৫৭. ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের মেজাজ

ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের মেজাজ আজ সকাল থেকেই দুর্যোগপূর্ণ আকাশের মতন। মাঝে মাঝেই ঝলসে উঠছে ক্রোধের অশনি। বাড়ির লোকজনদের বকাবকি করছেন অহেতুক। এই সব দিনেই সবাই ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকে, শিশুরা পর্যন্ত শব্দ করে কাঁদে না।

বাড়িতে তিনি রুগী দেখেন না, ভবানীপুরে আলাদা চেম্বার আছে। সেখানে বেরুবার আগে, প্রাতরাশের টেবিলে কোনও খাবারই তাঁর পছন্দ হল না। টোস্টের রং কালো হয়ে গেছে বলে তিনি ছুড়ে ফেলে দিলেন, ওমলেট বেশি ঝাল তাই বাবুর্চির দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন তাকে ভস্ম করে ফেলবেন, মেটুলির তরকারি মুখে দিয়ে থুথু করতে লাগলেন অনেকক্ষণ ধরে। তাঁর স্ত্রী দরজার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ওসবের বদলে তাঁকে লুচি-মোহনভোগ করে দেওয়া হবে কি না।

মহেন্দ্রলাল স্ত্রীর দিকে ফিরে বললেন, ওসব তোমরা খাও, যত ইচ্ছে গাণ্ডেপিণ্ডে খাও, আমার জন্য ভাবতে হবে না।

দপদপিয়ে উঠে গিয়ে তিনি তাঁর সহকারীকে ডেকে বললেন, আজ আর চেম্বারে যাব না, তুই গিয়ে রুগীদের ফিরিয়ে দে। বলবি কাল আসতে। যার বেশি গরজ, সে যেন অন্য ডাক্তারের কাছে যায়।

তারপর নীচে নেমে এসে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে সহিসকে বললেন, সুকিয়া স্ট্রিটে চল!

শ্রাবণ মাস, প্রায় প্রতিদিনই বৃষ্টি হচ্ছে, কাল রাতে প্রবল বর্ষণ হয়েছিল, রাস্তাঘাট জলকাদায় মাখামাখি। বিশাল বপু, মহেন্দ্রলাল থ্রি পিস লুট পরে পা বসে আছেন গাড়িতে, পথের দিকে তাকিয়ে আছেন বটে, কিন্তু কিছুই দেখছেন না, তাঁর মুখমণ্ডল অসন্তোষের রেখায় কুঞ্চিত।

একসময় তাঁর গাড়ি এসে থামল প্রসিদ্ধ আইনজীবী দুর্গামোহন দাসের বাড়ির সামনে।

দুর্গামোহনকে শুধুমাত্র একজন সার্থক উকিল বলা ঠিক নয়, তাঁর অন্যান্য কীর্তির জন্যই তিনি বেশি বিখ্যাত। একসময় প্রেসিডেন্সি কলেজের বৃত্তি পাওয়া মেধাবী ছাত্র ছিলেন, এখন ওকালতিতে অর্থ উপার্জন করেন প্রচুর, কিন্তু তাঁর মতন অর্থের এমন সৎ-ব্যবহার করতে পারে কজন? বছর পনেরো আগে বরিশালে দুটি কায়স্থ বিধবার বিবাহের সব ব্যবস্থা করেছিলেন দুর্গামোহন, তা নিয়ে যে প্রবল আন্দোলন হয়েছিল, তা আজও অনেকের মনে আছে। পূর্ববঙ্গে তার আগে কোনও বিধবার বিয়ে হয়নি। সে জন্য বরিশালে কত উৎপীড়ন সহ্য করতে হয়েছে দুর্গামোহনকে, রাস্তায় লোকে তাঁকে তাড়া করেছে। অসীম সাহসী দুর্গামোহন তাতে একটুও নিরস্ত না হয়ে আর একটি চমকপ্রদ দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন সেখানে। পিতার মৃত্যুর পর দুর্গামোহন তাঁর বিধবা বিমাতারও বিয়ে দিলেন এক পরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে।

তারপর কলকাতায় এসে তিনি যে কত অনাথা, অসহায় নারীকে সাহায্য করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। তাঁর বাড়িতে এসে কেউ আশ্রয় চাইলে তিনি নিরাশ করেন না। মেয়েদের শিক্ষা ও স্বাবলম্বী করার জন্য তিনি অর্থব্যয় করেন জলের মতন। নিজের মেয়েকে তিনি মাদ্রাজে পাঠিয়েছেন ডাক্তারি পড়বার জন্য।

মহেন্দ্রলাল গাড়ি থেকে নেমেই ডাকতে লাগলেন, দুর্গা, দুর্গা?

দুর্গামোহন বাইরের ঘরে মক্কেল পরিবৃত হয়ে বসে আছেন। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কী ব্যাপার মহেন্দ্ৰদা, হঠাৎ এ সময়ে-

মহেন্দ্রলাল চোখ পাকিয়ে বললেন, এই লোকগুলিকে এখন বিদায় করে দাও। তোমার সঙ্গে আমার গুরুতর কথা আছে।

মক্কেলদের মধ্যে অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি রয়েছে, তাদের কি আর হুট করে চলে যেতে বলা যায়? দুর্গামোহন মৃদু হেসে তাদের অপেক্ষা করতে বলে মহেন্দ্রলালকে নিয়ে এলেন অন্য একটি বৈঠকখানায়। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কোনও খবর না দিয়ে ধন্বন্তরির অকস্মাৎ আগমন…এ বাড়িতে কারুর তো অসুখ-বিসুখ করেনি?

কোমরে দু হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে চোখ পাকিয়ে মহেন্দ্রলাল বললেন, কে বললে কারুর অসুখ করেনি? তুই-ই তো অসুস্থ! তোর চোখ-মুখ দেখেই বুঝতে পারছি তোর মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছে!

দুর্গামোহন হা-হা করে হেসে উঠলেন।

প্রচণ্ড এক হুঙ্কার দিয়ে মহেন্দ্রলাল বললেন, শালা, হাসছিস যে! বড় নির্লজ্জের মতন হাসছিস! তোর মেয়ে মাদ্রাজ থেকে ছুটিতে এসেছে, তুই নাকি তাকে আর ফেরত পাঠাবি না। আজ সকালবেলা আনন্দমোহন খবরটা দিল, তা কি সত্যি?

দুর্গামোহন হাসি থামিয়ে বললেন, বসো, দাদা বসো। হ্যাঁ, যা শুনেছ তা সত্যি। মেয়ে আর ফিরবে না। ওর আমি বিয়ে ঠিক করেছি।

মহেন্দ্রলাল এবারে যেন আরও ফেটে পড়লেন। বিস্ফারিত চোখে বললেন, বিয়ে! তুই তোর মেয়ের বিয়ে দিবি এখন? পাগল না হলে কেউ এমন কথা ভাবে।

মহেন্দ্রলালের কথা শুনলে সত্যিই হাসি সামলানো শক্ত। কিন্তু তাঁর মেজাজ এখন সপ্তমে চড়ে আছে। এখন তাঁর সামনে হাসা উচিত নয়। দুর্গামোহন মহেন্দ্রলালের হাত ছুঁয়ে বললেন, দাদা, তুমি এমন রেগে আছ কেন বলো তো? লোকে কি মেয়ের বিয়ে দেয় না? এতে পাগলামির কী আছে?

মহেন্দ্রলাল বললেন, লোকে যত ইচ্ছে মেয়ের বিয়ে দিক। যা খুশি করুক। তা বলে তুই তোর মেয়ের বিয়ে দিবি।

দুর্গামোহন বললেন, মেয়ের ষোল বছর বয়েস হয়ে গেছে কবে। তোমার ম্যারেজ অ্যাক্ট ভায়োলেট করছে না। এতে অন্যায়টা কী হল?

মহেন্দ্রলাল আবার ধমক দিয়ে বললেন, অন্যায় না? ঘোর অন্যায়! খবরটা শোনার পর থেকেই আমি আর সুস্থির থাকতে পারছি না। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। তোর মেয়ে কি পাঁচপেঁচি কোনও সাধারণ মেয়ে? কত চেষ্টা করে তাকে ডাক্তারি পড়ার জন্য ভর্তি করা হয়েছে। কলকাতায় নিল না, অবলাকে পাঠানো হল মাদ্রাজে। আমাদের কথা শুনে অবলা যেদিন মাদ্রাজে যেতে রাজি হল, সেদিন গর্বে আমার বুক ভরে গিয়েছিল। তোর মেয়ে যেন আমারও মেয়ে। মাদ্রাজে সে পড়াশুনো ভালই করছিল, আমি নিয়মিত খবর নিয়েছি। সাড়ে তিন বছর কাটিয়ে দিল, আর দুটো বছর কোনওক্রমে কাটালেই সে পুরোপুরি ডাক্তার হবে, তোমাদের সে ধৈৰ্যটুকু রইল না? এর মধ্যে তার বিয়ে দিতে হবে?

দুর্গামোহন বললেন, দেখ দাদা, তোমার আর শিবনাথ শাস্ত্রী মশাইয়ের আগ্রহেই আমি অবলাকে পাঠিয়েছিলাম। আর কোন বাঙালির মেয়ে একা অত দূর পড়তে গেছে বলো? কিন্তু ওখানে আমার মেয়ের মন টিকছে না। শরীরও ভালো যাচ্ছিল না। ওখানে খাওয়া দাওয়ার সুবিধে নেই। এখানকার মতন তারি-তরকারি পাওয়া যায় না। মাছ রাঁধতে জানে না। দুবেলা দুটি ডাল-ভাত-মাছের ঝোল না পেলে কি বাঙালির শরীর টেকে!

মহেন্দ্রলাল মুষ্টি উঁচিয়ে বললেন, তোর আমি মাথা ভাঙব! হাড় গুড়ো করে দেব! না, না, এ বিয়ে আমি কিছুতেই হতে দেব না। ডাল-ভাত-মাছের ঝোল? তোদের মুখে আগুন! সামান্য খাওয়া দাওয়ার চিন্তা করে এত বড় একটা সুযোগ নষ্ট করবে অবলা? আর দু বছর পর ফিরে এসে যত ইচ্ছে মাছের ঝোল খাক না! ওসব বাজে কথা, তোরা জোর করে মেয়েটার হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দিচ্ছিস!

দুর্গামোহন বললেন, অবলা নিজেই তো আর পড়তে চায় না।

মহেন্দ্রলাল বললেন, মিথ্যে কথা! মেয়ে একটু ঢ্যাঙা হতে না হতেই তার বিয়ের চিন্তায় বাঙালি বাপ-মায়ের ঘুম আসে না। বিয়েটাই যেন পরমার্থ! কোনওরকমে শ্বশুরবাড়ির হেঁশেলে তাকে ঢুকিয়ে দিতে পারলেই হল। আর দুটো বছর সবুর করতে পারলি না?

দুর্গামোহন বললেন, আমরা ব্ৰাহ্মসমাজে কন্যার মতামত না নিয়ে বিবাহের ব্যবস্থা করি না। অবলার এ বিবাহে স্পষ্ট সম্মতি আছে। পাত্র আর পাত্রী পরস্পরের সঙ্গে আলাপ পরিচয়ও করেছে। বিশ্বাস না হয়, অবলাকে ডাকছি, তুমি তার সঙ্গে কথা বলো-

ভেতরের উঠোনে গিয়ে অবলার নাম ধরে ডাকতেই সে নেমে এল। মহেন্দ্রলাল একটা কোচে বসে আছেন, অবলা গিয়ে প্ৰণাম করল পায়ে হাত দিয়ে। নম্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছেন জ্যাঠামণি!

মহেন্দ্রলাল অতি কষ্টে ক্ৰোধ সংবরণ করেছেন। এখন তার মুখে বেদনার ছায়া। অবলা যেন তাঁর নিজেরই হাতে গড়া এক আদর্শ। আত্মীয়-বন্ধুদের যাদের বাড়িতেই মেয়েদের লেখাপড়ার চর্চা আছে, স্কুলের ওপরের ক্লাসে যে সব কিশোরীরা পড়ে, মহেন্দ্রলাল তাদের কানের কাছে মন্ত্র দেন, ওরে পাশ করার পর তোরা ডাক্তারিতে ভর্তি হবি। এ দেশে যে একটিও মেয়ে ডাক্তার নেই! মেয়ে ডাক্তারের যে কত দরকার, তা কি তোরা নিজের চোখে দেখছিস না? কত মা, কত ভগিনী বিনা চিকিৎসায় কিংবা কু-চিকিৎসায় মারা যায়। অন্দরমহলে পুরুষ ডাক্তারদের প্রবেশ নিষেধ। আঁতুরঘরে জননীরা যে কী কষ্ট পায় তা অবর্ণনীয়। কত বাচ্চা যে মরে, কত জননীও যে প্রসবের পর অক্কা পায় তার ঠিক নেই। একমাত্র মেয়েরাই পারে মেয়েদের বাঁচাতে। তুই ডাক্তারি পড়বি তো?

অধিকাংশ মেয়েই এসব কথা শুনে ভয় পায়। মেয়েরা ডাক্তার হবে, এ কি সম্ভব নাকি? বাবা-মায়েরাও মনে করে, মহেন্দ্রলালের এসব কথা বাতুলতার সমান! মেয়েরা ডাক্তারি পড়বে পুরুষদের সঙ্গে গিয়ে? ক্লাসরুমে অধ্যাপক মানুষের শরীরের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ছবি দেখবে মেয়েদের সামনে? মেয়েরা ছুরি-কাচি ধরে মড়া কাটবে? উদ্ভট যত কথা!

অবলা রাজি হয়েছিল। কলকাতায় ভর্তি হতে পারেনি। মাদ্রাজে একা একা যেতেও ভয় পায়নি। সেই অবলা!

মহেন্দ্রলাল দেখলেন, মাদ্রাজ যাওয়ার সময় যে অবলা প্রায় একটি কিশোরী, এই ক বছরে সে বেশ ডাগর হয়েছে, সে এখন এক সলজ্জা যুবতী। খাওয়ায় দাওয়ায় কষ্টের কোনও ছাপ নেই তার শরীরে।

মহেন্দ্রলাল অভিমান ভরা স্বরে বললেন, আমি ভালো আছি মা। তুমি নাকি মাদ্রাজে ফিরবে না? ডাক্তারি পড়া শেষ করবে না?

অবলা বলল, হ্যাঁ, জ্যাঠামণি, ওখানে আর আমার ভালো লাগছে না।

মহেন্দ্ৰলাল বললেন, তোমার রেজাল্ট তো ভালোই হচ্ছিল। অ্যাপোথিকারিতে ভালো করছিলে বেশ-

অবলা বলল, ওখানে থাকার বড় অসুবিধে। মেলামেশার মতন লোক পাই না। অন্য মেয়েরা সব খ্রিস্টান, ওরা নিজেদের নিয়ে থাকে।

মহেন্দ্রলাল বললেন, এসব কি কোনও কথা হল মা! বিদ্যা শিক্ষার জন্য কত কষ্ট করতে হয়। আর দুটো বছর কাটিয়ে দিতে পারলে তুমি হতে বাঙালি মেয়েদের মধ্যে প্রথম পাস করা ডাক্তার। ইতিহাসে তোমার নাম থাকবে। আমাদের কাছে তুমি হবে গর্বের ধন। কত নারীর উপকার করবে তুমি।

অবলা বলল, আমি তো চেষ্টা করেছিলুম; জ্যাঠামণি। আমার দ্বারা ওসব হবে না। অপারেশন থিয়েটারে ঢুকলে আমার বমি বমি ভাব হয়।

মহেন্দ্রলাল বললেন, সার্জারির ক্লাস তো সবে শুরু হয়েছে। প্রথম প্রথম ওরকম হয়, আমাদেরও হয়েছে, তারপর কেটে যায়। যা না মা, কোনওরকমে আরও দুটো বছর কাটিয়ে পাস করে আয়। কলকাতা শহরে সভা ডেকে তোর সুখ্যাতি করব। যাবি? তোর বাবাকে বলে দে। বিয়ের জন্য এখনই ব্যস্ত না হলেও চলবে!

মহেন্দ্রলালের এ মিনতিপূর্ণ কথার কোনও ফল হল না। অবলা চুপ করে রইল। তার নীরবতাই অস্বীকার বুঝিয়ে দেয়।

মহেন্দ্রলাল জিজ্ঞেস করলেন, তুই বুঝি এখনই বিয়ে করতে রাজি হয়েছিস ; ডাক্তারি পড়ার চেয়ে বিয়ে করাটাই বড় হল?

অবলা নত নেত্ৰে লজ্জাশীলা নারীর মতন বাঁ পায়ের নখ দিয়ে মাটিতে দাগ কাটতে লাগল।

মুহূর্তে বদলে গেলেন মহেন্দ্রলাল। তিনি আবার রুদ্র মূর্তি ধারণ করে বিকট কণ্ঠে বললেন, তুই যদি আমার নিজের মেয়ে হতিস, তা হলে তোর দু গালে আমি থাবড়া মারতাম। যাঃ দূর হয়ে যা আমার চোখের সামনে থেকে। তোকে আর আমি দেখতে চাই না! আমাদের এত আশা সব বিফলে গেল!

দুর্গামোহন বললেন, দাদা, তুমি এত বকাবকি করছ, কেন? মেয়ের যখন বিয়ে ঠিক হয়েই গেছে, তুমি ওকে আশীৰ্বাদ করো।

মহেন্দ্রলাল বললেন, মোটেই আমি মিথ্যে আশীৰ্বাদ করতে পারব না। তোদের বাড়িতে জীবনে আর আমি পা দেব না। অসুখবিসুখ হলে কেউ যদি আমায় ডাকতে যায়, তাকে আমি ঠ্যাঙাব।

দুর্গামোহন বললেন, অবলা, তুই ভেতরে যা তো মা। দাদাকে আমি ঠাণ্ডা করছি। তুই ভালো দেখে সরবত দে। দাদা, তুমি সবরত খাবে তো?

মহেন্দ্রলাল বললেন, সরবত তোর ব্যাপকে খাওয়াগে যা শালা! সর, সরে দাড়া। আমি এখন যাব!

মহেন্দ্রলালকে যারা চেনে, তারা ওঁর এ ধরনের কথা গায়ে মাখে না। দুর্গামোহন হাসতে হাসতে দু হাত ছড়িয়ে বললেন, ইস, তোমাকে এখন আমি যেতে দিচ্ছি। আর কি এত সহজে! তুমি আমাকে এত কথা শোনালে, এবার আমি কিছু শোনাব না? বসো!

মহেন্দ্রলাল রক্তচক্ষে তাকিয়ে রইলেন।

দুর্গামোহন বললেন, দেখলেই তো, অবলা আর মাদ্রাজে ফিরে যেতে রাজি নয়। যদি সে ডাক্তার হওয়ার জন্য আরও দুবছর পড়াশুনো করতে চাইত, আমার আপত্তি ছিল না। মেয়ের ডাক্তার হওয়ায় যদি আমার আপত্তি থাকত, তাহলে কি তাকে মাদ্রাজে পাঠাতাম? এখন সে আর চাইছে না. বিয়ের যুগ্যি মেয়ে, তার বিয়ের ব্যবস্থা করা কি দোষের? অবশ্য এক্ষুনি বিয়ে হচ্ছে না। কথাবার্তা চলছে, হলে হবে সেই জানুয়ারি মাসে। দেরি আছে।

মহেন্দ্রলাল জিজ্ঞেস করলেন, পাত্রটি কে? নিশ্চয়ই বড়লোকের বাড়ির কোনও একখানা মর্কট!

দুর্গামোহন বললেন, তুমি আনন্দমোহনের শ্বশুরকে চেনো? স্বর্ণপ্রভার বাবা। উনি একসময় বর্ধমানের ডেপুটি ছিলেন। তারপর আসামে চায়ের ব্যবসা করতে গিয়ে অনেক কিছু খুইয়েছেন। আমাদের ঢাকার লোক, ভারী তেজস্বী পুরুষ। পূর্ববাংলায় ভগবান বোসকে অনেকে একডাকে চেনে। আমার অনেকদিনের সাধ, তাঁর সঙ্গে আমাদের পরিবারের একটা সম্পর্ক হোক। তিনি এখন ছেলের বিয়ে দিচ্ছেন, এ সুযোগ ছাড়ি কেন? ছেলেটিরও অবলাকে বেশ পছন্দ হয়েছে।

মহেন্দ্রলাল বললেন, ছেলে কী করে? বাপের টাকায় শখের পায়রা ওড়ায়?

দুর্গামোহন বললেন, ভগবানবাবুর তেমন কিছু টাকা পয়সা নেই। বরং বাজারে অনেক ঋণ আছে বলেই জানি। তুমি শুনলে আবার চটে যাবে, এ ছেলেটিও ডাক্তারি পড়তে পড়তে ছেড়ে দিয়েছে। পড়া শেষ করেনি।

মহেন্দ্রলাল বললেন, বা বা বা বা! এ যে দেখছি সোনায় সোহাগা! এও হাফ ডাক্তার, সেও হাফ ডাক্তার। দেব-দেবীকে মানাৰে ভালো। দূর দূর, এসব কথা শোনাও পাপ! যে-কোনও কাজ যারা মাঝপথে ছেড়ে দেয়, তাদের মুখে এই আমি লাথি মারি!

দুর্গামোহন বললেন, দাদা, শোনো পুরোটা শোনো! ছেলেটির নাম জগদীশ। সে ডাক্তারি পড়ার জন্য বিলেতে গিয়েছিল। কিন্তু তার কিছুদিন আগে আসামে বাঘ শিকার করতে গিয়ে কালাজ্বর বাধিয়ে বসে। সেই জ্বর নিয়েই তো জাহাজে চাপে। তারপর এমন ধুম জ্বর, যে বাঁচে কি মরে সন্দেহ। সেই অবস্থাতেও লন্ডনে পৌঁছে ডাক্তারি পড়ার জন্য ভর্তি হল। কিন্তু প্রায়ই জ্বরে ভোগে, ক্লাস করতে পারে না। তখন তার অধ্যাপকরাই বললেন, এই স্বাস্থ্য নিয়ে তুমি বাপু ডাক্তারি পাশ করতে পারবে না। তুমি অন্য কিছু পড়ো! তখন সে-

মহেন্দ্রলাল বললেন, বুঝেছি! সে ছোঁড়াকে দেখে অবলা মজেছে। সে হতভাগা ডাক্তারি পাশ করতে পারেনি, তাই অবলাও ডাক্তার হল না। পতির চেয়ে তার যোগ্যতা বেশি হয়ে গেলে শ্বশুরবাড়িতে হ্যাটা করবে, দেমাকি বলে গঞ্জনা দেবে, সেই ভয়ে-

দুর্গামোহন বললেন, এখনও শেষ হয়নি। জগদীশ ডাক্তার হতে পারেনি বটে, কিন্তু সে বিজ্ঞানের ডিগ্রি নিয়েছে। কেমব্রিজে বিজ্ঞান পড়তে গিয়ে সেখানকার জল হাওয়ায় তার কালাজ্বরও সেরে যায়। এখন ফিরে এসে সে প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞানের অধ্যাপক হয়েছে।

মহেন্দ্রলাল এবার নড়েচড়ে বসে বললেন, অ্যাঁ? কী বললি? বাঙালির ছেলে প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞান পড়াচ্ছে? সে তো সাহেবদের আখড়া! সাহেবরা ওকে ঢুকতে দিল।

দুর্গামোহন দুঁদে উকিল, বিরুদ্ধ পক্ষকে অগাধ জলে খেলিয়ে খেলিয়ে কী করে হঠাৎ ডাঙায় তুলতে হয়, তা তিনি জানেন। তুরুপের তাসটি আস্তিনে লুকিয়ে রাখতে পারেন অনেকক্ষণ।

মুচকি হেসে বললেন, তা হলেই বুঝে দেখ কী দরের ছেলে! কোনও বাঙালির ছেলে আগে বিজ্ঞান, তাও ফিজিক্স পড়িয়েছে? সাহেবরা কি সহজে জায়গা ছাড়তে চায়? সাহেবরা ভাবে বাঙালিদের একেবারেই বিজ্ঞান-বুদ্ধি নেই। তুমি যে বিজ্ঞান চর্চার জন্য এত চেষ্টা করছ, তারও কি ওরা মূল্য দেয়? এ ছেলেটির জন্য সুপারিশ কে করেছে জান, স্বয়ং বড়লাট লর্ড রিপন!

মহেন্দ্রলাল আবার চমকে উঠে বললেন, অ্যাঁ! বলিস কি!

দুর্গামোহন বললেন, তুমি তো ফাদার লাফোঁ-কে চেন। জগদীশ সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ফাদার লাফোঁর কাছে বিজ্ঞান পড়েছে। ফাদারের সে প্রিয় ছাত্র। বিলেত যাওয়ার সময় ফাদার তাকে কয়েকটি চিঠিপত্র দিয়ে দেন। আনন্দমোহনের সে শ্যালক, আনন্দমোহন, বিলেতে দুর্দান্ত রেজাল্ট করেছিল, এখনও অনেক অধ্যাপক তাকে চেনে। আনন্দমোহন জগদীশের হাতে একটা চিঠি দিয়েছিলেন অর্থনীতির বিখ্যাত পণ্ডিত ফসেট সাহেবের কাছে। ফসেট সাহেব এখন ওখানকার পোস্টমাস্টার জেনারেল, তাঁর অনেক ক্ষমতা। তিনি জগদীশকে অনেক সাহায্য করেছেন, নিয়মিত ওর খোঁজখবর নিতেন। এই ফসেটের বন্ধু আমাদের বড়লাট লর্ড রিপন। জগদীশ দেশে ফেরার সময় তার রেজাল্ট দেখে খুশি হয়ে ফসেট সাহেব তাকে একটা সার্টিফিকেট লিখে দিয়ে বললেন, তুমি রিপনের সঙ্গে দেখা করো গিয়ে। তোমার চাকরি-বাকরির কোনও অসুবিধে হবে না। লর্ড রিপনও জগদীশের কাগজপত্র দেখে, কথাবার্তা কয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি বাংলার শিক্ষা দফতরের কর্তাকে নির্দেশ দিলেন, অবিলম্বে যেন জগদীশকে উপযুক্ত কোনও চাকরি দেওয়া হয়।

মহেন্দ্রলাল বললেন, বড়লাট কোনও নেটিভের চাকরির জন্য সুপারিশ করেছেন এমন কথাও আগে শুনিনি।

দুর্গামোহন বললেন, এখনও শেষ হয়নি। তুমি তো জানোই, সিভিলিয়ান ইংরেজগুলো সব বাস্তু ঘুঘু! আমাদের তারা যেন মানুষ বলেই গণ্য করে না। শিক্ষা দফতরের বড় সাহেব হলেন স্যার অ্যালফ্রেড ক্রফট। সে ব্যাটা বলে কী, বাঙালিরা সংস্কৃত কিংবা দর্শন পড়াতে পারে বড় জোর, তারা আবার বিজ্ঞান পড়াবে কী? প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রিন্সিপাল চার্লস টনিও অরাজি। বড়লাটের নির্দেশ একেবারে অগ্রাহ্য করতে পারে না। তখন যেন দয়া করে বলল, ইম্পিরিয়াল সার্ভিসে চাকরি খালি নেই, প্রভিন্সিয়াল সার্ভিসে হতে পারে। তুমি তো জান প্রভিন্সিয়াল সার্ভিসে বেতন আর পদমর্যাদা দুটোই কম। বিলেত থেকে যারা পাস করে আসে, তারা সবাই ইম্পিরিয়াল সার্ভিস পায়। জগদীশ ওই ছোট চাকরি নেবে কেন? সে প্রত্যাখ্যান করে চলে আসে।

মহেন্দ্রলাল বললেন, বেশ করেছে! বাপের ব্যাপার মতন কাজ করেছে!

দুর্গামোহন বললেন, লর্ড রিপন কিন্তু ঠিক খেয়াল রেখেছিলেন। গেজেটে জগদীশের নাম ওঠেনি দেখে তিনি ক্রফটকে হুড়কো দিলেন! ক্ৰফট তখন তাড়াতাড়ি জগদীশকে ডেকে বললেন, ইম্পিরিয়াল সার্ভিসেই তোমাকে চাকরি দিচ্ছি, কিন্তু আপাতত টেম্পোরারি। আরও একটা কী দুষ্টুমি করল জানেন? একই অধ্যাপনার চাকরি। কিন্তু সাহেবদের তুলনায় জগদীশের মাইনে হবে কম। এক ইংরেজ যদি পায় তিনশো টাকা, জগদীশ পাবে দুশো। এখন অস্থায়ী বলে আরও কম, মোটে একশো! জগদীশ চাকরিতে জয়েন করল, পড়াতে শুরু করল, কিন্তু শিক্ষা দফতরকে জানিয়ে দিল, অন্য ইংরেজ অধ্যাপকদের সমান মাইনে না দিলে সে এক পয়সাও নেবে না। কয়েক মাস ধরে তো পড়াচ্ছে, কোনও বেতন নিচ্ছে না।

মহেন্দ্রলাল এবার উদ্ভাসিত মুখে বললেন, বাঃ বাঃ, এ যে হীরের টুকরো ছেলে? এমন পাত্র পাগল ছাড়া কেউ হাতছাড়া করে। দুর্গা, এক্ষুনি ওই জগদীশের সঙ্গে অবলার বিয়ে দাও! খুব ভালো, খুব ভালো! বাঃ বড় আনন্দ হল!

দুর্গামোহন বললেন, দাদা, আমি জানতাম, সব কথা শুনলে তুমি খুশি হবেই। তুমি তো ডাক্তার নও শুধু, তুমি বিজ্ঞানের পূজারী। জগদীশের সঙ্গে তোমার আগে যোগাযোগ হয়নি, ওর সব কথা জানলে তুমি অবশ্যই আশীৰ্বাদ করবে ওকে!

মহেন্দ্রলাল বললেন, আশীর্বাদ কী রে, তাকে আমি মাথায় নিয়ে নাচব। এ ছেলে যে আমাদের গর্ব। ওকে আমি আমার ইনস্টিটিউটে এনে বক্তৃতা দেওয়াব।

দুর্গামোহন বললেন, তাহলে অবলা কিংবা আমার ওপর তোমার আর রাগ নেই তো?

মহেন্দ্রলাল বললেন, রাগ নয় রে দুর্গা, সকালবেলা যখন খবরটা শুনি, তখন মনে বড় আঘাত পেয়েছিলাম। যেন আমার একটা স্বপ্ন ভেঙে গেল। অবলার ওপর বড় আশা করে ছিলাম, আমাদের দেশের প্রথম মহিলা ডাক্তার। এ দেশে জন্মের সময়ই কত শিশু মরে। যে কটা বেঁচে থাকে, সে নেহাত ভাগ্যের জোরে। মেয়েদের কোনও অসুখেরই তো ঠিকমতন চিকিৎসা হয় না। আমরা কি সব ব্যাপারে সাহেব মেমদের ওপর নির্ভর করে থাকব। ইওরোপ-আমেরিকায় অনেক মেয়ে ডাক্তারি পড়ছে, নার্সিং শিখছে। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল নামে এক বিবি ক্রিমিয়ার যুদ্ধে সেবার কী আদৰ্শই না দেখাল। কিছু মেম ডাক্তার-নার্স এদেশে আসছে এখন। ডাক্তারিতে মেয়েদের পড়াবার ব্যবস্থা অনেক লড়াই করে আদায় করা হয়েছে। শুধু ফিরিঙ্গি মেয়েরা পড়বে, আমাদের ঘরের লেখাপড়া জানা মেয়েরা কেন যাবে না।

দুর্গামোহন বললেন, সকলের তো রুচি সমান হয় না। অবলা পারল না, অন্য মেয়েরা পারবে। তোমার কাদম্বিনী তো পড়ছে। সে নিশ্চয়ই পাস করে বেরুবে।

মহেন্দ্রলাল বললেন, হ্যাঁ, কাদম্বিনী পড়ছে। তার ওপর আমাদের অনেক ভরসা। কিন্তু দেখে, কাদম্বিনীরও বিয়ে হয়ে গেছে, তার স্বামী দ্বারিকানাথ গাঙ্গুলি তো বউকে এখনও পড়াচ্ছে। অবলারও না হয় বিয়ে হল, তারপর জগদীশ ওকে আরও দু বছর পড়াতে পারে না?

দুর্গামোহন বললেন, সে তো আমি বলতে পারি না। জামাই যা ভাল বুঝবে, তার ওপর আমার জোর খাটানো সাজে না। দেখ দাদা, তুমি প্রথমে ভেবেছিলে আমি বুঝি কোনও ধনবানের সন্তানকে পাকড়াও করেছি। ওদের বংশ বেশ ভাল, কিন্তু ভগবানবাবুর টাকাপয়সা নেই, সাহেবদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যবসা করতে গিয়ে ঋণের জালে জড়িয়ে আছেন। জগদীশ তার একমাত্র ছেলে, সে চাকরি করছে বটে, কিন্তু মাইনে পায় না। তার আত্মসম্মান জ্ঞান টনটনে, আমার কাছ থেকেও কোনও সাহায্য নেবে না। বিয়ের পর ওদের সংসার কীভাবে চলবে কে জানে! এ সব জেনেশুনেও আমি মেয়ের বিয়ে দিচ্ছি।

মহেন্দ্রলাল উঠে দাঁড়ালেন। দুর্গামোহনের পিঠ চাপড়ে বললেন, আমি কি তোকে চিনি না? তোর মতন মানুষ কটা? আমি আজই যাচ্ছি, জগদীশকে একবার দেখব। তাকে বোঝাব, যাতে বিয়ের পরেও সে অবলাকে আরও দু বছর পড়ায়। বউ ডাক্তার হলে তাকে অনেক সাহায্য করতে পারবে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *