মেয়েদের মধ্যে সঞ্চয়ের প্রবণতা একটু বেশি থাকে। কারণ তাদের ঘর সামলাতে হয়, ভবিষ্যতের জন্য চিন্তা করতে হয়। সোনার গয়না গড়াবার জন্য অনেক মেয়েরই খুব ঝোঁক থাকে, কিন্তু ক’জন মেয়ে আর সেই গয়না নিয়মিত পরে? সে সব তোলা থাকে সিন্দুকে, আসলে সেগুলি ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রতীক। এক সেট সুন্দর কাপ-ডিশ কিনলেও গৃহিণী তা সহজে ব্যবহার করতে চায় না, আলমারিতে সাজিয়ে রাখে ভবিষ্যতের কোনো একটা বিশেষ উৎসবের দিনের জন্য।
কিন্তু ঢাকায় এখন অনেকেই আর ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে না। প্রত্যেকদিন সকালে উঠেই মনে হয়, আজকের দিনটা ভালোয় ভালোয় কাটবে তো? যাদের বাড়ি থেকে বেরুতে হ্য, তারা ঠিকঠাক ফিরবে?
আজ জাহানারা ইমাম বিছানায় পাতলেন একটা ঝকঝকে নতুন চাঁদর। বালিশের ওয়াড়গুলো বদলালেন। দুটি বাথরুমেই ঝোলালেন নতুন বিলিতি তোয়ালে। এই ক’মাস যেমন-তেমন করে খাওয়া দাওয়া হচ্ছিল, আজ তিনি খাওয়ার টেবিলে পাতলেন অপূর্ব কারুকার্য করা লেসের টেবল ক্লথ। একবার একজন চিটাগাং থেকে এনে দিয়েছিল ইটালিয়ান ডিনার সেট, এর আগে একদিনও ব্যবহার করা হয়নি, আজ সেইসব প্লেট টেবিলে শোভা পেল। সেই সঙ্গে কাট গ্লাসের পানির গেলাস। কাঁটা-চামচগুলোও চকচকে নতুন।
খেতে এসে শরীফ আর জামী হাঁ হয়ে গেল। পিতা-পুত্র পরস্পরের দিকে চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। তারপর শরীফ জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার, আজ কোনো বড় দরের মেহমানকে দাওয়াত দিয়েছো নাকি? কিছু বলোনি তো?
জাহানারা ঈষৎ হেসে বললেন, নাঃ, আজ আমরাই আমাদের মেহমান।
শরীফ তবুও কিছু বুঝতে পারলেন না। ঈদ কেটে গেছে আটদিন আগে। এবারের ঈদ কেটেছে অত্যন্ত অনাড়ম্বর ভাবে। কারুর জন্যই নতুন পোশাক কেনা হয়নি, বাড়িতে বিশেষ খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা ছিল না। পাকিস্তানী আর্মির ঘোষণা ছিল, ঈদ উপলক্ষে সারা দেশে। জাঁকজমক করতে হবে, সে নির্দেশ পালন করেছে শুধু মুষ্টিমেয় কিছু ধনী পরিবার আর দালালশ্রেণী। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর গোপন ইস্তাহারে জানানো হয়েছিল, দেশের এই দুর্দিনে ঈদ উৎসবের আড়ম্বর করা অন্যায়। জাহানারা শুধু বিশেষ কয়েকজন অতিথির কথা চিন্তা করে ঈদের সেমাই, জদা বেঁধেছিলেন, তারা অবশ্য আসেনি।
তাহলে আজ কিসের উৎসব? শরীফের পীড়াপীড়িতে জাহানারা বললেন, কিছু না! এইসব জিনিসপত্র এতদিন প্রাণে ধরে জমিয়ে রেখেছিলাম। আজ হঠাৎ মনে হলো, কী হবে জমিয়ে। রেখে! হঠাৎ মরে গেলে তো সাত ভূতে লুটেপুটে খাবে। তারচেয়ে নিজেরাই ভোগ করে যাই!
শরীফ ও জামী দু’জনেই একটু গম্ভীর হয়ে গেল।
জাহানারা আবার বললেন, ভেবেছিলাম, রুমী-জামীর বিয়ের সময় এইগুলা বার করবো। ওদের কি আর বিয়ে হবার চান্স আছে? আগামীকালই কী হবে বলা যায় না!
আগামীকাল ‘ক্রাস ইন্ডিয়া’ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এই ঘোষণার মর্ম যে কী তাই-ই বুঝতে পারছে না কেউ। একটা গুজব রটেছে যে কট্টর পাকিস্তানী সমর্থকরা এই উপলক্ষে কয়েক লাখ বাঙালীকে ইন্ডিয়ার চর হিসেবে ঘোষণা করে মেরে ফেলবে। যাতে সেই দৃষ্টান্ত দেখে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা ভয় পেয়ে আত্মসমর্পণ করে।
পরিবেশ খানিকটা হালকা করার জন্য জামী বললো, জানো আম্মা, কয়দিন আগে জোনাকী সিনেমা হলের পাশে সেই যে মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কটা লুট হলো, সেইটা আসাদ, মুনীর, ফিরোজ, ফিরদৌসদের কীর্তি!
জাহানারা বললেন, তাই নাকি? ঐটুকু-টুকু ছেলেরা কী করে পারলো?
জামী বললো, শোনো না মজা। ওরা যোগাড় করেছিল একটা মোটে স্টেনগান। আসাদ নিল সেটা। আর মুনীরের হাতে একটা খেলনা রিভলবার। সেটাকে দেখতে একেবারে আসলের মতন। আরীফের বাবা পীরসাহেব, তাঁর গাড়িটা নিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়লো।
শরীফ হাসতে হাসতে বললেন, পীরসাহেবের গাড়ি নিয়ে ব্যাঙ্ক ডাকাতি? তোবা তোবা!
জামী বললো, পীরসাহেব কিছু টের পান নাই। গাড়ির নাম্বার প্লেটটাও বদল করে নেওয়া হয়েছিল জলিদের বাসায় গিয়ে। একজনকে ওরা আগেই ব্যাঙ্কের সামনের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখেছিল খবর নেবার জন্য। বেলা এগারোটায় ওদের গাড়ি পৌঁছাতেই সে বললো, অল ক্লিয়ার। আসাদ, মুনীর আর ফিরোজ দৌড়ে ভেতরে ঢুকেই দারোয়ানের কপালে স্টেনগানটা ঠেকাতেই সে হায় আল্লা, প্রাণে মাইরেন না বলে ফেলে দিল তার রাইফেল। মুনীর ক্যাশ কাউন্টারের ধারে গিয়ে খেলনা পিস্তলটা উচিয়ে বললো, হ্যান্ডস আপ! সব কয়টা লোক দুই হাত তুলে দাঁড়ালো। আর ম্যানেজার আগ বাড়িয়ে এসে বললো, ন্যান ন্যান, আপনেরা টাকা নিয়ে যান, যত খুশি নিয়ে যান, মুক্তিবাহিনীর টাকা দরকার, সে তো আমরা জানিই।
জাহানারা জিজ্ঞেস করলেন, কত টাকা পেয়েছে?
জামী বললো, শোনো না আরও মজা। তাড়াতাড়িতে ওরা কোনো বস্তা কিংবা থলি সাথে নেয় নাই। ম্যানেজার তোল বান্ডিল বান্ডিল টাকা এগিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু ওরা নেবে কিসে? ফিরোজ তার গায়ের শার্টটা খুলে তাতেই বেঁধে নিল যতগুলো পারলো, তারপর বাইরে আসতেই জামার হাত দিয়ে টুপটাপ করে টাকা খসে পড়তে লাগলো রাস্তায়।
শরীফ বললেন, নভিস আর কাকে বলে!
