যত যে রাণী হোক, সে তো নারীই
১. দেলমিরা আগুসতিনি উরুগুয়ের মেয়ে। দশ বছর বয়স থেকে কবিতা লেখেন। দেলমিরা তাঁর ‘সুদূর থেকে’ কবিতায় লিখেছেন—‘তুমি দূরে গেলেই আমার কান্না উপচে পড়ে/তোমার পায়ের শব্দ শুনে ঘুমের ভেতর সুখে নেচে উঠি,’ নিশ্চয় আমরা ভাবতে পারি, তিনি একজনকে বড় গভীর করে ভালবাসেন, যার নৈকট্য তিনি প্রার্থনা করেন। দেলমিরা লিখেছেন—‘আমার হৃদয় আর তুমি মুখোমুখি দাঁড়ানো, সমুদ্র এবং আকাশের মত/এদের মাঝখানে উড়ান মেঘের মত চলে যাচ্ছে স্রোত ও সময়, জীবন ও মৃত্যু।‘
দেলমিরা যাকে ভালবাসতেন, ভালবেসে যাকে তিনি জীবনের সঙ্গী করেছিলেন, সে-ই তাঁর লেখার একমাত্র বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দেলমিরা এই প্রতিবন্ধকতা শেষ অদি মেনে নিতে পারেননি, তিনি স্বামীর কাছে তালাক চেয়েছিলেন। বিনিময়ে স্বামী তাকে হত্যা করে এবং নিজেও আত্মঘাতী হয়। ১৮৮৬ সালে জন্মে মাত্র আঠাশ বছর বেঁচে ছিলেন কবি দেলমিরা আগুসতিনি। পাঠক, আমরা আজ দেলমিরা আগুসতিনিকে চলুন সর্বোত্তম শ্রদ্ধা জানাই এবং তার হত্যাকারী স্বামীকে অভিসম্পাত ।
২ জুলিয়া দ্য বারজোসের একটি কবিতার শিরোনাম জুলিয়া দ্য বারজোসকে। নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জুলিয়া বলছেন… ‘যে কণ্ঠস্বর আমার কবিতায় কথা বলে, সে তোমার নয়, আমার কণ্ঠস্বর/তুমি যদি পোশাক, আমি তার সুগন্ধ/আমাদের মাঝখানে শুয়ে আছে গভীর গহ্বর/তুমি সামাজিক মিথ্যের উপর দাঁড়ানো একটি ফ্যাকাসে পুতুল/আমি সত্য, আমি বীর্যবান অগ্নিকণা তুমি, তোমার পৃথিবীর মত স্বার্থপর, আমি নই/আমি আমার মত হতে আমার সকল কিছু নিয়ে জুয়োয় বসতে পারি/তুমি একজন নিপুণ সংসারী মেয়ে, শ্রীমতি জুলিয়া/আমি নই। আমি জীবন। আমি শক্তি। আমি নারী/তুমি তোমার স্বামী, তোমার মালিকের অধিকৃত দ্রব্য। আমি নই/আমি কারও সম্পত্তি নই, আমি সকলের, আমি সকলের জন্য, সকলের আমি/নিজেকে আমি শুভ্ৰ চিন্তা ও অনাবিল ভাবনা দিয়েছি। তুমি তোমার চুল কাল কর, মুখে প্রসাধন মাখো, আমি নই/আমার চুল কাল করে বাতাস, আমার মুখ রঙিন করে সূর্য তুমি ঘরের বধু বশ্যতা স্বীকার করা বিনীত বধ/নানা গোঁড়ামি ও কুসংস্কারে ক্লান্ত, আমি নই/আমি দ্রুতগামী অশ্ব, পৃথিবী ঘুরে খুঁজে ফিরি সামান্য সমতা।‘
১৯১৪ সালে জুলিয়া দ্য বারজোস পুয়েরতো রিকোয় জন্মেছেন, বড়ও হয়েছেন ওখানে। অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে নানা অসুখে ভুগে জীবনের অধিক সময় তার হাসপাতালেই কেটেছে। নুইয়র্ক শহরের রাস্তায় অজ্ঞাতপরিচয় জুলিয়া দ্য বারজোস একদিন মরে পড়ে ছিলেন (১৯৫৩)। বেঁচে থাকতে যৎসামান্য পরিচিতি পেলেও জুলিয়া এখন পুয়েরতো রিকের প্রধান কবি হিসেবে খ্যাতি পাচ্ছেন।
৩. কবি জুয়ানা, জুয়ানা ফেরনানদেজ জন্ম নিয়েছেন ১৮৯৫ সালে। ক্যাপটেন ডি. লুকাস ইবারব্যুরোকে বিয়ে করে নাম নিয়েছেন জুয়ানা দ্য ইবারব্যুরো। উরুগুয়েরর নানা রাজ্যে ঘুরে মনটেভিডিও শহরে এসে জুয়ানা স্থায়ী হন। ১৯১৯ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ বেরোয় এবং তার প্রতিভার খবর ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ১৯২৯ সালে লাতিন আমেরিকা ও স্পেন জুড়ে তার অগাধ খ্যাতি ও ব্যক্তিত্বকে সম্মান জানাতে জুয়ানা নিজের নাম রাখেন জুয়ানা দ্য আমেরিকা । বন্ধন নামে একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন–‘আমি প্লাবিত হয়েছি তোমার জন্য/আমাকে পান কর/স্ফটিকও আমার ঝরনার স্বচ্ছতাকে ঈর্ষা করে/আমি ডানা মেলেছি তোমার জন্য/আমাকে হানো/রাতের প্রজাপতি আমি, তোমার অধীর আগুনের চারদিকে ঘুরে মরি/—আমার চুলে পুতির মালার বদলে দোলে দীর্ঘ কণ্টক,/কানের দুলে দুটুকরো পদ্মরাগ মণির বদলে দুটো গনগনে কয়লা/আমাকে দেখে/আমার যন্ত্রণা দেখে তুমি হাসছ/একদিন তুমিই কাদবে/এবং তারপর তুমি আমার হবে/এর আগে যা তুমি হওনি কখনও ।’
৪ ম্রিরিদা নাইত আতিক মরক্কোর কবি। ম্রিরিদা ছিলেন আজিলাল শহরের একজন গণিকা। চমৎকার গান গাইতেন তিনি, তার এই গানের খ্যাতি ছিল খুব। বাড়ির অভ্যাগতদের গান শোনাতেন ম্রিরিদা। তিনি গান লিখতেন পাহাড়ের সাদাসিধে মেয়েদের জীবনযাপন নিয়ে। যুদ্ধের পর, ম্রিরিদার তখন তিরিশ বছরও হয়নি তাকে আর গণিকালয়ে, মাকদাজে, এবং তার গ্রামের বাড়ি মরক্কোর এটলাস পাহাড়ের তাসাউকেও পাওয়া যায়নি। ১৯৫৯ সালে রেলে ইয়লোগ নামের একজন ফরাসী সৈনিক (যাঁর সঙ্গে ম্রিরিদার ভাল বন্ধুত্ব ছিল) তার কবিতার ফরাসী অনুবাদ প্রকাশ করেন।
ম্রিরিদার একটি কবিতার নাম ‘ধোঁয়ার মত’। কবিতাটি এরকম–পরিত্যক্ত মেয়েদের তুমি রক্ষা করো লাললা হালিমা (একজন মুসলমান সন্ন্যাসীর নাম লাললা হালিমা, তিনি অবিবাহিত মা’দের আশ্রয় দিতেন।)/কাকে তুমি বিশ্বাস করতে পারো কৃপালু ঈশ্বর? এই আমি, আমি কোনও পুরুষকে কখনও বিশ্বাস করব না তাদের প্রতিজ্ঞা ধোঁয়া এবং হাওয়ার মত/গোশাবক নিয়ে যখন চরাতে যাই মাঠ/সঙ্গীতজ্ঞের ছেলেটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল/একটা খচ্চরও কিন্তু অধিক পিপাসার্ত না হলে/অধিক জলও আর পান করে না।/সৈনিক লোকটি তার গুণের পদক নিয়ে দিব্যি বেঁচে থাকে/যতটা সে পেতে চায়, পেয়ে যায় অনেকের মত/শুধু ওই খচ্চরটি তৃষ্ণার্ত না হলে/কিছুতেই জল পান করতে চায় না/দশজন যুবক/দশজন বিপত্নীক/দশজন প্রৌঢ়/সবাই দিয়েছে আমাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি/কেউ কথা রাখেনি তাদের/তাদের সকল তৃষ্ণ মিটিয়েছি আমি/আর তারা পুনর্বার পান করতে গিয়েছে অন্য কোথাও/ককে তুমি বিশ্বাস করবে, কৃপাময় ঈশ্বর আমার / এই আমি, আমি কোনও পুরুষের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারি না/তাদের সকল অঙ্গীকার ধোয়ার মত/ধোয়ার মত/ধোঁয়ার মত।
৫. কবি এডিথ সোডারগ্রাঁ ১৮৯২ সালে সেন্ট পিটার্সবুর্গে জন্মেছেন। সেখানে তার বাবা-মা সুইডিশভাষী জনগণকে নিয়ে একটি বিশাল দল গড়ে তোলেন। রাশিয়ার বিপ্লবের পর, এডিথ ও তার মা রাশিয়ার সীমান্তের কাছে ফিনল্যান্ডে আশ্রয় নেন, সেখানে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে তাদের দিন কাটে। হেলসিঙ্কিতে তার কবিতা প্রথম প্রকাশিত হবার পর হাতেগোনা ক’জন সমালোচক ছাড়া সবাই এর নিন্দ করে। এসময় এডিথ বিষম একা হয়ে পড়েন, কেবল তরুণ বিপ্লবী লেখিকা হ্যাঁগার অলসেন ছাড়া তাকে কেউ সঙ্গ দেয়নি। এই হ্যাঁগারই তরুণ ফিনিশ কবিদের কাছে এডিথের কবিতা পৌঁছে দেন। ১৯২৩ সালে যক্ষ্মা রোগে ভুগে এবং না খেতে পেয়ে কবি এডিথ সোডারগ্রা মারা যান। তার মৃত্যুর পর ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনে তিনি সুইডিশ কবিতার একজন সংস্কারক হিসেবে অভিনন্দিত হন এবং তার খ্যাতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়।
এডিথ সোডারগ্রাঁর একটি কবিতার নাম—‘দুঃখ’ । সুখের কোনও সঙ্গীত নেই, সুখের কোনও ভাবনা নেই, সুখের কিছু নেই/সুখকে স্পর্শ করলে সুখ ভেঙে যায়, নষ্ট হয়/গহন ঘুমের মধ্যে ভোরের গুঞ্জনে ভেসে সুখ আসে/গাঢ় নীল ভাবনার ওপর তুলো মেঘের মত উড়ে যায় সুখ/ সুখ হল দুপুরের পোড়া রোদে ঘুমিয়ে থাকার অবারিত মাঠ/সুখের কোনও শক্তি নেই, সে কেবল ঘুমোয় এবং বেঁচে থাকে/ আর কিছুই জানে না, কিচ্ছু না…/তুমি কি দুঃখকে চেন? সে তার বজমুঠিসহ কিরকম শক্তিমান এবং বিশাল?/তুমি কি দুঃখকে বোঝ? সে তার রক্তাভ চোখ এবং চোখের জলসহ আশান্বিত হাসে/আমাদের যা যা প্রয়োজন, দুঃখ সকলি দেয়/মৃত্যুকুঠুরীর চাবি দেয়/সে দরজার দিকে ঠেলে দেয় আমাদের দ্বিধান্বিত দেহ/ …সে লোভী মেয়েমানুষের গলার অলঙ্কার খামচে ধরে/সে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে যখন পুরুষ তার ভালবাসা ফেলে রেখে চলে যায়…/সে মুক্তো এবং ফুল দেয়, সে গান এবং স্বপ্ন দেয়/ সে আমাদের সহজ চুম্বন দেয়, সকলই অদৃশ্য চুম্বন/সে আমাদের একটি কেবল চুম্বন দেয়, যেটি সত্যি/ সে আমাদের আশ্চর্য একটি হৃদয় এবং প্রচণ্ড আকাঙক্ষা দেয়/সে দেয় জীবনের সর্বোচ্চ অর্জন/ভালবাসা, একাকীত্ব এবং মৃত্যুর সাদা মুখ ।
৬ রানী এলিজাবেথও (১৫৩৩-১৬০৩) কবিতা লিখেছেন। লিখেছেন–আমার কাছ থেকে আশা করা হয় অনেক কিছুই/অথচ আমার দ্বারা কোনও কিছু করা হয় না/রানী এলিজাবেথ তো বন্দিনী।
বন্দিনী কে নয়? জুয়ানা, ম্ৰিরিদা দেলমিরা, জুলিয়া, এডিথ কে নয়? গণিকা, গৃহিণী, ভিখিরি থেকে শুরু করে ইংলন্ডের রাণীও বন্দিনী। রাণী? যত যে রাণী হোক, সে তো নারীই!