আটান্ন
কলকাতা শহরের বিখ্যাত ব্যক্তিদের কাছে আমাদের আবেদন রাখা হয়েছিল শান্তি কমিটির পক্ষ থেকে। তাঁরা প্রত্যেকেই স্বীকার করেছেন এরকম উদ্যোগ মানুষের মনে অন্যায়ের সঙ্গে লড়বার শক্তি যোগাবে। সারা দেশ যেখানে পশুশক্তির কাছে মাথা নত করে থাকে সেখানে বেলগাছিয়ার মানুষ দেখিয়ে দিল সাধারণ মানুষ যখন একতাবদ্ধ হয় তখন কোন শক্তি তাদের দাবিয়ে রাখতে পারে না। একটি বিখ্যাত কাগজে লেখা হল, অন্যায়ের ছুরির যে কোন বাঁট নেই, যে মারে সেও রক্তাক্ত হয় তা এই ঘটনায় প্রমাণ হল। আর একটি কাগজ আর এক ধাপ এগিয়ে বলল, ‘বেলগাছিয়া প্রমাণ করল সাধারণ মানুষ বিপ্লব করতে আগ্রহী।’
শান্তি কমিটির তরফ থেকে কলকাতার বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, অভিনেতাদের কাছে আবেদন রাখা হল তাঁরা যদি সশরীরে এই উপলক্ষে আয়োজিত সভায় উপস্থিত হয়ে কিছু বলেন তাহলে এলাকার মানুষের মনের জোর আরও বাড়বে। কারণ এই মুহূর্তে পুলিস যদিও শান্তি কমিটির বিরোধিতা করছে না কিন্তু কয়লার সঙ্গীরা আশেপাশে এলাকায় এখনও সক্রিয়। কিছু কিছু ভয় দেখানোর ঘটনা ঘটছে। তাছাড়া এলাকার মানুষ যদি দেখে বিখ্যাত ব্যক্তিরা তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তাহলে আরো মনের জোর বাড়বে।
প্রত্যেকের সম্মতি নিয়ে সভা ডাকা হল। এলাকার মানুষের কাছে সে খবর মাইকের মাধ্যমে ঘুরে ঘুরে জানিয়ে দেওয়ায় সভা ভরে গেল। হাজার পাঁচেক মানুষ বিকেল হতেই পার্কে উপস্থিত। তাদের মধ্যে উৎসাহ বেশী মেয়েদের। যতটা না শোনার তার চেয়ে বেশী দেখার।
সকালে মাধবীলতাকে বলে এসেছিল যে সে বিকেলে আসবে না। শান্তি কমিটি থেকে তাকে কয়েকজন বিখ্যাত সাহিত্যিক এবং অভিনেতাকে নিয়ে আসবার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই কদিনে মায়ের কাছে এসব ঘটনা বিস্তারিত বলেছে সে। মাধবীলতা অবাক হয়ে শুনেছে। ঈশ্বরপুকুরের লোক এখন অশ্লীল শব্দ শুনছে না, গুণ্ডামি হচ্ছে না এটা ভাবতে তার অসুবিধে হচ্ছিল। দুটো ঘটনা অর্ক ইচ্ছে করে চেপে গেছে। মোক্ষবুড়ির মারা যাওয়া আর তার নিজের ছুরি খাওয়া। মনে হয়েছিল এই ঘটনা দুটো বললে মাধবীলতা উত্তেজিত হতে পারে। খুব দ্রুত সেরে উঠছে মাধবীলতা। যদিও তার শরীর খুবই দুর্বল এবং নড়াচড়া করা সম্পূর্ণ নিষেধ। পরমহংস এখন রোজ আসে না। অর্কর প্রশ্নের উত্তরে বলেছিল, ‘ক্রিকেট খেলেছ? যখন টিম ফলো অন খায় তখন এগার নম্বর ব্যাটসম্যান ঠকঠক করে কাঁপে। অ্যাদ্দিন আমার সেই অবস্থা ছিল। কিন্তু যখন তিরিশ রান তুললেই টিম জিতবে তখন সেই ব্যাটসম্যান হোটেলে ঘুমুতে পারে। আমার এখন সেই অবস্থা। বুঝলে? কি বুঝলে?’
সৌদামিনীও থাকছেন না। মাঝে একদিন নীপা মিত্রের হাত দিয়ে মাধবীলতার মাইনে পাঠিয়ে, দিয়েছেন। হাসপাতালে যা খরচ হবে তা স্কুল থেকেই দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।
ব্ৰজমাধব পালের গাড়ি পাওয়া গিয়েছিল। শান্তি কমিটিকে তিনি আজকের অতিথিদের নিয়ে আসার জন্যে গাড়িটি দিয়েছিলেন। অর্ক এবং আর একটি ছেলে চারটে নাগাদ বেরিয়ে পড়ল সেজেগুজে। সুবল ওদের বারংবার বলে দিয়েছিল বিনীত ব্যবহার করতে। কথাবার্তায় যেন সমীহভাব থাকে সব সময়। সাহিত্যিকদের সম্পর্কে অর্কর কোন ধারণাই ছিল না। যে দুজনকে তার নিয়ে আসার কথা তাদের কোন লেখা সে পড়েনি, নামও তেমন শুনেছে বলে মনে পড়ে না। মাধবীলতা নাম শুনে বড় বড় চোখে তাকিয়েছিল, ‘তোর কি সৌভাগ্য! নাম শুনিসনি কি রে? কি অশিক্ষিত রে তুই? এঁরা দুজনেই তো এখনকার সবচেয়ে বড় লেখক।’ কিন্তু অভিনেতা দুজনকে অর্ক জানে। ওদের আনতে হবে বলে সে কিঞ্চিৎ উত্তেজিত। দুজনের ছবি সিনেমার বিজ্ঞাপনে, হলের সামনে টাঙানো থাকে। কথা ছিল, আগে অভিনেতাদের তুলে আসবার সময় একটা কাগজের অফিস থেকে লেখকদের নিয়ে আসতে হবে।
নিউ আলিপুরে প্রথম অভিনেতার বাড়িতে গিয়ে হোঁচট খেল ওরা। তিনি বাড়িতে নেই। হঠাৎ শুটিং পড়ে যাওয়ায় বাইরে চলে গিয়েছেন। দ্বিতীয়জন থাকেন টালিগঞ্জে। বাড়িতেই ছিলেন। অর্ক বেল বাজাতে একটা চাকর দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করল, ‘কাকে চাই?’
নাম বলল অর্ক, ‘বলুন, বেলগাছিয়া থেকে এসেছি।’
বাইরের ঘরে মিনিট দশেক অপেক্ষা করার পর অভিনেতা এলেন। হাতে চুরুট। অর্ক উঠে দুহাত জড়ো করে নমস্কার করল। দারুণ ফর্সা লম্বা কিন্তু ছবিতে যা দেখায় তার চেয়ে বয়স বেশী। কিন্তু অর্ক খুব নার্ভাস হয়ে যাচ্ছিল। এত বড় মানুষের সামনে সে দাঁড়াবে ভাবাই যায় না। অভিনেতা বললেন, ‘কোত্থেকে আসা হয়েছে ভাই?’
‘বেলগাছিয়া। আমাদের ওখানে আপনি যাবেন কথা আছে।’
‘কথা?’ অভিনেতা চুরুটে টান দিলেন, ‘কথা তো থাকেই। ভেরি নোব্ল পার্পাস। সুন্দর উদ্যোগ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, হুঁ? রাশিয়াতে এরকম হয়েছিল। জারের সময়ে। তা তোমরা কি করেছ? দলবেঁধে মাস্তান পেঁদিয়েছ? কংগ্রেসী মাস্তান?’
‘আপনি তো সব জানেন। পাড়ার সবাই আপনার মুখ থেকে কিছু শুনতে চায়। আমাদের হাতে বেশী সময় নেই, অনেক দূর যেতে হবে।’ অর্ক খুব বিনীত গলায় বলল।
‘কে কে যাচ্ছে?’
‘অনেকেই যাবেন।’ অর্ক নামগুলো বলল।
‘সে কি? চ্যাটার্জী যাচ্ছে? ওকে বলেছ কেন? রিঅ্যাকশনারি, এসকেপিস্ট! তাছাড়া পাবলিক তো ওকে দেখতেই ভিড় করবে।’
‘আমরা তো অভিনেতা হিসেবেই বলেছি।’
‘অভিনেতা? ও আবার অভিনয় করতে শিখল কবে? মুখ দেখিয়ে পয়সা পায়। না না, ও গেলে আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।’
‘কিন্তু আপনি না গেলে—।’
‘দ্যাখো ভাই, আমি অভিনেতা, রাজনীতি করি না। তোমাদের এই ব্যাপারে নাক গলাননা ঠিক নয়। এসে জানতে চাইলে সমর্থন করলাম। মুখে বলা এক কথা আর নিজে হাজির হয়ে বক্তৃতা দেওয়া অন্য কথা। স্ট্যাম্প পড়ে যাবে। তোমরা বিপ্লব ফিপ্লব করছ করো, আমরা তো আছিই।’ কথাগুলো বলেই ঘাড় ঘুরিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন অভিনেতা, ‘কি বলছ? অ্যাঁ? ওহো ওষুধ খাওয়ার সময় হয়ে গেল। ঠিক আছে, চলি।’
অর্ক স্থির জানে ভেতর থেকে কেউ ওঁকে ডাকেনি। ও অভিনেতার নিষ্ক্রমণ দেখল। তারপর চাপা গলায় বলল, ‘শালা!’
অর্কর সঙ্গী বলল, ‘কি হবে এখন?’
বাঁ দিকের দেওয়ালে সাজানো রয়েছে অনেক কিছু। এখন ঘরে কেউ নেই। অর্ক হাত বাড়িয়ে একটা মূর্তি তুলে নিল। বিখ্যাত পত্রিকা থেকে অভিনয়ের জন্যে পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয়েছিল। সেটাকে তুলে অর্ক সোজা বাইরে বেরিয়ে আসতেই চাকরকে দরজায় দেখা গেল।
‘এই যে, ওটা কি নিয়ে যাচ্ছেন?’ ছুটে এল চাকর।
অর্করা ততক্ষণে গাড়িতে উঠে বসেছে। সেটা চালু হতে শূন্যে ছুঁড়ে দিল অর্ক মূর্তিটাকে। সুদৃশ্য পালিশকরা অ্যাবস্ট্রাক্ট মূর্তিটা মাটিতে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
সারাটা পথ ওরা কোন কথা বলল না। অর্কর মনে হচ্ছিল এই লোকটাকে যদি কয়লার সঙ্গে প্যাঁদানো যেত তাহলে মনে সুখ হতো। শালা দুনম্বরী! খবরের কাগজের অফিসে এসে সে আরও অবাক। নিচের রিসেপসনে তাকে আটকেছিল প্রথমে। অনেক বলাবলির পর সে ওপরে ওঠার ছাড়পত্র পেয়েছিল। একটি ঘরে চার-পাঁচজন মানুষ গল্প করছিলেন। অর্ক নাম বলতে দুজন বিখ্যাত লেখককে চিনিয়ে দিল একজন। অর্ক নমস্কার করে বলল, ‘আমি বেলগাছিয়া থেকে এসেছি। চলুন।’
মোটাসোটা স্বাস্থ্যবান বৃদ্ধ বললেন, ‘এখন তো যেতে পারব না ভাই। রবীন্দ্রসদনে আমার একটা সভা আছে ঠিক ছটায়। সেটা সেরে চলে যাবো। সাতটা নাগাদ পৌঁছে যাবো।’
‘আমি কি ততক্ষণ অপেক্ষা করব?’
‘না না। কোন দরকার নেই। এটা জনগণের নবজাগরণের ব্যাপার। এখানে না গিয়ে পারি? রবীন্দ্রসদনটা অ্যাভয়েড করতে পারছি না, আমার এক বান্ধবী খুব ধরেছে। চিন্তা করো না।’
অর্ক দ্বিতীয়জনের দিকে তাকাল। তিনি পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে এগিয়ে ধরলেন, ‘এটা নিয়ে যান।’
অর্ক কাগজটা নিয়ে দেখল তাতে চার লাইনে লেখা রয়েছে যে বেলগাছিয়ার জনগণের অসীম সাহসিক কাজের জন্যে লেখক গর্বিত। তিনি মনে করেন সমস্ত ভারতবর্ষ এই ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হবে।
অর্ক মুখ তুলল, ‘আপনি যাবেন না?’
নীরবে মাথা নাড়লেন লেখক, না।
‘কিন্তু আমরা সবাই আশা করে আছি।’
‘মোটেই না। ওখানে সবাই ভিড় করবে ফিল্ম স্টার দেখতে। নিজেদের খুব ফেকলু মনে হয় ওসব জায়গায় গেলে। এই কাগজটা মাইকে পড়ে দিও।’
‘কিন্তু আপনি যাবেন বলেছিলেন—!’
‘যাবো বলেছিলাম বলে কি জোর করে ধরে নিয়ে যাবে? তোমরা দেখছি সমাজবিরোধী তাড়াতে গিয়ে নিজেরাই তাদের ফলো করছ।’
টেবিলের অন্য প্রান্ত থেকে আর একজন বললেন, ‘এসব ঝামেলায় জড়ানোর কি দরকার। কাল দেখবেন ওই মাস্তান আপনার বাড়িতে বোম মেরে গেল। কলকাতার মাস্তানরা পুলিসের চেয়েও ইউনাইটেড।’
‘না না। ওকথা বলো না। প্রতিবাদ নিশ্চয়ই করব। তবে কিনা এক একজনের প্রতিবাদের মাধ্যম তার সুবিধে অনুযায়ী। আমি যদি একটা প্রবন্ধ লিখি অনেক বেশী লোক পড়বে, পড়ে অনুপ্রাণিত হবে। বুঝেছ?’
গাড়িতে এসে অর্ক সঙ্গীর দিকে তাকাল। এখন ওরা কি করবে? খালি গাড়ি নিয়ে ফিরে যাওয়া মানে নিজেদের অপদার্থতা প্রমাণ করা, সঙ্গীর এরকম বক্তব্য ছিল। সে চাইছিল রবীন্দ্রসদনের সামনে অপেক্ষা করে প্রথম লেখককে সঙ্গে নিয়ে ফিরতে। কিন্তু অর্ক বলল, ‘এরা কেউ যাবে না। সবাই নিজেদের বাঁচাতে চায়। মুখে বড় বড় কথা বলবে কিন্তু কাজের বেলায় এগোবে না।’
গাড়ি নিয়ে পাড়ায় ফিরে এল অর্ক। পার্কে সভার আয়োজন হয়েছে। কয়েক হাজার মানুষ বক্তৃতা শুনতে এসেছে। গাড়ি ছেড়ে দিয়ে অর্ক মঞ্চের পেছনে আসতেই সুবল উত্তেজিত হয়ে এগিয়ে এল, ‘ওঁরা এসেছেন?’
মাথা নাড়ল অর্ক, ‘না।’
ঘটনাগুলো খুলে বলল সে। চুল ছিঁড়তে লাগল সুবল। আরও দুটো দল গিয়েছিল বিখ্যাত মানুষদের নিয়ে আসতে। তারাও ব্যর্থ হয়ে ফিরেছে। বেশীর ভাগই বাড়িতে নেই, কেউ কেউ অসুস্থ। অর্ক দেখল চারজন মানুষ এসেছেন তালিকা অনুযায়ী। এঁদের কেউ আনতে যাননি। বয়স্ক এবং খুব কম পরিচিত মানুষ।
এখন এই ব্যগ্র জনতাকে কি বলবে ওরা? শান্তি কমিটি ঘোষিত মানুষদের আনতে পারেনি। কলকাতার বিখ্যাত মানুষরা শান্তি কমিটির সঙ্গে নেই? কিছু দুর্বল মানুষ তো সঙ্গে সঙ্গে ভেঙ্গে পড়বে। এত বড় একটা হাস্যকর অবস্থা বিরোধীরা কাজে লাগাবে। কি করা যায় ঠিক করতে পারছিল না কেউ। সতীশদা বলল, ‘আমরা বক্তৃতা শুরু করি তারপরে দেখা যাবে। যে চারজন এসেছেন তাঁরাও কিছু বলুন। আসলে পলিটিক্যাল বেস না থাকলে কোন আন্দোলন সফল হতে পারে না।’
সুবল বলল, ‘এ ধরনের কথা বলবেন না। তাহলে আমরা যেটুকু এগিয়েছি সেটা ভেস্তে যাবে।’
সতীশদা সামান্য উত্তেজিত হল, ‘আমি তোমাকে নিষেধ করেছিলাম সভা করতে। আমি মধ্যবিত্ত সুবিধাবাদীদের স্বরূপ জানি।’
সুবল মাথা নাড়ল, ‘ঠিক আছে। এই মানুষগুলো আমাদের সঙ্গে মিথ্যাচার করেছেন। ওঁরা যা বলেছেন তা সভায় বললে মানুষ আরো ঘাবড়ে যাবে। অতএব আমাদের মিথ্যে কথা বলতে হবে। এছাড়া কোন উপায় নেই।’
‘কি মিথ্যে?’
‘আমি বলব যাঁদের আসার কথা ছিল, এখানে আসতে যাঁরা খুব আগ্রহী ছিলেন তাঁদের প্রত্যেকের বাড়িতে কয়লার সমর্থক মাস্তানরা গিয়ে শাসিয়ে এসেছে এই সভায় এলে ফল খারাপ হবে। ফলে তাঁরা এখানে আসতে সাহস পাচ্ছেন না। কয়লা গ্রেপ্তার হয়েছে কিন্তু তার সঙ্গীরা যে এখনও আমাদের ক্ষতি করতে চাইছে এই ঘটনা থেকেই প্রমাণ হয়। অতএব এলাকার সমস্ত মানুষকে আরও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে যাতে ওরা অনুপ্রবেশ না করতে পারে। এইভাবে জনতাকে উত্তেজিত করা ছাড়া কোন উপায় নেই।’
অর্ক চুপচাপ শুনছিল। এবার বাধা দিল, ‘কিন্তু এটা তো মিথ্যে কথা।’
হয়তো মিথ্যে আবার সবটাই তো মিথ্যে নয়। ওঁরা আসেননি এই ভয়ে যদি কখনো ওঁদের বিপদ হয়। কেউ শাসায়নি সত্যি কিন্তু না শাসাতেই তো ওঁরা ভয় পেয়েছেন।’ সুবল চলে গেল সামনে।
অর্ক সতীশদাকে ‘বলল, আপনি যাননি। আমি ওঁদের কাছে গিয়েছিলাম। ওঁরা যে আসবেন বলে কথা দিয়েছিলেন তাই আমার মনে হয়নি। এঁদের মুখাশ খুলে দেওয়ার বদলে বাঁচানো হচ্ছে। এটা ঠিক কি?’
সতীশদা বলল, ‘উত্তেজিত হয়ো না অর্ক। তোমার বয়স কম। সুবল বোধ হয় ঠিক কাজ করছে। অন্তত আজকের সন্ধ্যায় এছাড়া কোন উপায় নেই।’
সভার কাজ শুরু হল। প্রথমেই সুবল এলাকার মানুষদের জানাল কি পরিস্থিতিতে এলাকার হয়ে নিমন্ত্রিতরা আসতে পারেননি। কয়লার বন্ধুরা কতখানি সক্রিয় হয়েছে তার বিস্তারিত বর্ণনা শোনাল। এমন কি টালিগঞ্জ থেকে একজন মানুষ বেলগাছিয়ায় যাতে না আসেন তার ব্যবস্থা করেছে ওরা। কাল্পনিক কাহিনী শেষ হওয়ামাত্র জনতা উত্তেজিত হল। আর কেউ প্রশ্ন করল না কেন বিখ্যাত মানুষেরা এলেন না। কিন্তু সভার আয়তন ধীরে ধীরে কমতে শুরু করল।
রাত সাড়ে আটটায় সব শেষ। সুবলকে খুব বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। অর্ক তাকে ডাকল, ‘আমরা এখন কি করব?’
‘কি করব মানে?’
‘শান্তি কমিটির কাজ কি হবে?’
‘পাড়ায় যাতে শান্তি বজায় থাকে তার দিকে নজর রাখব।’
‘কিন্তু সেটা কতদিন সম্ভব?’
সতীশদা এগিয়ে এল, ‘তুমি কি বলতে চাইছ?’
অর্ক বলল, ‘আজকেই একটা বিরাট মিথ্যে কথা বলে জনসাধারণকে শান্ত করতে হল। কিন্তু একদিন তো সত্যি কথাটা লোকে জানবেই।’
‘আমি তো বলেছি পুরো মিথ্যে বলিনি। এ নিয়ে তুমি ভেবো না।’
অর্ক আর কথা বাড়াল না। ওর মনে আজ এই মুহূর্তে অনেকগুলো প্রশ্ন এসেছিল। যখন সমাজবিরোধীদের ঠাণ্ডা করার প্রশ্ন উঠছে তখন শান্তি কমিটি একযোগে কাজ করতে পারছে। কিন্তু কদিন বাদে যখন রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের প্রয়োজনে আলাদা সভা করবে তখন? ধরা যাক একটা ইলেকশন এল। সতীশদারা তখন শান্তি কমিটির সহকর্মী কংগ্রেসীদের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে বাধ্য হবে। উল্টো দিক থেকেও তাই হবে। সে সময় শান্তি বজায় রাখবে কারা? ইলেকশনের সময় যেসব ছেলে বাইরে থেকে কাজ করতে আসে পার্টির হয়ে তারা কারা? তাছাড়া শান্তি কমিটি থাকলে এলাকার ওপর পার্টির জোর কমে যাবে। এটা কতদিন পার্টি চাইবে। আজকের সভায় নির্বাচিত এম এল এ এবং বিরোধী সদস্য এসেছিলেন। পাশাপাশি বসে কথা বলেছেন হাসিমুখে। কিন্তু কদিন সম্ভব হবে এই সম্পর্ক রাখা।
চারজন বিখ্যাত মানুষ যে দুনম্বরী আচরণ প্রকাশ্যে করতে পারলেন তা দেখে মনে মনে মুষড়ে পড়ছিল অর্ক। পার্ক থেকে বেরিয়ে সে চুপচাপ হেঁটে আসছিল অন্ধকার পথ দিয়ে। জায়গাটা নির্জন। কিছুক্ষণ হাঁটার পর তার খেয়াল হল একটা ট্যাক্সি খুব ধীরে তার পেছন পেছন আসছে। এদিক দিয়ে ঘন ঘন গাড়ি গেলেও মানুষের চলাচল কম। অর্ক বিপদের গন্ধ পেয়ে সতর্ক হবার চেষ্টা করামাত্র ট্যাক্সিটা পাশে এসে দাঁড়াল। অর্ক অবাক হয়ে দেখল বিলু মুখ বের করে জিজ্ঞাসা করল, ‘গুরু, তোমাকে কদিন থেকে খুঁজছি, কিছুতেই পাচ্ছি না।’
অর্কর নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হল; সে দেখল গাড়িতে কোয়া ছাড়াও আর একজন বসে আছে যাকে সে চেনে না। সে নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন?’
বিলু জিজ্ঞাসা করল, ‘আমার নাম নাকি লিস্টে ছিল না, তুমি ঢুকিয়েছ?’
অর্ক শক্ত হল, ‘হ্যাঁ।’
‘কেন গুরু? আমাকে এমন বাঁশ দিলে কেন?’
‘দুদিন বাদে এরা জানতেই পারতো।’
‘এখন আমরা কি করব? মাল তো ফুরিয়ে আসছে।’
‘থানায় যা। সারেণ্ডার কর।’
কোয়া এবার কথা বলল, ‘আমি তোকে বললাম এছাড়া উপায় নেই।’
‘তারপর? বেরিয়ে এলে তুমি ব্যবস্থা করবে? পাড়ায় কোন অসুবিধে হবে না?’
‘না।’
‘ঠিক হ্যায়।’ বিলু নির্দেশ দিতে ট্যাক্সিটা চলে গেল। আর অর্কর মন খারাপ হয়ে গেল। ছেলেগুলো তাকে বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু সে এদের দেখেই প্রচণ্ড ঘাবড়ে গিয়েছিল। মন কখনই কোন কিছুকে ভালভাবে নিতে পারে না কেন? তারপরেই তার মাথায় দ্বিতীয় চিন্তার উদয় হল। বিলু এবং কোয়া সমাজবিরোধী বলে চিহ্নিত। পাড়ার লোক ওদের পেলে ছেড়ে দেবে না। তা সত্ত্বেও ওরা ঝুঁকি নিয়ে এখানে এসেছে তার সঙ্গে কথা বলতে। শান্তি কমিটির কেউ সেটা দেখলে যদি ভুল বোঝে? যদি মনে করে তার সঙ্গে এদের গোপন যোগাযোগ আছে! সঙ্গে সঙ্গে একটা ডোণ্ট কেয়ার ভাব ওর মনে এল। যতক্ষণ সে নিজে অন্যায় করছে না ততক্ষণ এসব নিয়ে চিন্তা করার কোন মানে হয় না।
ঈশ্বরপুকুরে ঢুকেই ন্যাড়ার দেখা পেল সে। ন্যাড়া বিড়ি টানছিল। ওকে দেখে বলল, ‘যাঃ শালা, সব বিলা হয়ে গেল।’
‘কেন?’
‘ফিলিম স্টার এল না?’
‘তাই দেখতে গিয়েছিলি?’
‘আবার কি? শান্তি কমিটি হেভি ঢপ দিল।’
‘ওরা আসেনি শান্তি কমিটি কি করবে?’
হঠাৎ ন্যাড়া কাছে সরে এল, ‘জানো অক্কদা! কয়লাকে তো তোমরা তাড়ালে। ওদিকে ওয়াগনের কারবার কিন্তু থেমে নেই।’
‘থেমে নেই মানে?’
‘গ্যালিফ স্ট্রীটের কচুয়া তো কয়লার ভয়ে এতদিন এদিকে আসতে পারেনি এখন লাইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। এতদিন বেলগাছিয়ার ছেলেরা কাজকর্ম পেত এখন গ্যালিফ স্ট্রীটের ছেলেরা পাচ্ছে। কাজ চাইতে গেলে বলে, যাঃ ফট। শান্তি কমিটি মারাগে যা।’
‘তুই গিয়েছিলি নাকি?’
সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল ন্যাড়া, ‘না না। আমি শুনেছি।’
অর্ক ন্যাড়াকে ছেড়ে তিন নম্বরের সামনে চলে এল। তার মাথার ভেতরটা ক্রমশ অসুস্থ হয়ে আসছিল। কয়লা নেই কিন্তু আর একটা কয়লা তৈরি হয়ে যাচ্ছে। যতদিন মানুষের অভাব থাকবে তদ্দিন এসব থাকবেই। হাজারটা শান্তি কমিটি তৈরি করে দূর করা যাবে না।
গলিতে ঢুকতেই ডাক শুনতে পেয়ে মুখ ফেরাল অর্ক। সেই শীর্ণ প্রৌঢ় এগিয়ে এল তার সামনে, ‘তোমার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি বাবা।’
‘আমার জন্যে?’
‘হ্যাঁ। দ্যাখো আজ মদ খাইনি। সন্ধ্যে থেকে বসে বসে এখানে দাঁড়ালাম। শুনেছিলাম তুমি পার্কের মিটিং-এ গেছ। বাড়ি ফিরবার সময় ধরব বলে অপেক্ষা করছিলাম।’ প্রৌঢ় হাসল।
‘কিছু দরকার আপনার?’
‘কেন? তোমার তো মনে থাকার কথা। এই নাও দুশো টাকা। তোমার হাতে তুলে দিলাম। আমার মাস মাইনে। ওদের যদি পুরো মাস পেট ভরিয়ে রাখো তাহলে কথা দিচ্ছি আর মদ ছোঁব না। নাও, টাকাটা ধরো।’