জামী বললো, কাছেই দুটো আর্মির ট্রাক দাঁড়িয়েছিল। তারা এতক্ষণে কিছু টের পায় নাই। কিন্তু রাস্তার লোক আজকাল মুক্তিবাহিনীর কোনো অ্যাকশান দেখলেই আনন্দে হাততালি দেয় জানো তো! ওদের দেখে অনেক লোক হাততালি দিয়ে জয় বাংলা জয় বাংলা বলে চাচাতে লাগলো! অবশ্য আমির মোটা মোটা ট্রাকগুলো স্টার্ট নেবার আগেই ওরা গাড়ি নিয়ে হাওয়া।
শরীফ আর জাহানারা দু’জনেই হাসতে লাগলেন প্রাণ খুলে।
মানুষই একমাত্র প্রাণী যে বিপদের পরিমণ্ডলের মধ্যে থেকেও হাসতে পারে।
আলমারি দেরাজে সাজানো জিনিসপত্র ব্যবহারের জন্য বার করে ফেললেও জাহানারা-শীরফরা অবশ্য একটা ঘরে অনেক জিনিসপত্র জমাচ্ছেন। বিভিন্ন দোকান থেকে ঘুরে ঘুরে কিনে আনছেন সোয়েটার, মাফলার আর মোজা। একবার জিন্না এভিনিউয়ের ফুটপাথের এক দোকান থেকে জাহানারা একসঙ্গে ছ’খানা সোয়েটার কিনতে গিয়ে একজন আর্মির লোকের কাছে ধমক খেয়েছিলেন। হঠাৎ পাশে এসে দাঁড়িয়ে সেই লোকটি জানতে চায়, কেন এক সঙ্গে ছ’খানা সোয়েটার কেনা হচ্ছে! সেদিন জাহানারার মাথায় চট করে একটা উত্তর যুগিয়ে গিয়েছিল, তাই তিনি বিপদে পড়েননি। তিনি বলেছিলেন, বেগম লিয়াকত আলী কহা হয় না, জওয়ান লোগোঁকে লিয়ে সুয়েটার, টাওয়েল, সাবুন.ইয়ে সব খরিদ করকে আপওয়া অফিস মে ভেজ না? উয়ো যো অল পাকিস্তান উইমেন্স অ্যাসোসিয়েশন হ্যায়…
ওষুধও কিনতে হচ্ছে বিভিন্ন দোকান থেকে। শরীফ, জামী যে-যখনই বাইরে বেরোয়, কিছু ওষুধ নিয়ে আসে। কেনা হচ্ছে শত শত প্যাকেট সিগারেট। জমানো হচ্ছে চাল। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে ছোট ছোট পুঁটলি করে লুকিয়ে রাখা হচ্ছে চালের মধ্যে। কখন গোপন অতিথিরা আসবে, তার কোনো ঠিক নেই। ওদের জন্য এইসব লাগে। আগে শুধু টাকা আর সিগারেট দিলেই হতো। এখন শীত এসে গেছে, ওদের কারুরই শীতবস্ত্র নেই। তবে ঐ সব ছেলেরা বলে, মোজা কেনার দরকার নেই, মোজা কোনো কাজে লাগে না, কারণ ওদের প্রায় কারুরই পায়ে জুতো নেই!
পাকিস্তানী আর্মির সাংঘাতিক কড়াকড়ির মধ্যেও মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্ত থেকে ঠিকই চলে আসে ঢাকায়, দু-এক জায়গায় অ্যাকশান করেই আবার অদৃশ্য হয়ে যায়। জাহানারা চাতক পাখির মতন তাদের জন্য প্রতীক্ষা করে থাকেন। রাত দুটোর সময়েও যদি তারা এসে চুপি চুপি পেছনের দরজায় টোকা মারে, তাতেও আনন্দে তাঁর প্রাণটা লাফিয়ে ওঠে।
প্রত্যেকবারই তাঁর মনে হয়, ওদের সঙ্গে বুঝি রুমী এসেছে!
ঠিক আটানব্বই দিন আগে রুমীকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল মিলিটারি, তারপর থেকে আর রুমীর কোনো খবর নেই। সামরিক দফতর কোনো খবর তো দেবেই না, সেখানে কিছু জানতে যাওয়াও বিপজ্জনক। শুধু পাগলাবাবাই এখনো বলে যাচ্ছেন যে রুমী ঠিকই বেঁচে আছে, তিনিই একদিন রুমীকে ছাড়িয়ে আনবেন। পাগলাবাবা আরও অনেক জননীকেই এই আশ্বাস দিয়েছেন, এসব কি নিছক সান্ত্বনা?
এমনও তো হতে পারে যে রুমী বন্দীদশা থেকে পালিয়ে গেছে কোনোক্রমে! ইন্ডিয়ায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে? কিন্তু তা হলে কি রুমী তার মা বাবাকে একটা খবরও দেবে না? হয়তো একেবারে নিচ্ছিদ্র গোপনীযতা তার পক্ষে খুব জরুরি। এখনও সময় আসেনি!
মনি, বাচ্চু, মাহবুবরা এলে জাহানারা তাদের খাবার পরিবেশন করতে করতে এক সময় জিজ্ঞেস করেন, তোরা সত্যি করে বল তো, রুমী কোথায়? তোরা তো আমাকে জানিস, আমাকে মেরে ফেললেও পাক আমি আমার পেট থেকে কোনো কথা বার করতে পারবে না। চরম খারাপ সংবাদ হলেও তোরা আমাকে বল, আমি শুধু সত্যি কথাটা জানতে চাই!
দু’একজন মিথ্যে কথা বলার চেষ্টা করেছিল, জাহানারা ধরে ফেলেছেন। এরা সত্যিই রুমীর খবর জানে না।
বাবুল চৌধুরী অবশ্য পান মাঝে মাঝে। অল্প বয়েসীরা বাবুলকে একজন অদ্ভুত মানুষ হিসেবে সমীহ করে। সে প্রায় কারুর সঙ্গেই পারতপক্ষে কথা বলে না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে চুপ
করে এক দিকে চেয়ে বসে থাকে। কিন্তু অ্যাকশানে অংশ নিলে সে অসাধারণ সাহসের পরিচয়। দেয়। যেন তার বিন্দুমাত্র প্রাণের মায়া নেই।
মাঝখানে হঠাৎ শোনা গেল সেকটর টুর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ যুদ্ধক্ষেত্রে মারা গেছে। তাতে ঢাকার অনেক পরিবারে নিদারুণ শোক নেমে এসেছিল, জাহানারাও খুব ভেঙে পড়েছিলেন। কিছু অল্প বয়েসী ছেলে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠেছিল বুক চাপড়ে। খালেদ মোশাররফ যুবসমাজের হীরো, তার নির্দেশেই অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকায় এসে পাকিস্তানী শক্তিকে কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সেই খালেদ মোশাররফ নেই।
দু চারদিন পর সীমান্তের মেলাঘর ক্যাম্প থেকে সঠিক সংবাদটি আসে। খালেদ মারা যায়নি, কসবার যুদ্ধ পরিচালনা করার সময় সে সাঙ্ঘাতিক আহত হয়েছে। ত্রিপুরা থেকে তাকে হেলিকপ্টারে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে লখনউ-এর হাসপাতালে। শেলের টুকরোয় তার কপাল ফুটো হয়ে গেলেও সে বেঁচে যাবে। তার জায়গায় এখন সেকটর টু-র কমান্ডার হয়েছে মেজর হায়দার।
যে-ছেলেটি পাকা খবর এনেছিল, সে বললো, জানেন আম্মা, আমাদের বেস ক্যাম্পে যখন খালেদ ভাইয়ের সম্পর্কে ঐ দুঃসংবাদ আসে, তখন সেখানে যেন একেবারে কারবালার মাতন পড়ে গিয়েছিল! আমিও সারা রাত্রি ধরে কেঁদেছি!
বলতে বলতে চোখে পানি এসে গিয়েছিল তার, একটু সামলে নিয়ে সে আবার হেসে বললো, কিন্তু কসবার যুদ্ধে আমাদেরই জয় হয়েছে, আমরা কসবা কেড়ে নিয়েছি!
ঢাকার কাগজে অবশ্য পরপর চারদিন ফলাও করে কসবার ঘোরতর যুদ্ধের খবর ছাপা হয়েছে, ভারতীয় চররা কামান, ফিল্ডগান, ভারী মটার, অ্যান্টি ট্যাঙ্ক গান নিয়ে আক্রমণ করলেও পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের প্রচণ্ড মার মেরে ভাগিয়ে দিয়েছে। আসলে যে কসবা তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে তা কেউ বুঝতে পারেনি। পাকিস্তানী খবরে এখনো মুক্তিযোদ্ধাদের সামান্যতম উল্লেখও থাকে না, যদিও মিলিটারি জওয়ানরা নাকি এখন মুক্তি শব্দটা শুনলেই ভয় পায়।
খবরের কাগজ পড়লে মনে হয়, ভারতের সঙ্গে বোধ হয় সত্যিই যুদ্ধ বেধে গেছে। প্রায়ই হেডিং থাকে, ভারতের নির্লজ্জ আক্রমণ। যখন তখন কারফিউ দেওয়া হচ্ছে, এমনকি দিনে দুপুরেও। সন্ধের পর নিষ্প্রদীপের মহড়া। অথচ, ভারতের আকাশবাণী কিংবা স্বাধীন বাংলা বেতারে সর্বাত্মক যুদ্ধের কোনো ইঙ্গিত নেই। ইন্দিরা গান্ধী বিদেশে ঘুরছেন। ঢাকার অনেকেই মনে মনে অধীর হয়ে ভাবে, ভারত সত্যি সত্যি যুদ্ধে নেমে পড়ছে না কেন? এই অনিশ্চয়তা আর সহ্য হয় না। বুকে ব্যথা করে।
মুক্তিযুদ্ধের তৎপরতা যত বাড়ছে, ততই ঢাকার সাধারণ বাঙালীদের ওপর কট্টর পাকিস্তান সমর্থকদের অত্যাচার বাড়ছে। মিলিটারির লোক ছাড়াও বিহারীরা রাস্তা-ঘাটে যাকে তাকে ধরে বলছে, তুম মালাউন হ্যায়! সে বেচারী প্রবল প্রতিবাদ করে কোনোরকমে ভুল উর্দু উচ্চারণে কোরান-শরীফ থেকে মুখস্থ বলার চেষ্টা করে, মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে নামাজ পড়ে, তবু তাদের বিশ্বাস হয় না। পেছনে লাথি মারে। মিলিটারি পাশে দাঁড়িয়ে মজা দেখে। এলিফ্যান্ট রোডে একদিন দুপুরে একজন ভয় পেয়ে পালাবার চেষ্টা করেছিল, সঙ্গে সঙ্গে তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হলো। পরে জানা গেল, সে তো মালাউন নয় বটেই, তার বাবা শান্তি কমিটির এক পাণ্ডা, লোকটির মাথায় সামান্য দোষ ছিল।
একদিন জামীর এসে বললো, জানো আম্মা, বিহারীরা অনেকে এখন মাথা ন্যাড়া করে একটা লাল ফেট্টি বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
জাহানারা বললেন, আমি দেখেছি বাজার করতে গিয়ে। হঠাৎ মাথা ন্যাড়া করার ধুম পড়ে গেল কেন রে?
জামী বললো, কী জানি! ঠিক শয়তানের সহোদরের মতন দেখায়!
জাহানারা বললেন, তুই ভূতের গলির ইব্রাহিমকে দেখেছিল? সেও মাথা ন্যাড়া করেছে। আজ বায়তুল মোকাররমের কাছে দেখি, সেও মাথায় একটা লাল ফেট্টি বেঁধে ঘুরছে!
জামী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ইব্রাহিম ভাই? সে ওরকম সেজেছে কেন? সেও কি রাজাকার হলো নাকি?
জাহানারা বললেন, নারে! ভীতু মানুষ। ভেবেছে ঐ রকম সাজলে তাকে আর কেউ রাস্তা। ঘাটে জেরা করবে না।
জামীর তরুণ মুখশ্রীতে ঘৃণার রেখা ফুটে উঠলো। সে বললো, কাপুরুষ! আমি আর কোনোদিন ওর মুখ দেখবো না! ফুঁঃ!
জামীর রাগ দেখে হাসতে লাগলেন জাহানারা।
জামী বাইরে থেকে নতুন নতুন খবর নিয়ে আসে। কদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে, যুদ্ধ ঘনিয়ে এলে ঢাকায় স্ট্রিট ফাইট শুরু হবে। মুক্তিযোদ্ধারা আশা করে যে তারা যখন ঢাকাকে ঘিরে এগিয়ে আসবে তখন ঢাকার নাগরিকরাও যেন এদিক থেকে পাক বাহিনীকে আঘাত হানতে শুরু করে। সে জন্য প্রস্তুত থাকা দরকার। পরাজয়ের মুখোমুখি হলে নিয়াজীর সাঙ্গোপাঙ্গরা মরায়া হয়ে ঢাকা শহরে আগুন ধরিয়ে দিতে পারে।
জাহানারার মনে পড়ে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় চার্চিলের সেই বিখ্যাত বক্তৃতা, উই শ্যাল ফাইট ইন দা হাউজেজ, উই শ্যাল ফাইট ইন দা স্ট্রিটস!
জামী সেই চূড়ান্ত যুদ্ধে অংশ নেবার জন্য বদ্ধপরিকর। শরীফই বা বাদ যাবে কেন। জাহানারার আজ আপত্তি করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তিনি বুঝে গেছেন, এখন নিয়তির কাছে সব বন্ধক দেওয়া ছাড়া আর উপায় নেই। এইরকম ভাবে আরও কয়েকমাস চললে শেষপর্যন্ত কেউই বুঝি আর বেঁচে থাকবে না। সর্বস্ব পণ করলে যদি স্বাধীনতা আসে, তা হলে হয়তো কিছু মানুষ অন্তত বেঁচে থাকবে আবার এই বাংলাদেশে জীবনের স্পন্দন জাগাতে।
কেরোসিনের টিন এগারো টাকা থেকে লাফিয়ে উঠেছিল আঠারো টাকায়, গতকাল বাজার থেকে একেবারে উধাও! সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে বিস্ফোরণের পর প্রায়ই কারেন্ট থাকে না। কেরোসিনও না পাওয়া গেলে রান্না হবে কী করে। বুড়ামিয়াকে কেরোসিনের খোঁজে পাঠিয়ে জাহানারা গাড়ি নিয়ে বেরুলেন জরুরি কিছু কেনাকাটা করতে।
বায়তুল মোকাররমের কাছাকাছি যেতেই প্রচণ্ড কোলাহল শোনা গেল। হর্ন বাজাতে বাজাতে অনেকেই গাড়ি ঘুরিয়ে নিচ্ছে। লোকজনের চ্যাঁচামেচিতে একটু কান পেতে শুনে জাহানারা বুঝলেন, আবার ওখানকার একটা দোকানে বোমা ফেটেছে! দিনের বেলা মিলিটারির নাকের ওপর দিয়ে ছেলেগুলো বোমা ফাটিয়ে চলে যায়!
কয়েকদিন আগেই ফ্যান্সি হাউজ নামে শাড়ির দোকানটায় এ রকম একটা প্রচণ্ড শক্তিশালী বিস্ফোরণে একজন পাঞ্জাবী মেজর আর তার সঙ্গে কয়েকজন মহিলা জখম হয়েছে। দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছিল তিনজন মিলিটারি, তারা নিহত। কেউ এখন আর ভয়ের চোটে শাড়ির দোকানে ঢুকছে না! জাহানারা মনে মনে খুশিই হলেন। তিনি জানেন, ফ্যান্সি হাউজ যারা আক্রমণ করেছিল, সেই আসাদ, ফিরোজ, মুনীররা রুমীরই বন্ধু। এদের দলে রুমীও থাকতে পারতো। কোথায় গেল রুমী!
সর্বক্ষণই যে রুমীর কথা মনে পড়ে, তবু মুখ ফুটে তা বলেন না। যদি শরীফ কষ্ট পায়। শরীফের স্বভাবটা খুব চাপা। তিনিও যে আজকাল রুমীর প্রসঙ্গ আর বিশেষ তোলেন না, তা কি জাহানারার কথা ভেবেই? শরীফ দিন দিন রোগা হয়ে যাচ্ছেন, ওজন কমে গেছে অনেক, তবু সব সময় তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু না কিছু সাহায্য করার ব্যাপারে মেতে আছেন। যেন ওরা সকলেই তাঁর নিজের সন্তান।
গাড়ি ঘুরিয়ে জাহানারা চলে এলেন একটা ফটোগ্রাফির দোকানে। কয়েক দিন আগে তিনি রুমীর এক বন্ধু হ্যারিসের কাছ থেকে রুমীর একটা ছবির নেগেটিভ নিয়ে এসেছিলেন। ইদানীং রুমী বাড়িতে একেবারে ছবি তুলতে চাইতো না। হ্যারিসের কাছে বেশ কয়েকখানা ছবি ছিল, তার মধ্য থেকে একখানা বেছে জাহানারা নেগেটিভটা এনলার্জ করতে দিয়েছিলেন।
ছবির দোকানে সেটা ডেলিভারি নিতে এসে জাহানারার বুকখানা ধক করে উঠলো। এত জীবন্ত ছবি! কোমরে চিশতির পিস্তল, কাঁধের ওপর গুলির বেল্ট ঝোলানো, মাথায় একটা ক্যাপ ত্যারছা করে পরা, কোমরে দু’হাত দিয়ে একটুখানি ঝুঁকে রুমী যেন কার সঙ্গে কথা বলছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা! বলিভিয়া, কিংবা ভিয়েৎনামের নয়, এই বাংলার।
বাড়ি ফেরার পথে জাহানারা বিড় বিড় করতে লাগলেন কয়েকটি কবিতার লাইন। তাঁর কবিতাপাগল ছেলেটা জীবনানন্দ দাশের এই লাইনগুলি আবৃত্তি করতে খুব ভালোবাসতো :
আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়–হয়তো
বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের
দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়
হয়তো
বা হাঁস হবো–কিশোরীর
ঘুঙুর রহিবে লাল পায়
সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে
আবার আসিব আমি বাংলার মাঠ নদী খেত ভালোবেসে
জলঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলায় এ সবুজ করুণ ডাঙ্গায়…
দুচোখ দিয়ে অবিরল অশ্রু গড়াচ্ছে, কবিতার লাইনের মাঝে মাঝে জাহানারা ফিসফিস করে সেই ছবিটাকে জিজ্ঞেস করছেন, রুমী, তুই আসবি না? কবে আসবি? তোকে যে আসতেই হবে!
বাড়িতে ফিরে নিচের তলার বসবার ঘরের এক কোণের টেবিলে একটা স্ট্যান্ডের ওপর লাগালেন সেই ছবি। সারল্যমাখা মুখোনিতে কী দৃপ্ত তার ভঙ্গি! এই রকম হাজার হাজার ছেলে যে দেশকে স্বাধীন করার জন্য লড়তে যায়, সেই দেশকে পরাধীন করে রাখবে কোন্ শক্তি।
ছবিটার তলায় একটা কাগজ সেঁটে দিয়ে জাহানারা লিখলেন, আবার আসিব ফিরে–এই বাঙলায়।
দূর থেকে তিনি মুগ্ধ হয়ে ছবিটা দেখতে লাগলেন, খানিক বাদে হঠাৎ তাঁর মুখে ফুটে উঠলো একটা আতঙ্কের ছাপ। সর্বাঙ্গে বিধতে লাগলো অনুশোচনার কাঁটা। তিনি ছুটে গিয়ে ছবিটা তুলে নিয়ে বুকে চেপে ধরলেন।
এ কী করতে যাচ্ছিলেন তিনি! বসবার ঘরে রুমীর ছবি সাজিয়ে রাখছিলেন। তার মানে তিনিও কি ধরে নিয়েছেন, রক্ত মাংসের রুমী আর নেই, সে এখন শুধু ছবি! না, না, না, তা হতে পারে না!
রুমী তোকে ফিরতে হবে, ফিরে আসতেই হবে। এ দেশ স্বাধীন হবে, তা তুই দেখবি না? এরপর দেশ গড়ার কত রকম কাজ থাকবে, তাতে অংশ না নিয়ে তুই ফাঁকি দিয়ে চলে যাবি? তোর মতন ছেলে কি তা পারে?