2 of 2

৫৬. দিন ঘনায়ে আসলে মানুষ ধর্ম কপচায়

কলিমউল্লাহ তার স্ত্রী, শাশুড়িকে নিয়ে বর্তমানে নিউ পল্টনে যে বাড়িতে বাস করছে সেই বাড়ির নাম হেনা কুটির। বাড়িটা দোতলা। সব মিলিয়ে আটটা কামরা। দুটা দক্ষিণমুখি। একটা দক্ষিণমুখি ঘরে সে তার স্ত্রী মাসুমাকে নিয়ে থাকে। অন্যটায় তার শাশুড়ি, বড় মেয়ে মরিয়ম, ছোট মেয়ে মাফরুহ এবং ছোট ছেলেটাকে নিয়ে থাকেন। মরিয়মের জন্যে আলাদা ঘর দেয়া হয়েছে। সে সেখানে থাকে না। একা তার ভয় লাগে। বাড়ির সামনে ছোট্ট লনের মতো আছে। লনে দেশী ফুলের গাছ। বাড়ির এক পাশে হাসনাহেনার ঝাড়। বাড়ির পেছনে বেশ অনেকখানি জায়গা। সেখানে দুটা বড় কামরাঙ্গা গাছ আছে। একটা গাছের গুড়ি শ্বেতপাথরে বাঁধানো। কলিমউল্লাহ রোজ কিছু সময় এখানে কাটায়। তার হাতে তখন কাগজ-কলম থাকে। কামরাঙ্গা গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে গাছের চিড়ল চিড়ল পাতা দেখতে তার ভালো লাগে। নতুন কবিতা নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে। জীবন এত আনন্দময় কেন–এই নিয়ে ভাবতেও ভালো লাগে। ভালো লাগার ষোল কলা পূর্ণ হতো, যদি নতুন কোনো কবিতা লেখা হতো। বিয়ের পর থেকে তার মাথায় কবিতা আসছে না। একটাও না। একদিন শুধু একটা লাইন এসেছিল–

কামনায় রাঙ্গা ছিল কামরাঙ্গা ফল

এইখানেই সমাপ্তি। দ্বিতীয় লাইনটা আসে নি। প্রথম লাইনটাও মাথা থেকে যায় নি। কলিমউল্লাহ এখন নিশ্চিত–প্রথম লাইনটা মাথা থেকে না তাড়ালে নতুন কিছু আসবে না। তার এখন প্রধান চেষ্টা মাথা থেকে প্রথম লাইন সরানো। ব্যাপারটা খুব সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। গ্রামোফোনের প্যাঁচকাটা রেকর্ডের মতো একটা লাইনই শুধু মাথায় ঘুরপাক খায়। কবি হওয়ার যন্ত্রণা আছে। সাধারণ মানুষ এই যন্ত্রণা থেকে অবশ্যই মুক্ত।

নতুন বাড়ি কলিমউল্লাহর স্ত্রীর খুবই পছন্দ। মাসুমা জিজ্ঞেস করেছে, এই বাড়ি আসলে কার? কলিমউল্লাহ বলেছে, তোমার।

মাসুম বলেছে, আমার হবে কীভাবে? বাড়ি যদি আমার হতো তাহলে বাড়ির নাম হতো মাসুম কুটির। বাড়ির নাম তো হেনা কুটির।

কলিমউল্লাহ হাই তুলতে তুলতে বলেছে, বাড়ির নতুন নামের শ্বেতপাথর যখন বসবে তখন টের পাবে। অর্ডার দেয়া হয়েছে। সাদা পাথরে কালো অক্ষরে বাড়ির নাম লেখা হবে। এতদিনে হয়ে যেত, কারিগর নেই বলে হচ্ছে না।

কী নাম? মাসুম কুটির?

না। বাড়ির নাম রেখেছি মেঘবালিকা।

মেঘবালিকাটা কে?

তুমি। মেঘবালিকা কবিতা তোমাকে নিয়ে লিখেছি, ভুলে গেছ? এত ভুলোমনা হলে সংসার চলবে?

সত্যি করে বলো তো বাড়িটা কার?

এক হিন্দু উকিলের বাড়ি ছিল। ইন্ডিয়ায় পালায়ে গেছে। আমি বন্দোবস্ত নিয়েছি।

কীভাবে বন্দোবস্ত নিয়েছ?

আছে, আমার কানেকশন আছে।

দেশ স্বাধীন হলে তো এই বাড়ি তোমার থাকবে না।

কলিমউল্লাহ বিরক্ত হয়ে বলল, দেশ স্বাধীন হবে তোমাকে কে বলেছে?

মাসুমা অবাক হয়ে বলল, দেশ স্বাধীন হবে না?

কোনোদিন না। পটকা ফুটিয়ে দেশ স্বাধীন করতে লাগবে খুব কম করে হলেও একশ পঞ্চাশ বছর। বাঙালি জাতি কী রকম জানো? বাঙালি জাতি হলো স্বফুলিঙ্গ জাতি। যে-কোনো বিষয়ে উৎসাহে ফুলিঙ্গের মতো ঝলমল করে। সেই উৎসাহ ধাপ করে নিভে যায়। ফুলিঙ্গ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা জানো?

না।

রবীন্দ্ৰনাথ লিখেছেন

ফুলিঙ্গ তার পাখায় পেল
ক্ষণকালের ছন্দ
উড়ে গিয়ে ফুরিয়ে গেল,
সেই তারই আনন্দ।

মাসুমা মুগ্ধ গলায় বলল, এত কবিতা তুমি জানো, আশ্চর্য। মাসুমা যতই তার স্বামীকে দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে। প্রায়ই তার মনে হয়, একটা মানুষ একই সঙ্গে এত জ্ঞানী এবং এত ভালো হয় কীভাবে? ভাগ্যিস দেশে একটা যুদ্ধ শুরু হয়েছে। যুদ্ধ শুরু হয়েছে বলেই তো এমন একজন অসাধারণ মানুষের সঙ্গে হুট করে তার বিয়ে হয়ে গেল। যুদ্ধ যদি না হতো আর বাবা যদি তাদের সঙ্গে থাকতেন তাহলে নিশ্চয়ই তার বিয়ের জন্যে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার খোঁজা হতো। কবি খোঁজা হতো না।

মাসুমা এখন তার স্বামীর প্রতিটি কথা মনে-প্ৰাণে শুধু যে বিশ্বাস করে তাই না— কথাগুলি অন্যদের শোনানোর দায়িত্বও অনুভব করে। মরিয়ম এখন তার মেঝ বোনকে ডাকে হিজ মাস্টার্স ভয়েস। মাসুমা এতে রাগ করে না। সে আনন্দই পায়।

রাতের খাবার পর কলিমউল্লাহ সবাইকে নিয়ে টিভিতে খবর দেখে। খবর দেখার পর দেশের অবস্থা নিয়ে গল্পগুজব করে। এই সময়টা মাসুমার খুব ভালো কাটে। গল্প বলার সময়ই তার মনে হয়–একটা মানুষ এত সুন্দর করে কথা বলে কীভাবো! আর কত তার আদব-কায়দা! স্ত্রী সামনে থাকার পরেও সে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে কথা বলে না। কথা বলে তার শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে। কী মিষ্টি করেই না সে মা ডাকে! সব মানুষ তাদের শাশুড়িকে আম্মা ডাকে। শুধু এই মানুষটা ডাকে মা। মাসুমার মনে হয়, শুধুমাত্র একজন কবির পক্ষেই তার শাশুড়িকে এত মিষ্টি করে মা ডাকা সম্ভব।

মা মন দিয়ে শোনেন। আমাদের জাতিগত সমস্যা হচ্ছে, আমরা কোনো কথা মন দিয়ে শুনি না। কান দিয়ে শুনি। আমরা অতীত নিয়ে হৈচৈ করি।–ভবিষ্যতে কী আসছে সেটা নিয়ে ভাবি না। ঘটনার এ্যানালাইসিস করতে পারি না। আমি আজ একটা এ্যানালাইসিস দেব। দেখেন আপনার কেমন লাগে।

মুক্তিযুদ্ধের নামে যে পটকা ফাটাফাটি হচ্ছে তার পেছনের প্রধান মানুষ কে? শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি কোথায়? জেলে। তার কপালে কী আছে? ফাঁসির দড়ি। কাজেই শেখ মুজিবুর রহমানের প্রসঙ্গে এইখানেই শেষ। ফুল স্ট্রপ। কমা সেমিকোলন না, একেবারে ফুলস্টপ।

বাকি থাকল। কারা? আওয়ামী লীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। তারা কী করছেন? একে একে দল ছেড়ে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন। আজো একজন করেছেন। চট্টগ্রামের এমপি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। কিছুক্ষণ আগেই নিউজে দেখলেন। দেখলেন না? গত সপ্তাহে বগুড়ার দুই আওয়ামী এমপি পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিল। এরা কেউ বেকুব না। এরা বাতাস বোঝে। কখন কোন দলে যেতে হবে জানে।

যারা প্ৰথম ধাক্কায় ইন্ডিয়ায় চলে গেছে তারা পড়েছে বেকায়দায়। ইচ্ছা! থাকলেও ইয়াহিয়ার সঙ্গে যোগ দিতে পারছে না। তারা আছে সুযোগের অপেক্ষায়। ফিরে এলো বলে।

তারা যে আশা করছে ইন্ডিয়া বাংলাদেশের জন্যে যুদ্ধ করবে, সেই আশার গুড়ে বালি শুধু না, আশার গুড়ে গু। মা, একটা খারাপ কথা বলে ফেলেছি, বেয়াদবি মাপ করবেন। ইন্দিরা গান্ধী সাগু খাওয়া মেয়ে না। সে নামত জানা মেয়ে। ইন্ডিয়া পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করলেই লাদাখ দিয়ে শত শত চাইনিজ সৈন্য ইন্ডিয়ার ভেতরে ঢুকে পড়বে। এক টানে তারা চলে আসবে মেঘালয় পর্যন্ত। ইন্দিরার অবস্থা তখন কী হবে? ইন্দিরাকে বলতে হবে–ভিক্ষা চাই না, তোমার কুত্তাটারে একটু সামলাও। এইখানেই শেষ না, থাবা মেরে বসে আছে আমেরিকা। প্রেসিডেন্ট নিক্সন বিম ধরে আছেন। তবে বিপ্লাম ধরা অবস্থাতেও সিগন্যাল পাঠিয়ে দিয়েছেন ইন্ডিয়ার কাছে। সিগন্যালটা হলোইন্দিরা, তুমি অনেকদিন আমাদের চির শত্রু রাশিয়ার সঙ্গে ঘষাঘষি করেছ। আমি চুপ করে দেখেছি। আর দেখব না।

আমেরিকা কী বুঝেন তো মা? আমেরিকা হলো বাঘের বাবা টাগ। বাঘ লাফ দিয়ে ঘাড়ে পড়ে। টাগ লাফ দেয় না। লেজ দিয়ে একটা বাড়ি দেয়। এক বাড়িতেই কাজ শেষ।

মরিয়ম ভয়ে ভয়ে বলল, যারা মুক্তিযুদ্ধ করছে তাদের কী হবে?

কলিমউল্লাহ মরিয়মের দিকে তাকিয়ে বলল, আপা, সত্য জবাবটা আপনাকে দিতে খারাপ লাগছে। কারণ ভাইসাহেব মুক্তিযুদ্ধে গেছেন। ঝড়-বৃষ্টি, প্যাক-কাদায় কী করতেছেন তিনিই জানেন। তারপরেও সত্যটা বলি। এদের মোহভঙ্গ হবে। অনেকের ইতিমধ্যে হয়েও গেছে। এরা অস্ত্ৰপাতি ফেলে নিজের নিজের ঘরে ফেরার চেষ্টা করবে। যারা আগে রেগুলার আর্মিতে ছিল, তাদের কোর্টমার্শাল হবে। যারা রেগুলার আর্মির না, তাদের কী হবে বলতে পারছি না। শাস্তি হতে পারে, আবার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণাও হতে পারে।

আজকের মতো আলোচনা শেষ। মা যান। ঘুমাতে যান। আপনার ঘুম কম হচ্ছে। আপনার ঘুম দরকার। চিন্তা করবেন না। চিন্তায় ভাত নাই। কর্মে ভাত।

কৰ্মে ভাত কথাটা এখন কলিমউল্লাহর জন্যে প্রযোজ্য। সে প্রচুর কাজ করছে। সেনাবাহিনীকে ছোটখাটো জিনিস সাপ্লাই দিচ্ছে। অদ্ভুত অদ্ভুত সব জিনিস। একবার সাপ্লাই দিল এক টন নারিকেল তেল। এক টন নারিকেল তেলের তাদের প্রয়োজনটা কী কে জানে! ট্যাংকের চাক্কায় কী দেবে! জিজ্ঞেস করলে হয়তো জানা যায়। কলিমউল্লাহ জিজ্ঞেস করে না। বাড়তি কৌতূহল দেখানোর দরকার কি? তার সাপ্লাই দেয়া নিয়ে কথা। মিলিটারি সাপ্লাই মানে পয়সা। নগদ পয়সা।

মিলিটারি সাপ্লাই ছাড়াও সম্পূর্ণ নতুন এক জায়গা থেকে ভালো টাকা আসছে। টাকাটা অন্যায়ভাবে আসছে তা ঠিক, তবে যুদ্ধের বাজারে ন্যায় অন্যায় দুই যমজ ভাই। বোঝার উপায় নাই কোন ভাই ন্যায়, কোন ভাই অন্যায়। দুজনই দেখতে একরকম।

টাকা বানানোর নতুন কায়দাটা হলো বন্দিশিবির থেকে খবর বের করা। আত্মীয়স্বজনরা খবরের জন্যে আধাপাগল হয়ে থাকে। টাকা খরচ করতে তাদের কোনো অসুবিধা নেই। গয়না, বাড়ি-ঘর বিক্রি করে হলেও টাকার জোগাড় করবে, শুধু একটা খবর দরকার। বেঁচে আছে না। মারা গেছে।

খবর সাপ্লাইয়ের ব্যবসা অনেকেই করছে। ঘরে বসে উপার্জন। কোনো রিস্ক নেই। অনেক বিহারি যেখানে করছে, সেখানে তার এই ব্যবসা করতে ক্ষতি কী? বরং লাভ আছে। টাকাটা বিহারিদের হাতে না গিয়ে বাঙালির হাতে থাকিল।

এই ব্যবসায় তার এক বিহারি পার্টনার অবশ্যি আছে। মজনু শেখ। টাকার অর্ধেক ভাগ তাকে দিতে হয়। পুরো টাকাটা সে রাখতে পারে না। ব্যবসাটা একা করতে পারলে হতো। সেটা সম্ভব হচ্ছে না। বিহারি লোক ছাড়া বিষয়টা বিশ্বাসযোগ্য করা যায় না। বাঙালিরা এখন বিহারি বিশ্বাস করে না। শুধু এই একটি ক্ষেত্রে বিহারির কথা তারা বিশ্বাস করে।

ব্যবসাটা এইভাবে হয়–একজন এলো তার ভাইকে মিলিটারি ধরে নিয়ে গেছে। সে বেঁচে আছে না বন্দিীশিবিরে আছে জেনে দিবে। তার কাছে খবর পাঠাতে হবে। মুক্তির ব্যবস্থা করা যায় কি-না দেখতে হবে।

কলিমউল্লাহ প্রথমে খুব সূক্ষ্মভাৱে পার্টির টাকা-পয়সা কেমন আছে বােঝার চেষ্টা করে। পার্টি দুর্বল হলে এক ব্যবস্থা, সবল হলে অন্য ব্যবস্থা। মাঝামাঝি অর্থনৈতিক অবস্থার পার্টির সঙ্গে প্রথমদিন কলিমউল্লাহর নিম্নোক্ত কথাবার্তা হয়–

আপনার ভাইকে কবে ধরে নিয়ে গেছে?

সোমবার।

তারিখটা বলেন, শুধু বার বললে তো হবে না।

আঠারো তারিখ।

ভাইয়ের নাম, বয়স বিস্তারিত একটা কাগজে লেখে আমাকে দেন। ছবি এনেছেন?

জি-না।

কী আশ্চর্য কথা, একটা ছবি সঙ্গে করে আনবেন না!

এখন নিয়া আসি। সিঙ্গেল ছবি বোধহয় নাই, গ্রুপ ছবি আছে।

গ্রুপ ছবি থেকে কী বোঝা যাবে বলেন। সিঙ্গেল ছবি জোগাড় করার ব্যবস্থা করেন। তবে আজকে না। আজ আমার কাজ আছে। আগামীকাল এই সময়ে আসেন।

জি আচ্ছা। খবর কি পাওয়া যাবে?

সেটা তো ভাই বলতে পারব না। অবস্থা বুঝেন না? আমি চেষ্টা করব সেটা বলতে পারি।

টাকা-পয়সা কত দেব?

আরে রাখেন টাকা-পয়সা, আগে খোঁজটা পাই কি-না দেখি। আগামীকাল ছবি নিয়ে আসেন, আর ভাইকে যদি কোনো খবর পাঠাতে চান, সেটা চিঠির মতো করে দেন। সেই চিঠিতে খবরদার আপনার ভাইয়ের নাম উল্লেখ করবেন। না। নিজেদের নামও লিখবেন না। চিঠি ধরা পড়লে বিরাট সমস্যা হয়।

ভাই সাহেব, কিছু টাকা দিয়ে যাই?

আপনার মনে হয় টাকা বেশি হয়ে গেছে। এখন বাড়িতে যান। আল্লাহখোদার নাম নেন। টাকা খরচের সুযোগ পাবেন।

পার্টি খুবই খুশি হয়ে বাড়ি যায়। এক ধরনের ভরসাও পায় যে, এরা ধান্দাবাজ না।

পরের দুই সপ্তাহ পাটিকে শুধু খেলানো। প্রথমবার বলা যে বেঁচে আছে। তবে পুরো নিশ্চিত না।

তারপরের বার বেঁচে আছে এই ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত। তবে মিলিটারি খুবই অত্যাচার করছে। মার বন্ধ করার জন্যে টাকা।

তারপরের বার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ, একবেলা শুধু একটা শুকনা রুটি দিচ্ছে। টাকা খরচ করলে হয়তো রেশনের খাওয়া পাবে, তবে নিশ্চিত।

শেষবার বড় অংকের টাকা নেয়া হয় মিলিটারিকে ঘুস দিয়ে রিলিজ করে নিয়ে আসার জন্যে। তবে আগেই বলা হয় সম্ভাবনা মাত্র ত্ৰিশ পারসেন্ট। ভাগ্য ভালো থাকলে রিলিজ হয়ে যাবে। ভাগ্য খারাপ হলে পুরো টাকা নষ্ট হবে। এখন আপনি দেখেন চান্স নিবেন কি না। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন। আমি বলব, চান্স না নিতে। এরা আজকাল রিলিজ করে দেবে এই বলে টাকা খায় কিন্তু কাজ করে না। বিরাট হারামি জাতি।

এই কথা বলার পরেও সব পার্টি টাকা দেয়। সম্ভাবনা যত কমই হোক, একটা চেষ্টা তো করা হলো।

কলিমউল্লাহকে গুছিয়ে কথা বলা ছাড়া আর কিছুই করতে হয় না। ঘরে বসে রোজগার। কলিমউল্লাহর মাঝে মাঝে মনে হয়, যুদ্ধের সময় হলো বুদ্ধি পরীক্ষার সময়। বুদ্ধি থাকলে যুদ্ধের সময় করে খেতে পারবে, বুদ্ধি না থাকলে শেষ। নিজের বুদ্ধিতে কলিমউল্লাহ নিজেই মাঝে-মাঝে চমৎকৃত হয়।

জোহর সাহেবের সঙ্গে কলিমউল্লাহর যোগাযোগ আছে। তবে জোহর সাহেব এখন আগের চেয়ে অনেক ব্যস্ত। সব সময়ই তার ঘরে লোকজন থাকে। বেশির ভাগ দিন কথাবার্তাই হয় না। কলিমউল্লাহর ধারণা যে প্রয়োজনে প্রথম তাকে ডাকা হয়েছিল, সেই প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে বলেই তার আলাদা ডাক পড়ে না। প্রয়োজনটা কী ছিল তা এখনো কলিমউল্লাহর কাছে পরিষ্কার না। প্রয়োজন শেষ হলে তাকে পুরোপুরি বিদেয় করে দেয়ার কথা। তাও এরা করছে না। শত ব্যস্ততার মধ্যেও জোহর সাহেব তার দিকে তাকিয়ে পরিচিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়েন। এইটাই কম কী! জোহর সাহেব অতি ক্ষমতাধর ব্যক্তি। ক্ষমতাধর মানুষের চোখের ইশারারও দাম আছে।

জোহর সাহেবের শরীর-স্বাস্থ্য মনে হয় খুবই খারাপ হয়েছে। চাদর আগেই গায়ে দিয়ে রাখতেন, এখন চাদরের নিচে ফুল হাতা সুয়েটার পরেন। দুর্দান্ত গরমে একজন মানুষ ফুলহাতা সুয়েটার এবং চাদর গায়ে দিয়ে থাকে কীভাবে – সেও এক রহস্য। তিনি সারাক্ষণই কাশেন।। যক্ষ্মারোগীর কাশির মতো খুসখুসে কাশি। ব্যাটাকে যক্ষ্মায় ধরেছে কি-না কে জানে!

কলিমউল্লাহ যখন ধরেই নিয়েছিল জোহর সাহেব তাকে আর ডাকবেন না, আলাদা করে কথাবার্তা বলবেন না, তখন ডাক পড়ল। সেদিন ঘরে লোকজন নেই। জোহর সাহেব একা। তাঁর পুরনো ভাঙ্গতে চেয়ারে পা তুলে বসে আছেন। খুসখুসে কাশি কাশছেন।

কেমন আছ কবি?

বিনয়ে গলে যাবার মতো ভঙ্গি করে কলিমউল্লাহ বলল, স্যার আপনার দোয়া।

টাকা-পয়সা ভালো কামাচ্ছেন তো?

কলিমউল্লাহ খানিকটা হকচাকিয়ে গেল। সে টাকা-পয়সা কামাচ্ছে–এই তথ্য জোহর সাহেবের জানার কথা না। ব্যাটা মনে হয় আন্দাজে ঢ়িল ছুঁড়েছে। এরা আন্দাজে ঢিল ছোড়ার বিষয়ে ওস্তাদ।

জোহর সাহেব কাশতে কাশতে বললেন, টাকা-পয়সা যা কামানোর দ্রুত কামিয়ে নিন। সুযোগ বেশি দিন নাও থাকতে পারে।

কলিমউল্লাহ প্ৰসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে বলল, স্যারের শরীর কি খারাপ?

হ্যাঁ, খারাপ। আমার নিজের ধারণা লাংস ক্যান্সার। ডাক্তার এই কারণেই দেখাচ্ছি না। আপনার শরীর ভালো তো?

জি জনাব, আমি ভালো।

মোবারক হোসেন সাহেবের মেয়েকে বিয়ে করেছেন?

এইবার কলিমউল্লাহ সত্যি সত্যি চমকাল। এই খবর কোনোক্রমেই জোহর সাহেবের জানার কথা না। ব্যাটা জানে কীভাবে? কলিমউল্লাহ নিজের বিস্ময় গোপন করতে করতে বলল, জি স্যার। অসহায় পরিবার। মনটা এত খারাপ হয়ে গেল। মাথার উপরে দেখাশোনার কেউ নাই–এই ভেবে এত বড় দায়িত্ব নিলাম। আপনার কথাও তখন মনে পড়ল।

আমার কথা মনে পড়ল কেন?

আপনি বলেছিলেন পরিবারটির জন্যে আপনি কিছু করতে চান?

কলিমউল্লাহ।

জি স্যার।

তুমি অনেক বুদ্ধিমান, কিন্তু তোমার চেয়ে আমার বুদ্ধি অনেক বেশি। কেউ যখন আমাকে খুশি করার জন্যে কিছু বলে, আমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেলি। আমার তখন ভালো লাগে না।

আমি ভুল করে থাকলে মাফ করে দেবেন স্যার।

আলবদর বাহিনী তৈরি হচ্ছে শুনেছ?

জি-না স্যার।

আমি চাই তুমি আলবদরে ঢুকে যাও। সেখানে কিছু বুদ্ধিমান মানুষ দরকার।

আপনি যা বলবেন, তাই হবে স্যার।

কোরআন শরীফ পড়েছ?

কলিমউল্লাহ বিস্মিত হবার ভঙ্গি করে বলল, মুসলমানের ছেলে কোরআন শরীফ পড়ব না, কী বলেন স্যার!

জোহর সাহেব কাশি থামিয়ে শান্ত গলায় বললেন, আল্লাহপাক কোরআন শরীফে বলেছেন–মানুষকে আমি সর্বোত্তম রূপে তৈরি করি। সে যখন পরিবর্তিত হয়, তখন তাকে সর্বনিম্ন স্তরে নিয়ে যাই।

কলিমউল্লাহ বলল, বাহ সুন্দর আয়াত!

জোহর সাহেব কলিমউল্লাহর দিকে ঝুকে এসে বললেন, তুমি ছিলে কবি। একজন কবি হলো মানুষের সর্বোত্তম রূপ। তুমি যখন পরিবর্তিত হবে, তখন কতটা পরিবর্তিত হও–সেটা আমার দেখার ইচ্ছা।

স্যার কি আমার উপর কোনো কারণে রাগ করেছেন?

না, রাগ করি নি। একজন কবি কি কখনো আরেকজন কবির উপর রাগ করতে পারে? ভালো কথা, কোরআন শরীফে কবিদের প্রসঙ্গে একটা আয়াত আছে, সেটা কি তুমি জানো?

জি-না স্যার।

পরেরবার আয়াতটা জেনে আসবে। তখন এই আয়াত নিয়ে আমরা

আলোচনা করব।

জি আচ্ছা স্যার।

জোহর সাহেবের ঘর থেকে বের হয়ে কলিমউল্লাহ মনে মনে বলল, তোর দিন ঘনায়ে এসেছে। দিন ঘনায়ে আসলে মানুষ ধর্ম কপচায়, তুইও ধর্ম কপচাচ্ছিস।

মনে মনে এ ধরনের কঠিন কথা বললেও সে পরদিন আলবদরে ঢুকে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *