যে কোনও প্রাণীই কাজ করতে করতে, অতি পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়। খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিলে আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। আবার কাজের স্ফুর্তি দেখা যায়। জড় পদার্থেরও কি এরকম হতে পারে? যদি হয়, তা হলে প্রাণ ও জড় পদার্থের সীমারেখা কোথায়?
জগদীশচন্দ্র এই অত্যাশ্চর্য, অবিশ্বাস্য পরীক্ষাতেই এখন মেতে আছেন।
ইতালির বৈজ্ঞানিক গ্যালভানি দেখেছিলেন, একটা ঝোলানো ব্যাঙের শরীরে বিদ্যুৎ প্রবাহ চালনা করলে তার পায়ের মাংসপেশি কেঁপে কেঁপে ওঠে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ শক্তির প্রবাহে প্রাণিদেহকলা উত্তেজিত হয়। জগদীশচন্দ্র একটা যন্ত্র বানিয়েছিলেন। একটা ধাতুর পালিশ করা পাতের ওপর সূক্ষ্ম সূচের মুখ স্পর্শ করে আছে এক গ্রাহক যন্ত্র, বিদ্যুৎ তরঙ্গ চালালে সেই যন্ত্রে সাড়া পাওয়া যায়। জগদীশচন্দ্র লক্ষ করলেন, অনেকক্ষণ ধরে কাজ করতে করতে সেই গ্রাহক যন্ত্র আস্তে আস্তে কম সাড়া দিচ্ছে। যন্ত্রটা কিন্তু অকেজো হয়ে যাচ্ছে না। কয়েক ঘণ্টা কাজ থামিয়ে রাখলে আবার ঠিক প্রথমবারের মতন সাড়া দেয়। এটা কী ব্যাপার? ধাতুর যন্ত্রটা ক্লান্ত হয়ে পড়ছে? কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলে আবার কাজের ক্ষমতা ফিরে পায়?
পরীক্ষিত সত্য হলে বিজ্ঞানের কাছে কিছুই অবিশ্বাস্য নয়। জগদীশচন্দ্র বারবার পরীক্ষা করে একই ফল পেলেন, গ্রাফ আঁকলেন। প্রমাণিত হল যে, ঠিক যেমন প্রাণীর শরীরযন্ত্র কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর তার কর্মশক্তি ফিরে পায়, তেমনি ধাতুর তৈরি গ্রাহক যন্ত্রও কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর কাজের শক্তি আবার ফিরে পায়।
যন্ত্রপাতির ব্যবহারিক প্রয়োগে এই আবিষ্কারের ফল সুদূরপ্রসারী।
প্যারিসে শতাব্দী পৃর্তির আন্তজাতিক মেলার সঙ্গে একটি পদার্থবিদ্যা কংগ্রেসেরও আয়োজন হয়েছিল, সেখানে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন জগদীশচন্দ্র। বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের সামনে তিনি তাঁর গবেষণা প্রবন্ধ পাঠ করলেন, নিজের তৈরি যন্ত্রে রেখাচিত্রগুলি দেখালেন। বিদ্বৎ সমাজে এই প্রতিক্রিয়া হল অত্যন্ত মিশ্র ধরনের। কেউ কেউ মুগ্ধ, অভিভূত। অনেকে বললেন, বুজরুকি, হতেই পারে না। কেউ বলল, মৌলিকতার দিক থেকে জগদীশচন্দ্রের গবেষণা-প্রবন্ধটিই সর্বশ্রেষ্ঠ, কেউ বলল, এটা বিজ্ঞানের এলাকাতেই পড়ে না।
বিজ্ঞানীর চেয়েও যেন কিছুটা উঁচুতে উঠে গিয়ে সত্যদ্রষ্টা ঋষির মতন জগদীশচন্দ্র বললেন, এখন কোথায় সীমারেখা টেনে বলব যে পদার্থবিদ্যার নিয়ম এখানে শেষ হল, আর এইখান থেকে শারীরবৃত্তের নিয়মের শুরু? এ রকম ভেদরেখা নেই।
পরাধীন দেশের একজন মানুষ এরকম চমকপ্রদ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেখাবে, এটাই অনেকে মানতে পারে না। বহু শতাব্দী ধরে ভারতে বিজ্ঞানচর্চার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। ফিজিকস, বা পদার্থবিদ্যা ভারতে প্রায় অজ্ঞাত ছিল। সেখান থেকে একজন ভূঁইফোড় বৈজ্ঞানিক উঠে আসবে কী করে? সমকক্ষ বৈজ্ঞানিকদের এরকম মনোভাব হলেও সাধারণ মানুষ জগদীশচন্দ্র সম্পর্কে কৌতূহল ও শ্রদ্ধা বোধ করে। জগদীশচন্দ্র ও অবলা যেখানেই যান অনেকে তাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
এই প্রদর্শনী উপলক্ষে প্যারিস শহরে আইফেল টাওয়ার নামে এক বিশাল ধাতুর গম্বুজ তৈরি হয়েছে, তার ওপর উঠলে এই সুন্দরী নগরীটিকে সম্পূর্ণরূপে দেখা যায়। জগদীশচন্দ্র ও অবলা একদিন সেখানে ওঠার জন্য টিকিট কাটতে যাচ্ছেন, দ্বাররক্ষক সসম্মানে দ্বার খুলে দিয়ে বলল, আপনাদের টিকিট কাটতে হবে না, আপনারা ফ্রান্সের সম্মানিত অতিথি।
প্যারিসের পর লন্ডন। সেখানে ওই একই বিষয়ে আরও বিস্তৃতভাবে বক্তৃতা দিলেন। ‘দা ইলেকট্রিসিয়ান’ নামে নামজাদা পত্রিকায় ছাপা হল সেই প্রবন্ধ। এখানেও প্রতিক্রিয়া একেবারে দুরকম। কয়েকজন বৈজ্ঞানিক বন্ধু ব্যবস্থা করে দিলেন, রয়াল ইনস্টিটিউশনের সুবিখ্যাত ডেভি-ফ্যারাডে ল্যাবরেটরিতে তিন মাস গবেষণা করে তাঁর পরীক্ষাগুলি আরও সুদৃঢ় করবেন।
জগদীশচন্দ্র অতিকষ্টে ছুটি নিয়ে এসেছেন বাংলা শিক্ষা বিভাগ থেকে, কিন্তু বিদেশে থাকার খরচপত্র জোগাড় হবে কোথা থেকে। আসবার সময় জাহাজের টিকিট কাটার সময়ই টাকার টানাটানি হয়েছিল। এখন তাঁর কাজ নিয়ে প্রবল বিতর্ক শুরু হয়েছে, এই সময় ইওরোপে বেশ কিছুদিন থেকে গেলে তিনি তাঁর গবেষণার অনেক উন্নতি করার সুযোগ নিতে পারেন, কিন্তু পরাধীন দেশের এই সন্তানকে নিরন্তর অর্থ সংগ্রহের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেবে কে? তাঁর কৃতিত্বে দেশের অনেক মানুষই গৌরব বোধ করে, পত্রপত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়, কিন্তু তাঁর অসুবিধেগুলি দূর করার চেষ্টা কেউ করে না। একবার প্রস্তাব উঠেছিল, ভারতীয়দের মধ্যেও তো ধনীর অভাব নেই, জগদীশচন্দ্রের জন্য চাঁদা তুলে দু’লক্ষ টাকার একটা তহবিল সংগ্রহ করা হোক। কিন্তু কেউ সে উদ্যোগ নেয় না। স্বামী বিবেকানন্দও প্যারিসে জগদীশচন্দ্রের গৌরব দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন, একজন বাঙালি যুবার এই কৃতিত্বে মাতৃভূমিকে ধন্য মনে করেছিলেন, কিন্তু জগদীশচন্দ্রের ব্যক্তিগত সুবিধে-অসুবিধের কথা খেয়াল করেননি। অবশ্য তাঁর নিজেরও অন্য অনেক চিন্তা ছিল।
জগদীশচন্দ্রের শ্রেষ্ঠ বন্ধু এক কবি। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জগদীশচন্দ্রের নিয়মিত পত্রবিনিময় হয়। শুধু বন্ধু নন, দুজনে দুজনের সৃষ্টিকর্মেরও পরম ভক্ত। শুধু জগদীশচন্দ্রকে শোনাবার তাগিদেই এক সময় প্রতি সপ্তাহে একটি করে ছোটগল্প লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ, এ ছাড়া কত কবিতা, কত গান শুনিয়েছেন। আবার জগদীশচন্দ্রের গবেষণার প্রতিটি স্তর গভীর আগ্রহে শুনেছেন রবীন্দ্রনাথ, তা নিয়ে প্রবন্ধও লিখেছেন। জগদীশচন্দ্র চান রবীন্দ্রনাথের রচনাগুলি ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে লন্ডনে ছাপা হোক, সারা বিশ্বের মানুষ বাংলার এই কবিকে জানুক।
এবারে ইওরোপে জগদীশচন্দ্রের সাফল্যের সংবাদ পেয়ে রবীন্দ্রনাথ শুধু আবেগ ভরে কবিতা লিখেই ক্ষান্ত হননি, স্থির মস্তিষ্কে চিন্তা করেছেন, কীভাবে জগদীশচন্দ্রের গবেষণার সুবিধের জন্য তাঁকে আরও বেশি দিন ইওরোপে রাখা যায়। জগদীশচন্দ্রের কাছে নানা রকম লোভনীয় চাকুরির প্রস্তাব এসেছে ওদেশে, হয়তো এক সময় বাধ্য হয়ে সে রকম কোনও চাকরি নিতেই হবে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাতে কিছুতেই রাজি নন। ওদেশে চাকরি নিলে জগদীশচন্দ্র আর স্বাধীন বৈজ্ঞানিক থাকবেন না, ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য হবেন না। রবীন্দ্রনাথ বারবার লিখে জানান, তুমি চাকরি নিয়ো না, আমি তোমার জন্য অর্থ সংগ্রহ করব।
অর্থের জন্য রবীন্দ্রনাথকে আর এক বন্ধুর দ্বারস্থ হতে হয়। মহারাজ রাধাকিশোর মাণিক্য। রবীন্দ্রনাথের প্রতি রাধাকিশোরের অগাধ বিশ্বাস। ত্রিপুরা রাজ্যের সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে বিবাদের শেষ নেই, এখনও মামলা-মোকদ্দমা চলছে, কলকাতার কোনও কোনও পত্রিকায় রাধাকিশোরের বিরুদ্ধে বিষোদগারও ছাপা হয়। রবীন্দ্রনাথ সব সময় রাধাকিশোরের পক্ষ সমর্থন করেছেন, কলকাতার অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিদের রাধাকিশোরের পক্ষে আনবার চেষ্টা করেছেন। অনেক রাজকার্যে এবং যুবরাজদের শিক্ষার ব্যাপারেও মহারাজকে পরামর্শ দেন রবীন্দ্রনাথ। ভয়
বিদেশ যাবার প্রাক্কালে প্রেসিডেন্সি কলেজে জগদীশচন্দ্র যখন অনেকের সমক্ষে জড়ের অনুভবশক্তি বিষয়ে বক্তৃতা করেন ও পরীক্ষাগুলি দেখান, সেই সভায় বিনা আমন্ত্রণে উপস্থিত হয়েছিলেন মহারাজ রাধাকিশোর মাণিক্য। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দেখে অবাক হয়ে যান এবং রাধাকিশোরের সঙ্গে জগদীশচন্দ্রের পরিচয় করিয়ে দেন।
জগদীশচন্দ্র বক্তৃতা দিলেন ইংরেজিতে। রাধাকিশোরের ইংরেজি জ্ঞান যৎসামান্য, বাংলা সাহিত্য ছাড়া আর কিছু পড়েননি। আধুনিক বিজ্ঞান সম্পর্কেও কোনও ধারণা ছিল না। তবু রবীন্দ্রনাথের পাশে বসে জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কারের মূল ব্যাপারটি তিনি বুঝে ফেললেন এবং সেদিন থেকেই বিজ্ঞান সম্পর্কে আগ্রহী হলেন।
তারপর থেকে জগদীশচন্দ্রের অর্থাভাবের কথা রবীন্দ্রনাথের মারফত জানতে পারলে রাধাকিশোর বিনা দ্বিধায় পাঁচ হাজার, দশ হাজার টাকা পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। রবীন্দ্রনাথকে এরকম বহুবারই ছুটে যেতে হয়।
ভূমিকম্পে রাজপ্রাসাদ ধ্বংস হয়ে যাবার পর নতুন করে আগরতলার নয়া হাভেলিতে গড়ে উঠছে রাজধানী। রাজ কোষাগার প্রায় শূন্য, এর মধ্যে আবার যুবরাজের বিবাহের উদ্যোগ চলছে, তাতেও অনেক খরচপত্র আছে। রবীন্দ্রনাথকে বারবার টাকা দেওয়াটা রাজকর্মচারীদের পছন্দ হয় না। একবার রবীন্দ্রনাথের সে রকম চিঠি আসার পর মহিম ঠাকুর বলল, আপনি তো অনেক দিয়েছেন, এখন তো আর দেওয়া যাবে না। এবারে বরং কবিকে বলুন, অন্য কোথাও থেকে টাকা সংগ্রহ করে নিন। রাধাকিশোর মহিমের মুখের দিকে তাকিয়ে সহাস্যে বললেন, আমার ভাবী বধুমাতার জন্য দু’এক পদ অলঙ্কার না হয় না-ই হবে। তার বদলে, জগদীশবাবু সাগরপার থেকে যে অলঙ্কারে ভারতমাতাকে ভূষিত করবেন, তার তুলনা কোথায়!
অনেক সময় চিঠির বদলে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং রাধাকিশোরের সঙ্গে দেখা করে টাকা চেয়ে আনেন। এজন্য একবার তিনি আগরতলাতেও ছুটেছিলেন। জগদীশচন্দ্র কাজ অসমাপ্ত রেখে দেশে ফিরতে বাধ্য হবেন, তা কখনও মেনে নেওয়া যায়। বন্ধুর জন্য রবীন্দ্রনাথ ভিক্ষুকের মতন প্রার্থী হতেও রাজি।
রাজকর্মচারীরা যে আড়ালে রবীন্দ্রনাথের নামে কটুকাটব্য করে, তিনি তা জানেন। কিছু কিছু মন্তব্য তাঁর কানেও এসেছে। তাদের ধারণা, উদার, সরলপ্রাণ এই মহারাজটিকে কথার মোহে ভুলিয়ে ওই কবি বারবার টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। ত্রিপুরার টাকা চলে যাচ্ছে কলকাতায়। বাংলার কোন লেখক অসুস্থ, কোন পত্রিকা চলছে না, কোন লেখক বই ছাপাতে পারছেন না, সে জন্য ত্রিপুরার রাজা অর্থসাহায্য করতে যাবেন কেন? জগদীশবাবুর জন্য যে কত টাকা চলে যাচ্ছে তার ঠিক নেই। রবিবাবু নিজেও তো খুব ধনীর সন্তান, ওঁদের কতবড় জমিদারি, ওঁর বন্ধুর জন্য উনি নিজে পাঁচ-দশ হাজার টাকাও দিতে পারেন না! মহারাজকে দোহন করার কি শেষ নেই?
এ সব মন্তব্য কানে এলে রবীন্দ্রনাথ আঘাত পান বটেই, কোনও উত্তর দেন না। তিনি ধনীর সন্তান ঠিকই, কিন্তু নিজে ধনী নন। এখন তিনি প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় পৌঁছেছেন। জমিদারি তদারকির জন্য তিনি মাসোহারা পান তিনশো টাকা। তাতে তার সংসার চলে। পৃথক ব্যবসা করতে গিয়ে এক মারোয়াড়ির কাছ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলেন, সে ব্যবসা ফেল পড়েছে। মহাজনকে বার্ষিক শতকরা সাত টাকা সুদ দেওয়া চলছিল, সম্প্রতি সে মারোয়াড়ি এক সঙ্গে পুরো টাকা শোধ করতে বলায় মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। কোথায় পাওয়া যাবে অতগুলি টাকা! কিন্তু রবীন্দ্রনাথ মহারাজ রাধাকিশোরের কাছে কখনও ঘুণাক্ষরেও উচ্চারণ করেননি তাঁর এই ব্যক্তিগত ঋণের কথা। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে তিনি কখনও মহারাজের কাছ থেকে একটি পয়সাও নেননি, এইখানেই তাঁর জোর।
এর ওপর তিনি স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছেন শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্য স্কুল চালাবার দায়িত্ব। তার খরচ চালাতেও দিশেহারা হয়ে যাচ্ছেন তিনি।
এক এক সময় তাঁর মনের মধ্যে কেউ যেন প্রশ্ন করে, তুমি তো কবি, শিলাইদহে নির্জন নদীর বুকে বজরায় গভীর নিশীথে মোমবাতি জ্বালিয়ে কবিতা কিংবা গান রচনা করতেই তুমি সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি পাও। স্কুল স্থাপনের মতন গুরুতর কাজের দায়িত্ব নিতে গেলে কেন তুমি?
কবি নিজেই উত্তর দেন, বিদেশি শাসকরা যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালাচ্ছে, তা কী করে মেনে নেব? এ তো দাস-তৈরির শিক্ষা। আমাদের দেশের বর্তমানের শিক্ষিত সমাজ শাসককুলের কৃপাপ্রার্থী, সামান্য একটু অনুগ্রহ পেলেই ধন্য হয়ে যায়। প্রাচীন ভারতের আদর্শে শিক্ষা, বিশুদ্ধ জ্ঞানের চর্চা, সবই কি শেষ হয়ে যাবে! বিদেশি শাসকদের সঙ্গে বাহুবল কিংবা অস্ত্রবলে আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারব না। ভারতীয় দর্শন ও ধর্মই আমাদের আত্মশক্তি। সেই আদর্শেই আমি ব্রহ্মচর্যাশ্রম স্থাপন করেছি।
মন থেকে আবার প্রশ্ন ওঠে, এ দায়িত্ব অন্য কেউ নিতে পারত না? দেশে আরও তো কত বড় মানুষ রয়েছেন। এটা কি কবির কাজ!
কবি উত্তর দেন, অন্য কেউ নিলে তো ভালই হত। সে রকম কোনও উদ্যোগ দেখছি না, সবাই গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন, সরকারি স্কুলগুলি থেকে শিক্ষিত বেকারের উৎপাদন হচ্ছে।
তাই আমি এই ব্রহ্মচর্যাশ্রম চালাতে বদ্ধমূল হয়েছি। কবি কি শুধু গগনবিহারী হবে? যত বাধাই আসুক, দায়িত্ব গ্রহণে আমি কখনও পরাত্মখ নই।
সেই অদৃশ্য প্রশ্নকারী বলে, ওহে কবি, এত বড় দেশ, কোটি কোটি মানুষ, অশিক্ষার অন্ধকারে প্রায় গোটা দেশ ছেয়ে আছে, তুমি প্রাচীন আদর্শে বিদ্যালয় স্থাপন করে কতজনকে শিক্ষা দিতে পার?
কবি জেদের সঙ্গে বলে ওঠেন, আমার যতটুকু সাধ্য, ততটুকুই আমি করে যেতে চাই। আমার এই বিদ্যালয় নিয়ে আমি অধিক গোল করতে চাই না। এখানে অল্প ছাত্ৰই পড়বে। এখন আছে বারোজন, বড় জোর কুড়ি জনের স্থান সঙ্কুলান হতে পারে। শহরের বিষদৃষ্টি থেকে অনেক দূরে, শান্তিনিকেতনের নির্জনতায় এরা যদি মানুষের মতন মানুষ হয়ে উঠতে পারে, তাই বা কম কীসে!
শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রম স্থাপন ও পরিচালনার দায়িত্ব রবীন্দ্রনাথ নিয়েছেন অনেকটা জেদেরই বশে।
এই ব্রহ্মচর্যাশ্রম স্থাপনের প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল বলেন্দ্রনাথের। কয়েক বছর আগে শান্তিনিকেতনে এই উদ্দেশ্যে একটি বাড়িও তৈরি হয়েছিল। বলেন্দ্রনাথের অকালমৃত্যুতে সব কিছু থেমে যায়।
নিজের ছেলে রথীকে রবীন্দ্রনাথ কোনও স্কুলে পাঠাননি, তাকে নিজে পড়িয়েছেন, তার জন্য একাধিক গৃহশিক্ষকও রাখা হয়েছে। শিলাইদহের নিরিবিলি পরিবেশে রথীর পুথিগত বিদ্যা ও প্রকৃতিপাঠ দুটোই বেশ ভালভাবে চলছিল, কিন্তু রথীর মা বেশিদিন শিলাইদহে থাকলে হাঁপিয়ে ওঠেন। কবিকেও নানান জায়গায় ঘোরাফেরা করতে হয়। রথীর এখন চোদ্দো বছর বয়েস, এই সময়ে কোনও নির্দিষ্ট স্থানে নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে তার পড়াশুনোর বন্দোবস্ত করতে পারলে সে এন্ট্রান্স পাস করবে কী করে? শমীকেও ভালভাবে পড়াতে হবে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, এখন দুই ছেলের উপযুক্ত শিক্ষা সম্পর্কে পিতাকে চিন্তা করতেই হয়।
শুধু নিজের ছেলে দুটিই নয়, আরও কিছু ছাত্রকে নিয়ে একটি আদর্শ বিদ্যালয় স্থাপনের ইচ্ছা আস্তে আস্তে রবীন্দ্রনাথের মনে দানা বাঁধে। মাধুরীলতাকে শ্বশুরালয়ে পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথে শান্তিনিকেতনে নেমে দু’একদিন থাকতে থাকতে তাঁর মনে হয়, এই শান্তিনিকেতনেই তো প্রাচীন ভারতের পোবন হতে পারে। যদিও শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি বেশ রুক্ষ, চতুর্দিকে যত দূরে তাকানো যায় শুধু ঊষর প্রান্তর, মাঝে মাঝে এক পায়ে খাড়া দৈত্যের মতন কিছু কিছু তালগাছ, আর বিশেষ গাছপালা নেই। কিন্তু যখন আকাশ ছেয়ে ধেয়ে আসে ঝড়, যখন উঁচু-নিচু কংকরময় ভূমির ফাঁকে ফাঁকে কলকল করে ছুটে যায় বৃষ্টি ধারা, রাত্রির আকাশ সহস্রদল পুষ্পের মতন প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে, সেই সব দৃশ্য-সৌন্দর্যের মধ্যে যেন পবিত্রতার সৌরভ আছে। এখানে আগেই আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতি বৎসর উৎসব হয়, একটা বাড়িও খালি পড়ে আছে, এখানে তো একটা স্কুল শুরু করে দেওয়া যেতেই পারে!
