2 of 2

৫৫. সোহাগবালার মতন থাকোমণি

ঠিক সোহাগবালার মতন থাকোমণির শরীরেও মেদ জমতে শুরু করেছে। এটা বুঝি এই ছোট জলচৌকিখানিরই গুণ। নিচের তলার এই দরদালানের জলচৌকিতে যে বসবে ভৃত্য মহলের কর্ত্রীত্ব যেমন তার হাতে আসবে তেমনি তার চেহারাতেও পুষ্টি লাগবে। কয়েক বছর আগেও থাকোমণির দেহ ছিল যেন পাথরে কোঁদা, সাধারণ রমণীদের তুলনায় একটু বেশী লম্বা বলে তার মেদবিহীন শরীরটি ছিল রীতিমতন আকর্ষণীয়। এখন তার চিবুকে দুটি ভাঁজ পড়েছে, হাত-পা গোল গোল হয়ে এসেছে এবং আঙুলের ডগাগুলো যেন সব সময় টসটস করে।

মাঝখানে দু মাস থাকোমণি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ায় এই জলচৌকিটি প্রায় বেদখল হবার উপক্রম হয়েছিল। মানদা দাসী এখানে বসেছিল জাঁকিয়ে। মানদা এবং অন্যান্যদের ধারণা হয়েছিল যে থাকোমণি আর বাঁচবে না। প্ৰায় সেই রকমই দশা হয়েছিল তার, হাত-পা নাড়ার ক্ষমতাও চলে গিয়েছিল, একলা ঘরে পড়ে থেকে চি চি করতো, তবু ভাগ্যক্রমে সে আবার সেরে উঠলো।

তারপর এই জলচৌকি থেকে মানদা দাসীকে সরানোর জন্য প্ৰায় ধস্তাধস্তি করতে হয়েছিল থাকোমণিকে।

সেই অসুখের পর থেকেই থাকোমণি এ রকম স্ফীত হতে শুরু করেছে। শেষ পর্যন্ত সোহাগবালার মতনই পরিণতি তার হবে কি না। এই কথা ভেবে প্রায়ই থাকে।মণির বক্ষ কাপে। তা ছাড়া, এই জলচৌকিটা সে এখনো আঁকড়ে ধরে আছে বটে, কিন্তু সে টের পেয়ে গেছে, যে-কোনো মুহূর্তে তার পায়ের তলা থেকে মাটি ধসে যাবে। মানদা দাসী এবং অন্যান্য কয়েকজন সব সময় তার দিকে শকুন-চক্ষে তাকায়। থাকোমণির আর ভালো লাগে না, কিছু ভালো লাগে না।

নকুড় আর দুর্যোধন মাছ কুটছে চাতালে বসে। থাকোমণি অলসভাবে চেয়ে আছে সেদিকে। বড়বাবুর কুটুমবাড়ির কয়েকজন আজ নেমন্তন্ন খাবেন। এ-বাড়িতে, তাই আজ বেশি মাছ এসেছে। কুটতে কুটতে দু-একটা টুকরো বাঁদিকে ছুঁড়ে ফেললে দুর্যোধন, আর নকুড় তাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। ঐভাবে প্ৰায় সেরখানেক মাছ সরিয়ে ফেলে ওরা বাইরে বিক্রি করে আসবে। থাকোমণি ইচ্ছে করে দেখছে না। ওরা কি ভাবছে, ওরা থাকোমণির চোখে ধুলো দিতে পারবে? থাকোমণি সবই জানে। তবু নিত্যি তিরিশ দিন আর ওদের সঙ্গে খ্যাট খ্যাট করতে থাকোমণির ইচ্ছে করে না। মাছের দরের যা হিসেব দিলে নকুড়, তা শুনেও তাজ্জব হবার কথা। বলে কি না রুইমাছের মন বারো টাকা, এ কী মগের মুলুক পেয়েছে? ন টাকা সাড়ে ন টাকা মন দরে পাকা রুই বাড়িতে এসে বয়ে দিয়ে যায়! থাকোমণি তবু ওদের কাছ থেকে চুরির টাকার বখরা চায়নি।

টাকা পয়সার প্রতিও লোভ কমে গেছে থাকোমণির। কী হবে টাকা দিয়ে? এক সময় ভাবতো বটে, বন্ধু নাহি কড়ি বই কিন্তু বয়েস অস্তাচলের দিকে ঢলে পড়ায় সে উপলব্ধি করেছে যে কড়ি থাকলেও মেয়েমানুষের জীবনে নিরাপত্তা নেই। বলতে গেলে থাকোমণি তো টাকার ওপরেই শুয়ে আছে। তার শয্যার নিচে তোড়ায় বাঁধা বাঁধা টাকা আর খুচরো পয়সা। বিশ বৎসর ধরে সে যা উপাৰ্জন করেছে, তার থেকে পাই-পয়সাও খরচ হয়নি, সবই জমা আছে, তবু থাকোমণির অন্তরে অশান্তির আগুন ধিকি ধিকি করে জ্বলে কেন?

এই যে ইদানীং সে নকুড় বা দুযোধনের কাছ থেকে চুরির বাখরা নেয় না। সেইজন্যই বরং সে কিছু খাতির পায়। থাকোমণির এবংবিধ পরিবর্তনে নকুড় আর দুর্যোধন খুব আতাস্তরে পড়ে গেছে, ব্যাপারটির আগা-পাশ-তলা কিছুই তারা বুঝতে পারছে না। সেই সোহাগবালার আমল থেকেই এই দরদালানের জলচৌকির অধিকারিণী প্রত্যেকটি চুরির আধলারও ভাগ না নিয়ে ছাড়েনি। থাকোমণি যে এখন আর ভাগ চায় না, তার মানে কি তার গভীর কোনো মতলব আছে? দিবাকরকে বলে থাকোমণি যে-কোনো দাসী বা ভূত্যের চাকরি যখন খুশী খেয়ে দিতে পারে। থাকোমণির ক্ষমতা সোহাগবালার চেয়েও বেশি, কারণ সে দুলালের মা।

রাত্তিরবেলা সব কাজ মিটে গেলে নকুড় থাকোমণির ঘরের দোরের সামনে এসে জিজ্ঞেস করে, ও থাকোদিদি, ঘুমুলে নাকি, আসবো? পিছনের গোলপাতার ঘর অনেক দিন হলো ছেড়ে এসেছে থাকোমণি। দিবাকরের অনুগ্রহে সে নিচের মহলেই একটা পাকা ঘর পেয়েছে। ঘর থেকে যখনই বেরোয়, তখনই থাকোমণি সে ঘরের দরজায় তালা লাগায়। হুটহাট করে এ-ঘরে কারুর প্রবেশ করার হুকুম নেই। নকুড় বয়েসে থাকোমণির চেয়ে যথেষ্ট বড় তো বটেই, এক সময় সে ছিল থাকোমণির উপপতি, তবু এখন সে থাকোমণিকে দিদি বলে সম্বোধন করে। প্রথম দিন যে আচমকা থাকোমণির ঘরে ঢুকে তার ওপর বলাৎকার করতে এসেছিল, সেই নকুড় এখন থাকে।মণির ঘরে ঢোকার আগে বিনীত কণ্ঠে অনুমতি নেয়।

 

থাকোমণি বলে, না। ঘুমুইনি, আয়, ভিতরে আয়।

এই ভৃত্য মহলে নকুড়ের মতন শয়তান আর দুটি নেই। চুরির নেশায় সে এমনই পাগল যে পিঁপড়ের পেট টিপে মধু বার করতেও সে ছাড়ে না। কয়েক বছর অন্তর অন্তর নকুড়ের বউ মরে। আবার সে গাঁয়ে গিয়ে একটি করে বিয়ে করে আসে। এবং অন্যান্য ভৃত্যদের মতনই, দেশের বাড়িতে একটি বউ থাকলেও এখানেও সে একজন সঙ্গিনী রাখে। গ্রামের বাড়িতে যাবার জন্য তো বছরে ছুটি মেলে একবার, তাও বেশী দিন থাকা চলে না, পয়সার টানে নিজেরাই তাড়াতাড়ি ফিরে আসে। নকুড় আবার ঘন ঘন সঙ্গিনী বদলায়। যথেষ্ট বয়েস হলেও তার শরীরটি এখনো অসুরের মতন এবং সারা দিন ধরে সে এত রকম কাজ করতে পারে যে তার স্বভাবের যতই দোষ থাকুক, প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো কাজে নকুড়কে প্রয়োজন হয়।

নকুড়ের সঙ্গে থাকোমণির শারীরিক সম্পর্কনেই অনেকদিনই। নকুড় এখন মঙ্গলা নামী এক দাসীকে নিয়ে খুব মেতে উঠেছে। তা থাক, সেজন্য থাকোমণির কোনো খেদ নেই। নকুড় এখন তার সেবা-দাস।

ঘরে ঢুকে নকুড় দেয়ালের এক কুলুঙ্গি থেকে একটা বটুয়া বার করে মেঝের ওপর আসনপিঁড়ি হয়ে বসে। থাকোমণি বসে থাকে তক্তাপোশের ওপরে। বটুয়াটা খুলে কল্কে বার করে গাঁজা সাজতে শুরু করে নকুড়। সারা দিনের পর এই সময়টার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে থাকোমণি। এই নকুড়ই তাকে এক সময় গাঁজার নেশা ধরিয়েছে। এখন কয়েক ছিলিম গাঁজা না। টানলে থাকোমণির ঘুমাই আসে না রাত্রে। থাকোমণি নিজে যে গাঁজা সাজতে জানে না তা নয়, তবু অন্য কেউ সেজে দিলে ভালো লাগে। কিছুদিন হলো নকুড় আবার নিজেই গায়ে পড়ে এসে এই ভার নিয়েছে।

নকুড় ছিলিম সেজে ফুঁ দিতে দিতে ডান হাতের কনুই বাঁ হাত দিয়ে ছুঁয়ে সেটি এগিয়ে দেয় থাকোমণির দিকে। তার একদা-শিষ্যা থাকোমণিকেই সে প্রথম টানটি লাগাবার সম্মান দেয়। থাকোমণি দু হাতে কল্কেটি ধরে প্রথমে কপালে ঠেকায়, তারপর শিবনেত্র হয়ে টানতে শুরু করে। পট পট করে বীজ ফাটার শব্দ হয়, অনেকখানি ধোঁয়া বুকে টেনে দম বন্ধ করে থেকে কল্কেটা সে ফিরিয়ে দেয় নকুড়কে। তারপর এইভাবে কম্বেন্ধটি হাতবদলাবদলি হতে থাকে। ছিলিম শেষ হলে নকুড় আবার সাজতে বসে।

নকুড়ের চেয়ে থাকোমণিই আগে বুঁদ হয়। চোখ বুজে থেকে সে একটু একটু মাথা দোলাতে থাকে। নকুড়ের এর পরও অন্যত্র বহু কাজ আছে। সে একটু পরেই উঠে যাবে, তার আগে থাকোমণিকে খুশী করবার জন্য বললো, থাকোদিদি, তোমার হাঁটুতে আজ বেদনা আচে? তারপরই সে হাত বাড়িয়ে থাকোমণির পদসেবা শুরু করে। থাকোমণি চোখ মেলে ঘোর-লাগা দৃষ্টিতে নকুড়ের দিকে চেয়ে থাকে, কোনো কথা বলে না।

ঠিক সেই সময়টিতে কোনো রাজ রাজেন্দ্রাণীর সঙ্গে থাকোমণির কিছু তফাত থাকে না। বস্তুত উপরিতলা ও নিচতলায় অনেক কিছুই একই ভাবে চলে। অনেক কাহিনী-কিস্যায় পড়া যায় যে কোনো স্বেচ্ছাচারিণী রানী প্রতি রাতে এক একজন প্রেমিক পুরুষকে অন্দরমহলে নিয়ে আসতেন। এই ভৃত্যতন্ত্রে থাকোমণি এখনো সম্রাজ্ঞী, সেও কি তা পারে না? এই তো নকুড়ের মতন একজন সা-জোয়ান তার পা টিপছে! এই নকুড় এক সময় তাকে অসহায় অবলা পেয়ে মাটির পুতুলের মতন ভাঙচুর করতে চেয়েছিল।

একটু পরেই এক পা তুলে নকুড়ের বুকে একটা ঠোক্কর মেরে থাকোমণি বলে, যাঃ, এবার তুই যাঃ। নিতান্ত বাধ্যের মতন নকুড় উঠে পড়ে এবং যাবার সময় দরজাটি টেনে দিয়ে যায়। দিনের পর দিন থাকোমণি চুরির পয়সার বখরা চায় না, তার বদলে একটা করে পায়ের ঠোক্কর তো সে দিতেই পারে।

নকুড় চলে গেলে থাকোমণি ক্ৰন্দন শুরু করে, ক্রমশ তার কান্না বাড়তে থাকে। গাঁজার ধোঁয়ার মতন এই কান্নাও তার ঘুমের ঔষধ, চোখের জলে বালিশ ভিজিয়ে থাকোমণি ঘুমিয়ে থাকে।

দিবাকর এখনো সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করেনি থাকোমণিকে। শরীরে আর জোর নেই দিবাকরের, তবু এখনো সে নিচের মহলের প্রভু। বাড়ির কর্তাদের কোনো নজর নেই বলে দিবাকরের ক্ষমতা এখন অনেক বেশী। একা আর বেশীদিন সামাল দিতে পারবে না বলে সে গ্রাম থেকে তাঁর ভ্রাতুষ্পপুত্রকে আনিয়েছে। ছেলেটির নাম পঞ্চানন, অপুত্রক দিবাকরের এই পঞ্চাননই উত্তরাধিকারী। ছেলেটি মাথায় টেরি কাটে, সন্ধে হলেই উড়নি গায়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। গ্রামে দিবাকরের যথেষ্ট বিষয় সম্পত্তি, সেইজন্য ছেলেটির স্বভাব হয়েছে। বাবু ধরনের। একদিন নবীনকুমার বাড়ি থেকে নিৰ্গত হচ্ছে, সেই সময় পঞ্চানন তার সামনে পড়ে গিয়েও কোমর বাঁকিয়ে নিচু হয়ে হাত জোড় করে থাকেনি। ছোটবাবু অবশ্য লক্ষ্যই করেনি। কিন্তু দূর থেকে দিবাকর দেখতে পেয়ে পঞ্চাননকে কান ধরে হিড় হিড়ি করে ভেতরে টেনে এনে খড়ম পেটা করে কপাল ফাটিয়ে দিল। যে-কোনো উপায়েই হোক, দিবাকর তার এই ভ্রাতুষ্পুত্রটিকে মানুষ করবেই।

 

দিবাকর থাকোমণিকে হাতে রাখতে চায় বিশেষ উদ্দেশ্যে। এক একদিন সন্ধ্যেবেলা দিবাকর ডেকে পাঠায় থাকোমণিকে। ওরা স্বামী স্ত্রী নয়। তবু যেন ওদের অনেককালের দাম্পত্য সম্পর্ক, এমনভাবে কথা হয় সুখ-দুঃখের। বাইরের জগতের একটু-আধটু সংবাদ দিবাকরের কাছ থেকেই শুনতে পায় থাকোমণি। গত কুড়ি বৎসরের মধ্যে তিন চারবার মাত্র থাকোমণি এ বাড়ির বাইরে গেছে।

দিবাকরের কাছ থেকেই থাকোমণি এই অত্যাশ্চর্য খবরটি শুনেছে যে বড়বাবুর নতুন বউমণি গান গায়।

শুনে থাকোমণি চক্ষু কপালে তুলেছিল। বলে কি, একে বিধবা, তার ওপর গান করে নতুন বউ! এ কেমন বংশের মেয়ে?

থাকোমণির অবিশ্বাস দেখে দিবাকর বলেছিল, হ্যাঁ রে, থাকো, আমি নিজের কানে শুনিচি। আদালতের বেলিফ এশ্চিলো, আমি সে কাগচ নিয়ে ওপরে গিচি। বড়বাবুকে সই করাতে, হঠাৎ শুনি কত্তামার ঘরে কে গুনগুনোচে! কী অনাছিষ্টি ভেবে দ্যাক, কত্তামা আমাদের সতী সাবিত্তির, তেনার ঘরে ঐ অজাতি-কুজাতের মেয়েকে ঢোকালেন বড়বাবু!

গঙ্গানারায়ণ বিধবা বিবাহ করায় এ বাড়ির দুজন রসুই, ঠাকুর চাকরি ছেড়ে চলে গেছে পাপের ভয়ে।

বধূবরণের সময় কুসুমকুমারীকে দেখেছে থাকোমণি। নতুন বধূর রূপ দেখবে কী, বিধবার কপালে সিঁদুর, এটা ভেবে সেদিকে তাকাতেই ভয় করছিল তার। সবাই যখন উলুধ্বনি দিচ্ছিল, থাকোমণির জিহ্বা নড়েনি।

—এবার কোনদিন দেখবি হিজড়ে মাগীদের মতন বাবুদের বউ ধেই ধেই করে নেত্য কচ্চে।

—আমন কতা বলোনি গো, আমন কতা বলোনি! বাবুদের অমঙ্গল হলে যে আমাদেরও অমঙ্গল!

—তোকে আমি বলে রাকচি, থাকো, মিলিয়ে নিস, এ বাড়ি থেকে মা লক্ষ্মী বিদেয় নিয়েচোন! এত বড় বংশ এবার ছাগলে মুড়োবে। ছোটবাবু যেমন দুহাতে ট্যাকা খর্চা কচ্চেন তাতে কোনদিন না দেউলে হতে হয়। আমার চে তো কেউ বেশী জানে না! মাতার ওপর তো দ্যাকার কেউ নেই—

–ও বাড়ির বড়বাবু আর আসেন না।

–তেনার ভীমরতি হয়েচে, তিনি আর কী কৰ্বেন!

কথায় কথায় দিবাকর আসল কথাটা পাড়ে। পঞ্চাননকে থাকোমণি নিজের ছেলের মতন দেখে, তাকে শিখিয়ে পড়ে মানুষ করে নেয়। দিবাকর চোখ বুজলে তো পঞ্চাননকেই গোমস্তাগিরি করতে হবে। সুতরাং থাকোমণির সঙ্গে পঞ্চাননের মিল না হলে নিচের মহলের রাজ্যপাট ঠিকঠাক চলবে না!

থাকোমণি পোড় খেয়ে অনেক কিছু শিখেছে, সে দিবাকরের আসল মতলবটি ঠিকই বোঝে। দিবাকর চিরকালই স্ত্রীলোকদের সঙ্গে রুক্ষ ব্যবহার করে, শয্যাসঙ্গিনীদেরও সে একটিও নরম কথা বলে না। অথচ ইদানীং থাকোমণির সঙ্গে তার ব্যবহার একেবারে মধুমাখা। এমনকি নিজের পানের ডিবে থাকোমণির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সে বলে, নে থাকে, একখিলি পান খা!

দিবাকর থাকোমণিকে তার ছেলের বিপক্ষে দাঁড় করাতে চায়। দিবাকর জেনে গেছে যে দুলাল তার মাকে একটুও ভক্তিশ্রদ্ধা করে না। ছোটবাবুর পেয়ারের লোক দুলাল এখন সময় সময় দিবাকরের ওপরেও চোখ রাঙায়। সেই জন্যই দুলালের বিরুদ্ধে একটা জোট বাঁধা দরকার, তাতে থাকোমণিকেও দলে টানতে হবে। থাকোমণির যে এতবড় অসুখ গেল, দুলাল একদিনের জন্যও তার মায়ের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা করেনি। সুতরাং অমন ছেলেকে আর থাকোমণির দরকার কী?

থাকোমণির সত্যিকারের দুঃখের জায়গায় ঘা দেয় দিবাকর। সে ভেতরে ভেতরে পুড়তে থেকেও বলে, হ্যাঁ, পাঁচু তো আমার ছেলেরই মতন। একটু ভব্যিসাব্যির জ্ঞান কম, তা বয়েসকালে শুধরে যাবে। আমি বলি কি, পাঁচুর বে দাও, তার বউ এসে এখেনে থাকুক।

একটা নয়, ইতিমধ্যে দু-দুবার বিবাহ হয়ে গেছে। পঞ্চাননের। কোনো স্ত্রী-ই বাঁচেনি। আবার বিয়ে তো দিতে হবেই দেখে শুনে, তার আগে ছেলেটা খুঁটে খেতে শিখুক।

—পাঁচুর বউ এলে তখন তাকে আমি জলচৌকি ছেড়ে দেবো। ঐ মানদা হারামজাদীকে কোনোদিন দেবো না।

দিবাকর এমন মুখ করে থাকে যেন মানদাকে সে চেনেই না। অথচ থাকোমণির অসুখের সময় মানদা যে জলচৌকিতে গ্যাট হয়ে বসেছিল, সে কি দিবাকরের অনুমতি ছাড়াই? দিবাকরের শয্যায় হয়তো এখনো মানদার শরীরের গন্ধ লেগে আছে। থাকোমণি সব জানে। দিবাকর যতই চতুর হোক, সে এটুকু বোঝে না যে, মা কখনো তার সন্তানের বিরুদ্ধে যায় না।

থাকোমণির খুব বাসনা ছিল যে দুলালের পত্নী সুবালাকে ক্ৰমে ক্রমে সব হিসেবপত্র বুঝিয়ে দিয়ে একদিন তাকেই নিজের জায়গায় বসাবে। কিন্তু তা হলো না। সুবালা নিজে যেমন দেমাকী, দুলালও হয়েছে সেরকম। দুলাল তার মাকে ধমকে বলেছিল, তার বউ ভদ্রলোকের বাড়ির মেয়ে, সে কখনো দাসীবাঁদীগিরি করতে যাবে না। ছুতোর মিস্তিরির মেয়ে হলো ভদ্রলোক আর দুলালের নিজের মা দাসী!

দুলাল এখন প্ৰাণপণে ভদ্রলোক হবার চেষ্টা করছে। বাগানের মধ্যে একখানি একটরে ঘরে সে তার স্ত্রী-পুত্র নিয়ে থাকে। সে বা সুবালা ভুলেও কখনো দাসদাসী মহলে পা দেয় না। তাদের জন্য খাবার পাঠাতে হয়। দুলাল ঘরের মধ্যেও জামা পরে থাকে, জুতো পায় দেয় এবং ইকোয় তামাক খায়। নিজে সে বই পড়ে এবং বউ ও ছেলেকে পড়তে শেখায়। এমনকি দুলাল নিজের জন্য একটি চাকর পর্যন্ত রেখেছে!

থাকোমণি দেখা করতে গেলে দুলাল বা সুবালা বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলে, একবারও ভেতরে গিয়ে বসতে বলে না। নাতিকে নিয়ে সোহাগ করা আর থাকোমণির এ জন্মে হলো না। নাতি তাকে চিনলোই না ভালো করে। কেন যে মায়ের ওপর দুলালের এ রাগ তা থাকোমণি বুঝেও বুঝতে চায় না। সেটাও বুঝলে তার জীবনের আর বাকি রইলো কী!

একদিন দুলাল তা অতি নির্দয়ভাবে বুঝিয়ে দিল।

থাকোমণির একটাই শুধু স্বপ্ন আছে। কোনো জমি কিনে ঘর তুলবে, পুকুর কাটাবে, ধান চাষ করবে। দাসীবৃত্তি ছেড়ে সে আবার চাষীর বাড়ির গৃহিণী হবে। সেরকম পয়সা তো তার রয়েছেই, কিন্তু একা তো যাওয়া যায় না, ছেলে-বউকে সঙ্গে নিয়ে না যেতে পারলে সুখ কোথায়? কিন্তু দুলাল এ প্রস্তাব কিছুতেই কানে তোলে না। তবু সে যতই বকুনি-ঝকুনি দিক থাকোমণি প্রায়ই এই কথাটা বলে।

একরাত্রে থাকোমণির মাথায় এই স্বপ্নটা আবার বেশী চাগিয়ে উঠলো। গাঁজায় একটু দম দিলেই তার না-কেনা জমি, না-কাটা পুকুর, না-তৈরী বাড়ির চমৎকার ছবি ফুটে ওঠে মানস নেত্ৰে। সেই জন্যই সে কাঁদে। সে রাত্রে থাকোমণি আর থাকতে পারলো না একলা ঘরে। নকুড় ছুটি নিয়ে দেশে গেছে, দিবাকরের ঘরের দ্বার বন্ধ, শুনশান করছে নিচের মহল। একা একা গাঁজা টেনে থাকে।মণির বেশী ঘোর লেগে গেল, সে বাইরে এসে বাগানের মধ্য দিয়ে ছুটতে ছুটতে গিয়ে ধাক্কা মারতে লাগলো দুলালদের দরজায়। ঘুম ভেঙে উঠে দুলাল দরজা খুলতেই থাকোমণি তার হাত ধরে নেশাজড়িত কণ্ঠে আন্তরিকতম কাকুতি করে বললো,অ দুলে, চ না, আমরা গাঁয়ে যাই, সেখেনে মায়ে পুতে সুখে থাকবো, তোর বউকে আমি মাতায় করে রাখবো, আ দুলে, চ না যাই! এক্ষুনি চলে যাই—।

দাঁতে দাঁত চেপে হিংস্র কণ্ঠে দুলাল বললো, বেবুশ্যে মাগী, এত রাত্রে এয়েচিস ঢলানী কত্তে, এতটুকু হায়া নেই কো, তোর মুখ দেখলে পাপ হয়! ফের যদি কোনদিন—

বলতে বলতেই মাতৃবক্ষে সজোরে পদাঘাত করলে দুলালচন্দ্র। বিস্ফারিত নেত্ৰে থাকোমণি ধরাশায়ী হতেই সশব্দে দোর বন্ধ করে দিল তার পুত্র।

 

পরদিন ভোর থেকে থাকোমণিকে আর দেখতে পাওয়া গেল না। তাড়া খাওয়া বন্য পশুর মতন ছুটিতে ছুটতে থাকোমণি একসময় গঙ্গা পেয়ে গেল। তার ছেলে বলেছে তার মুখ দেখতে চায় না, তবে এ মুখ আর সে কাকে দেখাবে? ভোরের প্রথম খেয়ায় গঙ্গা পার হয়ে ওপারের মানুষদের জনে জনে জিজ্ঞেস করতে লাগলো, ওগো, ভিনকুড়ি গাঁ কোতায় বলতে পারো? আমি সেখেনে যাবো, ওগো, তোমরা আমায় পথ বলে দাও—। দু-চারজন তাকে সাহায্য করার চেষ্টায় জানতে চায়, কোন জেলা, কোন পরগনা কোন মৌজা? কিন্তু থাকোমণি সে সব কিছুই জানে না। ধানকুড়ি আর ভিনকুড়ি পাশাপাশি এই দুটি গ্রামের নাম ছাড়া তার আর কিছুই মনে নেই। কিন্তু শুধু গ্রামের নাম শুনে পথ বা দিকের সন্ধান দিতে পারে না কেউই। তবু থাকোমণি অন্ধের মতন ছুটতে থাকে। সে তার স্বামী শ্বশুরের ভিটেয় ফিরে যেতে চায়। সেখানে পৌঁছুতে পারুক বা না পারুক, সে আর পিছন পানে চাইবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *