2 of 2

৫৭. সেই সময় একটা কথা

সেই সময় একটা কথা খুব শোনা যাচ্ছিল, ইনডিপেন্ডেন্স ইজ নকিং অ্যাট দা ডোর। স্বাধীনতা এসে কড়া নাড়ানাড়ি করছে, দরজাটা খুললেই হল। কিন্তু দরজা খুলে সেই স্বাধীনতাকে কে বরণ করে নেবে, সেই অধিকারের জন্য ঘরের মধ্যে তখন শুম্ভ নিশুম্ভের যুদ্ধ শুরু হয়েছে।

কংগ্রেসের দীর্ঘকালের সংগ্রামের শেষ পরিণতি হঠাৎ বিভ্রান্তিকর হয়ে দেখা দিল। এত উচ্চ আদর্শ, এত মহৎ স্বার্থত্যাগ সব কিছুকেই প্রায় বানচাল করে দিল এক কঠিন বাস্তবতা। মহাত্মা গান্ধী অনেক তোষামোদ, অনেক আপোস করেও জিন্না সাহেবকে বাগ মানাতে পারলেন না।

কংগ্রেস আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাসে যে ক’টি ভুলভ্রান্তি হয়েছে, শেষ পর্যায়ে তার সারমর্ম একটি মাত্র বাক্যে প্রকাশ করা যায়। কংগ্রেস কোনও দিনই এ-দেশের স্বাধীনতা অর্জন করতে চায়নি, ইংরেজের হাত থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেতে চেয়েছিল। ইংরেজই যদি স্বেচ্ছায় স্বাধীনতা দেওয়ার মালিক হয়, তা হলে, সেই চল্লিশের দশকে, শুধু কংগ্রেসের হাতে তুলে দেবে কেন? অপর শরিক, মুসলিম লিগ কী দোষ করল?

আপাত দৃষ্টিতে, ইংরেজের এই ব্যবস্থাকে তো খুব দোষারোপ করা যায় না। মিঃ জিন্না ততদিনে একথা প্রমাণ করে ছেড়েছেন যে তার মুসলিম লিগই ভারতের সাড়ে আট কোটি মুসলমানের মুখপাত্র। কংগ্রেস যতই আদর্শবাদের কথা বলুক মুসলমানের কাছে। সে একটি হিন্দু প্রতিষ্ঠান মাত্র–ইংরেজ চলে যাবার পর ভারতীয় মুসলমানরা হিন্দুদের। অধীনে নির্যাতিত হতে চায় না। হিন্দু-মুসলমান কোনও দিন মিলেমিশে থাকেনি, কোনও দিন থাকতে পারবে না।

সিপাহি যুদ্ধের সময় কিংবা নীল আন্দোলনের সময়, এমনকী ওয়াহাবি আন্দোলনের সময়ও যে-হিন্দু-মুসলমান কিছুটা মিলেমিশে লড়তে পেরেছিল সুভাষ বোসের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ ছিল পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক–সেসব অস্বীকার করা হল। মিলনের জন্য নতুন কোনও প্রচেষ্টার বদলে বিচ্ছেদের কারণগুলোকেই বাড়িয়ে দেখা হতে লাগল। এই কথাই বলা হতে লাগল যে, দীর্ঘকালের বাদশাহী শাসনের পর ইংরেজ আমলে হিন্দুরা সঙঘবদ্ধ হবার সুযোগ পেয়েছে ব্রিটিশ-রাজ’ চলে গেলে তারা আবার ‘হিন্দু-রাজ’ স্থাপনের জন্য উঠে পড়ে লাগবে। তার উদ্যোগও যে একেবারে ছিল না তাও তো নয়। এককালের বিপ্লবী বীর সাভারকর দীর্ঘ দিন বাদে আন্দামান থেকে ফিরে এসে হঠাৎ হিন্দুত্বের প্রতিষ্ঠার জন্য জিগির তুলে দিয়েছেন। মাশারিকির খাকসার বাহিনীর দেখাদেখি হিন্দুরাও তৈরি করেছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ, প্রদেশে প্রদেশে গজিয়ে উঠেছে হিন্দু মহাসভা।

কিন্তু হিন্দুত্ব যে আসলে কী তা কেউ জানে না। মুসলিম লিগের দাবির মধ্যে গোঁড়ামি থাকলেও বক্তব্য অতি পরিষ্কার। একজন মুসলমান জানে, সে কেন মুসলমান। একজন হিন্দু তো তা জানে না। হিন্দুদের বারো জাতের তেরো হাঁড়ি। সারা ভারতবর্ষ জুড়ে হিন্দু নামে কোনও একটি বিশেষ জাত নেই, হিন্দুত্ব নামে সর্বজনগ্রাহ্য একটি ধর্ম নেই। এ দেশের রাজনীতিতে ভারতীয় মুসলমানদের কতখানি অধিকার চাই–সেটা জিন্না সাহেব বার বার স্বচ্ছ ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন। সেই তুলনায় হিন্দুরা অনেক ভণ্ড। তারা অনেকে উদারতার ভান দেখায়, কিন্তু সামাজিক জীবনে ঘোর সাম্প্রদায়িক। অনেকে। নিজেকে হিন্দু বলে পরিচয় দিতে লজ্জা পায় কিন্তু ভেতরটা সংস্কারাচ্ছন্ন। একজন খাঁটি ধর্মপ্রাণ হিন্দু এবং একজন খাঁটি ধর্মপ্রাণ মুসলমান কখনওই পরস্পরের আত্মীয় হবে

কারণ ধর্মের সঙ্গে অনেক অনুশাসন ও সংস্কার জড়িত, শুধু ব্যক্তিগত চর্যা হিসেবে গ্রহণ করতে পেরেছে অতি বিরল সংখ্যক মানুষ। একমাত্র, ধর্মহীন ছাড়া কেউ প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে না। দুই ধর্ম মেলাবার উদ্ভট অবাস্তব চেষ্টা করেছিলেন গান্ধীজি, কিন্তু নাস্তিকতা প্রচারের সাহস, তিনি দূরে থাকুন, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিও কখনও দেখাতে পারেনি।

ক্যাবিনেট মিশন এসে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটা নির্দিষ্ট তারিখ ঠিক করতে চাইছে। জওহরলাল নেহরু চাইছেন, কেন্দ্রে একটি জাতীয় সরকার গঠন করে সেই সরকারের হাতেই ক্ষমতা দেওয়া হোক। জিন্না সাহেব পাকিস্তানের দাবি নিয়ে বেঁকে বসে আছেন। মুসলমানদের হাতে আলাদা ভাবে ক্ষমতা না দিলে মুসলমানরা তা কিছুতেই মানবে না। এবং মুসলিম লিগ কোনও দিনই কংগ্রেসের মতন অহিংসায় বিশ্বাসের কথা বলেনি। বাংলায় তখন লিগ মিনিস্ট্রি।

এই অবস্থায় লিগ থেকে ১৬ই আগস্ট ডাইরেক্ট অ্যাকশানের দিন হিসেবে হরতাল ঘোষণা করে দেওয়া হল। হরতালের দিন দাঙ্গাহাঙ্গামার আশঙ্কা করে একদল সাংবাদিক জিন্না সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, এই ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশান’ কার বিরুদ্ধে?

জিন্না সাহেব চট করে উত্তর দিলেন, কেন, ইংরেজের বিরুদ্ধে! কিন্তু ইংরেজ তো পাকিস্তান দাবি অস্বীকার করছে না। হ্যাঁ-ও বলেনি, না-ও বলেনি। হিন্দুরাই তো পাকিস্তান বিরোধিতা করছে।

রণক্লান্ত বিধ্বস্ত ইংরেজ জানে ভারত এবার ছাড়তেই হবে। যুদ্ধের পরেই বিলেতে চার্চিলকে সরিয়ে দিয়ে লেবার পার্টি সরকার গঠন করে এ-সম্পর্কে বিশেষ ভাবে চিন্তা করছে। লালকেল্লায় আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার উপলক্ষে সারা দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। বোম্বাইতে নৌ-বিদ্রোহ হয়ে গেল। সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর মধ্যেও বিদ্রোহের পরিচয় পেয়েই ইংরেজ বুঝতে পেরে গেছে–দেশি সৈন্যদের সহায়তায় আর বেশি দিন এ-দেশ শাসন করার চিন্তা বিপজ্জনক। আর বেশি দিন দেরি করলে, যদি ১৮৫৭ সালের সিপাহি যুদ্ধের মতন আর একটা কিছু হঠাৎ ঘটে যায় তা হলে ভারতে বসবাসকারী ইংরেজদের জীবন ও ধনসম্পদ রক্ষা করা যাবে না। সুতরাং ভালোয় ভালোয় সরে পড়াই ভালো। হিন্দু-মুসলমান এবং শিখদের পারস্পরিক মনোভাব এখন যে-অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে তাতে নিজেদের মধ্যে একটা মারামারি বাধলে ওরা এখন আর সাহেবদের দিকে মনোযোগ দেবার সময় পাবে না। তাতে সাহেবদের লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই।

তা ছাড়া, এ-দেশের শাসন ক্ষমতা ছাড়লেও ব্যবসায়ের অধিকার ছাড়বে কেন ইংরেজ? চেম্বার অফ কমার্স বহু দিন থেকেই রাজনীতিতে অংশ নিয়ে আসছে। এ-দেশ যদি টুকরো টুকরো হয় পরস্পরের সঙ্গে শত্রুতা করেই সব শক্তি নষ্ট করে, তা হলে ভারতীয় উপমহাদেশে অর্থনীতির বনিয়াদ কখনও শক্ত হবে না, ব্রিটিশের বাণিজ্য-স্বার্থ বহু কাল অক্ষুণ্ণ থাকবে।

১৬ই আগস্টের প্রায় এক মাস আগেই কলকাতার একটি ইংরেজি সংবাদপত্র একটি গোপন খবর ফাঁস করে দিয়েছিল। পাটকল ও ব্যবসায়ী বাড়ির সাহেব মালিকরা নিজেদের মধ্যে একটা গোপন সার্কুলার পাঠিয়েছে–শিগগিরই দাঙ্গাহাঙ্গামা বাধবে– তোমরা তৈরি থাকো–নিজেদের সম্পত্তি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করো।

১৪ই আগস্ট হিন্দুরা শ্ৰদ্ধানন্দ পার্কে এক মিটিং করে প্রস্তাব পাস করল, এই হরতালের বিরোধিতা না করলে পাকিস্তানের দাবিই মেনে নেওয়া হচ্ছে। এই হরতাল সফল হতে দেওয়া চলে না।

এর পালটা মিছিল বেরোল কলকাতায়। স্লোগান উঠল, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। লেগে গেল লড়াই।

বহু দিন ভারতের মাটিতে যুদ্ধ হয়নি। তবু, জাতিগত ভাবে মানুষ নামক এই প্রাণীটির মধ্যে সব সময়ই রক্তের তৃষ্ণা থাকে। তাই কখনও ধর্মের নামে, কখনও ভাষার নামে, কখনও নতুন রাজনৈতিক স্বপ্নে, কখনও আরও অনেক ছোটখাটো স্বার্থে পরস্পরকে হত্যা করে এই রক্তের তৃষ্ণা মিটিয়ে নেয়। বহু যুগ ধরে শোষিত ও নিষ্পেষিত হয়ে কাপুরুষতার বীজ ঢুকে গেছে এ-জাতির মজ্জায়। রণক্ষেত্রে প্রবল শত্রুর মুখোমুখি হওয়ার সাহস হারিয়ে ফেলেছে–এখন শুধু লাঠিসোটা বা ছুরিছোরা নিয়ে পাড়াপ্রতিবেশীর মধ্যে বেছে বেছে নিরীহ মানুষকে মারার ব্যাপারে ওস্তাদ। যারা এই উন্মত্ততার বাইরে থাকতে চায়, এইসব দুঃসময়ে তারাই সবচেয়ে অসহায়।

সকালবেলা উঠেই সূর্যর একমাত্র কাজ দীপ্তির বাড়িতে যাওয়া। গত তিন-চার দিন ধরে সে প্রত্যেক দিন সকালে ও বিকেলবেলায় দীপ্তির বাড়িতে গিয়ে বসে থাকে। এক এক দিন দুপুরেও ফেরে না।

আজও সকালবেলা চা খেয়েই সূর্য বেরিয়ে পড়ল। রাস্তায় এসে দেখল, যানবাহন কিছু নেই, চার দিকে একটা থমথমে ভাব। দীপ্তির বাড়ি হাজরার মোড়ের কাছে–এত দূরের রাস্তা, কিন্তু সূর্য একটুও দ্বিধা করল না। সে হেঁটেই যাবে।

বিবেকানন্দ রোড থেকে কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটে এসে দেখল মোড়ের মাথায় বহু লোক জমায়েত হয়েছে, কয়েক জন উত্তেজিত ভাবে বলাবলি করছে কী সব। একদল আবার উৎসুক হয়ে মানিকতলার দিকে চেয়ে কী যেন দেখার চেষ্টা করছে। সেদিক থেকে গোলমাল ভেসে আসছে।

সূর্য হাঁটতে লাগল হ্যারিসন রোডের দিকে। অন্য কোনও দিকে তার মন নেই। হঠাৎ উলটো দিক থেকে একদল লোক হইহই করে ছুটে এল। সঙ্গে সঙ্গে গোটা রাস্তায় হুড়োহুড়ি পড়ে গেল একেবারে। রাস্তার বাকি লোকেরা কী হচ্ছে না হচ্ছে, না দেখেই ছুটতে শুরু করছে। সূর্যর গায়ে ধাক্কা দিয়ে ছুটে গেল কয়েক জন। সূর্য দেওয়াল ঘেঁষে পঁড়াল। রাস্তা একটু ফাঁকা হতেই আবার হাঁটতে লাগল সামনের দিকে।

একটা গলি থেকে দশ বারো জন লোক লাঠি ও লোহার রড হাতে নিয়ে বেরিয়ে এসে চিৎকার করে উঠল, জয় হিন্দ!

ইদানীং এই আওয়াজটা নতুন শোনা যাচ্ছে। জার্মানিতে সুভাষ বোস এটা প্রথম চালু করেছিলেন, আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারের সময় সাধারণ লোকের মধ্যেও চালু হয়ে যায়।

লোকগুলো সূর্যর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে কী যেন বলাবলি করতে লাগল, সূর্য ভ্রূক্ষেপ করল না। সুকিয়া স্ট্রিটের কাছাকাছি এসে দেখল, ইষ্টক বর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। এ-পাশে একদল লোক ও-দিকের একটা দলের দিকে যত না ইট, তারচেয়ে বেশি গালাগালি ছুঁড়ে দিচ্ছে।

সূর্য বিরক্তি বোধ করল। এ যেন শুধু তার যাওয়ার পথে বাধার সৃষ্টি করা। এর মধ্য দিয়ে সে হেঁটে যাবে কী করে। ভুরু কুঁচকে তাকে একটু দাঁড়াতেই হল।

কিন্তু দু’-চার মিনিটের মধ্যেই ঘটনা গুরুতর আকার ধারণ করল। একটা বন্ধ দোকানের পাল্লায় কয়েক জন তোক দমাদ্দম লাথি মারছিল–একসময় পাল্লাটা ভেঙে পড়তেই শুরু হয়ে গেল লুটপাট। সেটা একটা ঘুড়ির দোকান। মুহূর্তে ঘুড়ির কাগজ আর কাপ আর সুতো ভরতি লাটাই গড়াতে লাগল রাস্তায়। উন্মত্ত মানুষের চিৎকারে আর কান পাতা যায় না। চিৎকার আরও তুমুল হল, যখন সেই দোকানের ভেতর থেকে তাড়া খাওয়া ইঁদুরের মতন দু’জন লোক বেরিয়ে এল। রোগা চেহারার দু’জন প্রায় বৃদ্ধ মুসলমান। বিকট উল্লাসে লোকজন তাদের ঘিরে ধরে কিল চড় মারতে লাগল, তারপর দু’-একটা লাঠিও উঠতে দেখা গেল।

এতক্ষণে সূর্যর মনের মধ্যে একটা নাড়া জাগল। সে তার পাশের লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল, এ কী হচ্ছে কী? ওদের মারছে কেন?

পাশের লোকটি বলল, রাজাবাজারে পাঁচখানা লাশ পড়ে গেছে, জানেন? ওরাই তো শুরু করেছে।

কিন্তু এই লোকদুটো কী দোষ করেছে?

ও-শালাদের বিশ্বাস নেই।

সহজাত প্রবৃত্তিতেই সূর্য লোকদুটিকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু ওই পর্যন্ত পৌঁছোতে পারল না। মেছোবাজারের দিক থেকে একদল লোক সেই সময় তেড়ে এল, ফটাফট সোডার বোতল ফাটছে, সামনের কয়েক জনের হাতে তলোয়ার। এদিকে জনতা আবার পেছন দিকে ছুটল–সূর্যকেও সেই স্রোতে ভেসে যেতে হল। খানিকটা দৌড়ে এসে সূর্য দাঁড়াল একটা গলির মুখে।

ও-পাশের দলটা খুব বেশিদূর এল না। খানিকটা এসেই থমকে দাঁড়িয়ে আবার পেছন ফিরে আরও জোরে ছুটল। অকস্মাৎ দেখা গেল, রাস্তা ফাঁকা–অনেক দূর থেকে একটা পুলিশের গাড়ি আসছে। লুণ্ঠিত দোকানের সামনে সেই লোক দুটির মধ্যে একজন নিস্পন্দ, আর একজন তখনও ছটফট করছে–একজন দীর্ঘদেহী কালোয়ার অতি দুঃসাহসে দৌড়ে গিয়ে মুমূর্ষ লোকটার পিঠে এক ঘা রডের বাড়ি মেরে সট করে ঢুকে গেল একটা বাড়ির মধ্যে।

সূর্যর পাশেই একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন বাজারের শূন্য থলি হাতে নিয়ে। তিনি সূর্যর কানের পাশে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন, এই যে ভাই, শোনো, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? ও-দিকে চলে যাও!

সূর্য অবাক হয়ে বলল, কেন?

লোকটি প্রায় ধমক দিয়ে বললেন, যা বলছি তাই শোনো। ভালোর জন্যই বলছি। তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কী করছ?

কেন বলুন তো?

তুমি কি কলেজের ছাত্র? যাও, যাও, তোমাদের মহল্লার দিকে যাও। কে কখন ধরে বসবে!

লোকটি সূর্যর আপাদমস্তক দেখে মুখের দিকে অদ্ভুত ভাবে চেয়ে রইলেন। সূর্যর জাগতিক জ্ঞান কম, তাই সে লোকটির এ-ধরনের কথার অর্থ তক্ষুনি বুঝতে পারেনি। কিন্তু আত্মরক্ষার টানে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতন তার চেতনা হল, তার মুখে দাড়ি আছে, তাকে এরা মুসলমান বলে সন্দেহ করছে।

এটা হাস্যকর ব্যাপার। কিন্তু সূর্য হাসতে পারল না। কোথাও কারওর মুখেই এখন হাসি নেই। মাত্র একশো কি দেড়শো গজ দূরে দুটি লোক এইমাত্র প্রাণ হারাল। টাটকা রক্ত ছড়িয়ে পড়ে আছে রাস্তায়।

পুলিশের গাড়িটা যাওয়ার জন্য রাস্তাটা এখন ফাঁকা। সূর্য আর দেরি করল না, সে দৌড়ে গেল সামনের দিকে। সদ্যমৃত লোকদুটির পাশ দিয়েই যেতে হল তাকে, তাকাবার সময় পেল না। অনেক দিন পর সে এত জোরে ছুটছে! পেছন থেকে একটা আওয়াজ জেগে উঠল, কয়েকটা ইটের টুকরো উড়ে এল তার দিকে।

একদমে কলেজ স্ট্রিট বাজার পার হয়ে এসে সূর্য থামল। হাঁপাতে লাগল একটা দেওয়ালে ভর দিয়ে। তার শরীরের সমস্ত লোমকূপ, হাত-পায়ের নখ পর্যন্ত সতর্ক হয়ে গেছে। কিন্তু শরীরে কোনও উত্তেজনা নেই, মুখের মধ্যে একটা তেতো স্বাদ। এর চেয়ে ঢের বেশি জনতার মধ্যে মিশে থেকে সে লড়াই করেছে কিন্তু এ কী রকম জঘন্য লড়াই! এখন তাকে শুধু নিজের প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করে যেতে হবে।

এখানে রাস্তাটা ফাঁকাই ছিল, এক মিনিটের মধ্যেই কলাবাগানের দিক থেকে পিলপিল করে ছুটে এল আবার একটি দল। এদের অনেকেরই হাতে গাঁইতি আর শাবল। অবিলম্বেই এরা বাছা বাছা কয়েকটি দোকানের দরজা ভাঙার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল। সূর্যকে নিয়ে ওরা বিশেষ মাথা ঘামাল না। ওদেরও অনেকের গালে দাড়ি আছে।

এদিক-ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে সূর্য নিজের কর্তব্য স্থির করতে চাইল। এই ভাবে সে কত দূর যাবে? মেডিকেল কলেজের সামনেটা ফাঁকা হলেও দূরে বউবাজারের দিকটায় গোলমাল চলছে মনে হয়। এখনও সে তার নিজের বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে আসেনি। অন্য রাস্তার গলিঘুজি দিয়ে বাড়ি পৌঁছোনো যায়।

কিন্তু সূর্য বাড়ি ফেরার চিন্তাটা এককথায় উড়িয়ে দিল। সে দীপ্তির কাছে যাবেই।

হ্যারিসন রোড ধরে সূর্য এগোল সেন্ট্রাল এভিনিউ-র দিকে। এখানে ঠিক মারামারি শুরু হয়নি এখনও–এক দল লোক আর এক দলকে তাড়া করছে, তারা গোরু-ভেড়ার মতন ছুটছে। এক জায়গায় একটা বড় বাড়ি লক্ষ্য করে প্রচুর ইট ছোঁড়া হচ্ছে। সূর্য এসব পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে এগোতে লাগল। তাকে এখনও অনেক দূরে যেতে হবে।

সেন্ট্রাল এভিনিউতে আবার অন্য দৃশ্য। কোথাও একটাও লোক নেই। পথঘাট একেবারে শুনশান। গাড়িবারান্দার তলায় ভিখিরিরাও উধাও। একটুও শব্দ নেই– কয়েকটা ছেঁড়া খবরের কাগজ উড়ছে। কলকাতার রাজপথে দিনের আলোয় এই দৃশ্য কী রকম অপ্রাকৃত মনে হয়। রাস্তার দু’পাশে বাড়িগুলোর সব জানলা বন্ধ।

সূর্য একটু থমকে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকায়। বিপদের কোনও চিহ্ন চোখে পড়ে না। খুব সতর্ক ভাবে সে এগোতে থাকে ধর্মতলার দিকে। প্রত্যেক গলির মোড়ে এসে থমকে দাঁড়ায়–সেখান থেকে হঠাৎ কেউ বেরিয়ে আসে কি না দেখবার জন্য। কেউ নেই।

বউবাজার স্ট্রিটের কাছে এসে সূর্যর বুকের মধ্যে ধক করে ওঠে। এতক্ষণে সে বুঝতে পারে এই রাস্তা কেন এত নির্জন। সকালেই এখানে একটা খণ্ড প্রলয় হয়ে গেছে। কয়েকটি দোকানে আগুন লাগার চিহ্ন। রাস্তার মাঝখানে পড়ে আছে পাঁচটা মৃতদেহ। চার জন পুরুষ ও একটা দশ-এগারো বছরের ছেলে। এ-ওর গায়ের ওপর এলোমেলো। কনুই থেকে কাটা একটা হাত আলাদা ভাবে একটু দূরে রাস্তায় ওলটানো। আঙুলগুলো যেন মাটি খিমচে ধরতে চেয়েছিল। এই হাতটা ওই লোকগুলোর মধ্যে ঠিক কার–এটা জানা সূর্যর বিশেষ দরকার। সে দু’-এক পা এগিয়ে গেল ও-দিকে। নিহতদের চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে কার হাত নেই খুঁজতে লাগল। মনে হয় যেন এখনও ওদের নিশ্বাস সেখানকার বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।

সেই দৃশ্য সূর্যর চোখ চুম্বকের মতন টেনে ধরে। কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারে না। সে এখন কী করবে? আবার কয়েক পা পিছিয়ে এসে সে একটা থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে সামনে পেছনে ডাইনে বাঁয়ে দ্রুত দেখে নেয়। তারপর চোখ বোজে।

চোখ বুজতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে দীপ্তির মুখ। আঃ, কী ঠান্ডা লাগে তখন। সারা পৃথিবীতে সূর্যর আর কোথাও যাবার জায়গা নেই, দীপ্তির কাছেই যেতে হবে তাকে।

দেওয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে সূর্য এগোতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ আর কোনও বাধা পায় না। ধর্মতলার দিকে কয়েকটা গাড়ির যাতায়াত ও মানুষজনও চোখে পড়ে। আর কোনও দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে হনহন করে হাঁটতে আরম্ভ করল সূর্য। মাঝে মাঝে চোখ বুজে দীপ্তির মুখখানা দেখে নেয়।

পার্ক স্ট্রিট ছাড়াবার পর সূর্য আবার বিপদে পড়ে গেল। কয়েকখানা লরি-ভরতি মানুষজন হইহই করে যাচ্ছিল। সূর্য সেগুলোকে দেখে আবার দেওয়াল ঘেঁসে দাঁড়িয়েছে। একখানা লরি তার সামনেই এসে থামল। কয়েক জন ছোকরা নেমে এসে উত্তেজিত ভাবে জিজ্ঞেস করল, উধার কা কেয়া হাল হ্যায়?

সূর্য কী আর উত্তর দেবে? কোনওক্রমে আড়ষ্ট ভাবে বলল, উধার আগ লাগ গিয়া!

একটি ছোকরা গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, নারায়ে তকদির!

লরি থেকে প্রত্যুত্তর গর্জে উঠল।

এ-লোকগুলি অবাঙালি। এরা সূর্যকে নিজেদের দলের ভেবেছে। সূর্যকে লরিতে উঠতে বলল ওদের সঙ্গে।

সূর্য বলল, সে বিশেষ দরকারে সামনের দিকে যাবে। ওরা তাতে কর্ণপাত করল না। একদল জানাল যে, ও-দিকে ভবানীপুরের দিকে শিখ সর্দারজিরা দারুণ কাণ্ড করছে। হ্যাঁ, ওরাও ও-দিকে যাবে বটে, আরও দলে ভারী হয়ে বিকেলে যাবে সর্দারজিদের পাড়াকে পাড়া জ্বালিয়ে দেবে।

সূর্যকে লরিতে তোলার জন্য টানাটানি করতে লাগল। প্রতিবাদ জানিয়ে লাভ নেই। এতগুলো উন্মত্ত মানুষের কাছে কোনও সুস্থ কথারই কোনও মূল্য নেই।

লরিতে চেপে সূর্য যে-দিক থেকে এসেছিল, সেই দিকেই ফিরে যেতে হল। উর্দু-ঘেঁষা হিন্দি ভাষায় সূর্য বাল্যকালে রপ্ত ছিল–এখন তাতেই কাজ চালিয়ে যেতে লাগল এদের সঙ্গে।

লরিটা সেন্ট্রাল এভিনিউতে গেল না। তার বদলে বাঁক নিল ওয়েলিংটনের দিকে। ওয়েলিংটনের কাছে একেবারে তুলকালাম কাণ্ড চলছে। ক্রিক রো, তালতলার দিকে প্রচণ্ড গোলমাল আর আগুনের শিখা।

লরি থেকে সূর্য ঝুপ করে নেমে পড়ল অন্যদের সঙ্গে। হঠাৎ তার মনে পড়ল, এই দিকেই শ্রীলেখার বাবার বাড়ি। বাদলরাও এইখানে থাকে। ওদের কোনও বিপদ হয়নি তো? কিন্তু ও-দিকে এগোনো এখন অসম্ভব।

ওই বাড়ি থেকেই শ্রীলেখার বিয়ের সময় তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সূর্য শ্রীলেখার মুখখানা মনে করতে গিয়েও ঠিক মনে করতে পারছে না। দীপ্তির মুখের সঙ্গে শ্রীলেখার মুখটা মিশে যাচ্ছে। শ্রীলেখা আর দীপ্তি যেন একই।

গোলমালের সুযোগ নিয়ে সূর্য ওই দলটা থেকে আবার পালাল। এখানেও দোকানপাট লুঠ শুরু হয়েছে। লুঠের সময় মারামারিটা একটু কম হয়। ওয়েলেসলির দিকে সর্বত্র হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়েছে–তবে, এ-দিকে অনেকটা একতরফা চলছে– সূর্যকে কেউ বাধা দিল না।

এলিয়ট রোড পেরিয়ে সাহেবপাড়া আবার একেবারে শান্ত। পার্ক স্ট্রিটে বেশ কিছু দোকানপাট খোলা। সূর্য একটু জিরোবার জন্য একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে এক কাপ কফি নিয়ে বসে রইল। অবস্থা যে অত্যন্ত সাংঘাতিক দিকে যাচ্ছে সেটা বুঝতে তার দেরি হল না। শহরে এত ব্যাপক আকারে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে, সেই তুলনায় পুলিশ প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রথম সে একটিমাত্র পুলিশের গাড়ি দেখেছিল। শিখদের এলাকা কি সে পার হতে পারবে? তার গালে দাড়ি থাকলেও সে লুঙ্গি কিংবা পাজামা পরে নেই, আজ পরেছে ট্রাউজার্স। শিখদেরও তো দাড়ি থাকে। তার মাথায় পাগড়ি নেই।

আর না এগিয়ে সে যদি এই সাহেবপাড়ায় আশ্রয় নিয়ে থাকে তা হলে তার আর কোনও বিপদ নেই। এখানে বসে থাকলে একটানা-একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবেই। তবু সূর্য কফির দাম টেবিলে রেখেই উঠে পড়ল। তার জীবনের কী মূল্য আছে? তাকে দীপ্তির কাছে যেতেই হবে। দীপ্তি একা থাকে–তার কোনও বিপদ হয়েছে কিনা সেটা দেখতে হবে না? পার্ক স্ট্রিট ধরে খানিকটা নিশ্চিন্ত ভাবে হাঁটতে হাঁটতে সূর্য ভাবল, এরপর পার্ক সার্কাস, হাজরার ও-দিকে শিখদের পাড়া। দু’জায়গাতেই তার বিপদের সম্ভাবনা আছে। কেউ তাকে চেপে ধরলে–সে নিজেকে হিন্দু বা মুসলমান-এর কোনওটাই প্রমাণ করতে পারবে কি? কী ভাবে প্রমাণ দেবে? একটু আগেই ওয়েলেসলিতে সে দেখে এসেছে একটা ধুতি-পরা বুড়ো মতন লোকের মাথায় একদল লোক লাঠির বাড়ি মারছে, আর লোকটা হাউ হাউ করে বলছে, আল্লার কিরে, মুই মোছলমান, মুই মোছলমান। আর লোকগুলো বলছে, খোল শালা, কাপড় খোল–।

হিন্দুদের হাতে ধরা পড়লেই বা সে কী বলবে? তার মুখে দাড়ি-কোনও হিন্দুই কি দাড়ি রাখে না? সে নিজেকে বামুনও বলতে পারবে না, তার পইতে নেই–অথচ তার। সত্যিকারের পদবি শুনলে—

সূর্য মনে মনে বলল, দীপ্তি, তুমি কি বুঝতে পারবে, আমি তোমার কাছেই যেতে চাইছি। আমি যদি মরেও যাই, তবু আমি সব সময় তোমার কাছেই যেতে চাই।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গোলমাল বেড়ে যাচ্ছে। সূর্যর মতো একা আর কেউ রাস্তা দিয়ে হাঁটছে না, সব জায়গাতেই আলাদা আলাদা দল। সূর্যর ভেতরকার প্রচণ্ড রাগী ও

জেদি ব্যক্তিত্বটি ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে–কিন্তু এই ধর্মোন্মাদ রক্তপাগল জনতার কাছে। প্রকৃতপক্ষে সে অসহায়।

বেকবাগানের কাছে এসে সে বুঝতে পারল, সে অত্যন্ত ভুল জায়গায় পৌঁছেছে। এদিককার রাস্তাঘাটও সে ভালো ভাবে চেনে না। এদিকে প্রচণ্ড গোলমাল। হুড়োহুড়ি, মারামারি ও স্ট্যাবিং চলছে, কয়েকখানা বাড়ি জ্বলছে দাউ দাউ আগুনে।

তার মুখে দাড়ি থাকার জন্য সে হিন্দুদের দল এড়িয়ে চলে গেল মুসলমানদের দলে। নিজের দাড়ি তো সে উপড়ে ছিঁড়ে ফেলতে পারে না। স্রোতের শ্যাওলার মতন তার নিজের বিরুদ্ধে তাকে দৌড়োদৌড়ি করতে হল ওদের সঙ্গে। তার চোখের সামনেই একটা ঘড়ির দোকান লুঠ হল। যে-যা পারল নিয়ে পালাল, কয়েক জন বিনা কারণে আছড়ে আছড়ে ভাঙতে লাগল বড় বড় দেওয়াল-ঘড়িগুলো। বিভিন্ন ঘড়িতে অসময় লেখা আছে।

একটা লোকের পিঠে ছুরি মারা হয়েছে, সে শিরদাঁড়া-ভাঙা কুকুরের মতন রাস্তায় পড়ে ছটফট করছে। তার আততায়ী পাশে দাঁড়িয়ে রক্তাক্ত ছুরি তুলে হাসছে হা-হা করে আর চেঁচিয়ে বলছে, তিন শালাকো খতম কিয়া।

কী অদ্ভুত উল্লাস! অথচ যে আক্রান্ত এবং যে আততায়ী–এরা কেউ কারওর আসলে শত্রু নয়–দু’জনেই নিপীড়িত সমাজের মানুষ। যে-লোকটি আততায়ী, তারও নিশ্চয়ই বাড়িতে মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা–কেউ-না-কেউ আছে–সে জানে, তার অভাবে তার সংসারের কী অবস্থা হবে। কিন্তু অন্যের ক্ষেত্রে সেটা মনে পড়ে না।

সূর্য ওই মুমূর্ষ লোকটাকে কোনও সাহায্য করতে পারছে না। একবার তার ইচ্ছে হল, ওই আততায়ীর ঘাড় ধরে ওই মুমূর্ষ লোকটার সেবা করতে বাধ্য করায়।

কিন্তু তা সম্ভব নয়। মনের মধ্যে রাগ চেপে সে ছটফট করে। এই উন্মাদ জনতাকে সে কিছু বোঝাতেও পারবে না–এদের সঙ্গে লড়াই করতেও পারবে না–এই চিন্তা তাকে অসম্ভব কষ্ট দেয়। তার রাজনৈতিক জীবনে সে এই রকম অবস্থার কথা একবারও চিন্তা করেনি। এখন শুধু তার নিজের প্রাণ বাঁচাতে হবে।

বেপরোয়া ভাবে সে আবার ছুটতে শুরু করে এবং অচিরেই রাস্তা গুলিয়ে ফেলে। হাজরা মোড় কোন দিকে? সে কি উলটো দিকে চলে যাচ্ছে? কলকাতার শিরা-উপশিরার মতন গলিঘুজি দিয়ে সে অনবরত তার লক্ষ্যে পৌঁছোতে চাইছে।

আর একটা হিন্দু দলের হাতে পড়ে নাজেহাল হয়ে সূর্য কোনওক্রমে প্রাণে বেঁচে গেল, কিন্তু তার আগেই তার পিঠে কয়েক ঘা লাঠি পড়েছে। খালি পা ছেঁড়া জামা নিয়ে সূর্য যখন হাজরার মোড়ে পৌঁছোল, তখন দেখল দীপ্তিদের বাড়ির ঠিক নীচেই বড় রকমের হাঙ্গামা চলছে। ও-বাড়ির দরজা জানলা সব বন্ধ। বাড়ির সামনের ফুটপাতে দারুণ ভিড়, লাঠিসোঁটা নিয়ে একদল লোক রণহুংকার দিচ্ছে। এই দুর্ভেদ্য দেওয়াল পেরিয়ে যাওয়া শক্ত–কিন্তু সূর্যকে যেতেই হবে।

যদি ও-বাড়ির দরজা খোলা থাকত—তা হলে সূর্য গন্ডারের মতন একরোখা ভাবে। দৌড়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করতে পারত। কিন্তু বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তো সে ডাকাডাকি করার সময় পাবে না। কাছাকাছি একটা পাঞ্জাবিদের দোকান তখনও খোলা–সে দোকানের পাশটিতে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

কিছুক্ষণ বাদে আর একজন তোক দীপ্তিদের বাড়ির সামনে এসে কড়া নাড়তে লাগল। ভিড়টা তখন একটু দূরে সরে গেছে। দরজা কিন্তু তবু খুলছে না–লোকটি খুব জোরে জোরে দরজায় ধাক্কাছে আর কার যেন নাম ধরে ডাকছে। সূর্য এই সূযোগে দ্রুত লোকটির পাশে এসে দাঁড়াল।

সূর্যর বিপর্যস্ত চেহারা, মুখে দাড়ি দেখে ভয় পেয়ে গেল লোকটি। সূর্যর দিকে চোখ। তুলে তাকাতেই সে তাড়াতাড়ি বলল, আমি দীপ্তিদির সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

কে আপনি?

আমার নাম সূর্য। দীপ্তিদি আমাকে চেনেন।

দীপ্তিদি কে?

সূর্য এবার পালটা প্রশ্ন করল: আপনি কে? আপনি কি এ বাড়িতে থাকেন?

এই সময় দরজা খুলে গেল। যে দরজা খুলল, সে অন্য লোকটিকে চেনে, সূর্যকে চেনে না। সূর্যকে সে ঢুকতে দিতে চায় না। সূর্য জোর করে ভেতরে ঢুকে বলল, আমাকে দীপ্তিদির কাছে নিয়ে চলুন–

দোতলায় দীপ্তির ফ্ল্যাটের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ।

সূর্য নিরাশ হয়ে গেল। এত দূর এসেও দীপ্তির দেখা পাওয়া গেল না? অথচ কালও সে এসেছে, দীপ্তির তো যাবার কথা ছিল না কোথাও!

এদিকে অন্য লোকদুটি তাকে নানা প্রশ্ন করে জ্বালাতন করছে। এই রকম সময় কেউ অযথা বিরক্ত করলে বড় মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল, চলুন, তিনতলায়! সুকল্যাণদা আমাকে চিনতে পারবেন।

সুকল্যাণের ফ্ল্যাটে এসে দেখা গেল বাড়ির সব লোক সেখানেই জড়ো হয়েছে, দীপ্তিও সেখানে রয়েছে। সূর্যর সঙ্গে আসা অন্য লোকটি সুকল্যাণের পিসতুতো ভাই।

সুকল্যাণ সূর্যকে দেখে চিনতে পারলেও সূর্যই সুকল্যাণকে দেখে প্রথমটায় চিনতে পারেনি। কালকেও সে দেখে গিয়েছিল সুকল্যাণের একমুখ দাড়ি-গোঁফ, মাথার চুল বাবরি করা। আজ তার সব নিমূল। দাড়ি-গোঁফ বাদ দেবার জন্য হঠাৎ তাকে আজ খুব রোগা দেখাচ্ছে।

সুকল্যাণ চমকে বললেন, আরে, এ কী? তুমি আজ এলে কী করে?

সূর্য দীপ্তিকে একপলক দেখে নিয়ে শান্ত ভাবে বলল, আমার কোনও অসুবিধে হয়নি। রাস্তা মোটামুটি ফাঁকাই ছিল।

অত দূর থেকে কীসে এলে? ট্রামবাস তো কিছুই চলছে না।

হেঁটেই চলে এলাম।

সেই বিবেকানন্দ রোড থেকে? এ যে অসম্ভব কথা? শুনলাম যে কলাবাগানে দারুণ খুনোখুনি শুরু হয়ে গেছে?

না। ওসব গুজব।

দীপ্তি কাছে এগিয়ে এসে বললেন, তোমার এ রকম চেহারা হল কী করে?

ঘরের সবাই সূর্যকে ঘিরে ধরল। সুকল্যাণের ভাই উত্তেজিত ভাবে বলল, উত্তর কলকাতায় ডজন ডজন লাশ পড়ে গেছে, আর আপনি বলছেন কিনা সব গুজব?

সূর্য বলল, আমি তো কিছু দেখিনি।

এই সময় বাইরে আবার একটু গোলমাল হতেই সবাই ছুটে গেল জানলার কাছে। সামান্য খড়খড়ি ফাঁক করে উদগ্রীব হয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।

কী যে হচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে একদল লোক শুধুই চিৎকার করছে। অনেকেরই হাতে অস্ত্রশস্ত্র।

সুল্যাণরা সূর্যকে বললেন, তুমি শুধু শুধু এত দূর এলে। এখন ফিরবে কী করে?

সূর্য উত্তর দিল না।

সুকল্যাণদা আবার বললেন, ভীষণ ডেঞ্জারাস অবস্থা। এ-পাড়া অ্যাটাক হবে। সকাল থেকেই শোনা যাচ্ছে, চেতলার দিক থেকে এসে এ-পাড়া অ্যাটাক করবে। খানিকটা আগে বাজারের মধ্যে আমরা ওদের দুজনকে মেরেছি।

আমরা মানে?

এ-পাড়ায় আমাদের আর ওদের স্ট্রেংথ সমান সমান। ওরা অ্যাটাক করলে আমরাও ফাঁইট দেব।

তার আগে, পুলিশে খবর দিলে হয় না?

সেই আশায় আছ বুঝি এখনও? পুলিশ তো সব ওদের হাতে। বড়তলা থানার ওসি খোকার কী করেছে শুনেছ?

না।

তোমাদের তো পাড়ায়। সে পুলিশকে হুকুম দিয়েছে…

সুকল্যাণ সূর্যদের পার্টির সমর্থক ছিলেন। নিজে জেল না খাটলেও অনেক ভাবে সাহায্য করেছেন পার্টিকে। সূর্য লক্ষ করল, রাতারাতি সেই সুকল্যাণদা পুরোপুরি সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠেছেন। আজকের দিনের ঘটনার নিন্দেও তিনি করতে পারছেন না–তিনি চাইছেন পুরোপুরি লড়াই। কিছুতেই পাকিস্তান কায়েম হতে দেওয়া চলবে। না।

সুকল্যাণ সূর্যকে একবার নিয়ে গেলেন ছাদে। বাড়ির বাচ্চারা সেখানে একরাশ ইটের টুকরো জড়ো করেছে। কয়েকখানা বড় বড় ইট দিয়ে নেমন্তন্ন বাড়ির উনুনের মতন একটা বড় উনুন তৈরি করা হয়েছে। একটা ড্রামে জল ফোঁটানো হচ্ছে সেখানে।

এ-বাড়ি আক্রান্ত হলে ওপর থেকে গরম জল ঢেলে আর ইটপাটকেল ছুঁড়ে প্রতি-আক্রমণ চালানো হবে।

সুকল্যাণ বললেন, তুমি যখন এসে পড়েছ, আজ আর ফিরতে তো পারছনা। তোমার মতন এক লম্বা-চওড়া জোয়ান পেয়ে আমাদের ভালোই হল। দাড়িটা এক ফাঁকে কামিয়ে নিয়ো, বুঝলে?

সূর্য কী উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছে না। সকাল থেকেই তার মুখটা তেতো হয়ে আছে। সত্যিই যদি এ বাড়ি আক্রমণ করে, সে তা হলে কী করবে?

ছাদ থেকে তাকিয়ে দেখল, সব দিকের রাস্তাতেই মাঝে মাঝে লোকজন জড়ো হয়ে আছে। চেতলার দিকে দেখা যাচ্ছে ধোঁয়ার কুণ্ডলি। চিৎকার শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। সিভিল ওয়ারের দৃশ্য বোধহয় এই রকমই হয়।

অসম্ভব রোদের তেজের জন্য ছাদে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো যায় না। আবার নেমে এল। নীচে সুকল্যাণের ঘরে। সেখানে এত বেশি মানুষজন যে সূর্য দীপ্তির সঙ্গে নিরালায় কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে না। একতলার লোকেরা এত ভয় পেয়েছে যে, কিছুতেই তারা একতলায় থাকবে না–এখানেই এসে পাকাপাকি আশ্রয় নিয়েছে। দীপ্তিও কি দোতলায় যেতে ভয় পাচ্ছে?

তিন-চার বার রাস্তায় শোনা গেল চাচামেচি, এই আসছে, এই আসছে! অনেক বাড়িতে বেজে উঠল শাঁখ। কিন্তু কিছুই হল না। সুকল্যাণদা সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত দিলেন যে দিনের বেলায় না এলেও ওরা রাত্তিরে ঠিকই আসবে। আজ সারা রাত সবাইকে পালা করে জেগে থাকতে হবে।

দুপুর দেড়টা বাজে। খিদে পেলেও এতক্ষণ কেউ খাবারদাবারের কথা উচ্চারণ করেনি, এবার সেই প্রসঙ্গ এল।

সূর্য দীপ্তিকে বলল, আমি আজ আপনার সঙ্গে খাব।

দীপ্তি বললেন, এসো–।

নিজের ঘরে ফিরে এসে দীপ্তি সূর্যকে বললেন, তুমি কি পাগল হয়ে গেলে? এ রকম ভাবে কেউ আসে?

সূর্য বিমর্ষ মুখ করে বলল, আমার আসা উচিত হয়নি?

উচিত-অনুচিতের কথা হচ্ছে না। আজ এত সব সাংঘাতিক কাণ্ড হচ্ছে–এর মধ্যে কেউ রাস্তায় বেরোয়? আজকের দিনটা অন্তত তুমি বাড়িতে থাকতে পারতে না।

কী করতাম বাড়িতে থেকে।

আচ্ছা মুশকিল তো তোমাকে নিয়ে। তুমি কী করবে, তা কি আমি তোমায় বলে দিতে পারি?

আমার শুধু এখানেই আসতে ইচ্ছে করে।

যা শুরু হয়েছে, সহজে থামবে বলে মনে হয় না। তুমি বাড়ি ফিরবে কী করে?

আমি ফিরব না। আমি আজ রাত্তিরে এখানেই থাকব।

তুমি কি এতই ছেলেমানুষ–তুমি জানো না, তা হয় না?

আমি আপনার ঘরের বাইরে, সিঁড়িতে শুয়ে থাকব!

সূর্য, তুমি কী বলো তো? তোমাকে নিয়ে আমি কী যে করি! তোমার বাবা তোমার জন্য চিন্তা করবেন না? তোমার বাবাকে বলে এসেছ?

না।

দীপ্তি এবার অত্যন্ত রাগত মুখ করে বললেন, এসব আমার মোটেই ভালো লাগে না। তুমি এবার মার খাবে আমার কাছে।

সূর্যর মুখে হাসি ফুটেছে। বলল, মারুন।

দীপ্তি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সূর্যর দিকে। সূর্য চোখ থেকে চোখ সরাল না।

দীপ্তি ধমকের সুরে বললেন, যাও চান করে এসো। আমি ভাত চাপিয়ে দিচ্ছি।

সূর্য হাত বাড়িয়ে বলল, তোয়ালে?

বাথরুমেই আছে। তোমার জামাটা ছিঁড়ল কী করে? প্যান্টেও তো কাদা লেগেছে।

দীপ্তি এগিয়ে এসে সূর্যর পিঠে হাত রেখে বললেন, পিঠের এখানটা কেটে গেছে। কী হয়েছিল কী?

সূর্য তার পিঠ থেকে দীপ্তির হাতটা সরিয়ে এনে বলল, রাস্তায় একটা দল আমাকে ধরেছিল। তারা আমাকে বিষ্ণুর দশ অবতারের নাম জিজ্ঞেস করল। আমি বলতে পারিনি। তারপর তারা আমাকে আমাদের সাত পুরুষের নাম বলতে বলল। কিন্তু আমি আমার ঠাকুরদার নামই জানি না।

ঠাকুরদার নাম জানো না?

সত্যিই জানি না। আমার বাবার কাছে তার বাবার কথা কক্ষনও শুনিনি। একটা-দুটো নাম বানিয়ে বলছিলাম–ওরা শেষ পর্যন্ত আমাকে অবিশ্বাস করেনি–কিন্তু একজন। খারাপ হিন্দু হিসেবে কয়েক ঘা মেরেছে। তারপর আমি পড়লাম আর একটা দলের হাতে। সেখানে আমি বললাম, আমি মুসলমান। তারা কী একটা বয়েত বলে তার পরের লাইনটা বলতে বলল। সেটা আমি কখনও শুনিইনি–তবু আমার মুখে দাড়ি আছে বলে। কয়েক ঘা দিয়ে–

এটা কি ছেলেখেলা? কী শুরু হয়েছে চারদিকে, তুমি খবর রাখো না?

মানুষ মানুষকে মারছে। আমি যদি মরেও যেতাম, তবু আপনি কি বুঝতে পারতেন আমি আপনার কাছেই আসছিলাম?

তুমি আমার জন্য এ রকম কেন করছ বলো তো?

আপনি আমাকে নিয়ে নিন। আমার সবকিছু আপনি নিয়ে নিন।

সূর্য, তুমি বুঝতে পারো না আমার জীবন অন্য রকম।

এত শক্ত ব্যাপার আমি বুঝব কী করে?

দীপ্তিকে অত্যন্ত অস্থির দেখাচ্ছে আজ। একবার ধপ করে খাটের ওপর বসে পড়েই সঙ্গে সঙ্গে আবার উঠে পড়ে বললেন, যাও চান করে এসো। তোমার কি খিদেও পায়। না?

স্নান করে বেরিয়ে এসে শার্টটা খুলে রেখে, শুধু প্যান্ট আর গেঞ্জি পরে সূর্য খেতে বসল। খাবারগুলো সব টেবিলে এনে রেখে দীপ্তিও বসে পড়লেন। চিন্তিত ভাবে। বললেন, আমার দাদা বউদিরা থাকে ব্যারাকপুরে, ওদের কী হয়েছে জানি না। ওরাও নিশ্চয়ই আমার জন্য চিন্তা করছে। দাদার কোয়ার্টারে টেলিফোন আছে–স্কুলে যেতে পারলে টেলিফোনে খোঁজ নিতে পারতাম।

সূর্য বলল, আমি টেলিফোন করে আসব?

না, তোমাকে এখন বেরোতে হবে না।

শহরের মানুষ কি সারাক্ষণ বাড়িতে বসে থাকবে? এ রকম ভাবে চলবে না, একটা কিছু মিটমাট হয়ে যাবেই।

সুকল্যাণদা বলছেন, এই দাঙ্গা সহজে থামবে না। বিরাট এক চক্রান্ত আছে নাকি এর। পেছনে। তুমি মীনা পেশোয়ারির নাম শুনেছ? সে নাকি অনেক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তৈরি। আছে। টালার ট্যাঙ্কে নাকি বিষ মেশানো হবে? কী হয়ে গেল বললো তো দেশটা?

সূর্য উত্তর না দিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল। দেশ সম্পর্কে তার আর কোনও চিন্তা নেই।

দীপ্তি বললেন, আমিই বা এ ভাবে এখানে কত দিন থাকতে পারব? আমাকে দাদার কাছেই চলে যেতে হবে।

এই সময়ে আমাদের কি কিছু করার আছে?

তোমরা একটা কিছু করতে পারো। আমি মেয়ে হয়ে আর কী করব?

আমি আপনাকে আপনার দাদার কাছে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করতে পারি।

কী করে?

রাস্তায় পুলিশের গাড়ি দেখলেই থামাব।

তোমাকে নিয়েই আমার আরও বেশি ভয়। তোমার তো কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই।

দীপ্তিদি, এ-পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল, আমি সহজে মরব না। কিন্তু আজই প্রথম আমি দেখলাম, কত সহজে মানুষ মানুষকে মারতে পারে। আমাকেও ওরা মেরে ফেলতে পারত। এইসব কথা ভাবতে এখন আমার ঘেন্না হচ্ছে।

খাওয়া শেষ হবার পর দীপ্তি বললেন, চলো, সুকল্যাণদার ফ্ল্যাটে যাই।

ওখানে গিয়ে কী হবে?

ওখানে অনেকে রয়েছে।

অনেকের সঙ্গে আমার ভালো লাগে না। সুকল্যাণদাকেও আমার ভালো লাগে না।

এ রকম ভাবে তুমি ক’দিন থাকবে? পৃথিবীতে সবার সঙ্গে মিলেমিশেই তোমাকে কাটাতে হবে।

বাইরে আবার একটা গোলমাল হতেই দীপ্তি ধড়ফড় করে চলে গেলেন জানলার কাছে।

সূর্য চেয়ারেই বসে রইল। দীপ্তি খুব সামান্য জানলা ফাঁক করে বাইরের দিকে তাকিয়ে শিহরনের শব্দ করে বললেন, ইস, কাকে যেন ধরে এনেছে।

সূর্য বলল, ওখান থেকে চলে আসুন।

দীপ্তি বললেন, উঃ মা! এরা কি মানুষ।

শিগগির ওখান থেকে চলে আসুন।

একজন বুড়ো লোক। দেখবে এসো, একজন বুড়ো লোক।

আমি কিচ্ছু দেখতে চাই না।

কান ধরে ওঠ-বোস করাচ্ছে।

আপনি এ-দিকে চলে আসুন আমাদের ও-সব কিছু দেখবার দরকার নেই।

আমাদের বাড়ির একেবারে সামনেই। কেউ কি এসব বন্ধ করতে পারে না?

সূর্য উঠে দীপ্তির বাহু ধরে কড়া গলায় বলল, আপনাকে বলছি না জানলা থেকে সরে আসতে?

দীপ্তি বললেন, সূর্য আমার গা কাঁপছে। আমার বুকের মধ্যে কী রকম যেন হচ্ছে। আমার জানলার কাছেই এ রকম হইহল্লা হলে আমি বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারব না।

সূর্য দীপ্তির দুধে হাত রেখে একেবারে তার মুখের সামনে মুখ এনে চোখের পলক না ফেলে বলল, আমরা ও-সব কিছু দেখব না, আমরা ওসব কিছু শুনব না। পৃথিবীতে আর কেউ নেই।

কী রকম চাঁচাচ্ছে, আমার কানে তালা লেগে যাচ্ছে!

কান বন্ধ করে থাকুন।

চলো, ওপরে চলো। সেখানে অনেকে আছে।

আর কোথাও কেউ নেই। পৃথিবীতে আর কারও জন্য আমার মাথাব্যথা নেই।

সূর্য দীপ্তির গালে ঠোঁট বোলাতে লাগল। তারপর এমন অসম্ভব জোরে দীপ্তির ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরল যে প্রায় দম বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। দীপ্তি ছটফট করে কিছু একটা বলতে চাইছেন, সূর্য কিছুতেই তাঁকে কথা বলতে দেবে না। সূর্যর হাত ছাড়িয়ে যাবার জন্য দীপ্তি এদিক-ওদিক সরে যাচ্ছেন কিন্তু সূর্য তার সর্বাঙ্গ ধরে আছে।

বেশ কিছুক্ষণ পর সূর্য যখন তাকে ছাড়ল তখন দীপ্তির মুখখানা টকটকে লাল। উত্তেজিত ভাবে বললেন, তুমি আমাকে এ কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?

আপনি আমাকে নিয়ে নিন।

আমি জানি না, আমি কিছু জানি না।

সূর্য দীপ্তির হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে এল পাশের ঘরে। সেখানে তাঁর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, এই জঘন্য কুৎসিত পৃথিবীর আর কিছু আমি দেখতে চাই না। হয়তো আজকেই আমরা দুজনে মারা যেতে পারি—

এবার খুব নরম ভাবে দীপ্তির নাভির কাছে সূর্য তার মুখটা চেপে ধরল। দীপ্তির শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। সূর্যর মাথার চুল তিনি শক্ত করে চেপে ধরলেন। সূর্য দীপ্তির কোমর ধরে তাকে টেনে নামিয়ে আনল মাটিতে। প্রচণ্ড চুম্বনে দীপ্তির বুকে লাল দাগ করে দিল। তারপর একটা করে খুলতে লাগল বোতাম।

দীপ্তি বড় বড় নিশ্বাস ফেলে কাতর ভাবে বলতে লাগলেন, সূর্য আমি নিজের কাছে হেরে যাচ্ছি। বাইরে মানুষ মরছে, আর আমি–আমি আর পারছি না, চিন্তাও করতে পারছি না।

সূর্য একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দীপ্তির সুন্দর শরীরের দিকে। আস্তে আস্তে বলল, পৃথিবীতে এখন আর কেউ নেই। হয়তো আমরাও কাল আর বেঁচে থাকব না।

দীপ্তি চোখ বুজে বললেন, আমাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরো। আরও জোরে, আরও জোরে–।

সে-দিন সন্ধ্যাবেলা একদল লোক এসে বলল, এবাড়িতে একজন মুসলমানকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে, তাকে বার করে দিতে হবে।

সুকল্যাণ সূর্যকে টানতে টানতে নিয়ে এলেন তিন তলায়। আয়নার সামনে বসিয়ে দিয়ে বললেন, দাড়ি কামাও! এক্ষুনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *