৫৭. মাধবীলতাকে বিপদমুক্ত ঘোষণা

 সাতান্ন

তিনদিন পরে মাধবীলতাকে বিপদমুক্ত ঘোষণা করা হল। ওকে আজ দুপুরে পেয়িংবেডে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন এটাকে ঈশ্বরের দয়া বলা যেতে পারে। পেশেন্টের অবস্থা এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছিল যেখানে শতকরা নব্বুইভাগ মানুষ বাঁচে না। এখন সময় লাগবে সুস্থ হতে। এই অবস্থায় পেশেন্টকে বিরক্ত করা উচিত হবে না। অথবা অযথা ভিড় বা কোনরকম উত্তেজনা যাতে সৃষ্টি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ভিজিটার্সরা যেন পেশেন্টের সঙ্গে বেশী কথা না বলেন।

চারটের অনেক আগে থেকে ওরা ভিড় করেছিল। সৌদামিনী তার স্কুলের শিক্ষিকাদের আসতে নিষেধ করেছিলেন। এই কদিন মহিলা দুবেলা আসছেন, অনেকক্ষণ থাকছেন। ডাক্তারকে সক্রিয় রাখতে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছেন। অনিমেষ ওঁর সামনে দাঁড়াল, ‘আপনার কাছে আমরা—।’

‘এই রে!’ সৌদামিনী হাত নাড়লেন, ‘আপনি আবার ওসব বলবেন নাকি! কৃতজ্ঞতা, ধন্যবাদ! ওয়ার্থলেশ ওয়ার্ডস। টেক ইট ইজি। মেয়েটা আমার সহকর্মী তাই এসেছি। আপনাদের কৃতার্থ করার বিন্দুমাত্র বাসনা আমার ছিল না। এখন ও ভালর দিকে তাই কাল থেকে আসব না। ও যদ্দিন না কমপ্লিট সুস্থ হচ্ছে তদ্দিন স্কুলে যেতে হবে না। আর এই হাসপাতালের খরচ আমরা দেখব। আর কিছু বলার আছে?’

অনিমেষ অপ্রস্তুত। সে ম্লান হেসে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল।

সৌদামিনী বললেন, ‘আপনি মশাই খুব ফাঁকি দিয়েছেন। বউ-এর অসুখ হল, হাসপাতালে এল, আর আপনি কোথায় বসে রইলেন।’

পরমহংস কাছেই ছিল। বলল, ‘এটা আকস্মিক ব্যাপার। ওর দোষ নেই।’

সৌদামিনী কাঁধ নাচালেন, ‘যার শেষ ভাল তার সব ভাল। এখন ওকে একটু যত্নে রাখবেন। পরিশ্রম করতে দেবেন না। আর নিজেরা না খেয়ে মেয়েটা যাতে খায় সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন। আপনার ছেলে জানে ওর মায়ের কথা?’

‘না। একটু আগেই তো আমরা জানলাম। তবে জানে আজ জানা যাবে।’

‘কেমন আছে ও?’

‘ভাল। ডাক্তার তো বলেছে দিন চারেক একদম শুয়ে থাকতে।’

সৌদামিনী চশমার কাঁচ মুছলেন, ‘আমি আজকালকার ছেলেদের একদম বুঝতে পারলাম না। যার মা এমন অসুস্থ সে খামোকা আগ বাড়িয়ে ছুরি খেতে যাবে কেন?’

অনিমেষ কোন উত্তর দিল না। পরমহংস একটা সিগারেট ধরাল। এই কদিন তারও অফিস কামাই হয়েছে। আজ এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে কাল থেকে মুক্তি। যেন একটা যুদ্ধ হচ্ছিল এতদিন। জয় ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর আর তার কিছুই করার নেই। হার হলেও যেমন কিছু করার থাকত না।

চারটের সময় ওরা প্রবেশাধিকার পেল। অনিমেষের বুকের মধ্যে অকস্মাৎ আলোড়ন সৃষ্টি হল। তাকে দেখে মাধবীলতার কি রকম অনুভূতি হবে? যদি ও আচমকা উত্তেজিত হয়ে ওঠে? ঘোরের মধ্যে নাম ধরে ডেকেছে ঠিকই কিন্তু চেতনায় এলে যদি তার অভিমান উগ্র হয়ে ওঠে! অনিমেষ মনস্থির করতে না পেরে পরমহংসকে বলল, ‘তোমরা গিয়ে দেখে এসো। আমি প্রথমে যাব না।’

পরমহংস কাঁধ ঝাঁকাল, ‘ওপেন করতে ভয় পাচ্ছ? সেকেণ্ড ডাউন নামবে? নামবে? ঠিক হ্যায়, অপেক্ষা করো।’

সৌদামিনী এগিয়ে গিয়েছিলেন, ‘কি হল আসুন।’

পরমহংস পা বাড়াতে সৌদামিনীর কপালে ভাঁজ পড়ল, ‘কি হল, উনি আসবেন না?’

‘আমরা ঘুরে এলে ও যাবে। স্বামী স্ত্রীতে একটু নিরিবিলিতে দেখা হওয়া ভাল। আর আমরা পেশেন্টকে বলব না যে তার স্বামী এসেছে। একটু সার প্রাইজ থাকা ভাল, বুঝলেন।’ পরমহংস বোঝাচ্ছিল।

সৌদামিনী কি বুঝলেন তিনি জানেন, মুখে বললেন, ‘যত্তসব।’

ভিজিটার্সরা লাইন দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে। অনিমেষ দেখছিল। সে নিজে কেন প্রথমেই যেতে পারল না? শুধুই কি মাধবীলতা উত্তেজিত হবে এই ভয়ে, না তার ভেতরে কোন অপরাধবোধ কাজ করছিল? অন্তত গত কয়েকদিনে অর্কর পাশে বসে থেকে তার প্রতিক্ষণ মনে হয়েছে এই জেনারেশনটার কাছে সে হেরে গেছে। যা নেহাতই আকাশকুসুম, যার সঙ্গে মাটির কোন যোগ নেই সেটা তো আকাশকুসুমই, আঁকড়ে ধরার জন্যে সে চোখ কান মন বন্ধ রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পেছনে না তাকিয়ে, যার জন্যে মাধবীলতাদের জীবন দিয়ে দাম দিতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ দায়িত্ব তার, অর্করা এখন অনেক বেশী বোঝে। ওই বয়সে সে নিজে এসব কথা চিন্তাও করতে পারত না। কিন্তু জীবনের রূঢ় দিকটা সম্পর্কে অর্করা যতটা জেনে ফেলেছে এবং তাই নিয়ে যেভাবে কথা বলে সেটা ওই বয়সে তার পক্ষে অকল্পনীয় ছিল।

অনিমেষ নিজের পোশাকের দিকে তাকাল। বেশ ময়লা হয়েছে। অন্তত এরকম ময়লা পোশাকে কোন রোগীর পাশে যাওয়া উচিত নয়। জলপাইগুড়ি থেকে আসার সময় সামনে যা পেয়েছে ঝোলায় ঢুকিয়ে নিয়ে চলে এসেছে। এখানে আসার পর কাচাকাচির বালাই ছিল না। এই কয়দিন খাওয়াদাওয়া সারতে হয়েছে দোকান থেকে কিনে এনে। দুদিন আগে বস্তির একটা মেয়ে এসেছিল দরজায়। অর্ক তখন ঘুমাচ্ছিল। অনিমেষের হাসপাতালে যাওয়ার সময় হয়নি। সকাল আটটা সাড়ে আটটা তখন। মেয়েটি জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কেমন আছে ও?’ অনিমেষ তখন জলপাইগুড়িতে একটা চিঠি লেখার কথা ভাবছিল। মুখ ফিরিয়ে মেয়েটিকে দেখে সে অবাক। মেয়েটিকে সে আগে কখনও দ্যাখেনি। কিন্তু মনে হচ্ছিল বিবরণ শুনেছে। উনুনের কারখানায় আড্ডা মারার সময় অনেক গল্প কানে আসতো। ভদ্রতা করে ঘাড় নেড়েছিল সে, ‘ভাল। তুমি কে?’

‘আমি এখানেই থাকি।’

‘ও!’ অনিমেষ মুখ ফিরিয়ে ভেবেছিল অর্কর তাহলে পরিচিতি বেশ বেড়েছে। অনেকেই খোঁজ নিতে আসেছ। বস্তির লোক তো বটেই, শান্তি কমিটি থেকেও দুবেলা জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছে কিছু প্রয়োজন আছে কি না। তবে কোন মেয়ে এই প্রথম এল। অনিমেষের খেয়াল হল মেয়েটি খবরটা জানার পরেও দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। সে জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু বলবে?’

‘মেয়েটি ইতস্তত করল। তারপর নরম গলায় বলল, ‘আপনাদের খাওয়াদাওয়া?’

অনিমেষ অবাক হল। তাদের খাওয়া দাওয়া নিয়ে মেয়েটি মাথা ঘামাচ্ছে কেন? সে বলল, ‘বাইরে থেকে এনে খাচ্ছি। এ কথা জিজ্ঞাসা করছ কেন?’

‘যদি বলেন আমি রেঁধে দিতে পারি।’

‘কেন? তুমি রাঁধবে কেন?’

‘এমনি।’

‘তোমার নাম কি?’

‘ঝুমকি। আপনার ছেলে আমাকে চেনে।’

‘ও। না, না। রান্নার কোন দরকার নেই। তুমি যেতে পার।’ অনিমেষ রূঢ় গলায় কথাগুলো বলেছিল। এরকম গায়ে পড়া ভাব তার মোটেই ভাল লাগেনি। মেয়েটি মাথা নিচু করে চলে যাওয়ার পর অনিমেষ দেখল অর্ক তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ওকে চিনিস?’

নীরবে মাথা নাড়ল অর্ক, কথা বলল না।

‘কে? কোন ঘরে থাকে?’

‘এখানেই থাকে। ওর ইচ্ছে ছিল ক্যাবারের ড্যান্সার হবার। হতে পারেনি।’

হতভম্ব হয়ে পড়েছিল অনিমেষ, ‘তুই জানলি কি করে?’

‘জানি!’ চোখ বন্ধ করেছিল অর্ক।

অনিমেষ আর কোন প্রশ্ন করতে পারেনি। কিন্তু সে আর একবার হেরে গেল। তার মনে পড়ল, বাল্যে কিংবা কৈশোরে সে নিজে মহীতোষ কিংবা সরিৎশেখরকে কখনই বলতে পারত না একটা ক্যাবারে ড্যান্সারের সঙ্গে তার পরিচয় আছে। অথচ অর্কর গলা কাঁপল না। খুব সহজ ভঙ্গীতে খবরটা দিল। সামান্য অপরাধ বোধ নেই।

হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনিমেষ মনে মনে স্বীকার করল। আমরা যত আধুনিকতার কথা বলি, বিপ্লবের জিগির তুলি ঠিক ততটা যোগ্যতা এখনও অর্জন করিনি। এখনও মনের আড় ভাঙ্গেনি। অর্কর সহজভঙ্গীটা সে এখনও আয়ত্ত করতে পারেনি।

অর্কর ক্ষত খুব খারাপ অবস্থায় যেত যদি সেই রাত্রেই ডাক্তার ডেকে না আনা হত। বেশ কয়েকটা ইঞ্জেকশন আর ক্যাপসুল গিলতে হয়েছে তাকে। আজ সকালে দেখা গেছে ক্ষত শুকিয়ে গেছে। ব্যাণ্ডেজ খুলে নিয়ে ক্ষতর মুখ তুলো আর প্লাস্টারে চাপা দেওয়া হয়েছে। এসব করতে অনেক খরচ হয়ে গেল। এখন যে কি হবে কে জানে। অনিমেষ হেসে ফেলল। আমরা যত বড় বড় কথা বলি না কেন পকেটে টাকা না থাকলে সেসব এক সময় নিজেকেই গিলে ফেলতে হয়।

এই সময় পরমহংসর গলা শুনতে পেল অনিমেষ, ‘ভাল আছে, কিন্তু ভীষণ দুর্বল। যা ঝড় গেল মেয়েটার ওপরে। তবে ভাই মাস্টারনি ওখানে গিয়েও দাবড়ে এসেছে। যাবে তো?’

ততক্ষণে সৌদামিনী এসে পড়েছেন, ‘যান, কি সারপ্রাইজ দেয়ার দিন। তবে এমন দেবেন না যাতে চোখ উল্টে যায়। আমি চলি। এখন তো রোজ আসার দরকার নেই। কাল বিকেলে নীপাকে পাঠিয়ে দেব। যদি কোন প্রয়োজন হয় তাহলে আমাকে জানাবেন। আপনি যাবেন?’

প্রশ্নটা পরমহংসকে। সে সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় নাড়ল, ‘না না। আপনি এগোন। আমি অনিমেষের সঙ্গে ফিরব।’

মহিলা চলে যেতে পরমহংস মুখ ফোলাল, ‘ডেঞ্জারাস মহিলা রে। রোজ আমাকে সঙ্গে নিয়ে শ্যামবাজার পর্যন্ত যেতেন জ্ঞান দিতে দিতে।’

‘কি জ্ঞান?’

‘কেন পুরুষমানুষদের বিবাহ করা উচিত নয়। দে আর ওয়ার্থলেশ, একটা পুরুষমানুষের চেয়ে ওয়ার্থলেশ জীব নাকি পৃথিবীতে জন্মায়নি।’ মাথা নাড়ল পরমহংস।

একটা হিমেল বাতাস হাসপাতালের ওপর দিয়ে বয়ে গেল। কলকাতায় এখনও শীত পড়েনি কিন্তু তার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। অনিমেষ ক্রাচ নিয়ে এসেছিল। পরমহংস যে নির্দেশ দিয়েছে সেই মত চিনতে অসুবিধে হচ্ছিল না। কিন্তু সিড়ি ভাঙ্গতে গেলে প্রাণ বেরিয়ে যায়। আরও খারাপ লাগে সেই সময় যদি কেউ সাহায্যের কথা বলে। মনে একটা জেদ কাজ করে তখন, যত নিয়ে এসেছি প্রাণ বেরিয়ে তখন, যত কষ্ট হোক আমি নিজে ওপরে উঠব কারো সাহায্য না নিয়ে।

লম্বা করিডোরে নানান মানুষের ভিড়। দেখতে দেখতে অনিমেষ সেই হলঘরটার সামনে দাঁড়াতেই একটি নার্স তার দিকে কৌতূহলী চোখে তাকাল। হয়ত তার ক্রাচদুটোর জন্যেই এই কৌতূহল। অনিমেষ তাকে বিছানার নম্বর বলতেই মেয়েটি বলল, ‘আসুন আমার সঙ্গে।’

একদম কোণের দিকে একটি খাটে যে শুয়ে আছে সে কি মাধবীলতা? মেয়েটি মিষ্টি হেসে চলে যেতে অনিমেষ আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বুক অবধি সাদা চাদরে ঢাকা, কাগজের মত সাদা মুখ, চোখ বন্ধ। শরীরের আদল দেখলে মনে হবে চাদরের নিচে তেরো বছরের কিশোরী শুয়ে রয়েছে। অনিমেষের বুকের ভেতরটা যেন দুমড়ে গেল। মাধবীলতার মুখের সমস্ত সুস্থতা কেউ যেন খাবলে তুলে নিয়েছে। শুধু হাড়ের ওপর চামড়া টাঙানো। অনিমেষ ধীরে ধীরে ব্যবধান কমাল। বিছানার পাশে টুল রয়েছে। খুব সন্তর্পণে সে টুলটায় বসে ক্রাচদুটোকে বিছানায় ঠেস দিয়ে রাখল। মাধবীলতা তখনও জানে না কেউ তার পাশে এসে বসেছে। দুচোখ বন্ধ করে স্থির হয়ে শুয়ে রয়েছে সে। অনিমেষের খুব ইচ্ছে করছিল হাত বাড়িয়ে ওর চিবুক কপাল স্পর্শ করে। তার পাশের বিছানা ঘিরে অনেক মানুষের ভিড়। তারা তাদের প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলছে। অনিমেষ চুপচাপ বসে রইল। মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শুধু ক্ষরণ হয়ে যাচ্ছিল তার ভেতরে। অদ্ভুত এক আবেগে সমস্ত শরীর থরথরিয়ে কাঁপছে।

দুটো হাত দুপাশে নেতিয়ে রয়েছে। চাদরের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে রয়েছে সামান্য। এত সাদা হাতের তেলো আগে দ্যাখেনি অনিমেষ। অত্যন্ত লোভীর মত কিংবা কাঙালের মত সে ধীরে ধীরে মাধবীলতার আঙ্গুল স্পর্শ করল। আঙ্গুলগুলো কেঁপে উঠল সামান্য। অনিমেষ ধীরে ধীরে হাতটা নিজের দুহাতে তুলে নিল। শীতল হাত নিজের উত্তাপের মুঠোয় পূর্ণ মায়ায় ধরে রাখতে চাইল সে। আর তখনই ধীরে ধীরে চোখ মেলল মাধবীলতা। যেন অনেক, অনেক দূর থেকে তাকাচ্ছে সে। দৃষ্টি অস্বচ্ছ। যেন স্পষ্ট চোখে সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। অথচ প্রাণপণে লক্ষ্যবস্তুকে চিনতে চেষ্টা করছে। অনিমেষ বুঝতে পারল। পেরে কিছু বলতে গিয়ে আবিষ্কার করল তার গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। আচমকা গলায় স্বর আটকে গেছে। সে ঢোক গিলল। তারপর ধীরে ধীরে হাতখানা বিছানায় নামিয়ে দিতেই মাধবীলতার আঙ্গুল তার হাত আঁকড়ে ধরল। শরীরের সমস্ত আলোড়ন মুহূর্তেই স্থির দিঘির মত, অনিমেষ চোখে চোখ রাখল।

ঈশ্বর মানুষকে যা দেন তার অনেক বেশী কেড়ে নেন। হয়তো মানুষের অতটা পাওনা ছিল না, এবং কিছুকাল বাড়তি ভোগ করায় তাকে গুণাগার দিতে হয়। স্বাস্থ্য সৌন্দর্য সাদা কাগজের মত, যে কোন মুহূর্তে ঈশ্বরের ইচ্ছায় তাতে কালি ঢালা হতে পারে। কিন্তু মানুষের হাতে একটি ব্যাপারে ঈশ্বরের পরাজয় ঘটে যায়। সব ফিরিয়ে নিলেও একটি জিনিসে তিনি কিছুতেই হাত বসাতে পারেন না। সেটি হল মানুষের হাসি। সব হারিয়েও কোন কোন মানুষ সেই হাসির দ্যুতিতে তার হারানো রূপ ঢেকে দিতে পারে। চট করে সে উঠে আসতে পারে স্বমহিমায়।

এই মুহূর্তে মাধবীলতা তাই পারল। তার অসুস্থ পাণ্ডুর মুখে হঠাৎ ভোরের আলো খেলে গেল। অনিমেষের মনে হল অনেকদিন পর সে স্নিগ্ধ হল। এই হাসি এক লহমায় অনিমেষের সব অপরাধবোধ মুছিয়ে দিল। সে পরম মমতায় মাধবীলতার হাত আঁকড়ে ধরল।

বালিশে এবার গালের একপাশ চাপা। রুখু চুল অগোছালো। স্থির চোখে তাকিয়ে মাধবীলতা ঠোঁট নাড়ল, ‘কেমন আছ?’

ঘাড় নেড়ে ভাল বলতে গিয়ে আড়ষ্ট হল অনিমেষ। এই প্রশ্নটা কার করা উচিত ছিল। মৃত্যুর অন্ধকার থেকে ফিরে এসে কেউ জিজ্ঞাসা করতে পারে পৃথিবীর মানুষ কেমন আছে? কিন্তু উত্তর দেওয়া দরকার। আমি ভাল আছি; তোমাকে অসুস্থ দেখে আমার ভাল থাকা কমেনি। কথাটা হয়তো অনেকটাই সত্যি কিন্তু এই মুহূর্তে বলা কি যায়?

‘কি হল!’ মাধবীলতার গলার স্বরে দুর্বলতা মাখানো।

অনিমেষ হাসার চেষ্টা করল। এই হাসিতে যেন অনেক উত্তর দেওয়া যায়। তারপর গাঢ় গলায় বলল, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে?’

নিঃশব্দে ঘাড় নেড়ে না বলল মাধবীলতা। তার হাত তখনও অনিমেষকে আঁকড়ে আছে। চোখ জড়িয়ে রেখেছে অনিমেষের মুখ। তারপর আবার সেই এক প্রশ্ন, ‘বললে না, কেমন আছ?’

অনিমেষ এতটা ভাবেনি। সে এবার নিচু গলায় বলল, ‘বোঝ না, কেমন থাকতে পারি!’ সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ হয়ে গেল। মুখের সব আলো নিবে গেল। যেন আচমকা আকাশের সব দরজা জানলা বন্ধ হয়ে গেল। অনিমেষ চোরের গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হল, লতা?’

ততক্ষণে দুচোখ ছাপিয়ে জল গালে নেমেছে। মাধবীলতা ভেজা গলায় বলল, ‘কিন্তু দোষ আমার।’

কিসের দোষ, কি দোষ? অনিমেষের মাথায় এল না প্রথমে। সে আর একটু ঝুঁকে বলল, ‘কেঁদো না। এখন কাঁদলে শরীর খারাপ করবে।’

সাদা ঠোঁট কামড়ালো মাধবীলতা নিজেকে স্থির করতে, ‘আমি তোমার কাছে বড্ড বেশী চেয়েছিলাম তাই ভগবান এমন শাস্তি দিলেন।’

‘তুমি তো আমার কাছে কিছুই চাওনি লতা!’

‘চেয়েছিলাম। তুমি জানো না!’

‘তুমি আর কথা বলো না।’

‘ঠিক আছে, কিছু হবে না। সে কোথায়?’

অনিমেষ ইতস্তত করল, ‘ওর শরীরটা খারাপ তাই আমি আসতে নিষেধ করেছি।’

‘শরীর খারাপ? কি হয়েছে?’ চোখ খুলল মাধবীলতা এবং উদ্বেগের ছাপ খোদাই হয়ে গেল সারা মুখে।

‘এমন কিছু না, সামান্য জ্বরজারি।’

‘ও! আমার জন্যে খুব করেছে ছেলেটা।’

‘বাঃ। মায়ের জন্যে ছেলে করবে না?’

‘সবাই করে?’

মাধবীলতা আবার চুপ করে গেল। অনিমেষের অস্বস্তি হচ্ছিল। যে কোন কথা মাধবীলতা হঠাৎ এমন একটা জায়গায় এনে দাঁড় করিয়ে দেয় যে তার জবাব দেওয়া যায় না। কিংবা দিতে গেলে নিজেকে খুব খেলো মনে হয়। মাধবীলতা তার কাছে কি চেয়েছিল যা সে জানে না? টাকা পয়সা বা অন্য কিছু কোনদিন সে চায়নি। যদি ভালবাসার কথা ওঠে সে তো ওকে কম ভালবাসেনি। তাহলে?

‘কাঁদছ কেন?’

অনিমেষ চমকে মুখ ফিরিয়ে দেখল অর্ক তার পেছনে দাঁড়িয়ে মাধবীলতাকে প্রশ্নটা করছে। মাধবীলতা চোখ খুলে ছেলেকে দেখে অবাক হয়ে গেল, ‘কই, কাঁদছি কে বলল?’

দ্রুত পায়ে অর্ক বিছানা-ঘুরে মাধবীলতার ওপাশে হাঁটু গেড়ে বসল। তারপর আঙ্গুলের ডগায় গালের ভেজা জায়গা মুছে নিল, ‘চোখ থেকে জল বের হলে কান্না বলে।’

‘তুই কেমন আছিস?’

‘ভাল। আমি কখনও খারাপ থাকি না।’

‘তোর নাকি জ্বর হয়েছিল?’

‘ঠিক জ্বর নয়।’ তারপর অনিমেষের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি তো বলনি মাকে আজ দেখতে দেবে?’

‘আমি জানতাম না; এখানে এসে শুনলাম।’ অনিমেষের বলতে ইচ্ছে করছিল যে অর্কর আজই আসা উচিত হয়নি। আর একদিন রেস্ট নেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু কথাটা সে বলতে পারল না।

দুহাতে মাধবীলতার গলা গাল জড়িয়ে ধরেছিল অর্ক, ‘জানো, আমরা ভয় পেয়েছিলাম তুমি হয়তো বাঁচবে না।’

‘মেয়েদের কি অত সহজে মরণ হয়!’

‘কেন? মেয়েরা কি?’

মাধবীলতা হাসল, ‘পাগল! তোর চেহারা কি হয়েছে?’

‘যা ব্বাবা! নিজের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো। ফ্রক পরলে ক্লাশ সিক্সের মেয়ে মনে হবে। ওঃ, আমার আজ কি ভাল লাগছে না! হঠাৎ মনে হল আজ তোমাকে দেখতে পাব। মনে হতেই চলে এলাম।’

এই সময় নার্স এগিয়ে এল, ‘ব্যাস। আজকের মত ছেড়ে দিন ওঁকে। আর কথা বলবেন না।’

অর্ক উঠতে যাচ্ছিল। মাধবীলতা ওর হাত ধরল, ‘আর একটু থাক না।’

নার্স বলল, ‘না, থাকলেই কথা বলবেন।’

মাধবীলতা বলল, ‘না, কথা বলব না। শুধু একটু বসে থাকুক।’

‘ঠিক আছে। পাঁচ মিনিটের বেশী নয়।’

নার্স চলে গেলে অর্ক আবার বসল। তারপর ধীরে ধীরে মাধবীলতার কপালে গালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। অনিমেষের কিছুই করার নেই। সে অপলক এই দৃশ্য দেখছিল। সে নিজে কখনও মাধবীলতার এত কাছে যেতে পারেনি।

পাঁচ মিনিট হয়ে গেলে অর্ক কথা বলল, ‘তুমি তাড়াতাড়ি ফিরে চল। তোমাকে না পেলে আমার কিচ্ছু ভাল লাগে না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *