ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার প্রায় এক কোণে একটা নির্জন জায়গা গাছপালা দিয়ে ঘেরা, কাছাকাছি কোনো পাকা বাড়ি নেই। সেখানে মস্ত বড় একটা শিশুগাছের তলায়, অনেকখানি। ভূগর্ভে কংক্রিট দিয়ে বানানো হয়েছে কয়েকটি ঘর। নভেম্বর থেকে এই নিরাপদ, গোপন। জায়গাটিতেই সরিয়ে আনা হয়েছে পূর্বাঞ্চলের আর্মি কমান্ডের সদর দফতর। উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার ছাড়া অন্যদের এখানে প্রবেশ নিষেধ। সেনাবাহিনীতে এর নাম ট্যাকটিক্যাল হেড কোয়ার্টার, সংক্ষেপে ট্যাক।
শীতের সন্ধ্যা, বাতাস নেই বলে গাছের একটি পাতাও নড়ে না। চতুর্দিকে কোনো শব্দ নেই। দু’ জন স্টাফ অফিসারের সঙ্গে জুতোয় শব্দ তুলে সেই শিশুগাছটার নীচে এসে পৌঁছোলেন জেনারেল নিয়াজী। বাংলার শীত তাঁর কাছে তুচ্ছ মনে হয়, তিনি গরম পোশাকের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। তাঁর পরনে সামার ট্রাউজার্স, একটা ধূসর রঙের বুশ শার্ট এবং গলায় একটা সিল্কের স্কার্ফ জড়ানো। সরু সিঁড়ি দিয়ে তিনি নামতে লাগলেন মাটির নীচে। টিউব লাইটের আলোয় সেই ভূগর্ভও দিনের মতন উজ্জ্বল।
লম্বা করিডরের দু’পাশে ঘর। পর পর কয়েকটি ঘর পার হয়ে জেনারেল নিয়াজী ঢুকলেন একটি প্রশস্ত কক্ষে। সে ঘরের তিন দিকের দেওয়ালই বড় বড় মানচিত্র দিয়ে ঢাকা। এক পাশে সারি সারি কয়েকটি টেবিলের ওপর টেলিফোন ও ওয়্যারলেস সেট। মেজর জেনারেল সামসেদ, মেজর জেনারেল ফরমান, রিয়ার অ্যাডমিরাল শরীফ এবং আরও তিরিশজন অফিসার সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত। সকলেই গম্ভীর।
ঘরের মাঝখানে গটগট করে এসে দাঁড়িয়ে সেনাপতি নিয়াজী উচ্ছল গলায় বললেন, চীয়ার আপ! ফাইনালি দা ওয়ার হ্যাঁজ বিগান!
নিয়াজীর মুখে একটুও দুশ্চিন্তার রেখা নেই। বরং তিনি বেশ উৎফুল্ল। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যুদ্ধ লাগবে, কি লাগবে না বা কখন লাগবে, এই উদ্বেগ তাঁর সহ্য হচ্ছিল না। মাথার ওপর সর্বক্ষণ যুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে বসে থাকার চেয়ে প্রকৃত যুদ্ধ করা একজন যোদ্ধার পক্ষে সহজ। যুদ্ধ যে একটা লাগবেই এ তো জানা কথা। অবশেষে এসেছে সেই সময়। ইন্দিরা গান্ধী যখন বিকেলে কলকাতার ময়দানে বক্তৃতা করছেন, তখনই রাওয়ালপিণ্ডি থেকে পাকিস্তান বেতারে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা শুরু হয়ে গেছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তলায় তলায় সবরকম প্রস্তুতি নিলেও তেসরা ডিসেম্বর মধ্যরাত্রির আগে যুদ্ধের কথা উচ্চারণ করেন নি, কিন্তু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আর ধৈর্য রাখতে পারছিলেন না, নভেম্বরের শেষ দিকে রাজধানীতে একদল চীনা প্রতিনিধির সামনে তিনি হঠাৎ বলেছিলেন, এর পর আমাকে আর আপনারা এখানে পাবেন না। দশদিনের মধ্যেই হয়তো আমাকে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে হবে! সেই দশদিনও পূর্ণ হলো না। পূর্ব ও পশ্চিম, দু’দিকেই রণাঙ্গন খুলে গেল।
নিয়াজী নিজেও যুদ্ধ শুরু করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এর আগে কয়েকবারই তিনি বলেছেন যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ভারতীয় সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিশে সীমান্ত পেরিয়ে অনেকবার হামলা করেছে, তার সমুচিত জবাব দেবার জন্য তিনিও পশ্চিম বাংলার সীমান্তের ওদিকে বাহিনী পাঠিয়েছেন, বয়রা আর হিলিতে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়েছে, নিজেদের কয়েকটি বিমান ও ট্যাঙ্ক হারাতে হলেও ভারতীয়দেরও কম ক্ষতি হয় নি! নিয়াজীর আরও একটি ধারণা ছিল যে ভারতীয়রা আক্রমণ শুরু করবে পবিত্র ঈদের দিনে। সেদিন পাকিস্তানী সৈনিক ও কমাণ্ডাররা উৎসব পালনের জন্য অসতর্ক থাকবে। রাজধানী থেকেও এই মর্মে তাঁকে সাবধান করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ঈদের দিনে যুদ্ধ লাগিয়ে বাঙালী মুসলমানদের মনে যে আঘাত দিতে চাইবে না ভারতীয় পক্ষ, সে কথা তাঁদের মাথায় আসেনি।
সমবেত সেনানায়কদের কাছে নিয়াজী বললেন, এবার আর আন্তজাতিক সীমানা অতিক্রম করা না করার প্রশ্ন নেই! এখন খোলাখুলি যুদ্ধ। প্রতিপক্ষকে আমরা শুধু তাড়িয়ে নিয়ে যাবো না, যেখানে পাবো সেখানে মারবো। ইনসানাল্লা,এখন থেকে যুদ্ধ হবে ভারতের মাটিতে।
আগে থেকেই ঠিক করে রাখা ওয়ার স্ট্র্যাটেজি আবার ঝালিয়ে নিলেন নিয়াজী। অনেক দিক বিবেচনা করে দুর্গ প্রতিরক্ষা ধারাটিই বেছে নিয়েছেন তিনি। এই নীতিতে সীমান্তের শহরগুলিকে দুর্গে পরিণত করা হয়েছে। এক একটা দুর্গের মধ্যে শক্তি পুঞ্জীভূত করে রাখলে সেগুলিকে জয় না করে শত্রুপক্ষ এগোতে পারবে না। দুর্গে আত্মরক্ষাকারীদের দমন করতে হলে আক্রমণকারীদের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়া দরকার। এক একটা দুর্গ অবরোধ করে শত্রুপক্ষ যদি পাশ কাটিয়ে এগিয়ে আসতে চায়, তাতেও তাদের প্রচুর সৈন্য লাগবে। প্রথা অনুযায়ী আত্মরক্ষাকারীদের তুলনায় আক্রমণকারীদের সংখ্যা অন্তত তিনগুণ বেশি হওয়া উচিত। কিন্তু ইস্টার্ন সেকটরে পাকিস্তানী বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী প্রায় সমান সমান। সুতরাং দুর্গ প্রতিরক্ষা নীতিতে ভারতীয়রা সুবিধে করতে পারবে না।
যশোর, ঝিনাইদহ, বগুড়া, রংপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, ভৈরববাজার, কুমিল্লা এবং চট্টগ্রামের দুর্গগুলিতে ৬০ দিনের গোলাবারুদ আর ৪৫ দিনের উপযুক্ত খাবার মজুত করা হয়েছে। এ ছাড়াও আরও অনেক ছোট ছোট শহরকে দুর্গ পর্যায়ে উন্নীত করা হয়ে গেছে, শত্রু ঢুকবে কোন দিক দিয়ে?
উপমা দেবার জন্য জেনারেল নিয়াজী তাঁর ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন সামনে। সগর্বে বললেন, আমার এই হাতের আঙুলের মতন আমার সৈন্যরা সমস্ত বড়ার আউটপোস্টে ছড়িয়ে আছে, সেখানে তারা যতদিন সম্ভব যুদ্ধ চালাবে, তারপর এই দেখুন, আঙুলগুলো গুটিয়ে আনার মতন, তারা দুর্গে ফিরে এসে শক্ত মুষ্টি তৈরি করবে, এই মুষ্টির আঘাতেই শত্রুর মাথা ভাঙবে!
এ ছাড়াও ফরাক্কা বাঁধের ধ্বংসসাধনের জন্য তৈরি হয়েছে কমান্ডো বাহিনী। রাজসাহীর দিক থেকে ইংলিশবাজারে ঢুকে পড়ার পরিকল্পনা প্রস্তুত, চট্টগ্রামের প্রতিরক্ষাও এমনই সুদৃঢ় যে কোনোক্রমেই ঢাকার দিকে আসতে পারবে না ভারতীয়রা।
বক্তৃতা শেষ করে নিয়াজী সৈন্যাধ্যক্ষদের বললেন, আপনারা প্রতিটি যোদ্ধাকে জানিয়ে দিন যে লড়াই করতে হবে শেষপর্যন্ত, প্রাণপণে। শgs হাতে প্রাণ দিলে তারা শহিদ হবে, শত্রুর প্রাণ নিতে পারলে গাজী হবে। এখান থেকে আমাদের ফিরে যাবার কোনো পথ নেই। মওলা-এ-আলীর কৃপায় জয় আমাদের হবেই, পাকিস্তানকে আমরা অখণ্ড রাখবোই!
অফিসাররা মুখে স্বস্তির চিহ্ন নিয়েই ফিরলেন ট্যাক থেকে। তাঁরাও তো চাইছিলেন একটা কিছু হেস্তনেস্ত হয়ে যাক। আটমাস ধরে বাংলার মাঠে-ঘাটে, জল কাদায় বিদ্রোহীদের পেছনে। ছোটাছুটি করে সাধারণ সৈন্যরা ক্লান্ত, তাদের মনোবল ভেঙে পড়ছিল। পশ্চিম থেকে যখন তাদের পুবে পাঠানো হচ্ছিল, তখন তাদের বোঝানো হয়েছিল যে তারা কাফের মারতে যাচ্ছে। পবিত্র ইসলাম এবং পাকিস্তানের সংহতিরক্ষার পুণ্য দায়িত্ব তাদের ওপর। কিন্তু কয়েক মাস পরেই তারা বুঝে গেল যে হিন্দুরা সব ভেগে পড়েছে, মুক্তিবাহিনীর প্রায় সবাই মুসলমান, লড়াইটা হচ্ছে মুসলমানের সঙ্গে মুসলমানের।
শিক্ষিত অফিসারদের একটা অংশ আরও একটি কারণে ক্ষুব্ধ। তারা স্বচক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা এতদিন ধরে দেখে নিজেরাই বুঝতে পেরেছেন যে সত্যিই তো পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় এই অঞ্চল অনেক ভাবে বঞ্চিত। ঢাকায় প্রচুর ঝি চাকর পাওয়া যায়, কারণ, এখানে অসংখ্য বেকার, পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় এখানে একজন ভৃত্যকে অর্ধেক মাইনে দিলেই চলে। মেয়েরা পর্যন্ত রাস্তায় ভিক্ষে করে। গ্রামের অধিকাংশ লোকের চেহারা হাড় জিরজিরে, এরকম তারা পশ্চিমে দেখেনি কখনো।
আর্মি-অফিসার হলেই সকলের বিবেক নষ্ট হয়ে যায় না। যাদের বিবেক আছে, তাদের বিবেকদংশনও হয় কখনো কখনো। গত আট-ন’ মাস ধরে যা চলছে, তাতে অনেকেই অনুতাপ ও লজ্জা বোধ করেন। পঁচিশে মার্চ ঢাকা থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান চুপি চুপি পালিয়ে গেলেন। অনেকেই জানে সেদিনের ঘটনা। বিকেলবেলা ইয়াহিয়া খান ক্যান্টনমেন্টের ফ্লাগস্টাফ হাউসে গিয়েছিলেন এক চা-পানের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। সূর্যাস্তের সময় আবার তিনি ফিরলেন প্রেসিডেন্ট হাউসে অতি আড়ম্বরময় শোভাযাত্রা করে। প্রথমে তাঁর দেহরক্ষী অশ্বারোহী দল, তারপর পাইলট জিপ, প্রেসিডেন্টের নিজস্ব চার-তারকা প্লেটসহ পতাকা লাগানো গাড়ির দু’পাশে সিকিউরিটির একাধিক গাড়ি, সবাই ভাবলো প্রেসিডেন্ট আসছেন। আসলে রফিক নামে একজন ব্রিগেডিয়ার প্রেসিডেন্ট সেজে বসেছিলেন সেই শোভাযাত্রার মধ্যমণি হয়ে। ইয়াহিয়া খান তখন একটা ডজ গাড়িতে ছুটছেন এয়ারপোর্টের দিকে। এ কেমন প্রেসিডেন্ট যাঁকে নিজের দেশের দ্বিতীয় রাজধানী থেকে গোপনে প্রস্থান করতে হয়? রাত্তির থেকেই তিনি পূর্ব পাকিস্তানে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করার আদেশ দিয়েছিলেন, তার আগেই তাঁর রাওয়ালপিণ্ডি পৌঁছে যাবার ব্যস্ততা।
তারপর এই ন’ মাসে প্রেসিডেন্ট আর একবারও এলেন না পূর্ব পাকিস্তানে? দেশের যেটা বড় অংশ, সেখানে সে দেশের প্রেসিডেন্ট এতদিনে একবারও আসতে পারেন না? পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর লুণ্ঠন-ধর্ষণ-গণহত্যার কাহিনীতে সারা পৃথিবী আন্দোলিত, লক্ষ লক্ষ মানুষ দেশত্যাগ করে চলে যাচ্ছে, অথচ এই রাষ্ট্রের যিনি সর্বময় কর্তা তিনি বসে রইলেন চোদ্দশো মাইল দূরে! পশ্চিমের কোনো রাজনৈতিক নেতাও এদিকে আসেন নি। শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে জনাব ভুট্টোও এখানে এসে বাঙালীদের মুখোমুখি দাঁড়াতে সাহস করলেন না? বাঙালীরা বিক্ষুব্ধ, বিদ্রোহী, কিন্তু তাদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা কেউ করবে না, সামরিক বাহিনী দিয়ে তাদের শাসন করতে হবে? এই কি ইসলামের ভ্রাতৃত্ববোধ? বাঙালীদের মধ্যেও এখন কোনো গণ্য করার মতন নেতা নেই, গভর্নর আবদুল মালিক শুধু সামরিক শাসকদের পুতুল নন, একটা অকেজো, জং ধরা পুতুল। ন’মাস ধরে দেশের বৃহত্তম অংশের সাধারণ মানুষদের ওপর কর্তৃত্ব চালাচ্ছে শুধু আর্মি অফিসাররা। পূর্ব পাকিস্তান তো তা হলে সত্যিই নিছক একটা কলোনি, সেখানকার মানুষ পাকিস্তান রাষ্ট্রের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীরাও এতদিনে এই অন্যায় শাসনের স্বরূপ বুঝতে পেরেছে, সেখানেও প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। আর্মি অফিসাররাও বুঝতে পারছিলেন, এভাবে বেশিদিন চলে না।
প্রথম তিনদিনেই অনেকটা বোঝা গেল যুদ্ধের গতি কোন দিকে।
পাকিস্তানী বিমান কলকাতায় বোমা ফেলতে যায় নি, কিন্তু প্রথমদিনই পশ্চিম রণাঙ্গনে পাকিস্তান এয়ার ফোর্স সাতটি ভারতীয় ঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ করে এলো। কলকাতার দিক থেকে ৩রা ডিসেম্বর রাত দুটো চল্লিশে ভারতীয় যুদ্ধবিমান উড়ে এলো ঢাকার আকাশে। মেশিন গান, হাল্কা মেশিন গান এবং অ্যাক অ্যাক গোলাবর্ষণ শুরু হলো সেই বিমান আক্রমণের প্রতিরোধে। পাকিস্তানী ফাইটার বিমানগুলি আকাশে উড়লো। গোলাবর্ষণের ফুলঝুরি আর আকাশে বিমানে বিমানে ডগ ফাইট দেখলো ঢাকার নাগরিকরা। পাকিস্তানী বিমান ভেঙে পড়লে তারা হাততালি দেয়, ভারতীয় বিমানে আগুন লেগে গেলে তারা হতাশার শব্দ করে। একদিনেই পাকিস্তানী এয়ার ফোর্সকে ৩২ বার যুদ্ধের জন্য শূন্যে উড়তে হয়, গোলা খরচ হয় ৩০ হাজার রাউন্ড। ভূমি থেকে বিমানবিধ্বংসী কামান ৭০ হাজার গোলা ব্যয় করে ফেলে। প্রথম দিন বেশ কিছু ক্ষয়-ক্ষতি সহ্য করে ফিরে যায় ভারতীয় বিমানবাহিনী। পরদিন তারা আবার হানা দিল। অতর্কিতে, ছোট ছোট জঙ্গী বিমানের পাহারায় ১০টি মিগ ২১ এস, ৫০০ কিলোগ্রাম ওজনের। ছ’খানা বোমা ফেললো ঢাকা বিমানবন্দরের রানওয়ের ওপর। বিরাট বিরাট গর্ত সৃষ্টি হয়ে অকেজো হয়ে গেল সেই রানওয়ে। গর্ত ভরাট করতে না পারলে পাকিস্তানী স্যাবার জেটগুলি আকাশে উড়তে পারবে না। দ্রুত গর্ত মেরামতি শুরু করে দিল প্রকৌশলী বিভাগ, আর ভারতীয় বিমান যখন-তখন উড়ে এসে ঘায়েল করতে লাগলো মেরামতকারীদের, যতটা গর্ত বোজানো হয়, নতুন বোমার ঘায়ে তারচেয়ে আরও বড় বড় গর্ত তৈরি হয়। অসহায় ভাবে ভূমিতে আটকে থাকা স্যাবার জেটগুলো পড়ে পড়ে মার খেতে লাগলো। ক্ষতবিক্ষত তেজগাঁ এয়ারপোর্টের রানওয়ে অকেজো হয়ে গেল একেবারে।
তেজগাঁ থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে কুর্মিটোলায় আর একটি নতুন বিমানবন্দর তৈরি হচ্ছিল, রানওয়ের কাজ প্রায় শেষ, ভারতীয় বোমারু বিমান সেই রানওয়েটিও ধ্বংস করে দিয়ে গেল একই সঙ্গে। এর পরে সেকেন্ড ক্যাপিটালের নতুন চওড়া চওড়া রাস্তাগুলিকেই রানওয়ে হিসেবে ব্যবহার করার একটা মরীয়া প্রস্তাব উঠেছিল। কিন্তু কিছু কিছু টেকনিক্যাল সমস্যায় সে প্রস্তাবও বাতিল হয়ে যায়। ৬-ই ডিসেম্বর সকাল দশটার মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর যুদ্ধ শেষ। অবশিষ্ট ১৪ জন জঙ্গী পাইলট বেকার হয়ে বসে না থেকে বাম সীমান্ত দিয়ে কোনোক্রমে বেরিয়ে চলে গেল পশ্চিম রণাঙ্গনে। এরপর থেকে বাংলাদেশের আকাশে শুধু ভারতীয় বিমানের আধিপত্য।
পূর্ব পাকিস্তানে নৌবাহিনীর অবস্থা আরও করুণ।
পাকিস্তানী সাবমেরিন গাজীর ছিল ভয়াবহ খ্যাতি। যুদ্ধের শুরুতেই করাচী থেকে গাজী চলে এসেছিল অনেকখানি পথ, উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় ইস্টার্ন ফ্লিটকে চরম আঘাত হানার। কিন্তু বিশাখাপত্তন উপকূলের অদূরেই ভারতীয় ডেস্ট্রয়ার আই এন এস রাজপুত গাজীর সন্ধান পেয়ে গেল। গাজী আর রাজপুতের লড়াই চলেছিল অল্পক্ষণমাত্র, রাজপুতের ডেপথচার্জে গাজীর মতন শক্তিশালী সাবমেরিন টুকরো টুকরো হয়ে চিরকালের মত মিলিয়ে গেল সমুদ্রগর্ভে। এটা পাকিস্তানের পক্ষে দুভাগ্যই বলতে হবে। গাজীর অকাল মৃত্যুতে পাকিস্তানে নেমে এলো। শোকের ছায়া। এরপর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব দিকে নৌবাহিনীর আর কোনো সাহায্য পাঠাবার আশা রইলো না। বঙ্গোপসাগরে টহল দিতে লাগলো আই এন এস ভিক্রান্ত, তার ডেক থেকে ছোট ছোট সী হক বিমান উড়ে গিয়ে বারবার আঘাত হানলো চট্টগ্রাম, কক্সবাজারে।
পূর্ব পাকিস্তানের নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল শরীফের অধীনে ছিল মাত্র গোটা কয়েক গানবোট আর ফ্রিগেট, আর কিছু বেসরকারি লঞ্চ দখল করে তাতে কামান বসিয়ে জোড়াতালি দিয়ে। বানানো নৌযান। এর বিরুদ্ধে নিযুক্ত রয়েছে ভারতীয় টাস্ক ফোর্সের বিমানবাহী জাহাজ, ডেস্ট্রয়ার ও ফ্রিগেট। ১৪টি সী হক, ২টি সী কিং, ২টি সাবমেরিন, একটি মাইন সুইপার। যুদ্ধের প্রথম দিকেই চট্টগ্রামের কাছে কুমিল্লা নামে গানবোট ভারতীয় বিমান আক্রমণে ডুবে গেল, ‘রাজসাহী’ অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় কোনোক্রমে বন্দরে ফিরে এলো। আর কোনো গানবোট বন্দর এলাকার বাইরে যেতে সাহস করেনি। খুলনাতেও কয়েকটি নৌযান বোমার আঘাতে ঘায়েল। হয়, বাকি কয়েকটিকে লুকিয়ে রাখা হয় জঙ্গলের মধ্যে। পূর্ব পাকিস্তানে নৌযুদ্ধের প্রতিরোধেরও এখানেই শেষ।
বাকি রইলো শুধু স্থলবাহিনী।
পূর্ব পাকিস্তানে রয়েছে ১২৬০ জন অফিসার, ৪১,০৬০ জন বিভিন্ন শ্রেণীর সৈনিক নিয়ে গঠিত এক সুদক্ষ সেনাবাহিনী। এ ছাড়াও ৭৩ হাজারের একটি আধা সামরিক বাহিনী। পাকিস্তানী আর্মড ফোর্স বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই রাষ্ট্রের জন্মের অল্পকাল পর থেকেই সেনাবাহিনীর হাতে চলে এসেছে শাসনক্ষমতা, রাষ্ট্রীয় বাজেটে প্রতি বছরই সেনাবাহিনীর জন্য বিপুল ব্যয় করা হয়েছে, আমেরিকা এবং পশ্চিমী দেশগুলি থেকে নিয়মিত অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র পেয়েছে। অফিসাররা সুশিক্ষিত, সাধারণ সৈনিকেরা সুশৃঙ্খল। এই শক্তিশালী পাকিস্তানী বাহিনীকে দমন করা মোটেই সহজ কথা নয়। তবু, প্রথম দু’দিন বীরোচিত লড়াই করেই পাকিস্তানী বাহিনী পশ্চাৎ অপসরণ শুরু করলো কেন?
পূর্বাঞ্চলে ভারতের পক্ষে রয়েছে ৭টি পদাতিক ডিভিশান। পশ্চিম পাকিস্তানের লড়াই ছাড়াও চীনা সীমান্ত জুড়ে ভারতকে বিপুল সংখ্যক সৈন্যকে নিযুক্ত রাখতে হয়েছে, যে-কোনো মুহূর্তে চীনা হামলার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে নাগা-মিজো। বিদ্রোহীরা যাতে উদ্দাম হয়ে না ওঠে, সেজন্য সেখান থেকেও সৈন্য সরানো যায় না। সুতরাং বাংলাদেশ যুদ্ধের জন্য ভারতের পক্ষে ৭টি ডিভিশনের বেশী সেনা আনা সম্ভব নয়।
এ ছাড়া ভারতের সঙ্গে রয়েছে বাংলাদেশ বাহিনী। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ বাহিনী অনেকটা সংগঠিত হয়েছে, রয়েছে কে-ফোর্স, এস-ফোর্স আর জেড-ফোর্স নামে তিনটি ব্রিগেড। ৯টি সেকটরে ২০ হাজার সশস্ত্র বাঙালী সৈনিক। এবং ট্রেনিং প্রাপ্ত এক লাখ গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। এবং সবচেয়ে বড় কথা, সাধারণ মানুষের সমর্থন।
এমনকি বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরাও ভারত বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। এই আট ন’মাসে গ্রামের নিরক্ষর লোকেরাও এল এম জি, স্টেনগান, বাংকার, মাইন এইসব চিনতে শিখে গেছে। চাষী, জেলে, ইস্কুলের ছেলেরা পর্যন্ত গোপন খবর এনে দেয়। মুক্তিবাহিনীকে। একটা আট বছরের ছেলে এক নম্বর সেকটরের কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলামকে একদিন ফিল্ড ম্যাপের ওপর আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, এই দ্যাখেন স্যার, বল্লভপুর গ্রাম। আর এইখানে একটা বড় পুকুর। মেসিনগানটা বসানো আছে এই পুকুরের ধারে। আর ইস্কুল বাড়িতে থাকে খানসেনারা। এই ধান ক্ষেতের ধারে মাইন বসানো আছে স্যার, কিন্তু এই ধারটা দিয়া আমি গরুবছর নিয়া যাই, কিছু হয় না, তাইলে ঐখানে মাইন পেতে নাই…
যে-দেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধ হচ্ছে, সেই দেশের জনসাধারণ আক্রমণকারীদের দেখলে জয়ধ্বনি দেয়, ফুলের মালা পরাতে আসে। আর নিজের দেশের সেনাবাহিনীকে দেখলে ঘৃণার চোখে তাকায়, দূরে পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্যরা জিতবে কী করে!
এই আট ন’ মাসে পাকিস্তানী সৈন্যরা অনেকটা লাগামছাড়া হয়ে গিয়েছিল। তারা। লুণ্ঠন-ধর্ষণ করেছে অবাধে, সামান্য ছুতোয় গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, তার ফলে তারা সৈনিকের তেজও হারিয়েছে। বিলাসিতা ও দুর্নীতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠলে আর তা থেকে ফেরা যায় না। তা ছাড়া যুদ্ধের জন্য শুধু হাতিয়ার লাগে না, একটা কিছু চড়া ধরনের উন্মাদনারও প্রয়োজন হয়। শুধু ধর্মীয় উন্মাদনায় এতদিন টেনে রাখা যায় না।
প্রকৃত যুদ্ধে নেমে পড়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা উপলব্ধি করলো, কার জন্য তারা লড়াই করছে? দেশের যে-অংশ রক্ষা করার জন্য তারা প্রাণ দিতে যাচ্ছে, সেই অংশের অধিকাংশ মানুষই তাদের চায় না। এখানে ধর্ম অবান্তর। পাকিস্তানী সৈন্যরা ভারতীয় বাহিনীকে মোটেই ভয় পায় নি, তাদের প্রকৃত ভয় মুক্তি বাহিনীকে। ভারতীয়দের সঙ্গে তাদের লড়াই হবে সৈনিকের সঙ্গে সৈনিকের, তাতে জয়-পরাজয় আছে। কিন্তু মুক্তি বাহিনীর ছেলেরা আসছে মরিয়া হয়ে প্রতিশোধ নিতে, এই যুদ্ধ শুরু হবার অনেক আগেই তাদের অনেকের ভাই কিংবা বাবা নিহত হয়েছে, মা-বোন-স্ত্রী ইজ্জত হারিয়েছে। ওদের হাতে পড়লে ওরা যুদ্ধবন্দী রাখে না, সঙ্গে সঙ্গে কচুকাটা করে। সেইজন্যই যে-কোনো সম্মুখ যুদ্ধে হারের সম্ভাবনা দেখা দিলেই পাকিস্তানী সৈন্যরা চেঁচিয়ে ভারতীয় সৈন্যদের বলে, আমরা আত্মসমর্পণ করছি, আমাদের বন্দী করো, আমাদের মুক্তিবাহিনীর হাতে দিও না!
যুদ্ধের সময় মিথ্যে প্রচার চলে খুব, অপরপক্ষকে বিভ্রান্ত করার জন্য। অনেক সময় তাতে নিজেদেরও বিভ্রান্ত হতে হয়। রেডিওতে বলা হচ্ছে যে ঝিনাইদহে প্রচণ্ড লড়াইয়ে ভারতীয়পক্ষ খুব মার খাচ্ছে, কিন্তু ঝিনাইদহের মানুষ দেখছে, সেখানে কোনো লড়াই-ই নেই, পাকিস্তানী সৈন্যরা দুদিন আগেই সেখান থেকে পালিয়েছে। মাটির তলায় ট্যাকে বসে নিয়াজী খবর পেলেন যে পশ্চিম পাকিস্তানে ভারতীয়রা সাঙ্ঘাতিক হারছে, অমৃতসর শহরের পতন হয়েছে। নিয়াজী দু’হাত ছড়িয়ে হুররে বলে উঠলেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সেনাপতি, কিন্তু তাঁর হেড কোয়ার্টারের দেওয়ালে পশ্চিম পাকিস্তানের ম্যাপ, ঐদিকের যুদ্ধ সম্পর্কেই যেন তাঁর বেশি আগ্রহ। তিনি ধরে বসে আছেন যে পশ্চিম রণাঙ্গনে যদি অনেকখানি ভারতীয় ভূমি দখল করে ফেলা যায়, তা হলে তাই নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে দরাদরি করা যাবে!
দু’দিন পরেই জানা গেল, ওসব অমৃতসর দখল-খলের খবর ভুয়ো! এদিকে পূর্ব রণাঙ্গনে তাঁর বাহিনী প্রায় সর্বত্র পিছিয়ে আসছে, কয়েক জায়গায় যোগাযোগ ব্যবস্থাও ছিন্নভিন্ন। ভারতীয় বিমানবাহিনী নিয়মিত ঢাকার আকাশে এসে বোমা ফেলে যাচ্ছে, কিন্তু একটাও পাকিস্তানী বিমান আকাশে ওড়াবার উপায় নেই। জলপথে পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ। পশ্চিম থেকে তিনি আরও আটটি পদাতিক ব্যাটেলিয়ান চেয়েছিলেন, নভেম্বরের মধ্যে মাত্র পাঁচটি পেয়েছেন, বাকি তিনটি আর আসতে পারবে না। আকাশ কিংবা সমুদ্রপথ দিয়ে আর কোনো সাহায্য পাবার আশা নেই।
হাসিখুশী, উচ্ছল স্বভাবের এই সেনাপতি গুম হয়ে গেলেন হঠাৎ।
চতুর্থ দিনে গভর্নর আবদুল মালিক ডেকে পাঠালেন নিয়াজীকে। চতুর্দিকে প্রবল পরস্পরবিরোধী গুজব, তিনি যুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা জানতে চান। তাঁরও প্রাণের ভয় ধরে গেছে।
দু’জন সিনিয়র অফিসার নিয়ে নিয়াজী এলেন গভর্নর হাউসে। একটি নিভৃত কক্ষে তাঁদের মিটিং শুরু হলো। যুদ্ধ সম্পর্কে কথা বলতে বলতে হঠাৎ নিয়াজী চুপ করে গেলেন, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন গভর্নরের মুখের দিকে। আর কিছুই বলেন না, সে এক অস্বস্তিকর নীরবতা।
কিছু একটা বলতে হবে বলেই গভর্নর মালিক বললেন, জেনারেল সাহেব, জীবনে উত্থান-পতন তো থাকেই। এক সময় যার কপালে অনেক যশ আসে, তাকেই হয়তো এক সময় পরাজয়ের অমর্যাদা মেনে নিতে হয়। আবার অবস্থা বদলে যায়।
নিয়াজীর বিশাল শরীরটা কাঁপছিল, দু’হাতে মুখ ঢেকে তিনি শিশুর মতন কেঁদে উঠলেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে!
বৃদ্ধ মালিক সাহেবেরও চোখে জল এসে গেল। তিনি নিয়াজীর পিঠে হাত রেখে আপ্লুত স্বরে বললেন, মনের জোর হারাবেন না, জেনারেল। মহান আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখুন!
একজন বাঙালী ওয়েটার ট্রে-তে করে কফি আর স্যান্ডুইচ নিয়ে ঘরে ঢুকলো সেই সময়। নিয়াজীর সঙ্গী দু’জন অফিসার লাফিয়ে উঠে তাকে বললো, এই যা, যা, বেরিয়ে যা ঘর থেকে!
ওয়েটারটি বাইরে এসে ফ্যালফেলে চোখে অন্যদের বললো, সাহেবরা ভিতরে কান্নাকাটি করতেছে!
দু’তিনজন ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললো, এই চুপ! চুপ! এসব কথা কারুকে বলিস না!
পাকিস্তান ও ভারতের যুদ্ধনীতি সম্পূর্ণ বিপরীত। হেড কোয়ার্টারের নির্দেশে নিয়াজী চেয়েছিলেন যুদ্ধটাকে যতদূর সম্ভব প্রলম্বিত করতে। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে বাইরের অন্যান্য দেশ এসে মাথা গলাবে, রাষ্ট্রপুঞ্জে বিতর্ক হবে, পররাজ্য আক্রমণকারী হিসেবে ভারতকে দোষী করা যাবে। আর ভারতীয়পক্ষ ঠিক এই সবকটি ঝামেলা এড়াবার জন্যই ঠিক করেছিল, এই যুদ্ধ শেষ করতে হবে ঝড়ের বেগে। সেইজন্য প্রথম দিন থেকেই তারা নিয়োগ করেছে সর্বশক্তি। সেকটর কমান্ডাররা জেনে গিয়েছিলেন যে দু’সপ্তাহের বেশি এই যুদ্ধ কিছুতেই চলতে দেওয়া হবে না!
বেশ কয়েকটি বড় রকমের পরাজয়ের খবর এলেও নিয়াজী আবার চাঙ্গা হয়ে উঠলেন দুদিন বাদেই। তিনি ভূগর্ভ ট্যাকেই অধিকাংশ সময় কাটাচ্ছিলেন, তাঁকে কেউ দেখতে পায় না। সেইজন্য গুজব রটে গেল সেনাপতি নিয়াজী ভয় পেয়ে নিজের বাহিনীকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে হেলিকপটারে করে পালিয়ে গেছে। এই গুজব নিয়াজীর আত্মাভিমানে বড় আঘাত দিল। তিনি দর্পের সঙ্গে বেরিয়ে এলেন সুড়ঙ্গ থেকে।
বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের লোকজন ঢাকা ছেড়ে পালাতে শুরু করেছে। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালকে রেড ক্রস থেকে নিরপেক্ষ এলাকা বলে ঘোষণা করেছে, ভারতীয়রা। সেখানে বোমাবর্ষণ করবে না বলে অনেকে এসে আশ্রয় নিচ্ছে সেখানে। বিদেশী সাংবাদিকরাও আর ঢাকায় থাকতে চাইছে না। কারণ ঢাকায় বসে যুদ্ধের প্রকৃত খবর কিছুই জানা যায় না।
ট্যাক থেকে বাইরে আসবার আগে নিয়াজী নিজে রাওয়ালপিণ্ডির সঙ্গে একবার ফোনে কথা বলে নিলেন। প্রত্যেকদিনই হেড কোয়ার্টার থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল যে শ্বেত ও পীত বন্ধুরা এবার পাশে এসে দাঁড়াবে। উত্তরের পাহাড় থেকে নেমে আসবে চীনে সৈন্যরা আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে এসে ঢুকবে আমেরিকার সেভেনথ ফ্লিট। নিয়াজী অধৈর্যের সঙ্গে রাওয়ালপিণ্ডিতে জেনারেল হামিদের ব্যক্তিগত সচিবকে জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের বন্ধুদের জন্য আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে? উত্তর এলো, ছত্রিশ ঘণ্টা!
ঢাকা ছেড়ে গাড়িতে, হেলিকপটারে পালাচ্ছে বিদেশীরা। নিয়াজী এরই মধ্যে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে পোঁছে কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কে বলেছে আমি পালিয়েছি? আমি তার নাম জানতে চাই!
কেউ ভয়ে কোনো উত্তর দিল না।
এরপর নিয়াজী এলেন হাসপাতাল পরিদর্শনে। সেখানে ঢুকতেই একডজন পাকিস্তানী নার্স ঘিরে ধরলো তাঁকে। ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেছে সেই রমণীদের। মুক্তি বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে তাদের কী অবস্থা হবে সে দৃশ্য কল্পনা করেই তারা কাঁপছে। বাঙালী মেয়েদের ওপর যে পাকিস্তানী সৈন্যরা ধর্ষণ করেছে, তার কিছু কিছু বাস্তব প্রমাণ তো এই নার্সরা স্বচক্ষে দেখেছে।
নার্সরা নিয়াজীকে বললো, বর্বর মুক্তিসেনাদের হাত থেকে আমাদের বাঁচান। আমাদের হেলিকপটারে করে বামা পাঠিয়ে দিন।
যুবতী নারী দেখলেই নিয়াজী রঙ্গ-রসিকতার লোভ সামলাতে পারেন না। কিন্তু আজ তাঁর সে মেজাজ নেই। তিনি রুক্ষ ভাবে বললেন, অত ঘাবড়াবার কী আছে? শিগগিরই বড় রকমের সাহায্য আসছে! যদি সাহায্য শেষপর্যন্ত না-ও আসে, তবু তোমাদের মুক্তি বাহিনীর হাতে পড়তে হবে না। তার আগে, আমরাই তোমাদের মেরে ফেলবো!
সেখান থেকে নিয়াজী চললেন ক্যান্টনমেন্টের দিকে। বিমানবন্দরের বাইরে একদল বিদেশী এসে ভিড় করে আছে, কখন হেলিকপ্টার পাবে সেই আশায়। নিয়াজী সেই ভিড় ঠেলে দেখতে গেলেন প্রতিরক্ষার কামানগুলো কী অবস্থায় আছে।
ভিড়ের মধ্যে রয়েছে কয়েকজন বিদেশী সাংবাদিক। নিয়াজীকে দেখে তাদের ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। তাদের মধ্যে একজন হেঁকে জিজ্ঞেস করলো, জেনারেল, ভারতীয়রা দাবি করছে শিগগিরই তারা ঢাকায় পৌঁছে যাবে। এটা কতদূর সত্যি? তারা সঠিক কতটা দূরে আছে?
নিয়াজী ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনি নিজেই গিয়ে দেখে আসুন না!
সেই সাংবাদিকটি আবার জিজ্ঞেস করলো, আপনি আপনার দিকের কী অবস্থা সেটা অন্তত বলুন!
নিয়াজী বললেন, আমি আমার শেষ সৈন্যটি নিয়ে, শেষ গুলিটি থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ করবো। এটাই আমার কথা!
অন্য একজন প্রশ্ন করলো, ঢাকা মুক্ত রাখার মতন ফোর্স কি আপনার আছে!
নিয়াজী সগর্বে বুকে চাপড় মেরে বললেন, ঢাকার পতন যদি কখনো হয়, তবে তা হবে আমার মৃতদেহের ওপর! আমার এই বুকের ওপর দিয়ে ওদের ট্যাংক চালাতে হবে!
যুদ্ধের চতুর্থদিনে অগ্রগতি দেখে নিশ্চিত হয়ে ইন্দিরা গান্ধী আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ নামে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিলেন। দিল্লির পার্লামেন্টে তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে এই ঘোষণা সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে গেল সারা দেশে। কলকাতায়, সীমান্তের ক্যাম্পগুলিতে, সীমান্ত ছাড়িয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে বাংলাদেশের নাগরিকরা আনন্দে কোলাকুলি করতে লাগলো, মিষ্টি খাওয়া আর খাওয়ানোর ধুম পড়ে গেল। পূর্ব ও পশ্চিমের পাকিস্তান আর জোড়া লাগবে না।
ভারত যখন স্বীকৃতি দিয়েছে, তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন সমেত পূর্ব-ইউরোপের, সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রগুলোও আর দেরি করবে না। বাংলাদেশ এখন আর স্বপ্ন নয়, একটি বাস্তব সত্য। বাংলাদেশে পাকিস্তানী সৈন্যরাই এখন হানাদার বাহিনী। এখন একমাত্র লক্ষ্য হলো রাজধানী ঢাকা দখল করা। সেই শুভক্ষণটি আর কত দূরে?