বিশাল পদ্মানদীর এপার ওপার দেখা যায় না। চৈত্র মাসের আকাশে কোথাও কোথাও গুচ্ছ গুচ্ছ। মেঘ জমেছে, যে-কোনও সময় ঝড়ের সম্ভাবনা। ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ঢেউ ভাঙছে স্টিমারের গায়ে। স্টিমারের ডেকে দাঁড়িয়ে আছেন স্বামী বিবেকানন্দ। নদীর এমন রূপ আর কোন দেশে দেখা যায়? স্বামীজিও এর আগে পূর্ববঙ্গে আসেননি।
নদীতে মোচার খোলার মতন দুলছে প্রচুর জেলে ডিঙি, মাছ ধরা চলছে। এখন ইলিশের সময়, সরস্বতী পুজো পার হয়ে গেলে ইলিশ ভোলা শুরু হয়। স্টিমারের প্রায় লাগোয়া কয়েকটি নৌকোয় উঠছে ইলিশ মাছ, জাল টেনে তোলার পর ইলিশ একবার দুবার লাফিয়েই নিস্পন্দ হয়ে যায়। এ মাছ বড় স্পর্শকাতর, জল থেকে তোলার পর ওপরের বাতাসে কয়েক মুহূর্তের বেশি বাঁচে না। স্বামী বিবেকানন্দ এরকমভাবে, এত কাছ থেকে মাছ ধরা কখনও দেখেননি, জীবন্ত ইলিশ দর্শন করা তো দুর্লভ সৌভাগ্যের ব্যাপার। মাছের কী রূপ, যেন ঝকঝকে একটা রূপোর পাত। যেন নদীর অলঙ্কার।
অনেক মাছই স্বামীজির প্রিয়, বিশেষত ইলিশ। শরীর ভাল নেই, চিকিৎসকরা খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে অনেক বিধিনিষেধ জারি করেছেন। শরীরটা কিছুতেই সারছে না, মাঝে মাঝেই শ্বাসকষ্ট হয়, হাঁপানির টান ওঠে। তা বলে কি এমন টাটকা ও নিখুঁত গড়নের ইলিশ দেখে লোভ সংবরণ করা। যায়!
পাশের এক শিষ্যকে বললেন, ওরে কানাই, গোটাকতক ইলিশ কেন না! বেশ পাতলা ঝোল হবে। দু-একখানা পেটির মাছ ভাজা!
শিষ্য কুণ্ঠিতভাবে বলল, আপনার কি ইলিশ সহ্য হবে?
স্বামীজি বললেন, সহ্য হবে কি না আমি বুঝব। চোখের সামনে এমন ইলিশ দেখেও কেউ চলে যেতে পারে? তোরা দর করতে গেলে দাম বেশি চাইবে, ভাববে বিদেশি লোক, সারেঙসাহেবকে বল, তিনি ঠিক দর জানবেন।
এই ইলিশের স্বাদ গ্রহণের ইচ্ছে আরও অনেকের ছিল, স্বামীজির স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে কেউ মুখ খোলেনি। এবার কয়েকজন মহা উৎসাহে গিয়ে সারেঙকে ধরল। সারেঙসাহেব ভোঁপ ভোঁপ শব্দে কয়েকবার সিটি বাজিয়ে জেলে ডিঙিগুলোকে সচকিত করলেন, তারপর হাতছানি দিয়ে দু-তিনজনকে কাছে ডাকলেন।
অনেক দর কষাকষির পর ঠিক হল, চার পয়সায় এক একটি ইলিশ পাওয়া যেতে পারে। বেশ বড় বড় মাছ, কোনওটারই ওজন দেড় সের, পৌনে দু সেরের কম নয়। স্বামীজির সঙ্গী দলটিতে রয়েছে সাত আটজন, কানাই তাই বলল, তিনটি কিংবা চারটি কিনি, তাতেই কুলিয়ে যাবে।
স্বামীজি ধমক দিয়ে বললেন, দূর বোকা, আমরা কজনে মিলে খাব, আর এই স্টিমারের খালাসি-মাল্লারা চেয়ে চেয়ে দেখবে? কিপটেমি করিসনি, পুরো এক টাকা দিয়ে গোটা ষোলো মাছ কিনে ফেল, আজ সকলে মিলে ভোজ হবে।
নৌকো থেকে বেছে বেছে মাছ ভোলা হচ্ছে, স্বামীজি মুগ্ধভাবে দেখছেন। একসময় অন্যমনস্কভাবে হাত বাড়িয়ে বললেন, ওরে কানাই, তামাক দে।
কানাই দৌড়ে গিয়ে হুঁকো-কন্ধে সেজে নিয়ে এল।
দ্বিতীয়বার স্বামীজি আমেরিকা গিয়েছিলেন প্রধানত মিশনের কাজের জন্য অর্থ সংগ্রহ ও নিজের চিকিৎসা করাবার জন্য। কোনওটাতেই বিশেষ সফল হননি। জোসেফিন কত যত্ন করেছে, ডাক্তার হেলমার নামে একজন বড় চিকিৎসককে ডেকে এনে দেখিয়েছে। ডাক্তার হেলমারের মতে, বহুমূত্র ও হাঁপানি ছাড়াও স্বামীজির হৃৎপিণ্ড ও মূত্রাশয়ও কিছুটা জখম হয়েছে, তবে তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন এখনও নিরাময়ের অতীত নয়, তিনি স্বামীজিকে আগেকার মতন সুস্থ করে তুলতে পারবেন। কই পারলেন না তো! অবশ্য সেরকম বিশ্রামও নেওয়া হল না। ডাক্তার বলেছিলেন, ধুমপান আস্তে আস্তে কমিয়ে একেবারে ছেড়ে দিতে হবে। স্বামীজি ছাড়তে পারেননি। কখনও উত্তেজিত বা প্রফুল্ল বোধ করলে, কিংবা গভীর চিন্তার সময় ধূমপানের জন্য অন্তরাত্মা ছটফট করে।
তামাক টানতে টানতে স্বামীজির আর একটি সাধ জাগল। ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে পুঁইশাক বড় তোফা হয়। অনেকদিন খাওয়া হয়নি। পুঁইশাক পাওয়া যাবে কোথায়? স্টিমার ভেড়ানো হল এক গ্রামের ঘাটে, সেখান থেকে শুধু পুঁইশাক নয়, খুব ভাল জাতের চাল সংগ্রহ করা হল। ভূরিভোজের সময় স্বামীজি স্বয়ং সারেঙ ও মাল্লাদের আপ্যায়ন করে খাওয়াতে লাগলেন।
এই সব সময়ে শরীর খারাপের কথা একেবারেই মনে থাকে না। অনেকেই এই দেখে বিস্মিত হয়, আজ যে মানুষটি রোগে কাতর, পরদিন তিনিই কী করে সাগ্রহে চলে যান হিমালয়ে, কিংবা কোন শক্তিতে বক্তৃতা করেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, মঠের খুঁটিনাটি ব্যবস্থা পরিদর্শন করেন, পোষা পশুপাখিদের পরিচর্যা করেন নিজের হাতে!
খানিক বাদে বিশ্রম্ভালাপের সময় একজন কৌতুক করে বলল, স্বামীজি, আপনি খিচুড়ির গন্ধ পেয়ে বেলুড় মঠের গেট ডিঙিয়েছিলেন মনে আছে?
স্বামীজি হা-হা করে হেসে উঠে বললেন, খিচুড়ির গন্ধ পেয়ে, ঠিক বলেছিস! শুধু গেট ডিঙোনো নয়, আমেরিকা থেকেই লাফিয়ে চলে এসেছি।
বেশিদিন আগের কথা নয়, এবারে আমেরিকায় গিয়ে এক এক সময় এমন মনে হত যে বুঝি হঠাৎ মরেই যাবেন। তখন ব্যস্ত হয়ে ভাবতেন, যদি সেরকমই হয়, তা হলে স্বদেশে গিয়ে দেহরক্ষা করাই ভাল। আবার দু-একদিনের মধ্যে চাঙ্গা হয়ে উঠলে সে কথা মনে থাকত না। আমেরিকায় তাঁর সঙ্গিনী ধনী মহিলাদের ভ্রমণের নেশা, এ ছাড়া তাঁদের অন্য কাজও তেমন কিছু নেই। স্বামীজিও ভ্রমণে খুব উৎসাহী। আমেরিকা ছেড়ে তিনি প্যারিসে এলেন, সেখানে ধর্মমহাসভায় যোগ দেওয়ার ব্যাপার ছিল। শিকাগোর ধর্ম মহাসভার সঙ্গে অবশ্য এই মহাসভার কোনও তুলনাই চলে না। প্যারিসে বিখ্যাত গায়িকা শ্রীমতী কালভে মিশরে বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছা করে স্বামীজিকে আমন্ত্রণ জানালেন, স্বামীজিও সঙ্গে সঙ্গে রাজি।
ভ্রমণসূচি হল এইরকম : বিখ্যাত ওরিয়েন্টাল এক্সপ্রেস ট্রেনযোগে ভিয়েনা হয়ে কনস্টান্টিনোপল। তারপর জাহাজে গ্রিস, ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইজিপ্ট, সেখান থেকে এশিয়া মাইনর হয়ে জেরুজালেম। কিন্তু ইজিপ্ট ঘুরে দেখার সময় মন আবার উতলা হয়ে উঠল, শরীরও যেন। বইছে না। পথসঙ্গীরা যখন ইজিপ্ট ছেড়ে আবার অন্যত্র পাড়ি দেওয়ার কথা চিন্তা করছে, তখন স্বামীজি বললেন, তোমরা যদি কিছু না মনে করো, আমি এখান থেকেই দেশে ফিরে যেতে চাই। স্বামীজির ইচ্ছেতে কেউ বাধা দিতে চান না। কয়েকবার থেকে যাওয়ার অনুরোধ করে শ্রীমতী কালভে স্বামীজির জন্য ভারতমুখী জাহাজের প্রথম শ্রেণীর টিকিট কেটে দিলেন। স্বামীজির আর জেরুজালেম দেখা হল না।
প্রথমবার আমেরিকা থেকে ফেরার সময় অভ্যর্থনা জানাবার জন্য কী বিপুল জনসমাগম হয়েছিল, পথের বিভিন্ন নগরে কত সংবর্ধনার আয়োজন হয়েছিল। দ্বিতীয়বার এলেন নিঃশব্দে। বম্বের জাহাজঘাটায় যখন নামলেন, কেউ তাঁর জন্য দাঁড়িয়ে নেই, কেউ তাঁকে চেনে না। সাধারণ যাত্রীর মতন নিজের মালপত্র বয়ে নিয়ে রেল স্টেশনে গিয়ে কলকাতার ট্রেন ধরলেন। ট্রেনের কামরাতেও সাহেবি পোশাক পরা এই মানুষটির প্রকৃত পরিচয় কেউ জানতে পারল না, তিনি এক কোণে বসে আপনমনে চুরুট টানছিলেন। অনেকক্ষণ পর একজন বাঙালি ভদ্রলোক উঠে এসে জিজ্ঞেস করলেন, মাপ করবেন, আপনাকে চেনা চেনা লাগছে, আপনি কি মিস্টার নরেন দত্ত?
হাওড়া স্টেশনে পৌঁছবার পর অন্য কোথাও যাওয়ার চিন্তা না করে স্বামীজি একটা গাড়ি ডেকে সোজা চলে এলেন বেলুড় মঠে। তখন সন্ধে হয়ে এসেছে। দিনাবসানে মঠের বাগানের গেটে তালা পড়ে যায়। বাগানের মালি দূর থেকে দেখে ভাবল, সত্যি বুঝি এক সাহেব এসেছে, সে ভয় পেয়ে ছুটে গেল ভেতরে খবর দিতে। স্বামীজি শুনতে পেলেন, ভেতরে ঘণ্টা বাজছে। তিনি বুঝতে পারলেন, মঠবাসীরা এখন সবাই মিলে খেতে বসবে। তাঁর আর তালা খোলবার সবুর সইল না। গেট বেয়ে উঠে লাফিয়ে পার হয়ে দ্রুত পদে তিনি চলে এলেন খাওয়ার ঘরে।
মঠবাসীরা হতভম্ব। প্রথমে অনেকে চিনতেই পারল না, গুরুভাইরা চিনতে পেরেও যেন নিজেদের চক্ষুকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। সবাই জানে, স্বামী বিবেকানন্দ এখন বিদেশে রয়েছেন, বিনা আড়ম্বরে, বিনা অভ্যর্থনায় তিনি সশরীরে এখানে উপস্থিত, এও কী হতে পারে। সঙ্গীসাথী কেউ নেই, জয়ধ্বনি নেই!
স্বামীজি হাতে হাত ঘষে বললেন, আঃ চমৎকার খিচুড়ির গন্ধ বেরিয়েছে। শেষ হয়ে গেল নাকি? ওরে দে দে, আমার জন্য একটা পাত পেড়ে দে! কাঁচালঙ্কা আছে তো? কতদিন খিচুড়ি খাইনি!
দ্বিতীয়বারের ফেরাটা যে একেবারে অন্যরকম হয়েছে, শুধু তাই নয়, দ্বিতীয়বার আমেরিকায় গিয়ে তাঁর কিছু কিছু মোহভঙ্গও হয়েছে। প্রথমবার সে দেশের সমৃদ্ধির ভাল দিকগুলিই চোখে পড়েছিল। অনেক কিছু দেখেই চমক লাগত। এবারে সেই বিস্ময়বোধ ছিল না, তিনি দেখতে পেয়েছিলেন ওই সমৃদ্ধির মূলে আছে শোষণ। আমেরিকানরা পরিশ্রমী ও উদ্যমী জাত, উদ্ভাবনী শক্তিও আছে, সেই সঙ্গে আছে লোভ ও স্বার্থপরতা। মানবিক সম্পর্কের চেয়েও বেশি প্রকট ব্যবসাদারি মনোভাব। ছোট ছোট কারবারিদের গিলে খায় বড় বড় কারবারিরা।
সতীর্থ ও শিষ্যদের কাছে এবারের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে করতে স্বামীজি এক এবার বিরক্তিতে। বলে ওঠেন, নরক, নরক!
অবশ্য স্বামীজি ওদেশে অনেক উন্নতমনা, সদাশয় বন্ধুও পেয়েছেন। সেরকম বন্ধু অতি দুর্লভ।
স্টিমার একসময় পৌঁছে গেল নারায়ণগঞ্জ। আগে থেকেই খবর জানা ছিল বলে এখানে বেশ কিছ নোক স্বাগত জানাবার জন্য উপস্থিত। নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্রেনে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঢাকা আসা যায়, সেখানে এক জমিদারের বাড়িতে সদলবলে স্বামীজির আতিথ্যের ব্যবস্থা হয়েছে।
ঢাকায় পৌঁছেই স্বামীজি কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার মা এসেছেন?
খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, স্বামীজির মা এসে পৌঁছবেন আরও দু দিন পরে। স্বামী ব্রহ্মানন্দ সব ব্যবস্থা করেছেন।
পূর্ববঙ্গে স্বামীজি বিশেষ কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে আসেননি। খানিকটা ভ্রমণ, খানিকটা মায়ের সাধপূরণ। সন্ন্যাসী হয়েও নরেন্দ্রনাথ পূর্বাশ্রমের সঙ্গে সম্পর্ক পুরোপুরি ত্যাগ করেননি। মায়ের প্রতি তাঁর বরাবর দুর্বলতা। যে মানুষ নিজের মাকে ভালবাসে না, মাতৃস্নেহ উপেক্ষা করে, তার পক্ষে কি মানুষের সেবা করা সম্ভব! মায়ের অনেক বয়েস হয়েছে, তিনি যাতে কষ্ট না পান সেদিকে স্বামীজি সবসময় লক্ষ রাখেন। শ্রীমতী ম্যাকলাউড স্বামীজির হাতখরচের জন্য প্রতি মাসে পঞ্চাশ ডলার দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন, তিনি মাঝে মাঝে আরও টাকা দিয়ে সাহায্য করেন, স্বামীজি তার থেকে মায়ের জন্য একশো টাকা ও এক বোনের জন্য পঞ্চাশ টাকা মাসোহারা পাঠান।
দেশে ফিরে পরপর অতি প্রিয় দুজনের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে স্বামীজি খুব আঘাত পেয়েছেন। সস্ত্রীক শ্রীযুক্ত সেভিয়ার হিমালয়ের মায়াবতীতে আশ্রম স্থাপন করেছিলেন, তিনি হিন্দুত্ব বরণ করে বেদান্ত প্রচারের বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। সেভিয়ারের অসুস্থতার সংবাদ স্বামীজি বিদেশে থাকতেই পেয়েছিলেন, কিন্তু প্রত্যাবর্তনের আগেই সেভিয়ার শেষনিশ্বাস ফেলেছেন। শ্রীমতী সেভিয়ারকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও স্বামীজি চলে গেলেন হিমালয়ে।
খেতরির রাজা অজিত সিং নরেন্দ্রনাথ থেকে স্বামী বিবেকানন্দের উত্তরণে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন। স্বামীজির অকৃত্রিম ভক্ত হিসেবে তিনি কতভাবে যে সাহায্য করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। সেই খেতরির রাজার কী মর্মান্তিকভাবে মৃত্যু ঘটে গেল! সেকেন্দ্রায় সম্রাট আকবরের সমাধিভবনটি একটি শিল্পমণ্ডিত স্থাপত্য, রক্ষণাবেক্ষণের অমনোযোগে সেটি জরাজীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। অজিত সিং নিজ ব্যয়ে সেটি সংস্কারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, শুধু তাই নয়, অত্যুৎসাহী হয়ে তিনি মেরামতির কাজ নিজে দেখতে যেতেন। একদিন তিনি একটা সুউচ্চ গম্বুজের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন, এমন সময় দমকা বাতাস উঠল, সেই বাতাসের ধাক্কায় রাজা পড়ে গেলেন কয়েকশো ফুট নীচে।
এই দুজনের মৃত্যুশোক স্বামীজির বুকে খুব জোর ধাক্কা দিয়েছিল। শরীর দুর্বল থাকলে মনও দুর্বল হয়ে যায়। বাইরে ঘোরাঘুরি করলে তবু কিছুটা ভাল থাকেন, বেলুড় মঠে থাকতে শুরু করলেই স্বাস্থ্য ভাঙে। মঠের পরিচালন ব্যবস্থা থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে নিয়েছেন। কার্যত তাঁর কথাতেই সব চলে বটে, কিন্তু আইনত তাঁর নাম আর কোথাও নেই। কিছুদিন আগে পর্যন্ত স্থানীয় মিউনিসিপ্যালিটি বেলুড় মঠ ও সংলগ্ন জমিকে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সম্পত্তি বলে গণ্য করেনি, খাতায়পত্রে এসব ছিল নরেন দত্তর বাগানবাড়ি। সম্প্রতি স্বামীজি কয়েকজনের নামে ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে তাদের নামে সব সম্পত্তি তুলে দিয়েছেন, ব্রহ্মানন্দ সেই ট্রাস্টের সভাপতি।
শরীর ভাল থাকে না বলেই মাঝে মাঝে মঠ ছেড়ে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে হয়। পূর্ববঙ্গ আসাম কখনও দেখা হয়নি, এর মধ্যে মা একবার তীর্থদর্শনের ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। মায়ের এই শেষ বয়েসের সাধ আর অপূর্ণ থাকে কেন!
ব্রহ্মপুত্রের তীরে লাঙ্গলবন্ধ একটি বিখ্যাত তীর্থ। বুধাষ্টমীর সময় এখানে পুণ্যস্নানে বহু দূর দূর থেকে মানুষ আসে। কথিত আছে যে পরশুরাম এখানে স্নান করে মাতৃবধের পাপ থেকে উদ্ধার পেয়েছিলেন। এই লাঙ্গলবন্ধে এবার এক গৃহী মাতা ও তাঁর সন্ন্যাসী পুত্র একসঙ্গে স্নান করবেন।
ঢেঁকি-পাড়ানিকে যেমন স্বর্গে গিয়েও ধান ভানতে হয়, তেমনই স্বামী বিবেকানন্দ যেখানেই যাবেন, বক্তৃতা না দিলে ছাড়াছুড়িন নেই। ঢাকাতেও অনেকে তাঁকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য চেপে ধরল, শারীরিক অসুস্থতার কথা কেউ গ্রাহ্যই করে না। স্বামীজি বললেন, দাঁড়া বাবা দাঁড়া, একটু জিরিয়ে নিই, মাকে নিয়ে তীর্থস্থানটা ঘুরে আসি, তারপর ঢাকায় থাকব দু-চারদিন।
মা একা এলেন না, সঙ্গে তাঁর মেয়ে, এক বোন ও আর কয়েকজন মহিলা। একটা বড় নৌকো ভাড়া করে স্বামীজি সকলকে নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন। বুড়িগঙ্গা নদী ধরে কিছুটা গেলে নারায়ণগঞ্জের কাছে শীতলক্ষা নদীতে পড়া গেল। সেই নদী থেকে ধলেশ্বরী, তারপর ব্রহ্মপুত্র। নদীমাতৃক দেশ, চতুর্দিকেই জল, মাঝে মাঝে দ্বীপের মতন এক একটি গ্রাম। জলের এই রূপ দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। এ দলের অধিকাংশই কলকাতার মানুষ, কখনও নৌকায় বেশি দূরের পথ পাড়ি দেয়নি, তাদের কাছে এ এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।
লাঙ্গলবন্ধে পৌঁছে কিন্তু আবার অন্যরকম হয়ে গেল। তীর্থস্থানগুলিতে সৌন্দর্যের বদলে কুশ্রীতাই প্রকট। লক্ষ মানুষের ভিড় এখানে, চতুর্দিকে কোলাহল এবং আবর্জনা। এটা ব্রহ্মপুত্রের মূল ধারা নয়, পুরনো খাত, জল খুবই অগভীর, পারে থিকথিক করছে কাদা। তীর্থযাত্রীরা অস্থায়ী উনুনে রান্না করে খাচ্ছে, ধোঁয়া ও এঁটোকাঁটা ছড়ানো। এরকম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে যখন তখন কলেরা শুরু হয়ে যেতে পারে। জল এত ময়লা যে তাতে স্নান করতেই ভক্তি হয় না, এখানে স্নান করলে পুণ্য অর্জন হবে, এরকম বিশ্বাস করাই শক্ত, তবু অনেকে বিশ্বাস করে। জানার
স্বামীজি পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে খুব পিটপিটে। ঘাটের অবস্থা দেখে তিনি সবাইকেই সাবধান করে দিলেন। এখানকার জল কারুর খাওয়া চলবে না। অনেকে পুণ্য সলিল মনে করে ঘটিবাটিতে তুলে তুলে জল খাচ্ছে, কেউ কেউ বোতলে ভরে নিয়ে যাচ্ছে। সরকার থেকে কাছেই একটা টিউবওয়েল তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, সেদিকে কারুর ভুক্ষেপ নেই। স্বামীজি নির্দেশ দিলেন, ওই টিউবওয়েলের জল সকলকে পান করতে হবে, মানান্তে ওই জলেই ভাল করে ধুয়ে নিতে হবে হাত-পা।
পুজো সেরে নিয়ে স্বামীজি সবাইকে নিয়ে নদীতে নামলেন। সযত্নে জননীর হাত ধরে বললেন, আমার সঙ্গে এসো মা, পারের কাছটা বড় নোংরা, মাঝনদীতে তোমাকে ডুব দেওয়াব।
মা বললেন, ওরে বিলে, আমি তো সাঁতার জানি না, ডুবে যাব না তো রে!
স্বামীজি বললেন, মা, আমি খুব ভাল সাঁতার জানি। হেদোতে কত সাঁতার কাটতুম তোমার মনে নেই?
মা হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।
কত স্বামীজি ব্যস্ত হয়ে বললেন, কী হল, কী হল, পায়ে তোমার কিছু ফুটেছে?
মা বললেন, তা নয় রে। আজ আমার বড় সুখ। তুই আমার হাত ধরেছিস। ভেবেছিলাম আমার এই ছেলেটা জন্মের মতো হারিয়ে গেল–
স্বামীজি বললেন, হারাব কেন মা! আমি তো মনে মনে একদণ্ডও তোমাকে ছাড়িনি। আমি তোমার কাছেই আছি।
মা বললেন, দূর বিদেশে গিয়ে বছরের পর বছর থাকিস, কোনও খবর পাই না। আবার কোথাও চলে যাবি না তো?
স্বামীজি বললেন, নাঃ, আর কোথাও যাব না!
লোকজনের ভিড় থেকে সরে এসে মধ্যনদীতে মাকে কয়েকটি ডুব দেওয়ালেন স্বামীজি। তারপর সাবধানে তাঁকে তীরে পৌঁছে দিয়ে নিজে কিছুক্ষণ সাঁতার কাটলেন। এখানেও তাঁকে কেউ চেনে না, মনে করেছে আরও অনেকের মতন একজন গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী। আগেকার মতন সাঁতার কাটার আর দম নেই। পা ভারী হয়ে গেল, একটুক্ষণের মধ্যেই তিনি হাঁপিয়ে গেলেন।
তীর্থস্থানে বেশিক্ষণ না থেকে শুরু হল ফেরার পথে যাত্রা। নৌকো চলতে শুরু করার পর স্বামীজি জনে জনে জিজ্ঞেস করলেন, কেউ নদীর জল একফোঁটাও খাওনি তো? সত্যি করে বললো!
সবাই দৃঢ়বাক্যে স্বীকার করল, তারা অক্ষরে অক্ষরে স্বামীজির নির্দেশ পালন করেছে।
স্বামীজি মুচকি হেসে বললেন, আমি কিন্তু ডুব দিয়ে এক ঢোঁক জল খেয়ে নিয়েছি। কী জানি বাবা, কোথা দিয়ে পুণ্য ঢুকে পড়ে কে জানে! যদি এই জলে আমার হাঁপানিটা সেরে যায়।
তাঁর বলার ভঙ্গি দেখে সবাই হেসে গড়াগড়ি যেতে লাগল।
ঢাকায় ফিরে আবার চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ তীর্থে যাওয়ার কথা। সেখান থেকে আসামের কামাখ্যা। কিন্তু এর মধ্যেই ঢাকার ভক্তরা কয়েকটি বক্তৃতার আয়োজন করে ফেলেছে। সুতরাং কয়েকদিন থেকে যেতেই হবে। একদিন জগন্নাথ কলেজে আর একদিন পাগোজ স্কুলের প্রাঙ্গণে দীর্ঘ বক্তৃতা দিতে হল। তাও ইংরেজিতে। সাধারণ লোক সব বুঝুক না বুঝুক, তারা ইংরেজিতেই শুনতে চায়, ইংরেজি না হলে উচ্চাঙ্গের কিছু বলে মনে হয় না।
ইংরেজি বলা সাধুর নামও ছড়ায় তাড়াতাড়ি। স্বামীজির ঢাকায় আগমনের খবর খুব বেশি লোক জানত না, এই বক্তৃতার ফলে বহু লোক জানল, তারা দলে দলে ছুটে এল তাঁর বাসভবনে। বিভিন্ন জনের বিভিন্ন রকম প্রশ্ন, কেউ উপদেশ চায়, কেউ চায় সান্ত্বনা। সারাদিন জনসমাগম লেগেই আছে, কথা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে যান স্বামীজি, তবু নিস্তার নেই।
একদিন অনেক লোকের সঙ্গে কথা সেরে দুপুরবেলা স্নানাহারের জন্য যাওয়ার আগে দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন স্বামীজি। নীচে একটি ফিটন গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, তার সামনে কয়েকজন লোক উত্তেজিতভাবে কী যেন বলছে। এ গৃহের একজন কতা একটি লাঠি তুলে ভয় দেখাচ্ছেন যেন কাকে। স্বামীজি কৌতূহলভরে ওপর থেকে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে রে কানাই?
কানাই বলল, ও কিছু নয়। আপনি ভেতরে যান। ফিটন গাড়ি থেকে এক রমণী মুখ বার করে ওপরের দিকে তাকাল। সেই মুখোনি দেখেই স্বামীজি ব্যাপারটি বুঝতে পারলেন। সে মুখ কোনও সাধারণ গৃহস্থ রমণীর নয়। গাল গোলাপি বর্ণে রঞ্জিত, ভুরুতে কাজল, চোখ দুটিতে সুর্মা টানা, দৃষ্টিও কেমন ভাসা ভাসা। এ রমণী নিশ্চিত কোনও বাঈজি বা বারবনিতা।
এই কয়েক দিনে ঢাকা শহর সম্পর্কে পরিচিত হয়েছেন স্বামীজি। কলকাতার চেয়েও অনেক পুরনো শহর এই ঢাকা, তবু এখানে গ্রামীণ ও নাগরিক সভ্যতা এখনও সহাবস্থান করে আছে। কিছু কিছু পাকা বাড়ির পাশাপাশি প্রচুর খোলার ঘর ও বস্তি। বুড়িগঙ্গার ধারে অনেকগুলি সুদৃশ্য অট্টালিকা আছে জমিদার, অভিজাত ও ব্যবসায়ীদের, নদীবক্ষ থেকে ওই সব প্রাসাদমালা দেখে মুগ্ধবোধ হলেও ভেতরে ভেতরে রয়ে গেছে অনেক নোংরা ও কদর্য স্থান। রমনা নামে স্থানে ঢাকেশ্বরীর একটি অতি প্রাচীন মন্দির আছে, কিন্তু সে স্থানে এমনই গভীর জঙ্গল যে বন্য জীবজন্তুর ডাক শোনা যায় দিনেদুপুরে।
এ শহরে হিন্দুর চেয়ে মুসলমানের সংখ্যা কিছু বেশি। মুসলমানদের মধ্যে কিছু অতিশয় ধনী ও অভিজাত থাকলেও অধিকসংখ্যকই অতি দরিদ্র ও শ্রমজীবী। সে তুলনায় হিন্দুদের মধ্যে একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠেছে। তবে মহররম, ইদ, জন্মাষ্টমী ও দুর্গোৎসবে হিন্দু মুসলমান মিলেমিশে যোগদান করে।
শহরতলীর দিকে ওয়ারি নামে এক অঞ্চলের জঙ্গল সাফ করে নতুন নতুন ঘরবাড়ি নির্মিত হচ্ছে প্রধানত সরকারি কর্মচারীদের জন্য। সরকার নগরায়ণে উৎসাহ দেওয়ার জন্য ঋণও দিচ্ছে। সেই নতুন ঢাকায় এক বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছিলেন স্বামীজির দুই সঙ্গী। ফেরার সময় রাত্রি হয়ে যায়, পথ হারিয়ে তাঁরা কোনদিকে গিয়ে পড়েছিলেন ঠিক নেই, হঠাৎ যেন দেখতে পেলেন আলো ঝলমল এক মায়াপুরী, ঘরে ঘরে শোনা যাচ্ছে নূপুরের নিক্কণ, হাসির হররা, উন্মত্ত হুল্লোড়, আলুথালু বেশে এক বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে এল এক যুবতী, তাকে তাড়া করে এল দুজন পুরুষ। সেই দৃশ্য দেখে সন্ন্যাসীদ্বয় চোঁ-চা দৌড় লাগিয়েছিলেন।
পরে তাঁদের মুখে সেই ভয়কাহিনী শুনে হেসেছিলেন স্বামীজি। সব শহরেই কিছু অতিরিক্ত অর্থবান ও বাবু শ্রেণীর লোক থাকে, প্রমোদ বিলাসিতা ছাড়া যারা অন্য কিছু জানে না। জমিদাররা প্রজার অর্থ শোষণ করে নিজেদের ভোগবাসনার জন্য অজস্র ব্যয় করে। তাদের লালসা মেটাবার জন্যই অজস্র সাধারণ ঘরের মেয়েদের বারবনিতায় পরিণত করা হয়। স্বামীজি নিজেও কায়রো শহরে ভুল করে এরকম এক পতিতাপল্লীতে গিয়ে পড়েছিলেন। ভয় পাওয়ার কী আছে? নিজেদের দোষে তো নয়, সমাজের দোষেই এরা পতিতা। অদ্ভুত এই পুরুষদের সমাজ। রাতেরবেলা যেসব রমণীদের কাছে পুরুষরা ছুটে যায়, দিনেরবেলা সেই রমণীদের দেখলেই দুর দুর ছাই ছাই করে। যেন তারা অস্পৃশ্য।
স্বামীজি বললেন, কানাই, যদি আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়, ওপরে পাঠিয়ে দে।
স্ত্রীলোক একজন নয়, দুজন। একজন বেশ বয়স্কা, অন্যজন পরিপূর্ণ যুবতী এবং অতীব। রূপসী। এই দিনের বেলাতেও তার সাজগোজের কিছুমাত্র ঘাটতি নেই। রূপোর চুমকি বসানো নীল রেশমের শাড়ি পরা, সবাঙ্গে হীরে-মুক্তোর গহনা। সে অবশ্য মুখোনি নত করে আছে। বোঝাই যায়, এরা মা ও মেয়ে।
মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম জানিয়ে বয়স্কা মহিলাটি বললেন, সাধু মহারাজ, বড় আশা করে আপনার কাছে এসেছি। আমরা অভাগিনি, আমাদের এরা ঢুকতে দিতে চাইছিল না, কিন্তু ভগবান কী অভাগিনিদের দয়া করেন না?
স্বামীজি স্মিতহাস্যেই চেয়ে রইলেন।
স্ত্রীলোকটি আবার বলল, এই আমার মেয়ে। বাইরে থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু মেয়ে আমার খুবই অসুস্থ। হাঁপানির টান এক-এক সময় এত অসহ্য হয় যে যন্ত্রণায় মাটিতে গড়াগড়ি করে। মা মা বলে কাঁদে। মহারাজ, আপনি একে উদ্ধার করুন।
স্বামীজি এবার একটু চওড়া করে হাসলেন। বাইরে থেকে বোঝা যায় না। তাঁকেও তো দেখে অনেকেই বোঝে না যে তিনি কত অসুস্থ। অনেকেই এখনও মনে করে, তাঁর শরীরে সিংহের বিক্রম!
তিনি মৃদু স্বরে বললেন, মা, আমি আপনার মেয়েকে কী করে উদ্ধার করব বলুন তো! আমি মানুষের মনের শুশ্রূষা করতে তবু কিছুটা পারি, মানুষের শরীরের রোগ সারাবার কোনও ক্ষমতা তো
আমার নেই। আমার গুরুরও ছিল না। আপনি ভুল সাধুর কাছে এসেছেন। [ স্ত্রীলোকটি বলল, না, না কী হয়! কত লোক বলাবলি করছে যে ঢাকায় মস্ত বড় এক সাধু এসেছেন। আমি ভিক্ষা চাইছি মহারাজ, এ মেয়ের কষ্ট চোখে দেখা যায় না। আপনি মন্ত্র পড়ে একটা ওষুধ দিন।
স্বামীজি বললেন, আমি কী ওষুধ দেব? সেরকম মন্ত্রও আমি জানি না। আমার নিজেরই হাঁপানির অসুখ আছে। সেটাই তো সারাবার হদিশ পেলাম না আজ পর্যন্ত!
স্ত্রীলোকটি অবিশ্বাসের সঙ্গে কান্না মেশানো দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন একটুক্ষণ। তারপর ধরা গলায় বললেন, প্রভু, আমাদের সঙ্গে ছলনা করছেন! সাধু-সন্ন্যাসীদের কখনও রোগভোগ হয় না।
স্বামীজি বললেন, মা, তা ঠিক নয়। সাধুরাও মানুষ। তাঁরাও রোগ-ভোগ, জরা-মৃত্যুর অধীন। তাঁদেরও সময় ফুরোলে দেহরক্ষা করতে হয়। নইলে তো অমর সাধুতে দেশটা ভরে যেত।
তবু মানতে চান সে রমণী, বারবার একই অনুরোধ করে যেতে লাগলেন। হাপুস নয়নে কেঁদে লুটোলেন মাটিতে। শেষ পর্যন্ত বললেন, মহারাজ, ওষুধ না দিন, আপনি আমার মেয়েকে ছুঁয়ে একবার আশীর্বাদ করে দিন, তাতেই কাজ হবে।
এতক্ষণ পর মেয়েটি বলল, মা, চলো, এখানে বসে থেকে ওঁকে বিরক্ত করে আর লাভ নেই। আমরা পাপী, উনি আমাদের স্পর্শ করবেন না।
স্বামীজি এবার ডান হাত তুলে মেয়েটির মাথায় রেখে বললেন, আমি আশীবাদ করলে যদি তোমার রোগ নিরাময় হয়, তা হলে সর্বান্তঃকরণে আশীবাদ করছি। সেই সঙ্গে আমার একটা অনুরোধ আছে। যদি অন্য কোনও সাধু কিংবা ডাক্তারবদ্যির কাছ থেকে সত্যিই হাঁপানির কোনও ওষুধ পাও, তা হলে আমাকেও একটু দিয়ে যেয়ো। আমিও ওই রোগে বড় কষ্ট পাই।
মা-মেয়ে প্রস্থান করার পর স্বামীজি বড় একটা নিশ্বাস ফেললেন। অনেকক্ষণ ধরে নম্র, ভদ্র ব্যবহার করারও একটা ক্লান্তি আছে। অবুঝদের কী করে বোঝানো যায়! সম্প্রতি এই এক উৎপাত শুরু হয়েছে। অনেকেই এসে কোনও না কোনও রোগের ওষুধ চায়। এদেশের মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিক তৃষ্ণা আর কতজনের, অধিকাংশই অলৌকিকত্বে বিশ্বাসী। তারা মনে করে, সাধু হলেই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হবে। যার অলৌকিক ক্ষমতা নেই, সে আবার সাধু কীসের?
কিছু কিছু সাধুর নামে নানান আষাঢ়ে গাল-গল্প ছড়ায় বলেই এই বিপত্তি।
স্বামীজি উঠতে যাচ্ছেন, দেখতে পেলেন দরজার কাছে দেওয়াল ঘেঁষে একটি যুবক দাঁড়িয়ে আছে। কখন সে ঢুকেছে তিনি খেয়াল করেননি। বেশ ছিপছিপে, ফর্সা, সুদর্শন ছোঁকরাটি, স্বামীজির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই হাত কপালে চুঁইয়ে বলল, আসোলামু আলাইকুম।
স্বামীজি বললেন, তোমার আবার কী চাই?
ছেলেটি লাজুক লাজুক ভাব করে বলল, তেমন কিছু না। আপনাকে একটু দেখতে এসেছি।
স্বামীজি এবার খানিকটা রুক্ষ স্বরে বললেন, এখন তো দেখার সময় নয়। তোমরা কি আমাকে খাওয়া-দাওয়া করতেও দেবে না। অনেক বেলা হয়ে গেছে।
যুবকটি বলল, আপনি খেয়েদেয়ে আসুন, আমি অপেক্ষা করব।
স্বামীজি বললেন, খাওয়ার পরেও আমি কিছুক্ষণ বিশ্রাম করব।
যুবকটি বলল, তা হলে বিকালবেলা… আমি থাকব ধারেকাছেই।
স্বামীজি আর ভুক্ষেপ না করে চলে গেলেন অন্দরমহলে। সারাদিন ধরে অনর্গল বকবক করতে হয়। মানুষকে ফেরাতেও ইচ্ছে করে না। গুরুর একটা কথা মনে পড়ে, একটাই তো ঢাক, তার আর কত বাজাবে! হঠাৎ ফেঁসে যাবে না!
স্বামীজি খেতে না বসলে মাও খাবেন না। বহুঁকাল বাদে মা আর ছেলে একসঙ্গে বসবেন খেতে, মা মাঝে মাঝে এক একটা গেরাস তুলে দেন ছেলের মুখে। শিশুর মতন আহ্লাদ হয় স্বামীজির। মায়ের সুখ দেখেই তাঁর সুখ।
খাওয়ার পর মাকে আগে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন, তারপর নিজে বিছানায় শুয়ে তামাক টানলেন কিছুক্ষণ। একসময় ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল। কোনওদিন তাঁর দিবানিদ্রার অভ্যেস ছিল না। এখন শরীর বিশ্রাম চায়।
বেশিক্ষণ ঘুমোলেন না। কীসের যেন একটা অস্বস্তি, হঠাৎ মনে পড়ল মুসলমান ছেলেটির কথা। সে কি এখনও বসে আছে?
তিনি উঠে চলে এলেন দোতলার বৈঠকখানায়। সে ঘরে আর কেউ নেই, ঠিক একই জায়গায় দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যুবকটি।
স্বামীজি কৌতূহলী হয়ে বললেন, কী ব্যাপার তোমার বলো তোকী চাও আমার কাছে?
যুবকটি আমতা আমতা করে বলল, কী চাই, মানে, কিছুই চাই না। হুজুর, আমার নাম আবদুল সাত্তার। পাগোজ স্কুলের ময়দানে আপনার বক্তৃতা শুনতে গিয়েছিলাম, আপনার সব কথা বুঝিনি, কিন্তু তারপর কী যে হল, খালি মনে হয়, আপনাকে আবার দেখি, আপনার কাছে বসে থাকি। আমি মুসলমান, আপনি হিন্দু সন্ন্যাসী, আপনার কাছে আমি কী কথাই বা বলতে পারি! অথচ মনে আমার অনেক প্রশ্ন।
স্বামীজি ফরাসের ওপর চাপড় মেরে বললেন, দাঁড়িয়ে আছ কেন? এখানে কাছে এসে বসো আবদুল। আমি শুধু হিন্দু সন্ন্যাসী তো নই, আমি ভারতীয় সন্ন্যাসী। বিদেশে যখন যাই, তখন ভারতীয় হিসেবে যাই। মুসলমানদের বাদ দিয়ে কী ভারত হতে পারে? তোমরা জানো না, এবারেই তো আমেরিকার এক জায়গায় আমার বক্তৃতায় বিষয় ছিল শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর বাণী’। কাগজে সেরকম বিজ্ঞাপনও বেরিয়েছিল। মঞ্চে উঠে শেষ মুহূর্তে আমি বিষয়টা বদলে দিলাম, মহম্মদ ও তার বাণী।
আবদুল বিস্মিতভাবে জিজ্ঞেস করল, কেন, বদলালেন কেন?
স্বামীজি বললেন, বদলালাম, তার কারণ, একটু আগে ওখানে একজন ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে একটা বিশ্রী মন্তব্য করেছিল। ওরা তো অনেক বিষয়েই অজ্ঞ। কিছুই জানে না। খ্রিস্টানরা সেই যে মুসলমানদের সঙ্গে ক্রুসেড লড়েছিল, তারপর থেকে এখনও অনেক ভুল ধারণা নিয়ে বসে আছে। তাই মনে হল, শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কে তো অনেক বলেছি, এবারে ইসলামের সমভ্রাতৃত্ব, উচ্চ আদর্শের কথা এদের বুঝিয়ে বলি।
আবদুল বলল, কোনও মৌলবি তো হিন্দু ধর্মের প্রশংসা করবে না, আপনি কেন করলেন?
স্বামীজি বললেন, সকলে করে না বটে, তবে এরকম দু একজন শিক্ষিত মৌলবিও আমি দেখেছি, যাঁরা অন্য ধর্মের মহত্ত্বের কথাও স্বীকার করেন।
আবদুল জিজ্ঞেস করল, আপনার ওই বক্তৃতা খ্রিস্টান সাহেবরা শুনল? মানল?
স্বামীজি বললেন, শুনেছে, মেনেছে কি না জানি না। দু-চারজন অবশ্য গর্দভের মতন প্রশ্ন করছিল। বহুবিবাহে ওদের ঘোর আপত্তি। মহম্মদ কেন অতগুলি বিয়ে করেছিলেন, সেটা ওরা কিছুতে মানতে পারে না।
আবদুল সভয়ে এদিক ওদিক তাকাল। তারপর বলল, এটা তো আমারও প্রশ্ন। আমাদের পয়গম্বর এতগুলি বিবাহ করে আমাদের সামনে কী দৃষ্টান্ত রাখলেন? নিজের ভাই-বেরাদারদের কাছে এ প্রশ্ন তোলাই যায় না, তা হলে খুন করে ফেলবে। আপনি আমাকে একটু বুঝিয়ে দেবেন?
স্বামীজি গম্ভীরভাবে বললেন, মহাপুরুষদের জীবন ওভাবে বিচার করতে নেই। মহাপুরুষদের চরিত্র রহস্যাবৃত, তাঁদের কার্যধারা দুর্ভেয়। তাঁদের বিচার করতে যাওয়া আমাদের পক্ষে অনুচিত। ওদেশের খ্রিস্টানদের আমি বুঝিয়েছি, দুর্জনরা সদাই দোষত্রুটি খোঁজে। মাছি হোয়ো না, মৌমাছি হও। মহাপুরুষ দুশো পত্নী গ্রহণ করতে পারেন, উল্টোদিকে তোমাদের মতন ভূতকে একটি পত্নীও গ্রহণের অনুমতি দেওয়া যায় না। খ্রিস্টই মহম্মদের বিচার করতে সমর্থ, তুমি আমি কে? শিশুমাত্র! এই সকল মহাপুরুষকে কী করে বুঝব!
কথায় কথায় ইসলামের গৌরব কাহিনী, ভারতের বিজয়ী শাসক মুসলমান ও সাধারণ ধর্মান্তরিত মুসলমানের তফাত ইত্যাদি বিস্তারিতভাবে বোঝাতে লাগলেন স্বামীজি। তারপর একসময় বললেন, শেষ পর্যন্ত আমরা মানবজাতিকে সেই জায়গায় নিয়ে যেতে চাই, যেখানে বেদও নেই, বাইবেলও নেই, কোরানও নেই।
আবদুল মুগ্ধ হয়ে শুনছিল, এইখানে আবার ভয় পেয়ে বলল, সর্বনাশ, এ কথাটা বলবেন না, কোরান নেই, এমন অবস্থাটা মুসলমানরা সহ্য করবে না।
স্বামীজি বললেন, আহা, কোরান নেই মানে কী, কোরান মুছে ফেলা নয়। বেদবাইবেল-কোরানের সমন্বয়েই হবে মানব ধর্ম।
আবদুল দু দিকে সজোরে মাথা নেড়ে বলল, উহুঃ, এটাও বিপজ্জনক কথা। অন্য ধর্মগ্রন্থের সঙ্গে কোরানকে মিশিয়ে ফেলার কথাও না-পাক।
স্বামীজি বললেন, আমি যা বলতে চাই, তা তুমি বুঝতে পারছ না বোধ হয়। সমগ্র মানবজাতির কথা ছেড়ে দাও, আমাদের এই দেশের পক্ষে, এ দেশের উন্নতি ঘটাতে হিন্দু ধর্ম ও ইসলাম ধর্ম, এই দুই মহান মতের সমন্বয়, বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামীয় দেহ, একমাত্র আশা!
আবদুল বলল, হিন্দুদের মাথা বললেন আর মুসলমানের দেহ! তার মানে মুসলমানদের বুদ্ধি নেই, শুধু শক্তি, এ আপনি কী বলছেন স্বামীজি!
স্বামীজি বললেন, আরে দুর, এইভাবে অর্থ হয় নাকি! এ দুটোই হল প্রতীক।
আবদুল বলল, প্রতীক কজন বুঝবে?
স্বামীজি তাঁকে প্রতীক বোঝাতে লাগলেন। বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেলেন এক জায়গায়। উৎকর্ণ হয়ে বললেন, রাস্তায় একটা ফেরিওয়ালা হাঁকছে। কী বিক্রি করছে দেখো তো!
জানলা দিয়ে উঁকি মেরে আবদুল বলল, চানা ভোলা।
স্বামীজি বলল, যাও, খানিকটা কিনে আনো তো? অনেক জ্ঞানের কথা হয়েছে। এখন একটু ছোলাভাজা খাওয়া দরকার। বেশ করে ঝাল দিয়ে নিয়ে এসো—