হলুদ ও কমলা রঙের শাড়ি পরা, তার ওপরে একটা কালো ওভারকোট, ইন্দিরা গান্ধী বেরিয়ে এলেন নিউ ইয়র্কের জে এফ কে এয়ারপোর্ট থেকে। প্রায় শ পাঁচেক প্রবাসী ভারতীয় এসেছে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে, ভারতীয় অফিসাররাও রয়েছে, কিন্তু কয়েকজন নিরাপত্তারক্ষী ছাড়া আমেরিকান সরকারের কোনো প্রতিনিধি সেখানে নেই। আর কয়েক দিন পরই তাঁর চুয়ান্ন বছর বয়েস হবে, শরীর পরিপূর্ণ যৌবনময়, কিন্তু আজ তাঁর মুখে একটা কালো ছাপ। জনতার জয়ধ্বনি শুনেও তাঁর মুখে হাসি ফুটলো না। তিনি তলার ঠোঁটটা কামড়ে ধরে আছেন, এটাই তাঁর রাগের চিহ্ন।
প্রবাসী ভারতীয়রা নানারকম প্রশ্ন করতে লাগলো তাঁকে ঘিরে। তিনি কোনো উত্তর দিচ্ছেন না। একবার শুধু বললেন, তিনি সকলের সঙ্গে পরে এক সময় মিলিত হবেন নিশ্চয়ই, কিন্তু এখন তিনি ক্লান্ত, তিনি বিশ্রাম নিতে চান।
গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া বইছে, ওভারকোটের কলারটা তুলে দিয়ে, টকটক করে জুতোর শব্দ তুলে তিনি গিয়ে উঠলেন লিমুজিনে। ম্যানহাটনের লেক্সিংটন অভনিউতে একটি হোটেলে তিনি আগে কয়েকবার উঠেছেন, এবারও সেই হোটেলেই তাঁর জন্য সুইট বুক করা আছে।
চলন্ত গাড়ির জানলা দিয়ে তিনি বাইরে তাকিয়ে রইলেন, কিন্তু কিছুই দেখছেন না। তাঁর পাশে উপবিষ্ট একজন কূটনীতিবিদ গুনগুন করে বললেন, কী আশ্চর্য, প্রেসিডেন্ট নিক্সন যৌথ বিবৃতি দিতেও রাজি হলেন না? আমরা ভেবেছিলাম…
ইন্দিরা গান্ধী রাগতভাবে সেই ব্যক্তির দিকে তাকালেন। এ বিষয়ে তিনি এখন কোনো আলোচনা করতে চান না। এই অপমানটাই তাঁর বুকে সবচেয়ে বেশি বেজেছে। তিনি পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের নিবাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমেরিকায় এসেছেন, প্রেসিডেন্ট নিক্সন-এর সঙ্গে তার দু’দিন ধরে আলাপ-আলোচনা হয়েছে, তবু নিক্সন একটা যৌথ বিবৃতি দেবার প্রয়োজনও মনে করলেন না? যেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এই আগমনের কোনো গুরুত্বই নেই!
গোটা দেশকে দারুণ সংকটের মধ্যে রেখে ইন্দিরা বেরিয়ে পড়েছেন পশ্চিমী দেশগুলির কাছ থেকে নৈতিক সমর্থন আদায় করতে। প্রথমে গেলেন বেলজিয়াম, তারপর অস্ট্রিয়া, তারপর ব্রিটেনে। সবাই খুব আদর-আপ্যায়ন করছে, ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রশস্তি জানাতে কোনো কার্পণ্য নেই, শরণার্থী প্রসঙ্গ উঠলেই মৌখিক সহানুভূতি জানাচ্ছে প্রচুর, আর্থিক সাহায্যেরও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, কিন্তু আসল সমস্যাটি এড়িয়ে যাচ্ছে অতি ভদ্রতার সঙ্গে। কী যেন তারা গোপন করে যেতে চায়। সকলেরই ভাবখানা এই যে, আমেরিকান বড় ভাইয়ের সঙ্গে তুমি তো দেখা করতে যাচ্ছোই, সেখানেই তুমি সব শুনবে!
ওয়াশিংটন ডি সি-তে এসেও ইন্দিরা প্রথমে ঠিক আঁচ করতে পারেননি পাকিস্তানের প্রতি নিক্সনের কেন এত পক্ষপাতিত্ব। আমেরিকাও তো গণতন্ত্রের গর্ব করে, তবু পাকিস্তানের একজন সামরিক শাসক, যে গায়ের জোরে ক্ষমতা দখল করে রেখেছে, সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল অগ্রাহ্য করেছে, তাকেই অন্ধভাবে সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছেন নিক্সন!
প্রেসিডেন্ট নিক্সন আবহাওয়া, খাদ্য, শরীর-স্বাস্থ্যের খবর ও ঠাট্টা ইয়ার্কিতে সময় কাটাতে চান। ইন্দিরা গান্ধী এক সময় সরাসরি প্রশ্ন করলেন, পাকিস্তান সরকার সে দেশের পূর্বাঞ্চলে যে অত্যাচার চালাচ্ছে, সে বিষয়ে আপনি কি কিছু ভেবেছেন?
