2 of 2

৫৬. তৃষা তার ঘরের উত্তরের জানালা দিয়ে দেখছিল

তৃষা তার ঘরের উত্তরের জানালা দিয়ে দেখছিল। একটা ঝাপানো ফুলগাছের ইকড়িমিকড়ি চিকের মতো আড়াল করেছে জানালাটাকে। আর এবারকার হাড় কাঁপানো শীতের উত্তুরে হাওয়া এসে ডালপালায় হি-হি কাঁপুনি তুলছে মাঝে মাঝে। জানালাটা বন্ধ করতেই এসেছে তৃষা। বাইরে পাল্লার দিকে হাত বাড়িয়ে থেমে গেছে। দেখছে।

দেখছে একটা ভাঙাচোরা বুড়িয়ে যাওয়া মানুষের কাঠামো ভাবন-ঘরের বারান্দায় বসে আছে। কাঠের চেয়ারে। সকালের অঢেল রোদ আর অবারিত শীত হাওয়ায় রোগা মুর্তিটা নড়ছে কি? পড়ে যাবে না তো! লোকটা ঠিক বসেও নেই। যেন কেউ বসিয়ে রেখে গেছে। গলা পর্যন্ত একটা কুটকুটে মোটা লোহি আলোয়ান। মাথা ঢাকা মাফলারে। ভাঙচুরগুলো বুঝতে তবু কষ্ট হয় না। এতদূর থেকে শুধু অল্প খোলা মুখটুকুর দিকে চাইলেই বোঝা যায়। তৃষাকে তো ভাল করে দেখতে হচ্ছে না এখন। তার তো সবটুকুই দেখা। পা তুলে কাঠের চেয়ারে বসে চেয়ে আছে অনড়, অটল। কাঠের চেয়ার! তৃষা একটু ভ্রু কোঁচকায়। কাউকে বললেই তো ইজিচেয়ারটা টেনে বের করে দিত বারান্দায়।

বউমা! বউমা!—উঠোন থেকে দীননাথ ডাকছেন।

তৃষা জানালাটা বন্ধ করে উঠোনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল।

দীননাথ রোদে দেওয়া একরাশ লেপ-তোশকের পাশে লাঠি হাতে উবু হয়ে বসে আছেন! তৃষাকে দেখে বললেন, কাউকে পাহারায় রাখখানি, বজ্জাত কাক চড়ুই সব ননাংরা করে দেবে যে লেপ-তোশক।

করবে না। উঠোন দিয়ে তো আমরা অনবরত যাতায়াত করছি।

তবু সাবধান হওয়া ভাল। সকালবেলাটায় খবরের কাগজটা কোথায় যায় বলো তো! এই সময়টুকুতেই আমি যা একটু চোখে দেখতে পাই। ওরা সেই বেলা গড়িয়ে গেলে চাইতে চাইতে তবে দেয়। তখন বড় অক্ষর ছাড়া কিছু পড়তে পারি না।

খবরের কাগজ তো কেউ পড়ে না বাবা। দেখছি কোথায় আছে। বোধহয় আমার ঘরেই। দেখো গে। পেলে পাঠিয়ে দাও। রোদে বসে বসে পড়ি আর তোমার বিছানা পাহারা দিই।

নিজের ঘরে তৃষা স্টোভে চা বসিয়েছিল। সারাদিনে কয়েকবার সে নিজের হাতে তৈরি চা খায়। রান্নার ঠাকুর হুকুমমতো করে দেয় বটে, কিন্তু তৃষার রুচিমতো হয় না। ঘরে এসে তৃষা জল নামাল। অত্যন্ত দামি সুগন্ধী চা-পাতা ভিজিয়ে চা ঘঁাকল। খেল। কিন্তু সারাক্ষণ জোড়া কোঁচকানো রইল তার। চায়ের তেমন স্বাদ পেল না।

খবরের কাগজটা মেঝেয় পড়ে ছিল। বারান্দার জানালার ধারে। সে নিজে কদাচিৎ খবরের কাগজ পড়ে। চা শেষ করে খবরের কাগজটা শ্বশুরকে পৌঁছে দিয়ে সে উঠোনের বেড়ার আগল ঠেলে বেরিয়ে এল।

ঝাঁটপাট দেওয়া পরিষ্কার রাস্তার ওপর আবার দুটো-একটা করে পাতা খসে পড়ছে। কিন্তু পোড়া পাতা আর ছাই উড়ে এসেছে নিতাইয়ের ঝোপড়ার দিক থেকে। রোজ সন্ধেবেলা সে আগুন পোহায়।

বাগানের দিকে মুখ করে বসে আছে শ্রীনাথ। চোখ ড়ুবে আছে বাগানে। এবার মেদিনীপুরের একটা লোক বাগান করছে। কাজ জানে। সারা বাগান জুড়ে রঙের বান ডাকিয়ে দিয়েছে। এই একটা জিনিস শ্রীনাথ বোঝে। গাছপালা। যে লোকটা বাগান করেছে সে যে গুণী তাতে সন্দেহ নেই। আজকাল শুধু এই লোকটার সঙ্গে শ্রীনাথ যা একটু কথাবার্তা বলে। কথা বলে ভারী আরাম পায়।

লোকটা পপি ফুলের বেড উসকে দিচ্ছে এখন। জল দিয়ে আসবে। সিঁড়িতে বসে দু’দণ্ড জিরোবে। কথা হবে! শ্রীনাথ কাঙালের মতো চেয়ে আছে।

ভাওয়ালের কবি গোবিন্দ দাস লিখেছিলেন, ও ভাই বঙ্গবাসী, আমি মরলে তোমরা আমার চিতায় দিবে মঠ…। শ্রীনাথ মরলে বঙ্গবাসী অবশ্য মঠ দেবে না। তবু শ্রীনাথের বড় ইচ্ছে, তাকে যেখানে পোড়ানো হবে সেখানে যেন ছোট্ট করে ঘিরে নিয়ে কয়েকটা গাছ লাগানো হয়। মৃত্যুর পর তার মতো পাপী লোকের আত্মার তো গতি হবে না। তার আত্মা থাকবে মাটির খুব কাছাকাছি নিম্নস্তরে। তখন ওই নিজের ভস্মীভূত দেহের রেণুমাখা গাছপালার মধ্যে সে ঘুরে ঘুরে বেড়াবে। কাউকে ভয় দেখাবে না, কিছু চাইবে না সে।

ইজিচেয়ারটা কাউকে বের করে দিতে বলোনি কেন?

কথাটা খুব ভাল শুনতে পেল না শ্রীনাথ। বাগানের মধ্যে ড়ুবে ছিল। শুধু আস্তে মুখটা ঘুরিয়ে বলল, উঃ!

কাঠের চেয়ারে এভাবে কতক্ষণ বসে থাকতে পারে রোগা মানুষ?

এবার চমকাল শ্রীনাথ। তৃষা। তার সর্বাঙ্গে একটা অস্পষ্ট ভয়ের কাঁপুনি বয়ে যেতে থাকে। খুব অল্প অল্প করে বিষ ছড়িয়ে গেছে তার শরীরে। বিলম্বিত বিষ, কিন্তু অমোঘ। তার খাবারে, তার জলে, দুধে, তার ওষুধে পর্যন্ত। প্রতিবার ভাতের গ্রাস মুখে তুলতে গিয়ে থেমে যায় সে। নিজেকে জিজ্ঞেস করে, খাব? এই বিষ! তার ভিতরে হতাশায় ভেঙে পড়া মানুষ প্রতিবার জবাব দিয়েছে, খাও, খাও, অনেক ভোগ করেছ জীবনে। মরতে তো হবেই। তাই খেয়েছে শ্রীনাথ। শুধু আয়ু নয়, বিষে আক্রান্ত তার আত্মবিশ্বাস, তার যৌনবোধ, তার মস্তিষ্ক, অনুভূতি। তৃষা বিষ চেনে। প্রয়োগের বিধিও জানে চমৎকার। বিষের প্রভাবেই বুঝি আজকাল তৃষা সকালে এলে সাপুড়ের মন্ত্রের মতো কাজ হয়, ফণা নেমে যায় শ্রীনাথের। ফণা নেমে যায়? না কথাটা ঠিক হল না। আজকাল সে আর ফণা তোলে কই?

