ছাপ্পান্ন
অর্ক একটুও নড়ল না, অনিমেষই দূরত্বটা অতিক্রম করল।
মুখোমুখি হতে অনিমেষকে খুব নার্ভাস দেখাচ্ছিল। তার কাঁধে একটা ঝোলা, পোশাক মলিন এবং চেহারায় শ্রান্তির ছাপ স্পষ্ট। বোধ হয় কি কথা দিয়ে শুরু করবে ঠাহর করতে না পেরেই অনিমেষ বলল, ‘যাক, তোকে পেয়ে বাঁচলাম। তোর মা কেমন আছে?’
হঠাৎ অর্ক আবিষ্কার করল তার এরকম উত্তেজিত হওয়ার কোন কারণ নেই। অযথা রূঢ় কথা বলে কি লাভ! এই মানুষটিকে দেখা মাত্র তার শরীরে উত্তেজনা উথলে উঠেছে। মনে হয়েছে, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা ওই মানুষটিকে মৃত্যুর দরজায় নিয়ে গেছে এই লোকটি। এরই জন্যে আজ মায়ের ওই দশা। কিন্তু যেই অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, তোর মা কেমন আছে অমনি অর্ক নাড়া খেল। মায়ের এই অবস্থার জন্যে সে নিজেও তো সমানভাবে দায়ী। মাকে সে চিন্তিত করেছে, তার জন্যে এত বছর মা কম পরিশ্রম করেনি।
অনিমেষ ছেলেকে নিরুত্তর দেখে বোধ হয় আরও অস্বস্তিতে পড়েছিল। অসহায় গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কি রে কথা বলছিস না কেন?’
অর্ক মুখ নামালো, ‘আছে।’ তারপর সরাসরি জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি এখানে কেন এলে?’
‘কি বলছিস তুই? আমি আসব না? তোর মা হসপিটালে আর সেই খবর পেয়ে আমি সেখানে চুপ করে বসে থাকব?’
‘এসে কি করবে? বরং তোমাকে নিয়েই তো নানান অসুবিধে।’
অনিমেষ ছেলের দিকে তাকাল। তারপর আবেদনের গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘তুই এমনভাবে কথা বলছিস কেন?’
অর্ক নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। তারপর পেছন দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওখানে পরমহংস কাকুরা আছেন। ওঁদের সঙ্গে কথা বল। আমি যাচ্ছি।’
‘তুই কোথায় যাচ্ছিস?’
‘কেন?’
‘আমি শ্যামবাজারের মোড়ে শুনলাম ঈশ্বরপুকুরে খুব গোলমাল হচ্ছে।’
‘কে বলল?’
‘উনুনের কারখানার মালিক। তার কাছেই শুনলাম ও এই হাসপাতালে আছে। গোলমাল হচ্ছে যখন তখন পাড়ায় এখন যাস না।’
অর্ক বুঝতে পারছিল না আবার কিসের গোলমাল হতে পারে ঈশ্বরপুকরে! কয়লার লোকজন নিশ্চয়ই হামলা করতে সাহস পাবে না। ব্যাপারটা কি দেখবার জন্য তো এখনই যেতে হয়।
সে মুখ ফিরিয়ে পরমহংস কিংবা সৌদামিনীকে বারান্দায় দেখতে পেল না। অথচ একটু আগে ওঁরা ওখানেই ছিলেন। অনেকটা ইচ্ছের বিরুদ্ধেই সে অনিমেষের পাশে হাঁটতে লাগল। ক্রাচে ভর রাখার দরুন কিংবা অন্য কারণেই হোক অর্ক অনিমেষের মাথার মাঝখানটা দেখতে পেল। পরিষ্কার হয়ে এসেছে চুল। চকচকে সাদা চামড়া দেখা যাচ্ছে। তার মানে সে লম্বা হয়ে গেছে কিংবা বাবা বেঁটে হয়েছে। মোট কথা, সে ওই মানুষটিকে ছাড়িয়ে গেছে। এরকমটা ভাবতে পারায় মন প্রফুল্ল হল অর্কর।
অনিমেষ আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘ওর কি হয়েছে?’
‘অপারেশন। পেটে ঘা হয়েছিল। এখনও জ্ঞান ফেরেনি।’
‘কিরকম ঘা?’
‘তুমি কি খুব খারাপ কিছু ভেবেছ?’
‘অর্ক।’ চেঁচিয়ে উঠল অনিমেষ, ‘তুই কি ভেবেছিস?’
‘কিছুই না। তোমার সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছে না। ওই যে পরমহংস কাকু আসছে। তোমরা কথা বল।’
‘তুই কোথায় যাচ্ছিস?’
‘কাজ আছে।’
‘কি কাজ?’
‘সব কি তোমাকে বলতে হবে?’
‘তুই কিরকম পাল্টে গিয়েছিস!’
পরমহংস অনিমেষকে দেখতে পেয়ে ছুটে এল, ‘কখন এসেছ?’
‘এইমাত্র। ও কেমন আছে?’
‘কাল সকালের আগে বলা যাবে না। তবে আমরা যা ভয় পেয়েছিলাম তা নয়। মনে হচ্ছে বিপদ কাটিয়ে উঠবে।’
‘কি ভয় পেয়েছিলে?’
‘ক্যান্সার। কিন্তু তা নয়। বিরাট বোঝা নেমে গেল। তুমি এখন কোত্থেকে এলে? এ সময় কি ট্রেন আছে?’
‘আট ঘণ্টা লেট করল। আন্দোলনের জন্যে।’
‘চল। কোথাও গিয়ে বসি। একা একা আসতে অসুবিধে হয়েছে?’ অর্কর এসব কথা ভাল লাগছিল না। সে পরমহংসকে বলল, ‘আপনারা কথা বলুন, আমি চলি।’
‘কোথায় যাচ্ছ?’ পরমহংস জিজ্ঞাসা করল।
‘পাড়ায়। ওখানে যখন গোলমাল হচ্ছে তখন বেশী রাত হলে না যাওয়াই ভাল।’ শেষ কথাটা যে অনিমেষের উদ্দেশ্যে তা বুঝতে অসুবিধে হল না। পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার উণ্ড কেমন আছে?’
‘ভাল।’
‘আজ ডাক্তারকে দেখিয়েছ?’
‘না।’
‘কি আশ্চর্য। এটাকে নেগলেক্ট করো না।’
অনিমেষ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, ‘কিসের উণ্ড?’
‘অর্ককে সমাজবিরোধীরা ছুরি মেরেছিল।’
‘সে কি। কেন?’
অর্ক হাসল, ‘ওরা কেন ছুরি মারে তা জানো না?’
অনিমেষ তিক্ত গলায় বলল, ‘তুই একটুও পাল্টালি না। এখনও সেই গুণ্ডামি করে যাচ্ছিস!’
অর্কর মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছিল। অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করল সে। তারপর মুখ বেঁকিয়ে বলল, ‘যে সব সমাজবিরোধী সামনাসামনি ছুরি মারে তাদের ফেস করা যায়, কিন্তু যাদের ছুরি দেখা যায় না তারা আরও মারাত্মক।’
অর্ক আর দাঁড়াল না। সে উত্তপ্ত হয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এল। অনিমেষকে সে কিছুতেই সহ্য করতে পারছিল না। এই মানুষটাকে তার মা এমন ভালবাসে যে অবচেতনায় নাম ধরে ডেকে যাচ্ছে। হিংসেয় জ্বলছিল অর্ক।
সন্ধ্যে পার হয়ে গেলেই কাঁধে এক ধরনের টনটনানি শুরু হয়েছিল। ঠিক যে জায়গায় ছুরিটা বিঁধেছিল সেখানটায় যেন চিড়চিড় করছে মাঝে মাঝে। অর্কর ইচ্ছে করছিল একবার জামা খুলে ব্যাণ্ডেজ সরিয়ে ক্ষতটা কাউকে দেখায়। কিন্তু একটা অন্য ধরনের জেদে সে ইচ্ছেটাকে চেপে রাখছিল। তাছাড়া রাত এগারটা পর্যন্ত আজ নিঃশ্বাস ফেলার সময় ছিল না। একটার পর একটা কাজ এবং তার উত্তেজনা শরীরের কষ্ট ভুলিয়ে রাখার পক্ষে যথেষ্ট ছিল।
হরেন ড্রাইভারের ছেলেকে কয়লার লোক শ্যামবাজারে খুন করার চেষ্টা করেছে এই খবর পাড়ায় আসা মাত্র মানুষ পাগল হয়ে গিয়েছিল। শান্তি কমিটি কোন ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই উত্তেজিত মানুষেরা ছুটে গিয়েছিল কয়লার বাড়িতে। গ্রেপ্তার হওয়ার পর কয়লার আত্মীয়রা বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সেই বাড়িটাকে আগুনে ঠেসে দিয়েও যেন শান্তি হয়নি মানুষের। তাদের শান্ত করতে প্রচুর পরিশ্রম হয়েছে শান্তি কমিটির। তারপর শুরু হয়েছে পুলিসের সঙ্গে ঘনঘন আলোচনা। স্বয়ং পুলিস কমিশনার এসেছিলেন পাড়ায়। তিনি আবেদন করেছেন আইন নিজের হাতে না নিতে। শান্তি কমিটি ঘুরে ঘুরে তাঁকে কয়লার অত্যাচারের নিদর্শন দেখিয়েছে। যে পুলিস অফিসার কয়লার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ দিয়েছে কমিশনারের কাছে। পুলিস কমিশনার আশ্বাস দিয়েছেন যে সমস্ত সমাজবিরোধী এখনও আশেপাশের পাড়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের গ্রেপ্তার করবেন।
আগামীকাল একটা শান্তি মিছিল বের হবে। এলাকার নির্বাচিত এম এল এ এবং বিরোধীদলের নেতা সেই মিছিলে থাকবেন। এই প্রথম একটি এলাকার মানুষ অরাজনৈতিকভাবে সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়েছে, তাদের মনোবল বাড়াবার জন্যে পশ্চিমবাংলার সাহিত্যিক অভিনেতা এবং বুদ্ধিজীবীদের কাছে আবেদন জানানো হবে। সমাজবিরোধীদের তালিকা শান্তি কমিটির পক্ষ থেকে পুলিশ কমিশনারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। কোয়া এবং বিলুর নাম সেই তালিকায় রয়েছে।
দেখা গেল, একটা এলাকার মানুষকে সংগঠিত করতে প্রচুর কাজ করতে হয়। যাঁরা রাজনীতি করেন তাঁদের এক ধরনের নেশা থাকে। বর্তমান কিংবা ভবিষ্যতের দিকে না তাকিয়ে তাঁরা দলের জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু যাঁরা রাজনীতি করেন না, সুবিধেবাদী মধ্যবিত্তের সাইনবোর্ড যাঁদের কপালে টাঙানো তাঁরা সাধারণত সময় নষ্ট করতে রাজি হন না, বিশেষ করে যেখানে ব্যক্তিগত কোন লাভ নেই। কিন্তু এই ধারণার ব্যতিক্রম দেখা গেল এবার। সাধারণ মানুষ এমনকি বাড়ির মেয়েরা পর্যন্ত রাস্তায় নেমে এসেছেন সমাজবিরোধীদের রুখে দাঁড়াতে। তাঁদের অনেকেই এখন অফিসে যাচ্ছেন না ঝুঁকি থাকায় কিন্তু এলাকার ভেতরে যা কাজ করতে বলা হচ্ছে তা তাঁরা করছেন। এই মুহূর্তে কংগ্রেস কিংবা সি পি এম দলের কোন সক্রিয় অবস্থান নেই। রাত বারোটায় সুবলকে অর্ক বলল, ‘আমার শরীর খুব খারাপ লাগছে। আমাকে আপনারা যে পদ দিয়েছেন তা থেকে বাদ দিন।’
সুবল চোখ ছোট করল, ‘সে কি! কেন?’
‘আমি তো কিছুই করতে পারছি না। এইভাবে একটা পদ আঁকড়ে বসে না থেকে অন্য কাউকে দিলে সে আরও বেশী উৎসাহিত হবে।’
‘করার দিন তো শেষ হয়ে যায়নি। তাছাড়া তুমি পদত্যাগ করেছ জানলে অনেকে ভাববে আমরা বিভক্ত হচ্ছি। ঠিক আছে, সবাইকে বলে দেখি।’
রাত এখন সাড়ে বারোটা। অর্কর শরীরে প্রবল শীতভাব এল। শান্তি কমিটির অফিস থেকে তিন নম্বরে ফিরতে ওর খুব কষ্ট হচ্ছিল। এখন চারপাশে কোন শব্দ নেই। রকে কিংবা রাস্তায় কোন জটলা হচ্ছে না। এমন কি লাইট পোস্টের তলায় তাসের আড্ডাও জমেনি।
গলিতে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল অর্ক। অন্ধকার জমাট হয়ে রয়েছে যেখানে সেখানে মোক্ষবুড়ি বসতো। ওই রকম চুপচাপ অন্ধকারের মতন। অর্ক মাতালের মত হেঁটে এল অনুপমার ঘরের সামনে দিয়ে। তারপর পকেট থেকে চাবি বের করতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। দরজার গোড়ায় কেউ বসে আছে, অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ‘কে?’
‘আমি। এত দেরি হল তোর?’
অর্ক চমকে উঠল। অনিমেষ এতক্ষণ বন্ধ তালার নিচে অপেক্ষা করছিল। ছেলেকে দেখে এবার ক্রাচ দুটো হাতড়ে ওঠার চেষ্টা করল।
‘তুমি এখানে বসে আছ?’
‘দরজায় তালা থাকলে ঢুকব কি করে?’
চটপট তালা খুলল অর্ক। তারপর আলো জ্বেলে নিজে খাটের ওপর বসে পড়ল। বসে খুব আরাম লাগল তার। কিন্তু একটা অপরাধবোধ যে তাকে গ্রাস করছে তা টের পেয়ে সে মরিয়া হয়ে নিজেকে পরিষ্কার করতে চাইছিল। সে ভেবেছিল পরমহংসকাকুর সঙ্গেই অনিমেষ চলে যাবে। মাধবীলতা এখানে নেই এবং তার সঙ্গে যখন আর সম্পর্ক নেই তখন ঈশ্বরপুকুরে অনিমেষ আসতে যাবেই বা কেন? হাসপাতালে অর্ক এমনটা ভেবেছিল। তারপর এতক্ষণ শান্তি কমিটির কাজে ব্যস্ত থাকায় এইসব ভাবনা তার মাথা থেকে একদম উধাও হয়ে গিয়েছিল। অর্ক আবিষ্কার করল, অনিমেষ তো দূরের কথা, মাধবীলতার কথাও সব সময় তার মনে ছিল না। অর্ক নিজেকে বোঝালো, অনিমেষের অপেক্ষা করার জন্যে সে দায়ী নয়।
অনিমেষ ঘরে ঢুকলে সে বলল, ‘তুমি আসবে বললেই পারতে।’
‘আর কোথায় যাব?’
‘ভেবেছিলাম পরমহংসকাকুর কাছে যাবে।’
‘কেন?’
অর্ক অনিমেষের দিকে তাকাল কিন্তু কথাটাকে গিলে ফেলল। অনিমেষ এ ব্যাপারে আর কথা বলতে চাইল না। ছেলে যে তাকে পছন্দ করছে না সেটা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। সে ঘরটার দিকে তাকাল। চারধার ছন্নছাড়া, মেঝেয় সিগারেটের টুকরো পড়ে আছে। তার মানে অর্ক এখন ঘরে বসে সিগারেট খাচ্ছে। সে চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ‘ঘরের ভেতর সিগারেট ফেলেছিস কেন?’
অর্ক ঘাড় ঘুরিয়ে ওটাকে দেখতে পেল। তার মনে পড়ল কোয়া দুপুরে ওখানে বসে সিগারেট খাচ্ছিল। সে মাথা নেড়ে বলল, ‘আমি ফেলিনি। কোয়ারা এসেছিল।’
‘কোয়া? ওঃ, সেইসব রক্তবীজের দল!’
‘রক্তবীজ মানে?’
‘যাদের কোন পিছুটান নেই, দয়া মায়া ভালবাসা নেই। ইভিল স্পিরিট।’
‘এদের তো তোমরাই জন্ম দিয়েছ।’
‘আমরা?’ অনিমেষের বিরক্তি উড়ে গিয়ে বিস্ময় এল।
‘নিশ্চয়ই। ওরা আকাশ থেকে পড়েনি। তোমরা বোম নিয়ে পাড়ায় হামলা করতে, পুলিস মারতে। এরা সেইসব দেখেছে, দেখে শিখেছে।’
‘ইডিয়ট। তুই কিসের সঙ্গে কার তুলনা করছিস? আমাদের একটা আদর্শ ছিল। আমরা ভারতবর্ষে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিলাম। নকশালপন্থী ছেলেদের সঙ্গে বখাটে গুণ্ডাদের তুলনা করছিস?’
‘তোমাদের তো সবাই গুণ্ডা বলেই ভাবত। সাধারণ মানুষের কি উপকার করেছ তোমরা? আমি অত বড় বড় বিদ্যে জানি না। মাও সে তুং কার্ল মার্কসের দোহাই দিয়ে তোমরা যা করেছ তাতে দেশের কোন উপকার হয়নি।’
‘হয়তো। কিন্তু আমরা চেষ্টা করেছিলাম। তোদের মত গুণ্ডাবাজি করে সময় কাটাইনি। আমরা মানুষের ভাল চেয়েছিলাম।’
‘তাই নাকি? তাহলে তোমাদের কথা উঠলেই সাধারণ মানুষ এখনও আঁতকে ওঠে কেন? কেন বলে বিভীষিকার দিন? আজকে আমাদের এলাকায় সমস্ত সাধারণ মানুষ একজোট হয়ে সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, তোমরা তো এটুকুও করতে পারোনি।’
‘হ্যাঁ, আমি শুনলাম। এটা একটা সাময়িক উত্তেজনা।’
‘হয়তো। কিন্তু তা থেকে অনেক সময় বড় কাজ হয়।’
অনিমেষ যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। সেই অর্ক, এই সামান্য বয়সে তার সঙ্গে সমানে তর্ক করে যাচ্ছে বড়দের ভঙ্গীতে। সে ছেলের মুখের দিকে তাকাল ভাল করে। ওর দিকে তাকালে অবশ্য কেউ কুড়ির নিচে বলে ভাববে না। মুখে চোখে একটা পোড়খাওয়া ভাব এসেছে। ওই বয়সে সে যখন কলকাতায় এসেছিল পড়তে তখন অনেক সরলতা জড়ানো ছিল, মুখ দেখে বন্ধুরা বলত, অবোধ বালক! অনিমেষের মনে হল অর্ককে ছোট করে না দেখে খোলাখুলি আলোচনা করা বুদ্ধিমানের কাজ। ও কতটা বোঝে সে জানে না, খামোকা ছেলেমানুষ ভেবে এড়িয়ে যাওয়ার কোন মানে হয় না।
অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘এপাড়ার গুণ্ডারা শান্তি কমিটিতে নেই?’
‘গুণ্ডা বলতে তুমি কাদের বোঝাচ্ছ?’
‘লোকে যাদের গুণ্ডা ভাবে।’
‘লোকে তো তোমাদেরও গুণ্ডা ভাবত।’
‘অর্ক!’ অনিমেষ উত্তেজিত হল, ‘বারবার অনধিকার চর্চা করবি না।’
অর্কর ঠোঁটে হাসি খেলে গেল, ‘তাহলে এই ঘরে ফিরে এলে কেন?’
‘মানে?’ অনিমেষ হতভম্ভ। ‘আমি তোর বাবা—।’
‘সে কথা মা আমাকে না জানালে আমি জানতাম না। তুমি প্রমাণ করতে পার যে তুমি আমার বাবা?’
অনিমেষ ক্রাচদুটো আঁকড়ে ধরল, ‘তুই কি বলছিস!’
‘ঠিকই বলছি। তুমি প্রমাণ করতে পার?’
‘কেউ করতে পারে?’
‘পারে। তার চারপাশের মানুষ আত্মীয়স্বজন এবং আরো অনেক কিছু প্রমাণ দেয় যে কে বাবা! আমার মায়ের সন্তান হয়েছিল কিন্তু তিনি বলেছেন বলেই জেনেছি তুমি আমার বাবা। তোমার কোন জোর নেই। একটু আগে অধিকারের কথা বললে না? তোমার কাছ থেকে আমি কিছুই পাইনি, তুমি আমাকে কিছুই দাওনি। অধিকার কি করে পাবে?’ কথাগুলো বলার সময় অর্ক তার কাঁধে হাত রেখেছিল। প্রচণ্ড টনটন করছে। শরীর গরম হয়ে উঠেছে কিন্তু জ্বরটা ফিরে আসেনি।
‘তোর মা কি কিছু বলেছে?’
‘তুমি নিজেকে আরও ছোট করছ এই প্রশ্ন করে। মা হাসপাতালে ঘোরের মধ্যে তোমার নাম ধরে ডাকছে আর তুমি—।’ অর্ক ঠোঁট কামড়ালো।
‘মা হাসপাতালে ওই রকম অবস্থায় পড়ে রয়েছে। তুই আমাকে খবর দিসনি কেন?’
‘প্রথমত মা নিষেধ করেছিল আর আমারও ইচ্ছে হয়নি।’
‘কেন?’
‘তোমার জন্যেই মায়ের এই অবস্থা তাই। মাকেও তুমি কিছুই দাওনি। তোমার জন্যে মা একটু একটু করে নিজেকে শেষ করে ফেলেছে। সেই তোমাকে আমি মায়ের অসুস্থতার খবর দিতে যাব কেন?’
‘তুই নিজে কি করছিস? সে অসুস্থ হয়ে পড়ে রইল আর তুই পাড়ায় সমাজবিরোধী তাড়াচ্ছিস, তাদের ছুরি খাচ্ছিস?’
‘ঠিক করছি। আমি যদি একটা ভাল কাজ করি তাহলে মা খুশি হবে, মায়ের আয়ু বাড়বে তাতে।’ অর্ক চোখ বন্ধ করল।
অনিমেষ মাথার চুলে আঙ্গুল চালালো। তারপর ক্লান্ত গলায় বলল, ‘আমি স্বীকার করছি তোকে কিছু দিতে পারিনি। সেটা আমার অক্ষমতা। কিন্তু আমরা বিবাহিত। তুই আমাদের সন্তান।’
অর্ক চমকে মুখ তুলে তাকাল।
‘কথাটা শোন। আমরা পরস্পরকে ভালবেসেছিলাম। তোর মা সেই ভালবাসার জন্যে তার সব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করেছিল। আমার জগতে সে ছাড়া আর কারও অস্তিত্ব ছিল না। পৃথিবীতে এর চেয়ে বড় আর কোন আইন নেই। যেসব স্বামী স্ত্রী সই অথবা আগুন সাক্ষী রেখে বিয়ে করে তাদের দিকে তাকিয়ে দ্যাখ, নব্বুইজনই পরস্পরের সঙ্গে বাধ্য হয়ে বাস করে। ভালবাসা তো দূরের কথা ঘৃণা আর অশান্তি নিয়ে দিন কাটায়। তাদের সন্তান প্রয়োজনে আসে। সেই সন্তানদের পিতৃপরিচয় কি? কি পাচ্ছে তারা বাপমায়ের কাছে। তুই বল, কোন বিয়েটা বেশী জরুরী?’ কাঙালের মত তাকাল অনিমেষ।
‘তাহলে তুমি মাকে অপমান করলে কেন জলপাইগুড়িতে?’
‘আমি অপমান করতে চাইনি। এত সামান্য কারণে ওর অভিমান আহত হবে আমি ভাবিনি। আমি যদি তাই চাইতাম তাহলে এই শরীরে একা ছুটে আসতাম না। সে যদি আমায় অস্বীকার করত তাহলে আমার নাম ধরে ডাকত না। আমার মনে যেটুকু দ্বন্দ্ব ছিল হাসপাতালে এসে তা মুছে গেছে। আমি সব কথা তোকে খুলে বললাম, এবার তোর যা বিবেচনা করবি।’
অর্ক অনিমেষের দিকে তাকাল। ওর শরীরে কাঁটা দিচ্ছিল। ব্যথাটা পাক দিয়ে উঠছে। ওর মুখের চেহারা দেখে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হয়েছে তোর?’
‘কিছু না। আমি একটু শোব।’ কথাটা বলতে বলতে অর্ক উপুড় হয়ে পড়ল খাটে। আর তখনই অনিমেষ দেখল ওর পিঠে কালচে ছোপ। ক্রাচ নিয়ে সে কোন রকমে উঠে এল খাটে। তারপর নিঃশব্দে অর্কর জামা খুলে নিল সজোরে। ব্যাণ্ডেজটা চোখে পড়তেই চমকে উঠল। কালচে রক্তে ভিজে গেছে সেটা। অর্ককে জোর করে বসাল সে। তারপর ধীরে ধীরে ব্যাণ্ডেজটা খুলে নিতেই দেখল ক্ষতের মুখে পুঁজরক্ত জমেছে।
অনিমেষ ব্যাণ্ডেজের শুকনো অংশ দিয়ে সন্তর্পণে চাপ দিতে আরও কিছুটা পুঁজরক্ত বেরিয়ে এল। সেটাকে মুছিয়ে দিয়ে সে আবার অর্ককে শুইয়ে দিল, ‘এবার তুই শুয়ে থাক। আমি ডাক্তারকে ডেকে আনছি।’
অর্কর মনে হচ্ছিল তার পিঠের ব্যথাটা অনেক কমে এসেছে। বেশ আরাম লাগছে এখন।