৫৭০-১৯৭০/১৪০০ বছর হজরত মুহম্মদ (দ.)-এর চতুর্দশ জন্মশতবার্ষিকী
হজরতের জন্মদিন নিয়ে বিস্তর আলোচনা, সবিস্তর তর্কাতর্কি মোটামুটি এই চোদ্দশো বছর ধরে চলছে, এবং চলবেও।
আজ ৪ জ্যৈষ্ঠ, ১৮ মে, শুক্লপক্ষের দ্বাদশী। আরবি চান্দ্রমাসের গণনায় আজ রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ। দ্বাদশ শব্দের ফারসি : দোওয়াজদহম। দো = দ্ব = দুই; দহম = দশম = দশ। অর্থাৎ দ্বিদশ। বলা হয়, হজরত মুহম্মদ এইদিন জন্মগ্রহণ করেন। তাই চান্দ্রমাস রবিউল আউয়াল-এর বারো তারিখকে বলা হয় ফহ্-ই-দো ওয়াজদহম্। দোওয়াজদহম্ শব্দের অর্থ এইমাত্র নিবেদন করেছি। ফহ্ শব্দের অর্থ জয়। এই আরবি শব্দটি আমাদের সম্পূর্ণ অজানা নয়। শিখেরা গুরুজিকি ফতেহ জয়ধ্বনি করেন; বাদশা আকবর নির্মিত ফতেহপুর সিক্রি অনেকেই দেখেছেন।
কবি মরহুম গোলাম মোস্তফা তাঁর বিশ্বনবী গ্রন্থে এই মত পোষণ করেছেন।
পক্ষান্তরে সুপণ্ডিত মরহুম মাওলানা মোহম্মদ আকরম খান তাঁর মোস্তফাচরিত গ্রন্থে বিস্তর গবেষণার পর সিদ্ধান্ত করেছেন, হজরতের জন্ম হয়, ৯ রবিউল আউয়াল; ১২ নয়।
কিন্তু বাঙলা দেশের জনসাধারণ, তথা উভয় বাঙলার সরকার মেনে নিয়েছেন যে হজরতের জন্ম হয় ১২ তারিখে। কিন্তু সেটা চাঁদ দৃশ্যমান হবার ওপর নির্ভর করছে। কাজেই কেউ কেউ ১৮ মে, অন্যেরা ১৯ মে হজরতের জন্মদিবস (ঈদ-ই-মিলাদ-উন-নবি; ঈদ = আনন্দদিবস, মিলাদ = জন্মক্ষণ ও-ল-দ ধাতুর অর্থ জন্ম দেওয়া, তার থেকে মওলিদ, মিলাদ, মওলু অনেক শব্দই প্রায় একই অর্থে এসেছে, এমনকি আরবের খ্রিস্টানরা বড়দিনকে বলে ঈদ, উল মিলাদ তাই পাঠক নির্ভয়ে আজকের পরবকে মিলাদ শরিফ–শরিফ = উচ্চ, সম্মানিত, ভদ্র মওলুদ শরিফ, ঈদ-ই মিলাদ যা খুশি বলতে পারেন। কিংবা পূর্বোল্লিখিত আরবি-ফার্সির সংমিশ্রণে ফ-ই-দোওয়াদহও বলতে পারেন।
নবী, পয়গম্বর, রসুল ইত্যাদি শব্দ একই ব্যক্তি, অর্থাৎ হজরতকে বোঝায়।
হজরতের জন্মদিন নিয়ে দেশের জনসাধারণ যা মেনে নিয়েছেন আমরাও তাই মেনে নিলুম। এখন প্রশ্ন তাঁর জন্ম কোন বৎসরে?
কেউ বলেন ৫৬০ খ্রিস্টাব্দ, কেউ বলেন ৫৬৯ খ্রিস্টাব্দ, কেউ বলেন ৫৭০ খ্রিস্টাব্দ।
মোদ্দা কথা এই : যখন কোনও মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেন তখন তো মানুষ জানে না, তিনি একদিন মহাপুরুষ রূপে আত্মপ্রকাশ করবেন। তদুপরি হজরত জন্মগ্রহণ করেন বিত্তহীন অনাথের গৃহে। সে-কালে মক্কা শহরে লেখাপড়ার খুব একটা চর্চা ছিল না (হজরতকে লেখাপড়া শেখাবার কোনও চেষ্টা তাঁর বাল্যবয়সে করা হয়নি; বস্তুত তিনি নিরক্ষর ছিলেন)– কে লিখে রাখবে তার জন্মদিন?
এটা শুধু হজরতের বেলায়ই নয়। বুদ্ধদেব, মহাবীর, জরথুস্ত্র, খ্রিস্ট এঁদের সকলেরই জন্মদিবস এমনকি জন্মবছর নিয়েও পণ্ডিতেরা আদৌ একমত নন।
হজরতের পরলোকগমন দিবস সম্বন্ধে কোনও মতানৈক্য নেই। তিনি মরধাম ত্যাগ করেন ৭ জুন, ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে। এবং হিজরি তারিখ অনুযায়ী ১২ রবিউল আউয়াল। অর্থাৎ তার জন্মদিন এবং মৃত্যুদিন একই দিবসে। এতে ভক্ত মুসলমান মাত্রই আল্লাহতালার অদৃশ্য অঙ্গুলিসংকেত দেখতে পান।
পূর্বেই নিবেদন করেছি হজরতের জন্মবৎসর ৫৬০, ৫৬৯, ৫৭০ বলা হয়। আমরা ছেলেবেলা থেকেই স্কুলে পড়েছি ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে। সেই জনমতই আমরা আবার মেনে নিলুম। এখন যাচ্ছে ১৯৭০। তা হলে এই বৎসর, এই মাসে, এই দিনে ইজরতের ১৪০০ জন্মদিন। তাই বহু মুসলমান এদিনটিকে বিশেষ সম্মান দেখাচ্ছেন। কিন্তু এখানে কিঞ্চিৎ মতভেদের সম্ভাবনা রয়ে গিয়েছে। মুসলমানদের বৎসর গণনা চন্দ্র নিয়ে। চান্দ্র বৎসর সৌর বৎসরের চেয়ে হ্রস্বতর। তদুপরি গণনাতে আরেকটা অসুবিধা আছে। মুসলমানদের বৎসর হিজরি, গণনা আরম্ভ হয় জুলাই ১৬, ৬২২ খ্রিস্টাব্দ। কিন্তু তার পূর্বে আরবরা বৎসর গণনা করত সৌর বৎসরে। হিসাব তাই কঠিনতর হয়ে যায়। এবং সর্বশেষ বিপদ, যে খ্রিস্টান ক্যালেন্ডার নিয়ে আমরা সন তারিখ গণনা করি তারও পরিবর্তন সংস্কার একাধিকবার হয়েছে।
অতএব এসব হিসাব আপনার-আমার মতো সাধারণ জনের কর্ম নয়। আমরা সরল বিশ্বাসী। স্কুলে পড়েছি ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে হজরত মুহম্মদের জন্ম হয়। আজ তার জন্মদিন। এবং উপস্থিত ১৯৭০। অতএব আজ তার ১৪০০ বৎসরের জন্মদিন। আজ আনন্দের দিন। ঈদের দিন। মুসলমান হিন্দু, খ্রিস্টান, জৈন, (মারওয়াড়ি) সক্কলকে মিষ্টান্ন বিতরণ করতে হয়।*
[*এই সামান্য লেখনটি লেখার উদ্দেশ্য : বহু হিন্দু এবং অনেক মুসলমান হজরতের জন্মদিন, পরলোকদিবস সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল নন বলে মনে মনে সঙ্কোচ বোধ করেন। পণ্ডিতরাই যে বিষয়ে মনস্থির করতে পারেননি, সে স্থলে আমাদের অযথা কুণ্ঠিত হওয়ার কোনও কারণ নেই।]