কিন্তু ছাত্র জোটানোও সহজ নয়। শিক্ষার উদ্দেশ্য এখন আর উন্নত ধরনের মানুষ হওয়া নয়, কোনও রকমে ডিগ্রি সংগ্রহ করে জীবিকার সুযোগ পাওয়া। পরীক্ষায় পাশ করাটাই প্রধান কথা। কোন অভিভাবক তার সন্তানকে এরকম অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিতে চাইবে! নিজের বাড়ি ছেড়ে কেউ সন্তানকে দূরে পাঠাতেও চায় না। উপযুক্ত শিক্ষক সংগ্রহ করাও সহজ নয়। নিছক একটা স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নয়, যারা সনাতন ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে পারবে, ব্যক্তিগত জীবনেও যারা সব রকম আড়ম্বর বর্জন করতে সক্ষম হবে, সে রকম শিক্ষক চাই।
সোফিয়া নামে একটি পত্রিকায় ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় নামে এক ব্যক্তি ইংরেজিতে রবীন্দ্রনাথের কাব্যের খুব প্রশস্তি করেছিলেন। তারপর টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি পত্রিকাতেও তিনি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের “নৈবেদ্য” গ্রন্থখানি তাঁর খুব প্রিয়। প্রথমে চিঠিপত্র বিনিময়ের পর এই ব্রহ্মবান্ধবের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত পরিচয় হল, কবি এঁর প্রতি আকৃষ্ট হলেন। মানুষটি বিচিত্র। আসল নাম ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এক সময় ব্রাহ্মণ ছিলেন, এখন রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টান হয়েছেন। খ্রিস্টান হয়েও নাম নিয়েছেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় এবং প্রাচীন ভারতীয় বর্ণাশ্রম ধর্মে দৃঢ় বিশ্বাসী। ব্রহ্মবান্ধব কিছুদিন সুদূর সিন্ধু প্রদেশে গিয়ে শিক্ষকতা করেছেন। এখন কলকাতার সিমলা অঞ্চলে প্রাচীন আদর্শে একটি বিদ্যালয় চালাচ্ছেন, তাঁর বিশেষ অনুগত এক ধনী ব্যবসায়ী কার্তিকচন্দ্র নানের পরিবারের ছেলেরাই প্রধানত সেই বিদ্যালয়ের ছাত্র। রেবাচাঁদ নামে তাঁর এক শিষ্য ওই বিদ্যালয়ের সহ শিক্ষক।
ব্রহ্মবান্ধবের সঙ্গে বন্ধুত্ব হবার পর রবীন্দ্রনাথ দু’একদিন ব্ৰহ্মবান্ধবের এই বিদ্যালয় দেখতে গেলেন। দুজনের উদ্দেশ্য একই। ব্রহ্মবান্ধব একদিন বললেন, আপনি বোলপুরে ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপন করলে আমার এ স্কুল তুলে দিতে পারি। আমার ছাত্রদের আপনার বিদ্যালয়ে পাঠাব।
দেবেন্দ্রনাথের এখন পঁচাশি বছর বয়েস, তবু সব ইন্দ্রিয় সজাগ। কনিষ্ঠ পুত্রের প্রস্তাব শুনে তিনি শুধু সম্মতিই জানালেন না, মাসিক দুশো টাকার অনুদানের ব্যবস্থা করে দিলেন। সেই অনুযায়ী ট্রাস্ট ডিড হল।
উদ্বোধনের দিন ছাত্র সংখ্যা মাত্র পাঁচজন, ক্রমে বেড়ে বেড়ে এখন বারোজন। এদের জন্য পাঁচজন শিক্ষক। এ বিদ্যালয় সম্পূর্ণ অবৈতনিক তো বটেই, ছাত্রদের খাওয়া থাকার ভারও নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। ব্রহ্মবান্ধব বেশ কয়েকজন ছাত্র এনেছেন, তাঁর শিষ্য রেবাচাঁদ এখানে ইংরেজি পড়াবেন। ব্রহ্মবান্ধব নিজে এখানে স্থায়ীভাবে থাকতে পারবেন না। যখনই আসেন কয়েকটা ক্লাসে পড়িয়ে যান, যেমন রবীন্দ্রনাথ মাঝে মাঝে এসে যে-কোনও ক্লাসে ঢুকে পড়ান, সন্ধেবেলায় সবাইকে নিয়ে গল্পের আসর বসান।
ব্রহ্মবান্ধব সকলের সামনে একদিন রবীন্দ্রনাথকে বললেন, আপনি এই আশ্রমের গুরুদেব। এখন থেকে সবাই আপনাকে গুরুদেব বলে ডাকবে।
কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা মানতে হয় ছাত্রদের। প্রতিদিন বিছানা ছেড়ে উঠতে হয় ভোর সওয়া
পাঁচটায়। তাদের প্রথম কাজ ঘর ঝাঁট দিয়ে নিজেদের জিনিসপত্র ও শয্যা গুছিয়ে রাখা। তারপর প্রাতঃকৃত্য সারার জন্য মাঠে যাওয়া। ছাত্ররা তার নাম দিয়েছে মাঠ করা। শৌচাগার তো নেই-ই। স্নানাগারও নেই, স্নান করতে যেতে হয় ভুবনডাঙার বাঁধে। বর্ণাশ্রমকে বর্ণে বর্ণে পালন করার জন্য ছাত্রদের পোশাকও বিভিন্ন। ব্রাহ্মণদের সাদা, বৈদ্য ও কায়স্থদের জন্য লাল এবং বৈশ্যদের জন্য হলুদ আলখাল্লা। শিক্ষকদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে হবে বটে, কিন্তু ব্রাহ্মণ ছাত্ররা কায়স্থ শিক্ষকদের পায়ে হাত দেবে না, শুধু নমস্কার জানাবে। ব্রহ্মবান্ধবেরও এই ব্যবস্থা খুব পছন্দ।
স্নানের পর গাছতলায় এসে সংস্কৃত মন্ত্র সহযোগে উপাসনা। ব্ৰহ্মবান্ধব এক একদিন পাশে দাঁড়িয়ে দেখেন, ছাত্রদের উচ্চারণ ভুল হচ্ছে কি না। উপাসনার পর হালুয়া ভক্ষণ। তারপর আধ ঘণ্টা মাটি কোপানো। এরপর পড়াশুনো শুরু। তাও আগে ছাত্র ও শিক্ষকরা সমবেতভাবে একবার উপাসনা সেরে নেবেন। দশটায় ক্লাস শেষ, এখন কিছুক্ষণ কেউ হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান শিখবে, কেউ গল্পের বই পড়বে। সাড়ে এগারোটায় মধ্যাহ্নভোজন, ডাল-ভাত ও একটা কিছু সবজির ঘ্যাঁট, বিশুদ্ধ নিরামিষ। ব্রাহ্মণ ছাত্ররা এক পঙক্তিতে না বসে বসবে খানিকটা দূরে, ছোঁয়াছুঁয়ি বাঁচিয়ে। প্রত্যেক ছাত্রের নিজস্ব থালা-বাটি, খাওয়ার পর নিজেদেরই মেজে-ধুয়ে রাখতে হয়। সাড়ে বারোটায় আবার ক্লাস শুরু, তিনটের সময় মাত্র পনেরো মিনিটের বিশ্রাম, আবার সাড়ে চারটে পর্যন্ত। এরপর খেলাধুলোর ছুটি। ছাত্র-শিক্ষক সবাই মিলে কিছুক্ষণ ফুটবল পেটাপিটি করে। প্রাচীন ভারতের আশ্রম-বিদ্যালয়ে ফুটবলের তুল্য কোনও ক্রীড়াবস্তু হয়তো ছিল না, এখানে এটুকু ব্যতিক্রম করতে হয়েছে। সন্ধে হতে না হতেই হাত পা ধুয়ে এসে আবার উপাসনা। এরপর, যে-সময় রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত থাকেন তখন তিনি সবাইকে নিয়ে বসেন। গল্প-কবিতা-গান শোনান, নানা রকম মজার মজার খেলাও উদ্ভাবন করেন। তিনি যখন থাকেন না, তখন আর বিশেষ কিছু করার থাকে না, আবার নিরামিষ আহার শেষ করে রাত্রি নটার মধ্যে শয্যাগ্রহণ।
স্কুলটি শুরু হল তো বেশ ভালভাবেই, কিন্তু এর মধ্যে একটা মজার বৈপরীত্য আছে। নৈবেদ্যর কবিতাগুলি রচনার সময় থেকেই রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন ভারতের নেশায় মেতে আছেন, ব্রাহ্মণ কায়স্থের ভেদাভেদের মতন একটা কুপ্রথাকেও মেনে নিয়েছেন। এবং তাঁর প্রধান সহযোগী ব্ৰহ্মবান্ধব একজন কট্টর খ্রিস্টান! শিক্ষক রেবাঁচাঁদও খ্রিস্টান, তিনি নাকি ছেলেদের বাইবেলের গল্পও শোনান। ক্রমে এই নিয়ে ফিসফাস শুরু হল, ব্রহ্মচর্যাশ্রম কি শেষ পর্যন্ত খ্রিস্টানদের আখড়ায় পরিণত হবে? রবীন্দ্রনাথের খ্রিস্টানদের সম্পর্কে কোনও গোঁড়ামি নেই, কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ খ্রিস্টধর্মের ঘোর বিরোধী। ইংরেজ সরকার সারা ভারতে রবিবার ছুটির দিন হিসেবে চালিয়েছেন, কিন্তু রবিবার তো খ্রিস্টানদের স্যাবাথ ডে, অন্যরা তা মানতে বাধ্য হবে কেন? সেই জন্যই তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, শান্তিনিকেতনে ছুটির দিন হবে ব্রাহ্মদের পুণ্য দিন, বুধবার। সেই তিনি শান্তিনিকেতনে খ্রিস্টানদের কর্তৃত্বের কথা শুনলে তো বিরক্ত হবেনই।
রবীন্দ্রনাথ দোটানায় পড়লেন। পিতার মতামত তাঁকে মানতেই হবে, আবার ব্রহ্মবান্ধবকেও তিনি চলে যেতে বলতে পারেন না। ব্রহ্মবান্ধব চলে গেলে তাঁর অনুগত ছাত্রদেরও নিয়ে যাবেন। আবার খ্রিস্টানদের আধিপত্যের কথা যদি কলকাতা পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তা হলে হিন্দু পরিবার থেকে নতুন ছাত্র জোটানো শক্ত হবে। শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথকে কিছু বলতে হল না, রেবাচাঁদ টের পেয়ে গেলেন যে তাঁদের বিরুদ্ধে একটা ঘোঁট পাকানো চলছে। তিনি ব্রহ্মবান্ধবকে সে কথা জানাতেই ব্রহ্মবান্ধব জ্বলে উঠলেন। ব্রহ্মবান্ধব আবেগতাড়িত মানুষ, উত্তেজিতভাবে তর্ক বিতর্ক করলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে, সে তর্কের কোনও মীমাংসা হবার আগেই রেবাঁচাঁদকে সঙ্গে নিয়ে আশ্রমের সংস্পর্শ ত্যাগ করলেন চিরতরে।
এই ধাক্কা সামলাবার জন্য রবীন্দ্রনাথকে নতুন শিক্ষক নিয়োগ করতে হল। এবার অচিরেই তিনি টের পেলেন, তিনি তাঁর সামর্থ্যের চেয়ে অনেক বেশি দায়িত্ব নিয়ে বসে আছেন। যখন তখন খরচের ধাক্কা। দেবেন্দ্রনাথ মাসিক দুশো টাকা বরাদ্দ করেছেন, তাতে কী করে কুলোবে! শিক্ষকদের বেতন আছে, ছাত্রদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থার ত্রুটি থাকলে চলে না। ছোট্ট একটি বাড়িতে সকলের স্থান সঙ্কুলান হয় না, আরও বাড়ি বানাতে হচ্ছে। শিক্ষকরা অল্প বেতনে পড়াতে রাজি হয়েছেন, কিন্তু তাঁদের মাথার ওপর আচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতে হবে তো! এদিকে রবীন্দ্রনাথের হাত একেবারে খালি। এমনই অবস্থা যে স্ত্রীর কয়েকটি গয়নাও বন্ধক দিতে হয়েছে। মৃণালিনীর কাছ থেকে বারবার চাইতেও লজ্জা হয়।
একটা নতুন স্কুল বাড়ির গাঁথনি হয়ে গেছে, ওপরে কাঠের ফ্রেম করে টালি বসানো দরকার। সে খরচ কে দেবে? যে-কোনও দিন বষা এসে পড়বে। রবীন্দ্রনাথ কোনও কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছেন না। সর্বক্ষণ অর্থচিন্তা!
মৃণালিনী স্বামীর মুখ দেখেই বুঝতে পারেন, কোনও একটা সমস্যায় তিনি পীড়িত। বারবার কারণ জিজ্ঞেস করেন, রবীন্দ্রনাথ বলতেই চান না। শেষ পর্যন্ত বলেই বসলেন, নতুন বাড়ির জন্য কাঠের ফ্রেম ও টালির অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে। টাকা না পাঠালে ওরা সেগুলি ডেলিভারি দেবে না। এতগুলি টাকা আমি এখন কোথায় পাব!
মৃণালিনী নিজের হাত থেকে এক জোড়া মকরমুখো বালা খুলে দিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ব্যস্তভাবে বললেন, না, না, ওগুলো দিয়ো না। ও আমার মায়ের গহনা। পারিবারিক জিনিস, ও দুটো তোমার প্রথম পুত্রবধূকে দিয়ে।
মৃণালিনী বললেন, ভাগ্যে থাকলে রথীর বউয়ের জন্য আবার গহনা হবে। এখন এই দিয়ে কাজ চালাও।
রবীন্দ্রনাথ বললেন, তোমার হাত খালি করে দেবে? ও আমি নিই কী করে!
মৃণালিনী বললেন, মেলার সময় অনেক সুন্দর সুন্দর বেলোয়ারি চুরি পাওয়া যায়, তাতেই আমার হাত ভরে যাবে।
রবীন্দ্রনাথ বললেন, অনেকে বলে, এই ইস্কুলটা চালানো আমার একটা উৎকট শখ। তুমি যে আমার এই শখের বিরূপতা করোনি, আমার তালে তাল মিলিয়েছ, এ জন্য আমি যে কতখানি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। এই শেষ, তোমার কাছ থেকে আর চাইতে হবে না।
মৃণালিনী মুখ ফিরিয়ে হাসলেন। স্বামীকে না জানিয়েও তাঁকে কিছু কিছু গয়না বিক্রি করতে হয়েছে। ইস্কুল নিয়ে স্বামী এমনই ব্যস্ত যে সংসার কী করে চলছে, সেদিকেও খেয়াল রাখেন না।
রথী স্কুলে অন্য ছেলেদের সঙ্গেই খাবার খায়। প্রতিদিন এক ঘেয়ে নিরামিষ খাদ্য, পরিমাণও যথেষ্ট নয়। উঠতি বয়েসের ছেলে, এখন পেট ভরে ভাল করে না খেলে কি স্বাস্থ্য ভাল হতে পারে? এই কথা ভাবলেই মায়ের বুক ফেটে যায়। চুপি চুপি নিজের ছেলেকে বাড়িতে ডেকে এনে সুখাদ্য খাওয়ানোটাও অতি বিসদৃশ ব্যাপার। মৃণালিনী তাই প্রায়ই স্কুলের সব কটি ছেলেকেই নিমন্ত্রণ করে পঞ্চ ব্যঞ্জন বেঁধে খাওয়ান। মায়ের কাছে প্রশ্রয় পেয়ে রথীও যখন তখন সহপাঠীদের বাড়িতে এনে রান্নাঘর, ভাঁড়ারঘরের সব কিছু সাফ করে দেয়। এতগুলি ছেলের খাদ্য জোগানোর খরচ কি কম!
একটা সমস্যা মিটলেই আবার একটা অন্য সমস্যা দেখা দেয়। দেবেন্দ্রনাথ কখনও সখনও কিছু অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করেন বটে, কিন্তু বারবার তাঁর কাছ থেকে অর্থ আদায় করার বিপদও আছে। ব্রহ্ম বিদ্যালয়, রবির নিজস্ব উদ্যোগ, অন্য ভাইরা এতে উৎসাহ দেখাননি। দেশের সরকারের প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলিতে ছাত্রদের কাছ থেকে বেতন নেওয়া হয়, আর রবীন্দ্রনাথ শুধু বিনা বেতনে নয়, ভরণপোষণেরও দায়িত্ব নিয়েছেন। বারোজন ছাত্রের জন্য পাঁচজন শিক্ষক! এমন শখের স্কুল চালাবার জন্য দেবেন্দ্রনাথের তহবিল থেকে অনবরত ব্যয় করলে অন্যান্য শরিকদের ভাগে কম পড়ে যাবে না!
তবু সকালবেলা ছাত্ররা সার বেঁধে যখন উপাসনা শুরু করে, তখন সেদিকে তাকিয়ে রবীন্দ্রনাথের মন ভরে যায়। কয়েকজনের সমালোচনা শোনার পর এখন আর ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-শুদ্র ছাত্রদের বিভিন্ন রঙের পোশাক নয়, সকলের জন্যই গেরুয়া আলখাল্লার ব্যবস্থা হয়েছে। উদ্দীপনাময় কচি কচি মুখগুলিতে যেন ভবিষ্যতের ছবি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্য আত্মস্থ করে, পরিপূর্ণভাবে শিক্ষিত হয়ে এরা মানুষের মতন মানুষ হবে। স্বাবলম্বী, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নাগরিক, এরাই দেশ গড়বে।
রবীন্দ্রনাথ একটানা বেশিদিন শান্তিনিকেতনে থাকতে পারেন না। শিলাইদহে জমিদারি তদারকিতে যেতে হয়, কলকাতাতেও নানান সভায় বক্তৃতা ও গান করতে হয়, ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার কাজও আছে। সেখানে ধারাবাহিক উপন্যাস ‘চোখের বালি’ ও অন্যান্য প্রবন্ধাদি লিখতে হচ্ছে। পত্রিকার খরচ ওঠে না, সে দায়িত্ব রবীন্দ্রনাথের না হলেও চিন্তা তো হয়ই। মহারাজ রাধাকিশোর স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে একশো টাকা করে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ‘বঙ্গদর্শন’-কে সাহায্য করলে সরলা ঘোষালের ‘ভারতী’ পত্রিকাকে কেন সাহায্য দেওয়া হবে না, তা নিয়েও কেউ কেউ মনঃক্ষুণ্ণ।
বন্ধু-শুভার্থীরা অনেকে শান্তিনিকেতনে গিয়ে স্কুলটি দেখতে চায়। রবীন্দ্রনাথও অনেককে নিয়ে গিয়ে তাঁর কর্মকাণ্ডটি দেখাতে আগ্রহী, না হলে ভবিষ্যতে আরও ছাত্র সংগ্রহ হবে কী করে? কারুকে কারুকে তিনি যাতায়াতের ভাড়া দিয়েও নিয়ে যান। এতেও আছে অতিরিক্ত খরচের ধাক্কা।
বন্ধুরা সকলেই অবশ্য রবীন্দ্রনাথের এই উদ্যোগটি সমর্থন করেন না। দু-একজনের মতে, রবীন্দ্রনাথ জোর করে অতীতে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। স্কুলের ছাত্রদের আশ্রমবাসী ব্রহ্মচারীর মতন হতে হবে কেন? তা ছাড়া, রবীন্দ্রনাথের হিন্দু হিন্দু বাতিক হয়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলে মুসলমানদের স্থান কোথায়? মুসলমানরা কি ভারতবাসী নয়! কোনও মুসলমান ছাত্র ওই স্কুলে যোগ দিতে চাইলে তাকেও কি বেদমন্ত্র পাঠ করতে হবে? অন্য ছাত্রদের সঙ্গে সে পঙক্তিভোজনে বসতে পারবে? ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতি এর মধ্যেই বহু সংখ্যক মুসলমান বিরূপ হয়ে গেছে। এই ব্রহ্মচর্যাশ্রমের মতন আরও কিছু প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠলে তো মুসলমানদের দূরে সরিয়ে দেওয়া হবে ক্রমশ। মুসলমানদের মাদ্রাসায় হিন্দু ছাত্রদের স্থান নেই, হিন্দুরাও যদি শুধু হিন্দুদের জন্য আলাদা বিদ্যালয় গড়ে তুলতে থাকে, তা হলে ছাত্রসমাজের মধ্যে ভেদাভেদের সৃষ্টি হবে। ভবিষ্যতে এই ছাত্ররা কী আদর্শ ভারতীয় নাগরিক হতে পারে!
রবীন্দ্রনাথ তবু মনে করেন, ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষার বিকল্প হিসেবে প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষার আদর্শ ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। মৃত প্রাচীন ব্যাপারকে মন্ত্রবলে জীবিত করে তোলা যায় না, কিন্তু অতীতের যে সব ধারা প্রচ্ছন্নভাবে অথচ বেশ প্রবলরূপে বর্তমান, অন্ধের মতন তাকে অস্বীকার করতে গিয়েই আমাদের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। অন্য দেশের আধুনিকতাকে এ দেশের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়াও ক্ষতিকর।
অনেকবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তাঁর বিশেষ বন্ধু প্রিয়নাথ সেন কিছুতে শান্তিনিকেতন যেতে রাজি হলেন না।
স্কুল ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের সংসার এখন শান্তিনিকেতনে, তাই এখানে ঘন ঘন আসেন।
মৃণালিনীর শরীর ভাল যাচ্ছে না, স্বামীর কাছে তা তিনি গোপন করে যান। এখানে এসেই রবীন্দ্রনাথ ব্যস্ত হয়ে পড়েন, সারাদিন অনেক লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে হয়, মৃণালিনী যে মাঝে মাঝেই শুয়ে থাকেন, তা তাঁর নজরে পড়ে না।
একদিন রাত্রিবেলা, সকলে ঘুমিয়ে পড়ার পর তিনি পত্রিকার জন্য প্রাচীন সাহিত্য বিষয়ক একটি প্রবন্ধ লিখতে বসেছেন, বেশ খানিকটা লেখার পর থেমে গেলেন। হঠাৎ তাঁর মনে হল, অনেক দিন তিনি কোনও প্রেমের কবিতা লেখেননি। ইন্দিরার বিয়ে হবার পর তেমন অন্তরঙ্গ চিঠিও লেখেননি কারওকে। উপন্যাস লিখছেন বলে কবিতা কমে আসছে!
কলম হাতে নিয়ে ভাবতে লাগলেন, প্রেম তাঁকে ছেড়ে গেল! নতুন বউঠানের কথাও মনে আসেনি অনেকদিন। সেই মুখোনি যেন অস্পষ্ট হয়ে গেছে। এখন তিনি শুধু কাজের মানুষ? যে-সব কাজকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, বক্তৃতা করা, লেখালেখি, এখানে সেখানে ছুটে বেড়ানো, দেশ উদ্ধার করবার ফিকির, এগুলো কি সত্যি তাঁর কাজ। প্রেম কি এসব কিছুর চেয়ে বড় নয়! প্রেম ছাড়া জীবনটাই তো শুষ্ক। ছিলেন প্রেমিক কবি, হয়ে গেলেন এক আশ্রমের গুরুদেব।
আকাশে আজ পূর্ণ চাঁদের মায়া, বারান্দায় একটা মসলিনের চাঁদরের মতন ছড়িয়ে আছে জ্যোৎস্না। এখনকার স্তব্ধতার সঙ্গে শহরের রাত্রির কোনও তুলনাই হয় না। বাতাসে ভেসে আসছে কোনও ফুলের সুগন্ধ।
বাইরের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ বিষণ্ণভাবে বসে রইলেন। যে-সব দায়িত্ব নিয়েছেন, তা কোনওটা থেকেই বিচ্যুত হবেন না। কিন্তু কবিতা রচনাই তাঁর প্রধান কাজ। আবার লিখতে হবে।
এক সময় ঘোর ভাঙল। অনেক রাত হয়ে গেছে। কটা বাজে দেখার জন্য তিনি পকেট ঘড়িটা বার করলেন। তারপর ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলেন এক দৃষ্টিতে। এটা তাঁর বিয়ের সময় যৌতুক পাওয়া সোনার ঘড়ি। একটা বোম টিপলে ওপরের ডালা খুলে যায়। ডালার ভেতর দিকে ইংরেজি অক্ষরে তাঁর নামের আদ্যক্ষর খোদাই করা।
আবার বাস্তবতা তাঁকে আঘাত করেছে। ঘড়িটাতে সময় দেখার বদলে অন্য কথা তাঁর মনে পড়েছে। স্কুলের শিক্ষকদের এ মাসের বেতনের টাকার সংস্থান করা যায়নি এখনও। নির্দিষ্ট দিনে মাস-মাইনে দিতে না পারলে সম্মান রক্ষা করা যাবে না। টাকা সংগ্রহের কোনও উপায় দেখা যাচ্ছে না। মৃণালিনীর কাছ থেকেও আর গহনা চাওয়া যায় না।