শ্রীনাথের চাউনিটা খুব ভাল লাগল না তৃষার। চমকানোটাও লক্ষ করল। শ্রীনাথ কোনও দুয়ে কারণে তাকে ভয় পায় তৃষা জানে। তাই সে আজকাল শ্রীনাথের সামনে আসে না। ভাবে, বোমার সেই শক ওকে খানিকটা অস্বাভাবিক করে ফেলেছে। আপনা থেকেই সেরে যাবে। যায়নি যদিও।

দাঁড়াও, মালিটাকে বলি ইজিচেয়ারটা বারান্দায় দিয়ে যাক। বারান্দার ধারে গিয়ে তৃষা ডাকে, শ্রীপতি! এই শ্রীপতি!

খুব সংকোচের সঙ্গে শ্রীনাথ বলে, কিছু কষ্ট হচ্ছে না। বেশ আছি।

তৃষা গম্ভীর মুখটা ফিরিয়ে শ্রীনাথের দিকে চেয়ে বলে, না, ঠিক নেই।

শ্রীনাথ আর কিছু বলল না। শ্রীপতি দৌড়ে এসে ইজিচেয়ার বের করে রোদে পেতে দিল। শ্রীনাথ অস্বস্তির সঙ্গে সেটার ওপর আধশোয়া হল। চিত হয়ে ওপর পানে তাকিয়ে দেখল, তৃষাকে কত বিশাল বড় আর শক্তিময়ী দেখাচ্ছে। মাথাটা বারান্দার প্রায় ছাদে গিয়ে ঠেকেছে। দুই চোখে বুদ্ধির ধার আর ক্রুরতা ঝলমল করছে সকালের রোদে। গায়ের পশমি চাদরটার রং শুকিয়ে যাওয়া রক্তের মতো কালচে লাল, তাতে সবুজ আর হলুদ ফুলের এমব্রয়ডারি। কিন্তু এতেই প্রায় রাজেন্দ্রাণীর মতো দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে ওর পিছনেই রয়েছে শিকলে বাঁধা পোষা সিংহটা।

আজ বদ্রী তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে।

বদ্রী!–শ্রীনাথ অবাক হয়ে বলে, কেন?

ও একটা ভাল জমির খোঁজ পেয়েছে। এক লপ্তে পাঁচ বিঘা।

জমির খোঁজ পেয়েছে। কিন্তু শ্রীনাথ বুঝতে পারে না তাতে তার কী।

তৃষা কোমল গলায় বলে, তুমিই তো ওকে জমির কথা বলেছিলে। বলোনি?

শ্রীনাথের মনে পড়ল। মাথা নাড়ল, যা বলেছিলাম। সে কতকাল আগে।

কতকাল আবার কী! বছরখানেক হবে।

তবু অনেক দিন। এখন জমি দিয়ে আমি কী করব?

তোমাকে কিছু করতে হবে না। তোক রেখে চাষ করাতে চাইলে করাবে।

বিষণ্ণ শ্রীনাথ মাথা নেড়ে বলে, তা তো আমি চাইনি। আমি ভেবেছিলাম নিজে চাষ করব, সঙ্গে লোকও খাটাব। ভেষজের চাষ তো সোজা নয়। ইচ্ছে ছিল জমির পাশে একটা কাচা ঘর তুলে থাকব।

তৃষা মৃদু স্বরে বলে, যদি তাই চাও তবে এখনও তো হতে পারে।

শ্রীনাথ মাথা নেড়েই যাচ্ছিল। বলল, আর কিছু করার নেই। আমার শরীর বিষে ভরে গেছে। আর বেশি দিন

তৃষা রাগল না। হতাশার একটা শ্বাস ফেলে বলল, আমি শুনেছি, তোমাকে স্লো পয়জন করা হচ্ছে বলে তুমি সন্দেহ করো।

আতঙ্কে প্রায় সাদা হয়ে শ্রীনাথ তুষার দিকে তাকায়। কিন্তু চোখে চোখ রাখতে পারে না। বেশিক্ষণ। আবার মাথা নেড়ে বলে, ঠিক তা নয়। সন্দেহ করার কিছু নেই। তবে কোনও কারণে আমার মধ্যে বিষ ঢুকেছে।

কে তোমাকে বিয দিতে পারে বলো তো! আমি?

শ্রীনাথ মনের দিক থেকে এতটাই দুর্বল যে এত স্পষ্ট কথা সহ্য করতে পারল না। বলল, ওই যে দেশি মদ খেতাম, হয়তো তাই থেকেই..

বলে তাকিয়ে বুঝবার চেষ্টা করল তৃষা কথাটা বিশ্বাস করেছে কি না।

তৃষা মৃদু স্বরেই বলল, তোমার মনের কথা তো জানি না। তবে যদি সন্দেহই থেকে থাকে তবে সেই সন্দেহ নিয়ে তোমাকে এখানে থাকতেও বলি না। বদ্রী যে জমিটার খোঁজ আনবে সেটা কেনো। একটা ছোট বাড়ি তৈরি করে থাকো সেখানেই। কেউ বাধা দেবে না।

এ কথাটাও ভয়ংকর। এক বছর আগে এই প্রস্তাব মাথায় তুলে নিত সে। তৃষার বন্দিত্ব থেকে মুক্তি–সে এক অদ্ভুত সুখচিন্তা ছিল তখন। আজ সে কথা ভাবতেও ভয় করে। একা পাঁচ বিঘা। জমি কোলে করে বসে থাকা। সে যাও বা দু’দিন বাঁচত তাও বাঁচবে না তা হলে। এরা বিষ দেয় বটে কিন্তু তবু ঘিরেও থাকে তাকে। একা থাকার কথা সে এখন ভাবতেও পারে না। একা হলেই সমস্ত পৃথিবীর ভার বুকে চেপে বসবে।

শ্রীনাথ মাথা নেড়ে বলে, না না। থাকগে। এখন ওসব ভাবতে পারছি না। বদ্রীকে বারণ করে দিয়ো।

শ্রীনাথের শ্রীহীন বসে যাওয়া শরীরের দিকে চেয়ে সামলে গেল তৃষা, না হলে তার বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, বিষ তোমাকে কেউ দিচ্ছে না, বিষ তোমার মনের মধ্যে তৈরি হচ্ছে।

মুখে তৃষা বলল, যা ভাল বুঝবে করবে। আমি তোমার যাতে ভাল হয় তাই চাই।

তৃষার চাদরটায় রোদ পড়েছে। ভয়ংকর সেই শুকনো রক্তের রংটা চোখে বড় লাগে শ্রীনাথের। ভিতরটা চমকে ওঠে বার বার। সে প্রায় অস্ফুট গলায় হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, সেই তারা ধরা পড়েছে?

কারা?

ওই যারা তোমাকে বোমা মেরেছিল!

এ কথায় তৃষার চোখ দুটো ঝলসে ওঠে হঠাৎ। কিন্তু মুখে অন্য কোনও ভাবান্তর দেখা গেল না। স্বাভাবিক গলায় বলল, এখনও ধরা পড়েনি। তারা ফেরার।

কারা জানো?

জানি।

বড় দমে গেল শ্রীনাথ। ধরা পড়েনি অথচ তৃষা তাদের জানে। এর একটাই পরিণতি দাঁড়াতে পারে। পুলিশ ধরার আগেই তৃষার লোকেরা তাদের ধরবে। আবার চাদরের রংটার দিকে তাকায় শ্রীনাথ। যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক অভিনয় করার চেষ্টা করতে করতে শ্রীনাথ যা বলতে চায় না, তাই বলে গেল, ছি ছি কী কাণ্ড! বাড়িতে ঢুকে অবলা মেয়েমানুষকে বোমা মারা! বেত মারা উচিত। ধরে চাবকানো দরকার।

বলতে বলতে চোখ বুজে থাকে শ্রীনাথ।

তৃষা বলে, ও নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। পুলিশ আছে, আইন আছে।

মাথা নেড়ে শ্রীনাথ মনে মনে বলে, তুমিও আছ।

তৃষা নিজের কথার খেই ধরে রেখে বলে, এখন বরং অন্য একটা জরুরি কথা বলে নিই। চিত্রাব জন্য একটি ভাল পাত্র পাওয়া গেছে। এলাহাবাদেরই ছেলে। দিদি আমাদের মত চেয়ে চিঠি দিয়েছে।

কার পাত্র?

চিত্রার–আবার কার?

চিত্রার বিয়ে! চিত্রা! তার বিয়ে দেবে এখনই? বলো কী?

চিত্রার বয়স কত হল খেয়াল আছে?

শ্রীনাথ বেকুবের মতো বলে, কত হবে? তেরো! চৌদ্দ।

তোমার মাথা। আঠারো চলছে।

শ্রীনাথ তবু ব্যাপারটা বুঝতে পারে না, তা হলেও বিয়ের বয়স নয়।

আমার বিয়ে হয়েছিল আরও কম বয়সে। ষোলো ভাল করে পেরোয়নি তখনও। মনে আছে?

শ্রীনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার চোখ বোজে।

তৃষা বলে, তবু মানি বিয়ে আরও কদিন পরে দেওয়া যায়। কিন্তু মেয়ের বড় বাড়ন্ত গড়ন। পাত্রটিও ভীষণ ভাল। সুযোগটা ছাড়া উচিত হবে না।

তা বটে।

তোমার মত কী?

আমার মত!–শ্রীনাথ অবাক হয়ে বলে, আমার মত কী আবার! চিত্রাকে তো মনেই পড়ে না, সে যে আমার মেয়ে তাই তো ভুলে গেছি।

তবু তো মেয়ে।

তা ঠিক। শ্রীনাথ চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ বলে, বিয়ের আগে ওকে একবার আনাবে? দেখব! ওকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।

তৃষা একটু অবাক হল। কিন্তু সহৃদয় গলায় বলল, দেখবে? তা হলে যাও না, এলাহাবাদ থেকে কদিন ঘুরে এসো। ওরা খুশি হবে।

এ কথায় দপ করে নিভে গেল শ্রীনাথ। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, না না। আমি কোথায় যাব? আমি পারব না অত দূরে যেতে।

কেন?

আমার ইচ্ছে করে না। ভয় করে। অনেক দূর।

তৃষা দাঁতে ঠোঁট চাপল। শ্রীনাথের ভাঙচুর দূর থেকে সে ভাল করে বোঝেনি। এখন যা দেখল, তা ভয়ংকর। এতটা সে কখনও ভাবেনি।

শ্রীনাথ চোখ বুজে আপন মনে নিঃশব্দে ডাইনে বাঁয়ে মাথা নাড়ছিল।

তৃষা সিঁড়ি দিয়ে বারান্দা থেকে নেমে গেল। চলে যেতে যেতে একবার মুখ ফিরিয়ে আস্তে করে বলল, আসছি।

শ্রীনাথ সেকথা শুনতে পেল না, জবাবও দিল না।

 

তুমি কেন জোরে হাঁটছ না?

আমি অত জোরে পারি না।

পারো। নিশ্চয়ই পারো। ইচ্ছে করে হাঁটছ না।

না। মাথা নাড়ে শ্রীনাথ, পারি না। আমার হাঁফ ধরে যায়।

তুমি কিন্তু বুড়ো হওনি। তোমার অসুখও সেরে গেছে।

একটা দীর্ঘশ্বাস আপনা থেকেই ঝরে গেল শ্রীনাথের।

সজল বাবার মুখের দিকে তাকাল। আজকাল বাবার মুখের দিকে তাকাতে তাকে বেশি মাথা উঁচু করতে হয় না। তার মাথা শ্রীনাথের কান ছুঁয়েছে। ক’দিনের মধ্যেই মাথায় মাথায় সমান হয়ে যাবে। তারপর শ্রীনাথকে ছাড়িয়ে উঠবে সে।

সজল বলল, রোজ যদি আসন করো তবে সব সেরে যাবে।

যোগাসন?

যোগাসন। বড়কাকা অনেক আসন জানে।

তুইও কি আসন করিস?

করি। আরও কত কী করি। ফ্রি হ্যান্ড, বক্সিং, কুংফু…।

গুন্ডা হবি নাকি?

না, গুন্ডাদের ধরে ধরে ঠ্যাঙাব।

আজকাল গুন্ডাদেরই সম্মান। সবাই তাদের খাতির করে।

সজল এ কথায় হাসল।

মাঠের ধারে রোজই এক গাছতলায় শ্রীনাথকে বসিয়ে রেখে সজল ক্রিকেট খেলে। শ্রীনাথ নড়ে চড়ে না। চুপটি করে বসে আকাশপাতাল ভাবে। খেলা শেষ হলে সজল বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফেরে।

তুমি আবার কবে থেকে অফিসে যাবে, বাবা?

রোজই ভাবি, কাল যাব। আর যাওয়া হয় না। শরীরটা ভাল নেই।

তোমার চাকরি যদি নট হয়ে যায়?

তা যাবে না। ওরা আমাকে খুব ভালবাসে।

প্রকাণ্ড মাঠের মধ্যে নেমে গেল সজল। একটা অশ্বত্থ গাছের তলায় ঘাসের ওপর বসে থাকল শ্রীনাথ। দুর্বল, নির্জীব। তার ব্লাড সুগার ধরা পড়েছে। কিডনি ভাল না। লিভার ভাল না। কিন্তু সেসব তার এই নির্জীবতার কারণ নয়, শ্রীনাথ জানে। তাকে শেষ করে দিচ্ছে বিষ। আস্তে আস্তে শরীর ভরে যাচ্ছে বিষে। রেহাই নেই, পরিত্রাণ নেই।

ফেরার পথে সে বলল, শোন, আজকাল আমাকে কেউ কোনও খবর দেয় না। তুই একটা খবর কিন্তু আমাকে দিস।

কী খবর বাবা?

সেই যারা তোর মাকে বোমা মেরেছিল তারা যদি ধরা পড়ে তা হলে আমাকে জানাস।

সজল অবাক হয়ে বলল, তাদের তো ফাঁসি হয়ে গেছে।

যাঃ!–বলে ধমক দেয় শ্রীনাথ।

সজল হাসে, ধরা পড়লেই ফাঁসি হবে। আর ধরা তো পড়বেই।

সবাই কি ধরা পড়ে?

একজনকে কালিন্দীপুরে দেখেছে সখারামদা।

তারপর?

তাকে ফলো করা হচ্ছে কাল থেকে। আজকালের মধ্যেই অ্যারেস্ট হয়ে যাবে।

তুই জানলি কী করে?

মায়ের কাছে সব খবর আসে। তুমি মারদাঙ্গাকে ভয় পাও, বাবা?

শ্রীনাথ মাথা নেড়ে বলে, মারপিটকে ঠিক ভয় পাই না। ভয় পাই তোদের। পৃথিবীতে আমার কোনও আপনজন নেই, এ কথা ভেবে মরতে বড় কষ্ট হবে।

আমরা আপন নই তোমার?

তোদের সঙ্গে যে আমার মেলে না। আমি খারাপ, তোরাও খারাপ। দু’পক্ষ দু’রকমের খারাপ। মেলে না যে! কী করে আপন হবি?

বাবা, একটা কথা বলবে?

কী বল তো!

তুমি আমার বাবা নও?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *