিনি এক সকালে পদব্ৰজে আসছিলেন, দেখতে পেলেন এক মুদিখানার মালিক নিবিষ্টভাবে একটি বই পড়ছে। লেখক মাত্রই নিজের বইয়ের দিকে একপলক নজর দিলেই চিনতে পারে। মধুসূদন বুঝতে পারলেন, সেই বইটি মেঘনাদবধ কাব্য। লোকটির পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে কৌতূহলী মধুসূদন জিজ্ঞেস করলেন, মহাশয়, কী বই পাঠ কচ্চেন, জানতে পারি কি? মুদিটি চোখ তুলে হ্যাট-কোটধারী কালোকোলো ফিরিঙ্গিপান লোকটিকে দেখে কিঞ্চিৎ অবজ্ঞার সঙ্গে বললো, মশায়, এই বইয়ের ভাষা। আপনি বুঝবেন না। এ এক অপূর্ব কাব্য! আহা কী লিকেচেন! বাঁচালে দাসীরে আশু আসি তার পাশে হে রীতিরঞ্জন!
এমনকি বই লিখে বেশ দু পয়সা আয় হচ্ছে মধুসূদনের। হু হু করে বিক্রি হচ্ছে তাঁর সব রচনা, এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে মেঘনাদের দ্বিতীয় সংস্করণ। তাতে দীর্ঘ, জ্ঞানগর্ভ ভূমিকা লিখেছে হেমচন্দ্ৰ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে উদীয়মান এক কবি। এই যুবক কবিটি যথেষ্ট পণ্ডিত। বি এ পাস।
পিতৃ সম্পত্তি নিয়ে দীর্ঘকাল মামলা মোকদ্দমা চলার পর এই সময় জয়ী হলেন মধুসূদন। খিদিরপুরের বাড়ি, সুন্দরবনের জমিদারি সমেত অনেক কিছুই তাঁর হস্তগত হলো। অর্থ-কষ্ট কাটলো এতদিন পর। রাজনারায়ণ দত্তের পুত্র বহুকাল পর আবার যথেচ্ছ টাকা ওড়াবার স্বাধীনতা ফিরে পেলেন। লোয়ার চিৎপুরের বাড়ি ছেড়ে মধুসূদন চলে এলেন খিদিরপুরে, পৈতৃক বাড়িটির ভগ্নদশা বলে, কাছেই ভাড়া নিলেন বৃহৎ একটি উদ্যানবাটি। এর মধ্যে তাঁর দুটি সন্তান জন্মেছে। একজনের নাম রাখা হয়েছে। শৰ্মিষ্ঠা, অন্যজনের নাম মিল্টন। সংসারে এখন সুখের অবধি নেই। কর্মের প্রবল উৎসাহে এখন তাঁর সুরাপানও পরিমিত।
এত খ্যাতি-প্রতিপত্তি ও আর্থিক সচ্ছলতার সময়ে পুলিস আদালতের সামান্য চাকুরিটি চালিয়ে যাওয়ার আর কোনো মানে হয় না। মধুসূদন কিছু দিন যাবৎ মনে মনে অন্য একটি চিন্তা নিয়ে খেলা করছেন। ইতিমধ্যে ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর তাঁর স্কন্ধে অন্য একটি দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছেন। হরিশের মৃত্যুর পর তাঁর হিন্দু পেট্রিয়ট আর কিছুতেই ঠিক মতন চলছে না। নবীনকুমার তাই তার গুরু বিদ্যাসাগরকে অনুরোধ করেছিল, আপনি এটার যা-হোক কিছু ব্যবস্থা করুন। বিদ্যাসাগর মাইকেলকেই যোগ্যতম ব্যক্তি মনে করে তাঁকে ডেকে এই পত্রিকার সম্পাদনার ভার দিয়েছেন। বিদ্যাসাগরের সংস্পর্শে এসে মুগ্ধ হয়ে গেছেন মধুসূদন, ধুতি চাদর পর এই খর্বকায় ব্ৰাহ্মণকে তাঁর মনে হয়েছে বঙ্গকুলচূড়ামণি। বিদ্যাসাগরকেই তাঁর সদ্য রচিত কাব্য বীরাঙ্গনা উৎসর্গ করলেন সশ্রদ্ধ চিত্তে।
খিদিরপুরের বাড়িতে একদিন মধ্যাহ্নে বসে লেখাপড়ার কাজ করছেন মধুসূদন। এমন সময় শুনতে পেলেন বাইরে পথে তুমুল বাদ্যধ্বনি ও লোকজনের কোলাহল। কৌতূহলী হয়ে তিনি এলেন জানালার ধারে। সহধর্মিণী হেনরিয়েটা এতদিনে সুন্দর বাংলা শিখে নিয়েছেন। স্বামীর কবিতা পাণ্ডুলিপি অবস্থাতেই তিনি পাঠ করতে পারেন। একটি বই থেকে মুখ তুলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ও কিসের শব্দ, ডিয়ার?
মধুসূদন পত্নীকে হাতছানি দিয়ে ডেকে বললেন, ডারলিং, এদিকে এসো, দেকবে এসো!
পথ দিয়ে চলেছে মহরমের সাড়ম্বর বর্ণাঢ্য মিছিল। মস্ত বড় রঙীন তাজিয়া, দুলদুল অশ্ব, অল্পবয়স্ক ছেলেরা কোমরে ছোট ছোট ঘণ্টা-সমন্বিত দড়ি বেঁধে, হাতে তলোয়ার বা লাঠি নিয়ে নকল যুদ্ধের অভিনয় করতে করতে চলেছে। আর বয়স্করা বুক চাপড়ে চাপড়ে বিলাপ করছে। হায় হাসান, হায় হোসান।
তিন বছরের শিশু শৰ্মিষ্ঠা এসে দাঁড়িয়েছে বাবা-মায়ের পাশে। বাইরে অত কোলাহল শুনে শর্মিষ্ঠা প্ৰথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তারপর সে তার রিনিঝিনি কণ্ঠস্বরে জিজ্ঞেস করলো, ওঁরা কাঁদচে কেন?
মধুসূদন কন্যাকে বক্ষে তুলে নিয়ে মহরম উৎসবের পশ্চাৎ-কাহিনী শোনাতে লাগলেন।
হেনরিয়েটারও খুব আগ্রহ, তিনি প্রশ্ন করতে লাগলেন, এটা সেটা নিয়ে। মধুসূদন বললেন, আহো, কি মহান বিষাদ কাহিনী। জানো আঁরিয়েৎ, মুসলমানদের মধ্যে কেউ যদি হাসান-হোসেনের মামস্তিক পরিণতি নিয়ে কাব্য রচনা করে, তা হলে সে মহাকবির স্বীকৃতি পাবে। এই বিষয়বস্তু নিয়ে সে সমগ্ৰ মুসলমান জাতির মর্মবেদনা ফুটিয়ে তুলতে পারবে। আমাদের ধর্মে এমন তীব্ৰ শোকের বিষয়বস্তু নেই।
হেনরিয়েটা হঠাৎ মুচকি হাসলেন।
মধুসূদন ভ্রূ-কুঞ্চিত করে প্রশ্ন করলেন, তুমি হাসলে যে!
হেনরিয়েটা বললেন, ইউ সেইড, আমাদের ধর্মে!
এবার অট্টহাসি করে উঠলেন মধুসূদন। হাসতে হাসতে বললেন, মুখের কতায় ওরকম এসে যায়! হোয়াট আই মেণ্ট, হিন্দুদের ধর্মে! ব্ৰজাঙ্গনা লোকবার পর অনেকে আমাকে বোষ্টম বলতে শুরু করেচে! কিন্তু আমি খাঁটি ক্রিশ্চিয়ান।
একটু পরে মধুসূদন আবার বললেন, আমার বাল্যকালে আমাদের গ্রামে এরকম মহরমের উৎসব দেকিচি। সে স্মৃতি আমার মনে দেগে আচে। হাসান-হোসেনের দুঃখে আমিও কাঁদতুম। আহা, আমার ছেলে-মেয়েরা কেউ আমার জন্মস্থান দেকালে না কখনো।
হেনরিয়েটা বললেন, তোমার জন্মস্থান দেকতে আমারও সাধ হয়। আই লাভ দিজ কিউট লিটল বেঙ্গলি ভিলেজেস।
—যাবে? তা হলে চলো!
—আমরা ক্রিশ্চিয়ান। গ্রামের লোকেরা আমাদের টলারেট কর্বে কি?
–আমার জন্মস্থানে যাবো, কে বাধা দেবে! ড্যাঙ্গডেঙ্গিয়ে চলে যাবো! আমি এখন সে গ্রামের জমিদার।
যে-কথা, সেই কাজ। সপরিবারে যশোরের উদ্দেশে যাত্রা করলেন মধুসূদন। সঙ্গে আরও অনেক লোক-লস্কর। অর্থের কোনো অভাব নেই। যশোরে পৌঁছে মধুসূদন ভাড়া করলেন একটি বৃহৎ বজরা। তারপর সেই বজরায় চেপে কপোতাক্ষ নদীবক্ষে চললেন সাগরদাঁড়ি গ্রামের দিকে।
সেই শৈশবের আকাশ। নদীর দু ধারে সেই চিরতরুণ তরুশ্রেণী, মধুসূদনের হৃদয় উদ্বেল হয়ে উঠতে লাগলো। হেনরিয়েটা একবার নিজের কামরা থেকে বাইরে এসে দেখলেন বজরার ছাদের ওপর মধুসূদন প্রস্তরমূর্তির মতন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর দুই চক্ষু দিয়ে দরদীর ধারে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। জন্মভূমির সন্নিকটে এসে মধুসূদনের মনে পড়ে গেছে নিজের জননীর কথা। কত কষ্ট পেয়েই না। তিনি প্ৰাণত্যাগ করেছেন।
হেনরিয়েটা আর ডাকলেন না স্বামীকে।
একটু পরে শিশুপুত্র মিল্টনের জন্য দুধের প্রয়োজন হওয়ায় বজরা ভেড়ানো হলো এক স্থলে। দু জন পরিচালক গেল কাছাকাছি গ্রামে দুধের সন্ধানে। তাদের ফিরতে বিলম্ব হচ্ছে বলে অতিব্যস্ত মধুসূদন নিজেই নেমে পড়লেন পাড়ে। অদূরে কয়েকটি ঘরবাড়ি দেখে সেদিকে এগিয়েছেন, অমনি তাঁকে দেখে গ্রামের লোকেরা ছুটে পালাতে লাগলো। কয়েকটি শিশু কেঁদে উঠলো তারস্বরে। এ রকম হ্যাটিকেট পরা কোনো ট্যাস ফিরিঙ্গি সেই গণ্ডগ্রামে এ পর্যন্ত পদাপণ করেনি। গ্রামের লোক ভেবেছে এ কোন গ্রহান্তরের প্রাণী।
মধুসূদনও ছোড়বার পাত্র নন। তিনি পাল্লা দিয়ে ছুটলেন ওদের সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত একটি লোককে ধরে ফেলে বললেন, ওরে, আমায় দেকে ভয় পাচ্চিস? আমি যে তোদেরই এখেনকার মধু। ছোটবেলায় আমিও যে তোদেরই মতন এখেনে খালি গায়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে ধুলো মেখে খেলা করিচি। আমি এখুনো তোদের ভাষায় কতা কইতে পারি, দেকবি! খাতি নাতি বেলা গেল, শুতি পাল্লাম না।
এক এক করে লোকেরা ফিরে এলো তাঁর কাছে। মধুসূদন এক একজনের গলা জড়িয়ে ধরে কুশল সংবাদ নিতে লাগলেন, পকেট থেকে মুঠো মুঠো টাকা বার করে বিলিয়ে দিতে লাগলেন শিশুদের মধ্যে! শেষ পর্যন্ত গ্রামবাসীরা এত দুধ এনে উপহার দিল হেনরিয়েটাকে যা দিয়ে তিনি সপরিবারে সচ্ছন্দে স্নান সেরে নিতে পারেন।
গ্রামের স্বগৃহে মধুসূদনের ফেরা যেন মৃত্যুলোক থেকে প্রত্যাবর্তন। মাদ্রাজ প্রবাসকালে এক সময় মধুসূদনের মৃত্যু সংবাদ রটে গিয়েছিল। রাজনারায়ণ দত্তের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বংশনাশ হয়ে গেল ধরে নিয়ে আত্মীয়-পরিজনরা দখল করে নিয়ে নিল ঘরবাড়ি। সেই সব আত্মীয়স্বজন অবশ্য এখন বেশ সাদরেই বরণ করলো মধুসূদনকে। মধুসূদন দেখলেন, যে চণ্ডীমণ্ডপে বসে তিনি প্রথম বাংলা অ-কা-ক-খ শিখতে শুরু করেছিলেন, সে চণ্ডীমণ্ডপের এখন ভগ্নদশা। সেই বিশাল বাদামগাছটা অবশ্য এখনো টিকে রয়েছে। যার নিচে বসে তিনি প্ৰপিতামহের কাছ থেকে রামায়ণের কাহিনী শুনেছিলেন। সেই সব মনে পড়ে আর বারবার চক্ষে অশ্রু আসে।
হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বহু মানুষ ভিড় করে এলো মধুসূদনকে দেখবার জন্য। হেনরিয়েটা সম্পর্কে কৌতূহল আরও বেশী। ঐ স্বর্ণকেশিনী স্ত্রীলোকটি নদীর জলে পা ধুয়ে যখন ওপরে উঠে আসে, তখন সকলেরই সে দৃশ্যটি যেন অলৌকিক বোধ হয়। অমন গাত্রবৰ্ণ মানুষের হয়? আর ঐ শিশু দুটি? ঠিক যেন দেব-শিশু!
বহুদিন পরে গ্রামে ফিরে মধুসূদন খুব আমোদে মেতে উঠলেন। খুড়ীমা জেষ্ঠীমা সম্প্রদায়ের যাঁরা এক সময় তাঁকে কোলে নিয়ে আদর করতেন, তাঁরা এখন দ্বিধায় সঙ্কোচে দূরে সরে থাকলেও মধুসূদন নিজে গিয়ে হাজির হন তাঁদের ঘরে। কারুকে ডেকে বলেন, আমায় ভয় পাচ্ছে খুড়ীমা? ছুঁয়ে দেবো। কিন্তু। তা হলেই তোমার জাত যাবে। কী সুন্দর খিচুড়ি রাঁধতে তুমি খুড়ীমা, এখন একদিন রোধে খাওয়াবে না? কারুর কাছে গিয়ে বলেন, ও জ্যাঠাইমা, এতদিন পর তোমার হাতের পায়েস খাবো বলে এলুম, আর তুমি মুখ লুকিয়ে রইলে? কখনো বা হেনরিয়েটাকে সঙ্গে করে কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে ঢুকে বলেন, কই গো, গাঁয়ে এলুম, তোমরা বউ বরণ কল্লে না? শাঁক বাজাও, বউয়ের সিথেয় সিঁদুর পরাও।
ছোট ছোট বালকদের ধরে ধরে কোলে পিঠে নিয়ে মধুসূদন বলেন, আয় বেটা, আমার মুখের এঁটো খাইয়ে তোর জাত মেরে দিই!
তিনি নিজেও যেন পুনরায় শিশু হয়ে গেলেন আটত্রিশ বছর বয়েসে।
কিছুদিন নিজের গ্রামে বাস করে মধুসূদন বেড়াতে গেলেন কাটিগ্রামে মামার বাড়িতে। জাহ্নবী দেবীর ভ্রাতা বংশীধর ঘোষ এখনো জীবিত রয়েছেন এবং তাঁর সংসারের অনেক শ্ৰীবৃদ্ধি হয়েছে। এতকাল পরে ভাগিনেয়কে দেখে তিনি একেবারে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লেন। মধুসূদনের প্রভূত খ্যাতির কথা পৌঁছেছে তাঁর কানে। তিনি জাতপাত তেমন মানেন না। মধুসূদনের হাত ধরে একেবারে নিজের শয়নকক্ষে নিয়ে গিয়ে একটি পালঙ্ক দেখিয়ে বললেন, ছোট্টবেলায় এই খাটে তোর মা আর আমি দুই ভাই-বোনে শুতাম, তুই এইখানে বোস, মধু!
মামা-ভাগ্নেতে অনেক সুখ-দুঃখের কথা হলো।
বংশীধর ঘোষ তাঁর বাড়ির লোকেদের হুকুম দিয়ে দিলেন, তাঁর এই বিখ্যাত ভাগিনেয়কে সমস্ত আহার্য দ্রব্য পরিবেশন করা হবে স্বর্ণপাত্রে। সেই জন্য সিন্দুক খুলে সোনার থালা, ঘটি-বাটি-গেলাস বার করা হলো। কিন্তু অন্তঃপুরের মহিলারা অতখানি উদার হতে পারেন না, তাঁদের ধারণা, খ্ৰীষ্টান মধুসূদন ছুঁয়ে দিলে সেই সব স্বৰ্ণপাত্র আর কেউ ব্যবহার করতে পারবে না। তাই গৃহকর্তার অগোচরে অন্য ব্যবস্থা হলো। বংশীধর হঠাৎ এক সময় দেখে ফেললেন, এক ভৃত্য স্বৰ্ণ-গাড়ুর বদলে মাটির কলসী থেকে জল ঢেলে দিচ্ছে মধুসূদনের হস্ত প্ৰক্ষালনের জন্য। ক্ৰোধে উন্মাদ হয়ে ছুটে এসে তিনি এত জোরে এ লাথি মারলেন যে মুছিত হয়ে গেল ভৃত্যটি। মহিলাদের উদ্দেশ করে তিনি বলতে লাগলেন, ছিঃ, এত নীচু মন তোমাদের? না হয় একসেট সোনার বাসনই নষ্ট হতো। আমার ভাগ্নের জন্য আমি এটুকু পারি না?
মধুসূদন মামার হাত ধরে তাঁকে থামিয়ে বললেন, মামা, করেন কী! করেন কী! মাটিতে আসন-পিঁড়ি হয়ে বসে কলাপাতায় চাট্টি গরম ভাত খেতেই যে আমার সব চেয়ে বেশী আনন্দ হয়! সেই আনন্দ থেকে আমায় বঞ্চিত করেন কেন?
মুর্ছিত ভৃত্যটিকে নিজে সেবা করলেন মধুসূদন, তারপর তাকে দশটি টাকা দিলেন।
মামাবাড়ি থেকে আবার সাগরদাঁড়িতে ফেরা হলো। মধুসূদনের বেশী সময় কাটে নদীতীরে। নদীর ঘাটিলায় বসে তিনি কপোতাক্ষীর দিকে চেয়ে বসে থাকেন, দেখে দেখে যেন আশ মেটে না। নৌকোয় করে যারা যায়, তাদের সঙ্গে তিনি ডেকে ডেকে কথা বলেন। তারা কেউ তাঁকে কবি হিসেবে চেনে না। কিন্তু কোনো জমিদারকে এমন সহজ আন্তরিকভাবে কথা বলতে তারা কখনো শোনে নি।
হেনরিয়েটার স্বাস্থ্য ভালো যাচ্ছে না বলে এবার এখান থেকে বিদায় নিতে হবে। শেষবারের মতন বাল্যসঙ্গী নদীটিকে সম্বোধন করে বললেন, কপোতাক্ষ, যে তোমার তীরে পাতার কুটীর বেঁধে বাস করতে পায়, সেও পরম সুখী। একদিন আমি আবার ফিরে আসবো। তোমার কাছেই থাকবো। আমায় ভুলে যেও না।
কলকাতায় ফিরেই মধুসূদন একদিন বন্ধুদের ডেকে বললেন, তিনি বিলাতে যাবেন। কৈশোরের সেই স্বপ্ন! অ্যালবিয়ানস ডিসট্যাণ্ট শোর কতবার তাঁকে ডেকেছে, এই তো সময় সেই সাধ চরিতার্থ করার।
রাজনারায়ণ বললেন, সে কি, মধু! গ্রন্থকার হিসেবে তোর কত খ্যাতি হয়েছে, লোকেরা একবাক্যে তোকে বঙ্গের শ্রেষ্ঠ কবি বলে মেনে নিয়েছে। কেউ বলে তুই বঙ্গের মিলটন। কেউ বা বলে তুই ভারতের নব কালিদাস। এখন পাঠকরা তোর কাঁচ থেকে আরও কত প্ৰত্যাশা করে। এই সময় তুই দেশ ছেড়ে চলে যাবি?
মধুসূদন বললেন, সার্থকতা পেয়েছি বলেই তো এখন ছেড়ে যেতে পারি! এসিচি, লিখিচি, জয় করিচি! বঙ্গ সরস্বতীকে দিয়িচি অমিত্ৰাক্ষর ছন্দ, তিনি গলায় মালা করে পরেছেন। যদি ব্যর্থ হতুম, তা হলে মোটেই পালাতুম না। আরও আরও চেষ্টা করে দেশের জন্য কিচু না কিচু দিয়ে যেতুম। এখন আমি যেতে পারি বিজয়ী বীরের মতন।
কোনো বন্ধুর পরামর্শই গ্রহণ করলেন না মধুসূদন। তিনি যাবেনই। তাঁর প্রধান যুক্তি, এ রকম বসে বসে খেলে বিপুল পিতৃ-সম্পত্তিও তিনি দুদিনে উড়িয়ে দেবেন। এ দেশে কাব্য লিখে তো আর সংসার চলে না! সুতরাং রোজগারের জন্যই তিনি লণ্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে আসবেন।
বিষয়সম্পত্তি সব গচ্ছিত করা হলো মহাদেব সরকার নামে এক ব্যক্তির কাছে। সে মধুসূদনের বিলাতে পড়ার খরচ পাঠাবে এবং মাসে মাসে কলকাতায় হেনরিয়েটাকে দেবে দেড় শো টাকা। মধুসূদনের সব কিছুই তড়িঘড়ি, অর্থের ব্যবস্থা হওয়া মাত্র তিনি টিকিট কিনে ফেললেন জাহাজের।
বন্ধুদের মনের মধ্যে একটা ভয় সব সময় উঁকি মারে। কিন্তু কুসংস্কার মনে হবে, এই জন্য কেউ কারুকে মুখ ফুটে বলেন না। রামমোহন, দ্বারকানাথ ঠাকুর কেউই বিলেতে গিয়ে আর ফিরতে পারেননি। তারপর অবশ্য অনেকে গিয়েছে এবং ফিরেও এসেছে, তবু, ঐ দুটি মানুষের কথাই বেশী করে। মনে পড়ে। ওঁদের দু জনের পর বিখ্যাত ব্যক্তি হিসেবে মধুসূদনই তৃতীয়।
মধুসূদন নিজেও এই কথাটা বোঝেন এবং সেই জন্যই তাঁর বন্ধুদের বলেন, তোরা কিছু চিন্তা করিস নি। আমি ঠিক ফিরে আসবো। কিন্তু তোরা আমায় মনে রাকবি তো? চক্ষের আড়াল হলেই কি এ দেশের মানুষ আমায় ভুলে যাবে?
আগামী কাল ক্যাণ্ডিয়া জাহাজ ছাড়বে।–সন্ধ্যার সময় মধুসূদন নিজ বাসভবনে বন্ধু-বান্ধব ও কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে পান-ভোজনের জন্য.ডেকেছেন। নানা রকম হাসা পরিহাস হচ্ছে, এর মধ্যে এক সময় গঙ্গানারায়ণ মধুসূদনকে ডেকে বললেন, মধু, তুই যে আমাদেরকে ছেড়ে চলে যাচ্চিস, তোর মন কেমন কচ্চে না? তুই এত হাসতে পাচ্চিস কী করে?
মধুসূদন বললেন, একটা নতুন কবিতা লিকিচি, তুই শুনবি, গঙ্গা?
গঙ্গানারায়ণ বললো, শুধু আমায় কেন, সকলকেই পড়ে শোনা না? তোর নতুন কবিতা!
সকলে নিঃশব্দে একাগ্র হলে মধুসূদন কুর্তার পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে বললেন, বায়রণের সেই লাইন মনে আচে? মই নেটিভ ল্যাণ্ড গুড নাইট! সেই মর্মে আমি এটা লিকিচি, আপনারা শুনুন।
রেখো মা দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে
সাধিতে মনের সাধ ঘটে যদি পরমাদ
মধুহীন করো না গো তব মনঃ কোকনদে…