2 of 2

৫৯. জুন মাসের তিন তারিখে

জুন মাসের তিন তারিখে ঘোষণা করা হল ভারত বিভক্ত করে দুটি আলাদা রাষ্ট্রকে স্বাধীন করে দেওয়া হবে পনেরোই আগস্ট। মাঝখানে মাত্র বাহাত্তর দিনের মধ্যে সীমানা, সম্পত্তি, সেনাবাহিনী, চাকরিবাকরি প্রভৃতি ভাগ বাটোয়ারার সব রকম জটিল প্রশ্ন সেরে নিতে হবে।

সাধারণ মানুষ জানে না, এই স্বাধীনতার প্রকৃত স্বরূপ কী, ডোমিনিয়ান স্টেটাস বলতেই বা কী বোঝায়। শুধু স্বাধীনতা কথাটার মধ্যেই একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ আছে। দীর্ঘকাল ধরে অত্যাচার, উৎপীড়ন, আত্মক্ষয়ী দাঙ্গা-হাঙ্গামা, জাতীয় নেতাদের নিজেদের মধ্যে মন কষাকষি ও দলাদলিতে মানুষ একেবারে তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছিল হঠাৎ স্বাধীনতা আসছে শুনে সকলেরই মনে হল, এইটাই পরম প্রাপ্তি।

১৪ই আগস্ট সন্ধ্যা থেকেই সারা দেশে অভূতপূর্ব উত্তেজনা। আগামী কাল একটা বিরাট উৎসবের দিন, কিন্তু সেই উৎসবের চেহারা কী রকম হবে কেউ জানে না। ভারতবর্ষের আবহমান কালের ইতিহাসে কোনও দিন স্বাধীনতার উৎসব তো হয়নি। রামায়ণ-মহাভারতেও স্বাধীনতা উৎসবের বর্ণনা নেই। ইতিহাস দিয়েছে শুধু নতুন রাজ্যাভিষেকের খবর। এই দিনটিতে সব মানুষ তাই ঘর ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল; দাঙ্গা-হাঙ্গামাও অকস্মাৎ থেমে গেছে।

বড়বাবু একটা নতুন রেডিয়ো কিনে ফেললেন। কদিন থেকেই তার শরীরটা খারাপ যাচ্ছিল, কোমরে ব্যথার জন্য হাঁটাচলা করতে পারছিলেন না–তবু তিনি এ-দিনটিতে বেশ উত্তেজনা বোধ করছিলেন–শিয়রের কাছে সারাক্ষণ রেডিয়োটা খুলে রাখলেন। মাঝে মাঝে চিররঞ্জন এসে পাশে বসেন। খবর শুনতে শুনতে হঠাৎ একসময় চিররঞ্জনের চোখে জল আসে। অস্ফুট গলায় বলেন, সবই শেষ পর্যন্ত মিটে গেল, মাঝখান থেকে দাদা…

বৃদ্ধ বয়সে শোক বেশি হয়। চিররঞ্জন তাঁর দাদার অপঘাত মৃত্যুর কথা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না।

বড়বাবু তাকে কোনও সান্ত্বনা দেন না। অন্যমনস্ক ভাবে চেয়ে থাকেন কড়িকাঠের দিকে। তারপর হঠাৎ একসময় ব্যাকুল ভাবে বলেন, এই দেশভাগের পরিণতি কী হবে, আমি তো ভাবতেই পারছি না।

চিররঞ্জন চোখের জল মুছে বলেন, আমার শ্বশুরমশাই চিঠি লিখেছেন-ওখানকার বিষয়-সম্পত্তি বেচে দিয়ে এ দিকে চলে আসবার চেষ্টা করবেন।

অতটা বোধহয় দরকার হবে না। একটা কিছু প্রটেকশন থাকবেই। দু’দিকেই তো মাইনরিটি রয়ে গেল।

একটু থেমে বড়বাবু আবার বললেন, শরীরটা যদি সুস্থ থাকত আমি এই সময় দিল্লি চলে যেতাম। এই দৃশ্য তো আর জীবনে কখনও দেখতে পাব নাকাল লালকেল্লায় যখন তেরঙ্গা ঝান্ডা ওড়াবে জওহরলাল।

গান্ধীজির কোনও কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি না কেন?

ওঁর দিন শেষ হয়ে গেছে। উনি এখন সবরমতী নিয়েই থাকুন! থার্টিজেই ওঁর রিটায়ার করা উচিত ছিল।

আপনার কি মনে হয় ওঁর কথা মতন কংগ্রেস পার্টিটা এখন ভেঙে দেওয়া হবে?

রেডিয়োর দিকে উৎকর্ণ হয়ে বড়বাবু বললেন, চুপ, কী বলছে শোনো। ঠিক রাত বারোটায় জওহরলাল রেডিয়োতে ভাষণ দেবে। আমাদের এখানকার চিফ মিনিস্টার হল প্রফুল্ল ঘোষ। বাঙালদের আর দুঃখ করার কিছু রইল না।

সূর্য কিংবা বাদল কেউই বাড়ি নেই।

বাদল সারা সন্ধেটা কাটাল ভাস্কর আর পঙ্কজদের সঙ্গে। কাল খুব ভোরে প্রভাতফেরি বার করবে। তার প্রস্তুতি চলছে। ভাস্করদের বৈঠকখানায় ওরা গানের রিহার্সাল দিল, কদম কদম বাড়ায়ে যা, খুশি কে গীত গায়ে যা এবং কারার ওই লৌহ কপাট ভেঙে ফ্যাল কর রে লোপাট।

রাত ন’টার সময় ওরা দল মিলে এল বিষ্ণুদের বাড়িতে। বিষ্ণুদের বাড়িতে রীতিমতো হইচই চলছে। ওদের অতবড় বাড়ি আগামীকাল উৎসব সজ্জায় সাজানো হবে। ইলেকট্রিকের মিস্তিরি এসেছে–ছাদের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত আলো লাগাবার জন্য তার টানা হচ্ছে। প্রায় শ’খানেক পতাকা কেনা হয়েছে। বাড়ির ছেলে-মেয়েরা বসে গেছে কাগজের শিকলি তৈরি করতে। সুপ্রকাশ তদারক করছে এসবের।

বাদলরাও শিকলি বানাতে বসে গেল। বাদল অন্যদের দেখাদেখি বেশ চটপট বানিয়ে ফেলল অনেকখানি। ভাস্কর এসব কাজে মন বসাতে পারে না। সে একটু বাদে বাদেই বলে, উঃ টায়ার্ড হয়ে গেলুম। এই বিষ্ণু, চা পাঠাতে বল না।

বিষ্ণুর মা ছেলেদের বেশি চা খাওয়া পছন্দ করেন না। একতলা থেকে চাকর চায়ের ফরমাশ নিয়ে গেলেই তিনি প্লেট-ভরতি সন্দেশ আর শরবত পাঠিয়ে দেন।

একটু বাদে সবাইকেই ওপরে ডেকে পাঠানো হল। সকলেরই খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে।

এবাড়ির দোতলার হলঘরটা বহুদিন ব্যবহার করা হয় না। আজ ঝেড়ে পুঁছে সাফ করা হয়েছে। বার করা হয়েছে পুরনো কালের রূপোর থালাবাসন। পড়ন্ত অবস্থা হলেও এখনও যেতে যেতে কিছু আছে। বিষ্ণুর মা নিজে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাপনা করেছেন। তিন রকম মাছমাংস এবং চার রকমের মিষ্টি না হলে তিনি লোককে খাওয়ানোর কথা ভাবতেই পারেন না। অনেক কিছুই কিনে আনিয়েছেন একটু আগে। সব দোকানপাট এখনও খোলা, বোধহয় সারা রাতই ভোলা থাকবে।

বাদল অনেকদিন বাদে এ বাড়ির ওপরে এল। আজই সে প্রথম রেণুর আর এক কাকাকে দেখল, যাঁর স্ত্রী ছিলেন হৈমন্তী কাকিমা। হৈমন্তী কাকিমার নাম এবাড়িতে অনেকদিন শোনা যায় না। তার বরের চোখ ফুলো ফুলো। গালে চাকা চাকা দাগ তবে খুব শৌখিন মানুষ, কোঁচার প্রান্তটি ফুলের মতন ছড়ানো, হাতে সবুজ রঙের সিগারেটের টিন।

খাওয়া শেষ করে ওরা সবাই ছাদে এল। পতাকাগুলো লাগাতে হবে–আলোর ব্যবস্থা হয়ে গেছে। এত রাত পর্যন্ত বাদলরা এর আগে কখনও বাড়ির বাইরে থাকেনি– কিন্তু আজ সে সম্পর্কে কোনও চিন্তাই নেই।

আকাশে কয়েক টুকরো পাতলা মেঘের দিকে তাকিয়ে সুপ্রকাশ বলল, এই সেরেছে। কাল যদি বৃষ্টি নামে! বাদলরা হইচই করে উঠল, না সুপ্রকাশদা, আপনি ও রকম অপয়া কথা বলবেন না। বৃষ্টি হলে সব মার্ডার হয়ে যাবে!

বিষ্ণু বলল, আয়, একটা জিনিস ঠিক করবি? এখন থেকে কাল সারা দিন আমরা একটাও ইংরেজি কথা বলব না। যে একটা ইংরেজি শব্দ বলে ফেলবে, তার তক্ষুনি এক পয়সা করে ফাইন হবে।

সুপ্রকাশ সঙ্গে সঙ্গে বললে, এই তোমরা বিষ্ণুর কাছ থেকেই প্রথমে এক পয়সা নিয়ে নাও। ও ফাইন বলেছে। ওকেই প্রথমে জরিমানা দিতে হবে!

সবাই হোহো করে হেসে উঠল। বিষ্ণু ক্ষীণ প্রতিবাদ করে বলতে গেল যে এখনও খেলা শুরুই হয়নি–সে শুধু প্রস্তাব তুলেছে। কিন্তু বিষ্ণুর কথা গ্রাহ্য করা হল না। তাকে পয়সা দিতেই হবে।

সুপ্রকাশ বলল, দেখো, কাল অনেক পয়সা পাওয়া যাবে। পয়সাগুলো একজন কেউ জমা রাখুক–তোমরা ভাস্করকে ক্যাশিয়ার করে দাও।

ভাস্কর হাত বাড়িয়ে বলল, সুপ্রকাশদা আপনিও দিন এক পয়সা। আপনি ক্যাশিয়ার বলেছেন।

সুপ্রকাশ থতমত খেয়ে বলল, আরে ওটা তো বাংলাই। ক্যাশিয়ার কথাটার আবার বাংলা আছে নাকি?

পঙ্কজ বলল, তা হলে, ইংরেজরা আসবার আগে আমাদের দেশে কি টাকাপয়সা ছিল না? কিংবা কারওর কাছে জমা রাখা হত না।

ভাস্কর বলল, একটু বাদে ইংরেজরা এ-দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে আর ইংরেজি ছাড়া আমরা একটাও সেন-থুড়ি, বাক্য বলতে পারি না? আমাদের লজ্জা হওয়া উচিত।

তুমি বলো, ক্যাশিয়ারের বাংলা কী? তোমাদের মধ্যে কে বলতে পারে?

অন্য কেউ উত্তর দেবার আগেই ভাস্কর বলল, আপনি রামপ্রসাদের গানটাও শোনেননি?

ভাস্কর দু হাত ছড়িয়ে চেঁচিয়ে গান জুড়ে দিল, ‘আমায় দে মা তবিলদারি, আমি নিমকহারাম নই শঙ্করী—’

সবাই হাততালি দিয়ে উঠল। আনন্দ করার জন্য সমস্ত মন প্রাণ উদগ্রীব, যে-কোনও একটা উপকরণ পেলেই হল।

ঠিক বারোটার সময় মুহুর্মুহু শোনা গেল কামান গর্জন। সমস্ত ট্রেন হুইস দিয়ে উঠল। সেই শব্দও ছাপিয়ে গেল শঙ্খধ্বনিতে। পাড়ার প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই শাঁখ বাজছে। অনেক বাড়িতে উলু দিয়ে উঠেছে মেয়েরা।

ওরা দুদ্দাড় করে নেমে এল ছাদ থেকে। বিষ্ণুদের ঘরে বিশাল রেডিয়োটি খুব জোরে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। একটু ধরা ধরা গলায় জওহরলাল নেহরু বলে চলেছেন, সারা পৃথিবী যখন ঘুমিয়ে আছে, তখন একটি পরাধীন জাতি স্বাধীনতা পেয়ে জেগে উঠল…

ইংরেজি মতে শুরু হয়ে গেছে নতুন দিন, এসে গেছে স্বাধীনতা। সেই মুহূর্তে সারা দেশের অনেকেই জেগে আছে, এমনকী হাসপাতালের রুগিরাও ঘুমোয়নি। অন্ধকার নদীতে মাছধরা জেলে ডিঙিগুলো থেকে ভেসে আসছে ‘জয় হিন্দ’। সেই মুহূর্তে অনেকে অনেক রকম মানত ও শপথ নিয়ে ফেলেছিল, অনেক ক্লান্ত অকৃতদার দেশকর্মী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিয়ে করার। আচার্য কৃপালনী সত্যিই বিয়ে করেছিলেন সেই রাত্রে।

বাড়ি ফেরার জন্য সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বাদল রেণুকে বলেছিল, এখন আমার সঙ্গে একটা প্রতিজ্ঞা করবি!

রেণু শুধু চোখ তুলে চেয়ে রইল।

বাদল আবেগপ্লুত গলায় বলল, আমি তোকে যখন যা বলব তুই শুনবি। তুইও আমাকে যা বলবি আমি শুনব।

রেণু বলল, যদি কিছু অন্যায় কথা হয়?

বাদল জোর দিয়ে বলল, তা হলেও অন্যায় হোক আর নাই হোক।

রেণু চুপ করে রইল। বাদল আবার বলল, আমি কি কখনও তোকে কোনও অন্যায় কথা বলতে পারি? কিংবা তুই–

রেণু তখনও কোনও উত্তর দিচ্ছে না। দরজার কাছ থেকে ভাস্কররা বাদলকে ডাকল, আর সময় নেই। অভিমান নিয়ে বাদল শেষবারের মতন জিজ্ঞেস করল, তুই তা হলে প্রতিজ্ঞা করবি না?

রেণু বলল, আচ্ছা করলাম। কিন্তু তোর মনে থাকবে তো?

দেখিস!

বাদল তরতর করে নীচে নেমে এসে বলল, কাল কিন্তু খুব ভোরে ডাকতে আসব–রাত্তিরে কতটুকুই বা ঘুম হল। ভোরের আলো ফোঁটার আগেই বাদল আবার বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে। পঙ্কজের বাবা একটা লরি দিয়েছেন, সেই লরি নিয়ে ঘুরে ঘুরে তোলা হল সকলকে। আজ এই শুক্রবার সকালে কলকাতা শহরটা একেবারে নতুন। এ রকম কলকাতা ওরা কখনও দেখেনি।

যেদিকে তাকাও শুধু তিন রঙের পতাকা। প্রত্যেক বাড়ির ছাদে, প্রত্যেক মানুষের পোশাকে, সব লাইট পোস্টে, সব গাড়িতে। রাস্তায় রাস্তায় পতাকা কিংবা ব্যাজ বিক্রি হচ্ছে–সেগুলো কেনার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। সমস্ত শহর আজ রঙে ঝলমল। মোড়ে মোড়ে বিরাট বিরাট তোরণ–তার ওপর জাতীয় নেতাদের ছবি। অসংখ্য প্রভাতফেরির দল বেরিয়েছে–এক দল আর এক দলের মুখোমুখি এলেই গান থামিয়ে ধ্বনি দিয়ে ওঠে, জয় হিন্দ! বন্দে মাতরম্‌! ভারত মাতা কি জয়!

আজ আর কলকাতায় কোনও নিষিদ্ধ এলাকা নেই। প্রায় এক বছর বাদে বাদলরা রাজাবাজার, কলাবাগান, কলুটোলা, মির্জাপুরে ঢুকল–সেখানে উৎসাহ-উদ্দীপনা একটুও কম নয়। সেখানেও বাড়িতে বাড়িতে উড়ছে ভারতের জাতীয় পতাকা, মুসলমানরাও সমান ভাবে অভিনন্দন জানাচ্ছে। রাস্তায় রাস্তায় মানুষে মানুষে কোলাকুলি, এক একটা লরি দেখে অন্যরা হাত বাড়িয়ে ছুটে আসছে একটু করস্পর্শ করার জন্য অনেকেই লরি থেকে লাফিয়ে নেমে অচেনা কোনও মানুষকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে লাফাচ্ছে। আজ একবারও মনে হয় না–গত কয়েকটা মাস ধরে এই কলকাতায় কী নারকীয় কাণ্ড চলেছে। হিন্দু-মুসলমানের অভূতপূর্ব মিলনের দৃশ্যই সকলকে আরও বেশি আনন্দে মাতোয়ারা করে দেয়। পরস্পর পরস্পরের জামায় পতাকা আটকে দিচ্ছে, বিনিময়ে পরস্পরকে দিচ্ছে গ্লানিহীন হাস্য।

বাদলরা সকাল থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত ঘুরল লরিতে। তারপর ফিরে এল ভাস্করদের বাড়ি। ভাস্করদের বাড়ি থেকে সেদিন পাড়ার গরিব-দুঃখীদের খাওয়ানো হচ্ছে। কাছাকাছি দুটো বস্তির সকলের নেমন্তন্ন। সামনের রাস্তায় লম্বা লাইন করে পাতা পড়েছে। তাদের পরিবেশন শেষ করে নিজেদের খেতে খেতে বাদলদের দুটো-আড়াইটে বেজে গেল।

খেয়ে উঠেই কিন্তু ওরা আবার বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। এক মুহূর্ত বাড়িতে বসে থাকতে ইচ্ছে করে না। আজ ট্রাম বাসে টিকিট নেই। ওরা চলল সাহেবপাড়া আর গভর্নরস হাউসের দিকে।

সূর্য দীপ্তিকে নিয়ে হোয়াইটওয়ে লেড ল’র সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দীপ্তি মাঝে মাঝে হাতঘড়ি দেখছেন।

সূর্য আজ পরেছে সাদা খদ্দরের ধুতি ও পাঞ্জাবি। দীপ্তিও পরেছেন সরু লাল পাড় খদ্দরের শাড়ি। জায়গাটায় এত অসম্ভব ভিড় যে এক জায়গায় সুস্থির ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় অসম্ভব–জনতার স্রোত প্রায় ঠেলে নিয়ে যেতে চায়। সূর্য দীপ্তির একটা হাত শক্ত করে ধরে আছে।

একটু বাদেই ক্ষিতীশদা এসে হাজির হলেন একঠোঙা বাদাম হাতে নিয়ে। হাসতে হাসতে বললেন, দেখ, এইটুকু বাদাম চার আনা। ঝোঁকের মাথায় আজ একটা সিকি খরচ করে ফেললাম!

ওদের দু’জনের হাতে কিছু কিছু বাদাম তুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আর কেউ আসেনি?

পেছন থেকে দু’জন বলল, এই তো আমরা এসেছি।

রণেন আর সুশোভন। রণেন মাত্র কয়েক দিন আগে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে, এখনও জেলের দাড়ি কামায়নি। তার সেই হাসিখুশি মেসোমশাই-মার্কা চেহারা এখন আর চেনাই যায় না। সুশোভন অনেক দিন পলাতক ছিল যুক্তপ্রদেশে। সে বলল, আমি কাল শান্তিদি আর ক্ষেমেনদাকে খবর দিয়ে এসেছি।

ক্ষিতীশদা বললেন, আমার সঙ্গে শঙ্করের দেখা হয়েছিল বুঝলে, কিন্তু তাকে খবর দেব কি না ঠিক করতে পারলাম না। সে তো আমাদের দল ছেড়ে দিয়েছিল।

রণেন বলল, তাকে না ডেকে ভালোই করেছেন।

দীপ্তি বললেন, শঙ্করবাবু কিন্তু দাঙ্গার সময় রিলিফের কাজ করেছেন খুব।

সূর্য বলল, আমরা ডাকলেও উনি আসতেন না। আমাদের পছন্দ করেন না এখন।

মিনিট পনেরোর মধ্যেই এগারো জন এসে সমবেত হল সেখানে। ক্ষিতীশদা বললেন, আর তো কেউ নেই। এবার চল।

সূর্য ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। কাছেই রিপন স্ট্রিটে তারিখ সাহেবের বাড়ি। দাঙ্গার সময় সূর্য এবাড়িতে কিছু দিন আশ্রয় নিয়েছিল।

তারিখ সাহেবের বাড়ির তিনতলায় মস্ত একটি ঘর। টেবিল চেয়ার নেই, মেঝেতে ফরাস পাতা। মাঝখানে একটি নিরাবরণ জলচৌকি।

কোনও খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা নেই। অনুষ্ঠান আগে থেকেই ঠিক করা আছে। তারিখ সাহেব বললেন, আমি মোমবাতি এনে রেখেছি। কটা জ্বালাতে হবে বলুন?

ক্ষিতীশদা দীপ্তিকে বললেন, কটা জ্বালবে?

দীপ্তি বললেন, আপনিই ঠিক করুন। আমাদের মধ্যে–যারা যারা–

রণেন বলল, শুধু আমাদের কেন, সারা ভারতে যারা প্রাণ দিয়েছে। এক কাজ করুন, সকলের জন্য তো আলাদা ভাবে কিছু করা যাবে না। নব্বই বছর ধরে স্বাধীনতার লড়াই। চলেছে, সেই হিসেবে নব্বইটা–

তারিখ সাহেব বললেন, আমার কাছে অনেক আছে।

এই প্রস্তাবটা সকলের পছন্দ হল। দীপ্তি এক এক করে মোমবাতি জ্বেলে বসাতে লাগলেন জলচৌকির ওপর। জানলা দিয়ে ফাঁকা হাওয়া এসে মাঝে মাঝে দু-একটা। নিবিয়ে দিচ্ছে। দরজা-জানলা সব বন্ধ করে দেওয়া হল–অন্ধকার ঘরে জ্বলে উঠতে লাগল একটার পর একটা বাতি। নব্বইটা মোমের আলোয় ওদের মুখগুলো জ্বলজ্বল করতে লাগল।

দীপ্তি তার হাতব্যাগ থেকে রবীন্দ্রনাথের ক্ষণিকা বইটি বার করে বললেন, এই বইটা ব্রজদার–আমার কাছে ছিল। ক্ষিতীশদা পকেট থেকে একটা নোটবই বার করে। বললেন, এটা ছিল অশোকের। এই রকম ভাবে কয়েকটি রুমাল, কিছু চিঠি, একটা চিরুনি, তিনটি ছোরা বেরোল অন্যদের পকেট থেকে। এগুলো যাদের জিনিস, তারা আজ আর কেউ বেঁচে নেই।

রণেন আপন মনে বলতে লাগল, চাফেকার, প্রফুল্ল চক্রবর্তী, প্রফুল্ল চাকী; ক্ষুদিরাম, কানাই, সত্যেন, ধিংড়া, কানহেরে–

সুশোভন বলল, কত আর নাম বলবি। সারা ভারতে এ রকম তো হাজার হাজার বরং সকলের জন্য একসঙ্গে দু’মিনিট–

তারিখ সাহেব বললেন, কিছু ফুল আনলে হত। আনব?

সূর্য বলল, না ফুল দরকার নেই।

ওরা সবাই হঠাৎ চুপ করে গেল। স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল মোমবাতিগুলোর দিকে। এলোমেলো ভাবে সাজানো হলেও মোমবাতির আলোয় একটা আল্পনার রূপ এসেছে। দপ দপ করে কাঁপছে শিখাগুলো। ফোঁটা ফোঁটা মোম গলে পড়ছে অশ্রুবিন্দুর মতন। একটা ঘড়ির শব্দ হচ্ছে টিক টিক টিক। দু’ মিনিট সময়কেই কত দীর্ঘ মনে হয়। যেন এই দু’মিনিটেই স্মৃতির রাজ্যে পেরিয়ে গেল নব্বই বছর।

ক্ষিতীশদা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, সময় হয়ে গেছে। এবার ওঠা যাক। দীপ্তি রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছলেন।

ক্ষিতীশদা তারিখ সাহেবকে বললেন, সিরাজুল, সবার পক্ষ থেকে তুমি কিছু বলো।

তারিখ সাহেব বললেন, আপনি দাদা সবার মধ্যে এখন বয়ঃজ্যেষ্ঠ, আপনি থাকতে আমি কী বলব, আপনিই বলুন।

ক্ষেমেনদা বললেন, হ্যাঁ, ক্ষিতীশদাই কিছু বলুন।

ক্ষিতীশদা মুখ নিচু করে বললেন, বিশেষ কিছু বলার নেই। আজ এই জাতির ইতিহাসে একটা পরম ক্ষণ। আজ আর প্রশ্ন কিংবা সমালোচনা করার দিন নয়। আজ আনন্দেরই দিন। তবু আমাদের যেসব সহকর্মী এবং বন্ধু এই স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছেন–আমরা আজকের দিনে তাঁদের স্মরণ না করে পারি না। আমি শুধু এইটুকুই বলতে চাই, তাঁদের প্রাণ দান ব্যর্থ হয়নি। ১৯২০ সালে অনুশীলন পার্টি থেকে বেরিয়ে এসে হরদা এই দল গড়েছিলেন। সমুদ্রবন্ধনের সময় কাঠবেড়ালি যতটুকু সাহায্য করেছিল, হয়তো আমরাও ততটুকু সাহায্য করতে পেরেছি স্বাধীনতাকে নিয়ে আসার জন্য। আজ আর পুরনোদের মধ্যে কেউই বেঁচে নেই। দলের অস্তিত্বও কিছু নেই বলতে গেলে। তবু যেহেতু আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয়েছিল, সেই জন্য আনুষ্ঠানিক ভাবেই এটা ভেঙে দেওয়া উচিত। স্বাধীনতার পরবর্তীকালের জন্য আমাদের কোনও প্রোগ্রাম ছিল না। তা ছাড়া, ক্ষমতাশীল সরকার আমাদের কী চোখে দেখবে, তাও আমরা জানি না। সুতরাং দলের কাছে আমাদের যার যা শপথ ছিল–তার দায়িত্ব থেকে সকলকেই নিষ্কৃতি দেওয়া হল। এখন যে-কেউ ইচ্ছে করলে অন্য যে-কোনও দলে যোগ দিতে পারে। এ-সম্পর্কে কারও কোনও আপত্তি আছে?

কেউ কোনও কথা বলল না। নৈঃশব্দেই সম্মতি বোঝা গেল। ক্ষিতীশদা উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। হাওয়া এসে নিবিয়ে দিতে লাগল মোমবাতিগুলো।

একটু পরেই ওরা বেরিয়ে পড়ল তারিখ সাহেবের বাড়ি থেকে। সবাই খুব কাছাকাছি হাঁটতে লাগল। রাস্তার প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে বোঝাই যায় না, ওদের একটা ছোটখাটো মিছিল চলছে।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা চলে এল গঙ্গার ধারে। এখানেও ভিড় কম নয়। হাওড়া থেকে বহু লোক নৌকোয় বা স্টিমারে আসছে কলকাতার আলোকসজ্জা দেখতে।

ওদের মৃত সহকর্মীদের ব্যবহৃত জিনিসপত্রগুলো একটা ব্যাগে ভরে নিয়ে আসা হয়েছিল। তার থেকে ক্ষণিকা বইটা তুলে নিয়ে দীপ্তি বললেন, এটা আমার কাছেই রেখে দিতে চাই।

কেউ কোনও আপত্তি জানাল না।

বাকি জিনিসপত্র ভরা থলেটা নিয়ে সূর্য জলের ধারে এসে জোরে ছুঁড়ে দিল। জলে পড়তে না পড়তেই ঢেউয়ের ঝাঁপটায় মিলিয়ে গেল।

সূর্য যখন পারে উঠে এল, তখন পর পর কয়েকখানা লরিতে অনেক লোক বন্দে মাতরম ধ্বনি দিচ্ছে। সূর্য হঠাৎ তাদের দিকে ফিরে ভরাট গলায় চেঁচিয়ে উঠল, বন্দে মাতরম্‌!

এই শেষ বার। এরপর সূর্য আর কখনও রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোনও ধ্বনি দেয়নি।

.

বাদল ভাস্কর, বিষ্ণু আর পঙ্কজ ঘুরতে লাগল সাহেব পাড়ায়। সন্ধ্যার দিকে এত মানুষ রাস্তায় বেরিয়েছে যে, শহরে আর গাড়িঘোড়া চলার উপায় নেই। এত লোক বোধহয় একসঙ্গে কখনও ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসেনি। মুক্ত হাওয়ায় এসে দাঁড়ানোই যেন স্বাধীনতার প্রতীক। গোলমালের আশঙ্কায় বহু সংখ্যক পুলিশের গাড়ি ছাড়া হয়েছিল– কিন্তু সারা দিনে একটা পকেটমারির ঘটনা পর্যন্ত ঘটেনি। শুধু উল্লাস আর উত্তেজনা। মুসলমান পাড়ায় আতর ছেটানো হচ্ছে সবার গায়ে। কোথাও উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। গোলাপ ফুলের পাপড়ি।

রয়াল এক্সচেঞ্জ প্লেস ও ক্লাইভ স্ট্রিটের মোড়ে বিরাট এক তোরণের গায়ে বাল গঙ্গাধর তিলকের প্রতিচ্ছবি। বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সের বাড়িতে ভারতের একটি বিরাট মানচিত্র। এইসব বাড়ি থেকে একসময় কত রকম ভারত-বিরোধী রাজনীতি চালানো হয়েছে। লোকেরা সাহেবদেরও ধরে ধরে বুকে পতাকা আঁকা ব্যাজ পরিয়ে দিচ্ছে, তারাও আপত্তি করছে না।

সন্ধ্যার পর আলোর ফোয়ারা ছড়িয়ে পড়ল সারা শহরে। তারপরই নানা রকম বাজির খেলা দেখা গেল আকাশে।

অনেক রাত পর্যন্ত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরল বাদল আর তার বন্ধুরা। সারা দিন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বাদলের গলা ভেঙে গেল।

এর কয়েক মাস পরেই অবশ্য বাদলরা রাস্তায় আবার ছাত্র মিছিল বার করে ধ্বনি দিয়েছে, ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, ভুলো মাত্, ভুলো মাত্।

.

কলেজে আমাদের ক্লাস থেকে দশ জনকে পাঠানো হয়েছে আর ডব্লু এ সি-তে। আমিও সেই দলে ছিলাম। আমরা প্রত্যেক দিন যেতাম শিয়ালদা স্টেশনে। বিরাট বিরাট ড্রামে দুধ গুলে বিতরণ করা ছিল আমাদের কাজ। প্ল্যাটফর্মগুলোতে মানুষ থিকথিক করছে। নোংরা মানুষের শরীরের গন্ধ ও ব্লিচিং পাউডারের কড়া গন্ধ মিলে মিশে প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসে।

প্রত্যেক দিন দলে দলে ওরা আসছে। কোথাও আর তিলধারণের জায়গা নেই। প্ল্যাটফর্ম থেকে উপচে পড়ছে রাস্তায়। কলকাতা শহরের ছিমছাম চেহারাটা চিরকালের মতন নষ্ট হয়ে গেল।

খাটতে খাটতে আমাদের দম বেরিয়ে যায়। দয়া, মায়া ইত্যাদি অনুভূতির আর জায়গা থাকে না। বহু দূরের সব গণ্ডগ্রাম থেকে এসেছে ছেলে-মেয়ে বুড়ো-শিশুর দল কলকাতার মতন অজানা অচেনা পুরীতে এসে তাদের চোখের বিহ্বলতা এখনও কাটেনি।

অনেকে এসেছে মৃত্যুর খুব কাছ ঘেঁষে। এখানকার নিয়মকানুন ওরা জানে না।

কিছুতেই লাইনে দাঁড় করানো যায় না ওদের। সবাই একসঙ্গে হুড়োহুড়ি করে আসে। আমরা ওদের বকুনি দিই, ঠেলে দিই, এমনকী অনেক সময় মেজাজ হারিয়ে মারতেও উঠি।

পঙ্কজ এক এক সময় বলে ওঠে, এই বাঙালগুলোকে নিয়ে আর পারা যায় না।

আমি মুখ লুকোই। জন্মসূত্রে আমিও যে বাঙাল সে-কথাটা এখন প্রকাশ করতে লজ্জা পাই। অনেক দিন আমাকে কেউ বাঙাল বলেনি। আমার কথায় আর টান নেই, অচেনা লোক কিছুই বুঝতে পারবে না।

পঙ্কজ কিন্তু জানে। সে আমাকে একসময় জিজ্ঞেস করে, হ্যাঁ রে, তোদের বাড়ির কী হয়েছে রে?

আমি সংক্ষপে উত্তর দিই, কী জানি!

তোদের আত্মীয়স্বজন কেউ আসেনি?

না।

ও, তোরা তো বোধহয় জমিদার ছিলি, তাই না? যত বাঙাল আসছে, সবাই নাকি ওখানে জমিদার ছিল?

পঙ্কজ জানে না, দু-চার বছরের মধ্যেই এদিকে এত বেশি বাঙাল এসে পড়বে যে তখন আর বাঙালকে প্রকাশ্যে বাঙাল বলে মনের সুখও করা যাবে না।

রেডক্রসের কাছে যুদ্ধের উদ্বৃত্ত বহু টুথপেস্টের টিউব ছিল, একদিন দু’হাজার সেই টিউব আমাদের কাছে এল বিলি করার জন্য।

আমাদের ইনচার্জ ফণীদা বললেন, দেখো কাণ্ড! যারা কোনও দিন টুথব্রাস চোখেই দেখেনি, তাদের এগুলো দিয়ে কী হবে বলদিনি? নে, এগুলো তোরা যে ক’টা পারিস নিয়ে যা।

বলা মাত্রই আমরা মুঠোয় করে তুলে পকেটে ভরলুম। প্যান্টের দু পকেট ফুলে গেল। যে-কোনও জিনিসই বিনা মূল্যে পেলে বেশ একটু আনন্দ হয়। এগুলো নেওয়ার জন্য আমাদের কোনও অপরাধ বোধ হয় না–এত লোকের মধ্যে সামান্য দু’ হাজার টুথপেস্ট টিউব বিলি করা সত্যিই অর্থহীন। বরং আমাদের কাজে লাগবে।

রাস্তায় বেরিয়ে পঙ্কজ পকেট থেকে একটা টিউব বার করে দেখে। খাঁটি বিলিতি জিনিস দেখে তার একটু আনন্দ করার কথা, তবু বিনা পয়সায় পেয়েছে বলেই অবহেলার সঙ্গে ছিপি খুলে একটু টিপে দেখতে চায়। ফুস করে শব্দ হয়, তারপর কালচে কালচে ময়লা রঙের কিছু বেরোতে থাকে।

পঙ্কজ বলল, দূর শালা! যত সব রদ্দি মাল বলেই ওইসব হাড়হাভাতেদের মধ্যে চালিয়ে দেবার চেষ্টা!

পঙ্কজ চিনেম্যানদের কায়দায় চার-পাঁচটা টিউব একসঙ্গে লোফালুফি করার চেষ্টা করে–আমি পকেট থেকে সবক’টা বার করে ছুঁড়ে ফেলে দিই ট্রাম লাইনে। তার ওপর দিয়ে ট্রাম চলে গেলে সেই দৃশ্য দেখে মজা লাগে।

গান্ধীজি গুলি খেয়ে মারা গেছেন। কাশ্মীরে পাকিস্তানের সঙ্গে প্রথম বারের যুদ্ধ হয়ে গেছে। জিনিসপত্তরের সাংঘাতিক দাম। যুদ্ধ-ঘাটাই হাজার হাজার বেকার, তার ওপরে এই রিফিউজি। সে-বছর ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময় বাইরে থেকে মাইক বাজিয়ে উত্তর বলে দেওয়া হয়েছিল এবং চেয়ার টেবিল পর্যন্ত পাস করে গিয়েছিল। খাদ্যদ্রব্য তো দুষ্প্রাপ্য বটেই, জামাকাপড়ও সহজে কিনতে পাওয়া যায় না। কন্ট্রোলে শাড়ি-ধুতি দেয়, গামছার মতন আকৃতি।

তবু এরই মধ্যে ফুটবল মাঠে ভিড় হয়, রাত্তিরবেলা আলো জ্বেলে টেনিস খেলা জমে। রাস্তা দিয়ে ব্যান্ড বাজিয়ে বরযাত্রীসহ বর বিয়ে করতে যায়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও বাদ পড়ে না। সন্ধ্যার পর শিয়ালদহ স্টেশন থেকে মেয়ে কেনার জন্য কারা নাকি আড়কাঠি পাঠায়–তা নিয়ে আবার খবরের কাগজে লেখা হয় গরম গরম সম্পাদকীয়।

সকালবেলা আমরা এই দুঃসহ দৃশ্য এবং নির্যাতিত মানবতার মধ্যে কাটিয়ে এসেও সারা দিন সেই চিন্তা মাথায় ধরে রাখি না। প্রকৃতির কোনও এক অদ্ভুত নিয়মে আমাদের চেতনার মধ্যে সব সময় অসামঞ্জস্য থেকে যায়। আমরা বন্ধুরা এখনও হাস্য-পরিহাস করি এবং প্রণয়লিপ্সায় অনেকটা সময় কেটে যায়।

প্রথম প্রথম আমি শিয়ালদা স্টেশনের দৃশ্য দেখে খুব অবসন্ন বোধ করতাম। এক এক সময় মনে হত, যেন আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে। চতুর্দিকে কিলবিল করছে মানুষ, এরই মধ্যে তারা মরছে, অসুখে কুঁকছে, খিদের জ্বালায় ছটফট করছে। তবুও প্রতিদিন গেছি, ইচ্ছে করলেই না যেতেও পারতাম যদিও। দিনের পর দিন দেখতে দেখতে মনের মধ্যে একটা আস্তরণ পড়ে যায়। তখন দুধ বিলি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলে–বিশ্রাম নেবার জন্য সিগারেট ধরাই। ক্ষুধার্ত লোকগুলো সেই সময়ে চাচামেচি করলে ধমক দিই। হঠাৎ কোনও স্বাস্থ্যবতী যুবতাঁকে দেখলে দু’-এক পলক বেশি তাকাই। আমাদের ইনচার্জ ফণীদা ভিড় সামলাবার জন্য এক এক সময় বড়ই কর্কশ ভাষায় বকাবকি করেন। অথচ, সবাই জানে, ব্যক্তিগত জীবনে ফণীদা খুব দয়ালু মানুষ।

পঙ্কজ আর আমি শিয়ালদা থেকে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করি কলেজের দিকে। সেদিন আকাশ বেশ মেঘলা।

পঙ্কজ বলল, আজ আর কলেজে যেতে ইচ্ছে করছে না। চল, আজ কাট মারি!

আমার কোনও আপত্তি নেই। বললাম, চল, বিষ্ণুকে ডেকে নিয়ে ওদের বাড়িতে গিয়ে আড্ডা মারি।

পঙ্কজ চোখের কোণে ঝিলিক দিয়ে বলল, তোর খুব ঘন ঘন বিষ্ণুদের বাড়িতে যাওয়ার শখ কেন রে?

আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম।

পঙ্কজ বলল, তার চেয়ে চল একটা সিনেমা দেখি!

তখন ইংরেজি বই মানেই যুদ্ধের ছবি। অধিকাংশ ছবিতেই আমেরিকান-জাপানি বন্ধুত্বের গল্প, শেষ দৃশ্যে রাইফেলের ডগায় প্রজাপতি। বললাম, নাঃ, সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করছে না।

তা হলে চল নানকিংয়ে গিয়ে ডাক রোস্ট খাই!

না, থাক।

পঙ্কজ অবাক হয়ে বলল, কেন?

কয়েক দিন আগেই ওখানে ডাক রোস্ট খেয়ে আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু পঙ্কজ প্রত্যেক দিন দাম দেয়, আমি পয়সা দিতে পারি না। এ রকম ভাবে চলে না।

পঙ্কজ আমার হাত ধরে টানাটানি করতে লাগল, আমি কিছুতেই রাজি হলাম না। শেষ পর্যন্ত পঙ্কজ রাগ করে চলে গেল।

আমি রেণুর সঙ্গে দেখা করার জন্য ওদের বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম। খামিকটা দূর গিয়ে আর সেখানেও যেতে ইচ্ছে করল না। খুব মনখারাপ লাগছে হঠাৎ।

জ্যাঠামশায়ের মৃত্যুর ফলে তার কারবার হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে। আমার বাবা আবার বেকার। এই বয়সে তার পক্ষে নতুন কোনও চাকরি পাওয়া সম্ভব নয়। বড়বাবুর বাড়িতে আমরা তখন পুরোপুরি আশ্রিত হয়ে গেছি, কিন্তু তার কাছে তো টাকাপয়সা চাওয়া যায় না! আমার হাতে একটাও পয়সা থাকে না। হাতখরচ জোগাড় করার জন্য আমি একটা টিউশানি নিলাম।

দুটি ছেলেকে পড়াতে যেতে হয় মদনমোহনতলায়। পুরনো আমলের বাড়ি, কলকাতার এরা আদি বাসিন্দা হলেও এই পরিবারটির মধ্যে শিক্ষাদীক্ষার তেমন চল। নেই। ছাত্রদের বাবার সঙ্গে একবারই মাত্র দেখা হয়েছে, তিনি রিকশাকে বলেন, রিস্কা, বাক্সকে বলেন বাস্ক, ক্লাসকে বলেন কেলাস। আমি বাড়ির দরজার কাছে দাঁড়ালেই। ছাত্রদের এক বর্ষিয়সী আত্মীয়া চেঁচিয়ে বলেন, ওরে তপু-নেপু, তোদের ম্যাস্টার এয়েছে!

মাইনে পাই পনেরো টাকা।

প্রথম কিছু দিন এক কাপ চা একখানা করে থিন এরারুট বিস্কুট দেওয়া হয়েছিল। সপ্তাহ দুয়েক পরে হঠাৎ সেটা বন্ধ হয়ে গেল। তার পরেও বেশ কিছু দিন আমি আশায় আশায় থাকতাম। সন্ধ্যা হলেই বড় খিদে পায়। কলেজ থেকে আর বাড়ি না ফিরেই পড়াতে আসি বলে আর খাওয়া হয়ে ওঠে না। চা খেলে খিদেটা মরে।

একদিন ছাত্রের এক কাকা এসে বলল, মাস্টারমশাই, আপনি আর এক জায়গায় পড়াবেন? আমার এক বন্ধু বলছিল–একটি বেশ ভদ্দরলোকের ছেলে চায়–

আমি রাজি হয়ে গেলাম। তখন আমার বই কেনার দারুণ নেশা–অথচ পয়সায় কুলোয় না। দু’জায়গায় টিউশানি করলে আমার রোজগারটা ভদ্রগোছের হতে পারে।

এই বাড়িটা আহিরীটোলায় এবং পরিবারটি একটু আলোকপ্রাপ্ত। বাড়িটাও দেখতে সুন্দর, পড়বার ঘরটা দোতলায়, একটি মাত্র ছাত্র, বয়স এগারো বছর, ছাত্রের মা প্রথম দিন আমাকে শোনপাপড়ি আর শরবত খেতে দিলেন। মাইনে এখানে কুড়ি টাকা।

কয়েক দিন বাদেই বুঝলাম, দুটি টিউশানি করলে আমার নিজের পড়াশুনোর সময় পাব না–তাই প্রথম টিউশানিটা ছেড়ে দিলাম।

এই বাড়ির পরিবেশটি অত্যন্ত ঘরোয়া ধরনের। ছাত্রের দাদা আমার সঙ্গে মাঝে মাঝে গল্প করতে আসে। ছাত্রের মা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার বাড়ির খবর জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু একটা মুশকিল, ছাত্রের বাবা এক এক দিন এ-ঘরে বসে হঠাৎ এমন বাঙালদের নিন্দে করতে শুরু করেন যে আমি কাচুমাচু হয়ে যাই। ওঁর অফিসে একটি বাঙাল কর্মচারী রেখেছিলেন, কিন্তু সে-লোকটা এমন গোঁয়ার আর নিমকহারাম সামান্য কথা কাটাকাটিতে একদিন মালিককেই মারতে এসেছিল। এ-জাতকে কখনও বিশ্বাস করতে আছে। এত বেশি রেফিউজি আসতে শুরু করায় কলকাতার মানুষ নতুন করে বাঙালদের ওপরে বিরক্ত।

আমি নিঃসাড় হয়ে বসে থাকি। আমিও যে বাঙাল সেকথা উনি জানেন না। এবং বাঙালের বাঙালত্ব, কয়লার রঙেরই মতন, কখনও ঘোচে না। হঠাৎ একদিন জেনে ফেললে উনি নিশ্চয়ই খুব লজ্জা পাবেন, আমার সামনেই এইসব কথা বলেছেন বলে। কিংবা রেগেও উঠতে পারেন, যদি ভাবেন আমি আত্মগোপন করে ওঁকে ঠকিয়েছি। কিন্তু আত্মগোপন করার প্রশ্ন ওঠে না। প্রথম দিন কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেনি, আমিও কিছু বলিনি। লোককে কি ডেকে ডেকে বলতে হবে যে আমি বাঙাল, আমি বাঙাল!

ওই বাড়িটির সূত্রেই আমি আর এক জায়গায় টিউশানি পেয়ে গেলাম। প্রাইভেট টিউশানির জগতে এ রকম একটা শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যাপার আছে।

এই বাড়িটি নয়নচাঁদ দত্ত স্ট্রিটে, আমার বাড়ির কাছে হয় বলে, আমার পক্ষে সুবিধাজনক। আগেরটা ছেড়ে আমি এইটাই নিলাম। মাইনেও অনেক বেশি, তিরিশ টাকা। আমার প্রায় বড়লোক হয়ে যাবার মতন অবস্থা।

কিন্তু এ-বাড়িতেও ঝাট আছে। গৃহকর্তা খুব লম্বা-চওড়া চেহারার বিশাল পুরুষ, নাকের তলায় শেয়ালের ল্যাজের মতন পুরুষ্ট গোঁফ। গলার আওয়াজ জলদ গম্ভীর।

তিনি প্রথম দিন আমার রীতিমতন একটা ইন্টারভিউ নিলেন। ইস্কুলে কোন পরীক্ষায় কত নম্বর পেয়েছি, ম্যাট্রিকে কোন ডিভিশান, আমার বাবার লেখাপড়া কদুর ইত্যাদি প্রশ্ন থেকে শুরু করে–ভবিষ্যতে আমি কী হতে চাই, তা পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত তিনি আমাকে পছন্দ করলেন। তারপর দিলেন তার শর্ত।

তিনি বললেন, তিনি এককথার মানুষ, মাসের ঠিক এক তারিখে মাইনে দেবেন। গ্রীষ্ম এবং পুজোর সময় সাত দিন করে ছুটি। কিন্তু মাঝখানে কোনও দিনই হঠাৎ ছুটি নেওয়া যাবে না। এবং প্রতিদিন ঠিক তিন ঘণ্টা পড়াতে হবে। সাড়ে ছ’টা থেকে সাড়ে ন’টা! এর এদিক-ওদিক হওয়া চলবে না।

আমি রাজি হয়ে গেলাম। একটি আট বছরের ছেলে, একটি তেরো বছরের মেয়েকে পড়াতে হবে একসঙ্গে। দু’-একদিন পড়িয়েই বুঝতে পারলাম, মেয়েটি কোনও দিনই পাশ করবে না, আর ছেলেটি এতই বুদ্ধিমান যে ঠিকমতন পড়াশুনো করলে ম্যাট্রিকে স্ট্যান্ড করবে। ছেলেটির নাম সুবোধ, মেয়েটির নাম ছন্দা।

এই দু’জনকে একসঙ্গে পড়ানো খুবই অসুবিধাজনক। কিন্তু একজনকে পড়িয়ে ছুটি দিয়ে আর একজনকে পড়ানোও চলবে না। অভিভাবকের হুকুম, দু’জনকেই সাড়ে তিন ঘণ্টা পড়াতে হবে। পড়ানো কিংবা আটকে রাখা।

ছেলেটি দারুণ ছটফটে। তবু ওকে আমার খুব ভালো লাগে। অঙ্ক দিলে চোখের নিমেষে করে ফেলে। ডিকটেশন দিলে বানান ভুল করে না। কিন্তু আমি একটু অন্যমনস্ক হলেই সে ঘর থেকে পালিয়ে যেতে চায়। আর মেয়েটি পড়াশুনো না করে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে।

ছেলেটিকে আটকে রাখার জন্য আমি একটা করে গল্পের বই নিয়ে যাই। সে তাতে বেশ আটকে থাকে। আর মেয়েটিকে আমি বলি, পড়ার বই থেকে পাতার পর পাতা টুকতে। তার তো এমনিতেই কিছু হবে না হাতের লেখাটা অন্তত ভালো করুক।

প্রথম টিউশানিটা নিয়ে আমি বন্ধুবান্ধব বা বাড়ির কারোকে কিছুই বলিনি। বাড়িতে বলিনি, কারণ টাকাটা আমি সম্পূর্ণ নিজে খরচ করতে চাই। মায়ের কাছ থেকে যে দু’একটা টাকা হাতখরচ মাঝে মাঝে পাই, সেটাও যাতে বন্ধ না হয়। আড্ডা দিয়ে সাড়ে ন’টা-দশটার সময়ই বাড়ি ফিরি তখন–কেউ কিছু বুঝতে পারে না।

বন্ধুদের বলিনি লজ্জায়। কারণ, বন্ধুরা আর কেউ তো টিউশানি করে না। নিয়মিত আড্ডায় যাই না কিংবা আড্ডা থেকে হঠাৎ উঠে যাই দেখে ওরা অবাক হয়ে অনেক প্রশ্ন করে। আমি মিথ্যে কথার ফুলঝুরি ছড়াই।

শুধু রেণুর কাছেই একদিন কথায় কথায় বলে ফেললাম। ছাত্রছাত্রীদের সম্পর্কে এত সব গল্প মনের মধ্যে টগবগ করে যে কারোকে না বলে কত দিন আর থাকব।

রেণু বলল, তুই প্রত্যেক দিন সন্ধেবেলা ওখানে যাস?

হ্যাঁ।

আর যেতে হবে না—

কেন?

আমি বলছি।

রেণু গম্ভীর ভাবে হুকুমের সুরে এই কথা বলে। আমিও গম্ভীর ভাবে উত্তর দিই, এটা মানা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

রেণু বলল, তুই কিন্তু আমার একটা কথাও মানিস না। অথচ কী যেন একটা প্রতিজ্ঞা করেছিলি?

আমি বললাম, সেটা এইসব সাধারণ ব্যাপারে নয়। সেটা জীবনের অনেক গভীর ব্যাপার সম্পর্কে।

এইসব কারণেই আজকাল তোর কবিতা লেখা হচ্ছে না!

লিখব লিখব, অনেক লিখব।

রেণু রাগ করে কয়েক দিন আমার সঙ্গে কথা বন্ধ করে দেয়।

এর মধ্যেই আমি টিউশানিতে ফাঁকি দিতে শুরু করেছি। ছাত্রছাত্রীকে অন্য কাজে ব্যস্ত রেখে আমি অনেক সময় নিজের কাজ করি।

পকেট থেকে ছোট্ট একটা নোটবই বার করে আমি কবিতা লেখার চেষ্টা করি। কবিতা মাথায় আসে না। রেণুকে চিঠি লিখতে ইচ্ছে করে শুধু। একটা লাইনই বার বার লিখে যাই, রেণু, আমাদের কখনও ভুল বোঝাবুঝি হবে না।

এ-বাড়িটি কিন্তু বেশ রহস্যময়। প্রায়ই ওপরে দুপদাপ আওয়াজ শুনতে পাই। এক এক সময় মনে হয় কে যেন কাকে চাবুক দিয়ে খুব মারছে। একজন মহিলার গলার আর্ত চিৎকার ভেসে আসে। আমি সচকিত ভাবে তাকিয়ে দেখি, আমার ছাত্রীটি মুখ নিচু করে আছে। টপ টপ করে জল পড়ছে তার চোখ দিয়ে।

তখন আমার কোনও প্রশ্নেরই সে উত্তর দেয় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *