৫৬.
তবু নিজের চেয়ে রিহানার কথাটাই বুঝি বেশি করে ভাবে মালু। রিহানা ঠকে গেছে। ও ভুল করেছে। তাই অনুতাপে তুষের আগুনের মতো ও জ্বলছে সারাক্ষণ। কী এক সহানুভূতিতে ভিজে যায় মালুর মনটা। ওর মনে হয় ওর চেয়েও রিহানার দুঃখটা অনেক গভীর, আশা ভঙ্গের গ্লানিটা অনেক বেশি।
এ কী করছ রিহানা? অন্ধরাগে এ কোন্ নর্দমায় ডুব দিচ্ছ তুমি? মাথার দিকে বালিশ দুটোকে উঁচিয়ে ত্রি-ভঙ্গিমায় শুয়ে আছে রিহানা। মুখটা ঘুরিয়ে শুধাল, কী বলছ? বুঝতে পারছি না।
বুঝি বোঝাবার জন্যই উঠে এল মালু। কিন্তু, বসতে পারল না রিহানার পাশটিতে। কী এক দ্বিধা, কী এক সংকোচ। তার সাথে যেন ভয়ের মিশেল। ফিরে গিয়ে মোড়াতেই বসল মালু। বলল : যা ছেড়ে এসেছ সে দিকে আবার চোখ ফেরাচ্ছ কেন, রিহানা? যা হারালে তার ক্ষতিপূরণ আমাকে দিয়ে হল কিনা সে তর্ক তুলব না আজ। কিন্তু যে গর্বিণীর দীপ্তি নিয়ে ঝাঁপ দিয়েছিলে তুমি অনিশ্চয়তার গর্ভে সে তো জীবনের এক মহা মানিক। তাকে অমন করে ম্লান হতে দিচ্ছ কেন?
তোমাকে না নিয়ে মায়ের সাথে দেখা করতে যাই কেন, এই তো? কিন্তু আমাদের ফ্যামিলিতে তুমি যে গ্রহণযোগ্য নও সে তো বলেই দিয়েছি তোমাকে। করাতের মতো কাটা কাটা কথা রিহানার।
তা নয়। আমি বলছিলাম দোতলার ওই বেপারিটার সাথে তোমার অন্তরঙ্গতাটা বড় দৃষ্টিকটু, পাড়ার লোকেরা মুখ আড়াল করে হাসছে, দেখছ না?
দৃষ্টিকটু? এক ফুলকি আগুনের মতো দপ করে জ্বলে উঠল রিহানা। কমজাতে জন্ম নিলে মনটাও এত ছোট হয়, তাতো জানতাম না? বলি, নামমাত্র ভাড়ায় এতগুলো ঘর যে ছেড়ে দিল তাকে কোনোদিন দিয়েছ একটি ধন্যবাদ? দাওয়াত দিয়ে দুটো খাওয়ানের কথা ভেবেছ কখনো? ভদ্রতা, সৌজন্যবোধ এসব না হয় শেখনি। তাই বলে কৃতজ্ঞতা বোধটুকুও থাকবে না?
আহ্ রিহানা।
মুরোদ তো তোমার খুব দেখলাম। নতুন বৌকে নিয়ে তুললে পচা রাস্তার ঘিঞ্জি ঘরে। আবার বড় বড় কথা!
সেই ঘিঞ্জি ঘরের দুর্গন্ধটা এখনো ভুলতে পারেনি রিহানা। বুঝি সেই দুর্গন্ধটা এখুনি এসে আবার লেগেছে ওর নাকে। তাই নাক আর ঠোঁটের কুঞ্চনে চেহারাটাকে বিশ্রী করল রিহানা।
শিউরে উঠল মালু। যাকে মনে হয়েছিল রূপসী আজও সে সুরূপা সে মুখ এতো কুশ্রীও হতে পারে?
রোজ রোজ এই একই কথা আমাকে শুনিয়ে কোনো লাভ আছে রিহানা? মোহ ভেঙেছে তোমার। অনুতপ্ত তুমি। তাই তো বলছি, মুক্তির পথ তোমার খোলা, সে পথে না গিয়ে কাদা ঘাটছ কেন? পৃথিবীর যে অটল সহিষ্ণুতা আর নিঃসীম আকাশের যে উদারতা তাই যেন কথা বলে গেল মালুর কণ্ঠে।
সাপের জিবের মতো লকলকিয়ে উঠল রিহানা। মুক্তি? মুক্তি কে চায় তোমার কাছে? আমার সব কিছু কেড়ে নিয়ে আমার সর্বনাশ করে উদারতার অহংকার নিয়ে তুমি কেটে পড়বে ভাবছ? ভাবছ গানের বেহেশতে ফিরে গিয়ে নতুন নীড় বাঁধবে তুমি? সে আমি হতে দিচ্ছি না। তিলতিল যন্ত্রণার দাহ নিচ্ছি আমি, তার আঁচ থেকে বাঁচতে চাও তুমি? দুরাশা।
এ কী প্রতিহিংসা রিহানার?
হতভম্ব স্তব্ধ মালু।
এক চিলতে বিকেলের রোদ মেঝের উপর পিঠ এলিয়ে খেলা করছে আপন মনে। শার্শির কোনো কাছে গিয়ে পড়েছে তার প্রতিবিম্ব, সেই প্রতিবিম্বের কোনো চুম্বক আকর্ষণে কেঁপে কেঁপে চলেছে রোদের ফালিটুকু। স্থির দৃষ্টিতে সে রোদের খেলার দিকে চেয়ে মালু যেন ধ্যান করল আদিম কোনো পৌরুষ সত্তার।
ধীরে ধীরে উঠে এল মালুর দৃষ্টিটা। স্থির হল রিহানার মুখের উপর। বলল মালু : আচ্ছা রিহানা। সত্যি করে বলোনা, তুমি কী? আমার সুরের মিতা? অথবা শুধুই গঞ্জনা। এক পুঁটলি স্থূল কামনা?
রিহানার কানে বোধ হয় গেল না কথাগুলো। অথবা কানে তুলল না ও।
ও ফুঁসছে। ফুলছে। কাঁপছে। আচমকা এক ভাঁজ স্প্রিংয়ের মতো আন্দোলিত হয়ে উঠে বসল ও। কী এক ধিক্কারে নিজের প্রতিই যেন ছিটিয়ে দিল ঘৃণার ঝুরি–ইস, যদি জানতাম।
কী জানতে না? শুধাল মালু।
জানতাম না যে তুমি একটা অকাট মূর্খ। বলনি সে কথা।
আর কী বলিনি?
বলনি, জন্ম পরিচয়হীন ভৃত্যের জীবিকায় মানুষ।
আর?
অক্ষম অপদার্থ। সাধ আকাশের চাঁদ ধরবার।
সাধ হয়ত ছিল রিহানা। কিন্তু আকাশের চাঁদটা যে নিজে এসেই ধরা দিল আমার হাতে।
সেটা ভুল।
সবটাই কী ভুল? যে গান যে সুর সমুদ্র মন্থন করে তুলে এনেছিল তোমাকে, সেটাও কী ভুল? রিহানা, সে গান সে সুর তো আমার এখনো স্তব্ধ হয়নি। এসো সুরের রাজ্যে আমরা নতুন বাসর গড়ি? এসো না নতুন প্রাণে বাঁচি? আসবে? যেন মুমূর্ষুর অন্তিম আকুতি কেঁপে উঠল মালুর কণ্ঠে। লিকলিকে বেতের মতো একটুখানি বেঁকেই সোজা হল রিহানা।
সুর সুর সুর। গান গান গান। যেন সুর আর গান খেয়েই বাঁচতে পারে মানুষ। মর্যাদা। গান বেচে কিনতে পেরেছ এক আধলা সামাজিক মর্যাদা? পাত পেয়েছ কোনো ভদ্র ঘরে?
স্থৈর্যের ধৈর্যের অটলতার সেই যে মহা শক্তি মালুর সত্তার গভীরে, সে বুঝি এগিয়ে এল না মালুর সহায়তায়। আঘাতে অপমানে বুঝি ধুলোয় গুঁড়িয়ে যাবে মালু।
কী ভাবছে মালু? পৌরুষে আক্রোশে পরাভূত করবে, ঝলসিয়ে দেবে ওই স্থূল রুচির মেয়েটাকে? শক্তির আলিঙ্গনে খান খান করে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে ওর মিথ্যা গৌরব? স্বামিত্বের অধিকারে কেড়ে নেবে ওর এই মিথ্যা তেজ?
এত কথা কী ভাবল মালু, না অবকাশ পেল ভাববার? তার আগেই ও লুফে নিল সাপের জিবের মতো লকলকিয়ে যাওয়া সেই দেহখানি।
প্রচণ্ড আঁচে বলক খেয়ে টগবগিয়ে উঠল রিহানা। হাত পা ছুঁড়ল। চিৎকারে কান্নায় ছটফটিয়ে গেল। কামড় বসিয়ে দিল মালুর কাঁধে। আঁচড় কেটে, ঠেলা মেরে আলগা হতে চাইল মালুর নিষ্ঠুর আলিঙ্গন থেকে। কিন্তু আদিম বন্যতার আক্রমণের মুখে কতক্ষণ টিকে থাকবে ওর প্রতিরোধ।
স্তব্ধ হল প্রতিবাদের কণ্ঠ।
নেতিয়ে পড়ল প্রতিরোধের দুটো বাহু।
অবশ হয়ে সিধা হল পা জোড়া।
নিস্তেজ হল রিহানা।
পৌরুষ এসে বিদ্ধ করল ওকে।
বিধ্বস্ত হল আজকের মুখরা রিহানা। পৌরুষ উত্তাপে সিদ্ধ হল রিহানা। সিদ্ধ হয়ে হয়ে নরম হল। নরম হয়ে রোঁয়া রোঁয়া ছিটকে পড়ল। ছিটে-ভিটে একাকার হবার আগে ওর আহত নারীত্বটা বুঝি শেষ বারের মতো একটুখানি শক্তি সংগ্রহ করল। দুর্বল বুজে আসা কণ্ঠের চাপা গর্জনে উচ্চারিত হল একট ভয়ংকর শব্দ-বর্বর।
৫৭.
এ কী করল মালু?
লাঞ্ছিত করল নিজের পৌরুষকে? অপমানিত করল রিহানার নারীত্বকে? কেমন করে ওকে মুখ দেখাবে মালু? পৌরুষ অহংকারের এতবড় পরাজয় নিয়ে ও কী কোনোদিন যেতে পারবে রিহানার সুমুখে?
আশ্চর্য মানুষের মন। আত্মার শাসনের বিদ্রোহ করার জন্যই যেন তার সৃষ্টি। তাই যদি না হবে, তবে কেমন করে বর্বরতার আচরণে আপনাকে কলঙ্কিত করল মালু?
মনটা যদি হত ইস্পাতের কাঠি অথবা একতাল কাদা। তা হলেই যেন তাকে বিশ্বাস করা যায়, নির্ভর করা যায়। আর এমনি মনকে নিয়ে হয়ত যা খুশি তাই করা যায়।
কিন্তু, মালু যেন আর পারছে না ওর মনটাকে নিয়ে যা খুশি তাই করতে। পারছে না মন নামের শক্তিটার উপর নির্ভর করতে। অল্প কয়েকটি দিনের ভেতর কখন এতটা অধঃপতন হল মালুর?
রিহানা উঠে গেছে দোতলায়। সেখানেই থাকে ও।
হঠাৎ কোনোদিন নেবে আসে। দুদণ্ড বসে যায়। দেখা হয় না মালুর সাথে। কখনো বা দেখা হয়ে যায়। কথা হয় না।
রিহানার আর এক খালু করাচী থেকে বদলি হয়ে এসেছে ঢাকায়। ছয় মেয়েকে নিয়ে খালু আপাতত উঠেছে দোতলায়।
ব্যবসার কাজে আহসান গেছে কন্টিনেন্টে। হামবুর্গ, ডুসেলডর্ফ, মিলান, কোপেনহেগেন ইয়োরোপের এমনি সব শহরের ছাপ নিয়ে চিঠি আসে ওর। ছয় বোনের সাথে রিহানা, সাত বোনে মিলে গোগ্রাসে গেলে চিঠিগুলো। সে চিঠি নিয়ে গল্প করে সাত বোন, হয়ত মালুকে শোনাবার জন্যই। মালুর কানে আসে।
সাতটি নানা রং ফুলের তোড়ার মতো ওরা সাজে। বেড়াতে যায়। বাইরে খেতে যায়। সিনেমায় যায়। গেইটে অথবা একতলার দোর গোড়ায় হয়ত দেখা হয়ে যায় মালুর সাথে। আর তখন বারটি চোখের নিগ্রহে মাটির সাথে থেতলে যায় মালু। রিহানা চেয়ে থাকে অন্য দিকে।
ছয় বোনের ছোট দুজন, সবে মাত্র ফ্রক ছেড়ে শাড়ি ধরেছে। ওদের চোখে কৌতূহল মেশানো অনুকম্পা। সিঁড়ির গোড়ায় ওদেরই মুখোমুখি মালু। দাঁত জিব কেটে চোখ কপালে তুলে শুধায় ওরা, এ্য মা! ছিঃ আপনি নাকি ম্যাট্রিক পাস করেন নি? গানের টুশানি করে পেট চালান?
ওরা অপেক্ষা করে না উত্তরের জন্য। দৌড়ে উঠে যায় দোতলায়। সেখান থেকে চেয়ে থাকে অসহায় মালুর দিকে।
ছয় বোনের সব চেয়ে বড়জন, সে মুখ খোলে না। যদি কখনও চোখাচোখি হয় মালুর সাথে, নিঃশব্দ অবজ্ঞায় চোখ ফিরিয়ে নেয় ও, যেন বলে, কী স্পৰ্দ্ধা!
দিনগুলো বেশির ভাগ বাইরেই কাটছে মালুর।
কিন্তু বাইরের জগটাও তো বিষিয়ে উঠেছে। বিষিয়ে উঠেছে সেই হলদে বাড়িটার হাওয়া। সেখানেও উপেক্ষা, সন্দেহ, কিছু অনুকম্পা। শেষ পর্যন্ত হয়ত লাঞ্ছনাও।
মালু প্রস্তুত। জীবনে কোনো কিছুই আর অসম্ভব, অভাবিত বলে ধরে নেয় না ও। সবই সম্ভব এই মানুষের পৃথিবীতে। যে পৃথিবীর বিচিত্র বৈপরীত্যে একই মাটিতে বাস করছে রিহানা, রাবু অথবা ইয়াসীনের বাগদত্তা হোসনার মতো মেয়ে, জাহেদ আর আহসানের মতো পুরুষ। তাই লাঞ্ছনার মুহূর্তটি যখন এসে গেল নিজেকে একটুও অপ্রস্তুত দেখল না মালু।
মালেক, তোমার ওই উদ্ভট এক্সপেরিমেন্টটা ছাড়তো।
স্যার, সব এক্সপেরিমেন্টই প্রথম প্রথম উদ্ভট বলে মনে হয়।
বেশি কাজ অল্প কথার মানুষ বড় সাহেব। মালুর জবাবটা শুনে কেমন থ মেরে চেয়ে থাকেন ওর দিকে। তার পর যা তিনি কখনো করেন না তাই করে বসলেন। অর্থাৎ পয়লা বাক্যে হুকুমটা জানিয়ে দিয়ে ও তর্কে অবতীর্ণ হলেন মালুর সাথে।
দেখ, কলা পাতায় কী ডিনার খাওয়া চলে?
ডিনার মানে, আমরা যা বুঝি বিলেতী পদ্ধতিতে বিলেতী খাবার। এই তো?
হাঁ তাই।
টেবিল চেয়ার কাঁটা চামচ আমাদের নেই বলে সে খাদ্যটা তো আর হারাম হয়ে গেল না? কলা পাতা রয়েছে আমাদের সেই কলাপাতাই সই।
কিন্তু, বেমানান, দৃষ্টিকটু।
হোক বেমানান। স্বাদ দিয়ে কথা। স্বাদটা নেব। নেব আমাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে, প্রয়োজন মতো সংমিশ্রিত করে। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে এ সংমিশ্রণ অনিবার্য। নইলে আমাদের গান, কতগুলো মিষ্টি কথা হয়েই থাকবে, সঙ্গীতে উত্তীর্ণ হতে পারবে না। বড় সাহেব নয়, যেন সামনে সমানে তর্ক করছে মালু, তেমনি জোর ওর কথায়।
লোকে বলছে এ নাকি খিচুড়ি এবং জগা খিচুড়ি।
বলুক। লোকে তো অনেক কথাই বলে। উদ্ধত, এমন কী দাম্ভিক জবাব মালুর।
বড় বড় চোখ করেন বড় সাহেব। স্নেহ করেন মালুকে, ওর শ্রোতা বিজয়ী কণ্ঠ আর প্রতিভার জন্য। একটুখানি আশকারাও দিয়ে এসেছেন সব সময়। কিন্তু এমন বেয়াড়া কথাটা বুঝি আর হজম করা যায় না।
কিন্তু মালেক, পল্লী গানে পশ্চিমী বাজনা, দেহাতীদের জন্য ক্লাসিক্যাল রাগ, এতো স্রেফ পাগলামি। এই ক্ষ্যাপামি তোমার বাড়িতে চলতে পারে, কিন্তু, রেডিও হল সরকারি প্রতিষ্ঠান, এখানে চলবে না। তর্কের ইতি টেনে আখেরী ফরমানটা আবার শুনিয়ে দিলেন বড় সাহেব। এর কোনো জবাব নেই। উচ্চতর আদালতে আপিল নেই।
বশির ঝুঁকিয়ে সালাম ঠুকে চলেই আসছিল মালু। আবার ডাক এল, শোন, আর একটা কথা।
ফিরে দাঁড়াল মালু।
খানিক আগের বড় সাহেবী চেহারা আর মেজাজ দুটোই যেন একটু নরম হয়ে এসেছে, নরম গলায় বললেন বড় সাহেব : কানাঘুষো উঠেছে অফিসে, অফিসের বাইরেও। অমন দায়িত্বপূর্ণ পদে নন ম্যাট্রিক কেন? যেখানে অনুরূপ পদে সর্বত্র গ্র্যাজুয়েট! ইদানীং তোমার নামটা অফিসে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে পড়েছে। তাই…
এতে এত চিন্তিত হচ্ছেন কেন, স্যার? এই অস্বস্তির মাঝে আমারও চাকরি করার ইচ্ছে নেই। ইস্তফা পত্রটা লিখে এখুনি আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি আপনাকে।
ধাঁ করে বলে গেল মালু। দরজা অবধি গিয়ে আবার ফিরল। বলল : আপনার স্নেহ এবং অনুগ্রহ আমি কখনো ভুলব না।
নিজের কামরায় এসে তক্ষুনি ইস্তফা পত্রখানা লিখে ফেলল মালু। বড় সাহেবের হাতে পৌঁছিয়ে দিয়ে যেন স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। চেয়ার খানিতে হেলান দিয়ে হাত পা ছাড়িয়ে আরাম করার অবকাশ পেল মালু।
কিন্তু, একী বিদ্রূপ ওকে ঘিরে! বড় সাহেবের খাস কামরার কথাবার্তাগুলো বুঝি দেয়াল ফুড়েই বেরিয়ে এসেছে, তাই সহকর্মীদের মুখে বিদ্রূপের অবজ্ঞার কী এক চাপা হাসি, খানিকটা তিরস্কার যারা একটুবা সহানুভুতিশীল তাদের চোখে অনুকম্পা!
আরও অসহ্য, মালু ঘৃণা করে অনুকম্পাকে।
আরো আশ্চর্য হয় মালু। কী অদ্ভুত সাদৃশ্য ওদের সাথে রিহানার। এদের চোখ আর রিহানার চোখ, সব চোখেই যেন একই বিদ্রূপ : মূর্খ হয়ে কতদিন আর ফোঁপর দালালী করবে? সব জারিজুরি তো ধরা পড়ে গেল তোমার।
গুণের কদর নেই, রিহানার কাছেও না। এখানেও না।
করিম মিঞা আর ইয়াসীন। মাথা হেঁট ওদের। যেন ওরাই অপরাধী। ওরা বুঝছে না ওরা কী করবে কী বলবে।
তবু ছাই তার চেয়ে একটু ঘুরেই আসা যাক। বিদ্রূপ ভরা চোখগুলোর উপর এ রকম তাচ্ছিল্য ছুঁড়ে বেরিয়ে এল মালু।
রাস্তায় নেবে নিজেকে খুব হাল্কা মনে হয় মালুর, নিজেকেই যেন আজ অদ্ভুত ভাবে ভালো লেগে যায় ওর।
অনেক শৃঙ্খল বুঝি আপনা থেকেই খসে পড়ল। মুক্তি দিল মালুকে। রিহানা গেছে, ছাত্রীরা গেছে। ভক্তজনের বাহবা, আনুকূল্য, শ্রোতার হাত-তালি সবই গেছে। আজ চাকরিটাও গেল।
দায় দায়িত্বের বালাই নেই, বিবেকের তাড়নায় অসমাপ্ত কাজের হিসেব নিয়ে সারাক্ষণ ছটফটিয়ে মরা, কোনো কিছুর বালাই নেই। তালতলি বাকুলিয়া ছাড়ার পর নিজেকে কখনো এত মুক্ত, এত স্বাধীন মনে হয়নি মালুর।
নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে ঢাকার বেতারে রেকর্ড বাজল। পর পর দুহপ্তা!
৫৮.
সব শুনলেন রাকীব সাহেব। গম্ভীর হলেন, কী এক অকল্যাণের চিন্তায়। তাঁর ছোট মুখখানি কুঁচকে আরো ছোট হয়ে এল শুকনো আঙ্গুরের মতো। বললেন, ভুল করছ।
কিন্তু, আত্মসম্মান যে থাকে না রাকীব ভাই।
দায়িত্বের চেয়ে তোমার আত্মসম্মানটাই বড় হল? অকস্মাৎ কী এক উষ্মায় ফেটে পড়লেন রাকীব সাহেব।
নত মুখে নীরব হল মালু।
তারুণ্যটিকে যেমন দীর্ঘদিন ধরে রেখেছিলেন রাকীব সাহেব তেমনি হঠাৎই বুড়িয়ে গেছেন তিনি। সেই কচি কচি মুখখানিতে বয়সের রেখাগুলো আজ প্রকট। মরে গেছে মুখের সেই শ্যামলাপানা রংটি। তার জায়গায় এসেছে বার্ধক্যের পাণ্ডুরতা, রোদ বৃষ্টির ধকল সয়ে সয়ে আঁশ ওঠা ফাটা কাঠের মতো বিবর্ণতা।
হয়ত এই বার্ধক্যের কারণেই জীবনকে গুটিয়ে এনেছেন রাকীব সাহেব। বাড়ি করেছেন শহরতলির নিভৃতে। সেরা জলসাগুলোতে ডাক পড়লে গাইতে আসেন। সেও কদাচিৎ। বেশির ভাগ সময়টা তার নিরালা অবসরেই কেটে যায়।
ঢাকায় যেদিন প্রথম এলাম, সবাই মিলে দল বেঁধে সে দিনটির কথা একবার ভেবে দেখতো? মনের এক অদম্য প্রেরণা ছাড়া কিছুই তো ছিল না আমাদের। তিল তিল করে দানা বাঁধল, গড়ে উঠল আজকের শিল্পী আর গায়কগোষ্ঠী। নিজের শ্রমে, নিজের হাতে গড়া জিনিসটা ছেড়ে যাবে তুমি? বাজবে না বুকে? গানের মতোই কথাগুলো বলে গেলেন রাকীব সাহেব। তেমনি দরদ। তেমনি হৃদয়ের আবেদন।
ছাড়ছি কোথায়? ছাড়িয়ে দিচ্ছে যে? প্রতিবাদ করল মালু। তারপর নিজেকে বুঝি আর একটু স্পষ্ট করার জন্য বলল : আমার গান আমার মতো করে গাইতে পারব না। গাইতে হবে মান্ধাতার আমলের রীতি অনুযায়ী, ফরমাশ মোতাবেক। একি জবরদস্তি নয়?
সেদিন ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁর ব্যাপারটা দেখলে তো? ফস করে অন্য প্রসঙ্গে এসে গেলেন রাকীব সাহেব।
দেখলাম তো, বিড়াল ডাক, কুকুর ডাক, ইঁদুর ডাকের শোর মুচিয়ে বাজনা তাঁর থামিয়ে দিল।
ফল হয়েছে–পাট গুটিয়ে দেশান্তরী হয়েছেন তিনি।
খবরটা জানা ছিল না মালুর। তাই একটু আশ্চর্য হল। কী এক ব্যথায় মোড় খেয়ে গেল ওর শিল্পী মন।
বেদনার ছায়া নেবে এল ওদের মুখে। ওরা নীরব হল।
এক চাক জমাট স্তব্ধতা সুমুখে নিয়ে বসে রইল ওরা, মুখোমুখি অনেকক্ষণ। খ্যাতির শিখরে তৃপ্ত সুখী বৃদ্ধ শিল্পী। আর আপনার বেগে অস্থির চঞ্চল তরুণ ভক্ত।
হঠাৎ স্তব্ধতা ভাঙলেন রাকীব সাহেব, হয়ত আপনার সঙ্গীত আপনার সাধনাকে অপমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্যই ভারতে চলে গেছেন তিনি। কেননা সেখানে তাঁর সমঝদার, কিন্তু তুমি তো আর তা পারবে না। এ মাটির সাথে যে তোমার নাড়ীর বন্ধন। উপেক্ষা অনাদর অপমান নির্যাতন সব তো পথের ধুলো মালু। পথ চলতে গেলে ধুলো যে গায়ে লাগবেই।
জানি রাকীব ভাই, জানি। জানি বলেই তো ছুটে এসেছি আপনার কাছে। আসুন, আমরা একটা কিছু করি হবে আমাদের কীর্তি, আমাদের গৌরব, আপনি হবেন তার পুরোধা।
আমি? বুঝি আকাশ থেকে পড়ে শুধালেন রাকীব সাহেব।
হ্যাঁ রাকীব ভাই আপনিই, আপনাকে কেন্দ্র করে সমাবেশ হবে যত গুণী আর জ্ঞানীর। আপনাকে কেন্দ্র করেই আমরা গড়ব নতুন এক সঙ্গীত নিকেতন। যেখানে থাকবে না চিত্তবিনোদনের সস্তা চটক, থাকবে না গানের নামে প্রহসন, ফিন ফিনে গলার চিঁ চিঁ কান্না। যেখানে স্থান নেই মামুলিয়ানার, যেখানে অনুশীলন হবে কঠিন, ব্রত হবে সৃজনের।
কী এক আবেগে গড় গড় করে বলে যায় মালু। বলতে বলতে বুঝি ক্লান্ত হয়। শ্বাস টেনে দম নেয়। ফের বলে : আমরা শুধু গাইব না, নিজেকে আনন্দ দেব না। আমরা সৃষ্টি করব সুর। পুরাতনে দেব জীবন, নতুন জীবন, নতুনে দেব অর্থ, ভাব। রাকীব ভাই, বলুন আপনি রাজি। গভীর প্রত্যাশায় চেয়ে থাকে মালু।
কিন্তু আঁশ ওঠা ফাটা কাঠের মতো বিবর্ণ সেই মুখখানিতে খেলে গেল না অভয় জ্যোতি, একটুখানি উৎসাহের দীপ্তি।
একি আর চাট্টিখানি কথা? বলা যত সহজ, করা ঢের কঠিন। সংশয়ে মাথা দোলান রাকীব সাহব।
দশটি হাত মিললে কোনো কিছুই কঠিন নয় রাকীব ভাই।
বুড়ো বয়সে এসব কী আমার পোষায়? পোষায় না।
আপনি। আপনি একথা বলতে পারলেন রাকীব ভাই? মাত্র এক শো খানি গানের রেকর্ড, এই কী আপনার আজীবনের সৃষ্টি? এতেই আপনি তৃপ্ত? আর কিছু আরও বৃহৎ কোনো স্মারক আমাদের জন্য রেখে যাবেন না আপনি? না না রাকীব ভাই আরও বড় কিছু আপনি করতে পারেন, সে বিশ্বাস আমার আছে। আপনার ডাকে জড়ো হবে দেশের শিল্পী, গড়ে তুলবে একটি সার্থক প্রতিষ্ঠান। নইলে দেখছেন না, কেমন গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে চলেছি আমরা? এ আপনাকে করতেই হবে রাকীব ভাই। চাকরি ছাড়ার পর থেকেই গত কয়েকটি দিন শুধু এ কথাটাই যে ভাবছি আমি।
যেন হোঁচট খেয়েই থেমে গেল মালু।
চোখ পড়ল রাকীব সাহেবের মুখের উপর। এ যেন মৃত্যুরই মুখ। মৃত্যুর মতোই অসহায় নির্জীব হিম ছড়ানো।
শুধু বাইরে নয় ভেতরেও বুঝি বুড়িয়ে গেছেন রাকীব সাহেব। মরে গেছে শিল্পীর সে অজেয় সত্তা। একটুক্ষণ আগে যে মানুষটি বলছিল উপেক্ষা অনাদর অপমান নির্যাতন, এ সব তো পথের ধুলো, পথ চলতে গেলে ধুলো যে গায়ে লাগবেই, এ কী সেই মানুষ? বিশ্বাস করতে কষ্ট হল মালুর।
রাকীব সাহেবই বুঝি শেষ নির্ভর ছিল মালুর। শক্ত একটা খুঁটি পাবে। পাবে আশ্বাসে প্রেরণায় দ্বিধাহীন নির্দেশ। সার্থকতর সৃষ্টির মাঝে নতুন খাতে নিয়ে আসবে জীবনটাকে, সুরের সাধনাকে।
শেষ আশাটাও বুঝি গুঁড়িয়ে গেল মালুর।
কিন্তু একি দেখছে মালু পল্লীগীতির সম্রাটের চোখে? চমকে কেঁপে কেমন শিরশিরিয়ে গেল ওর গাটা।
এই যে দেখছ সব কিছু পাওয়ার নিটোল সুখের ছবিটি, এ যে মিথ্যা। মিথ্যা এই নিরালা তুষ্টি, এই প্রশান্তির সমাহিতি। সবটাই যে খোলস–এই নাম ধাম যশ আড়ম্বর। জীবন তো মোটে একশখানি গানের রেকর্ড। আর কিছু কী? একশখানি কীর্তি গাথা, আর কত ভ্রান্তির আমলনামা, কে জানে–এতো খ্যাতির শিখর নয়, আশার ভগ্ন দেউল। অঙ্গার-স্তূপ। রাশি রাশি ছাই অতৃপ্তির। ব্যর্থতার।
এক লহমায় দৃষ্টির অতল থেকে এত ইতিহাস কথা কয়ে উঠতে পারে? অদ্ভুত অকপট এক স্বীকৃতি রাকীব সাহেবের ঝাপসা চোখে। নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো মালু।
চলতে চায় না পা। ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে পা দুটোকে ও নিয়ে এল হলদে বাড়ির সেই সাদা দেয়ালের কামরায়।
না আসার মতোই অফিসে আসে মালু। একান্ত জরুরি কাজগুলো সেরেই বেরিয়ে যায়। অকারণেই বুঝি ঘুরে বেড়ায়। পদত্যাগপত্র ওর গৃহীত হয়েছে নতুন লোক আসা সাপেক্ষে।
চা আনব ভাই?
মুখ তুলে তাকায় মালু। করিম মিঞার কণ্ঠে আত্মীয় বিয়োগ বেদনা। তোমার জন্যও। বলে একটু বুঝি হাসল মালু।
শোন ইয়াসীন। কাল পরশু এসে যাবে নতুন লোক। বকেয়া কাগজ পত্র সব ঠিক করে রাখছো তো?
ইয়াসীন বুঝি কানেই তুলল না কথাটা। ওর অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখা চোখের দৃষ্টিটা পানির ভারে ঝাপসা।
শুধু শুধু কী যে ঝামেলা ডাকলেন ভাই সাহেব! শুভাকাঙ্খীর মোলায়েম স্বরে বলল ইয়াসীন।
ঝামেলা? ঝামেলা কোথায় নেই বলতো? এবারও যেন ম্লান মুখে আধখানি হাসি ফোটাতে চায় মালু। বলল আবার : সেই যে হোসনা, সুন্দরের আকর, সেও কী কম ঝামেলা ইয়াসীন? বল, ঝামেলা নয়?
ফাইলের আড়ালে তক্ষুণি বুঝি অদৃশ্য হয়ে যায় ইয়াসীনের মুখখানি। হোসনার নামে যত রাজ্যের লজ্জা এসে ঘিরে ধরে ওকে।
কত আশ্বিনের শেফালী ঝরে গেল। কত সুন্দর লজ্জা মাথা কুটে মরে গেল। তবুও কী তুমি মোহাম্মদ ইয়াসীন, ঝামেলা মুক্ত হয়েছ? নিশ্চিন্ত নির্ভয়ে বলতে পার, ব্যর্থ যাবে না আগামী আশ্বিনের সোনালী ভোর? এ বুঝি মালুর নিজেরই ভাবনার প্রক্ষেপ, অপূর্ণ কোনো আকাক্ষার খেদোক্তি? আপন মনে নিজকে শোনাবার জন্যই বলে চলেছে।
মুখ সমেত মাথাটাকে টেবিলের তলায় চালান দিতে পারলেই বুঝি বেঁচে যেতো ইয়াসীন। ফাইলের আড়াল থেকেই জবাব দেয় : হলাম গিয়ে ছাপোষা মানুষ। ঝামেলা ঝক্কিই তো নিত্যকার জীবন।
এবার হো হো করে হেসে উঠল মালু। বলল, এতক্ষণে খাঁটি কথাটি বলেছ ভাই। আরে ঝামেলা ঝক্কি, হ্যাঙ্গাম হুজ্জতই যদি থাকল না, তবে আর বাঁচা কেন। ওই এক স্বাদ, টক মিষ্টি অম্বলের মতো।
কথাটার আগামাথা কিছুই বুঝল না ইয়াসীন। হঠাৎ এমন বেদম হাসিরই বা কী কারণ ঘটল তাও ভেবে পায় না ও। কিন্তু, গান গাইছেন না কেন? এটা অন্যায়। সংকোচ ভরে বলল ইয়াসীন।
হ্যাঁ অন্যায়। রাকীব ভাইও তাই বলে। গম্ভীর আর ম্লান হয়ে গেল মালু। চা। এল।
যন্ত্রের ঠোঁট দিয়েই যেন চা টানে মালু, নিঃশব্দে। দৃষ্টিটা ওর ঘুরে বেড়ায় ঘরময়। ক্যালেন্ডারে গত মাসের একটি তারিখের তলায় লাল পেন্সিলের দাগ। ঘড়ির কাঁটাটা কবে যে পাঁচের ঘরে পৌঁছে থমকে গেছে কেউ তার খবর রাখে না। সেকেন্ডের কাঁটাটা পা পিছলে নিজের ঘর ছেড়ে অনেক দূরে এসে আশ্রয় পেয়েছে। আর একটি ক্যালেন্ডারে বিদেশি মহিলার ছবি কেন যে মুখ ঢেকে ওদের দিকে পিঠ করে রয়েছে, বোঝে না মালু।
উল্টো দিকের খোলা কপাট আর দেয়ালটুকুর ফাঁকে একটা মরা মাকড়সা চিৎ হয়ে ঝুলে রয়েছে। নিজের জালে জড়িয়েই মরেছে বেচারী। ওপাশের জানালার শিকে ঝুলছে কালির ঝুল। খেয়াল রাখছে না মালু, তাই এমনি দুরবস্থা ঘরটির। ইচ্ছে হল করিম মিঞাকে ডেকে একটু ধমকে দিক। কিন্তু ডাকতে গিয়ে ওর গলার স্বরটা যেন নিচের দিকেই নেবে গেল। এ ঘরের সাথে সম্পর্ক তো তার চুকেই গেছে। কী হবে অযথা করিম মিঞাকে হয়রান করে।
গান তো আমি ছেড়ে দিয়েছি ইয়াসীন! অনেকক্ষণ পর ইয়াসীনের কথাটার জবাব দিল মালু।
গান ছেড়ে দিয়েছেন? না না না, এ আমি বিশ্বাস করি না। কী এক আকুলতায় যেন চেঁচিয়ে উঠল ইয়াসীন।
ওরা বলে আমার সুর নাকি বিধি নিয়মের বাইরে। তাই অপাংক্তেয়।
কিন্তু যা গাইছিলেন?
একটু যেন ভাবল মালু। বলল : যা আছে শুধু মাত্র সেটুকুও নিয়ে কেউ তুষ্ট থাকতে পারে ইয়াসীন? তুমি পার?
তা আর পারি কই। চাকরি যখন ছিল না তখন ষাট টাকাই মনে হয়েছে স্বর্গ। এখন আশি টাকায়ও অসন্তোষ। কেননা আজ আছি একলা তাই কোনো রকম চলছে। কিন্তু কাল?
হ্যাঁ হ্যাঁ। কাল তো তোমরা দুজন।
পরশু? তখন হব তিনজন, কী আরো বেশি। তোড়ের মুখে বলে ফেলেই বুঝি লজ্জা পায় ইয়াসীন। মুখটাকে তাড়াতাড়ি অন্যদিকে ঘুরিয়ে লজ্জা ঢাকে।
ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা অনিশ্চয়তা সব কিছু মিলিয়ে কেমন স্পষ্ট করে ভাবে ইয়াসীন। বর্তমানটা যেমন গণ্ডিবদ্ধ, কল্পনাটাও বুঝি তেমনি বলগা ধরা, কখনো যায় না আয়ত্তের বাইরে। এরি মাঝে ছোট ছোট ইচ্ছার সুন্দর রূপায়ণ। আর সেটাই বুঝি জীবনে পরমতম আনন্দ। সব মিলিয়ে যেন বাহুল্য বর্জিত সাদাসিধে একতারা। একতারার সহজ স্বচ্ছন্দ সুর। ইয়াসীন আর হোসনা, যাকে এখনো দেখেনি মালু, একটি সহজ জীবনের জন্য ওদের নিঃশব্দ আরাধনার কথাটা ভাবতে গিয়ে আজ কেন যেন বিশেষ করে ভালো লাগল মালুর। আর একদিন এমনিভাবে বিশেষ করে ভালো লেগেছিল ইয়াসীনকে। যেদিন শরমে লাল হয়েও জানিয়েছিল পয়লা আশ্বিনের কথাটা। এই বুঝি ভালো। ওই একতারার মতো অনাড়ম্বর সহজ সুর। অনেক তারে টংকার তুলে অনেক ঝংকারের অনেক অমিলের দুরন্ত সমুদ্রে দিশে হারাবার বিড়ম্বনার চাইতে এই তো ভালো। যেমন ভালো উঁচু নীচু পাথর ছড়ান পথে টক্কর খেয়ে ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার চেয়ে ছোট্ট কোনো নীড়ের মোলায়েম শয্যা।
হঠাৎ যেন আলপিনের খোঁচা খেয়ে চমকে উঠল মালু, কী সব ভাবছে ও। টাল হয়ে আছে চিঠি। বিরক্তি ভরে মালু ঠেলে দিল চিঠির টালটা। এ সব চিঠিতে আর কোনো আকর্ষণ নেই ওর।
ফাইলের ভেতর মুখটা ডুবিয়ে আছে ইয়াসীন। সেদিকে তাকিয়ে বুঝি আগের কথাটারই জের টানল মালু : আমি বলছিলাম ভালোর চেয়ে ভালো, উত্তমের চেয়ে উত্তম, তার আকাঙ্ক্ষা, তার চাহিদা। এই স্বাভাবিক কথাটাকেই আমল দেয় না কিছু লোক।
ঘাড় গোঁজা কলম ঠেলা লোকটি বুঝি ঘাড়টাকে একটু সিধা করল। বিড় বিড় করে বলল : ভাগ্যিস গরিবের ওসব ঘোড়া রোগ নেই।
মালুর কান পর্যন্ত পৌঁছল না কথাটা, ও জিজ্ঞেস করল, কিছু বলছ?
বলছিলাম হোসনার পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। পয়লা আশ্বিন কিন্তু আপনাকে আসতেই হবে। উঠে এসে দাওয়াতের চিঠিটা মালুর হাতে তুলে দিল ইয়াসীন।
বাহ। কার্ড সব ছাপানো সারা? চমৎকার। খাম খুলে কার্ডটার উপর একবার চোখ বুলালো মালু। তারপর পিঠ চাপড়ে উচ্ছ্বাসের বন্যা ঢেলে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল ইয়াসীনকে। আনন্দটা যেন তারই, ইয়াসীনের নয়।
তা হলে ইয়াসীন, আশ্বিনের লগ্নটি সত্যি এল? এল পয়লা আশ্বিনেই? শিশির ছোঁয়ায় নরম হয়ে। শিউলির মতো পবিত্র হয়ে, মিষ্টি রোদে ঝলমলিয়ে। তাই না?
সলজ্জ হেসে সরে যায় ইয়াসীন। কাব্যিক হতে পারে না ও, অথবা জানে না।
ইয়াসীনকে ছেড়ে বেরিয়ে এল মালু।
অকস্মাৎ মনের সমস্ত গ্লানি আর তিক্ততা কোথায় যেন উবে গেছে। মনটা ওর ভরে গেছে নির্মল এক আনন্দে। আহা, তবু তো এক জোড়া মানুষ সুখী হল পৃথিবীতে। এ পৃথিবীতে কোনো মানুষকে সুখী দেখবার চেয়ে আর কোনো বড় আনন্দ নেই।
৫৯.
একটি মেয়ে। সে যে এত যন্ত্রণা জানত না মালু।
দুপুর বেলায় খেতে এসেছে মালু। কিন্তু, টেবিলের কাছটিতে এসেই সমস্ত ক্ষিধে ওর উবে গেল। ঘন কালির পোঁচ পড়ল ওর মুখে।
বিদ্যে তো তোমার ডিম ভাজা আলু সেদ্ধ। এই মোরগ-পোলাও আর কোর্মা এল কোত্থেকে? ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল মালু।
মুখ লুকিয়ে মিটমিট করে হাসে ছেলেটা।
এই প্রথম নয়। এর আগেও কয়েকদিন এরকম হয়েছে। রিহানা এসে রান্না করে গেছে।
একটা একটা করে ডিশগুলো তুলে মেঝেতে ছুঁড়ে মারল মালু। ঝনঝনিয়ে টুকরো টুকরো হল চীনে মাটির বাসন খোরা।
দুরন্ত ইচ্ছা জাগল মালুর–কয়টিই বা সিঁড়ি, টপাটপ ডিঙিয়ে উঠে যাক উপরে। কথার তীরে বিদ্ধ করবে রিহানাকে। ফুঁড়ে ফুঁড়ে রক্ত ঝরাবে। নোংরা হবে মালু। ইতর হবে কুৎসিত হবে। স্বামিত্বের অধিকারে পরাভূত করবে ওকে। তারপর পাঁজা কোলা করে ওকে নিয়ে আসবে এক তলায়, সেই ঘরে যেখানে ওর বিকাশ, যেখানে ওর মর্যাদা।
ইচ্ছাটা ইচ্ছাই রইল।
ভীষণ হতে পারল না মালু, ইতরও হতে পারল না। পারল না ছেলেটাকে উপরে পাঠিয়ে রিহানাকে একবার ডেকে আনাতে। এ সবে নিজেকেই ছোট করা হবে আর অপমান করা হবে রিহানাকে।
আশ্চর্য হয় মালু। ওর ভেতরের সেই শক্তিটা যার নাম পৌরুষ, যার নাম সংযম সেই শক্তিটা বার বার ওর স্বামিত্বের অধিকার বোধটাকে খর্ব করে দিয়ে যায়। ও পারে না নৃশংসতার উত্তরে নিষ্ঠুর হতে, ভয়ংকর হতে। ভেবে পায় না মালু, এ কী ওর পৌরুষ না কী দুর্বলতা?
মালুকে খতিয়ে দেখতে হয় নিজের মনটা।
আচমকা কী এক আঘাত খেয়ে সারা দেহটা ওর টন টন করে উঠল। অবাক হল মালু। কখন নীড় বেঁধেছে একটি ভালোবাসা। হৃদয়ের সহস্র পথে শিকড় চালিয়ে বেড়ে উঠেছে। টের পায়নি মালু। অথবা টের পেয়েও অস্বীকার করেছে। ও ভালোবেসেছে রিহানাকে।
অথচ এই দুর্বল অর্থহীন অনুভূতিটাকেই আপন পৌরুষের শক্তি বলে ভুল করে এসেছে মালু। এখানেই বুঝি ওর সবচেয়ে বড় পরাজয় রিহানার কাছে।
রিহানা জানে, ভালোবাসার দুর্বলতা নেই ওর। ভালোবাসা ছিল না কোনোদিন। ছিল মোহ। সেই মোহ ওর ভেঙে গেছে। তাই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে ও, সরিয়ে নিতে পেরেছে এত সহজে। ও বুদ্ধিমতি। আপনার শক্তির উপর ওর অবিচল আস্থা। তাই তো পারছে ও অমন নৃশংস হতে। আর ও জানে মালুর রয়েছে ভালোবাসার দুর্বলতা।
ডিশ ভাঙার তিন কী চারদিন পর।
খুট করে একটা শব্দ হল। যেন বাতাসের গর্ভ থেকেই উঠে এল রিহানা। বসল খাটের পাশে চেয়ারটিতে। বলল : কোথায় কোথায় থাক, সারাদিন তোমার যে দেখা পাওয়াই ভার। উল্টো অভিযোগ রিহানার।
ঘুরে বেড়াই। সংক্ষেপে বলল মালু।
সেই ভালো। মনের জ্বালা, সুরের জ্বালা সবই ভুলে থাকা যায়।
ঘরটার চারিদিকে চোখ বুলিয়ে আনল রিহানা। যেন দেখে নিল সব ঠিক আছে কিনা। তারপর প্রসঙ্গটা পাল্টিয়ে দিল : বেচারা চাকরটার উপর ঝাল ঝেড়ে লাভ কী? থালা বাসনগুলোরও কোনো দোষ ছিল না। আমি তো ভাবলাম কী দক্ষযজ্ঞই না বাধিয়ে তুলছ। নিচে নেমে দেখলাম তুমি বেরিয়ে গেছ।
কে বলে তোমায় আসতে? কেন আস? কেন এমন করে দিনগুলো আমার দুর্বিষহ করে তুলেছ?
ওরে বাবা! এ যে দেখছি রাগ! তা হলে রাগও হয় তোমার? রিহানার চোখে বিদ্রূপের ঝিলিক।
খুশি হয়েছ বুঝি? সীমার মাঝে নিজেকে বেঁধে রাখবার ব্যর্থ চেষ্টায় ঠোঁটগুলো কেঁপে কেঁপে যায় মালুর। স্বরে আসে বিকৃতি।
খুশি হব না? ভালোবাসলেই ঈর্ষা আসে মানুষের। ঈর্ষা থেকে রাগ। এতো উন্নতি হয়েছে তোমার। খুশি হব না?
মালুর দুর্বল জায়গাটুকুতেও হাসতে হাসতেই বুঝি বল্লমের তীক্ষ্ণ আগাটা বসিয়ে দেয় রিহানা।
এতো উন্নতি নয়। আমার অধঃপতন। কেমন ব্যথাতুর অসহায় মালুর গলাটা।
যাক বাঁচলাম। অহংকারটা এখনো অটুট আছে তোমার। বিদ্রূপের ঝিলিকটা এবার তেরছা একটা হাসি হয়ে ছুটে যায়।
বাঁচলে কী রকম? ওর কথার বুঝি খেই পায় না মালু।
বাঁচলাম না? আমার তো ভয় ছিল দেখা হলেই পায়ের উপর লুটিয়ে পড়বে তুমি। যেমন পড়ে সব পুরুষ। ইনিয়ে বিনিয়ে কান্না জুড়বে, উত্ত্যক্ত করবে আমায়।
মালুর মনে হল ঠাণ্ডা মাথায় বুঝি খুনও করতে পারে রিহানা।
তা না করে যদি এখন বেঁধে রাখি তোমায়?
ও, স্বামিত্বের অধিকার ফলাবে? সেও পারবে না। তোমার অহংকারে বাধবে।
আমাকে ক্ষমা কর রিহানা। সেদিন অন্যায় করেছিলাম…
মালুর কথাটা শেষ হবার আগেই বলে গেল রিহানা : সেদিনের বর্বরতার জন্য তুমি অনুতপ্ত। সে তোমার চোখ দেখেই বুঝেছি। কিন্তু, ওইটুকুও আর পারবে না। কেননা শক্তি তোমার ফুরিয়েছে।
ফুরিয়েছে বলছ তুমি?
আমি বলছি স্বামিত্বের নৈতিক অধিকার, ভালোবাসার নৈতিক জোর যে আমার পক্ষে। সেই তো আমার শক্তি। যে শক্তি আমি এই মুহূর্তে প্রয়োগ করতে পারি তোমার উপর।
আর আমার শক্তি ঘৃণা। ঘৃণা দিয়েই আমি রুখব তোমার বর্বরতা। তোমার জবরদস্তি।
ঘৃণা? যেন দূরাগত কোনো আর্তনাদের মতোই রিহানার কথাটার প্রতিধ্বনি করল মালু।।
বলল মালু : আর ওই কালোবাজারের পাণ্ডাটি? ওখানে বুঝি শুধু ভালোবাসার মিষ্টি সুধা? এতক্ষণে একটুখানি ইতরামির ঝাঁঝ ঢালতে পেরে যেন খুশি হল মালু।
অদ্ভুত। রাগল না রিহানা।
আকর্ষণের, বন্ধনের শেষ সুতোটাও বুঝি ছিঁড়ে ফেলেছে ও। হয়ত তাই প্রতি আঘাতে উদ্যত হবার প্রয়োজনটাও ফুরিয়েছে।
গম্ভীর হল রিহানা। বলল : জানি ওসব নোংরা চিন্তাই গিস গিস করছে তোমার মাথায়।
কাজটাও নোংরা, অতি নোংরা, জঘন্য। দ্বিচারণ। কথার চাবুক মেরে ছিঁড়ে ছুঁড়ে ওকে বুঝি মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে চায় মালু।
চেঁচিয়ো না। চাপা গলায় ধমক দিল রিহানা। দৃষ্টিটাকে তীরের ফলার মতো তীক্ষ্ণ করে ধরে রাখল মালুর মুখের উপর। বলল : অভিযোগটার জবাব দিতেও ঘৃণা বোধ করছি। কিন্তু, একটা কথা শুধাই, কালো বাজারের পাণ্ডার কাছেই যদি আমি সুখ পাই তাতে তোমার অত জ্বালা কেন? একি গায়ক মহলে তোমার মান গেল বলে, না অন্য কিছু?
রিহানাও বুঝি ঠিক করে এসেছে আজ, স্থূল হবে, ভোঁতা হবে; এতটুকু আব্রু রাখবে না শালীনতার অথবা রুচির।
ঠিক। আবগারি কর্তার কন্যার যোগ্য কথা বটে। মালুও ভোঁতা আঘাতটা ফিরিয়ে দিয়ে বিকৃত এক আনন্দের তৃপ্তি পেল। অবশেষে রিহানাও বুঝি রাগল। মালু দেখল লাল রাগটা ওর ফর্শা মুখের ত্বক বেয়ে ছড়িয়ে পড়ছে গলার শিরায়।
এটা তো গালি হল। আমার কথার জবাব হল না।
জবাব যা সে তো তোমার কাছে, রিহানা। দেখছ না? রোঁয়ায় রোঁয়ায় জ্বলছি আমি? অনুক্ষণ দগ্ধ হয়ে চলেছি? আমি যে আর সইতে পারছি না রিহানা।
নোংরা হতে গিয়ে ইতর হতে গিয়ে এ কী কাঙ্গালের কান্নায় ভেঙে পড়ল মালু?
কোন্ ছুমন্তরে উড়ে গেল রিহানার মুখের টকটকে রাগটা। তীক্ষ্ণ এক বিদ্রূপ ঝিলিক খেয়ে নেচে গেল ওর চোখের তারায়। তারপর গোটা শরীরটাকে ঢেউয়ের মতো ফুলিয়ে দুলিয়ে দমকা হাসিতে যেন লুটিয়ে পড়ল রিহানা। থামতে চায় না ওর হাসি।
মালুর সারা গায়ে বুঝি ফোসকা তুলে যায় ওর হাসিটা।
ইস্! শেষমেষ অহংকারটাকেও বিসর্জন দিলে? রইল কী তোমার? এর পরই হয়ত পায়ে ধরবে।
যেন সে রকম পরিস্থিতিতে বিব্রত হতে চায় না রিহানা। তাই পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে যায় ও। চটর চটর চটির বোল তুলে উঠে যায় দোতলার সিঁড়িতে। কিন্তু কী মনে করে তখুনি ফিরে আসে। বলে, একটা সৎ পরামর্শ দিতে পারি?
কি? ক্লান্ত স্বর মালুর।
গান ফানে যে কিছু হবে না সে তো দেখতেই পাচ্ছ। রোজগারের অন্য পথ দেখ, তাতে রোজগারও হবে ভালো, মেজাজটা থাকবে শান্ত। অপেক্ষা করে না রিহানা। কথাটা শেষ করেই যেমন এসেছিল তেমনি চলে গেল।
অথচ, কী আশ্চর্য!
এই রিহানাকে কাঁদতে দেখল মালু। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদেছে রিহানা।
৬০.
সারা সকাল আর দুপুর ইয়াসীনের সাথে ঘুরতে হয়েছে মালুকে। ইয়াসীন বিয়ের বাজার করছে।
দুপুরটা যখন বিকেলের দিকে গড়িয়ে পড়েছে সেই সময় বাসায় ফিরল মালু। দেখল বসবার ঘরের কপাটটা ভোলা।
পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে বসবার ঘর। প্রথম দিন যেমন সাজিয়েছিল রিহানা মনে হয় ঠিক তেমনি। গতকালও এঘরে এসেছিল মালু একটা আলপিনের খোঁজে। ঘরে ঢুকেই দমটা আটকে এসেছিল। রিহানা উপরে উঠে যাওয়ার পর থেকেই ঘরটা বন্ধ। আলোহীন ঘরে ধুলো বালি জমে বিশ্রী গন্ধ আর গুমোটের রাজত্বটা জেঁকে বসেছে। তাড়াতাড়ি জানালাটা খুলে কোনো রকম নিশ্বাস নিয়েছিল মালু।
কাচঢাকা বইয়ের তাক, তারই এক কোণে আলপিনের বাক্সটা গুঁজে রেখেছিল রিহানা। কোনো রকমে আলপিন নিয়ে ছুটে বেরিয়ে এসেছিল মালু। শোবার ঘরে এসে ভেবেছিল এত শখ করে, এত যত্ন দিয়ে যে ঘরটা সাজিয়েছিল রিহানা সে ঘরটার কথা কী একবারও মনে পড়ে না ওর?
অনেকদিন ঘরে বসে না মালু। আজ বসল। পাখাটা ছেড়ে দিল। জামাটা খুলে ফেলল। হাওয়া খেয়ে গাটা ঠাণ্ডা করল।
অনুরাগ সুরুচি আর যত্নের হাত দিয়ে যে ঘরটা সাজিয়েছিল রিহানা হয়ত সে ঘরটার কথা মনে পড়েছিল ওর। হয়ত তাই আজ নিচে এসেছিল ও। পরিষ্কার করে সাজিয়ে গুছিয়ে আবার উঠে গেছে ওপরে। হয়ত তক্ষুণি তক্ষুণি উঠে যায়নি রিহানা। পরিশ্রম করে হাঁপিয়েছিল। দু দণ্ড বিশ্রাম নিয়েছিল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে নিশ্চয় ওর মনে পড়েছিল অনেক কথা, প্রথম প্রেমের আশ্চর্য মধুর অনুভূতিগুলোর কথা ঘুম ঘুম আবেশে মুগ্ধ প্রহরগুলোর কথা। সত্যি কী তাই? সে সব কথা কী আজ মনে পড়ে রিহানার? ওর ভাবনার পৃথিবীতে কী জেগে ওঠে সে সব মুগ্ধ প্রহর? আসলে এটা মালুরই মনের মাধুরী। এক দণ্ড বসেনি রিহানা। কোনো কিছু ভাবেনি। তীব্রভাবে তীক্ষ্ণভাবে কোনো কিছু অনুভব করার ক্ষমতা ওর নেই, ছিল না কখনও। ওর আছে প্রত্যাঘাতের হৃদয়হীন নিষ্ঠুর স্থূল ইচ্ছা। সেই ইচ্ছাটাই ওকে টেনে এনেছিল।
ঘরময় ঘুরে বেড়ায় মালুর চোখজোড়া।
একটা জাপানী পুতুল কিনেছিল রিহানা। দাম নিয়েছিল সাড়ে তিন শো টাকা। দামের অঙ্কটা শুনে মালু প্রায় হার্টফেল করছিল। কিন্তু রিহানা ওকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, আসলে পুতুলটা বেশ সস্তাই হয়েছে। দোকান থেকে এনে যেখানে রেখেছিল রিহানা ঠিক সেখানেই রয়েছে পুতুলটা।
ফুলদানির শখ ছিল রিহানার। দেশি, বিলেতী, জাপানী-নানা দেশের, নানা সাইজের, নানা রংয়ের ফুলদানি। কোনোটা চীনে মাটির, কোনোটা বাঁশের, কোনোটা শেলাকের, কোনোটা খাঁটি দেশি মাটির মসৃণ পালিশ করা, কোনোটা পেতলের, নিরলংকার অথবা মোরাদাবাদী কাজ করা।
ঢাকার দোকানে যত দেশের যত কিসিমের ফুলদানি পাওয়া যায় সবই এনে জড়ো করেছিল রিহানা। আতঙ্কিত মালু চেঁচিয়ে উঠেছিল, এ কী করছ রিহানা? ঘরটাকে কী ফুলদানির দোকান বানাবে।
মালুর শঙ্কিত চিৎকারটা গায়ে না মেখে বলেছিল রিহানা, দেখই না কেমন করে সাজাই।
মালু দেখেছিল এবং চুপ করে গেছিল। ওকে চুপ হতে হয়েছিল কেননা ঘরের কোণে, শো-কেসের মাথায়, দরজার পাশে, বইয়ের তাকের ফাঁকে, কোথাও ফুলের গুচ্ছ, কোথাও বিনা ফুলে, ফুলদানিগুলোর অবস্থান ওকে খুশি করেছিল। বিজয়িনীর হাসি হেসেছিল রিহানা।
ঘরময় ঘুরে বেড়ায় মালুর চোখ। সেই পুতুল, ফুলদানি, যেটির পেছনে রিহানার নিজের হাতের বুটি-কাজ, যেটি যেখানে ছিল তেমনি রয়েছে। নেই শুধু রিহানা।
খচ করে কী যেন বিঁধে গেল বুকের ভেতর। বুকের ভেতর সেই চিন চিন ব্যথাটা। রিহানা নেই ওর জীবনে, এই নিষ্ঠুর সত্যটাকে আজও মেনে নিতে পারছে না মালু। মেনে নিতে কষ্ট হয়।
বুঝি এই কষ্টটাকে অস্বীকার করার জন্যই গাঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল মালু। হাতে তুলে নিল পাঞ্জাবিটা, এল শোবার ঘরে।
বিছানার কাছে এসে থমকে দাঁড়াল মালু। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে রিহানা। রিহানা কাঁদছে।
হতভম্ব মালু। কী করবে, কী করা উচিত জানে না ও। এই মুহূর্তে গোটা দোতলা বাড়িটাই যদি ভেঙে পড়ত ওর মাথায় তাহলেও বুঝি এমন বেদিশা হত না মালু।
বিছানায় রিহানার পাশে বসে ওর মাথায় সান্ত্বনার হাতটা বুলিয়ে দিতে চাইল মালু। পারল না।
রি–, প্রিয় সম্বোধনে রিহানাকে ডাকতে চাইল মালু। পারল না। আওয়াজ নেই গলায়।
বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে রিহানা। কান্নাটা যেন আসছে দুর্বার কোনো স্রোতের মতো। ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। বুঝি তাই বালিশটাকে প্রাণপণে আঁকড়ে রয়েছে রিহানা।
দুহাতে টেনে নিক কান্না-চৌচির দেহটাকে। অনুরাগে চুম্বনে মুছে দিক ওর সমস্ত কান্না। দুরন্ত ইচ্ছেটা মালুকে টেনে আনল বিছানার মাথায়, রিহানার খোলা বাহুর পাশে।
ততক্ষণে মুখ তুলেছে রিহানা। চোখ মেলেছে। আধ-ভেজা বালিশটাকে সরিয়ে রেখেছে একপাশে। ভেজা এলোমেলো চুলে ঢাকা পড়েছে রিহানার অর্ধেকখানি মুখ, একটা চোখ। কানের পাশের গুঁড়ো গুঁড়ো চুলগুলো মানচিত্রের চিকন কালো রেখার মতো সেঁটে রয়েছে ওর গালে। কান্নার মাঝেও এমন সুন্দর রিহানা? মালুর বুক জুড়ে ভালোবাসা। ভালোবাসাটা কী এক করুণার নিঃশব্দ কান্নায় ভেঙে পড়ল, মালুকে ভাসিয়ে নিল।
ভালবাসা দুর্মর। দুর্নিবার রিহানার আকর্ষণ। এই মুহূর্তে সমস্ত পৃথিবীটাই বুঝি মিথ্যা। মিথ্যা সঙ্গীত, মিথ্যা গানের আরাধনা, চেতনার কশাঘাত, দায়িত্বের বোঝ। সত্য শুধু রিহানা। এই মুহূর্তে সব কিছু ছেড়ে দিতে পারে মালু রিহানার একটি মধুর নির্দেশে।
পাখির পালকের মতো মসৃণ রিহানার বাহু। সে বাহুটাই স্পর্শ করল মালু। রেশমের মতো মিহিন পিছল চুল রিহানার। সে চুল স্পর্শ করল মালু। কানের নিচে রিহানার বাহুর পাশটা জড়িয়ে রয়েছে এক গোছা চুল। একদিন বুঝি এখান থেকেই রিহানা এক গুচ্ছ চুল কেটে নিয়েছিল, সোহাগ করে গুঁজে দিয়েছিল মালুর হাতে। সে চুলগুলো এখনও লম্বা হয়নি।
ভালবাসার মতোই বুঝি ভালোবাসার কান্না। এর কোনো শুরু নেই, এর কোনো শেষ নেই। অথবা এর শুরু আছে, শেষ নেই। মালুর বুক জুড়ে সেই কান্নার ঢল।
আর একটু কাছে এল মালু। রিহানাকে টেনে নিল কোলের পাশে। বলল, চল রি। আমরা চলে যাই অন্য কোথাও, অনেক দূরে; যেখানে জাতের বড়াই নেই, ধনের দম্ভ নেই। যেখানে মিথ্যার আঘাতে মৃত্যু হয় না ভালোবাসার। যেখানে গুণের সমাদর। চল যাই সেখানে।
আহ্। বিরক্ত হল রিহানা। ঠেলে বিছানা থেকে সরিয়ে দিল মালুকে। এক চোখেই তাকিয়ে আছে রিহানা। চোখের পাতাগুলো এখনও ভেজা। অশ্রুর কণাগুলো এখনও শুকায়নি। চোখের কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়া কান্নার দাগটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মালু।
উহ্! যাও তো তুমি! আমাকে একটু একলা থাকতে দাও। দোহাই তোমার। চেঁচিয়ে উঠল রিহানা। কান্নার ঢেউ হয়ে ভেঙে পড়ল আবার। বসবার ঘরে এল মালু। তারপর বারান্দায়। বারান্দা থেকে চত্বরে পাম গাছটির তলায়।
পাম গাছের তলা থেকেও শোনা যাচ্ছে রিহানার কান্না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে রিহানা।
কেন অমন করে কাঁদছে রিহানা?
পাম গাছের তলায় দাঁড়িয়ে প্রশ্নটার জবাব খোঁজে মালু।