নিক্সন আলগা ভাবে বললেন, অবশ্যই ভেবেছি! পাকিস্তান আর ভারতের মধ্যে যদি কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয়, তা হলে তাতে আমাদের মাথা গলানো ঠিক নয়। আমাদের কাছে দুটি দেশই সমান। তোমাদের মধ্যে একটা দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে রাজনৈতিক সমাধান করে ফেলা উচিত। এই দুটি দেশে আবার যুদ্ধ লাগুক, তা আমরা চাই না, আশা করি তোমরাও চাও না!
ইন্দিরা বললেন, সমস্যাটা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নয়। পাকিস্তানের অভ্যন্তরেই। সেখানে নৃশংস গণহত্যা চলেছে। তোমার দেশের সাংবাদিকরাই সে সব বিস্তৃত খবর প্রকাশ করেছে। আনটনি ম্যাসকারেনহাসের ‘দা রেপ অফ বাংলাদেশ’ নামে বই বেরিয়েছে, তাতে জেনারেল ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীকে হিটলারের নাৎসী বাহিনীর সঙ্গে তুলনা দেওয়া হয়েছে।
নিক্সন সূক্ষ্ম বিদ্রূপের হাসি দিয়ে বললেন, এটা যদি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হয়, তাহলে তাতে আমাদেরও মাথা গলানো উচিত নয়। তোমাদেরও মাথা গলানো উচিত নয়, তাই নয় কি?
ইন্দিরা বললেন, ইয়োর এক্সেলেন্সি, দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ লাগলে সারা পৃথিবী উদ্বিগ্ন হয়। আর কোনো একটি দেশের মধ্যেই যদি সেনাবাহিনী লক্ষ লক্ষ সাধারণ নাগরিককে খুন করে, বিশেষ কোনো ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক মতবাদসম্পন্ন মানুষদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়, তা নিয়ে সারা পৃথিবীর মাথাব্যথা থাকবে না। এটা শুধু রাজনীতির প্রশ্ন নয়। মানবতার প্রশ্ন। এটা এখুনি বন্ধ করা দরকার। সে জন্য আপনাদের উদ্যোগ নেওয়া উচিত, যাতে পূর্ব পাকিস্তানের নিবাচিত নেতাদের সঙ্গে পাকিস্তানী সামরিক শাসকরা অবিলম্বে আলোচনায় বসে। শেখ মুজিবকে মুক্তি দেবার জন্য আপনারাই চাপ দিতে পারেন।
নিক্সন বললেন, আমি এখনও বুঝতে পারছি না। সে জন্য ভারত এত বেশি চঞ্চল হচ্ছে কেন? এই বিষয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জে তো আলোচনা হচ্ছেই।
ইন্দিরা বললেন, ভারতের বিচলিত হবার প্রধান কারণ এর মধ্যেই সীমান্ত পেরিয়ে প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে চলে এসেছে। আমরা এই বিপুল জনসংখ্যার ভার সহ্য করবো কী
নিক্সন বললেন, সে তো বটেই। সে তো বটেই। সেনেটর কেনেডি গিয়ে শরণার্থী শিবিরগুলি দেখে এসেছেন। আমরা তো খাদ্য দিচ্ছি, অর্থ সাহায্য দিচ্ছি, কম্বল পাঠাচ্ছি!
ইন্দিরা বললেন বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছ থেকে সাহায্য আমরা পাচ্ছি বটে, কিন্তু পাকিস্তান তার জনসংখ্যা কমাবার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষকে ঠেলে ভারতে পাঠিয়ে দেবে, আর আমরা তাদের খাইয়ে পরিয়ে যাবো, এরকম কতকাল চলবে?
নিক্সন বললেন, প্রয়োজনে আমরা সাহায্যের পরিমাণ বাড়িয়ে দেবো!
আরক্ত মুখে ইন্দিরা বললেন, মাননীয় প্রেসিডেন্ট, ভারত গরিব দেশ ঠিকই, দেশের সমস্ত মানুষকেই আমরা খাওয়াতে পারি না, এর ওপর এক কোটি শরণার্থী এলে আমরা বিশ্বের সাহায্য নিতে বাধ্য। কিন্তু আমি আপনার কাছে ভিক্ষের পাত্র নিয়ে আসিনি। ভিক্ষের পরিমাণ। বাড়িয়ে দিতেও অনুরোধ করছি না। আমরা চাইছি, এই সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান। একদিকে আপনারা শরণার্থীদের জন্য সাহায্য পাঠাবেন, অন্যদিকে পাকিস্তানী অত্যাচারী সেনাবাহিনীর হাতে আরও অস্ত্র তুলে দেবেন, এ কেমন নীতি?
নিক্সন সহাস্যে বললেন, আপনার শাড়িটা অপূর্ব সুন্দর! ইন্ডিয়াতে কি এখনো মসলিন হয়? কাশ্মীরের সঙ্গে নাকি সুইটসারল্যান্ডের খুব মিল আছে?
পরদিন সেক্রেটারি অফ স্টেট রজার্সের সঙ্গে কিছুক্ষণ বৈঠক হলো ইন্দিরার, তাতে অনেক কিছু পরিষ্কার হলো। রজার্স চাঁছাছোলা মানুষ। তিনি দু’চার কথার পরই বললেন, সম্মানীয়া প্রধানমন্ত্রী কি জানেন যে আজ, আপনার সঙ্গে যখন আমি কথা বলছি, ঠিক এই সময়েই পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিশেষ দূত হিসেবে মিঃ ভুট্টো চীনে মিঃ চু-এন লাইয়ের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন!
ইন্দিরা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন, দিল্লিতে র আগে থেকে এর সামান্য ইঙ্গিতও পায়নি? ওয়াশিংটনের দূতাবাসও তাকে কোনো খবর দেয়নি!
রজার্স বললেন, কয়েক ঘণ্টা আগে পিকিং এয়ারপোর্টে প্রায় দু’হাজার চীনা তরুণ-তরুণী। গান গেয়ে মিঃ ভুট্টোকে সংবর্ধনা জানিয়েছেন।
ইন্দিরার মুখে আবার অপমানের ছাপ পড়লো। তিনি আমেরিকায় পদার্পণ করার সময়ে তো কিছু ভারতীয় ছাড়া আমেরিকান জনসাধারণ তো তাঁকে কোনো সংবর্ধনাই জানায়নি! ভারতের প্রতি সাধারণ আমেরিকানদেরও কোনো সহানুভূতি নেই? দূতাবাস ও কনস্যুলেটগুলি অপদার্থ, তারা ভারতের বক্তব্য ঠিক মতন তুলে ধরতে পারে নি এখানকার জনগণের কাছে, অ্যামেরিকার গায়ক-শিল্পী-কবিরা বাংলাদেশ শরণার্থীদের জন্য চাঁদা তুলছে, প্রচার চালাচ্ছে, তা হলে তো এখানে সহানুভূতিসম্পন্ন মানুষ কিছু আছে।
রজার্সের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, চীন-পাকিস্তান-আমেরিকা মিলে একটা ত্রিপাক্ষিক শক্তি হতে চলেছে। কয়েকটা অদ্ভুত যোগাযোগও ঘটে গেছে এর মধ্যে। মাঝখানে প্রচারিত হয়েছিল যে মাও সে তুং-এর যোগ্য উত্তরাধিকারী লিন পি আও। এই লিন পি আও অত্যন্ত উগ্র আমেরিকা-বিরোধী, ভারতের উগ্রপন্থী নকশাল বিপ্লবীদেরও তিনি দ্রোণাচার্য। সেই লিন পি আও রহস্যজনক ভাবে হঠাৎ অন্তর্ধান করেছেন। কেউ বলছে তিনি গুরুতর অসুস্থ, কেউ বলছে মৃত, আবার কেউ বলছে হঠাৎ চীনের ক্ষমতা দখল করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে তিনি চীন ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। মোট কথা, লিন পি আও সরে যাবার ফলে চীনে আমেরিকার প্রবেশের পথ তৈরি হয়ে গেছে, পাকিস্তানের মাধ্যমে কিসিংগারের দৌত্যে নিক্সনের চীন-সফর আসন্ন। এই রকম একটা পরিস্থিতিতে কোনো কারণেই বর্তমান পাকিস্তান সরকারকে পদচ্যুত করতে চায় না আমেরিকা। হিটলারের ইহুদি নিধনে আজও সমগ্র পশ্চিম দুনিয়া অশ্রু বিসর্জন করে, অসংখ্য বই লেখা হয়, ফিল্ম তোলা হয়, তার কারণ ইহুদিরা ধনী এবং শ্বেতাঙ্গ। এশিয়ার কয়েক লক্ষ গরিব মুসলমান-হিন্দু নিহত হলে মার্কিন সরকার তা নিয়ে মাতামাতি করতে যাবে কেন? গরিবরা তো এমনিতেই মরে!
