2 of 2

৫৮. মাওলানা ভাসানী

কোলকাতায় পার্ক সার্কাসের একটি অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের নাম কোহীনূর ম্যানশন। কোহীনূর ম্যানশনের মাঝারি ধরনের ফ্ল্যাটে বাংলাদেশের প্রবাদ পুরুষ মাওলানা ভাসানী বাস করেন। তাঁর সঙ্গী মুজাফফর-ন্যাপের এক সময়ের কমী জনাব সাইফুল ইসলাম। সাইফুল ইসলামের দায়িত্ব বিভিন্ন জায়গায় মাওলানা ভাসানীর বিবৃতি পাঠানো, রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে লেখা চিঠি কপি করা। চিঠি পাঠানোর ব্যবস্থা করা।

মাওলানা সেখানে খানিকটা নির্বাসিত জীবন-যাপন করছেন; স্বাধীনতা যুদ্ধের মূলধারা থেকে আলাদা। সংগ্ৰামময় দীর্ঘ জীবন পার করে এখন একটু যেন ক্লান্ত।

তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে নিজের হাতে একটি চিঠি লিখেছেন। তার বক্তব্য–

আমার প্রথম পুত্রের মৃত্যু হয় ধুবড়ির গ্রামে। তাই আমার
বৃদ্ধ স্ত্রীর আশা শেষ দাফন ধুবড়ির কোনো গ্রামে হয়।…*

চিঠিতেও বিষাদের সুর। যেন তিনি দূরাগত ঘণ্টা ধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন।

মাওলানা ভাসানী তার ফ্ল্যাটের বসার ঘরে বসে আছেন। তার পরনে সেলাইবিহীন লুঙ্গি, গায়ে ধবধবে সাদা ফতুয়া। ডান হাতে তসবির ছড়া। তিনি তসবি টানছেন। তাঁর দৃষ্টি স্থির। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ। প্রধানমন্ত্রী মাওলানার পা স্পর্শ করে সালাম করলেন। বিনীত, গলায় বললেন, হুজুর কেমন আছেন?

মাওলানা বললেন, ভালো আছি মনের সুখে মাছি মারতেছি। এদিকে অনেক মাছি।

আপনার খাওয়া দাওয়ার কোনো অসুবিধা কি হচ্ছে?

মাওলানা তসবি টানা বন্ধ করে বললেন, খাওয়া দাওয়ার সুবিধা অসুবিধার কথা বাদ দেও। কোনো কাজের কথা থাকলে বলো।

হুজুর, আমি নানান অসুবিধায় আছি।

কেউ সুবিধায় নাই। তবে তোমার অসুবিধা বুঝতে পারি। বাতাস বড় গাছে লাগে। ছোট গাছে লাগে না। তুমি এখন বড় গাছ।

বড় গাছ হওয়ার বাসনা কোনো দিন আমার ছিল না।

হ্যাঁ, এই কথাটা সত্য বলেছ।

আপনার কাছে পরামর্শের জন্যে এসেছি।

শোনো তাজউদ্দিন, আমি পরামর্শের মুদির দোকান খুলি নাই। দোয়া যদি চাও বলো দোয়া দিতে পারি।

আমি আপনার কাছে পরামর্শ চাই।

কোন বিষয়ে?

তাজউদ্দিন চুপ করে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ মওলানার হাতের তসবি দ্রুত ঘুরল। একসময় তসবির ঘূর্ণন বন্ধ হলো। তিনি শান্ত গলায় বললেন, নিজের বুদ্ধিতে চলবা–এইটাই আমার পরামর্শ। যুদ্ধের বাজারে ভেজাল বুদ্ধির বিকিকিনি হয়। বুদ্ধি কিনতে গেলে ভেজাল বুদ্ধি পাইবা। এই আমারে দেখ, সারাজীবন নিজের বুদ্ধিতে চলেছি। ভালো কথা, তোমার কি ক্ষুধা হয়েছে? কিছু খাবা?

তাজউদ্দিন না-সূচক মাথা নাড়লেন। মাওলানা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, বয়স হয়ে গেছে। শরীরে শক্তি নাই। মনে শক্তি আছে শরীরে নাই। শরীরে শক্তি থাকলে তোমারে বলতাম, আমারে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার বানায়া আমার নিজ গ্রামে পাঠায়ে দেও।

অনেক বড় যুদ্ধ অস্ত্র ছাড়া করা যায়।

শেষে কিন্তু অস্ত্ৰ লাগে। খবরের কাগজে দেখলাম, ফ্রান্সের আঁদ্রে মালরো এই বয়সেও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে থেকে সরাসরি যুদ্ধ করতে চান। খবরটা পড়ে এত ভালো লেগেছে সঙ্গে সঙ্গে চোখে পানি এসেছে। আমি খাস দিলে উনার জন্যে দোয়া করেছি। আমি উনাকে ধন্যবাদ জানায়ে একটা পত্ৰ দিব। তুমি পাঠাবার ব্যবস্থা করো।

জি করব। আমার প্রতি আপনার আর কোনো আদেশ কি আছে?

একটা আদেশ আছে। আদেশ বলো, অনুরোধ বলো, নির্দেশ বলো একটা আছে।

বলুন কী আদেশ?

আমাকে স্বাধীন বাংলাদেশের ধুবড়ি গ্রামে পাঠাবার ব্যবস্থা করো। আমার সময় শেষ হয়ে আসছে। আমি আমার নিজ গ্রামে মরতে চাই।

মাওলানা চোখ বন্ধ করলেন। আবারো তসবি ঘুরতে লাগল। প্রধানমন্ত্রী উঠার ভঙ্গি করতেই মাওলানা ইশারায় তাঁকে বসতে বললেন। মাওলানা চোখ মেলে শান্ত গলায় বললেন, মাথা কাছে আনো, তোমার জন্যে একটু দোয়া করে দেই। ভালো কথা, আমার এখান থেকে কিছু মুখে না দিয়া যাবে না। চালভাজা খাবে? চাল ভাজতে বলি। তেল-মরিচ দিয়ে চালভাজা খাও। বাংলাদেশী খাদ্য।

প্রধানমন্ত্রী মাথা এগিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। মাওলানা তাঁর মাথায় হাত রেখে বিড়বিড় করে দোয়া পড়ছেন।

—————

সূত্র : স্বাধীনতা ভাসানী ভারত, সাইফুল ইসলাম

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *