৫৬-৬০. সেদ্ধ ডিম

৫৬.

কাজটা দেখতে সামান্যই। সেদ্ধ ডিম কেটে দু-আধখানা করা। কিন্তু তার মধ্যেও যে কত কারিকুরি আছে সেটা অবাক হয়ে দেখছিল ধীরেন কাষ্ঠ। তার বউ একটা সুতো পায়ের আঙুলে চেপে হাত দিয়ে টান করে ধরে কত সাবধানে হিসেবনিকেশ করে ডিমগুলো কাটছে, একটু হেলদোল নেই, ডিম ছোট-বড় হচ্ছে না। ঠিক মাঝখানটা দিয়ে সুতোর করাতে ভাগ হয়ে যাচ্ছে ডিম। সূক্ষ্ম কাজ। বাহবা দেওয়ার মতো। শুধু কি তাই? সাদা সুতোটার গায়ে ডিমের কুসুম লেগে ভারী সুন্দর একটা রং-ও ধরে যাচ্ছে। রসস্থ মুখে বসে দেখছিল ধীরেন।

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। এ বাড়িতে আস্ত ডিমের চলনই উঠে গেছে। আধখানা বৈ পুরো আর পাতে পড়ে না। আধখানা ডিম এরা কী করে রাঁধে কে জানে। রান্নার সময় নাড়াচাড়ায় কুসুমটা বেরিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু যায় না। খোলর মধ্যে ঠিক আটকে থাকে। আধখানা ডিম রাঁধতেও মাথা চাই। হাতের কারসাজি চাই। এইসব প্রতিভা ছাড়া কি গরিবের চলে?

একটা ডিম ভাগ করে থালায় রেখেছে তার বউ। ধীরেন ডিম দেখছিল। তখনই লক্ষ করল ডিমটাও দেখছে তাকে। দু-আধখানা ডিম ঠিক একজোড়া চোখের মতো ভারী ফ্যাকাশে নির্বিকার চোখে একটা অপদার্থ লোককে চেয়ে দেখছে খুব। মাপজোক করছে, বুঝবার চেষ্টা করছে লোকটা কেমনধারা। ডিমের এই তাকিয়ে থাকা দেখে ভারী খুশি হচ্ছে ধীরেন। এও একটা ঘটনা। লোকে টেরই পায় না, এরকম কত ঘটনাই সবসময়ে ঘটে যাচ্ছে চারদিকে।

দিন দশেক হল চোখ খুলে গেছে ধীরেনের। আজকাল খুব দেখছে সে। কত রং, কত সূক্ষ্ম ঘটনা, কত শিল্প। ডান চোখের ছানি কাটিয়ে এল বর্ধমান থেকে। সেও এক অশৈলী ব্যাপার। ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। মানুষকে বড্ড প্রণাম করতে ইচ্ছে যায় ধীরেনের। মানুষ যে কী কাণ্ড ঘটাতে পারে তার কি লেখাজোখা আছে। তার আবছা ভাল চোখটায় কুটুস করে কী একটু করে দিল ডাক্তার, ব্যান্ডেজ খোলার পর ধীরেন অবাক। মরি মরি! সে যে একেবারে আদিগন্ত দেখতে পাচ্ছে। মানুষের এলেম কি কম? যত ভাবে তত মানুষের ওপর ভারী শ্রদ্ধা হয় তার।

অপারেশনের পাঁচদিন পর চেক আপ-এ গিয়েছিল ধীরেন। অল্পবয়সি ডাক্তারবাবুটি দেখে-টেখে বললেন, বাঃ, চোখ তো খুব ভাল আছে!

ধীরেন ডাক্তারবাবুটির মুখের দিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে আপ্লুত হয়ে তাকিয়ে ছিল। এরা কি আর মানুষ? এদের ভিতরেই ভগবান ভর করে আছে।

সে বলে ফেলল, ডাক্তারবাবু, আমি কি আপনাকে একটু প্রণাম করতে পারি?

ডাক্তার চমকে উঠে বলল, না না, সে কী? প্রণাম করবেন কেন? ছিঃ ছিঃ, আপনি পিতৃতুল্য মানুষ।

ধীরেন বলল, প্রণাম তো আপনাকে নয়, মানুষকে। মানুষ যে বড় ভাল ডাক্তারবাবু। মানুষ যে বড় ভাল।

ডাক্তার হাসল। বলল, তা তো ঠিকই। কিন্তু প্রণাম করার দরকার নেই। আপনি খুশি হয়েছেন, সেইটেই বড় কথা।

শুধু ডাক্তারবাবুটিই বা কেন? যারা নিজের খরচে তার অপারেশন করিয়ে দিল তারাই কি কিছু কম ভগবান? ট্যাঁকের পয়সা খরচ করে চোখ কাটানো তো সম্ভব ছিল না ধীরেনের।

চোখ খুলে যাওয়ায় এখন দেখার খুব নেশা চেপেছে ধীরেনের। খুব দেখছে চারদিক, মনের সুখে দেখে বেড়াচ্ছে। এই যে ডিমের দুখানা চোখ তার দিকে চেয়ে আছে এটাই তো চোখে পড়েনি এতদিন! ওই যে চৌকির নীচে ডাঁই করা কৌটোবাউটোর ভিতর থেকে একটা ইঁদুর তার ছুঁচলে মুখ বাড়িয়ে চারদিকটা দেখে নিচ্ছে এটাও কি এতদিন নজরে পড়েছে ধীরেনের! মুগ্ধ হয়ে ইঁদুরটার কাণ্ড দেখছিল ধীরেন। চারদিকে পুঁতির মতো চোখ দুটো দিয়ে দেখে নিচ্ছে। মুখখানা কী সুন্দর! কী নিষ্পপ! মুখ থেকে লেজের ডগা অবধি সৌন্দর্য উঁদুরের। লোকে তেমন লক্ষ করে না, করলে বুঝত এত সুন্দর জীব বড় বেশি নেই।

মোট ছটা ডিম কেটে বারো টুকরো করল তার বউ। একেবারে মাথা গুনতি হিসেব। এখন অনেকগুলো ডিমের চোখ তাকে দেখছে। আহা, দেখুক। তাকে তো কেউ বিশেষ চেয়ে দেখে না।

ওই যে তার বউ, এক ঘরে থাকে বটে, কিন্তু তাদের চোখে চোখে কদাচিৎ হয় কি হয় না। বেঁচে থেকেও কেমন করে যেন মানুষ একে অন্যের কাছে মরে যায়। ভেবে ভারী অবাক হতে হয় বটে।

এই যে মরে যাওয়াটা, এটা কিন্তু তেমন খারাপ লাগে না ধীরেনের। আসল মরার পর তো কিছু টের পাওয়া যাবে না। এই জীয়ন্ত মরার মধ্যে একটা মজা আছে কিন্তু।

এই যে চোখ কাটাতে বর্ধমান যাওয়া সেটাও ভারী মজার হল। লায়নস ক্লাব অপারেশনের তারিখ জানিয়ে চিঠি দেওয়ার পর ধীরেন সেটা প্রথমে তার বউ, তারপর দুই ছেলেকে জানিয়েছিল। কেউ যেন তেমন গা করল না। ধীরেনের ছানি কাটার ওপর তো দুনিয়ার কিছু নির্ভর করছে না। কিন্তু একজন সঙ্গীর দরকার ছিল। চিঠিতেও লিখেছে, একজন অ্যাটেনডেন্ট সঙ্গে আনতে হবে।

বউ শুনে বলল, আমার মাজায় যা ব্যথা। ছেলেদের বলে দেখ, ওরা যদি যায়।

বড় ছেলে সবে গ্রিলের একটা কারখানা খুলেছে বাড়িতেই। মহা ব্যস্ত। বলল, দেখছ তো ফুরসত নেই।

ছোট ছেলে এতদিন নেশাভঙের ব্যবসা করত। তারপর গাঁয়ের ভাল ছেলেরা জোট বেঁধে তাকে প্রথমে শাসায়, তারপর উস্তমকুস্তম পেটায়। বিজু ছিল তাদের নেতা। বিজুর ভয়েই এখন ওসব ব্যবসা ছেড়ে সে শাড়ির ব্যবসায় নেমেছে। বলতেই বলল, কালই আমি মংলা হাটে যাচ্ছি। সেখান থেকে শান্তিপুর।

জানাই ছিল। একটুও দুঃখ হল না ধীরেনের। জীয়ন্ত থাকতে থাকতেই নিজের মরাটা কেমন তা বেশ উপভোগই করছিল সে।

কথাটা লতায়পাতায় বেয়ে বেয়ে যার কানে পৌঁছল সে ধীরেনের কেউ নয়। তার গরজও থাকার কথা ছিল না। তবু বিজুই বলল, ভাবছেন কেন ধীরেনখুড়ো, আমি তো রোজ বর্ধমানে যাই। আমার মোটরবাইকের পিছনে চেপে যেতে পারবেন না?

শুনে একগাল হেসেছিল ধীরেন, মোটরবাইক! ওরে বাবা! সে তত বড় ভাল জিনিস! জীবনে কখনও চাপিনি। জন্মের শোধ একবার চেপে নিলে হয়। উরে বাবা, মোটরবাইক যখন ছোটে তখন যেন চারদিকের বায়ুমণ্ডলে একটা মন্থন হতে থাকে।

শুনে বিজু খুব হাসল।

 বিজুই নিয়ে গেল। আর সেই যাওয়াটার কথা মরণ অবধি মনে থাকবে ধীরেনের। কানমুখ ভাল করে ঢেকে নিয়েছিল বটে, তবু কী হাওয়া রে বাবা! আর কী স্পিড। এ যেন মাটির ওপর উড়ে যাওয়ার মতোই ব্যাপার। পড়ার মরার ভয় করেনি একটুও। তার মতো মনিষ্যির মরাই বা কতটুকু ঘটনা? উকুন মারার শব্দটুকুও হবে না। ভয় নয়, বরং ভারী অন্যরকম লাগছিল ধীরেনের। একটু দোল খেয়ে খেয়ে ডাইনে বাঁয়ে হেলে দুলে এরকম যাওয়া সে কখনও যায়নি তো। মানুষ যে কত কলই বানিয়েছে। কী যে আছে মানুষের মাথায় কে জানে বাবা! কী বুদ্ধি! কী বুদ্ধি! মানুষকে তার বারবারই প্রণাম করতে ইচ্ছে যায়।

বিজুই ছিল আগাগোড়া তার সঙ্গে। অপারেশনের পর বিকেলে যখন ছেড়ে দিল তখন বিজু বলল, মোটরবাইকে ঝাঁকুনি লাগতে পারে ধীরেনখুড়ো, চলুন আপনাকে গাড়ি করে নিয়ে যাই।

ধীরেন হাঁ করে থেকে বলল, না না বাবা, ওতেই হবে। গাড়ি যে অনেক পয়সা নেবে।

সেসব চিন্তা করতে হবে না। গাড়ি আমার মক্কেলের। আমি তাকে ফোন করে দিচ্ছি।

শেষ অবধি মারুতি গাড়িতেও চড়ল ধীরেন। নিজেকে রাজাগজার অধিক মনে হচ্ছিল তার। আনন্দে চোখে জল আসছিল।

তুমি অনেক করলে বাবা, আমার জন্য। কী যে বলি তোমাকে!

 দুর দুর! এসব তো আমাকে করতেই হয় খুড়ো। কতটুকু আর পারি।

 কথাটা ঠিক। বিজু মানুষের জন্য করে। সারা গাঁয়ে তার নামে একটা ধন্যি ধন্যি ভাব আছে।

কৃতজ্ঞতায় অভিভূত ধীরেন মারুতি গাড়ির ভিতর থেকে বাইরের দিকে একটা চোখে চেয়ে বুঝল জলে চোখটা আরও ঝাপসা হয়ে গেছে।

ইঁদুরটা আবার ঢুকে গেছে ভিতরে। চৌকির তলায় অন্ধকার জগতে ওদের দিব্যি থাকা। ওদের মতো যদি অন্ধকারেও দেখতে পেত ধীরেন আরও কত কী দেখা যেত!

উঠোনের ওধারে দুই বউয়ের মধ্যে একটা চাপা গলার ঝগড়া চলছিল কিছুক্ষণ ধরে। এবার সেটা তুঙ্গে উঠল। প্রায়ই হয়, চুলোচুলি অবধি গড়ায়। আর ভাষা যা ব্যবহার হয় তা কোনও ডিকশনারিতে পাওয়া যাবে না।

হঠাৎ তার বউ তার দিকে ফিরে বলল, শুনলে?

কী শুনব?

বড়বউ বলছে তারা নাকি বাড়ির সবটাই আমাদের কাছ থেকে কিনে নিয়েছে। আমাদের নাকি বের করে দেবে।

ও আর শুনে কী হবে?

ভাল করে খোঁজ নাও। গুণধর ছেলে কোনও বদমাশ উকিলের সঙ্গে সাঁট করে সত্যিই নকল দলিল টলিল কিছু বের করেছে কিনা। আজকাল বড়বউয়ের মুখে প্রায়ই কথাটা শুনছি। ছেলেকে জিজ্ঞেস করলে চুপ করে থাকে। কিন্তু তলে তলে কিছু একটা ঘোঁট পাকাচ্ছে নিশ্চয়ই।

ধীরেন একটু চিন্তিত হয়ে বলল, তাই কি হয়?

আজকাল সব হয়। মাস ছয়েক আগে একবার আমার কাছে বাড়ির দলিল চেয়েছিল। আমি দিইনি। কিছু একটা মতলব আঁটছে তখনই সন্দেহ হয়েছিল। গ্রিলের কারখানা খুলে এখন সাপের পাঁচ পা দেখেছে। কাঁচা টাকা আসছে তো হাতে।

ধীরেন উঠে পড়ল। আয়ুর আর কটা দিনই বা বাকি? মন ভারাক্রান্ত হয়ে থাকলে মূল্যবান সময় লোকসানে যাবে।

কোথায় চললে?

একটু ঘুরে-টুরে আসি।

সারাদিনই তো ঘুরছ। বলি এদিকটাও তো দেখতে হবে।

 ধীরেন তটস্থ হয়ে বলে, আমি দেখে কী করব? আমাকে কি কেউ মানে?

 তোমাকে মানে না, সে তোমারই দোষ। মানবে কী করে বলো তো! একটু মানুষের মতো হবে তো!

তা তো বটেই।

চুপ করে থাকে বলেই যে তুমি ভালমানুষ তা তো নয়। তোমাকে কি আমি আজকে চিনেছি? এত বড় শয়তান গোটা পরগনা খুঁজলে পাওয়া যাবে না। বাবা তোমার মধ্যে কী দেখেছিল বাবাই জানে।

এসব কথায় যে ধীরেনের রাগ হয় তা নয়। একসময়ে হত বটে, আজকাল আশ্চর্যের বিষয় এইসব গালমন্দের মধ্যে সে নিজেকে একটু একটু আবিষ্কারও করে ফেলে। সে কতখানি শয়তান তার খবর কিন্তু তার বউ রাখে না। ঘোর বর্ষার এক ভুতুড়ে দিনে তার হাতে খুন হয়েছিল মিদ্দার। ঠিক বটে, মিদ্দার খুন না হলে মিদ্দারের হাতে সে খুন হয়ে যেত। যেত তো যেত। তার পরেও এতগুলো বছর বেঁচে থেকে হল কোন অষ্টরম্ভা?

গলা দিয়ে যে এখনও তোমার ভাত নামে এতেই আশ্চর্য হয়ে যাই। নিজের ওপর ঘেন্নাও হয় না তোমার? গলায় দড়ি জোটে না? আবার গিয়ে চোখ কাটিয়ে এলে। বলি চোখ কাটিয়ে হবেটা কী? লেখাপড়া করে ব্যারিস্টার হবে নাকি বুড়ো বয়সে? নাকি পথে পথে ঘুরে ছুঁড়ি দেখে বেড়াবে!

বেশ বলছে কিন্তু। জিভের ধার আছে। কথাও গুছিয়ে বলে। এও এক প্রতিভা। শান পড়ে পড়ে আরও ধারালো হচ্ছে দিনকে দিন।

এবাড়ি সে-বাড়ি ঘুরে এঁটোকাঁটা খেয়ে বেড়াও, লজ্জাশরম নেই? বাসন্তীর মা এসে কত কুচ্ছো গেয়ে যায়। লজ্জায় মরি।

বাসন্তীর মা যে এবাড়িতে আসে তা জানে ধীরেন। কেন আসে তাও জানে। ধীরেন যে লজ্জা পাচ্ছে না তা নয়। বাস্তবিক লজ্জা করে বইকী! বাসন্তীর মা তো কত কথাই শুনিয়েছে আড়াল থেকে। কিন্তু কথাগুলো তাকে তেমন চিমটিও কাটে না। বরং সে কথাগুলো শুনে তারিফই করে। বেশ বলে লোকে। মানুষকে কেমন করে অপমান করতে হয়, কখনও সূক্ষ্মভাবে, কখনও স্থূলভাবে তাও কি একটা শিক্ষার বিষয় নয়? এই রণচণ্ডী মহিলা আজ যেমনই হোক, একদিন কিন্তু ভারী রসালো রকমের যুবতী ছিল। ঢলঢল করত। বউঠানের কাছে যেতে বুক ঢিপঢিপও করত একটু। তাকালে জীবন যেন ধন্য হয়ে যেত। ঠোঁট টিপে মাঝে মাঝে এমন মোহন হাসি হাসত যে সারাদিন ওই হাসি মনে পড়ত।

বলি বাড়িতে কি গেল না? সকালে গুচ্ছের বাসি রুটি না হয় মুড়ি তো দেওয়া হয়, নাকি? দুপুরে থালাভর্তি ভাত তো জুটছে। তবে কুকুরের মতো লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ল্যালানোর মতো রুচি হয়? লোকে কী বলে তা কি কানে যায় না? মানুষের চামড়া, না গণ্ডার?

ধীরেন একটু তটস্থ ভাব করে মাত্র। বউকে খুশি কবার জন্যই। নইলে বড়ই বেহায়া ভাববে।

বলি, মুখে কি পুলিপিঠে গুঁজে বসে আছ? বলবে তো কিছু?

 ধীরেন বেশ শ্রদ্ধার সঙ্গেই বলল, তা কী বলতে বলছ?

ওদের বাড়িতে যাও কেন? কোন মধু আছে ওখানে শুনি?

ধীরেন ভালমানুষের মতো বলে, না এমনি যাই না। বাঙাল ধরে নিয়ে যায় তাই যাই। বাসন্তীও শ্রদ্ধাভক্তি করে খুব। ওদের পাম্পটা সারিয়ে দিলুম তো সেদিন।

ওসব আমি জানি। ছোঁচার মতো বেহান হতে না-হতেই গিয়ে হানা দাও খাবারের লোভে। ছিঃছিঃ ঘেন্নায় মরে যাই। ঝাঁটা মারি অমন খাবারের মুখে। আর মাগীরও আস্পর্ধা কম নয়, বাড়ি বয়ে এসে বিষ উগড়ে গেল। বলি লোকে এত সাহস পায় কেন? তোমার মতো ঘাটের মড়ার জন্যই তো!

ওদিকে দুই বউয়ের ঝগড়া একেবারে উদারা-মুদারা-তারায় ঠেলে উঠছে। বাচ্চাগুলো তার মধ্যে ভেজালে পড়ে চিল-চেঁচানি চেঁচাচ্ছে। তার মধ্যেই কিল চাপড় মারার শব্দ হচ্ছে। সব মিলিয়ে ভারী একটা গোলমাল। যেমন কেত্তনের সময় খোল কত্তাল বাজে, এও যেন ঠিক তেমনি। অনেক চেঁচামেচি মিশে একটা শব্দের ঘ্যাঁট তৈরি হয়।

ঝগড়া শোর্না ধীরেনের পুরনো বাতিক। একটু বয়স হওয়ার পর থেকেই হয়েছে এই বাইটা। পথেঘাটে ঝগড়া লেগেছে দেখলে সে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে শোনে।

বউ ডিমের থালা নিয়ে উঠে গেল। এখন সেও গিয়ে আসরে নেমে পড়বে। দুই বউয়ের ঝগড়া লাগলে শাশুড়ির তাতে মুখ এঁটো না করাটা বোধহয় খারাপই দেখায়।

ঝগড়া শুনতে ধীরেন বারান্দায় এসে দাঁড়াল।

 খুড়া আছেন নাকি বাড়িতে? খুড়া!

 ধীরেন তাড়াতাড়ি বারান্দা থেকে নেমে একগাল হেসে বলল, বাঙাল যে!

 তড়াতড়ি লন তো খুড়া, আমাগো মিক্সিখান খারাপ হইছে। যন্ত্রপাতি লগে লইয়া লন তো।

 আহা, পরান মিস্তিরিকে ডেকে নিয়ে যাও না।

আরে ওইটা একটা পাঠা। বাসন্তী কয়, খুড়া হইল কলকবজায় ওস্তাদ। তারে ধইরা লইয়া আস গিয়া। চলেন চলেন, ভাল চিতল মাছ আনছি বৈঠকখানা বাজার থিক্যা। আইজ আমার বাড়িতেই দুফুরে দুইটা খাইবেন।

ধীরেন ফাঁপড়ে পড়ে বলে, খাবো!

 ক্যান, খাইবেন না ক্যান? খুড়িমারে কইতে হইব নাকি? উরেব্বাস, ঘরে তো কাইজ্যা লাগছে দেখি।

ধীরেন হেসে বলে, না বলতে হবে না। বলার কিছু নেই। চলো, যাচ্ছি।

 বাঙালের পিছু পিছু বেরিয়ে এল ধীরেন। না, তার লজ্জা করছে না তো!

মিক্সি তেমন জটিল যন্ত্র নয়। ধীরেনের বিদ্যের অকুলান হল না। যন্ত্রটা খুলে খুব যত্ন করে সারাল সে। একটা কানেকশনের অভাব ঘটেছিল। আধঘণ্টাতেই হয়ে গেল।

সকালে কী খাইছেন খুড়া?

ধীরেন হেসে বলল, খেয়েছি দুখানা রুটি আর গুড়।

 রামচন্দ্র! রুটি আর গুড় একটা খাদ্য হইল?

ধীরেন মাথা নেড়ে বলে, না হে বাঙাল, রুটি গুড় কিছু খারাপ জিনিস নয়। আখিগুড়ে একটা ভারী মিঠে গন্ধ আছে, রুটির সঙ্গে বনেও ভাল।

কী যে কন। গরমাগরম একটু হালুয়া খাইয়া জুইৎ কইরা বসেন। মুখ গুইজ্যা বাড়িতে বইয়া থাকেন ক্যান? বাড়িতে যত গুইজ্যা থাকবেন ততই অশান্তি। বউ বুড়া হইলেই খাণ্ডার।

ধীরেন তা জানে। খাণ্ডারকে সবাই ভয় খায়। ধীরেনও খায় বটে, তবে তার তেমন বিচলন হয় না। মিহিন মানুষ না হলে দুনিয়াটাকে বোঝাও যায় না কিনা। মাথা গরম হলে দুনিয়া আবছা হয়ে যায়। তখন মানুষ নিজের বিষে নিজেই জ্বলেপুড়ে মরে। ওতে লাভ হয় না কিছু। বরং জলের মতো মানুষ হওয়া ভাল।

হালুয়া এসে গেল। গরিব ঘরের কেলটি মার্কা জিনিস নয়। গাওয়া ঘিয়ের গন্ধ ছাড়ছে। কিসমিস কাজু গিজগিজ করছে।

কেমন খান খুড়া?

বাস রে! এ যে একেবারে দাঙ্গাহাঙ্গামা হে বাঙাল। এরকমও যে হয় জানতাম না।

যত গুড়, তত মিষ্টি, বুঝলেন খুড়া? যত মালমশলা ঠাসবেন ততই স্বাদ সোয়াদ পাইবেন।

 তাই নাকি?

আইজ্ঞা। খাওনের ব্যাপারে বাঙালের লগে কেউ পারব না। বাঙালরা আর কিছু না পারুক কাছা খুইলা খাইতে জানে।

শুধু খেতেই জানে না, খাওয়াতেও জানে।

ওই কথা কইয়েন না খুড়া, মাইনসে খায় নিজের কপালে।

হালুয়াই চেচেপুঁছে খেল ধীরেন। তারপর চা। লজ্জা হল না তো! লজ্জা-লজ্জা করছেও না তার।

চিন্তা কইরেন না খুড়া। মরণরে পাঠাইয়া দিছি, খুড়িমারে কইয়া আইতে যে আপনে আইজ দুফুরে এইখানে খাইবেন।

ধীরেন একটু ভাবল। আধখানা ডিম বরাদ্দ ছিল আজ। তার বাড়িতে ডিমের ঝোলে তেমন মশলাপাতি পড়তে পায় না। ট্যালট্যালে ঝোল হয়। তাও কিছু খারাপ লাগে না তার। সকাল থেকে ডিমের জন্য মনটা প্রস্তুত হয়ে ছিল বলে একটু খারাপ লাগল ধীরেনের। ভাগের ডিমটা ফাঁকই গেল আজ।

তার বদলে দুপুরে চিতলের পেটি ধীরেনের সব দুঃখ ভুলিয়ে দিল বটে, কিন্তু তবু খুব সূক্ষ্মভাবে একটা অভাববোধও কাজ করছিল। তার বরাদ্দ আধখানা ডিম কি তার জন্য অপেক্ষায় ছিল না!

কত কী চোখে পড়ছে আজকাল তার! চালে লাউডগার মধ্যে গা-ঢাকা দিয়ে থাকা কচি লাউ, ওই উঁচু আমগাছের জটিল ডালপালার মধ্যে একখানা মৌচাক। দোতলায় একটা দরজার ওপর একটা ঘোড়ার নাল লাগানো। কই, এসব তো এতদিন চোখে পড়ত না।

এই চোখেই ধীরেন বিকেলে কাঞ্জিলালের পোড়ো জমিটার ধারে একটা মেয়েকে একা বসে থাকতে দেখল। কী যে সুন্দর মেয়েটা! টকটক করছে গায়ের রং, তেমনি সুন্দর মুখের ডৌল। ভারী আনমনে বসে আছে।

ধীরেন দাঁড়িয়ে দূর থেকে দেখল। মেমসাহেব নয় তো!

একটু চেনা-চেনাও ঠেকছিল যেন! কে মনে পড়ছে না।

তারপর মনে পড়ল। এ তো মহিমার নাতনি!

 দেখেছে বটে, তবে আবছা চোখে এতদিন বুঝতেই পারেনি যে মেয়েটা এত সুন্দর।

এই যে এইসব সুন্দর ছেলেমেয়ে এরা যে কোথা থেকে আসে কে জানে! ওই যে ক্ষুরধার বুদ্ধির মানুষ, ওই যে রবি ঠাকুর বা আইনস্টাইন, কিংবা যে লোকটা এরোপ্লেন বানিয়েছে এরাই বা হয় কী করে? এই যে তারা কালো ময়লা খবঁটে হাঁদা মানুষ, সাহেবরা তো এমন নয়। তারা কেমন ফর্সা, তাগড়াই, বুদ্ধিমান মানুষ। এই যে এত তফাত এইটেই ভারী অবাক করে দেয় ধীরেনকে।

সন্ধের পর মহিম ঘরেই ছিল। সাড়া পেয়ে বলল, আয় ধীরেন।

ধীরেন ঢুকে দেখল, গরম চাদরে মুড়িসুড়ি দিয়ে মহিম রায় বসা।

আজ যা শীত পড়েছে, হাতে পায়ে যেন সাড়া পাচ্ছি না।

 ধীরেন বলল, তা পড়েছে।

তোর তো গায়ে তেমন কিছুই নেই দেখছি। ওই ছেঁড়া হাফ সোয়েটারে শীত মানে?

ধীরেন লজ্জা পেয়ে বলে, তা মানে।

বলিস কী?

ধীরেন বলল, শীত করতে করতে এক সময়ে আর করে না। এক জায়গায় থেমে যায়। শীতেরও তো ধৈর্যের শেষ আছে।

ভাল বলেছিস। চা খাবি?

 তা একটু হলে হয়।

ভুল বললুম। চা নয়, কফি।

 ও বাবা, সে তো তোফা জিনিস।

নাতনি এবার নিয়ে এসেছে আমার জন্য। একটা হিটার আর সসপ্যানও এনেছে। যা, ওই টেবিলে সব আছে। হিটার জ্বালিয়ে জল বসিয়ে দে তো।

বাঃ, এ তো দিব্যি ব্যবস্থা।

হ্যাঁ। নাতনি বলে, তোমার আর একটু ভাল থাকা উচিত।

 বলে বুঝি? দেখতেও হয়েছে মেমসাহেবের মতো। বিকেলে কাঞ্জিলালের মাঠে বসেছিল। যেন পদ্মফুল।

মেয়েও বড্ড ভাল। আগে একটু সাহেবি ভাব-টাব ছিল, এখন ঝরে গেছে।

দুজনে মিলে কফি বানিয়ে খেল। ধীরেনের সবই ভাল লাগে। কফিটাও লাগল। বেজায় ভাল জিনিস।

চোখটা কেমন আছে রে?

একগাল হেসে ধীরেন বলল, চোখের কথা আর কবেন না দাদা। এত দেখছি যে অবাক কাণ্ড! দেখে দেখে যেন আর কূল করতে পারছি না।

এত দেখতে দেখতেই ফিরছিল ধীরেন। রাত হয়েছে। চারদিকে কুয়াশা। তার ফাঁকেই চাঁদ উঠেছে ঠেলে। চারদিকে কুয়াশামাখা জ্যোৎস্না যেন দুনিয়া ছাড়া জিনিস। এরকম জ্যোৎস্না বিলেতে-টিলেতে ওঠে। এদেশের জিনিসই নয়।

আচমকাই যেন বাতাসে একটা ঢেউ দিয়ে কে যেন তার পাশে চলে আসে। পায়ে পায়ে চলে তার সঙ্গেও।

ধীরেন, মেরে ফেললি আমাকে?

সে কবেকার কথা, অত কি মনে রাখতে আছে দাদা?

 কিন্তু এখনও ব্যথা করে যে রে! এখনও যে দম বন্ধ হয়ে আসে।

ওসব বোলো না। তুমি কি কিছু কম করেছ?

করব না! আমার বউয়ের সঙ্গে নষ্টামি করলি, তাই তো ওকে মারলুম। আমার সংসার ভাসিয়ে দিলি তুই।

ও মেয়েছেলেকে কি সামলাতে পারতে মিদ্দার দাদা? ও ছিল কেউটে। সাপের মন্তর না জানলে কি বশ করা যেত ওকে?

.

৫৭.

একজন অন্ধ মানুষ নিশ্চিন্দিপুর যাবে বলে বেরিয়েছে, সঙ্গে একটা বাচ্চা ছেলে। তারা হাঁটছে আর হাঁটছে।

ও দাদু, আর কতদূর গো? বেলা যে মজে এল!

 ওরে, দূর বইকী! সোজা দূর! অনেক দূর চলে গিয়েছিলুম যে নিশ্চিন্দিপুর থেকে।

ওই যে একটু আগে চাষি লোকটা বলল, আর একটুকুন পথ! তা সেই একটুকুন পথ তো কখন ফুরিয়ে গেছে! তুমি তা হলে ছাড়িয়ে এসেছ নিশ্চিন্দিপুর। চোখে তো দেখতে পাও না, তাই বুঝতে পারোনি।

পাগল! তাই কখনও হয়! নিশ্চিন্দিপুর এলে আমি ঠিক বুঝতে পারব।

কী করে পারবে? নিশ্চিন্দিপুরের হাওয়াবাতাস কি অন্যরকম, নাকি তার কোনও আলাদা গন্ধ আছে? তুমি টের পাওনি।

তাই কি হয় রে! আমি নিশ্চিন্দিপুরে পা দিলেই পুরনো সব গাছপালা ফিস ফিস করে বলে উঠবে, ওই আমাদের অপু। নিশ্চিন্দিপুরের মাটি ঠিক বলে উঠবে, অপু এলি বাবা? বাতাসে মায়ের গায়ের গন্ধ পাবো ঠিক। বাবার কাশির শব্দ, দিদির কান্না সব এখনও নিশ্চিন্দিপুরের বাতাসে ঘুরে বেড়ায়। তুই বুঝতেও পারবি না সেসব। আমি কিন্তু ঠিক শুনতে পাবো।

ওরকম হয় নাকি! গাঁ কি কাউকে মনে রাখে! তোমার নিশ্চিন্দিপুর নিশ্চয়ই হেজেমজে গেছে। কেউ নেই সেখানে। আমাদের পটাশপুরে সেবার কলেরা হয়ে সবাই মরে গেল। গাঁ উজাড় হয়ে গেল। তারপর আগাছা হল, জঙ্গল হল, সাপ-খোপের বাসা হল।

বুড়ো লোকটা মাথা নেড়ে বলল, না, নিশ্চিন্দিপুর কখনও মরে না। ওটা এক আশ্চর্য জায়গা। যত দিন আমি আছি, ততদিন মরবে না। কোল পেতে বসে থাকবে আমার জন্য।

আমার যে খিদে পাচ্ছে দাদু, পা ব্যথা করছে।

খিদে! খিদের কথা বললি নাকি?

বললুম তো।

সেই খিদের গল্পই তো আমাদের সবার গল্প। সারা নিশ্চিন্দিপুর কেবল এক-পেট খিদে নিয়ে বসে থাকত। সকলের খিদে পেত, কেবল খিদে পেত। খিদে কিছুতেই মিটত না। আর ওই খিদে থেকেই তৈরি হত আমাদের গল্প। কত কত গল্প রে! বাঁচার গল্প, মরার গল্প। প্রেম ভালবাসার গল্প। সব কিছুর গোড়ায় ওই এক বাটি খিদে।

এক বাটি খিদে কী গো! খিদের কি বাটি থাকে?

থাকে রে থাকে। নিশ্চিন্দিপুরের যিনি ভগবান তিনিই গাঁয়ের মাঝ মধ্যিখানে কোথায় যেন খিদের বাটিটা লুকিয়ে রেখে দিয়েছিলেন। আর আমরা সারাদিন ধরে সেই বাটিটা খুঁজে বেড়াতাম। আজও তার সন্ধান মেলেনি। কিন্তু বাটি একটা ঠিকই আছে কোথাও।

হ্যাঁ দাদু, নিশ্চিন্দিপুরের ভগবানও কি আলাদা?

তা বইকী! সব জায়গারই আলাদা আলাদা ভগবান। যে যার নিজের ভগবান খুঁজে নেয়। ও তুই বুঝবি না।

ও দাদু, রোদে মাথা গরম হয়ে ভুল বকছ না তো!

ভুল! সেও কি আর বকি না! যত ভুল বকি, ভুল করি, ভুল পথে চলে যাই, চারদিকে কত ভুল কথা, ভুল কাজ, ভুল পথ। ভুল তো হতেই পারে। হ্যাঁ রে, গোরুর গলার একটা ঘণ্টি শুনলুম না!

হ্যাঁ তো।

ওটা আসলে কী যাচ্ছে রে! আমি একটা ছিলছিলে শব্দ শুনতে পাচ্ছি রে।

 ও বাবা, মস্ত একটা সাপ যে গো! দাঁড়াশ সাপ।

অন্ধ মানুষটি আনন্দে চিৎকার করে উঠল, ওই! ওই তো এসেছে আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে। চল চল, ওর পিছু ছাড়িস না। ওই নিয়ে যাবে নিশ্চিন্দিপুর।

খানিকক্ষণ তারা পড়ি কি মরি করে হাঁটল।

ধুস, সাপটা যে গর্তে ঢুকে গেল গো দাদু!

 ঢুকে গেল! তা হলে দাঁড়া। এইখানেই!

এইখানে কী?

এটাই নিশ্চিন্দিপুর। কী দেখছিস বল তো!

এ তো একটা মাঠ, আগাছার জঙ্গল! আর কিছু নেই।

 দূর বোকা! ভাল করে দ্যাখ। ওই বাঁদিকে তাকালে শিবমন্দির। সামনে ওই একটা দোতলা বাড়ি দেখছিস না, ওরাই নিশ্চিন্দিপুরের সবচেয়ে বড় মানুষ। আর ওই আশ-শ্যাওড়ার জঙ্গলটা দেখছিস, ওটা পেরোলেই মজা পুকুর। তার ডান পারে আমাদের বাড়ি। দেখ না ভাল করে।

ধুস! কোথায় কী গো!

ওই শুনছিস, কে যেন বলে উঠল, অপু এলি? শুনলি না।

না দাদু। আমার একটু ভয়-ভয় করছে।

বোকা ছেলে, ভয়ের কী? এবার বাতাসে কান পাত। গাছের পাতায় ফিসফিস শব্দ হচ্ছে, ওই আমাদের অপু!

তোমার মাথা ঠিক গরম হয়েছে দাদু।

না রে, না। আমি এসেছি বলে নিশ্চিন্দিপুরের আকাশে বাতাসে জলে স্থলে যে সাড়া পড়ে গেছে। সবাই কেমন খুশি, ডগমগ করছে টের পাচ্ছিস না?

আমি শুধু কাকের ডাক শুনতে পাচ্ছি গো।

 ভাল করে দেখ, সব আছে। সব ঠিক সেই আগের মতোই আছে। ভাল করে ঠাহর করে দেখ তো, একজন বুড়ো মানুষকে কোথাও দেখা যাচ্ছে কি না! অল্প অল্প খোঁচা খোঁচা দাড়ি, রোগা, চোখটা একটু ঘোলাটে, গাঁয়ে ছেঁড়া গেঞ্জি, পরনে হেঁটো ধুতি। দ্যাখ কোথাও গাছতলায় বসে আছে কি না, নয়তো কাঠকুটো কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে, কিংবা মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে আকাশ পানে চেয়ে আছে।

কেউ কোথাও নেই।

 তোর একদম চোখ নেই!

ওই বুড়োমানুষটা কে গো দাদু? কার কথা বলছ?

ওই হল নিশ্চিন্দিপুরের ভগবান। আমাদের গরিব গাঁ তো, তাই আমাদের ভগবানও বড্ড গরিব। ছেলেবেলায় কতবার তাকে দেখেছি।

কথা বলেছ?

না। কথা বলতে গেলেই একটু হেসে পালিয়ে যেত। তার ভয় ছিল আমরা পাছে নালিশ করি।

 কী নালিশ ছিল তোমার?

কত নালিশ! খিদের কথা, অভাবের কথা, আকালের কথা, রোগভোগের কথা, নির্যাতনের কথা। ভাল কথাও ছিল অনেক বলবার মতো। কী সুন্দর জংলা ফুল ফুটত, গাছে ফল হত, শরৎকালে কী সুন্দর আলো হত!

না গো, তোমার বুড়ো ভগবানকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তোমার ভয়ে সে তা হলে পালিয়ে গেছে।

না রে। সে পালাবে কোথায়? নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে সবাই চলে গেলেও তার যে পালানোর উপায় নেই। সে যে ঘুরে ঘুরে নিশ্চিন্দিপুরের ঘরে ঘরে কখনও দুঃখ, কখনও আনন্দ ছড়িয়ে দিয়ে আসে। সে কত কী চুরি করে নিয়ে চলে যায়, আবার কত কী পূরণও করে দিয়ে যায়।

এই খাড়া দুপুরে মাঠের মধ্যে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে গো দাদু? ফিরে চলো।

ফিরে যাবো? কী যে বলিস, তুই এখানে একটু দাঁড়া। আমি সবার সঙ্গে দেখা করে আসছি।

 কার সঙ্গে দেখা করবে! এ যে পতিত একটা জায়গা। কেউ কোথাও নেই।

ওই চোখ দিয়ে কি দেখা যায়? আমার চোখ হলে দেখতে পেতি।

 তুমি কী করে দেখছ দাদু? তুমি যে অন্ধ!

কে বলল আমি অন্ধ! আমি যে সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আজ। নিশ্চিন্দিপুরের ভগবান আজ আমাকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়েছে যে। বাতাসে বলে পাঠিয়েছে আজ তুই দেখতে পাবি। দাঁড়া না, একটু দাঁড়া। আমি দৌড়ে যাব, আসব।

বেশি দেরি কোরো না কিন্তু। দেরি দেখলে আমি ঠিক পালিয়ে যাবো।

তাই যাস। নিশ্চিন্দিপুর যদি আমাকে তার বুকের মধ্যে রেখে দেয় তা হলে তুই একা ফিরে যাস। অন্ধ মানুষটি এগিয়ে গেল। বড় আনন্দ, বড় চঞ্চলতা।

ছেলেটা দাঁড়িয়ে রইল। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। দাদু ফিরল না। আর ফিরল না। কোনওদিনই আর ফিরল না।

শোনো! একটা কথা বলছি।

অমল তার আচ্ছন্ন চোখ তুলে মোনার দিকে চাইল।

কিছু বলছ?

হ্যাঁ। কিছু যদি মনে করে তা হলে একটা কথা বলব?

অমল আজকাল তার বউয়ের সঙ্গে বাক্য ব্যবহারে সতর্ক হয়েছে। মাইন পাতা জমির ওপর দিয়ে যেমন পা টিপে টিপে হিসেব করে হাঁটতে হয় ঠিক তেমনভাবে। এই সতর্কতার সুফলও সে পায় আজকাল, ঠিক কথা, তাদের মধ্যে নতুন করে প্রেম জন্মায়নি, মানসিক দূরত্বও দুস্তর। কিন্তু আজকাল তারা মিলেমিশে থাকছে। এ ব্যাপারে মোনাও কি তারই মতো সতর্ক নয়? হ্যাঁ, হয়তো মোনাও দাম্পত্যটাকে অক্সিজেন দেওয়ার চেষ্টা করছে।

অমল অমায়িক হেসে বলল, কী ব্যাপার?

 আমাদের তো উইক এন্ড শেষ করে আগামীকাল কলকাতায় ফেরার কথা।

হ্যাঁ।

কিন্তু আমার একদম মনে ছিল না, আগামীকাল সকাল নটায় পার্ক স্ট্রিটে আমার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। ডাক্তার বিমল সেনের সঙ্গে।

অবাক হয়ে অমল বলে, ডাক্তার! ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট কেন! কী হয়েছে তোমার?

মোনা ম্লান একটু হেসে বলল, কাছে থেকেও তো আমার খোঁজ রাখো না। হয়েছে একটা কিছু। মেয়েলি ব্যাপার। বিমল সেন ভারী ব্যস্ত ডাক্তার। কালই বিদেশে চলে যাবে। অ্যাপয়েন্টমেন্টটা মিস করা চলবে না।

অমল মোনার দুটো বাহু দুই হাতে ধরে বলল, খুব গুরুতর কিছু নয় তো মোনা? সিরিয়াস কিছু নয় তো!

মোনা হেসেই বলল, তা কী করে বলব? তবে প্রবলেম একটা হচ্ছে।

অমলের মুখ শুকিয়ে গেল। ভালবাসা থাক বা না-থাক, সে কোনও জনকে হারাতে চায় না। মোনা ডিভোর্স করবে বলে হুমকি দেওয়াতেও তার ভুবন শূন্য হয়ে গিয়েছিল। বড্ড অসহায় লেগেছিল তখন। এখন আবার কী বিপত্তি হল কে জানে!

মোনা মায়াভরে একটু হেসে বলল, টেনশনের মতো কিছু হয়নি এখনও। ডাক্তার দেখালে ব্যাপারটা পরিষ্কার বোঝা যাবে।

তা হলে আমাদের তো আজই কলকাতায় ফেরা উচিত।

হ্যাঁ। তবে তাড়াহুড়ো নেই। সন্ধেবেলা রওনা হলেই হবে। গাড়িতে তো মোটে আড়াই ঘণ্টার রাস্তা। এখন তো সবে সকাল।

তা হলে বাসুদেবকে একটা ফোন করে দাও।

 ফোন করে লাভ নেই। আমাদের লাইনে কেবল ফল্ট হয়েছে। সাত দিনের ধাক্কা ধরে রাখো।

ঠিক আছে।

তোমার মন খারাপ হল না তো! উইকএন্ডটা এখানে এসে থাকতে তোমার ভাল লাগে।

না মোনা। মন খারাপ হবে কেন? একটা তো মোটে রাত। বরং তোমার কথা শুনে মনটা একটু আপসেট লাগছে।

মেয়ে একটু আপসেট হবে। সে তো এখানে এসে পিসি, পান্না, বড়মা এদের নিয়ে মজে থাকে। সি এনজয়েস হিয়ার ভেরি ম্যাচ।

প্রতি উইক-এই তো আসছি আমরা। ওটা কোনও ব্যাপার নয়। বুঝিয়ে বললেই বুঝবে। ওকে বলেছ তোমার অসুখের কথা?

না। কী জানি কেন, দেখেছি অসুখ শুনলেই সোহাগ কেমন নার্ভাস হয়ে যায়। বিশেষ করে আমার।

 শি লাভস ইউ।

এমনিতে তো আমি ওর চোখের বিষ। লোককে বলে, আমি এবং আমরা কেউ নাকি ওকে পছন্দ করি না, ঘেন্না করি।

সেটা ওর বুঝবার ভুল!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোনা বলল, ভুল বোঝার তো শেষ নেই। তবে আমাকে একটুও পছন্দ করে বলে মনে হয় না। কিন্তু অসুখ-বিসুখ করলে খুব ঘাবড়ে যায় দেখেছি। রীতিমতো আপসেট। তাই মনে হয় একটু মায়া হয়তো আছে।

অমল একটু হাসল মাত্র। বেশি ব্যাখ্যায় গেল না। সে দেখেছে বেশি ব্যাখা-ট্যাখ্যা করতে গেলেই নানা রকম অনভিপ্রেত কথার সৃষ্টি হয় এবং তর্ক ঝগড়া ঘুলিয়ে ওঠে।

অমল শুধু বলল, ঠিক আছে। বিকেল পাঁচটা ছটা নাগাদ বেরোলেই হবে। ফেরার পথে পার্ক স্ট্রিট বা কোথাও ডিনার সেরে নিয়ে বাড়ি ফিরব। কী বলে?

সেটাই ভাল। ওরাও চাইনিজ-টাইনিজ খেতেই ভালবাসে।

অপু তার নিশ্চিন্দিপুর খুঁজতে বেরিয়ে পড়ল। মোনাকে বলল, একটু ঘুরে আসছি। অপু তার নিশ্চিন্দিপুরকে কখনওই আর খুঁজে পাবে না, অমল তা জানে। একমাত্র অন্ধই খুঁজে পায়। সে তার মনের মধ্যে সব গড়ে নিতে পারে।

বিকেলে রওনা হল তারা। আসার সময় ড্রাইভার ছিল। কিন্তু সে থাকেনি। ছুটি নিয়েছে দুদিনের। তাতে অসুবিধে নেই। অমল ভালই চালায়। তবে অভ্যাস কম।

সোহাগ বলল, বাবা, পারবে তো!

খুব পারব।

বুডঢা বলল, দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে কিন্তু আমি চালাব বাবা।

 সেটা কি ঠিক হবে? তোর লাইসেন্স নেই।

তাতে কি? ওখানে পুলিশ-টুলিশ থাকে না। আর আমি তো ভালই চালাই।

ঠিক আছে। চালাস কিছুক্ষণ।

শুধু এ ব্যাপারে নিস্পৃহ রইল সোহাগ। সে যন্ত্রপাতি পছন্দ করে না তেমন। গাড়ি চালানোর আগ্রহ তার কখনওই হয়নি।

সে বলল, আজ আমরা কোথায় খাব বাবা?

তোরাই ঠিক কর না।

বুডঢা বলল, তোমরা যাই বলল, আমার ফ্যানটাস্টিক লাগে ধাবা। ধাবার রান্না খেলে অন্য কিছু মুখে লাগে না।

সোহাগ বলল, তোর ধাবা ভাল লাগবে না কেন, তুই তো একটা ছোটোলোক।

তুই খাসনি, তাই বলছিস।

যত তাড়াতাড়ি ফেরা যাবে ভেবেছিল তারা তত তাড়াতাড়ি হল না। ট্রাকের একটা লম্বা জ্যাম পেরোতে গিয়ে ঘণ্টা খানেক মার খেয়ে গেল। তাও নটার মধ্যে পার্ক স্ট্রিটে ঢুকে গেল তারা।

নিজের পরিবারটিকে এতকাল অনুভবই করত না অমল। কত ছাড়া ছাড়া ছিল তারা, কত আলগা ছিল সম্পর্ক। এখন ততটা নয়। কোনও না কোনও সূত্রে তারা একটু কাছাকাছি হচ্ছে। পরস্পরের সঙ্গে তাদের বাক্য বিনিময় একসময়ে এত কম ছিল যে, বোবার বাড়ি মনে হত। এখন ততটা হয় না। পরস্পরের মধ্যে একটা আনন্দিত হাই-হ্যালো সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। ঠিক বেঁধে ওঠেনি এখনও। তবু হচ্ছে। প্রগ্রেস ভালই।

বাবা, তুমি কি ড্রিংক করবে?

কেন রে? করলে আপত্তি আছে?

না। তবে গাড়ি চালিয়ে বাকি পথটা ফিরতে হবে তো!

মেয়ের দিকে চেয়ে হাসল অমল। তারপর হঠাৎ বলল, ঠিক আছে, আজ শুধু খাবারটাই খাই। দেখি হজম করতে পারি কিনা।

মোনা সামান্য আপত্তি করে বলল, তোমার পুরনো অভ্যাস। একদম ড্রিংক না করলে কি পারবে?

 চেষ্টা করা যাক। বলে হাসল অমল।

বুডঢা মন দিয়ে মেনু পড়ছিল। বলল, আমি কিন্তু একটা চিংড়ি খাবোই। আর চাওমিন, তোমরা?

সোহাগ বলল, আমার টেস্ট বাড চেঞ্জ করে গেছে। আজ বড়মা কচুর শাক বেঁধেছিল। সেটা খেয়ে এত মুগ্ধ হয়ে গেছি যে এসব আমার ভাল লাগবে না। জীবনে খাইনি ওরকম জিনিস।

মোনা অমলকে বলল, তোমার মেয়ে কিন্তু আস্তে আস্তে গেঁয়ো হয়ে যাচ্ছে।

তা যাচ্ছি। উচ্ছে চচ্চড়ি, চাপর ঘন্ট, খেজুর গুড় চালতা আর নারকোল দিয়ে অম্বল, পাটিসাপটা ইট ওয়াজ এ রিয়েল ট্রিট।

অমল স্নিগ্ধ চোখে তার পরিবারটিকে দেখছিল।

 হ্যাঁ গো, তুমি সত্যিই ড্রিংক করবে না?

না, আজ থাক। তেমন অসুবিধে বুঝলে বাড়িতে ফিরে শোওয়ার আগে একটু খেয়ে নেওয়া যাবে।

খেয়ে-দেয়ে বিল মিটিয়ে উঠতে রাত এগারোটার কাছাকাছি হল। বাড়ি ফিরতে সোয়া এগারোটা।

লিফটে ওপরে উঠে তার হ্যান্ডব্যাগ খুলে দরজার চাবি বের করল মোনা। বলল, হ্যাসবোল্ট দিয়ে না থাকলে বেচারাকে আর জাগানোর দরকার নেই।

হ্যাসবোল্ট দেওয়া ছিল না। চাবি ঘোরাতেই নিঃশব্দে দরজা খুলে গেল। বাঁদিকে পর পর দুখানা শোওয়ার ঘর দুই ভাইবোনের। ডানদিকে অমলের স্টাডি, হলঘরে মৃদু একটা বা জ্বলছে, আর পুরো ফ্ল্যাটটা অন্ধকার। বুডঢা আর সোহাগ তাদের ঘরে গিয়ে ঢুকল।

মোনা শোওয়ার ঘরের দরজায় চাবি দিয়ে খুলতে গিয়ে একটু থমকাল।

অমলের দিকে চেয়ে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ থাকতে ইশারা করে দরজায় কান পেতে কিছু শুনল।

তারপর ফিসফিস করে বলল, ভিতরে কারা আছে বলো তো!

অমল অবাক হয়ে বলল, কে থাকবে!

মেয়ের গলা শুনতে পাচ্ছি।

 মাই গড!

দেখ তো, প্যাসেজের ঘরে বাসুদেব আছে কিনা।

অমল গিয়ে দেখল, বিছানা ফাঁকা।

স্কাউড্রেলটা কি বান্ধবী নিয়ে তাদের ঘরে ফুর্তি করছে। সেটা কি সম্ভব? গত দু বছর ধরে আছে, বিশ্বাসী ভাল লোক বলেই তো বিশ্বাস ছিল তাদের।

মোনা তার হাতে চাবিটা দিয়ে বলল, দুজন আছে। ডুয়িং সামথিং… দরজাটা তুমিই খোলো।

বুডঢা তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।

এনিথিং রং ড্যাড?

কিছু সন্দেহ করে সোহাগও বেরিয়ে এল, কী হয়েছে মা? আমি দেখছি।

অমল চাপা গলায় বলল, তোরা ঘরে যা। বি অন দি সেফ সাইড। আমি দেখছি।

বুডঢা অবশ্য এগিয়ে এসে বলল, ইনট্রিউডার?

 তাই মনে হচ্ছে।

অমল দরজাটা খুলল না। নক করল।

ভিতরে কথাবার্তা থেমে গেল। একদম চুপ।

অমল ফের নক করে বলল, দরজা খোলো।

 কোনও কাজ হল না কথায়। অগত্যা অমল চাবি ঘুরিয়ে দরজাটা খুলে ফেলল।

ভিতরে আবছা আলোয় দুই নগ্ন নরনারী তাড়াতাড়ি তাদের পোশাক পরে নেওয়ার নিষ্ফল চেষ্টা। করছিল। অমল আলোটা জ্বেলে দিল।

দুটি নগ্ন নরনারী তাদের নগ্নতা ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা করতে গিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়াল।

 অমল দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে বলল, আপনারা পোশাক পরে বেরিয়ে আসুন।

মোনা বলল, কারা?

অমল একটা মাথা নাড়া দিয়ে বলল, ছেলেটাকে চিনি না। মহিলা ওপরের তলার সুহাস মজুমদারের বউ।

কে! পিউ?

 হ্যাঁ।

 সর্বনাশ! পিউ কী করছিল আমার ঘরে?

 ওকেই জিজ্ঞেস করো।

 ছিঃ ছিঃ। সেই জন্যেই আমার শোওয়ার ঘরে মাঝে মাঝে কন্ডোম পাওয়া যায়! ছেলেটা কে?

কী করে বলব? তবে ভদ্রলোকের মতোই তো চেহারা।

 সে ছেলেমেয়ের দিকে চেয়ে বলল, তোদের দেখলে লজ্জা পাবে। তোরা বরং একটু আড়ালে যা।

সোহাগ তেতো মুখে বলল, আমাদের ফ্ল্যাটে এসব কী হচ্ছে বলো তো! কেন এরকম হবে?

 অমল দাঁতে দাঁত চেপে বলল, বাসুদেব স্কাউড্রেলটাকে আজ রাতেই বিদেয় করে দেব বুঝলে?

মোনা বলল, বিদায় করব মানে? ওকে পুলিশে দেব। বুডঢা থানায় ফোন কর তো!

অমল বলল, প্লিজ! অতটা কোরো না। পুলিশ এলে বিচ্ছিরি লজ্জার ব্যাপার হবে।

 হোক। তা বলে ছেড়ে দেব? কোথায় গেল বলো তো! নীচে গিয়ে কোথাও আড্ডা মারছে হয়তো।

ধীরে দরজা খুলে মাথা নিচু করে দুজন বেরিয়ে এল। ছেলেটি লম্বা, ফর্সা এবং সুপুরুষ। মেয়েটিকে তারা সবাই চেনে, ওপরের তলার পিউ। চমৎকার ফিগারের জন্য তার প্রশংসা হয়ে থাকে।

কোথাও কিছু না, হঠাৎ বুডঢা একটু খাপ্পা হয়ে এগিয়ে এসে লোকটাকে ঠাস করে একটা চড় মারল।

লোকটা পালাল না। দাঁড়িয়ে একটু অবাঙালি টানে বাংলাতেই বলল, মারছেন কেন? আমি কী করেছি?

কিছু করনি!

অন্যায় কিছু করিনি। এবাড়ির কেয়ারটেকারকে নগদ একশো টাকা দিয়ে তবেই ঢুকেছি। এতে অন্যায়ের কী আছে?

.

৫৮.

লোকটার সাহস এবং স্মার্টনেস দেখে অবাক হন অমল। একজন সৎ ও সাহসী লোকের যে-গুণগুলো থাকে আজকালকার বদমাইশরাও কি সেইসব গুণ অর্জন করছে নাকি? অন্যের ফ্ল্যাটে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে ঢুকে অন্যের বিছানায় পরস্ত্রীর সঙ্গে ফুর্তি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে। পরিস্থিতি ওর সম্পূর্ণ প্রতিকূল। এই অবস্থায় লোকে ঘাবড়ে যায়, তোতলায়, উলটোপালটা মিথ্যে কথা বলে, হাতে পায়ে ধরে বা কাকুতি-মিনতি করে। এ তো অকুতোভয়, বিন্দুমাত্র ঘাবড়ায়নি এবং বেশ হিসেব করে তেজের সঙ্গে মুখে মুখে জবাব দিচ্ছে! এর তো পিঠ চাপড়ে দেওয়া উচিত।

আর একটা হতাশার চড় তুলেছিল বুডঢা, অমল গিয়ে তাকে আটকাল। বলল, এসব করা ঠিক নয়। ঘরে যা, আমি দেখছি।

বুডঢাকে না আটকালে বুডঢা হয়ত আবার মারত। সেটা বুদ্ধিমানের কাজ হত না। অবাঙালি ছেলেটা বুডঢার চেয়ে অনেক লম্বা এবং অ্যাথলেটিক চেহারার মানুষ। উলটে সে বুডঢাকে মারলে বিপদ ঘটবে। মারপিট ব্যাপারটা অমল একেবারেই সহ্য করতে পারে না।

স্কাউলে! ইতর! বদমাশ! বলে গালাগাল দিতে দিতে বুডঢা গিয়ে তার ঘরে ঢুকে একটা বেসবল ব্যাট হাতে করে বেরিয়ে এল।

লোকটা অমলের দিকে সটান তাকিয়ে বলল, আপনার ছেলেকে ঝামেলা করতে বারণ করুন। আই অ্যাম সরি। আমি জানতাম এ-ফ্ল্যাট এসব কাজে ভাড়া দেওয়া হয়।

অমল শান্ত থাকার চেষ্টা করছিল, কিন্তু উত্তেজনায় তার গলা কাঁপছে এবং স্বরভঙ্গ হয়ে যাচ্ছে। সে বলল, আপনি এই ফ্ল্যাটে আগেও এসেছেন?

তিন চারবার।

আমি যদি পুলিশ ডাকি?

ছেলেটা অসহায়ভাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ডাকলে ডাকবেন। কী আর হবে বলুন, পুলিশ কিছু টাকা খাবে। তার চেয়ে ইফ ইউ ওয়ান্ট মানি, আই শ্যাল পে ইউ। কেন ওসব ঝামেলায় যাবেন? এটা ফ্যামিলি অ্যাপার্টমেন্ট জানলে আমি আসতাম না।

এ-ফ্ল্যাটের সন্ধান আপনাকে কে দিয়েছে?

উনি। বলে পিউকে ইশারায় দেখিয়ে দিল।

 পিউ বেরোতে পারেনি, কারণ, বুডঢা দরজাটা আটকে দাঁড়িয়েছিল তখন থেকে। সে দেওয়ালের দিকে সরে গিয়ে নতমুখে দাঁড়িয়ে আছে। চুপচাপ।

এবার মোনা তাকে জিজ্ঞেস করল, এসব কী পিউ?

 আই অ্যাম সরি বউদি। এক্সট্রিমলি সরি।

সে তো বুঝলাম। কিন্তু সরি বললেই তো হল না। তুমি কী কাণ্ড করছ তা তুমি জানো?

আমি পরে এসে আপনাকে সব বুঝিয়ে বলব। প্লিজ, এখন এটা নিয়ে চেঁচামেচি করবেন না।

মোনা অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে বলল, পিউ, তোমার একটা পাঁচ বছর বয়সের মেয়ে আছে। তুমি একজন হাউজওয়াইফ। এই লোকটাকে কোথা থেকে জুটিয়েছ?

আপনাকে পরে বলব বউদি।

তুমি যেমন মেয়েই হও তাতে আমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু ওসব নোংরামি আমার ফ্ল্যাটে কেন?

পুজোর সময় আপনারা অনেকদিন ছিলেন না। তখন বাসুদেব

ফ্ল্যাট খালি ছিল বলেই সেটাকে অপবিত্র করতে হবে? তোমার বিবেক কি তাই বলে?

পিউ আর কথা বলল না। চুপ করে নতমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

মোনা অমলের দিকে চেয়ে বলল, তুমি থানায় ফোন করে দাও। পুলিশ এসে যা করার করুক।

এতক্ষণ বাদে হঠাৎ সোহাগ বলল, আমাদের ফোন তো ডেড।

তাহলে বুডঢা, তুই যা তো দারোয়ানদের ডেকে আন।

স্মার্ট ছেলেটা মোনার দিকে চেয়ে বলল, ম্যাডাম, ব্যাপারটা এত বেশি সিরিয়াসলি নিচ্ছেন কেন? আমি কলকাতায় একা থাকি। আই নিড গার্লফ্রেন্ডস।

তার জন্য তো হোটেল আছে, গেস্ট হাউস আছে, ব্রথেলস আছে। আমার ফ্ল্যাটে কেন, উড ইউ এক্সপ্লেন?

প্লেসটা মেয়েরাই ঠিক করে। ওটাই সিস্টেম। আপনার ফ্ল্যাটে আসাটা আমার ভুল হয়েছে বুঝতে পারছি। আমি বরং কিছু টাকা দিয়ে যাচ্ছি ফর এনি ড্যামেজ আই হ্যাভ ডান। লেট আস মেক পিস। ফাইফ থাউজ্যান্ড ম্যাডাম? ইজ দ্যাট ওকে?

এবার বেসবল ব্যাটটা নিয়ে আর একবার এগিয়ে এল বুডঢা। তাকে ফের ঠেকিয়ে অমল বলল, আপনার নাম কী?

অরুণ মালিক। বিজনেসম্যান। আমার কার্ডটা রেখে দিন বরং। নাথিং টু হাইড অন মাই সাইড। আমি পাটনার লোক। কলকাতায় মাসে দু-চারবার আসতে হয়।

ফুর্তি করতে নাকি?

না স্যার। বিজনেসে আসি।

ছেলেটা তার দামি ওয়ালেট খুলে একটা সুদৃশ্য কার্ড বের করে অমলের হাতে দিয়ে বলল, আই অ্যাম এ জেনুইন পারসন। নট এ ফ্রড। ইচ্ছে করলে আমার মোবাইল ফোন-এ আপনি পাটনার নম্বর ডায়াল করে জেনে নিতে পারেন।

আপনি ম্যারেড?

না স্যার। আমি এখনও ব্যাচেলর। পুলিশ ডেকে যদি ধরিয়ে দেন তাহলেও আমার কিছু হবে না। পুলিশ টাকা পেয়ে ছেড়ে দেবে, কেস দেবে না। তার চেয়ে আমি ফাইভ থাউজ্যান্ড অফার করেছি, প্লিজ হাস ইট আপ।

অমলের খুব ক্লান্ত লাগছিল। আজ সে অনেকক্ষণ টানা গাড়ি চালিয়েছে। চাইনিজ ডিনারটাও বেশি খাওয়া হয়ে গেছে। ঘুম পাচ্ছে। সে মোনার দিকে চেয়ে বলল, কী করবে মোনা?

তুমি কী করতে চাও?

বুঝতে পারছি না। এরকম অদ্ভুত সিচুয়েশনে তো পড়িনি কখনও।

ছেড়ে দাও। কিন্তু কাল সকালেই মিস্টার মজুমদারকে তুমি নিজে গিয়ে ব্যাপারটা জানাবে।

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।

এরপর লোকটার দিকে চেয়ে অমল বলল, নাউ ইউ মে গো।

হিপ পকেট থেকে একগোছা পাঁচশো টাকার নোট বের করেছিল ছোকরা। অমল সেদিকে তাকিয়ে বলল, আপনি খুব টাকায় বিশ্বাসী, না?

ছোকরা থমকে গিয়ে বলল, না স্যার, ব্যাপারটা ওভাবে নেবেন না। আই অ্যাম জাস্ট ট্রায়িং টু কমপেনসেট।

আপনার কি মনে হয় আমরা যে-শকটা পেয়েছি তা টাকা দিয়ে কমপেনসেট করা যাবে? বিশেষ করে আমাদের ছেলেমেয়েরা যে-শকটা পেয়েছে?

আই অ্যাম রিয়েলি সরি স্যার। ভেরি সরি।

 টাকাটা পকেটে রেখে দিন। অ্যান্ড প্লিজ গেট আউট।

ইয়েস স্যার। অ্যাজ ইউ প্লিজ।

 মোনা পিউয়ের দিকে চেয়ে বলল, তুমিও যাও।

মোনা আর অরুণ দুজনে দরজার দিকে নিঃশব্দে এগোল। দরজার কাছ থেকে ফিরে অরুণ হঠাৎ বলল, স্যার, যদি কিছু না মনে করেন তবে একটা কথা বলব?

কী?

শুনলাম আপনাদের ফোনটা খারাপ আছে। আপনি ইচ্ছে করলে আমার মোবাইল ফোনটা রেখে দিতে পারেন। রোমিং সিম কার্ড লাগানো আছে। আমার আরও দুটো মোবাইল ফোন আছে, কোনও অসুবিধে নেই। কয়েকদিন কাজ চালিয়ে নিন, আমি কাল সকালে চার্জারটা পাঠিয়ে দেব।

না, আমার মোবাইল ফোনের দরকার নেই।

রেখে দিন স্যার। আমি কয়েকদিন পরে এসে নিয়ে যাব।

না, আমি আর আপনার মুখ দেখতে চাই না। প্লিজ গো।

অ্যাজ ইউ প্লিজ, বলে ছোকরা বেরিয়ে গেল। পিছু পিছু পিউ।

বুডঢার মুখ রাগে ফেটে পড়ছিল। বলল, তোমরা লোকটাকে ছেড়ে দিলে বাবা? ধোলাই দেওয়ার দরকার ছিল।

কী লাভ? একটা সিন ক্রিয়েট করা হত। লোকটা বদমাশ, কিন্তু ওর চেয়ে বাসুদেব বেশি ক্রিমিন্যাল। আর এই পিউ।

সোফায় বসে মোনা ক্লান্ত স্বরে বলল, আমার শরীর ভীষণ খারাপ লাগছে। বোধহয় প্রেশার বেড়ে গেছে।

সোহাগ গিয়ে তার মায়ের পাশে বেড়ালের মতো গুটিসুটি হয়ে বসে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, চলো আমার বিছানায় একটু শুয়ে থাকবে। ইউ লুক সিক!

ঘেন্নায় গা রি রি করছে। এই বেডরুমে আজ আর আমি ঢুকতেই পারব না। মা গো! কী জানোয়ার হয়ে গেছে মানুষ! আমি এখনও বুঝতে পারছি না, পিউ এরকম কাজ কী করে করতে পারে। দেখা হলে এমনিতে তো কত ন্যাকা ন্যাকা কথা!

এসব নিয়ে এখন ভাবতে হবে না। একটা সেডেটিভ খেয়ে শুয়ে থাকো। টেক রেস্ট।

 মোনা উঠে অমলের দিকে চেয়ে বলল, বাসুদেব এখনও ফিরল না। ও ফিরলে আমাকে ডেকো তো।

অমল বলল, বাসুদেবের ফেরার চান্স খুব কম। আমরা যে এসে গেছি তা ও হয় দারোয়ানদের কাছে জেনে যাবে না হয় তো গ্যারাজে গাড়ি দেখে বুঝবে। সুতরাং হি উইল স্ক্র্যাম।

কী সাংঘাতিক শয়তান বলো তো!

তাই তো দেখছি।

তুমি বরং বাইরের ঘরে সোফাতেই শুয়ে রাতটা কাটিয়ে দাও। কাল বেডরুম ভাল করে ডেটল ফিনাইল দিয়ে পরিষ্কার না করিয়ে ও-ঘর আমি ব্যবহার করব না। ওয়াশিং মেশিনে চাদর বালিশের ওয়াড় সব কাঁচতে হবে।

হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে। তুমি সোহাগের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে থাকো।

মোনা সোহাগের ঘরে গিয়ে শুল।

বুডঢা বলল, বাবা, সোফায় বরং আমি শুচ্ছি, তুমি আমার বিছানায় শুয়ে থাকো।

আরে না। আমার ঘুম চটে গেছে। আমি বরং বসে একটু বই-টই পড়ি, তুই শুয়ে পড় গিয়ে।

সবাই শুয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে পড়ল বোধহয়।

একা অমল বাইরের ঘরে সোফায় অনেকক্ষণ বসে রইল। নৈতিক অধঃপতনের কথাই ভাবছিল সে। অনেক বছর আগে সে কি ওই অরুণ মালিকের চেয়ে উচ্চতর মানুষ ছিল? এক দুরন্ত দুপুরের স্মৃতি যেন হাউড় বাতাসের মতো ধেয়ে এসে তার শ্বাসনালি আটকে দিচ্ছিল। তার হাতে একটি প্রস্ফুটিত ফুল্ল কুসুম ঝরে পড়ে গিয়েছিল। এক সুন্দরকে মলিন করে দিয়েছিল সে।

পতিতাগমনের অভ্যাস তার তৈরি হয়েছিল ইনজিনিয়ারিং পড়ার সময়েই। তারপর পারুল তাকে প্রত্যাখ্যান করায় প্রতিহিংসায় পাগলের মতো হয়ে সে আরও ভেসে গিয়েছিল। আজ মধ্যবয়স্ক, শান্ত ও নির্জীব বটে সে, কিন্তু অনেক প্রায়শ্চিত্তই তার বাকি।

তার কাল অতিক্রান্ত। অরুণ মালিকের মতো এ-যুগের লম্পটরা লুকোছাপার ধার দিয়েও যায় না। তাদের গোপন করার মতোও কিছু নেই। ধরা পড়লেও তারা চোখে চোখ রেখে দিব্যি ঠান্ডা মাথায় কথা কইতে পারে। এ-বিদ্যে অমলের নেই। আজ একটি ঘটনার গ্লানি তার গায়ে এঁটেল মাটির মতো লেগে আছে।

জেনারেশন গ্যাপটা বড় বিশাল। মাত্র কুড়ি বছরের তফাতে এ-দেশের মানুষ কত পালটে গেছে।

তার অন্যমনস্কতার সুযোগে চোখের সামনেই মানুষ কতটা পালটে গেছে তার প্রমাণ অমল পেল পরদিন সকালে।

পিউয়ের স্বামী সুহাস মজুমদার একজন চোখা চালাক মধ্য ত্রিশের লোক। বেশ স্মার্ট হাসিখুশি। ওদের ফ্ল্যাটে প্রায়ই পার্টি-টার্টি হয়। তার একটা কনসালটেনসি ফার্ম আছে বলে অমল জানে। তবে সেটা কীসের কনসালটেনসি তা জানা নেই। একখানা ফিয়াট গাড়ি আছে। সুতরাং পয়সাওলা লোক বলেই মনে হয়। এইসব তথ্য দিয়ে একটা মানুষ সম্পর্কে কোনও অঙ্কই মেলানো যায় না।

অঙ্কটা আজ সকালে আরও বিপথে চলে গিয়ে গোলমেলে হয়ে দাঁড়াল।

অমল মুখোমুখি সুহাসকে ব্যাপারটা বলতে সংকোচ বোধ করছিল বলে সকালে কাছে-পিঠের একটা বুথে গিয়ে ফোন করল।

সুহাসের আহ্লাদিত গলা বলে উঠল, হেল্লো! মজুমদার হিয়ার।

সুহাসবাবু, আমি অমল রায় কথা বলছি।

গলায় আরও একটু আহ্লাদ মিশিয়ে সুহাস বলল, আরে হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলুন। কী খবর?

ইট মে বি শকিং টু ইউ। কীভাবে বলব তা ভেবে পাচ্ছি না। কিন্তু বলাটাও দরকার।

আরে, সংকোচ করছেন কেন? বলেই ফেলুন না।

ইট ইজ রিগার্ডিং ইওর ওয়াইফ পিউ।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলুন।

 আমরা কলকাতায় ছিলাম না।

হ্যাঁ, আপনারা তো উইক এন্ডে কোথায় একটা র‍্যানচ হাউসে যান বলে শুনেছি।

 র‍্যানচ হাউস নয়, আমাদের গ্রামে যাই।

দ্যাটস গুড। তারপর বলুন।

কাল একটু আন-এক্সপেকটেডলি আমরা রাত বারোটা নাগাদ ফিরে আসি। এসে দেখি আমাদের বেডরুমে পিউ আর একটি ছেলের সঙ্গে শুয়ে আছে।

সুহাস মজুমদারের শক অ্যাবজর্ভারগুলো বোধহয় খুবই ভাল। বিন্দুমাত্র না চমকে খুবই আপসোসের ভান করে একটা চুকচুক জাতীয় শব্দ করে সে বলল, দ্যাটস ব্যাড, ভেরি ব্যাড।

আপনি কি কাল রাতে বাড়িতে ছিলেন না?

ছিলাম। তবে নট ইন মাই সেনসেস। বুঝতেই তো পারছেন। তাজ-এ পার্টি ছিল। ড্রাইভার ধরে ধরে এনে ফ্ল্যাটে তুলে দিয়ে যায়।

বলে খুব আহ্লাদের হাসি হাসল সুহাস মজুমদার।

আপনার জানা দরকার যে ছোকরার নাম অরুণ মালিক।

 ও। ইটস ওকে মিস্টার রায়। আমি দেখছি।

 সুহাসবাবু, আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা আপনি গায়ে মাখছেন না।

 সুহাস মজুমদার একটু চুপ করে থেকে বলল, পিউ তো একজন স্বাধীন মহিলা মিস্টার রায়, তাই না?

তাই নাকি? স্বাধীন মহিলা কাকে বলে আমি অবশ্য জানি না। তাদের কি লাভার নিয়ে অন্যের ফ্ল্যাটে অনধিকার প্রবেশ করে ফুর্তি করার স্বাধীনতা আছে?

আই অ্যাম সরি ফর দ্যাট। কিন্তু কমপেনশেসন দিলে চলবে?

তার মানে?

আরে মশাই, উই আর নাউ ইন এ পারমিসিভ সোসাইটি। এসব কি কেউ মাইন্ড করে?

 আপনি না করলেও আর কেউ যে করবে না তা তো নয়।

সে যাই হোক, মিস্টার রায়। আমরা দুজনেই খুব দুঃখিত।

আমার সন্দেহ হচ্ছে পিউ যা করেছে তা আপনার অজানা ছিল না।

 বললাম তো মিস্টার রায়, পিউ একজন স্বাধীন মহিলা, আমার কেনা বাঁদি তো নয়। আমিও নই তার কেনা গোলাম। উই হ্যাভ আওয়ার পারসোন্যাল লিবারটিজ।

অবশ হাত থেকে প্রায় খসেই পড়ে যাচ্ছিল ফোনটা। না, দুনিয়া তাকে এক জায়গায় বসিয়ে রেখে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। স্ত্রীর ব্যাভিচারের খবরেও যে-মানুষ দেবশিশুর মতো নিরুদ্বেগ ও অবিচল থাকে তার কাছে কি অমলের অনেক কিছুই শেখার নেই?

সে নিজেকেই প্রশ্ন করল, ব্যাপারটা কী?

অঙ্কটা যে মিলবে না তা সে জানত, কিন্তু এতটাই গরমিল হবে বলে বুঝতে পারেনি। খানিকক্ষণ জ্ব কুঁচকে থেকে অমল হঠাৎ হেসে ফেলল একা একাই। সাহেবরা অনেক বেশি পিরমিসিভ বটে, কিন্তু তাও এতটা সহ্য করে না। পৌরুষে লাগে।

বাড়ি ফিরে অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছিল অমল। বাসুদেব না থাকায় আজ মোনা আর সোহাগ রান্নায় নেমেছে। এজেন্সিকে ফোন করে দেওয়া হয়েছে, তারা কাজের লোক পাঠিয়ে দেবে। আজ সকালেই তারা স্থির করেছে আর উটকো কাজের লোক রাখা হবে না। এজেন্সির লোক বরং ভাল, কিছু করলে এজেন্সি দায়ি থাকবে।

মোনা তাকে খাবার দিতে এসে বলল, একটু আগে পিউ এসেছিল।

 তাই নাকি? কী চায়?

ভিতরে আসেনি। দরজা খুলে দেখি, পঁড়িয়ে আছে। পরনে নাইটি। মুখেচোখে লজ্জা সংকোচের বালাই নেই। বলল, কাল আমি একটা জিনিস ফেলে গিয়েছি। নিতে এলাম।

কী জিনিস?

বলল, আংটি। আমি বললাম, ও-ঘরে আমরা এখনও ঘেন্নায় ঢুকিনি। আজ ঘর পরিষ্কার করা হবে। তখন পাওয়া গেলে পাঠিয়ে দেব।

আর কিছু বলল না?

 মনে হয় বলতে চাইছিল। আমি মুখের ওপরেই দরজা বন্ধ করে দিয়েছি। তুমি বরং অন্য কোথাও ফ্ল্যাট দেখ। এই ঘটনার পর আমার আর এখানে ভাল লাগছে না।

কেয়াতলার মতো ভাল জায়গা কোথায় পাবে? আর এসব এলিমেন্ট সব জায়গাতেই আছে।

মোটেই না। এসব মেয়েকে কী বলে জান?

 জানি। হাফ গেরস্ত।

হ্যাঁ। অনেক মেয়ে-বউ আছে যারা পার্ট টাইম প্রস্টিটিউশন করে সংসার চালায়। কিন্তু পিউরা তো তী নয়। ওদের পয়সার অভাব নেই।

কে বলল নেই?

আছে! দেখে তো মনে হয় না। সুহাস মজুমদারের নাকি অনেক পয়সা শুনতে পাই।

পয়সা থাকলে কী হবে? অভাব তো মনে। পয়সার অভাব থেকে তো পয়সার অভাব আসে না। আসে মন থেকে।

সুহাস তোমাকে কী বলল?

 খুব সারপ্রাইজিং কথাবার্তা বলল।

 কীরকম?

মনে হল, সবই জানে। অবাক হল না।

দেখ তো, হয়তো বউ ভাঙিয়ে কাজ আদায় করে নিচ্ছে। পুরুষমানুষরা সব পারে।

হ্যাঁ, এবার অঙ্কটা মিলে গেল অমলের। তাই তো! এরকম তো হতেই পারে। অরুণ মালিক তো সুহাস মজুমদারের একজন কাস্টমারও হতে পারে। আর বিজনেসের ব্যাপারে মেয়েদের কাজে লাগানো নতুন কিছু নয়।

আজ বাজার করল কে বল তো!

বুডঢা।

বুডঢা বাজার করতে পারে বুঝি?

করল তো! শুধু পরিমাণটা একটু গোলমাল করেছে। পাঁচশো গ্রাম উচ্ছে নিয়ে এসেছে। মাছটা ভালই কিনেছে।

এইভাবেই তারা চারজন প্রাণী ক্রমে আরও একটু কাছাকাছি হচ্ছে বলে মনে হয় অমলের। আক্রমণ প্রতি-আক্রমণের ব্যাপারটা কমছে, উদাসীনতা বা উপেক্ষা কমছে। একটা ঘরের মধ্যে যে কত কুরুক্ষেত্র লুকিয়ে থাকে!

অফিস থেকে ফিরে অমল দেখল একজন মধ্যবয়স্কা গ্রাম্য চেহারার মহিলা কাজে বহাল হয়েছে। বেতন আটশো টাকা। মুখখানা দেখে ভালমানুষ বলেই মনে হয়। বাসুদেব ফিরে আসেনি, তবে তার দেশের একজন লোক এসেছিল। সে খবর দিয়েছে, বাসুদেবের মায়ের খুব অসুখ। খবর পেয়ে সে দেশে চলে গেছে। সে আর কাজ করবে না। তার জিনিসপত্র আর বকেয়া বেতন যেন লোকটার হাতে দেওয়া হয়। মোন তাকে বলে দিয়েছে, বাসুদেবের নামে পুলিশে ডায়েরি করা হয়েছে, সে এলেই পুলিশ তাকে ধরবে। টাকা-পয়সা বা জিনিস কিছুই দেওয়া হবে না।

রাতে দুজনে এক বিছানায় শোয়ার পর মোনা বলল, জান, আমার এখনও কেমন যেন ঘেন্না করছে।

ঘেন্নার কী আছে? ওরা তো আদিম নরনারীর পবিত্র কাজটাই করছিল।

 পবিত্র কাজ বুঝি? মুখে আটকাল না বলতে?

তা নয়তো কী? ওর ভিতর দিয়েই সন্তান আসে।

ওরা তো আর সেজন্য অসভ্যতা করছিল না।

 তা অবশ্য ঠিক। ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলে?

হ্যাঁ।

কী হল?

আজকালকার ডাক্তাররা যা করে। একগাদা টেস্ট করাতে বলল।

কিন্তু ডাক্তার তো আজই বিদেশে চলে যাচ্ছে বলছিলে।

হ্যাঁ। তবে এক মাসের জন্য।

 ততদিন অপেক্ষা করতে হবে? বাজারে কি ডাক্তারের অভাব?

 আসলে একে একজন রেফার করেছিল।

কী হয়েছে তোমার?

মোনা একটু হাসল। অমলের গলাটা দুহাতে জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নিয়ে বলল, বউকে নিয়ে পুরুষের দুশ্চিন্তা কখন শুরু হয় জান?

কখন?

 বুড়ো হলে। তাই বলি, তুমিও বুড়ো হচ্ছ নাকি?

তা তো হচ্ছিই। কী হয়েছে তোমার?

 হয়তো কিছুই নয়।

হয়তো কেন?

পরীক্ষা করলে জানা যাবে।

আমাকে বলতে চাইছ না কেন?

ইউটেরাসে টিউমারিক গ্রোথ বলে আলট্রাসোনোতে ধরা পড়েছে।

 বিপজ্জনক কিছু?

কে জানে কী। বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মোনা।

এটা এমন কিছু গোপন করার মতো ব্যাপার তো ছিল না। তাহলে আমার কাছে গোপন করছিলে কেন মোনা?

একটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। তোমার সঙ্গে একটা দূরত্ব ছিল তো। তখন সব কথা চেপে রাখতাম। সেই থেকে অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেল।

মোনাকে হঠাৎ প্রগাঢ় আলিঙ্গনে বেঁধে অমল বলল, কাছে এসো, আরও কাছে। কত কাছে আসতে পার।

এ বাবা! দম বন্ধ হয়ে আসছে যে! পাগলটা কোথাকার।

অমলের মনে হল, এত কাছে, তবু কি দূরত্ব নেই?

.

৫৯.

টুপুকে সে পুকুরে স্নান করতে দেখেছিল। টুপু বেশ দীঘল, লম্বাটে ঢলঢলে মুখ। চোখ দুখানা খুব ঝকঝকে। এসব আগে কখনও দেখেনি সে। পরশু দেখল। দুপুরবেলা সে উঠেছিল মনু পিসিমার আমগাছে ভীমরুলের চাক ভাঙতে। কষে খুঁটে আর ভেজা তুষ এবং কাঠকুটোর ধোঁয়া দিয়েছিল মনুপিসি। শীতের দুপুরে থম-ধরা বাতাসে ধোঁয়ার কুণ্ডলি পাকিয়ে উঠতেই ভোঁ ভোঁ করে একটি দুটি ভীমরুল উড়ে যেতে লাগল। ধোঁয়া মোটে সহ্য হয় না ওদের। উড়ন্ত কীট পতঙ্গরা ধোঁয়া সহ্য করতে পারে না কখনও।

মনুপিসি কদিন ধরেই বলছিল, সবাইকে বলে বলে মুখ ব্যথা হয়ে গেল বাবা, ভীমরুলের চাক ভাঙতে কেউ সাহস পায় না। তুই তো ডাকাবুকো আছিস, দে বাবা ভেঙে, নইলে কবে কোন দুষ্টু ছেলে দূর থেকে ঢিল মেরে পালায়, তখন কি রক্ষে আছে? ভীমরুলের হুল যমের দোর। শয্যে নিতে হবে। দে বাবা ভেঙে, পেট ভরে পিঠেপায়েস খাওয়াব।

মরণ এসব কাজ খুব পারে। বোলতা, ভীমরুল, মৌমাছির হুল কতবার খেয়েছে সে। ওসব তার তেমন লাগে না। গতবার যখন একটা প্রায় এক ফুট লম্বা পাকা তেঁতুলবিছে তাকে কামড়েছিল তখন তো ব্যথায় নাকি তার হার্টফেল করার কথা। কিন্তু সেই আশ্চর্য সাংঘাতিক ব্যথাও প্রায় নীরবে সহ্য করেছিল সে। পাড়ার লোক তাকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যায় ভয় পেয়ে। সেখানকার ডাক্তারবাবু পর্যন্ত তাকে অবশ করার ইনজেকশন দেওয়ার সময়ে বলেছিল, এ ছেলেটির ব্যথা সহ্য করার শক্তি তো সাংঘাতিক! এসব কেসে ব্যথায় তো অনেকে মরেও যায়।

মরণ মরেনি। বরং তার মনে হয়েছে, সে এর চেয়েও বেশি ব্যথা অনায়াসে সহ্য করতে পারে। মানুষ ব্যথাকে খুব ভয় পায়। মরণ পায় না। বরং ব্যথাকে তার কখনও কখনও বন্ধু বলে মনে হয়।

আমগাছটা বড্ড পুরনো। বর্ষাকালে মনুপিসির এই আমগাছের কোটর থেকে সে একটা সাপকে বেরোতে দেখেছিল। কে জানে সাপটা হয়তো এখন কোটরের মধ্যে শীতঘুম ঘুমোচ্ছে। মোটা আমগাছটায় হালকা শরীরে দিব্যি উঠে গেল মরণ। কোমরে দা। ভীমরুলের মস্ত মাটির চাকটা অনেক ওপরে। এক-আধটা ভীমরুল থেকেও যেতে পারে হয়তো। কিন্তু এসব ভয় মরণের নেই। সে বিশাল চাকটাকে দা দিয়ে কুপিয়ে ভেঙে ফেলতে লাগল টুকরো টুকরো করে। একটু মায়াই বরং হচ্ছিল তার। কী সুন্দর মসৃণ চাকটা বানিয়েছে ভীমরুলরা, কত কষ্ট করে।

আর তখনই নীচের পুকুরে তাকিয়ে সে টুপুকে দেখতে পেয়েছিল। জলে ডুব দিয়ে উঠছে। লম্বা চুল লেপটে আছে গালে, কপালে। ভেজা ফ্রক আঁকড়ে ধরেছে লতানে শরীর। বুকে সদ্য ফুটে ওঠা দুটি স্তন। দেখতে নেই। ওসব দেখতে নেই। লজ্জার কথা। তবু কি চোখ মানে! পাপ হচ্ছে। শিবঠাকুর। শিবঠাকুর! বলে যে বিড়বিড় করল কয়েকবার। কিন্তু এ যেন আঠাকাঠিতে আটকে পড়া পাখি। তার চোখ বারবার ধেয়ে যায় টুপুর দিকে।–

ডুব দিয়ে উঠে ফের সাঁতার কাটছিল টুপু। গাঁয়ের মেয়েরা ভাল সাঁতার জানে না। ঘুপ ঘুপ করে জল ভেঙে ভেঙে এগোয়। আমগাছে ডালপালার আড়ালে বসে চোরের মতো দেখছিল মরণ।

নীচে ঊর্ধ্বমুখ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মনুপিসি।

ও মরণ! সবটা ভেঙেছিস তো বাবা? ভাল করে জায়গাটা চেঁছে দে। বাসার গোড়া থাকলে আবার এসে জোটে।

না পিসি, আর জুটবে না। ভাল করে চেঁছে দিয়েছি।

 তাহলে নেমে আয় বাবা। পরের ছেলে, পড়ে-উড়ে গেলে বড় পাপ হবে।

মরণ তবু একটু অপেক্ষা করল, টুপু জল থেকে উঠে গামছা নিংড়োচ্ছে, দুটো হাত তুলে মাথা মুছছে। চুলে গামছার ঝটকা মারছে। মুগ্ধ চোখে দেখছিল সে।

টুপুকে সে পুকুরে স্নান করতে দেখছে। টুপুর বয়স চৌদ্দ। তার চেয়ে দু বছরের বড়। কিংবা তাও নয়। এক বছর কয়েক মাস।

কেউ তাকে বারণ করেনি তবু তার মনে হয়, বড় মেয়েদের এভাবে দেখতে নেই। ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকলে মেয়েরা রাগ করে। দোষ হয়। টুপু অবশ্য তেমন বড় মেয়ে নয়। মরণের চেয়ে একটু বড়। ওরও ক্লাস সিক্স। এই তো সেদিনও টুপু গোল্লাছুট কি দড়ি লাফানো কি চারা ছুঁড়ে এক্কাদোক্কা খেলত, দুই বেণী দুলিয়ে স্কুলে যেত। কতবার তাদের বাড়ি এসেছে নুন, তেল, চিনি ধার করতে। মায়ের সঙ্গে ষোল গুটি খেলেছে দুপুরে। কখনও তাকিয়েও দেখেনি মরণ। আজ সেই গুয়ের গ্যাংলা মেয়েটার ভিতর থেকে কি রাজকন্যা বেরিয়ে এল? রাজকন্যা বললে বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। রাজকন্যাদের থাকে দুধে-আলতায় গায়ের রং–সেটা কীরকম রং তা অবশ্য মরণ জানে না। আর থাকে কুঁচবরণ কেশ। কুঁচফল খুব চেনে মরণ, তাদের বাড়ির বেড়াতেই তো কত লতিয়ে ওঠে। ছোট্ট দানার আধখানা লাল, বাকি অর্ধেক কালো। এত সুন্দর ফল যে কেন খাওয়া যায় না কে জানে। কুঁচবরণ কেশ কি লাল না কালো তা নিয়ে ধন্ধ আছে মরণের। রাজকন্যাদের আরও কী কী সব যেন থাকে। না, টুপু মোটেই রাজকন্যার মতো নয়। তবু টুপুর ভিতর থেকে এক অচেনা টুপু বেরিয়ে এসে ওই চান করছে পুকুরের জলে। মরণ তাকে দেখছে, আর পাপ করছে। শিবঠাকুর এত পাপ সইবে কি? শিবঠাকুরকে তার বড় ভাল লাগে। সব দেবতার মধ্যে শিবঠাকুর তার সবচেয়ে প্রিয়। আর শিবঠাকুরকে মরণ যখনই ডাকে তখনই যেন এসে হাজির হন। না, চোখ খুললে দেখা যায় না ঠিকই, কিন্তু কষে চোখ বন্ধ রাখলে ঠিক তাঁর গায়ের সুন্দর বোঁটকা গন্ধটা পায় মরণ। শিবঠাকুর তো আর সাবান মাখে না, তার ওপর শ্মশান-মশানে পড়ে থাকে, গায়ে ছাই-টাই মাখে, বোঁটকা গন্ধ হতেই পারে। সেই গন্ধটা খুব ভাল লাগে মরণের।

শিবঠাকুরের কাছে মরণ যা চায় তাই শিবঠাকুর দিয়ে দেন। না, সব দেন না। আসলে শিবঠাকুর তো বড্ড ভুলো মনের মানুষ। আধখানা হয়তো দিলেন, বাকি আধখানা দিতে ভুলেই গেলেন। তবুমরণ যা চায় তার সবটাই প্রায় তাকে দিয়ে দেন শিবঠাকুর। তাঁর বরেই না তার মাকে মা বলে ডেকে ফেলল দাদা। দিদিটা তেমন সুন্দর হল না ঠিকই, কিন্তু কেমন ভাব করে গেল মরণের সঙ্গে! তাকে দাদা আর দিদির খুব পছন্দ হয়েছে। তারা বলে গেছে আবার আসবে। হয়তো বড়মাও আসবে একদিন। শিবঠাকুরের কাছে এই বরটা চেয়ে রেখেছে মরণ। হে ঠাকুর, বড়মা এসেও যেন আমাকে খুব ভালবাসে। আমি তো বাঁদর ছেলে, লেখাপড়ায় নম্বর পাই না, আবার নামটাও ভারী বিশ্রী, তবু যেন বড়মা আমাকে অপছন্দ না করে। যেন বলে, ও মরণ, আমার সঙ্গে কলকাতায় চল তো বাবা! তোকে আমিই মানুষ করব। না, তা বলে মরণ হুট করে চলেও যেতে পারবে না। ঠিক বটে, মায়ের ওপর রাগ হলে সে মাঝে মাঝে কলকাতায় বড়মার কাছে চলে যাবে বলে ঠিক করে ফেলে। আবার এও মনে হয়, মাকে ছেড়ে সে তো থাকতেও পারবে না। মা কেঁদে কেঁদে মরেই যাবে। আর মাকে ছেড়ে নরও খুব মন খারাপ হবে।

জিজিবুড়ি অবশ্য খলখল করে হেসে বলে, ওরে, ও ডাইনি এল বলে। আগে ছানাপোনা পাঠিয়ে তত্ত্বতালাশ নিয়ে রাখল। ওরা হচ্ছে ডাইনির চর। তারপর সে এসে মুষলপর্ব শুরু করবে। তোর মেনিমুখো মা পারবে তার সঙ্গে যুঝতে? বেড়াল-কুকুরের মতো তাড়াবে। কত করে বললুম, ওলো, ভাইদের হাতে দলিল-টলিলগুলো সব দিয়ে রাখ। তারা ভাল উকিল লাগিয়ে সব বুঝে রাখবে। তা শুনল আমার কথা? কিছু কিছু করে টাকাপয়সা সরিয়ে আমার কাছে গচ্ছিত রাখতে বললুম, তা মেয়ের কী রাগ! ওরে গর্ভধারিণী মাকে অবধি তোর বিশ্বাস হয় না এমন গুণ তোকে কে করল বল তো!

মরণ জানে জিজিবুড়ির অনেক দোষ আছে। কিন্তু মরণের তাকে মোটেই খারাপ লাগে না। জিজিবুড়ি তাকে অনেক গল্প শোনায়। আর কাছে বসলেই জিজিবুড়ির গা থেকে দোক্তার মিষ্টি গন্ধ আসে। আর জিজিবুড়ি খারাপ লোক হলেও মরণকে ভালবাসে খুব। অসুখের সময় তার শিয়রে বসে কী কান্না!

সংসারের এই খারাপ, ভাল লোকের বিচারটা ভাল বুঝতে পারে না মরণ। জিজিবুড়িকে বাড়ির সবাই খারাপ বলে, কিন্তু বুড়িটার জন্য মরণের বড় মায়া। সে অনেক সময়ে চুরি করে জিজিবুড়িকে জিনিসপত্র দেয়। বাঙাল কলকাতা থেকে ফি সপ্তাহে রাজ্যের জিনিস নিয়ে আসে। সংসারের যাবতীয় জিনিস– দড়িদড়া থেকে আচার আমসত্ত্ব সোনামুগের ডাল অবধি। সব জিনিসেরই অবশ্য হিসেব থাকে তার মায়ের। বাবা বেহিসেবি কেনাকাটা করলেও মা সব গুছিয়ে গুনেগেঁথে খাতায় লিখে রাখে। তাই থেকে মাঝে মাঝে জিজিবুড়ি চায়। মা দেয় না। তখন হয়তো চুপি চুপি মরণকে বলে, দিবি ভাই, এক শিশি মধু? বাঙাল নাকি কোথা থেকে খাঁটি চাকভাঙা মধু আনে। তা বাঙালরা খাবার জিনিস খুব চেনে। ওরা রাক্ষসের জাত তো, খেতে-টেতে খুব ভালবাসে।

তা দেয় মরণ। কিন্তু মায়ের কাছে ধরাও পড়ে যায়। মা একদিন গুম করে তার পিঠে কিল দিয়ে বলেছিল, অত আদিখ্যেতা কীসের রে? তুই দিতে যাস কেন? মাকে যখন যা দেওয়ার আমিই তো বুঝে সুঝে দিই। কাঙাল ভিখিরির মতো হাত তো পেতেই আছে সব সময়। সব খাঁই মেটাতে গেলে তো আমার সংসার লাটে উঠবে। দানছত্র তো খুলে বসিনি।

তা জিজিবুড়ির জন্য একটু কষ্ট আছে বটে মরণের। মা বলে, জিজিবুড়ির কথায় নাকি এমন ধার যে লোহা কাটতে পারে। কটর কটর কথা বললেও জিজিবুড়ির কি গুণও নেই? মহাভারতের অত কথা জিজিবুড়ির মতো কেউ জানে? কত অবাক করা গল্প শোনায় তাকে জিজিবুড়ি!

তবে হ্যাঁ, যখন জিজিবুড়ি বড়মাকে ডাইনি ডাকে তখন তার কষ্ট হয়। কিংবা বলে, ওই বড় মাগী কি আর তোর মায়ের মতো বোকা মাথার মানুষ? শহুরে মেয়েছেলে বাবা, জাঁহাবাজ মানুষ, সাত হাটে তোর মাকে বিক্রি করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। তার ওপর যদি সেও বাঙাল মেয়েছেলে হয়ে থাকে তবে তো আরও চিত্তির। শুনি তো নাকি হুগলির মেয়ে। ও বাপু, আমার বিশ্বাস হয় না। বাঙালরা কত ফেরতাই জানে। দ্যাখ গে খোঁজ নিয়ে, সে মাগীও বাঙাল। এসব শুনলে মরণের ভারী রাগও হয়। বড়মার একটা ছবি সে তার মনের মধ্যে টাঙিয়ে রেখেছে। বড় বড় শান্ত চোখ, মুখে একটু প্রশ্রয়ের হাসি, আর ভারী ঢলঢলে দুর্গা প্রতিমার মতো মুখ। তবে না বড়মা! যদি সত্যিকারের বড়মা ওরকম নাও হয় তবু মরণ ঠিক মানিয়ে নেবে। জিজিবুড়ি যে কেন ওসব বলে।

মা কিন্তু কখনও বড়মা সম্পর্কে খারাপ কথা বলে না। তবে একটু ভয় পায়। মা অবশ্য সব কিছুতেই ভয় পায়। ভয়ের শেষ নেই মায়ের। দাদাকে ভয়, দিদিকে ভয়। বড়মাকে দেখেনি, কেমন মানুষ তাও জানে না। ভয়টা সে কারণেই। কিন্তু মরণ বড়মাকে ভয় পায় না। সে ঠিক জানে, শিবঠাকুর তার বড়মাকেও ঠিক মনের মতোই করে একদিন এই গাঁয়ে নিয়ে আসবেন।

সবাই জানে সে বাঁদর ছেলে। টুপুও তাই জানে। এ-গাঁয়ে মরণের কোনও সুনাম নেই। অনেকদিন আগে টুপুদের বাড়িতে বর্ষাকালে একদিন মেঘ কেটে রোদ ওঠায় তোশক বালিশ রোদে দেওয়া হয়েছিল উঠোনে। বিকেলবেলায় তোশক তুলবার সময় মস্ত এক কেউটে সাপ বেরিয়ে এসেছিল তোশকের ভাঁজ থেকে। প্রবল চিৎকার আর চেঁচামেচি শুনে দৌড়ে গিয়েছিল মরণ। বাড়ির সবাই বারান্দায় উঠে পড়ে তারস্বরে চেঁচাচ্ছিল। বিশাল সাপটা বুকসমান ফণা তুলে দুলছিল উঠোনের মাঝমধ্যিখানে।

এসব মরণের কাছে জলভাত, কত সাপ মেরেছে সে। যদি বুদ্ধি থাকত তাহলে সাপেরা মরণের বিরুদ্ধে মিটিং বসাত। সে একখানা আধলা ইট তুলে ঘাঁই করে মেরে দিয়েছিল। তার হাতের টিপ কখনও ফসকায় না। একবারেই সাপের মাথা থেঁতলে দিয়েছিল সে। কিন্তু দুঃখের বিষয় তখন তার ওই বাহাদুরিতে বাহবা দেওয়ার মতো বড় ছিল না টুপু। আর তখন লক্ষ করে দেখার মতোও ছিল না হাড় জিরজিরে মেয়েটা। এই টুপু অন্য আর একজন, যেন এ-গাঁয়ে নতুন আসা মেয়ে। একে কী বাহাদুরি দেখাতে পারে মরণ? ধারেকাছে তো ফণা-তোলা সাপ নেই!

গাছের একটা আড়া ডাল অনেকখানি এগিয়ে ঝুঁকে আছে পুকুরের ওপর। মরণ হিসেব করে দেখল ওই ডালটা বেয়ে যদি একেবারে শেষপ্রান্তে যাওয়া যায় তাহলে পুকুরের জলে লাফিয়ে পড়া সম্ভব। তবে একটু ভুলচুক হলে ঘাটের সান বাঁধানো সিঁড়িতে পড়ে যাওয়া বিচিত্র নয়। বাহাদুরিটা দেখাতে পারলে এই নতুন টুপু কি নতুন চোখে তাকে দেখবে না? একটু হিরোর মতো ভাববে না তাকে?

আড়া ডালটায় নামা কঠিন নয়, কিন্তু মুশকিল হল, গাছটা পুরনো, পোকা-টোকা লেগে যদি আড়া ডালটার গোড়া কমজোরি হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে আগার দিকে মরণের ভার বইতে না পেরে মড়মড় করে ভেঙে পড়তে পারে। তা পড়ুক, তাহলেও তো মরণের জন্য একটু আহা উঁহু করবে ওই নতুন টুপু!

ওপরের ডাল থেকে হাতের ঝুল খেয়ে তলার ডালটায় নেমে পড়ল মরণ। আড়া ডালটা মোটা, মরণ গাছের চরিত্র খুব ভাল চেনে, মোটা ডাল মানেই ভারী জিনিস। অনেকখানি ঠেকনোহীন ক্ষীণ ঝুলে আছে বলে এসব ডালই বেশি বিপজ্জনক, যখন তখন ভেঙে পড়তে পারে। কিন্তু অত হিসেব করার সময় নেই। টুপুর চুল ঝাড়া হয়ে গেছে। এবার চলে যাবে। হাওয়াই চটি জোড়া জলে ধুতে সিঁড়িতে নেমে টুপু জলে নামা অন্য কয়েকজন মেয়েছেলের সঙ্গে কথা কইছে। বিশ্বাস বাড়ির বড়বউ রাধিকা, নয়নের বুড়ি পিসি, কাদুর মা।

মরণ বুক হেঁচড়ে ডালটা বেয়ে বেয়ে ঠিক চলে এল ডগায়। ডালটা দোল খাচ্ছে খুব জোর। সামনে কোথাও কাকের বাসা আছে বোধহয়। কাকগুলো খুব ডেকে উঠল হঠাৎ। তাদের ক্রুদ্ধ ডানার শব্দ শোনা যাচ্ছে। বিপদ বুঝলে ঠিক এসে ঠুকরে দেবে মরণকে।

ডালটার ডগায় এসে মরণ বুঝতে পারল ফুটখানেকের হিসেব গোলমাল হয়েছে। লাফ দিলে জলে পড়তে পারে। আবার পৈঠাতে পড়াও বিচিত্র নয়। কিন্তু হিসেব করলে আর বাহাদুরিটা কী হল?

মরণ ডালটা ধরে ঝুলে পড়ল প্রথমে। তারপর ট্রাপিজের খেলোয়াড়ের মতো শরীরটা বারকতক দুলিয়ে নিল ভাল করে। তারপর জলের দিকে ঝুল খেয়ে হাত ছেড়ে লাফিয়ে পড়ল জলে। অনেকটা ওপর থেকে। এত ওপর থেকে কখনও যে জলে লাফায়নি সে এ কথাটা খেয়াল ছিল না তার। টুপু আজ মাথাটা গোলমাল করে দিয়েছে যে!

জলে পড়ার কিছু নিয়ম আছে। খাড়া হয়ে সরু হয়ে না পড়লে মসৃণভাবে জলে ঢুকে যাওয়া যায় না। চিৎপাত হয়ে পড়লে জলের চাটি খেতে হয়। মরণের জুটলও তাই। ডাইভ দিতে জানলে এরকমটা হত না। সে পড়ল নিরালম্ব চিৎপাত হয়েই। জলের প্রচণ্ড চাটি লাগল পিঠে, মাথায়। দম বন্ধ হয়ে এল তার ব্যথায়। সবজে নীল জল কলকল করে ঢুকল কানে, নাকে, চোখে। কয়েক ঢোঁক জল গিলেও ফেলল সে। চোখে অন্ধকার ঠেকল কিছুক্ষণ। কোন তলানিতে চলে যাচ্ছিল সে কে জানে। হাত-পা অসাড় লাগল কিছুক্ষণ। কিন্তু তবু গাঁয়ের পুকুরে দীর্ঘদিন স্নান করার অভ্যাস আছে বলে সে সামলেও গেল। ভুরভুরি কেটে ভুস করে যখন ভেসে উঠল তখন পুকুরধারে গেল গেল বলে শোরগোল উঠে গেছে।

সবার আগে মরণের চোখ পড়ল টুপুর ওপর। ভারী অবাক হয়ে চেয়ে আছে টুপু। মুখে ভয়, চাউনি অবাক।

বাহাদুরিটা ভালই দেখিয়েছে মরণ। সে হি হি করে হেসে উঠল আনন্দে।

 কে যেন বলে উঠল, আ মোনলা ওটা কি মরণ নাকি রে? পিলে যে চমকে দিয়েছিলি বাবা।

কোথা থেকে জলে পড়লি রে, ও ভূত!

 কী অসভ্য ছেলে রে বাবা।

 সবচেয়ে আশ্চর্য কথা বলল টুপু, কী বদমাশ ছেলে রে বাবা!

বলেই মুখটা ফিরিয়ে পৈঠা বেয়ে উঠে গেল ওপরে। তারপর আর দেখাই গেল না তাকে।

ভেজা গায়ে উঠে এল মরণ। জামা প্যান্ট সব ভেজা। কেমন বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। অপমানও বোধ হচ্ছে। তোর জন্যই লাফ দিলাম টুপু, আর তুই-ই ওরকম করলি? তোদের বাড়িতে যে কেউটে সাপ মারলুম, মনে নেই? আমার মতো গাছ বাইতে পারে কেউ? জোরে ছুটতে পারে আমার মতো কেউ? পারে কেউ আমার মতো তেঁতুলবিছের কামড় সহ্য করতে? পারুক তো কেউ দেখি!

ঘরের কাজে ব্যস্ত ছিল বলে মা লক্ষ করল না তাকে। করলে জামা ভিজিয়ে এসেছে বলে বকুনি দিত। গা মুছে জামা প্যান্ট ছেড়ে নিজের পড়ার ঘরখানায় এসে চুপটি করে বসে রইল মরণ। টুপু কি আর কখনও তার দিকে তাকাবে? দেখলেও হয়তো অবহেলায় চোখ ফিরিয়ে নেবে। পাত্তাও দেবে না তাকে! না দিক। তারই বা কী গরজ! এই তো সেদিনও টুপুকে পাত্তা দিত না মরণ। ভারী তো মেয়ে। রোগা, কেলটিস মার্কা। উঁচ-কপালি, চিরুনাতি কোথাকার। অবশ্য উঁচ-কপালি আর চিরুনাতি কাকে বলে তা জানে না মরণ।

লেখাপড়ায় ভাল হলে তাকে কি কেউ এত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত? এটা মরণ আজকাল খুব টের পায়। কিন্তু তার যে মোটে পড়তে ইচ্ছে যায় না। কী যে করবে তা বুঝতে পারছিল না সে।

দুপুরবেলা খেয়ে-দেয়ে মা যখন শুতে গেল তখন মরণ চুপ করে গাছতলায় তার নিজস্ব শিবঠাকুরের থানে এসে ঘাসের ওপর বসল। এখানে মন্দির নেই, শিবলিঙ্গ নেই, কিছু নেই। তবু মরণের এটাই শিবঠাকুরের থান। এখানেই সে ডাকলে শিবঠাকুর এসে হাজির হন।

আজও সে চোখ বুজে শিবঠাকুরকে খুব প্রাণভরে ডাকল, শিবঠাকুর আজ কি পাপ করে ফেললাম? ক্ষমা করে দিও ঠাকুর। তোমাকে বলছি, আমাকে কিন্তু কেউ ভালবাসে না। আমি কি খুব খারাপ? আজ যদি পুকুরে ডুবে মরে যেতাম তাহলে বুঝি ভাল হত?

শিবঠাকুরের গায়ের বোঁটকা গন্ধটা আজও পেল মরণ। তার সামনেই শিবঠাকুর ব্যোম ভোলানাথ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখ না খুললেই তাকে দেখা যায় ভাল।

একটু থেমে খুব লজ্জায় লজ্জায় মরণ বলল, ও যেন আমার দিকে একটু তাকায়-টাকায় ঠাকুর।

এই বলেই ছুটে পালিয়ে এল ঘরে।

এই তো সেদিন জিজিবুড়ি সকালে রোজকার মতো এসে বসে ছিল উঠোনে। রোদ পোয়ানোর নাম করে রোজই আসে, যদিও তাদের বাড়িতে রোদের অভাব নেই। চোখ কুঁচকে মরণকে দেখে বলেছিল, তুই কি একটু ঢ্যাঙা হয়েছিস নাকি রে ভাই?

ভারী লজ্জা পেয়েছিল মরণ। সে যে একটু ঢ্যাঙা হচ্ছে, তা সে খুব টের পায়। শরীরে আরও নানা বদল ঘটছে তার। সুড়সুড়ি বাড়ছে, হাতে পায়ে কেমন একটা অস্বস্তি যেন, চামড়ায় কখনও কখনও ফাটলের মতো দাগ। এসব কী হচ্ছে তা ঠিক বুঝতে পারে না মরণ।

জিজিবুড়ির কথাটা কানে গিয়েছিল বাসন্তীর। কেঁঝে উঠে বলল, নজর দিও না তো মা। এটা তো বাড়েরই বয়স। বাড়বে না তো কী? অত তাকিয়ে থাকার মতো কিছু হয়নি।

মায়ের নানা ভয় আছে। নজর লাগার ভয়, শনির দৃষ্টি, ফঁড়া, আরও কত কী। মাঝে মাঝেই তার আঙুল কামড়ে, শরীরে থুথু ছিটানোর ভান করে কী সব যেন তুকতাক করে মা। তার নামে বারের পুজো দিতে শনি মন্দিরে যায় ফি শনিবার।

আমাকে নিয়ে তোমার এত ভয় কেন মা?

আমার বাপু সবাইকে নিয়েই ভয়।

.

৬০.

এই যে প্রাণের তত্ত্ব শাস্ত্রে এত বলা আছে, তা সেই প্রাণটা কোথায় থাকে এই দেহপিঞ্জরে সেটাই তো আজ অবধি ঠাহর পাওয়া গেল না। প্রাণ কি বিন্দু, না শিখা, নাকি বুদ্বুদ? জিনিসটা খুব একটুখানি। এই শরীর আর মনের নিউক্লিয়াস। তাকে ঘিরেই কি শরীরের অণুপরমাণু আবর্তিত হয়? কে জানে বাবা কী, কিন্তু আছে একটা কিছু। চোখের দেখা, কানের শোনা, বুদ্ধিশুদ্ধি, বুকের ধুকপুকুনি এইসব তার জন্যই হচ্ছে-টচ্ছে। অথচ তার হদিশ করাই মুশকিল।

আজকাল কফি খাওয়ার ঝোঁক হয়েছে মহিমের। জিনিসটা ভাল। শীতে বেশ গা গরম হয়। শরীরটা চনমনে লাগে। তার নাতনি সোহাগ জিনিসপত্র সব এনে দিয়েছে তাকে। শিখিয়েছে কালো কফি খেতে। বলেছে, দুধ দিয়ে খেও না দাদু, ওতে খারাপ হয়।

সন্ধের পর নিজের ঘরে স্টোভ জ্বেলে নিজেই এক কাপ কফি করে মহিম খুব তৃষ্ণার্তের মতো খায়। ওই এক কাপই। লোভে পড়ে একবার তিন কাপ খেয়ে বিপদ হয়েছিল। রাতে কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না। উগ্র জিনিস, সাবধানে খেতে হয়।

সন্ধের পর কারেন্ট থাকলে মুকুল এসে তাকে হাত ধরে একরকম টেনে তাদের ঘরে নিয়ে যায়, চলো দাদু, সিরিয়াল দেখবে। মুকুল হল মুকুলিকা, কমলের ছোট মেয়ে। ওদের ঘরে এখন রঙিন টিভি এসেছে, কে কানেকশন নেওয়া হয়েছে। লোকে আজকাল খাক না খাক, টিভি না দেখলে বেজার হয়ে পড়ে। ওয়ান ডে ক্রিকেট থাকলে তো ও-ঘরে ঘেঁষাঘেঁষি ভিড় হয়। সিরিয়াল দেখার তেমন আগ্রহ বোধ করে না মহিম। সবই কৃত্রিম লাগে। বানানো গল্প, বানানো রিঅ্যাকশন। যাত্রা বা নাটকে যে একটা উচ্চগ্রামের ব্যাপার থাকত এসব সেরকম নয়। তবু গিয়ে মাঝে মাঝে ওদের আসরে বসতে হয়।

সেদিন সন্ধেবেলাতেও মুকুল এসে ডেকে গেছে। যাবে বলে তৈরি হয়ে মহিম তার বরাদ্দ কফিটা তৈরি করে সবে ঘুরে চেয়ারের দিকে আসছিল। হঠাৎ মাথায় একটা প্রবল চক্কর। গোটা ঘর যেন টালমাটাল হয়ে দোল খেয়ে গেল, মেঝেটা যেন নেমে যাচ্ছিল পাতালে। প্রথমে মনে হয়েছিল বুঝি ভূমিকম্প। কিন্তু ভূমিকম্প হলে চারদিকে শাঁখ বাজত। কয়েক মুহূর্তেই মহিম ওই অবস্থাতেও বুঝতে পারল, আশি পেরোনো এই শরীরেরই কোনও অধঃপাত। সে কি মারা যাচ্ছে?

কফির কাপটা পড়ে ভাঙল, গরম কফি ছিটকে লাগল পায়ে। চোখে অন্ধকার, কানে ঝিঁঝির ডাক। জ্ঞান হারানোর আগে সে টের পেল, কাপ ভাঙার শব্দ পেয়েই বোধহয় সন্ধ্যা দৌড়ে আসছিল, ও বাবা! কী হল…।

ডাক্তার বদ্যি সারাজীবনে খুব কমই দেখিয়েছে মহিম। একটা জীবনে হোমিওপ্যাথির চর্চা করত। চার পাঁচখানা ইংরিজি এবং বাংলা বই আছে তার। ওষুধের বাক্স আছে। একসময়ে পাড়া প্রতিবেশীরা অনেকেই তার কাছে এসে ওষুধ নিত। তখন গাঁ গঞ্জে ডাক্তার অমিল ছিল খুব। অসুখ হলে দু-তিনজন শখের হোমিওপ্যাথই ভরসা। নইলে বর্ধমান নিয়ে যেতে হত রুগিকে। আজকাল অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। পাশ করা বড় ডাক্তাররা নিয়মিত আসছে গাঁয়ে। তিন চারজন পাশ করা হোমিওপ্যাথ ডাক্তারও আছে।

তাকে দেখতে এল অনল বাগচী। মেডিকেল কলেজে নাকি পড়ায়। খুব নাম। ভারী অমায়িক মানুষ, গোমড়ামুখো গেরামভারি নয়।

প্রেশার দেখে বলল, সামান্য বেশি আছে। এর জন্য ওষুধ খাওয়ার দরকার নেই। একটু হাঁটাহাঁটি করলেই কমে যাবে।

মহিম বলল, থোড়ের রস খেলে প্রেশারের উপকার হয় শুনেছি।

অনল ডাক্তার ভারী সুন্দর করে হেসে বলল, টোটকাতে কাজ হতে পারে। ইচ্ছে হলে খেয়ে দেখবেন। আজকাল তো এসব টোটকা ওষুধকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ডাক্তারি শাস্ত্রে থোড়ের কথা অবশ্য নেই। কিন্তু তাতে কী? খাবেন। তবে হাঁটাচলাটা বাদ দেবেন না।

না। হাঁটতে আমার ভালই লাগে।

 বয়সের অনুপাতে আপনার শরীর তো বেশ ভালই আছে দেখছি। হার্ট ইজ ওকে, বুকে কোনও কমপ্লিকেশন নেই। তবে মাথার রিলিংটা হয়তো স্পন্ডেলাইটিসের জন্যও হতে পারে। একবার বর্ধমানে গিয়ে ঘাড়ের একটা এক্স-রে করাবেন। আর একটা ব্লাড টেস্ট। সবই প্রেসক্রিপশনে লিখে দিয়েছি।

একটা কথা ডাক্তারবাবু।

 বলুন।

আপনারা তো মানুষের শরীরে অনেক কাটাছেঁড়া করেন।

অনল বাগচী মৃদু হেসে বলল, আমি মেডিসিনের লোক। কাটাছেঁড়া সার্জনদের কাজ। তবে ডাক্তারি পড়ার সময়ে ডিসেকশন করতে হয়েছে। যাই হোক, আপনি বলুন।

না, এই মাঝে মাঝে অনেক আবোল তাবোল কথা মনে হত। খুব জানতে ইচ্ছে করে মানুষের আত্মাটা শরীরের ঠিক কোথায় তাকে। ডাক্তাররা শরীর কাটাছেঁড়া করার সময়ে কি সেটা বুঝতে পারে?

অনল বাগচী বিশেষ ভদ্রলোক। এ কথায় একটুও তাচ্ছিল্য প্রকাশ করল না। বরং বেশ সিরিয়াস মুখ করেই বলল, ডাক্তাররা আত্মা দূরে থাক, শরীরেরই বা কতটুকু জানে বলুন। এই তো মানুষের একটুখানি শরীর, কতই বা লম্বা চওড়া। তবু এর মধ্যেই এত অদ্ভুত আর সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি যে তাক লেগে যেতে হয়। এর মধ্যে কত জটিলতা, কত কো-অর্ডিনেটেড সিস্টেম। শরীরকেই তো আজও পুরোপুরি জানি না আমরা। আত্মা তো আরও দুয়ে।

ডাক্তারবাবুটিকে বড় ভাল লেগে গেল মহিমের। সে সাগ্রহে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি আত্মা মানেন?

আমি না মানার কে? প্রায় সব ধর্মেই আত্মার কথা বলা আছে। সুতরাং জিনিসটা তো উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। আমরা যে ভাইটাল ফোর্সের কথা বলি সেটাই হয়তো এই আত্মা।

শুনে বড় ভাল লাগল। আজকাল তো এসব কেউ মানতে চায় না।

মানুষ ভাবতে চায় না বলে মানে না। আত্মার অস্তিত্ব আমি অস্বীকার করতে পারি না।

মহিম একটা স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

 আমি একটু হোমিওপ্যাথির চর্চা করি। স্পন্ডেলাইটিসের ওষুধ আছে। খাব কি?

 নিশ্চয়ই খাবেন। আমার নিজের কোনওরকম পেন-টেন হলে আমিও তো আর্নিকা খাই।

সত্যি?

অনল বাগচী হেসে বলল, বললাম না আজকাল খুব আনকনভেনশনাল ওষুধের গুরুত্ব বাড়ছে। ভারত সরকার তো আদিবাসীদের ওষুধ নিয়ে রিসার্চ করাচ্ছে। বিদেশেও হারবাল মেডিসিনের চল হচ্ছে। কীসে যে কী হয় তা তো আমরা জানি না।

আপনি বড় উদারচেতা মানুষ।

তা নয়, আই ট্রাই টু বি লজিক্যাল। আমাদের লিমিটেশনগুলোও যে আমি জানি।

মহিমের খুব ইচ্ছে হল ডাক্তারবাবুটিকে আশীর্বাদ করে। মুখে শুধু বলল, ঠাকুর আপনার মঙ্গল করুন। বড্ড অমান্যির যুগ পড়েছে বলে ভারী দুশ্চিন্তা হয়। কেউ কিছু মানতে চায় না।

তা ভাবছেন কেন? কিছু লোক মানে, কিছু লোক মানে না। বরাবরই এরকম চলে আসছে। আপনি যা বিশ্বাস করেন সেটা ছাড়বেন কেন? শুধু অন্ধ কুসংস্কার জিনিসটা ক্ষতিকারক। সেটা পেয়ে বসলে মুশকিল।

ডাক্তার চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ মহিম লোকটার কথা খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে ভাবল।

সন্ধ্যা কাছেই বসেছিল। কেঁদে কেটে চোখ লাল। গলা ধরেছে। ডাক্তারের কথা শুনে এখন একটু মুখটা স্বাভাবিক হয়েছে। বাড়ির সবাই ভিড় করে ছিল এতক্ষণ। কমল এখনও আছে। আর মুকুল পায়ের কাছে বসে একটা হট ওয়াটার ব্যাগ ধরে আছে পায়ের তলায়।

কমল বলল, অমলকে ফোন করে দিয়েছি বাবা।

মহিম অবাক হয়ে বলে, কেন?

 তুমি মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ায় ভয় পেয়ে ওকে জানিয়েছি।

দেখ কাণ্ড! তাড়াহুড়োর কী ছিল? সে কাজের মানুষ, অফিস কামাই করে হয়তো এসে পড়বে। ডাক্তার তো বলেই গেল কিছু হয়নি।

আহা, আসুক না। আজ তো শুক্রবার। আগামীকাল তো এমনিতেই ওদের আসবার কথা।

 তাহলেও দুশ্চিন্তা করতে পারে। হ্যাঁ রে, ডাক্তার কোনও ওষুধ দিয়েছে?

হ্যাঁ, প্রেসক্রিপশনে তিনটে ওষুধের নাম দেখছি।

 ওসব ওষুধ আর আনিস না যেন। খাওয়ার কথা কিছু বলে গেল?

শুধু বলল, নুনটা কম খেতে। আর তেল মশলা তেমন না খাওয়াই ভাল। তা খাওয়া নিয়ে আবার কবে তোমার মাথাব্যথা ছিল? তুমি এমনিতেও তো একটুখানি খাও। তোমার বউমা তো বলে, বাবার খাওয়া দিনদিন কমে যাচ্ছে। হ্যাঁ বাবা, কফি ধরেছ বুড়ো বয়সে, তাই থেকেই এসব হল না তো!

দুর পাগল। কফি থেকে কী হবে?

নেশার জিনিস তো!

 নেশা মানে তো মদ গাঁজা নয় রে বাবা।

সন্ধ্যা বলল, ও তোমার আর খেয়ে দরকার নেই বাবা। কী থেকে কী হয় কে জানে। তোমার কিছু হলে আমার বাপু হার্টফেল হয়ে যাবে। যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে আজ।

আমার কী মনে হয় জানিস?

কী?

পেটে বায়ু হয়ে এরকমটা হয়েছিল। ঊর্ধ্বগামী বায়ু থেকে কত কী যে হয়।

আমার কাছে হজমি আছে। দেব? নিজের হাতে যত্ন করে তৈরি করেছি। যারা খাচ্ছে সবারই উপকার হচ্ছে।

দিস খন। ভয়ের কিছু নেই।

 চুপটি করে শুয়ে থাকো। আজ রাতে আমি এ-ঘরেই ক্যাম্পখাট পেতে শুয়ে থাকব।

আবার লেপতোশক টানাহ্যাঁচড়া করতে যাবি কেন? আমি তো ভালই আছি।

ভালই যদি আছ তাহলে মাথা ঘুরল কেন?

 ওই যে বললুম, বায়ু।

 থাক আর নিজের ডাক্তারি নিজে করতে হবে না। তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে বলো তো। তোমার কিছু হলে আমার যে কী হবে।

এ কথায় মহিমের বুকের ভিতরটায় যেন একটা মন্থন শুরু হল। তার এই মেয়েটা যে কত অসহায় তা মহিম জানে। ভাগ্য ভাল যে নিজের আর্থিক সংগতিটা নিজেই করে রেখেছে। কাজকর্ম নিয়ে সংসার ধর্মের অভাব ভুলে আছে। কিন্তু এ তো খেলনা, চুষিকাঠি। মেয়েদের রক্তের ভিতরে তো অন্য স্বপ্ন থাকে। যতই জজ ব্যারিস্টার হোক, তার মাতৃত্বে হাহাকার থাকলে সব ছাইমাটি হয়। আজকালকার মেয়েরা হয়তো বুঝতে চাইবে না। কিন্তু সত্যকে আর কত ঢাকাঁচাপা দিয়ে রাখা যাবে?

মহিম মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে বলল, ওসব ভাবছিস কেন? দুনিয়ায় কারও জন্য কিছু আটকে থাকে না।

ওরকম বোলো না। আজ আমি বড্ড ভয় পেয়েছি।

 ভাবিস না। শরীর আমার ভালই আছে।

পায়ের কাছ থেকে মুকুল বলল, ও দাদু, টক করে রাত আটটার সিরিয়ালটা দেখে আসব?

 দেখে আয়। আর পায়ে সেঁক দিতে হবে না তোকে। পা গরম হয়ে গেছে।

 আধঘণ্টা বাদেই ফের আসব।

 আসিস।

 হ্যাঁ দাদু, মা জানতে চাইল রাতে কী খাবে?

 আজ কিছু না খাওয়াই ভাল।

 সন্ধ্যা বলে, না বাবা, শরীর দুর্বল হবে। বরং দুধ-খৈ খেও।

তাই পাঠিয়ে দিতে বলিস।

 বলে একটু চোখ বুজল মহিম। মাথা ঘোরার ভাবটা একটু আছে। মাথা নাড়া দিলেই টলটলে একটা ভাব। ঘর দুলে উঠছে। বয়স আশির চৌকাঠ ডিঙিয়েছে। এখন কত কী হতে পারে। বেসুর বাজতে লেগেছে।

রাতে গভীর ঘুম হল মহিমের। সকালবেলা সূর্যাস্তের কিছু আগে ঘুম ভাঙল। পুব আকাশ সবে ফর্সা হতে লেগেছে। মহিম রোজ অন্ধকার থাকতে ওঠে। আজ দেরিই হল।

খুব সাবধানে পাশ ফিরে কাত হয়ে হাতের ভর দিয়ে মাথাটা তুলল সে। প্রথমটায় মনে হল, ঠিক আছে। কিন্তু আর একটু খাড়া হয়ে বসতে যেতেই মাথাটায় এমন চক্কর দিল যে মহিম ধপ করে বালিশে ক্লান্ত মাথাটা ফেলে হাঁফাতে লাগল। কী মুশকিল। সকালে প্রাতঃকৃত্য আছে, পুজোপাঠ আছে। এরকম হলে কী করে চলবে?

সন্ধ্যা পাশেই ক্যাম্পখাটে শুয়ে আছে। একবার ভাবল, সন্ধ্যাকে ডাকবে। তারপর ভাবল, এই অবস্থায় ওকে ডেকেই বা কী হবে! কিছু তো করতে পারবে না। বরং চেঁচিয়ে-মেচিয়ে লোক জড়ো করবে।

তার চেয়ে শুয়ে থাকাই ভাল।

মনে পড়ছিল এই মাথা ঘোরার ব্যামো ছিল তার মায়ের। আর সেই ব্যায়ো নিয়েই মা মরে মরে ঘর-সংসারের কাজ করত। মাঝে মাঝে বাড়াবাড়ি হলে শয্যা নিয়ে পড়ে থাকত। চিকিৎসা বলতে মাথায় ভেজা গামছা চেপে রাখা। স্পন্ডেলাইটিসই হবে বোধহয়। তখন তো লোকে এত জানত না।

বেশ একটু বেলার দিকে মহিম উঠতে পারল। মাথা ঘুরছে বটে তবে সওয়া যাবে। পুজোর ফুল সন্ধ্যাই তুলে দিয়ে গেল। মহিম পুজোপাঠ সেরে রোদে ইজিচেয়ারে বসে রইল ক্লান্ত শরীরে।

বসে ঘুমিয়েই পড়েছিল বোধহয়।

ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার চেঁচানিতে, ওম্মা গো, কে এসেছে দ্যাখোসে সব। এতদিনে মনে পড়ল আমাদের, ও জ্যাঠাইমা।

 মহিম চমকে চোখ মেলে যাকে দেখল তাকে প্রথম যেন মতের মানবী বলে মনেই হল না তার।  শ্বেত শুভ্র বসনে এ যেন শ্বেতপাথরের দেবীপ্রতিমা। বলাকা কদাচিৎ কারও বাড়িতে যান। পাড়া বেড়ানোর অভ্যাস কোনওকালে ছিল না বলাকার, গাঁয়ের মেয়েদের মতো কূটকচালিও করেননি কখনও। আর সেই জন্যই সারা গাঁয়ে এই মহিলার প্রতি প্রত্যেকের ভীতিমিশ্রিত সম্ভ্রমের ভাব আছে।

একবার–জীবনে মাত্র একবার, বহুকাল আগে এক বৈশাখী ঝড়ের দিনে আমবাগানে কিশোরীরবধূ বলাকার প্রতি কামভাব বোধ করেছিল মহিম। সেটা বয়সের দোষ। অমন সুন্দরীর প্রতি কোন পুরুষ না আকর্ষণ বোধ করবে? কিন্তু মহিলা তো মানবী নন, দেবী। চোখ দেখেই কিছু টের পেয়ে এক ছুটে পালিয়ে গিয়েছিলেন বাড়ির ভিতরে। ওই একবারই। তার পর থেকে মহিম এই মহিলাকে সর্বদাই শ্রদ্ধা করে এসেছে। একটু ভয় পেয়েছে।

বউঠান! বলে তড়িঘড়ি উঠতে যেতেই মাথার শত্রুতায় ফের এলিয়ে পড়তে হল মহিমকে।

উঠবেন না। চুপ করে বসে থাকুন তো। বলে বলাকা সন্ধ্যার এগিয়ে দেওয়া কাঠের চেয়ারটায় বসে বলল, আজ সকালে খবর পেয়েই ছুটে এসেছি। কী হয়েছে আপনার?

মহিম ম্লান হেসে বলে, গুরুতর কিছু নয় বোধহয়, ডাক্তার ভরসা দিয়ে গেছে। স্পন্ডেলাইটিস বলে সন্দেহ।

ওসব আজকাল সকলের মুখেই শুনি। রোগটা কী?

ঘাড়ের হাড়ে গোলমাল। তাই থেকে নার্ভের দোষ।

যাক বাবা, সিরিয়াস কিছু না হলেই হয়। আমাদের বয়সিরা তো সব একে একে চলে যাচ্ছে। তাই খবরটা পেয়েই খুব চিন্তা হয়েছিল। কর্তা তো মহিম বলতে অজ্ঞান হতেন।

মহিম ভারী খুশির হাসি হাসল। বলল, দাদা আর আমি ছিলুম হরিহরাত্মা, ছায়া হয়ে ঘুরতুম পিছনে পিছনে। উনি গিয়ে অবধি আমার ভারী একা লাগে বউঠান।

তা জানি। দুজনের বন্ধুত্ব তো দেখেছি।

বলাকা এসেছেন খবর পেয়ে বাড়ির সবাই এসে ঘিরে ফেলল। এটা একটা ঘটনাই বটে। বলাকাকে গাঁয়ের অন্য কোনও বাড়িতে যেতে দেখে না কেউ। এই আসাটা তাই এ বাড়ির পক্ষে একরকম একটা গৌরবজনক ঘটনাই। গৌরহরি যেমন তেজি মানুষ ছিলেন, বলাকাও তেমনি তেজস্বিনী।

বলাকার গায়ে একটা দামি কাশ্মীরি শাল। কী মুখ চোখ, কী গায়ের রঙের জেল্লা। বাড়ি যেন আলো হয়ে গেল।

মহিম কৃশ, দীপশিখার মতো নারীমূর্তির দিকে চেয়ে থেকে বলল, আপনি রোগা হয়ে গেছেন বউঠান।

মোটা হলে ভাল হত বুঝি? মেয়েরা যত মোটা হবে ততই রোগের আকর হবে। সেদিন এক ডাক্তার তো বলে গেল, আমার নাকি কোনও রোগই নেই।

রোগা হয়ে ভালই আছেন বউঠান। এরকমই ভাল।

ভাল থাকতে কে চায় বলুন তো! বেঁচে থাকার মতো এমন একঘেয়ে জিনিস আর হয় না। উনি যতদিন ছিলেন কিছুই খারাপ লাগত না। এখন প্রতিদিন সকালে মনে হয়, দিনটা কেমন করে কাটবে। কতদিন যে বেঁচে থাকতে হবে তাই ভেবেই ভয় করে।

মহিম একটু হেসে বলল, বেঁচে কি আপনি আছেন বউঠান? যেদিন গৌরদা মারা গেলেন সেদিন আপনি সহমরণে যেতে চেয়েছিলেন, আমার মনে আছে। সেদিনই বুঝেছিলাম গৌরদার সঙ্গে আপনার শরীরটা না গেলেও সত্তাটা সহমরণেই গেছে। আনন্দে আমার চোখে জল এসেছিল।

এখন চুপ করুন তো, অত কথা বলতে হবে না। ওষুধপত্র কিছু খেয়েছেন?

না। ডাক্তার বলে গেছে ওষুধের তেমন দরকার নেই। হাঁটাহাঁটি করলেই হবে।

আমি আপনাকে চিনি ঠাকুরপো। আপনি অ্যালোপ্যাথি করতে ভয় পান।

তা একটু পাই।

কিন্তু পুরনো অভ্যাস আঁকড়ে থাকলে তো চলবে না। মাথা ঘোরাটা না কমালে অচল হয়ে পড়বেন যে।

মহিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, অচল হওয়াতেই তো ভয। মৃত্যুটা তো ভয়াবহ নয়, ভোগান্তিই আসল ভয়ের জিনিস।

তা হলে ওষুধ আনিয়ে আজ থেকেই খান।

বলাকা বেশিক্ষণ বসলেন না। বললেন, একা সংসার আগলানো যে কী বন্ধন তা কী আর বলব। উনি যে কী অচলায়তনের সঙ্গে জুতে রেখে গেলেন আমাকে। ওই রাক্ষুসে বাড়ি যেন সারাদিন আমাকে গিলতে আসে। হ্যাঁ, ঠাকুরপো, মানুষ এমন বিষয় সম্পত্তির জন্য হেদিয়ে মরে কেন বলতে পারেন? আমার কোন কাজে লাগছে বলুন তো বিষয়-আশয়? ছেলেমেয়ে কেউ কাছে থাকে না, কারও ভোগে লাগে না। কী যে জ্বালা!

মহিম ম্লান হেসে বলে, সব জানি বউঠান। গৌরদা তো বলতেন, দ্যাখ মহিম, এই যে বিষয় সম্পত্তি তিল তিল করে করলাম, এ আবার তিন মিনিটে উড়িয়েও দিতে পারি। তবে না পুরুষ!

তিনি পুরুষ ছিলেন, আমি তো তা নই। আমি তো তিন মিনিটে ওড়াতে পারব না। বড় জ্বলছি ভাই।

বলাকা উঠে বড়বউয়ের সঙ্গে একটু বাড়িঘর ঘুরে দেখল। যাওয়ার সময় বলল, ভাল থাকবেন আর বেঁচে থাকবেন। বুঝলেন?

এটা কি আশীর্বাদ বউঠান?

আপনি বয়সে বড় না? আপনাকে কি আশীর্বাদ করতে পারি?

 দেবীরা পারেন। সে যাক, সহজে মরব বলে মনে হয় না বউঠান। ভাববেন না।

বলাকা চলে যাওয়ার পর সন্ধ্যা এসে বলল, চলো তো বাবা, এবার ঘরে গিয়ে একটু শুয়ে থাকবে।

কেন রে, আমাকে রুগি বানাতে চাস কেন? বেশ তো খোলামেলায় বসে আছি। আমার ভালই লাগছে তো।

চোখমুখ তো সে কথা বলছে না। দেখে মনে হচ্ছে ভারী ক্লান্ত আর দুর্বল হয়ে পড়েছ।

ও তোর মনের ভুল। তেমন খারাপ লাগছে না। বরং একটু কফি করে দে, রোদে বসে খাই। কফি বড্ড ভাল জিনিস। শরীর চনমনে করে দেয়।

ভাল না ছাই। ওটা খেয়েই তো এরকমটা হল তোমার।

দুর পাগলি। তোর শাসনেই আমি কাহিল হয়ে পড়ব।

এইসব কথাবার্তার মাঝখানেই উঠোনের বড় আগলটার কাছ ঘেঁষে নিঃশব্দে অমলের ঝকঝকে গাড়িটা এসে থামল।

মহিম ভারী খুশি হয়ে বলল, ওই তো ওরা এসে গেছে!

খাড়া হতে গিয়ে মাথাটা ফের টলোমলো হল মহিমের। সভয়ে মাথাটা পিছনে হেলিয়ে ইজিচেয়ারে চেপে ধরে রইল সে। কী যে হল মাথায় কে জানে বাবা।

প্রথমেই নেমে দৌড়ে এল সোহাগ। হাঁটু গেড়ে বসে মহিমের হাঁটুর ওপর হাতের ভর দিয়ে মুখের দিকে চেয়ে বলল, কী হয়েছে তোমার?

কিছু হয়নি রে তেমন। মাথাটা কাল থেকে বড্ড ঘুরপাক খাচ্ছে দিদি।

জেঠু ফোনে বলেছে স্ট্রোক। সেই থেকে আমার কী মনখারাপ।

আরে না। স্ট্রোক নয়। কমল ভয় পেয়ে বলেছে।

মহিম তার দুর্বল চোখে চেয়ে দেখল তার সামনে যেন ঝলমল করছে চারটে মানুষ। অমল, মোনা, সোহাগ আর বুডঢা। কিছু কাল আগেও বড্ড ম্লান, মলিন, দড়কচা মেরে ছিল ওরা। কোন মন্ত্রে যেন আরোগ্য হয়েছে। সংসারে তো জোয়ার ভাঁটার বিরাম নেই। মাঝখানে তো অমল আর মোনার ডিভোর্সের কথা চলছিল। আজ ওদের দেখে বুকটা ভরে গেল মহিমের। জীবনের শেষ রাউন্ডে এরকম ছোটোখাটো কিছু আনন্দ পাওয়াই তো অনেক পাওয়া।

অমল রাগ করে বলল, দাদা এমনভাবে খবরটা দিয়েছে যে আমি তো ভাবলাম সকালে এলে আর তোমাকে দেখতেই পাব না। এত ভয় পেয়েছিলাম।

মহিম হেসে বলল, ওর দোষ কী? ঘটনাটা এমন অতি নাটকীয়ভাবে ঘটল যে ওরা ভেবেছিল গুরুতর কিছু। ডাক্তার এসে দেখে-টেখে বলল তেমন কিছু নয়। হার্ট ভাল আছে, লাংস ক্লিয়ার।

যে যাই হোক, এবার কলকাতায় চলো তো আমার সঙ্গে। ভাল করে চেক আপ করিয়ে দেব।

মহিম হেসে বলে, আগেই উতলা হওয়ার কী আছে। ডাক্তারবাবুটি বেশ ভাল, বিবেচক। মস্ত বিলিতি ডিগ্রি আছে। এরও চিকিৎসা খারাপ নয়। সামান্য ব্যাপার হলে টানা হ্যাঁচড়ার দরকার কী?

মোনার হাতে প্লাস্টিকের ব্যাগে ফলের ঠোঙা।

আপনার জন্য এনেছি।

ভারী আপ্যায়িত হয়ে মহিম বলল, বাঃ! কত কী এনেছ?

শরীরটা তো একটু শুকিয়েছে দেখতে পাচ্ছি।

এই বয়সে একটু শুকোনোই ভাল বউমা। হালকা পলকা থাকলে রোগ বালাই কম হয়। তোমরা যাও, বিশ্রাম করোগে। এতটা পথ গাড়িতে এসেছ।

শুধু সোহাগ রইল কাছে। দাদুর হাঁটুতে হাত রেখে নিলডাউন হয়ে বসে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইল মুখের দিকে। চোখ দুখানা করুণ।

কেন রে দিদি, অমন করে চেয়ে আছিস? এত সহজে মরব না রে। ভয় পাস না।

সোহাগ অনেকক্ষণ চুপচাপ চেয়ে থেকে হঠাৎ অদ্ভুত একটা কথা বলল, তুমি এতদিন কোথায় ছিলে দাদু? তোমাকে তো ভাল করে চিনতামই না।

মহিম হেসে বলল, সাহেবদের দেশে থাকলে ওরকমই তো হয়। আর সেইজন্যই আমার ওসব দেশ ভারী অপছন্দ। ওরা রক্তের টানটা মানেই না।

সন্ধ্যা কফি করে নিয়ে এসে বলল, এই মেয়ে, আমার ঘরে চল তো। সকালে কিছু খেয়েছিস? মুখটা তো শুকিয়ে গেছে।

খেয়েছি। টোস্ট আর দুধ।

দুর; সে তো কখন হজম হয়ে গেছে। আমার ঘরে আয়, তোকে চন্দ্রপুলি খাওয়াব।

চলো, বলে উঠে গেল সোহাগ।

মহিম চুপচাপ একা বসে রইল কিছুক্ষণ। সংসারের নানা কাজের শব্দ-সাড়া পাওয়া যাচ্ছে এখানে বসে। রোদটা মুখে লাগছে বড়। গাছের ছায়া সরে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।

কফিটা শেষ করে খুব সাবধানে ধীরে ধীরে মাথাটা তুলল মহিম। না, ঘুরছে না তো!

খুব সাবধানে উঠে দাঁড়াল সে। না, ঘুরছে না এখনও। বিশ্বজয়ীর মতো একটা হাসি ফুটল তার মুখে। ধীরে ধীরে হেঁটে সামান্য কয়েক পা হেঁটে নিজের ঘরের দরজায় উঠল সে৷ এখন এইসব ছোটোখাটো অ্যাচিভমেন্টে যুদ্ধজয়ের আনন্দ।

শুয়ে থাকা ব্যাপারটা ভারী অপছন্দ মহিমের। বিছানা জায়গাটা তার কোনওকালেই প্রিয় নয়। সে তাই শুল না। একখানা হোমিওপ্যাথির বই নিয়ে জানালার পাশে চেয়ারে বসল। সন্ধ্যার ঘর থেকে পিসি-ভাইঝির কলকলানি আর হাসির শব্দ আসছে খুব।

মহিম একটু তৃপ্তির হাসি হাসল।

.

সন্ধেবেলা কম্পিউটার নিয়ে বসেছিল বিজু। অখণ্ড মনোযাগে ই-মেল চেক করছে।

 দরজার কাছ থেকে মিহি মেয়েলি গলা এল, ও বিজুদা, তোমার কি ইন্টারনেট কানেকশন আছে?

বিজু ভ্রূ কুঁচকে দরজার দিকে চোখ ফিরিয়ে পান্নাকে দেখে বলল, কেন রে বাঁদর, তোর সে খবরে দরকার কী? কতবার তো বলেছি কম্পিউউটার শিখতে, কথা শুনেছিস?

আহা, শেখার সময় বুঝি চলে গেছে!

গেছে নয়, যাচ্ছে। আজকাল বাচ্চা ছেলে মেয়েরাও কম্পিউটার জানে। তোর তো ওইজন্যই ভাল পাত্র জুটছে না। যখনই পাত্রপক্ষ জানবে যে তুই একটা কম্পিউটার-মূর্খ তখনই সম্বন্ধ বাতিল করে দেবে।

আহা, আজ তো আমি কম্পিউটার শিখতেই এসেছি।

তাই বুঝি? আজ বোধহয় পশ্চিমে সূর্য উঠেছে।

তা বলে তোমার কাছে নয়।

 তবে কার কাছে?

আমি তাকে সঙ্গে নিয়েই এসেছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *