৫৫. শ্ৰীরামকৃষ্ণের শারীরিক অবস্থার অবনতি

শ্ৰীরামকৃষ্ণের শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে দিন দিন। শয্যা ছেড়ে প্রায় উঠতেই পারেন না, তবু জোর করে যখন স্নান করতে যান অমনি গলায় প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়, সেইসঙ্গে একনাগারে কাশি ও রক্তপাত। এর মধ্যে জিভে ঘা হয়েছে, কোনও শক্ত খাদ্যই গলা দিয়ে নামতে চায় না।

ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার পরামর্শ দিলেন যে কলকাতার ধুলো-ধোঁয়া মেশানো বাতাসে শ্ৰীরামকৃষ্ণের রোগের প্রকোপ ক্রমশ বৃদ্ধি পাবে। ইনি সারাজীবন ফাঁকা জায়গাতেই থেকেছেন, কলকাতার মতন জনাকীর্ণ, ধূলো-ময়লাজঞ্জালময় শহরে কখনও বাস করেননি, এঁকে খোলামেলা, স্বাস্থ্যকর কোনও স্থানে বায়ু পরিবর্তনের জন্য নিয়ে যাওয়া দরকার।

দাৰ্জিলিং-সিমলা-পুরীর মতন বিখ্যাত স্বাস্থ্যকর স্থানগুলিতে গুরুকে নিয়ে যাবার মতন সঙ্গতি নেই শিষ্যদের। তা ছাড়া অচেনা জায়গায় দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসার ব্যবস্থাই বা হবে কী ভাবে? দু-একজন বলল, আবার দক্ষিণেশ্বরে ফিরে গেলেই তো হয়। শ্ৰীরামকৃষ্ণের তা পছন্দ নয়। দক্ষিণেশ্বরে ফিরে যাবার যুক্তি হিসেবে একজন বলল, সেখানে কালী আছেন। শ্ৰীরামকৃষ্ণ তার উত্তরে শুধু বললেন, এখানে বুঝি কালী নেই?

দক্ষিণেশ্বরের সেই ঘরখানির প্রতি শ্ৰীরামকৃষ্ণের যেন একেবারেই আর কোনও মায়া নেই। যে-কালীমূর্তির সঙ্গে ছিল তাঁর এতকালের হাসি-কান্নার সম্পর্ক, এর মধ্যে আর একদিনও সেই মূর্তি দর্শনের কথা বলেননি। তাঁর মনের কোনও একটা জায়গায় আঘাত লেগেছে, অভিমান জমে উঠছে অনেক দিন ধরে। মথুরবাবুর ছেলে ত্ৰৈলোক্য এখন দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের মালিক, সে তো একবারও তাকে দক্ষিণেশ্বরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইল না, কোনও খোঁজ-খবরই নেয় না!

ভক্তরা ঠিক করল, কলকাতার বাইরে কোথাও একটা বাড়ি ভাড়া নিতে হবে। বেশি দূর হলে চলবে না, ভক্তদের যাতায়াতের অসুবিধা হবে, ডাক্তারদেরও তো নিয়ে যাওয়া চাই।

এক-একজন এক-একটি বাড়ির সন্ধান আনে, শ্ৰীরামকৃষ্ণ সব শোনেন। পৌষ মাস পড়ে গেলে শ্ৰীরামকৃষ্ণ আর স্থান ত্যাগ করতে চাইবেন না, তাই সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। শ্যামপুকুরের বাড়িওয়ালাও তাড়া দিচ্ছে, এ ভাড়াটেরা এ মাসের মধ্যে উঠে না গেলে সামনের মাসে বাড়ি ভাড়া হবে না।

সৌভাগ্যবশত কাছাকাছির মধ্যেই একটা পছন্দসই বাড়ি পাওয়া গেল। বাগবাজারের খাল পেরিয়ে বরানগরের পথে কাশীপুর, সেখানে রানী কাত্যায়নীর জামাতা গোপালচন্দ্র ঘোষের উদ্যানবাড়ি খালি পড়ে আছে। এগারো বিঘা চার কাঠা জমির মাঝখানে দোতলা বাড়ি, চারদিক উঁচু পাচিল দিয়ে ঘেরা, ভেতরে দুটি পুকুর ও নানারকম ফুল ও ফলের বাগান। ভাড়া মাসিক আশি টাকা। জমিদারদের বাগান-বিলাসের দিন আর নেই, রেস্তোয় টান পড়েছে, এইসব বাড়িতে এখন আর ঝাড়লণ্ঠন জ্বলে না। নর্তকীদের নূপুরের রিনিঝিনি শোনা যায় না, অযত্নে পড়ে থাকা এইসব পেল্লায় পেল্লায় বাগানবাড়ি এখন অনেকেই ভাড়া দিতে পারলে বাঁচে।

অত বড় বাড়িতে তো শ্ৰীরামকৃষ্ণ একা থাকতে পারবেন না, কয়েকজন ভক্তকে সর্বক্ষণ থাকতে হবে সেবার জন্য। তাদের খাওয়ার খরচ, বাড়ি ভাড়া, ওষুধপত্র, যাওয়া-আসার ব্যয় এসব আসবে কোথা থেকে? কতদিন এই খরচ চালাতে হবে, তাও তো কেউ জানে না। যে পনেরো-ষোলোজন ভক্ত অতি ঘনিষ্ঠ, তারা ঠিক করল যে বাড়ি ভাড়া নেওয়া হবে আপাতত ছমাসের জন্য, আর সব খরচ নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে চালাবো হবে।

শ্ৰীরামকৃষ্ণ সবই শুনতে পান। তিনি প্রত্যেক ভক্তের বাড়ির হাঁড়ির খবর পর্যন্ত রাখেন। তিনি টাকা পয়সা স্পর্শ করেন না, কিন্তু কোন জিনিসের কী দাম, সে সম্পর্কে তাঁর টনটনে জ্ঞান আছে। একখানা ঘটি বা কম্বল বা থিয়েটারের টিকিট কিনতে কত খরচ পড়ে তাও তিনি জেনে নেন। ভক্তদের মধ্যে সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের অবস্থা বেশ সচ্ছল, তাঁর স্বভাবটাও ব্যয়-কুণ্ঠ নয়, শ্ৰীরামকৃষ্ণ তাঁকে নিভৃতে ডেকে বললেন, দেখ সুরেন্দর, এরা সব কেরানি-মেরানি ছাপোষা লোক, এরা এত টাকা চাঁদা তুলতে পারবে কেন? ভাড়াই আশি টাকা… সে যে অনেক গো! বাড়ি ভাড়ার টাকাটা সব তুমিই দিও!

সুরেন্দ্র তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলেন। কাশীপুরের বাড়িতে যেতে যে শ্ৰীরামকৃষ্ণ সম্মত হয়েছেন, তাতেই তিনি ধন্য।

অঘ্রান মাসের ২৭ তারিখ শুক্রবার, শুক্লাপঞ্চমী, বেশ ভালো দিন। সেই দিনই দু’খানা ঘোড়ার গাড়ি ডেকে যাত্রা শুরু হল। একটি গাড়িতে শ্ৰীরামকৃষ্ণ ও সারদামণি ও নরেন, অন্য গাড়িতে আর কয়েকজন ভক্তের সঙ্গে রয়েছে লাটু। বাসা বদলের উত্তেজনায় শ্রীরামকৃষ্ণ হঠাৎ যেন আজ বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন। শ্যামপুকুরের বাড়িতে তিনি কাটালেন সত্তর দিন। এর মধ্যে একদিনও বাইরে যাননি, আজ এতদিন পরে পথে নেমে তিনি যেন শিশুর মতন খুশি ও বিস্ময়ে সব কিছু নতুন করে দেখছেন।

বাগবাজারের পুল পেরিয়ে গাড়ি চলল কাশীপুর চৌরাস্তার দিকে। আসন্ন শীতে নরম হয়ে এসেছে রোদ, আকাশ প্ৰসন্ন নীল। শ্ৰীরামকৃষ্ণের রোগজীর্ণ মুখখানিতে আজ হাসি ফুটেছে, মাঝে মাঝে তিনি মুখ বাড়িয়ে অন্য গাড়ির ছেলেদের সঙ্গে কথা বলছেন। তাঁর অবস্থা দেখে দু’দিন আগেও কয়েকজন ভক্ত কান্নাকাটি শুরু করেছিল, আজ শুরুকে সুস্থ দেখে উদ্বেল হয়ে উঠেছে তাদের বুক। একগলা ঘোমটায় মুখ ঢেকে বসে আছেন সারদামণি!

এবড়ো-থেৰবড়ো পাথরে বাধানো রাস্তা। দু’পাশে মুটে-মজুরদেব চালাঘর। গঙ্গার ধারে ধারে পাটকল ও কল-কারখানা স্থাপনের সঙ্গে অবাঙালি শ্রমিকরা এসে জুটছে এখানে। গাড়ি ছাড়িয়ে যেতে লাগল পাটগুদাম, দাস কোম্পানির লোহার কারখানা, রেলি ব্ৰাদার্সের কারখানা, মদের দোকান, চালের আড়ত, ঘোড়ার আস্তাবল। মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে একএকখানা বাগানবাড়ির ভগ্নদশা, এরই মধ্যে মতি শীলের বাগানবাড়িটি এখনও রয়েছে অক্ষুণ্ণ মনোরম। পথে পড়ল সর্বমঙ্গলার মন্দির, শ্ৰীরামকৃষ্ণ অন্যদের ডেকে বললেন, ওরে ওই সর্বমঙ্গলা বড় জাগ্রত, প্ৰণাম কর, প্ৰণাম কর।

মতি শীলের বাগানবাড়ির সামনে দিয়ে একটা ঝিল চলে গেছে বলে এই অঞ্চলটাকে বলা হয় মতি ঝিল। এই মতি ঝিলের উত্তরের বরানগর বাজার যাবার রাস্তার মোড়ের বাড়িটিই এদের উদ্দিষ্ট।

লোহার ফটক পেরিয়ে গাড়ি দুটি ঢুকে এল ভেতরে। এককালে খুবই সমৃদ্ধ বাগান ছিল, এখন অযত্নের ছাপ স্পষ্ট। তবু গাড়ি থেকে নেমে শ্ৰীরামকৃষ্ণ তাকিয়ে বাঃ বাঃ বলতে লাগলেন। শহরের ঘিঞ্জি এলাকায় ছোট বাড়ির তুলনায় এখানে কতখানি উন্মুক্ত স্থান, কত গাছপালা। শ্ৰীরামকৃষ্ণ টলটলে পায়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন, লাটু রয়ে গেল পাশে পাশে, একটু হোঁচট খেলেই ওঁকে ধরে ফেলবে।

নরেন্দ্র এ বাড়ি আগে দেখেনি, সে বাগান পরিদর্শনে না গিয়ে সোজা ঢুকে গেল বাড়ির মধ্যে। জিনিসপত্র কোথায় রাখা হবে, কে কোন ঘরে থাকবে, এইসব বিলিব্যবস্থা লেগে গেল। তাকে কেউ নেতৃত্বের ভার দেয়নি, তবু সে যেন সহজাতভাবে নেতা। কারা কারা দিনের বেলা গুরুর সেবায় নিযুক্ত থাকবে, কে কে রাত্রি জাগবে, ওষুধ ও ডাক্তারের ভার থাকবে কার ওপর, কে বাজার করবে। প্রতিদিন, এই সব কিছুই সে আগে ঠিক করে ফেলেছে। সুরেন মিত্তির, রাম দত্ত, মহেন্দ্র মাস্টারের মতন বয়স্ক ও দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা থাকতেও নরেন্দ্রর ব্যবস্থাপনা সবাই মেনে নেয়।

একতলায় চারখানি ঘর, ওপরতলায় দুটি। দোতলার একটি বড় ঘর অতি চমৎকার, উত্তর, পশ্চিম আর দক্ষিণ দিক খোলা, পশ্চিমের দেয়ালটি আবার অর্ধগোলাকার, বাড়ির মালিক নিশ্চয়ই এ ঘরে এসে থাকতেন। এই ঘরখানিই শ্ৰীরামকৃষ্ণের জন্য নির্দিষ্ট হল। পাশের ছোটঘরটিতে থাকবে লাটু ও রাত্রের সেবকরা। নীচের বড় হলঘরটি সকলের বসবার জায়গা, তার পাশের একটি ঘরে অন্য ভক্তরা শোবে। উত্তর দিকে কোণের ঘরটিতে থাকবেন। সারদামণি, তার পাশের ঘরটি দিয়ে দোতলায় যাবার জন্য আছে আর একটি কাঠের সিঁড়ি। বাড়ির পেছন দিকে ঠাকুর-চাকর-দারোয়ানদের জন্য রয়েছে অনেকগুলি ঘর।

শ্ৰীরামকৃষ্ণ ওপরে এসে তাঁর ঘর সংলগ্ন ছাদে দাঁড়ালেন। দেখে মনে হয়, তাঁর শরীরে যেন আর কোনও ব্যাধির জ্বালা নেই, দু-এক বছর আগেকার সেই চঞ্চল, স্নিগ্ধ, রসে-বশে থাকা মানুষটি হয়ে গেছেন।

নরেন্দ্র আজ বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না। তাকে বাড়ি ফিরে গিয়ে নিজস্ব ব্যবহার্য কিছু কিছু জিনিস ও বইপত্র নিয়ে আসতে হবে। তার চেয়েও বড় কথা, নিতে হবে মায়ের অনুমতি। শ্যামপুকুরের বাড়িতে সে রাত্রিবাস করত না, কিন্তু এখানে নিজের বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হচ্ছে। মা ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনদের তাতে ঘোর আপত্তি। নরেনের ওপর যে একটা সংসারের দায়িত্ব, শিগগিরই বি এল পাস করে তার উকিল হবার কথা।

কিন্তু নরেন্দ্ৰ এখন কাশীপুর থেকে দূরে থাকতে পারবে না কিছুতেই। সে মাকে বোঝাবার জন্য দৌড়ে চলে গেল।

গিরিশের নতুন পালার জন্য রিহার্সাল ছিল, তিনি দুপুরে আসতে পারেননি। কিন্তু রিহার্সাল দিতে দিতেও মন সর্বক্ষণ ছটফট করেছে। অমৃতলালের সঙ্গে বসে সন্ধের পর মদ্যপানও হয়ে গেল খানিকটা। একসময় আর কিছুই ভালো লাগল না। আজ গুরুর পায়ের ধুলো নেওয়া হয়নি, তাকে যেতেই হবে।

কাশীপুরের বাগানবাড়ি চেনেন না গিরিশ। নিজের ঘোড়ার গাড়ি চেপে মহেন্দ্র মাস্টারের বাড়ির সামনে গিয়ে ডাকাডাকি করতে লাগলেন। মহেন্দ্র মাস্টার বেরিয়ে এসে বিস্মিতভাবে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার ও গিরিশ তার হাত ধরে টেনে বললেন, উঠুন, উঠুন, শিগগির গাড়িতে উঠুন, কাশীপুরে যাব। মহেন্দ্র মাস্টার বললেন, এত রাতে ঐ পরমহংসদেব নিশ্চয় ঘুমিয়ে পড়েছেন।

গিরিশ তাঁকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বললেন, দূর মশাই! ভক্ত যদি ব্যাকুল হয়ে ছুটে যায়, তা হলে ভগবান কি নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারেন?

গাড়িতে উঠতে বাধ্য হলেন মাস্টার। চলতে শুরু করার পর জিজ্ঞেস করলেন, আপনি ওঁকে ভগবান বলে ধরে নিয়েছেন?

গিরিশ বললেন, আলবাত ভগবান, তা ছাড়া আর কী সাক্ষাৎ অবতার।

মাস্টার বললেন, তাদের অসুখের কোনও বর্ণনা পেয়েছেন কোথাও? ওঁদের রোগ-ভোগ হবার কথা নয়, অবতারদের ইচ্ছামৃত্যু।

গিরিশ বললেন, আরে মশাই, এসব হল লীলা, সব আমরা কী করে বুঝব? “কৃষ্ণের যতেক লীলা, সর্বোত্তম নরলীলা। নর বাপু তাঁহার স্বরূপ।” আমাদের যত দুঃখ-কষ্ট-পাপ সব উনি কণ্ঠে ধারণ করেছেন, যখন ইচ্ছে হবে, তখনই আবার ঝেড়ে ফেলে দেবেন, আবার সুস্থ হয়ে উঠবেন।

মাস্টার বললেন, আমরা সকলেই তাই চাই।

গিরিশ বললেন, চাই মানে কী, হবেনাই! উনি অনেক দিন থাকবেন আমাদের মধ্যে।

নেশা পূর্ণ হয়নি বলে গিরিশ একটি বোতল সঙ্গে এনেছেন। সেটা তুলে একটা চুমুক দিলেন।

গিরিশকে মত্ত অবস্থায় দু-একবার দেখেছেন মাস্টার। তখন গিরিশ যেন একটা অসুরের মতন দাপাদাপি শুরু করে দেন।

মাস্টার শঙ্কিত হয়ে ভাবলেন, সেই অবস্থায় কি একজন মানুষের কাছে যাওয়া ঠিক হবে?

তিনি ইতস্তত করে বললেন, গিরিশবাবু, আমি বলছিলাম কী, আজ এত রাতে না গিয়ে কাল সকালে গেলে হত না? আজ প্রথম দিন, গাড়িতে যাওয়ার ধকল গেছে, উনি বিশ্রাম নেবেন…

গিরিশ শান্তভাবে বললেন, আমি মদ খেয়েছি বলে ভয় পাচ্ছেন তো? মদ্যপান করেছি বটে, কিন্তু মাতাল হয়েছি কি? আজ মাতাল হব না। পরমহংসদেব আমাকে মদ ছাড়তে তো কখনও বলেননি। তিনি জানেন, আমার বীর ভাব। তিনি আমার বকলমা নিয়েছেন।

একটু থেমে গিরিশ আবার বললেন, আমি জানি, পরমহংসদেব আমার ভার নিয়েছেন। তিনি আমার সঙ্গে সঙ্গে আছেন। আমি দুনিয়ার কাউকে ভয় করি না, গ্রাহ্য করি না। আমি যমকেও ভয় করি না।

মাস্টার চুপ করে গেলেন।

মদ্যপায়ীদের নেশার একটি স্তরে আপন মনে কথা বলার প্রবৃত্তি হয়। গিরিশ বলতে লাগলেন, একদিন রাত্তিরে দক্ষিণেশ্বরে গেসলাম, উনি নিজের হাতে আমাকে পায়েস খাইয়ে দিলেন। আমি বাগবাজারের মস্তান, কত বাঘা বাঘা লোক চড়িয়ে খেয়েছি, নেশা-ভাঙ কিছু বাকি রাখিনি, রাতের বেলা আমায় দেখলে অনেকে ভয় পায়, সেই আমাকে কেউ মুখে তুলে কিছু খাইয়ে দেবে? মা যেমন একটা শিশুকে…আমিও শান্ত হয়ে খেলুম! অ্যাঁ? ওগো, আমার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছিল…

অন্য দিকে কথা ঘোরাবার জন্য মাস্টার জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, অবতাররা তো বিশেষ একটা উদ্দেশ্য নিয়ে ধরাধামে আসেন। আমাদের গুরু কিসের জন্য…

গিরিশ হুঙ্কার দিয়ে বললেন,… ‘ধর্ম সংস্থাপনাৰ্থ সম্ভবামি যুগে যুগে।’ নতুন ধর্ম সংস্থাপন করে গেলেন পরমহংস। যত মত তত পথ। ওগো, সব ধর্মের পথগুলিই যে ঈশ্বরের দিকে যায়, সব ধর্মের মতই যে এক, এমন কথা কেউ আগে বলেছে? আজ অবধি কোনও ধর্মের গুরুঠাকুররা ভাবতে পেরেছে এত বড় একটা সহজ সত্য কথা? সেই যে উনি উপমা দিয়ে বলেন না, বাঙালি হিন্দু বলে জল, উর্দুওয়ালা মুসলমানরা বলে পানি আর ইংরেজিওয়ালা খ্রিস্টানরা বলে ওয়াটার। যেনামেই ডাকো, সকলেই চায় একই জিনিস!

মাস্টার বললেন, আমি যতটুকু পড়াশুনো করেছি, তাতে এমন পরমতসহিষ্ণুতার কথা কোথাও দেখিনি।

গিরিশ নিজের বুকে টোকা মারতে মারতে বললেন, আর একটা কথা কী জান মাস্টার, উনি অবতার হয়ে এসেছেন আমার জন্য। হ্যাঁ হ্যাঁ আমার জন্য। এ রকম একটা পাপীকে উদ্ধার করে তাকে দিয়ে লোকশিক্ষার কাজে লাগাবেন। আমি কী ছিলাম আর কী হয়েছি! সব পাপ ধুয়ে মুছে গেছে।

ডিসেম্বর মাসের রাত, পথঘাট একেবারে নিখাত নিস্তব্ধ অন্ধকার। তার মধ্য দিয়ে ঘোড়ার গাড়িটি চলেছে ঝুম ঝুম শব্দ করে। মাঝে মাঝে দু-চারটে পেঁচি মাতালের হল্লা ছাড়া আর কোনও মানুষের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না।

উদ্যানবাটি ঘুমন্ত, অন্ধকারে ঢাকা। তবে গিরিশের আশা ব্যর্থ হয়নি, শুধু দোতলার ঘরে এখনও বাতি জ্বলছে। মশারি টাঙিয়ে খাটে শুয়ে আছেন শ্ৰীরামকৃষ্ণ, এখনও ঘুমোননি। খাটের পায়ের কাছে বসে আছে অতি বিশ্বস্ত লাটু। ঘর ভনভন করছে মশা, লাটুকে একেবারে ছেকে ধরেছে, কিন্তু পাছে মশা মারার শব্দে প্রভুর ব্যাঘাত হয়, তাই সে অত মশার কামড় সহ্য করেও বসে আছে স্থির হয়ে। একটা লণ্ঠন জ্বলছে এক কোণে।

এত রাতে দুই ভক্তকে দেখে শ্ৰীরামকৃষ্ণ উঠে বসলেন। বিকেলের দিকের সেই উৎফুল্ল ভাবটা আর নেই, কালব্যাধি তাঁর কণ্ঠ আঁকড়ে ধরেছে আবার।

গিরিশ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে নানা কথা বলতে লাগলেন। বারবার বললেন, আপনি অবতার, আপনি ইচ্ছে করলেই তো সুস্থ হতে পারেন। আপনাকে শুয়ে থাকতে দেখলে ভালো লাগে না।

শ্ৰীরামকৃষ্ণ ঈষৎ বিরক্তভাবে বললেন, এই আমার আর আপনি পূর্ণ অবতার— ইচ্ছা করেই ব্যাধিধারণ কচ্ছেন—এসব কথা আর ভালো লাগে না।

মাস্টারের দিকে তাকিয়ে বললেন, কাশি কফ বুকের টান এসব নেই, তবে পেট গরম। ঘুম আসে না। ঘরেই পায়খানার ব্যবস্থা করতে হবে। বাইরে যেতে পারব বলে মনে হয় না।

লাটু হাতজোড় করে বলল, যে আজ্ঞে মোশাই, হামি তো আপনার মেস্তর হাজির আছি!

গিরিশ তার কথা শুনে হা-হা করে হেসে উঠলেন।

শ্ৰীরামকৃষ্ণ আবার মাস্টারকে উদ্বেগের সঙ্গে বললেন, দূর হয়ে গেল, ডাক্তার-কোবরেজরা কি এতটা পথ আসতে চাইবে?

মাস্টার তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, আসবেন বৈকি! গাড়ি করে আসবেন… সময় বেশি লাগবে না।

গিরিশ বললেন, আপনি ওষুধ খান শুধু কবিরাজের অহঙ্কার বাড়ানোর জন্য।

শ্ৰীরামকৃষ্ণ চুপ করে গলায় হাত বুলোতে লাগলেন।

গিরিশ আবার চেপে ধরার সুরে বললেন, বলুন, আপনি কেন ওষুধ খান?

শ্ৰীরামকৃষ্ণ বললেন, ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকছে। পুবের জানলাটা বন্ধ করে দাও না গো!

মাস্টার এবার জোর করে গিরিশকে নিয়ে নীচে চলে গেলেন।

এক-একদিন খুবই কাতর হয়ে থাকেন। শ্ৰীরামকৃষ্ণ, আবার মাঝে মাঝে চাঙ্গা হয়ে ওঠেন। সেই সাময়িক সুস্থতার সময় ভক্তদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা রসালাপে মেতে ওঠেন, তারই মধ্যে ভাবের ঘোর হয়। পাঁচ-ছ’দিন পর অনেকটা সুস্থ বোধ করে তিনি নীচের বাগানে বেড়াতে যেতে চাইলেন। সে কথা শুনে সকলেই খুব আনন্দ হল।

গরম বনাতের কালো কোট, মাথাবন্ধ টুপি, মোজা ও চটি জুতো পরে, হাতে একটা ছড়ি নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে তিনি নেমে এলেন। আর তাঁর পা টলটল করছে না, নিজে নিজে দিব্যি হাঁটতে পারছেন। পেছনে ও দু’পাশে ভক্তদের দল, তিনি বাগানে এসে ছড়ি তুলে তুলে এক-একটা গাছ দেখাতে লাগলেন। অন্য সকলের চেয়ে তিনিই গাছপালা বেশি চেনেন। শীতের মরসুমি ফুলে বাগান ভরে আছে। অন্যদের ছেড়ে একটু এগিয়ে তিনি সেই ফুলের ঝাড়ের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালেন, ভক্তদের দিকে সামনাসামনি ফিরে মধুর হাস্য করতে লাগলেন।

সকলেই ভাবল, ইনি যদি প্রতিদিন একবার এমনভাবে বাগানে বেড়াতে পারেন, তা হলে পুরো সুস্থ হয়ে উঠবেন। কিন্তু সেই দিনই ঠাণ্ডা লেগে তিনি এমন দুর্বল হয়ে পড়লেন যে বিছানা ছেড়ে আর উঠতেই পারেন না, কাশিও বেড়ে গেল খুব।

মাংসের সুরুয়া খাওয়া কিছুদিন বন্ধ ছিল, ডাক্তারের নির্দেশে আবার সেটা শুরু করতে হল। প্রতিদিন এক ভক্ত আইনসম্মত দোকান থেকে মাংস কিনে আনে। সারদামণি সেই মাংস রান্না করেন। কাঁচা জলে অনেকক্ষণ ফোটে, তাতে কয়েকটা তেজপাতা ও সামান্য মশলা মিশিয়ে একেবারে তুলতুলে সেদ্ধ হলে নামিয়ে ছেকে নেওয়া হয়। তারপর সেই জুস টুকু শুধু খেতে দেওয়া হয় রোগীকে।

এই অসুখের সময়েই বলতে গেলে প্রথম সারদামণি তাঁর স্বামীর সেবা করার সুযোগ পেয়েছেন। অন্য ভক্তরা উপস্থিত থাকলে তিনি দোতলার ঘরে আসেন না। শ্ৰীরামকৃষ্ণকে খাওয়াবার সময় কোণের দিকে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসেন সারদামণি, তখন ঘর খালি করে দেওয়া হয়, শুধু পাশে দাঁড়িয়ে থাকে লাটু।

শ্ৰীরামকৃষ্ণের খুব ভাত আর ঝোল খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এখন আর তা গলা দিয়ে নামে না। সারদামণি করে সেই জুস খাইয়ে দেন। নারীহস্তের এই সেবাটুকু বেশ উপভোগ করেন শ্ৰীরামকৃষ্ণ। মাঝে মাঝে ইয়ার্কি করেন সঙ্গে। একদিন বললেন, হ্যাঁ গা, তুমি কখনও অষ্টা-কষ্ট খেলেছ?

সে এক রকম গ্রামের কড়ি খেলা। সারদামণি দুদিকে মাথা নাড়লেন।

শ্ৰীরামকৃষ্ণ বললেন, তাতে যুগ বাঁধলে আর সে গুটিদের কাটা যায় না। সেইরূপ ইষ্টের সঙ্গে যুগ বাঁধতে হয়। তা হলে আর ভয় থাকে না। নইলে পাকাগুটি আবার ক্যাঁচ করে কেটে দেয়।

ক্রমশ সারদামণির জড়তা কাটছে। আগে পরপুরুষদের সঙ্গে কথাই বলতেন না। এখন নরেন্দ্র, বাবুরাম, রাখাল এইসব তরুণ বক্তদের সঙ্গে তাঁর স্বামীর অসুখ ও পথ্য নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁর সঙ্গে কথা কয়ে এইসব তরুণীরাও বিস্মিত। এতদিন তাদের মনে হত, নহবতখানায় ঘোমটা টানা নারীটি যেন নেহাতই একটা কাপড়ের পুটুলি। এখন বোঝা যায়, এঁর বেশ ব্যক্তিত্ব আছে, জাগতিক বিষয়ে জ্ঞান ও নিজস্ব মতামত রয়েছে।

একদিন একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল।

একটা বড় বাটিতে প্ৰায় আড়াই সেরা গরম দুধ নিয়ে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠছেন। সারদামণি, হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। ছিটকে পড়ল, বাটিটা, তাঁর এক পায়ের গোড়ালির হাড় ঘুরে গেল, নরেন-বাবুরাম দৌড়ে এসে ধরল তাঁকে। দারুণ যন্ত্রণা নিয়ে একতলার ঘরে নিজের বিছানায় শুয়ে রইলেন তিনি, স্বামীকে আর খাওয়াতে যেতে পারেন না।

শ্ৰীরামকৃষ্ণ স্ত্রীর খোঁজ-খবর নেন। আর চিন্তিতভাবে বলেন, তাই তো, এখন কী হবে, কে আমাকে খাওয়াবে? একজন রাঁধুনি নিযুক্ত হয়েছে, নরেন-বাবুরামরা খাইয়ে দেয়, শ্ৰীরামকৃষ্ণের তা ঠিক পছন্দ হয় না। সারদামণি নাকে নথ পরেন, নিজের নাকের সেই জায়গাটায় হাত দিয়ে রঙ্গ করে বলেন, ওরে, সে আর আসবে না? ও বাবুরাম, ওই যে ওকে তুই বুড়ি করে মাথায় তুলে এখানে নিয়ে আসতে পারিস।

বাবুরাম-নরেন হেসে খুন হয়। কয়েকদিন পর সারদামণির পায়ের ফোলা খানিকটা কমলে নরেনরা তাকে ধরে ধরে ওপরে নিয়ে আসে, নরেন বলে, এই যে দেখুন এনেছি, এবার ভালো করে খান তো!

শ্ৰীরামকৃষ্ণ যখন রস-তামাসা করেন তখন অনেকেই হাসে বটে, কিন্তু ঘর থেকে বেরিয়েই তাদের মুখ থমথমে হয়ে যায়। নরেন অবতারতত্ত্ব মানে না। অন্য অনেকে বিশ্বাস না করলেও নরেন বিশ্বাস করে যে পরমহংসদেবের এ রোগের নাম ক্যানসার, ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের মতন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের মতামত মিথ্যে হতে পারে না। এবং ক্যানসার রোগের পরিণাম সে জানে। শ্ৰীরামকৃষ্ণের আয়ু ফুরিয়ে এসেছে।

আইন পরীক্ষার জন্য বইপত্র এনেছে বটে নরেন, কিন্তু কিছুতেই তার মন বসে না। দোতলার ঘরের ওই প্রিয় মানুষটির রোগযন্ত্রণার কথা মনে পড়লেই বুকের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। উনি আর থাকবেন না? এ যে বিশ্বাসই করা যায় না। এই চিন্তা ভোলার জন্য বইয়ের পৃষ্ঠা কোনও সাহায্য করে না, বরং গান-বাজনা, আড়-গল্প নিয়ে মাতামাতি ভালো লাগে। একখানা ঘরের মেঝেতে সতরঞ্চি পেতে আট-দশজন শোয়, নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করে, এক-এক সময় খুব দাপাদাপি শুরু হয়ে যায়। তাই ঘরটার নাম দেওয়া হয়েছে, দানাদের ঘর!

মাঝে মাঝে নিজের বাড়ি ঘুরে আসে নরেন। ধার-ধোর করে সংসার খরচ দেয়, মাকে খুশি রাখার চেষ্টা করে, কিন্তু ক্রমশই সংসার থেকে তার মন বিযুক্ত হয়ে যাচ্ছে। এখানে শ্ৰীরামকৃষ্ণের সাহচর্যে, অন্য ভক্তদের সঙ্গে থেকেই সে বেশি তৃপ্তি পায়। মাঝে মাঝে সে চিন্তা করে, এরকম দু নৌকোয় পা দিয়ে কতদিন চলবে? আগে সে ঠিক করেছিল, ওকালতি পাস করে কিছুদিন প্র্যাক্টিস জমিয়ে বেশ কিছু টাকা উপার্জন করবে। ছোট ভাই দুটিকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে, তাদের হাতে সংসারের হাল তুলে দিয়ে সে বেরিয়ে চলে আসবে। কিন্তু এইভাবে কি ত্যাগ হয়? এমন অঙ্ক কষে কি বৈরাগ্যের দীক্ষা নেওয়া যায়? আবার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে মায়ের মুখ।

কখনও কখনও জোর করে, প্রায় কানে তুলো গোঁজার মতন অন্য কিছু না শুনে সে জেদ নিয়ে পড়াশুনো শুরু করে দেয়। দু-তিন দিন আর ওপরের তলায় যায় না। শ্ৰীরামকৃষ্ণ উতলা হয়ে ওঠেন। বারবার জিজ্ঞেস করেন, নরেন কোথায়? নরেন কোথায়? বাবুরাম-রাখালরা জোর করে নরেনের পড়া ছাড়িয়ে তাকে টেনে নিয়ে আসে ওপরে।

শ্ৰীরামকৃষ্ণ জিজ্ঞেস করেন, কী রে, তুই আমাকে দেখতে আসিস না কেন?

নরেন মুখ গোঁজ করে উত্তর দেয়, সামনে আমার বি এল পরীক্ষা। প্রস্তুত হতে হবে না? এমনি এমনি পাস করা যায়।

শ্ৰীরামকষ্ণ বললেন, তুই উকিল হবি? তা হলে আর কোনও দিন আমি তোর হাতের ছোঁওয়া খাব না।

নরেন মুখ তুলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর হাসে। যাঃ, মুক্তি, মুক্তি। আর দ্বিধার প্রশ্ন নেই।

নরেন দৌড়ে নীচে চলে আসে। বইখাতা সব ছুড়ে ছুড়ে ফেলে দেয়। নাচতে থাকে মনের আনন্দে। এ দেশ থেকে একজন উকিল কমে গেলে কারুর কোনও ক্ষতি হবে না।

রাত্ৰিবোলা সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে, নরেন হঠাৎ উঠে বসল। ঘরের মধ্যে তার ভালো লাগছে না। আরও দুচারজনকে ডেকে তুলে বলল, চল, বাইরে হাঁটতে যাবি? বেড়াতে বেড়াতে তামাক খাব।

শরৎ, গোপাল এই রকম আরও কয়েকজন রাজি হয়ে যায়। খেলো হুঁকোতে তামাক ধরানো হল। হাতে হাতে ঘুরতে লাগল সেই হুঁকো। শীতের নিশুতি রাত, ওদের সঙ্গে কোনও উষ্ণ বস্ত্র নেই, তাতেও গ্রাহ্য নেই। হুঁকো টানতে টানতে বাগানের মধ্যে এসে নরেন গম্ভীর গলায় বলল, দেখ, পরমহংসদেবের যা শরীরের অবস্থা, তাতে আর কতদিন থাকবেন ঠিক নেই। সময় থাকতে থাকতে ওঁর কাছ থেকে আধ্যাত্মিক উন্নতি করার জন্য যতখানি শেখার শিখে নে। উনি চলে গেলে আর অনুতাপের শেষ থাকবে না। দিন দিন আমরা বাসনাজালে জড়িয়ে পড়ছি। এই বাসনাতেই সর্বনাশ। বাসনা ত্যাগ কর, বাসনা ত্যাগ কর।

একটা গাছতলায় এসে বসল। নরেন। কাছাকাছি অনেক শুকনো ডাল ও পাতা পড়ে আছে, কেউ যেন একটা স্তূপ বানিয়ে রেখেছে। নরেন সেই দিকে চেয়ে থেকে বলল, এটাতে আগুন ধরিয়ে দে! সাধুরা যেমন ধুনি জ্বালায়, আমরাও ধুনি জুলিয়ে অন্তরের সুপ্ত বাসনাগুলি পোড়াব।

দপ করে জ্বলে উঠল আগুন। গোল হয়ে ঘিরে বসল। ক’জন তরুণ। আগুনের আঁচে শীতের আরাম হয়, হাত সেঁকে নিতে ইচ্ছে করে। ওরা আরও কাঠাকুটো টেনে টেনে আনে। ‘অগ্নিয়ে স্বাহা’ বলে ছুড়ে ছুড়ে দেয়। নরেন এক-একটা ডাল ছোড়ে আর বলে, এই আমাদের বাসনা। এই আমাদের বাসনা। যাক, পুড়ে যাক। অন্তরটা শুদ্ধ হোক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *