ঊনষাট
তিন নম্বর ঈশ্বরপুকুর লেনে একটি অভিনব কাণ্ড আরম্ভ হল। ব্যাপারটা যে এইরকম পর্যায়ে পৌঁছাবে তা অর্ক কখনও চিন্তা করেনি। সেদিন টাকাটা নিতে চায়নি সে। মনে হয়েছিল লোকটা মতলববাজ। নাহলে এইভাবে টাকা দেবার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকে? নিশ্চয়ই অন্য কোন ধান্দা আছে।
সে বলেছিল, ‘যদি আমি ওই টাকায় সারা মাস আপনার পরিবারকে খাওয়াতে পারি তাহলে আপনিও পারবেন।’
‘না, আমি পারছি না। তুমি যখন বলেছ পারবে তখন তোমাকে পারতে হবে। নইলে বস্তির সবার সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চাইতে হবে আমাকে মারার জন্যে। বলতে হবে তুমি অন্যায় করেছ।’
‘আমি কোন অন্যায় করিনি। আপনি মদ খেয়ে খিস্তি করছিলেন। আমি যা করেছি তা ঠিক করেছি।’
‘তাহলে যা বলেছ তা ঠিকভাবে পালন কর।’
‘আপনার মতলবটা কি খুলে বলুন তো?’
‘কোন মতলব নেই। তুমি যা বলেছ তাই করো। আমি আর মদ্যপান করব না কথা দিচ্ছি।’
‘ঠিক আছে। আপনি আপাতত টাকাটা রাখুন। আমি কাল সকালে আপনার সঙ্গে কথা বলব। আমার মা হাসপাতালে। এখন আমি কিছু ভাবতে পারছি না।’
‘সে কথা বললে অবশ্য কিছু বলার থাকে না। তবে আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু তোমাকে টাকাটা নিতেই হবে। নইলে আমি ছাড়বো না। তুমি আমাকে প্রকাশ্যে অপমান করেছ। গুণ্ডা তাড়ালেই কি সব হয় বাবা, আমাদের পেটের ওপর যে গুণ্ডামি হয় সেটা বন্ধ করো আগে তবে বুঝি!’
‘ঘরে ঢুকে অর্ক দেখেছিল অনিমেষ শুয়ে আছে। ওকে দেখে বলল, ‘তোদের মিটিং কেমন হল?’
‘হল!’ অর্কর মন স্থির ছিল না।
অনিমেষ ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হয়েছে?’
‘কিছু না।’
‘গোলমাল হয়েছে?’
‘না। জানো বাবা, বিখ্যাত মানুষের কাজ আর কথা সব সময় এক হয় না। যাঁরা আজকে আসবেন বলে কথা দিয়েছিলেন তাঁরা কি সুন্দর কেটে পড়লেন। তাঁদের অপরাধ ঢাকতে শান্তি কমিটিকে একগাদা মিথ্যেকথা বলতে হল।’
‘তুই কাদের আনতে গিয়েছিলি?’
অর্ক নামগুলো বলল। এমন কি সেই চিত্রাভিনেতার সঙ্গে তার বাক্যালাপ পরিণামে মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা, কিছুই বাদ দিল না। শুনতে শুনতে অনিমেষ উত্তেজিত হয়ে উঠল, ‘আরে কি আশ্চর্য। এতগুলো বছর হয়ে গেল তবু লোকটা একটুও পাল্টায়নি।’
অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি চেনো ওঁকে?’
‘দুদিন দেখেছিলাম। য়ুনিভার্সিটিতে ভিয়েৎনামের ওপর একটা অনুষ্ঠানে ওঁর দল নাটক করেছিল। উনি করেননি। কারণ আমরা ওঁর জন্যে পয়সা দিতে পারিনি। অথচ সেদিন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে তিনি জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছিলেন। একগাদা মিথ্যে কথা। সারাটা জীবন লোকটা ভাঁওতা দিয়ে কাটিয়ে গেল? আশ্চর্য!’
রাত্রে খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়ে পড়ার পরও ঘুম এল না। অর্কর মাথার মধ্যে শুধু বুড়োর কথাগুলো পাক খাচ্ছিল। গুণ্ডা তাড়ালেই কি সব হয় বাবা, আমাদের পেটের ওপর যে গুণ্ডামি সেটা বন্ধ করো আগে তবে বুঝি! চোখ বন্ধ করলেই যেন শীর্ণ হাতের মুঠোয় ধরা টাকাগুলো সামনে চলে আসছিল। শেষ পর্যন্ত উঠে বসেছিল অর্ক। সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘ঘুমোসনি?’
‘তুমি জেগে আছ?’
‘তোর মায়ের কথা ভাবছিলাম। চেহারাটা কেমন যেন পাল্টে গিয়েছে, না?’
অর্ক বাবার দিকে তাকাল। অন্ধকারে বাবার মুখ দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ তার মনে অন্যরকম অনুভূতি এল। কেমন একটা কষ্ট, বাবার জন্যে একধরনের মমতা যা তার কোনকালে কখনও মনে আসেনি। জলপাইগুড়ি থেকে আসার পর আজ এই মুহূর্তে অর্কর মনে অনিমেষ সম্পর্কে আর কোন ক্ষোভ রইল না। সে কোন জবাব দিল না। অনিমেষ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিঃশ্বাস ফেলল, ‘জীবনটা মিছিমিছি খরচ হয়ে গেল।’ তারপরেই সে যেন সচেতন হল, ‘তুই ঘুমোসনি কেন?’
অর্ক কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর ধীরে ধীরে ঘটনাটা খুলে বলল। সব শুনে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘তুই কি করবি ভেবেছিস?’
‘বুঝতে পারছি না। লোকটা যেন আমাকে জব্দ করতে চাইছে।’
‘তুই জব্দ হবি কেন?’
‘কি করব আমি?’
‘তুই চ্যালেঞ্জটা অ্যাকসেপ্ট কর।’ অনিমেষ উত্তেজিত হয়ে উঠে বসল, ‘বিখ্যাত ব্যক্তিরা যেসব থিওরি দিয়ে গেছেন সেসব বাস্তবে সম্ভব হয় কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা যাক। কিন্তু একটা ফ্যামিলি নয়। এই বস্তিতে ওইরকম আয়ের পরিবারগুলো একত্রিত করে এই পরীক্ষা চালাতে হবে। অর্ক, আমি তোর সঙ্গে আছি।’
‘কিন্তু বাবা, অন্য সবাই রাজি হবে কেন?’
‘হবে। কারণ প্রত্যেক মানুষ একটা রিলিফ চায়।’
সেই রাত্রে অনেকক্ষণ ওদের কথা হয়েছিল। অন্ধকার ঘরে পিতা এবং পুত্র পরস্পরের মুখ দেখতে পায়নি কিন্তু উত্তেজনার স্পর্শ পেয়েছিল। বাবাকে এতটা উৎসাহিত হতে অর্ক কখনও দ্যাখেনি।
পরের দিন সকালে দ্বিতীয় ব্যক্তিটি স্বেচ্ছায় এগিয়ে এলেন। দরজায় দাঁড়িয়েছিল হরিপদ। বউ মারা যাওয়ার পর লোকটার দেখাই পাওয়া যেত না। এখন ন্যাড়াই যেন অনেক বেশী সাবালক হয়ে গেছে। অনুপমা আসে যায়। দরজায় দাঁড়িয়ে হরিপদ তার প্রায় মিনমিনে গলায় বলল, ‘একটু কথা আছে।’
অর্ক তাকাল। খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি নিয়ে লোকটা ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে। এই পৃথিবীতে যেন মানুষটার জোর করে বলার কিছু নেই। সে দাঁড়াতেই হরিপদ এগিয়ে এল, ‘সত্য মিথ্যে জানি না, তুমি নাকি দুশো টাকা দিলে একটা পরিবারকে সারা মাস খাওয়াবে। শুনলাম কিন্তু বিশ্বাস হল না। সত্যি?’
অর্ক মাথা নাড়ল, ‘অনেকটা তাই। তবে পরিবার বলতে যদি একশজন মানুষ হয় তাহলে পারব না।’
‘আমার তো বেশী লোক নেই। সে চলে গেছে। অনু তো এখন শ্বশুরবাড়িতে, থাকার মধ্যে আমি আর ওরা তিনজন। খুব বেশী হবে?’
‘না।’ অর্ক মাথা নেড়েছিল।
‘তাহলে বাবা তুমি আমাকে উদ্ধার করো। আমি আর বোঝা টানতে পারছি না। যে ক’দিন আছি তোমার ওপর দায়িত্ব দিলাম। কিন্তু একটা কথা, তুমি আগ বাড়িয়ে দায়িত্ব নেবে কেন?’
‘কেন বলুন তো?’
‘সেটাই তো বুঝতে পারছি না। এতে কি তোমার কোন লাভ হবে? আমি নিজে দুশো টাকায় ওদের মুখ বন্ধ করতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি—তুমি কি করে তা থেকে লাভ করবে? আমার মাথায় ঢুকছে না।’
‘থাক।’ অর্ক হেসে ফেলল, ‘এ নিয়ে চিন্তা করে কি হবে। আমি লাভ করলে তো আপনার আপত্তি নেই!’
‘না আপত্তি কিসের! শুধু ওরা যেন দুবেলা পেট ভরে খেতে পায়।’
‘আমি এখনই আপনাকে কথা দিচ্ছি না। তবে পেট ভরে খাওয়া মানে খুব সাধারণ খাওয়া। এই নিয়ে কারো কোন নালিশ করা চলবে না। আসলে যাঁদের পুরো মাস খাওয়া জোটে না তাঁরাই আসতে পারেন।’
‘বুঝেছি, বুঝেছি। আমি বলছি না তুমি পোলাও কালিয়া খাওয়াবে। দুবেলা পেট ভরলেই হল।’
খবরটা যেন তিন নম্বরে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। সবাই অর্ককে জিজ্ঞাসা করছে কথাটা সত্যি কিনা। দেখা যাচ্ছিল বেশীরভাগ পরিবার যেন নিজেদের কাঁধ থেকে দায়িত্ব নামিয়ে দিতে পারলে বাঁচে। আবার উল্টো সন্দেহের কথাও কানে আসছিল। হাসপাতালে যাওয়ার আগে অর্ক শান্তি-কমিটির অফিসে গেল। কয়লার বিরুদ্ধে এলাকার বাসিন্দাদের পক্ষে কয়েকটি মামলা করা হয়েছে। সেই মামলার খরচ চালানোর জন্যে চাঁদা তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সুবল সতীশদা সে ব্যাপারে ব্যস্ত। একটু ফাঁক পেলে অর্ক ওদের কাছে কথাটা তুলল।
সুবল বলল, ‘তুমি ক্ষেপেছ? সাধ করে এসব ঝামেলায় কেউ জড়ায়? দুদিন বাদে সবাই বদনাম দেবে। তাছাড়া অন্যের হাতে টাকা তুলে দিলেই মানুষের মনে বাবুয়ানা এসে যায়। তখন দেখবে হুকুম করবে।’
অর্ক বলল, ‘কিন্তু যদি করা যায় তাহলে মানুষগুলোর সত্যিকারের উপকার হতো। এদিকের সমাজবিরোধীরা তিন নম্বরের অভাবকে কাজে লাগায়। যদি পেট-ভরা খাবার পায় তাহলে—।’
‘বোকার মত কথা বলো না। আমরা মানুষের ব্যক্তিগত সমস্যায় নাক ঢোকাতে চাই না। তাছাড়া দুশো টাকায় চারজন মানুষকে তুমি কিভাবে খাওয়াবে যদি তারা সেটা নিজেরা না পারে!’
অর্ক বলল, ‘আমি কালকে হিসেব করেছি। সেটা সম্ভব। অনেক মানুষ একসঙ্গে খেলে সেটা সম্ভব। আর তার ওপরে যদি বাইরের সাহায্য পাওয়া যায় তাহলে তো কথাই নেই।’
‘কিন্তু আলটিমেট লাভ কি হবে?’
‘সবাই যদি একত্রিত হয়, একটা পরিবারের মত সম্পর্ক হবে। এখন যেসব কাজ করা সম্ভব নয় তখন সেটা সহজ হবে।’
সুবল বলল, ‘আকাশকুসুম কল্পনা।’
এইবার সতীশদা কথা বলল, ‘অর্ক, তোমার মাথায় কমিউনের চিন্তা কে ঢোকাল? তার জন্যে একটা রাজনৈতিক শিক্ষা প্রয়োজন।’
অর্ক উঠে দাঁড়াল, ‘যদি বাইরের গুণ্ডামি রুখতে আমরা কোন রাজনৈতিক শিক্ষা ছাড়া এক হতে পারি তাহলে পেটের খিদে মেটাতেও এক হতে পারব। দেখি কি করা যায়!’
সুবল বলেছিল, ‘অর্ক, এটা তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। শান্তি কমিটিকে এর সঙ্গে জড়িও না। এতবড় একটা ব্যাপার সামলাতে আমরা নাস্তানাবুদ হচ্ছি।’
এইসব কথা শুনে অর্কর জেদ আরও বেড়ে গেল। ওরা যদি যুক্তি দিয়ে তাকে বোঝাতো সে মেনে নিত। কিন্তু শুধুই সমালোচনা, ঝামেলা এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে উপদেশ—এগুলো শুনলেই মনে অন্য রকম প্রতিক্রিয়া হয়।
হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে তার জন্যে অন্য বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। গেটের কাছে বিলু দাঁড়িয়ে, একা।
অর্ক অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘থানায় যাসনি?’
হাসল বিলু, ‘গিয়েছিলাম। শালারা আমাকে পছন্দ করল না।’
‘মানে?’
‘মানে আবার কি? বলল, শান্তি কমিটির লিস্টে যদিও আমার নাম আছে কিন্তু কোন ঠিকঠাক অভিযোগ নেই। একরাত হাজতে রেখে বলল, যা শালা, শান্তি কমিটির সঙ্গে বোঝাপড়া করে নে।’
‘কোয়া?’
‘ওকে ধরেছে। খুব আদর করছে। গুরু, আমি কয়লার সঙ্গে কদিন মাল টানার ব্যবসা করেছি, গুণ্ডামি তো করিনি। এখন কি হবে?’
‘যা তাহলে শান্তি কমিটির কাছে। গিয়ে বল।’
‘আমি একা পাড়ায় ঢুকতে সাহস পাচ্ছি না।’
‘অর্ক বিলুর দিকে তাকাল, ‘তুই সত্যি থানায় গিয়েছিলি তো?’
চোখ কপালে তুলল বিলু, ‘আই বাপ! আমি কি মিথ্যেকথা বলছি? তুমি আমার সঙ্গে থানায় চল তাহলে।’
‘ঠিক আছে। তুই আমার সঙ্গে পাড়ায় চল।’
ফেরার পথে অর্ক বিলুকে ঘটনাটা বলল। তার মাথায় যে জেদ চেপেছে সেই কথাও। বিলু বলল, ‘কাজটা ভাল, কিন্তু মুনাফা?’
‘কিসের মুনাফা?’
‘মাল আসবে এ থেকে?’
‘ভ্যাট। আমি চাইছি তিন নম্বরের গরীব মানুষগুলো দুবেলা পেট ভরে খেয়ে বাঁচুক। তাহলেই পরিবেশটা পাল্টে যাবে। এর পরে আমরা তিন নম্বরের বেকার ছেলেদের নিয়ে আরও কিছু করতে পারি।’
বিলু হাল ছেড়ে দিল, ‘আমি আর পারছি না। ক’দিন চোরের মত ঘুরে ঘুরে পাগলা হয়ে গেছি। ঠিক আছে, এখন তুমি যা বলবে আমি তাই করব। এতে তো পাড়ায় থাকা যাবে।’
বিলুকে নিয়ে শান্তি কমিটির সঙ্গে অর্কর একটু ঝামেলা হল। যতক্ষণ না বিলু সমাজবিরোধী নয় বলে প্রমাণিত হচ্ছে ততক্ষণ তাকে পাড়ায় ঢুকতে দিতে শান্তিকমিটি চায়নি। অর্ক বলেছিল, ‘ও যে সমাজবিরোধী সেটা প্রমাণ করুন আগে। পুলিস যখন বলেছে কোন কেস নেই তখন আমরা কি করতে পারি। তাছাড়া এ ব্যাপারে যা শাস্তি পাওয়ার ও পেয়েছে।’
শেষ পর্যন্ত ঠিক হল, বিলুর সমস্ত দায়িত্ব অর্কর। ভবিষ্যতে যদি বিলু কোন কাজ করে তবে তার জন্যে অর্ক দায়ী থাকবে। বিলুকে দিয়ে অর্ক প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিল, অন্তত মাসখানেক সে অন্য কোন ধান্দায় যাবে না। অর্ক যা বলবে তা শুনতে হবে।
কিন্তু এর মধ্যেই তিন নম্বরে একটা আলোড়ন উঠেছে। অর্ককে প্রতিনিয়ত নানান প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে। অনিমেষের সঙ্গে কথা বলে অর্ক শেষ পর্যন্ত পা বাড়াল। তিন নম্বরের মাঝখানে যে জলের কল আছে তার পাশে খানিকটা খোলা জায়গায় মেয়েরা গল্প করত। সেই জায়গাটিকে নির্বাচন করা হল। ঈশ্বরপুকুর লেনের একমাত্র ডেকোরেটরের দোকান থেকে ত্রিপল ভাড়া করে আনা হল। সেই সঙ্গে বড় বড় হাঁড়ি কড়াই। ঠিক হল, মাসকাবারে ভাড়া দেওয়া হবে। ছ’টি পরিবার এগিয়ে এসেছিল অর্কর কাছে। তাদের কাছে মাথাপিছু পঞ্চাশ টাকা করে নেওয়া হল। বিলুকে ক্যাশের ভার দিল অর্ক। প্রথমে দ্বিধা এবং নিরাসক্তি কাজ করলেও হঠাৎই যেন খুব উৎসাহিত হয়ে পড়েছে বিলু। চিৎকার চেঁচামেচি করে খাটছে, খাটাচ্ছে। ন্যাড়াকে সঙ্গে পাওয়া গেল। বিলু আসার পর ন্যাড়া সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে। কিন্তু রান্নার লোক নিয়ে সমস্যা হল। ন্যাড়া এবং অর্কর বাড়িতে কোন মহিলা নেই এই মুহূর্তে যে রান্না করতে পারে। অন্য চারটি পরিবারের মেয়েরা এত লোকের রান্না করতে রাজি নয়। তারা নানা রকম বাহানা করতে লাগল। রান্নার মেনু কি হবে তা নিয়েও মতবিরোধ শুরু হল। শেষ পর্যন্ত অর্ক বলল, ‘আমার হাতে যখন আপনারা টাকা দিয়েছেন তখন আমি যা বলব তা আপনাদের শুনতে হবে। এই টাকায় যা খাওয়ানো সম্ভব তাই ব্যবস্থা করা হবে। আপনারা অভুক্ত থাকবেন না এই কথা ছিল। এর বেশী কিছু চাইলে সম্ভব নয়।’
অসন্তোষ চলছিল। যদিও মুখ ফুটে কেউ কিছু বলছিল না। অর্কর মুখের দিকে সেই মাতাল বুড়ো পিটপিটিয়ে তাকায়, ভাবখানা, কি হে কেটে পড়বে নাকি? তাহলে আমি কিন্তু ছাড়ব না।
অর্কর লোকটাকে দেখলেই জেদ বেড়ে যায়। সে ঠিক করল যেমন করেই হোক একটা মাস অন্তত চালাতে হবে। কিন্তু রাঁধবে কে?
সেদিন বিকেলে হাসপাতালে শুয়ে মাধবীলতা হেসে বলল, ‘আমার হাতের রান্না যদিও খুব খারাপ তবু একবার চেষ্টা করতে পারি।’
অর্ক আঁতকে উঠল, ‘তুমি রাঁধবে? মাথা খারাপ।’
‘কেন? আমি তো ভাল হয়ে গিয়েছি।’
কথাটা অর্ধসত্য। মাধবীলতার এখন তেমন কোন অসুবিধে না থাকলেও শরীর প্রচণ্ড দুর্বল। এখনও সাদাটে ভাব রয়েছে। সেলাই কাটা হয়েছে। ডাক্তার অবশ্য কিছুদিন রেখে দিতে চাইছেন কিন্তু মাধবীলতা ছটফট করছে বাড়িতে ফিরবার জন্যে।
হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পথে অর্ক দেখল ঝুমকি আসছে। সেই দিনের পর এই প্রথম ঝুমকিকে দেখল সে। তাকে দেখে ঝুমকি এমন ভঙ্গীতে ট্রামের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল যাতে বোঝা যায় এড়াতে চাইছে। অর্ক খানিকটা দৌড়ে ওকে ধরে ফেলল, ‘কি ব্যাপার?’
‘কিসের কি ব্যাপার?’
‘আমাকে দেখে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছিল কেন?’
‘আমার কি দরকার পড়েছে এড়িয়ে যাওয়ার?’
‘কি ব্যাপার বলো তো, রাগ করেছ?’
‘আমার রাগের আর কি দাম আছে?’
‘বুঝেছি। যাচ্ছ কোথায়?’
‘যেখানে ইচ্ছে!’
‘এত সেজেগুজে?’
‘আমাদের সাজ না দেখলে তো কেউ পকেটে হাত দেবে না।’
‘মানে?’
‘মানে বোঝার মত যথেষ্ট বয়স হয়েছে। ছেড়ে দাও পথ, আমি যাব।’
‘তুমি সেই ক্যাবারে ড্যান্সারের কাছে যাচ্ছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘কেন? তুমি তো ছেড়ে দিয়েছ সেসব।’
‘আমি কোনদিন ড্যান্সার হতে পারব না। কিন্তু আমাদের পেট তো এই কথা শুনবে না। কদিন ধরে বাড়িতে বসে বসে আর সহ্য করতে পারছি না।’
‘তাই শরীর বিক্রি করতে বেরিয়ে পড়লে?’
‘নইলে এই শরীরটাকে দড়িতে ঝোলাতে হয়।’
‘ঘেন্না করে না তোমার?’
হঠাৎ ঝুমকির মুখ শক্ত হয়ে গেল, ‘অন্য কেউ হলে আমি জবাব দিতাম। তোমার বাবাও তো আমাকে ঘেন্না করেন, তাই না। আমার হাতের রান্না খেতে তাঁর আপত্তি। শোন, এছাড়া আমার কোন উপায় নেই।’
অর্ক হতভম্ব হয়ে গেল। তার পর সে মাথা নাড়ল, ‘তোমার যাওয়া চলবে না।’
ঝুমকি হাসল, ‘গায়ের জোরে? এখনই সমাজবিরোধী বলে চেঁচাব নাকি?’
‘সমাজবিরোধী?’ অর্ক হেসে ফেলল, ‘ভাল বলেছ। কে সমাজবিরোধী নয় সেটাই বোঝা মুশকিল। গায়ের জোর খাটাবো তেমন জোরও নেই। কিন্তু তুমি না গেলে আমার ভাল লাগতো। তুমি নষ্ট হয়ে যাবে।’
তবু তো বেঁচে থাকব। বাঁচাতে পারব। আমি দুদিন কিছু খাইনি।’
হঠাৎ অর্কর মাথায় একটা চিন্তা পাক খেয়ে গেল। সে গাঢ় গলায় বলল, ‘আমি যা বলব তা তুমি শুনবে?’
‘কি?’
‘তুমি আমার সঙ্গে ফিরে চল।’
‘তারপর?’
‘আমার সঙ্গে কাজ করো।’
‘কি কাজ?’
‘আমি যা বলব তাই। তুমি আমাকে সাহায্য করবে না?’
‘তাতে আমার কি লাভ?’
অর্ক বলল, ‘বুঝিয়ে বলছি। তুমি আমার সঙ্গে ফিরবে?’
ঝুমকির ইতস্তত ভাবটা যাচ্ছিল না। একটা ট্রামকে চলে যেতে দেখল সে। তারপর যেন অনিচ্ছায় অর্কর সঙ্গে হাঁটতে লাগল। অর্ক সেটা লক্ষ্য করল, ‘তুমি কি খুব বড়লোক হতে চাও?’
‘কে বলেছে! আমি স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে চাই।’
‘তুমি নিশ্চয়ই শুনেছ আমরা তিন নম্বরে কি করতে যাচ্ছি?’
‘শুনেছি। কিন্তু সেই টাকাটা দেবার সামর্থ্য আমার নেই।’
‘তোমার কাছে টাকা চেয়েছে কে?’
‘মানে?’
‘তুমি রান্নার ভারটা নাও।’
‘রান্না?’
‘হ্যাঁ, সেদিন আমাদের দুজনের ভাত রাঁধতে চেয়েছিলে আজ এই বড় দায়িত্বটা তোমাকে নিতে হবে।’
‘এত লোকের রান্না আমি রাঁধতে পারব?’
‘তুমি একা থাকবে না। তুমি এগিয়ে এলে অন্য মেয়েরাও আসবে। তোমার ওপর ভার থাকলে আমি নিশ্চিন্ত হতে পারি।’
‘কিন্তু?’
‘তোমাদের খাওয়াবার দায়িত্ব আমাদের। তোমরা তো তিনজন?’
ঝুমকি হাসল, ‘অন্য কেউ হলে না বলতাম। কিন্তু এতে কি আমাদের অভাব মিটবে। নাহয় খালিপেটে থাকতে হল না।’
‘সেটা তো কম কথা নয়। পেট ভর্তি থাকলে অন্য কাজের কথা চিন্তা করতে অসুবিধে হয় না। কি, রাজি?’
ঝুমকি মুখ তুলে তাকাল। তার রঙকরা মুখটা হঠাৎ যেন স্বাভাবিক হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। সে বলল, ‘হ্যাঁ।’
a