নিক্সন নিজের মুখে যা বলতে চাননি, তা রজার্সকে দিয়ে বলালেন। পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার যে অস্ত্র সরবরাহের চুক্তি আছে, তা আমেরিকা রক্ষা করে যাবে, সে অস্ত্র পাকিস্তানীরা যেমন ভাবেই ব্যবহার করুক না কেন! সোভিয়েত ইউনিয়ানের সঙ্গে ভারতের মৈত্রী চুক্তি ছদ্মনামে সামরিক চুক্তি হয়েছে, সেই ভারত এখন আবার নির্লজ্জ ভাবে পশ্চিমী দেশগুলির কাছে সমর্থন চাইতে আসে কেন? ভারত কি গাছেরও খাবে, তলারও কুড়োবে? মোটকথা, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের এখন যুদ্ধ বাঁধানো মোটেই সুবিবেচনার কাজ হবে না, পাকিস্তানের পক্ষে অনেক বন্ধু আছে। যুদ্ধ বাধিয়ে ভারত ভূখণ্ডে যদি সোভিয়েত ইউনিয়ানকে টেনে আনা হয়, তাহলে সেখানে আর একটি ভিয়েৎনাম হবে।
রজার্সের সঙ্গে বৈঠকের পর নিক্সনের সঙ্গে আবার নৈশভোজে মিলিত হলেন ইন্দিরা। আনুষ্ঠানিক সব কিছুই হলো, কিন্তু যুক্ত বিবৃতি বেরুলো না–অর্থাৎ ইন্দিরার আমেরিকায় আগমনের ফলাফল শূন্য।
ইন্দিরা ঠিক করলেন, আমেরিকার সাধারণ মানুষের কাছে যতদূর সম্ভব সত্যিকারের বাস্তব চিত্রটি বুঝিয়ে দিয়ে যাবেন। এটা ভারত-পাকিস্তানের কূটনৈতিক লড়াই নয়, সাময়িক প্রাধান্যের বিষয়ও নয়, এটা কয়েক কোটি মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন। পাকিস্তানে যা চলছে, তা জেনোসাইড, পৃথিবীর সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরই এটা বন্ধ করার জন্য প্রতিবাদ জানানো উচিত।
আমেরিকার প্রেস ও টি ভি অত্যন্ত শক্তিশালী মিডিয়া। আমেরিকার যুবসমাজ ভিয়েনাম যুদ্ধকে নৈতিক সমর্থন দেয়নি। এখানকার সাধারণ মানুষ স্বাধীনতার সমর্থক, বিপন্নদের সাহায্য করার ব্যাপারে তাদের কার্পণ্য নেই। সুতরাং জনমানসের প্রতিফলন হিসেবে মিডিয়া যদি প্রবল ভাবে চাপ দেয়, তা হলে আমেরিকান সরকার বর্তমান নীতি বদল করতে বাধ্য হতে পারে।
সেই জন্যই ইন্দিরা বক্তৃতা করেছেন প্রেস ক্লাবে, গীর্জায়। সেই উদ্দেশ্যেই তিনি এসেছেন নিউ ইয়র্কে। এখানে তিনি কলমবিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেবেন, ন্যাশনাল নেটওয়ার্কে টি ভি সাক্ষাৎকারও নির্দিষ্ট হয়ে আছে।
হোটেলে পৌঁছে ইন্দিরা নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেন।
কিছু ভারতীয় এখানেও তাঁর জন্য অপেক্ষা করে আছে। খানিক পরে স্নান সেরে তিনি তাদের সামনে এসে বসলেন। তাদের নানা প্রশ্নের উত্তরে ইন্দিরা যুদ্ধের প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলেন। একবারও পূর্ব পাকিস্তানের বদলে বাংলাদেশ নামটি উচ্চারণ করলেন না। বারবার জোর দিয়ে বললেন, মনে রাখবেন আমরা গরিব হলেও কিছুতেই আত্মসম্মান বিসর্জন দেবো না। স্বাধীনতার চব্বিশ বছরে ভারত গণতন্ত্র টিকিয়ে রেখেছে, এ পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো বৃহৎ শক্তির কাছে মাথা নিচু করেনি।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তৃতায় ইন্দিরার সুর অনেক চড়া হলো। তিনি বললেন, ভারত ও পাকিস্তানের দায়িত্ব সমানভাবে দেখার চেষ্টা করছে আমেরিকান সরকার, এটা কী ধরনের যুক্তি? পাকিস্তান তার নিজের লোকদের মারছে, সেখানকার জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ বাধ্য হয়ে এসে আশ্রয় নিচ্ছে ভারতবর্ষে, মানবিকতার খাতিরে ভারত তাদের খাওয়াচ্ছে-পরাচ্ছে, এর কোনোটাই তো অসত্য নয়! তবু এই সংকট সৃষ্টিতে ভারত ও পাকিস্তানের সমান দায়িত্ব!
টি ভি সাক্ষাৎকারে ইন্দিরা বললেন, ভারতের ধৈর্যের একটা সীমা আছে! চীন এবং আমেরিকা পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য করলেও কিছু আসে যায় না, ভারত এই সমস্যার সমাধান। করবেই! সবাই রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত নেতাদের সঙ্গেই আলোচনা করে সে সমাধান আনতে হবে! পশ্চিম পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীরা পর্যন্ত শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে বিবৃতি দিয়েছেন, অথচ আমেরিকান সরকার ওঁর মুক্তির জন্য কোনো চেষ্টাই করবে না?
আমেরিকা থেকে ইন্দিরা এলেন ফ্রান্সে। প্যারিসের ওর্লি বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানালেন প্রধানমন্ত্রী জর্জ পঁপিদু।
অল্প বয়েসে সুইজারল্যান্ডে থাকার সময় ইন্দিরা ফরাসী ভাষা ভালোই রপ্ত করেছিলেন। দোভাষীর দরকার হলো না, পঁপিদুর সঙ্গে সরাসরি কথা শুরু করলেন। জর্জ পঁপিদু সংস্কৃতিবান পুরুষ, রূপসী নারীদের প্রতি ফরাসীদের আদিখ্যেতা সুবিখ্যাত, তিনি মহা আড়ম্বরের সঙ্গে ইন্দিরার সংবর্ধনার ব্যবস্থা করলেন। তার উত্তরে ইন্দিরা বললেন, প্রত্যেকবার ফরাসী দেশে এলেই তাঁর শিহরন হয়। কারণ, ফ্রান্স তো শুধু একটি দেশ নয়। ফ্রান্স তার চেয়েও বড়। ফ্রান্স একটি আদর্শ। সারা পৃথিবীতে সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার স্বপ্ন প্রথম দেখিয়েছে এই দেশ।
ইন্দিরার বাবার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল জর্জ পঁপিদুর। ইন্দিরার প্রতি তাঁর ব্যবহার কিছুটা স্নেহমিশ্রিত। ইন্দিরা তাঁকে আন্তরিক ভাবে বললেন, আমি এখন কী করবো, তা বলতে পারেন? আমি যেন একটা আগ্নেয়গিরির ওপর বসে আছি। আমার দেশের অনেক লোক যুদ্ধ যুদ্ধ বলে লাফাচ্ছে। কিন্তু একটা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেও যে দেশটার সর্বনাশ হয়ে যাবে, তা কি আমি বুঝি না? এ দিকে প্রায় এক কোটি শরণার্থীর বোঝা কাঁধে নিয়ে বসে আছি। সত্যি কথা বলতে কি, এত লোকের ঠিকঠাক বাসস্থান এখনো আমরা দিতে পারি নি, খাদ্য। বণ্টনের ব্যবস্থাপনাতেও অনেক ত্রুটি আছে। অনেকে ছড়িয়ে পড়ছে শিবিরের বাইরে, তারা অনেকেই স্থানীয় ভাবে কম মজুরিতে কাজ করছে। এমনিতেই আমাদের দেশে বেকারের সংখ্যা বিরাট, তার ওপরে যদি এই সব শরণার্থীরা প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে, তা হলে যে-কোনোদিন বিক্ষোভ শুরু হয়ে যাবে। এই শরণার্থীরা কবে দেশে ফিরবে তার যদি নিশ্চয়তা না থাকে, তা হলে স্থানীয় লোক কতদিন এদের সহ্য করবে? তার ওপরে আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক সমস্যা আছে। তুচ্ছ উপলক্ষে দাঙ্গা বাধতে পারে। দাঙ্গা বাধাবার জন্য পাকিস্তানও চেষ্টা চালাবেই। শুধু পশ্চিম বাংলাতেই এ পর্যন্ত এক হাজার পাকিস্তানী চর ধরা পড়েছে। হঠাৎ যদি সারা দেশে বড় আকারের দাঙ্গা বেধে যায়, তা হলে কত অসহায় মানুষ যে মরবে তার ইয়ত্তা নেই। এই অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা কিছুতেই জিইয়ে রাখা যায় না।
পশ্চিমী শক্তিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাকে বড় কোনো আশ্বাস দিতে পারলেন না। তবে পঁপিদু এইটুকু ভরসা দিলেন যে যুদ্ধ বাধলে ফ্রান্স কোনো অস্ত্র সরবরাহ করবে না পাকিস্তানকে। এবং শরণার্থীদের জন্য সাহায্য দানের পরিমাণ বাড়াবে।
প্যারিসে বসে ইন্দিরা একটি ভালো খবর পেলেন।
জনাব ভুট্টো পিকিং-এ গিয়ে চীনের নেতাদের সঙ্গে যতই দহরম মহরম করুন, চু-এন লাইকে খুশি করার যতই ব্যবস্থা নিন না কেন, তবু তিনি কোনো যৌথ বিবৃতি আদায় করতে পারেন নি। গোপন সংবাদ ছিল এই যে ভারত যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ানের সঙ্গে কুড়ি বছরের মৈত্রী চুক্তি করেছে, সেরকম পাকিস্তানও চীনের সঙ্গে একটা মৈত্রী চুক্তি আদায় করতে চায়, যাতে পাকিস্তানের বিপদে চীন সামরিক শক্তি নিয়ে পাশে দাঁড়াতে নৈতিক ভাবে বাধ্য থাকে। কিন্তু চীনের নেতারা প্রকাশ্যে অন্তত সেরকম কোনো চুক্তি ঘোষণা করেন নি। ভুট্টোর দৌত্যকেও খুব সার্থক বলা যায় না।
চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার খুব ইচ্ছে ইন্দিরার। দেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত জুড়ে বিশাল সৈন্যবাহিনী মোতায়েন খরচ তা হলে কমানো যায়। দেশের উগ্রপন্থী বিপ্লবীদেরও তাতে ঠাণ্ডা করা যাবে। চু-এন লাইয়ের সঙ্গে তিনি একবার আলোচনায় বসতে চান। পঁপিদুকে তিনি। অনুরোধ করলেন, এই ব্যাপারে যদি কোনোরকম মধ্যস্থতা করে সাহায্য করতে পারেন।
প্যারিস ছাড়ার আগে ইন্দিরা গেলেন পিতৃবন্ধু, প্রখ্যাত লেখক আন্দ্রে মালরোর সঙ্গে দেখা করতে। এককালে তিনি ফরাসী সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন। যথেষ্ট বয়েস হয়েছে মালরোর, তবু সব ব্যাপারেই উৎসাহ প্রবল। তিনি বললেন, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ স্বাধীনতা চাইছে, কেন ওদের স্বাধীনতা দেওয়া হবে না? আমি সব সময় স্বাধীনতার সমর্থক। বাংলাদেশ নিয়ে যুদ্ধ বাধলে আমি নিজে বন্দুক নিয়ে ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবো।
আলাপচারির সময় ইন্দিরাকে একটু বোর্দোর বিখ্যাত লাল মদ্য পান করাবার জন্য পীড়াপীড়ি করতে করতে এক সময় মালরো মুচকি হেসে বললেন, এ বছর নোবল পুরস্কার পেল পাবলো নেরুদা। হুঃ! তুমি ওর কবিতা-টবিতা কিছু পড়েছো নাকি? সময় পেলে পড়ে দেখো!
এরপর পশ্চিম জার্মানিতে গিয়ে উইলি ব্রানটের কাছে প্রায় একইরকম কথা শুনতে হলো ইন্দিরাকে। নাৎসী অত্যাচারের স্মৃতি যে-দেশে এখনো, দগদগ করছে, তারাও এখন পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ মানুষের নিধন নিয়ে বেশি মাথা ঘামাতে রাজি নয়। মানবতার চেয়েও রাজনীতি অনেক বড়।
ব্যথা এবং অপমানবোধের সঙ্গে সঙ্গে একটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞাও জেগে ওঠে। সেইরকম মনোভাব নিয়ে ইন্দিরা কুড়ি দিন পর ফিরে এলেন দিল্লিতে। এয়ারপোর্টে তাঁর ক্যাবিনেটের সদস্যরা প্রশ্ন তুললো, এরপর কী? যুদ্ধ ছাড়া আর কি কোনো সমাধান আছে?
ইন্দিরা বললেন, আমার এতগুলি দেশ ঘোরার একটাই সুফল আপনাদের জানাতে পারি। আমি সবাইকেই বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি যে পাকিস্তান সমস্যার কোনো জোড়াতালি সমাধান করা যাবে না। যদি সংকট মেটাতে হয়, পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের মতামত নিয়েই তা মেটাতে হবে। শরণার্থীদের আমরা তাদের দেশে ফেরত পাঠাবোই! আপনাদের এখন যুদ্ধের কথা চিন্তা করবার দরকার নেই। তার আগে দেশের মানুষদের বোঝানো দরকার, এই দুঃসময়ে কিছুতেই যেন জাতীয় সংহতিতে ফাটল না ধরে। কোনো রকম উস্কানিতেই যেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না বাধে। আপনারা যে যার এলাকায় গিয়ে এই কথা প্রচার করুন।
একজন প্রশ্ন করলো, আপনি এখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবেন না?
ইন্দিরা চুপ করে রইলেন। সাতচল্লিশ সালে ভারত দু’খণ্ড হয়েছে। এবার তিন খণ্ড হবে, সে দায়িত্ব তিনি কি সহজে নিতে পারেন? এরপর যদি আরও খণ্ড খণ্ড হতে থাকে? তাহলে ইতিহাস কি তাঁকে ক্ষমা করবে?
চুয়ান্নতম জন্মদিনটি তিনি নিরিবিলিতে বাড়িতে কাটালেন।
মাথার ওপর সব সময় যেন একটা বিরাট বোঝা। সীমান্তে সংঘর্ষ দিন দিন যেমন বাড়ছে, তাতে যে-কোনো সময় হঠাৎ যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। যুদ্ধ যদি লাগে, তা কতদিন চলবে? ভিয়েৎনামের দৃষ্টান্ত মনে পড়লেই আতঙ্ক হয়। এ বছর বন্যা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ দুর্বল হয়ে আছে, এর পর একটা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ চালাতে গেলে দেউলিয়া হয়ে যেতে হবে, দেশে চরম উচ্ছঙ্খলা আসবে, গণতন্ত্র উচ্ছন্নে যাবে। পশ্চিমী শক্তিগুলি সেটাই চায়।
দেশে ফিরে ইন্দিরা একটা ব্যাপার অনুভব করলেন। বিরোধী দলগুলি তাকে আর আক্রমণ। করছে না। যারা কংগ্রেসকে সমর্থন করে না, ব্যক্তিগত ভাবেও নেহরু-কন্যাকে অপছন্দ করে, তারাও নিজের দেশের প্রধানমন্ত্রীকে অন্য দেশে অপমানিত বা প্রত্যাখ্যাত হতে দেখলে খুশি হয় না। এত সংকটের মধ্যেও ইন্দিরার সংযমকে প্রশংসা করতে হয়। সাম্প্রদায়িক দল কিংবা বামপন্থী দলগুলিও বাংলাদেশের প্রশ্নে সরকারবিরোধী নয়। বাষট্টি কিংবা পয়ষট্টির যুদ্ধের সময়ও সারা দেশে এরকম সর্বদলীয় ঐক্য দেখা যায় নি। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের নির্যাতনে সকলেই আবেগমথিত।
একদিন কলকাতায় একটা জনসভা করতে এলেন ইন্দিরা।
পশ্চিম বাংলায় বিধানসভা ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা হয়েছে, কেন্দ্রের প্রতিনিধি হিসেবে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে পাঠানো হয়েছে সরকারি কাজকর্ম পরিচালনার জন্য। বামপন্থী দলগুলি এজন্য দারুণ ক্ষুব্ধ, তারা অবিলম্বে নির্বাচন দাবি করেছে। অতিবাম বিপ্লবী নকশালপন্থীরা এখনো পুরোপুরি দমিত হয়নি, চারু মজুমদার পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কলকাতায় গণ্ডগোল লেগেই থাকে।
কিন্তু এবার ইন্দিরাকে কেউ কোনো কালো পতাকা দেখালো না, বামপন্থীরা কোনো প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করেনি। ময়দানের বিশাল জনসভায় ইন্দিরার ভাষণের সময় সসম্ভ্রম নিস্তব্ধতা বিরাজ করতে লাগলো। সিদ্ধার্থ রায়ের কাছে আগেই ইন্দিরা খবর পেয়েছেন যে অনেক অকংগ্রেসীও তাঁর আজকের মিটিং শুনতে এসেছেন।
এই সভাতেও ইন্দিরা বাংলাদেশ সমস্যার কোনো স্পষ্ট সমাধানের ইঙ্গিত দিতে পারলেন না। যুদ্ধের কোনো উল্লেখ নেই। দেশের মানুষকে তিনি আরও আত্মত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত হতে আহ্বান জানালেন।
মিটিং সেরে ইন্দিরা এলেন রাজভবনে। এখানে শিল্পী, সাহিত্যিক, চিত্রতারকাদের সঙ্গে তাঁর ঘরোয়া আলোচনার কথা। ময়দানে বক্তৃতা করে এসে ইন্দিরা কিছুটা ক্লান্ত। ওডিকলন দেওয়া পেপার ন্যাপকিন দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে তিনি সামনের কয়েক জনের দিকে তাকিয়ে বললেন, এ রাজ্যের সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি কেমন, আপনারাই বলুন, আমি শুনি। আচ্ছা, এখানে মিটিং শুরু হবার আগে যে কোরাস গান হয়, তা বছরের পর বছর একই রকম কেন? এখানে কি নতুন গান কিছু হয় নি? গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের পর আর কেউ গান লেখেন না?
এখন সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনায় কারুর মন নেই। কথায় কথায় যুদ্ধের প্রসঙ্গ এসেই গেল। মাথার ওপরে যুদ্ধের ছায়া। কলকাতায় গত এক মাস ধরে নিয়মিত অপ্রদীপের মহড়া চলছে। সীমান্তসংঘর্ষ সীমান্ত ছাড়িয়ে প্রায়ই ঢুকে পড়ছে ভেতরে। এই তো কয়েকদিন আছে বয়ড়ার কাছে পাকিস্তানী স্যাবার জেটের সঙ্গে ভারতীয় ন্যাটের মুখোমুখি লড়াই হয়েছে, দুটি পাক বিমান শেষপর্যন্ত ভেঙে পড়েছে ভারতের ভূমিতে। এটা খবরের কাগজের গুজব বা আকাশবাণীর অতিশয়োক্তি নয়, কারণ বন্দী পাইলট দু’জনের ছবিও ছাপা হয়েছে। ওদিকে হিলি সীমান্তে পাক ফৌজ অনেকখানি ঢুকে এসে সাধারণ নাগরিকদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করে গেছে। মুক্তিযোদ্ধারা প্রায়ই দাবি করে যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে তারা অনেক জায়গা দখল করে নিয়েছে, তাই-ই বা কতখানি সত্য। সর্বাত্মক যুদ্ধ কি আসন্ন?
ইন্দিরা বললেন, যুদ্ধ কবে হবে কিংবা আদৌ হবে কি না, সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো, যুদ্ধের চাপ আমরা সহ্য করতে পারবো কি না। সৈন্যরা হাতিয়ার নিয়ে লড়াই করে বটে, কিন্তু সিভিলিয়ানদেরও অনেক দায়িত্ব নিতে হয়। আমাদের দেশে কত রকম জটিল সমস্যা, সীমান্তে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী, এর মধ্যে আমাদের মাথা ঠাণ্ডা রাখাই আসল দরকার।
তারপর তিনি স্মৃতিচারণের ভঙ্গিতে বললেন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় আমি কিছুদিনের জন্য লণ্ডনে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম। তখন লণ্ডনে নিয়মিত বোমা পড়ছে। তবু ব্রিটিশ সরকার সমস্ত কনসার্ট হলগুলো খোলা রাখতেন, লোকের টিকিট লাগতো না। বোমা পড়ার একটু বিরতি হলেই লোকে বাজনা শুনতে ছুটে যেত। উদ্বেগ, দুশ্চিন্তার সময় গানবাজনা শোনার খুবই উপকারিতা আছে। আপনারা যাঁরা লেখক-শিল্পী, আপনাদের দেখতে হবে, যাতে দেশের মানুষ যুদ্ধের উন্মাদনায় না মেতে ওঠে।
এই রকম কথা চলছে, হঠাৎ হলঘরের দরজায় সামনে পুরোদস্তুর সামরিক পোশাক পরা একজন শিখ এসে দাঁড়ালো। দু’একজন অবাক হয়ে ফিসফিস করে বললো, ইনি তো লেফটেনান্ট জেনারেল অরোরা। আর্মির ইস্টার্ন কমাণ্ডের প্রধান।
লেফটেনান্ট জেনারেল অরোরা একটা স্যালুট দিয়ে এগিয়ে এলেন ভেতরে। তারপর ইন্দিরার হাতে একটা চিরকুট দিলেন।
ছোট্ট একটি কাগজ, সেটি পড়তে এক মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়। তবু ইন্দিরা সেটার দিকে চেয়ে রইলেন তিন-চার মিনিট। তারপর কাগজটা ভাঁজ করতে লাগলেন। আট ভাঁজ–ষোলো ভাঁজ করার পর সেটাকে ছিঁড়ে ফেললেন কুটি কুটি করে।
তাঁর মুখের একটা রেখাও কাঁপলো না। উত্তমকুমারের সঙ্গে তিনি একটা কথা বলতে বলতে থেমে গিয়েছিলেন, সেই কথাটা শেষ করলেন। এর মধ্যে চা-জলখাবার এসে গেল।
ইন্দিরা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনারা আমাকে মাপ করবেন, আমি বেশিক্ষণ আপনাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ আজ পাচ্ছি না। একটা জরুরি কাজে আমাকে এক্ষুনি দিল্লি ফিরতে হবে। আবার পরে কোনোও একদিন আপনাদের সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করা যাবে। আপনারা চা খান। আমি আসি।
অরোরার সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন ইন্দিরা। ততক্ষণে সিদ্ধার্থ রায় এসেগেছেন সেখানে। তিনজনে দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগলেন। সিঁড়ির কাছাকাছি গিয়ে ইন্দিরা দৌড় মারলেন বাচ্চা মেয়ের মতন। বাইরে এসেই প্রায় লাফিয়ে উঠে পড়লেন একটা জিপে। সোজা দমদম। সেখান থেকে এয়ার ফোর্সের প্লেনে দিল্লি।
এক ঘণ্টার মধ্যেই সারা কলকাতায় খবর ছড়িয়ে পড়লো যে পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তান ভারতের পাঁচটি শহরে বোমারু বিমান নিয়ে আক্রমণ করেছে। পুরোপুরি যুদ্ধ লেগে গেছে। সেই জন্যেই প্রধানমন্ত্রী তাড়াহুড়ো করে ফিরে গেলেন দিল্লিতে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম পাটনায় রয়েছেন, তাঁকেও এক্ষুনি দিল্লিতে ডেকে পাঠানো হয়েছে।
কেউ কেউ অবশ্য বললো, ভারতই আগে অতর্কিতে পশ্চিম সীমান্ত আক্রমণ করে এখন পাকিস্তানের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে। যুদ্ধ লাগাবার এটাই নিয়ম। কোনো দেশই নিজেকে আক্রমণকারী বলে স্বীকার করতে চায় না। সারা বিশ্বকে জানায় যে আক্রান্ত হয়ে প্রতিরক্ষা করছে।
এর কিছু পরেই রাষ্ট্রপতি সারা দেশে জরুরি অবস্থা জারি করলেন।
ঠিক মধ্য রাতে ইন্দিরা গান্ধী জাতির উদ্দেশে বেতার ভাষণ দিলেন। ভারত-পাকিস্তান আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
যুদ্ধ, তা হলে সত্যিই লাগলো।
যুদ্ধে জয় বা পরাজয় যাই হোক, দু’পক্ষেরই ক্ষয়ক্ষতি হয় সাঙ্ঘাতিক। অনর্থক মানুষের কষ্টার্জিত সম্পদের অপচয় হয়, সহস্র সহস্র প্রাণের অপচয় হয়, তবু মানুষ যুদ্ধ করে। যুদ্ধের অস্ত্র গুলি যতক্ষণ দূরে গর্জায়, ততক্ষণ সাধারণ মানুষ যুদ্ধটাকে একটা উৎসব মনে করে যেন। বহুলোক ব্ল্যাক আউটের মধ্যেও রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বোমারু বিমানের জন্য উৎসুক হয়ে রইলো। রেডিও চালু রইলো সারা রাত।